২
মাথার ভেতরে যেন কেউ গরম পেরেক ঢুকিয়ে রেখেছে, এমন যন্ত্রণা হচ্ছিল। ধ্যানেশ চোখ মেলল। চোখের সামনে কি রয়েছে বুঝতে সময় লাগল। কিন্তু মাথা পরিষ্কার হচ্ছে না কিছুতেই। এক ঝটকায় সে উঠে বসতে গিয়ে টলে উঠল। চারপাশে অন্ধকার। দূরে দূরে আলো জ্বলছে। সে বসে আছে ঘাসে। ধ্যানেশ চোখ বন্ধ করল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। নিকট অতীতের কোন ঘটনাই মনে পড়ছে না তার। এই বিশাল মাঠ, ওই দূরের আলো ঠিক কোন জায়গার, তা বুঝে উঠতে সময় লাগল। কয়েক পা টলোমলো পায়ে হাঁটার পর সে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারল। কবজি চোখের কাছে এনে বুঝল এখন রাত দুটো। আর সে দাঁড়িয়ে আছে গড়ের মাঠের মাঝখানে। তার গাড়ি? ধ্যানেশ চারপাশে ঘুরে কোথাও গাড়ি দেখতে পেল না। সে এখানে এল কি করে? খুব বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। এবং তাপরেই বাবার শ্রীমুখ মনে ভেসে উঠলো। সে প্রাণপণে বাবাকে ডাকতে লাগল। পৃথিবীর অন্যসব কিছু বিস্মৃত হয়ে ওই একটি মুখ যেন সে হৃদয় দিয়ে আঁকড়ে ধরল। কতক্ষণ এই অবস্থায গিয়েছে খেয়াল নেই, হঠাৎ তার মুখে টর্চের আলো পড়ল। ধ্যানেশ কম্পিত গলায় বলল, ‘বাবা!’
একটি শক্ত হাত তার কনুই ধরল। তারপর প্রায় টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে চলল আলোর দিকে। ধ্যানেশ অত্যন্ত তৃপ্ত মনে বলে যাচ্ছিল, ‘বাবা, বাবা।’ একটা লম্বা ভ্যানের ভেতর প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে দিযে লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল, ‘চল, শালা, বাপকে দেখবি।’ হাতে এবং হাঁটুতে আঘাত লাগল ধ্যানেশের। সে দেখল ভ্যানটা চলছে। ভ্যানের পেছনে আরও দুজন শক্ত চেহারার সাদা পোশাকের মানুষ। এপাশে তিনটে শাড়ি পরা মেয়েছেলে। একজন বলে উঠল, ‘মাঝরাতে বুড়ো খোকার বাই উঠেছে দ্যাখো!’
ধ্যানেশ ভ্যানের অন্ধকারে মুখগুলো দেখতে পেল না। সে কাতর গলায় বলে উঠল, ‘আপনারা কে জানি না, কিন্তু আমি ধ্যানেশ্বকুমার, গান গাই!’
সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। একজন বলল, ‘তালে আমি হেমামালিনী।’ দরজার কাছে বসা দুজন শক্ত চেহারার একজন ধমকে উঠল, ‘অ্যাই, চোপ!’
কোন কথা না বলে ওরা লক আপে পুরে দিচ্ছিল ধ্যানেশকে। সে শেষবার মরীয়া হয়ে চিৎকার করতেই কনস্টেবল এমন একটা লাঠির ঘা মারল যে মাটিতে পড়ে যেতে হল। রাত দুপুরে থানার অফিসাররা এদিকে তাকালেন না। ধ্যানেশকে লক আপে পুরে কনস্টেবল বলল, ‘নতুন ফ্যাসান হয়েছে। মাল না খেয়ে ড্রাগ খাওয়া।’ তারপর চিৎকার করে জানাল, ‘মেজবাবু, একটা ড্রাগের পার্টি এসেছে।’
মেজবাবু বললেন, ‘সুখ করে নে। ড্রাগে ধরলে আর বাবার বাবাও ছাড়াতে পারবে না। মেজবাবুর সামনে যে লোকটি বসেছিল, তার পরনে সাফারি স্যুট, গায়ের রঙ কালো। মেজবাবু তাকে এবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপারটি কি বলুন তো? কোথাকার কোন বাবার কে হারিয়ে গিয়েছে তাই নিয়ে পুরো শহর তোলপাড় করছেন। বিকেল থেকে তিনচারবার টেলিফোন হয়েছে শুনলাম। আপনার আগে দুজন এসেছিল। রাত কত হল খেয়াল আছে?’ লোকটি হিন্দী বাংলায় মিশিয়ে বলল, ‘বস বলেছে খুঁজতে, খুঁজে যাচ্ছি। বলেছিল সিক্রেট রাখতে, মনে হয় থাকবে না! কলকাতা শহর অনেক বড়। আমরা ধর্মতলার আশেপাশে থানাগুলোয় খোঁজ করছি। তাহলে কুড়ি একুশ বছরের কাউকে আপনারা পাননি?’
‘না। লোকটা, আই মিন ছেলেটা, কোন বাবার চেলা?’
‘বলা নিষেধ অফিসার। তবে শুনেছি ড্রাগ খাওয়া ধরেছিল। ‘বাঃ। কিন্তু ইউনিস সাহেব কাউন্সিলব। তিনি মুসলমান। বাবা তো হিন্দু, তাই না?’
‘আমি কিছুই জানি না। শুধু জানি, বস যা বলবে তাই শুনতে হবে।’ লোকটা উঠে দাঁড়াল। একজন সার্জেন্ট এসে বললেন, ‘মেয়ে তিনটের একটা লাইনে নতুন। ‘
মেজবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত রাত্রে কোন খদ্দেরের জন্য ঘুরছিল?’
সার্জেন্ট বললেন, ‘রোজগার হয়নি বলে রাতের ঠিক ছিল না।’
‘ওই লোকটাও কি ওদের সঙ্গে ছিল?’
‘না। মুখ দেখিনি আমি। তবে একাই ছিল।’
‘বয়স কত, কুড়ি- একুশ নাকি?’
সার্জেন্ট চিৎকার করে কনস্টেবলকে ডাকলেন। লোকটা দরজায় দাঁড়াতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যে ছোকরা ড্রাগ খেয়েছে তার বয়স কত?’
‘এটা বলা মুশকিল।’
‘নিয়ে এস।’
মেজবাবুর সামনে বসা লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু কৌতূহলে আবার বসে পড়ল। একটু বাদে কনস্টেবল ধ্যানেশকে টেনে হিচড়ে ঘরে এনে মাটিতে বসিয়ে দিল। সার্জেন্ট বলে উঠলেন, ‘কুডি-একুশের বাপ মনে হচ্ছে। ড্রাগ খাওয়ার পক্ষে বয়সটা বেশি, তাই না? কিন্তু ড্রাগ খেয়েছে বুঝলি কি করে?’ বলে এগিয়ে গিয়ে বাঁ হাতে চিবুকটা জোর করে ভুলতেই চিৎকার ছিটকে বের হল গলা থেকে, ‘আরে! এ তো ধ্যানেশকুমার!’
মেজবাবু এতক্ষণ নির্লিপ্ত হয়ে বসেছিলেন, এবার তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠলেন, ‘সেকি! তুমি সিওর? ধ্যানেশের মুখে তখন রক্ত। চুল বিস্রস্ত। কথা বলতে চেষ্টা করেও পারল না। মেজবাবু ততক্ষণে চিনতে পেরেছেন, ‘মুখে রক্ত এল কি করে?’
কনস্টেবল বলল, ‘আপনি তো বললেন সুখ করে নিতে।’
‘সর্বনাশ। ইন্ডিয়া—ফেমাস সিঙ্গারের ওপর হাতের সুখ করেছ তুমি! পুলিশে চাকরি কর বলে কি সংস্কৃতি ব্যাপারটা ভুলে যেতে হবে? কি করা যায় বল তো সামন্ত?’ মেজবাবুর গলার স্বরে নার্ভাসনেস এখন স্পষ্ট। সার্জেন্ট বললেন, ‘এখন আমরা ছাড়লেও উনি ছাড়বেন না। ড্রাগ পরে প্রমাণ করতে পারব না। চোলাই খাইয়ে গায়ে ঢেলে হসপিটালাইজড্ করে দিই। সেশন করে পাবলিক প্লেসে মারপিট করেছেন বলে একটা কেস স্টার্ট করা যাক।’ এইসময় মেজবাবুর উল্টোদিকে বসা লোকটি বলল, ‘আপনার টেলিফোনটা ইউজ করতে পারবো?’
মেজবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? কাকে করবেন?’
‘বসকে।’ বলতে বলতে লোকটি রিসিভার তুলে ডায়াল করতে শুরু করেছে।
মেজবাবু বললেন, ‘এব্যাপারে কিছু না তো?’
ততক্ষণে লোকটা কথা বলতে শুরু করেছে, ‘বস, মায় বসির বোল রহা হুঁ। হ্যাঁ। এক নম্বরকো নেহি মিলা। বাকি দো নম্বব আভি থানামে হ্যায়। জী একদম সাচ্চা, ইন্ডিয়া ফেমাস সিঙ্গার ধ্যানেশকুমাব। আপ আ রহে? ঠিক হ্যায়।’ টেলিফোন বেখে বসিব আলি বলল, ‘বস আসছে, তার আগে হসপিটালাইজড্ করবেন না।’
সার্জেন্ট আর মেজবাবু চোখাচোখি করলেন। মেজবাবু বললেন, ‘ইন্টারেস্টিং। আপনি সকাল থেকে খোঁজ নিচ্ছেন কুড়ি-একুশ বয়সের ছেলের। হঠাৎ এই লোকটাকে দরকার হল কেন?’
বসির আলি বলল, ‘বস আসুন, তিনিই বলবেন।’
ইউনিস পৌঁছে গেল যখন তখন ধ্যানেশের চেতনা স্বচ্ছ, শবীবের বেদনা প্রবল। কাছে গিয়ে ভাল করে দেখে ইউনিস মেজবাবুকে বলল, ‘ওঁকে নিয়ে যাচ্ছি।’
মেজবাবু বললেন, ‘সরি মিস্টার ইউনিস। ওকে ছাড়তে পারছি না।’
ইউনিস শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
মেজবাবু বললেন, ‘উনি নেশা করে মারামারি করেছেন। তা ওঁকে হসপিটালাইজড় করতে হবে। ডেফিনিট কেস আছে। মিস্টাব আলির জন্যে।’
ওঁকে থামিয়ে ইউনিস বলল, ‘ঠিক আছে, কিন্তু আমি বলছি ওঁকে ছেড়ে দিন।’
‘অসম্ভব। এখন আর পারব না।’ মেজবাবু মাথা নাড়লেন।
বসির আলি বলে উঠল, ‘বস, উনলোগ ফলস্ কেসকো প্ল্যান কিয়া।’
ইউনিস বলল, ‘ঠিক হ্যায় বসির। অফিসার, একটা ফোন করতে পারি?’ একটু ইতস্তত করে মেজবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে করুন।’
ইউনিস টেলিফোন তুলে ডায়াল করল। বেশ কিছুটা সময় বাজার পর সে কথা বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার। আমি ইউনিস বলছি। এত রাতে ফোন করছি বলে কিছু মনে নেবেন না। বাত শেষ হয়ে আসছে বলেই তো গুড মর্নিং বললাম। বড়ে মহারাজ আমাকে একটা কাজ দিয়েছিলেন। একজনকে খুঁজে বের করা। নাম নাই শুনলেন। না-না, শীরফ আদমি। কোন ঝামেলা হবে না। ও আছে এই থানায়। মনে হয় কেউ ফালতু কেস সাজিয়েছে। তা মেজবাবু বলছেন ছাড়া যাবে না। কথাটা বড় মহারাজকে ব্লতেই হবে। তার আগে ভাবলাম আপনার সঙ্গে কথা বলে নিই। আপনার ডিপার্টমেন্ট।’ ওপাশ থেকে সংলাপ শুনে ইউনিস ইশারায় মেজবাবুকে ডেকে রিসিভার দিলেন। ‘হ্যালো’ বলেই মেজবাবু এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে ‘না স্যার, না স্যার’ বলতে শুরু করলেন। তারপর রিসিভার রেখে বললেন, ‘আপনারা তো ডেঞ্জারাস লোক। যান নিয়ে ওকে।’
ড্রাইভারের পাশে বসেছিল বসির আলি। পেছনের সিটে বসে ইউনিস জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে পুলিশ কোথায় পেয়েছিল?’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’ যন্ত্রণায় সমস্ত শরীর টনটন করছে, ধ্যানেশ বলল, ‘একবার মনে হয় গড়ের মাঠ, তবে নিশ্চিত নই।’
ইউনিস আর কথা বাড়ালো না। বদলে ধ্যানেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে ঠিক কে পাঠিয়েছেন? বাবা কি বড়মহারাজকে—।’ হাত নেড়ে ইউনিস বলল, ‘এসব কথায় এখন তো কোন কাজ হবে না। আগে আপনার ট্রিটমেন্ট করা দরকার। বসির, বাঁ দিকের গলিতে ঢুকব আমরা।’
গলির মুখেই নার্সিং হোম। দরজাটা গলির ভেতরে। গাড়ি সেখানে দাঁড়াতে ইউনিস বলল, ‘বসির, বেল বাজাও।’
ভোর চারটের সময় নার্সিং হোমের ডাক্তারকে বিছানা থেকে ডেকে তুলতে ঝামেলা করতেই হল। ধ্যানেশকে দেখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘জয় বাবা! একি অবস্থা আপনার?’
ইউনিস বলল, ‘যা করার করে ফেলুন। লোকজন ওঠার আগেই চলে যাব।’ ডাক্তার যত তাড়াতাড়ি পারলেন ড্রেস করে দিলেন। তারপর একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বললেন, ‘ঠিক কি খেয়েছিলেন বলুন তো?’
ধ্যানেশ উত্তর দিল, ‘আমি খাইনি। খাওয়ানো হয়েছিল।’ ইউনিস বলল, ‘আমি একটা ফোন করব, আশ্রমে।’
‘আশ্রমে? নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।’ ভদ্রলোক রিসিভার এগিয়ে দিলেন। অনেকক্ষণ বেল বাজার পর বড় মহারাজের গলা পাওয়া গেল। ইউনিস বলল, ‘জয় বাবা! বড় মহরাজ, আমি ইউনিস। দুনম্বর, মানে ধ্যানেশবাবুকে পেয়েছি। থানায় ধরে নিয়ে এসেছিল। এইমাত্র ওকে রায় নার্সিং হোমে এনে ড্রেস করিয়েছি। হাঁ, এক নম্বরের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ বলে ইশরায় ধ্যানেশকে ডাকল সে। ধ্যানেশের সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল। আঘাতজনিত ব্যাথার কারণে কাঁপুনি নয়, যেন তার হৃৎপিণ্ড সুস্থির হচ্ছিল না। বাবার একটা কাজ সে সুচারু ভাবে করে আসতে পারেনি এই ভয় এবং লজ্জায় তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে আসতে আসতে তার সমস্ত কথা মনে পড়েছে। যে বাবা তাঁর জন্যে এত করেছেন, পথের ধুলো থেকে তুলে এনে সিংহাসনে বসিয়েছেন, তার জন্যে সে কিছুই করতে পারল না। কি দরকার ছিল ওই সরবত জাতীয় পানীয় পান করার! সে রিসিভার ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বড় মহারাজের গলা ভেসে এল, ‘বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। কাঞ্চনজঙ্গা এক্সপ্রেস ধরে চলে এস।’
লাইনটা কেটে গেল। ইউনিস লক্ষ করছিল। ধ্যানেশ রিসিভার নামিয়ে রাখতেই বলল, ‘কোথায় যাবেন?’ ধ্যানেশ বলল, ‘হাওড়া স্টেশন। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখল পার্সটা ঠিক আছে। তাতে টাকাও রয়েছে। ডাক্তার বললেন, ‘আপনার কিন্তু এখন একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিত।’ ধ্যানেশ বলল, ‘আমি যাঁর কাছে যাচ্ছি তিনিই আমার বিশ্রাম। জয় বাবা।’
বসির আলি একটা ট্যাক্সি ধরে দিতে ধ্যানেশ তাতে উঠে বসল। ভোরবেলায় যে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা সহজেই হাওড়া স্টেশনে যেতে চায়, তা তার জানা ছিল না। ইদানিং তো নিজের গাড়ি ছাড়া যাওয়া আসা হয় না। এসি চেয়ার-কারে বসে সে সমস্ত ঘটনাটা ভাববার চেষ্টা করছিল। নিত্যনাথের সঙ্গে সে যে কথা বলেছিল তা স্পষ্ট মনে করতে পারল। চলে যাওয়ার আগে নিত্যনাথ বলেছিলেন সেবা গ্রহণ না করলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন। সেই সূত্রে তাকে মিষ্টান্ন এবং পানীয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। ওগুলো খাওয়ার পর আর কোন ঘটনা স্মৃতিতে নেই। অর্থাৎ ওই পানীয়েই কিছু যুক্ত হয়েছিল যা তার চেতনাকে অবশ করে দিয়েছে। কিন্তু কেন? কি প্রয়োজন হয়েছিল ওদের ওইভাবে অজ্ঞান করে মাঠময়দানে ছেড়ে দেওয়ার? ওরা ডাকাত নয়। তার পকেটের কোন কিছু খোয়া যায়নি। কথা হল, এই দীর্ঘ সময় সে কোথায় ছিল? সনাতননাথের আশ্রমে না ময়দানে? দ্বিতীয়টিতে থাকলে অনেক আগেই পুলিশের নজরে পড়ত। সনাতননাথের আশ্রমে থাকলে তার গাড়ির ড্রাইভার নিশ্চয়ই—ধ্যানেশ নড়েচড়ে বসল। এখনও শরীরে ব্যথা। আচ্ছা, লোকটা কোথায় গেল গাড়ি নিয়ে? সে কি এখনও ওই আশ্রমে তার জন্যে অপেক্ষা করে চলেছে! ইউনিসকে ওর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়নি। ইউনিসই বা তাকে খুঁজে বের করার আদেশ এরমধ্যে কখন পেল? এসব ভাবনা তাড়াহুড়োয় তার মাথায় তখন আসেনি। কিন্তু ধ্যানেশ আবার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করল। যদি পুলিশ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে তার বিরুদ্ধে কেস ফাইল করত তাহলে, ভাবতেই সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ধ্যানেশকুমার মদ্যপান করে ময়দানে মারপিট করে আহত হয়েছেন; খবরের কাগজ তো প্রথম পাতায় ছেপে দিত। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে জনতার কাছে তার ছবিটা হয়ে যেত ছিন্নভিন্ন।
ট্রেন থেকে নামতেই ধ্যানেশ অবাক। মেজ মহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে কেউ নেই। আশ্রমের সুবিধের জন্যে একটি স্টেশন তৈরির আবেদন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সম্মত হয়েছেন কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ হতে দেরি আছে। এখন যেখানে নামতে হয়, সেখান থেকে আশ্রমের দূরত্ব আছে। ট্যাক্সি পাওয়া যায়। বেশির ভাগ সময় ধ্যানেশ কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে সটান চলে আসে। নইলে স্টেশনে ট্যাক্সিওয়ালারা তাকে দেখতে পেলেই কৃতার্থ হয়ে ছুটে আসে। মেজ মহারাজ তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। ধ্যানেশ সোজা দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করতেই পিঠ টনটন করে উঠল। তাকে ইশারায় আসতে বলে মেজ মহারাজ বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আজ একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করল ধ্যানেশ। এসি চেয়ারকারে কেউ তাকে বিরক্ত করেনি। হয়তো অসুস্থ ভেবেই করেনি। কিন্তু স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে অথবা বাইরে যাওয়ার পথে সবাই সসম্ভ্রমে মেজ মহারাজকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। হয়তো তার মাথার ব্যান্ডেজ, মলিন জামাকাপড় ওদের দেখা ধ্যানেশকুমারের থেকে একটা আলাদা চেহারা দিয়েছে, যা কেউ মেলাবার কথা ভাবছিল না। কৌতুকবোধের সঙ্গে সঙ্গে একধরনের অভাববোধ ধ্যানেশের মন বিমর্ষ করে তুলছিল। জনপ্রিয়তায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে মন সর্বত্র অবহেলার ভূত খোঁজে।
গাড়িতে বসে মেজ মহারাজ বিমর্ষভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। এখন দুপুর! ধ্যানেশ খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘মহারাজ! ছোটে মহারাজের কোন খবর পাওয়া গিয়েছে?’
স্থির গলায় মেজ মহারাজ বললেন, ‘এখনও না।’
এর পরে কোন কথা নেই। ধ্যানেশের অস্বস্তি বাড়ছিল। ইদানিং আশ্রমের কেউ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করে না। কারণ সবাই জানে সে বাবার বিশেষ স্নেহভাজন পুত্র। মেজ মহারাজ কি কোন নির্দেশেই এমন ব্যবহার করছেন? চিন্তা করতে পারছিল না ধ্যানেশ। বাবা বিরূপ হলে তার বেঁচে থাকাই অর্থহীন হয়ে যাবে! এক্ষেত্রে মৃত্যুই শ্রেয়।
ধ্যানেশ বলার চেষ্টা করল, ‘মহারাজ! আমি কর্তব্য সম্পাদন করেছিলাম।’
মেজ মহারাজ গম্ভীর মুখে বললেন, ‘এসব কথা বড় মহারাজ শুনবেন। এত ব্যস্ত হবার তো কোন কারণ নেই।’ আশ্রমের অতি চেনা পথ হঠাৎ অচেনা মনে হচ্ছিল ধ্যানেশের কাছে।
.
বিকেল তিনটার সময় পর পর তিনটি গাড়ি এসে থামল শ্রীশ্রীসনাতননাথের আশ্রমের সামনে। প্রহরীরা সম্ভবত আগে থেকেই সজাগ ছিল। অত্যন্ত দ্রুততায় তারা ফটক খুলে গাড়িগুলোকে ভেতরে প্রবেশের পথ করে দিল। নিত্যনাথ লনে অপেক্ষা করছিলেন যুক্তকরে। প্রথম গাড়ি থেকে আনন্দ স্বরস্বতী নামামাত্র বললেন, ‘সুস্বাগতম্। মহাপুরুষের তরফ থেকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।’
আনন্দ সরস্বতীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘আমরা যখন একত্রিত হয়েছি তখন মহাপুরুষ শব্দটি ব্যবহার না করলেই খুশি হব।’
নিত্যনাথ সবিনয়ে বললেন, ‘আমরা তাঁকে মহাপুরুষ বলেই মনে করি।’
‘সে স্বাধীনতা আপনাদের আছে। কিন্তু আমরা মনে করি মহাপুরুষ শব্দটি বিভেদ সৃষ্টি করবে। শুরুতেই দ্বিমত পোষণ করা কি সঙ্গত হবে?’ আনন্দ সরস্বতী চারপাশে নজর বোলাচ্ছিলেন। কোন মানুষজন, কোন ভক্তশিষ্যকে তিনি দেখতে পেলেন না।
শ্বেত পাথরের ঘরে সুদৃশ্য আসনে বসে আলোচনা শুরু হবার আগে প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী বললেন, ‘আমরা শ্রীশ্রীসনাতননাথের আমন্ত্রণে এখানে এসেছি তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্যে। তাঁর অনুপস্থিতিতে কোন কথা হতে পারে না।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তীর এই মন্তব্যের সঙ্গে মহর্ষি প্রাণদীপ একমত হলেন। নিত্যনাথ এইসব কথা সকৌতুকে শুনে বললেন, ‘আজ সকাল থেকেই, মহাপুরুষ, এই শব্দটিতে আপনারা আপত্তি জানিয়েছেন, কিন্তু এছাড়া অন্য কোন শব্দ জিহ্বা উচ্চারণ করতে অক্ষম! তিনি যোগাবিষ্ট ছিলেন, দুপুরের আহারও গ্রহণ করেননি। তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। তবে যেহেতু তিনি এই আলোচনা সভার আয়োজক তাই অবশ্যই আপনাদের দেখা দেবেন।
নিত্যনাথ কথা শেষ করা মাত্র দুজন শিষ্য ঘরে ঢুকে জানাল, ‘মহাপুরুষ আসছেন।’ আর তারপরেই ষাটোর্ধ এক সুন্দর পুরুষ ঘরে প্রবেশ করে দুই হাত জোড় করে সবাইকে নমস্কার করলেন। তিনজনেই তৎক্ষণাৎ বিরূপ মানসিকতা পরিত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতি-নমস্কার জানালেন। শ্রীশ্রীসনাতন নাথের ঠিক পেছনে আশ্রমাধ্যক্ষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের দিকে তিনি না তাকিয়ে বললেন, ‘এবার তোমরা নিজের কাজে যাও।’ আশ্রমাধ্যক্ষের সঙ্গে শিষ্যরা বেরিয়ে গেলে শ্রীশ্রীসনাতননাথ অন্য তিনজন গুরুর সঙ্গে আসন গ্রহণ করলেন। নিত্যনাথ অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গীতে ঈষৎ দূরে দাঁড়িয়েছিলেন।
শ্রীশ্রীসনাতননাথ বললেন, ‘আপনাদের মত সাধুজন আমার আমন্ত্রণে এখানে পদধূলি দিয়েছেন বলে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি।’
আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘এইরকম একটি মিলনের প্রয়োজন আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশ কিছুদিন থেকেই অনুভব করছিলাম। আপনার আহ্বান পেয়ে মনে হল সময় হয়েছে।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী বললেন, ‘আজ হিন্দুধর্ম বিপন্ন। মুশকিল হল এক্ষত্রে যেন কারো কিছু করার নেই। ইসলাম বিপন্ন হলে সমস্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন, খ্রীষ্টানরাও নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন, শুধু আমাদের দেশে হিন্দুরাই বড় উদাসীন। তাঁরা একটু শিক্ষিত হলে মন্দিরে যাওয়া তো দূরের কথা, বারোয়ারি পূজা প্রাঙ্গণেও উপস্থিত হয় না। ধর্ম সম্পর্কে এই অবহেলা প্রকাশের সাহসই কিছু মানুষকে দুঃসাহসী করে তুলতে সাহায্য করেছে।’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এটা আশার কথা, যাদের কথা আপনি বললেন তারা মাত্র কুড়িভাগের মধ্যেই সীমিত। কিন্তু আশি ভাগ মানুষ এখনও ধর্মে বিশ্বাস করে। উপনয়ন, বিবাহবিধি, পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে ধর্মের আশ্রয় নেয়। ওই কুড়ি ভাগের মধ্যে অন্তত উনিশভাগ পিতা- মাতার মৃত্যুর পর নাস্তিক হয়ে থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে সম্ভবত আমরা যারা হিন্দুধর্মের সংরক্ষণ চাই তাদের কাজ করতে কোন অসুবিধে নেই।’
আনন্দ সরস্বতী মন দিয়ে আলোচনা শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘কিন্তু এর সঙ্গে যে বিষয় নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব বলে সমবেত হয়েছি তার সম্পর্ক কোথায়?’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ বললেন, ‘প্রসঙ্গে আসছি। মানুষ ধর্মের কাছে কি চায়? আশ্রয়! কিসের আশ্রয়? না আত্মার। ধর্মের ওপর নির্ভর করতে চায় সে। জীবন ধারণের ক্লান্তি বা আনন্দের তাৎক্ষণিকতার বাইরে যে চিরন্তন শান্তির জগৎ আছে তার কেন্দ্রতে পৌঁছতে চায়। মৃত্যুর পরে এই জীবনের সমস্ত কাজের বিচার হয়। সেই মহা সময়ের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতেই ধর্মের আশ্রয় দরকার হয়। হিন্দুধর্ম সেই আশ্রয় দিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। অপার্থিব আনন্দময় জগতে পৌঁছে দিয়েছে আশ্রয়প্রার্থীকে। শুধু এই কারণেই পশ্চিমের ক্ষুব্ধ-হৃদয় মানুষেরা প্রায়ই ছুটে আসছেন ভারতবর্ষে, এসে আমাদের বলছেন, দীক্ষা দাও।’
এই পর্যন্ত বলা মাত্র প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী বলে উঠলেন, ‘তাঁরা আসছেন আপনার এবং মহর্ষি প্রাণদীপের কাছে। তাঁদেব সম্পর্কে কিছু আলোচনা না করাই সঙ্গত।’
শ্রীশ্রীসনাতননাথের ঠোঁটে হাসি ফুটল। সেটাকে দমন করে তিনি বললেন, ‘পিতার যেমন পুত্রের প্রতি কর্তব্য রয়েছে, শিক্ষকের যেমন ছাত্রের জন্যে ব্যস্ত থাকার প্রয়োজন আছে তেমনি আমাদের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের সঠিক পথে চালনা করার দায়িত্ব আমাদেরই। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, বাহ্যিক চটক এবং পাইয়ে দেবার মোহ ছড়িয়ে কেউ কেউ সাধারণ মানুষকে অত্যন্ত বিভ্রান্ত করছেন। আগুনের স্বরূপ না জেনে যেমন পতঙ্গ তার ঔজ্জ্বল্য দেখে ধাবিত হয়, তেমনি লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যাচ্ছে সেই পাওয়ার আশায়। এতেও আমার আপত্তি করার কিছু ছিল না। হিন্দুধর্ম আমাকে শিখিয়েছে সহনশীল হতে। কিন্তু প্রকৃত ধর্মভীরু মানুষেরা এই ফাঁদে পা দিচ্ছে। যে সমস্ত শিষ্যরা আমার আপনার শরণার্থী ছিল তারা ক্ষণিক পাওয়ার মোহে বিভ্রান্ত হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম তারা যদি সেখানে গিয়ে ধর্মের আশ্রয় পায় তো আমি আপত্তি করব কেন? কিন্তু কি পাচ্ছে তারা সেখানে! আপনি কি এ বিষয়ে কোন তথ্য পেয়েছেন?’ প্রশ্নটি আনন্দ সরস্বতীর উদ্দেশে। তিনি মাথা নাড়লেন, ‘জেনেছি। তিনি একটি সাম্রাজ্য তৈরির চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে তার পঁচাত্তর ভাগ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তিনি কোন ধর্মীয় শাস্ত্রের কথা বলেন না। হিন্দু ধর্মের পূজা পদ্ধতি বা তার মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা করেন না। তিনি শুধু বলেন মানুষ হতে। কিভাবে মানুষ হবে তার ব্যাখ্যাও অদ্ভুত। কিন্তু তাঁর কাছে গেলে কিছু পাওয়া যায় এ ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। তিনি অবশ্য বলেন শূন্য থেকে মুঠোয় কিছু ধরতে পারেন না, কোন অলৌকিক ক্রিয়ার মাধ্যমে মৃতের শরীরে প্রাণ-সঞ্চার করতে পারেন না। অথচ দেখা গেছে সব শিষ্যই তাঁর কোন না কোন অলৌকিক উপকারের জন্যে কৃতজ্ঞ।’
‘হ্যাঁ। এইটেই বিস্ময়ের। এতক্ষণে মহর্ষি প্রাণদীপ কথা বললেন। একটি- দুটি ঘটনা ঘটলে বুজরুকি বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু—‘
আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘মানুষের মনে সবসময় একটা কুসংস্কার ওত পেতে থাকে। সন্ধ্যেবেলায় কোন বিপদে পড়লে সকালে যার মুখ দেখে শয্যা ত্যাগ করেছে তাকে দায়ী করে। কোন আপাত অসম্ভব ঘটনা ঘটে গেলে সে আপনি একটা কারণ ঠাওরে নেয় এবং যেহেতু তা বাবা করেছেন ভাবতে পারলে সুখ হয় তাই বাবার নামেই চালায়। যারা আশ্রমে টেলেক্স রাখে, ট্রাক্টর চালায়, মাছ না খেয়ে মাছের চাষ করে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে, তাদের গুরু যদি অলৌকিক কাণ্ড করতে পারেন তাহলে এসবের প্রযোজন হত না।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে কোটি কোটি শিষ্য হল কিভাবে?’
‘কোটি শব্দটি অত সস্তা নয়।’ আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘লক্ষ করে থাকবেন নিশ্চয়: এদেশের প্রশাসনের ওপরতলার বেশ কিছু মানুষ ওঁর শিষ্য। তারা আরও ওপরে ওঠার জন্যে শিষ্য হয়েছে। সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়লে বাবা ওইসব শিষ্যদের দিয়ে উপকার করিয়ে দেন। ব্যবসায়ীরা ওঁর শিষ্য। কারণ বাবার নির্দেশে তাঁরা ব্যবসা পান। এসব করে বাবা নিশ্চয়ই বঞ্চিত থাকেন না। কোটি কথাটি ছেড়ে দিন, যদি পঞ্চাশ লক্ষ শিষ্য প্রতিমাসে বাবার কাছে ত্রিশ টাকা প্রণামী হিসেবে পাঠায় তাহলে বাবার মাসিক আয় কত দাঁড়াচ্ছে ভাবুন!
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী বললেন, ‘সেকথা শুনেছি। দুই পুত্র বাদে বাবার দশজন নির্বাচিত প্রধান শিষ্য রয়েছে যাদের মহারাজ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেইসব মহারাজের প্রত্যেকের শতাধিক প্রধান শিষ্য বর্তমান। এই শিষ্যরা নিয়মিত দীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বাবার হয়ে। সাধারণ মানুষকে নিয়মিত সঞ্চয় করে আশ্রমে টাকা পাঠাতে হয় যাতে আশ্রমের কাজ অর্থাভাবে নষ্ট না হয়। অবশ্য এই পাঠানোর ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যে অর্থ সঞ্চিত হল তার একটা ক্ষুদ্র অংশ সেইসব প্রধান শিষ্যের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে তাঁরা বাবার বাণী প্রচার করতে পারেন। কি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। এর ফলে শতাধিক প্রধান শিষ্য নিজের স্বার্থের জন্যেই চিরকাল বাবার অনুগত হয়ে থাকবে।’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ চুপচাপ শুনছিলেন কথাবার্তা। এবার বললেন, ‘অন্যের ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কোন যুক্তি নেই। আমাদের শিষ্যরা নিজে থেকেই আশ্রমে দান করে থাকেন। বিদেশী ভক্তদের কথা আপনারা বললেন। হ্যাঁ, আমার এবং মহর্ষি প্রাণদীপের আশ্রমে তাদের নিয়মিত দেখা যায়। কিন্তু বাবার আশ্রমে কোন বিদেশী যায় বলে শুনিনি। কেন যায় না? না, সেখানে তারা আত্মার আরাম পায় না। এসব থাক। এই বাবা হিন্দুধর্মের প্রতি যেমন অনুগত নন তেমন কোন অলৌকিক ক্ষমতাও নেই। এর প্রমাণ আমি পেয়েছি। সম্প্রতি ওঁব ছোট পুত্র কলকাতা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। এই পুত্র ভাবী মহারাজ হিসেবে নির্বাচিত ছিল। উনি তো এই বিশাল সম্পত্তি পরিবারের বাইরে যেতে দেবেন না। যা হোক, ওঁর ধারণা হয়েছে আমি বিদ্বেষবশত ওঁর পুত্রকে হরণ করেছি। এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কি আছে। উনি যদি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হতেন তাহলে দিব্যদৃষ্টিতেই পুত্রের হদিশ পেতেন। আমার আশ্রমে দূত পাঠাতে হত না।’
আনন্দ সরস্বতী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওর কনিষ্ঠ পুত্র নিরুদ্দিষ্ট? কি করত সে?’
‘কলকাতার কলেজে থেকে পড়াশুনা করত।’
‘কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্যের অংশীদার হবার প্রলোভন ছেড়ে সে কেন উধাও হতে যাবে?’
‘সেইটেই বিস্ময়কর। আমার ধারণা সে কোথাও যায়নি। তাকে উধাও করে দায় আমার ওপর চাপাতে চাইছেন বাবা। আমাকে চিহ্নিত করে জনসমক্ষে হেয় করতে পারলে তাঁর সুবিধে হবে।’
‘কি সুবিধে?’
‘উনি চান না, এদেশে আর কেউ নিজের মত করে ধর্মাচরণ করুক। মুখে সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন কিন্তু বাস্তবে একাই রাজত্ব করতে চান। আমার শিষ্যসংখ্যা, বিদেশে আমার প্রচার হয়তো বেশি বলেই তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন আঘাত করতে।’
মহর্ষি প্রাণদীপ বললেন, ‘যদিও আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই তবু যদি বাবা এইরকম পরিকল্পনা করে থাকেন তবে পরবর্তীতে আঘাত আমাদের ওপরেও আসতে পারে। অতএব এখনই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী প্রশ্ন করেন, ‘কি ভাবে?’
আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘ধর্ম রক্ষার জন্যে প্রত্যাঘাত করা প্রকৃত ধার্মিকের কর্তব্য।’
‘যদি বাবা আমাদের ওপর কোন কল্পিত অভিযোগ চাপিয়ে দেন তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। বাবার কনিষ্ঠ পুত্রটি কোথায় থাকতে পারে আপনার ধারণা?’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ তাঁর প্রধান শিষ্য নিত্যনাথের দিকে তাকালেন। নিত্যনাথ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ। এবার ইঙ্গিত বুঝে বললেন, ‘কিন্তু বাবার কনিষ্ঠ পুত্র ছোটে মহারাজ সত্যি সত্যি উধাও হয়েছেন। কলকাতার যে বাড়ির চারতলায় তিনি থাকতেন সেখানে খবর নিয়েছিলাম। যদিও কেউ সত্য প্ৰকাশ করতে চায়নি তবু দুজন লোককে ওই কারণে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বাবার শিষ্যদের মধ্যে কয়েকজন শহর তোলপাড় করে ফেলছে ছোটে মহারাজকে সন্ধান করার জন্যে। শেষ যা জেনেছি, ওকে এখনও পাওয়া যায়নি।’
মহর্ষি প্রাণদীপ বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একটু আগে শুনলাম বাবার কনিষ্ঠ পুত্র এখনও মহারাজ আখ্যা পায়নি। তাহলে আপনি ছোটে মহারাজ বলছেন কেন?’
