জন-যাজক – ৪

আজ সকালে কানাই, সুদীপ এবং অনিলবাবু চলে গিয়েছেন। ঠিক হয়েছে, নির্মল এবং লাবণ্য দায়িত্ব নেবে কলকাতার। কলকাতার সব কটি বিধানসভার নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে দলের যোগ্যতম প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের মাধ্যমে এ মাসের মধ্যেই নির্মল এবং লাবণ্য কাজ শুরু করবে। কানাই চেয়েছিল নির্মল আরও কিছুদিন আত্মগোপন করে থাক। নির্মল সেটা আর চাইছিল না। এই সময় লাবণ্য একটা পরামর্শ দিল। গোর্খাল্যান্ডের দাবী নিয়ে দার্জিলিং জেলায় যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার জের ছড়িয়ে পড়েছে ডুয়ার্সের অর্ধেক জায়গায়। যদিও সেই আন্দোলন তেমন জোরদার হয়ে ওঠেনি এখনও কিন্তু বামফ্রন্টের কাজ করার জায়গা তাতে সংকুচিত হয়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে তিস্তার ওপারের মানুষ প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় দিন যাপন করছেন। কলকাতার কাজ শুরু করার আগে নির্মলের উচিত ওই এলাকায় কিছুদিন থাকা। দলের কিছু কর্মী ওখানে তৈরি হয়ে আছেন। সেখানে সংগঠনের কাজ এই সুযোগে চালু করে দেওয়া সম্ভব। লাবণ্যের প্রস্তাবে সবাই একমত হয়েছিল। এমন কি নির্মলও। ঠিক হয়েছিল, কলকাতাকে এড়িয়ে আজকের দুপুরের বাস ধরে ওরা বর্ধমান যাবে। সেখান থেকে দার্জিলিং মেল ধরবে। দুপুরে আকাশবাণীর খবরটা শোনার পরই ওর বাবার মুখ মনে পড়ল। হঠাৎ এসব কি আরম্ভ হল? তার চলে আসার জন্যে নিশ্চয়ই বাবার সুনাম হানি হয়েছে! তিনু মহারাজের মৃত্যু এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক ভক্ত নিহত হল। ঘটনাগুলো কোন কিছু নির্দেশ করছে বলে মনে করতে পারল না সে। অবশ্য ব্যাপারটা এত সাধারণ যে বাবার দুর্গে কোন আঘাত হানবে না।

বারোটা নাগাদ ওরা মহিলার কাছে বিদায় নিল। তার আগে অবশ্য একটা ছোট ঘটনা ঘটেছিল। লাবণ্যকে নির্মল বলেছিল, ‘আমরা জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের একজন হয়ে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছি। এক্ষেত্রে আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যার ফলে সাধারণ মানুষ আমাদের দূরের লোক বলে ভাবে। ওই পোশাকে আপনি নিশ্চয়ই স্বচ্ছন্দ কিন্তু একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত মহিলা আপনজন ভাববে না। চুল বড় করার আপাতত কোন উপায় নেই। কিন্তু আপনি শাড়ি পড়লে কি খুব অসুবিধে হবে?’

লাবণ্য অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তাকে শাড়ি পরতে কেউ কখনও জোর করেনি। বাড়ির আবহাওয়া এমন ছিল যে, সার্টপ্যান্টে কোন অসুবিধে হয়নি। আজকের পশ্চিমবাংলায় ষোল-সতের বছরের মেয়েদের দশজনের অন্তত তিনজন প্যান্ট পরে। ব্যাপারটা মেনে নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। প্যান্টে সে স্বস্তি পায়, চটপটে হওয়া যায়। একটা কড়া জবাব দিতে গিয়েও সে সামলে নিল। নির্মলের চোখেমুখে, তাকানোর ভঙ্গিতে অদ্ভুত এক মায়াময় ব্যক্তিত্ব আছে যার সামনে দাঁড়িয়ে তর্ক করতে ইচ্ছে করে না। কানাই-এর কাছে সে নির্মলের ইতিহাস শুনেছে। গুরুবাদে তার কোনদিনই বিশ্বাস নেই। বাবাকে সে কখনও দ্যাখেনি, আগ্রহও নেই। কিন্তু গতবাতে আলোচনার সময় তো বটেই, আজ যতবার নির্মল কথা বলেছে মনে হয়েছে এক ধরনের জ্যোতি ওকে ঘিরে রেখেছে। সবকথা যে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত নির্মল বলছে এমন নয়। মাঝে-মাঝেই তাকে বাস্তব জগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। প্রায় শিশুর সারল্য নিয়ে সে কথাগুলো বলছে। কিন্তু তত্ত্বগত ব্যাপারে কথা বলার সময়ে খুব দৃঢ় দেখাচ্ছে ওকে। মনে হয় যেন নেতৃত্ব দিতেই ও জন্মগ্রহণ করেছে। চট করে পাঁচটা ছেলের থেকে ওকে আলাদা মনে হয়। লাবণ্য বলল, ‘মুশকিল হল নির্মলবাবু, আমার সঙ্গে শাড়ি নেই। প্যান্ট সার্ট নিয়েই বেরিয়েছি।’

‘কাজটা ঠিক করেননি। কোলাঘাটে পৌঁছে কোন দোকান থেকে এক প্রস্থ কিনে নিন।’

নির্মল কথা শেষ করতে যদি লাবণ্যের ঠোঁটে চিলতে হাসি ফোটে তাই মহিলা হেসে উঠলেন সশব্দে। খুব বোকার মত কিছু বলে ফেলেছে কিনা ঠাওর করতে পারল না নির্মল। সে আরও গম্ভীর হয়ে গেল। মহিলা হাসি থামিয়ে বললেন, ‘উফ্‌! তুমি বুঝি মেয়েদের সঙ্গে কোনদিন থাকনি?’

‘না। আমার মা বাল্যকালেই মারা গিয়েছেন।’

‘শোন। শুধু শাড়ি কিনলেই হবে না, মাপমত মেলানো জামা চাই, পেটিকোট দরকার। কোলাঘাটের দোকানে ও এই বেশে সেসব কিনতে গেলেই দোকানদার সন্দেহ করবে কিছু গোলমাল আছে। তাছাড়া রেডিমেড জামায় তো সবার ফিটিংস ঠিক হয় না। যে দেখবে সেই বুঝবে।’ খুব সরলভাবে কথাগুলো বলেছিলেন মহিলা। কিন্তু কথাগুলো নির্মল নিয়েছিল বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। শুধু একটা সুন্দর শাড়ি মানেই পরিপূর্ণতা নয়, তার সঙ্গে মিলিয়ে অন্যান্য উপকরণ দরকার। অর্থাৎ সব কিছু একত্রিত না হলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হয় না। আলাদা আলাদা করে কারো তেমন মূল্য নেই তা যত বড়ই হোক না কেন?

নির্মল বলল, ‘আপনি কি বাড়িতে শাড়ি পরেন না?’

লাবণ্য অকপটে স্বীকার করল, ‘না। খুব মুশকিলে ফেলে দিলাম না? আচ্ছা, আমাকে মেয়ে বলে ট্রিট করার দরকার কি? ট্রিট মি অ্যাজ এ পার্শন।’

বেরিয়ে আসার মুখে মহিলা বললেন, ‘তোমার কথা অনেকদিন মনে থাকবে নির্মল। যদি কখনও এদিকে আসো তখন দেখা করো।’

নিচে নেমে হাঁটতে হাঁটতে নির্মল পেছন ফিরে তাকাল। পেছনের জানলায় সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে আছে। হঠাৎ নির্মলের খেয়াল হল গতরাত থেকেই ওকে সে বেশি দেখেনি। এখন মুখটাকে খুব করুণ দেখাচ্ছে। লাবণ্য মেয়েটিকে লক্ষ করেছিল। বলল, ‘মেয়েটি কথা বলতে পারে না অথচ ভীষণ এক্সপ্রেসিভ।’

চমকে উঠল নির্মল। ছোট ছোট ঘটনাগুলো মনে পড়ল ওর। এমন কি বমি করার পর যেভাবে মেয়েটি এগিয়ে এসেছিল তাও। ভেবেছিল ভীষণ লাজুক বলেই কথা বলতে চায়নি মেয়েটি। কখনও কখনও কথার কোন প্রয়োজন হয় না। বোঝাতে যে পারে তার কাছে কথা হার মানে। সে আবার পেছন ফিরে তাকাল। গাছের আড়ালে জানলা ঢাকা পড়ে গেছে।

.

মৃতদেহ নিয়ে শোকমিছিল বের করতে দিল না পুলিশ। কিন্তু সমস্ত শহর অবাক হয়ে দেখল দীর্ঘ তিনমাইল ব্যাপী একটি শোকমিছিল শহর পরিভ্রমণ করল। কোন পোস্টাব নেই, লরি-বাসে গ্রাম থেকে পয়সা দিয়ে লোক না এনেও এমন মিছিল করা সম্ভব যা যে কোন রাজনৈতিকদলের ক্রিয়াকাণ্ডকেও হার মানায়। শোক মিছিল যেখানে সবশেষে জমায়েত হয়েছিল সেখানে বাবার পক্ষ থেকে বড় মহারাজ মৃত ভক্তদের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করলেন। তিনি লক্ষ ভক্তদের বললেন, ‘ধর্মাচরণের স্বাধীনতা হরণ করার কোন অধিকার এই সরকারের নেই। ধ্যানেশকুমারের সঙ্গে আশ্রমের সম্পর্ক সাময়িকভাবে ছিন্ন হলেও তিনি বাবার পবিত্র নাম প্রচার করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমাদের গুরুভাইরা সরল মনে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। নাম যখন হৃদয় থেকে উচ্চারিত হয় তখন কে শিষ্য কে নয়, তা বিচাব করে দেখা বাতুলতা। ধ্যানেশ অন্যায় করেছিল কিনা তা বিচার করার জন্য আদালত রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন খুনের আসামীকে কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু স্বার্থসর্বস্ব সম্প্রদায়ের প্ররোচনায় পুলিশ গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলার পাঁচকোটি গুরুভাইকে কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করছি। আপনারা পূজনীয় বাবার পরবর্তী আদেশের জন্যে অপেক্ষা করুন। ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করা ভক্তের প্রধান কর্তব্য। সেই আদেশ না আসা পর্যন্ত সবাই স্থির থাকুন।’

এই শোকসভার বিবরণ পাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে মেজ মহারাজ টেলেক্স মারফত আশ্রমে বসে খবর পেলেন রাজ্যমন্ত্রী বাবার দর্শনপ্রার্থী। তিনি রাত দশটায় বাবার আশ্রমে আসতে চান। বাবা কি অনুমতি দেবেন?

পরিস্থিতি এখন এমন যে,মেজ মহারাজ জানেন, বাবা রাজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। রাত দশটার সময়ে তিনি বহিরাগতদের সঙ্গে দেখা করেনও না। তাছাড়া গুলিচালানোর ঘটনা আকাশবাণী প্রচার করার কয়েক ঘণ্টা পরেই দিল্লী থেকে খবর এসেছে কেন্দ্রীয়মন্ত্রী তাঁর কর্মসূচী এগিয়ে এনে আগামীকাল সকালে কলকাতায় পৌঁছেই এখানে উপস্থিত হবেন। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর আসার খবর স্থানীয় সরকারি কর্তারা জানেন। আজ জেলা শাসক এবং এস পি তাঁর সঙ্গে দেখা করে গেছেন। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন আশ্রমের ভেতরে কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর সমস্ত দায়িত্ব তাঁদের। পুলিশ যদি আশ্রমে ঢুকতে চায় তাহলে কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন না। এস. পি. খবরটা ওপরতলায় জানাবেন বলে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রাজ্যমন্ত্রীর এই আচমকা দেখা করতে চাওয়াটা বিস্ময়ের। তিনি সময়সুবিধে মত একবার আসবেন বলে কিছু দিন আগে জানিয়েছিলেন। মেজ মহারাজ আনন্দভবনে ছুটলেন গাড়ি নিয়ে।

বাবা গতকাল থেকে জলস্পর্শ করছেন না। দুই ভক্তর মৃত্যুসংবাদের পর তিনি জল এবং অন্ন গ্রহণ করবেন না আটচল্লিশ ঘণ্টা, বলে স্থির করেছেন। এই খবরও সংবাদপত্র মারফত প্রচারিত হয়েছে। আজ ও গতকাল সাংবাদিকরা তাঁর দর্শন পাওয়ার জন্যে অনেক পীড়াপীড়ি করে ব্যর্থ হয়েছে। একজন শিষ্যচিকিৎসক সবসময় আনন্দভবনে তৈরি আছেন বাধার শরীরের ওপর লক্ষ রাখতে। আশ্রমের সর্বত্র একটা কি হয় কি হয় ভাব।

অসময়ে আসার জন্যে অনুমতি প্রার্থনা করে অপেক্ষা করছিলেন মেজ মহারাজ। বড় মহারাজ এখন কলকাতায়। অন্যান্য মহারাজদের সঙ্গে আলোচনার পর বড় মহারাজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছেন তিনি। বড় মহারাজ কি আশঙ্কা করছেন বাবা তাঁকে প্রধান উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে যাবেন না। সেদিন আলোচনার সময় বাবা যদিও স্পষ্ট ভাষায় মনের কথা ব্যক্ত করেননি। তবু ওইরকম একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। বাবা বারংবার ছোটে মহারাজের নাম বলছিলেন। এটা মেজ মহারাজেরও পছন্দ হয়নি। অবশ্য তিনি ছোটে সম্পর্কে তাঁর কোন ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেননি। আবার বড় মহারাজকে কলকাতার জনসভায় বক্তৃতা দিতে পাঠিয়ে বাবা তাঁর মনে আবার বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছেন যে, তিনিই প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এক্ষেত্রে তাঁর নিজের জায়গা কোথায়? মেজ সন্তান হয়ে জন্মাবার জন্যে তিনি তো দায়ী নন। কিন্তু কেউ যদি প্রকৃত নিষ্ঠার সঙ্গে বাবার আদর্শ অনুসরণ করে থাকে সে তো তিনিই।

অনুমতি পাওয়া মাত্র মেজ মহারাজ কক্ষ পেরিয়ে বাবার সামনে উপস্থিত হয়ে নতজানু হয়ে প্রণাম জানালেন। বাবা শুয়ে আছেন ইজিচেয়ারে। চিকিৎসক তাঁর প্রেসার মাপছিলেন। কাজটি শেষ হলে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি দেখলে বৈদ্য?’

চিকিৎসক অত্যন্ত বিনীত স্বরে বললেন, ‘ধৃষ্টতা মাফ করবেন, আপনার প্রেসার খুব নেমে গেছে। এখন আহার এবং বিশ্রামের অত্যন্ত প্রয়োজন।’ বাবা হাসলেন, ‘আগামীকাল সকালের আগে তো ওই চিন্তা করা বাতুলতা। এবার এসো তুমি।’ চিকিৎসক চলে গেলে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জনসভায় কোন গেলামাল হয়েছে?’ মেজ মহারাজ বললেন, ‘না। খুবই শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে খবর পেলাম।’

‘হুঁ! ছোটের কোন খবর পেলে?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সুধাময় এবং ইউনিস যে এত ব্যর্থ হবে আমি ভাবিনি। ওদের তুমি শেষবারের মত নির্দেশ দাও। আগামী পূর্ণিমার মধ্যে ছোটের খবর চাই আমি। এখানে কি কারণে আসার প্রয়োজন হল এই সময়ে?’

‘বাবা, এইমাত্র খবর পেলাম রাজ্যমন্ত্রী আজ রাত্রে আপনার দর্শন চান।’

‘তাই নাকি? কিন্তু আমি তো অসুস্থ।’

‘সেইমত জানিয়ে দেব!’

‘দাও। না, না। অসুস্থতার সংবাদ প্রচারিত হলে সনাতননাথেরা ভাববে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। আসতে দাও ওকে। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলবে।’ বাবা নিঃশ্বাস ফেললেন, কেন্দ্রীয়মন্ত্রীকে অভ্যর্থনার সব আয়োজন করা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। আপনি যদি আদেশ দেন তাহলে রাজ্যমন্ত্রীর দপ্তরে আপনার অনুমতির কথা জানিয়ে দিতে পারি। সময় বেশি নেই।’ মেজ মহারাজ সোজা হয়ে বসলেন।

‘যাও। কিন্তু ছোটের কথা মনে রেখ। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’

রাজ্যমন্ত্রী এলেন সরকারী হেলিকপ্টারে, ঠিক দশটা বাজতে দশ মিনিট আগে। তার সঙ্গে কোন সরকারি কর্মচারি ছিল না। মন্ত্রীসভায় তাঁর একান্ত অনুগত এক তরুণ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিচে নেমে এলেন। তাঁর এই আগমনের কথা জেলা শাসককেও জানানো হয়নি। কোন সিকিউরিটির ব্যবস্থাও হয়নি। মেজ মহারাজ এগিয়ে গিয়ে নমস্কার জানাতে রাজ্যমন্ত্রী স্মিতমুখে হাত জোড় করলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি কেমন আছেন?’

মেজ মহারাজ় মাথা নাড়লেন, ‘প্রেসার খুব কমে গেছে। চিকিৎসক দেখছেন।’

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘অসময়ে এলাম। কোন অসুবিধে হবে না তো?’

মেজ মহারাজ হাসলেন, ‘আপনার কথা শুনে উনি আপত্তি করেননি।’

‘আগামীকাল কেন্দ্রীয়মন্ত্রী তো এখানে আসছেন।’

‘হ্যাঁ। তাঁকে বাবা শৈশব থেকেই চেনেন।’

গাড়িতে ওঠার আগে রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমি আসার এই খবরটা প্রচার হয়নি তো?’

‘আজ্ঞে না। আশ্রমে রাত নটার পর শিষ্যদের ঘরেই থাকতে হয়। তাছাড়া সবাই এখন শোকবিহ্বল। তবে সাংবাদিকদের কাছে খবরটা পৌঁছয়নি।’

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘ওইটেই গোলমাল। আমি চাই না এ নিয়ে প্রচার। এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত সফর।’ গাড়িতে যেতে যেতে মন্ত্রীসভার তরুণ সদস্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই যে এত এলাকা জুড়ে আশ্রম করেছেন আপনারা, আসল উদ্দেশ্য কি?’

‘ধর্মাচরণ।’ মেজ মহারাজ জবাব দিলেন এক কথায়।

আনন্দভবনের পেছনের দরজায় গাড়ি থামল। সাংবাদিক বা কোন উৎসুক দৃষ্টি এড়াতেই এই ব্যবস্থা। গাড়ি থেকে নেমে মেজ মহারাজ একজন সেবককে বললেন, ‘বিশেষ অতিথি এসেছেন। খবরটা দাও।’ মিনিট খানেকের মধ্যে সেবক ঘুরে এল, ‘বাবা এখন কিছুক্ষণ মৌনী আছেন। আধঘণ্টা পরে কথা বলবেন।’

রাজ্যমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি কথা বলছেন না কেন?’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘গুলিতে নিহত ভক্তদের আত্মার শান্তির জন্যে।’

রাজ্যমন্ত্রী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মেজ মহারাজ বললেন, ‘আপনি আমাদের অতিথিশালায় চলুন, সেখানেই বিশ্রাম করবেন।’

রাজ্যমন্ত্রী মাথা নাড়লেন, ‘না, না। এই বেশ আছি। এই নির্জন পরিবেশ খুব ভাল লাগছে।’ উপাসনাগৃহ থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল। মন্ত্রীসভার তরুণ সদস্য জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওটা কি কোন মন্দির? মেজ মহারাজ মাথা নাড়লেন, ‘না। বাবা মনে করেন মানুষের মনই ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় মন্দিব। ওটি এই আশ্রমের উপাসনাগৃহ। আসুন না।’মেজ মহারাজ সম্মতির জন্যে অপেক্ষা না করে এগিয়ে যেতেই বাজ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গীসহ অনুসরণ করলেন। বাবা এইটুকু পথ গাড়িতে যান। কিন্তু সেবকদের পাহারায় মেজ মহারাজ রাজ্যমন্ত্রীকে পথটুকু হাঁটিয়েই আনলেন। উপাসনাগৃহের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে মেজ মহারাজ নতজানু হয়ে বাবার নাম জপ করলেন। তারপর উঠে দেখলেন রাজ্যমন্ত্রী তেমনই ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রাজ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গীকে বললেন, ‘সত্যি, এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে বেশ শান্তি হয়। ধ্যানের পক্ষে আদর্শ জায়গা।’

মন্ত্রীসভার তরুণ সদস্য বলে ফেললেন, ‘ধ্যান?’

রাজ্যমন্ত্রী জবাব দিলেন না। তিনি তখন ধীরে ধীরে চারধার ঘুরে দেখতে ব্যস্ত। ঠিক আধ ঘণ্টা পরে সেবক ছুটে এসে জানাল, বাবা স্মরণ করেছেন। দ্রুত পথটুকু পার হবাব পর মেজ মহাবাজ লক্ষ করলেন রাজ্যমন্ত্রী সিঁড়িগুলো প্রায় যুবকের মত ডিঙিয়ে এলেন। জুতো খুলে দ্বিতীয় কক্ষে ওঁরা প্রবেশ করতেই মেজ মহারাজ নতজানু হলেন। রাজ্যমন্ত্রী তাই দেখে নতজানু হতে গিয়েও সামলে নিয়ে দুটো হাত বুকের ওপর যুক্ত কবে রাখলেন। বাবা বসেছিলেন ইজিচেয়ারে, সেই একই ভঙ্গিতে। এবার সামান্য মাথা নেড়ে ইঙ্গিতেই বসতে বললেন। মেজ মহারাজ খানিকটা দূরত্ব রেখে মেঝের ওপর বসছেন দেখে রাজ্যমন্ত্রী সেইখানেই বসে পড়লেন। মন্ত্রীসভার তরুণ সদস্য বসলেন রাজ্যমন্ত্রীর পেছনে।

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপনার শরীরের কথা আমি শুনেছি। এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে হল বলে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু না করেও উপায় ছিল না।’

‘আমি যদি বিরক্ত হতাম তাহলে কি দেখা হত?’ বাবা মৃদু হাসলেন, ‘আর অসময় আবার কি? যত রাত হবে তত তোমার সুবিধে, মানুষজনের সামনে পড়তে হবে না। তারা তোমাকে দেখার জন্যে হুড়োহুড়ি করবে না। এটাই তো তোমার ঠিক সময় রাজ্যমন্ত্রী রুমাল বের করেও আবার সেটাকে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে, মানে, একটু নিভৃতে, বুঝতেই পারছেন! ‘

‘নিভৃতে? এর চেয়ে নিভৃত পেতে গেলে মেজকে আর তোমার সঙ্গীকে চলে যেতে বলতে হয়। মেজর ওপর আমার বিশ্বাস আছে, তোমার সঙ্গীর ওপর কি তোমার আস্থা নেই? সেক্ষেত্রে অবশ্য। বাবা আবার হাসলেন ‘ রাজ্যমন্ত্রী খুব অস্বস্তিতে পড়লেন। তাঁর সঙ্গী উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু রাজ্যমন্ত্রী ইঙ্গিতে তাকে বসতে আদেশ করলেন। করে মেজ মহারাজের দিকে তাকালেন একবার। ইতিমধ্যে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ বল? তোমাব তো আরও পরে আসার কথা ছিল।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি জানেন কিনা জানি না, ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরাই একমাত্র দল যারা জনসাধারণের বিশ্বাস অর্জন করেছি। শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। ভারতবর্ষের সংবিধানানুযায়ী রাজ্যের হাতে বেশি ক্ষমতা নেই। কেন্দ্রে যেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল সরকার রয়েছে তাই নানা কাজে আমাদের বাধা পড়ছে। তবু আমরাই একমাত্র দল যারা মানুষের উপকারে আসতে পেরেছি। এই অবস্থায় জনসাধারণ যদি কোন ব্যাপারে আমাদের ভুল বোঝে, তাহলে পশ্চিমবাংলার মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নেই বাধা পড়বে।’

বাবা মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক কথা। যারা কাজ করতে চায় তাদের সেটা করতে দেওয়া উচিত।’ রাজ্যমন্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল, ‘পুলিশের গুলি চালনার ব্যাপারে জনসাধারণের কিছু অংশ আমাদের ভুল বুঝেছে। আমি আপনার স্টেটমেন্ট কাগজে পড়েছি। ওই শোকমিছিলে আপনি যাননি বলে কৃতজ্ঞবোধ করছি।’

বাবা বললেন, ‘দ্যাখো, এতক্ষণ তুমি যা বললে তাতে যদি রাজনীতি থাকে তাহলে সেটা আমার বোধগম্য হয়নি। রাজনীতি আমি বুঝি না। কিন্তু তোমার ভাই যদি পুলিশের গুলিতে মারা যায় তাহলে তুমি দুঃখিত হবেই, এটা আমি বুঝতে পারি।’

‘ঠিকই। খুব অন্যায করেছে পুলিশ। আসলে পুলিশবাহিনীর একাংশ আমাদের সমর্থক নয়। তারাই এই ধরনের বিপাকে আমাদের ফেলে দেয়।’

‘তা তুমি কেন ছুটে এলে বল?’

‘আজ শোকসভায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, আপনার পরবর্তী আদেশের জন্যে ভক্তরা যেন অপেক্ষা করেন। এ ব্যাপারে আমি আপনার শরণাপন্ন।’

‘আমার? সেকি! কেন? তুমি তো আমার শিষ্য নও।’

‘ঠিকই। কিন্তু জনসাধারণ যাঁকে শ্রদ্ধা করে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আপত্তি নেই। একসময় আমরা সুভাষ বোসকে গ্রহণ করতে পারিনি কিন্তু জনসাধারণ তাঁকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে দেখে এখন গ্রহণ করেছি।’

‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না বাপু। তুমি বলছ জনসাধারণ তোমাদের বিশ্বাস করে, কাছের লোক বলে মনে করে। তাহলে আর তোমাদের ভয় কি?’

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘জনসাধারণের মন হল জলের মতন। যে পাত্রে থাকবে সেই পাত্রের আদল নেবে। ভুল বুঝতে ওদের জুড়ি নেই।’

বাবা হাসলেন, ‘তাহলে তোমরা কাছের লোক হলে কি করে? এখন কি করতে চাও?’

রাজ্যমন্ত্রীর মুখে ছায়া নেমেছিল। সেটি সরিয়ে তিনি বললেন, ‘যিনি মারা গিয়েছেন তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেব। প্রশাসনিক তদন্তের ব্যবস্থা করব যাতে দোষী পুলিশরা শাস্তি পায়।’

বাবা হাসলেন, ‘এসব করে কি তুমি নিহত মানুষটির প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে?’

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘না। আমার সেই ক্ষমতা নেই। কিন্তু আপনি যদি আদেশ করেন কোন কাজ সম্পন্ন করতে, আমি বিনা দ্বিধায় সেটা করে দেব।’

বাবা বললেন, ‘কারণ?’

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপনি বিচক্ষণ। নইলে এত মানুষ আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করত না। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো যাই প্রচার করি এদেশের মানুষের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। আপনিও জানেন মুসলমানরা তাঁদের ধর্মবিশ্বাসে অটল। হিন্দুরা একটু সহনশীল। কিন্তু আপনার শিষ্যরা প্রমাণ করছেন যে, আদেশ পেলে তাঁরা উগ্র হতে পারেন। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না।’

‘বেশ। আমি তোমার ওপর আর একবার আস্থা রাখছি। এবার তুমি যাও, আমার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়েছে।’ বাবা ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।

রাজ্যমন্ত্রী হাত জোব করলেন, ‘আপনি, আপনি কিছু বলবেন না?’

বাবা গম্ভীর হলেন, ‘অনেক কথাই তো বললাম।’

রাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপনি যদি আমাদের হয়ে কাগজে একটা বিবৃতি দেন—’

বাবা বললেন, ‘তোমাদের কাউকে তো জানি না বাপু। তুমি এসেছ, তোমার হয়ে বলব, শরণাপন্নকে আশ্রয় দেওয়া মানবধর্মের অঙ্গ।’

রাজ্যমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, ‘নির্বাচন আর কয়েকমাস বাদে। পাঁচ কোটি ভোটের অভাব আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।

‘সেকি! এই পাঁচ কোটি ভোট যারা দেবে তাদের তোমরা বোঝাওনি?’

‘চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার আদর্শ ওঁদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।’

‘সেটা ভাল না মন্দ?’

‘মন্দ হলে ওঁরা নিশ্চয় ভুল বুঝতে পারতেন।’

‘বেশ। এই ঘটনার জন্যে কোন ভোট হারাবে না তুমি।’

রাজ্যমন্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল। দাঁড়িয়েই তিনি প্রণাম সারলেন। তারপর বললেন, ‘বিদায় নেওয়ার আগে আর একটা কথা বলতে পারি?’

‘স্বচ্ছন্দে। তবে বেশি সময় নিও না।’

‘আগামীকাল কেন্দ্রীয়মন্ত্রী আসবেন দর্শনের জন্যে।’

কিন্তু রাজ্যমন্ত্রীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হাত তুলে থামালেন বাবা, ‘অন্যের ঘরে উঁকি মারা অভ্যাস অত্যন্ত অশোভন। নিজেরটা সামলে থাকলেই তো হল। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী আর তুমি আমার কাছে সন্তানতুল্য। আগে থেকে কান ভারী হলে আমার খুব জ্বালা হয় শরীরে। এসো।’

হেলিকপ্টারের কাছে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত রাজ্যমন্ত্রী কোন কথা বলেননি। মেজ মহারাজ সঙ্গে ছিলেন, ওঠার আগে বাজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আপনাদের যদি সরকারি লেভেলে কোন প্রয়োজন থাকে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। আর এই বিবৃতি আমি ফিরে গিয়েই কাগজে পাঠাবো যাতে আগামীকাল বের হয়। বাবা কাগজ পড়েন তো?’

মেজ মহারাজ মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ। বাবা সব খবরই রাখেন।’

.

