জয়দ্রথ বধ
অর্জুন এসে আমাকে বললে, চল প্যালা, জয়দ্রথ বধ করে আসা যাক।
শুনেই আমি চমকে গেলুম। কারণ অর্জুন নিতান্তই কিছু আর মহাভারতের অর্জুন নয়–সে আমাদের পটলডাঙার মিত্র স্কুলের পিলার–মানে ক্লাস টেনে তিনবার ফেল করে থামের মতো পাকাপোক্ত হয়ে আছে। আমাদের হেডমাস্টার মশাই তাকে ডাকেন খর্জুর বলে। অর্জুন অবশ্য খর্জুর খেতে ভালোই বাসে, কিন্তু ওই খাদ্যবস্তুটি হতে তার নিজের একটু আপত্তি আছে।
এ-হেন খর্জুর, থুড়ি, অর্জুন জয়দ্রথ বধ করতে চায় শুনে আমার কেমন যেন বিষম লেগে গেল।
অর্জুন বললে, হাঁ করে আছিস কেন? আমি কি তোর মুখে রসগোল্লা দিতে চেয়েছি নাকি?
আমি বললুম, না, প্রাণে ধরে কাউকে কোনও দিন তুই রসগোল্লা দিতে পারবি এ-অপবাদ তোর সব চেয়ে শত্রু-মানে হেডমাস্টার মশাইও দিতে পারবেন না। কিন্তু তুই এই কলিকালে জয়দ্রথকে পাবিই বা কোথা, আর বধ করবিই বা কেমন করে?
অর্জুন বললে, ধ্যাৎ, তুই কোনও কাজের নোস। খালি পেট ভর্তি পালাজ্বরের পিলে নিয়ে পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোলই খেতে পারিস। আরে আমি বলছি দিকপাল সাহিত্যিক জয়দ্রথ বোসের কথা–যে-ভদ্রলোক তিনশো তিপ্পান্নখানা উপন্যাস লিখেছেন।
আমি বললুম, তা খামকা তাঁকে বধ করবি কেন? আমি তো তাঁর খানপাঁচেক বই পড়েছি–নেহাত খারাপ তো লেখেন না। তাঁর সেই যে বইটাতে বাঙালী ডিটেকটিভ হিমাদ্রিপ্রসাদ সাবমেরিন নিয়ে চীনে দস্যু চুং চাংকে প্রশান্ত মহাসাগরের ত্রিশ হাজার ফুট জলের তলায় গ্রেপ্তার করেছিল–সেটা তো দারুণ থ্রিলিং। তা ছাড়া তাঁকে যে বধ করতে যাচ্ছিস, গায়ের জোরে কি পারবি? একটা মিটিঙে আমি তাঁকে দেখেছি। বিরাট মোটা-অ্যায়সা ভুঁড়ি—
অর্জুন বললে, ধ্যাৎ, তুই জ্বালালি। তোর মাথার ভেতরে তুরপুন চালালে গোবরও বেরুবে না, বেরুবে ছাগলের নাদি! আরে সে-বধ নয়। আজকাল বিনি পয়সায় লেখকদের কাছ থেকে বই বাগাচ্ছি আমি। এবার জয়দ্রথ বোসের পালা।
বিনি পয়সায় লেখকরা বই দেন তোকে?–আমার রোমাঞ্চ হল; তুই বুঝি তাঁদের বাড়িতে গিয়ে ধরপাকড়–কান্নাকাটি, এই সব করিস?
ধরপাকড়, কান্নাকাটি করব আমি—ছোঃ! –অর্জুন তার খর্জুরবৃক্ষের মতো ঝাঁকড়া মাথাটা নেড়ে, হাত-পা ছুঁড়ে বললে, আমি অর্জুন শিকদার– বুদ্ধির জোরেই ম্যানেজ করে নিই।
কাতর হয়ে বললুম, সেই বুদ্ধির একটু আমায়ও দে না ভাই। আমিও না হয় খানকয়েক বই ম্যানেজ করব।
অর্জুন বললে, হবে হবে। চল আমার সঙ্গে। দেখবি আমার কায়দাটা। এরই জোরে ভস্মলোচনবাবুর মতো খিটখিটে লোক–যার বাড়ির সামনে দিয়ে কুকুর পর্যন্ত হাঁটতে ভয় পায়–সেই ভস্মলোচন পর্যন্ত আমায় চার-খানা বই দিয়েছে।
–সত্যি?
–সত্যি, কিনা নিজেই চোখেই দেখবি। কিন্তু খবর্দার–একটা কথা বলবি না। আমি যা বলব–যা করব, সব দেখে যাবি, মাঝে মাঝে মাথা নাড়বি– ব্যাস। বুঝেছিস তো! রাজি?
.
জয়দ্রথ বোস চেয়ারের ওপর উবু হয়ে বসে হুঁকো খাচ্ছিলেন। আমরা ঢুকতেই বললেন, কী চাই?
অর্জুন আমায় চোখ টিপলে। তারপর বললে, আমরা বিউটি পিকচার্স কোম্পানি থেকে আসছি স্যার। আপনার বই ফিলিম করব। আমার নাম অর্জুন শিকদার–ফিলিম ডিরেক্টার, আর এ আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্যালারাম ব্যানার্জী।
জয়দ্রথবাবু বললেন, বসুন বসুন।
এদিকে ফিলিম ডিরেক্টার ফিরেক্টার শুনেই তো আমার ভিরমি লাগবার জো! কী একটা বলে ফেলতে যাচ্ছি, অর্জুন পেছনে হাত নিয়ে কটাং করে আমায় চিমটি কাটলে। আর আমি তখুনি মুখ বুজে একটা চেয়ারে বসে পড়লুম।
জয়দ্রথ বললে, তা আমার কী বই ফিলিম করতে চান?
আজ্ঞে চারখানা বই নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে–রক্তমাখা তক্তপোশ, টিকিসহ ছিন্নমুণ্ডু, শ্যাওড়া বনের হাতছানি, আর-একখানা উকুনপুরের জোড়া খুন। বই চারখানা যদি একবার আমাদের পড়তে দেন
জয়দ্ৰথবাবু যেন মুখিয়েই ছিলেন। বললেন, নিশ্চয়। নিশ্চয়! এ আর বেশি কথা কী? এখুনি দিচ্ছি।
থেলো হুঁকো রেখে জয়দ্রথ বেরিয়ে গেলেন।
আনন্দে অর্জুনের চোখ মিটমিট করতে লাগল।
–দেখলি? এই হচ্ছে আমার কায়দা। ফিলিমের নাম শুনলে টাকার লোভে লেখকদের আর মাথার ঠিক থাকে না। এই করে কত বই আমি বাগিয়েছি।
–কিন্তু লেখকদের সঙ্গে যদি কখনও দেখা হয়? পথে দেখে যদি চেপে ধরে?
ইঃ, ধরলেই হল। বললেই হবে–না স্যার, শেষ পর্যন্ত বই পছন্দ হল না। ব্যাস।
চটির চটাপট আওয়াজ করতে করতে জয়দ্রথ ফিরে এলেন। তারপর চারখানা বই অর্জুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই নিন। তা ফিলিম করছেন কবে?
যত শিগগির পারি।–একগাল হেসে অর্জুন বললে, তিন-চার দিনের মধ্যেই খবর দেব! আজ তা হলে উঠি?
জয়দ্রথ বললেন, একটু দাঁড়িয়ে যান। বলেই ড্রয়ার থেকে একটা লম্বা মতন কাগজ বের করে বললেন, এর তলায় একটা সই করে দিন। আর ঠিকানটাও লিখে দিন।
–সই কেন?–একটু যেন ঘাবড়েই গেল অর্জুন।
–কিছু না কিছু না–আমার বাড়িতে মান্যিগণ্যি কেউ এলে আমি তাঁদের অটোগ্রাফ রাখি। হ্যাঁ-ঠিকানাটাও দেবেন।
–ও এই কথা!–এক গাল হেসে অর্জুন তখুনি তার তলায় সই করে দিলে।
আমি অবিশ্যি অটোগ্রাফ খাতা অনেক দেখেছি, কিন্তু এরকম লম্বা কাগজে কাউকে অটোগ্রাফ নিতে দেখিনি। আবার কাগজটার মাথার ওপর টিকিট-ফিকিটের মতো কী সব ছাপা। কে জানে বড় লেখকদের অটোগ্রাফের কাগজ হয়তো ওই রকমই হয়।
রাস্তায় বেরিয়ে অর্জুন প্রায় চার-পা তুলে লাফাতে লাগল; দেখলি–দেখলি তো প্যালা। কেমন মোক্ষম কায়দাটা। মুখের কথা পড়তে না-পড়তেই চার-চারখানা বই। এমনি চাইলে তো দিতই না– বলত, কিনে নিয়ে পড়ো গে। দ্যাখ–তির করে বই তো দিলই সঙ্গে সঙ্গে ডাঁটের মাথায় অটোগ্রাফও দিয়ে এলুম।
আমি বললুম, কিন্তু নিজের ঠিকানা দিয়ে আসিসনি তো?
পাগল! অত কাঁচা ছেলে পেয়েছিস আমাকে? যা মনে এসেছে তাই লিখে দিলাম : ৫/৭/২ বাদুড়বাগান বাই লেন–এই যাঃ-ওটা যে রাঙাপিসের ঠিকানা।
বললুম, সর্বনাশ করেছিস! যদি ওখানে খুঁজতে যায়?
অর্জুন বললে, খেপেছিস? সময় আছে নাকি লেখকদের? ঠিকানাই যদি খুঁজে বেড়াবে, তা হলে তিনশো তিপ্পান্নখানা উপন্যাস লিখবে কখন? তা ছাড়া সে অ্যায়সা গলি যে সাতদিনেও বের করতে পারবে না। আচ্ছা প্যালা–গুডনাইট। চলি। টা—টা–
আমি বললুম, বা-রে! চারটে বই বাগালি, একটা আমায় পড়তে দিবি না? অন্তত উকুনপুরের জোড়া খুনটা–
নাক কুঁচকে অর্জুন বললে, যা–যা! ইচ্ছে হয়, পয়সা দিয়ে কিনে পড় গে। বলেই বিশ্বাসঘাতক এক লাফে সামনের একটা দোতলা বাসে উঠে পড়ল। ঠিক দশদিন পরে অর্জুন এসে হাজির হাউহাউ করতে করতে।
–প্যালা রে, আমি গেলুম!
কী হয়েছে?
–ওই জয়দ্রথ বোস! দু হাজার টাকার দাবিতে উকিলের চিঠি দিয়েছে রাঙাপিসের ঠিকানায়। রাঙাপিসে সেটা আবার পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের ঠিকানায়। আর বাবা সেটা খুলে পড়েছে।
–অ্যাঁ! চারটে বইয়ের দাম দু হাজার টাকা!
–আরে বইয়ের নয়, ফিলিমের! ওই যে আমাকে দিয়ে অটোগ্রাফ সই করাল না? ওটা স্রেফ শয়তানি–আমি কি জানি ওকে স্ট্যাম্প কাগজ বলে? সেই কাগজে আমি নাকি লিখেছি–এই চারখানা বই আমি ফিলিমের জন্য আট হাজার টাকার চুক্তি করেছি আর আগাম বাবদ দু হাজার টাকা এক হপ্তার মধ্যেই দেব। সে-টাকা দিইনি বলেই উকিলের চিঠি।
–অ্যাঁ! অর্জুন চিঁ চিঁ করে বলতে লাগল বাবা হান্টার নিয়ে তাড়া করেছিল, কোনও মতে পালিয়ে বেঁচেছি। কিন্তু এখন কী করি বল তো প্যালা–বাড়ি ফিরব কেমন করে?
মহাভারতের অর্জুন জয়দ্রথকে বধ করেছিল, কিন্তু কলির জয়দ্রথ অর্জুনকেই বধ করে ফেলেছে! আমি তাকিয়ে দেখলুম, অর্জুনের মুখটা এখন ঠিক খর্জুরের মানে একতাল পিণ্ডিখেজুরের মতোই দেখাচ্ছে।