জন-যাজক – ৩

আশ্রমে খবরের কাগজ আসে বিকেলে। বাবা নিজে পড়েন না। মেজ মহারাজ কাগজের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোর সারমর্ম পাঠিয়ে দেন প্রতি বিকেলে। আজ ‘আশ্রমসংবাদ’ প্রকাশের জন্যে তৈরি। তার একটি কপি ও খবরের কাগজের সারমর্ম নিয়ে তিনি চললেন আনন্দভবনের উদ্দেশে। ধ্যানেশকুমাবের সাংবাদিক সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোথাও সেই অশ্লীল ছবিগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়নি। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। সাংবাদিকদের ক্ষমতা অসীম। তাদের কাছে নিশ্চয়ই সত্য গোপন নেই। তবু খবরটা ছাপা হল না কেন? বড় মহারাজ আজ আনন্দভবনের দ্বারেই অপেক্ষা করছিলেন। তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আশ্রমসংবাদ প্রস্তুত?’ মেজ মহারাজ মাথা নাড়লেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তুমি ধ্যানেশের কথাগুলো পড়েছ?’

‘হ্যাঁ। লিখে এনেছি ‘

‘সে কি করতে চায় বুঝতে পেরেছ? কলকাতায় আর একটি বেআইনী আশ্রম তৈরি করতে চায়। ব্যাপারটা পরে খুব সাংঘাতিক হতে পারে।’

‘কিন্তু কাগজে তো শুধু মন্দিরের কথাই লিখেছে।’

‘অঙ্কুর থেকেই তো ডালপালা ফুল ফল জন্মায়। এ ব্যাপারে বাবাকে অবহিত করতে হবে।’ সেবকদের নমস্কার নিতে নিতে বড় মহারাজ মেজ মহারাজকে নিয়ে বাবার শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। বাবার দিকে তাকিয়ে তাঁরা আপ্লুত হয়ে গেলেন।

বসে আছেন বাবা। ধ্যানমগ্ন। বোঝা যাচ্ছে, তিনি এখন বাহ্যিক চেতনারহিত। ওঁদের মনে হল বাবার শরীর থেকে এক পরমসুন্দর জ্যোতি বেরিয়ে চারপাশ আলোকিত করেছে।

দুই মহারাজ নতজানু হয়ে বসলেন। ক্রমশ এক পবিত্র স্পর্শ যেন তাঁদের জাগতিক চিন্তাভাবনা থেকে বহুদূরে সরিয়ে আনল। যে ক্ষমতা তাঁরা অর্জন করেননি বাবার অসীম কৃপায় সেই আনন্দলোক যেন তাঁদের সামনে প্রতিভাত হল। এইরকম অবস্থা কতক্ষণ চলেছিল তা তাঁদের জানা নেই, চেতনা স্বচ্ছ হল বাবার ডাকে। তাঁরা মুগ্ধ চোখে বাবাকে দেখলেন।

বাবা বললেন, ‘আগামী গুরু পূর্ণিমায় আমি আমার সমস্ত প্রধান শিষ্যদের সঙ্গে মিলিত হতে চাই।’

বড় মহারাজ মাথা নাড়লেন। মেজ চুপ করে বসে রইলেন।

বাবা বললেন, ‘আমার সমস্ত শিষ্যকে একত্রিত করবে তোমরা। স্থানাভাব, খাদ্যাভাব ইত্যাদির যুক্তি আমি শুনতে চাই না।’

বড় মহারাজ বললেন, ‘গুরু পূর্ণিমার তো এখনও কয়েকমাস দেরি আছে।’

‘সময় কখনও অপেক্ষা করে না বড়! আমি খুব অস্বস্তিবোধ করছি। আজ আমি উপাসনা মন্দিরে যোগ দেব। চারপাশে এত অন্ধকার, হাত বাড়ালেই নোংরা লাগে।’

মন্দির শব্দটি কানে যাওয়ামাত্র মেজ মহারাজের স্মরণে এল এখানে আসার উদ্দেশ্যের কথা। এতক্ষণ ওইসব যেন বিস্মরণে তলিয়ে গিয়েছিল। তিনি ‘আশ্রমসংবাদ’ পত্রিকার প্রথম কপিটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বাবার শ্রীচরণে নিবেদন করলেন। বাবার মুখে এবার হাসি ফুটল। পাতা উল্টিয়ে তিনি সম্পাদকীয় পড়লেন। মাথা নাড়লেন। তারপর পত্রিকাটিকে এক পাশে সরিয়ে রাখলেন।

‘ছোটে পথভ্রষ্ট কি হয়েছে? আমার পুত্র, আমারই রক্ত তার শরীরে, কি করে পথভ্রষ্ট হল তাই বুঝতে পারছি না। অবশ্য সে আলোর পথ থেকে অন্ধকারের পথে সবে পা বাড়িয়েছে। এখনও তার ফিরে আসার সময় রয়েছে।’ বাবা চোখ বন্ধ করে বললেন।

বড় মহারাজ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘সে কোথায়? আপনি যদি হদিশ দেন তাহলে ভাল হয়।’ মেজ মহারাজ না জিজ্ঞাসা করে পারলেন না, ‘তাকে কি সনাতননাথের শিষ্যরা জোর করে লুকিয়ে রাখেনি?’

বাবা জবাব দিলেন না এই প্রশ্ন দুটির। মাথা নেড়ে বললেন, ‘আগামী পরশু আমি দশজন মহারাজের সঙ্গে মিলিত হব। ব্যবস্থা করো।’ তিনি উঠলেন। উপাসনা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল। বড় মহারাজ মেজ মহারাজের উদ্দেশে বললেন, ‘আজকের সংবাদপত্রের সারমর্ম রেখে যাও।’

মেজ মহারাজ দুটি ফুলস্কেপ কাগজ বাবার সামনে রাখলেন, ‘এতে ধ্যানেশের সাংবাদিক সম্মেলনের কথাও বলা আছে।’

‘সে কি আমার নির্দেশ অমান্য করেছে?’

বড় মহারাজ নড়েচড়ে বসলেন, ‘অমান্য করেনি কিন্তু সে বিনীত ভঙ্গীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে। আশ্রম তাকে বিতারিত করলেও সে আশ্রম ছাড়বে না। কলকাতায় সে নতুন আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আপনার উপাসনা করবে। শিষ্যদের সে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।’

‘আশ্রম নয়, মন্দির।’ মেজ মহারাজ সংশোধন করে দিলেন।

‘একই ব্যাপার। কলকাতায় আমাদের উপাসনাগৃহ আছে। তা সত্ত্বেও আর একটি উপাসনাগৃহ তৈরি করা মানে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা। দলচ্যুত হলে যেমন নতুন দল গড়ার চেষ্টা হয় এও তেমনই।’

বাবা হাসলেন, ‘নতুন মন্দির তৈরি করলে সেখানেও তো আমাকে প্রয়োজন হবে।’

‘কিন্তু এতে ভক্তরা বিভ্রান্ত হবে।’

‘সেই বিভ্রান্তি দূব করবে তোমরা। কিন্তু মন্দির প্রতিষ্ঠার ভাবনাটি ওকে ত্যাগ করতে বল। আমার নামগান করতে চাইলে করতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।’

.

উপাসনা গৃহের সামনে নিযমিত ভক্তরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সংখ্যা শ’ছয়েক। হঠাৎ তারা লক্ষ করলেন, বাবা আরাধনায় যোগ দিতে আসছেন। নিয়মিত এই দৃশ্য দেখা যায না। তাঁরা আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বাবার স্পর্শকৃপা পাওয়ার জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। সেবকরা কঠোর হাতে তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখছিল। উপাসনাগৃহে প্রবেশ করে বাবা নামগান শুরু করলেন। মুহূর্তেই বাইরের চেঁচামেচি থেমে গেল। সমস্ত ভক্তবৃন্দ সেই গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। প্রায় এক ঘণ্টার পর বাবা শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে মন্দিরের চাতালে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের আর্তচিৎকার শুরু হয়ে গেল। ‘প্রত্যেকেই নিজস্ব প্রয়োজন এবং কষ্টের কথা জানাতে ব্যাকুল। বাবা হাত নাড়লেন। আজ তাঁর অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু এইসময় বড় মহারাজ তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কিছু বলতেই তিনি একটু থেমে গেলেন। নিচু গলায় নির্দেশ দিয়ে একজন সেবকের এগিয়ে ধরা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘জন্মালেই তো মরতে হবে। জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে যে সময়টা তা খুব অল্প। চোখের পলক ফেললেই ফুড়ুৎ হয়ে যায়। কিন্তু কার চোখের পলক? না মহাকালের। মানুষের নয়। মানুষ যদি একটু হুঁশ রেখে সময়টাকে খরচ করে তাহলে এই ধরিত্রীর বড় উপকার হয়। পিতামাতার কর্তব্য সন্তানকে ভাল রাখা। অর্থাৎ আগামীকালের মানুষের ভাল থাকার জন্যে একালের মানুষকে কিছু করে যেতে হবে। সেই কাজ করাটা কি ধরনের? সবসময় যদি আমি আমি করি। আমার এই নেই সেই নেই ভাব তাহলে কাজটা করবে কখন? নিজেকে অতিক্রম কর। তুমি মনে রেখ যা কিছু করছ তা আগামীকালের মানুষের জন্যে। তুমি শুধু নিমিত্ত মাত্র। পাখি যেমন তার ছানার জন্যে খাদ্য আহরণ করে মুখে নিয়ে নীড়ে ফিরে আসে, তুমি তাই করছ। উত্তেজনা পরিহার কর। কোন কোন মানুষ অথবা সংঘবদ্ধ দল আমাকে হেনস্থা করতে চায়, আমার ওপর কালি লেপন করতে চায়। তাদের সেটা করতে দাও। কালবৈশাখীর মত মহাতেজী মেঘও তো আকাশকে বেশিক্ষণ অধিকার করতে পারে না। শান্তি পাও, শান্ত হও।’

সেবকরা যখন বাবাকে আনন্দভবনে নিয়ে এল তখনই মোটরবাইকের শব্দ শোনা গেল। আশ্রমের ভেতর সাইরেন বাজানো নিষিদ্ধ। বড় এবং মেজ মহারাজ প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিবার যখন সচিব, কেন্দ্রীয়মন্ত্রী কিংবা রাজ্যমন্ত্রী আসেন তখন তাঁরা ওখানে দাঁড়িয়েই তাঁদের অভ্যর্থনা জানান।

বিশাল গাড়ি থেকে দশাসই চেহারার সচিব নেমে এলেন ‘ পরনে খাদির শেরওয়ানি আর মাথায় গান্ধি টুপি। নেমে দুই হাত যুক্ত করে হাসলেন। বড় মহারাজ নমস্কার ফিরিয়ে দিলে সচিব বললেন, ‘হঠাৎ এভাবে বিরক্ত করায় আমি দুঃখিত। আমি কি বাবার দর্শন পেতে পারি? বেশি সময় আমি নেব না।’

বড় মহারাজ বললেন, ‘বাবা এইমাত্র উপাসনা শেষ করে এলেন। একটু ক্লান্ত। তবে আপনি মিনিট দশেক কথা বলতে পারেন।’

সচিব বললেন, ‘তাই যথেষ্ট। সচিবের এক সঙ্গী পেছন পেছন আসছিল। তিনি তাকে নিষেধ করলেন, ‘আমি এখন মহাপুরুষদর্শনে যাচ্ছি। তোমার এখন প্রয়োজন নেই।’

সিঁড়ি ভেঙে উঠতে সচিবের খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মুখে হাসিটি ধরে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। সময় লাগল কিন্তু ওপরে উঠে আসতে সক্ষম হলেন। এর আগের বার তিনি এসেছিলেন কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর সঙ্গে। সেবার তাঁকে সিঁড়ি ভাঙতে হয়নি। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী একাই সিঁড়ি ভেঙে উঠে গিয়েছিলেন।

সচিবকে নিয়ে বড় মহারাজ দ্বিতীয় ঘরে প্রবেশ করতেই বাবাকে দেখতে পাওয়া গেল। ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন তিনি। তাঁকে দেখামাত্র সচিব নতজানু হতে চেষ্টা করতেই বাবা বললেন, ‘থাক। অযথা শরীরকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। তুমি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছ, এই যথেষ্ট। ওকে একটা টুল দাও।’

ঘরের কোণ থেকে একটা টুল এনে বড় মহারাজ নিজেই সচিবের সামনে রাখলেন। হাতজোড় করেই তাতে বসলেন সচিব। বসতে পেরে খুব আরাম হল তাঁর। হাত জোড় করেই তিনি বললেন, ‘আপনার দর্শন পেয়ে আমি ধন্য।’

বাবা হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গী করলেন। কোন কথা বললেন না। সচিব সামান্য ঝুঁকে বললেন, ‘আমি আপনার অত্যন্ত অনুগত। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীও একথা জানেন। তাই তিনি আমাকে গতকাল দিল্লীতে বলেছেন যে তাঁর হয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে। তিনি কলকাতায় এলেই এখানে চলে আসবেন।’

বাবা এবারও নির্বাক রইলেন যদিও তাঁর মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। সচিব এবার যেন কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দুটো হাত ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি আপনার সেবক। আদেশ করুন কি সেবা করতে পারি?’

বাবা এবার মাথা নাড়লেন, ‘তুমি এসেছ, তোমার মনে ভক্তিভাবের উদয় হয়েছে এই তো যথেষ্ট। মন দিয়ে কাজ করো। নিজের ওপর আস্থা রেখো।’

সঙ্গে সঙ্গে সচিবের গলা সরু হয়ে এল, ‘এটা কি কোন কাজ বাবা? আমি তো পুতুল হয়ে আছি। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আমি যাতে কেন্দ্রীয়মন্ত্রীর অনুগ্রহ পেয়ে মুখ্যসচিব পদে নির্বাচিত হতে পারি!’

‘ছোট পুতুল থেকে বড় পুতুল হতে চাও?’

‘তবু তো বড়।’

‘যেমন কর্ম করবে তেমন ফল ভোগ হবে। আমি কে? তবু তেমার ইচ্ছার কথা আমার কানে গেল। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী কবে আসছে এদিকে? তাকে অনেকদিন দেখিনি।’

বিগলিত সচিব বললেন, ‘আমি খবর নিয়েই আপনাকে জানিয়ে দেব।’ বাবার ইঙ্গিত বুঝে বড় মহারাজ এগিয়ে এলেন, ‘এবার বাবার বিশ্রামের সময় হয়েছে।’

সচিব সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তিনি সোজা হলেন। হয়ে নমস্কার জানালেন বাবাকে। তারপর হৃষ্টচিত্তে বড় মহারাজের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়িতে পা দেবার আগে সচিব চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মহারাজ, বাবার শিষ্যসংখ্যা এখন কত?’

‘পাঁচ কোটি।’

‘ওহ! এত শিষ্য আর কোন গুরুর নেই। বাবার দর্শন পেয়ে আমার প্রাণ তাজা হয়ে গেল। কি আনন্দ, কি আনন্দ। কেন্দ্রীয়মন্ত্রী দেখা করতে এলে বাবাকে আমার কথাটা স্মরণ করিয়ে দেবেন মহারাজ।’

কোলাঘাট স্টেশনে তখন ঘুম-ঘুম আবহাওয়া। ট্রেন থেকে নেমে নির্মল এক মিনিট চুপ করে দাঁড়াল। তার টিকিট নেই। ট্রেনে কোন চেকার অবশ্য সামনে এসে দাঁড়ায়নি। কিন্তু বিপদটা গেট পেরিয়ে যাওয়ার সময় ঘটতে পারে। ক্রমশ প্ল্যাটফর্ম নির্জন হয়ে গেল। এবার সে পা বাড়াল। গেটে কেউ নেই। হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে শুনতে সে বাইরে বেরিয়ে এল। এখানেই কাউকে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। এত রাত্রে যারা স্টেশনে থাকে তাদের সবসময় এখানেই পাওয়া যায়। কেউ যদি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে খোঁজ পেতে অসুবিধে হবে না। নির্মল একটা রিকশা নিয়ে বলল, ‘চল।’ লোকটিও কোন প্রশ্ন করল না। স্টেশন ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে সে রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘স্কুলে চল।’

চালক বলল, ‘কোন স্কুল?’

নির্মল একটা দ্বিধায় পড়ল। লোকটাকে বলবে নাকি যে-স্কুলের মাঠ আছে সেই স্কুলে। কিন্তু তাতে তো লোকটা বুঝে যাবে সে কোলাঘাটে নতুন। কটা স্কুল আছে এখানে? রিক্সাওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে। সে বলল, ‘সামনের স্কুলটাতেই।’

‘ও। ওখানে তো হেঁটেই যেতে পারতেন। পুরো ভাড়া দিতে হবে কিন্তু।’ রিকশা যেখানে থামল তার সামনেই স্কুল। মাঠটা পেছন দিকে। দূরত্ব স্টেশন থেকে তিন মিনিটের বেশি নয়। তবু রিকসাওয়ালার দাবি পূর্ণ করল নির্মল।

অন্ধকারে স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়াল সে। ভদ্রলোকের নাম অবিনাশ চন্দ্ৰ দে। স্কুলে পড়ান এই স্কুলেই? অন্য স্কুলের গায়েও তো মাঠ থাকতে পারে। স্কুলের নাম কেন লিখে দেয়নি কাগজে? অবিনাশ চন্দ্র দে তাকে দেখে কি রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন কে জানে?

স্কুলের মাঠের পেছনে যে বাড়িগুলো তার সামনে দিয়ে একবার হেঁটে এল নির্মল। রাত এখন এগারটা ছাড়িয়ে গেছে। হঠাৎ একটি গলা কানে এল ওর, ‘শুনুন!’

সে দেখল মাঝখানের একটি বাড়ির বারান্দা থেকে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক নেমে আসছেন। খোলা দরজা দিয়ে যে আলো বাইরে বেরিয়েছে তাতেই বোঝা গেল ওঁর মাথায় টাক আছে। মুখোমুখি হতেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাকে খুঁজছেন?’

‘শিক্ষক অবিনাশ চন্দ্র দে-র বাড়ি!’

‘আপনি নির্মল?’

‘হ্যাঁ।’

‘দাঁড়ান এখানে। ভদ্রলোক ফিরে যেতেই নির্মল বুঝতে পারল এর নামই অবিনাশ। কানাই কি এঁকে আগাম খবর দিয়েছিল? কিন্তু উনি ওকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন কেন? একটু বাদেই বাড়িটির আলো নিভে গেল। সব চুপচাপ। হঠাৎ সামান্য আওয়াজ শুনে মুখ ফিরিয়ে নির্মল দেখল পাশের টিনের দরজা খুলে অবিনাশ একটা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। কাছে এসে ভদ্রলোক সাইকেলের পেছনের সিট দেখিয়ে বললেন, ‘উঠুন।’

কথা না বাড়িয়ে নির্মল উঠে বসল। জীবনে সে প্রথমবার সাইকেলে উঠল! মনে হচ্ছিল সবকিছু টলোমলো লাগছে। প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে অবিনাশ বললেন, ‘ইজি হয়ে বসুন। আঁকড়ে ধরবেন না। স্টেশনে কি আমার নাম জিজ্ঞাসা করেছেন?’

‘না। কাউকেই কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।’

প্রায় এক ঘন্টা ওরা নিঃশব্দে চলল। কোলাঘাট ছাড়িয়ে নদীর ধার দিয়ে অনেকটা যাওয়ার পর ওরা গ্রাম পার হল দুটো। তারপর জঙ্গল শুরু হতেই কিছু কাঠের বাড়ি নজরে এল। তার একটার সামনে সাইকেল থামালেন অবিনাশ। চাপা গলায় বললেন, ‘শব্দ না করে ওপরে উঠে আসুন।’ দেখে মনে হয় সরকারি বাড়ি। দোতলা। গেট খুলে সিঁড়ি বেয়ে অবিনাশ ওপরে উঠে আসতেই নিৰ্মল ওর পিছু নিল।

দরজায় মৃদু টোকা দিলেন অবিনাশ। দ্বিতীয়বারে পাশের একটা জানলা খুলে গেল। সেখানে এসে একটি মহিলা কণ্ঠ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’

‘অবিনাশ। দরজা খোল।’

আর কোন প্রশ্ন উচ্চারিত হল না। দরজাটা খুলল। হ্যারিকেন জ্বলছে দেখে অবিনাশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত রাতেও লোড শেডিং? বাঃ চমৎকার। এক মধ্যবয়সী মহিলা সম্ভবত সদ্য ঘুম ভাঙায় বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ‘আবার কি হল?’

‘এর নাম নির্মল। আমাদের ছেলে। কিছুদিন থাকবে।’

‘আমার কোয়াটার্স কি ধর্মশালা? যাকে পারছ তুলে দিচ্ছ?’

‘রাগ করো না। পরে এ ব্যাপারে কথা বলব। আমাকে এখনই ফিরতে হবে। কারেন্ট এলেও আজ রাত্রে আলো জ্বেল না। নির্মল এখানে নিশ্চিন্তে থাকুন। বাইরে না বেরুলেই ভাল। খবর থাকলে পাঠাবো।’ অবিনাশ আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। মহিলা দরজা বন্ধ করলেন, ‘আচ্ছা জ্বালা। মাঝরাতে এমন হুজ্জত ভাল লাগে কারো? বিয়ে করা বউও এত ঝক্কি সামলায় না।’

নির্মল সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, ‘আমি না হয় চলে যাচ্ছি!’

‘আপনাকে কে যেতে বলেছে। ওমা! এ যে ঠোঁট ফোলানো ছেলে! কত বয়স?

‘একুশ ‘

‘তাই। একুশ বছর বয়সটা খুব খারাপ। কবিতাটা পড়নি? তাহলে তোমাকে তুমিই বলব।’

‘আপনার অসুবিধে হলে—’

‘তুমি আমার কোন অসুবিধে করোনি। করেছে ওই টেকোটা। হুটহাট করে বলে এটা করো ওটা করো। পেটে কিছু পড়েছে?’ আচমকা প্রশ্ন হতে নির্মল হকচকিয়ে মাথা নেড়ে না বলল। মহিলা এবার ভাল করে মুখ দেখলেন। তারপর বললেন, ‘এ ঘরে এস।’

দ্বিতীয় ঘরে না ঢুকে পাশের একটি ছোট ঘরে ঢুকলেন তিনি। একটা তক্তাপোষ, টেবিল আর বইপত্র ছাড়া কিছু নেই সেখানে। মহিলা বললেন, ‘এখনেই শোবে। গরম কাল, বেশি কিছু লাগবে না। বাথরুমটা দেখিয়ে দিচ্ছি, এসো।’ কয়েক পা এগিয়ে একটা অন্ধকার দরজা দেখিয়ে বললেন, ‘এইটে। হ্যারিকেন নিয়ে যাও। বেশি জল ঢালবে না।’ তারপর দ্বিতীয় ঘরে ঢুকে গেলেন।

বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল নির্মলের। সময় নষ্ট না করে সে হ্যারিকেন তুলে বাথরুমে ঢুকল। গায়ে জল ঢালার পর শরীর জুড়লো যেন। এ বাড়িতে আর কে কে থাকে? এখনও কোন পুরুষের অস্তিত্ব টের পায়নি সে। এত রাতে দরজায় শব্দ করলে তো ছেলেরাই সামনে আসবে! নির্মল ঠিক করল, কোন ব্যাপারে কৌতূহলী হবে না। যা পরে এসেছিল তাই চড়িয়েই বাথরুম থেকে বের হয়ে ছোট ঘরে এল সে। ঘরে যে জানলা আছে তা এখন বন্ধ। খুলে দেবে নাকি? সাহস হল না তার। এইসময় মহিলা একটা ডিস আর গ্লাস নিয়ে ফিরে এলেন, ‘মাঝরাতে এর বেশি কিছু জুটবে না। খাও।’

নির্মলের খুব মজা লাগল। আজ পর্যন্ত এইরকম কথার সঙ্গে কেউ তাকে খাবার দেয়নি। আশ্রমে তো বটেই, কলকাতার বাড়িতেও সেবকরা আসন পেতে খাবার পরিবেশন করে তাকে সসম্ভ্রমে ডাকত। সে ডিসের ওপর নজব বোলালো। তিনটে রুটি, একটা ভাজা গোছের কিছু আর খানিকটা মধু। কোন বাক্যব্যয় না করে রুটি ছিঁড়ে মুখে দিল সে। খাবার আগে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে নিবেদন করতে গিয়ে সামলে নিল অবশ্য। মহিলা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে ওর খাওয়া দেখলেন। তারপর ঘরের কোণে সরে গিয়ে একটা স্যুটকেস টেনে বের করলেন তক্তাপোষের নিচ থেকে। ডালা খুলে সাদা পাজামা বের করে বললেন, ‘দ্যাখো, তোমার হবে কিনা। না হলেও এটা পরে শোবে। একেবারে নাগা সন্ন্যাসী হয়ে আসা হয়েছে। বলে স্যুটকেস তক্তাপোষের নিচে আবার ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি ঘুমতে চললাম। সকালে ডিউটি আছে।’ যাওয়ার সময় অবশ্য ডিস গ্লাস নিয়ে যেতে ভুললেন না।

অন্যের পায়জামা পরে তক্তাপোষে শুয়ে নিজেকে প্রবোধ দিল নির্মল। এ অন্তত বস্তির ঘরে পশুপতির কৃপায় থাকার চেয়ে ঢের ভাল। কিন্তু তবু তার ঘুম আসছিল না। হ্যারিকেন ঘরে নেই। সে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে জানলা খুলে দিতেই মৃদু বাতাসের স্পর্শ পেল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে জঙ্গলের বিচিত্র শব্দ ভেসে আসছে। নির্মল আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। একটু একটু করে বাইরের অন্ধকার চোখে সয়ে গেল। তারার আলো এখন চমৎকার। বাবার মুখ মনে পড়ল তার। অমন ক্ষমতাবান মানুষ নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে বের করার জন্যে তোলপাড় করছেন সারা দেশ। বাবাকে ধ্যানের সময় ভাবাবিষ্ট হতে দেখেছে সে। ধ্যানে বসলে বাবার দৃষ্টির অগম্য স্থান কিছু থাকে না বলে মহারাজদের বিশ্বাস। তিনি কি এখন জানতে পারছেন সে এই তক্তাপোষে অন্যের পাজামা পরে শুয়ে আছে? বড় অস্বস্তি হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল যেন দুটি চোখ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে মায়ের মুখ মনে করতে চেষ্টা করল ওই চোখ দুটোকে অস্বীকার করতেই। মৃত্যুর সময় মা মামার বাড়িতেই ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে বাবা সেখানে যাননি। বলেছিলেন, ‘ওর সময় শেষ হয়ে গেছে। বিকেল হয়ে গেল বলে দিন গেল দিন গেল করে কেঁদে কি লাভ। সন্ধ্যাকে সন্ধ্যার মত আসতে দাও।’

কিন্তু মেজ মহারাজের সঙ্গে তাকে মায়ের কাছে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। নির্মল যখন মায়ের বিছানার পাশে উপস্থিত হয়েছিল তখনও তাঁর কথা বলার শক্তি ছিল। একটু একা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘নিমু, বড় কষ্ট।

সে কেঁপে উঠেছিল। তারপর বলেছিল, ‘তোমার কষ্ট বাবা দূর করছেন না কেন?’

হঠাৎ কঠোর হয়েছিল মায়ের মুখ, ‘কে বাবা? ওই লোকটা তার শিষ্যদের কাছে বাবা, আমার কি? তোর জন্মদাতা, কিন্তু তুই আমার ছেলে। তোর বাবা তোকে কোনদিন বুকে জড়িয়ে আদর করেনি। আঃ।’

হঠাৎ একটা মৃদু শব্দ হল! চোখ খুলতেই চমকে উঠল নির্মল। এক জোড়া চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। বাবা বলে চিৎকার করে উঠতে গিয়েই সামলে নিল সে নিজেকে। ততক্ষণে তার নজর কিন্তু ওই চোখ ছাড়িয়ে শরীরটার ওপর পড়েছে। একটা বিরাট চেহারার সাদা প্যাঁচা তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। সাদা প্যাঁচা এই প্রথম দেখল সে। এরাই কি লক্ষ্মীর বাহন? পাখিটাকে তাড়ানো দরকার। ওইরকম চোখ নিয়ে জানলায় বসে থাকলে কোন মানুষের ঘুম আসবে না। নির্মল বিছানা থেকে নামতেই পাখিটা ঘুরে বসল। বেশ ওজনদার পাখি। তারপর ডানা মেলে দিল অন্ধকারে।

সকালে নির্মলের যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদ বেশ কড়া। চোখ খুলে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই কানে একটা বিদঘুটে শব্দ ভেসে এল। সে কোথায় শুয়ে আছে এই বোধ স্পষ্ট হওয়ামাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠল তক্তাপোষ ছেড়ে। এবং তখনই আবিষ্কার করল, তার ফরসা শরীরে চাকা চাকা লালচে দাগ ফুলে উঠেছে। বেশ চুলকচ্ছে ওগুলো। আর সেই শব্দটা হয়ে যাচ্ছে একটানা। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সে দরজা দিয়ে মুখ বের করল। তারপর সোজা বাথরুমে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে পোশাক পাল্টে নিল। ব্যবহৃত পাজামাটাকে নিয়ে সমস্যায় পড়ল সে। আশ্রম বা কলকাতায় তার ছাড়া পোশাক সেবকরাই কেচে দেয়। বাসি কাপড় জলে না দিয়ে রেখে দেওয়া অন্যায়। অথচ—! নির্মল পাজামাটাকে ভাঁজ করে সঙ্গে নিয়ে ঘরে চলে এল। যে পোশাক এই মুহূর্তে পরে আছে সে তা থেকেই বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। টানা কদিন এই পোশাকেই থাকতে হয়েছে তাকে। বরং এগুলোকেই কেচে দিলে ভাল হত। এইসময় দরজায় শব্দ হল। নির্মল দেখল একটি মেয়ে, যার চুল পিঠ ছাড়িয়ে নিতম্ব ছেয়ে রয়েছে, দুহাতে চায়ের কাপ আর বিস্কুটের ডিস নিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। এই মেয়েটি কে? গায়ের রঙ শ্যামলা কিন্তু মুখ মিষ্টি চেহারা। গতরাতে যে মহিলা তাকে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁর বোন?

দশটা বেজে গেল। নির্মলের ঘরে কেউ এল না। সে-ও ওই ঘর থেকে বেরোয়নি। দোতলায় কারো কথা শোনা যাচ্ছে না। অবশ্য বাইরে মানুষজনের কথা যেমন শোনা যাচ্ছিল তেমনি জঙ্গল থেকে পাখির ডাক ভেসে আসছিল সজোরে। আর সেই বিদঘুটে শব্দের বহস্যভেদ হল যখন সে কাঠঠোকরাটাকে দেখতে পেল জানলার উল্টোদিকের গাছে এসে বসায়। ওই ছোট্ট পাখির ঠোঁট যে অমন শব্দ তৈরি করতে পারে কে জানত। টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়েছিল সময় কাটাবার জন্য। ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা বই-এর বাঙলা অনুবাদ, আমার ডায়েরি থেকে! পড়তে পড়তে এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে একটা প্লেটে ডিমভাজা আর চায়ে কাপ নিয়ে কেউ এসেছে খেয়ালই করেনি। যখন খেয়াল হল তখন সংকুচিত হযে সরে বসল। মেয়েটি ওদুটো টেবিলে রেখে সকালের কাপ ডিস তুলে চলে যাচ্ছিল, নির্মল সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, উনি আছেন?

মেয়েটি মুখ ফেরাল। তার চোখে কৌতূহল। নির্মল তাড়াতাড়ি বলল, ‘ওই যে, যিনি গতরাতে আমাকে এখানে থাকতে দিলেন।’ মেয়েটি মাথা নেড়ে না বলল। তারপর বেরিয়ে গেল।

অর্থাৎ সেই মহিলা সকাল থেকেই বাড়িতে নেই। কি যেন বলেছিলেন কাল রাত্রে, ডিউটিতে যেতে হবে না ওই ধরনের কিছু! নির্মল ডিসের দিকে তাকাল। জন্মাবার পর থেকে সে কখনও ডিম খায়নি। অথচ এখন খিদে পাচ্ছে তার। একটা টুকরো চামচে কেটে মুখের কাছে নিয়ে আসতেই নাকে গা গুলানো গন্ধ ধ্বক্ করে লাগল। চামচটা নামিয়ে অসহায় চোখে তাকাল সে। তার শরীর চাইছে না এই বস্তুটিকে গলা দিয়ে নামাতে। অথচ কোটি কোটি মানুষ এই খাদ্য পরমানন্দে খেয়ে নেয়। তাহলে সে পারবে না কেন? শরীরের নাম মহাশয় যা সওয়াবে তাই সয়। নাক টিপে বড় একটা টুকরো মুখে চালান করে দিল নির্মল। স্বাদ তো ভাল। আশ্রমে আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ। তাদের সিস্টেমেই মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজ কিংবা রসুন কখনও প্রবেশ করেনি। পেঁয়াজ বা রসুন নিরামিষ তরকারির সঙ্গে খেলে খুব অসুবিধে হয় না। ওইভাবে ডিমভাজা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিল সে। তরল পদার্থটি পেটে যাওয়ামাত্র শরীর গুলিয়ে উঠল। এবং তার পরেই পেট থেকে সব কিছু যেন ছিটকে ওপরে উঠে আসতে চাইল। নির্মল কয়েকবার চেষ্টা করল সামলাবার। তারপর বিপদ আসন্ন বুঝে ছুটে গেল বাথরুমে। সশব্দে পেট থেকে ডিমের টুকরোগুলো সজলে বেরিয়ে আসতে লাগল বাইরে।

বমি শেষ হবার পর দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল সে কিছুক্ষণ। প্রচণ্ড কাহিল লাগছে এখন। শেষদিকে তেতো জল বেরিয়েছে। হঠাৎ পেছনে আওয়াজ পেল নির্মল। অবসন্ন হয়ে মুখ ফেরাতেই সে মেয়েটিকে দেখতে পেল। বাথরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হতেই মেয়েটি তাকে ইশারা করল বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। কিন্তু উদ্‌গারিত পদার্থগুলো পরিষ্কার না করে সে বের হয় কি করে! কিন্তু তার আগেই মেয়েটি বাথরুমের কোণ থেকে একটা ঝাঁটা তুলে নিয়ে পরিষ্কার করতে অরম্ভ করেছে। খুব লজ্জা লাগছিল নির্মলের। তার বমি আর একজন কেন পরিষ্কার করবে? কিন্তু তার প্রতিবাদ জানাবার কোন সুযোগ রইল না। তার আগেই মেয়েটি জল ঢালতে শুরু করেছে। ঘরে ফিরে এল নির্মল। খুব খারাপ লাগছে। শরীর তো বটেই মেয়েটির কাজে সে আরও লজ্জিত বোধ করছে। তক্তাপোষে চিত হয়ে শুয়েছিল সে। ধীরে ধীরে শরীরের অস্বস্তি কমে এল এবং তখনই মেয়েটি আবার এল। শুকনো মুড়ি একটা বাটিতে করে এনে টেবিলে রেখে চলে গেল। খুব অবাক হল নির্মল। এত কাণ্ড হয়ে গেল কিন্তু মেয়েটি কোন কথা বলছে না কেন?

বারোটার পর বাইরের দরজায় শব্দ হল এবং মহিলার গলা শুনতে পেল নির্মল। মিনিট খানেক পরেই তিনি দরজায়, পরনে নার্সের পোশাক, ‘কি ব্যাপার, বমি করা হয়েছিল শুনলাম। ডিম খাও না?’

নির্মল লজ্জিত হল। সে বলল, ‘আসলে অভ্যেস নেই তো। আমি খুব দুঃখিত।’

‘আরে দুঃখ প্রকাশ করার কি আছে। কিন্তু অভ্যেস নেই কেন? তোমাদের বাড়িতে ডিম খায় না? এ তো বড় অদ্ভুত কথা! মাছ মাংস খাও তো?’

‘এতদিন খাইনি। কিন্তু খেতে আর আপত্তি নেই।’

‘ওমা। আবার পয়সা দিয়ে কেনা জিনিস বমি করে নষ্ট করবে?’

‘আর হবে না, প্রথমবার বলেই—।’

‘তোমাদের বাড়ির সবাই কি খুব ভক্ত? দীক্ষা নিয়েছে কারো?’

নির্মল মুখ তুলল। সত্যি কথাটা বলার জন্যে মন উশখুশ করছিল। যারা তার জন্যে এত করছে তাদের কাছে মিথ্যে বলা ঠিক নয়। কিন্তু না, তার এই আত্মগোপন করে থাকা বিফলে যেতে পারে সামান্য একটা ভুলের জন্যে। সে বলল, ‘ওই আর কি!’

মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার শরীর খারাপ করছে না তো?’

‘না।’ জড়তা কাটাতে পারছিল না নিৰ্মল।

‘তুমি তো ভাবিয়ে তুললে ভাই। পথে নামার আগে ভাল করে চিন্তা করা দরকার ছিল। যখন যেমন তখন তেমন না হলে কি করে পারবে? খুব আদরে ছিলে?’

‘আদর নয়, যত্নে। যত্নটা গলায় ফাঁস হয়ে ছিল।’

‘মায়ের?’

‘না। আমার মা নেই।’

‘ও।’ মহিলা চলে গিয়েছিলেন ঘর ছেড়ে। আর নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল নির্মলের। এই শরীর কেন ননীগোপাল হয়ে ছিল এতদিন। আর নয়। কিন্তু মহিলা তার সম্পর্কে অন্য প্রশ্ন করছেন না কেন? কেন সে এসেছে, কি করতে চায়—ইত্যাদি বিষয় তুলছেনই না। মহিলা যে নার্সের চাকরি করেন তা বোঝা গেল কিন্তু অবিনাশের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক কি? হঠাৎ বাবার একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাবা প্রায়ই শিষ্যদের উপদেশ দেন, ‘সংসার থাকবে মাছের মত। সাঁতার কাটবে, ঘুরবে ফিরবে কিন্তু গায়ে জল লাগাবে না।’ অর্থাৎ তুমি থাকো তোমার মত, খামোকা জড়িয়ে পড় না। আজ এই মুহূর্তে নির্মলের পছন্দ হল কথাটা। এরা কে কি ভাবছে, কার সঙ্গে কি সম্পর্ক তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? সে কানাইদের পাঠানো খবরের জন্যে অপেক্ষা করবে। আশাকরি কদিন তাকে আশ্রয়হীন হতে হবে না।

.

পার্ক সার্কাসে ইউনিসের দেখা পেলেন না তিনকড়ি রায়। ইউনিস নাকি কদিন থেকে চরকির মত ঘুরছে। ওর এক চামচে বলল, ‘বসকো ডিফিট হো গিয়া। বাকি হামলোগ নেহি ছোড়ে গা। বসকো প্রেস্টিজ বাঁচানেই পড়েগা। আপ উনসে মিলনে মাংতা তো যাইয়ে থিয়েটার রোড।’ লোকটা এর বেশি কিছু জানে না বলে জানাল। ওর বস সকালে একজনকে বলেছিল যে থিয়েটার রোড যেতে হবে এইটেই তার কানে লেগে আছে।

থিয়েটার রোডে ইউনিসের কোথায় আড্ডা তা তিনকড়ি রায়ের জানা নেই। হঠাৎ সুধাময় সেনের কথা মনে পড়ল তার। ছোটে মহারাজের ব্যাপারে সুধাময় প্রথম প্রথম তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন কিন্তু ইদানিং কোন সাড়াশব্দ নেই। আশ্রম থেকে নির্দেশ না এলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। মহারাজ পদমর্যাদায় তিনি তিন নম্বর সারিতে ছিলেন এতদিন। বুকের ভেতর কষ্টটা যেন উথলে উঠল। তিনকড়ি রায় থিয়েটার রোডে যাওয়ার জন্যে একটি ট্যাক্সি ধরলেন। তাঁর মনে পড়েছিল সুধাময় সেনের অফিস ও পাড়াতেই। ইউনিসকে না পাওয়া যাক, সুধাময়ের সঙ্গে কথা বলা যাক। ওই একটা ছেলেকে পাওয়ার ওপর তার সবকিছু নির্ভর করছে। লাউডন স্ট্রিট ছাড়িয়ে এসে তিনি ট্যাক্সি ছেড়ে দিলেন। এখনও এ পাড়ায় দিন শুরু হয়নি। রাস্তা বেশ নির্জন। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন। ডান দিকের গলিতে ঢুকে পঞ্চাশ গজ হাঁটলে সুধাময়ের অফিসের দরজা পাওয়া যাবে। তিনকড়ি রায় লক্ষ করেননি আর একটা ট্যাক্সি এতক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করছিল। তিনি গলিতে ঢুকতেই সহসা বাঁক নিয়ে গতি বাড়িয়ে দিল সেটা।

.

সুধাময়ের অফিসে এত সকালে লোকজন নেই। কিন্তু তাঁর অ্যাসট্রে উপচে পড়ছে। খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। বাঁ হাতে চুলের গোছা মুঠোয় নিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন তিনি। তাঁর উল্টো দিকে গম্ভীর মুখে ইউনিস বসে।

হঠাৎ ইউনিস বলল, ‘এতদিন আমরা আলাদা আলাদা তালাস করেছি কেন সেনবাবু? যদি এককাট্টা হতাম তাহলে ছোটে মহারাজকে পেয়ে যেতাম।’

‘কি করেছি কেন করেছি বলে কোন লাভ নেই। এখনও যদি ওকে খুঁজে না পাই তো হয়ে গেল। আশ্রম থেকে যে ভাষায় কথা শুনিয়েছে তার পরে মুখ দেখাবো কি করে জানি না।’

‘ঠিক বাত। প্রিস্টিজ তো আমার ভি পাংচার হয়ে গেল। আমি সনাতননাথের আশ্রমে পাত্তা লাগালাম। না, সেখানে ছোটে মহারাজ যাননি। আমার সন্দেহ হচ্ছে ওই আনন্দ সরস্বতীকে। ওর ওখানে আমার লোক ঢুকতেই পারছে না।’

সুধাময় সেন মুখ তুললেন, ‘না মশাই। কেউ ছোট মহারাজকে ইলোপ করেনি। তিনি নিজেই হাওয়া হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কথাটা বলা যাবে না। ‘

‘প্রমাণ পেয়েছেন কিছু?’

‘পেয়েছি। প্রথমে জেনেছিলাম ছোটে মহারাজ কলেজ থেকে লুকিয়ে খিদিরপুর ব্রিজের নিচে যেতেন গাঁজা খেতে। খুব অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু আমার লোক প্রমাণ এনেছে। তারপরে একটা সোর্স বলল ওরা গাঁজা কিনেছে কিন্তু খায়নি। ওঁর সঙ্গে যে ছেলেটা যেত সে-ও কলকাতা থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। এবার তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেছি। সে নাকি কড়া রাজনীতি করে। সি পি এম, কংগ্রেস কিংবা নকশাল নয়। সে বিশ্বাস করে এইসব বাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়ে কিস্যু হবে না। মানুষকে জাগাতে হবে। তাদের সক্রিয় করতে হবে, তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।’

‘ব্যস ব্যস’। হাত তুলে থামাল ইউনিস, ‘এইসব লম্বাচওড়া বাত আমি বহুৎ শুনেছি। কিন্তু এর সঙ্গে ছোটে মহারাজের কি সম্পর্ক?’

‘ছোটে মহারাজ যখন এই ছেলেটার সঙ্গে উধাও হয়েছেন তখন মনে হচ্ছে উনি ওই দলে জয়েন করেছেন।’ গম্ভীর গলায় বললেন সুধাময়।

‘আই বাপ! কি বলছেন আপনি?’

‘ঠিকই। প্রহ্লাদকুলে দৈত্য। কেউ যদি একা লুকিয়ে থাকতে চায় তাহলে শেষপর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হয় না কিন্তু দল যদি তাকে লুকোতে সাহায্য করে তাহলেই মুশকিল। আমার লোক ওকে একটা বস্তি পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল। কিন্তু বস্তি থেকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে।’ সুধাময় বললেন।

‘বস্তি? ছোটে মহারাজ? আপনি যা বলছেন তা যদি সত্যি হয় তো আমাদের জান চলে যাবে। এই রিপোর্ট আপনি আশ্রমে পাঠিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। ওখানে আমি অসৎ হতে পারব না।’

‘আচ্ছা! আপনি আমাকে বস্তির ঠিকানাটা দিন, আমি একবার কৌশিস করি।’

সুধাময় মাথা নাড়লেন, ‘কোন লাভ হবে না। আমার লোক কোন ক্লু পায়নি ওখানে। যে লোকটার কাছে উনি ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছে সেখানে উনি থাকতেই পারেন না। ছোটে মহারাজ যে ভাবে মানুষ হয়েছেন তাতে তাঁর পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব নয়।’

ইউনিস চুপ করে দেখল সুধাময়কে। তার মনে হল সুধাময় যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। বস্তিতে ওর লোক যেহেতু কিছু পায়নি তাই হয়তো ভয় হচ্ছে ইউনিস যদি কিছু পেয়ে যায় তাহলে বাবার কাছে হেয় হয়ে যাবে। সে ঠোঁট ওল্টালো, ‘সেনসাহেব, এখন সময়ের দাম খুব বেশি। আপনার লোক যেভাবে খবর খুঁজছে আমার লোক তার উল্টো তরিকা নেবে। গলায় ছুরির চাপ পরলে সত্যি কথা বোবার পেট থেকেও হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসে। উনি ওখানে নেই, কিন্তু কোথায় গিয়েছেন সেই খবরটা আপনাকে দেব।’

অগত্যা সেন একটা কাগজে বস্তির আর পশুপতির নাম লিখে দিলেন। ঠিক সেইসময় নিচে একটা সোরগোল উঠল। আর তার পরেই অফিসের একটা বেয়ারা ছুটতে ছুটতে বলল, ‘মর গিয়া, একদম গাড়িকা নিচে চলা গিয়া।’

সুধাময় ধমকালেন, ‘কি হয়েছে? কে গাড়ির নিচে পড়েছে!’

লোকটা দাঁড়াল, ‘সার, নিচে হামলোঁগকো গলিমে। হাম ব্যালকনিমে খাড়া থা। এক বুড্ডা হামলৌগকো গলিমে যব ঢুকা ফটকে ট্যাক্সি উনকো ওপর আ গিয়া হেভি স্পিডমে। অ্যাকসিডেন্ট নেহী, জানবুঝকে মার ডালা।’

ইউনিস বলল, ‘ছেড়ে দিন। কলকাতায় রোজ এরকম গোটা দশেক কেস হয়।’

ইউনিসের সঙ্গে কথা শেষ করে সুধাময় সেনের মনে হল একটু শুতে পারলে ভাল হত। শরীর যেন আর পাবছে না। সে ইউনিসকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোনদিকে যাবেন?

‘পার্ক সার্কাস। তারপর এই বস্তিতে। কাগজ দেখিয়ে উঠে দাঁড়াল ইউনিস। বলে নেমে গেল সে। সুধাময় ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি করে যাঁর দয়ায় আজ করে খাচ্ছেন তাঁর এতবড় বিপদে কোন উপকারে আসতে পারলেন না এখনও। মনের মধ্যে যেন একটা অস্বস্তি কাঁটার মত বিঁধছিল। তিনি মুখ বাড়িয়ে নিচের গলির দিকে তাকালেন। বেশ ভিড় জমে গেছে সেখানে। ট্যাক্সিটা নেই। নিশ্চয়ই কেউ এতক্ষণে পুলিশকে খবর দিয়েছে। হাই তুললেন সুধাময়। এখন এই মুহূর্তে পাঁচজন দক্ষ অফিসার তাঁর কোম্পানির হয়ে ছোটে মহারাজকে খুঁজে যাচ্ছে। অতএব বাড়িতে নয়, এখানেই, অফিসেই বিশ্রাম নিতে হবে। ঘরে ফিরে আসতেই পাগলের মত ইউনিস ঢুকল, ‘সেনসাহেব, সর্বনাশ হো গিয়া। আই বাপ, আভি কিয়া হোগা?’ কপাল চাপড়াল লোকটা।

‘কি হল?’ মুহূর্তে সুধাময়ের শরীর থেকে ক্লান্তি দূর হয়ে গেল যেন।

‘তিনুমহারাজকা মার ডালা।’

‘তিনু—?’ নামটা পুরো উচ্চারণ করতে পারলেন না সুধাময়।

‘হ্যাঁ। আপনার গলিতে ওঁকে একটা ট্যাক্সি এসে চাপা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। কেউ নাম্বারটাও বলতে পারছে না। খুন।’ ইউনিস টেলিফোনের দিকে ছুটে গেল।

সংবিৎ ফিরে পেলেন সুধাময় ইউনিসের ছুটে যাওয়া দেখে, ‘কাকে ফোন করছেন?’

‘আশ্রমকে। বড়ে মহারাজকে।’

‘দাঁড়ান। আপনি ওই ঘরের ফোনে ওসির সঙ্গে কথা বলুন: আমি দেখছি।’

ইউনিসের চোখেমুখে অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটে উঠলেও সে নিজেকে সামলে নিল। তারপর কাঁধ নাচিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। সুধাময় চেয়ারে ফিরে এসে রিসিভার তুললেন। এস টি ডিতে লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। লাইনিং কল বুক করলেন তিনি। লাইন পাওয়ার আগেই ইউনিস বেরিয়ে এল, ‘ওসি খবর পেয়ে গেছেন। আমি চলি।’

‘দাঁড়ান ইউনিসভাই। কথা আছে।’ সঙ্গে সঙ্গে রিঙ শুরু হতেই রিসিভার তুলে নিলেন সুধাময়, ‘হেলো, বড় মহারাজাকে চাই। সুধাময় বলছি কলকাতা থেকে। মহারাজ, সুধাময় বলছি। না, এখনও কোন খবর পাইনি তবে যা সূত্র—, না, না, আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, হ্যাঁ, না, না, আপনি লাইনটা কাটবেন না। কি বললেন? আপনি খবরটা পেয়েছেন? কখন পেলেন? ও, ও, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ইউনিস? আচ্ছা। আচ্ছা!’ রিসিভার নামিয়ে রেখে রুমালে মুখ মুছলেন সুধাময়। এই সাত-সকালেও তাঁর কপালে ঘাম জমেছে। তাঁর গলা থেকে অদ্ভূত স্বর বেরুলো, ‘ইউনিস ভাই!’

‘কি হল?’ ইউনিস চেয়ার টেনে নিলেন, ‘উনি কি বললেন?’

‘উনি খবরটা পেয়ে গেছেন।’

‘সেকি? কে খবর দিল?’

‘নাম বলেনি। শুধু বলেছে তিনকড়ি বায় যিনি মহারাজ ছিলেন, একটু আগে সুধাময় সেনের গলিতে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। এরকম অ্যাক্সিডেন্ট যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে বাবা যেন একটু ভাবনা-চিন্তা করেন। সাহস বুঝুন!

‘এ তো রীতিমত ওয়ার্নিং। খুন করেই ওয়ার্নিং দিয়েছে। কারা?’

‘বড় মহারাজ বললেন এখনই কোন সিদ্ধান্ত না নিতে। আর ওসিকে বলতে তিনি যেন খুনের কেস না বলে অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে ব্যাপারটাকে ট্রিট করেন। এব্যাপারে যা করার আপনি করুন।’ সুধাময় মাথায় হাত দিলেন।

ইউনিস একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বড়ে মহারাজ আমার কথা কিছু বললেন?’

‘হ্যাঁ। এখন থেকে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে বললেন।’

ইউনিস সোজা হয়ে দাঁড়াল, ‘আমি ওসিকে সামলাচ্ছি। কিন্তু সেনসাহেব, মনে হচ্ছে যুদ্ধটা শুরু হয়ে গেল। এখন খুনকা বদলা খুন চলবে।’

‘খুন? তিনু মহারাজ খুন হননি বলতে হবে কিন্তু।’

‘তা জানি। এখন যতগুলো অ্যাক্সিডেন্ট হবে তাকে অ্যাক্সিডেন্টই বলতে হবে।’

ইউনিস বেরিয়ে গেল। এইসময় টেলিফোন বেজে উঠতে সুধাময় রিসিভার তুলে খুব ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে বলছেন?’

‘স্যার, আমি ব্যানার্জি। দারুণ একটা সূত্র পাওয়া গিয়েছে। ছোটে মহারাজ রাত আটটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে ঢুকেছিলেন।’

সুধাময়ের হৃৎপিণ্ড যেন গলায় উঠে এল, ‘তারপর?’

‘ওইসময়ের ট্রেনগুলো দেখছি।’

‘ননসেন্স। হাওড়া স্টেশন থেকে তখন গাদা গাদা ট্রেন ছাড়ে দূর পাল্লার।’

‘তা ছাড়ে। কিন্তু লোকাল ট্রেন বেশি ছাড়ে না। সঙ্গে কোন জিনিষপত্র ছিল না বলেই এই পয়েন্টটা ভাবছি। মনে হল আপনি ইন্টারেস্টড হবেন, তাই ফোন করলাম।’

‘ইন্টারেস্টেড হবেন! হয়ে করবটা কি? ছোটে মহারাজকে হাওড়া স্টেশনে দেখা গেছে, এইটে বলে আমি কোথাও পৌঁছলাম? ওটা শিয়ালদা হলে কি এসে যেত?’ লাইনটা কেটে দিলেন সুধাময়। এরকম নাকে দড়ি দিয়ে অনেকদিন কেউ তাকে ঘোরায়নি।

.

শুধু নিরামিষ তরকারি দিয়ে তৃপ্তি করে দুপুরে খেল নির্মল। এখন তার পরনে পাজামা আর গেঞ্জি। ময়লা হয়ে যাওয়া পোশাক প্রায় জোর কবেই কেচে দিয়েছেন মহিলা। খাওয়া শেষ হলে তিনি এলেন নির্মলের কাছে, ‘তুমি বিড়ি সিগারেট খাও না?’

মাথা নাড়লো সে, না। তারপর লাজুক হাসল।

‘কি ব্যাপার বল তো?’ তোমাকে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘কেন?’ নির্মল একটু সঙ্কুচিত হল।

‘তোমার আগে আরও দুজনকে রাখতে হয়েছে আমাকে। তোমার দলেরই লোক। তাদের মত তোমার আচরণ তো দূরের কথা, কথাবার্তাও নয়। তুমি খুব বড়লোকের আদুরে ছেলে?’

কি বলবে বুঝতে না পেরে নির্মল বলল, ‘আদুরে কি না জানি না তবে আমার বাবা অনেক বিষয় সম্পত্তির অধিকারী। অবশ্য নিজের নামে বা উপার্জনে নয়।’

‘সে আবার কি কথা? তোমরা নিশ্চয়ই কয়েক পুরুষের বড়লোক। তা বাপু তোমার গায়ের রঙ, মুখের গড়ন দেখেই আমার সন্দেহ হযেছিল।’ মহিলা হাসলেন।

‘আপনার কাছে বুঝি এইরকম হুট করে লোক আসে?’

‘না না। দুজনই এসেছিল। অবিনাশ নিয়ে এসেছিল। প্রথমবার রাখতে খুব ভয় লেগেছিল। তারপর দেখলাম ছেলেদুটো একটু জেদী তবে খারাপ নয়। তুমি এদের দলে কতদিন ঢুকেছ?’

‘বেশি দিন নয়। অবিনাশবাবু কোন খবর দেননি, না?’

‘না। কেন, এখানে খুব অসুবিধে হচ্ছে?’

‘না, না। উনি বলেছিলেন খবর পেলেই দেবেন, তাই।

‘খবর পায়নি হয়তো। আচ্ছা, কি করতে চাইছ তা তোমরা ঠিক জানো? ‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল নির্মল।

‘এই উত্তরটা তোমার আগের দুজনই ওইভাবে বলেছিল। কিন্তু আমি ভাই কোন আশা দেখি না। অতবড় নকশাল আন্দোলন পর্যন্ত বিফল হল। অবিনাশ বলে, এখন আর সশস্ত্র আন্দোলন নয়, জনসাধারণকে সচেতন করবে ওরা তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে। এদেশের মানুষ যেন মাটির পুতুল। কদিন পরেই তোমরা হতাশায় ভুগবে।’ মহিলা ঘর থেকে মুখ বের করে বললেন, ‘অমু, কাপড় শুকিয়েছে কিনা দ্যাখ।’ মহিলাকে বেশ পছন্দ হয়েছিল নির্মলের। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘অবিনাশবাবু কি বলেন এ ব্যাপারে?

‘ও কি বলবে? একসময় সি পি আই করত, তারপর সি পি এম। নকশাল আন্দোলনের সময় নিজের দলের সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটলেও দল ছাড়েনি। দল ছেড়েছে ওর পার্টি যখন ক্ষমতায় এল। বলল, ‘দুবছর ক্ষমতায় এসেও যে দল একটি পাড়ার একটা রাস্তার মানুষকে সচেতন করতে পারেনি, তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি,তাদের দিয়ে বুরোক্রেটিক শাসনব্যবস্থা চালানো সম্ভব কিন্তু শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা অসম্ভব।’

‘আপনি অবিনাশবাবুর সঙ্গে আছেন?’

‘ওর দলে আছি নাকি? না বাবা। নার্সের চাকরি করি। কোনমতে বেঁচে আছি। গরীবের ঘোড়ারোগ হলে আর দেখতে হবে না।’

যে প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরে করব করব করেও করতে পারেনি নির্মল, সেটা এবার আচমকা বলে ফেলল, ‘অবিনাশবাবু কি আপনার আত্মীয়?’

মহিলার মুখ হাঁ হয়ে গেল। তারপর হাসিতে ভেঙে পড়লেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আত্মীয়তার চেষ্টা করছি সেই পনের বছর বয়স হতে। বেজাত বলে হল না সেইবয়সে। বিয়ে হল আমার। বিধবাও হলাম। অবশ্যি তার আগেই অবিনাশের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। ছেলেমেয়ে হয়নি। ওর বউ আমার কথা জানে। তবে ভাই একটা কথা বলি, আমার পেটে ব্যথা হলে জেনেছি ওরও হয়। যেদিন আমি কোন কারণে খেতে পারিনি সেদিন শুনি অবিনাশও না খেয়ে থেকেছে। একে যদি আত্মীয়তা বল, বলতে পার। উঠি, একটু গড়িয়ে নিই ভাই। শরীর ভারী হলে দুপুরে না গড়িয়ে উপায় নেই।’ মহিলা চলে গেলেন। আশ্রমের জীবনে নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে একটি শৃঙ্খলা সবসময় বজায় থাকত। যেখানে অনুলোম অথবা প্রতিলোম বিবাহের ব্যাপারেই বিধিনিষেধ ছিল সেখানে এইরকম বিবাহোত্তর সম্পর্ক বজায় রাখলে আশ্রম কোন সম্পর্ক রাখত না। কিন্তু এই মহিলাকে দেখে তার খারাপ লাগছে না কেন? কেন মনে হচ্ছে অবিনাশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি অকপট। মা বলতেন, যে কাজ করে পরে কোন অনুশোচনা হয় না সেই কাজ কখনই পাপ নয়। মহিলা সম্ভবত সেই স্তরে পড়েন।

দুপুরটা কাটতেই চাইল না। ঘরে বসে বসে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হল সে। বিকেলে মেয়েটি এল দুধের গ্লাস নিয়ে। সেটা দেখে নির্মল জিজ্ঞাসা না করে পারল না, ‘দুধ কেন?’

মেয়েটি ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি সামলাতে চেষ্টা করল। নির্মল বলল, ‘আমাকে চা দিলেই ভাল লাগবে।’ মেয়েটি না দাঁড়িয়ে চলে গেল। কিন্তু মহিলা এলেন, ‘কি ব্যাপার, তুমি দুধ খাবে না?’

‘না। আমাকে চা দেবেন, দুধ খেতে ভাল লাগে না।’

‘চা খেয়ে তোমার বমি হয়ে গিয়েছিল না?’

‘ওঃ। কিন্তু তা বলে আবার চেষ্টা করব না? আমি অসম্ভব বলে কিছু আছে বিশ্বাস করি না। সবাই যা পারে আমি তা নিশ্চয়ই পারব।’ নির্মল বলল।

মহিলার মুখে চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল, ‘তুমি কে বল তো?’ হকচকিয়ে গেল নির্মল, ‘মানে?’

‘তুমি কোন সাধারণ পরিবারের ছেল নও।’ মহিলা চলে গেলেন। মেয়েটি চা নিয়ে এল খানিক পরে। নির্মল মেয়েটির দিকে তাকাল। এখন ও ওর ছোট্ট কপালে টিপ পরেছে। বেশ লাগছে দেখতে। মেয়েটি কথা বলল না। একটা মানুষ এত চুপচাপ থাকে কি করে কে জানে!

সন্ধের পর দরজায় শব্দ হল। নির্মল তার ঘরে বসেই গলা শুনল, ‘সব ঠিক আছে তো? নির্মলবাবু কোথায়?’

একটা হাসি বাজল, ‘এতকাল পরেও আমার ওপর কি আস্থা! ছেলেটি কে?’

‘কেন? হঠাৎ এরকম প্রশ্ন?’ গলাটা অবিনাশের।

‘আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সাধারণ পরিবারের ছেলে নয়।’

‘সেটা হতেই পারে। তোমাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছে?’

‘না, না। ও সেরকমই নয়। সারাদিন ঘরে বসে বই পড়ে গেছে।’ এরপরেই ওর ঘরে অবিনাশ এলেন, ‘কানাই আজ রাত্রে আসছে। সঙ্গে দুজন নেতা থাকবেন। আপনাকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে। হয়তো আজ রাত্রেই আপনাকে এখান থেকে অনা কোথাও যেতে হতে পারে।

নির্মল হাসল, ‘আমার তো তৈরি হবার জন্যে সময়ের দরকার নেই।’ অবিনাশ ওর খাটে বসলেন, মহিলা দরজায়, ‘নির্মল, আমাকে এখনই কোলাঘাটে ফিরে যেতে হবে। দূরত্বটা তো দেখেছেন। এক কাজ করুন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। ওরা তো আমার বাড়িতেই প্রথমে আসবেন। কথাবার্তা ওখানে বলেই ঠিক করা যাবে সবকিছু।’

মহিলা বললেন, ‘ওরা কি কোলাঘাট থেকে ফিরে যাবে, না এদিকেও আসবে?’

‘বুঝতে পারছি না। শুধু বলা হয়েছে ওকে খবরটা দিতে।’

নির্মল উঠে দাঁড়াল, ‘চলুন। আবার ওদের নিয়ে কেন এতদূর ফিরে আসবেন?’

অবিনাশ হাত তুললেন, ‘দাঁড়ান। এত তাড়াতাড়ি কে ফিরছে। চা খাওয়াবে?’

মহিলা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলেন। হঠাৎ পাল্টে গেলেন অবিনাশ, ‘নির্মল, আমাদের কাজ, লক্ষ্য এবং পদ্ধতির কথা আপনি জানেন?’

‘লিফলেট এবং কানাই-এর কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি।’

‘আপনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দিতে পারবেন?’

‘এইভাবে সারা দিনরাত যদি ঘরে বসে থাকতে হয় তাহলে অবশ্য কিছুই বলা সম্ভব নয়।’

‘এটা তো টেম্পোরারি। কারণটা আমার চেয়ে আপনি জানেন ভাল করে।’

‘হ্যাঁ জানি। মুশকিল। হল কলকাতায় কি হচ্ছে তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়!’

‘আমি জানি না কলকাতায় আপনি এমন কোন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছেন কিনা যে কারণে আপনাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমি কিন্তু বারংবার বলেছি প্রত্যেককে ক্লিন শ্লেট হতে হবে। জনসাধারণ যেন আমাদের সম্পর্কে কোন বিরূপ ধারণা পোষণ না করে!’

‘আমি কখনও কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না।’ নির্মলের কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা কর্তৃত্ব ছিল যে অবিনাশের মনে হল ও সত্যি কথা বলছে। তাছাড়া এমন উজ্জ্বল চেহারার যুবক কেন অপরাধ করতে যাবে। যদিও এভাবে লুকিয়ে থাকাটাও তার পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু একটু বাদেই তিনি তাঁদের ভাবনা ও কাজের সমন্বয়মূলক আলোচনায় জড়িয়ে পড়লেন। কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ও সি পি এমের সদস্য হিসেবে তিনি কিছুই করতে পারেননি। শুধু দলের নির্দেশ মেনে চলা ছাড়া তাঁর করণীয় কিছু ছিল না। ভারতবর্ষের কথা দূরে থাক, পশ্চিমবাংলার একটি এলাকার মানুষকেও আজ পর্যন্ত বোঝানো সম্ভব হল না যে, কম্যুনিজম কতটা প্রয়োজনীয়। এখনও প্রতিটি নির্বাচনের সময় সদলে ঘনঘন বক্তৃতা করে নিজেদের সম্পর্কে প্রচার করতে হয়। মানুষের আস্থা অর্জন করার মত কোন কাজ দল করেনি। পরবর্তীকালে নকশালরা বিপ্লবের কথা বলেছিল মাটি তৈরি না করেই। এবং সেই বিপ্লব কার বিরুদ্ধে? কিছু পুলিশের গলা কেটে, কিছু মূর্তির মুণ্ডু ভেঙে, কিছু স্কুল পুড়িয়ে দিয়ে ধরা যাক পশ্চিমবঙ্গের দখল পেয়ে গেল ওরা, কিন্তু কদিন? মিলিটারি যদি অস্ত্র ধরতো তাহলে এক দিনেই ধ্বংস হয়ে যেত তারা। বিপ্লব প্রাদেশিকভাবে সম্ভব নয়। বিশেষত সেই বিপ্লব যদি সশস্ত্র হয়।

কয়েক শ’ যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে এদেশের মানুষের সমস্ত মনুষ্যত্ব একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ১৮৯৩ সালে বিদেশযাত্রার সময়ে জাহাজে বসে বিবেকানন্দ একটি চিঠিতে কথাগুলো লিখেছিলেন। তিনি আরও লিখেছিলেন, এমন কিছু নিঃস্বার্থ যুবক চাই যারা, ‘ক্ষুধার্তমুখে অন্নদান করবে, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে, আর পূর্বপুরুষগণের অত্যাচারে যারা পশুপদবীতে উপনীত হয়েছে তাদের মানুষ হবার জন্যে আমরণ চেষ্টা করবে।’ অবিনাশ বললেন, ‘আজকের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ তুললেই অনেকে নাক কোঁচকান। তাঁর সময়ে যারা অত্যাচারী ছিল তারা এখন নেই। কিন্তু তাদের জায়গা পাল্টে গিয়েছে কিন্তু লুপ্ত হয়নি। আর একদল কায়েমী স্বার্থন্বেষী মানুষ সেটা দখল করেছে। পঞ্চাশের দশকে কংগ্রেসকে আমরা অত্যাচারী শোষক বলতাম। তার আগে ব্রিটিশের ওই ভূমিকা ছিল। গত দশ বছরে কংগ্রেসের জায়গা নিয়েছে যারা তারা কিন্তু নিজেদের অজান্তেই ওই ভূমিকায় কাজ করছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরলেই এটা সত্যি বলে প্রমাণিত হবে। আমার কয়েক বিঘে জমি আছে। ভাল ফসল হয়। কিন্তু গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমি শাসক দলকে ভোট দিইনি। পার্টি অফিসে আমার যাতায়াত নেই। অতএব ফসল ফললেই আমার জমিতে সারারাত হাত চালিয়ে সেটি যদি উধাও করে দেওয়া হয় তাহলে থানা কোন ডায়েরি নেবে না। যারা মাঠে কাজ করবে ‘তাদের বলা হবে আমাকে বয়কট করতে। এক কিংবা দুবছর চাষ করার চেষ্টা না করে আমি জমি ফেলে রাখলাম। তারপর একদিন কিছু শ্রমিক সেখানে চাষ করতে এল। আমি বাধা দিতে গিয়ে মার খেলাম। পুলিশ জানাল, গোলমাল না করে কোর্টে যেতে। আদালত মানেই অনন্তকাল।’

‘তাদের কোন উপায় নেই, রাস্তা নেই, সাহায্যকারী বন্ধু নেই। রাক্ষসের মত নৃশংস সমাজ তাদের উপর ক্রমাগত যে আঘাত করছে, তার যন্ত্রণা তারা পাচ্ছে কিন্তু জানে না কোথা থেকে ওই মার আসছে। আর যারা মারছে তারা বেশ সুখী; শোক, তাপ,দৈন্য ও পাপের কাতর ধ্বনিতে তাদের দিবাস্বপ্নের ব্যাঘাত হয় না।’

নির্মল মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। বিবেকানন্দের রচনা সে পড়েছে। অবিনাশ সেই বক্তব্যকে সমকালীন পরিস্থিতিতে যেভাবে প্রয়োগ করছিলেন তাতে তার বিস্ময় বাড়ছিল। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বাবার কোন বিরোধ এখনও হয়নি। ও ব্যাপারে তিনি কখনও কথা বলেননি। বিবেকানন্দ মানে একজন ধর্মপ্রচারক এই রকম ধারণা তারও প্রথম দিকে ছিল। বিবেকানন্দের যে কথাটা তাকে প্রথম নাড়া দিয়েছিল তা হল ধর্ম সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার মতামত। ‘ধর্মের কতগুলো আচরণকে ধর্ম নাম দিয়ে ধর্মধ্বজীরা স্বার্থসিদ্ধি করে গেছে বহুবছর ধরে। যদি এই অবস্থার পরিবর্তন না হয়, তাহলে যখন জনগণ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায়। উত্থিত হবে, তখন ধর্মকে বিসর্জন দেবে শোষণের যন্ত্র জ্ঞান করে।’ ভোগাধিকারসাম্য ছাড়া মানুষের মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠা পায় না। আজ সমস্ত পশ্চিমবাংলার শহরে, পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে যদি বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, তাঁদেরও মেরুদণ্ড আছে, তাঁদেরও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাহলে সময়টা পাল্টে যাবেই। ক্ষুধার্তের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে পোড়া রুটি অথবা কাঁকর ভর্তি ভাত পরিবেশন করা হয়েছে। তাকে ওই দুটির একটিকে নির্বাচন করতে হবে বেঁচে থাকার জন্যে। আর কোন তৃতীয় বস্তু তার সামনে নেই। সে হয়তো পোড়া রুটি ফেলে কাঁকর বাছার চেষ্টা করে ভাত খাচ্ছে ক্ষুধার জ্বালায়। এই পরিস্থিতিতে মুক্তি সেবা, সামাজিক উন্নয়নের চেষ্টা নিয়ে বন্ধুর মত তাদের পাশে দাঁড়ালে তারা নির্বাচন নামক ব্যবস্থার মাধ্যমেই নিজেদের অধিকার কায়েম করতে পারবে। এর জন্যে সময় লাগবে। মানুষের বিশ্বাস অর্জনে যে কাজ করতে হবে তা কন্টকশূন্য হবে না। যাদের স্বার্থ এতে স্পষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে তারা বাধা দেবেই। কিন্তু পরিণতিতে জয় অবশ্যম্ভাবী। সোনার পাথরবাটি বলে যারা এই ধারণাকে ঠাট্টা করবেন, তাদেরই একদিন নিজের রসিকতা গিলতে হবে।

অবিনাশ চলে গেলেন। তিনি নির্মলকে সঙ্গে নিতে রাজী হলেন না। বললেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে আপনাকে একটা গোপন জায়গায় সাবধানে রাখতে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমি আবার আজ রাত্রেই আসব।’ যাওয়ার আগে অবিনাশ মহিলার সঙ্গে বাইরের ঘরে কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন। অন্ধকার ঘন হলে নির্মলের মনে হল যদি একটু বাইরে নেমে পায়চারি করা যায় তাহলে একঘেয়েমি কাটবে। সে পাজামার ওপর জামা পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরের ঘরে মহিলা একা বসে আছেন। তাঁর মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। নির্মলের মনে হল, ওর চোখদুটো ঈষৎ ফোলা। চোখাচোখি হতেই সে বলল, ‘আমি একটু বাইরে হাঁটতে চাই। অসুবিধে হবে?’

‘বেশিদূরে না যাওয়াই ভাল।’ মহিলা মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

সেইসময় হাওয়া আরম্ভ হল। গাছগাছালি দুলতে শুরু করেছে। মাটিতে নেমে খুব ভাল লাগল নির্মলের। এই কদিন অদ্ভুত টেনসনের মধ্যে কাটাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু কেন? আইনের চোখে সে প্রাপ্তবয়স্ক। এখন কোথায় থাকবে, কি করবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তার রয়েছে। তাহলে এই লুকিয়ে বেড়ানো কেন? বাবার শিষ্য সেবকরা এলে সটান বলে দেবে, ‘আমি বেশ আছি। আশ্রমজীবনের পবিত্রতা আমার জন্যে নয়।’ এরপরেও জোর করলে তখন পুলিশের সাহায্য চাওয়া যাবে। এই পর্যন্ত ভেবে বেশ খুশি হল সে। বাবার মুখ মনে পড়তেই সেই খুশি অবশ্য অন্তর্হিত হল। বাবা কি ক্ষমা করবেন? যিনি ক্ষমা করতে না চেয়ে নীরবে থাকেন তাঁকে বোঝা যায় কিন্তু নীরবতা সম্পর্কে যখন সন্দেহ থাকে তখনই গোলমাল হয়। বাবা একদিন বলেছিলেন, ‘শরীরের কোন অংশে পচন এলে তা সঙ্গে সঙ্গে বাদ দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।’

এই নির্জন অন্ধকারে একা একা হাঁটতে নির্মলের বিবেকানন্দের কথা মনে পড়ল। কানাই কখনও আলোচনার সময়ে বিবেকানন্দের কথা বলেনি। অবিনাশ যখন কম্যুনিস্ট পার্টি শুরু করেন, তখন কানাই জন্মায়নি। সেই মানুষ এখন বিবেকানন্দের কথা উদ্ধৃত করছেন স্বচ্ছন্দে। নির্মলের মনে হচ্ছিল ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া মার্কসের সঙ্গে বিবেকানন্দের কোন পার্থক্য নেই সাম্যচিন্তায়। সব কিছু ছাড়িয়ে বিবেকানন্দ ঈশ্বরে দৃঢ়বিশ্বাস রাখতেন এবং তিনি মনে করতেন, ‘হিন্দুধর্মের মত আর কোন ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না।’ কিন্তু বিবেকানন্দ যে পথের সন্ধান দিয়েছেন তা যে কোন সমাজতান্ত্রিকের পক্ষে আদর্শ হওয়া উচিত। এদেশের মানুষকে মেরুদণ্ডহীন করে রাখা হয়েছে। যারা ব্যবসা করে, তারা ননারকম উপায়ে লাভের পরিমাণ দিনভর বাড়িয়ে হয় বাবা নয় সনাতননাথের আশ্রমে গিয়ে দক্ষিণা দেয় শান্তির জন্যে। যারা চাকরিসূত্রে ঘুষ নেয় তারা বাবার শ্রীচরণে গড়াগড়ি খায় পরকালের জন্যে পুণ্য সঞ্চয় করতে। এদেশের বাবারা জেনেশুনেই এদের নিয়ে আছেন। রাজনৈতিক নেতারা তথ্যটি চমৎকার জানেন বলেই এদের ভাঙিয়ে কাজ আদায় করেন। ওই ব্যবসায়ীরা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের ফাণ্ডে অর্থ দেয়, ওই সাধারণ চাকুরেরাই ভোটের বাক্স ভরাট করে। ধর্ম এবং রাজনীতির লীলাক্ষেত্র হল ওইসব মেরুদণ্ডহীন মানুষ, যাদের কথা কেউ ভাবে না, যারা নিজেদের সম্পর্কে ভাবতে গিয়েও এক পায়ের বেশি এগোতে পারে না। এবং এই সময়ে বিবেকানন্দের সেই লাইনটি তার মনে পড়ল, ‘হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরিব ও পতিতদের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোন ধর্ম সেরূপ করে না।’

.

অবিনাশ, কানাই এবং আরও তিনজন এলেন ঠিক রাত দশটায়। নিৰ্মল তখনও বাড়ির সামনে একটা পাথরের ওপর বসে। এই এতক্ষণে সে মাত্র দুটি মানুষকে দেখেছে যারা নিজের প্রয়োজনে যাওয়ায় তার উপস্থিতি লক্ষ করেনি। অবিনাশরা এলেন হেঁটে। এতটা রাস্তা ওরা হাঁটল কেন ভাবতেই নির্মলের মনে হল এটা অনাবশ্যক চিন্তা। এখন থেকে সে এইসব অনাবশ্যক ভাবনা পরিহার করবে। অন্ধকারেও চিনতে পেরে সে সোজা এগিয়ে গেল। কানাই তাকে দেখতে পেয়ে অবাক হল, ‘আরে, তুমি বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ?’

‘আর কতদিন ইঁদুর হয়ে ঘুরে বেড়াব, এবার একটু মানুষের মত আচরণ করি।’

নির্মলের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যা কানাইকে চমকে দিল। অবিনাশ বললেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে কথা না বলে ভেতরে চলুন।’

নির্মল গম্ভীর গলায় বলল, ‘অবিনাশবাবু, আমরা নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু তার আগে আপনি একা যান। ভদ্রমহিলা প্রচুর সাহায্য করছেন বঝুঁকি নিয়েও। কিন্তু তাঁকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়াটা আমি পছন্দ করছি না। ওটা মিটিয়ে নিন।’ অবিনাশ যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘আমি মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছি?’

‘আপনি চলে যাওয়ার পরে উনি কাঁদছিলেন। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার অবশ্য আমাদের নেই। কিন্তু উনি এমন অন্যমনস্ক ছিলেন যে, আমাকে বেরিয়ে আসতে দিতেও আপত্তি করেননি। আমাদের একটা ভাল জায়গা আমরা হারাতে চাই না।’ নির্মলের কথা শেষ হওয়ামাত্র অবিনাশ হনহনিয়ে উঠে গেলেন।

কানাই জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কেমন আছ নিৰ্মল?’

‘চমৎকার। এই প্রথম মনে হচ্ছে বেঁচে আছি। এটা আমার প্রথম উপলব্ধি।’

‘এরপরে কোন উপলব্ধি আছে নাকি?’

‘নিশ্চয়ই। ব্যক্তিগতভাবে কে কেমন আছে, তা জানার বা জানাবার সময় এটা নয়।’

কানাই আবার হোঁচট খেল। নির্মলের কথাবার্তা এমন পাল্টে গেল কি করে, এত ব্যক্তিত্ব ও পেল কোথায়! সে সঙ্গীদের সঙ্গে ওব আলাপ করিয়ে দিল, ‘উত্তরবাংলার বালুরঘাটের সুদীপ মণ্ডল, মেদিনীপুরের অনিল চক্রবর্তী আর কলকাতার লাবণ্য মিত্র। এর কথা বলেছিলাম, নির্মল। প্রত্যেকে হাত মেলালো। নাম শুনে ভ্রু কুঁচকেছিল, হাত মেলাতে স্পষ্ট হল। প্যান্ট সার্ট পরা ছেলেদের মত চুল ছাঁটা তৃতীয়জন মহিলা। এইসময় অবিনাশ নেমে এলেন ওপর থেকে, ‘আসুন’।

ওরা আর কথা না বলে ওপরে উঠে আসতেই মহিলাকে দেখতে পেল। ওদের বসতে বললেন তিনি। নির্মল লক্ষ করল ইতিমধ্যেই তাঁর মুখচোখ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। অবিনাশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কি চা খাবেন?’

কানাই বলল, ‘চা চলতে পারে। কিন্তু দিদি, আপনি যদি কয়েকটা রুটি আর একটা ভাজা করে দেন তাহলে বেশি খুশি হব।’ মহিলা হেসে ভেতরে চলে গেলেন।

নির্মল তখন বাকি তিনজনকে দেখছিল। অনিলবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছে। সুদীপ তিরিশ ছুঁয়েছে নিশ্চয়ই। আর লাবণ্য কি কলেজে পড়ে? মুখচোখে রুক্ষতা ছড়ানো। চট করে মেয়ে বলে বোঝা মুশকিল। গায়ের ফরসা চামড়ায় সামান্য ছায়া লেগেছে। কানাই বলল, ‘নির্মল, তিনকড়ি রায় মারা গেছেন।’

নির্মল চমকে উঠল। কিন্তু দ্রুত সামলে নিল সে। বলল, ‘ও।’

কানাই সেটা লক্ষ করল। সে বলল, ‘সকালে থিয়েটার রোডের কাছে একটা গলির ভেতর জেনেশুনে ট্যাক্সি চাপা দিয়েছে তাকে। অবশ্য বলা হয়েছে, এটা অ্যাক্সিডেন্ট।’

‘জেনেশুনে বলছ কেন?’ নির্মল জিজ্ঞাসা করল।

‘তুমি ইন্টারেস্টেড হবে ভেবে আমি একটি ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। সে লোকাল লোকের কাছে শুনেছে ট্যাক্সিটা গলিতে ঢুকেছিল ওঁকে মারতেই। অথচ কেন, ঘটনাটাকে অ্যাক্সিডেন্ট বলে চালানো হল জানি না।’

‘এটা কি জানতে চাওয়ার মত বিষয়? আমাদের কোন কাজে লাগবে?’

‘সরাসরি নয়। পুলিশকে না জানিয়ে প্রথমে তোমাকে পরে আমাকে খুঁজে বের করতে তোমার বাবার অনুচররা সমস্ত পরিচিত জায়গা চষে বেড়াচ্ছে। তিনকড়িবাবু তোমার দায়িত্বে ছিলেন। জানি না সেই কারণে এই অ্যাক্সিডেন্ট ঘটল কিনা।’

নির্মল হাসল, ‘কানাই, যে জীবন এবং মানুষদের আমি ফেলে এসেছি তাদের সম্পর্কে আমি লিস্ট ইন্টারেস্টেড! তোমরা কাজের কথা আরম্ভ কর।’

‘কিন্তু সন্ধান পেলে ওরা তোমাকে আশ্রমে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।’

‘আশ্চর্য! আমি বাচ্চা ছেলে নই। একুশ বছর পেরিয়েছি। আমি ঠিক করেছি এইভাবে লুকিয়ে থাকব না। তোমাকে তো বললাম, ইঁদুরের জীবন আর ভাল লাগছে না।’ বেশ উত্তেজিত গলায় বলল নির্মল।

এবার অনিল চক্রবর্তী কথা বললেন, ‘নির্মলবাবু, ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক কিন্তু এটা তো সত্যি ঘটনা, এদেশের খুব প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলগুলোও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কৃপা প্রার্থনা করে। আমি আপনার পরিচয় জেনেছি। ইচ্ছে এবং ধৈর্য থাকলে আপনি আপনার পিতৃদেব প্রতিষ্ঠিত ওই বিশাল সাম্রাজ্যের প্রধান সিংহাসনে বসতে পারতেন। কিন্তু আপনি সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন আদর্শের তাগিদে। আমরা যে সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি, তাকে বাস্তবায়িত করতে হলে লড়তে হবে ধর্ম এবং রাজনীতির বিরুদ্ধে।’

এইখানে তাঁকে থামিয়ে দিল লাবণ্য, ‘কথাটা ঠিক বলা হল না। ধৰ্ম বা রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য নেই। আমাদের লড়াই ভ্রষ্ট ধর্মগুরু অথবা স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধেই। জানি, কোন গুরুই নিজেকে ভ্ৰষ্ট বলে চিন্তা করতে পারেন না।’

অবিনাশ বললেন, ‘সে বিচার করবে কে? একজন ভক্ত যদি তাঁর গুরুকে ভগবান মনে করেন তাহলে আমরা কিভাবে তাঁকে বোঝাবো, তিনি তা নন।’

‘খুব সহজেই।’ নির্মল বলল, ‘কারণ কোন মানুষ ভগবান হতে পারে না।’ সুদীপ মণ্ডল বলল, ‘কিন্তু আপনার পিতৃদেব শুনেছি অলৌকিক কাজের মাধ্যমে অনেক শিষ্য পেয়েছেন। তাঁর সেইসব অলৌকিক ক্রিয়ার কোন ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষ না পেয়ে অন্ধভাবে তাঁকে অনুসরণ করেছে। এর কারণ কি?’

নির্মল মাথা নাড়ল, ‘আমি জানি না। তবে একথা ঠিক কোটি কোটি মানুষের চেয়ে নিশ্চয়ই তিনি আলাদা। কোটি কোটি মানুষ যা করতে পারেনি তিনি তা পেরেছেন। এই পারাটা নিশ্চয়ই একদিনে হয়নি। দীর্ঘদিনের যোগাভ্যাস ওঁকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। বাবার কিছু অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডের পরিচয় আমিও পেয়েছি। পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে হলে মানুষকে তো কিছু ক্ষমতার পরিচয় দিতেই হয়।’

এরপর আলোচনা ক্রমশ রাজনীতিতে ফিরল। ওপর ওপর রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে জনসাধারণের ওপর কিছু চাপিয়ে দিলে সেটা ঝেড়ে ফেলতে তাদের সময় লাগবে না। হয়তো কিছুদিন সেই চাপে ওরা নুয়ে থাকবে মাত্র। এই ঘটনা বারংবার এদেশে ঘটেছে। পরিস্থিতি যা, তাতে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা চিন্তাও করা যায় না। ধর্মের দোহাই দিয়ে একধরনের গোঁড়া সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করে সমস্ত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অস্ত্র ধরানো যায় অথবা বঞ্চিত জাতির কথা বলে একটি বিশেষ ভাষাভাষীকে উত্তেজিত করে গেরিলা যুদ্ধের পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিন্তু সেইসময় যুদ্ধ নেহাতই অন্ধ ভাবাবেগের পথেই পরিচালিত হয়ে থাকে। ভিন্দ্রেওয়ালরা বা ঘিসিংদের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কোন লক্ষ্যে সেটা পৌঁছায় না। দল চায় না সেই পথে গিয়ে জনসাধারণকে আরও বিভ্রান্ত, আরও সর্বনাশের পথে ঠেলে দিতে। জনসাধারণের আস্থা অর্জন করে, তাঁদের একত্রিত করার চেষ্টা করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তাঁদের জন্যে কাজ করার পরিকল্পনা ফলপ্রসূ করতে হবে। এর জন্যে যে সময় লাগে লাগুক। পশ্চিমবাংলার নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে এখন থেকেই ছড়িয়ে পড়তে হবে। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার অর্জনের জন্যে এলাকাভিত্তিক আন্দোলন শুরু করতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য এবং আস্থাভাজন কমরেড নির্বাচিত করতে হবে প্রতিটি কেন্দ্রের জন্যে। তাঁরা একশজন সহকর্মী নিয়ে এখনই কাজে নেমে পড়বেন। নির্বাচন লক্ষ্য থাকবে না আপাতত, দলের প্রচারও নয়, কাজের মাধ্যমে সে এলাকার মানুষের আপনজন হতেই হবে। মানুষ এখনও ভালবাসার মানুষকে কিছু মূল্য দেয়। নইলে নির্দল প্রার্থীরা নির্বাচিত হত না। একথা ঠিক, শুধু রাজ্যের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা দখল করলেই জনসাধারণের জীবনযাত্রা পাল্টে দেওয়া যাবে না। কিন্তু সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেও কাজ করে কিছুটা দুর্গতি লাঘব করা সম্ভব হবেই। অবশ্য নির্বাচনে নামার আগে বামপন্থীদল একথাই বলেছিল। দুর্গতি লাঘবের বদলে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করলে জনসাধারণ নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ভিত যদি হয় পরিবাবে পরিবারে তাহলে পশ্চিমবাংলার মানুষ জানবে এরা ঘরের লোক। যে কোন কাজে সঙ্গী পেতে তাই অসুবিধে হবে না। কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে কিছু প্রস্তাব পেশ করার খসড়া করা হল। এই জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সুবিধে হল পার্টিকে আত্মগোপন করে কাজ করতে হচ্ছে না। পুলিশের তাড়া খাওয়ার কোন ভয় নেই। আন্দোলন অস্ত্র বিনা ব্যাপক অর্থে? প্রায় প্রতিটি বাড়ির অন্দরমহল থেকে শুরু করতে হবে। এ ব্যাপারে এলাকার ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে। রাত দুটোর সময় আলোচনা শেষ হল। এত রাত্রে এখান থেকে বের হওয়া উচিত হবে না। রুটি তরকারি খেয়ে ওরা যে যার মত পড়ে রইল। নির্মল নিজের ঘরে যাওয়ার সময় অস্বস্তি বোধ করছিল। লাবণ্য চেয়ারে শরীর এলিয়ে পা তুলে দিয়েছে মোড়ার ওপর। তার ঘরে তক্তাপোষ রয়েছে। ওখানে লাবণ্যকে শুতে বলা যায়। এইসময় মহিলা চাপা গলায় তাকে ডাকলেন। ঘন্টা তিনেক আগে খাবার দিয়ে তিনি নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। নিৰ্মল কাছে এগিয়ে যেতেই বুঝলেন ওঁর ঘুম এখনও চোখ ছেড়ে যায়নি। মহিলা বললেন, ‘খাটটা, ঘরটা আমি তোমাকে দিয়েছি থাকার জন্যে। কাউকে দাতব্য করার অধিকার কিন্তু দিইনি। যাও, শুয়ে পড়।’

বড় এবং মেজ মহারাজ বাবার বাম দিকে বসে আছেন। ডান দিকে নয়জন মহারাজ অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গীতে অপেক্ষা করছেন বাবার আদেশের জন্যে। বাবার চোখ বন্ধ। বেশ কিছুক্ষণ তিনি ওই অবস্থায় রয়েছেন। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন তিনি, ‘তিনু তার যাবতীয় বিষয়চিত্তা সত্ত্বেও নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে। ওর শরীর আর আমাদের মধ্যে নেই। আশ্ৰম একজন একনিষ্ট কর্মীকে হারাল। ওর কাজের দায়িত্ব অন্য একজনকে দেওয়া প্রয়োজন। কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট বরদাচরণ সেনগুপ্তকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করে বড় তুমি যোগাযোগ কর।’

বড় মহারাজ নীরবে মাথা নাড়লেন।

‘তোমরা নিশ্চয়ই জানো হিন্দুধর্ম বিনাশের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। পৃথিবীতে সব যুগেই কলঙ্ক লেপন করা প্রচলিত রীতি। এ-নিয়ে আমি চিন্তা করি না। কিন্তু সনাতননাথ আর আনন্দ সরস্বতী শুধু বদনাম দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, আমাকে আঘাত করার কাজেও নেমেছে। একজন ম্যাজিসিয়ান আমাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি নাকি অলৌকিক কাণ্ড করবেন। আমি ম্যাজিক জানি না। আমার শিষ্যরা যে অলৌকিক অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছে তা তাবা নিজেদের ভাগ্যেই অর্জন করেছে। আমি নিমিত্ত মাত্র। কিন্তু আমি আশঙ্কা করছি তিনুকে যারা সরিয়ে ফেলল তারাই ছোটেকে সরিয়েছে কিনা! এতদিন হয়ে গেল কেউ ছোটের খবর পেল না, এ হতে পারে না! এ ব্যাপারে তোমাদের কোন বক্তব্য আছে?’

বড় মহারাজ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হাত তুলে তাকে থামালেন বাবা। নয় মহারাজের উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরাই আমার দক্ষিণ-হস্ত। তোমরা কিছু বল?’

মহারাজরা উশখুশ করছিলেন। শেষপর্যন্ত একজন বললেন, ‘বাবা, আপনি ছাড়া জগতে আমাদের কেউ নেই। আপনার সম্মান রক্ষার জন্যে আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিতে পারি। ছোটে মহারাজের কোন ক্ষতি করলে আমরা চুপ করে বসে থাকব না।’

বাবা মাথা নাড়লেন, ‘ধর্মযুদ্ধ। ধর্মযুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু যাদের কিছু হারাবার ভয় নেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাভ নেই। যার কিছু নেই তার কোন ক্ষতি হবে না কিন্তু আমাদের সামান্য ক্ষতি অনেক বড় হয়ে উঠবে। অতএব মুখোমুখি সংঘর্ষে নয়। ওদের ফেলতে হবে বোকামির ফাঁদে। তা দেখে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে ওদের চরিত্র। তিনুর আত্মা নিজের জায়গা খুঁজে পেলেও শান্তি পাবে না যদি না একটা বিহিত হয়। কিন্তু তোমরা কখনই প্ররোচনাতেও উত্তেজিত হবে না। এটা আমার আদেশ।’ বাবা থামলেন, ‘আমার শরীরের বয়স হচ্ছে। ছোটের জন্য মন চঞ্চল। আমি বিশ্বাস করি ছোটের মধ্যে যে শক্তি আছে তা তাকে সবসময় রক্ষা করবে। কেউ ওকে ধ্বংস করতে পারবে না। কিন্তু যদি শোন, আমি নেই, যদি হঠাৎ ইচ্ছে হয় এই জীর্ণদেহ ত্যাগ করতে, তাহলে আমার বাণী, আমার সাধনা, আমার কর্ম বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমাদের ওপর। কিন্তু তার আগে ছোটেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমি তাকে দীক্ষিত করে যেতে চাই।’

সঙ্গে সঙ্গে মেজ মহারাজ প্রায় ককিয়ে উঠলেন, ‘বাবা, এমন কথা বলবেন না। আপনাকে ছাড়া আমরা কিছু ভাবতেই পারি না।’

‘তুমি ভাবপ্রবণ। বড় আত্মমুখী। তোমাদের দুজনকেই এই কুবোধ ত্যাগ করতে হবে। পৃথিবীতে যখন কেউ জন্মায় তখনই তার মৃত্যু নির্দিষ্ট হয়। কর্মের দ্বারা, আচরণের দ্বারা মানুষ সেই মৃত্যুর আবির্ভাবকে বিলম্বিত করতে পারে মাত্র। তোমাদের অনেকবার বলেছি শরীরের মৃত্যু মানেই অস্তিত্বের মৃত্যু নয়। আমাকে যদি তোমরা সঠিক অনুসরণ কর, তাহলেই দেখবে আমি তোমাদের মধ্যে বেঁচে আছি। না, না। আমি এখনই দেহত্যাগ করছি না। শুধু তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তেমন সময় এলে স্থির থেকো। ছোটের জন্যে আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।’

বাবা নীরব হতেই নয় মহারাজের একজন বিনীত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছোটে মহারাজ দীক্ষিত হলে তাঁর স্থান কোন স্তরে থাকবে?’

বড় মহারাজ বললেন, ‘তার নামেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। কনিষ্ঠতম মহারাজ হবে সে।’

বাবা হাসলেন, ‘সবকিছুর সমাধান যদি এত সরলভাবে হত, বড়, তাহলে কি ভালই না হত। না, ওই প্রশ্নের জবাব দেবে সময়। তোমাদের তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি বরদাচরণ সেনগুপ্তকে লিখে দাও, ব্যারিস্টার জে সি ঘোষকে নিয়ে অবিলম্বে আমার সঙ্গে দেখা করতে। এ ব্যাপারে যা কিছু আমি কাগজপত্রে লিখে রাখতে চাই। আর হ্যাঁ, ধ্যানেশ-এর কোন খবর জানো?’

মেজ মহারাজ জবাব দিলেন, ‘ইউনিসের মাধ্যমে ধ্যানেশকে জানানো হয়েছে যে, সে যদি আপনার নামগান করতে চায় তাহলে স্বচ্ছন্দে তা করতে পারে। এতে সে আনন্দিত হয়েছে। আগামীকাল থেকে সম্ভবত সে রাজপথে গান শুরু করবে।’

‘ভাল। কর্মের দাবাই মানুষ প্রায়শ্চিত্ত করে। আগামীকাল কেন্দ্রীয়মন্ত্রী পশিচমবাংলায় আসছে। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। কিন্তু আমি আশ্রমে কোন পুলিশ অথবা কম্যান্ডোকে প্রবেশ করতে দিতে চাই না। তোমরা সবাই এই ব্যাপারটি ভাল ভাবে দেখবে। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীকে কিছু বলার আছে?’

বড় মহারাজ এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। তাঁর মুখে মলিন ছায়া মাখামাখি। তা সত্ত্বেও তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘আশ্রমে একটি মিনি এয়ারপোর্ট—।’

‘না। ওটা এখন নয়। মনে রেখ শত্রুরা যখন আক্রমণ করে তখন সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের বড় করে দেখাতে নেই। যেদেশের মানুষ কেউ গাড়িতে চড়ে গেলে ঈর্ষাকাতর হয় সেদেশে ব্যক্তিগত এয়ারপোর্ট করার চেষ্টাকে কি চোখে দেখা হবে বুঝতে পারার মত বাস্তবজ্ঞান তোমার হওয়া উচিত। শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিয়ে সময়ের জন্যে অপেক্ষা কর।’

.

বাড়ির সামনে সামিয়ানা টাঙানো। শতাধিক অনুরাগীকে নিয়ে খোল-করতাল সহযোগে ধ্যানেশকুমার বাবার নামগান করছেন আজ সকাল থেকে। ভক্তি ভক্তদের টানে। বেলা যত বাড়ছে তত ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে। তারস্বর চিৎকারে আশেপাশের বাড়ির মানুষেরা ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠল। যদিও বাবার নামগান চলছে তবু ভক্ত ধ্যানেশের বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না সে-ই এই জনতার প্রধান আকর্ষণ। বাবার বিশাল ছবিটিতে মালা পরিয়ে গান চলছিল।

ধ্যানেশের বাড়ির কাছাকাছি আছেন এক জাঁদরেল উকিল যিনি সনাতননাথের অনুগত শিষ্য। খবরটা সেই সূত্রে পৌঁছল সনাতননাথের আশ্রমে। ঘনবসতি অঞ্চলে চিৎকার করে শান্তিভঙ্গ হচ্ছে এই অভিযোগ স্বচ্ছন্দেই তোলা যায়। সেই মর্মে লোকাল থানায় একটি ডায়েরি করা হল। থানার অফিসার ঘটনাস্থলে ঘুরে গেলেন কিন্তু নামগানের উন্মাদনা দেখে কোন ব্যবস্থা নিলেন না। আশ্রম থেকে বিতাড়িত হওয়া সত্ত্বেও ধ্যানেশকুমার নামগান করছেন এই খবর যত রটতে লাগল তত ভিড় বাড়তে লাগল। ধ্যানেশ ঘোষণা করল এই নামগান চলবে বাহাত্তর ঘন্টা ধরে। ভিড়ের জন্যে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। সনাতননাথের একজন শিষ্য এই অঞ্চলের পুলিশের বড় কর্তা। তিনি এসে হুকুম করলেন, ‘জনসাধারণের যাতায়াতের পথ এইভাবে বন্ধ করা বেআইনি কাজ। রাস্তা খালি না করে দিলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’

আজ যারা ধ্যানেশের সঙ্গে নামগান তদবকি করছিলেন, তাঁদের অনেককেই সে আগে দ্যাখেনি। বস্তুত আশ্রমের কর্মীদের সে ডাকেনি সংস্রব নষ্ট করতে বলায়। যাঁরা তদারকি করছিলেন তাঁরা খুবই দক্ষ বলে মনে হচ্ছিল তার। তাঁদের একজন ঘর্মাক্ত মুখে ধ্যানেশের সামনে এসে বলল, ‘রাস্তাটা যেন ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। এমন ভিড় বাড়ছে যে, এর পরে সামলানো যাবে না!’

‘তাহলে কি করা যায়?’

‘এসবই হচ্ছে আপনার জন্যে। আপনাব ইমেজ বাড়াবার দারুণ সুযোগ এটা। নামগান এই ছোট্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ না রেখে সমস্ত কলকাতায় ছড়িয়ে দিন।’ লোকটা পরামর্শ দিল।

‘কিভাবে?’ ধ্যানেশ উৎসাহিত বোধ করল।

‘ভক্তদের নিয়ে মিছিল বের করুন। গান গাইতে গাইতে আমরা শহর পরিভ্রমণ করব। এতে আরও লোক যোগ দেবে। সবাই বুঝবে আপনি বাবার শ্রেষ্ঠ ভক্ত।’

ব্যাপারটা মনে ধরল ধ্যানেশের। এবং সেইমত ঘোষণা করা হল। যদিও বিখ্যাত হবাব পর আজকাল আর হাঁটাহাঁটির অভ্যেস নেই তবু, সে থেমে গেল না। কিন্তু উদ্যোক্তাটি পরামর্শ দিল এই ভিড়ে সবার মাথা ছাড়িযে ধ্যানেশকে যদি জনসাধারণ দেখতে না পায় তাহলে সুযোগটাই বৃথা যাবে। ধ্যানেশের একটা হুডখোলা মারুতি জিপসি ছিল। তাকে জিপে তোলা হল মাইক সহ। সেই জিপ নিয়ে মিছিল শুরু হল। পেছনে হাজার দুয়েক ভক্ত নামগান করছে। ক্রমশ একটা কিছু করার উন্মাদনা ধ্যানেশের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। তার গলা ভারী হয়ে গেলেও সে প্রাণপণে গান গেয়ে যাচ্ছিল। খোল করতাল বাজছে সমানে। পেছনে ট্রাম-বাস এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। সেই উদ্যোক্তাটি ধ্যানেশের জিপে দাঁড়িয়ে মিছিল পরিচালনা করছিল। এক ফাঁকে সে বলল, ‘দেখছেন, মানুষের সংখ্যা কেমন হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এরা যত আসছে তত আপনি বাবার কাছে নতুন করে চলে যাচ্ছেন। আর বাবা যদি বোকামি করে আপনাকে গ্রহণ নাও করেন তাহলে আপনি নিজেই এদের নিয়ে একটা সম্প্রদায় খুলতে পারবেন।’

হাসতে গিয়েও পারল না ধ্যানেশ। লোকটা বলে কি? বাবাকে অস্বীকার করে সে সম্প্রদায় চালাবে? ধ্যানেশবাবা? দূর! তা কি সম্ভব? এত লোক তাকে চাইছে নাকি? ব্যাপারটা ভাবতেই সাহস পাচ্ছিল না সে। লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল সে, ‘আপনি কে?’

‘আমি?’ লোকটা বিনয়ে গলে গেল যেন, ‘ধ্যানেশকুমার ফ্যানক্লাবের সেক্রেটারি।

চোখ বড় হয়ে গেল ধ্যানেশের, ‘আমার ফ্যানদের আবার ক্লাব হয়েছে নাকি?’

‘হয়েছে। আপনি এত ওপর তলায় থাকেন যে খবর রাখেন না। এবার কোন দিক দিয়ে যাব?’

‘যেদিক দিয়ে ইচ্ছে। নামগান ছড়িয়ে দেব সারা কলকাতায়।’

‘স্যার, আপনি এককালে রাইটার্সে চাকরি করতেন। সেদিকেই বরং চলি।’

ঘাড় কাত করে চলন্ত জিপে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে সম্মতি দিল ধ্যানেশ। এককালে সে রাইটার্সে কেরানির চাকরি করত, কেউ পাত্তা দিত না। আজ একটু নামগান শুনিয়ে আসা যাক। শ্রীচৈতন্যও নবাবের বাড়িতে নামগান শোনাতে গিয়েছিলেন। মিছিল যাচ্ছে রাজভবনের দিকে। প্রবল চিৎকার উঠছে। হঠাৎ কেউ চিৎকার করে উঠল, ‘পুলিশ।’ ধ্যানেশ দেখল সামনে পুলিশের একটা বিশাল বাহিনী কর্ডন করে আছে। মিছিল সামান্য থমকে দাঁড়াতেই একজন অফিসার মাইকে ঘোষণা করলেন, ‘এই এলাকায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা আছে। আপনারা একেই বেআইনি মিছিল বের করেছেন, পুলিশের অনুমতি নেননি। এর পরে আর এগোলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মিছিলের মানুষেরা দ্বিধায় পড়ল। ধ্যানেশ তাকিয়ে দেখল সেই উদ্যোক্তাটি কাছে-পিঠে নেই। কিন্তু এখন এই অবস্থায় পিছু হটা মানে তার নতুন তৈরি ইমেজ ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া। সে মাইকে চিৎকার করে বলল, ‘এই পৃথিবী ঈশ্বরের সৃষ্টি। বাবার লীলাভূমি। আমরা বাবার নামগান করছি। তাই কোন অশুভশক্তি আমাদের বাধা দিতে পারে না। বলুন সবাই, জয় বাবা।’

হাজার কণ্ঠ চিৎকার করল, ‘জয় বাবা।’

মিছিল এগোল। পুলিশ দ্বিতীয়বার ওয়ার্নিং দিল। এবং তারপর মুখোমুখি হতেই ওরা লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিছিলের ওপর। কিছু লোক ভয়ে পালাচ্ছিল। ধ্যানেশ চিৎকার করল মাইকে, ‘বন্ধুগণ, ধর্মের ওপর পুলিশের অত্যাচার আপনারা মুখ বুজে সইবেন না। মাথার ওপর বাবা আছেন।’ ততক্ষণ ইটবৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। চওড়া রাস্তায় জিপে ধ্যানেশ একা। এমন কি তার ড্রাইভারও নেই। পুলিশ ও জনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ধ্যানেশ লক্ষ করল জনতার ভেতরে কিছু লোক শিক্ষিত ভঙ্গিতে পুলিশকে আক্রমণ করে যাচ্ছে। একজন এ. সি মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই পুলিশ গুলি চালাল। সঙ্গে সঙ্গে একজন ভক্ত মাটিতে পড়ে যেতেই জনতা ছত্রভঙ্গ হল। ধ্যানেশ দেখল যে লোকটা মাটিতে শুয়ে পড়েছে সে আর নড়ছে না। গুলি লেগেছে তার মাথায়। দুহাতে মুখ ঢাকল সে। জলজ্যান্ত একটা মানুষ মরে গেল? ধ্যানেশ লক্ষ করেনি পুলিশের দল তার দিকে এগিয়ে আসছে। বেশ রূঢ় গলায় একজন তাকে হুকুম করল জিপ থেকে নেমে আসতে। বলা হল, ‘বেআইনি মিছিল করে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙা এবং জনতাকে সেটা করতে উত্তেজিত করার জন্যে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হল।’ দুটো পুলিশ তার দুই হাত ধরে টানতে টানতে ভ্যানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ধ্যানেশের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। পেছনে একটা অফিসার যেভাবে রিভলভার উঁচিয়ে আছে, তাতে হঠাৎ গুলি বেরিয়ে আসতেই পারে। একটার বদলে দুটো শরীর মাটিতে পড়লে কি এমন ক্ষতি হবে! কিন্তু ভ্যানের ঘেরা সিটে বসে সে দ্বিতীয় আনন্দের সন্ধান পেল। এই ঘটনা নিশ্চয়ই চাপা থাকবে না। খবরটা কাগজে ছাপা হবেই। জনপ্রিয় গায়ক ধ্যানেশকুমার গ্রেপ্তার। দেশের মানুষ তার হেনস্থার কথা জানবে। আশ্রম থেকে বিতাড়িত হওয়ায় তার ইমেজ যদি নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে এই সংবাদ সেটা দ্বিগুণ ফিরিয়ে আনবে। সে ধর্মানুষ্ঠান করতে গিয়ে, বাবার নামগান করতে গিয়ে পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হয়েছে। নিজের অসাবধানতায় যে পথ থেকে সরে গিয়েছিল আবার সে-পথে ফিরে আসতে পারল। কিন্তু সেই লোকটি কোথায়? নামগান মিছিল করে যাওয়ার জন্যে যে তাকে উৎসাহ দিয়েছিল তাকে সে অনেকক্ষণ দ্যাখেনি। গুলিছোঁড়া তো দূরের কথা, লাঠি চার্জ করার আগে থেকেই লোকটাকে দেখতে পায়নি ধ্যানেশ। কিন্তু সে যেই হোক, ধ্যানেশ তার কাছে কৃতজ্ঞ। ওর বুদ্ধি না পেলে আজ সে ভ্যানে বসে থাকার সুযোগ পেত না। বলা যায় না, সব থেমে গেলে ওরা তাকে ভ্যান থেকে নামিয়েও দিতে পারে। কথাটা মাথায় আসতেই ধ্যানেশ চিৎকার করে বলল, ‘কি হচ্ছে কি? ভ্যানটা ছাড়তে বলুন না।’

আকাশবাণী পুলিশের গুলি চালনা এবং এক ভক্তের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করল। সেইসঙ্গে বিখ্যাত গায়ক ধ্যানেশকুমার গ্রেপ্তার হয়েছেন একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে নামগান করার অপরাধে, তা সবাই জানল। পরের দিন অবস্থাটা বদলে গেল। হাজার হাজার ভক্ত জড় হতে লাগল রাজভবনের সামান্য দূরে যেখানে গুলিতে তাঁদের গুরুভাই নিহত হয়েছেন। লালবাজারের স্পেশ্যাল ফোর্স কোনক্রমে সামাল দিচ্ছিল তাদের। আজ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে কোন অবস্থায় গুলি না চালাতে। জনতা ক্ষিপ্ত। তারা দোষী পুলিশের বিচার চাইছিল। আইন ভাঙা অপরাধ হলে তার বিচার করবে আদালত। পুলিশ কেন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করবে?

সেই সন্ধ্যায় সমস্ত দেশব্যাপী বাবার শিষ্যরা সিদ্ধান্ত নিলেন বড় মহারাজের নেতৃত্বে এই ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানোর। আগামীকাস একটি শোকমিছিল বের হবে। যদিও ধ্যানেশকুমার এখন আর আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়, কিন্তু ধর্মাচরণ করতে গিয়ে একজন বাবার ভক্ত নিহত হয়েছেন যে সরকারের পুলিশের হাতে, শোক মিছিলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানানো হবে। ধ্যানেশকুমার এখন লালবাজারে বন্দী। তাকে মুক্ত করার কোনো প্রচেষ্টা দেখা গেল না।

পরদিন সকালে বাবার বক্তব্য প্রতিটি খবরের কাগজ ছাপাল। বাবা বললেন, ‘প্রশাসন যখন অশুভ শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই দেশের ঘোর দুর্দিন আসে। যুগে যুগে শাসকরা ধর্মাচরণের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে ভীত হয়ে। একশজন চাঁদ কাজী একজন নিমাইকেও শত চেষ্টা করেও কোনদিন বশ মানাতে পারে না। আমার এক ভক্তকে হত্যা করা হয়েছে কারণ সে নামগান করতে চেয়েছিল একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে। কতটা উন্মত্ত হলে সরকার ধর্মাচরণের ওপর বাধা সৃষ্টি করতে চায়, এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ। এই অবস্থায় আমি আমার আশ্রমে চুপ করে বসে থাকতে পারি না।’

‘আমি সরকারকে এই বলে সাবধান করতে চাই, এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে। আগামীকাল সমস্ত দেশব্যাপী আমার ভক্তরা শোকমিছিল বের করবেন। সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্যে তারা আমাকে অনুরোধ করেছিল কিন্তু আবেগ বাঁধ ভাঙতে পারে, এই আশঙ্কায় আমি যোগ দেব না বলে স্থির করেছি। এই সরকারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের অভিযোগ অনেক। আমি রাজনীতি বুঝি না। আমি মানবতায় বিশ্বাস করি। সেই মানবতা বিপন্ন হলে আমি চুপ করে বসে থাকতে পারি না।’

বাবা তাঁর বক্তব্যে কোথাও ধ্যানেশকুমারের নাম উল্লেখ করেননি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *