জয়নাল
জয়নাল আমার বন্ধু। সে থাকত, দোলাইগঞ্জ স্টেশনে পুবে, তিন মাইল দূরে।…বিলান দেশ, তাই ছমাস সে আসত পায়ে হেঁটে, ছমাস নৌকায়।
যখন হেঁটে আসত, তখন তিন মাইল পুরো হাঁটতে হত, যখন নৌকায় আসত তখন, ওই তিন মাইল হত দেড় মাইল।
কেন না, দোলাইগঞ্জের রেললাইনের উঁচু ডাঙায় দাঁড়িয়ে এই যে দেখা যায় বহু দূর দিগন্ত ভাসিয়ে থই থই করছে বর্ষার জল, যার কোথাও বিস্তৃত কচুরিপানা বা জলঘাসের নোয়ানো মাথা, কোথাও আকাশের ছায়া টলটলে জলে, পাশে তার কলমি হিঞ্চের দাম উদ্দাম হয়ে ছড়িয়ে আছে বহু বাহু মেলে, কিংবা কোথাও আচমকা জেগে ওঠা কিশোরী পাট গাছের সটান ডাঁটার অজস্র মাথা, এরই ধারে ধারে জয়নাল তার ডিঙি নৌকাটি নিয়ে সোজা পাড়ি দিত ওই দিগন্তে মেশা গাঁয়ের কালচে রেখার দিকে। ওই যে দেখা যায় একটা মন্দিরের একটুখানি মাথা, তারও পিছনে ঝাপসা রেখা দুটি মসজিদের মিনার, ওইখানেই জয়নালদের বাড়ি। বন্যাকালে এ সোজাপথটুকু যেতে তাকে ভাঙতে হয় লালমাটির তিন মাইল উঁচুনিচু বাঁকা পথ।
এই যে জল, এটা কোনও নদী নয়, খাল নয়, নয় কোনও গাঙ; বহু খাল নালার মারফত এসে ছোট বিলের বুকে মহাসঙ্গম ঘটেছে ধলেশ্বরী ও শীতলাক্ষার, যার মৃদু আবর্ত নাকি তটকে দিয়েছে একেবারে ভাসিয়ে। দুয়ে মিলে এর এক স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ। হঠাৎ হাওয়ায় শিউরে ওঠা এ টলটলে জল ও তার বন, নীড়বিবাগী মাছখেকো পাখি ও ফড়িঙের ভিড়, কই, জিয়ল, ট্যাংরা ও পুঁটির আচমকা ভেসে উঠে পুচ্ছ নাড়ার চকমকানি ও চকিতে অতলে ড়ুবে যাওয়া, আর উপরে মেঘভারাতুর উদার আকাশ, এ-সবের কথা যে বার বারই বলতে ইচ্ছে করছে, তার কারণ জয়নালের রূপ।
কেন না, জয়নালের কালোচোখের অতল চাউনি, তার চিকন শ্যামল রং, মাথায় অবিন্যস্ত শ্যাওলা রঙের চুল, বড় বড় সাদা ঝকঝকে দাঁতের হাসি, দীর্ঘ শক্ত শরীর এবং অখণ্ড নৈঃশব্দের মধ্যে বহুতল থেকে উঠে আসা অল্প ও গম্ভীর কথার সুর, এ-সবের সঙ্গে ওই প্রকৃতির কোনও তফাত নেই। ওই প্রকৃতি ও জয়নালকে দেখা যেন এক জনকেই দেখা।
জয়নাল দোলাইগঞ্জ পেরিয়ে গেণ্ডারিয়ার একটা হাইস্কুলে পড়তে আসত। আসত সকালবেলা মাথায় শাক তরকারির বোঝার উপরে পাঠ্যবই দড়ি দিয়ে বেঁধে। সূত্রাপুর বাজারে শাক তরকারি বিক্রি করে ওখানেই এক মুসলমান মহাজনের গদিতে বসে পড়াশুনো করত। তারপর চান করে, নাস্তা করে চলে যেত স্কুলে। স্কুল শেষে বাড়ি।
তার সঙ্গে আমার পরিচয়টা স্কুলেই বটে, কিন্তু বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল স্কুলের পাঁচিলের বাইরে, শহরের সীমা ও দোলাইগঞ্জ পেরিয়ে, জলে স্থলে, মাঠে ঘাটে, জলে ডোবা পাটখেতের ভিতরে ডিঙি নৌকা ঢুকিয়ে তামাক খেয়ে আর কাঁচা বুকে তার ধক্ সইতে না পেরে হাসিতে কাশিতে স্তব্ধ বিল ও আকাশকে সচকিত করে দিয়ে।
জয়নাল মনোযোগ দিয়ে স্কুলে পড়ত, আর বাড়ি ফেরার জন্যে তাড়াতাড়ি ছুটত পুবে।
আমি প্রায় কোনওদিনই স্কুলে পড়তে যেতুম না, আর বাড়ি ফেরার কথা মনে হলেই আমার কিশোর মনে একটা তিক্ত বিদ্রোহের ভাব জেগে উঠত।
জয়নাল বাড়ি ছেড়ে পালাবার কথা ভাবতেও পারত না, আমি বাড়ি থেকে প্রায়ই পালিয়ে যেতুম। জয়নালকে কোনওদিনই মার খেতে দেখিনি, আমার গায়ে এক লাঞ্ছনার দাগ মিশে না যেতে আসত আবার উজান লাঞ্ছনা। জয়নাল শিষ্ট, আমি অশিষ্ট। সে গম্ভীর, আমি চঞ্চল। সে ছিল হিসেবি, আমি বেহিসেবি। মিতালিতে সে বিনীত, আমি দুর্বিনীত। আমাদের এ বিপরীত চরিত্রে, দুটো হিন্দু মুলসমান ছেলের মধ্যে তবু কেমন করে যে এমন গম্ভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল, সেটা বিস্ময়েরই এবং সে বন্ধুত্ব দু-দিক থেকে ছুটে আসা ধলেশ্বরী ও শীতলাক্ষার মিলনে আমাদের এ প্রাণ বিলকে ঢেউ বন্যায় কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
সেদিন এমনি এক বর্ষার দিন। বৃষ্টি ছিল না। নীল আকাশের এখানে ওখানে সাদা ধবধবে মেঘ যেন ডানা মেলে দেওয়া রাজহাঁস। পুবের জলো হাওয়ায় ঝড়ো বেগ। সে হাওয়ায় ভেসে আসছে। কোন্ জন্মবাউলের বাঁশির সুর। সে সুরে ঘর ছাড়ার ডাক।
জয়নালও বেরিয়ে এল স্কুল থেকে। বাঁশির সুর বোধহয় আজ ওর কানেও গিয়েছিল। আমি তো ছিলুম ওরই অপেক্ষায়। ও এসে আগেই বলল। মধু, আইজ আর পড়াশুনায় মন লাগতেছে না, চল যাইগা কোনখানে!
কোনখানে মানে হচ্ছে জয়নালের বাড়ি। আর আমি তো ছিলুম পা বাড়িয়ে! বললুম, চল।
কিন্তু তখন জানতুম না, আজকের এ হাওয়া শহরের বুকে লাগিয়ে দিয়েছে আর এক সর্বনাশের মাতন! দাঙ্গার আগুন জ্বলেছে দিকে দিকে। সূত্রাপুরের দোলাইখালের জল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। জানতুম না, শহরে চলেছে তখন লুট আর ছিন্নমুণ্ড নিয়ে খুনেদের লোফালুফি।
আমরা এসে ডিঙিতে উঠলুম। পাতলা ছোট ডিঙি লাফিয়ে উঠল। ডিঙি নৌকা যেন কিশোরী চঞ্চলা। একটু হাওয়া বা নাড়া পেলেই সে নেচে ওঠে।
ডিঙিতে থাকত জয়নালের বাবার একটি হুঁকো কলকে, একটি ছোট মালসা আগুনের। বাঁশের খোলে তামাক আর টিকে।
আমি ধরি লগি বাঁশ, সে ধরে বৈঠা। লগির খোঁচায় আমি ডিঙি চালাই বিপথে, বৈঠার টানে সে নিয়ে আসে পথে। কিছুক্ষণ চলে আমাদের এই পথে-বিপথের খেলা, চড়া হাসি ঘা খায় আকাশে।
হাসির শব্দে গুপ্ করে জেগে ওঠে জলঘাস বা কলমিদাম কুঁড়ে দুএকটা মানুষের মাথা, ঝিকিয়ে ওঠে হাতে তীক্ষ্ণ ফলার ল্যাজা। হাসি চকচকিয়ে ওঠে মুখে।
লোকগুলো একশ্রেণীর জলচর, মাছশিকারি। মানুষ তো দূরের কথা, মাছও টের পায় না বিলের কোন্খানে ওত পেতে আছে তাদের মৃত্যুদূত। যেন বকের মতো। বললুম, জয়নাল, বিষ্টি হইলে আইজ মাছ উজাইতে পারে। না?
এ-সব বিষয়ে জয়নাল অনেক অভিজ্ঞ। সে বলল, মাছ তো আর এমনে উজায় না, অমাবস্যা পুনিমার কটাল হইলে হয়। ক্যান্, মাছ ধরবি নাহি?
আইজ রাতে ধরলে হয়, অ্যাঁ?
জয়নাল কোনও কথা বলে না। দুজনেই আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসি।
অন্ধকার রাতে জলে বিলে ফিরে ফিরে মাছ ধরা, প্রতি মুহূর্তে মাছ-লোভ জল পেতনীর অস্তিত্ব ও ঘাড়ের কাছে তার নিশ্বাস অনুভব করা, আচমকা যেন কার নাকি গলায় মাছ চাওয়ার কথা শোনা ছিল আমাদের রোমান্সের একটা দিক।
আজ ঢেউ ভারী বিলে, বেতবনের শন্ শন্ শব্দ আসে কানে।
আমি বক্বক করি শহরের বুকে কী ঘটন অঘটন ঘটেছে তারই কাহিনী। তার কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে। এই পনেরো বছর বয়স জয়নালের, শহরে আসে পড়তে, কিন্তু একদিন ঢাকার নবাববাড়িও তার দেখা হয়ে ওঠেনি। আমি শোনাই তাকে সে কথা।
সে তাড়াতাড়ি সুতোর থলি থেকে বের করে আমচুর আর আমসত্ত্ব।—নে, আমায় দিছিল খাওনের লেইগ্যা।
খামু। সে নিজের জন্য এক চিমটি রেখে সবটুকু তুলে দিল আমার হাতে। আমি নির্বিবাদে তা একগালে পুরে দিলুম।
জয়নাল তার বড় বড় দাঁতে এক ঝলক হেসে সবলে, চুকা মিঠা এক লগে খালি?
আমার জিভ তখন উভয় রসে জরে গেছে। খালি হাসলুম।
মনে পড়ে, বন্ধুত্ব হওয়ার পর জয়নাল একদিন থলে ভরে নিয়ে এসেছিল মেলাই ফলপাকুড়। শশা, নারকোল, লঠকন, ডউয়া, চিড়ে মুড়ির মোয়া, নারকোলের সন্দেশ, বাজার থেকে কেনা ইরানি খেজুর। বলেছিল, দোস্তির খাওয়া। তুই দিবি আমার মুখে, আমি দিমু তর মুখে, এইডা কানুন।
এক বনের মাঝে লুকিয়ে আমরা দোস্তির ভোজনপর্ব উপভোগ করেছিলুম।
এ-দিক ওদিক দেখে আমরা ডিঙি ঢুকিয়ে দিলুম পাটখেতের মধ্যে। সে যেন গহন অরণ্য। তায় আজ আবার পাটখেতে লেগেছে মাতন। ডিঙিও যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়।
আরম্ভ হয় তামাক খাওয়ার পালা। জয়নাল যতটা গম্ভীর হয়ে হুঁকো টানত, আমি আবার তা পারতুম না। এটা আমার কাছে ছিল যেন বিরাট কুটিলবাধা ডিঙিয়ে এক মহামুক্তির স্বাদ। জয়নালের বাড়িতে ছিল না বিশেষ আপত্তি এই তামাক খাওয়ায়।
জয়নাল পাকা বুড়োর মতো হুঁকো টানতে টানতে বলল, মধু, বাপজানে কয় যে, মেট্রিক পাশ করলে, মোক্তারি পড়াইব।
মোক্তারি? আমরা দুজনে হো-হো করে হেসে উঠলুম গলা ছেড়ে, আমাদের চোখে বারবার ভেসে উঠল গোঁফওয়ালা এক বিদঘুটে বুড়োর মুখ, গোল চোখে তার ধুর্তের চাউনি।…মোক্তারি? যত ভাবি, তত হাসি।
আরও কী কয়, শুনছসনি? বলে সে লুঙ্গিতে মুখ মুছে হাসে মিট মিট করে।
আমি সে হাসির ভাবার্থ না বুঝে বললুম, কী?
বলতে তবু বাধে জয়নালের। বলে, কয়, এই বছরডা গেলে, আমারে নাকি শাদি দিব।
হ?
হ?
