জন-যাজক – ৫

বরদাচরণ সেনগুপ্তকে কলকাতা হাইকোর্টে সবাই অত্যন্ত সমীহ করেন। উনি যার কেস হাতে নেন সে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারে। সাধারণ মানুষের পক্ষে অবশ্য তাঁর নাগাল পাওয়া শক্ত। খুব জটিল এবং ধনবানদের কেস না হলে তিনি গ্রহণও করেন না। বলেন, ‘মাথা ঘামাবো অথচ পেট ভরবে না, তা কখনো হয়?’ নিন্দুকেরা বলে, তার পেটের গহ্বর নাকি এক ডজন চালু অ্যাডভোকেটের চেয়ে গভীর। কিন্তু এখন তিনি বসেছিলেন নতজানু হয়ে। অত্যন্ত মন দিয়ে তিনি শুনছিলেন নির্দেশ। তারপর শ্রদ্ধা সহকারে বললেন, ‘আমি চারদিনের মধ্যে আপনার আদেশ পালন করে এখানে উপস্থিত হব।’ তিনি আবার প্রণাম করলেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। আজ তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল, বাবা ঠিক স্বাভাবিক নন। মুখে যেন বয়সের ছাপ পড়েছে। বরদাচরণ আর একটু সময় অপেক্ষা করলেন। বাবা বললেন, ‘প্রয়োজন বোধ করলে আমিই সমস্ত কিছু ঘোষণা করব। তোমার ভূমিকা শুধু নীরব সাক্ষীর।’

বরদাচরণ মাথা নাড়লেন, ‘এক্ষেত্রে আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।’

‘তোমার ওকালতি কেমন চলছে? জে সি ঘোষকে নিয়ে এলে না কেন?’

‘আপনার আশীর্বাদে বিশ্রামেরও সময় পাই না। মিস্টার ঘোষ এখন বিদেশে।’

‘ও। না না, বিশ্রামের সময় তৈরি করে নেবে। শুধু পরিশ্রম করলে চলবে না। এসো।’

বরদাচরণ যখন আনন্দভবন থেকে বেরিয়ে এলেন, তখনই এক সেবক তাঁকে জানাল বড় মহারাজ অপেক্ষা করছেন। বরদাচরণ তাকে অনুসরণ করলেন। বড় মহারাজ খুব বিমর্ষমুখে বসেছিলেন। তাঁর ঘরের জানলায় ‘আত্মারাম’ খাঁচায় ঝুলছে। বরদাচরণ ঘরে ঢুকে প্রণাম করতেই আত্মারাম বলল, ‘জয়বাবা। নেকুবাবু এলেন।’

বরদাচরণ থতমত হয়ে পাখিটাকে দেখলেন। বড় মহারাজ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আত্মারামকে বললেন, ‘অসভ্যতা করো না! নইলে খাবার বন্ধ হবে। জয়বাবা।’

বরদাচরণ জবাব দিলেন, ‘জয়বাবা।’

‘বসো। আমাদের বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নিয়েছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে এখনও রহস্য আছে। সেটা তিনু মহারাজ কাগজে কলমে লিখে যাননি। কিছু নয়ছয় হয়েছে।’

‘তিনু মৃত্যুর সময় আর মহারাজ ছিল না। পাপের বেতন মৃত্যু। তিনুর তাই হয়েছে। কিন্তু এই একমাসের মধ্যে আশ্রমের ওপর একটার পর একটা আঘাত আসছে। এখন পর্যন্ত ইউনিসের মনে পড়ছে না, সে কোন আততায়ীকে দেখেছে কিনা।’

‘ইউনিস তো সুস্থ এখন?’

‘প্রায়। একটু নার্ভাস হয়ে রয়েছে। ধ্যানেশের হত্যাকারীকে পুলিশ বের করতেই পারছে না। যদিও সে আমাদের কেউ ছিল না। যাক। বাবার সঙ্গে কথা হল?’ খুব সাধারণ গলায় প্রশ্নটি করলেন বড় মহারাজ। আর এইরকম একটা প্রশ্নের সামনে পড়বেন বলে মনে মনে তৈরি হচ্ছিলেন বরদাচরণ। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’

‘তুমি আদেশ পেয়েছ?’

‘আজ্ঞে।’

‘না না। তুমি বিচলিত হয়ো না। তুমি তোমার মন্ত্রগুপ্তি নিশ্চয়ই রক্ষা করবে।’

‘মেজ মহারাজ কি আশ্রমে আছেন?’

বড় মহারাজের কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘মেজকে দরকার? কেন?’

‘না। আশ্রমে এলাম, দর্শন করব।’

‘ও। মেজ তো আশ্রম থেকে সচরাচর কোথাও যায় না।’

‘ছোটে? ছোটে নেই। ছোটে নেই। আত্মারাম হঠাৎ চিৎকার করে উঠল।

বরদাচরণ পাখিটিকে দেখলেন। বড় মহারাজের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি হাসবার চেষ্টা করলেন, ‘পাখিটা বড্ড বাজে কথা বলছে আজকাল।’

বরদাচরণ উশখুশ করে বললেন, ‘অপরাধ নেবেন না, ছোটে মহারাজ সম্পর্কে কিছু উড়ো খবর কলকাতায় ভাসছে। অবশ্য হাতে কোন প্রমাণ নেই।’

‘কি রকম?’ বড় মহারাজ কৌতূহলী হলেন।

‘আমার কাছে নানান ধরনের লোক আসে। তাদের কেউ দাবি করেছিল, সে ছোটে মহারাজকে একটি প্যান্টশার্টপরা মেয়ের সঙ্গে বর্ধমান স্টেশনে দেখেছে।’

‘বাজে কথা। ছোটে বেড়াতে গিয়েছে। মেয়েছেলের সঙ্গ ছোটে করবে এটা ভাবলে কি করে?’

‘না, না, আমি ভাবিনি। আমি ভাবতে পারি না।’ বরদাচরণ যেন আঁতকে উঠলেন।

‘তুমি কি আর কোন খবর দিতে পার?’

‘উপস্থিত না।’

‘বেশ। এসো এখন।’

বরদাচরণকে বিদায় করে বড় মহারাজ কলকাতায় টেলিফোন করলেন। ইদানিং একবারে লাইন পাচ্ছেন না তিনি। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে মিনিট পাঁচেক পরে সুধাময়কে পেলেন, ‘ছোটের খবর কিছু জানো?’

সুধাময় গতরাত্রে ঘুমিয়েছিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘একটা উড়ো খবর পেয়েছি।’

‘কি খবর?’

‘ওঁকে একটি প্যান্টপরা মেয়ের সঙ্গে বর্ধমানে দেখা গিয়েছিল। সম্ভবত সেখান থেকে ট্রেন ধরে উত্তরবাংলায় গিয়েছেন। আমি উত্তরবাংলা চষে ফেলার ব্যবস্থা করেছি। যে ছেলেটির সঙ্গে কলেজে ছোটে মহারাজ মিশতেন তার নাম কানাই। গোপন রাজনীতি করে। কানাই-এর এক মেয়েবন্ধু প্যান্টশার্ট পরে। যদি গুজব সত্যি হয়, তাহলে ছোটে মহারাজের সঙ্গে তাঁকেই দেখা গিয়েছে। উত্তরবাংলায় ওঁরা গেলে খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগবে না।’ সুধাময় গড়গড় করে বলে গেলেন।

‘গুজবটাকে সত্যি প্রমাণ কর।’ বড় মহারাজের মুখে এতক্ষণে যেন রক্ত ফিরে এল।

সুধাময় বললেন, ‘আমার লোকজন কাজে নেমেছে খবরটা পাওয়ামাত্র।’

‘বাবা খুব অধীর হয়েছেন। আগামী পূর্ণিমার মধ্যে ছোটের খবর চান। এটা মনে রেখো।’

‘এবার মনে হচ্ছে ব্যর্থ হব না।’

‘ইউনিসকে দেখতে গিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ। মাথার চোট সারতে দেরি হবে। কিন্তু লোকটি খুব নার্ভাস হয়ে রয়েছে।’

‘তুমি সাবধানে থেকো। জয় বাবা।’

‘জয় বাবা।’

টেলিফোন নামিয়ে রেখে বড় মহারাজের মনে হল অনেকদিন তিনি হেঁটে আশ্রমের পথে যাওয়া আসা করেননি। আজ সেটি করলে কেমন হয়! সাধারণ ভক্তশিষ্যদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ যত বেশি থাকবে তত মঙ্গল। তিনি আত্মারামের দিকে তাকালেন। পাখিটা আজকাল বাইরের লোকের সামনে খারাপ কথা বলছে। এর জন্যে দায়ী অবশ্য তিনি নিজেই। যখন কাছে-পিঠে কেউ থাকে না তখন মাঝে মাঝে শব্দগুলো শোনার জন্যেই আত্মরামকে বলতেন। বাবা বলেন যা কিছু পাঁক নোংরা মনে পাক খায় তা বের করে দিয়ে নির্মল হও। এই যেমন একদিন একটা লোককে দেখে বড় মহারাজের খুব রাগ হল। মনের মধ্যে চট করে খচ্চর শব্দটি চলে এল। লোকটা একটি খচ্চর। কিন্তু উচ্চারণ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কেউ যদি শুনে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে ঢি ঢি পড়ে যাবে। কিন্তু নোংরাটা মন থেকে বের করে দেওয়া দরকার। একা কোন নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে বললে মনে হয়, নিজের গায়েই শব্দটা জড়িয়ে গেল। সামনে একজন শ্রোতা চাই। তাই আত্মারাম। সে কান খাড়া করে, মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্যাখে। ভবনের ছাদে নীল আকাশের তলায় আত্মারামকে নিয়ে গিয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে বড় মহারাজ পাখির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই ব্যাটা খচ্চর।’ পাখিটা মাথা নিচু করতেই মন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তাঁর। যেন শরীর থেকে নোংরা ধুয়ে ফেলে নির্মল হলেন। একবার উচ্চারণ করা শব্দ শুনলে কিছুতেই মনে রাখতে পারে না আত্মারাম। এইটাই যা বাঁচোয়া। কিন্তু পাখিটাকে বাবা একবার দেখতে চেয়েছিলেন। নানান ঝামেলায় সেটা খেয়াল ছিল না। বড় মহারাজ একজন সেবককে নির্দেশ দিলেন আত্মারামকে সঙ্গে নিয়ে আসতে।

মাটিতে পায়ে হেঁটে বড় মহারাজ পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন। তিনু, ধ্যানেশ এবং ইউনিস তৈরি করা দুর্ঘটনায় পড়ার পর আশ্রমে পাহারা জোরদার করা হয়েছে। যে সমস্ত ভক্তরা আজ এখানে এসেছেন তাঁরা বড় মহারাজকে বারংবার প্রণাম করতে লাগলেন। হাঁটতে খুব ভাল লাগছিল তাঁর। আশ্রমের বিভিন্ন মহল পরিদর্শনের সময় অন্যান্য মহারাজরা তাঁর সঙ্গ নিলেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে তিনি মেজ মহারাজের দর্শন পেলেন। কয়েকজন নবীন দীক্ষিতের সঙ্গে কথা বলছিলেন মেজ মহারাজ। বড় মহারাজকে দেখেই তিনি বললেন, ‘জয় বাবা।’ শব্দদুটি ফিরিয়ে দিয়ে বড় মহারাজ বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার একটু নিভৃত আলোচনার দরকার।’ মেজ মহারাজ শশব্যস্তে তাঁর ভবনের একতলায় বড় মহারাজকে নিয়ে এলেন। সঙ্গীদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হল। ঘরে ঢুকে বড় মহারাজ বললেন, ‘তোমার এই ভবনটির কোন অংশ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত?’

‘আজ্ঞে অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও সেটা করা হযনি।’

‘আঃ। মিছিমিছি এই গরমে কষ্ট পাচ্ছ। এটা প্রয়োজন। করে নাও। হ্যাঁ, ছোটের একটা হদিশ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু খবরটা যদি সত্যি হয় তাহলে আশ্রমজীবনে তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না।’

বড় মহারাজ খুব বিমর্ষ মুখে জানাতেই মেজ মহারাজ চমকে উঠলেন, ‘কেন? কি হয়েছে তার?’

বড় মহারাজ মাথা নাড়লেন, ‘সুধাময় টেলিফোনে বলল তাকে নাকি বর্ধমান স্টেশনে একটি ফিরিঙ্গি টাইপের মেয়ের সঙ্গে দেখা গিয়েছে। ছোটে নারীর আকর্ষণে আমাদের সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। সে নিশ্চয়ই নারীসঙ্গ ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। তার সঙ্গে প্যান্টপরা নারী ছিল। অর্থাৎ কোনরকম সঙ্কোচ লজ্জার বালাই যার নেই তার শরীর সম্পর্কেও কোন রক্ষণশীলবোধ থাকবে না। ছোটে সেই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু খবরটা বাবাকে কিভাবে জানাবো?’

মেজ মহারাজ অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। সৎ-ভাই সত্ত্বেও তিনি ছোটেকে বিশেষ স্নেহ করতেন।

বড় মহারাজের কাছে বিবরণ শুনে তিনি মাথা নাড়লেন, ‘আমরা প্রকৃত অবস্থা জানি না। শুধু অনুমান করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কি ঠিক হবে? ছোটের চরিত্রবল এত অল্পে বিনষ্ট হবে, ভাবতে খারাপ লাগছে আমার।’

‘জীবন বড় নিষ্ঠুর সত্যের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে মেজ। আর সত্যানুসন্ধানের জন্যে সবসময় সাক্ষাৎ প্রমাণের দরকার পড়ে না। ক্ষুধার্ত এবং খাবার একজায়গায় থাকলে পরিণতি ভিন্ন হতে পারে না। ছোটের আর মহারাজ হবার যোগ্যতা নেই।’

‘এই সিদ্ধান্ত তো বাবাই নেবেন। যত নিষ্ঠুর সংবাদ হোক, বাবাকে তা দিতেই হবে। তিনি সাংসারিক শোকতাপের ঊর্ধ্বে।’

‘বেশ, তুমি আমার সঙ্গে চল। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হল, আজ বরদাচরণ উকিল এসেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যারিস্টার জে সি ঘোষকে আনেননি। বাবার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে নিভৃতে। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।’

‘আপনি মনে হয়, অনাবশ্যক দুশ্চিন্তা করছেন।’

‘তোমার কথাই যেন সত্যি হয়। তৃতীয়ত, রাজ্যমন্ত্রী বিপদে পড়ে বাবার শরণাপন্ন হলেন, কেন্দ্রীয়মন্ত্রীও এলেন কিন্তু আশ্রমের জন্যে কিছুই পাওয়া গেল না তাঁদের কাছ থেকে। বাবা হঠাৎ এমন নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছেন কেন?’

‘জাগতিক কোন চাহিদা তো আমাদের নেই। প্রতিমাসে ভক্তরা যে প্ৰণামী পাঠায় তাই এখন উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে আশ্রমের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গিয়েছে। এখন বিদেশের বড় শহরগুলোতে যাতে শাখা খোলা যায়, তার চেষ্টা চলছে। আর এই সমস্ত খরচ চলছে প্রণামীর টাকায়। মন্ত্রীরা আর কি দিতে পারেন। অবশ্য আপনি কোন পাওয়ার কথা বলছেন আমি জানি না।’ মেজ মহারাজ বললেন।

‘প্রতি মাসে প্রণামী বাবদ পাওয়া অর্থের অডিটেড রিপোর্ট তুমি দেখেছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

বড় মহারাজ নীরবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘এসো, আমার সঙ্গী হও।’

দুই মহারাজ বাইরে বেরিয়ে আসামাত্র এক বৃদ্ধ ভক্ত প্রায় আছাড় খেয়ে পড়লেন ওঁদের পায়ের সামনে। হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন তিনি। সেবকরা ছুটে এল। কিন্তু বৃদ্ধকে কিছুতেই তারা সরিয়ে নিয়ে যেতে পারছিল না। মেজ মহারাজ তাদের শান্ত হতে বলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে তোমার? এত বিচলিত কেন?’

বৃদ্ধের গলার স্বর কান্নায় বসে যাচ্ছিল। সেই অবস্থায় তিনি কোনমতে বললেন, ‘বাবার দর্শন চাই। আমার সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। একমাত্র বাবা ছাড়া আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘কেন বাবার দর্শন চাও?’

বৃদ্ধ উন্মত্তের মত বললেন, ‘মহারাজ, দয়া করুন। বাবার কাছে আমাকে নিয়ে চলুন। আমি তাঁর ছেলে। আমার বিপদে তিনি রক্ষা করবেনই।’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘তোমার সমস্যা আমাকে খুলে বলতেই হবে। কারণ অনেকেই একটা মিথ্যে কারণ দেখিয়ে বাবার কাছে পৌঁছতে চায়। বাবাকে শুধুই বিরক্ত করে তারা। কিসে তোমার সর্বনাশ হল বল?’

বৃদ্ধ আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, ‘নিজের মুখে কি করে বলব মহারাজ!’

মেজ মহারাজ বড় মহারাজের দিকে তাকালেন, ‘আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে এর সঙ্গে কথা শেষ করে আসছি।’

বড় মহারাজ আপত্তি জানাতে গিয়েও জানালেন না। বললেন, ‘আমি কৃষিপ্রকল্প ঘুরে আসছি। তুমি আমার সঙ্গে সেখানেই যোগ দিও।’

বৃদ্ধকে নিয়ে মেজ মহারাজ ভবনের অফিসঘরে চলে এলেন। অনুসরণকারীদের চলে যেতে বলে তিনি বৃদ্ধকে একটি চেয়ারে বসতে বললেন। কিন্তু বৃদ্ধ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর গাল ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে। মেজ মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এবার বল, কেন তুমি এইরকম বিচলিত হয়েছ? কি ঘটনা ঘটেছে তোমার জীবনে?’

বৃদ্ধ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন। তারপর সেই অবস্থাতেই বললেন, ‘আমার মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। সে সন্তানসম্ভবা।’

‘সর্বনাশ? সে কি বিবাহিতা নয়? তোমার কাছে থাকে না?’

‘আজ্ঞে না। আমি অত্যন্ত গরীব। গ্রামে চাষবাস করি। মেয়ে স্কুলফাইন্যাল পাশ করার পর বড় মহারাজের অনুমতি নিয়ে আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম। সে এখানকার সেবিকা।’

‘সেবিকা?’ চমকে উঠলেন মেজ মহারাজ।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। দশদিন হল, সে দেশে ফিরে গিয়েছে। আমার স্ত্রী খবরটা জানতে পেরে প্রায় উন্মাদিনী। এখন বাবা যদি দয়া না করেন তাহলে আত্মঘাতী হতে হবে আমাকে।’ বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন।

‘এই ক্ষতিটি কি আশ্রমেই হয়েছে?’ মেজ মহারাজের গলার স্বর কঠোর।

‘আজ্ঞে। গত তিন বছর ধরে সে এখানেই ছিল। একবারও দেশে যায়নি।’

‘ঘটনার জন্যে কে দায়ী?’

বৃদ্ধ আচমকা চুপ করে গেলেন। তার চিবুক বুকের উপর নেমে এল।

‘আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছেন সেই পাষণ্ডটি কে?’

এবার বৃদ্ধের মুখে আতঙ্ক ফুটল, ‘না না, মহারাজ। আমাকে প্রশ্নটি করবেন না। তিনি পাষণ্ড নন। আমি জানি না আমার কি বলা উচিত। শুধুই আপনি আমাকে ওঁর নাম জিজ্ঞাসা করবেন না। আমার মহাপাপ হবে। মহাপাপ।’

‘শুনুন। তোমার মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে, তার নাম উচ্চারণ করলে মহাপাপ হবে কেন?’

‘হবে। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’

‘অসম্ভব। দোষী শাস্তি পাবে না এমন কাজ করতে পারি না আমি। বাবার দর্শন চাইছিলে তুমি। বাবা তো জানতেই চাইবেন উত্তরটা।’

‘বাবার কাছে আমি সব বলতে পারি। তিনি ভগবান।’

মেজ মহারাজ বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। এই চাষী বৃদ্ধের হৃদয়ে বাবা কোন জায়গা নিয়েছেন? বৃদ্ধ তখন বলছেন, ‘বাবা সব শুনলে নিশ্চয়ই আমাকে বাঁচাবেন।’

‘কি রকম বাঁচতে চাইছ তুমি? তোমার মেয়েকে কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।’

‘সেই সুযোগ আর নেই। সময় পেরিয়ে গিয়েছে।’

‘তুমি যদি অপরাধীর নাম বলতে না পার তাহলে আমার কিছুই করণীয় নেই।’ কিছুটা রেগে গিয়েই মেজ মহারাজ বেরিয়ে এলেন অফিসঘর থেকে। কয়েকজন সেবক তখনও অপেক্ষায় ছিল। বৃদ্ধ তাদের নিষেধ অমান্য করে পেছনে পেছনে আসছিল। মেজ মহারাজের মন তেতো হয়ে গিয়েছিল। কে সেই লোক যার নাম উচ্চারণ করতে ভয় পাচ্ছেন বৃদ্ধ? কেন মনে করছেন প্রকাশ করলে মহাপাপ হবে? মেজ মহারাজের মনে হল সেই ব্যক্তি শুধু এই আশ্রমের কিছু ক্ষমতার অধিকারী তো বটেই, ধর্মাচরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন মহারাজ। কৃষি প্রকল্পের বদলে আনন্দভবনের দিকেই তিনি এগিয়ে চলছিলেন। পেছনে বৃদ্ধ যে তাঁকে অনুসরণ করে আসছেন তা খেয়াল করেননি। আনন্দভবনের সামনে উপস্থিত জনতা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই সহজ হবার চেষ্টায় তাঁদের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বললেন তিনি। মধুসূদন নামের একটি দরিদ্র আদিবাসী যুবক দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটি প্রকৃত ধার্মিক। আশ্রমের যেকোন উৎসবে সব ফেলে ছুটে আসে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। ওদের সম্প্রদায়ে বাবার শিষ্যসংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। মধুসূদন দীক্ষা নিয়েছিল যখন সে শহরে এক ধনীর বাড়িতে কাজ করত। হঠাৎ মেজ মহারাজের মাথায় একটি চিন্তা প্রবেশ করল। তিনি মধুসূদনকে কাছে ডাকলেন, ‘আমার সঙ্গে এস।’

অনুগ্রহ পেয়ে গলে গেল মধুসূদন। মেজ মহারাজের পেছনে সে ঢুকে পড়ল আনন্দভবনে। সেবকদের বাধা মেজ মহারাজের ইঙ্গিতে দূর হল। নির্জনে দাঁড়িয়ে মেজ মহারাজ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের জাতের মানুষেরা বাবা সম্পর্কে আগ্রহী নয় কেন, মধুসূদন?’

মধুসূদন মাথা নিচু করে কোনক্রমে জবাব দিল, ‘কেউ ওদের দীক্ষিত করে না। তাই।’

‘তুমি কোন যাজককে অনুরোধ করেছিলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আমার সম্প্রদায়ের লোকজন—’ হঠাৎ চুপ করে গেল মধুসূদন।

‘কি হল? থামলে কেন?’

‘আজ্ঞে, ছোট মুখে বড় কথা বলা হয়ে যাবে।’

‘কথাটা শুনিই না।’

‘আমরা খুব গরীব। তাই বোধহয়।’ মাথা নিচু করেই জানাল মধুসূদন।

‘আশ্চর্য! যারা গরীব তারাও তো মানুষ। বাবার কাছে কোন ভেদাভেদ নেই। তাদের আত্মার উন্নতি, জীবনের স্থিতির জন্যেই দীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার।’ মেজ মহারাজ সোজাসুজি মধুসূদনকে দেখলেন, ‘তোমার মধ্যে সবগুণ আছে। ভক্ত হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছ তুমি। তোমাকে যাজক হিসেবে দায়িত্ব দিতে চাই।’

সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু মুড়ে হাত জোড় করে বসে পড়ল মধুসূদন, ‘এত অনুগ্রহ হবে আপনার?’

‘ভুল করলে। আমার নয়। বাবার। এখানে যা হয় তা বাবার ইচ্ছেতেই। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কি বিবাহিত?’

‘আজ্ঞে না। আমি এত গরীব যে ওই চিন্তাই করি না।’

‘আমি তাই জানতাম। অর্থ নেই বলে নিজেকে গরীব ভেব না, অন্তরে তুমি অনেকের চেয়ে বিত্তশালী। তাছাড়া যাজকপদে উন্নীত হয়ে তুমি যাদের দীক্ষা দেবে, তারা মাসান্তে যে প্রণামী আশ্রমে পাঠাবে তার একটা অংশ তোমার প্রচার কাজের ব্যয় নির্বাহ করতে তুমি পাবে, মনে হয় তাতেই তোমার অভাব দূর হবে। যত দীক্ষা দেবে তত তোমার মঙ্গল হবে। আগামী পূর্ণিমায় আমার কাছে এস। সেদিন আমি তোমাকে নতুন দায়িত্ব দেব।’ মেজ মহারাজ হঠাৎ দেখলেন সদর দরজায় একটা ঝামেলা হচ্ছে। সেই বৃদ্ধকে সেবকরা ভেতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। তাঁর মুখে হাসি ফুটল। তিনি সেবকদের নির্দেশ দিলেন তাকে ভেতরে আসতে দেওয়ার জন্যে। প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় বৃদ্ধ সামনে এসে দাঁড়ালেন মাথা নিচু করে। তাঁর দিকে খানিক তাকিয়ে মেজ মহারাজ বললেন, ‘মধুসূদন, কিন্তু তার আগে তোমার একটা কাজ করতে হবে।’

যাজক হবার সুযোগের আনন্দে মধুসূদন তখন স্বপ্ন দেখছিল। যাজকদের সে দেখেছে। প্রায় প্রত্যেকেই যাজক হবার পর প্রণামীর অংশ পেয়ে সংসারের চেহারা পাল্টে ফেলেছে। সে যাজক হওয়ামাত্র যদি হাজার দুই মানুষকে দীক্ষিত করতে পারে তাহলে আর চিন্তা নেই। তাছাড়া যাজকদের সম্মানই আলাদা। সে তড়িঘড়ি জবাব দিল, ‘আদেশ করুন।’

‘এই বৃদ্ধ কন্যাদায়গ্রস্ত। এর কন্যাটিকে উদ্ধার করতে হবে বিনা বাক্য ব্যয়ে।’

মধুসূদন লজ্জায় কেঁপে উঠল। কিন্তু বৃদ্ধ হকচকিয়ে গেলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘কিন্তু ওর জাত, ওর ভাষা!’

মেজ মহারাজ কঠোর স্বরে বললেন, ‘বাবার ভক্তের একটি মাত্র পরিচয় সে মানুষ। পূর্ণিমার আগেই কন্যাদান করো। মধুসূদন, তোমার আপত্তি আছে?’

মধুসূদন উঠে দাঁড়াল, ‘বিন্দুমাত্র না।’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘মেয়েটির কখনও যেন অযত্ন না হয়। সে এই আশ্রমের সেবিকা ছিল। সাধারণ মানুষ যে কাজের জন্যে অপরাধী হয় সে তা থেকে মুক্ত। কোনদিন তাকে অপ্রিয় প্রশ্ন করবে না। পূর্ণিমার আগেই বিবাহ শেষ করবে। তোমরা এস।’

এইসময় বড় মহারাজকে আত্মারামের খাঁচা নিয়ে প্রবেশ করতে দেখে এগিয়ে গেলেন মেজ মহারাজ, ‘ক্ষমা করবেন। ওই বৃদ্ধের সমস্যায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম বলে আমি সময় রক্ষা করতে পারিনি। আত্মারামকে সঙ্গে এনেছেন যে?’

‘বাবা দেখতে চেয়েছিলেন। বৃদ্ধের সমস্যা নিয়ে বাবাকে বিব্রত করো না।’

‘আজ্ঞে না। তার আর প্রয়োজন হবে না। আপাতত সমাধান হয়েছে।’

‘কি রকম?’

‘মধুসূদন নামের ওই দরিদ্র যুবকটি বৃদ্ধের কন্যাকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছে।’

‘চমৎকার। যুবকটি কি দীক্ষিত?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে ওকে যাজক করে দাও।’

‘সেইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।’

‘ভাল। এসো।’ বড় মহারাজ আত্মারামকে নিয়ে এগিয়ে গেলে মেজ মহারাজ অনুসরণ করলেন।

.

কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর সঙ্গে বাবার কথাবার্তা হয়েছিল নিভৃতে। তিনি ছিলেন মাত্র পনের মিনিট। কিন্তু খবরের কাগজগুলো এ ব্যাপারে নানান গালগল্প জুড়েছে। কোন তৃতীয় ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত না থাকায় গল্পগুলো পল্লবিত হচ্ছিল। পরে কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয়মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘নিছক সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার। আপনাদের রাজ্যমন্ত্রীও তো গতকাল ওঁর কাছে গিয়েছিলেন।’ খবরটা এত অপ্রত্যাশিত যে, তাই নিয়ে হৈচৈ উঠল। দলে দলে সাংবাদিকরা এসেছিলেন আশ্রমে। বাবার সাক্ষাৎ তাঁরা পাননি। মেজ মহারাজকে সেই ধকল সামলাতে হয়েছিল। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর সঙ্গে কি কথা হয়েছিল বাবার, রাজ্যমন্ত্রী কেন এসেছিলেন, এইসব প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাল মানুষেরাই তো আরও ভালমানুষের কাছে আসে।’ সাংবাদিকদের বিদায় করে সেদিন মেজ মহারাজ যখন বাবার সামনে নতমস্তকে ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন, তখন তিনি মৃদু হেসেছিলেন। কোন মন্তব্য করেননি। এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও ওই হাসিতে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। এই মহামানব কি করে এমন নির্লিপ্ত থাকেন তা মেজ মহারাজের বোধগম্য হয় না। বাবা আজ বসে আছেন বাঘের ছালের ওপর। তাঁর চোখ বন্ধ, শরীরে দোল আসছে। বড় মহারাজ নতজানু হয়ে প্রণাম সেরে উঠে বসতেই বাবা চোখ তুললেন, ‘তোমরা আসামাত্র আমার অস্বস্তি হচ্ছে কেন? কি করেছ তোমরা?’

বড় মহারাজ বিব্রত হয়ে মেজ মহারাজের দিকে তাকালেন, তিনিও প্রণাম সেরে তখন নতজানু। বড় মহারাজ বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ‘আমরা আপনাতে নিবেদিত। আর কিছু করিনি তো।’

‘ওটা কি? পাখি? ও, তোমার সেই পাখি! কি নাম যেন?’

‘আজ্ঞে আত্মারাম।’ বড় মহারাজ জানালেন।

শিশুর মত হেসে উঠলেন বাবা, ‘আত্মারাম খাঁচাছাড়া হতে চায় নাকি? ও আত্মারাম?’ সঙ্গে সঙ্গে দুবার ঘাড় ঘুরিয়ে আত্মারাম বলে উঠল, ‘নেকু!’

বড় মহারাজের হৃৎপিণ্ড যেন গলায় উঠে এল। চকিতে ঘুরে বসে খাঁচার ওপর দিয়েই তিনি পাখিটিকে প্রহার করতে গিয়ে শেষমুহূর্তে আত্মসংবরণ করে নিলেন। বাবা কিন্তু তাঁকে তিরস্কার করলেন, ‘কি করছিলে তুমি? ছি ছি। ওই নির্বোধ প্রাণীকে তুমি প্রহারে শিক্ষিত করছ। আশ্চর্য! বোধ কবে সম্পূর্ণ হবে?’ তারপর হাসি ফুটল বাবার মুখে, ‘বেশ তো কথা বলে ও, নেকু! ঠিকই বলেছে। সব জেনেশুনে না জানার ভান করে আছি এ পৃথিবীতে! আত্মারাম তো আমার বিবেক।’

বড় মহারাজ দেখলেন আত্মারাম বাবার দিকে লেজ ঝুলিয়ে ঘুরে বসল। এই পাখিটা আগে কখনই খারাপ কথা বলত না। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলেন, ‘সুধাময় আমাকে জানিয়েছে ছোটেকে সে কয়েকদিনের মধ্যেই খুঁজে বের করবে।’

‘সব অপদার্থ। এদের ওপর আমার আস্থা নেই। আমি অন্য ব্যবস্থা করেছি ছোটের সন্ধানের জন্যে।’ মেজ মহারাজ চকিতে মুখ তুললেন। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর চলে যাওয়ার আগে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব তাঁকে হাসিমুখে অনুরোধ করেছিলেন বাবার তিন পুত্র অর্থাৎ তাদের তিন ভাই-এর ছবি দিতে। তিনি গত জন্মোৎসবে বাবাকে ঘিরে তোলা তাঁদের একটি গ্রুপ ছবি দিয়েছিলেন। বাবা কি গোপনে কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর গোয়েন্দাসংস্থাকে তদন্ত করতে দিয়েছেন?

বড় মহারাজ কথাটা ধরতে চাইলেন না, ‘আমি সুধাময়কে শেষবার সুযোগ দিয়েছি। ছোটেকে নাকি বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন ধরতে দেখা গিয়েছে। সে উত্তর বাংলায় এসেছে।’

‘খুঁজে বের করো, খুঁজে বের করো।’ বাবা অস্থির হয়ে উঠলেন হঠাৎ। বড় মহারাজ মেজ মহারাজের দিকে সমর্থনের আশায় তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে নির্দেশ ছিল বাকিটা বলার জন্যে। মেজ মহারাজ দ্বিধায় পড়লেন। এবার বাবা বললেন, ‘মনে হচ্ছে তোমাদের কিছু বলার আছে। সময় নষ্ট করো না।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’ বড় মহারাজই কথা বললেন, ‘ছোটের সঙ্গে প্যান্টসার্ট পরা একটি নারী ছিল। যে নারীর স্বভাবচরিত্র সন্দেহজনক। ছোটের মত সংসারানভিজ্ঞ তরুণ ইতিমধ্যে বিপথে চলে যে যায়নি, তা কে বলতে পারে?’

‘নারীসান্নিধ্য সম্পর্কে তুমি অত্যন্ত কাতর, না? কিন্তু একমাত্র ছোটেই বলতে পারে সে ঠিক কি করেছে। আমাদের তার ফেরার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।’ বাবা একমুহূর্ত ভাবলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সনাতননাথ, আনন্দ সরস্বতী যে চক্রান্ত করছে, তোমরা সেই সম্পর্কে কিছু ভেবেছ?’

বড় মহারাজ বললেন, ‘ধ্যানেশের মৃত্যু নিয়ে তো শোকমিছিল করা সম্ভব ছিল না।’

‘শোকমিছিল! কি হবে করে? তার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানালে সে হাসবে দূরে বসে। এবার আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। ওরা একের পর এক আঘাত হেনেই চলেছে। আমি অপেক্ষা করছি ছোটের ফিরে আসার জন্যে। তার আগে কিছু করাটা ঠিক হবে না। ছোটে জীবিত কিন্তু তাকে ফিরে আসতে না দিলে ওদের সুযোগ বেড়ে যাবে।’ বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কোন অভাব নেই যার সে কেন এমন ভুল করে কে জানে।’

হঠাৎ বড় মহারাজ বলে ফেললেন, ‘কিন্তু অবস্থা যা তাতে ছোটে ফিরে এলে তাকে মহারাজ পদের সম্মান দেওয়ার আগে আপনি নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন।’

‘কারণ?’

‘দীক্ষার আগে স্ত্রীসংসর্গ এবং অন্যায়ভাবে কৌমার্যমোচন সম্ভবত প্রতিবন্ধক হতে পারে?’ বড় মহারাজ বেশ তেজী গলায় বললেন, যে গলায় তিনি কখনও কথা বলেন না। বিস্ময়ে বাবা তাঁর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন। এমন সময় একবার ডানা ঝাপটাবার চেষ্টা করে আত্মারাম বলে উঠল, ‘খচ্চর।’

মেজ মহারাজ চমকে উঠলেন। যেন এই ঘরে অ্যাটম বোমা পড়লেও এত অবাক কেউ হতো না। বড় মহারাজের চিবুক নেমে এসেছে তাঁর বুকে। এত লজ্জিত এবং অপমানিত তিনি কখনও হননি। আফশোসে তিনি দিশেহারা। কি দুর্মতি হয়েছিল তাঁর, না হলে এই হতচ্ছাড়া পাখিটাকে বাবার কাছে নিয়ে আসেন। অথচ এই পাখি গত সাতদিনে কোন ইতর শব্দ বলেনি। আজ অবশ্য উকিলকে একবার নেকু বলেছিল। কিন্তু ওই কতকাল আগে শোনা খচ্চর শব্দটাকে এই মুহূর্তে উগরে দেবে কে জানত। তিনি বাবার গলা শুনতে পেলেন, ‘তোমরা এখন যাও। আমি বিশ্রাম করব। আর হ্যাঁ, আত্মারাম এখন থেকে আমার কাছে থাকবে। বড় সত্য কথা বলে ও।’ মেজ মহারাজ চকিতে বাবাকে দেখলেন। বাবা নির্লিপ্ত। তিনি বেরিয়ে আসার সময় বড় মহারাজের দিকে তাকালেন। স্বস্তির চিহ্ন সেখানে। বাইরে বেরিয়ে এসে বড় মহারাজ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ডুবিয়ে দিয়েছিল পাখিটা। খুব জোর বেঁচে গেছি।’ মেজ মহারাজ আর একবার অবাক হলেন মানুষটির নির্বুদ্ধিতায়।

.

‘আপনি ঘুমাবেন না?’ বিছানার একপাশে টানটান শুয়ে প্রশ্ন করল লাবণ্য। ওদের রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছে সাড়ে আটটায়। নির্মল চুপচাপ বসেছিল চেয়ারে। মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ। এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসছে না।’

‘আমি আবার আলো জ্বললে ঘুমাতে পারি না।’

‘ওহো। সরি।’ নির্মল উঠে সুইচ অফ করতে যাচ্ছিল।

‘কিন্তু আপনি শোবেন কোথায়?’

মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল নির্মল, ‘তাই তো! ঠিক আছে, আমি একটা ব্যবস্থা করে নেব।’

‘কি করবেন? তার চেয়ে বলি, মেয়ে হয়েই বলছি, সাধুত্ব হারাবার ভয় যদি না থাকে তাহলে এই চওড়া বিছানার একধারে শুয়ে পড়ুন, আমি বিরক্ত করব না।’

লাবণ্য হেসে ফেলল। নির্মল বলল, ‘কি আশ্চর্য! আপনি খামোকা বিরক্ত করতে যাবেন কেন? ঠিক আছে, আমি একপাশে শুয়ে পড়ব।’

‘খামোকা কি কেউ কাউকে বিরক্ত করে? ধরুন, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। জীবনে কখনো কোন পুরুষের সঙ্গে এক বিছানায় শুইনি। আজ পছন্দসই পুরুষকে এরকম নির্জন রাত্রে চাবাগানের আউটহাউসের বিছানায় পেয়ে আমার অন্যরকম ইচ্ছে হল। সেই ইচ্ছেটাকে খামোকা বিরক্ত বলবেন?’ অপাঙ্গে তাকাল লাবণ্য। আর সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল নির্মল। এরকম কাঁপুনি এ-জীবনে কখনও টের পায়নি সে।

‘আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে, খুশি হলাম, কিন্তু আপনার সবকিছু আমার পছন্দ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবস্থাটা সমান হল না।’ নির্মল বলল।

হাসি নিভে গেল লাবণ্যর, ‘ও।’

‘তাছাড়া আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে আদর্শহানি হয়।’

‘আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন, না?’

‘না তো!’

‘হঠাৎ এমন জ্ঞান দিতে শুরু করলেন যে!’ পাশ ফিরে শুলো লাবণ্য, ‘শুয়ে পড়ুন, আপনার চরিত্র অটুট থাকবে।’

আলো নিভিয়ে জানলায় গিয়ে দাঁড়াল নির্মল। এখন রক্তে তিরতিরানিটা রয়েছে। এই দুদিনে লাবণ্য কখনও ওই চোখে তাকায়নি। সে কাচের জানলার বাইরে পৃথিবীটাকে দেখার চেষ্টা করল। কোথাও কোন আলো নেই। ব্যানার্জি সাহেবের বাংলো অন্ধকারে ঢাকা। রাত্রে চৌকিদারটা যখন খাবার নিয়ে এল তখন সে নির্মলকে সাহেব আর লাবণ্যকে মেমসাহেব বলছিল। লোকটা নির্ঘাৎ ভেবেছে তারা স্বামী-স্ত্রী। খবরটা যদি আশ্রমে পৌঁছায় তাহলে তার পেছনে লাগা ফেউগুলো সরে যাবে। কানাই বলেছিল বাবার বাহিনী তাকে খুঁজে পেতে তোলপাড় করছে কলকাতা। খবরটা আজ না হোক পরশু পৌঁছবেই। কিন্তু উল্টোটা যদি হয়। ধর্ম নিয়ে যারা দিনরাত থাকে তাদের মনে উদারতা, ভক্তিভাবের প্রাবল্যের পাশাপাশি একটা রক্ষণশীল নিষ্ঠুরতা সক্রিয় সবসময়। সে আশ্রমের সম্মান নষ্ট করেছে, এই অপরাধে বাবা কি তাকে শাস্তি দেবেন? বড় মহারাজ তো কিছুতেই মানতে পারবেন না।

নির্মল আর ভাবতে পারছিল না। সে অন্ধকার হাতড়ে বিছানার একটা পাশে চলে এল। সতর্কভঙ্গীতে শরীর এলিয়ে দিতেই যেন আরাম নেমে এল সর্বাঙ্গে। এবং তারপরেই অন্ধকার ঘরে লাবণ্যর নিঃশ্বাসের শব্দ কানে বাজল। একমুহূর্ত সেটা শুনে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুম আসছে না?’

প্রায় হাত দেড়েক দূরে শোওয়া লাবণ্য বলল, ‘এসেছিল, চলে গেল।’

‘কেন?’

‘আপনার বাণীতে। আমার রসিকতা নিশ্চয়ই মাত্রা ছাড়িয়ে ছিল।’

নির্মল জবাব দিল না। কিন্তু জীবনে প্রথমবার একই বিছানায় কোন নারীর সঙ্গে শোওয়ার অস্বস্তি ক্রমশ প্রবল হতে লাগল। শরীরের প্রতিটি শিরায় যেন অস্বস্তি পাক খাচ্ছে। সে উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজল।

.

পিঠের ওপর নরম আঙুলের আলতো ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল নির্মলের। চোখ বন্ধ রেখেই সে লাবণ্যর স্পর্শ টের পেল। এবং তখনই খুব চাপা গলায় লাবণ্য ডাকল, ‘শুনছেন! নির্মল?’ নির্মল পাশ ফিরল, ‘কি ব্যাপার?’

আর তখনই জানলায় শব্দ হল। কেউ যেন কাচের ওপর আঙুলের শব্দ তুলছে। নির্মল মাথা তুলল। বাইরেটা দৃষ্টির আড়ালে। লাবণ্য প্রায় তার কাছে ঘেঁষে এসেছে। অদ্ভুত মায়াময় গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে। লাবণ্য বলল, ‘মিনিট দুয়েক ধরে কেউ ওই জানলায় শব্দ করে যাচ্ছে। রাত এখন একটা। আপনার ঘুম ভাঙাতে পারছিলাম না।’ উঠে বসল নির্মল, ‘কে বলুন তো? চৌকিদার নয় তো?’

‘চৌকিদার হলে তো ডাকাডাকি করত। দরজাটা খুলবেন?’

‘হ্যাঁ। নিশ্চয়ই লোকটার প্রয়োজন আছে।’

বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বাললো নির্মল। একবার জানলার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল। লাবণ্য ততক্ষণে উঠে বসেছে। প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলতেই সে একটি লোককে সামনে দেখতে পেল। তারপর দ্বিতীয়জনকে তারার আলোয় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার?’

‘নমস্তে। আপনি তো আজ এই বাগানে প্রথম এসেছেন?’ লোকটা বাংলা বলছিল হিন্দি জড়িয়ে। লম্বায় বেশি নয়। স্বাস্থ্য ভাল। নির্মল মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘আমি ঘরে ঢুকতে পারি?’ লোকটা প্রশ্ন করতেই নির্মল জবাব দিল, ‘আসুন।’

ঘরে ঢোকার আগে লোকটা বাইরে দাঁড়ালো, সঙ্গীকে হাত নেড়ে ইশারায় কিছু বলল। নির্মল এক পলকে ওই পাতলা অন্ধকারে যেন লোকটার হাতে কোন অস্ত্র দেখতে পেল। ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে লোকটা বলল, ‘আমি এত রাত্রে এলাম খুব খারাপ লাগছে। আমার নাম প্রধান। আপনি আমার মাকে চাবাগান থেকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে এসেছেন বলে আমার ধন্যবাদ নিন। আমি কৃতজ্ঞ, তাই জানাতে এলাম।’

‘উনি আপনার মা হন?’

‘ইয়েস।’ লোকটা হাসল, ‘আন্দোলনের জন্যে আমি ঘরছাড়া, কিন্তু এই শালা হাসপাতাল তো মুরগির খাঁচা। ট্রিটমেন্টভি হয় না। শুনলাম, আপনি সন্ধ্যের পর আবার আমার মাকে দেখতে গিয়েছিলেন, কেন?’

নির্মল বলল, ‘উনি কেমন আছেন জানতে ইচ্ছে করছিল।’

‘অদ্ভুত ব্যাপার! চাবাগানের কুলিকামিনদের শরীর খারাপ হলে ম্যানেজার তো দূরের কথা, বাঙালিবাবুরাও খবর নেয় না।’ লোকটা নির্মলকে ভাল করে দেখল, ‘লাইনের লোকজন যারা আপনাকে দেখেছিল তারা দেওতা দেওতা করছিল। আপনার চেহারাটা রামায়ণের হিরোর মতন। এ বাগানে কেন এসেছেন?’

নির্মল বলল, ‘এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার!’

‘ব্যানার্জিসাহেব আপনাদের কেউ হয় না বুঝতে পারছি, কারণ আপনাদের আউট হাউসে পাঠিয়েছে। কিন্তু আপনি আমার মায়ের উপকার করেছেন বলে একটা পাল্টা উপকার করছি। যে ধান্দায় আপনি এখানে এসে থাকুন, এখনই বাগান ছেড়ে চলে যান। আমার সঙ্গে আসুন। একটা জায়গায় রাত কাটিয়ে সকালে বাস ধরবেন।

‘কেন?’ নির্মল না, লাবণ্য প্রশ্নটা করে ফেলল।

‘আপনাদের ভাল হবে তাতে।’ হঠাৎ লোকটার মুখ শক্ত হয়ে গেল।

নির্মল বলল, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি বুঝতে পারছি না।’

‘আমি চাই না আপনাদের কোন ক্ষতি হোক। আপনার নামও আমি জানি না। কিন্তু আপনি আমার মায়ের উপকার করেছেন। এইটা আমি মনে রাখছি।’

‘ধন্যবাদ। আমার নাম নির্মল, এর নাম লাবণ্য। মানুষ হিসেবে যে কাজটা না করলেই নয় সেটাই আপনার মাকে দেখে করেছি। কিন্তু ক্ষতির কথা কি বলছিলেন? আমাদের কি ক্ষতি হতে পারে?’ নির্মল সন্দেহের চোখে তাকাল। লোকটা ইনফরমার নাকি? এবং তখনই বিকেলে বাগানে ঢোকার মুখে দারোয়ানটির কথা মনে পড়ল। সে বলল, ‘মনে পড়ছে। আপনার মাকে নিয়ে যখন বাগানে আসছিলাম তখন একজনের কাছে আপনার কথা শুনেছিলাম।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সচকিত হয়ে উঠল, ‘কার কাছে? কি নাম?’

‘জানি না। এখানে আমরা নতুন। কাউকে চিনি না। আমি শুনেছিলাম দার্জিলিং-এই আপনারা আন্দোলন করছেন। আন্দোলন ঠিক না বেঠিক এ নিয়ে কোন কথা বলছি না। কিন্তু এই ডুয়ার্স অঞ্চলে ওই আন্দোলন করার কি কোন কারণ আছে?’

‘নিশ্চয়ই। প্রথমত, আমাদের ভাইবোন দার্জিলিং-এ মার খাচ্ছে, আর আমরা এখানে বসে থাকতে পারি না চুপ করে। তাছাড়া ডুয়ার্স ছিল ভুটানিদের। ব্রিটিশরা লিজ নিয়েছিল। এই জায়গা ছিল কোচ রাজবংশী আর পাহাড়িদের। বাঙালিরা এখানে এসেছে চাকরির ধান্দায়। তাদের দেশ এটা নয়। এখানকার মাটি চাষ করে যারা, চা বাগানে পাতি তোলে যারা, তাদের ষাটভাগ পাহাড়ি আর চল্লিশভাগ রাচী-সাঁওতাল পরগনার লোক, যারা একশ-দেড়শ বছর আগে এসেছিল, যাদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু আমরাই এখানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। ছেড়ে দিন এসব কথা। আজ রাত তিনটের সময় হাইওয়ের ওপাশে যে ফরেস্ট বাংলো আছে, তা পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে এই আউট হাউসটাও।’

‘পুড়িয়ে দেবেন? কেন?’ হতভম্ব হয়ে গেল নির্মল।

‘আউটহাউসটা পোড়ানো হবে কারণ বাগানের মালিককে আমরা একটা ওয়ার্নিং দিতে চাই। আপনি আমার মাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন তাই আমি সতর্ক করে দিচ্ছি এখনই এই ঘর ছেড়ে যেতে।’ উঠে দাঁড়াল প্রধান, ‘আপনি কি আমার সঙ্গে যাবেন?’

নির্মল লাবণ্যর দিকে তাকাল। তার মুখ শক্ত। লাবণ্য বলল, ‘মিস্টার প্রধান, আপনি আর পাঁচটা মিনিট বসতে পারবেন?’

প্রধান দরজার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। তারপর ফিরে এসে বলল, ‘কি ব্যাপার?’

‘আপনারা আন্দোলন করছেন নিজেদের অধিকার পাকা করতে। কিন্তু এই যে একটার পর একটা সরকারি বাড়ি, বিশেষ করে ফরেস্ট বাংলো পোড়াচ্ছেন, এতে কার লাভ হচ্ছে? সরকারের ক্ষতি করা মানে জনসাধারণের ক্ষতি করা। তাছাড়া যদি আপনারা সফল হন, এইসব সম্পত্তি থেকে নিজেদেরই বঞ্চিত করবেন না কি?’ লাবণ্য সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।

‘আপনি তো সরকারের মত কথা বলছেন! ভারতবর্ষের কাগজগুলো রোজ যেসব খবর ছাপছে তাতে মনে হয় আন্দোলনটা যেন শুধু দার্জিলিং-এই হচ্ছে। বাগরাকোট, ওদলাবাড়ি, সামসিং থেকে আরম্ভ করে হাসিমারা পর্যন্ত ডুয়ার্সটায় যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সেই খবর কেউ ছাপে না। বাংলো পুড়িয়ে দিলে আবার হবে কিন্তু এইসব না করলে খবর ছাপবে না।’

প্রধান হাসল, ‘আপনাদের সঙ্গে কোন পার্টির সম্পর্ক? সি পি এম?’

লাবণ্য মাথা নাড়ল, ‘না। আমরা সি পি এম, কংগ্রেস কিংবা নকশাল নই। আমরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকতে চাই। কোন পার্টির ব্যানারে নয়।’

‘এটা আবার কিরকম ধান্দা? শুনুন, আমাদের এলাকায় জি এন এল এফ ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ওসব সঙ্গে থাকার মতলব ছাড়ুন।’

‘আপনাকে তো বললাম কোনরকম রাজনৈতিক প্রচার আমরা করব না। আপনার মা চা গাছের পাশে পড়ে ছিলেন। ওঁকে হসপিটালাইজড্‌ করে নিশ্চয়ই অন্যায় করিনি?’

প্রধানের ঠোঁট মোচড় খেল, ‘রেডক্রশ?’

‘সেইরকমই।’

‘দেখুন, আপনাদের সাবধান করে দিলাম, রিস্ক নেবেন তো নিন। কোন কিছুর ধান্দা ছাড়া কেউ পাবলিকের জন্যে কিছু করে না। আপনাদের বিশ্বাস করা মুস্কিল। যাহোক, আউট হাউস ছেড়ে দিন। সময় আর বেশি নেই। আমরা কাউকে জ্যান্ত পোড়াতে চাই না। একশ’র ওপর বাংলো পুড়িয়েছি কিন্তু কেউ এই বদনাম দেবে না।’ প্রধান দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

লাবণ্য নির্মলের দিকে তাকাল। নির্মল মাথা নাড়ল, ‘এসবের কোন মানে নেই। এই আউট হাউস পুড়িয়ে আপনারা কিছুই লাভ করবেন না। এটা একদমই বোকামি। পোড়াতে গেলে আমাদের কেন বাদ দেবেন? আপনারা গেরিলা যুদ্ধ করছেন, কিন্তু এটা কি ধরনের যুদ্ধ?’

প্রধান কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা যাবেন না?’

‘না।’

‘তাহলে আমার আর কিছু করার নেই। কিন্তু কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করবেন না। সেরকম কিছু করলে এই এলাকা থেকে কোনদিন বেরুতে পারবেন না।’ প্রধান আর দাঁড়াল না। নির্মল দরজাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লোকটা এসেছিল কৃতজ্ঞতা জানাতে, গেল হুমকি দিয়ে।’

‘কিন্তু ওরা যদি আগুন ধরিয়ে দেয় এখানে, কিছু একটা তো করা উচিত?’

নির্মল হাসল, ‘এখন আর ঘুম আসবে না। আপনি শুয়ে থাকুন, তেমন বুঝলে আপনাকে ডেকে দেব। জ্যান্ত রোস্ট হতে আমারও বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।’

লাবণ্য চোখ বন্ধ করল। ঘুম তারও আসবে না। জীবনে প্রথম রাত কোন পুরুষের সঙ্গে একঘরে কাটাচ্ছে সে!’

.

নির্বাচনে শাসকদল বিপুল সংখ্যাধিক্য পাওয়ায় সরকার গড়তে কোন অসুবিধে হল না। পুনঃনির্বাচিত রাজ্যমন্ত্রী ময়দানে বিরাট জনসভা করলেন বিজয়োৎসব পালন করতে। সেখানে তিনি বললেন, ‘ভারতবর্ষের মানুষ চিরকালই অন্যায়কে বর্জন করেছে, ন্যায়ের গলায় মালা পরিয়েছে। আমরা আপনাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেবার চেষ্টা করেছি, করব। একমাত্র বিভেদকামী শক্তি ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই। পশ্চিমবাংলার মানুষের রাজনৈতিক চেতনা স্বচ্ছ। আমাদের বেছে নিয়ে আপনারা প্রমাণ করেছেন যেসব ব্যক্তি ধর্মের নামে মানুষকে উসকে দেয় তাদের কোন গুরুত্ব নেই। ধর্মগুরুরা আছেন, থাকবেন। তাঁরা তাঁদের কাজ শান্তিতে করুন, আমাদের কোন আপত্তি নেই। এইমুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদলের কোন অস্তিত্ব নেই।’

কিন্তু যে খবর রাজ্যমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছয়নি তা জেনে গেছেন সুধাময় সেন। নির্দিষ্ট সময়ে ছোটে মহারাজকে খুঁজে বের করতে পারেননি তিনি। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি শহরে কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। বারংবার ব্যর্থ হওয়ায় বড় মহারাজ তাঁকে বলেছেন, সন্ধান করতে হবে না। ছোটে মহারাজ সম্পর্কে বাবার আর কোন আগ্রহ নেই। সেইসঙ্গে সুধাময় আর একটি জিনিস লক্ষ করলেন। তাঁর কয়েকজন বড় পার্টি কন্ট্র্যাক্ট তুলে নিচ্ছে। অনেক বড় কোম্পানির সিকিউরিটির দায়িত্ব তাঁকে বহন করতে হয়। এজন্যে ভাল টাকা পাওয়া যাচ্ছিল। সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা। সেই পর্যায়ে পৌঁছবার সম্ভাবনা রয়েছে। সুধাময় জানেন, বাবার কাছে গিয়ে অনুরোধ জানালে কোন লাভ হবে না। হয়তো পৌঁছতেই পারবেন না সেখানে। তাছাড়া অসফল মানুষকে বাবা কখনই কৃপা করেন না।

একই অবস্থা ইউনিসের। সম্পূর্ণ সুস্থ হবার পর পুলিশ তাকে হয়রানি করেই চলেছে। একটার পর একটা কেস তার ওপর চাপানো হচ্ছে। আশ্রমের সাহায্য চেয়ে বারংবার দরবার করে কোন কাজ হচ্ছে না। এবং তাকেও বড় মহারাজ জানিয়ে দিয়েছেন ছোটে মহারাজকে খুঁজতে হবে না আর। ব্যর্থতা বাবা ক্ষমা করেন না। ইউনিস জানে। কিন্তু ধ্যানেশকে যারা মারল, তাকে যারা এতদিন বিছানায় শুইয়ে রাখল, তাদের কোন শাস্তি হল না কেন? সুস্থ হবার পর ইউনিস চামচেদের নিয়ে নেমে পড়েছিল আততায়ীদের সন্ধানে। যারা সেদিন গুলি চালিয়েছিল তাদের সন্ধান পেয়েছিল একমাস পরে। দুটো লোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল কৃষ্ণপুরের খালে। ধ্যানেশের মৃত্যু নিয়ে খবরের কাগজে খুব হৈচৈ হয়েছিল। এক জোড়া মৃতদেহ পাওয়ার পর সেটা সমাজবিরোধীদের দলীয় ঝগড়ার ফল বলে লেখা হল। এবং তার ঠিক সাতদিন পরে সনাতননাথের আশ্রমের সামনে বোমাবর্ষণ হল। সনাতননাথের প্রধান শিষ্য শ্রীনাথ তখন একটা লাল মারুতিগাড়িতে চেপে বের হচ্ছিলেন। গাড়িটা গুঁড়িয়ে গেল। রক্তাপ্লুত শ্রীনাথকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। আততায়ী ধরা পড়ল না।

অঙ্কটা সমান হয়ে যাওয়ার পর ইউনিস ভেবেছিল বাবার আশীর্বাদ পাবে। যাকে ওই কাজ করতে পাঠিয়েছিল তাকে পাকিস্তানে চালান করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশ্রম থেকে তার জন্যে অভিনন্দন তো দূরে থাক, কোন যোগাযোগ করল না কেউ। ইউনিস এইসময় সুধাময় সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করল। নিঃসঙ্গ সুধাময় ইউনিসকে পেয়ে স্বস্তি পেল। তারা দুজনেই স্থির করল, যে করেই হোক ছোটে মহারাজকে খুঁজে বের করবেই। একমাত্র ওঁকে খুঁজে নিয়ে বাবার কাছে গেলেই অবস্থা আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কানাই-এর সূত্র আগেই পাওয়া গিয়েছিল। প্যান্ট পরা মেয়েবন্ধু কানাই-এর বেশি না থাকায় লাবণ্যর খবর জানা গেল। ছোটে মহারাজ যখন উধাও হয়েছেন লাবণ্য তখন থেকেই আর বাড়িতে থাকছে না। সুধাময় লাবণ্যর বাবার সঙ্গে দেখা করলেন। অর্থবান এই মানুষটি কখনও মেয়েকে শাসন করেননি। তিনি মনে করেন লাবণ্য কোন অন্যায় করতে পারে না। সে গিয়েছে দেশের মানুষের জন্যে কাজ করতে। কোন রাজনৈতিক চালু দলের আদর্শে তার বিশ্বাস নেই। সমস্ত পশ্চিমবাংলার মানুষের বিশ্বাস অর্জন না করা পর্যন্ত ওরা একত্ৰিত ঘোষণা করবে না। দীর্ঘসময় আলোচনার পর সুধাময় এটুকু জানতে পারলেন। তাঁর ধারণা হল বৃদ্ধ মিথ্যে বলছেন না।

ইউনিস সেটা মানতে নারাজ। তার ধারণা, মেয়ে উগ্রপন্থী রাজনীতি করছে। কানাই এবং ছোটে মহারাজ সেই একই দলের সদস্য। বৃদ্ধকে চাপ দিলে মেয়ের হদিস পাওয়া যাবে। সুধাময় তাকে কাজটা করতে নিষেধ করলেন। দীর্ঘদিনের পুলিশের চাকরি তাঁকে যে অভিজ্ঞতা দিয়েছিল তাতে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন একটা অন্যরকম ঘটনা নিঃশব্দে ঘটছে। পশ্চিমবাংলার কোথাও উগ্রপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে না। এমন কি ডুয়ার্সের ওপরের দিকে জি এন এল এফের আক্রমণ এখন বেশ স্তিমিত। ইউনিসকে নিয়ে তিনি সোজা উত্তরবঙ্গে চলে এলেন। শহর নয়, ট্যাক্সি নয়, শিলিগুড়ি থেকে বাসে বাসে চষে বেড়াতে লাগলেন চা-বাগান অঞ্চল।

.

কানাই জানিয়েছিল, পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গোপন বৈঠকে স্থির করেছেন দুশ চুরানব্বইটি বিধানসভার আসনভিত্তিক এলাকার জন্য নির্বাচিত কর্মীরা আরও ব্যাপকভাবে যেন কাজ শুরু করেন। আপাতত অর্থের সাশ্রয় কম। সাধ্যের মধ্যে প্রত্যেককে এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারে। এবং কোন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে যাওয়া চলবে না। নেতৃত্ব আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, নির্মলের ডুয়ার্সের চা বাগান অঞ্চলে জনপ্রিয়তার কারণে সেখানেই কাজ করে যেতে হবে। লাবণ্যর সঙ্গে এলাকা সে যেন ভাগ করে নেয়।

বিশেষ কারণেই কানাই এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেদের গোপন রেখেছেন। তাঁরা সাধারণের সামনে কোনরকম রাজনৈতিক পরিচয় রাখছেন না। কানাই এখনও আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেটা নিজের প্রয়োজনে যতটা নয় তার থেকে অনেক বেশি নির্মলের কারণে।

সকালবেলায় নির্মল বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। এখানে স্ট্যান্ড বলতে হয়তো কোন একটি বিশেষ গাছ নির্দিষ্ট করা। তার চেহারায় একটা তামাটে ছাপ পড়েছে। পোশাকও মলিন। রিয়াবাড়ি চা বাগান থেকে চলে আসার পর বেশ কয়েকটা জায়গা ঘুরে এখন সে আশ্রয় নিয়েছে লঙ্কাপাড়া বাজারে। সানু ব্যানার্জি ফিরে আসার পর ওদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা আমার কাছে অতিথি হিসেবে থাকতে পারেন কিন্তু কুলিকামিনদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন না। এতে আমার চাকরি চলে যাবেই।’ প্রস্তাবটা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সেইরাত্রে কাঁটা হয়ে বসে থেকেও আউটহাউসে কোন অগ্নিকাণ্ড ঘটেনি। কিন্তু ফরেস্ট বাংলোটা জ্বলে গিয়েছে বলে পরে খবর পাওয়া গিয়েছিল। মিসেস ব্যানার্জির সঙ্গে সেই সকালে দেখা হয়নি। ওরা দুজনে বেরিয়ে গিয়েছিল চা খেয়ে। সেদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। নির্মল কুলিলাইনের যেখানেই গিয়েছে সেখানেই ভিড় জমে গিয়েছে তাকে ঘিরে। গরীব অশিক্ষিত মানুষগুলো তাকে ঘিরে চিৎকার করছিল দেওতা দেওতা বলে। নির্মল এবং লাবণ্য দেখল মানুষগুলো ন্যূনতম চিকিৎসা এবং বেঁচে থাকার বেশির ভাগ সুব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। হয়তো সেই সকালেই এই তল্লাটের মানুষ ভালবেসে ফেলেছেন নির্মলকে।

বাস থানামাত্র নির্মল হ্যান্ডেল ধরে পাদানিতে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল ভেতর থেকে। বাসে প্রচণ্ড ভিড়। ছাদ তো বটেই, পেছনের সিঁড়িতেও মানুষ বাদুড়ের মত ঝুলছে। কিন্তু কন্ডাক্টরও উদ্যোগ নিল ওকে ভেতরে জায়গা করে নিতে। এখন নির্মল এইরকম ব্যবহারে অভ্যস্ত। মানুষের অনাবিল ভালবাসা পাচ্ছে সে। ভারতীয় রাজনৈতিক পার্টিগুলো এখানে সক্রিয় নয় কিন্তু যারা সক্রিয় সেই জি এন এল এফ পর্যন্ত নির্মলকে কোন বাধা দেয়নি আর। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রধান মারা গিয়েছে এর মধ্যে। অথচ নির্মলকে আঁকড়ে ধরেছে প্রধানের মা। যতই উগ্র এবং বেহিসাবী রাজনীতি কেউ করুক না কেন, নিঃস্বার্থপর মানুষকে অসম্মানিত করার কথা চট করে কেউ ভাবে না। নির্মল ওপরে ওঠার আমন্ত্রণ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে পাদানিতেই দাঁড়িয়ে রইল। বীরপাড়ায় বাস ঢুকতেই সে নেমে পড়ল। এলাকার জন্যে যেন কয়েকটা কাজ নিয়ে সে এসেছে। জি এন এল এফের ভয়ে কোন সরকারি কাজকর্ম ওদিকে হচ্ছে না। ঘটনা যা ঘটেনি তার চেয়ে গুজব এত বেশি ছড়িয়েছে, কিছু কর্মচারি ভয়ে সেটাকেই অছিলা করে কাজ বন্ধ করে রয়েছে। বাস স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে খানিকটা যেতেই দুটো মানুষকে দেখতে পেল নির্মল। এরা বীরপাড়ায় নতুন। লোকদুটো পরস্পরকে দেখে নিয়ে সামনে এগিয়ে এল। ফর্সা বয়স্ক ভদ্রলোক নমস্কার করলেন বেশ সমীহ নিয়ে, ‘নমস্কার ছোটে মহারাজ! আপনার দর্শন পাওয়ার জন্যে আমরা সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ খুঁজে বেড়াচ্ছি। উফ্! আপনার, আপনার একি অবস্থা হয়েছে?’

‘আপনাদের পরিচয় জানতে পারি?’ নির্মল অত্যন্ত বিরক্ত হল।

‘আজ্ঞে আমি সুধাময় সেন, আর ইনি ইউনিস। আমরা বাবার অনুগত শিষ্য।’

‘আমাকে কি দরকার?’

‘আজ্ঞে, আপনার অনুপস্থিতিতে বাবা অত্যন্ত বিচলিত হয়েছেন। তিনি আমাদের আদেশ দিয়েছেন আপনাকে খুঁজে বের করতে। আসলে নির্দিষ্ট সময়ে আপনাকে খুঁজে বের করতে পারিনি বলে তিনি আমাদের ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’ সুধাময়ের খুব আনন্দ হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত তিনি সাফল্য পেলেন। এবার বাবার কোন ক্ষোভ থাকবে না তাঁর ওপর।

‘এসব কথা আমাকে বলে কোন লাভ নেই। আমি আশ্রম ত্যাগ করেছি। এখানে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’ আচমকা কথা শেষ করে নির্মল তার পথ ধরল। ইউনিস কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সুধাময় তাকে বাধা দিলেন। তিনি ইউনিসকে নির্দেশ দিলেন দূরে থেকে ছোটে মহারাজকে অনুসরণ করতে। সেই সুদর্শন তরুণের এখনকার সঠিক অবস্থা তিনি আগে জানতে চান। কিন্তু সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। বাবার ছেলের পক্ষে আশ্রমকে অস্বীকার করা আর কোন যুবরাজের ইংলন্ডের রাজসিংহাসন ত্যাগ করা মোটামুটি একই ব্যাপার।

সরকারি কর্তাদের বুঝিয়ে স্পটে নিয়ে যেতে পারা আর হিমালয়কে নড়ানো প্রায় এক ব্যাপার। পাহাড়িদের আন্দোলন না থামা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব নয়। প্রাণ হাতে করে ওখানে কাজ করা অসম্ভব। যে রেটে ফরেস্ট বাংলো পোড়াচ্ছে তাতে সরকারি কর্মচারি দেখতে পেলে হয়তো জ্যান্তই পুড়িয়ে ফেলবে। নির্মল তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করল, যারা আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে তারা সমগ্র জনসাধারণের পাঁচ শতাংশ। বাকি পঁচানব্বই ভাগই কিন্তু শান্তিকামী। সে শুনেছে কলকাতা শহরকে একসময় নকশালরা আতঙ্কিত এলাকায় ভাগ করে ফেলেছিল। সন্ধ্যের পর কোন মানুষ সেইসব এলাকায় হাঁটাচলা করতে চাইত না প্রাণের ভয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিনের বেলায় মানুষ অফিস, ব্যবসা করেছে। বোমা ফাটার পাঁচ মিনিট পরে মানুষ একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। তাহলে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ভয়ে সাধারণ মানুষের উপকার হবে, এমন কাজ থেকে সরকারি কর্মীরা কেন বিরত থাকবেন? রাস্তার প্লানটা যখন অনুমোদিত হয়েই আছে তখন বর্ষা নামবার আগে সেটা শুরু এবং শেষ করা উচিত। বিডিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুটি নলকূপ চা বাগান এলাকার ঠিক বাইরে তৈরি করে দেওয়া হবে। যে সমস্ত মানুষ চা বাগানে কাজ করেন না তাঁরা জলের অভাবে বড় বিপাকে পড়েছেন। পাহাড়ি ঝরণার জল খেয়ে ওই এলাকায় ইদানিং পেটের অসুখ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এসব কথা বলতে এসে প্রথম প্রথম যে প্রশ্নটার সম্মুখীন হতে হত তা হল, আপনি কোন পার্টির লোক? যেই ওঁরা শুনলেন যে নির্মল কোন পার্টির সমর্থক বা কর্মী নয় অমনি অবিশ্বাসের চাহনি আসত চোখগুলোতে। ঘরের খেয়ে কেউ বনের মোষ তাড়ায় না। কিন্তু ধীরে ধীরে ওঁরাও ব্যাপারটাকে মেনে নিতে আরম্ভ করেছেন। খবরটা পৌঁছেছে পার্টি অফিসগুলোয় যারা সরতে সরতে জি এন এল এফ অধ্যুষিত এলাকার বাইরে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাচ্ছে। ইতিমধ্যে নির্মলের কাছে দুই বিপরীত মানসিকতার পার্টি তো বটেই, বামফ্রন্টের শরিকদলগুলো থেকে আলাদা করে প্রস্তাব এসেছে তাদের হয়ে কাজ করতে। কি ভাবে রটে গিয়েছে নির্মলকে জনসাধারণের পাশে দাঁড়াতে বাধা দিচ্ছে না পাহাড়ি আন্দোলনকারীরা।

মালবাজারের ওপাশে লাবণ্য কিন্তু ঠিক এই সহায়তা পায়নি। ওখানে, বাগরাকোট-ওদলাবাড়ি এলাকায় প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে জি এন এল এফের সংঘর্ষ হচ্ছে। দুই-একজন করে প্রায় মারা যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ আরও ভীত হয়ে পড়েছে। লাবণ্য আশ্রয় পেয়েছিল বালুরঘাটের সুদীপ মণ্ডলের এক আত্মীয়র বাড়িতে, যিনি চালমায় মাস্টারি করেন। চালমার পার্টি অফিস এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। প্রায়ই তাদের সঙ্গে জি এন এল এফের জায়গা দখলের লড়াই হচ্ছে। সামসিং থেকে চাপড়ামারি আজ এর কাল ওর। এই অবস্থায় কাজ করতে গিয়ে দুই পক্ষ থেকে শাসানি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। সেই সঙ্গে সন্দেহ। রাতারাতি কিছু করা অসম্ভব হলেও হাতে যেহেতু সময় আছে, লাবণ্য দাঁত কামড়ে পড়ে আছে সেখানে। হয়তো মহিলা বলেই এখনও সে কিছুটা কাজ করে যেতে পারছে। কিছু কিছু মানুষ তার ওপর ভরসা করতে শুরু করেছে। এইসময় নির্বাচনে শাসকদল জয়ী হল। জলপাইগুড়ি জেলায় বিরোধীপক্ষ যেন পাতার মত ঝড়ের দোলায় উড়ে গেল। সাধারণ মানুষের সমর্থনের ওপর নির্ভর করলে আজকাল ভোটে জেতা যায় না। এলাকার মানুষেরা কেউ ভালবেসে ভোট দেয়নি। যারা দিয়েছে তাদের একাংশ ভয়ে, একাংশ অভ্যেসে, একাংশ জি এন এল এফের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সংগঠিত দলকে সমর্থনের জন্যে ব্যালটে ছাপ মেরেছে। এরপরেও আজকের ভারতবর্ষে যেটা নিতান্তই সত্য বলে স্বীকার করতে হবে সেটা হল ভোটের দিন যে রাজনৈতিক দল সংগঠন শক্তিতে ক্ষমতাবান, যারা পুলিশকে কতটা নিষ্ক্রিয় করে রাখতে সক্ষম তার ওপর জেতা-হারা নির্ভর করে। শাসক দলের কাছে বিরোধীরা কোন অবস্থাতেই হালে পানি পাবে না নিজেদের অপদার্থতার কারণে। কিছুদিন থেকেই লাবণ্য যে অভাবটা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছিল, তা হল অর্থের। ইতিমধ্যে সে একটা ছোটখাটো সংগঠন তৈরি করতে পেরেছে। কিছু অরাজনৈতিক ছেলেমেয়েকে নিয়ে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এলাকার বিত্তবান মানুষেরা শাসকদল, বিরোধী দল এবং পাহাড়ি আন্দোলনকারীদের চাঁদা দিয়ে এমন জর্জরিত যে, তাদের কাছে কোন সাহায্য পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দু-একটা ছোটখাটো ঘটনা লাবণ্যকে উৎসাহিত করেছে। সামসিং-এর কাছাকাছি একটি প্রাইমারি স্কুল আন্দোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাতিল হয়েছিল। লাবণ্যরা সেই স্কুলটিকে কোনমতে মেরামত করে আবার চালু করার চেষ্টা করছিল। গ্রামের বাচ্চাদের পাঠানোর জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরছিল। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে কিছু বাচ্চা এলে তাদের ভাঙা বারান্দায়, সামনের মাঠে বসে পড়ানো শুরু হল। এইসময় হঠাৎ মেটেলির এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি দশহাজার থাকা খরচ করে স্কুলটির চেহারা ফিরিয়ে দিলেন। লাবণ্যর বিশ্বাস হল কোন সৎ প্রচেষ্টা যখন টাকার অভাবে আটকে যায়, তখন কিছু কিছু মানুষের বিবেক আক্রান্ত হয়।

চালমা থেকে সোজা বীরপাড়ায় চলে এল এক দুপুরের বাস ধরে লাবণ্য। এখন সে প্যান্ট আর সার্টের ওপর ভরসা রেখেছে। শাড়ি ব্যবহার করলে অনেক পরিস্থিতিতে তাকে ঝামেলায় পড়তে হত। জিনসের প্যান্টের মজা হল হাজার ময়লা হয়ে গেলে অথবা রঙ চটে গেলেও চট করে বোঝা যায় না। সুবিধেটুকু নিতে চেয়েছে সে। নির্মলের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে কয়েকদিন থেকেই প্রবল হচ্ছিল। চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু চিঠি লেখার ব্যাপারে নির্মল বড় অলস।

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছনো মাত্র লাবণ্যকে দেখতে পেল সুধাময়। এই প্যান্টসার্ট পরা মেয়েটির সঙ্গে ছোটে মহারাজ চলে এসেছেন বলে তিনি নিশ্চিত হলেন। মেয়েটি হয়তো সুন্দরী ছিল কিন্তু ইতিমধ্যে একধরনের কাঠিন্য সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মালবাজার অঞ্চলে তিনি একটি প্যান্টশার্ট পরা সমাজসেবিকার কথা শুনেছিলেন। কিন্তু ছোটে মহারাজকে খোঁজার ইচ্ছা এত প্রবল ছিল যে, সেবিকাকে দেখার বাসনা হয়নি। ইউনিস গিয়েছে অনেকক্ষণ। তার কিংবা ছোটে মহারাজের দেখা না পাওয়াতে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। এইসময় লাবণ্যকে দেখে কিছু উৎসাহ ফিরে এল। সুধাময় এগিয়ে গেলেন লাবণার সামনে। নমস্কার করে বললেন, ‘আমার নাম সুধাময় সেন! আপনি কি ছোটে মহারাজের জন্যে অপেক্ষা করছেন?’

‘কে ছোটে মহারাজ?’ লাবণ্য অবাক হল।

’ওঁর ভাল নাম নির্মল।’

‘না। এখানে আমি কোন মানুষের জন্যে অপেক্ষা করছি না।’ লাবণ্য হাসল, কি ব্যাপার বলুন তো? আপনার কৌতূহলের কারণটা জানতে পারি?’

সুধাময় বুঝলেন, এই মেয়ে সুবিধের নয়। অতএব ভনিতা না করে তিনি সরাসরি বললেন, ‘আমি জানি নির্মলবাবু আপনার সঙ্গেই এই অঞ্চলে এসেছেন। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে চলে আসায় ওদিকে খুব অশান্তি হচ্ছে। আপনার কাছে আমি অনুরোধ করছি ওঁকে বুঝিয়ে বলতে যেন একটি বারের জন্যে হলেও আশ্রম থেকে ঘুরে আসেন।’

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *