জমছে খেলা কার্নিভালে
পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের সবারই কিছু না কিছু করা উচিত, গম্ভীর গলায় বলল অয়ন হোসেন।
তাই নাকি? টিভির পর্দা থেকে চোখ ফেরাল জিমি পারকার, এতক্ষণ তাতে ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট দেখাচ্ছিল। অয়নের হাতে একটা গল্পের বই দেখে মনে হচ্ছিল কার্টুনে তার আগ্রহ নেই, তবে এইমাত্র যা বলল তাতে বোঝা যাচ্ছে, ক্যাপ্টেন প্ল্যানেটের পরিবেশ রক্ষার যুদ্ধ ও দেখেছে মনোযোগ দিয়েই।
হ্যাঁ, অয়ন মাথা ঝাঁকাল। গাছ কেটে, বন্য প্রাণী মেরে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছি আমরা।
তুই আবার পরিবেশবাদী হলি কবে? জিমির গলায় ব্যঙ্গের সুর।
পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিবেশবাদী হতে হয় না, জিমি, অয়নকে সিরিয়াস মনে হলো, একজন সচেতন মানুষ হওয়াই যথেষ্ট।
এসব বড় বড় সাবজেক্ট নিয়ে মাথা ঘামানোর বয়স এখনও আমাদের হয়নি, অয়ন।
কী বলছিস অয়ন প্রতিবাদ করল। প্ল্যানেটিয়ার্সদের দেখছিস না? ওরা কেউই আমাদের চেয়ে বড় নয়।
ওটা তো কার্টুন।
তাতে কী? আমাদের বয়সী গোয়েন্দা থাকতে পারে, আর প্ল্যানেটিয়ার থাকতে পারে না?
তোর কী হয়েছে, বল তো? জিমি বিরক্তি প্রকাশ করল। গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে কি পরিবেশ রক্ষার সংগ্রাম শুরু করতে চাস নাকি?
সংগ্রামটা আমরা গোয়েন্দাগিরির মাধ্যমেও করতে পারি।
ঠিক বুঝলাম না।
ঠিক আছে, বুঝিয়ে দিচ্ছি। পরিবেশ বিষয়ক অপরাধের তদন্ত করতে পারি আমরা।
প-রি-বে-শ-বি-ষ-য়-ক-অ-প-রা-ধ! কী ভাষা এটা? হিব্রু?
ফাজলামি করলে গাট্টা খাবি! অয়ন চোখ রাঙাল।
কী আশ্চর্য! প্রফেসরদের মত কথা বলবি, আবার গাঁট্টাও মারবি? বুঝিয়ে বল নারে, ভাই! আমি তো তোর মত পণ্ডিত নই।
ঠিক আছে। ধর, কেউ একজন অবৈধভাবে গাছ কেটে ফেলছে, অথবা নদীতে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলছে। এটা হলো পরিবেশ বিষয়ক অপরাধ।
তা আমরা কী করব?
তদন্ত করে কে এসব করছে বের করব, তাকে ধরিয়ে দেব!
এবার বুঝলাম। কিন্তু এ ধরনের কেস পাচ্ছিস কোথায়?
এরকম ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবি।
কী রকম?
গত সপ্তাহের একটা ঘটনাই বলি। স্যান ফ্রান্সিসকো বের অ্যালামি পোর্টে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আটক করা হয়। পাচার করার উদ্দেশ্যে সেটাকে একটা মার্চেন্ট শিপে করে ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
বলিস কী? সেটা এখন কোথায়?
এখানেই রহস্যের শুরু। খাঁচাসহ বাঘটাকে পোর্ট অথরিটি রেখে দিয়েছিল উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের জন্য। কিন্তু এক রাতে হঠাৎ বাঘটা উধাও হয়ে গেছে, সোজা কথায় পাচার হয়ে গেছে। শূন্য খাঁচাটা এখন শুধু পড়ে আছে। পুলিশ জোর তদন্ত চালাচ্ছে, তবে কোনও সুরাহা হয়নি। বাঘটাকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একটা বাঘকে লুকানো তো যা-তা কথা নয়!
এই ভো লাইনে আসছিস, অয়ন হাসল। চুরিটা ভেতরের কারও যোগসাজশে ঘটেছে হয়তো। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাঘটা গেল কোথায়? তদন্তের জন্য দারুণ একটা কেস, কী বলিস?
তবেই সেরেছে! কোথায় পোর্ট অ্যালামিড়া, আর কোথায় আমরা! তা ছাড়া পুলিশ যে কেস নিয়ে ব্যস্ত, তা তুই কীভাবে পাবি?
এটা তো জাস্ট উদাহরণ দিলাম, সত্যি কি আর যাচ্ছি নাকি?
বাঘের কথা বলে ভাল জিনিস মনে করেছিস, জিমি হঠাৎ বলল। হারকিউলিস আর মহারাজার খেলা দেখতে যাবি না?
কী! কার্নিভালে কি বিগ অ্যামেরিকান সার্কাস চলে এসেছে? অয়ন উত্তেজিত।
হ্যাঁ, জিমি বলল। গতকালই।
তা হলে তো আজই যেতে হয়। কখন যাবি?
সন্ধ্যায়। রেডি থাকিস।
শিয়োর!
বছর ঘুরে আবার এসেছে শীতকাল। সামনেই ক্রিসমার্স, স্কুল ছুটি। অয়নদের বাসায় বসে আড্ডা জমাচ্ছিল দুবন্ধু। ফি বছরের মত এবারও লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি ক্লাবের মাঠে বসেছে বিশাল কার্নিভাল। লোকজনের মনোরঞ্জনের জন্য সব রকমের ব্যবস্থাই খাকে ওতে, তার মধ্যে সার্কাস অন্যতম। গত পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত কার্নিভালে আসছে বিগ অ্যামেরিকান সার্কাস নামে একটা দল। এদের পোষা রয়েল বেঙ্গল টাইগার মহারাজা আর রিংমাস্টার হারকিউলিসের খেলা সার্কাসের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বাঘটার সঙ্গে হারকিউলিস যেসব দুঃসাহসিক খেলা দেখায়, তাতে শরীরের রোম খাড়া হয়ে যায়। অয়ন আর জিমির উত্তেজনা তাই খুবই স্বাভাবিক।
সন্ধ্যা পর্যন্ত তর সইল না দুবন্ধুর। বিকেল হতেই ছুটল কার্নিভালে। প্রথমে দুটো চক্কর দিল পুরো এলাকায়, তারপর টিকেট কেটে সার্কাস দেখতে ঢুকল।
বেশ ভালই জমল সার্কাস। ট্রাপিজ থেকে শুরু করে সমস্ত খেলাই দেখানো হলো। বিভিন্ন আইটেমের ফাঁকে ফাঁকে একজন জোকার এসে সবাইকে বেদম হাসাচ্ছিল। অয়ন আর জিমি ভীষণ উসখুস করছিল। কারণ যা দেখতে এসেছে, সেই বাঘের খেলাই শুরু হচ্ছে না। ওদের অবাক করে দিয়ে শেষ খেলাটাও হয়ে গেল, কিন্তু হারকিউলিস বা মহারাজার দেখা পাওয়া গেল না। এই সময় সার্কাসের উপস্থাপক স্পটলাইটের নিচে এসে বলল, প্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজ আমাদের বাঘের খেলাটি স্থগিত করা হয়েছে…
কথাটা শোনামাত্রই দর্শকদের মাঝে সরব গুঞ্জন শুরু হলো। উপস্থাপক হাত তুলে মানুষকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বলল, প্লিজ, আপনারা শান্ত হোন। আমাদের বাঘ মহারাজা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে সুস্থ করার চেষ্টা চলছে। ভাল হওয়ামাত্র তাকে আবার শো-তে হাজির করা হবে। সবাইকে শুভকামনা, ধন্যবাদ।
উপস্থাপক পালিয়ে বাঁচল। দর্শকরা সবাই নানারকম বিরক্তিসূচক শব্দ করছে। অয়ন শুধু তার ব্যতিক্রম। সার্কাসের তবু থেকে বেরিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলল, মহারাজার কী হলো?
শুনলি না, অসুখ করেছেঃ জিমি বিরক্তি ঝরাল। কেন, বাঘদের কী রোগ-শোক হয় না?
তা নয়। তবু মনে হচ্ছে, ভেতরে গিয়ে দেখে আসতে পারলে ভাল হতো।
সার্কাসের বিশাল তাঁবুটার পেছনে একটা ঘেরা জায়গা-সমস্ত স্টাফ, পশুপাখি আর জিনিস পত্র রাখা হয় ওখানে। অয়ন সেদিকেই তাকাচ্ছে। জিমি বলল, তোর মাথাটাথা খারাপ হয়নি তো? তোকে ঢুকতে দেবে ভেতরে?
কী মনে হয়? অয়ন ভুরু নাচাল। অয়ন হোসেনকে ঢুকতে দেবে না, এমন বান্দা এখনও পয়দা হয়নি।
প্রবেশপথে দুই মুটকো পালোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে তাদের কিছুক্ষণ দেখল ও। তারপর বলল, একটু টেকনিক খাটাতে হবে। তুই শুধু আমাকে সায় দিয়ে যাবি, ওকে?
ওকে।
তা হলে চল।
মুহূর্তেই চেহারা পাল্টে গেল অয়নের। উদ্বেগ ফুটিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকল, সেইসঙ্গে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুখে ডাকছে, ম্যাক্স! ম্যাক্স!!
প্রবেশপথের সামনে গিয়ে ও ঢুকেই পড়ছিল, খপ করে, এক পালোয়ান কাধ চেপে ধরল। বলল, আই, ছোকরা, কোথায় যাওয়া হচ্ছে, শুনি?
ম্যাক্সকে খুঁজতে! চেহারায় বোকা বোকা ভাব ফোঁটাল অয়ন। ও. ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
চাপাবাজি! পালোয়ান খেঁকিয়ে উঠল। আমাদের চোখ এড়িয়ে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারে না, তোমার ম্যাক্স তো কোন্ ছার?
ও পায়ের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে, আপনারা দেখতে পাননি।
অ্যাঁ! পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখতে কীরকম ও?
এটুকু লম্বা, মাটি থেকে এক ফুট ওপরে হাত রেখে দেখাল অয়ন।
চারটা পা, একটা লেজ আছে। শরীর একদম ধবধবে সাদা।
মানে? পালোয়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
আরে, মিয়া, ম্যাক্স একটা কুকুর, বুঝলেন? এখন সরুন তো, ওকে খুঁজতে দিন।
অ্যাই! অন্য পালোয়ান মুখ খুলল। ভেতরে ঢোকা নিষেধ!
তা হলে আমার কুকুরের কী হবে?
আমরা কী জানি?
কী জানি মানে? দেখুন, ম্যাক্সের কিছু হলে কিন্তু আমি আপনাদের ছাড়ব না। আমার বাবা পুলিশ। সবাইকে হাজতে পুরবে।
কী ঝামেলা! বলল প্রথম পালোয়ান। তারপর সঙ্গীর দিকে তাকাল। তুই এদিকটা সামলা। ছেলেটাকে আমি বসের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি একা যাব না, অয়ন প্রতিবাদ করল। আমার বন্ধুও ভেতরে ঢুকবে।
ঠিক আছে, ঠিক আছে! চলল।
ভেতরে পা ফেলে জিমির দিকে মুখ ঘোরাল অয়ন, চোখ টিপল। একটা ট্রেলারের সামনে ওদের নিয়ে গেল পালোয়ান। তারপর ওদের অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে ঢুকল।
কোথায় গেল ব্যাটা? ফিসফিসাল জিমি।
বসের কাছে, অয়নের সংক্ষিপ্ত জবাব।
সেটা আবার কে?
কে আবার? সার্কাসের মালিক–জর্জ রিড।
এতক্ষণ তো ভালই অভিনয় দেখালি। মি. রিডের সামনে কী করবি?
কন্টিনিউইটি বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
মানে একই জিনিস?
অফ কোর্স! যা-ই বলিস, গল্পটা ভারি কনভিন্সিং-তাই না?
তা তো বটেই। কিন্তু তোর মতলবটা কী?
সিম্পল, কুকুর খোঁজার নাম করে মহারাজাকে দেখতে যাব।
কথাটা শেষ করেই চারদিকে নজর বোলাল অয়ন। একজন আলখেল্লাধারীর ওপর চোখ আটকে গেল ওর। লোকটা খুব একটা দূরে দাঁড়িয়ে নেই, এদিকে পিঠ ফিরিয়ে রেখেছে। আশপাশে সবাই খুব ব্যস্ততার সঙ্গে ছোটাছুটি করছে, শুধু তার ভেতরই কোনও বিকার নেই। ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক বলা চলে না। তবে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তাও করতে পারল না। ট্রেলার থেকে সার্কাস-মালিক বেরিয়ে এসেছে।
জর্জ রিড মধ্যবয়েসী। পোশাক-আশাক, সেইসঙ্গে আচরণেও ভদ্রলোক মনে হলো। ওদেরকে বলল, কী ব্যাপার, খোকা? শুনলাম, তোমার কুকুর নাকি হারিয়ে গেছে?
হারায়নি, আপনার এই জায়গায় ঢুকে পড়েছে। দয়া করে খোঁজার অনুমতি দেবেন?
দেখো, আমরা একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। তুমি একটা কাজ করো। কুকুরের বর্ণনা দাও, আমাদের লোকেরা ওটাকে ধরে রাখবে।
তুমি শুধু পরে এসে নিয়ে যেয়ো।, তা হয় না, স্যর। আমার কুকুর আমিই খুঁজে বের করতে চাই।
শ্রাগ করল রিড। বেশ, তা হলে দেখো চেষ্টা করে।
ধন্যবাদ। বলেই জিমির হাত ধরে টান দিল অয়ন। হাঁটা শুরু করেই আলখেল্লাধারীর দিকে তাকাল।
নেই লোকটা! তাকে দেখার আশায় দ্রুত ভিড়ের ওপর দৃষ্টি বোলাল ও। এবং দেখতেও পেল। জায়গা বদলেছে লোকটা। আঁতকে উঠল অয়ন। একটা ছুরি দুআঙুলে ধরে ছুঁড়তে যাচ্ছে সে, লক্ষ্য জর্জ রিড। একটা চিৎকার দিয়ে ছুটল অয়ন।
সার্কাস-মালিক উল্টো ঘুরে ট্রেলারে উঠতে যাচ্ছিল, আচমকা অয়নের ধাক্কায় হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল। পরক্ষণেই ঠং করে একটা ছুরির ফলা ট্রেলারের গায়ে আছড়ে পড়ল, একমুহূর্ত আগে রিড সেখানেই ছিল। শোয়া থেকে ঝট করে মাথা তুলল অয়ন। দেখল, আততায়ীর আলখেল্লার হুড পড়ে গেছে। সেখানে দাড়িগোঁফে ঢাকা হিংস্র একটা মুখ দেখা যাচ্ছে।
মাত্র এক সেকেণ্ডের জন্য অপেক্ষা করল লোকটা।
তারপরই উল্টো ঘুরে ছুট লাগাল। সার্কাসের লোকজন ধাওয়া করল তাকে।
শরীর থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল অয়ন আর রিড। জিমি ছুটে এল। বলল, অয়ন, তুই ঠিক আছিস?
জবাব না দিয়ে মাটি থেকে ছুরিটা তুলল অয়ন, জরিপ করল। থ্রোয়িং নাইফ হিসেবে জিনিসটা অদ্ভুতই বটে। হাতল আর ফলা দেখে মনে হচ্ছে হাতে বানানো।
থ্যাঙ্কস, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল জর্জ রিড। আমার জীবন বাঁচিয়েছ। কী নাম তোমার?
আমি অয়ন হোসেন, মিষ্টি করে হাসল অয়ন। ও আমার বন্ধু জিমি পারকার।
দুই
রহস্যময় আততায়ীকে ধরা গেল না। খানিক পরে মি. রিডকে এসে জানাল দুজন। লোকটা নাকি ভীষণ জোরে দৌড়ায়। কার্নিভালের ভিড়ের ভেতর চোখের পলকে মিশে গেছে।
অয়নেরা তখন সার্কাস-মালিকের ট্রেলারে বসে আছে। লোকটা বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে, ভারি অস্বস্তির ব্যাপার। ইতিমধ্যে একটা রহস্যের গন্ধ পেয়েছে অয়ন, কিন্তু এ-প্রসঙ্গে কোনও প্রশ্ন করারই সুযোগ পাচ্ছে না।
তা, অয়ন, বলল রিড. তুমি কি অরিজিন্যালি আমেরিকান?
জী না। আমরা আসলে বাংলাদেশের মানুষ। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, আমার জন্মেরও আগে মা-সহ আমেরিকায় এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। পরে সেটল করেছেন।
ভেরি ইন্টারেস্টিং!
এভাবেই আলাপ চলছিল, হঠাৎ রিডের এক কর্মচারী হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাধা পড়ল। সার্কাস-মালিক উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ড্যান, কী হয়েছে?
সর্বনাশ হয়েছে, বস্! রজারকে বদমাশ বাঘটা…
মাই গড! কীভাবে ঘটল?
খাবার দিতে খাঁচায় ঢুকেছিল, সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ওকে আগেই মানা করেছিলাম… বিড়বিড় করল রিড। এখন কী অবস্থা, ড্যান? বেঁচে আছে?
আছে, তবে খুব খারাপ অবস্থা। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়েছে।
এক্সকিউজ মি, জিমি বলে উঠল। কে আহত হয়েছে?
হারকিউলিস, রিংমাস্টার, মি. রিড বললেন। ওর আসল নাম রজার।
মহারাজা হারকিউলিসকে আক্রমণ করেছে! দেয়াল ফেটে একটা জ্যান্ত পরী বেরিয়ে এলেও অয়নেরা এত অবাক হতো না। যে রিংমাস্টার মহারাজার মুখের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে খেলা দেখায়, বাঘটা কিছু করে না, সেই বাঘটা আজ হারকিউলিসকে আক্রমণ করে বসল।
ছেলেরা, আমাকে যেতে হয়, রিড বলল।
তোমরা থাকো! সার্কাস-মালিক তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। অয়নের কপালে কুটি। তা দেখে জিমি বলল, কী ভাবছিস?
পর পর দুটো দুর্ঘটনা ঘটল, জিমি। তোর কাছে অস্বাভাবিক লাগেনি?
কাকতালীয় ব্যাপার আর কী!
বড্ড বেশি কাকতালীয় হয়ে যাচ্ছে। মি. রিডকে ওই লোকটা খুন করতে চাইল কেন? মহারাজাই বা হারকিউলিসকে আক্রমণ করল কেন?
লোকটা হয়তো মি. রিডের ব্যবসায়িক শত্রু। আর মহারাজা যে অসুস্থ, তা তো আগেই শুনেছিস।
উঁহুঁ, আমার মনে হচ্ছে আরও বড় প্যাঁচ আছে। একটা কেস পেয়ে গেলাম বোধহয়।
সত্যি? জিমিও উত্তেজিত।
হ্যাঁ, তবে এখানে বসে থাকলে কোনও কাজ হবে না। চল, আশপাশটা ঘুরে-ফিরে দেখি। লোকজনের সঙ্গেও বলা বলা দরকার।
ট্রেলার থেকে বেরুল দুজনে। চারদিকে সবাই ব্যস্ত, কথা বলার কাউকে পাওয়া গেল না।
অয়ন, দেখ! হঠাৎ জিমি বলল।
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে অয়ন দেখল, একটা কাঠের বাক্সের ওপর সার্কাসের জোকার ছেলেটা বসে আছে। মনে হচ্ছে একমাত্র তারই কোনও কাজ নেই।
চল, কথা বলি, অয়ন প্রস্তাব দিল।
হ্যালো! কাছে গিয়ে হাত নাড়ল ওরা।
হ্যালো! প্রত্যুত্তর দিল জোকারও। মেকাপে তার মুখ ঢাকা, তবে বোঝা যাচ্ছে বয়েসে ওদের চেয়ে তেমন বড় নয় সে।
চমৎকার সন্ধ্যা, অয়ন বলল।
সত্যিই তাই। আচ্ছা, তুমিই মি. রিডের জীবন বাঁচিয়েছ, তাই না?
ঠিকই ধরেছেন…
উঁহুঁ, তুমি করে বললো। আমার বয়স এমন কিছু বেশি নয়।
শিয়োর!
আমি মার্কো, অয়নের সঙ্গে হাত মেলাল জোকার।
আমি অয়ন হোসেন। ও আমার বন্ধু জিমি পারকার।
নাইস টু মিট ইউ, জিমিও হ্যাণ্ডশেক করল।
এক মিনিট! মার্কো আঙুল তুলল। অয়ন-জিমি… নামদুটো চেনা। চেনা লাগছে… ইউরেকা! তোমরা তো বিখ্যাত গোয়েন্দা!
ঠিক তা না…অয়ন বলতে চাইল।
থাক, থাক, আর বিনয় করতে হবে না। তা, এখানে কী মনে করে? রহস্য?
আমরা এসেছি সার্কাস দেখতে।
তাতে কী? রহস্য পেলে সমাধান করবে না? এখানে তো রহস্য থই থই করছে।
তাই নাকি? জিমি আগ্রহ দেখাল।
নিশ্চয়ই মি. রিডকে ছুরি মারার, কথা বলছ?
আরে দূর! ওটা আবার রহস্য কীসের? তাকে ছুরি মারার লোকের অভাব আছে নাকি?
কেন? অয়ন অবাক! তাকে লোকে ছুরি মারতে চাইবে কেন?
লোকটা ভাল নয়, এজন্য। আমার ঘটনা শুনবে? আমি আসলে মেক্সিকান। ভীষণ গরিব ঘরে জন্ম নিয়েছি। ভাগ্য বদলানোর জন্য এদেশে এসেছিলাম। কয়েক মাস ঘুরলাম, কিন্তু চাকরি জুটল না। রীতিমত আত্মহত্যার কথা ভাবছি, এই সময় রিড আমাকে সার্কাসে জোকার হিসেবে কাজ দিল। প্রথমে তাকে আমার মহাপুরুষ মনে হলো। কিন্তু ধীরে ধীরে লোকটার মুখোশ আমার সামনে খুলে গেল। মানুষ নয় সে, পিশাচ। কর্মচারীদের ওপর যে সে কীভাবে অত্যাচার করে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। হারকিউলিস, মানে রজার হলো তার ডান হাত। আজ ওদের দুজনের ওপর দিয়েই ফাড়া গেছে। সবাই তাই খুশি।
কেউ প্রতিবাদ করে না?
কে করবে? সব ভীতুর ডিম, মুখ পর্যন্ত খুলতে রাজি নয়। একা.তো আর কিছু করা যায় না, সঙ্গী-সাথী লাগে।
তুমি তা হলে প্রতিবাদ করতে চাইছ?
নিশ্চয়ই। আর কিছু না পারলে সার্কাস ছেড়ে চলে যাব। টাকা জমানোর চেষ্টা করছি। সেটাও সহজ নয়। বেতন বলতে গেলে কিছুই দেয় না রিড। যাক গে, অনেক দুঃখের কথা বললাম। তোমরা আমাকে সাহায্য করবে?
সাহায্য! পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল অয়ন আর জিমি। তোমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতে আমরা কীভাবে সাহায্য করব?
রিডের মুখোশ খুলে দিতে চাই আমি তোমাদের সাহায্য পেলে তা সম্ভব।
পরিষ্কার করে বলল, অয়ন বলল।
রিড কোনও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। সার্কাসের পাশাপাশি কোনও না কোনও অবৈধ কাজ করে সে, আমি শিয়োর! সেটাই তোমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
কাজ শুরু করার জন্যে আমাদের কিছু সূত্র তো লাগবে, জিমি বলল।
ঠিক আছে, চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি ফেলল মার্কো। তারপর বলল, গত কয়েকদিন থেকে রহস্যময় কয়েকজন লোক রোজ রাতে সার্কাসের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। মাঝে মাঝে রিডের সঙ্গে দেখাও করে। আমাদের জানতে হবে, এরা কারা। কেনই বা গোপনে আসা যাওয়া করে?
হুঁ, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তায় ডুবে গেল অয়ন।
একটা গুঁতো দিল জিমি। অ্যাই, অয়ন, কী ভাবছিস?
মহারাজাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। ও হারকিউলিসকে আক্রমণ করল কেন? এতদিনের পুরনো ট্রেনার…
ওটা কোনও ঘটনা হলো নাকি? মার্কো বিরক্তি প্রকাশ করল। রিংমাস্টাররা প্রায়ই বাঘ-সিংহের থাবা খায়।
কোনোকিছুকেই হেলা করে দেখা ঠিক নয়, মার্কো, অয়ন বলল।
তা ছাড়া এতদিনের পুরনো বাঘ এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটায়ও না।
তার মানে?
মানে এটাও একটা রহস্য। আচ্ছা, মহারাজার খেলা কি আজই প্রথম স্থগিত করা হলো?
না, মার্কো মাথা নাড়ল। ট্রেনটনেও মহারাজা খেলা দেখায়নি।
শুরু থেকে বলো।
গত সপ্তাহে আমরা উত্তরের কোকো বিচে খেলা দেখাই। সেখান থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসার কথা ছিল। পথে হঠাৎ ট্রেনটনে তাঁবু ফেললাম আমরা, একটা শো-ও করলাম। পরদিন আবার রওনা দিয়েছি। কোকো বিচে মহারাজা শেষবার খেলা দেখায়। তারপর রিডের মাথায় কী যেন ভূত চাপল, বাঘটাকে একটা চারদিক বন্ধ বাক্সে ভরল, খাঁচায় আর রাখল না। ওকে আবার খাঁচায় রাখা হলো ট্রেনটন থেকে রওনা দেবার আগে। সেই থেকে ও কেমন জানি হয়ে গেছে, অস্থির। এমন আগে কখনও দেখিনি।
ইন্টারেস্টিং!।
হয়তো ওভাবে বন্দি করায় বাঘটা রেগে গেছে, জিমি বলল।
অ্যাবসার্ড! অয়ন প্রতিবাদ করল। এমন হতেই পারে না। অন্য কোনোকিছু মহারাজাকে আপসেট করেছে। সেটাই বের করতে হবে।
তোমরা বাঘ-বাঘ করে অস্থির হচ্ছ, কিন্তু রহস্যময় লোকগুলোর ব্যাপারে কী করছ? মার্কো বলল।
আজও আসবে ওরা? প্রশ্ন করল অয়ন।
বোজই আসে। আজ না আসার কোনও কারণ নেই।
গুড। তা হলে নজর রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। জিমি, তুই থাক মার্কোর সঙ্গে। আমি একটু ঘুরে আসি।
কোথায় যাচ্ছিস? জানতে চাইল জিমি।
রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল অয়ন। বলল, লাইব্রেরি এখনও বন্ধ হয়নি। রয়েল বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন দরকার। হয়তো মহারাজার অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা পেয়ে যাব। তুই খেয়ে নিস। আমি একেবারে খেয়ে-দেয়ে ফিরব। বাসায়ও খবর দিতে হবে, রাতে ফিরতে দেরি হবে। তোর বাবা-মাকেও খবর দিয়ে আসব।
ঠিক আছে, যা। ফিরবি কখন?
এই ধর, এগারোটা নাগাদ। কাছাকাছি থাকিস।
ওকে।
অয়ন চলে গেল। মার্কো বলল, ব্যাপারটা কী? বাঘ নিয়ে মেতেছে কেন ও?
নিশ্চয়ই কোনও খটকা লেগেছে। অবাক হবার কিছু নেই, বলল জিমি।
আমি মেকাপটা ধুয়ে আসি, তুমি অপেক্ষা করো।
শিয়োর।
.
লাইব্রেরিতে রাত দশটা পর্যন্ত কাটাল অয়ন, একগাদা বই নিয়ে বসেছে। বেশ কিছু তথ্য পেল ও। তবে কোনোটাই মহারাজার আচরণের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত অন্য লাইনে চিন্তা করার চেষ্টা করল। আচ্ছা, বাঘটা কখন, কোথায় প্রথম অস্বাভাবিক আচরণ করল? ট্রেনটনে। কিন্তু কেন? বিশেষ কোনোকিছু কি ঘটেছিল, নাকি ওখানকার পরিবেশ সহ্য হয়নি? ভাল কথা, ট্রেনটন শহরটা আসলে ঠিক কোথায়?
একটা গাইডবুক নিয়ে বসল অয়ন। ট্রেনটন নামটা পাওয়া গেল, পরমুহূর্তেই ওর বুক ধক করে উঠল। এটা কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি…
সবকিছু নতুন করে সাজাল ও। হ্যাঁ, মিলে যাচ্ছে,.. সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। পরক্ষণেই জিমির কথা মনে পড়ল ওর। বেচারা কিছুই জানে না, সে বিরাট বিপদে পড়তে চলেছে। তাড়াতাড়ি বইগুলো গুছিয়ে রাখল ও। বাসায় আগেই ফোন করে দিয়েছিল, এখন লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল। একটা ট্যাক্সির খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাল, কিন্তু দেখতে পেল না। আচমকা ওর ঘাড়ের রোম শিরশির করে দাঁড়িয়ে গেল, কে যেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঝট করে ও ঘোরার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই রুমাল ধরা একটা হাত ওর নাক-মুখ চেপে ধরল।
মিষ্টি একটা গন্ধ নাসারন্ধ্র বেয়ে ঢুকে যাচ্ছে শরীরে। কেমন একটা অবসাদ ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। জ্ঞান হারাবার আগে প্রতিপক্ষের মুখের দিকে এক পলক ফেলতে পারল অয়ন। সেটা দাড়িগোঁফে ঢাকা হিংস্র একটা মুখ।
তিন
নজর রাখার জন্য একটা ভাল জায়গা বের করেছে মার্কো। জর্জ রিডের ট্রেলারের কাছাকাছি, খড়ের গাদার ভেতরে। রাত দশটার দিকে সেখানে আত্মগোপন করল জিমি আর সে।
ধীরে ধীরে সময় গড়াতে লাগল। এগারোটা, বারোটা… কিন্তু অয়নের দেখা নেই। চিন্তিত হয়ে উঠল জিমি, কোনও বিপদ ঘটল না তো! দুবার লুকানোর জায়গা থেকে বেরিয়ে চক্করও দিল অয়ন ওদের খুঁজে পাচ্ছে না ভেবে, কিন্তু কোনও লাভ হলো না।
কার্নিভালের সমস্ত কোলাহল একসময় থেমে গেল। সবাই ঘুমিয়ে সজনে ছায়ায় ছায়ার খাঁচার সামনে লোকগুলোকে দেত আকৃতির পড়েছে। জিমি আর মার্কোও ঢুলুঢুলু চোখে খড়ের গাদায় বসে রইল। অনেক রাতে হঠাৎ মার্কো জিমিকে ধাক্কা দিল। ফিসফিস করে বলল, ওরা এসেছে।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল জিমি। জর্জ রিডের ট্রেলারের বাইরে চারটে ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। ট্রেলারের ভেতরেও আলোর আভা, সম্ভবত ডিমলাইট জ্বলছে। একটু পর দরজা খুলে সার্কাস-মালিক লম্বা-চওড়া এক লোকই বেরিয়ে এল। তারপর পুরো দলটা কোথায় যেন রওনা দিল।
চলো, ফলো করি, বলে জিমি আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তারপর দুজনে ছায়ায় ছায়ায় দলটাকে অনুসরণ করল।
সোজা মহারাজার খাঁচার সামনে গিয়ে থামল লোকগুলো, বাঘটা অস্থিরভাবে তখনও পায়চারি করছে। লোকগুলোকে দেখে মৃদু গর্জনও করল। লম্বামত লোকটা কী যেন বলতেই তার এক সঙ্গী অদ্ভুত আকৃতির একটা বন্দুক তার হাতে ধরিয়ে দিল।
ট্র্যাঙ্কুইলাইজার গান! জিমি বিড়বিড় করল।
বাঘটাকে সই করে গুলি করল লোকটা। চাপা একটা শব্দ করে একটা ভার্ট বেরিয়ে গেল, সোজা গিয়ে বিধল মহারাজার শরীরে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই মহাপরাক্রমশালী রয়েল বেঙ্গল টাইগার জ্ঞান হারাল, পা মুড়ে পড়ে গেল খাঁচার মেঝেতে।
কী করছে ওরা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল মাকে।
শ্শ্শ্, ঠোচে আঙুল চাপা দিয়ে দেখাল জিমি। শব্দ কোরো না।
কয়েক মিনিট পর একটা ট্রাক এসে থামল ওদের সামনে। ধরাধরি করে অজ্ঞান বাঘটাকে খাঁচা থেকে বের করা হলো, তোলা হলো ট্রাকে।
সর্বনাশ, মহারাজাকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা! মার্কো আঁতকে উঠল।
ঝড়ের বেগে চিন্তা করছে জিমি, শেষ পর্যন্ত চরম সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল। ট্রাকের পেছনে কেউ নেই, তিনজন দুবৃত্ত উঠেছে ড্রাইভারস ক্যাবে। বাকি সবাই জর্জ রিডসহ একটা কারে উঠে রওনা হয়ে গেল। ট্রাকটা ছাড়তে সময় নিচ্ছে-এই সুযোগটা নেবে বলে ঠিক করল জিমি। মার্কোর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, এসো!
জিমির প্ল্যানটা ধরতে পারেনি মার্কো, তবুও নির্দেশ পালন করে ছুটল। ট্রাকের পেছনের দরজা আস্তে করে খুলল জিমি, তারপর দুজনে তাতে চড়ে বসল। তারপরই ট্রাকটা চলতে শুরু করল।
মাই গড়, জিমি! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মার্কো! কোন দুঃখে ট্রাকে উঠলাম আমরা? সঙ্গে একটা জ্যান্ত বাঘ, সামনে তিনজন বদমাশ আছে। মারা পড়ব তো!
কী করা যাবে, বলো? নো রিস্ক, নো গেইন।
ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, জিমির হাসিটা তাই দেখতে পেল না মার্কো।
.
জ্ঞান ফিরতেই অয়ন দেখল, একটা বিছানায় শুয়ে আছে ও। মাথার ওপর একটা বালব জ্বলছে। ঝট করে উঠে বসল ও, ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে বারোটা বাজে। ইশ, অনেক দেরি হয়ে গেল। জিমি আর মার্কো কী করছে, কে জানে।
ঘুম ভাঙল তা হলে?
ঝট করে ঘাড় ফেরাল অয়ন। রুমের অন্য প্রান্তে একটা চেয়ারে বসে আছে রহস্যময় লোকটা।
বাব্বাহ্, সামান্য ক্লোরোফর্মের গন্ধে এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকবে, বুঝতে পারিনি, আবার বলল সে।
এসবের মানে কী, জানতে পারি? অয়ন কড়া গলায় বলল।
আপনি কে? কেনই বা আমাকে ধরে এনেছেন?
সবই বলব। তার আগে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল। আমি তোমার শত্রু নই, কোনও ক্ষতিও করার ইচ্ছে নেই।
তা হলে কিডন্যাপ করলেন কেন?
কারণ, আর কোনও উপায় ছিল না। তুমি আমার সঙ্গে এমনিতে কথা বলতে না।
আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান? অয়ন অবাক হলো। কিন্তু কেন?
তোমার সাহায্য চাই আমি, বাঘটার ব্যাপারে।
কোন বাঘ? মহারাজা, নাকি যেটাকে ভারত থেকে ধরে আনা হয়েছে?
তুমি জানো! লোকটা ভীষণ অবাক হয়েছে। কিন্তু কীভাবে?
অঙ্ক কষে। কিন্তু কোন বাঘটার কথা বলছেন, তা তো বললেন না।
দ্বিতীয়টা, নিজেকে সামলাল আগন্তুক। গোড়া থেকেই সব খুলে বলি, কেমন?
আমার নাম বালকিষণ। ব্যাঙ্গালোর থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দক্ষিণে গভীর জঙ্গলে কয়েকশো বছরের পুরনো একটা ব্যাঘ্র-মন্দির আছে। এখন সেখানে কোনও পুজো হয় না, তবে এককালে মহান ব্যাঘ্র-দেবতার উপাসনা হতো সেখানে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, স্বয়ং ভগবান বাঘের রূপ ধরে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। ব্যাপারটা কুসংস্কারের মত শোনালেও এটা ঠিক, যুগ যুগ ধরে একটা বাঘকে এই মন্দিরের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। এই বাঘের ঘটানো অনেক অলৌকিক কীর্তির কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে।
আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন এই মন্দিরের পুরোহিত। এখন মন্দিরে উপাসনা হয় না, দিন বদলে গেছে। আমরাও জঙ্গল ছেড়ে শহরে চলে গেছি। তবে এই মন্দিরের সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু এখনও আমাদেরই।
কয়েক মাস আগেকার কথা। হঠাৎ খবর পেলাম, মন্দিরের আশপাশে যে বাঘটা ঘুরে বেড়াত, সেটাকে দেখা যাচ্ছে না। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, বিদেশি কিছু সাহেব শিকারে এসেছিল, মন্দিরের আশপাশে কয়েকদিন ঘোরাফেরাও করেছে। স্থানীয় কিছু লোক ওদের গাইড করেছে। বিশ্বাসঘাতকগুলোকে ধরে দুঘা দিতেই বেরিয়ে পড়ল আসল কথা। বাঘ-দেবতাকে ফাঁদ পেতে ধরেছে সাহেবরা, তারপর রাতের আঁধারে পাচার করে নিয়ে গেছে। পাগলের মত তাদের ধাওয়া করলাম, কিন্তু তার আগেই জাহাজে তুলে দেয়া হয়েছে ব্যাঘদেবকে, গন্তব্য আমেরিকা।
ব্যাঘ্র-পুজো কিন্তু এখনও বিলুপ্ত হয়নি। বহু অনুসারী সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে। তাদের সাহায্য নিলাম আমি, চলে এলাম আমেরিকায়। এখানে এসে রীতিমত আশাভঙ্গ হলো আমার। আইনের লোকেরা আমার কথা শুনতেই রাজি নয়। বহু তদবিরের পর পোর্ট অ্যালামিডায় বাঘটাকে আটক করা হলো ঠিকই, কিন্তু সেখান থেকে রাতের আঁধারে সরিয়েও ফেলা হলো। কাজেই একা-একাই যা করার করব ঠিক করলাম।
টাকা-পয়সা খরচ হলো, কিছু ইনফরমেশনও পেয়ে গেলাম। কোনও এক ক্ষমতাবান কোটিপতির চোখ পড়েছে আমাদের ব্যাঘ্ৰদেবের ওপর। কিংবদন্তি বলে, মহান ব্যাঘ্ৰদেবের রক্ষণাবেক্ষণকারী একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছুলে অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করে। এই কাহিনী কী করে যেন সেই কোটিপতির কানে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাঘটাকে ধরে এনেছে। যা হোক, আরও জানতে পারলাম, একটা সার্কাসের বাঘ সাজিয়ে তাকে পাচার করা হয়েছে।
সার্কাসের মালিককে প্রথমে ভালভাবে বাঘটাকে মুক্তি দিতে চিঠি দিলাম, লাভ হলো না। হুমকি দিলাম, কাজ হলো না। কাজেই বাধ্য হয়ে জানের ভয় দেখাতে হলো। ছুরি মারাটা তারই ফলশ্রুতি। ওকে খুন করতাম না আমি। তুমি না বাঁচালেও জিনিসটা ওর গায়ে বিধত না। ছেলেবেলায় হাতে বানানো ছুরি দিয়ে বহু শিকার করেছি, এ ব্যাপারে আমাকে একজন এক্সপার্ট বলতে পারো তুমি।
ভালই তো এগোচ্ছিলেন, বলল অয়ন। আমার সাহায্য চাইছেন কেন?
দেখো, আমি অনেক ভেবে দেখেছি, এভাবে কিছু করতে গিয়ে আইনের চোখে উল্টো আমিই অপরাধী হয়ে যাচ্ছি। তা ছাড়া এই অবস্থায় বাঘটাকে উদ্ধার করলেও একা আমার পক্ষে দেশে সেটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার মত আগন্তুককে কেউ বিশ্বাস করছে না, গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমি খবর পেয়েছি, বয়সে ছোট হলেও তুমি আর তোমার বন্ধু বেশ কিছু জটিল রহস্য সমাধান করেছ। পুলিশের সঙ্গে তোমাদের ভাল খাতির আছে, তাদের আমার সমস্যাটা বোঝাতে পারবে-যা আমি পারছি না। এই সাহায্যটাই প্রয়োজন আমার।
কিন্তু পুলিশের কাছে যেতে হলে কিছু নিরেট প্রমাণ চাই। বাঘটা যে সার্কাসের নয়, সেটা প্রমাণ করতে পারবেন?
হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল বালকিষণ।
অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে তা হলে, অয়ন বলল। সেই কোটিপতিটা কে?
তাও জানতে পারিনি।
বিরাট ঝামেলায় পড়া গেল। নো চিন্তা, উপায় একটা বেরিয়ে যাবে। চলুন কার্নিভালে যাই, জিমিকে ওখানে নজর রাখার জন্য রেখে এসেছি। ও হয়তো কোনও সূত্র পেয়েছে। ভাল কথা, আমরা আছি কোথায়?
এটা একটা বোর্ডিং হাউস। কার্নিভাল দশ মিনিটের পথ। আমার সঙ্গে একটা ভাড়া করা গাড়ি আছে।
ভেরি গুড। চলুন যাই।
গাড়িতে চড়ে অয়ন প্রশ্ন করল, আচ্ছা, মি. বালকিষণ, আপনাকে তো শিক্ষিতই মনে হচ্ছে। বাঘ-দেবতার গল্প আপনি বিশ্বাস করেন?
শত শত বছরের পুরনো একটা কিংবদন্তি, আমার পূর্বপুরুষরাই যা বিশ্বাস করে গেছেন, পুরোপুরি অস্বীকার করি কীভাবে, বলো? তবে কথা হচ্ছে, এই মন্দিরের বাঘ আমাদের ঐতিহ্য… আমাদের জাতীয় সম্পদ। কোনও বিদেশি বদমাশ তাকে চুরি করে নিয়ে আসবে, তা তো মেনে নেয়া যায় না।
তাই এত দূরে ছুটে এসেছেন?
ঠিকই ধরেছ।
একটু পরই কার্নিভালে পৌঁছে গেল ওরা। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে জিমি আর মার্কোর খোঁজ করল অয়ন, কিন্তু পেল না। বালকিষণ গেল বাঘটা দেখতে। দুমিনিট পরই ছুটে এল সে। বলল, বাঘটা নেই?
জর্জ রিডের ট্রেলারের দরজায় টোকা দিল অয়ন। কোনও জবাব নেই। সার্কাস-মালিকও উধাও। চিন্তিত হয়ে পড়ল অয়ন। বাঘটাও পাচার হয়ে গেছে। জিমি কি তা হলে পিছু নিল? লোকজনকে ডেকে তুলবে কি না ভাবল একবার, পরমুহূর্তেই সে-চিন্তা বাতিল করল। রিডের খাস লোক নিশ্চয়ই দুচারজন আছে। তারা বালকিষণসহ ওকে বিপদে ফেলে দিতে পারে।
দুটো গাড়ি এসেছিল, মাটির ওপর ট্র্যাক পরীক্ষা করে বলল বালকিষণ।
টায়ারের দাগ ধরে হাঁটতে শুরু করল অয়ন। হঠাৎ মাটিতে এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখল। জিমির নোটবুকের পাতার মত মনে হচ্ছে। সেটা তুলে ভাজ খুলে পড়ল ও।
অয়ন, কাগজের টুকরো ফেলে গেলাম। পিছু নে।–জিমি।
খুশিতে শিস দিয়ে উঠল ও। বলল, মি, বালকিষণ, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আমার বন্ধু দ্য গ্রেট জিমি পারকার একটা কাজের কাজ করেছে। আসুন।
চার
ট্রাকটা একটানা কতদূর চলেছে, তা বলতে পারবে না জিমি। ও মাঝে মাঝে শুধু দরজা ফাঁক করে একটা করে কাগজে নাম লিখে নিজে ফেলেছে আর প্রার্থনা করেছে, অয়ন যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে। এদিকে মার্কো দারুণ ভয় পেয়ে গেছে। বাঘটা কখন জেগে উঠে হামলা করে বসে, এটা চিন্তা করেই সে আধমরা হয়ে গেছে। আশঙ্কাটা যে জিমির মনেও আসছে না, তা নয়। তবে ট্র্যাঙ্কুইলাইজার বুলেটে ঘুমিয়ে পড়া বাঘের এত তাড়াতাড়ি জেগে ওঠার কথা না, এ-ই যা সান্তনা।
এক সময় থামল ট্রাকটা। ঘড়ঘড় জাতীয় একটা শব্দ শুনে মনে হলো, গ্যারেজের দরজা খোলা হচ্ছে। ভেতরে ঢুকল ট্রাকটা। গ্যারেজের দরজা আবার বন্ধ করে দেয়া হলো। দ্রুত চিন্তা করছে জিমি। এখুনি বাঘটা নিতে আসবে ওরা, ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রাকের ভেতর প্রচুর খড় পড়ে আছে। মার্কোকে নিয়ে সেগুলোর তলায় গা-ঢাকা দিল ও।
একটু পরই কয়েকজন লোক এসে বাঘটাকে ট্রাক থেকে নামাল। দম বন্ধ করে পড়ে রইল ওরা, দেখে ফেললেই শেষ। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। এক টুকরো খড় মার্কোর নাকে খোঁচা দিতেই বিকট শব্দে হাঁচি দিল সে।
ধরা পড়ে গেল ওরা।
.
একটা পুরনো বাগানবাড়ির কাছে শেষ কাগজটা পেল অয়নেরা।
ওখানেই আছে ওরা, অয়ন বলল।
কী করতে চাও এখন? বালকিষণ প্রশ্ন করল।
বাড়িটার চারপাশে কোনও বাউণ্ডারি ওয়াল নেই। সামনে দুটো কার দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু দেখে অয়ন বলল, ভেতরে ঢুকে আগে অবস্থাটা দেখা দরকার। তারপর ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
কীভাবে ঢুকবে?
দরজা বন্ধ থাকলে তো ভেতরে ঢোকার পথ একটাই–জানালা। আপনি এখানে থাকুন। আমি ঘুরে আসি।
উঁহুঁ, তোমাকে একা ছাড়ছি না। আমিও যাব সঙ্গে।
শ্রাগ করল অয়ন।বেশ, চলুন।
.
জিমি লক্ষ করল, সামনে বসা লোকটা বেশ হোমরা-চোমরা গোছের। ওদেরকে বেশ মনোযোগর সঙ্গে জরিপ করল সে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কে তোমরা?
জবাব না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল জিমি।
কী ব্যাপার, কথা বলছ না কেন?
স্যর, পেছন থেকে বলল জজ রিভ। এদের একজন হচ্ছে আমার জোকার। অন্যটা বাইরের ছেলে। বন্ধুসহ সার্কাস দেখতে এসেছিল।
কোথায় সেই বন্ধু?
ইয়ে… তাকে তো পাইনি, এদের সঙ্গে ছিল না।
গর্দভ! সেই বন্ধু যে আমাদের ব্যাপারে কিছু জানে না, সেটা তুমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারো?
না, স্যর, রিড ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
তা ছাড়া সে তার বন্ধুর খোঁজে বের হবে না?
জবাব দিতে পারল না রিড। লোকটা খেপে গেল। বলল, সামান্য একটা কাজ, তাতেও ঘাপলা বাধিয়েছ? এই ছেলেদুটোই বা ট্রাকে উঠল কী করে?
রিড নিশ্চুপ। শেষে মিনমিন করে বলল, সরি, মি. মরগান…
তোমার সরির নিকুচি করি! আমার বাঘ কোথায়?
আছে, স্যর। খাঁচায় এখনও ঢোকানো হয়নি। একটা রুমে রাখা হয়েছে।
গুড! এক সঙ্গীর দিকে ফিরল মরগান। প্যাট, আমি কোনও ঝামেলা জিইয়ে রাখতে চাই না। রিড নামের ওই ছাগল আর বিচ্ছু ছেলেদুটোকে বাঘের সঙ্গে বেঁধে রাখো। জ্ঞান ফিরলেই যেন আমার বাঘ জ্যান্ত কিছু খাবার পায়।
কথাটা শুনেই রিড মরগানের পা জড়িয়ে ধরল। মার্কো তো প্রায় কেঁদেই ফেলল। শক্ত রইল শুধু জিমি। এত সহজে ভেঙে পড়তে রাজি নয় ও।
মন গলল না মরগানের। দুজন লোকসহ জিমি, মার্কো আর রিডকে পাঠিয়ে দিল সে।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু শুনতে পেল অয়ন আর বালকিষণ। দ্রুত বন্ধুদের উদ্ধার করার জন্য একটা প্ল্যান খাড়া করে ফেলল অয়ন।
বন্দিদের নিয়ে দুই গুণ্ডা কিছুদূর এগোতেই আক্রান্ত হলো। বালকিষণের ক্লোরোফর্মের বোতলটা কাজে লাগাল অয়ন। রুমাল তাতে ভিজিয়ে পেছন থেকে গুণ্ডাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও আর বালকিষণ, নাকে মুখে চেপে ধরে অজ্ঞান করে ফেলল।
অয়ন! স্বস্তির শ্বাস ফেলল জিমি। এত দেরি করলি কেন? সঙ্গে
একজন বন্ধু। পরে সব খুলে বলব। এখন অনেক কাজ বাকি।
এই সুযোগে পালাবার চেষ্টা করছিল রিড. খপ করে তার কলার চেপে ধরল মার্কো।
কোথায় যাচ্ছেন, বস্?
ছাড়ো ওকে, মার্কো, অয়ন বলল।
মি. রিড. আপনার সমস্ত কুকীর্তি ফাঁস হয়ে গেছে। যদি বাঁচতে চান, তা হলে আমাদের সাহায্য করুন।
নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই করব, রিড বলল। ওই মরগান আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাকে বাঘের মুখে ফেলে দিতে যাচ্ছিল।
ওকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।
প্ল্যানটা কী, অয়ন? জিমি শুধাল।
সিম্পল। একটা ঝামেলা বাধাতে যাচ্ছি আমি। তোদের কাজ হবে সবগুলো গাড়ির চাকার বাতাস ছেড়ে দেয়া। যাতে কেউ পালাতে না পারে।
কিন্তু পাহারাদার আছে…
মাত্র দুজন, রিড বলল। ওরা এখনও জানে না, দল বদলেছি আমি। কাবু করা কঠিন হবে না।
দারুণ! বলল জিমি। কিন্তু, অয়ন, ঝামেলা বাধাবি কী করে?
একটা ম্যাচের কাঠি, আর কয়েক টুকরো কাগজ দিয়ে।
হেঁয়ালি করিস না!
হেঁয়ালি করছি না, যথাসময়ে দেখতে পাবি। এনিওয়ে, তোদের জন্য পনেরো মিনিট সময় দিচ্ছি। এরপরই খেল দেখাব আমি। যা।
জিমিরা চলে গেল। অন্ধকার একটা রুমের ভেতর আশ্রয় নিল অয়ন। ওর প্ল্যানটা খুবই সাধারণ। বাড়িটাতে ঢুকেই ও লক্ষ করেছে, প্রতিটা রুমের ছাতেই স্মোক ডিটেক্টর লাগানো আছে। তারমানে, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম রয়েছে এ বাড়িতে, যার কানেকশন রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অফিসে। কাগজে আগুন ধরিয়ে স্মোক ডিটেক্টরের সামনে ধোয়া দিলেই হলো, সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের অফিসে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। আগুন নেভাতে কয়েক মিনিটের ভেতরে চলে আসবে তারা, সঙ্গে থাকবে পুলিশ। সবকটা গাড়ি বিকল থাকলে দুবৃত্তরা পালাতেও পারবে না, ধরা পড়বে।
পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল। পকেট থেকে দেশলাই আর নোটবুক বের করল অয়ন। প্ল্যানমত কাজ করল। সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী আর্তনাদ তুলে বেজে উঠল ফায়ার অ্যালার্ম। দুবৃত্তরা চমকে উঠে ছোটাছুটি শুরু করল।
বাঘটাকে সরাও, বাঘটাকে সরাও! চেঁচাতে থাকল মরগান। ওটার যেন কোনও ক্ষতি না হয়।
উত্তেজনায় সে নিজেই ছুটে গেল বন্ধ কামরাটার দিকে। দরজা খুলতেই সে চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। ঘরের ভেতর কোনও বাতি জ্বলছে
না, তবু অদ্ভুত এক আলোয় ভেতরটা আলোকিত। বাঘটা হিংস্র ভঙ্গিতে বসে আছে, লাফ দেবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ট্র্যাঙ্কুইলাইজারে বেহুশ বাঘের এত সহজে জেগে ওঠার কথা নয়, কিন্তু তা-ই ঘটেছে। লাফ দিল বাঘটা!
পিছাতে গিয়ে পড়ে গেল মরগান। তার গায়ের ওপর এসে পড়ল বাঘটা, থাবা ওঠাল আঘাত করার জন্য। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল সে।
না, প্রভু, না! হঠাৎ বালকিষণের কণ্ঠ শোনা গেল। কখন যেন এসে পড়েছে সে। বলল, ক্ষমা করুন, প্রভু। অবোধ সন্তান, অপরাধ বুঝতে পারেনি।
পেছন পেছন অয়ন আর জিমিও এসেছে। বিস্ময়ের সঙ্গে ওরা লক্ষ করল, থাবা ভোলা অবস্থায় থেমে গেছে বাঘটা। মাথা তুলে হাত জোড় করে থাকা পুরোহিতের দিকে একবার তাকাল, তারপর পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল। এই সময় বাইরে শোনা গেল দমকলের ঘন্টা।
ওরা এসে পড়েছে, অয়ন, বালকিষণ বলল।
যাও, দেখো গিয়ে।
দুবৃত্তরা দুএকজন পালিয়েছে, বাকিরা পাংচার হওয়া গাড়িতে বসে ছিল। ওই অবস্থায় কাবু করা গুণ্ডাদের পিস্তল তাক করে ওদের আটকেছে মার্কো আর জর্জ রিড। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আসা পুলিশদের সংক্ষেপে সব খুলে বলল অয়ন আর জিমি, অপরাধীদের তাদের হাতে তুলে দিল।
সবকিছু শেষ হবার পর বাঘটাকে আনতে গেল ওরা। রুমের বাতি জ্বালতেই চমকে গেল অয়ন আর জিমি। ট্র্যাঙ্কুইলাইজারে অজ্ঞান প্রাণীটা আগের মতই মেঝেতে পড়ে আছে, এখনও বেহুশ। তা হলে ওটা মরগানকে হামলা করল কী করে? সেই অদ্ভুত আলোটাই বা কোত্থেকে এসেছিল?
ওদের অবস্থা বুঝতে পেরে হাসল বালকিষণ। বলল, পৃথিবীতে অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা থাকে না। ধরে নাও, এটা তেমনই এক রহস্য।
পাঁচ
জটিল এক রহস্য, বলল জিমি। কী করে সমাধান করলি?
আসলে যতটা জটিল মনে হচ্ছে, ততটা জটিলতা এতে ছিল না, অয়ন জবাব দিল।
তিনদিন পরের ঘটনা। সার্কাসের গ্যালারিতে বসে কথা বলছিল ওরা। এই রহস্যটা সমাধান করে একদিক থেকে দারুণ লাভবান হয়েছে দুবন্ধু। বিনে পয়সায় যতদিন খুশি সার্কাস দেখতে পারছে।
কিন্তু প্রথম থেকেই বাঘটা নিয়ে দুই মেতে ছিলি কেন? জিমি জানতে চাইল।
দেখ, গোয়েন্দাগিরিতে পশুপাখির আচরণকে সবসময়ই খুব গুরুত্ব দিয়ে চলতে হয়। মানুষ প্রতিনিয়তই তার স্বভাব পাল্টে কাজ করে, কিন্তু পশুপাখি তা করে না। সুতরাং এদের অস্বাভাবিক আচরণ সবসময়ই ভিন্ন কিছু নির্দেশ করে।
বাঘটার আচরণ তাই প্রথমেই আমার মনে সন্দেহের জন্ম দিল। হারকিউলিস মহারাজার বহু পুরনো ট্রেনার, দুজনের ভেতর সখ্যও প্রচণ্ড। তা হলে কেন বাঘটা তাকে আক্রমণ করে জখম করবে? দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, বাঘটা নিজের নিরাপত্তার জন্য পরিচিত লোককেও আঘাত করেছে। দুই, বাঘটা আদৌ মহারাজা নয়। আসলে কিন্তু দুটোই সঠিক। বাঘটা মহারাজা ছিল না, তার ওপর হারকিউলিস ছিল ওটার শত্রু।
লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি গাইড বুকে দেখলাম, পোর্ট অ্যালামি থেকে ট্রেনটন মাত্র দুই মাইল দূরে অবস্থিত। সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাটা আমার মাথায় টোকা দিয়ে গেল, এটা সেই চোরাই বাঘটা নয় তো? ভেবে দেখলাম, হ্যাঁ, তাই হবে। আসল মহারাজাকে কোকো বিচেই রেখে আসে রিড। চারদিক বন্ধ বাক্সে আসলে কোনও বাঘই ছিল না। ট্রেনটনে এসেই আবার সেটা উদয় হলো। সার্কাসের বাঘ… পাচার করার জন্য এরচেয়ে ভাল কাভার আর কী-ই বা হতে পারে?
কিন্তু মরগানের প্রস্তাবে রিড রাজি হলো কেন?লস অ্যাঞ্জেলেসে এসে যে বাঘটা ওর হাতে তুলে দিল, বাঘ উধাও হবার ঘটনাটা কীভাবে সামাল দিত সে?
মরগান বিরাট ধনী, তাই টাকার লোভে রাজি হয়েছিল রিড। তবে তাকে বিশ্বাস করেনি মরগান। সবসময় নিজের লোকজনকে সার্কাসের কাছাকাছি রেখেছে, যাতে বাঘটা পাচার হয়ে না যায়। এনিওয়ে, রিডের জন্য সবকিছু সামাল দেয়া তেমন কঠিন ছিল না। সার্কাসের প্রাণীরা প্রায়ই খাঁচা থেকে সুযোগ পেলে পালায়। এটাও তেমনই একটা ঘটনা হিসেবে দেখানো হতো। এই ফাঁকে আসল মহারাজাকে লস অ্যাঞ্জেলেসে নিয়ে আসা হতো, তাকে উদ্ধার করা হতো কোনও পার্ক-টার্ক থেকে। কাজেই পুরো ব্যাপারটা আর অস্বাভাবিক থাকত না।
রিড তা হলে এখন রাজসাক্ষী হচ্ছে?
হ্যাঁ, শাস্তির মাত্রা কমানোর তো ওই একটাই উপায়!
ভাল।
তবে তুই কি জানিস, জিমি, পরিবেশ বিষয়ক একটা অপরাধের সমাধান করে আমরা প্ল্যানেটিয়ার হয়ে গেছি?
কী রকম?
একটি বন্য প্রাণীর অবৈধ পাচার রোধ করেছি আমরা।
তাও ভাল, নিজেকে ধর্মবীর বলছিস না।
ধর্মবীর! অয়ন অবাক! তা হতে যাব কেন?
ধর্মীয় অপরাধের সমাধান করলাম যে!
সেটা আবার কী রকম?
জনৈক দেবতা পাচার হয়ে যাচ্ছিলেন, তাকে রক্ষা করলাম…
জিমি! চোখ রাঙাল অয়ন। মস্করা করছিস? খাবি গাঁট্টা!
তুইও গাঁট্টা খাবি?
দুজনে হাতাহাতি শুরু করল। হঠাৎ থেমে গেল ওরা। রিঙের ভেতরে দুজন জোকার ঢুকে ওদের নকল করছে, হাতাহাতি দেখাচ্ছে। তাই দেখে দর্শকেরা হেসে লুটোপুটি!
মার্কো! হুঙ্কার দিয়ে উঠল দুবন্ধু। তারপরই গ্যালারি টপকে দুই জোকারকে ধাওয়া করল। দর্শকেরা আরও জোরে হেসে উঠল।
ততক্ষণে পরের খেলা শুরু হয়ে গেছে।