হাসিতে আমার পেট ফেটে যাওয়ার জোগাড় হল। এইটুকু জয়নালের বিয়ে? ওর সঙ্গে নিজেকে বিচার করে আমি একেবারে হাসিতে মাতাল হয়ে গেলুম এই পুব হাওয়ার মতো। মাথায় উঠল তামাক খাওয়া।
কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে যতই বিস্ময়ের ও হাসির হোক, জয়নালের তা নয়। ওর বাপ ভাইসাহেবেরা ওর মতো বয়সেই বিয়ে করেছিল।
সুতরাং ও কেন করবে না?
কিন্তু আমি কইছি বাপজানেরে যে, মোক্তারি আমি পড়ম না। এম এ পাশ কইরা আমি কইলকাত্তায় বড় চাকরি করুন। আর শাদি…
পাটখেতের হাওয়ার ঝাপটায় ভেসে গেল তার গলা।
বলল, কী রে?
সে বলল, মধু, তুই যদি কস, তবে করি।
মহা ভাবনার কথা। এবার আর হাসি ঠাট্টা নয়। দুই বালক বন্ধুতে আমরা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলুম পাটখেতের মধ্যে, দোলায়মান ভিঙিতে।
শেষে ঠিক করলুম, এটা বড় কম সম্মানের কথা নয় যে, এ বয়সে আমি হব একজন বিবাহিতের বন্ধু। বললুম, হঃ কৈরা ফেলা একটা শাদি।
কিন্তু, বউ যদি তর লগে মিলতে না দেয়? জয়নালের চোখে দুশ্চিন্তা।
ক্যান্ দিব না?
ঠোঁট উলটে বলল বনাল, কী জানি, বউগুলাইনে নাহি দোস্তি ভাঙায়। তার থেইকা ভাল আমার শাদি না করন।
এমন সময় একটা শোরগোল ভেসে এল দোলাইগঞ্জ স্টেশনের দিক থেক। আমরা তাড়াতাড়ি ডিঙি নিয়ে এগিয়ে এলুম।
দেখলুম দুটো নৌকা হাওয়া কেটে এদিকে আসছে এগিয়ে আর স্টেশনের উপরে খুবই ভিড়। অনেকে ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়ে সাঁতার কেটে আসছে এদিকে।
এক মুহূর্ত সেদিকে দেখে ও কান পেতে, চকিতে ডিঙির মুখ পুবে ফিরিয়ে শক্ত হাতে দ্রুত বৈঠায় চাড় দিল জয়নাল।
আমরা একসঙ্গেই বলে উঠলুম, রায়ট!…
মুহূর্তে আমার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। পুবে হাওয়ার ঝাপটায় কে যেন হিসিয়ে উঠল, মৃত্যু!… মনে পড়ল চকিতে, আমি হিন্দু আর ওই বিলের বুকে যারা ধেয়ে আসছে, মাছ ধরছে, তারা সবাই মুসলমান। এখুনি লগির কয়েক ঘায়ে শেষ করে ঢুকিয়ে দেবে কলমিদামের তলায়।
ফিরে তাকালুম জয়নালের মুখের দিকে। সে মুখ শক্ত, দৃষ্টি নিবদ্ধ আমারই দিকে। কিন্তু কেন?
ধাঁ করে প্রথমে মনে পড়ল, জয়নাল মুসলামান! আমি যে দেখলুম, তার ঠোঁটের কোণে ছদ্মবেশী আততায়ীর গোপন হাসি।
ডাকলুম তবু, জয়নাল।….
ডাকলুম, কিন্তু শব্দ বেরুল না গলা দিয়ে।
হাওয়া ঠেলে দোলাইগঞ্জ থেকে ভেসে এল মৃত্যুর আর্তনাদ। এল বন্দে মাতরম্ ও আল্লা-হো-আকবর ধ্বনি।
সংশয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে আমি প্রায় কেঁদে উঠলুম, জয়নাল, আমি বাড়িতে যামু।
না।
না? চকিতে মনে পড়ল সেই কুমিরের কথা, যে বাঁদরকে খাওয়ার জন্য ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিল জলে বেড়াতে। আমার ঘরবিমুখ মন প্রাণভয়ে হাহাকার করে উঠল বাবা মার কথা মনে করে।
আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম জলে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য।
খেঁকিয়ে উঠল জয়নাল, আরে, করস্ কী?
বাড়িতে যামু।
পিছে চাইয়া দ্যাখ।
চেয়ে দেখি, মানুষের ঝাঁক আসছে এ-দিকে সাঁতার কেটে বিল তোলপাড় করে। আসছে কয়েকটা নৌকা। তারা তো আমাকে ছাড়বে না।
সোঁ করে একটা ঝোপে ছাওয়া নালার মধ্যে ডিঙি ঢুকিয়ে ঘস করে থামিয়ে দিল জয়নাল। নৌকা বেঁধে আমার হাত ধরে লাফিয়ে ডাঙায় পড়ে একছুটে এসে সে হাজির হল ওদের বাড়িতে।
ডাকল, বাপজান!
আইছস, আইছসরে বাপজান! বলতে বলতে বেরিয়ে এল তার বাবা মুখ ভরা গোঁফ দাড়ি নিয়ে।
আইছস, আইছস, আমার মানিক! মোলক দুলিয়ে হুঁকো হাতে ছুটে আসে তার মা।
তার বারো বছরের ভাবি ঘোমটা তুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দরজা ধরে। ইতিমধ্যেই শুনেছে তারা দাঙ্গার কথা।
আমার দিকে চেয়ে দেখবার কারও অবসর নেই। ত্রাসে ফুঁপিয়ে উঠল জয়নালের আম্মা, আমার মজিদ কেমনে আইব গো-।
মজিদ জয়নালের বড় ভাই। সে কাজ করে টিকাটুলির গ্ল্যাস ফ্যাক্টরিতে।
জয়নালের বাবা বলল, আমি একবার ডিঙিখানা লইয়া দেইখ্যা আহি দোলাগঞ্জে।
না গো বাপজান, হেইখানে বড় কাটাকাটি লাগছে। জয়নাল বলে বাপের হাত ধরে। বাইরে কারখানার মধ্যে থাকতে পাবঅনে। আইজের রাইতটা থাউক।
একমূহুর্ত স্তব্ধ থেকে বলল তার বাবা, তবে থাউক। কী হও গো মজিদের মা?
যা বোঝো। বলে আম্মা উঠোনেই বসে পড়ে।
দরজা থেকে ঘরের অন্ধকারে মিশে যায় মজিদের বারোবছরের বউ।
তারপর হঠাৎ যেন তাদের সকলের নজরে পড়ে আমাকে। কিন্তু নেই সেই অভ্যর্থনা, স্নেহ-খুশির হাসি।
এ মুসলমান গ্রামের মধ্যে আমি যেন স্বজনহীন, অসহায়, আবদ্ধ হয়েছি শত্ৰুপুরীতে। আমি পালাতে পারি না, কেঁদে উঠতে পারি না। সংশয়ে যতক্ষণ কাটে, সেটাই যেন আশা।
একবার যেন হেসে উঠতে চাইল জয়নালের বাবা। বলল, জয়নাল, দোস্তরে তর ঘরে নিয়া তো।
কতদিন একথাটি শুনেছি, কিন্তু আজকের মতো এমন বেসুরো বাজেনি। আমার বালক মন বার বার মনে মনে গাইল, বুঝি খুন করার জন্য, বুঝি মজিদের প্রাণের জামিন হিসাবে আমাকে তারা তুলে রাখল ঘরে।
তারপর রাত্রি গেল, দিন গেল। জলো হাওয়ায় ঝড় বয়ে গেল বেতবনের উপর দিয়ে, কলাবাগানের ঢেউ দিয়ে, ছিটে বেড়ায় ঝাপটা খেয়ে।
আমি বন্ধ ঘরে, ভয়ে আধখানা হয়ে কে কোণে বসে বসে করছি বুঝি মৃত্যুরই প্রতীক্ষা, হাওয়ায় শুনছি তারই শাসানি।
আজ সকালে দেখি জয়নালকে তার বাপজান কী যেন বলল আমার দিকে ইশারা করে। সেই থেকে ওরা আমাকে শিকল বন্ধ করে দিয়েছে।
বললুম, জয়নাল শিকল দ্যাছ ক্যান?
বলল, তুই যদি পালাইয়া যাস্?
ওরা আমাকে পালাতেও দেবে না। জয়নাল আমার কাছে এসে বসেও না দুদণ্ড।
তবু ওরা আমাকে খেতে দেয়। কিন্তু কে খাবে?
আম্মা বলে, খাও মানিক, হাঙ্গাম থামূলে যাইয়ো বাপ মার কাছে।
মনে হল ওটা মিঠে গলার ছলনা। তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। কিন্তু আড়াল থেকে দেখছি, ওরাও খায় না শুধু ভাত নিয়েই বসে। দেখছি মজিদের কলাবউ জামতলায় দাঁড়িয়ে, ঘোমটা সরিয়ে ব্যাকুল চোখে কী যেন দেখে পশ্চিম মুখে। দেখছি জয়নালের বাপজানের শরীরটা ফুলে ফুলে ওঠে নামাজে বসে।
এ গ্রামের অনেকেই শাক তরকারি বেচতে যায় সূত্রাপুর বাজারে। তারা অনেকেই আসেনি ফিরে, কারও বা এসেছে মৃত্যুর খবর।
দিনে রাত্রে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে কান্না। কখনও শোনা যায় জেহাদি কোলাহল, আচমকা আকাশ লাল হয়ে ওঠে এ-দিকে ও-দিকে।
আমার যেন দিনরাতেরও হিসাব নেই।
প্রায় দিন চারেক বাদে হঠাৎ জয়নাল আমার কাছে এল। উসকোখুসকো চুল, কোলবসা চোখ, শুকনো মুখ। বলল, মধু, আমি যামু টিকাটুলি ভাইজানের খোঁজে। ফিরা আহি, তারপরে দিয়া আমু বাড়িতে।
তারপরে হঠাৎ কলসি থেকে মুঠোভরে তুলে আনল আমচুর। বলল, নে, খা। তোর মজার আমচুর।
বলে সে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হল এ যেন কত যুগের পুরনো কথা। ছুড়ে ফেলে দিলুম আমচুর আর হু-হু করে আমার চোখ ছাপিয়ে জল এল। আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও।
তারপর কয়েকদিন বাদে আমি ঘরে থেকেও বুঝলাম, অবস্থা অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। কিন্তু জয়নাল বা মজিদ কেউ-ই আসেনি।
ভাবছি, এমন সময় সবাই চেঁচিয়ে উঠল, আইছে, মজিদ আইছে। ঘর থেকে দেখলুম, একটা ছোট পুঁটলি বগলে মজিদ এসে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। সারা মুখে তার গোঁফদাড়ি, বসা চোখে যেন অর্থহীন দৃষ্টি। ঝড়ো হাওয়ায় উড়ছে রুক্ষ চুল।
আইছস্ সোনা, মানিক, আইছস্। বাবা মা জড়িয়ে ধরে মজিদকে।
বারোবছরের কলাবউটি ঘোমটা ঢাকতে ভুলে যায় তার হাসি মুখে।
মণিরে আমার খোদা ফিরাইয়া দিছে। আম্মা বলল, আমাগো জয়নাল আইছে না?
পুঁটলি থেকে রক্তমাখা জামা আর লুঙ্গি বের করে ফুঁপিয়ে উঠল মজিদ, জয়নালরে মাইরা ফেলাইছে।
ড়ুকরে উঠল সবাই, মাইরা ফেলাইছে?
মজিদ বসে পড়ে মাটিতে মুখ চেপে হা হা করে কেঁদে উঠল, হ কারফিউ এলাকা দিয়া যাওনের সময় তারে মিলিটারিতে গুলি কইরা মারছে। আমার কাছে যাওনের সময়।…
কারও কান্না আমার কানে গেল না। মনে হয় দুরন্ত হওয়ায় ঝাপটাই যেন দুনিয়াকে উলটে দেবে।
মেঝেতে তখনও ছড়িয়েছিল আমার ছুড়ে ফেরা আমচুর, জয়নাল দিয়েছিল।
আমাকে ফিরিয়ে দিতে চলেছে জয়নালের বাপজান ডিঙিতে করে।
আজ বিল শান্ত। থেকে থেকে হঠাৎ হাওয়ায় শিউরে উঠেছে কলমিদাম আর শাপলা ফুল, টলটলে জলে লুকোচুরি খেলছে ট্যাংরাপুঁটি, স্তব্ধ পাটখেত। পাখি একটা ডাকছে, ওহো… ওহো… সে শব্দ মিশে যাচ্ছে শূন্য আকাশের বুকে।
সন্দেহে প্রাণের ভয়ে আমি কাউকে ছোট করেছি কি না করেছি, কি ভাল কি মন্দ, সে বিচারের অবসর ছিল না আমার মনে। কেবল থেকে থেকে কুড়িয়ে আনা সেই আমচুর ভরা মুঠো বুকে চেপে, আমার বালকের বোবা মন গুমরে গুমরে উঠল আর খালি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, জয়নাল…জয়নাল!
বাপজান শুধু বলল, কাইন্দ নারে সোনা!…