৬
লাবণ্য মাথা নাড়ল, ‘এটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি কেন কথা বলতে যাব?’
‘দেখুন আমার ধারণা আপনার কথা উনি শুনবেন?’
‘কি করে আপনার এমন ধারণা হল?’
‘আপনার আগে কোন নারী ওঁর জীবনে আসেনি।’ সুধাময় সতর্ক হয়েই বললেন। লাবণ্য বুঝতে পারল তার মুখে আচমকা রক্ত জমছে। সেটা কাটাতেই সে যেন রুক্ষ হল, ‘আপনি আমাকে অত্যন্ত অভদ্র ইঙ্গিত করছেন। যান, এখান থেকে চলে যান।’
এই সময় একটি বাস এসে দাঁড়াল। সুধাময় দেখলেন মেয়েটি সেই বাসে উঠে বসল। এদিকের বাসের সঙ্গে চক্রধরপুর লাইনের বাসের কোন তফাত নেই। কিন্তু ভিড় ঠেলে উঠতে মেয়েটির কোন জড়তা দেখা গেল না। সুধাময় ফিরে গেলেন চায়ের দোকানে। দোকানদার ইতিমধ্যে যেন কিছুটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে। সুধাময় তাকে এই অঞ্চলের নানান বিষয়ে এর মধ্যে প্রশ্ন করে ফেলেছেন। জি এন এল এফদের বিষয়েও। আজকাল ছটার পর হাইওয়ে দিয়েও কেউ গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না। হ্যামিলটনের মজুমদার টকিস্ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বীরপাড়াতেই বেশ কয়েকটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। এইসব গল্প করে লোকটা এবার সতর্ক হয়েছে। সুধাময় আবার ফিরে আসতে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাসে উঠলেন না?’
‘এত ভিড়, পরের বাসটায় যাব।’ সুধাময় জবাব দিলেন।
‘পরের বাসে এর চেয়ে বেশি ভিড় হবে। ওই দিদি উঠে গেলেন আর আপনি পারলেন না? আপনি তো ওঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন।’
‘উনি অভ্যস্ত। আমার বয়স হয়েছে।’
‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে মালকড়ি আছে। ট্যাক্সিতে চলে যান লঙ্কাপাড়ায়। ট্যাক্সি ডেকে দেব? দিন শেষ হলে ট্যাক্সিও যেতে চাইবে না।’ দোকানদার বেরিয়ে এল।
সুধাময় একটু অসহায় বোধ করলেন। তাঁর সামনে বাসস্ট্যান্ডে গোটা পাঁচেক বাসের কন্ডাক্টর চিৎকার করে বিভিন্ন জায়গার জন্যে যাত্রী ডাকছে। ইউনিস চলে এলে আপাতত কোথাও চলে যাওয়া যেত। হঠাৎ দোকানদার চেঁচাল, ‘এবার বলুন তো আপনার ধান্দাটা কি? সেই দুপুর থেকে বসে এর ওর খবর জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’
সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে গেল। লোকটা স্পাই, ধান্দাবাজ থেকে আরম্ভ করে নানান বিশেষণ বর্ষিত হতে লাগল। সুধাময় এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন যে সাজিয়ে মিথ্যে কথা বলতেও আর পারলেন না। জনতা যখন তাকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে সেই সময় নির্মল ফিরে এল বাসস্ট্যান্ডে। ঝামেলা দেখে সে এগিয়ে গেল। সুধাময় তখন মাটিতে পড়ে গিয়েছেন, এখানকার কেউ কেউ নির্মলকে চেনে, কেউ নাম শুনেছে কিন্তু অনেকেই চিনতো বা জানতো না। ভিড় সরিয়ে কোনমতে সুধাময়ের সামনে পৌঁছে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল সে, ‘কি হয়েছে? এঁকে মারছেন কেন?’
দোকানদার নির্মলকে দেখেছে আগে, পরিচয় নেই, গলা নামিয়ে বলল, ‘আরে এই লোকটা দুপুর থেকে কেবল এর ওর খোঁজ-খবর করছে। পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে বলছে না।’ নির্মল দেখল সুধাময়কে। বীরপাড়ায় নামামাত্র এই ভদ্রলোক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন। অবশ্যই বাবার শিষ্য এবং সম্ভবত পুলিশের লোক। সে সুধাময়কে বলল, ‘উঠুন আপনি।’ তারপর জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একে আমি অল্প অল্প চিনি। ওঁকে নিয়ে আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। উনি খুব খারাপ লোক নন বলে মনে হচ্ছে।’
সুধাময় কিঞ্চিৎ আহত হয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে কাছাকাছি একটা ডাক্তারখানায় গিয়ে ওষুধপত্র লাগালো নির্মল। এবং তখনই ইউনিসকে দেখতে পেল। বুঝতে পারল এই দুজনের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে। নির্মল বলল, ‘এবার চলে যান আপনারা।’
সুধাময় মরীয়া হয়ে বলে ফেললেন, ‘ছোটে মহারাজ, আপনাকে ফিরিয়ে নিতে না পারলে হয়তো আশ্রম আমাদের ত্যাগ করবে। আর আশ্রমের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলে ব্যবসা মাথায় উঠবে। একটাও কেস পাবো না আমি।’
ইউনিস বলল, ‘আপনাকে পাচ্ছি না বলে এর মধ্যেই বাবা বোধহয় বিরক্ত হয়েছেন। আমি কিছু দুনম্বরী কারবার করলেও বাবাকে ভগবানের মত ভক্তি করি। কিন্তু আপনাকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে ফেল করছি বলে পুলিশ এরমধ্যেই আমার পেছনে লাগতে শুরু করেছে। আমি মরে যাব ছোটে মহারাজ।’
ওরা বাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। সুধাময়কে নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা এখানে কোথায় উঠেছেন?’
সুধাময় বললেন, ‘জলপাইগুড়ির একটা হোটেলে জিনিসপত্র রেখে এসেছি।’
‘আমাকে খুঁজে বের করতে আপনাদের বাবা কাগজে বিজ্ঞাপন বা পুলিশকে দায়িত্ব দেননি কেন বলুন তো? আমি তো তাই আশা করেছিলাম।’
‘বাবা ব্যাপারটা গোপন রাখতে চান। অবশ্য বড় মহারাজ আর আপনাকে খুঁজে বের করতে চান না। কিন্তু আমাদের মনে হয় বাবা চাইছেন!’
‘বড় মহারাজ আর আমাকে খুঁজতে চান না? কেন?’
‘সেটা আমাদের জিজ্ঞাসা করবেন না।’
নির্মলের মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ‘আর আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। শেষ বাস এখনই ছাড়বে। নমস্কার।’ আর কথা না বাড়িয়ে সে চলে এল বাস স্ট্যান্ডে। ভিড বাসটা দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখতে পেয়ে কন্ডাক্টর ড্রাইভারের পাশেব দরজা খুলে দিল। সেখানে অবশ্য কিছু লোক রয়েছে তবু কোনমতে বসা যায়। চলন্ত বাসে বসে নির্মল হেসে ফেলল নিজের মনে। বড় মহারাজের সিংহাসন অধিকারের পথে এখন মাত্র একটাই কাঁটা। মেজ মহারাজ। অবশ্য তিনি কখনও বাধা হয়ে উঠবেন না। বাবা যা এক্সপ্লয়েট করেছেন বড় মহারাজ সিংহাসনে বসলে সেটা দ্বিগুণ হবে। হঠাৎ পাশে উবু হয়ে বসে থাকা দেহাতি লোকটা বলে উঠল, ‘দেওতাকা দিল আজ খুশ হ্যায়?’ চমকে উঠল নির্মল। লোকটা তাকে হাসতে দেখেই প্রশ্ন করেছে। সে মাথা নেড়ে আর একবার হাসল। রোদ নেই। দুপাশের চা বাগানে হু হু করে ছায়া নেমে আসছে। কিন্তু যাত্রীবোঝাই বাসটায় কোন মানুষের শব্দ নেই। নিরাপদে ঘরে ফেরার জন্যে সবাই কাঁটা হয়ে রয়েছে। নির্মলের সামনে বসা লোকটা হঠাৎ তার পা জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠে তার হাত জোর করে ছাড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল?’
‘মেরা লেড়কাকো জলপাইগুড়িসে চালান কর দিয়া, দেওতা। থানাকো বড়বাবুকো কিতনা বোলা, নেহি শুনা। তুম বাঁচাও দেওতা।’ লোকটা ডুকরে উঠল।
‘কি করেছে তোমার ছেলে?’
‘চা পাতি লেকে নিকালা থা গোদামসে।’
‘কোন বাগান?’
‘লঙ্কাপাড়া।’
‘অন্যায় করলে তো শাস্তি পেতেই হবে। তবে এই অন্যায়ের জন্যে বেশিদিন জেলে থাকবে না ও। চাপাতা চুরি করতে গেল কেন তোমার ছেলে?’
‘ঘরমে চাপাতি নেহি থা। হামলোগ বাগানসে পাতি তুলতা হ্যায়, গোদামমে কাঁচা পাতি পাকা করনে কো কাম হামলোগ করতা হ্যায়, বাকি থোড়াসে পাতি ঘরমে লিয়া, কিউ জেল হোগা? লোকটার চোখে মুখে অভিযোগ, ‘ওই শালা গোদাম জ্বালা দেনেকে ঠিক হ্যায়।’
‘তারপর খাবে কি? তুমি কাজ করো না?
‘নেহি। বুড্ডা হো গিয়া, কাম ভি খতম হো গিয়া।’
নির্মল লোকটার হাড়-জিড়জিড়ে শরীরটা দেখল। কয়েকপুরুষ আগে রাঁচী হাজারিবাগ অঞ্চল থেকে এরা এসেছিল এখানে খাবাবের সন্ধানে চা বাগানের কাজে। এখনও সেই সন্ধান শেষ হয়নি, শুধু মাঝখান থেকে সেই দেশটাই হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর সমস্যা সমাধান করার কোন ক্ষমতা তার নেই। তাছাড়া সে ঠিক করেই নিয়েছে কোথাও কোন অন্যায় সুবিধে আদায় করতে যাবে না। এই কারণে তাকে একটা টিউশানি ছেড়ে দিতে হয়েছে। এলাকার বিখ্যাত টিম্বার মার্চেন্টের ছেলেকে সে পড়াত। ভদ্রলোক তার গোদামে নিজেই আগুন ধরিয়ে জি এন এল এফের ওপর দায় চাপিয়ে ইন্সুরেন্স থেকে টাকা আদায়ের ফিকিরে ছিলেন। প্রতিবাদ করেছিল নির্মল। ভদ্রলোক তাঁর পক্ষে সাক্ষী দেওয়ার জন্যে যে অনুরোধ করেছিলেন তা রাখতে পারেনি সে। ফলে এখন মাত্র দেড়শ টাকায় তার খাওয়া-থাকা চলছে। এখানে ওই টাকাও ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। যদিও এই লাইনের বাসে উঠলে কোন কন্ডক্টর তার কাছ থেকে ভাড়া নিতে চায় না। একটি বাইরের মানুষ এখানে এসে নিঃস্বার্থভাবে গরীবের সেবা করে চলেছে, এই খবরটা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
বাস থেকে নামতেই সন্ধেটা জেঁকে এল। পেছনের দুটো দরজা দিয়ে অনেকেই নামাওঠা করল, নির্মল সেটা লক্ষ করেনি। বুধন নামের একটি বালক ছুটে এসে জানাল, ‘মালবাজারসে দিদি আগিয়া।’ নির্মল ওর তেলচিটচিটে চুলে হাত বোলাল। লাবণ্য হঠাৎ চলে এল কেন? কোন সমস্যা হয়েছে? বেচারাকে অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে ওই এলাকায়। কিন্তু একজন বাঙালি মেয়ে হিসেবে লাবণ্য চমৎকার দৃষ্টান্ত রাখছে। হরিরামের মুদির দোকানের পেছনে আট বাই বারো দরমার দেওয়াল দেওয়া ঘরটি নির্মলের রাত কাটানোর জায়গা। দরজায় তালা থাকে না কারণ চুরি যাওয়ার মত সম্পত্তি কিছু নেই। উল্টোদিকে, হরিরামের মুদিখানায় দিনভর বিক্রি দেড়শটাকার বেশি হয় কিনা সন্দেহ। হরিরাম তাকে বলেছে মাস গেলে হাজার টাকা রোজগার হয়। ওই পেছনের ঘরে একসময় হরিরাম থাকত। কিন্তু বউ বাচ্চা মুলুক থেকে এসে যাওয়ায় অন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। হরিরামের দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে জমিয়ে গল্প করছিল লাবণ্য। তার শ্রোতার দলে যেমন মদেশিয়া নারীপুরুষ রয়েছে তেমনি নেপালিরাও। নির্মলকে হরিরামের হ্যাজাকের আলোয় দেখতে পেয়ে সে হাত তুলে একটু অপেক্ষা করতে বলল। তারপর শ্রোতাদের দিকে ফিরে কথা শেষ করল, ‘এদিকে বাঙালিবাবুরা তোমাদের থেকে বেশি রোজগার করে। তা ঠিক। কিন্তু একটা বাঙালি পরিবারে একজন রোজগার করে, দশজন খায়। আর তোমরা দশজনের পরিবার হলে নজন রোজগার কর। মাসের শেষে ওদের অবস্থা তোমাদের চেয়ে মোটেই ভাল নয়। তোমাদেরটা যে ভাল তাও বলছি না। এখন কথা হল রোজগার বাড়াতে হবেই। মালিককে যদি বল মাইনে ডাবল করে দাও তো সে ফ্যাক্টরি লকআউট করে দেবে। তাতে তোমাদের ক্ষতি। আমি আমার ওখানকার জি এন এল এফ নেতাদের রোজ বলি, তোমরা আন্দোলন কর কোন আপত্তি নেই, কিন্তু গরীবমানুষগুলোর রোজগার বন্ধ করে দিও না।’
কেউ একজন বলল, ‘দেওতা এখানে আসার পর আর কোন বাংলোয় আগুন ‘জ্বলেনি।’
লাবণ্য বলল, ‘কিন্তু কিছুদিন আগে এখানে একটা বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে।’
একজন নেপালি বলল, ‘ওই শালা বাসের মালিক পুলিশ নিয়ে গাড়ি চালাত।’
‘কিন্তু বাস পুড়িয়ে তোমাদের কি লাভ হল? একটা বাস কমে যাওয়া মানে রোজ কমপক্ষে দুশ মানুষ যাতায়াত করতে পারবে না।’ লাবণ্য উঠে দাঁড়াল। লোকগুলো ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘কি খবর বল?’
‘নাথিং।
কেন্দ্রীয় কমিটিকে তিন তিনটে চিঠি পাঠিয়েছি। নো রিপ্লাই।’
‘টাকা চেয়ে পাঠিয়েছ নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ।’
‘ওইটেই বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু খাবে?’
‘খুব খিদে পেয়েছে।’
নির্মল হরিরামকে বলল, ‘এক টাকার মুড়িতে একটু তেল ছড়িয়ে দিন তো।’ তারপর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা কেউ মুড়ি খাবে?’
লাবণ্য অবাক হয়ে দেখল, মানুষগুলো সবাই একসঙ্গে মাথা নেড়ে না বলল। নির্মল হাসল, ‘ওরা খুব ভাল মানুষ। আমার কাছে যে বেশি পয়সা নেই তা ওরা জানে।’
জনতাকে পেছনে রেখে নির্মল নিজের ঘরে ঢুকে কুপি জ্বাললো। এই অঞ্চলে কুপিকে বলে ঢিবরি। এই কয়মাসে নির্মলের সম্পত্তি বেশি বাড়েনি। ঘরের একপাশে মাটিতে বাঁশ পুঁতে তার ওপর তক্তা ফেলে সুন্দর শোওয়ার জায়গা করা হয়েছে। ওপাশে মুখোমুখি ছোট ছোট বাঁশের দুটো বেঞ্চি। লাবণ্য খাটের ওপর উঠে বসতেই মুড়ি পাঠিয়ে দিল হরিরাম এক বালকের হাত দিয়ে। লাবণ্য তাকে কিছুটা দিতে চাইল কিন্তু সে নিল না। সে চলে গেলে লাবণ্য নির্মলকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমিও নিতে অস্বীকার করবে?’
‘মাথা খারাপ! আজ সকাল থেকে শুধু চা গিলে যাচ্ছি।’
মুড়ি দু’ ভাগ করে লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, ‘সকাল থেকে খাওনি?’
‘না। আসলে রোজ রাত্রে রান্না করি। ভাত আলু সেদ্ধ, ঢ্যাঁড়স সেদ্ধ,কখনও ডিমসেদ্ধ। বেশি করে করি যাতে সকালেখেতে পারি।’
‘ভাল।’
‘ওভাবে বললে কেন?’ নির্মল হাসল, ‘অভ্যেস হয়ে গেলে সব কিছু মানিয়ে যায়।’
‘আমার কথা মনে পড়ে না?’ চোখ না তুলে জিজ্ঞাসা করল লাবণ্য।
‘পড়ে।’
এইসময় দরজার বাইরে মানুষের কথাবার্তা শোনা গেল। নির্মল বেঞ্চিতে বসেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কে ওখানে? ভেতরে আসুন।’
দরজা খোলাই ছিল। সুধাময় সেন এবং তাঁর পেছনে ইউনিস হাত জোড় করে সেখানে এসে দাঁড়াল। নির্মল কিছু বলার আগেই লাবণ্য প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি এখানে?
সুধাময় বললেন, ‘না এসে পারলাম না। ছোটে মহারাজ, আমাদের ক্ষমা করুন।’
‘কিসে এলেন বীরপাড়া থেকে?’ নির্মল অবাক।
‘আপনি যে বাসে এসেছেন সেই বাসেই।’
‘অত ভিড়ে উঠতে পারলেন?’
‘উঠতে হল। প্রাণের দায়।’
‘প্রাণের দায়? কার জন্যে ভয় পাচ্ছেন? কি করতে পারেন আপনাদের বাবা?’
‘আপনি তো জানেন। উনি কিছুই করবেন না। সেটাই আমার সর্বনাশ ডেকে আনবে।’
‘আপনাকে আমি তখন স্পষ্ট বলে দিয়েছি যে, আশ্রমের ব্যাপারে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। ধর্মের নামে মানুষকে শোষণ করার কাজে সাহায্য করতে চাই না আমি।’
সুধাময় জবাব দিলেন না। তাঁর চোখ এই ঘর এবং দুজনের সামনে রাখা কাগজের ঠোঙার ওপর ঘুরছিল। এটাকে কি একধরনের সন্ন্যাস বলা যায়? ওই প্রাচুর্য ছেড়ে এই রিক্ততায় চলে আসা কোন সুখের জন্যে? মানুষ বৈভব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয় ধর্মের আকর্ষণে। আর ধর্ম ছেড়ে মানুষ যখন পথে নামে বেগার খাটতে তখন তাকে কি বলে? সুধাময়ের মত দুঁদে পুলিশ অফিসারের চোখেও জল এসে গেল।
নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি নিজে কি করেন?’
‘এককালে পুলিশে চাকরি করতাম। এখন প্রাইভেট ইনটেলেজিন্সি কোম্পানি খুলেছি।’
‘আপনার সাহস তো খুব। পুলিশে ছিলেন জানলে এখানে বিপদে পড়বেন।’
‘জানি। কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসতেই হল।’ সুধাময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমরা একটু বসতে পারি? ইনি ইউনিস, বাবার ভক্ত।’
‘বসুন। নাম শুনে মনে হচ্ছে আপনি মুসলমান। বাবার শিষ্য হলেন— ‘ ইউনিস বাধা দিয়ে বলল হাত জোড় করে, ‘না, না। আমি শিষ্য নই। কিন্তু ওঁর ভক্ত। ওঁর কাছে জীবনে অনেক উপকার পেয়েছি যার জন্যে জান দিতে আমার আপত্তি নেই।’
‘বীরপাড়ায় ফেরার কোন বাস আর নেই। এখানে কোথায় থাকবেন?’ সুধাময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাছাকাছি কোন রেস্টহাউস নেই?’
‘ছিল। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।’
নির্মল দেখল কথাটা শুনে দুজনে দুজনের মুখ দেখলেন। সে স্পষ্ট বলল, ‘দেখুন, আমি জেনে শুনেই আশ্রমের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেছি। আমি একটা সমাজ চাই যেখানে ধর্মপ্রচারক এবং রাজনৈতিকদের শোষণ থাকবে না। এতদিন যাদের আমরা শোষক বলে জেনে এসেছি সেই ব্যবসায়ীরা আসলে ওই দুই সম্প্রদায়ের হাতের পুতুল। এ দেশের যা অবস্থা তাতে আমাদের ভাবনার বাস্তব রূপ পেতে দীর্ঘসময় লাগবে। কিন্তু আমি হাল ছাড়ব না। ধরুন এখানে বিখ্যাত এক কমরেড বক্তৃতা দিতে এলেন। এবং সেই দিন একই সময়ে এক মাইল দূরে মির্যাকল্ দেখাতে সক্ষম এক ধর্মগুরু সভা করছেন। পার্সেন্টেজ অফ দর্শক কমরেডের সভায় হাস্যকর ভাবে কম হবে। চল্লিশ বছর ধরে এদেশে যাঁরা রাজনীতি করছেন তাঁরা তাদের মতবাদে সাধারণ মানুষ শতকরা পাঁচভাগকেও বিশ্বাস করাতে সক্ষম হননি। কারণ তাঁদের মতবাদ যতই শ্রদ্ধাই হোক না কেন, তাঁদের কথাবার্তা, সুবিধেমত নিজেদের চেহারা পরিবর্তন করা এবং কাজ এবং কথার ব্যবধান সাধারণ মানুষকে দলে টানতে পারেনি। আর ধর্মগুরুদের কাছে মানুষ যায় ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। বাবার শিষ্য হয় কারণ আশ্রমে এলে এমন গুরুভাই-এর সান্নিধ্য পাবে যার কাছে এমনিতে পৌঁছানো অসম্ভব। স্বার্থসিদ্ধি না হলেই তারা সরে আসে। আমরা এই দুই ভ্রান্তি থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চাই।’
সুধাময় মন দিয়ে শুনছিলেন। তিনি আর ইউনিস এখন বেঞ্চিতে নির্মলের মুখোমুখি বসে আছেন। নির্মলের কথা শেষ হলে বললেন, ‘আপনার বিশ্বাস সত্য হলে বলব আপনি ভুল করছেন। সহজ পথ, যা কিনা একমাত্র আপনার পক্ষেই পাওয়া সম্ভব, ছেড়ে জটিল পথ ধরছেন। আমরা প্রায় পাঁচ কোটি শিষ্য বাবার মুখ চেয়ে আছি। আশ্রমে থেকে আপনি এতগুলো মানুষকে নিজের মত চালনা করার সুযোগ পেতেন!’
নির্মল হো হো করে হেসে উঠলেন, ‘বাবা, বড় মহারাজ আমাকে ওসব করতে দেবেন? জানেন না, রাজনীতিকের চেয়ে ধর্মগুরুরা বহুগুণ নিষ্ঠুর!’
‘আপনি সবাইকে এক জায়গায় বসাচ্ছেন কেন?’
‘না। আমি তা করছি না। খুব কম ধর্মগুরুই মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের সন্ধান করেন। সেই সন্ধানের নামই ধর্ম। আপনাদের আশ্রমে সেই সন্ধানের কোন বালাই নেই।’
‘কিন্তু হতে তো পারে। বাবার বয়স হয়েছে। তিনি বলেন প্রকৃতির নিয়মে তাঁকেও চলে যেতে হবে।’
‘আর একজন, বড় মহারাজ তখন বাবা হয়ে বসবেন। তিনি গেলে মেজমহারাজ আছেন।’
‘মেজ মহারাজ না থাকলে?’ সুধাময় হাসলেন।
‘কি বলতে চান?’ নির্মল তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
‘সমস্ত কিছু কি এক হিসেবে চলে? তিনুমহারাজ কত প্রতাপশালী ছিলেন। তিনি আজ মৃত। ধ্যানেশকুমারকে সবাই বাবার এক পুত্র বলে জানত। তিনি আশ্রম থেকে বিতাড়িত হয়েও আততায়ীর হাতে মারা গেলেন। অন্যান্য সংগঠনগুলো বাবার ক্ষমতা খর্ব করতে সক্রিয়। আমি জানি না, বাবা বড় মহারাজের ওপর কতটা আস্থা রাখেন। কারণ রাজ্যমন্ত্রী কিংবা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী যখন বাবাকে দর্শনের জন্যে যান তখন সেখানে বড় মহারাজ ছিলেন না। আমরা এও শুনেছি যে বাবা বগলাচরণ সেনগুপ্তকে আশ্রমে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।’
‘তিনি কে?’
‘হাইকোর্টের বিখ্যাত উকিল।’
‘কেন?’
‘তা জানি না।’
‘আমাকে নতুন কিছু শোনাবেন না আর কারণ তার কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। আজ রাত্রে এই ঘরেই থাকুন আপনারা। কারণ কয়েক মাইলের মধ্যে কোন থাকার জায়গা নেই। আমি আপনাদের এই রাতে বের করে দিতে পারছি না। তবে কাল ভোরের প্রথম বাসেই দয়া করে ফিরে যাবেন।’
‘বেশ। কিন্তু আমরা এখানে থাকলে আপনাদের কোন অসুবিধে হবে না তো?’
‘অসুবিধে মানে?’ নির্মল মুখ তুলল, ‘ও, লাবণ্য আছে বলে কথাটা বললেন? লাবণ্য আমার মতই একজন কর্মী। ও এরকম পরিবেশে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার কাছে যে বাসন আছে তাতে চারজনের ভাত হবে না যে। ‘
লাবণ্য ঠোঁট কামড়াল। কি সহজে নির্মল লোকদুটোকে এখানে থাকতে বলল। অথচ সে মনস্থির করে আজ এখানে এসেছিল। সেই বয়সটায় পৌঁছনোর পর থেকেই সে কেবল ছেলেদের চোখে মুগ্ধতা দেখে এসেছে। বেশির ভাগই অবশ্য সাহস পায়নি সেটা মুখে বলতে। হয়তো তার ছেলেমি চালচলন, কথাবার্তা, সাজগোজ দেখে শেষপর্যন্ত সামলে নিত সবাই। শাড়ি ইচ্ছে করেই পরত না লাবণ্য। কারণ দেখেছে সে শাড়ি পরলেই ছেলেদের মানসিক দূরত্বটা চলে যায়। এমন কি কানাই পর্যন্ত প্রথম দিকে নরম হয়ে যাচ্ছিল। লাবণ্য তাকে পরিষ্কার বলেছিল, ওসব ভাবনা মাথায় না রাখাই ভাল। তাছাড়া প্রেমিক হিসেবে কানাই তার পছন্দসই নয়, বন্ধু হিসেবে অনেক বেশি গ্রহণীয়। কানাই বুঝেছিল। কিন্তু নির্মলের সঙ্গে এতদিন একসঙ্গে থেকে লোকটার ব্যবহার পরিবর্তিত হতে দ্যাখেনি সে। নির্মলকে শালগ্রামশিলা বলে ভাবতেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু কিছুদিন থেকেই নির্মলের কথা মনে হলেই নিঃশ্বাস ভারি হয়ে বুক টনটনিয়ে ওঠে। অনেক লড়াই করেছে ওই বোধের সঙ্গে। ব্যাপারটা মন যেভাবে নিচ্ছে তা এই অবস্থায় কখনই অভিপ্রেত নয়। অথচ একা হলেই কেবলই মনে হয় নির্মল কি ইচ্ছে করেই নির্লিপ্ত হয়ে আছে। দেশবিখ্যাত বাবার সন্তান হয়ে এতকাল বড় হয়েছে যে ছেলে, যার জীবনে কোন নারী আসেনি কখনও যে আশ্রমজীবনের বাইরে এসে নাগরিকজীবনে মিশে গিয়েও যখন নিজেকে সংযত করে রাখে তখন তার ওপর শ্রদ্ধা আসেই। কিন্তু সবটাই কি অভ্যেসজাত সংযম? নাকি কোথাও অভিনয় করে নিজেকে ঠকানোর চেষ্টা আছে? লাবণ্য ঠিক করেছিল আজ রাত্রে নির্মলের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রশ্ন করবে। কিন্তু নির্মল যেভাবে এই লোকদুটোকে থাকতে বলল তাতে আর ওসব চিন্তা মাথায় রাখার উপায় রইল না। বীরপাড়ায় ওই লোকটা তাকে যে ইঙ্গিত দিয়েছে তারপরে এখন সে আর আপত্তি তুলতেই পারে না।
সুধাময় চারপাশ দেখছিলেন। ইউনিস বলল, ‘ছোটে মহারাজ, যদি অপরাধ না নেন তো বলি, আমাদের জন্যে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। এখানকার রাস্তা দিয়ে রাত্রে ট্রাক যায় না?’
‘আগে যেত। এখন সন্ধের পর সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’
‘পুলিশের গাড়ি?’ প্রশ্নটা সুধাময় করলেন।
‘কনভয় আসে টহল দিতে। কিন্তু কোন সময় বাঁধা নেই।’
‘ওপাশের চা বাগানের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বললে তিনি সাহায্য করতে পারেন?’
‘ইচ্ছে করলে পারেন। তবে সেটা আপনাদের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে। আমাকে দেখলে হিতে বিপরীত হবে। মাইলখানেক হেঁটে যেতে পারলে—। মনে হচ্ছে এই ঘরের আরাম আপনারা পেতে চাইছেন না। আসুন আমার সঙ্গে।’ নির্মল কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুধাময় এবং ইউনিস ওকে অনুসরণ করল। মুদির দোকান তখন বন্ধ হচ্ছে। হঠাৎ গোটা ছয়েক লোক যেন অন্ধকার ফুঁড়ে উদয় হল। ওদের দেখে যারা তখনও দোকানের সামনে বসে ট্রানজিস্টর শুনছিল, তারা হাওয়া হয়ে গেল। ছয়জনের দুজন রাস্তার দিকে মুখ করে পজিশন নিল। তাদের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। চারজন দোকানদারকে বলল, ‘চাল আর আটার বস্তা কোথায়? দোকানদার ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘মর যায়েগা, হাম মর যায়েগা।’
‘চোপ। শালা কুত্তা।’ দোকানের ভেতর দুজন ঢুকে গেল।
নির্মল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল। সে ইশারা করল সুধাময়দের সরে যেতে। তারপর এগিয়ে গেল আলোয়। লোকগুলো তাকে দেখল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পোশাক মলিন। দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত খাওয়াদাওয়া হয় না। কাছের ভুটানের পাহাড়ে এরা পুলিশের তাড়া খেয়ে লুকিয়ে থাকে দিনভর। মাঝে মাঝে রাত্রে বেরিয়ে এসে আন্দোলন এবং লুটপাট করে। নির্মল মাথা নাড়ল। যে লোকটাকে ওদের নেতা মনে হল তাকে বলল, ‘দাজু, ইউ রামরো ছইনা।’
লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। ওর হাতে রিভলভার। নির্মল হাসল, ‘প্রধানদাজু মেরো দোস্ত ছ।’ পাশে দাঁড়ানো লোকটা নেতাকে বলল, ‘দেওতা! রামরো আদমি ছ।’
নেতা চিৎকার করল, ‘ক্যা বোলতা তুম?’
নির্মল আবার হাসল, ‘আজ তুমলোগ ইয়ে মাল লে যানেসে কাল দোকান বন্ধ হো যায়েগা। সারে লাইনকো আদমি ভুখা মরেগা। ইহাঁ মদেশিয়া যিতনা হ্যায় নেপালি হ্যায় উসকো ডাবল। আপনা জাতভাইকো মুস্কিলমে গিরা দেতা হ্যায় আপলোগ।’ লোকটা একটু অন্যমনস্ক হল যেন। আর তখনই পাহারাদারদের একজন চিৎকার করে উঠল, ‘কনভয়!’ সঙ্গে সঙ্গে ছটা লোক দোকান ছেড়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। দোকানদার তখনও থরথর করে কাঁপছে। পুলিশের টহলদারি জিপগুলো সামনের রাস্তায় ব্রেক কষল। একটি গলা চিৎকার করল, ‘সব ঠিক হ্যায়?’
নির্মল জবাব দিল, ‘ঠিক হ্যায়।’ জিপগুলো বেরিয়ে গেল।
তখনও আটার বস্তাটা দোকানের সামনে নামানো। নির্মল দোকানদারকে বলল, ‘ওদের দশ কেজি আটা কিংবা চাল দিয়ে দাও।’ দোকানদার বলল, ‘উনলোগ ভাগ গিয়া?’ আর তখনই অন্ধকার কুঁড়ে ওরা ফিরে এল। নেতা নির্মলকে বলল, ‘শুক্রিয়া। হামলোগ ভূখা হ্যায়। কুছ খানে দেও।’
দোকানদার ততক্ষণে দশ কেজি চাল আর আলু প্যাকেট করে এগিয়ে দিয়েছে। নেতা বলল, ‘ইসমে ক্যা হোগা। ষাট রুটি আউর সবজি বানাও। হামলোগ এক ঘণ্টাকা বাদ আয়েগা।’ ওরা চলে যাচ্ছিল। নির্মল পেছন থেকে ডাকল, ‘শুনিয়ে। ইনলোগ মেরা দোস্ত হ্যায়। ম্যানেজারকো কুটিমে যানে মাংতা।’
লোকটা বলল, ‘আইয়ে।’ সুধাময় তখন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আচমকা ব্যাপারটা হতে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। নির্মল বলল, ‘যান। কোন ভয় নেই। এখনও এখানে বেইমানিটা চালু হয়নি তেমন করে।’ প্রায় বলির পাঁঠার মত ইউনিস সুধাময়ের সঙ্গে ওদের অনুসরণ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে দোকানদাব ছুটে এসে নির্মলের দুই হাত জড়িয়ে ধরল, ‘আপ দেওতা হ্যায়। মুঝে বাচায়া আপনে। হনুমানজী আপকো ভালা করেগা।’
নির্মল বলল, ‘ঠিক আছে। এখন দোকান বন্ধ করে ওদের জন্য রুটি তরকারি তৈরি করে আন। অনেক কমে হয়ে গেল।’
দোকানদার মাথা নাড়ল। ‘জী। দেওতা, আউর এক বাত হ্যায়। আপ আজ মত পাকাইয়ে।’
নির্মল হাসল, ‘আমার কাছে এক অতিথি আছে যে।’
‘দিদিভি মেরা মেহমান আজ। ব্যস।’ লোকটা চলে গেল দোকান বন্ধ করতে।
নির্মল আবার ফিরে এল পেছনের ঘরে। এসে দেখল লাবণ্য তার তক্তাপোশের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আছে চোখে হাত চাপা দিয়ে। ওর জন্যে যে মুড়ি আনানো হয়েছিল, তা আধখাওয়া হয়ে পড়ে রয়েছে। ঘুমন্ত মানুষকে ডাকা উচিত নয় ঠিক করে নির্মল বাঁশের বেঞ্চিতে বসে নিজের মুড়ি এক মুঠো তুলে মুখে দিতেই বুঝতে পারল এরই মধ্যে কিছু মিইয়ে এসেছে। মুড়ি চিবোতে চিবোতে সে অন্যমনস্কভাবে সুধাময়ের কথা ভাবতে শুরু করল। রাত আটটার সময় দুজন অজানা লোককে চা বাগানের ম্যানেজার আতিথ্য দেবেন কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যদি সুধাময় তার পুরোন এবং বর্তমান পরিচয়পত্র দিতে পারেন তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। লোকদুটো কোন স্বার্থে এত কষ্ট করে এখানে এসেছে বোধগম্য হচ্ছিল না। যদি বাবার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবার আশঙ্কাই বড় হয়ে থাকে ওদের কাছে, তা হলে বলতে হবে বাবার ক্ষমতা আরও প্রবল হয়েছে। কিংবা এমনও হতে পারে সেটা ছিলই, সে-ই জানত না। ওরা ফিরে গেলে বাবা জানতেই পারবেন তার অস্তিত্বের কথা। তখন কি তিনি তাঁর অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে তাকে আশ্রমে টেনে নিয়ে যাবেন? নির্মলের সেটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। স্নেহ-ভালবাসা যে মানুষের জীবনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেই, নিজের তৈরি আদর্শে যাঁর আস্থা প্রবল তিনি কিছুতেই বদনামের ঝুঁকি নিতে পারেন না।
কিন্তু সুধাময় তাকে আর একটা কথা বলেছে। বাবা বেঁচে থাকতেই কি তাঁর সিংহাসন নিয়ে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে? বড় মহারাজ তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছেন। মেজ মহারাজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। পাঁচ কোটি মানুষের অধিকার অর্জন করার জন্যে বড় মহারাজ এখন ব্যগ্র। অথচ এই পাঁচ কোটি মানুষকে যদি সামাজিক সচেতন করা হত, যদি তাদের মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা হত তাহলে আখেরে দেশেরই লাভ হত। হঠাৎ একটা বিদ্যুতের ঝলকানি যেন নির্মলের মস্তিষ্কের কোষে কোষে আলো ফেলল। কেবলমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা এই কাজ করতে পারেন না। কারণ তাঁর ওপর জনসাধারণের ভক্তি নেই, আস্থা নেই। হয়তো সাময়িক বিশ্বাস আছে। অন্যদিকে একজন ধর্মগুরু ভক্তি এবং আস্থার অধিকারী হয়েও কাজটি করতে পারবেন না কারণ মানুষ তাঁকে ওই ভূমিকায় দেখতে অভ্যস্ত নয়। তিনি তাঁর জীবনযাত্রাই বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করে জনসাধারণ থেকে আলাদা হয়ে রয়েছেন চিরকাল। হঠাৎ নির্মলের একটি মুখ মনে পড়ল। চট করে গিয়ে সে তক্তাপোশের ওপর থেকে বইটা তুলে নিয়ে কুপির কাছে চলে এল। দ্রুত আঙুলে পাতা উলটে উলটে আকাঙ্ক্ষিত জায়গায় চলে আসতেই পেছন থেকে লাবণ্য বলে উঠল, ‘হঠাৎ কি পড়তে ইচ্ছে হল?’
নির্মল উদ্বেলিত স্বরে বলল, ‘শোন, পড়ছি। নিখিল আত্মার সমষ্টিরূপে যে একমাত্র ভগবান বিদ্যমান—সেই ভগবানের পূজার জন্য যেন আমি বারবার জন্মগ্রহণ করি, এবং সহস্র যন্ত্রণা ভোগ করি। আর আমার সবাধিক উপাস্য—আমার পাপী নারায়ণ, আমার তাপী নারায়ণ, আমার সর্বজাতির, সর্বজীবের দরিদ্র নারায়ণ।’ নির্মল উঠে দাঁড়াল, ‘লাবণ্য, আমি বিবেকানন্দ পড়লাম। ধর্ম এবং রাজনীতিকে একত্রিত না করলে এদেশের মানুষের মুক্তি অসম্ভব। আমি এ দুটোকে মেলাতে চাই। অধ্যাত্মভিত্তিক ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ নীতিগুলোকে সম্মিলিত করাই এখন একমাত্র প্রয়োজন। আমাকে এটাই করতে হবে।’
লাবণ্য উঠে বসল, ‘কিভাবে?’
বই রেখে দিয়ে দুহাতে মাথার চুল আঁকড়ে ধরল নির্মল, ‘আমি জানি না। এখন পর্যন্ত জানি না। আমরা শরীরের চিকিৎসা করতে চাইছ মন উপেক্ষা করে। কিন্তু মনের শুদ্ধি ছাড়া শরীর কখনই সুস্থ হতে পারে না।’
লাবণ্য এগিয়ে এল, ‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না, নির্মল।’ হতাশায় মাথা নাড়ল নির্মল, ‘আমিও পারছি না। শুধু আমার মনের ভেতর একটা শক্তি উদ্ধত হয়ে বলছে তোমাকে করতেই হবে, করতেই হবে। কিভাবে করব, তা জানি না।’
‘শান্ত হও। এসব নিয়ে আর চিন্তা করো না। ওঠো।’ নির্মলের দুটো হাত ধরল লাবণ্য।
নির্মল মুখ তুলে তাকাল। সহসা দুটো মুখের ছবি ভেসে উঠল লাবণ্যের মনে। যীশুখ্রীস্ট এবং যুবক রবীন্দ্রনাথ। সেই উজ্জ্বল চোখ, কপাল নাকে দুরন্ত জীবন স্থির, দাড়ির আড়ালে প্রজ্ঞার প্রকাশ! লাবণ্য সম্ভবত অবচেতনের ছবির সঙ্গে বাস্তবের মুখটিকে মেলাচ্ছিল, নির্মল হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল তোমার?’
‘কিছু না। বইটা দাও।’
বিবেকানন্দের বইটি তুলে দিল নির্মল। লাবণ্য সেটিকে যথাস্থানে রেখে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা হল?’
নির্মল বলল, ‘ওঁরা ম্যানেজারের বাংলোয় গিয়েছেন। বড়দা চান না আমি ফিরে যাই, বাবার মন বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এঁরা এসেছেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নিজেদের তাগিদে। ছেড়ে দাও এসব কথা। তোমার ওখানে কাজকর্ম কেমন এগোচ্ছে?’
হচ্ছে। খুব আশাপ্রদ নয়। কোথাও একটা গলদ থেকে যাচ্ছে। প্রথম থেকেই লোকে সন্দেহ করছে। স্বাধীনতার একচল্লিশ বছরে কেউ তো স্বার্থহীন হয়ে মানুষের জন্যে কিছুই করেনি। সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। দুটো বড় পার্টিও আমাকে মেনে নিতে পারছে না। তারা নিশ্চয়ই আমার অতীত খুঁড়েছে। এছাড়া যে সব কাজ শুধু টাকার জন্যে আটকে আছে, সেখানে তো আমিও অসহায়। বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে কিছু কাজ করতে পারতাম কিন্তু সেক্ষেত্রে এরাই প্রশ্ন তুলবে টাকাটা আমি পাচ্ছি কোথায়? ঘরের টাকা নিশ্চয়ই এভাবে পাঁচ ভূতের জন্যে কেউ ঢালে না। তা হলে আমার পেছনে কোন মতলবাজের স্বার্থ কাজ করছে। এদেশে এখনও সি আই এ-র দালাল শব্দটা বেশ কাজ দেয়।
‘এসবই তো আমরা জানতাম।’ নির্মল বলল।
‘জানতাম। থিওরি আর প্র্যাকটিসের মধ্যে পার্থক্য থাকবে না? আমার কেবলই মনে হচ্ছে, পরিচয় গোপন করে নয়, দল নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করুক। নেতারা বলে দিন, আগামী দশ বছর এই দল কোন রাজনৈতিক কাজকর্ম করবে না। দশ বছর ধরে মানুষের সঙ্গে থেকে কাজ করে যাবে। এতে সুবিধে হবে বেশি। চাঁদা তোলা থেকে অনেক কাজ প্রকাশ্যে করতে পারবে। সমাজসেবী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলে রাজনৈতিক দলগুলো উপেক্ষা করতে আরম্ভ করবে। এতে কাজের সুবিধে হবে।’ লাবণ্য গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমি এই প্রস্তাব কলকাতায় পাঠিয়েছি।’
নির্মল চুপচাপ শুনছিল। এইসময় কুপির আলো দপদপ করে উঠল। নির্মল বলল, ‘সেরেছে!’
‘তেল নেই?’
‘না। অবশ্য এটা ওয়ার্নিং। এখনও মিনিট পনের আলো দেবে। ও হ্যাঁ, রাঁধতে হবে না আজ। রুটি তরকারি আসছে। তুমি খেয়েদেয়ে ওই তক্তাপোশে শুয়ে পড়ো। ঘর থেকে বেরিয়ে ডানদিকে একটা শেড আছে টয়লেটের জন্য।’
‘তুমি কোথায় শোবে?’
‘আমি এখানকার মাঠেঘাটে শুতে অভ্যস্ত। চিন্তা করো না।’
লাবণ্য অবাক হল। সে না বলে পারল না, ‘তোমার মনে আছে নিৰ্মল, পালিয়ে আসার পর রিয়াবাড়ি চা-বাগানে প্রথম রাতটা আমরা একসঙ্গেই কাটিয়েছিলাম। তোমার কোন সঙ্কোচ ছিল না। আমরা এক বিছানা ব্যবহার করেছিলাম স্বচ্ছন্দে। সেই মনটা তোমার নষ্ট হয়ে গেল?’
নির্মল মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। এবং তার জন্যে দায়ী সেই রাতটাই।’ লাবণ্যর মনে হল নির্মল তাকে খোঁচা দিল, ‘তার মানে?’ নির্মল বলল, ‘দ্যাখো, আশ্রমে বা কলকাতায় থাকতে কখনই চিন্তা করিনি কোন মেয়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে আছি। এসব ভাবনা আমার মাথায় কখনও আসেনি। মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করার অভ্যেস আমার ছিল না। হয়তো যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেই পরিবেশই এমনটা না ভাবতে শিখিয়েছিল। তাই তোমার সঙ্গে যে রাত্রে এক খাটে শুয়েছিলাম আমার কোন অসুবিধে হয়নি। কিন্তু ওই ঘটনাটার প্রতিক্রিয়া হল পরে। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই, আমি আকর্ষণ বোধ করতে লাগলাম। একা শুলেই তোমার শোওয়ার ভঙ্গী চোখে ভাসতো। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই চলেছে অনেকদিন। এখন আর নিজের ওপর আস্থা নেই আমার।’
‘আমার ওপর তোমার আস্থা নেই?’ লাবণ্য নির্মলের চোখের দিকে সরাসরি তাকাল।
‘তুমিও আজ সেই রাতের লাবণ্য নও।’
‘না, নই। সেই রাত্রে তুমি আমার কাছে গাছ পাথর কিংবা শুধুই একটা মানুষ ছিলে। অথচ তারপর থেকে আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না। নির্মল, আই নিড ইউ এমোশনালি।’
ঠিক এইসময় দোকানদার এসে দাঁড়াল খোলা দরজায়। তার হাতে একটা বড় ঠোঙা আর বাটি। দোকানদার হেসে বলল, ‘উনলোগ খানা লে গিয়া।’
নির্মল এগিয়ে গিয়ে খাবার নিল।
সুধাময় এবং ইউনিসকে ম্যানেজারের গেটে পৌঁছে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল পাহাড়ি মানুষগুলো। গেটের ভেতরে দুজন রক্ষী তখন বন্দুক উঁচিয়ে পাহারায় রয়েছে। গেটে কথাবার্তা শুনেই তারা চ্যালেঞ্জ করল। ইউনিস চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যানেজারসাব হ্যায়?’
‘কৌন হ্যায় আপলোগ?’
‘কলকাত্তাসে আয়া হ্যায়।’
‘গেট খুলকে সিধা আইয়ে।’
ওঁরা হুকুম মান্য করলেন। তারও মিনিট সাতেক বাদে সুধাময় এবং ইউনিস অবাঙালি ম্যানেজারের মুখোমুখি বসেই চমকে উঠলেন। ভদ্রলোকের গলায় যে লকেট ঝুলছে তাতে বাবার ছবি সাঁটা। সুধাময় আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘জয় বাবা!’
ম্যানেজারের মুখের বিরক্তি, সন্দেহ চট করে উধাও হয়ে গেল, তিনিও বললেন, ‘জয় বাবা।’
কলকাতার বাড়িতে এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। বছরে একবার বাবা আসেন কলকাতায়। তিনদিন থাকেন। এই তিনদিন ভক্তদের ভিড়ে সামনের রাজপথে ট্রাফিক বন্ধ হয়ে যায়। নো এনট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। সমস্ত বাড়ির ঝাড়পোঁছের কাজ শেষ। এই বাড়ির চারতলায় ছোটে মহারাজ ছিলেন। তিন এবং চারতলায় কোন সিঁড়ি নেই। তিনতলাটি এয়ারকণ্ডিশন। বাবা ছাড়া কারো পদধূলি সেখানে পড়ে না। আশ্রম থেকে দুজন সেবিকা আসেন বাবার সঙ্গে। অবস্থানের সময় তাঁরাই ফ্ল্যাটটি দেখাশোনা করেন। একতলায় বিশাল উপাসনাগৃহ। কিন্তু বাবা এ বাড়িতে এলে সেটি ভক্তদের চাপে নিতান্তই ছোট হয়ে যায়।
গতকাল বাবা এখানে এসেছেন। সঙ্গে বড় মহারাজ। মেজ মহারাজ আশ্রমের দায়িত্বে রয়ে গিয়েছেন। গতকাল ঘরে ঢোকার পর বাবা আর তিনতলা থেকে বের হননি। আজ সকালে তাঁর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সামনে ভিড় করে থাকা জনতার উদ্দেশে হাত নেড়েছেন একবার। তাঁকে দর্শন করার জন্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পুলিশ এবং সেবকরা ভিড় সামলাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
বড় মহারাজ ইন্টারকমে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন চারতলা থেকে, ‘সুধাময় এবং ইউনিস কলকাতায় নেই। তারা কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারছে না।’
‘সুধাময় যেন এলেই আমার কাছে চলে আসে।’
‘ঠিক আছে। সনাতননাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে যথেষ্ট আগ্রহী। এ ব্যাপারে আপনার কোন আদেশ আছে?’
‘ভেবে দেখছি। ছোটের ঘর ভাল করে দেখেছ?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি এখানে কিছু কাগজপত্র পেয়েছি। রাজনীতি সংক্রান্ত।’
‘রাজনীতি?’ বাবার গলায় বিস্ময়।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এবং বিবেকানন্দের বইপত্তর এবং সেই সংক্রান্ত অন্যান্য আলোচনা গ্রন্থ। দেখতে পাচ্ছি বিবেকানন্দ যেখানে রাজনীতির কথা বলেছেন সেই লাইনের নিচে দাগানো রয়েছে।’ বড় মহারাজ জানালেন।
‘বিবেকানন্দ? আশ্চর্য! বিবেকানন্দের বই কে ওকে যোগান দিল?’
‘তিনু বলতে পারত। সে বেঁচে নেই, জানা যাবে না।’
‘কোন মহিলা সংক্রান্ত কিছু?’
বড় মহারাজ কথা খুঁজে পেলেন না। সঠিক উত্তরটা দিতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু মিথ্যে কথাটা কিভাবে বলা যায়, তা বুঝতে পারছিলেন না।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
‘আপনার পুত্র হয়ে কিভাবে উচ্চারণ করব?’
‘সেকি? ওর ফ্ল্যাটে মহিলা এসেছে নাকি?’
‘না। কিন্তু মহিলাদের অস্তিত্বের প্রমাণ আছে।’
‘হুঁ। শোন। তুমি বগলাচরণকে খবর দেবে যাতে সে আগামীকাল সকালে প্রার্থনার পর আমার সঙ্গে দেখা করে।’ ইন্টারকম-এর সুইচ বন্ধ হতেই বড় মহারাজের মুখে হাসি ফুটল। বগলাচরণ! ইতিমধ্যে তিনি খবর পেয়েছেন বাবা বগলাচরণকে দিয়ে একটা উইল করিয়েছেন। উইলের বিষয়বস্তু এখনও তিনি জানেন না। কিন্তু ওই ব্যাপারে তাঁর মনে অস্বস্তি ছিল। আজ ছোটের কথা শোনার পর বাবা যখন বগলাচরণকে আবার ডেকে পাঠালেন, তখন নিশ্চয়ই ওই উইল বদল করবেন। বড় মহারাজের মনে হল ছোটে সম্পর্কে বাবার যাবতীয় দুর্বলতার আজ অবসান হল। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
তাবৎ ভক্তবৃন্দকে সন্তুষ্ট করতে বাবা তাঁর ব্যালকনি থেকে বিকেলে বক্তৃতা দেবেন। খবর কলকাতা শহরে বাতাসের আগে দৌড়োয়। দুপুর থেকেই লোক জমছে রাজপথে। বিকেলের আগেই কালো মাথায় ভরে গেল চারদিক। এমনকি আশেপাশের সমস্ত বাড়ির জানলা, ছাদ লোকে ঠাসা। তিনতলার ঘরে বাবা স্নান সেরে উঠলেন। সেবিকারা তাঁকে পোশাক পরিয়ে দিল। এরপর বাবা বড় মহারাজকে ডেকে পাঠালেন। তিনতলার ঘরে সাধারণত কারো যাওয়ার হুকুম নেই। কথাবার্তা ইস্টারকমেই হয়ে থাকে। বড় মহারাজ বিচলিত হলেন। দ্রুত লিফটে তিনতলায় নেমে এসে বাইরের ঘরে বাবার সামনে নতজানু হয়ে বসলেন তিনি। বাবা হাসলেন, ‘তোমার ছোটভাই তাহলে অধঃপতিত হয়েছে?সুযোগ ছাড়লেন না বড় মহারাজ, ‘ব্যাপারটা দুঃখজনক কিন্তু প্রমাণিত।’
‘হুঁ! মন আমার ভাল নেই বড়। মেজ মানুষ হিসেবে ভাল, কর্তব্যপরায়ণ কিন্তু ব্যক্তিত্বহীন। আমার অবর্তমানে এত মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা তার নেই। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় এই যোগ্যতা অর্জন করেছ?’ বাবা সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আমি আপনার আদর্শে নিজেকে তৈরি করেছি।’ দীপ্ত স্বরে জানালেন বড় মহারাজ।
‘অর্থাৎ তুমিই প্রকৃত উত্তরাধিকারী, কি বল?’
এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না বড় মহারাজ। সেটা নিজের কাছেই ঔদ্ধত্য বলে মনে হবে।
বাবা বললেন, ‘দেখি, ভেবে দেখি। বগলাচরণ এলে তোমাকে ডাকবো মানুষজন কি এসেছে আমার কথা শুনতে?’
পুলকিত বড় মহারাজ দ্রুত মাথা নাড়লেন, ‘এক লক্ষ মানুষ আগ্রহে অপেক্ষা করছে কোনরকম প্রচার ছাড়াই। তারা আপনার দর্শন চায়।’
‘বেশ, বল।’ বাবা উঠলেন।
‘ছোটের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে?’
‘দেখি, ভেবে দেখি।’
‘যদি আপনি তাকে ত্যাগ করেন, তাহলে সেটা খবরের কাগজ মারফত জানিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। এতে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।’ অত্যন্ত সাহসী হলেন বড় মহারাজ।
‘হুম্।’ বাবা আর কোন কথা বললেন না। ধীরে ধীরে তিনি ব্যালকনির দিকে এগিয়ে এলেন। সেবিকারা সেখানে মাইক চালু রেখেছিল। মানুষের সামান্য কথাই সম্মিলিত হয়ে প্রচণ্ড আওয়াজ তুলছে। বড় মহারাজ আগে এগিয়ে গেলেন ব্যালকনিতে। দুটো হাত ওপরে তুলে সবাইকে ইঙ্গিত করতে লাগলেন শান্ত হতে। তবু কথার আওয়াজ কমল না। শেষে তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, ‘এবার আমাদের পরমপূজনীয় বাবা আপনাদের দর্শন দিতে আসছেন। এই পবিত্র সময়ে আপনারা অবশ্যই নীরবতা অক্ষুণ্ণ রাখবেন।’ কথা শেষ করে বড় মহারাজ দুটো হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকের কাছে রেখে সরে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে বাবা ব্যালকনিতে এসে মাইকের সামনে দাঁড়াতেই সমস্ত কলকাতা যেন হাততালিতে ফেটে পড়ল। সেইসঙ্গে ধ্বনি উঠল, ‘জয় বাবা কি জয়।’ বাবার মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠল। তিনি ডান হাত মাথার ওপরে তুললেন হাস্যমুখে। মানুষজন সেই দৃশ্য দেখে যেন পাগল হয়ে উঠল। কেউ কেউ সাক্ষাৎ ভগবানকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এক বৃদ্ধ সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাবা, দয়া কর, দয়া কর।’ বাবা ধীরে ধীরে তাঁর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ঈষৎ। তাঁর মুখ থেকে হাসি সরছিল না। তিনি হাত নেড়ে সবাইকে শান্ত হতে ইঙ্গিত করলেন। তাঁর হাতের মুদ্রায় বরাভয় ফুটে উঠল।
.