৭
সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সমস্ত শব্দ যেন অন্তর্হিত হল। সহস্র সহস্র মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি মাইকের দিকে তাকিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিলেন। বাবা যেই কথা বলতে ঠোঁট খুললেন, অমনি তাঁর হাত ছিটকে উঠল ওপরে। শরীরটা যেন প্রচণ্ড আলোড়ন খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিচে। শ্রোতা দর্শকরা এখন ওঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাঁরা নির্বাক। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগে বাবার মাথা থেকে রক্ত ছিটকে বেরোতে লক্ষ করেছেন অনেকে। চেতনা ফিরে আসতেই চিৎকার এবং কান্না আকাশ ফাটাল। বড় মহারাজ নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এইসময় সেবিকারা ভেতর থেকে ছুটে এসে বাবার শরীর আঁকড়ে ধরতেই বড় মহারাজ চেতনা ফিরে পেলেন। আকুল স্বরে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘ডাক্তার, ডাক্তার।’ এই চিৎকার মাইক গ্রহণ করে চারধারে ছড়িয়ে দিল। বড় মহারাজ বাবার মাথায় হাত দিয়েই বুঝলেন কোন সম্ভাবনা নেই বেঁচে থাকার। সমস্ত শরীরে কাঁপন এল তাঁর। সময় হয়ে গেল, সময় এসে গেল!
ভেতরে টিভি চলছিল। ম্যানেজার বললেন, ‘আপনাদের দেখে খুব ভাল লাগছে। কিন্তু এই অসময়ে কি করে এলেন, জানতে আগ্রহ হচ্ছে। এখন এখানকার পরিস্থিতি এমন যে, কেউ সন্ধের পর বের হয় না।’
সুধাময় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য আপনি আমাদের গুরুভাই। তাই আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলার কোন কারণ দেখছি না।’
ম্যানেজার একটু ঝুঁকে বসতেই টিভিতে দিল্লী থেকে খবর আরম্ভ হল। সংবাদপাঠক প্রথমেই বললেন, ‘আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজ কলকাতায় এক ভক্তসমাগমে বক্তৃতা করার সময় পাঁচ কোটি শিষ্যের পরমপূজ্য গুরু যিনি বাবা নামেই পরিচিত ছিলেন, অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হন। আততায়ীরা কাছাকাছি কোন বাড়ির ছাদ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। সংবাদ প্রচারিত হওয়ামাত্র কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভক্তদের বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। রাজ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ সন্ধ্যায় কলকাতা রওনা হয়েছেন। বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী বড় মহারাজ অল্পের জন্য রক্ষা পান। তিনি এই ঘটনাটিকে ধর্মের ওপর অধর্মের অত্যাচারের বর্বর নিদর্শন বলে ঘোষণা করেছেন।’
তিনজন মানুষ আচমকা বাক্শক্তিরহিত হয়ে গেলেন। ভেতরের ঘরে সংবাদপাঠক তখনও এই খবর পড়ে যাচ্ছেন। ইউনিসের চেতনা প্রথমে স্বচ্ছ হল, ‘কি বলল? বাবা?’
সুধাময় কথা খুঁজে পেলেন না। তাঁর মুখ থেকে একটা তীব্র চিৎকার ছিটকে এল। দু হাতে মুখ ঢেকে তিনি কেঁদে উঠলেন। আর ম্যানেজার দৌড়ে চলে গেলেন ভেতরের ঘরে টিভির উদ্দেশে। ইউনিস উঠে এসে সুধাময়কে ঝাঁকাতে লাগল, ‘খতম কর দিয়া? বাবা মর গিয়া?’
সুধাময় মুখ থেকে হাত সরাচ্ছিলেন না। ম্যানেজার আবার ফিরে গেলেন বাইরের ঘরে। ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বাবা ইজ কিলড্। কিন্তু কে বাবাকে মারবে? কেন মারবে? ওঃ।’
সুধাময় তখনও আবেগে থরথর করে কাঁপছিলেন, ‘যীশুখ্রীস্টকেও তো মানুষই মেরেছে। যাদের স্বার্থ ছিল, তারাই বাবাকে মেরেছে। এখন কি হবে?’ ম্যানেজার বললেন, ‘বড় মহারাজ বাবাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন।’
‘কেন?’
সুধাময় মুখ থেকে হাত সরালেন।
‘সেসব কিছু বলল না খবরে।’
সুধাময় উঠে দাঁড়ালেন, ‘ইউনিস, আমাদের এখনই ছোটে মহারাজের কাছে যেতে হবে।’
‘ছোটে মহারাজ?’ ম্যানেজার অবাক হলেন।
‘হ্যাঁ। আপনারা যাঁকে নির্মল বলে জানেন, তিনিই ছোটে মহারাজ।’
‘সেকি?’
‘হ্যাঁ। আমাদের একটা গাড়ি দিতে পারেন?’
‘নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু এত রাত্রে রাস্তায় গাড়ি চালানো খুব রিস্কি।’
‘ওসব ভেবে কোন লাভ নেই।’
‘চলুন। আমিই গাড়ি বের করছি।’
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটা জিপ তীব্র গতিতে চা-বাগান থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে পড়ল। ম্যানেজার গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কেউ কোন কথা বলছিল না। হঠাৎ সুধাময় বললেন, ‘আপনি বাবার শিষ্য, এটা যেমন বিস্ময়ের বিষয় তেমনি আপনার ওখানে মৃত্যুর ঘটনাটা শোনাটাও অদ্ভুত ব্যাপার। যেন বাবার ইচ্ছেতেই এগুলো ঘটল।’
‘যিনি এত জানতেন তিনি নিজের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারেননি?’ ম্যানেজার প্রশ্ন করলেন, এই প্রশ্নের কেউ কোন উত্তর দিল না।
সবে খাওয়া শেষ হয়েছে। লাবণ্য টয়লেটে গিয়েছে। এই সময় ওঁরা ঘরে ঢুকলেন ঝড়ের মত। নির্মল তখন জল খাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার? যাননি?’
সুধাময় দুটো হাত জোড় করে কেঁদে উঠলেন। অন্যেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
‘কি হয়েছে?’ নির্মল এগিয়ে এল।
ম্যানেজার বললেন, ‘বাবা ইজ মার্ডারড। আজ বিকেলে।’
নির্মল বড় বড় চোখে লোকটিকে দেখল। তার ঠোঁট নড়ল, ‘মার্ডারড?’
‘ইয়েস।’ ম্যানেজার বললেন, ‘সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে গুলিতে মারা যেতে হয়েছে তাঁকে।’
নির্মল চোখ বন্ধ করল। মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা জানলেন কি করে?’
‘টিভিতে বলল।’ ইউনিস জবাব দিল।
‘কে মেরেছে?’
ম্যানেজার বললেন, ‘ধরা পড়েনি কেউ। ‘
এইসময় লাবণ্য ঘরে ফিরল। এদের দেখে সে অবাক। জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে?’
নির্মল ওর দিকে ফিরল, ‘এঁরা টিভিতে শুনেছেন বাবা নিহত হয়েছেন আজ।’
‘সেকি?’ লাবণ্য অবাক হল।
সুধাময় এবার এগিয়ে গেলেন, ‘ছোটে মহারাজ, সময় হয়েছে। এবার আপনি ফিরে চলুন।’
‘তার মানে? ওঁর মৃত্যুর সঙ্গে আমার ফিরে যাওয়ার কি সম্পর্ক?’
‘আপনি না গেলে সমস্ত কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।’
‘তাতে আমার কি? ধর্মের নামে যে এক্সপ্লয়টেশন চলছিল, তা আরও কিছুদিন চলবে। এতে আমার কি ভূমিকা থাকতেপারে?’
‘পারে।’ সুধাময় বললেন, ‘এবং আমার বিশ্বাস আছে। পাঁচ কোটি মানুষের আনুগত্য পেলে আপনি এইভাবে কৃচ্ছসাধন করে যা করতে চাইছেন তা অনেক সহজেই করতে পারবেন। দশবছর ধরে মানুষের উপকার করার পরও তারা আপনাকে ঠকাতে পারে, আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, কিন্তু পাঁচ কোটি মানুষ যদি আপনাকে গুরুর আসনে বসায় তাহলে তাদের আনুগত্য সবসময় পাবেন। এদেশে কখনই ধর্মগুরু এবং রাজনৈতিক নেতা, এক ব্যক্তি হয়নি। সেই সুযোগ আপনি হাতছাড়া করবেন না।’
নির্মল চমকে উঠল। এইরকম একটা ভাবনা তার মাথাতেও এসেছিল। মন আর শরীরের চিকিৎসা একই সঙ্গে করার সুযোগ এসেছে। বড় মহারাজ চাইবেন ক্ষমতা দখল করতে। সিনিওরিটির জোরে তিনি তা চাইতেই পারেন। কিন্তু!
সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি সেখানে গেলেই যে ক্ষমতা পাব তার কোন স্থিরতা নেই। আমার ওপরে দুই দাদা আছেন।’
সুধাময় হাসতে চেষ্টা করলেন, ‘নিশ্চয়ই। কিন্তু ঘটনাস্থলে উপস্থিত না হলে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করা যায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে না গেলে জয়ী হবার সম্ভাবনাই বা আসবে কি করে? আমরা কেউ জানি না, বাবা তাঁর উইলে কি কথা লিখে গেছেন!’
নির্মল চোখ বন্ধ করল। তার শরীর শিহরিত হল। শরীরে কাঁটা ফুটল। গাঢ় স্বরে সে বলল, ‘বাবা আমার জন্মদাতা। আর কিছু না হোক তাঁর পারলৌকিক কাজের সময় আমার উপস্থিতি মানুষ হিসেবে কর্তব্য।’
‘তাহলে এখনই চলুন। এখন রাত বেশি নয়। এখনই রওনা হয়ে গেলে আমরা কাল এগারটার মধ্যে পৌঁছে যাব কলকাতায়। আর বাবার মৃত শরীর যদি আশ্রমে নিয়ে আসা হয় তাহলে তা পথেই পড়বে।’
নির্মল চটপট জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে গেল। লাবণ্য তাকে সাহায্য করল। এবং এইসময় সুধাময় বললেন, ‘অপরাধ না নেন তো বলি। আপনি একা আমাদের সঙ্গে চলুন। ওঁকে সঙ্গে নেবেন না।’
নির্মল তীব্রস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
সুধাময় মাথা নত করলেন, ‘আপনি বিচক্ষণ। আশ্রমের নিয়ম তো আপনার অজানা নয়। আমি যতদূর জানি, এখনও মহারাজ উপাধি আপনি পাননি।’
‘আমি আপনার কথা বুঝতে চাইছি। লাবণা সঙ্গে থাকলে অসুবিধে হবে কেন?’
‘ওঁকে সঙ্গে দেখলে শত্রুদের হাত শক্ত হবে। তারা আপনার বদনাম করবে। মহারাজ হবার আগে কোনরকম স্ত্রীসংসর্গ রাখা আশ্রমের আইনবিরুদ্ধ। এমনিতেই আপনার চলে আসার সময় সার্টপ্যান্ট পরা এক মহিলা সঙ্গে ছিল বলে গল্প চালু আছে। কানে শোনা এক ব্যাপার আর চোখে দ্যাখা অন্য জিনিস। ওঁকে সঙ্গে নিয়ে গেলে আপনার যাওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। আপনি বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা হঠকারিতা করেন না।’
সুধাময় খুব শান্ত স্বরে কথাগুলো বুঝিয়ে বললেন।
নির্মল একমুহূর্ত চুপ করে থাকল। সুধাময়ের কথাগুলো কঠোর হলেও সত্য। পাঁচ কোটি মানুষের শ্রদ্ধার্জনের জন্যেই লাবণ্যকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া চলবে না। কিন্তু সমস্যা মিটে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই কিছু করার স্বাধীনতা থাকবে তার। সে বলল, ‘আপনারা পাঁচ মিনিটের জন্যে যদি বাইরে অপেক্ষা করেন তাহলে খুশি হব। লাবণ্যর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
তিনটে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। নির্মল লাবণ্যর দিকে তাকাল, ‘সমস্ত ঘটনা তুমি শুনেছ। এই পরিস্থিতিতে আমার কি করা উচিত বলে তোমার মনে হয়?’
লাবণ্য হাসল, ‘সিদ্ধান্ত তো তুমি নিয়েই ফেলেছ।’
‘হ্যাঁ। তবু, এখনও সময় রয়েছে।’
‘তুমি কেন ফিরে যাচ্ছ তা তোমার কাছে কি স্পষ্ট? ‘
‘হ্যাঁ। পাঁচ কোটি মানুষের আনুগত্য পেলে অনেক কাজ করা সহজ হয়ে যায়।’
‘শুনেছি সিংহাসনে বসলেই রাজার মত ব্যবহার করতে হয়। সেক্ষেত্রে—।’
‘সিংহাসন ছেড়ে যে একবার সরে আসে সে সিংহাসনে বসলেও নিজেকে সমর্পণ করে না! লাবণ্য, আমি চাই এই মানুষগুলোকে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের হাত থেকে বাঁচাতে। তুমি কি আমার জন্যে অপেক্ষা করবে?’
নীরবে মাথা নাড়ল লাবণ্য, ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু, কিন্তু তুমি যোগাযোগ করবে কি করে?’
‘আমি করে নেব। তুমি চিন্তা করো না।’
নির্মল তবু দাঁড়িয়ে রইল। সে ঠিক জানে না তাকে কোন অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে রাখছিল কিনা। সে বলল, ‘এখন রাত। তুমি আমাদের সঙ্গে চল। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যেতে নিশ্চয়ই কোন অসুবিধে হবে না।’
‘আমার হবে। এত রাত্রে সেখানে দরজা খোলানো মুস্কিল হবে। তাছাড়া এখন আমি ভাবতে পারব না যে রাত বলেই তুমি আমাকে সঙ্গে নিচ্ছ। দ্বিধা করো না। আমরা যা করতে যাচ্ছিলাম তা তুমি যদি আরও সহজে করতে পার তাহলে তার চেয়ে খুশির ব্যাপার আর কি হতে পারে?’
‘তুমি এইঘরে একা থাকতে পারবে?’
‘একটাই তো রাত। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’
নির্মল তবু ইতস্তত করছিল। লাবণ্য মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘যাও, দাঁড়িয়ে থেকো না।’
দরজায় পৌঁছে আর একবার পেছন ফিরে তাকাল নির্মল। শূন্য ঘরে লাবণ্য তক্তাপোষের ওপর দুহাতে পেছন দিকে শরীরের ভর করে শূন্যে চেয়ে আছে। হঠাৎ যেন বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল নির্মলের। এই সময় সুধাময় চাপা গলায় ডাকলেন, ‘ছোটে মহারাজ!’
নির্মল দ্রুত জিপের দিকে পা চালাল।
মধ্যরাত্রে শিলিগুড়িতে পৌঁছে ম্যানেজার একজন সাপ্লায়ারকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন, পথে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। নির্মল ম্যানেজারের পাশে গম্ভীর মুখে বসেছিল। এই লোকটা এতদিন তার অনেক কাজই অসন্তোষের চোখে দেখেছে। চা কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে চা বাগানে ম্যানেজার একজন ব্যুরোক্র্যাট। সেই লোক বাবার শিষ্যত্ব নিয়েছিল কি কারণে, তা তিনিই জানেন। হয়তো ওঁর কোম্পানির মালিকদের কেউ বাবার শিষ্য। চাকরিতে উন্নতির প্রয়োজনে তাঁকে শিষ্যত্ব নিতে হয়েছে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল তিনিই জিপ চালিয়ে কলকাতায় নিয়ে যাবেন। শিলিগুড়িতে আসার পথে তাঁর মনে পড়ল কোন অনুমতি ছাড়া তিনি চা-বাগান ছেড়ে বাইরে যেতে পারেন না। সেই কারণেই সাপ্লায়ারকে ডেকে মধ্যরাতে আর একটা গাড়ির ব্যবস্থা করলেন ভদ্রলোক। চা-বাগানের সাপ্লায়াররা ম্যানেজারকে খুশি করতে পারে না, এমন কাজ নেই।
শিলিগুড়িতেই বিদায় নিলেন ম্যানেজার। রাত সেখানেই কাটিয়ে ভোরে ফিরবেন। জি এন এল এফের ভয়ে মাঝরাতে একা গাড়ি চালাবার সাহস নেই। বিদায় নেবার আগে হঠাৎ তিনি প্রায় নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন নির্মলকে। ছিটকে সরে গেল নির্মল। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার বললেন, ‘হয়তো একসময় অনেক অন্যায় করেছি কিন্তু তা না জনেই ঘটেছে। আপনার কৃপা থেকে যেন বঞ্চিত না হই।’
তিনজন যাত্রী নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে রওনা হল গাড়ি। সুধাময় হিসাব করছিলেন যদি পথে কোন বিভ্রাট না হয়, তাহলে কলকাতায় পৌঁছাতে বারোটা বেজে যাবে। তবে ভোর ছটা নাগাদ পথেই আশ্রম পড়বে। সেখানে খোঁজ নেওয়া দরকার। এমনও হতে পারে বাবাকে সবাই সকালে আশ্রমে ফিরিয়ে আনছে।
নির্মল কোন কথা বলছিল না। তার মুখ গম্ভীর, ঠোঁট শক্ত। লাবণ্যর মুখ মনে পড়ছিল শিলিগুড়ি পর্যন্ত। ওরা একসঙ্গে উত্তর বাংলায় এসেছিল। আলাদা ছিল কিন্তু দূরত্বে বেশি নয়। যদি তাকে ফিরতে না হয় এখানে তাহলে লাবণ্যকে দশ বছর এখানে একাই থাকতে হবে। বুকের ভেতর আরও ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। লাবণ্যকে সে বন্ধুর মত নিয়েছিল। কিন্তু মনের মধ্যে আর একটা মন যে বড় হচ্ছিল চুপচাপ, তাকে আজ টেনে সামনে নিয়ে আসছিল লাবণ্য!
কিন্তু এসব চিন্তা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল যেই ম্যানেজার তাকে প্রণাম করলেন। অত বয়স্ক একটি মানুষ নিশ্চয়ই স্বার্থচিন্তা করে তাকে প্রণাম করেছে। তা সত্ত্বেও কেন নিজেকে মূল্যবান মনে হচ্ছে। লোকটা তার কাছে কৃপা চাইল। মানুষ কৃপা চায় ক্ষমতাবানের কাছে। তার তো কোন ক্ষমতাই নেই। সুধাময় যা বলছেন তা সম্ভব না হবার সম্ভাবনাই বেশি। সে যাচ্ছে শুধুই একটা সুযোগ নেওয়ার জন্যে। বাবা যা নির্দেশ দিয়ে গেছেন তাই মান্য করবে সবাই। যতদূর মনে পড়ছে দশজন মহারাজ সিদ্ধান্ত নেবেন যদি বাবার কিছু ঘটে, এইরকম একটা আভাস পেয়েছিল সে একসময়।
বাবা চলে গেলেন। পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটিকে গুলি করে হত্যা করা হল। তিনু মহারাজ তাকে প্রায়ই সতর্ক করতেন বাবার শত্রুদের সম্পর্কে। কলেজ থেকে বেরিয়ে একা যেন কোথাও না যায় সে। সনাতননাথ, আনন্দ সরস্বতী প্রভৃতি নামগুলো সেইসময় শুনেছে সে। শুধু ঈর্ষা থেকেই গুরু পরিবারগুলো কেউ কারো ভাল দেখতে পারে না। কিন্তু তাই বলে বাবা খুন হবেন ওঁদের হাতে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল নির্মলের। এবং তখনই তার মনে হল, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোন রাজনীতির খেলা নেই তো? ধর্ম চিরকাল এদেশে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। কিন্তু রাজনীতি সেটা মেনে নিয়েছে বাধ্য হয়ে। আর যে বাধ্য হয় তার ভেতরে একটা জ্বালা থাকেই। সেই জ্বালা থেকেই প্রতিশোধ কিংবা কাঁটা সরিয়ে দেবার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। সমগোত্রীয় অন্যান্য ধর্ম-শরিকরা হয়তো এ ব্যাপারে রাজনীতিকে মদত দিতে পারে। নির্মলের চোয়াল শক্ত হল।
সকাল সাতটায় গাড়ি পৌঁছে গেল আশ্রমে। নির্মলের মনে হল সে শ্মশানপুরীতে ঢুকছে। কোথাও কোন মানুষ নেই। কিন্তু দূর থেকে আনন্দভবনের দিকে তাকিয়ে সে গাড়ি থামাতে বলল। হাজার হাজার মানুষ নীরবে বসে আছে উপাসনামন্দিরের সামনের মাঠে। কেউ কোন কথা বলছে না। বসার ভঙ্গী এতদূর থেকেও যা বোঝা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট ওরা ওই অবস্থায় রয়েছে অনেকক্ষণ।
সুধাময় বললেন, ‘ছোটে মহারাজ, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে মেজ মহারাজের কাছে যাওয়া উচিত।’
নির্মল বলল, ‘আমার মনে হয় না কালকের ঘটনার পর তিনি আশ্রমে আছেন। চলুন।’
গাড়ি ঘুরিয়ে মেজ মহারাজের ভবনের কাছে নিয়ে আসা হল। সেখানে তিনজন সেবক গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিল। নির্মলকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে তারা সতর্ক হল। যেহেতু ছোটে মহারাজ সম্পর্কে কোন নির্দেশ নেই তাই কি করবে বুঝতে পারছিল না। দ্রুত ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে সুধাময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেজ মহারাজ কি কলকাতায়?’
একজন সেবক জবাব দিল, ‘কাল খবর পেয়েই রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। আজ ভোরে আবার ফিরে এসেছেন। ভবনেই আছেন।’
‘বাবার পারলৌকিক কাজ কোথায় হবে?’
‘আশ্রমেই। বারোটা দশ মিনিটে তাঁকে নিয়ে আসবে হেলিকপ্টার।’
সুধাময় ছুটে এলেন ছোটে মহারাজের কাছে, ‘বাবাকে এখানেই আনা হবে বারোটার সময়। আমাদের আর কলকাতায় যেতে হবে না। খানিকটা সময় পাওয়া যাচ্ছে। আপনি মেজ মহারাজের সঙ্গে দেখা করুন। তিনি আজ ভোরেই ফিরে এসেছেন কলকাতা থেকে।’
‘কেন?’ ছোটে মহারাজ চোখ তুললেন।
‘অপরাধ নেবেন না। আমি জানি না আপনি দীক্ষিত কিনা। যদি না হন, তাহলে বাবার কাজ হয়ে যাওয়ার আগে আপনার দীক্ষা নেওয়া উচিত। আপনার উদ্দেশ্য সফল করতে ব্যাপারটা সাহায্য করবে। বাবার আশীর্বাদ থাকবে আপনার ওপর।’
‘বাবার আশীর্বাদ। আমি দীক্ষায় বিশ্বাস করি না।’
‘ছোট মুখে বড় কথা বলছি। যুদ্ধে কখনও কখনও অপছন্দের কাজ করতে হয় কৌশলের কারণে। দীক্ষা হল একটা পথে হাঁটার স্বীকৃতি।’ সুধাময় বিনীতস্বরে বললেন।
ছোটে মহারাজ মাথা নেড়ে হাঁটতে লাগলেন। একজন সেবক তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। একটু নার্ভাস বোধ করছিলেন তিনি।
বাবার ছবির সামনে পদ্মাসনে বসে চোখ বন্ধ করে ছিলেন মেজ মহারাজ। সেবককে চলে যেতে ইঙ্গিত করে ছোটে মহারাজ সেই ঘরে ঢুকলেন। তাঁর পায়ের আওয়াজে চোখ খুললেন মেজ মহারাজ। প্রথমে বিস্ময় পরে হাসি ফুটে উঠল মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই যেন সেটা নিভে গেল, ‘সেই এলে কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেললে।’
ছোট মহারাজ বাবার ছবির দিকে তাকালেন। যেন শান্ত মুখে তাঁকে লক্ষ করছেন বাবা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছিল?’
‘কলকাতার বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে যাওয়ার মুখে কেউ বিপরীত দিকের বাড়ির ছাদে বসে তাঁকে গুলি করে।’
‘কে?’
‘জানা যায়নি। কেউ ধরা পড়েনি।’
‘কাউকে সন্দেহ করেন?’
‘না। কারণ মিথ্যে বলা হবে। ওঁকে আজ দুপুরে এখানে আনা হবে। বড় মহারাজ সেই থেকে সঙ্গে আছেন। আমি কিছু ভাবতে পারছি না ছোটে। এইভাবে পিতৃহীন হব!’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন মেজ মহারাজ। ‘এখন এই আশ্রমের কি হবে?’
‘আপনি শক্ত হন।’
চোখ মুছলেন মেজ মহারাজ, ‘তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তোমার জন্যে তিনি কিরকম উতলা হয়েছিলেন তা আমিই জানি। কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’
‘মানুষ দেখতে।’
‘অর্থাৎ?’
‘দেশের মানুষ কি অবস্থায় আছে, তা দেখতে চেয়েছিলাম আমি।’
‘আমাদের কাউকে না জানিয়ে, চোরের মত পালিয়ে গিয়ে?’
‘আপনি এমন ব্যাখ্যা করতে পারেন, কিন্তু আমার প্রয়োজন ছিল।’ ছোটে মহারাজ গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী।’
‘কি ব্যাপার?’ বিস্ময় ফুটে উঠল মেজ মহারাজের মুখে।
‘আমাকে দীক্ষা দিন। আজ এবং এখনই।’
‘না! অসম্ভব। এখন দীক্ষা হতে পারে না। এখন আমাদের কালাশৌচ চলছে।’
‘কালাশৌচ? এই সময়ে মানুষ আহার গ্রহণ করে না? প্রাকৃতিক কাজগুলো বন্ধ রাখে? দীক্ষা মানে নিজের পথ খুঁজে পাওয়া। কালাশৌচ বলে আপনি কি আমাকে পথ দেখাবেন না! ওই ছবির দিকে তাকিয়ে বলুন, না।’ ছোটে মহারাজের গলা চড়ছিল।
‘তুমি, তুমি আমার সঙ্গে এই গলায় কথা বলছ?’
‘আমি আপনাকে অশ্রদ্ধা করছি না। আমাকে দীক্ষিত করা উচিত, আপনার নিজের স্বার্থে।’
‘তার মানে?’
‘আজ বাবা নেই। আশ্রমের দায়িত্ব নিশ্চয়ই নিতে চাইবেন বড় মহারাজ। তিনিই শাসন করবেন পাঁচ কোটি মানুষকে। আমি জানি, তাঁর সঙ্গে আপনি সব ব্যাপারে একমত নন।’
‘না। বাবা উইল করে গেছেন কে পরবর্তী উত্তরাধিকারী হবে। গতকাল সকালে তিনি উইল পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আর সময় পাননি। বড় মহারাজ যে ক্ষমতা পাবেনই তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তিনি পেতে পারেন, আমি পারি, আবার দশজন মহারাজের যে কেউ পেতে পারেন।’
‘ভাল। কালাশৌচের অজুহাত দিচ্ছেন। কোন পরিবারের কেউ মারা যাওয়ার খানিকবাদে যদি কোন শিশু জন্মগ্রহণ করে তাহলে কি তার মুখে মধু দেওয়া হয় না?’
‘হয়।’ মাথা নাড়লেন মেজ মহারাজ।
‘তাহলে আমাকে দীক্ষা দিতে আপনার বাধা কোথায়?’
‘তুমি পবিত্র নও বলে অভিযোগ উঠেছে।’
‘পবিত্র নই মানে?’
‘তোমার সঙ্গে কোন নারীর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।’
‘প্ৰমাণ?’
‘না, কোন প্রমাণ নেই।’
‘তাহলে? আমার সম্পর্কে কুৎসা ছড়িয়ে আপনার কি লাভ?’
‘আমি ছড়াইনি। বড় মহারাজ কলকাতায় তোমার ঘরে নারীদের ব্যবহার্য জিনিস পেয়েছেন।’
‘বাজে কথা। তিনি বানিয়েছেন ঘটনাটা।’
‘তুমি সত্য বলছ ছোটে?’
‘আমি জ্ঞানত মিথ্যে বলি না। আজ পর্যন্ত কোন নারীকে আমি স্পর্শ করিনি শুধু আমার মা ছাড়া।’
‘বেশ। তোমার দাবী আমি মেনে নিচ্ছি। তোমার মন্দ ভাগ্য। পরম পূজনীয় বাবার কাছ থেকে দীক্ষা নেবার অধিকার ছিল তোমার। পেলে না।’
‘মানুষের মৃত্যুতেই তার সব শেষ হয়ে যায় না। আমি আপনার মাধ্যমে তাঁর কাছে দীক্ষা নিচ্ছি। আপনি আয়োজন করুন।’
.
ঠিক বারোটা দশে মৃতদেহ নিয়ে হেলিকপ্টার নামল আশ্রমের হেলিপ্যাডে। সমস্ত মহারাজদের নিয়ে মেজ মহারাজ দাঁড়িয়েছিলেন সামনে। পেছনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। মৃতশরীর নামানো মাত্র কান্নার রোল উঠল। বড় মহারাজকে অত্যন্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তিনি, মেজ মহারাজ এবং অন্যান্যেরা সুদৃশ্য খাটে বাবাকে শুইয়ে ফুলমালায় সাজাতে লাগলেন। হঠাৎ বড় মহারাজ যেন ভূত দেখলেন, ‘তুমি? এখানে?’
ছোটে মহারাজ বাবার নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, ‘যে অধিকারে আপনি এখানে, সেই অধিকারেই আমি এসেছি!’
‘তুমি কার সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলছ জানো?’
‘জানি। বাবার এক শিষ্যের সঙ্গে।’ ছোটে মহারাজ বাবার পাশে দাঁড়ালেন।
‘না। তুমি স্পর্শ করবে না। দীক্ষিত মানুষেরাই শুধু ওঁকে স্পর্শ করতে পারেন।’
‘নিয়মটা যদি তাই হয় তাহলে আমি বেনিয়ম করছি না। আমি দীক্ষিত।’
‘কার কাছে দীক্ষা নিয়েছ তুমি! পরিবারের গুরুজনদের বাইরে কারো কাছে দীক্ষা নিলে সেটা অবৈধ হবে।’
‘এটাও অযৌক্তিক। তবু আমি পরিবারের গুরুজনের কাছেই দীক্ষিত হয়েছি। মেজ মহারাজ আমাকে দীক্ষা দিয়েছেন। দোহাই, একটু সংযত হন। বাবা এখনও সামনে রয়েছেন।’ মেজ মহারাজ তখন বাবার খাট কাঁধে নিচ্ছিলেন অন্য মহারাজদের সঙ্গে। ছোটে মহারাজ এগিয়ে গিয়ে কাঁধ দিলেন। বড় মহারাজ স্তম্ভিত।
বাবার শরীর সমস্ত দুপুর উপাসনামন্দিরের সামনে সযত্নে শায়িত রইল। হাজার হাজার ভক্ত লাইন দিয়ে এসে শেষ দেখা দেখে যাচ্ছেন। চিৎকার কান্নায় চারধার ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ছোটে মহারাজ চুপচাপ বাবার পায়ের কাছে বসে ছিলেন। বড় মহারাজ কোন কথা বলছিলেন না। মেজ মহারাজই ব্যস্ততার সঙ্গে পরবর্তী কাজগুলো তদারকি করছিলেন। এইসময় ভিড় ঠেলে কোনরকমে সুধাময় ছোটে মহারাজের পাশে এসে প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ইউনিস একটি লোকের সাক্ষাৎ পেয়েছে যার সঙ্গে আপনি কথা বললে সুবিধে হবে।’
ছোটে মহারাজ উঠলেন। সেবকরা তাঁকে রাস্তা করে দিল। বড় মহারাজ তাঁর যাওয়াটা লক্ষ করলেন, কিছু বললেন না। জনতার মধ্যে দিয়ে বাইরে আসতে অনেক সময় লাগল। বটগাছতলায় একটি বৃদ্ধ তখন মুখে দুই হাত রেখে বসে। পাশে ইউনিস দাঁড়িয়ে। কয়েকজন উৎসুক মানুষ তাদের দেখছে। ছোটে মহারাজ পৌঁছনো মাত্র ইউনিস বলল, ‘এই বুড়ো বাবার কাছে যেতে চাইছিল। যেতে না দেওয়ায় গালাগাল করছে।’
‘কেন যেতে দেওয়া হয়নি? ভক্ত শিষ্যদের বাবাকে অন্তিমদর্শনের অধিকার আছে।’
ইউনিস মাথা নিচু করল, ‘এর মাথা ঠিক নেই।’
‘কেন?’ ছোটে মহারাজ প্রশ্নটা করেই ঈষৎ ঝুঁকলেন, ‘কি হয়েছে?’
বৃদ্ধ মুখ তুলল, ‘সর্বনাশ। সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার। আমি ওঁকে দেবতা মনে করতাম। আমার মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম আশ্রমে। সে ফেরত গেল পেটে বাচ্চা নিয়ে। প্রতিকারের জন্যে ছুটে এলাম এখানে। ওরা আমাকে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দিল না। মেজ মহারাজ আমাকে উদ্ধার করলেন। তিনি এক হারামজাদার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেই বদমাস টাকার লোভে আমার মেয়েকে বিয়ে করল। কিন্তু যেই কাল শুনতে পেল বাবা নেই, অমনি মেরেধরে মেয়ে আর নাতিকে ফেরত পাঠিয়ে দিল।’
‘কেন?’
‘নাতিটা ওর বাচ্চা নয়। বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই সে জন্মেছিল। আমার দেবতা আজ মরে গেছে। তার শরীরকে আমি টুকরো টুকরো করে ফেলব যদি সে এর প্রতিকার না করে।’ চিৎকার করে উঠল বৃদ্ধ।
ছোটে মহারাজ অবাক হয়ে সুধাময়ের দিকে তাকালেন। সুধাময় মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর চোখ চকচক করছে গল্প পেয়ে। ছোটে মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় কাজ করছিল মেয়ে?’
‘আশ্রমের কাজে ছিল সে।’
‘আশ্রমের কোন কাজে?’
‘আমার আর কোন ভয় নেই। মেরে ফেলুক তবু বলব। বড় মহারাজের ভবনে সে কাজ করত।’
‘সে কিছু বলেছে? কে দায়ী?’
‘উঃ। দুপুর বেলায় মেঘ না থাকলে কোত্থেকে রোদ পড়ছে তা কি বলে দিতে হয়?’
সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট কামড়ালেন ছোটে মহারাজ, ‘মেজ মহারাজ এই ঘটনা জানেন যখন তিনি তোমার মেয়ের বিয়ে দিলেন?’
‘না। তিনি জিজ্ঞাসা করেননি।’
‘তুমি যে অভিযোগ করছ, তা সত্যি?’
‘নিজের মেয়ের নামে কোন অভাগা বদনাম দেয়?’
‘বেশ। কিন্তু চিৎকার করে এর সুরাহা হবে না। তুমি এখনই গ্রামে ফিরে যাও। তোমার মেয়ে আর নাতিকে আজই এখানে নিয়ে এস। এঁরা তোমাকে সাহায্য করবেন। আজ থেকে ওদের সমস্ত দায়িত্ব আশ্রমের।’ ছোটে মহারাজ ইউনিসকে ইঙ্গিত করতেই বৃদ্ধ তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল, ‘আজ থেকে তুমিই আমার দেবতা।’
পা সরিয়ে নিলো ছোটে মহারাজ। কিন্তু তাঁর সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল যেন। দেবতা! শব্দটি সমস্ত শরীরে মনে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। দ্রুত পা চালালেন তিনি। এখন আর পেছন ফিরে তাকাবার সময় নেই।
.
গোধূলি লগ্নে বাবার শরীর পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাবে। ঠিক চারটের সময় উকিল বগলাচরণ এলেন। আনন্দভবনের একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাঁর সামনে বড় এবং মেজ মহারাজ বসে আছেন। প্রত্যেকের চেহারা বিধ্বস্ত। দশজন মহারাজ তাঁদের পেছনে। এই বিশেষ সভা যেহেতু মহারাজদের নিয়েই তাই ছোটে মহারাজ প্রবেশাধিকার পাননি। তিনি দীক্ষিত হলেও বাবা তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মহারাজ পদে স্বীকৃতি দেননি। ছোটে মহারাজ ছিল তার নিতান্তই আদরের ডাক। পরিবেশ খুব গম্ভীর। বগলাচরণ কান্না জড়ানো স্বরে বললেন, ‘এখনও বাবার শরীর আমাদের মধ্যে রয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, দাহ করার আগে যেন আমি আপনাদের সামনে তার উইল পড়ে শোনাই। বাবার শিষ্য হিসেবে এই পবিত্র দায়িত্ব আমার ওপর তিনি অর্পণ করেছেন। আপনারা সবাই আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। এই অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ তিনি একটা সিল করা খাম খুললেন।
বগলাচরণ বাবার উইল পড়তে লাগলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় আমি মানুষের সেবা করতে চেয়েছি আমার মত করে। আমি যখন থাকব না, তখন যে দায়িত্ব নেবে তাকে সেই কাজ করতে হবে।’ বগলাচরণ পড়ে চললেন। নানান ব্যাপারে বাবা স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। ধর্মীয় অনুশাসন যেন কঠোর ভাবে রক্ষা করা হয়, অর্থনৈতিক ব্যাপারে যেন কোন অনাচর না হয়—সব ব্যাপারেই তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল। বগলাচরণ শেষ পরিচ্ছেদে এলেন, ‘সমস্ত ব্যাপার এবং পরিস্থিতি চিন্তা করে আমি আদেশ দিচ্ছি আশ্রমের আচার অনুষ্ঠান পালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিচ্ছি বড় মহারাজকে। সে যতদিন সত্যনিষ্ঠ এবং কর্তব্যপরায়ণ থাকবে ততদিনই এই কাজের দায়িত্ব পাবে। মেজ মহারাজকে আশ্রমসংবাদ সম্পাদনা, শিষ্যদের সঙ্গে আশ্রমের তরফে যোগাযোগ এবং অর্থ কমিটির একজন সদস্য হিসেবে মনোনীত করছি। মহারাজ ক, খ, গ, ঘ ওই অর্থকমিটিতে থাকবে। মহারাজ ঙ, চ, ছ, জ একটি কমিটি তৈরি করবে যার ওপর আশ্রমের নিয়মশৃঙ্খলার দায়িত্ব থাকবে।’
‘আমার এই উইল পাঠ করে শোনানোর দায়িত্ব আমি বগলাচরণকে দিচ্ছি। এটি পাঠ করতে হবে আমার মুখাগ্নি হবার আগে। সেই মুহূর্তে যদি আমার কনিষ্ঠপুত্ৰ শ্ৰীমান নির্মল আশ্রমে উপস্থিত থাকে, তবে সে আমার মুখাগ্নি করবে। মুখাগ্নি করবার আগে সে যদি দীক্ষিত হয় তাহলে তাকে মহারাজ পদে গ্রহণ করার আদেশ দিলাম। আমার মৃত্যুর পরে সে অর্থকমিটি এবং নিয়মশৃঙ্খলা রূপায়ণের কমিটির প্রধান হবে। এবং সে যদি নিজের গুণ ও ক্ষমতায় শিষ্যদের শ্রদ্ধার্জন করতে পারে, তাহলে আমার উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু আমার শরীর বিনষ্ট হবার আগে তার কোন সন্ধান না পাওয়া গেলে অথবা দীক্ষিত না হলে সে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সেক্ষেত্রে আমার মুখাগ্নি করবে বড় মহারাজ জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবেই এবং ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার তার ওপর বর্তাবে। আমার শরীর যেন আশ্রম প্রাঙ্গণেই ভস্মীভূত হয়। যে ধর্মজীবনের স্বপ্ন আমি দেখে এসেছি, তা যেন আমার উত্তরাধিকারী বাস্তবে রূপায়িত করে।’
বগলাচরণ পড়া শেষ করে বললেন, ‘এই উইলের আরও দুটো কপি যথাস্থানে সুরক্ষিত আছে। এখন আপনারা ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।’
কয়েক মুহূর্ত ঘরে এমন নৈঃশব্দ্য এল যেন নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ‘ক’ মহারাজ বললেন, ‘তাহলে ছোটে মহারাজকে এখানে আসতে বলা উচিত।’
সঙ্গে সঙ্গে বড় মহারাজ তীব্র প্রতিবাদ করলেন, ‘না। এ অসম্ভব। আশ্রমের পবিত্রতার সঙ্গে ছোটের কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মাচরণের কোন তত্ত্ব সে জানে না। সে এখনও অস্থিরমতি, বাস্তবজ্ঞান শূন্য, আধ্যাত্মিকবোধ রহিত। বাবা এই দিকটি চিন্তা করেননি।’
‘কিন্তু মৃতের উইল অনুসরণ করতে আমরা বাধ্য নই কি?’
‘ক’ মহারাজ প্রশ্ন করলেন।
‘নিশ্চয়ই। বাবা বলেছেন মৃত্যুর সময় ছোটেকে এখানে উপস্থিত থেকে দীক্ষিত হতে হবে।’ বড় মহারাজ হাসলেন, ‘না। সে ছিল না। সে তখন নিরুদ্দিষ্ট। আশ্রমের এই ক্ষমতা অর্জন করবে যে তার কানে বাবার জীবদ্দশায় বীজমন্ত্র প্রবেশ করেনি। এক্ষেত্রে বাবা তো স্পষ্টই বলে গিয়েছেন কি করতে হবে।’
বগলাচরণ বললেন, ‘একটু ভুল হল বোধহয়। মৃত্যুর আগে শব্দদুটি তিনি বলেননি, উইলে লেখা আছে মুখাগ্নির আগে এই উইল পাঠ করার মুহূর্তে তিনি যদি আশ্রমে উপস্থিত থাকেন এবং দীক্ষিত হন তাহলেই হবে। তিনি উপস্থিত জানি কিন্তু দীক্ষিত কিনা তা জানি না। বাবার মৃত্যুর আগে যদি তিনি দীক্ষিত না হন তাহলে সেটা হওয়া সম্ভব নয়, কারণ আপনাদের নিয়ম পরিবারের গুরুজনদের কাছে দীক্ষিত হওয়া।’
মেজ মহারাজ বললেন, ‘আজ সকালে ছোটে আমার কাছে দীক্ষা নিয়েছে।’
বড় মহারাজ চিৎকার করলেন, ‘এই দীক্ষা অবৈধ। এখন আমাদের কালাশৌচ চলছে। এই অবস্থায় দীক্ষা দিয়েও তুমি অন্যায় কাজ করেছ।’
মেজ মহারাজকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘বাবা এইরকম নির্দেশ কখনও দেননি। বরং একবার এক সদ্য বিধবাকে তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন তার স্বামীর শ্রাদ্ধ হবার আগেই। বলেছিলেন, তোমাকে পথ করে দিলাম বেঁচে থাকার।’
‘ক’ মহারাজ বয়সে সবার প্রবীণ। তিনি বললেন, ‘বাবার শেষ ইচ্ছা মান্য করা আমাদের কর্তব্য।’ বড় মহারাজ মাথা নাড়লেন, ‘না। এসব বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল না। মৃত্যুর দিন তিনি উইল পাল্টাতে চেয়েছিলেন। সেইমত বগলাচরণকে সন্ধ্যায় দেখা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কি বগলাচরণ, বল?’
বগলাচরণ স্বীকার করলেন, ‘হ্যাঁ, ঘটনা সত্য। তবে জানি না বদলে তিনি কি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাতিল না হওয়ায় এই উইল এখন আইনসম্মত।’
মেজ মহারাজ এবার সোজা হয়ে বসলেন, ‘আমাদের কিছু করা উচিত নয় যাতে বাবার অসম্মান হয়। তিনি যে আদেশ দিয়েছেন তা মাথা পেতে নিতে হবে। আপনারা অনুমতি দিলে ছোটেকে ডাকা যেতে পারে। মুখাগ্নির সময় হয়ে এল।’
বড় মহারাজ পাগলের মত চিৎকার করলেন, ‘না। সে লম্পট। চরিত্রহীন। এতবছর ধরে আমরা আশ্রমের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করলাম আর সে এসবের বাইরে থেকেও আজ হঠাৎ সিংহাসনে বসবে, তা হতে পারে না।’
মেজ মহারাজ বললেন, ‘আপনি এমনভাবে বিচলিত হবেন না। বাবা ছোটেকে আপাতত মুখাগ্নি করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু বলেছেন উত্তরাধিকার অর্জন করতে হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। আপনি ওর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করছেন তা সামনাসামনি বলুন। একজন লম্পট নিশ্চয়ই শ্রদ্ধার্জন করতে পারে না।’
বড় মহারাজ হতাশায় ভেঙে পড়ছিলেন। ছোটে মহারাজকে ডেকে পাঠালেন তিনি, হতাশ গলায় বলে উঠলেন, ‘কে কবে শুনেছে বড় ছেলে থাকতে ছোট মুখাগ্নি করে!’
‘মুখাগ্নিতে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?’
‘চুপ করো। তোমার বিষয়জ্ঞান কোনদিন হবে না।’
এইসময় ছোটে মহারাজ ধীরে ধীরে ঘরে এল। বলল, ‘এইসময় আমি কাউকে নমস্কার করতে পারছি না। আমার পিতৃদেব এখনও শায়িত।’
বগলাচরণ তাঁকে বললেন, ‘আপনি আসন গ্রহণ করুন।’
ছোটে মহারাজ খানিকটা দূরত্ব রেখে বসলেন। বগলাচরণ ‘ক’ মহারাজের দিকে ইঙ্গিত করলেন। ‘ক’ মহারাজ বললেন, ‘আমরা পূজ্যপাদ বাবার উইল শ্রবণ করেছি। আপনি তা পাঠ করুন।’
ছোটে মহারাজ বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি পাঠ করতে চাই না। সেই মানসিকতাও নেই। প্রয়োজনীয় যদি কিছু থাকে শুনলেই চলবে।’
‘ক’ মহারাজ বললেন, ‘বাবার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী আপনি মুখাগ্নি করবেন। কিন্তু আপনি কি আজ সকালে দীক্ষা নিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। মেজ মহারাজ আমাকে পবিত্রতা দান করেছেন।’
‘বেশ। এখন থেকে আপনি মহারাজ হিসেবে স্বীকৃত হলেন। বাবাই এই আদেশ দিয়েছেন। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী বড় মহারাজ আবার অনুষ্ঠান পালনের দায়িত্ব নেবেন। মেজ মহারাজকেও নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। অর্থকমিটি এবং প্রশাসন কমিটির প্রধান আপনি। তাছাড়া তিনি আপনাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছেন। এই পবিত্র সম্মান রক্ষার দায়িত্ব আপনার ওপর। কারণ আপনিই আশ্রমের মর্যাদা রক্ষা করবেন।’
‘ক’ মহারাজের কথা শেষ হওয়ামাত্র মেজ মহারাজ বললেন, ‘কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে বড় মহারাজ কয়েকটি অত্যন্ত মারাত্মক অভিযোগ তুলেছেন।’
‘কি অভিযোগ?’ ছোটে মহারাজ তখন সমস্ত শরীরে কম্পন অনুভব করছেন।
‘তুমি চরিত্রহীন, লম্পট। তোমার নিরুদ্দিষ্ট হওয়া এবং নানারকম গুজব আমাদের কানে আসায় আমরা স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্ত।’ মেজ মহারাজ জানালেন।
‘এসব আলোচনা মুখাগ্নির পরে করলে হয় না?’ ছোটে মহারাজ বললেন।
‘না!’ বড় মহারাজ মাথা নাড়লেন। তাঁর মুখে রক্ত জমেছিল।
‘বেশ। অভিযোগকারীকে প্রমাণ করতে হবে আমার জীবন ওই খাতে বয়ে গিয়েছিল কিনা। প্রমাণিত হলে আপনারা যা বলবেন তা মান্য করব।’
বড় মহারাজ বললেন, ‘সুধাময় জানিয়েছিল তুমি একটি প্যান্টসার্ট পরা মেয়ের সঙ্গে বর্ধমান স্টেশন থেকে ট্রেন ধরেছিলে। উত্তরবঙ্গে তোমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ছিলে। তোমার কলকাতার ঘরে আমি মেয়েদের জিনিস পেয়েছি। আর কি প্রমাণ চাও? অবিবাহিত জীবনে নারী-সংসর্গ করেছ তুমি, তোমার কোন অধিকার নেই।’
ছোটে মহারাজ হাসলেন, ‘সুধাময় এখানে আছেন। তাঁকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা হোক তিনি বর্ধমানে আমার সঙ্গে কোন নারীকে দেখেছেন কিনা। আমি যেখানে ছিলাম সেখানে সুধাময় গিয়েছিলেন। আমার জীবনযাত্রা তিনি দেখে এসেছেন। সেব্যাপারেও তিনিই সাক্ষী হতে পারেন। বাংলাদেশের গরীব মানুষ লাম্পট্য বরদাস্ত করতে পারে না। কোন লম্পটকে তারা দেবতা বলে ডাকতে পারে না।’
মেজ মহারাজ বললেন, ‘কলকাতার বাড়িতে মেয়েলি জিনিসপত্র?’
‘কে দেখেছেন? বড় মহারাজ। ওগুলো তিনিই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন। আপনারা কেউ নির্বোধ নন। কলকাতার বাড়ির চারতলায় কোন সিঁড়ি নেই। লিফটে ওঠা-নামা করতে হয়। নিচে সেবকরা দিনরাত পাহারায় থাকে। কোন নারী আমার ঘরে গেল লিফটে চড়ে আর কেউ তাকে দেখল না, এমন হাস্যকর অভিযোগ আপনারা শুনছেন কি করে?’
‘ছোটে, তুমি আমাকে অপমান করছ! তোমার স্পর্ধা সীমা ছাড়াচ্ছে।’
‘না। অভিযুক্ত হওয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থন করছি। এবার আমি মেজ মহারাজকে প্রশ্ন করব। আপনার কি মনে পড়ে, এক বৃদ্ধের সন্তানসম্ভবা কন্যার সঙ্গে আপনি বাবার খুব গরীব শিষ্যকে বিবাহবন্ধনে বদ্ধ হতে আবদ্ধ করেছিলেন, যাজক পদ পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে?’ ছোটে মহারাজ সরাসরি প্রশ্ন করলেন। মেজ মহারাজের চোয়াল শক্ত হল, ‘সেইসময় আমার অন্য কোন উপায় ছিল না।’
‘কারণ?’
‘তা নাহলে আশ্রমের দুর্নাম বাড়তো।’
‘আপনি কি খোঁজ নিয়েছিলেন মেয়েটির শরীরে সন্তান আসার জন্যে কে দায়ী?’
‘না। আমার প্রবৃত্তি হয়নি। আমি ওদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।’
‘আপনার বক্তব্য আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু সেই লোকটি তার স্ত্রী ও সন্তানকে ত্যাগ করেছে। ওই বৃদ্ধ এসে বিলাপ করছে এখন। সে তার মেয়েকে সরল বিশ্বাসে এই আশ্রমের সেবিকা হতে পাঠিয়েছিল। আমি জানি না লম্পট ও চরিত্রহীনের সংজ্ঞা কি? আশ্রিত সেবিকাকে সন্তানসম্ভবা করাটা কি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে? আপনারা কি বলেন?’
বড় মহারাজ অবাক হয়ে বললেন, ‘এসব কি কথা? কে করেছে এ কাজ?’
ছোটে মহারাজ বললেন, ‘ওঁকে এই প্রশ্ন করুন।’
বড় মহারাজ উন্মাদের মত বলে উঠলেন, ‘মিথ্যে কথা। আমার চরিত্রে নোংরা ছেটানো হচ্ছে। তুই ধ্বংস হবি।’
হঠাৎ একটি গলা চিৎকার করে উঠল, ‘করেছে, করেছে।’
সবাই অবাক হয়ে ঘরের একটি বিশেষ কোণের দিকে তাকাল। সেখানে কাপড় ঢাকা অবস্থায় খাঁচায় বসে আছে আত্মারাম। একটা ছোট্ট ফাঁক দিয়ে সে এদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বড় মহারাজ আক্রোশে ফেটে পড়লেন, ‘চুপ কর হতভাগা!’
আত্মারাম ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘খচ্চর।’
ঘরে যেন বজ্রপাত হল। ছোটে মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ পাখি কার?’
মেজ মহারাজ জবাব দিলেন, ‘বড় মহারাজের। ওর নাম আত্মারাম।’
‘আত্মারাম খাঁচা-ছাড়া করুন।’
একজন মহারাজ উঠে আত্মারামকে খাঁচাশুদ্ধ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ছোটে মহারাজ বললেন, ‘আমি কারো নামে নোংরা ছড়াচ্ছি না। সেই বৃদ্ধকে আমি অনেক কষ্টে শান্ত করেছি। তাকে এখানে নিয়ে এলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে। আপনি বিবাহিত, বাবার আশীর্বাদধন্য। কিন্তু লম্পট কে? আপনি না আমি? বড় মহারাজের চিবুক তখন বুকে এসে ঠেকেছে। আত্মহত্যার বাসনা জেগেছে তাঁর। ছোটে মহারাজ বললেন, ‘নিজেদের মধ্যে বিভেদ ঘটুক, তা আমি চাই না। বাবার মৃত্যু যার জন্যে হয়েছে, তাকে আমি ছেড়ে দেব না। এই মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য সম্পাদন করা উচিত। চলুন সবাই।’ ছোটে মহারাজের সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়ালেন। বড় মহারাজ শুধু মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ছোটে মহারাজ তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মনে হয়, আপনার এখানেই অপেক্ষা করা উচিত। আর একটি হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়। সেই বৃদ্ধ আপনাকে দেখলে আবার উন্মাদ হয়ে যেতে পারে।’
শব্দ আলোর চেয়ে দ্রুতগামী! মুখাগ্নির আগেই ছড়িয়ে পড়ল সংবাদ। কেউ খুশি হল, কেউ বিস্মিত, কেউ সমালোচনা করল। কিন্তু প্রধান সচিব, রাজ্যমন্ত্রী, জেলাশাসক ও পুলিশপ্রধানের উপস্থিতিতে মুখাগ্নি করলেন ছোটে মহারাজ। মুখাগ্নির সময় ভক্তশিষ্যরা বিলাপ শুরু করল। কলকাতায় আজ দাঙ্গা বেঁধে গেছে খবর আসায় পুলিশ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে মুখাগ্নির সময়। বাবা চাইতেন আশ্রমে যেন পুলিশ না প্রবেশ করে। মরদেহ ভষ্মীভূত হওয়ামাত্র ছোটে মহারাজ জেলাশাসককে অনুরোধ করলেন অবিলম্বে পুলিশ প্রত্যাহার করতে। সবাই যখন শোকে বিহ্বল তখন তিনি পূর্ণ মর্যাদায় প্রধান সচিব এবং কেন্দ্রীয়মন্ত্রীকে বাবার প্রতি শেষ সম্মান দেখানোর জন্যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালেন। ঘোষণা করা হল আগামীকাল দুপুর বারোটায় নবনির্বাচিত উত্তরাধিকারী ছোটে মহারাজ শিষ্যভক্তদের উদ্দেশে তাঁর বাণী দেবেন। দাহ শেষ হলেও আশ্রম-প্রাঙ্গণে বিলাপ বন্ধ হল না।
.
সুধাময় ভাবতে পারছিলেন না, একটি মানুষ রাতারাতি কতটা বদলে যেতে পারে! যে ব্যক্তিত্ব এবং নির্লিপ্ততা ছোটে মহারাজের আচার-আচরণে ফুটে উঠেছে তা তিনি গতকাল পর্যন্ত দ্যাখেননি। ক্ষমতার সিংহাসনে বসলে পরিবেশ কোন কোন মানুষকে নিজের মত তৈরি করে নেয়। এইসময়ে আনন্দভবনে সুধাময়ের ডাক পড়ল।
ছোটে মহারাজের সামনে তখন মহারাজরা উপস্থিত। শুধু বড় মহারাজকে দেখা যাচ্ছে না। খবর পাওয়া গিয়েছে, তিনি নীরবে আশ্রম ত্যাগ করেছেন। ছোটে মহারাজ বলছিলেন, ‘বাবার আততায়ীকে খুঁজে বের করতেই হবে। তিনটি সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। এক প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মীয় সংগঠন, দুই, রাজনৈতিক দল আর তিন নম্বর হল যার স্বার্থ ছিল। বড় মহারাজ আশ্রম থেকে কাউকে না বলে চলে গিয়েছেন। বাবার উইল আমি দেখলাম। তিনি লিখেছেন : যতদিন বড় মহারাজ সত্যনিষ্ঠ ও কর্তব্যপরায়ণ থাকবেন ততদিন আশ্রমের আচার-অনুষ্ঠান পালনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি পাবেন। বৃদ্ধের কন্যার প্রতি ওই কাজ করে এবং দায়িত্ব এড়িয়ে চলে গিয়ে তিনি শর্তভঙ্গ করেছেন। তাঁকে আর আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত রাখা সঠিক মনে করছি না। আশ্রম তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করছে। বাবার জীবদ্দশায় আশ্রমের কাজ যেমন চলছিল তেমন চলবে।’
মেজ মহারাজ বললেন, ‘কিন্তু বড় মহারাজের সেবার ইতিহাস মনে রেখে এতবড় শাস্তি না দিলে হয় না? লোকে গুজব রটাবে। তুমি ভেবে দ্যাখ।’
‘পচে যাওয়া আলুর সঙ্গে টাটকা ফসল রাখার ঝুঁকি আমি নেব না। আমরা জনসাধারণের জন্যে নিবেদিত। ব্যক্তিবিশেষের মান রাখতে নয়। আর হ্যাঁ, আপনি আমার দীক্ষাগুরু। কিন্তু বাবার হয়ে দীক্ষা দিয়েছেন। তাই মনে রাখবেন আপনারা বয়সে বড় হলেও পদমর্যাদার সম্মানে আমি আপনাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আশা করব। আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করবেন না। অনেক পরিশ্রম করেছেন আপনারা। এবার বিশ্রাম করুন।’ ছোটে মহারাজ কিছুটা ক্লান্ত হয়ে বাবার ইজিচেয়ারের দিকে এগিয়েও মন পাল্টে পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন। এইসময় সেবক এসে জানাল সুধাময় অপেক্ষা করছেন।
ঘরে ঢুকে সুধাময় সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। ছোটে মহারাজ বললেন, ‘জয় বাবা।’
সুধাময় আপ্লুত স্বরে উচ্চারণ করলেন, ‘জয় বাবা।’
ছোটে মহারাজ সুধাময়কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এবার কি তুমি কলকাতায় ফিরে যাবে?’
‘যদি আজ্ঞা করেন—।’
‘না। আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। তুমি যদি আমাকে না নিয়ে আসতে, যদি সকালে দীক্ষা নেবার পরামর্শ না দিতে তাহলে—।’
‘আপনি আসতে চাননি মহারাজ।’
‘হ্যাঁ। নির্বোধের মত কাজ করেছিলাম। আমি তোমাকে আশ্রমে চাই। তোমার ব্যবসা তুলে দাও। আমার ব্যক্তিগত সচিব হয়ে কাজ করো।’
‘আমি কৃতজ্ঞ।’
‘আর সেইসঙ্গে ইউনিসকেও আমার দরকার। আশ্রমের রক্ষী ও সেবক বাহিনীর সে দায়িত্ব নেবে। তোমাদের দুজনকে আমি ছেড়ে দিতে পারি না।’
‘অপরাধ না নিলে কারণ জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
‘ওই যে বললাম, কৃতজ্ঞতা। তাছাড়া আমার কাছাকাছি বিশ্বাসভাজন মানুষ চাই। ভক্ত শিষ্যদের, অচেনা মানুষদের আমি চট করে গ্রহণ করতে পারি না। এবার এসো। আমি বিশ্রাম নেব।’
ছোটে মহারাজ ইঙ্গিত করতেই আবার প্রণাম করে সুধাময় প্রফুল্লচিত্তে বেরিয়ে গেলেন। ছোটে মহারাজ হাসলেন, সাক্ষীদের কখনই নজরছাড়া করতে নেই।
এইসময় দুজন সেবিকা সরবৎ নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারা আদেশের জন্যে নম্রতা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ছোটে মহারাজ তাদের দেখলেন। দুজনই যুবতী। একজন সুন্দরী।
‘তোমরা এখানে কি করতে?’
‘সেবা।’
‘আমার সেবিকার প্রয়োজন নেই।’
সেবিকারা মাথা নিচু করল।
‘তাই বলে তোমাদের চলে যেতে বলছি না। তোমাদের জন্যে অন্য কাজের ব্যবস্থা করতে আমি মেজ মহারাজকে বলব। আপাতত সরবৎ দিয়ে যাও।’
ট্রে থেকে গ্লাস তুলে নিতেই যুবতীরা চলে গেল। চেয়ারে বসে সরবতে মৃদু চুমুক দিতে লাগলেন ছোট মহারাজ।
.
সকাল থেকেই উপাসনামন্দিরের সামনের মাঠে জনসমাগম হচ্ছিল। এগারটার মধ্যে সমস্ত স্থান ভরে গেল। কিন্তু কারো মুখে কোন শব্দ নেই। মহারাজরা অনুষ্ঠানমঞ্চের তদারকিতে ছিলেন। মেজ মহারাজ আনন্দভবনে গিয়ে অবাক হলেন। ছোটে মহারাজ গেরুয়া আলখাল্লা পরেছেন। কোমরে হলুদ কোমরবন্ধ। চেতনা ফিরে আসতেই তিনি নমস্কার করে বললেন, ‘জয় বাবা।’
ছোটে মহারাজ উত্তর দিলেন, ‘জয়বাবা।’
মেজ মহারাজ বললেন, ‘মানুষজনে প্রাঙ্গণ ভরে গেছে।’
‘কিন্তু এখনও বারোটা বাজতে বিলম্ব আছে। আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল। ভালই হল, হাতে কিছুক্ষণ সময় রয়েছে। আশ্রমের নিয়মশৃঙ্খলা কঠোরভাবে যাতে পালিত হয়, তা আপনি দেখবেন। আমার এখানে যেসব সেবিকা রয়েছে তাদের অন্য কাজে নিয়োগ করুন। ‘ক’ মহারাজকে দায়িত্ব দেবেন আচার-অনুষ্ঠান পালন করার। আর আশ্রম সংবাদের সম্পাদকীয় এখন থেকে আমিই লিখব।’
‘আদেশ মান্য হবে।’
‘সুধাময়কে আমি আমার সচিব হিসেবে নির্বাচিত করেছি। সরকার এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সে আমার হয়ে যোগাযোগ করবে। সনাতননাথের সঙ্গে কোন আপোস নয়। কিন্তু প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী ও আনন্দ সরস্বতীর সঙ্গে আমি আলোচনায় বসতে চাই। এই দায়িত্ব আপনি নেবেন। শত্রুপক্ষে ভাঙন সৃষ্টি না করলে জয়লাভ দুরূহ হয়ে ওঠে।’ মেজ মহারাজ বিহ্বল হয়ে পড়েন, ‘আঃ। আমার আর সংশয় নেই। শেষবার তোমায় তুমি বলছি। তোমার যোগ্যতা তুমি ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছ।’
.
ঠিক বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিটে মহারাজদের সঙ্গে মঞ্চে প্রবেশ করলেন ছোটে মহারাজ। তাঁর পোশাক এবং আকৃতি দেখে একটা গুঞ্জন উঠল শুধু। মেজ-মহারাজ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আজ এই শোকের মুহূর্তে আমাদের একটা পবিত্র কর্তব্য পালন করতে হচ্ছে। পরমপূজণীয় বাবার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে ছোটে মহারাজ মনোনীত হয়েছেন। এখন থেকে তিনিই আমাদের পথ দেখাবেন। ছোটে মহারাজ এবার আপনাদের বাণী দেবেন।’
ধীর পায়ে ছোটে মহারাজ মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। সবাই নির্বাক।
নম্র গলায় তিনি বললেন, ‘আজ আমরা পিতৃহারা। তিনি নেই। বর্বর ঘাতক তাঁকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তিনি আছেন। আমাদের কাছে, আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। আমাদের অস্তিত্বে। যতদিন প্রাণ থাকবে ততদিন কেউ তাঁকে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারবে না। বাবা বলতেন ভগবান আছেন মানুষের কর্মে, যে কর্ম শুভফল প্রসব করে। অশুভের সঙ্গে থাকেন শয়তান। সেই শয়তানদের হাতেই বাবা নিহত হলেন। যীশুখ্রীস্টকে শয়তানরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। যীশু বেঁচে আছেন মানুষের মনে, মানুষের ভালবাসায়। আপনারা, যাঁরা বাবার সন্তান, আমার ভাই, অথবা বোন, এখন থেকে প্রতিদিনের বেঁচে থাকা সার্থক করে তুলুন বাবার নির্দেশিত পথে এগিয়ে গিয়ে।’
গত রাত্রে মুখাগ্নির পর আমি যখন ক্লান্ত তখন আমার জন্মান্তরের দীক্ষা হয়ে গেল। সেই মধ্যরাত্রে বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি বিহ্বল। বাবা হেসে বললেন, ‘জানিস না আত্মা অবিনশ্বর? আমার মরদেহ ধ্বংস হয়েছে কিন্তু আমি রয়ে গেছি।’ আমি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাবা বললেন, ‘অনেক কাজ বাকি আছে। আমি তোর মাধ্যমে সেই কাজগুলো শেষ করতে চাই।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি কাজ? কি আমায় করতে হবে?’ বাবা বললেন, ‘মানুষকে ভালবাসা দিতে হবে। এদেশের মানুষের বড় কষ্ট।’
আমি বললাম, ‘তোমাকে কে মেরেছে?’
তিনি হাসলেন, ‘যারা চিরকাল মেরে থাকে। তুই এগিয়ে যা।’ ব্যস। তিনি চলে গেলেন। আমার চোখে আর তন্দ্রা এল না। তারপর থেকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করছি তিনি আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আছেন বাতাসের মত। তিনি যদি আমাকে তাঁর মুখপাত্র করতে ইচ্ছে করেন তাহলে তার জন্যে যে গুণের ও শক্তির প্রয়োজন তিনিই তা জুটিয়ে দেবেন।’
ছোটে মহারাজ সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ করলেন। এখনও তিনি মানুষের কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছেন না। ছোটে মহারাজ আবার কথা শুরু করলেন, ‘সহস্র বছরের দাসত্বের জন্যে আমরা আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলেছি। নিজের গুরুত্ব অনুভব করার শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা কখনই মহান জাতিতে পরিণত হতে পারব না যতক্ষণ না আমাদের ধর্মকে ভালবাসতে পারব, নিজের সমাজ আর দেশবাসীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ করতে পারব। আমাদের জাগতে হবে। ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে রাজনৈতিক সত্যজ্ঞানকে। ধর্ম কি? বাহ্য ও অন্তঃপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত করে অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশের জন্যে যে চেষ্টা তারই অন্য নাম ধর্ম। কর্ম, উপাসনা, মনঃসংযোগ এবং জ্ঞান, এসবই ওই চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
‘কিন্তু আমি বিষ্ঠায় বাস করলে আমার মন বেশিক্ষণ ফুলের স্বপ্ন দেখতে পারে না। মানুষের জন্যে এমন একটা সমাজব্যবস্থা চাই, যেখানে প্রতিনিয়ত তাকে আত্মমর্যাদাহীন হয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু কি করে সেটা সম্ভব? ধর্ম তো কর্ম ছাড়া নয়। শুধু অধ্যাত্মচিন্তা করলে তো আত্মার মুক্তি সম্ভব নয়। এখন চারপাশে রাজনীতির বাহুবল এমনই প্রবল যে সহস্র বছরের দাসত্ব মাঝে মাঝেই ফিরে আসে। যাঁরা নেতা, তাঁরা দলের নেতা, মানুষের নেতা নন। তাঁরা রাজনীতির কথা বলেন, জননীতির ধারে কাছে যান না। এঁরা কারা? রাজনীতি বা নেতৃত্ব করার জন্যেই কি এঁদের জন্ম? একজন চিকিৎসক, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেরানি, একজন কৃষক সমাজকে যা দিচ্ছেন তা দেওয়ার যোগ্যতা এঁদের নেই। এঁরা শুধু দলের জোরে মোড়লি করে যাচ্ছেন। পাঁচ বছরের জন্যে ইজারা নিয়ে শুধু নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করছেন। আমরা মুসলমানদের দাস ছিলাম, ইংরেজদের গোলাম ছিলাম, এখন রাজনৈতিক দলগুলোর পুতুল হয়েছি। জনগণকে অবহেলা করাই ভারতের প্রবল জাতীয় পাপ এবং তা ভারতের অবনতির প্রধান কারণ। যত রাজনীতিই করা যাক না কেন, তাতে কিছুই হবে না যতক্ষণ না জনগণের উপযুক্ত শিক্ষা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং উন্নতির দিকে দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই কাজ কারা করবে? আমি মনে করি, এই কাজ করতে পারে উদীয়মান তরুণ সম্প্রদায়। তাদের ভেতর থেকেই কর্মীদল আসবে। স্বার্থপরতা ও অহমিকাপূর্ণ বর্তমান রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ধ্বংস হবেই। সাধারণ মানুষের মুক্তির যুগ আসছে। কেউ তার প্রতিরোধ করতে পারবে না। ধর্মের সঙ্গে সেই যুগের আত্মিক সম্পর্ক। ধর্মের মূল কথাটা মানুষকে বোঝাতে হবে। ধর্মের বাহ্যিক কতগুলো আচরণকে ধর্ম নাম দিয়ে ধর্মধ্বজীরা স্বার্থসিদ্ধি করে গেছে বহুযুগ ধরে। সেই শোষকদের মানুষ বর্জন করবেই। কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানুষকে আত্মানুসন্ধানে সাহায্য করার জন্যে আমার জীবন উৎসর্গ করলাম আমি। বাবার আশীর্বাদ আমার পাথেয়। বলুন সবাই আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে—‘জয় বাবা।’
সঙ্গে সঙ্গে যে জয়ধ্বনি উঠল তা যেন আকাশ স্পর্শ করল। জয়ধ্বনি থামতে চাইছে না। এবং ক্রমশ সেই ধ্বনি পাল্টে যেতে লাগল। জনতা এখন বলছে ‘জয় মহারাজ।’
.
আনন্দভবনের সাধনকক্ষে ছোটে মহারাজ পদ্মাসনে বসেছিলেন। এক ঘণ্টা মনঃসংযোগ করে তিনি যখন বেরিয়ে এলেন তখন সুধাময় হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। পাশে মেজ মহারাজ। মেজ মহারাজ বললেন, ‘আমি আপ্লুত।’
‘সাধারণ মানুষ?’
‘তারা একজন নেতাকে পেল যিনি তাদের ধর্ম ও সমাজচেতনা দান করবেন।’
ছোটে মহারাজ বললেন, ‘এই আশ্রমের প্রতি যারা অনুগত তাদের নির্দেশ দিন যেন প্রতিমাসে তারা একদিন এমন কোন কাজ করে যাতে একজন নিঃস্ব মানুষের উপকার হয়। বাবা মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলেন। আমাদের কর্তব্য সেই চেষ্টা করে যাওয়া।’
মেজ মহারাজ বিদায় হবার পর সুধাময় বললেন, ‘মহারাজ, একটা কথা নিবেদনের ছিল।’
ছোটে মহারাজ লক্ষ করলেন, সভার পর থেকেই ‘ছোটে’ শব্দটি বর্জিত হয়েছে।
‘বল।’
‘তিনি দর্শন প্রার্থনা করছেন।’
‘কে?’
‘লাবণ্যদেবী।’
ছোটে মহারাজ চমকে উঠলেন। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি চারপাশে তাকলেন। চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষের শ্রদ্ধাবনত মুখ এবং কানে তাদের দেওয়া জয়ধ্বনি বেজে উঠল। এখন কোনরকম ঝুঁকি নেওয়া মানে মানুষের সন্দেহের শিকার হওয়া। বিশেষ করে বড় মহারাজ যত দূরেই যান তাঁর অনুগতরা নিশ্চয়ই এখানে রয়ে গেছেন।
ছোটে মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার পোশাক?’
‘একই। প্যান্ট-সার্ট।’
‘বেশ। তাকে জানাও আমার সাক্ষাৎ পেতে হলে বাঙালি নারীর পোশাকে আসতে হবে। যা ওর কাছে সুবিধেজনক তা সাধারণ মানুষের প্রিয় নাও হতে পারে।’
সুধাময় বেরিয়ে গেলেন। ছোটে মহারাজ অস্থির হয়ে উঠলেন। লাবণ্য কেন এল? ও কি তাকে ওই প্রশ্ন করবে সেই রাত্রে যার উত্তর দেওয়া হয়নি? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি তার কি জবাব দেবেন? ছোটে মহারাজ জানলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকে সামনের চাতাল স্পষ্ট দেখা যায়। সুধাময় ও লাবণ্য কথা বলছে। লাবণ্যকে আরও কৃশ আরও মলিন দেখাচ্ছে। মাথা নাড়ল লাবণ্য। একবার ওপরের দিকে তাকাল। না, সে দেখতে পায়নি তাঁকে।
তারপর ধীর পায়ে চলে যেতে লাগল ফটকের দিকে। ছোটে মহারাজের বুকের ভেতর একটা বাষ্প জন্মাচ্ছিল। তিনি আশা করছিলেন লাবণ্য নিশ্চয়ই আর একবার পিছু ফিরে তাকাবে। লাবণ্য তাকাল না।
***