দার্জিলিং মেইল নিউজলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছলো বেশ লেটে। স্টেশন থেকে বেরোবার আগে খবরের কাগজ কিনল নির্মল। প্রথম পাতার মাঝামাঝি জায়গায় তার চোখ পড়ল। রাজ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ‘গুলি চালানোর ব্যাপারে প্রশাসনিক তদন্ত হবে। মৃত ভক্তের আত্মীয়দের পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। দোষী পুলিশরা শাস্তি এড়াতে পারবে না। ঠিক তার পাশেই বাবার বিবৃতি ‘এই দুঃখজনক ঘটনা মেনে নেওয়া সত্যি অসম্ভব। ভক্তদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু রাজ্যমন্ত্রীর ওপর এখনও আস্থা রাখছি আমি। প্রশাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি থাকলেও তিনি পরিস্থিতি সামলে উঠবেন বলে, মনে হয়। এক্ষেত্রে ভক্তশিষ্যরা যেন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন।’

নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে ডুয়ার্সে যাওয়ার জন্যে যে বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, তার একটায় বসে নির্মল খবরগুলো, খুঁটিয়ে পড়ল। ধ্যানেশকুমারের সঙ্গে তার সামান্যই আলাপ ছিল। কিন্তু ভারতবিখ্যাত ওই গায়ককে আনন্দভবনে বাবার ঘরের সামনে পড়ে থাকতে সে দেখেছে অনেক বার। তিনি আশ্রম থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। মন্ত্রী কিংবা সচিবেরা মাঝেমাঝেই আশ্রমে যেতেন। আজ ওই বিবৃতি দুটো পড়ে মনে হল দুজনের কথার মধ্যে কোথাও একটা গোপন সমঝোতা আছে। কিন্তু বাবা কখনই রাজনীতির ধারেকাছে যাবেন না। কানাই যা বলেছিল, বাবা রাজনীতিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের পরিচালনা করবেন। শিষ্যশক্তিতে ক্ষমতাবান গুরুরা এদেশে তাই কবে থাকেন। নির্মলের মনে হল আশ্রমের সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ সূত্র থাকলে ভাল হত। অথচ ওখানে এমন কেউ নেই, যে বাবাকে লুকিয়ে তাকে খবরাখবর দিতে পারে। পাঁচ কোটি ধর্মান্ধ মানুষ বাবার প্রতি উৎসর্গ করেছে নিজেদের। এই পাঁচ কোটি মানুষের আনুগত্য পেলে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে দেশের সমগ্রিক জীবনযাত্রা পাল্টে দেওয়ার কাজ সহজ হত। ধর্মের আকর্ষণশক্তি রাজনীতির চেয়ে কয়েক’শ গুণ বেশি। চোখ বন্ধ করে বসেছিল নির্মল।

লাবণ্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে নির্মলকে চুপচাপ লক্ষ করছিল। সেই কোলাঘাট থেকেই ও বুঝতে পেরেছিল এভাবে যাতায়াতের অভ্যাস নির্মলের নেই। খুব বড়লোকের ছেলেরাও যেসব ব্যাপারে অভ্যস্ত থাকে বলে অসুবিধায় পড়ে নির্মল অবশ্যই সেই গোত্রের নয়। কিন্তু দেখেশুনে মনে হয়েছে বাস্তবজীবনের নিয়মকানুনগুলোর সঙ্গে ওর এতকাল কোন সম্পর্কই ছিলনা। কানাই-এর মুখে লাবণ্য কিছুটা শুনেছে। পশ্চিমবাংলায় বাস করে বাবার নাম শোনেনি এমন বাঙালি পাওয়া যাবে না। সেই বাবার কনিষ্ঠ সন্তান মানে প্রায় ইংলন্ডের রাজবংশধর। পরিচয় দিয়ে কোথাও দাঁড়ালে মাটিতে কয়েক’শ মানুষ শুয়ে একেই প্রণাম করবে। এরকম পরিবারের ছেলেকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু ওকে দেখার পর লাবণ্যর ভাবনা পাল্টেছে। আশ্রমের গন্ধ একেবারে ঝেড়ে ফেলেছে নির্মল। শুধু অনভ্যাসের দাগগুলো মাঝে মাঝে স্পষ্ট হচ্ছে। গতরাত্রে ট্রেনে জায়গা না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল ও। অথচ পরে উঠেও অনেকে জায়গা করে নিচ্ছিল। শেষপর্যন্ত লাবণ্য উদ্যোগী হয়ে পাশে জায়গা করে দেয়। নির্মল বলেছিল, ‘জোর করে একজনকে সরে বসতে বলাটা ঠিক নয় বলে মনে হচ্ছিল।’ লাবণ্য নিজেও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছে। কিন্তু এরকম উত্তর পেয়ে আর কথা বলতে পারেনি। হঠাৎ নির্মল বলেছিল, ‘জানেন, মনে হচ্ছে আমি এতকাল জেলখানায় বন্দী ছিলাম। অবশ্য জেলখানার পরিবেশ কিরকম সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু এখন নিজেকে খুব হালকা লাগছে!’

যে-লোকটা শুধু পাঁউরুটি, দুধ, বিস্কুট খেয়ে রয়েছে, কোলাঘাট থেকে বের হবার পর তার মুখে এইরকম কথা শুনে একটু গোলমাল লাগে বইকি। এখন ডুয়ার্সমুখী বাসে বসে লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ভাবছেন বলুন তো তখন থেকে?’

নির্মল মুখ ফেরাল, ‘খবরটা পড়ুন।’ কাগজ এগিয়ে দিল সে লাবণার দিকে।

লাবণ্য খবরগুলো পড়ল, ‘খুব সাধারণ ঘটনা। আপনার বাবাকে রাজ্যমন্ত্রীর প্রয়োজন, রাজ্যমন্ত্রীকে হয়তো কোন কাজে লাগাবেন আপনার বাবা। নিচে দেখুন, কেন্দ্রীযমন্ত্রী আজ আশ্রমে যাচ্ছেন বাবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করতে। এটাও ওই একই ব্যাপার। কিন্তু আপনার হারিয়ে যাওয়ার খবর কাগজে দিচ্ছে না কেন? আমি পর পর কয়েকদিনের কাগজে এসম্পর্কে কোন খবর পাইনি।’

‘খবরটা বোধহয় প্রচারিত হয়নি। বাবা চাননি পাঁচজন জানুক।’

‘আপনার বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ।’

‘বুদ্ধিমান না হলে এতবড় ধর্মরাজ্য চালানো যায় না।’

একপাশে তিস্তা অন্য পাশে পাহাড় রেখে বাস চলছিল। একটু ঠাণ্ডা লেগেছে বাতাসের গায়ে। নির্মল মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। সেবক ব্রিজের ওপরে এসে ওরা প্রচুর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর লোক দেখতে পেল। প্রত্যেকে সশস্ত্র হয়ে পাহারা দিচ্ছে। পাহারাদার পুলিশ পাওয়া গিয়েছিল পাহাড়ে ওঠার পর থেকেই। কিন্তু সেবক পেরিয়ে বাগরাকোট ওদলাবাড়িতেও তাদের দেখা গেল। একজন সহযাত্রী বললেন, ‘গোর্খাল্যান্ডের দাবী তো এখন দার্জিলিং ছাড়িয়ে এই অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়ছে। প্রায়ই রেললাইনে বোমা পাওয়া যাচ্ছে, সমস্ত ফরেস্ট বাংলো পুড়িয়ে ফেলছে।’

নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘সরকারি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে ওদের কি লাভ?’

‘প্যানিক তৈরি করা। এই যে আমাদের বাস যাচ্ছে এ পথে, বলা যায় না বন্দুক দেখিয়ে বাস থামিয়ে আমাদের নামিয়ে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দিতেও পারে।’ ভদ্রলোক এই অঞ্চলের ব্যবসায়ী। বললেন, ‘এই অঞ্চলের নেপালিরা শান্তিপ্রিয় ছিল। দার্জিলিং থেকে তাড়া খেয়ে জি এন এল এফ সাপোর্টারবা এই এলাকায় নেমে এসেছে। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে দিনের বেলায়। ওরা কিন্তু বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষে আসছে না। কেউ মারা গেলে দেখা যাচ্ছে লোকটা নেপালি। তবু আমরা মশাই সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে আছি।’

নির্মল চুপচাপ শুনছিল। মাঝে মাঝে বাস এক একটা ছোটখাটো জনপদে ঢুকছিল। সমতলের এই অঞ্চলেও বাঙালির সংখ্যা খুব বেশি নয়। ভদ্রলোককে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাঙালির পার্সেন্টেজ এদিকে কেমন?’

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ‘খুব কম। অন্তত এই বেল্টে। বেশিরভাগই মদেশিয়া, লেপচা, নেপালি আর রাজবংশী। বাঙালি ধরুন টোয়েন্টি পার্সেন্ট। চাকরি, দোকান, নয় আমার মত ব্যবসা।’

মালবাজার নামে একটা জায়গায় নেমে গেলেন ভদ্রলোক। নির্মলের মনে হল এখানে প্রচুর বাঙালি আছে। হয়তো একটি থেকে আর একটি জনপদে পৌঁছবার সময় যখন পনের-বিশ কিলোমিটার পথ পার হতে হয় তখন দুপাশে শূন্য মাঠ, জঙ্গল অথবা চায়ের বাগান পড়বে সেখানে কোন বাঙালি থাকে না। এই অঞ্চল যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই, তাই দু‘শ বিরানব্বইটি নির্বাচন কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে এই অঞ্চলেও কি বামপন্থী দলগুলো সক্রিয় নেই? দক্ষিণবঙ্গে যেমন তাদের সদম্ভ উপস্থিতি টের পাওয়া যায় এখানে তার কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে তাদের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে এই এলাকা অনেক বেশি অনুকূল। এইসময় লাবণ্য বলল, ‘উত্তরবাংলায় এলেই চোখের বড় আরাম হয়। এত সবুজ চারপাশে, আর সবুজটাকে দেখুন, ভীষণ টানে।’

বানারহাট নামে একটা জায়গায় লাবণ্য ওকে নামতে বলল। স্ট্যান্ডে আসবার আগে রেললাইন পেরিয়েছিল বাস, নির্মলের চোখে ন্যারো গেজ লাইনের ছোট্ট স্টেশন পড়েছিল। দুপাশে কাঠের প্রায় জীর্ণ দোকান, বাড়িঘর। বাস থেকে নেমে লাবণ্য যেন একটু ধন্দে পড়ল। অনিলবাবু তাকে যে সহকর্মীর ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি একটি ফটোর দোকানের মালিক। বানারহাটের চৌমাথায় তার দোকান। অথচ এখানে সেরকম কোন দোকান তার নজরে পড়ছে না। নিৰ্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘ভদ্রলোকের নাম কি?’

‘অনিলবাবু বলেছিলেন কানা মিত্তির বললেই সবাই চিনবে।’

‘কাউকে তাই জিজ্ঞাসা করুন।’

লাবণ্য মাথা নাড়ল, ‘সবাই কিভাবে দেখছে আমাদের লক্ষ করেছেন? বুঝে নিয়েছে নতুন এসেছি। ঔৎসুক্য বেড়ে যাওয়া মানে আমরা ওদের কাছে ফরেনার হয়ে গেছি। তার চেযে চলুন, আর এক জায়গায় যাই। একটা দিন ওখানে থেকে তারপর কানা মিত্তিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।’ পকেট থেকে একটা ছোট ডায়েরি বের করে সে চারপাশে তাকাল। একদিকে লেখা আছে গয়েরকাটা, অন্যদিকে পশালবাড়ি। চৌমাথাটা খুবই শান্ত। কিছু দোকানপাট রয়েছে, বাস এলে দাঁড়ায়। স্থানীয় কিছু লোক ওদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। নির্মলের মনে হল এরা লাবণ্যর সাজপোশাক দেখছে। ওরা বাসস্ট্যান্ড ছেড়ে খানিকটা এগোতেই একটা থানা দেখতে পেল। পুলিশের জিপ বেরিয়ে আসছিল থানা থেকে। লাবণ্য হাত তুলতেই সেটা দাঁড়িয়ে গেল। লাবণ্য এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, রিয়াবাড়ি টি এস্টেটে কি ভাবে যাব বলতে পারেন?’

অফিসার পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার কাছে যাবেন?’

‘সানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ম্যানেজার।’

‘মোড় থেকে বাস পাবেন চামুর্চি। আচ্ছা, এক কাজ করুন, পেছনে উঠে বসুন। আমি ওইদিকেই যাচ্ছি। মেইন রোডে নামিয়ে দেব। বাকিটা আপনাদের হেঁটে যেতে হবে।’ অফিসার কথা শেষ করতেই ব্যাগ নিয়ে পেছনের দিকে চলে যাচ্ছিল লাবণ্য। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি সামনে বসতে পারেন।

অতএব নির্মল পেছনে বসল। তার সামনে পাশে বন্দুকধারী সেপাইরা রয়েছে। মনে হল এরা যেন ঠিক স্বাভাবিক নেই। লাবণ্য বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘দ্যাটস নাথিং। আমরা তো ওদিকেই যাচ্ছিলাম। মিস্টার ব্যানার্জির সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল। হাতে সময় থাকলে আপনাদের ওর বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে আসতাম। কিন্তু আমাদের যেতে হচ্ছে একটা রেইডে। এখন তো এইটেই লেগে আছে।’ অফিসার বললেন।

‘রেইড মানে, অ্যান্টিশোস্যাল কিছুর বিরুদ্ধে?’ লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল। ‘না, অ্যান্টি ন্যাশনাল। জি এন এল এফ। রিয়াবাড়ি ছাড়িয়ে একটা বস্তিতে দুজন সেল্টার নিয়েছে বলে এইমাত্র খবর পেলাম।’

‘খবরটা পান কি করে?’

‘এখনও ভাই এ অঞ্চলে আমাদের সোর্সগুলো সক্রিয় আছে। বাইরে থেকে কেউ ঢুকলেই থানায় খবর চলে আসে। আপনারা কি জন্যে এসেছেন?’

‘বেড়াতে।’

অফিসার একবার তাকলেন লাবণ্যর দিকে কিন্তু কিছু বললেন না। দুপাশে সবুজ গালচের মত চাবাগান রেখে দারুণ চমৎকার কালো রাস্তা দিয়ে জিপ ছুটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে চা বাগানের গায়ে সুন্দর বোর্ডে কোম্পানি এবং বাগানের নাম চোখে পড়ছিল। এত শান্ত এবং সুন্দর পরিবেশ দেখে শরীরের ক্লান্তি পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল নির্মল।

পিচের রাস্তার একপাশে জিপ থামিয়ে অফিসার বললেন, ‘ওই যে রিয়াবাড়ি চা বাগানের বোর্ড। পাশ দিয়েই রাস্তা। হেঁটে গেলে বেশিক্ষণ লাগবে না।’ ওরা নেমে পড়ে আর একবার ধন্যবাদ দিতেই জিপটা বেরিয়ে গেল। লাবণ্য হেসে বলল, ‘আমার এই সাজগোজ কোন কাজে লাগছে না নির্মলবাবু, পুলিশ আমাকে ঠিকই মেয়ে বলে চিনতে পেরেছিল নইলে এতটা দূর লিফট দিতে চাইতো না।’

নির্মল তাকাল লাবণ্যর দিকে। কি করে যে সে ছেলে ভেবে নিজেকে ভুল বোঝায় তা বোধগম্য হয় না। মুখে কমনীয়তা ছাড়াও শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গের প্রকাশ যে কোন দৃষ্টিকেই আকর্ষণ করবে। লাবণ্য হাঁটা শুরু করেছিল, সে ওকে অনুসরণ করল। দু‘পাশে চায়ের গাছ, মাঝে মাঝে লম্বা ছায়াগাছ যেন প্ল্যান করেই ছড়ানো। পাখি ডাকছে অদ্ভূত সুরে। খানিকটা হাঁটতেই যেন বিশ্বচরাচর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। চারধারে শুধু সবুজ আর মাথার ওপরে নীল আকাশ। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল নির্মলের। সে দাঁড়িয়ে পড়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল। গোটা কুড়ি সবুজ টিয়া হঠাৎ একটা গাছ থেকে একইসঙ্গে ডানা মেলে দিল আকাশে। নির্মলের মনে হল এত সুখের দৃশ্য সে কখনও দ্যাখেনি। ঘাড় ঘুরিয়ে টিয়ার ঝাঁকটাকে দেখতে দেখতে এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে কতটা এগিয়ে গিয়েছে খেয়াল করেনি। এবার সামনে তাকাতে শূন্য নুড়ির পথ আর চায়ের গাছ নজরে এল। লাবণ্য গেল কোথায়? সে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে পা চালাল। হঠাৎ নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হল তার। এবং এই প্রথম উপলব্ধিতে এল যে, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ পেয়েও মানুষ সুখী হয় না যদি সে একাকীত্ব বোধের শিকার হয়। বাঁক ঘুরতেই নিৰ্মল দেখল লাবণ্য চা বাগানের গায়ে দাঁড়িয়ে কিছু করছে। দ্রুত কাছে পৌঁছতেই সে দেখল, একটি মহিলা গাছের তলায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। বয়স অন্তত পঞ্চাশের কাছে। চেহারা দেখে নেপালি শ্রমিক বলে মনে হচ্ছে। লাবণ্য পাশে বসে কপালে হাত দিল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ভাল জ্বর আছে গায়ে। কি করা যায় বলুন তো?’

‘মিস্টার ব্যানার্জির ওখানে গিয়ে খবর দিলে হয় না?’

‘হয়। কিন্তু এ হাসপাতালে যেতে চাইছে না।’

‘কি করে বুঝলেন?’

‘পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল, হাসপাতালে গেলে মরে যাবে। এই চাগাছের গন্ধ নাকে এলে ও নাকি ভাল হয়ে যাবে।’ হাসতে গিয়েও সামলে নিল লাবণ্য। তারপর ঝুঁকে বলল, ‘ও মা, তোমার ঘর কোথায়?’

প্রৌঢ়া শ্রমিক কোনমতে বিড়বিড় করল, ‘লাইন।’

নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘লাইন মানে কি?’

লাবণ্য মাথা নাড়ল, ‘কুলি-লাইন বলে একটা কথা পড়েছিলাম। কুলিরা যে জায়গায় থাকে সেই জায়গাটাকেই লাইন বলে। চলুন, একে হাসপাতালেই নিয়ে যাই।’

‘হাসপাতাল এখানে কোথায় জানেন?’

লাবণ্য ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, ‘এই বুড়িকে আপনি কাঁধে তুলতে পারবেন?’

‘তা পারব। এত রোগা, ওজন কিছুই হবে না।’

লাবণ্য ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’

‘মরনেকো লিয়ে। কুছ নেহি খায়া দোদিন।’ বুড়ি চোখ মেলল। অত্যন্ত নির্জীব চাহনি। শরীরে যে একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই, তা স্পষ্ট। নির্মল এগিয়ে গেল সামনে। হঠাৎ বুড়ির চোখের তারা নড়ে উঠল। ঠোঁট কেঁপে উঠল। মুখ থেকে একটা কান্না জড়ানো শব্দ ছিটকে এল। এবং ধীরে ধীরে দুটো শীর্ণ হাত যুক্ত হয়ে মাথার ওপর ঠেকাতে লাগল ঘাসের ওপর শুয়ে। নির্মল হতবাক্। লাবণ্য এই পরিবর্তনের অর্থ বুঝতে পারল না। সে দ্রুত বুড়ির কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? অমন করছ কেন?’ বুড়ি একবারও নির্মলের ওপর থেকে দৃষ্টি সরায়নি। সেই অবস্থায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘দেওতা, মেরি দেওতা আ গিয়া। ব্যস। ব্যস।’ অবাক লাবণ্য সেখান থেকেই মুখ ঘুরিয়ে নির্মলের দিকে তাকাল। হাত দুয়েক দূরে হতভম্ব নির্মল দাঁড়িয়ে। কিন্তু পেছনের নীল আকাশের চালচিত্রে নির্মলকে তার এক অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ বলে মনে হল। আর তখনই নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার বলুন তো?’

লাবণ্য হেসে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ‘আপনি সত্যি সুন্দর। একটু বেশি সুন্দর।’ লজ্জা পেল নির্মল, ‘কি আজেবাজে বকছেন।’

‘নইলে ও আপনাকে দেবতা বলে ভাবত না।’ লাবণ্য হাসল, ‘দেবতা সবসময় ভক্তকে রক্ষা করে। অতএব ওকে কাঁধে তুলুন।’ একটু ইতস্তত করে বুড়ির শরীরটাকে যখন নির্মল কাঁধে তুলে নিল তখন সেই দুর্বল কণ্ঠ প্রায় চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘দেওতা, দেওতা, দেওতা।’

বর্ধমান থেকে দু সেট পাজামা পাঞ্জাবি আর অন্তবাস কিনেছিল নির্মল। সেই ব্যাগটা এখন লাবণ্য বইছে। বুড়ি আর শব্দ করছে না। হাঁটতে হাঁটতে নির্মলের মনে হল এই মহিলা এতদিন বেঁচে ছিলেন কি ভাবে! পাখির মত হালকা শরীর নিয়ে বেঁচে থাকা যায়? আর তখনই নিজের মায়ের চেহারাটা মনে পড়ল। এখন যদিও ঝাপসা হয়ে এসেছে তবু চেহারার আদল গেঁথে আছে মনে। প্রায় এইরকমই শীর্ণ ছিল মা। বাংলাদেশের মায়েরা কি ভাবে বেঁচে থাকে? প্রায় মিনিট পনের হেঁটে আসার পর একটা চেকপোস্ট মত নজরে এল। বাঁশ দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা আছে। আশেপাশে কিছু কোয়ার্টার্স। ওদের দেখে অবাক হওয়া এক নেপালি দারোয়ান গোছের লোক জিজ্ঞাসা করল, ‘কাঁহা যায় গা আপলোগ?’

‘মিস্টার ব্যানার্জি।’ ম্যানেজার।’

লোকটা এবার সসম্ভ্রমে সেলাম করল, ‘ইনকো কাঁহাসে মিলা?

‘চা বাগানের মধ্যে পড়ে ছিলেন। খুব অসুস্থ। একে চেনেন আপনি? ‘জী। এই বাগানে পাতি তুলতো। ওর ছেলে।’ হঠাৎ থেমে গেল লোকটা, ‘এখন আর নৌকরি নেই ওর। কাল রাত্রে হসপিটালসে ভাগ গিয়া থা।’ কথাটা শুনে লাবণ্য নির্মলের দিকে তাকাল। নির্মলের মুখেও বিস্ময়। লোকটা আবার বলল, ‘উসকো ইঁহা পর রাখ দিজিয়ে। উধার মৎ লে যাইয়ে।’

‘কেন?’

‘উসকো লেড়কাকা সবকোই ডরতা হ্যায়। ব্যস। আউর মৎ পুছিয়ে।’ কিন্তু কথাটাকে আমল দিল না ওরা। লোকটা কিছু চেপে যাচ্ছে এটা বুঝতে পারলেও এমন একটা অসুস্থ মানুষকে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা অসম্ভব ব্যাপার। লোকটার নির্দেশিত পথে এগোতে ইঞ্জিন চলার শব্দ এল। চায়ের ফ্যাক্টরি নিশ্চয়ই কাছাকাছি। অফিসবাড়িগুলো বাঁ দিকে। একজন সুদর্শন যুবক বৃদ্ধা নেপালি মহিলাকে কাঁধে নিয়ে প্যান্ট পরা মেমসাহেবের মত বাঙালি মেয়ের সঙ্গে হাঁটছে, দৃশ্যটি ভিড় জমিয়ে তুলতে বেশি দেরি করল না। এরমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে হাসপাতালের হদিশ জেনে নিয়েছিল লাবণ্য। কিন্তু বাড়িটার সামনে গিয়ে অত্যন্ত হতাশ হল সে। ছোট্ট একতলা হলুদ-রঙা বাড়ি। একদিকে ডিসপেন্সারি অন্যদিকে পেশেন্টদের ব্লক। নির্মল ধীরে ধীরে বেঞ্চির ওপর বৃদ্ধাকে নামিয়ে দিতেই দেখা গেল সে বেহুঁশ হয়ে আছে। ইতিমধ্যে হাসপাতালে বেশ সাড়া পড়ে গেল। একজন মহিলা, তিনি সম্ভবত নার্সের দায়িত্ব পালন করেন, এসে বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একে আপনারা কোথায় পেলেন? কে আপনারা?’ লাবণ্য লক্ষ করল, মহিলা প্রশ্ন করছেন আর নির্মলের দিকে তাকাচ্ছেন। সে ঘটনাটা বলল।

মহিলা বললেন, ‘ভেগে যাওয়া পেশেন্টের নামে থানায় ডায়েরি করতে হয়। ওদের লাইনে খবর পাঠিয়েছি, কেউ আসেনি। আপনারা এখানে এসে ঝামেলায় ফেললেন।’ এবার নির্মল বলল, ‘ওরকম একজন অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসা না করে ঝামেলার কথা বলা কি ঠিক হচ্ছে? বিশেষ করে এটা একটা হাসপাতাল।’

মহিলা বললেন, ‘আপনি এখানে নতুন। এদের চেনেন না তো। কি চীজ সব। মরে গেলে বলে আমরা মেরে ফেলেছি। ঠিক আছে থাকুক ওখানে, ডাক্তারবাবু এলে যা ভাল মনে হয় করবেন। আমার কিছু বলার নেই।’

লাবণ্য দেখল সামনে ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মুখ এখন বেশ থমথমে। সে বলল, ‘কোন পেশেন্ট ওভাবে হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলে তার দায়িত্ব কিন্তু কর্তৃপক্ষের ওপর পড়ে।’

এখানে ওসব নিয়ম চলে না। বাচ্চা বিয়োনোর পর রেজিস্টারে লেখার আগেই কোলে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে কত। এটা শহর নয়।’ মহিলা চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নির্মল তাঁকে পেছন থেকে ডাকল, ‘শুনুন! আপনি একটু সদয় হবেন?’

নির্মলের মুখের দিকে তাকিয়ে যে মহিলার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটল, তা লাবণ্যর নজর এড়াল না। নির্মল বলল, ‘অনেকক্ষণ এই বুড়ি বাইরে পড়েছিল। ডাক্তারবাবু আসবার আগে আপনি যদি দয়া করে ওকে কোন ওষুধ দেন তাহলে আমাদের ভাল লাগবে।

মহিলা এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘ডাক্তারবাবু না বললে আমার উচিত হবে না ওষুধ দেওয়া তবে ওর বিছানার ব্যবস্থা করছি।’ মহিলার নির্দেশে দুটো লোক বৃদ্ধাকে তুলে ভেতরে নিয়ে গেল। নির্মল পেছন পেছন গিয়ে দেখল গোটা বারো সিঙ্গল খাটে যত রোগী শুয়ে আছে তার সমানই পড়ে আছে মেঝেতে পাতা কম্বলের বিছানায়। বৃদ্ধার কপালেও সেইরকম একটা জুটল। চোখ মেলল বৃদ্ধা কম্বলে শুয়ে। নির্মল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বৃদ্ধা আবার বিড়বিড় করল, ‘দেওতা, দেওতা। বাঁচাও।’ শব্দটা কেউ কেউ শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তারা নির্মলের দিকে ফিরে তাকাল। গত কাল ট্রেনেও সে একধরনের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে পড়েছিল। কিন্তু এই দৃষ্টিতে অন্যকিছু আছে যা তাকে খুব সংকুচিত করল। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে সে লাবণ্যর পাশে দাঁড়াতেই দেখল ভিড়টা তখনও সরে যায়নি। সবাই তার দিকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকাচ্ছে। নির্মল বলল, ‘চলুন।’

ম্যানেজার সানু ব্যানার্জির বাংলোর দিকে ওরা হেঁটে যাচ্ছে দেখে ভিড়টা ক্রমশ পাতলা হয়ে গেল। নির্মলের শরীরে তখনও বৃদ্ধার উত্তাপ রয়ে গেছে। একটা ঘোর যেন জমা হয়েছিল তার মধ্যে। সেটা কাটাতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘স্নানু ব্যানার্জির সঙ্গে আপনার পরিচয় কিভাবে?’

লাবণ্য বলল, ‘বাবার খুব অন্তরঙ্গ। ভদ্রলোক একসময় স্টেটসম্যানে ছিলেন। একবার এভারেস্ট একপিডিসনে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। কলকাতায় গেলেই আমাদের বাড়িতে যেতেন। খুব হইচই করা লোক। বেশ দুঃসাহসী। বাবার এই একটি জুনিয়ার বন্ধুকে আমার ভাল লাগে।’ বলতে বলতেই ওরা বিশাল লনওয়ালা একটা বাংলো বাড়ির সামনে উপস্থিত হল।

গেট খুলে খানিকটা এগোতেই চৌকিদার গোছের একটা লোক এগিয়ে এসে সেলাম করল, ‘কাকে চান আপনারা?’ লোকটা বাঙালি নয়, কিন্তু কথায় টান আছে।

লাবণ্য মিস্টার ব্যানার্জির নাম করতেই চৌকিদার বলল, ‘সাব জলপাইগুড়ি গিয়েছেন।’

লাবণ্য নির্মলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কেউ নেই?’

‘মেমসাহেব আছেন।’

‘ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। বল, কলকাতা থেকে আসছি।’

বারান্দায় সাজিয়ে রাখা সুদৃশ্য বেতের চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে লোকটা ভেতরে চলে গেল। নির্মল একটু কাহিল বোধ করায় বসে পড়ল। চারপাশের সবুজ রকমারি গাছপালা, মাথার ওপর টাটকা নীল আকাশ, ওর ভারি পছন্দ হচ্ছিল। এখানেও বাঙালির সংখ্যা খুব বেশি নেই। কিছু হাফপ্যান্ট পরা লোককে ফ্যাক্টরির কাছে দেখেছিল সে, যাদের বাঙালি বলেই মনে হয়েছে। এখন বেশ খিদে পাচ্ছে তার। লাবণ্য অবশ্য এ ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করছে না। মেয়েদের কি খিদেটিদে বেশি পায় না?

‘আপনারা?’

প্রশ্নটি এল নির্মলের পেছন থেকে। লম্বা বারান্দার ওপাশে কিছু সৌখিন গাছ টবে বেড়ে উঠেছে। সেগুলোর আড়ালে ছিল সম্ভবত দরজাটা। ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন সেখান থেকেই। লাবণ্য দেখতে পেয়েছিল বলেই এগিয়ে গেল, ‘নমস্কার। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। মিস্টার ব্যানার্জি বাইরে গিয়েছেন শুনলাম। উনি কি আজই ফিরবেন?’

‘হ্যাঁ, আজ বিকেলের মধ্যেই ফেরার কথা ছিল। কিন্তু পাঁচটা বেজে গেলে কাল ফিরবেন। পাঁচটার তো বেশি দেরিও নেই। আপনাদের তো চিনলাম না?’ মহিলা কথা বলছিলেন চমৎকার ব্যক্তিত্ব নিয়ে। লাবণ্যর মনে হল একটু বেশি রকমের সুন্দরী ইনি। যেন সিংহী পার্ক বা মার্বেল প্যালেসের স্ট্যাচুকে লাল শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

লাবণ্য জবাব দিল, ‘আমার বাবার সঙ্গে ওঁর অনেকদিনের সম্পর্ক। সেই যখন স্টেটসম্যানে ছিলেন।’ বাবার নাম ও বিশদে বলল নিজেদের পরিচয়। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘মনে হচ্ছে শুনেছি আপনাদের কথা। আসলে এত লোকের সঙ্গে ও মেশে যে, সবার নাম আমি মনে রাখতে পারি না। সানু এলে খুব ভাল হত। আপনারা তো আজ রাত্রে এখানে থাকবেন? এদিকে কোথাও বেড়াতে এসেছেন বুঝি?’

নির্মল উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু ইচ্ছে করেই ভদ্রমহিলার মুখোমুখি হয়নি। এখন ওঁর কথাগুলো খুব অপছন্দ হচ্ছিল। সে শুনল লাবণ্য বলছে, ‘আমরা কাজেই এসেছিলাম এদিকে। ভাবলাম সানুকাকুর সঙ্গে দেখা করে যাই। আপনার অসুবিধে হলে কাছাকাছি কোথাও—।’

ভদ্রমহিলা হেসে উঠলেন, ‘অসুবিধে বলতে আমি যেহেতু আপনাদের আগে কখনও দেখিনি তাই আপনারা আমার কাছে উটকো লোক। কিন্তু এখন রাস্তায় পৌঁছে আপনারা কোন বাস পাবেন না। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার পর রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় জি এন এল এফের ভয়ে। আর পেলেও পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটারের মধ্যে কোন হোটেল পাবেন না। কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ডাকলেন, ‘চৌ-কি-দার!’

কাছেপিঠে ছিল সম্ভবত, তৎক্ষণাৎ ছুটে এল লোকটা, ‘জী।’

‘এদের আউট হাউজে নিয়ে যাও।’ ভদ্রমহিলা আর দাঁড়ালেন না।

লোকটাকে অনুসরণ করে ওরা বাড়ির সমান্তরাল একটা এক কামরার বাংলোয় এল। দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকে লোকটা তড়িঘড়ি বাথরুম দেখে এল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা চা খাবেন তো?’ লাবণ্য মাথা নেড়ে বলল, ‘খালি চা খেতে পারব না, সঙ্গে কিছু এনো।’ লোকটা বেরিয়ে গেলে নির্মল হেসে ফেলল, ‘যাক! আপনারও তাহলে খিদে পেয়েছে।’

‘পেয়েছে মানে? প্রচণ্ড পেয়েছে। মিসেস ব্যানার্জি যদি কাটিয়ে দিতেন তাহলে যাওয়ার আগে খাবার চেয়ে নিতাম। এটা কিন্তু সত্যি আউট হাউস, গেস্ট হাউস নয়।’

‘দুটোর পার্থক্য কি?’

‘গেস্ট হাউস একঘরের হয় না। গেস্টকে আরাম দেবার ব্যবস্থা অনেক বেশি থাকবে।’

‘আপনি কি আগে স্নান করবেন?’

‘আপনি করে নিন আগে।’

লাবণ্য কোন কথা না বলে তার ব্যাগ খুলে এক প্রস্থ জামাকাপড় বের করে বাথরুমে ঢুকে গেল। এঘরে দুটো চেয়ার একটা টেবিলের দুপাশে। ডাবল বেড একটা। একটা ওয়ার্ডরোবের মত কিছু। পদাটা সরিয়ে দিয়ে চেয়ারে বসতেই কাঁচের জানলার ওপাশে দেওদার গাছের গা ঘেঁষে পড়ে থাকা চা বাগানের ওপর সূর্যদেবকে শেষবার আলো ছড়াতে দেখল সে। ওপাশের আকাশটা ক্ৰমশ লাল হয়ে এল। টুপ করে সূর্য নেমে গেল চাগাছের আড়ালে। প্রচুর পাখি ছোটাছুটি করছে আকাশে। শরীরে ক্লান্তি এবং ক্ষুধা যতই প্রবল হোক এই মুহূর্তে নির্মল সবই বিস্মৃত হল। হঠাৎ তার অবচেতন মনে কেউ যেন মৃদুস্বরে বলে উঠল, ‘দেওতা, দেওতা।’ তারপরেই সেই বৃদ্ধা অসুস্থা রমণীর মুখ ভেসে উঠল। পরমপ্রাপ্তির আনন্দ সেই মুখে। এবং তখনই দরজায় শব্দ হল। লাবণ্য কিছু বলল। কি বলল সেটা কানে ঢুকল না নির্মলের। যেন অসীম আকাশ থেকে সে সোঁ সোঁ করে নিচে নেমে আসছে।

‘কি হয়েছে আপনার? কি ভাবছিলেন?’

নির্মল দেখল লাবণ্যর পরিষ্কার মুখ তার সামনে ঝুঁকে রয়েছে বিস্ময়ে। এমনটা তার কখনও হয়নি। সমস্ত শরীরে ক্লাস্তি দ্বিগুণ হয়েছে। ম্লান হাসল সে, ‘না কিছু নয়।’ তারপর সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের পুঁটলি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। টয়লেট থেকে বেরিয়ে শাওয়ার দেখতে পেয়ে সেটা খুলে দিয়ে নিচে দাঁড়াল। বৃষ্টিধারার মত জল নামছে শরীরে। আরাম। একটু একটু করে ক্লান্তি মুছে যাচ্ছে। তাকে দেবতা বলল কেন বৃদ্ধা? বৃদ্ধা কি দেবতার ছবি দ্যাখেনি আগে? তাহলে। বড় ধন্দ লাগল। হাসল নির্মল। কোটি কোটি ভক্তর কাছে বাবা দেবতা। যে দেবতা বাণী দেন, কখনও অলৌকিক কাণ্ড করেন, যাঁর আশীর্বাদ অনেকের জীবনে সুদিন আনে। তার তো সেসব ক্ষমতাই নেই। হোক তাও চায় না সে। তোয়ালে ঝুলছিল ব্র্যাকেটে। সেটা তুলতেই চোখের দৃষ্টিতে অস্বস্তি লাগল। মেয়েদের অন্তবাস সে নিজের চোখে আগে কখনও দ্যাখেনি। স্নান করে লাবণ্য ধুয়ে ওখানে মেলে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেন আড়ালে, শরীরের প্রয়োজনীয় পোশাককে এভাবে আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হবে কেন? সে যখন বর্ধমানে নিজের অন্তবাস কিনেছিল তখন তো লাবণ্য পাশেই ছিল। বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ হয়নি তখন। আর হবেই বা কেন? লাবণ্যর এই ব্যবহারের কোন হদিশ পাচ্ছিল না সে।

নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আসার আগে সে পুরোনো পোশাক জলে ধুয়ে মেলে দিল বাথরুমেই। তার বেশি ঘাম হয় না কিন্তু এরমধ্যেই সেগুলো গন্ধ ছাড়ছিল। নতুন পাজামা পাঞ্জাবিতে খুব তাজা লাগছে এখন। টেবিলে তখন খাবার সাজাচ্ছে লাবণ্য। একটা চায়ের পট, এক জোড়া কাপডিস, ওমলেট, এবং টোস্টের সন্নিবেশ চোখের আরাম এনে দিল। এবং তারপরেই নজরে পড়ল লাবণ্যকে। আশ্চর্য, এখন একদম মেয়ে মেয়ে লাগছে। হলদে পাজামা এবং কলার তোলা হলুদ পাঞ্জাবি পরেছে লাবণ্য। ছেলেদের মত চুল ছাঁটা সত্ত্বেও বেশ মমতাময়ী বলে মনে হচ্ছে। স্নান করলে মেয়েদের চেহারা কি এমন টাটকা হয়ে যায়? লাবণ্য বলল, ‘বাড়ি থেকে বের হবার সময় কিছু জিনিসপত্র তো সঙ্গে আনলে পারতেন। চিরুনি ওখানে আছে।’ মেয়েলি চিরুনিতে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নির্মল বলল, ‘কিভাবে এসেছি যদি জানতেন তাহলে বলতেন না। কাপড় পাকানো দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে, মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে সেইদিনই আমার শেষদিন। তার ওপর বোঝা বইতে গেলে দেখতে হত না।’

দুটুকরো ডিমের ওমলেট মুখে পোরার পর বিদঘুটে গন্ধটায় শরীর আক্রান্ত হল। প্রাণপণে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল নির্মল। সে একটা টোস্ট তুলে নিয়ে কামড়াল। নতুন মাখনের গন্ধ আগের অস্বস্তিকে সামান্য ঢাকল যেন। লাবণ্য সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে?’

‘কখনও ডিম খাইনি। গন্ধটা খুব—।’

‘খাচ্ছেন কেন? আপনি টোস্টগুলো খেয়ে নিন।’

‘না। সবাই যা পারে আমি তা পারব না কেন?’

কিন্তু মিনিট দশেক পরেও নির্মলের মনে হচ্ছিল অস্বস্তিটা শরীর জুড়ে রয়েছে। দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত শরীর কিছুতেই মানতে চাইছে না। সে বলল, ‘একটু ফাঁকা জায়গায় হেঁটে আসি। আপনি বিশ্রাম নিন।’ লাবণ্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বেরিয়ে এল। যদি বমি করতেই হয় তাহলে নির্জনে একা একা করাই ভাল।

অন্ধকার নেমে এসেছে চা বাগানে। কলকাতা কিংবা আশ্রমে এত ঘন অন্ধকার সে কখনও দ্যাখেনি। ঠাণ্ডা বাতাস পেয়ে শরীর শীতল হল। অস্বস্তি কমতে লাগল। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল তার। এতদিন আদরে মানুষ হয়ে সে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এত পার্থক্য নিয়ে কেউ তাদের জন্যে কাজ করতে পারে? কিন্তু মনের সায় যার আছে তার পক্ষে কি শরীরকে বশ মানানো অসম্ভব? এই যে, কাল রাত থেকে, প্রায় বিশ ঘন্টা অন্নজল ছাড়া ছিল, তা কি আগে কখনও কল্পনা করতে পারত?

হাঁটতে হাঁটতে বাংলোর উল্টোদিকের গেটে চলে এসেছিল সে। সেটাকে খুলে অন্ধকারে আর একটু এগোতেই চায়ের তীব্র গন্ধ নাকে এল। এখনও ফ্যাক্টরি চলছে নাকি? আওয়াজ কানে আসছে না তো। সে আলো লক্ষ করে এগিয়ে যেতেই হাসপাতালটিকে পেয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দারোয়ান গোছের একটা লোক সামনে এসে দাঁড়াল, ‘বলিয়ে সাব!’

‘নার্স নেই?’

‘নেহি। ডিউটি খতম হো গিয়া।’

‘ডাক্তারবাবু এসেছিলেন?’

‘আয়া থা। চলা গিয়া।’

নির্মল একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভেতরে যেতে পারি? একজনকে একটু দেখব?’

‘আভি তো অন্দর যানা মানা হ্যায়। আপ ওহি বুড্ডিকো লিয়ায়া থা না?’

‘হ্যাঁ। কেমন আছে?’

‘থোড়া আচ্ছা হ্যায়। ডাকদারবাবু সুঁই দিয়া।’ লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপ বড়া সাহাবকো রিলেটিভ হ্যায় না? ঠিক হায়, আপ আইয়ে।’ হঠাৎ মন পাল্টে ওকে ইঙ্গিত করে ভেতরের দিকে এগোল লোকটা। বৃদ্ধাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল নির্মলের। সে ওই একই পথে ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল। সমস্ত ঘর জুড়ে কাতরানি আর কান্না পাক খাচ্ছে। নির্মল অস্থির হয়ে উঠল। লোকটা বলল, ‘আইয়ে সাব।’ যন্ত্রণাকাতর মেয়েদের মধ্যে দিয়ে সে বৃদ্ধার কাছে পৌঁছাল। এত কাতরানির মধ্যেও বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। মুখে যেটুকু আলো পড়ছে তাতে বোঝা গেল গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে রয়েছে। হয়তো ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে ওকে। লোকটা ডাকতে যাচ্ছিল, নির্মল নিষেধ করল। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এল। তখনও কানের পর্দায় যন্ত্রণাকাতর মানুষের কান্না লেগে আছে। মানুষগুলো যন্ত্রণা পাচ্ছে অথচ কেউ নেই ওখানে ওদের যত্ন করার। এখানকার হাসপাতালের নিয়মকানুন তার জানা নেই।

ফিরে এসে ব্যাপারটা বলল লাবণ্যকে। লাবণ্য তখন আলো জ্বেলে চুপচাপ শুয়েছিল। শোনামাত্র উঠে বসল, ‘আমরা যদি কিছু করতে যাই তাহলে সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? প্রথমত নার্সিং জানি না, ভাল করতে গিয়ে খারাপ না করে বসি। দ্বিতীয়ত, নতুন জায়গায় এসেই যদি লোকজনকে চটাই—, না, আজ থাক।’

জানলার পাশের চেয়ারে বসে নির্মল জিজ্ঞাসা করল, ‘মিস্টার ব্যানার্জি আসেননি?’

‘সম্ভবত না। এলে নিশ্চয়ই দেখা করতেন।’

‘দেখা হলে ওঁকে জিজ্ঞাসা করব মানুষগুলোকে এভাবে কুকুর বেড়ালের মত ফেলে রাখার কি মানে? একজন নার্স কি রাত্রে ওদের পাশে থাকতে পারে না?’ নির্মল চুপ করে গেল। ওরা কেউ অনেকক্ষণ কোন কথা বলেনি। হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, ‘এই চা বাগানের মালিক তো মিস্টার ব্যানার্জি নন। উনি ম্যানেজার। চাকরি করেন। মালিক তবে কে?’

লাবণ্য বলল, ‘জানি না। চা বাগানের মালিকরা শুনেছি খুব বড়লোক হয়।’

নির্মল মাথা নাড়ল, ‘সে তো নিশ্চয়ই। নইলে তাদের বিলাসের জন্যে এইসব শ্রমিকরা অজ্ঞতার অন্ধকারে ও অভাবের নরকে ডুবে থাকে!’

লাবণ্য বলল, ‘মাঝে মাঝে আপনি অদ্ভুত শব্দ প্রয়োগ করেন।’

নির্মল বলল, ‘এসব আমার ভাল লাগার কথা। বলেছেন যিনি তাকে আপনিও জানেন। চেনেন কতটা তা জানি না। তিনি বলেছিলেন নতুন ভারত বেরুবে লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্যে থেকে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট বাজার থেকে। ওরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরবে সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। দুঃখভোগ করে অর্জন করেছে অটল জীবনীশক্তি। এরা রক্তবীজের প্রাণসম্পন্ন। ভারতের চিরপদদলিত এই শ্রমজীবিরাই নূতন ভারত গড়তে যাচ্ছে। স্বার্থান্বেষী ধনীরা যদি নিজেদের সমাধি খনন না করে এখনই তাহলে পরে সেই শক্তির উত্থানের সময় আর সুযোগ পাবে না।’ নির্মল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লাবণ্যকে দেখল, ‘এসব বিবেকানন্দের কথা।’

‘আমার কেমন মনে হচ্ছিল। আমি কখনও পড়িনি। প্রচণ্ড সাম্যবাদী মানুষ ছিলেন। সম্ভবত অসময়েই এসেছিলেন ভারতবর্ষে।’

লাবণ্যর কথাটা খুব ভাল লাগল নির্মলের, ‘এইটে আমি বিশ্বাস করি। বিবেকানন্দ যদি স্বাধীনতার পরে জন্মগ্রহণ করতেন তাহলে ভারতবর্ষ হয়তো দার্শনিক ধর্মপ্রচারককে পেত না, কিন্তু মার্কস্‌, লেনিন মাও সেতুং-এর মতই জীবনীশক্তি সম্পন্ন এক বিপ্লবী নেতাকে পেত যিনি এদেশের চেহারাটাকে বদলে দিতে পারতেন।’

.

রাত দশটায় থানায় এল ইউনিস। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ধ্যানেশকুমার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারল আজ। গুলিতে মৃত্যু নিয়ে আর কোন হৈ চৈ হবে না যখন তখন তাকে খামোকা ধরে রেখে লাভ কি!

থানার বাইরে নিজের গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে ইউনিস নির্দেশ দিল নেমে যেতে। ‘আপনি এবার দূরে থাকবেন ধ্যানেশবাবু। বাবার আদেশ তাই।’ ইউনিস বলল।

‘কেন?’

‘আপনি আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত নন। এর বেশি আমাকে প্রশ্ন করবেন না।’

‘আমি কি করব?’

‘যা করছিলেন। গান বাজনা। যদি কখনও বাবার দয়া পান, তাহলে আশ্রমের জীবনে ফিরে আসবেন। ছোটে মহারাজকে এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় আছেন।’ ইউনিস ড্রাইভারকে ডাকল। সে এলে ধ্যানেশকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি বাড়িতে ফিরে যাবেন?’

ধ্যানেশ পাথরের মত বসেছিল। সাড়া দিল না। তার মাথা কোন কাজ করছিল না। ভক্তের মৃত্যুর জন্যে সে দায়ী নয়। তাহলে আবার বাবা তার ওপর রুষ্ট হলেন কেন? সে ঠিক করল, কাল সকালেই আশ্রমে রওনা হবে। বাবা যদি দেখা না করতে চান তাহলে অনশন করবে।

এখন রাস্তা নির্জন। নিজের বাড়ির কাছে যে পৌঁছে যাচ্ছে খেয়াল করেনি ধ্যানেশ। ইউনিস তাকে সচেতন করল, ‘ধ্যানেশবাবু, আপনার বাড়ি এসে গিয়েছে।’

হুঁশ ফিরতেই ধ্যানেশ জানলা দিয়ে মুখ বের করতেই চারধার কাঁপিয়ে শব্দ উঠল। গাড়িটা কেঁপে উঠে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে গড়িয়ে একটা পাঁচিলে ধাক্কা খেল সশব্দে। পর পর পাঁচবার শব্দটা করে ফুটপাতের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা তীব্রগতিতে বেরিয়ে গেল। শব্দটা হতেই ইউনিস তার দীর্ঘকালের মানসিক প্রস্তুতিতে দুই সিটের নিচে কুঁকড়ে বসে পড়েছিল। কিন্তু পাঁচিলে ধাক্কা লাগা মাত্র সামনের সিট পেছনে সরে এসে তাকে এমনভাবে চেপে ধবল যে জ্ঞান হারাল সে।

মধ্যরাতে সুধাময় সেন টেলেক্সে খবর পাঠাচ্ছিল। মেজ মহারাজ সেই খবর দ্রুত লিখে নিচ্ছিলেন বাংলায়। ‘অজ্ঞাত আততায়ীরা আজ রাত পৌনে এগারটায় ধ্যানেশকুমারের বাড়ির সামনে গুলি চালায়। গুলিতে ধ্যানেশ এবং ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ নিহত হয়। ইউনিসকে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার পাঁজর এবং মাথা ভেঙে গেছে। ঘটনাস্থলে কোন প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়নি। পুলিশ সন্দেহ করছে আততায়ীরা জানত, আজ রাত্রে ধ্যানেশ মুক্তি পাবে তাই তারা সেখানে অপেক্ষায় ছিল।’

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *