জমাখরচ

জমাখরচ

হুঁম! এ যে দেখছি একেবারে চক্রব্যূহের মতো ঘিরে ধরেছে রে? মুক্তির পথ তো দেখছি না। মা! মাগো—হাতে ধরা করতলটা থেকে চোখ সরিয়ে ঊর্ধ্বাকাশের দিকে চেয়ে হুঙ্কার ছাড়ে ভরাটি গলায়, সবই তোর ইচ্ছা মা।

এখানে আকাশও ঠিকমতো দেখা যায় না। ঘন গাছগাছালিতে ঠাঁইটা ঢাকা। গাছ বলতে বড় বড় শ্যাওড়া, বিশাল আসশেওড়া, বুনো জাম, পিঠুলি গাছের ঘন জঙ্গল। তাদের বুক জড়িয়ে উঠেছে লতা—তেলাকচু, আঁটাড়ি লতার ঘন আবেষ্টনী। গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে প্রবহমান নদীর কিছুটা দেখা যায়। দিনের বেলাতেও এখানে রোদ ঠিক ঢোকে না। স্যাঁতসেঁতে।

জায়গাটাকে লোকে বলে, মহাশ্মশান। তারই একদিকে একটা ঝুপড়ি চালাঘর, সামনে কিছুটা উঁচু মাটির ঢিবি মতো। এদিকে-ওদিকে মড়ার হাড়গোড়, ছেঁড়া কাঁথা, পোড়া কাঠ, আধপোড়া বাঁশও ছড়িয়ে রয়েছে।

সেই ঢিবির উপর সমাসীন কামড়বাবা ওরফে ভৈরববাবা। বলিষ্ঠ দেহ, চওড়া কপাল, বড় বড় দুটো চোখ দ্রব্যগুণে লালচে হয়েই থাকে। সামনে ধুনি জ্বলছে। এক মুখ দাড়ি-গোঁফ—চুলগুলো সিংহের কেশরের মতো এলোমেলো, রুক্ষ। গলায় স্ফটিকের মালা, লালনীল পাথর, তাবিজ কি নেই।

ওই সাবধান বাণীতেই কাজ হয়। লোকটা এসেছিল তীর্থদর্শনে। অনেক মানুষ দূর-দূরান্ত থেকেই এই তীর্থে আসে দেবী দর্শনে। ওদিকে বিশাল মন্দির, তোরণ। সারা উঠান বহু শত মানুষের নাম উৎকীর্ণ শ্বেতপাথরের ফলকে মোড়া। সহস্র যাত্রীর পদধূলি পড়ে ওই ফলকে মোড়া উঠানে।

গুপীনাথ সামন্তও তীর্থযাত্রায় এসেছিল এখানে। বাকসিদ্ধ কামড়বাবার মুখে সাবধানী বাণী শুনে গুপীনাথ বলে—বাঁচাও বাবা।

কামড়বাবা ধুনির পোড়া কাঠ তুলে গর্জায়, ভাগ শালা। দু’নম্বরী ধান্দা করবি, মেয়েদের সব্বোনাশ করবি। তখন মনে থাকে না?

গুপীনাথের ম্যানেজার উমানাথ দে এতক্ষণ ঘটনাস্থলে ছিল না। উমানাথ খুবই চালু লোক, কয়লাখাদান অঞ্চলের ঘুণ ব্যক্তি। সে এবার পুরো মাল টেনে একটা বোতল স্টক করে টলতে টলতে আর খুঁজতে খুঁজতে শ্মশানে এসে ওই দৃশ্য দেখে বলে জড়িত কণ্ঠে, কিছু একটা গতি করো বাবা। মায়ের ছেলে, তাকে বাঁচাতে হবে তো?

কামড়বাবা বুঝেছে পার্টি বেশ শাঁসালো। তার সহচর ভুতোও খবর এনেছে এখানের সেরা হোটেলে পার্টি, গাড়ি নিয়ে এসে উঠেছে। ভুতো এসব খবর জেনে এসেছে হোটেলের কেরানীর কাছ থেকে।

কামড়বাবা বলে, হোম করতে হবে, ধ্যান—ভৈরবের হোম। কত রকম ধ্যান আছে জানো? ব্রাহ্মী ধ্যান, নারায়ণী ধ্যান, মহেশ্বরী ধ্যান, চামুণ্ডা ধ্যান, কৌমারী ধ্যান, অপরাজিতা ধ্যান।

উমানাথ বলে, ওসব ধ্যানের হিসেব রাখো বাবা। কিসে উদ্ধার হবে গুপীবাবু তাই করো।

কামড়বাবা আকাশের দিকে চেয়ে বলে, হুম, তুই বলছিস মা! কে যেন শূন্য থেকে নির্দেশ দিচ্ছে। বাবা বলে গম্ভীর স্বরে, হোম করতে হবে, ভৈরব হোম, কতরকম ভৈরব আছে জানিস?

গুপীনাথ শুধু ব্যবসার গলিঘুঁজির হিসাবই জানে। তাই বলে, জানি না বাবা।

বাবা বলে, অষ্ট ভৈরব—অসিতাঙ্গ ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, চণ্ড ভৈরব, ক্রোধ ভৈরব, উন্মত্ত ভৈরব, কাপালি ভৈরব, ভীষণ ভৈরব আর সংহার ভৈরব। একেক জনের নামে হোম।

উমানাথ বলে, রাখো ওসব ভৈরব। আমিও বাবা উমানাথ ভৈরব, এটা রাখো। বিলেতী এসকচ। কি খরচা-টরচা লাগবে হেঁচে কেশে বলো। ব্যাটা চিফ ইনজিনিয়ারের পিছনে এক ব্যাটা ভৈরবকে ফিট করে দাও, শালাকে টাইট দিয়ে দিক।

বাবা ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে হুঙ্কার ছাড়ে,—

ওঁ কালী, কালী মহাকালী, কালীকে পাপহারিণী

ধর্ম কামপ্রদে দেবি নারায়ণী নমোহস্তুতে।। ওঁ কালী—

তারপরই গুপীনাথকে বলে, মা তোর ব্যাকুল প্রার্থনা শুনছে রে! হবে, তোর কর্মসিদ্ধি হবে, মা বলেছে।

গুপীনাথ এবার দামী গরদের পাঞ্জাবি পরা নধর দেহটাই শ্মশানের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, হাতের আঙুলে গোটা নয়েক রত্নের আংটি ঝকমকিয়ে বাবার চরণ স্পর্শ করে কাতর স্বরে বলে, রক্ষা করো বাবা।

উমানাথের কাছেই ক্যাশ থাকে। জাতে মাতাল হলেও উমানাথ তালে ঠিক আছে। সে বলে, তা ওই হোম-যজ্ঞির খরচে একটু ডিসকাউন্ট লেস করে বলো বাবা। মানে কমসম করে বলো—

বাবা বলে, হাজার পাঁচেক না হলে অষ্ট ভৈরবের হোম, শ্মশান কালিকার পূজা-হোম এসব তো হবে না। তারপর রৌপ্য-কাঞ্চন-মণি-রত্ন—

গুপীনাথের কাছে ওসব কিছুই নয়। এক রাতে পাঁচ-সাত ট্রাক কয়লা দু’নম্বরী করতে পারলেই পাঁচ হাজারের কয়েকগুণই এসে যাবে। গুপীনাথ বলে, পুণ্যের কাজকর্মে দরাদরি করতে নেই উমানাথ, কর্মসিদ্ধি হয় না। বাবার কথামতোই কাজ হবে।

কামড়বাবা আজ একটা শাঁসালো পার্টি ধরেছে। এখন খেলিয়ে তুলতে যা দেরী। উমানাথ বলে, বাবা, হোটেলে তোমার চ্যালাকে পাটিয়ে দাও, ক্যাশ দিচ্ছি।

কামড়বাবা জানে এতগুলো টাকা ভুতোর হাতে দেওয়া নিরাপদ নয়। বলে সে, কোথায় উঠেছিস?

গুপীনাথ বলে, হোটেল অপ্সরায়—

বাবা বলে জিনিসপত্রের মধ্যে কিছু মূল, বল্কলের আয়োজন করতে হবে। আমিই যাচ্ছি, তোরা যা। তখনই বলে দেব অমাবস্যার রাতে কখন কোথায় হোম করবো।

এখন কালীপুরকে আর চেনা যায় না। ক’বছরেই তার জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগে ছিল বনের কিছুটা অংশ, ধানজমি আর জলা। কচুরিপানায় বুজে থাকতো। মানুষজন বিশেষ আসতো না।

এখন পাকা রাস্তাটা ব্রিজ পার হয়ে কালীপুরকে বেড় দিয়ে জেলা শহরের দিকে গেছে। বাস-মিনিবাস-মালবোঝাই ট্রাক হরদম ছুটে চলে এই রাস্তা দিয়ে। এখান থেকে প্রথমে সাইকেল রিকশা যেতো রেল স্টেশনে। কয়েক কিলোমিটার পথ। এখন জমেছে অটো রিকশার ভিড়। যন্ত্রযুগের দখলদারি। ওদিকে বিরাট এলাকা জুড়ে বাসস্ট্যান্ড, যাত্রীরা পিলপিল করে নামছে বাস, মিনিবাস, অটো থেকে।

আর আশপাশে নদীর দু’ধার ঘেঁষে এখন গড়ে উঠেছে বড় ছোট মাঝারি অনেক হোটেল। রকমারি রেট তাদের, ঠাটবাটও তেমনি। কেউ মার্বেল পাথরের মেঝে, কাচের বড় বাহারি জানলা—ব্যালকনি, দামী পর্দা ঝুলিয়ে কয়েকশো টাকা দৈনিক ভাড়া হাঁকে।

তবে গঞ্জ এলাকায় পুরোনো দিনের ধর্মশালাও আছে। সেখানে ওঠে কমপুঁজির যাত্রীরা। অবশ্য যোগেযাগে এখানের ধর্মশালা, হোটেলে ঠাঁই মেলা ভার। ওই সদ্য গড়ে ওঠা হোটেলের তিনশো টাকার ঘরের জন্য আটশো টাকা দেবার লোকের অভাব নেই। মাথা গোঁজার জন্য মাটির বাড়িতেই তখন এক-দেড়শো টাকা চায়। অর্থাৎ ঝোপ বুঝে কোপ মারাটাই তীর্থস্থানের রীতি, তার ব্যতিক্রম এখানেও নেই। কামড়বাবার চোখের সামনে ধীরে ধীরে এই কালীপুরের ভিতর, বাইরের চেহারাটা বদলেছে। সেই বদলের ধাক্কা কামড়বাবাকেও বদলে দিয়েছে অনেকখানি।

শশী ভট্টাচার্যের বাড়ি ছিল বর্ধমানের কোন গ্রামে। ওর বাবার টোল ছিল, আর ছিল কিছু যজমান। তাদের পুজো, বিয়ে এসব কাজকর্ম করতে হতো। ছেলেবেলা থেকেই শশীও তাই পুজো-আর্চা কিছু শিখেছিল আর তখন থেকেই নজর পড়েছিল ওই গাঁয়ের সৌরভীর উপর। কৈবর্ত্যঘরের মেয়ে সৌরভী। সবে কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। শশী তখন ওর প্রেমে মশগুল।

কাজের ফাঁকে, সন্ধ্যার অন্ধকারে এসে হাজির হয় সৌরভীদের ওখানে। জাল বুনছে সৌরভী, হাতের সুতোর লাচির ওঠানামার সঙ্গে সৌরভীর যৌবনও নাচছে, চোখের তারায় সন্ধ্যাতারার ঝিলিক।

ঠাকুর যি গো? ইখানে?

শশী ওর পাশেই মাটির দাওয়ায় বসে বলে, এলাম সৌরভী, তোকে না দেখলে মনে ঝড় বয় রে!

সৌরভী বলে, দেখলে তো, ইবার যাও।

শশী এদিক-ওদিক চেয়ে সৌরভীর হাতটা ধরে বলে ব্যাকুল কণ্ঠে, তোরে ছেড়ে থাকতে পারি না রে।

সৌরভী দেখছে শশীকে। বলে, ঘরকে যাও ঠাকুর, লোকে দেখলে বদনাম দিবেক। তুমি পূজারী বামুন, বড় জাত—

জাতের ক্যাঁথায় আগুন, তোর জন্যে আমি সব ছাড়তে পারি রে।

সৌরভীর দেহে-মনে ঝড় ওঠে। তবু মেয়ে সে, মনের হিসাব করে। বলে, শেষে পস্তাবা, ঘরে যাও।

শশীর বুকে ঝড়ের মাতন। সৌরভীকে ছেড়ে বাঁচা যাবে না। কাজকর্মেও মন বসে না। একদিন বিকালের পড়ন্ত আলোয় কাঁদরের ধারে নির্জন বনে সৌরভীকে দেখে এগিয়ে আসে। গাছের পাতায় হাওয়ার লুটোপুটি, দিগন্তে আকাশ উবু হয়ে নেমেছে, বাতাসে কাঁঠাল ফুলের তীব্র মদির সুবাস। সৌরভীকে বুকের কাছে টেনে নেয় শশী।

ই কি ঠাকুর!

শশী বলে, চল, তোকে নিয়ে কোথাও চলে যাই। সেখানে ঘর বাঁধবো।

সৌরভী তবু ভরসা করতে পারে না। জানে গ্রামসমাজে তাহলে ঝড় উঠবে। নিজেকে ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বলে, তুমি সত্যি পাগল গো ঠাকুর, ই হয় না।

সৌরভীদের জাতে ওর মতো মেয়ের বাজারদর অনেক। সৌরভীর বাবাও বসে নেই। কানাঘুষোয় সেও কিছু শুনেছে। এ নিয়ে বামুন পাড়াতেও অনেক গোলমাল হয়েছে। শশীর বাবা নোটন ভটচাযকে গ্রামের পাঁচজনে বলেছে, ছেলেকে সামলাও নোটন। পণ্ডিতের বংশ শেষে অজাত-কুজাতের মেয়ে নে মজবে?

নোটন ভটচায ছেলেকেও শাসায়, খড়মপেটা করে গাঁ থেকে তাড়াবো তোকে।

শশী বলে, কেনে? রামী চণ্ডীদাস তো ছিল। চণ্ডীদাস কত বড় সাধক।

মারবো এক ঘা। চণ্ডীদাস হবার সাধ ঘুচিয়ে দেব তোর জন্মের মতন। বাবা এবার তেরিয়া হয়ে উঠেছে।

শশী তখন মনে মনে তৈরি। সৌরভীকে নিয়ে পালাবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না। সৌরভীর বাবা মোটা টাকার লোভে সৌরভীর বিয়ের ব্যবস্থা করেছে কালীপুরের ওদিকে কোন গাঁয়ে। পাত্র লোকটার নাকি অনেক পয়সা, দ্বিতীয়পক্ষের গৃহিণী গত হবার পর সৌরভীকে দত্তপুরের কালীতলায় দেখে পছন্দ করেছে।

চলে গেল সৌরভী। শশীর বুকটা যেন ভেঙে যায়। শূন্য হয়ে যায় তার চারিদিক। মনে হয় জগৎটাই মিথ্যা হয়ে গেছে। কাজেও মন লাগে না, বের হয়ে পড়ে পথে।

ক্রমশ যাযাবর জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে যায় শশী। শেষে একদিন এসে হাজির হয় গ্রাম থেকে দূরে এক বনঘেরা মন্দির অট্টহাসে। একটা জলভরা কাঁদর এই ঠাঁইটাকে হাঁসুলীর মতো ঘিরে রেখেছে, চারিদিকে বেশ কিছু অর্জুন-শেওড়া-বট-তমাল নানা গাছের জঙ্গল। শশী ওখানেই থেকে যায়।

বেশ কিছুদিন হলো কাপড়টা ও রাঙিয়ে নিয়েছে। অযত্নবর্ধিত দাড়ি-গোঁফ। জীবন সম্বন্ধে একটা বিবাগী ধারণাই হয়েছে। তাই নির্জনে পড়ে থাকে আর দু’মুঠো অন্নের জন্য যাত্রীদের সামনে সবজান্তা বাবার অভিনয় করে, তত্বকথার ফানুস ওড়ায়।

ক্রমশ শশী বুঝেছে এই পথে রোজগার ভালোই হতে পারে। নামডাকও হয়। তবে এই নির্জন অট্টহাসে যাত্রীও আসে কম। ওখানে বসেই শোনে কালীপুরের কথা।

তাই সেখানেই গিয়ে ওঠে শশী ভটচায। ততদিনে সে নাম বদলে হয়ে গেছে ভৈরববাবা।

কালীপুর তখন সবে জমছে, পাকারাস্তা নদীর ওপারে এসে থেমেছে, ব্রিজ হয়নি। ভৈরববাবা এসে শ্মশানে জোটে। অনেকেই আসে আবার চলে যায়। ভৈরববাবা কিন্তু রয়ে যায়। আর এখন সে কালীপুরে সুপরিচিত কামড়বাবা বলেই।

অপ্সরা হোটেলের সামনে পার্কিং লটে বেশ কিছু রকমারি গাড়ির ভিড়। টাটা সুমো, মারুতি এইট হান্ড্রেড, মারুতি থাউজেন্ড, অ্যামবাসাডার অনেক গাড়িওয়ালা পার্টি এসেছে। হোটেলের লাউঞ্জে কার্পেট পাতা, ঝকঝকে সোফা, ওদিকে একটা কালার টিভি। এখন এখানে ডিশ অ্যান্টেনা বসিয়ে ইংরাজী ছবিও দেখানো হয়।

গুপীনাথ সামন্ত, উমানাথ ঘরেই ছিল। সামনে মদের বোতল। বাবাকে ঢুকতে দেখে মদের বোতল রেখে বাবাকে প্রণাম করে উমানাথ ব্যাগ খুলে পাঁচ হাজারের একটা বান্ডিল বের করে। বাবা টাকা স্পর্শ করে না। বলে, রাখ ভুতো। ফর্দগুলো এনেছিস?

ভুতোও রেডি। টাকাটা প্রথমে হস্তগত করে কাঁধের থলিতে পুরে বলে, হ্যাঁ বাবা।

বাবা বলে, তাহলে গুপীনাথ, তোমরা রাত্রি এগারোটার পর এসো। মধ্যরাতেই তোমাদের ক্রিয়া শুরু করবো। চলি, জয় কালী—হুঙ্কার ছেড়ে উঠে পড়ে ভৈরববাবা।

উমানাথ এবার বাইরে এসে নির্জন সিঁড়িতে ধরে ভৈরববাবাকে, তাহলে আমার কর্ম কখন হবে? টাকা তো আগেই দিয়েছি।

ভৈরববাবা এদিক-ওদিক চেয়ে বলে, আশ্রমে এসো। কথা হবে।

এই কালীপুরের বিস্তীর্ণ শ্মশানে এই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের শবদেহ আধপোড়া করে জ্বালানীর অভাবে নদীর ধারে মাটির নিচেই পোঁতা হয়ে থাকে। বহুকাল ধরেই এখানে এই নিয়ম চলে আসছে।

ভৈরববাবা যখন এসেছিল তখন গ্রীষ্মের দাবদাহ চলেছে। রোদের তাতে চারিদিক যেন জ্বলছে। নদীতে শুধু বালির রাশি। একফালি জল তিরতির করে বইছে। শ্মশানের ওই জায়গাটা তবু ছায়াস্নিগ্ধ। সন্ধ্যার পর বাতাসের অগ্নিজ্বালা থামে, মন্দিরে শুরু হয় সন্ধ্যারতি, শ্মশানের গাছে পাখিদের হাজারো কণ্ঠের কলরব ওঠে।

সেদিন মন্দিরে গেছে ভৈরববাবা। পরনে রক্তাম্বর, মাথার চুলে ক্রমশ জট বাঁধছে। জয় কালী—মন্দিরে ঘণ্টা বাজিয়ে ঢুকছে সে। হঠাৎ সামনে কিছু যাত্রীদের ভিড়ের মাঝে কাকে দেখে চমকে ওঠে ভৈরববাবা। অতীতের ফেলে আসা দিনগুলো ভিড় করে, সেদিনের সৌরভীর ডাগর চোখ, ঢলঢল মুখখানা মনে পড়ে যায়। আজও সেই চাহনি বদলায়নি। বরং আরও নিটোল হয়েছে দেহটা।

সৌরভী অবশ্য চিনতে পারেনি। তার দাড়ি-গোঁফ ঢাকা মুখ, কপালে সিঁদুরের মাতুলি, জটা, রক্তাম্বর পরা চেহারার সঙ্গে সৌরভী সেদিনের শশীর কোনো সাযুজ্য খুঁজে পায়নি। সেও শুনেছে শ্মশান ভৈরববাবার কথা।

সৌরভীরা এসে প্রণাম করে। তখন দুপুর। শ্মশান ছায়াচ্ছন্ন। ভৈরববাবা শুধোয়, বাড়ি কোথায়?

সৌরভীর সঙ্গের যাত্রীরা বলে, কাছের নন্দীপুরে বাবা। সৌরভীও প্রণাম করে। একজন বলে, ওর কোল খালিই রয়ে গেল। সোয়ামীর এত পয়সা, বংশধর হবে না বাবা?

ভৈরববাবা দেখছে ওকে। এতদিন পর হঠাৎ আজ তার মনেও ঝড় ওঠে। সৌরভীর চোখে জল। বলে ভৈরববাবা, তোর অনেক দুঃখ, নারে? মাকে ডাক, সব দুঃখ দূর হবে।

গ্রামের এক বয়স্কা বলে, নবীন দাসের বৌ। নন্দীগাঁয়ের সবাই চেনে।

ভৈরববাবারও মনে পড়ে। নবীন দাস! ওই নামটা সেও যে শুনেছে।

এর মধ্যে ভৈরববাবা এখানে বাজারের খবরও জেনেছে। নবীন দাসের এখানে পাইকারি চাল-ডাল মুদিখানা ব্যবসা। ট্রাকে করে বস্তা বস্তা মাল আসে। নবীন দাস শ্মশানের বাইরের চত্বরে প্রায়ই ভাণ্ডারা দেয়। শ্মশানের ডোমগুলোকে ধুতি-কম্বল, মাল খাবার পয়সা নাহয় চোলাই তৈরি করতে চালও দেয়।

ভগলু, এতোয়ারিরা এখানের শ্মশানের চিতা জ্বালায়, শেষকৃত্য করে। আর দিনরাত মদে টং হয়ে ঘোরে। দেখেছে ভৈরব মাঝরাতে দু’একজন শ্মশানে ঘোরে, ঝুপঝাপ কোদালের শব্দও ওঠে।

সকালে এখানে-ওখানে খোঁড়ার চিহ্ন। আবার পায়ে পায়ে গাছের ঝরাপাতায় সব ক্ষত মিলিয়ে যায়। দূর থেকে ভৈরববাবাও দেখে রহস্যময় ওই ঘটনাগুলো।

তখন বর্ষাকাল। নদীতে বান ডেকেছে। গেরুয়া জল বাঁধ ছাপিয়ে দু দিকে এগিয়ে গেছে। এদিকের শ্মশান তখন জলের নিচে। সাধু তপস্বীরাও ঝুপড়ি ছেড়ে মন্দিরের ওদিকে আশ্রয় নেয়। দু’চারদিন পর জল নামে। নদীর ধারে এসে দেখে বন্যায় নদীর এপাড় ধসেছে আর সেই ধসা মাটির নিচে দেখা যায় বেশ কয়েকটা পুরোনা সমাহিত মৃতদেহ, এখন সেগুলো পুরো কঙ্কালে রূপান্তরিত হয়েছে। যেন তাকে রাখা কঙ্কাল।

আবার শ্মশানে ঘর বাঁধে ভৈরব। দেখে পরদিন কঙ্কালগুলোর চিহ্নমাত্র নেই। রাতে দেখেছিল ভগলুকে ওদিকে, আর সকালে ভগলু মদে চুর হয়ে ঘুরছে। ফতুয়ার পকেটে একগাদা নোট।

ভৈরববাবা এবার বুঝেছে ব্যাপারটা। নবীন দাসকেও দেখেছিল কাল ভগলুর সঙ্গে কি সব কথা বলতে।

নবীন দাস প্রায়ই শ্মশানে এসে সাধুদের প্রণাম করে কিছু টাকা দেয়। আজ এসেছে। এবার ভৈরববাবাকে দশ টাকা দিতে ভৈরব বলে, তিনখানা কঙ্কালের দাম কত রে!

চমকে ওঠে নবীন দাস, আজ্ঞে!

ভৈরব এর মধ্যে খবরও পেয়েছে। খবর দেবার মতো লোক আছে। ওই ভূতনাথ এদিক-ওদিকে ঘোরে। এখানকার চলমান গেজেট। মন্দির-বাজার-হোটেল ইত্যাদির অনেক গুপ্ত খবর সে জানে। এ হেন ভূতনাথ ভৈরববাবার খুব অনুগত। সেই খবর আনে।—কাল ভোর রাতে খড় জড়িয়ে কাঠের বাক্সে কি গেল রে কলকাতায়?

নবীন দাস এবার দুটো একশো টাকার নোট বের করে গলা নামিয়ে বলে, এ নিয়ে গোলমাল করো না বাবা। এখন থেকে প্রণামী বেশিই দেব।

ক্রমশ ভৈরববাবা আর নবীনের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি গড়ে ওঠে। দু’জনে দু’জনকে চেনে। আজ ভৈরববাবা নতুন করে চিনেছে নবীনকে। ওই লোকটার জন্যই শশী ভটচায আজ শ্মশানে পড়ে আছে ভৈরববাবা ওরফে কামড়বাবা হয়ে। এবার সে নবীন দাসকেই শেষ কামড় দেবে। সৌরভীকে দেখার পর থেকে সে এখন অন্য মানুষ।

সৌরভী ঘর-সংসার করে কিন্তু তার মন বসে না। নবীন দাস কালীপুরেই পড়ে থাকে। মাইল তিনেকের পথ, তবু গ্রামের বাড়িতে যায় খুবই কম। সন্ধ্যার পর গেলে রাতভোর সেখানে আড়তে জরুরি কাজে ব্যস্ত থেকে ভোরেই আবার চলে আসে। টাকাই তার ধ্যান-জ্ঞান। টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।

সৌরভীর আশা, স্বপ্ন সবই ব্যর্থ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুঃসহ রাগে জ্বলে ওঠে। কালীপুরেও আসে সে। দূর থেকে দেখে লোকটার এখানের হোটেল, বিশাল বাড়ি, ওদিকে মাঠ জুড়ে আড়ত, ট্রাক নানা কিছু। লোকটা যেন তাকে বন্দী করে তার জীবনের সব আশা, স্বপ্নকে শেষ করেছে।

সামনে ভৈরববাবাকে দেখে চাইল সৌরভী। স্তব্ধ ছায়াঘন শ্মশান, নদীতে কলকল শব্দে জলস্রোত বয়ে চলেছে। ঢিবির ওপর বসে আছে ভৈরববাবা। সৌরভী এসেছে তার কাছে, যদি সন্ন্যাসীর কৃপায় তার বাসনা পূর্ণ হয়। প্রণাম করে সে।

ভৈরববাবা বলে, তুই শশীকে ভালোবাসতিস? তোদের গাঁয়ের শশী ভটচায?

চমকে ওঠে সৌরভী। তার জীবনের ওই এক চরম দুর্বল ঠাঁইকে স্পর্শ করেছে সর্বজ্ঞ ওই সন্ন্যাসী। সৌরভী বলে, তুমি তো সবই জানো বাবা।

হাসে এবার ভৈরব। দেখছে সে সৌরভীকে। তারও মনে হয় সৌরভী তাকে ভোলেনি। আজও তার মনে সেই সুর বাজে। ভৈরব বলে, আমি সেই শশী রে সৌরভী। চিনতে পারিসনি?

চমকে ওঠে সৌরভী, দেখছে সে শ্মশানচারী লোকটিকে। সেই নাক মুখ চোখ—সেই কণ্ঠস্বর। এ তো তার সেই ছেলেবেলার সাথী। সৌরভী অবাক হয়, এই দশা হয়েছে তোমার? ঘর ছেড়ে এই শ্মশানে পড়ে আছো?

ঘর আর হলো কই? তুই তো চলেই এলি। এখন আবার বড়লোকের বউ।

সৌরভী জ্বলে কাঠ, ঝাঁটা মারি অমন বড়লোকের মুখে। জীবনটাই ছারখার করে দিলে।

শশী বলে, একা তোমারই নয়, আমার জীবনটাও।

সৌরভীর চোখে জল নামে। ওই নবীন দাস একা তাদের দু’জনকে তিলে তিলে শেষ করেছে। বলে সৌরভী, ওকে শেষ করতে পারো না তোমার তন্তরমন্তর দিয়ে? আপদ বিদেয় হয়।

তুই বলছিস?

সৌরভী বলে, হ্যাঁ বলছি। দু’জনেই জ্বলে পুড়ে মলাম ওই একটা লোকের জন্যে।

রাতে শ্মশানে চিতার ওপর বেলকাঠের স্তূপ জ্বেলে হোম করছে ভৈরববাবা, এখন সে অন্য মানুষ। হু হু অগ্নিশিখার সামনে তার বজ্রগম্ভীর নাদ ধ্বনিত হয়—

ওঁ সংহার ভৈরবং ধ্যায়েং প্রলয়ানিল সন্নিভং

জটাভারলসচ্চন্দ্রং খড়গম্ উগ্র ভয়ঙ্করম্।।

মুণ্ডমালাবলাকীর্ণং শ্রুতিকুন্তলমণ্ডিতং

চতুর্ভুজামদোন্মত্তং অট্টহাস্যম দিগম্বরম্—

ওঁ অগ্নয়ে স্বাহা—

আগুনে আহূতি দিচ্ছে। লাফিয়ে ওঠে অগ্নিশিখা। সংহারভৈরব যেন ওই আহূতি গ্রহণ করছে।

গুপীনাথ সামন্ত, উমানাথ—আরও অনেকে জুটেছে। নবীন দাসও শ্মশানে ঘুরতে এসে দেখছে ওই হোম।

ওর নজর অন্যদিকে। উমানাথ এক সময় উঠে আসে নবীনের কাছে। ওদিকে অন্ধকার। উমানাথের ব্যবসা কঙ্কাল সংগ্রহ করা, নবীনের লোকজন ফিট করা আছে। শ্মশানের এদিকে-ওদিকে কঙ্কালের সার। ওদের কাছে রত্নখনিই। কোনোমতে তুলে নবীন তার আড়তের ওদিকের বড় চুনজল ভর্তি চৌবাচ্চায় ওসব ধুয়ে জোড়াতালি দিয়ে কঙ্কাল বানায়, এক একটার দাম আট-দশ হাজার বা তারও বেশি। নগদ টাকা।

নবীন বলে, পাবে মাল পাবে। তবে কিছু অ্যাডভ্যান্স—

হোমযজ্ঞ শেষ হলো যখন তখন মধ্যরাত্রি। গুপীনাথের মনোবাসনা পূর্ণ হবে, উমানাথও মাল পাবার ব্যবস্থা করেছে। শ্মশান এখন স্তব্ধ। অন্ধকারে ঢাকা। ওদিকে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা গর্ত বেশ গভীর করে কাটা হয়েছে। ওর মধ্যে থেকে কোন অতীতের হাড় কঙ্কাল বের করে গুদামে পাঠিয়েছে নবীন। আরও কিছু মেলে কিনা দেখছে গর্তের মধ্যে। হঠাৎ উপর থেকে একটা ভারী পাথর এসে পড়ে তার ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে। কোনো শব্দও হয় না। লুটিয়ে পড়ে নবীন। ওর উপরই ঝপাঝপ করে রাশি রাশি মাটি চাপা দিচ্ছে বলিষ্ঠ ভৈরববাবা, কেউ কোথাও নেই। ঘামছে উত্তেজনায়। তবু মাটি চাপা দিয়ে চলেছে। একাই এত বড় গর্তটা বুজিয়ে ফেলে তার ওপর ঝরাপাতার স্তূপও ঢেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয় সব কিছু।

ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শশী ভটচায ওরফে কামড়বাবাজী এসে কুঠিয়ায় বসে বেশ খানিকটা তাজা মদ গিলে এবার শুয়ে পড়ে।

নবীন দাসের অন্তর্ধানের খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। বাজারে রটে যায় নবীন দাস সংসার ত্যাগ করে কোন মহাপুরুষের সঙ্গে হিমালয়ে চলে গেছে।

এর কিছুদিন পর এক রাতে সৌরভীও ঘর ছাড়ে। তবে একা নয়, সঙ্গে ওই শশী ভটচায। দাড়ি-গোঁফ-জটা আর নেই—নেই রক্তাম্বর । সৌরভীও এই চেয়েছিল। আজ তার টাকার অভাব নেই, শুধোয়, কোথায় যাবো?

শশী ভটচায বলে, চলো, এখান থেকে অনেক দূরে।

ওরা দু’জনে আজ আবার নতুন স্বপ্ন দেখে। মাটির অতলে নবীন দাস তখন উমানাথের হিসাবে প্রায় কঙ্কালেই পরিণত হয়ে গেছে। কোন শ্মশান ডোম তাকেও দেশান্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে।

ভোর হয়ে আসছে। শশী-সৌরভী চলেছে। ভোরের ট্রেনেই তারা এই জগৎ থেকে অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে বাঁচবে। কালীপুর শ্মশান থেকে ভৈরববাবা হারিয়ে গেল। অবশ্য সে হিসাবও কেউ রাখে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *