জয়ন্তী নদীর রেলব্রিজ
ভূত নাকি এমন একটা জিনিস, চাইলে দেখা করতে আসে, আবার না চাইলেও দেখা করতে আসে। কিন্তু আমরা অনেকবার চেয়ে দেখেছি, ভূত আসুক, ভূত আসুক। কিন্তু ভূত আসেনি।
সেদিন আমরা আমাদের পাড়ার গন্ধবণিকদের পোড়ো বাড়িতে বসে আছি। আমি, অলয় আর নীলিম। ঘরঘুট্টি অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে। জোনাকি উড়ছে দল বেঁধে। অন্ধকার ছিঁড়ে কু: কু: করে একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল একটু দূরে।
অলয় নিজের মুখে আঙুল চাপা দিয়ে বলল, ‘ওই শোন, কালপ্যাঁচা ডাকছে।’
নীলিম চাপা গলায় বলল, ‘ওটা যে কালপ্যাঁচার ডাক, তুই বুঝলি কী করে?’
‘আমি দাদুর কাছে শুনেছি, কালপ্যাঁচার ডাক নাকি ওরকম! আর ভূতুমপ্যাঁচা ডাকে ‘বুম বুম’ করে।’
অলয়ের কথায় আমরা দু-জন চুপ করে আছি দেখে অলয় বলল, ‘জানিস তো, কালপ্যাঁচার মাংস খেলে নাকি মানুষ অন্ধ হয়ে যায়?’
তখনও আমরা ওর কথার কোনো উত্তর দিলাম না। কালপ্যাঁচার নাম শুনে একটু যেন গা-টা ছমছম করে উঠল। তখন অলয় বলল, ‘এতবার তো আমরা চাইলাম, ভূত আসুক, ভূত আসুক! ভূত আর এল কই? এবার একবার না-চেয়ে দ্যাখ না, ভূত আসে কি না?’
এরকম একটা সময় ছিল, যখন আমরা দিনরাত ভূতুড়ে বাড়ি খুঁজে বেড়াতাম। যেভাবেই হোক, ভূত দেখতেই হবে। তখন সবে কলেজ পাস করেছি। না, কলকাতার ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। কলকাতার কোনো বাড়িতে ভূত থাকতে পারে আমাদের বিশ্বাস করানোই ছিল কঠিন। মানুষেরই থাকার জায়গা নেই, তায় ভূত! অত লোক যেখানে গিজগিজ করছে, সেখানে ভূত থাকবে কী করে? আমরা সপ্তাহের শেষে বেরিয়ে পড়তাম। ভূতের গন্ধ আছে এমন যেকোনো বাড়ির খোঁজ পেলেই আর শনি-রবিবার আমাদের পায় কে?
ভূতুড়ে বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমি, অলয়, নীলিম, চাকরির চাপে কেমন করে যেন একসময় আলাদা হয়ে গেলাম। এখন কারও সঙ্গে আর দেখাও হয় না প্রতি সপ্তাহে। ফোনে কথা হয়, তাও খুব যে নিয়মিত, তা নয়।
নীলিম এখন হঠাৎ দেশ দেখায় মন দিয়েছে। সময় পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে। আর অলয় এখন ফুলের গাছ দেখে বেড়ায়। যেখানে নতুন ফুলের খোঁজ পায়, শত কাজ ফেলে সেখানে ছোটে। বাড়িতে কাঠাখানেক জায়গায় সুন্দর একটা বাগানও করেছে। কত রকমের যে গাছ আছে ওর বাগানে, দেখলে অবাক হতে হয়। সেদিন শুনলাম, ওদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে অলয় নাকি তিন কাঠা জমি কিনে ফেলেছে। বলে বেড়াচ্ছে, সে নাকি আকাশপারের কোনো অজানা গাছের চারা এনে সেখানে বাগান করবে। দুর, আকাশপারে আবার গাছ আছে নাকি? ও একটা বদ্ধ গাছপাগল! মাস খানেক আগে দেখা হয়েছিল। তখন আবার বলল, ‘মৈনাক, যে জমিটা কিনেছি, জানিস তো, ওখানে ধানের চাষ করব। প্রাচীন কালের দুটো ধানের বীজের সন্ধান পেয়েছি। কী সুন্দর নাম জানিস ওই ধান দুটোর? একটার নাম ‘কানাইবাঁশি’, আর একটার নাম ‘গেরিকাজল’।’
সেদিন ওর মুখের উপর কথা বলতে পারিনি। মনে মনে বলেছি, ‘ও নামের ধান পৃথিবীতে আছে কখনো শুনিনি।’
আর আমি? আমি এখন আর ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে ভূত দেখেছে, এমন লোকের খোঁজ করতে থাকি। কোনো চায়ের দোকানে ভূত দেখেছে এমন লোককে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে শুনলে, চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে পড়ি। উশখুশ করি তার ঠিকানা জানার জন্যে।
সেদিন আমার অফিসের বেয়ারা তিনু ক্যান্টিনে টিফিন কৌটো থেকে টিফিন বের করে খেতে খেতে বলল, ‘জানেন তো মৈনাক দাদা, যারা সত্যি সত্যি ভূত দেখেছে, আপনি তাদের গায়ের কাছে যেতে পারবেন না, এমন বিচ্ছিরি গন্ধ!’
আমি বললাম, ‘ভূত-দেখা লোকের গায়ে অমন গন্ধ হয়, কই আগে তো শুনিনি? তুমি ভূত দেখেছে এমন লোকের সন্ধান জানো নাকি?’
তিনু নিজের মনে ফিকফিক করে হাসল মনে হল। তারপর আমার দিকে মুখ তুলে বলল, ‘দীপেন সাঁতরা। আমাদের পলাশকুঁড়ি গ্রামের যে মোরাম রাস্তাটা এখন পঞ্চায়েত থেকে কংক্রিট করে দিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলে বাঁদিকে পড়বে একটা বাঘআঁকোড় গাছের ঝোপ। তার গায়ে উঠেছে গন্ধভাদালি গাছ, বিচ্ছিরি গন্ধে তার কাছে দাঁড়ানো দায় গো। ওর পাশে তাল পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরটা দীপেন সাঁতরার। ছোটো-বড়ো সকলেই লোকটাকে ‘দীপেন সাঁতরা’ বলেই ডাকে।’
আমি বললাম, ‘বাঘআঁকোড় গাছটা কী গাছ, আমার বন্ধু অলয়কে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু গন্ধভাদালি গাছের নামও তো কখনো শুনিনি?’
তিনু হেসে বলল, ‘ও তো গাঁদাল গাছ গো, ভালো নাম গন্ধভাদালি। পাতার গন্ধটা খুব খারাপ, তবু লোকে বড়া করে খায়। খুব উপকারী গাছ গো! পেটের অসুখের পক্ষে খুব ভালো!’
আমি বললাম, ‘গন্ধভাদালির কথা ছাড়ো তিনু! তা তুমি যে দীপেন সাঁতরার নাম বললে, সে কি কোনোদিন ভূত দেখেছে?’
যেন কেউ শুনে ফেলতে পারে, তিনু অমনভাবে গলা নীচু করে বলল, ‘দ্যাখেনি আবার? বিচ্ছিরি গন্ধে তার গায়ের কাছে আপনি দাঁড়াতে পারবেন না মৈনাক দাদা।’
আমি তিনুর কাছ থেকে সব জেনে নিলাম, দীপেন সাঁতরা কখন বাড়িতে থাকে, কখন গেলে দেখা হতে পারে। তারপর শনিবার সকালেই গিয়ে হাজির হলাম পলাশকুঁড়ি গ্রামে দীপেন সাঁতরার কুঁড়েঘরে।
লোকটা বেঁটেখাটো। শ্যামলা গায়ের রং। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কোনোদিন মাথায় তেল পড়েছে বলে মনে হল না। বাঁহাতে দেখলাম ছ-টা আঙুল। বুড়ো আঙুলের পাশে একটা ছোটো আঙুল লিকপিক করছে। মনে হয়, ওই ছোটো আঙুলটায় একটাও হাড়গোড় নেই।
তবে তিনুর কথাই ঠিক, খুব বিচ্ছিরি একটা গন্ধ আসছে দীপেন সাঁতরার গা থেকে। মনে হয়, লোকটা চানটান করে না সবসময়। আর তিনুর কথা যদি ঠিক হয়, ভূত-দেখা লোকের গায়ে বিচ্ছিরি গন্ধ থাকে, তা হলে তো দীপেন নিশ্চয়ই ভূত দেখেছে। কেননা, তার গা থেকেই তো অমন বিচ্ছিরি গন্ধটা ভেসে আসছে।
দীপেনের ঘর বলতে দশ ফুট বাই আট ফুটের মতো বাঁশের বেড়া আর মাটির লেপ-দেওয়া একটা রুম। বাঁশের খুঁটি পুঁতে মাচার উপর একটা তেল চিটচিটে ছেঁড়া কাঁথা পাতা। সেই বিছানার উপরই আমাকে বসতে বলল। আমি বসতেই মচাৎ করে জোরে একটা শব্দ করল। বিছানাটা আমাকে মেনে নিতে পারছে না বলেই প্রতিবাদ করল বলে মনে হল।
আমি বার তিনেক প্রশ্ন করলাম, ‘দীপেন, তুমি কোনোদিন ভূত দেখেছ? আমি কিন্তু কোনোদিন ভূত দেখিনি। আমাকে একদিন ভূত দেখাও না!’
কিন্তু দীপেন সাঁতরা ভূত দেখেছে কি দেখেনি, একথার উত্তর তার কাছ থেকে তিনবার প্রশ্ন করেও পেলাম না। শুধু বলল, ‘চলেন, আপনারে এক জায়গায় নিয়ে যাই।’
তারপর দীপেন সাঁতরার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হল, আগস্ট মাসের প্রথম অমাবস্যার দিন আমরা বক্সা টাইগার রিজার্ভ পেরিয়ে যাব জয়ন্তীর জঙ্গলে আর জয়ন্তী নদীতে। দীপেন নাকি আজ বছর দশেক ওখানে যাচ্ছে, এই আগস্ট মাসের প্রথম অমাবস্যার দিন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘যেকোনো দিন গেলেই তো হয় দীপেন। অমন দিন ঠিক করে যাওয়ারই বা কী দরকার? তা ছাড়া এমন ভরা বর্ষা-বাদলার দিনে? বর্ষা থামলে পরে না হয় একসময় গেলেই হত?’
সে একথার উত্তর দেওয়ারই প্রয়োজন বোধ করল না। মনে মনে বললাম, কেন, দীপেন সাঁতরা এমন দিন ঠিক করেই বা যায় কেন জয়ন্তীর জঙ্গলে? তারপর ভাবলাম, যে লোকটা এভাবে এত দারিদ্র্য নিয়ে থাকে, সে প্রতি বছর বক্সা যাওয়ার খরচ জোগাড় করে কী করে? তিনু বলেছে, দীপেন কাজটাজ বিশেষ কিছু করে না। কেমন করে যে ওর দিন চলে, সেকথা ওদের গ্রামের কেউ নাকি বলতে পারে না।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম, এবার যা খরচ হবে, না হয়-সমস্ত খরচটাই আমি বেয়ার করব। দিনহাটায় আমার এক কলেজের বন্ধুর বাড়িও আছে। পারলে ওর বাড়ি ঘুরেও আসা যেতে পারে।
দু-জনের ট্রেনের টিকিট কাটলাম আমি। একদিন গিয়ে এও জিজ্ঞেস করে এলাম দীপেন সাঁতরাকে, ‘ওখানে থাকব কোথায়? সেটাও তো বুক করতে হবে?’
দীপেন সাঁতরা তার সরু লিকলিকে হাত দুটো তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। এর মানে উদ্ধার করে আমার মনে হল, তার কোনো দরকার নেই।
২
রাতের ট্রেন জার্নির পর আমাদের কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস থেকে আলিপুরদুয়ারে নামতে নামতে সূর্য মাথার উপর। স্টেশনের উলটো দিক থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করলাম।
দীপেন নিষেধ করেছিল, ‘কী দরকার গাড়ির? যেসব ট্রাক বক্সা জঙ্গলে যাচ্ছে, ওতে উঠে পড়লে কম পয়সায় পৌঁছে যেতাম!’ দীপেন সাঁতরা এত বছর কি অমন করে বক্সা যাচ্ছে? সে-কথা জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর পেলাম না। কাল শিয়ালদায় ট্রেনে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত দীপেন সাঁতরার সঙ্গে সাকুল্যে আমার কথা হয়েছে আট-দশটি বাক্য। এমন লোকের সঙ্গে কোথাও যাওয়া যায় না। ভূত দেখেছে এমন একজন লোকের সঙ্গে আমি যাচ্ছি, এটুকুই! কেন যাচ্ছি জানি না। দীপেন সাঁতরা কখনো বলেনি, সে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ভূত দেখাবে। তবু ওর সঙ্গেই দু-দিনের জন্যে যাচ্ছি।
আমাদের গাড়িটা যখন বক্সা মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিল, দীপেন নিজের মনে বলল, ‘এবার শুরু হল জয়ন্তীর জঙ্গল! আরও আট মাইল যেতে হবে।’
বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে গাড়ি ছেড়ে দিতে হল। গাড়ির টাকা মিটিয়ে দিলাম। একটা ছোটো দোকানে বসে চা-পাউরুটি খেলাম দু-জনে। দীপেনই বলল চা খাওয়ার কথা। মনে হল, এটাই বুঝি আজকের মধ্যাহ্নভোজন। আজ দুপুরে আর কিছু জুটবে বলে মনে হচ্ছে না। এবার নাকি টানা হন্টন!
লোকটা এত কম কথা বলে যে, ওর সঙ্গে আমারও আর কথা বলার আগ্রহ নেই। চুপ করে বনবিভাগের দেওয়া জীবজন্তু সম্পর্কে নানা নির্দেশিকা পড়তে পড়তে চললাম। মাথার উপর দুপুর রোদ গাছগাছালির পাতার ফাঁক দিয়ে গলে পড়ছে। দূর থেকে হঠাৎ হাতির বৃংহণ শুনতে পেলাম। পাশ দিয়ে একটা লোক কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে যাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ‘বড়ো বিলটায় হাতিরা চান করতে এসেছে। ওদের চান হয়ে গেলে বনবিভাগের লোক ফের হাতিদের জঙ্গলে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।’
দুপুর গড়িয়ে পড়ছে বিকেলের দিকে। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না। আমি দীপেন সাঁতরার পিছন পিছন হাঁটছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। একসময় আমি আর থাকতে না পেরে দীপেনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কত দূর গো? পা যে আর চলে না!’
তখনও দীপেন নিরুত্তর। এর আগে যে দু-তিনদিন দীপেনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে সামান্য, তাতে বুঝেছি, দীপেন কথা বলা মোটেও পছন্দ করে না। কাল থেকে আজ এখন পর্যন্ত আমার সেই অভিজ্ঞতা বদলায়নি।
ক্লান্ত পায়ে ব্যথা হয়ে ওঠার মতো দূরত্ব পেরিয়ে একটা ইটের দেওয়াল দেওয়া টিনের চালার সামনে এসে দীপেন ডাক দিল, ‘হান্না মা!’
ওর ডাকে কোনো জবাব ভেসে এল না। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম, দিগন্তরেখার কাছে অনেকটা দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সবুজে মোড়া ভূটান পাহাড়। তার ঠিক সামনে একটু দূরে জয়ন্তী নদী। খানিক পরে এক থুত্থুড়ে বৃদ্ধা ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। দীপেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এসে গেছ? তুমি দেখি দিন-তারিখ ভুলো না কখনো!’
বৃদ্ধার বয়স আশির কাছে। গুনে শেষ করা যাবে না মুখের চামড়ায় এমন অসংখ্য ভাঁজ। চোখের তারা ঘষা কাচের মতো। তাতে সন্ধ্যে নেমে-আসা সূর্যের মতো অন্ধকার জড়িয়ে আছে। বেঁটেখাটো চেহারা। ভুটিয়াদের মতো পোশাক। কিন্তু বৃদ্ধা কথা বলছে বাংলায়। বলল, ‘ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। আজ সন্ধ্যের আগে আগে ওরা এসে যাবে।’ তারপর হান্না মা দীপেনের দিকে হাত তুলে বলল, ‘ডিপেন, তুমি আসবে ভেবে দুটো ভাত রেখে দিয়েছিলাম। কেমন যেন মন বলছিল, এবারও তুমি আসবে। কিন্তু তুমি সঙ্গে মেহমান আনবে বুঝতে পারিনি। ওটাই দু-জনে ভাগ করে খাবে চলো!’
বুড়ি ‘দীপেন’ উচ্চারণ করতে পারে না, বলল ‘ডিপেন’। চোখে-মুখে জল ঢেলে নড়বড়ে একটা প্লাস্টিকের টুলে খেতে বসলাম আমি আর দীপেন সাঁতরা। এখানে এসে দীপেন যেন আরও স্পিকটি নট হয়ে গেছে। আমাদের ভাগে এক মুঠো করে ভাত আর কী সব শাক-পাতা দিয়ে একটুখানি তরকারি। খেতে কিন্তু মন্দ লাগল না। সে হয়তো ভীষণ খিদে পেয়েছে বলে।
আমি দীপেন সাঁতরাকে বললাম, ‘চলো, বিকেল হয়ে এল, এবার একবার জয়ন্তী নদীটি দেখে আসি? এখানে আসার পর কিছুই তো দেখা হল না।’
দীপেন ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে জয়ন্তীর দিকে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট তিন-চার হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম জয়ন্তী নদীর ধারে। এটা কালজানি নদীর উপনদী। একে কি নদী বলা যায়? হাঁটু ছোঁয়া স্বচ্ছ জল তিরতির করে বয়ে চলেছে নীচের দিকে। দীপেন আঙুল তুলে দেখাল, ‘ওই ওদিকটায় ছিল সেই জয়ন্তী রেলব্রিজটা।’
দেখলাম, ব্রিজ মানে দুটো সিমেন্টের পিলার ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে নদীর এপারেই। এ ব্রিজটাই যে একসময় জয়ন্তী পেরিয়ে অ্যাপ্রোচ রোড ধরে এগিয়ে ভূটান পাহাড়ের সঙ্গে জুড়ে ছিল, এখন তা গল্পকথার মতো মনে হচ্ছে। এখন ব্রিজের কোনো চিহ্নই নেই।
ব্রিজটার কথা ইন্টারনেট-এ পড়েছি। ছবিও দেখেছি। আগে এই ব্রিজটার উপর দিয়ে রেললাইন ছিল। সে-ব্রিটিশ আমলের কথা। জয়ন্তী নদীর ওপারে ডলোমাইট খনিজের অঢেল ভান্ডার ছিল। ব্রিটিশরা ওপার থেকে ডলোমাইট কেটে এনে সারাদেশে রপ্তানি করার জন্যে তৈরি করেছিল এই রেলব্রিজটা উনিশশো পনেরো সালে। ভূটান পাহাড় থেকে ডলোমাইট ট্রেনে বোঝাই করে চলে যেত দেশের নানা প্রান্তে। ডলোমাইট ইস্পাত কারখানায় ইস্পাত তৈরির কাজে দরকার হত। তখন ভুটানের গরিব মানুষরা দু-পয়সা রোজগারের আশায় এখানে এসেছিল কাজ করতে। ব্রিটিশরা তাদের জন্যে জয়ন্তীর এপারে জঙ্গল পরিষ্কার করে একটা থাকার জায়গাও করে দিয়েছিল। লোকমুখে তার নাম ছিল ‘ভুটিয়া বসতি’। প্রায় তিরিশটার মতো ফ্যামিলি ভূটান থেকে চলে এসেছিল এখানে। এখনও দেখলাম, ওই নামটাই রয়ে গেছে। একটু পরে ভূটান পাহাড়ের আড়ালে সূর্য মুখ লুকোতে দীপেন সাঁতরা বলল, ‘চলো, হান্না মা-র বাড়িতে ফিরে যাই। তুমি যা দেখতে চাও, যা কোনোদিন তুমি দ্যাখোনি, আজ রাতে তোমাকে তা দেখাব।’
ওর কথা শুনে আমার গা-টা ছমছম করে উঠল। তার মানে? আমি তো ভূত দেখতে চেয়েছি দীপেন সাঁতরার কাছে। দীপেন কি তা হলে আমাকে আজ রাতে ভূত দেখাবে? আমরা ফিরে এলাম। ততক্ষণে হান্না মা-র ছেলে এবং মেয়েও এসে গেছে। আমার সঙ্গে হান্না মা আলাপ করিয়ে দিল, ‘আমার ছেলে সোনম!’
দেখলাম সোনমের বয়স তিরিশের কাছে। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। মাথা ভরতি কালো চুল। ফরসা গায়ের রং।
বুড়ি মেয়ের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিল, ‘আর এই আমার মেয়ে কেলজাং। শাদি হয়েছে ভূটান পাহাড়ের ওদিকে, ফুন্টসোলিংয়ের কাছে, চুখা জেলার জুরমা গ্রামে।’ দেখলাম, কেলজাংয়ের বছর ছাব্বিশেক বয়স। ফরসা। বেঁটেখাটো চেহারা। ভুটানি পোশাক পরা।
চারপাশে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এমন কালো অন্ধকার আমি জীবনে দেখিনি। মনে হল, জঙ্গলের এই নিবিড় অন্ধকারের চোখে এখন যেন পলক পড়ছে না। অন্ধকার যেন ভূটান পাহাড়ের উপর থেকে স্থির দৃষ্টিতে মুখ নীচু করে চেয়ে আছে জয়ন্তী নদীর দিকে। ঘরের ভিতর টিমটিম করে একটা কেরোসিনের চৌখুপি জ্বলছে। আকাশে একটা কালো মেঘ এসে জুটেছে ভূটান পাহাড়ের মাথায়। থমকে আছে পাহাড়টার গায়ে। আমরা হান্না মা-র ঘরের উঠোনটায় দাঁড়িয়ে আছি। মেয়ে কেলজাং ঘরের ভিতর থেকে একটা ছেঁড়া শতরঞ্চি এনে পেতে দিল উঠোনে। আমরা চারজন গোল হয়ে বসলাম, আমি, দীপেন সাঁতরা, কেলজাং আর সোনম। একটু পরে হান্না মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল উঠোনে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেদিনও কোথা থেকে অমন একটা কালো মেঘ এসেছিল ভূটান পাহাড়ের মাথায়।’
কোত্থেকে খক-খক খক-খক করে একটা শব্দ ভেসে এল জঙ্গলের ওদিক থেকে। গা ছমছম করে উঠল আমার। বুড়ির দিকে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা কীসের শব্দ হান্না মা?’
বুড়ি তুচ্ছ ভঙ্গিতে বলল, ‘ও কিছু না। ও হল বুড়ো বন-কাঁঠাল গাছের কোটরের বর-বউ তক্ষক দুটোর কান্ড! রাত নামছে তো, এবার সারারাত ডেকে ডেকে পাগল করে তুলবে দেখো! রাতে ওদের চোখে ঘুম নামে না!’
আমি শিউরে উঠে বললাম, ‘তক্ষক? ভয়ের কিছু নেই? কামড়াতে আসবে না তো? শুনেছি, তক্ষক নাকি উড়তে পারে? যদি উড়ে এসে কামড়ায়?’
সোনম হাসল খুব একচোট। বলল, ‘ও কথা কে বলেছে?’
দীপেন আমার পিঠে আঙুলের টোকা দিয়ে বলল, ‘ভয় নেই, ও কিছু করবে না। আমি আজ দশ বছর ধরে এমন দিনে তক্ষকের ডাক শুনে আসছি।’
হান্না মা দূরের দিকে তাকিয়ে ফের বলল, ‘সেদিনও অমন কালো মেঘ উড়ে এসেছিল আকাশে, বুঝলে ডিপেন! সেদিনও ছিল অমাবস্যা।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে?’
আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ভূটান পাহাড়ের দিক থেকে জয়ন্তী নদী টপকে হু হু করে বৃষ্টি এসে গেল। আমরা হুড়মুড় করে দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।
বুড়ি বলল, ‘উঃ, আবার বৃষ্টি এল!’ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দ্যাখ জাং, সেদিনের মতো বৃষ্টির ধরনটা না? সেরকমই ঘনঘন বাজ পড়ছে?’ বুড়ি আদর করে মেয়ে কেলজাংকে ‘জাং’ বলে ডাকে।
আমার কৌতূহল বাড়ছে। বললাম, ‘কোন দিন? কী হয়েছিল সেদিন হান্না মা?’
সকলে চুপ একেবারে। বুড়ির বুক ভেঙে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে খুপরি জানলার পাশেই কড়কড় শব্দে একটা বাজ পড়ল। বুড়ি একটু কেঁপে উঠল যেন ভয় পেয়ে। তারপর বলল, ‘তিরানব্বই সালের আগস্ট মাসের এরকম দিনেই তো সেই হড়কা বান এসেছিল গো জয়ন্তীতে।’ ছেলের দিকে আঙুল দেখিয়ে হান্না মা বলল, ‘সোনুর বয়স তখন আর কত, সাত-আট হবে।’ বুড়ি সোনমকে ‘সোনু’ বলে ডাকে। বলল, ‘আর জাং তখন বছর চারেকের। ওর বাবা বন্যার জলে মাছ উঠে আসবে বলে জাল নিয়ে ছুটেছিল জয়ন্তীতে। কত করে না বলেছিলাম। কিন্তু শুনলে তো? ওর বাবা করমা দরজি কখনো কি কারও কথা শুনত?’
আমি নেট-এ পড়েছিলাম, জয়ন্তী নদীর সেই বন্যা ছিল ভয়াবহ। এও পড়েছি, পাহাড়ি নদী কখনো-সখনো তার গতিপথ বদল করে, যখন পাহাড়ের নীচের মাটি সরতে থাকে। তখন পাহাড়ে ভয়াবহ ধস নামে। ঠিক ওই সময় ডিমা নদীর শাখানদী, লোকে যাকে বলত ‘বক্সা ঝোরা’, সে তার গতিপথ বদল করেছিল বলে সেবার অমন বন্যা হয়েছিল ডুয়ার্স জুড়ে। বান এসেছিল জয়ন্তী নদীতে। তার উপর ছিল আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি। দুশো লোক মারা গিয়েছিল সেবার। কেউ বলে, সেই বন্যায় ভেসে গেছে জয়ন্তী নদীর লোহার রেলব্রিজটা। আবার কেউ বলে, গোটা রেলব্রিজটা নদীর তলায় পলি মাটির নীচে ডুবে গেছে। তারপর থেকে জয়ন্তী নদীর বেড় এমন উঁচু হয়ে উঠেছে। এখন অমন রং-বেরং-এর পাথরে ছেয়ে আছে গোটা নদীটা। এসবই পাহাড় থেকে জলস্রোতে নেমে আসা পাহাড়ের অন্দরের রংবাহারি নুড়ি-পাথর। তাই অমন রং-বেরং। সেসব ভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে আমি হান্না মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর কী হল?’
হান্না মা বুকে সেই লম্ব দীর্ঘশ্বাসটা ঢোক গেলার মতো করে চেপে রাখল মনে হল। তারপর বলল, ‘মানুষটা জয়ন্তী নদীর রেলব্রিজের নীচে নেমে গিয়েছিল, হয়তো বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যে, নয়তো বেশি মাছের লোভে। তারপর…আর ফিরল না!’
সোনম মুখ খুলল। কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে, ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে সে। বাংলায়ই কথা বলে সোনম। গম্ভীর গলায় সে বলল, ‘লোকের মুখে মুখে গল্প উড়ে বেড়াত এখানে। এই লোহার রেলব্রিজটা তৈরির সময় ব্রিটিশদের নাকি খুব নজর ছিল, যাতে ব্রিজ তৈরি করতে গিয়ে একজন মানুষও না মারা যায়। কিন্তু একদিন লোহার পিলার পোঁতার সময় পা ফসকে পিলারের বেড়ির গর্তের মধ্যে পড়ে যায় একজন ব্রিটিশ ওভারসিয়ার। তার নাম ছিল সেসিল সাহেব। লম্বা চেহারা, গায়ের রং তামাটে। মাথায় সাদা টুপি পরে কাজে আসত। দু-হাতে পরা থাকত রবারের গ্লাভস। পায়ে ওয়াটার প্রুফ গামবুট। তারপর এক সময় ব্রিজ তৈরি হল। অন্ধকার রাতে যখন ডলোমাইট ভরতি ট্রেন ব্রিজের উপর দিয়ে ঝমঝম শব্দে পার হত, ট্রেনের গার্ডরা অনেকেই সেসিল সাহেবকে ব্রিজের লোহার থাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। আমার বাবাও নাকি কয়েকবার অন্ধকার রাতে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সেসিল সাহেবকে। কিন্তু বন্যায় ব্রিজটা নদীতে বসে যাওয়ার পর থেকে…’
আমি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল? বন্যার পর থেকে কেউ আর সেসিল সাহেবকে দেখতে পায়নি?’
সোনমের গলাটা ভারী হয়ে এল। বলল, ‘সেসিল সাহেবকে প্রতি বছর বন্যার দিন ওই জয়ন্তীর ব্রিজের ভাঙা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমরা সকলে। আমি, মা, কেলজাং। বেশ ক-বছর ধরে দেখছে দীপেন আঙ্কলও।’
কেলজাংয়ের চোখে-মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, ‘বাবা এসে যেই সেসিল সাহেবের পাশে দাঁড়ায়, অমনি দু-জনের চোখ চাওয়াচায়ি হয় পলকের জন্যে। বাবার পরনে সেই নীল রঙের হাফপ্যান্ট, মাথায় বৃষ্টি বাঁচাতে ফেটির মতো করে গামছা বাঁধা। কোমরে বাঁধা মাছ রাখার থলে। তারপর আমরা যে ওদের দেখছি, কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় দু-জনে। টুপ করে দু-জনেই ডুবে যায় জলের তলায় মাটির নীচে। তারপর, উঃ…’
ভয়ে দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকল কেলজাং। তখন দীপেন সাঁতরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও তোমার এখন শুনে কাজ নেই। একটু পরে নিজের চোখে দেখবে।’
দীপেনের কথার খেই ধরে সেই তক্ষক দুটো একসঙ্গে খক খক করে ফের ডেকে উঠল জঙ্গল কাঁপিয়ে। ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিল।
৩
বৃষ্টি আরও জোরে নামল। ঘনঘন বাজ পড়ছে। হঠাৎ দীপেন সাঁতরা উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। আমি দীপেনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এসবের খোঁজ পেলে কী করে?’
‘খুঁজতে খুঁজতে বছর দশেক আগে একদিন চলে এসেছিলাম হান্না মা-র কাছে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খুঁজছিলে তুমি?’
দীপেন বলল, ‘তুমি যা দেখবে বলে ঘুরে বেড়াও, তাই।’
আমি দীপেনের মধ্যে একটা চনমনে ভাব লক্ষ করলাম। দীপেন যেন উশখুশ করে উঠছে। বারবার জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে দেখছে। মনে মনে বললাম, দীপেন কি ভূতের কথাই বলল?
একটু পরে হান্না-মা কান্না জড়ানো গলায় বলল, ‘ওর বাবাকে দেখবে বলে এই দিনে জাং চলে আসে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে। সোনুও কাজে ছুটি নিয়ে চলে আসে। ক-বছর ধরে ডিপেনও আসছে। আমারও করমা দরজিকে দেখতে মন টানে। এক পলকের জন্যে, তবু…। চল রে, আর দেরি করব না।’ বলে হান্না-মা ময়লা ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নিল। ঘরে একটা ছেঁড়া টুপি পড়ে ছিল। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সোনম। দীপেন সঙ্গে আনা গামছাটা মাথায় জড়াল। কেলজাং একটা পলিথিনের প্যাকেটকে টুপির মতো মাথায় পরে নিল। সোনম বৃষ্টির পরোয়া না করেই বেরিয়ে পড়ল।
আমি মনে মনে বললাম, খিদেয় পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভূত দেখার জন্যে মানুষের এত ব্যাকুলতা থাকে, আগে জানতাম না। দীপেন যেন আমাকে চিনতেই পারছে না। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আমি চললাম সকলের পিছনে।
বৃষ্টি, অন্ধকার, সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। উঁচু-নীচু পাথরের উপর দিয়ে ঠিকমতো পা ফেলে এগোনো যাচ্ছে না। আমি একবার পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কেউ ফিরেও দেখল না আমাকে। অন্ধকারে হয়তো কেউ দেখতে পায়নি আমাকে। দীপেন যেন লাফ কেটে সকলের আগে আগে যাচ্ছে। আমরা তখন ভাঙা ব্রিজটার টুকরো থাম দুটোর থেকে একটু দূরে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সকলেই অন্ধকারে চোখ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছি। হান্না-মা আমার পাশে।
হঠাৎ একটা বাজ ভূটান পাহাড়ের দিক থেকে ছিটকে এসে চড়াৎ করে আছড়ে পড়ল ভাঙা থাম দুটোর উপর। অমনি ক্ষণেকের সেই আলোয় হান্না-মা ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘ওই তো সাদা টুপি মাথায় সেসিল সাহেব, হাতে গ্লাভস। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় গামছা বাঁধা করমা দরজি! জাং, সোনু, তোরা দেখতে পাচ্ছিস? মেহমান, তুমি দেখলে?’
আমি যেন আবছা দেখলাম, একজন সাহেবের পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দীপেন সাঁতরা তখন আরও এগিয়ে গেছে ব্রিজটার কাছে। জয়ন্তীতে এখন জল প্রায় কোমর সমান। ওরা হান্না মা-র গলা শুনতে পেল কি না কে জানে? টুপুস করে যেন জলজ্যান্ত দুটো মানুষ জলে ডুবে গেল!
দীপেন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে অন্ধকারে। কেন? এমন সময় সোনম বলে উঠল, ‘এবার ব্রিজটাকে ওরা মাথা দিয়ে ঠেলে উপরে তোলার চেষ্টা করবে!’
আমি ঘনঘোর তীব্র অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে আছি জয়ন্তী নদীর দিকে। হঠাৎ কেলজাং চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই তো, ওই তো, ব্রিজটা জল ছুঁইছুঁই! ওই তো ধীরে ধীরে জল থেকে মাথা তুলছে ব্রিজটা!’
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই কারা যেন মাটির নীচ থেকে দু-দিকে মাথা দিয়ে ঠেলে তুলছে ব্রিজটাকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, যেন একটুখানি উঠেছে ব্রিজটা। আমি স্পষ্ট দেখলাম, হ্যাঁ, ইন্টারনেটে দেখা জয়ন্তী রেলব্রিজের ফোটোর মতো হুবহু একটা ব্রিজের মাথা দেখতে পাচ্ছি জলের উপর। তারপর আমার আর কিচ্ছু মনে নেই।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। রোদ ঝলমল করছে বাইরে। এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই। ভূটান পাহাড়ের সবুজে সকাল বেলার আলো পড়ে বড়ো মায়াময় দেখাচ্ছে। শুনলাম, কাল রাতে ব্রিজের কাছ থেকে সোনম নাকি আমাকে কাঁধে করে বয়ে এনেছে হান্না মা-র ঘরে। কালকের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
আমি টইটই করে ছুটলাম জয়ন্তী নদীর দিকে। নদীতে সামান্য জল। আপন মনে তিরতির করে বয়ে চলেছে জয়ন্তী নদী। আঁতিপাতি করে লোহার রেলব্রিজটাকে খুঁজলাম। না, ব্রিজটার কোনো চিহ্নই নেই। শুধু হেলে-পড়া মানুষের চেয়ে উঁচু দুটো সিমেন্টের থাম তাকিয়ে আছে। তারা যেন বলছে, ‘এইখানেই সেই ব্রিজটা ছিল!’
হঠাৎ আমার নাকে এসে লাগল একটা বিচ্ছিরি পচা গন্ধ! আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, দীপেন সাঁতরা আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে! তখনই আমার মনে হল, এখন আমার গা থেকেও কি লোকে অমন বিচ্ছিরি গন্ধ পাবে?