নিত্যনাথ বললেন, ‘ওটা বাবা আদর করে বলে থাকেন। সেই থেকেই ওই নামেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত। গতকাল বাবার এক গৃহী শিষ্য মহাপুরুষে দর্শন প্রার্থনা করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। অনুমতি পেয়ে আমিই ওর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বাবার প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসে অযথা আমাদের অনেক কুকথা বলে শাসিয়ে যান। এইসব ব্যাপার রীতিমত অপমানজনক। এই শিষ্যটি বাবার কল্যাণে গানবাজনার লাইনে খ্যাতি পেয়েছে। বাবা চান শিল্প সংস্কৃতির বিখ্যাত মানুষদের কিছু সুযোগের ব্যবস্থা করে শিষ্য হিসেবে আরও প্রচারিত করতে, যাতে সাধারণ মানুষরা এদের দেখে বাবার প্রতি আরও মুগ্ধ হন। কিন্তু সেই শিল্পীশিষ্যের ব্যক্তিজীবন অত্যন্ত নিচুমানের। বাবার শিষ্য হয়ে তিনি সবরকম সুযোগ নিচ্ছেন খ্যাতির পথে, কিন্তু সুরা এবং মহিলা সংক্রান্ত ব্যাপারে অত্যন্ত আসক্ত। আমরা বাবাকে জানাতে চাই যে এইরকম শিষ্যকে তিনি যেন দূত হিসেবে আমাদের আশ্রমে পাঠিয়ে এখানকার মাটিকে অপবিত্র না করেন।’
আনন্দ সরস্বতী কৌতূহলী হলেন, ‘তার এই চরিত্রহীনতার প্রমাণ জোগাড় করা দরকার।’ নিত্যনাথ বললেন, ‘মহাপুরুষের, হ্যাঁ আমার অভ্যাস এবং বিশ্বাস আমারই, আশীর্বাদে আমি সেই প্রমাণ পেয়েছি।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রমাণ কিসের?’
নিত্যনাথ বললেন, ‘ধ্যানেশকুমারের চরিত্রহীনতার ছবি।’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ হাত তুললেন, ‘অন্যের কুরুচির নিদর্শন আর আমরা দেখতে চাই না। তুমি ওগুলোর কপি এবং একটি পত্র বাবার কাছে পাঠিয়ে দিও।’ আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘কিন্তু বাবার ছোট ছেলে যদি নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তাকে খুঁজে বের করা দরকার। আমরা যদি তাকে পেয়ে যাই, আচ্ছা, পুলিশকে খবর দিয়েছে ওরা?’
নিত্যনাথ মাথা নাড়লেন, ‘না। বাবা জানেন পুলিশ মানেই প্রচার।’ ‘তাহলে তো অতি উত্তম। আমরা যদি ছোটে মহারাজকে খুঁজে পাই তাহলে বাবাকে আমাদের মত আচরণ করতে বাধ্য করব। কিন্তু সে কোথায় যেতে পারে?’ অনন্দ সরস্বতী প্রশ্ন করলেন।
আশ্রমে টাকা পাঠাতে হয় যাতে আশ্রমের কাজ অর্থাভাবে নষ্ট না হয়। অবশ্য এই পাঠানোর ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যে অর্থ সঞ্চিত হল তার একটা ক্ষুদ্র অংশ সেইসব প্রধান শিষ্যের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে তাঁরা বাবার বাণী প্রচার করতে পারেন। কি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। এর ফলে শতাধিক প্রধান শিষ্য নিজের স্বার্থের জন্যেই চিরকাল বাবার অনুগত হয়ে থাকবে।’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ চুপচাপ শুনছিলেন কথাবার্তা। এবার বললেন, ‘অন্যের ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কোন যুক্তি নেই। আমাদের শিষ্যরা নিজে থেকেই আশ্রমে দান করে থাকেন। বিদেশী ভক্তদের কথা আপনারা বললেন। হ্যাঁ, আমার এবং মহর্ষি প্রাণদীপের আশ্রমে তাদের নিয়মিত দেখা যায়। কিন্তু বাবার আশ্রমে কোন বিদেশী যায় বলে শুনিনি। কেন যায় না? না, সেখানে তারা আত্মার আরাম পায় না। এসব থাক। এই বাবা হিন্দুধর্মের প্রতি যেমন অনুগত নন তেমন কোন অলৌকিক ক্ষমতাও নেই। এর প্রমাণ আমি পেয়েছি। সম্প্রতি ওঁর ছোট পুত্র কলকাতা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। এই পুত্র ভাবী মহারাজ হিসেবে নির্বাচিত ছিল। উনি তো এই বিশাল সম্পত্তি পরিবারের বাইরে যেতে দেবেন না। যা হোক, ওঁর ধারণা হয়েছে আমি বিদ্বেষবশত ওঁর পুত্রকে হরণ করেছি। এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর কি আছে। উনি যদি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হতেন তাহলে দিব্যদৃষ্টিতেই পুত্রের হদিশ পেতেন। আমার আশ্রমে দূত পাঠাতে হত না।’
আনন্দ সরস্বতী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওর কনিষ্ঠ পুত্র নিরুদ্দিষ্ট? কি করত সে?’
‘কলকাতার কলেজে থেকে পড়াশুনা করত।’
‘কিন্তু এই বিশাল সাম্রাজ্যের অংশীদার হবার প্রলোভন ছেড়ে সে কেন উধাও হতে যাবে?’
‘সেইটেই বিস্ময়কর। আমার ধারণা সে কোথাও যায়নি। তাকে উধাও করে দায় আমার ওপর চাপাতে চাইছেন বাবা। আমাকে চিহ্নিত করে জনসমক্ষে হেয় করতে পারলে তাঁর সুবিধে হবে।’
‘কি সুবিধে?”
‘উনি চান না, এদেশে আর কেউ নিজের মত করে ধর্মাচরণ করুক। মুখে সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন কিন্তু বাস্তবে একাই রাজত্ব করতে চান। আমার শিষ্যসংখ্যা, বিদেশে আমার প্রচার হয়তো বেশি বলেই তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন আঘাত করতে।’
মহর্ষি প্রাণদীপ বললেন, ‘যদিও আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই তবু যদি বাবা এইরকম পরিকল্পনা করে থাকেন তবে পরবর্তীতে আঘাত আমাদের ওপরেও আসতে পারে। অতএব এখনই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী প্রশ্ন করেন, “কি ভাবে?’
আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘ধর্ম রক্ষার জন্যে প্রত্যাঘাত করা প্রকৃত ধার্মিকের কর্তব্য।’
‘যদি বাবা আমাদের ওপর কোন কল্পিত অভিযোগ চাপিয়ে দেন তাহলে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। বাবার কনিষ্ঠ পুত্রটি কোথায় থাকতে পারে আপনার ধারণা?’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ তাঁর প্রধান শিষ্য নিত্যনাথের দিকে তাকালেন। নিত্যনাথ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ। এবার ইঙ্গিত বুঝে বললেন, ‘কিন্তু বাবার কনিষ্ঠ পুত্র ছোটে মহারাজ সত্যি সত্যি উধাও হয়েছেন। কলকাতার যে বাড়ির চারতলায় তিনি থাকতেন সেখানে খবর নিয়েছিলাম। যদিও কেউ সত্য প্রকাশ করতে চায়নি তবু দুজন লোককে ওই কারণে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বাবার শিষ্যদের মধ্যে কয়েকজন শহর তোলপাড় করে ফেলছে ছোটে মহারাজকে সন্ধান করার জন্যে। শেষ যা জেনেছি, ওকে এখনও পাওয়া যায়নি।’
মহর্ষি প্রাণদীপ বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একটু আগে শুনলাম বাবার কনিষ্ঠ পুত্র এখনও মহারাজ আখ্যা পায়নি। তাহলে আপনি ছোটে মহারাজ বলছেন কেন?’
নিত্যনাথ বললেন, ‘ওটা বাবা আদর করে বলে থাকেন। সেই থেকেই ওই নামেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত। গতকাল বাবার এক গৃহী শিষ্য মহাপুরুষের দর্শন প্রার্থনা করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। অনুমতি পেয়ে আমিই ওর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বাবার প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসে অযথা আমাদের অনেক কুকথা বলে শাসিয়ে যান। এইসব ব্যাপার রীতিমত অপমানজনক। এই শিষ্যটি বাবার কল্যাণে গানবাজনার লাইনে খ্যাতি পেয়েছে। বাবা চান শিল্প সংস্কৃতির বিখ্যাত মানুষদের কিছু সুযোগের ব্যবস্থা করে শিষ্য হিসেবে আরও প্রচারিত করতে, যাতে সাধারণ মানুষরা এদের দেখে বাবার প্রতি আরও মুগ্ধ হন। কিন্তু সেই শিল্পীশিষ্যের ব্যক্তিজীবন অত্যন্ত নিচুমানের। বাবার শিষ্য হয়ে তিনি সবরকম সুযোগ নিচ্ছেন খ্যাতির পথে, কিন্তু সুরা এবং মহিলা সংক্রান্ত ব্যাপারে অত্যন্ত আসক্ত। আমরা বাবাকে জানাতে চাই যে এইরকম শিষ্যকে তিনি যেন দূত হিসেবে আমাদের আশ্রমে পাঠিয়ে এখানকার মাটিকে অপবিত্র না করেন।’
আনন্দ সরস্বতী কৌতূহলী হলেন, ‘তার এই চরিত্রহীনতার প্রমাণ জোগাড় করা দরকার।’ নিত্যনাথ বললেন, ‘মহাপুরুষের, হ্যাঁ আমার অভ্যাস এবং বিশ্বাস আমারই, আশীর্বাদে আমি সেই প্রমাণ পেয়েছি।’
প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রমাণ কিসের?’
নিত্যনাথ বললেন, ‘ধ্যানেশকুমারের চরিত্রহীনতার ছবি।’
শ্রীশ্রীসনাতননাথ হাত তুললেন, ‘অন্যের কুরুচির নিদর্শন আর আমরা দেখতে চাই না। তুমি ওগুলোর কপি এবং একটি পত্র বাবার কাছে পাঠিয়ে দিও।’ আনন্দ সরস্বতী বললেন, ‘কিন্তু বাবার ছোট ছেলে যদি নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তাকে খুঁজে বের করা দরকার। আমরা যদি তাকে পেয়ে যাই, আচ্ছা,পুলিশকে খবর দিয়েছে ওরা?’
নিত্যনাথ মাথা নাড়লেন, ‘না। বাবা জানেন পুলিশ মানেই প্রচার।’
‘তাহলে তো অতি উত্তম। আমরা যদি ছোটে মহারাজকে খুঁজে পাই তাহলে বাবাকে আমাদের মত আচরণ করতে বাধ্য করব। কিন্তু সে কোথায় যেতে পারে?’ আনন্দ সরস্বতী প্রশ্ন করলেন।
‘সেইটেই বিস্ময়ের।’ নিত্যনাথ জবাব দিলেন।
মহর্ষি প্রাণদীপ জানতে চাইলেন, ‘সেকি পিতৃবিদ্বেষী? দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ?’
‘তাও জানি না। ওকে সর্বসাধারণের সঙ্গে মিশতে দেওয়া হত না।’ চারজন ক্রমশ আরও বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নিলেন। হিন্দুধর্ম বিপন্ন এ ব্যাপারে যখন চারজন একমত, তখন তা রক্ষা করার জন্যে যে কোন পর্যায়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ওঁরা করলেন। পর পর তিনটি পরিকল্পনা নেওয়া হল ছোটে মহারাজকে খুঁজে বের করার চেষ্টা ছাড়া। অবিলম্বে একটি মহাসম্মেলন ডেকে হিন্দুধর্মের প্রকৃতরূপ সাধারণ মানুষকে বোঝাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আনন্দ সরস্বতী প্রস্তাব দিলেন সেই সম্মেলনে বাবাকেও আমন্ত্রণ জানানো হোক। তিনি যদি বিপরীত কিছু বলতে চান তাহলে সেটা খণ্ডন করে জনসাধারণের কাছে তার স্বরূপ নগ্ন করে দেওয়া যাবে। আর এখন থেকে এঁরা সর্বসম্মতভাবে কাজ শুরু করবেন বলে স্থির করলেন। যদিও প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী বারংবার দ্বিমত প্ৰকাশ করছিলেন তবু বাকিরা বৃহত্তর স্বার্থে তা উপেক্ষা করাই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করলেন। বিদায় নিয়ে তাঁরা যখন গাড়িতে উঠলেন তখনও শ্রীশ্রীসনাতননাথের বিশাল আশ্রমপ্রাঙ্গণ জনশূন্য। প্রভু জনার্দন চক্রবর্তী প্রশ্ন করেছিলেন বাইরে বেরিয়ে শ্রীশ্রীসনাতননাথের শিষ্যরা, বিশেষ করে বিদেশীরা নাকি এখানে গিজগিজ করে। কই, তাদের একটিকেও দেখছি না যে।’
আনন্দ সরস্বতী জবাব দিয়েছিলেন, ‘গুরুর অস্তিত্ব নির্ভর করে শিষ্যের ওপরে। আপনি কি চাইবেন, আপনার শিষ্যকে আমার কাছে ছেড়ে দিতে? তারওপর বিদেশী বলে কথা। ওপরের জানলায় দাঁড়িয়ে শ্রীশ্রীসনাতন এঁদের বিদায়দৃশ্য দেখছিলেন। বিপদের সময় বড় শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ছোট শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, এটা যেন কার কথা?’ তাঁর মনে হল মহর্ষি প্রাণদীপ বেশি কথা বলেননি। কেন?
.
প্রায় বারো ঘণ্টা হয়ে গেছে ধ্যানেশ আশ্রমে আবদ্ধ। মেজ মহারাজ তাকে অতিথিশালায় পৌঁছে দেবার পর আর কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। ধ্যানেশ কয়েকবার টেলিফোন তুলে বড় মহারাজকে চেয়েছিল কিন্তু অপারেটার প্রতিবারই বলেছে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত। এখন আর বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাওয়ার সাহস তার নেই। এর আগে যখনই সে এখানে এসেছে পায়ে হেঁটে অথবা প্রয়োজন বোধ করলে গাড়িতে সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছে। আনন্দভবনে সরাসরি যাওযাব স্বাধীনতা তার ছিল। কিন্তু আজ যতবার সে অতিথিশালা থেকে বেরুতে চেয়েছে ততবারই সেবকরা জানিয়েছে আপনার ওপর আদেশ হয়েছে ঘরেই অপেক্ষা করার। ধ্যানেশ বুঝতে পেরেছিল তার জায়গা আর ঠিক জায়গায় নেই। এইসব সামান্য সেবকরা সাহস পেত না তার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলতে। চরম কোন দুর্ভাগ্য নেমে আসছে তার ওপরে। বাবার যদি তাই ইচ্ছা হয় তাহলে কিছুই করার নেই। শরীরে এখনও ব্যথা। মন অবসন্ন। ধ্যানেশের মনে হল অনেককাল গান গাওয়া হয়নি। এই অবস্থায় গান গাইতে চাওয়া হাস্যকর ব্যাপার।
রাত বারোটায় একজন সেবক এসে নিদ্রাহীন ধ্যানেশকে জানাল, বড় মহারাজ তার জন্যে আনন্দভবনে অপেক্ষা করছেন। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে আবার বেদনা টের পেল। থানার মেজবাবুর কাছে অনুমতি পাওয়ামাত্র কনস্টেবলটি বেধড়ক ঠেঙিয়েছে তাকে। ইউনিস যদি উপস্থিত না হত তাহলে যে কি পরিণাম হত! ইউনিসের উপস্থিতি তো বাবারই ইচ্ছায়। তার মানে বাবা তাকে প্রহার থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন নিশ্চয়ই। মনে নবীন বল পেল ধ্যানেশ। সেবকটির সঙ্গে মধ্যরাতের আশ্রমের নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে সে ক্রমাগত বাবানাম জপ করে যাচ্ছিল। এতরাত্রে আনন্দভবনের সামনে কোন জমায়েত নেই। অতিথিশালার সেবকটি আনন্দভবনের সেবকের কাছে তাকে সমর্পণ করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। আনন্দভবনের সাধক তাকে নিয়ে চলল সিঁড়ি ভেঙে।
বাবা দাঁড়িয়েছিলেন একটি বিশাল রঙিন মাছের চৌবাচ্চার সামনে। কাচের ভেতর আলোয় তাদের চমৎকার দেখাচ্ছে। বাবার হাতে কিছু খাদ্যদ্রব্য ছিল। তিনি নীরবে তা একটা একটা করে চৌবাচ্চার ওপরের খোলা অংশ দিয়ে জলে ফেলছিলেন। বড় একটি ফাইটার সবাইকে সরিয়ে আগে এসে সেই খাবার খেয়ে নিচ্ছিল। অন্যেরা বোকার মত সেই খাওয়া দেখছিল। ঘরের একপাশে বড় মহারাজ একটি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। ধ্যানেশ ঘরে ঢুকেই ওঁদের দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে বাবার দুই চরণ জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সশব্দে। মাছের খাবার দিতে দিতে বাবা একবারও মুখ নামিয়ে ধ্যানেশকে দেখলেন না। বড় মহারাজ সতর্ক হয়ে এগিয়ে এসে বাবাকে শান্ত দেখে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। ধ্যানেশ তখন কাতর গলায় কেঁদে বলছে, ‘বাবা, আমাকে বাঁচান। বাবা, আমি আপনার ছেলে। আপনাকে জ্ঞানত কোন অসম্মান করিনি আমি। বাবা গো।’
যতক্ষণ হাতের খাবার শেষ না হল ততক্ষণ বাবা ধ্যানেশের দিকে নজর দেবার সময়ই পেলেন না। কেউ যে তাঁর দুই পা জড়িয়ে ধরে পড়ে আছে তাও যেন তাঁর হুঁশে নেই। খাবার শেষ হলে তিনি মৃদুস্বরে বললেন, ‘বড়, ওকে উঠে বসতে বল।’ বড় মহারাজকে কিছু বলতে হল না। ওই কণ্ঠস্বরে ধ্যানেশের হাত শিথিল হয়ে এল। ধীরে ধীরে সে বাবার চরণ ছেড়ে দিল। বাবা এগিয়ে গিয়ে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বললেন, “বড়, গঙ্গাজল আনো। আমার পায়ে দাও। বড় জ্বলছে।’ বড় মহারাজ একটি পাথরের পাত্র থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে বাবার চরণে সযত্নে লেপন করলেন। করে প্রণাম সারলেন। নিজেকে রোগগ্রস্ত সারমেয়র মত মনে হচ্ছিল ধ্যানেশের। সে উঠে দাঁড়াতেই সাহস পাচ্ছিল না।
কিন্তু বাবা আদেশ করলেন, ‘ধ্যানেশ এখানে উঠে এস।’ বাবা ততক্ষণে চলে গিয়েছেন টেবিলের ওপাশে। কাঁপতে কাঁপতে ধ্যানেশ তার কিছু দূরে উপস্থিত হল। বাবা বললেন, ‘তুমি এত তাড়াতাড়ি নিজের অতীত ভুলে গেলে কি করে ধ্যানেশ?’
‘ভুলিনি বাবা। আমি সবসময় আপনার শ্রীচরণে সমর্পিত।’ ডুকরে উঠল সে।
‘মিথ্যে কথা! তুমি আমাকে ব্যবহার করেছ নিজের ভোগ লালসা চরিতার্থ করতে।’
‘না বাবা, না। আপনি সারাক্ষণ আমার অন্তরে আছেন—’
ধ্যানেশ অসহায় চোখে তাকাল। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। বড় মহারাজ পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। ধ্যানেশ মরীয়া হয়ে বলল, ‘আমি আপনার আদেশ পালন করেছি ঠিকঠাক। নিত্যনাথের সঙ্গে কথা বলার সময় আপনাকে একবারও অপমানিত হতে দিইনি। তিনি যখন সেই চেষ্টা করছিলেন তখন আমি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের বক্তব্য ওঁর কাছে স্পষ্ট বলতে কোন দ্বিধা করিনি। কিন্তু—।’
‘থামলে কেন, বল?’
‘কিন্তু উনি আতিথ্য নিতে এমন পীড়াপীড়ি করলেন আর আমি ভুলেও ভাবিনি ওই সরবতের মধ্যে কোন মাদক মেশানো রয়েছে। আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল।’
‘তোমার কথার কোন প্রমাণ দিতে পারবে?’
‘আজ্ঞে না।’
‘তাহলে তোমার ড্রাইভারকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমার বাড়িতেই পাওয়া গিয়েছে। তোমার গাড়ি ছিল পার্কস্ট্রীটের একটি কুখ্যাত বাড়ির সামনে। আর।—’ বাবা বাম হাতের একটি আঙুল ঘৃণার সঙ্গে তুলে ধরলেন, ‘এইগুলো আশ্রমের ডাকবাক্সে পাওয়া গিয়েছে।’
ধ্যানেশ কম্পিত হাতে খামটা তুলে নিল। ভেতরে কয়েকটা ফটোগ্রাফ এবং একটি চিঠি। বাবা বললেন, ‘চিঠিটা জোরে পড়।’
ধ্যানেশের গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সে কোনমতে পড়ল, ‘আপনার সঙ্গে আমাদের আজ পর্যন্ত কোন বিরোধ নেই। কিন্তু একথা কি আমরা বলতে পারি, যদি আপনি আমাদের মহাপুরুষের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন না কবেন? যে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনার জন্য আপনি বিশেষ দূত পাঠিয়েছিলেন তা আমাদের অজ্ঞাত বিষয়। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম যে, আমাদের আশ্রমের পবিত্রতা একজন ধর্মগুরু হিসেবে আপনি রক্ষা করবেন। এমন কাউকে পাঠানো কি আপনার উচিত হয়েছে যার জীবন পঙ্কিলময়? সঙ্গের ছবিগুলো তার প্রমাণ। ধ্যানেশ ছবির বাণ্ডিল দেখে আঁতকে উঠল। এই অশ্লীল ছবি তার? এই মেয়েরা কারা যাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না!
ধ্যানেশের মুখ থেকে কথা সরছিল না। তার হাত থেকে ছবিগুলো পড়ে গেল টেবিলের ওপর। পরক্ষণেই সে যেন শক্তি ফিরে পেল। প্রবল আক্রোশে ছবিগুলো তুলে নিয়ে সে ছিঁড়তে লাগল। যেন এই কুশ্রীতার চিহ্ন সে আর রাখবে না। বাবা বললেন, ‘কত ছবি তুমি ছিঁড়বে ধ্যানেশ? ওরা কপি পাঠিয়েছে। ইচ্ছে করলে লক্ষ লক্ষ কপি চারধারে ছড়িয়ে দিতে পারে। ভেবে দ্যাখো, এর যে কোন একটা কপি খবরের কাগজে ছাপা হলে আমার শিষ্যদের হৃদয় কি পরিমাণে ব্যথা পাবে। তাদের পিতা হিসেবে আমি সেটা চাইতে পারি না।’
‘আমি-আমি।’ টুকরোগুলো মুঠোয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে গেল।
‘না। তোমার কথা এখন চিন্তা করার কোন যুক্তি নেই। তুমি আর তোমার সম্মান ফিরে পাবে না। কিন্তু আমাদের অসম্মানিত করবে। খবরের কাগজের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে আমি তোমাকে এখানে আনিয়েছিলাম। এখন তোমার হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হবে।’
ধ্যানেশ সোজা হয়ে দাঁড়াল, ‘আপনাকে আমি আমার ঈশ্বর বলে গ্রহণ করেছি। আপনি আমাকে আদেশ দিন আমি আজ রাতেই আত্মহত্যা করব।’
‘ছি ছি ছি। আত্মহত্যা করে কাপুরুষরা। তুমি তো কাপুরুষ নও বলেই জানতাম। শোন, তোমার গানের গলা আছে। তোমাকে পরিচিত করে দিয়েছি। শুনেছি ওসব লাইনে চরিত্রহীনদেরই বেশি খ্যাতি হয়। তোমার আর ভয় কি!’ বাবা আবার ধীরে ধীরে মাছের চৌবাচ্চার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে আহার গ্রহণ করে। পশুদের মধ্যে অনেকেই খিদে না পেলে খায় না। কিন্তু এই মাছগুলোকে দ্যাখো, এত রাতেও খাবার দেখে ছুটে এসে গিলেই চলেছে। কোন কোন মানুষের চরিত্র এমনি। ন্যায় নীতি বর্জিত জীবন তাদের এভাবেই আকর্ষণ করে। যেমন তুমি।’
বড় মহারাজ এতক্ষণে কথা বললেন, ‘বাবা, রাত গভীর হয়েছে। আপনি যদি একটুও বিশ্রাম না নেন তাহলে –!’ আশংকার কথা তিনি আর উচ্চারণ করলেন না।
‘যে ছেলেটি ছবিটবি আঁকে তার নাম কি যেন?’ বাবা মুখ না ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন। বড় মহারাজ প্রশ্নটির উত্তর চট করে খুঁজে পেলেন না। কত ছেলে তো ছবি আঁকে। এই আশ্রমের বাসিন্দা শিষ্যদের মধ্যেও অনেকে অবসর সময়ে চমৎকার আঁকাআঁকি করে। বাবা উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে নিজেই বললেন, ‘ছবি এঁকে কি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়? তারা কি শিল্পীকে আপন করে মাথায় রাখে?’
বড় মহারাজ এবার বললেন, ‘না বাবা। অল্প সংখ্যক বোদ্ধাই তাঁদের সম্পর্কে উৎসাহ দেখান।’ বাবা ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘তুমি আর এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমি বিশ্রাম নেব।’
ধ্যানেশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
বাবা এগিয়ে এলেন কাছে, ‘আজ রাত্রেই তুমি কলকাতায় চলে যাও। আগামীকাল সকালে প্রত্যেকটা কাগজে আমাদের আশ্রম থেকে দেওয়া বিবৃতি বের হবে যে, তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা হয়েছে। তুমি চরিত্রহীনতার কাজ করেছ যা আশ্রমের সম্মান এবং আদর্শবিরোধী। তোমার কাছে নিশ্চয়ই কাগজের লোক যাবে। তুমি অভিযোগ অস্বীকার করবে। বলবে আমার শত্রুপক্ষ ঘটনাটাকে সাজিয়েছে ঈর্ষাবশত। আশ্রম তোমাকে ত্যাগ করলেও তুমি ধর্মচ্যুত হবে না। আমৃত্যু তুমি আমার প্রতি অনুগত থাকবে।’ বাবা কিছুটা সময় নিলেন, ‘ইউনিস তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। যাও। দেরি কোরো না।’
ধ্যানেশ আবার ভেঙে পড়ল বাবার শ্রীচরণে। আত্মহত্যা করার আগেই যেন সে আবিষ্কার করল তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। বাবা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বড় মহারাজ এগিয়ে এলেন, ‘ধ্যানেশ!’
ধ্যানেশ উঠল। এখন নিজেকে তার প্রাণহীন শবের মত মনে হচ্ছে, যে-শব হাঁটতে পারে। আশ্রমের গাড়ি তাকে স্টেশনে নয়, পৌঁছে দিয়ে এল দূরপাল্লার বাসস্টপে। যে রাস তাকে আগামীকাল সকালে কলকাতায় পৌঁছে দেবে। যে আগামীকালে প্রতিটি সংবাদপত্রে আশ্রম থেকে প্রচারিত সংবাদে চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে বহিষ্কার করা হবে।
.
সকালবেলায় তিনু চুপচাপ বসেছিলেন কলকাতার বাড়িতে। গতরাতে তাঁকে আশ্রম থেকে সরাসরি জানানো হয়েছে এখন থেকে তিনি আর মহারাজ পদে নেই। সাধারণ শিষ্য হিসেবে তিনি তিনকড়ি রায় হিসেবেই আবার পরিচিত হবেন। বাবার অসীম দয়া যে, তাঁর শিষ্যত্ব লোপ করে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এটা যে কত বড় আঘাত তা তাঁর মুখের চেহারাতে স্পষ্ট। সারাটা রাত একবারও চোখ বন্ধ করতে পারেননি। মহারাজ পদ পাওয়ার পর তাঁর মনে অহঙ্কার জন্মেছিল। শুধু ছোটে মহারাজ উধাও হয়ে সেই অহঙ্কারের বেলুন ফুটো করে দিলেন। এতদিন নজরে রেখেছিলেন তিনি, বড় মহারাজের নির্দেশ যথাযথ পালন করেছিলেন এব্যাপারে, অথচ ঘটনাটি ঘটে গেল। ছোটে মহারাজ কখনও এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু সুধাময় সেন জানিয়েছেন যে ছোটে মহারাজ প্রায়ই কলেজ পালিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন! ওঁর অভিনয় তিনি কেন যে ধরতেই পারেননি! মহারাজ পদ লোপ পাওয়া মানে শুধু সম্মান নয, আর্থিক দিক দিয়ে প্রচণ্ড ক্ষতি তাঁর। তাঁর নিজস্ব শতাধিক শিষ্য আছে যারা প্রধান শিষ্যের পদ পেয়েছে। ওইসব প্রধানশিষ্য যে অজস্র শিষ্যদের দীক্ষা দিয়েছে তাদের প্রেরিত প্রণামীর একটা অংশ তো তাঁর কাছেও আসে ধর্মানুষ্ঠান সংগঠিত করার জন্যে। তিনি এখন সেই প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত! আশ্রমের মামলাগুলো তিনিই আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরিচালনা করেন। এই দায়িত্ব এখনও তুলে নেওয়া হয়নি। হতে কতক্ষণ! শ্যামবাজারের অধীর চন্দ্র মল্লিকের বসতবাড়ি তিনি গতকাল দখল করেছেন। এব্যাপারে ওঁর স্ত্রীপুত্র মামলা দায়ের করবেনই। পুলিশের কাছে ডায়েরিও করেছেন। কিন্তু তিনু মহারাজ, তখন তো তিনি মহারাজই ছিলেন, কোন ভুল করেননি। প্রথমেই পুলিশের বড়কর্তাকে জানিয়েছেন অধীর চন্দ্রের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে বাবার আদেশ পেয়েছেন। ইতিমধ্যেই আশ্রম থেকে অধীরের চিঠির জেরক্স তাঁর হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। পুলিশকর্তা বাবার শিষ্য। তিনি স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সহযোগিতা করার। সেইমত তিনুমহারাজ অধীর চন্দ্রের স্ত্রী ও পুত্রদের কাছে গিয়ে সবিনয়ে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। প্রস্তাব শোনার পর যেন তাঁদের মাথায় বাজ পড়েছিল। অধীরচন্দ্র যে এমন কাজ কখনই করতে পারেন না সেই বিশ্বাসের কথা বারংবার বলেছিলেন। তিনু মহারাজ অধীরচন্দ্রের চিঠির জেরক্স কপি ওঁদের দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাদের প্রয়াত গুরুভাই-এর নিকট-আত্মীয়। আপনাদের চট করে কোন বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে চাই না। কিন্তু অধীরবাবুর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানানো আমাদের কর্তব্য। আপনারা এই বাড়ির নিচতলাটা সাতদিন ব্যবহার করুন। ওপরের তলাটিতে আমরা বাবার আসন পেতে যাচ্ছি। শিষ্যভক্তরা নামগান করবেন। সাতদিনের মধ্যে আপনারা উপযুক্ত বাসস্থানে চলে যান।’
অধীরচন্দ্রের পুত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় আক্রমণ করেন আর কি, ‘এইসব ভাঁওতা আমরা মানি না। বাবা কবে কাকে কি লিখেছিলেন সেটা আইন হতে পারে না। ডিড দেখান। উইল দেখান। আপনারা কি এ-বাড়ি জবর দখল করছেন? আমরা মরে গেছি? এই শোকের সময়ে—’
তিনুমহারাজ আরও বিনীত হয়ে বলেছিলেন, ‘ওসব দেখালে তো আপনারা বুঝবেন না। যদি আপনাদের অভিলাষ হয় তাহলে আদালতকে দেখাতে পারি। তাছাড়া এসব করছি আপনার বাবার আত্মার শান্তির জন্যে।’ তিনুমহারাজের ইঙ্গিতে শিষ্যরা ওপরে উঠে গিয়েছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল নামগান। অধীরের আত্মীয়রা মরীয়া হয়ে বাধা দিতে চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। তারা বলে, ‘যদি আপনাদের মনে হয় আপনার বাবার গুরুভাইরা বেআইনি কাজ করছেন তাহলে থানায় এসে ডায়েরি করুন। কেস করুন। আইন আপনাদের সবরকম সাহায্য দেবে।’ তিনুমহারাজ সেইরকমই চেয়েছিলেন। পুত্রেরা থানায় চলে গেলে নামগান শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে কোর্টে আইনজ্ঞ মারফত আবেদন জানিয়েছিলেন তিনু, অধীর চন্দ্রের শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানাতে ইনজাংশন চেয়ে। এখন মামলা চলবে অনন্তকাল। সাতদিনের মধ্যে অধীরের স্ত্রীপুত্ররা যদি স্বেচ্ছায় একতলা ছেড়ে না যায় কেউ শক্তি প্রয়োগ করবে না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হবে যে, ওরা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। এই কলকাতা শহরে এমন অনেক ভক্ত ছিল যারা নিজেদের আবেগে বাবাকে সম্পত্তি সমর্পণ করেছে। সেই সম্পত্তি কিভাবে ধীরে ধীরে আইনসম্মত করে নেওয়া যায় তিনি জানেন। কোন বাড়ির একটি তলা বাবার কাজে লাগবে না। সেক্ষেত্রে আইনসম্মত অধিকার পাওয়ার পর মৃত শিষ্যের আত্মীয়দের কাছেই প্রস্তাব দেওয়া হয় সম্পত্তিটি কিনে নেওয়ার। বাধ্য হয়েই তারা রাজী হয়। এখন এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।
তিনকড়ি রায় ভেবে পাচ্ছিলেন না ছোটে মহারাজ কোথায় যেতে পারেন। পুলিশের কাছে এখনও ডায়েরি করা হয়নি। সুধাময় সেনের এজেন্সি হদিশ পায়নি। বাবা নিশ্চয়ই চুপচাপ নেই। আরও অন্য সূত্র থেকে তার খোঁজ-খবর চলছে বলে তিনকড়ির বিশ্বাস। এদের সবাইকে নাজেহাল করে ওই অল্পবয়সী নিষ্পাপ চেহারার যুবক কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে! একমাত্র তিনি যদি ওকে খুঁজে বের করতে পারেন তাহলে হয়তো বাবা প্রসন্ন হয়ে আবার মহারাজপদ ফিরিয়ে দেবেন। তিনকড়ি রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সামনে একটিই আশার আলো। এবং তখন তার ইউনিসের কথা মনে পড়ল। বাবার অত্যন্ত অনুগত এই লোকটি এককালে গুণ্ডা ছিল। তিনকড়ির অনেক কাজ সে করে দিয়েছে। টেলিফোনে কথা না বলে নিজে যাওয়াই ভাল। আর তখনই ভোরের হকার কাগজ দিয়ে গেল। উদাসীন চোখে নজর বোলাতে বোলাতে হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল নিচের দিকে ছাপা একটা ছোট খবরে। ‘ভারতবিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ধ্যানেশকুমার আশ্রমকর্তৃক বহিষ্কৃত।’
.
চারপাশে শুয়োরের পাল, আবর্জনা, মুরগিদের চিৎকার, সব মিলিয়ে জায়গাটা খুব জান্তব। ঘরটির দেওয়াল বাখারির, মাথার ওপরে টিনের ছাদ, রোদ বাড়লেই তেতে যায়। নিচে একটা নড়বড়ে তক্তপোষ ছাড়া কোন আসবাব নেই। সেই তক্তাপোষের ওপর চিত হয়ে শুয়েছিল যে সুদর্শন তরুণ তার গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। পরনের পাজামা আর পাঞ্জাবি এখন বেশ মলিন। ঘরে আর কোন মানুষ নেই। হঠাৎ একটি শুয়োর কাছাকাছি তীব্র একটানা চিৎকার করতেই সে চোখ খুলল। অলসভাবে বাম হাতের তালু দিয়ে চিবুকের দাড়ি ঘষল। তারপর হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা একটা বিড়ির বাণ্ডিল থেকে বিড়ি নিয়ে শুয়ে শুয়েই সেটাকে ধরাল। দুতিনবার টান মারতেই কাশি এল। কাশি গিলতে চেষ্টা করতেই সেটা আরও বাড়ল। সিগারেট বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস তার কোন কালেই ছিল না। ঠিক একমাস আগে কানাই-এর সঙ্গে খিদিরপুর ব্রিজের তলায় বসে সে সিগারেটে তালিম নিয়েছে। এখনও তেমন জুত করে ওঠেনি। এ তল্লাটে সিগারেট পাওয়া যায়নি বলে বিড়ির ব্যবস্থা। কিন্তু বিড়ি খেলেই শরীর গুলিয়ে ওঠে।
একমাত্র খিদে পাওয়া আর বাথরুম পায়খানা ছাড়া এখানে কোন অসুবিধে নেই। দুদিন এই জায়গায় চুপচাপ পড়ে আছে সে। সন্ধ্যের আগে সে ঘর ছেড়ে বের হয় না। খুব নিম্নজাতের বস্তি বলেই চারধারে নোংরা গন্ধ পাক খায়। প্রথম রাতে বমি হয়ে গিয়েছিল তার। সেটা দেখার পর কানাই জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কি সত্যি মন থেকে তৈরি নির্মল?’ সে মাথা নেড়েছিল, ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু এত অল্পে যদি বমি আসে, কাতর হও, তাহলে তো তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না।’
‘আমি পারব। শুধু অভ্যস্ত হতে যেটুকু সময় —’
‘আমি আজ রাত্রেই চলে যাচ্ছি। পরশু ফিরে আসব। যা খাবার আছে তাতেই চালিয়ে নিও। ঘর থেকে বেরিও না। পশুপতি তোমাকে মাঝে মাঝে দেখে যাবে। কেউ ডাকলে সাড়া দিও না। পশুপতি ছাড়া এই ঘরে কেউ ঢুকবে না।’ কানাই চলে গিয়েছিল।
পশুপতিকে দেখেছিল নির্মল। দড়ি পাকানো হাফপ্যান্ট পরা প্রৌঢ় এবং বৃদ্ধব মাঝামাঝি লোকটা গাঁজা খাওয়া চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিল প্রথম রাতে। কানাই-এর সঙ্গে ওর যোগাযোগ কিভাবে বা কতদিনের, প্রশ্ন করেনি নির্মল দুজনকেই। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকটা হিন্দীবাংলায় মেশানো কথা বলেছিল, ‘চা আনতে হবে?’
সকালবেলায় চা খাওয়ার অভ্যেস ছিল না নির্মলের। কিন্তু সারারাত না ঘুমিয়ে ওর প্রচণ্ড তেষ্টা পাচ্ছিল। তাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিল। কয়েকমাসের কলেজের মাইনে তার কাছে জমানো ছিল। তা থেকে দশটা টাকা দিয়ে বলেছিল, ‘চা বিস্কুট সিগারেট।’
পশুপতি একটা কেটলি নিয়ে ফিরে এসেছিল কিছুক্ষণ পরে। সঙ্গে বিস্কুট, বিড়ির প্যাকেট। জানিয়েছিল সিগারেট পাওয়া যায়নি। নিজে মগে চা খেয়েছিল, নির্মল গ্লাসে। অত বিশ্রী স্বাদ ও গন্ধের অর্ধতপ্ত তরল পদার্থ সে কোনদিন খায়নি। বিস্কুটটা তবু মচমচে থাকায় ভাল লাগল। চা খেয়ে পশুপতি বলল, ‘এই বালতিতে জল আছে। দুপুরে ভাত খাবেন?’
নির্মল মাথা নেড়েছিল। পশুপতি বলেছিল, ‘দেখি যদি আমি ফিরে আসতে পারি তো রাঁধব।’
.
পশুপতি দুপুরে আসেনি। সারাটা সকাল ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল নির্মল। দুপুরবেলায় প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে উঠে পড়েছিল। তখন থেকেই খিদে জানান দিয়েছিল। খিদের সময় বিড়ি ধরাতে ওই বোধটা চাপা পড়ে যায়। কাশি হতেই নিভিয়ে ফেলেছিল। আব তখনই মনে পড়েছিল বাবার মুখ। বড়দা আর মেজদার চেহারা। কি পরিমাণ খেপে যাবে ওরা তা অনুমান করতে অসুবিধা নেই। কোপটা পড়বে তিনু মহারাজের ওপর। ওই ধান্দাবাজ লোকটাকে বেশ শায়েস্তা করা গেল এবার। সবসময় ওর পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে রাখত। বাবার হাত সর্বত্র। কানাই ভরসা না দিলে সে পালাবার সাহসই করত না। তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল দর্শনে এম এ করার জন্যে। তারপর ওই বিশাল সাম্রাজ্যের ছোট মহারাজ হিসেবে পাকাপাকি বসতে হত। বড় মহারাজ তো এখন থেকেই আশ্রমের অনেক ক্ষমতা দখল করে রেখেছেন। মেজ মহারাজ সেই কারণে মনে মনে বড়কে ঈর্ষা করেন কিন্তু মুখে কিছুই বলেন না—এটা নির্মল স্পষ্ট টের পেত। কোটি কোটি টাকা এবং যার জন্যে কোন ট্যাক্স দিতে হয় না, কে হারাতে চায় বেফাঁস কথা বলে!
ধর্ম! খুব শৈশবেই তাকে ভোরবেলা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত ধর্মাচরণ করতে হয়েছে। শুধু যে কয়বছর মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকত সেই কয়বছর অনুশাসন কম ছিল। মামাও বাবার দীক্ষিত। বাড়ি সুদ্ধু সবাই। কিন্তু মা তাকে প্রশ্রয় দিতেন। খেলার মাঠ, কাঠি আইসক্রিম আর গল্পের বই পড়তে দিতেন চুপিসাড়ে। সম্ভবত ওই কারণেই মাকে কখনও সে আশ্রমের মা-জননী রূপে দেখতে পায়নি। মাকে একদিন সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ধর্ম মানে কি?’ মা একটা বই খুলে তাকে পড়তে বলেছিলেন কয়েকটা লাইন। ব্যাখ্যাটা আজও তার মনে বসে আছে, যাঁকে সকলেই চায় তাঁকে পাওয়ার সহায়ক যে কর্ম, তাই স্বভাবের ধর্ম। আর যা দুঃখ অশান্তি আনে, তাই অভাবের কর্ম। তা-ই অধর্ম। মা বলেছিলেন ‘যেটা তুমি সৎভাবে করবে সৎকাজের জন্যে সেটাই তোমার ধর্ম বলে মনে করবে। জেনো ধর্মাচরণ করলে মনে কখনও অশান্তি আসে না, কোন লোভ জাগে না, ক্ষমতা বাড়াবার জন্যে পরিকল্পনা করতে হয় না।’ বাবার সঙ্গে তখন তার যোগাযোগ কত কম। ছিল না বলাটাই ঠিক। উপনয়নের সময় বাবা তাকে খুব আদর করেছিলেন। ছোটে মহারাজ নামটা তখনই দেওয়া। আর নামকরণ হবার পর থেকে সে অবাক হয়ে দেখত বুড়ো বুড়ো মানুষেরা তার সঙ্গে কথা বলার সময় কেমন সমীহ করে বলছে। একদিন একজন বৃদ্ধা তো তাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল তাঁর জলের পাত্রে পায়ের বুড়ো আঙুল ডুবিয়ে দেবার জন্যে। লজ্জায় পালিয়ে এসে বেঁচেছিল। কিন্তু একটা খারাপ লাগা মনের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল। এবং যেদিন এক বৃদ্ধ আনন্দভবনের সামনে বুক চাপড়ে বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘কিসের তুমি বাবা, আমার সবেধন নীলমণিকে বাঁচাতে পারলে না, কিসের তুমি ভগবান। কেন বলেছিলে ও সেরে যাবে? জবাব দাও! এতদিন ধরে তোমাকে আমি এই জন্যে জীবন দিয়েছি যে তুমি আমায় মিথ্যা স্তোক দেবে? তুমি কেউ নও, কেউ নও। তোমার কোন ক্ষমতাই নেই!’ বৃদ্ধকে আর বেশী কথা বলতে দেয়নি সেবকরা প্রায় জোর করেই টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আড়ালে। সেই বৃদ্ধকে আর কোনদিন দ্যাখেনি সে। কিন্তু লোকটার শোকার্ত মুখ বুকের পাঁজর নাড়িয়ে দিয়েছিল।
বুজরুকি? এক্সপ্লয়টেশন? কানাই তো তাই বলে। কিছু লোক কোন কাজ না করে একটি ভগবান-ভগবান টাইপের মানুষকে খাড়া করে লক্ষ লক্ষ ভক্তকে এক্সপ্লয়েট করে যাচ্ছে, প্রতিদিন। তাদের সঙ্গে রেষারেষি করে আরও কিছু মানুষ আরও একাধিক দেবতামার্কা লোককে নিয়ে শিষ্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে এদেশে। একই হিন্দুধর্ম নিয়ে ভারতবর্ষে চমৎকার ব্যবসা করা যায়। কানাই বলেছিল, ‘লক্ষ করে দ্যাখো, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে কতগুলো যোগী, মহর্ষি, আচার্য, বাবা, ব্রহ্মচারী রয়েছেন। প্রথম সারির গুরুর সংখ্যাই অন্তত দশজন। দ্বিতীয় সারিতে পঞ্চাশ আর তার পরে কোন হিসেব নেই। ইতিমধ্যে ইমেজ খারাপ করে ফেলেছেন কেউ কেউ। যাঁরা ইমেজ বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন তাঁদের শিষ্যসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। একই ধর্মের এত মহাপুরুষ এদেশে একত্রিত অথচ তাঁরা এক হতে পারছেন না। কেন? হলে যে নিজেদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ভারতবর্ষে এত সব নেতা রাজনীতি করেন, পশ্চিমবঙ্গে এত বামপন্থী দল ক্ষমতায় আছেন, কেউ কখনও ভুলেও এঁদের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করেন না। কারণ মনে মনে সবাই এঁদের ভয় পান।’
কানাই-এর কথাগুলো যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল নির্মলের। ভারতবর্ষের মানুষ আসলে ধর্মভীরু। ধর্মের কোন আসল চেহারা এদের কাছে স্পষ্ট নয়। যা অলৌকিক তাই যেন ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। অথবা ধার্মিক হলে কিছু পাওয়া যাবে। যে লোকটা সারাজীবন ঠাকুরের সামনে বসে পুজো করে গেল তার ছেলের যদি ক্যান্সার হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে অত ধার্মিক মানুষকে ঈশ্বর কেন এমন শাস্তি দিলেন? পার্থিব কিছু পাওয়া না গেলেও যেহেতু আমি গুরুর চরণাশ্রিত তাই গুরু আমার সংসারে কোন অশান্তি আনতে দেবেন না। ছেলে হচ্ছে না গুরুদেব দয়া করুন, অসুখ হয়েছে গুরুদেব আপনি ভাল করে দিন, চাকরির ইন্টারভিউ পাওয়া গিয়েছে গুরুদেব আপনি চাকরিটা পাইয়ে দিন। এই যে নিরন্তর চাওয়ার জন্যে একটা জায়গা তৈরি হয়, এরই জন্যে শিষ্যত্ব গ্রহণ করা। সব মানুষ তো সব গুরুর শিষ্য হয় না। যারা মহর্ষি প্রাণদীপের শিষ্য হয়েছে তারা নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে আকাঙ্ক্ষা মেটাবার আশ্বাস পেয়ে থাকে। সেই আকাঙ্ক্ষা না মিটলে আবার আর একজন গুরুর কাছে আশ্রয় নেওয়া। বাবার ক্ষমতা যেহেতু বেশি তাই তাঁর শিষ্যসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বাবা বলেন, ‘তাঁর কাছে জাতপাতের স্থান নেই, তাঁর ধর্মে সঙ্কীর্ণতার ছায়াও নেই। তিনি যে কোন আশ্রিতকেই আশ্রয় দিতে চান অবশ্য সেই মানুষের আশ্রয় চাইবার আকাঙ্ক্ষা যদি সত্যি হয়।’ অথচ বাবা প্রণাম গ্রহণের পর প্রতিদিন নিজের পা ডেটলজলে ধুয়ে নেন। হাতের আঙুল আশীবাদ শেষ হলে সাবানে নির্মল করেন। কোন অব্রাহ্মণ তাঁর দুনম্বর ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। এবং স্নানের আগে তিনি ‘সেবিকাদের সামনেই নিরাবরণ হন নিজেকে ষড়রিপুর ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন প্রমাণ করতেই। বড় ও মেজ মহারাজ অবশ্য এখনও সেই স্তরে পৌঁছাননি।
নির্মল তক্তাপোষ থেকে নেমে বালতি থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে গলায় ঢালল। এখন তার খুব ইচ্ছে করছিল স্নান করতে। এভাবে কতদিন এখানে থাকা সম্ভব হবে কে জানে।
হঠাৎ বাইরে প্রচণ্ড সোরগোল শুরু হয়ে গেল! রমণীরা পৃথিবীর অশ্লীলতম ভাষায় পরস্পরকে গালাগালি করছে। পুরুষদের গলাও কানে এল। এত খারাপ কথা নির্মল কখনও শোনেনি। এবং এর মধ্যেই কেউ এসে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল, ‘পশুপতি, এ পশুপতি, ভীমরুকো জার ভীমরুকো মার ডালা। এ পশুপতি!’ নির্মল কাঁটা হয়ে বসে রইল। কয়েকবার ডাকাডাকি করার পব সম্ভবত হতাশ হয়েই লোকটা চলে গেল। এবং তার কিছুক্ষণ বাদেই সশব্দে বোমা ফাটতে লাগল। মানুষ শুয়োর এবং মুরগির চিৎকার একত্রিত হয়ে নির্মলকে সন্ত্রস্ত করে তুলল। ওর মনে হল এখান থেকে ছুটে পালাতে পারলে বেঁচে যাবে। কিন্তু এখন এই পরিবেশে বাইরে বেরুলে আর দেখতে হবে না। ঢোকার সময়টা ছিল ভর দুপুর। বস্তিতে লোকজন ছিল কম। কানাই তার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে বলতে এসেছিল যে সে এখানকার খুব পরিচিত এবং সম্ভবত সেই কারণেই কেউ তাদের তেমন করে লক্ষ করেনি। এখন ৰাইরে পা দিলেই হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যেজন্যে এখানে আশ্রয় নেওয়া তাই বানচাল হয়ে যাবে।
একটু একটু করে গোলমাল কমে এল। মেয়েটি কিন্তু থেকে থেকেই অশ্লীল গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের চরিত্র পৃথিবীতে আছে তা নির্মলের ধারণায় ছিল না। বাবা যদি তাঁর শিষ্যদের মধ্যে এই এমন একজনকে পেতেন তাহলে আনন্দভবনের চেহারা কি হত ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। হিন্দী ভাষাভাষি এই বস্তির লোক কি ধর্মালোচনা করে না? যে বঙ্গরমণীটি হিন্দী ভাষাভাষিণীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করেছিল তার শব্দ ভাণ্ডারে ছিল নারী এবং পুরুষের গোপন অঙ্গগুলোর বিকৃত নামাবলী। মানুষ যা বহন করে জন্ম থেকে অথবা প্রকৃতির নিয়মে যা শরীরে ক্রমশ আবির্ভূত হয় তা কেন অপরকে আঘাত করার জন্যে শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, নির্মলের অবাক লাগল। যদিও সে সব শব্দের অর্থ স্পষ্ট বুঝতে পারেনি, তবু অনুমান, একটা আবছা ধারণা ছিল।
কলেজে ভরতি হবার পর যে জিনিসটা তাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছিল তা হল দুদল ছেলেমেয়ের রাজনীতি। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে কলেজের মাধ্যমে দেশের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা তাকে বিভ্রান্ত করেছিল। ভরতি হবার সময় মেজ মহারাজ এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার কাজ হবে পাঠ ত্বরান্বিত করা। এই কলেজ কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত, অতীত এবং বর্তমানেও। শুধু তুমি ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে। ছাত্র রাজনীতি সবসময়েই জেনো অন্তঃসারশূন্য হয়। কলেজের দেওয়ালে যেসব পোস্টার দেখবে তা আমাদের সময়েও দেখেছি। বছরের পর বছর ওই পোস্টারগুলোর ভাষা ও বক্তব্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। তাহলে এদের আন্দোলনের ফল কি, বুঝতেই পারছ। কলেজে যারা মাতব্বরি করতে চায় তারা তা করুক। তুমি এসব থেকে দূরে থেকো।’ প্রথম প্রথম তাই সে থাকত। এইসময় কানাই-এর সঙ্গে তার পরিচয়। খুব ভাল রেজাল্ট করে কানাই এই কলেজে ভরতি হয়েছিল। কলেজ ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে ওর কোন সংস্রব ছিল না। প্রসঙ্গ উঠলে বলত, ‘এরা সব এ্যাপ্রেন্টিসশিপ করছে। এই করতে করতে দাদাদের দয়ায় যদি পার্টি অফিসে কল্কে পায় তো বর্তে যাবে।’ অথচ কানাই নিজেও প্রত্যহ ক্লাশ করত না। নির্মলকে সেবকরা কলেজে পৌঁছে দিচ্ছে দেখে ওর সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল পরিচয়। সেটা জেনে সে হেসে বলেছিল, ‘বাঃ, তুমি তো এ দেশের সম্রাটের পুত্র হে। বাঃ, চালিয়ে যাও।’
নির্মল অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল কথাটার মানে কি? কানাই হেসে বলেছিল, ‘এ দেশের রাজনীতিতে শাসকরাই রাজা। পাঁচ বছরের জন্যে। কিন্তু একবার ক্ষমতা হাতে পেলে এমনভাবে কাজ গুছিয়ে নেয় যে খুব মারাত্মক ভুল না করলে কয়েকটা পাঁচ বছরের জনা সিংহাসন অটুট। কিন্তু যতই কম্যুনিজমের অথবা সোস্যালিজমের কথা বলুক, ওরা জানে জনসাধারণ ওসব কানে ঢোকায় না। তারা ধর্মের নামে এখনও টলোমলো। ধর্ম এ দেশের অর্থনীতি রাজনীতিকে তাই কন্ট্রোল করে চলেছে। তাই রাজারা ধর্মগুরুদের শরণাপন্ন হয়। তেনারা যদি প্রসন্ন হন তো শিষ্যদের ভোট পকেটে এসে যাবে। এখন বল তুমি সম্রাটের পুত্ৰ কিনা!’
ব্যাখ্যা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল নির্মল। তার মনে পড়ল ছোটবেলা থেকেই সে আশ্রমে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের আসা-যাওয়া করতে দেখেছে। মন্ত্রী বা সচিবেরা অবশ্যই বিশেষ আপ্যায়ন পেয়েছেন কিন্তু বাবার দর্শনের জন্যে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাবার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়তেও সে দেখেছে তাদের কাউকে। নির্বাচনের আগে ওদের আসা-যাওয়া বেড়ে যেত। এসব কথা আগে কখনও ভেবে দ্যাখেনি নির্মল। কানাই-এর কথায় মনে পড়ছিল সব। ক্রমশ সে কানাই-এর প্রতি আকৃষ্ট হল। তার নিজস্ব উপলব্ধির কথা সে বলতে লাগল কানাইকে। একটু একটু কবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব জন্মাল। কানাই কিছু লিফলেট পড়তে দিল তাকে একদিন। বলল খুব গোপনে রাখতে। তিনুমহারাজের লোকজন তার বইপত্র ছুঁয়ে দেখার সাহস করত না, প্রয়োজনও ছিল না। সেই সব লিফলেটের লাইন থেকে কানাইকে চিনতে পারল নির্মল। এ দেশের রাজনীতি নিজস্ব অথবা পার্টি সর্বস্ব রাজনীতি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিটেফোটা। শুধু দালালি করার জন্যে ওরা নির্বাচনে নামে। রাজনীতি যেমন মানুষকে বিভ্রান্ত করে তেমনি ধর্মগুরুরা তাদের ড্রাগ খাওয়ায়। রাজনৈতিক নেশা মুষ্টিমেয় মানুষের আর ধর্মভয় প্রায় সমস্ত দেশের। যেহেতু দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে মানুষেরা বাধ্য হয় জীবনযাপন করতে তাই তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যেতে বাধ্য। এই আত্মবিশ্বাসের অভাবকে এক্সপ্লয়েট করে ধর্মগুরু এবং রাজনৈতিক দল। প্রথম পক্ষ যেহেতু দ্বিতীয় পক্ষের থেকে প্রচুর শক্তিশালী, তাই তারা কখনই অস্বীকার করার চেষ্টা করে না। বরং বলা যায় কোনরকম সাযুজ্য না থাকা সত্ত্বেও পরস্পর বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। এই পরিস্থিতিতে একসময় এদেশে বিপ্লবের ডাক দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁদের আবেগ বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অন্ধত্ব এনে দিয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ ছিল দর্শকের ভূমিকায়, তাঁদের চেষ্টা তাদের ঘরের মত ভেঙে পড়েছিল। এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষিত করেছে। প্রথমে ভূমি প্রস্তুত করা উচিত। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে তারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বোঝানোর কাজ এগিয়ে গেলেই মাটি তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, এই কাজ সহজসাধ্য নয়। শাসক দল তো বটেই, বিরোধীরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে পদে পদে বাধা দেবে। কিন্তু আমাদের প্রধান কাজ হবে দেশের মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা।
কানাই বলত, ‘শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার চিন্তা এই মুহূর্তে অবাস্তব। কিন্তু মানুষকে মনুষ্যত্বের সম্মান দেওয়ার মত পরিবেশ তৈরি করা তো আকাশকুসুম নয়।’
খিদিরপুরের ব্রীজের নিচে পৃথিবীর সবরকম নেশারুদের ভিড়। ড্রাগ থেকে সাপের ছোবল কিছুই বাদ যায় না। পুলিশ জানে ওখানে যারা যায় তারা তেমন কোন ভয়ঙ্কর মানুষ নয়। নেশা করে করে এরা নিজেদেরই ধ্বংস করছে। অতএব এদের মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে আসা ছাড়া পুলিশ সময় নষ্ট করতে চায় না। যারা নেশার জিনিস বিক্রী করে তারা যদি নিয়মিত দক্ষিণা দিয়ে যায় তাহলে কথাই নেই।
কানাইরা এই জায়গাটিকে বেছে নিত মাঝে মাঝে আলোচনা করার জন্যে। ওখানে নির্ভেজাল গাঁজাও বিক্রি হত। বিক্রেতাদের সন্দেহ যাতে না পড়ে, তাই গাঁজা কিনে নিত ওরা। একপাশে গোল হয়ে বসত। গাঁজা ফেলে দিয়ে তাতে সিগারেটের তামাক ভরে টানত সবাই। আর কথা হত। কানাই-এর সঙ্গে দুদিন গিয়েছে সেখানে নির্মল, কলেজ পালিয়ে। একদিন একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। একটা সিড়িঙ্গে মত লোক এসে কানাইকে বলেছিল, ‘বাবু, আপনারা এখানে এসে কেন যে মাঝে মাঝে গাঁজা খান বুঝি না। রাজার নেশা করুন।’ কানাই জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘রাজার নেশা?’ লোকটি বলেছিল, ‘আসুন দেখাচ্ছি।’ ওকে অনুসরণ করে ওরা ব্রীজের নিচে সব চেয়ে নোংরা কোণে চলে গিয়েছিল। সেখানে একজন হাড় জিড়জিড়ে কালো মানুষ বসেছিল। লোকটার জামাকাপড় দেখে মনে হচ্ছিল বেশ সম্পন্ন অবস্থা। সিড়িঙ্গেকে দেখেই খিঁচুনি শুরু হয়েছিল, ‘বাঃ চমৎকার! আমি কি দাম দিই না? কখন থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছি আর তোমার দেখা নেই চাঁদু। আরে যদ্দিন ছবি না হচ্ছি তদ্দিন সময়মত এসো চাঁদু। এরা আবার কে?’
সিড়িঙ্গে বলল, ‘আমার জানপয়চান। আপনার নেশা করা দেখবে। টাকা দিন।’
লোকটা টাকা দিতেই সিড়িঙ্গে লোকটা চলে যাচ্ছিল। তাকে থামাল লোকটা, ‘শোন, ফেরেব্বাজী আমি একদম বরদাস্ত করতে পারি না। সেদিন দুটোর বিষ ছিল না। দেখো।’ সিড়িঙ্গে চলে গেলে লোকটা বলেছিল, ‘দেখতে তো নাড়ুগোপাল, এ শখ হল কেন? সব নেশা হয়ে গেছে? সিগারেট, গাঁজা, মদ, চোলাই, ট্যাবলেট? ওসব না সেরে রাজার নেশায় আসা কেন? এই দাঁত দেখছ? যদি কাউকে কামড়ে দিই সে চোখ ওল্টাবে।’
কানাই জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘রাজার নেশা না করলেই নয়।’ লোকটা হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘নেশাটাই তো রাজা বানায় হে।’
সিডিঙ্গে ফিরে এল একটা মাঝারি কৌটো নিয়ে। নির্মল দেখল কৌটোর ঢাকনায় গোটা ছয়েক ফুটো গায়ে গায়ে। ফুটোগুলো খুব সরু। আর শব্দ থেকেই বোঝা যাচ্ছে কৌটোর ভেতরে যারা রয়েছে তারা বেশ ক্ষিপ্ত। শব্দ শুনেই লোকটা উল্লসিত মুখে হাত বাড়াল। সিড়িঙ্গে বলল, ‘আজ একটু সাবধানে নেবেন রাজাবাবু। ওস্তাদ বলে দিল দুটোর দাঁতে বেশি বিষ জমে গেছে।’ লোকটা খুশিতে মাথা নাড়ল, ‘সাবাস, দশটার সময় ডেকে দিবি। তারপর ধীরে ধীরে কালচে নীল জিভ বের করে ঠেকাল ফুটোগুলোর ওপরে। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল শরীর। সিডিঙ্গে রিলে করছিল যেন, ‘ছোবল মারছে। বিষ ঢালছে। মুখ দেখুন, কি আরামই না পাচ্ছে। প্রথম প্রথম একটা সাপ, একবার ছোবল। তাতেই কয়েক ঘণ্টার জন্যে মুক্তি। রাজার নেশা বটে।’
নির্মল জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘সাপের বিষে মানুষ মরে যাবে না?’
‘না গো। মারবার মত শক্তি নেই ও বিষের। সবে গরল জমছে যে সাপের তাকেই তো কৌটোয় পোরা হয়। নেবেন বাবু?’ সিড়িঙ্গে প্রশ্ন করতেই লোকটা কৌটো নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। ওর চোখ স্থির। হাত পা নড়ছে না।
কানাই আঁতকে উঠল, ‘মরে গেল নাকি?’
সিড়িঙ্গে বলল, ‘দূর মশাই। কয়েক ঘণ্টার জন্যে ঘুমবে। রাত দশটায় ডেকে দিতে বলল একটু আগে, শুনলেন না?’
সিড়িঙ্গেকে কাটিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটতে হাঁটতে কানাই বলেছিল, ‘সারাদেশের মানুষ ওইভাবে জিভ এগিয়ে দিচ্ছে। আর রাজনীতি এবং ধর্ম সাপ হয়ে ছোবল মেরে যাচ্ছে।’ খুব নাড়া খেয়েছিল কথাগুলো শুনে নির্মল।
.
সন্ধ্যে হয়ে গেলেও ঘরে আলো জ্বালতে পারল না নির্মল। কাল রাত্রে ওই কোণে একটা কুপি দেখেছিল। আলো দেখে যদি কারো সন্দেহ হয়। খানিকপরে দরজায় শব্দ হল। পশুপতি যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল তিনবার টোকা দিলে তবে যেন সে দরজা খোলে। টোকাগুলো গুণে হাতড়ে হাতড়ে দরজায় পৌঁছে সে ওটাকে খুলল। আর তখনই কেউ একজন চিৎকার করে বলল, ‘পুলিশ এসেছিল, ভীমরুর বউকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’ পশুপতির গলা পাওয়া গেল, ‘ঠিক করেছে। ঘরে ঢুকে লোকটা কুপি জ্বালল। তারপর একটা বড় ঠোঙা এগিয়ে দিল, ‘দুপুরে টাইম মিলল না। এইটা খেয়ে নিন।’
কচুরি আর তরকারি। অমৃত বলে মনে হল নির্মলের কাছে। খাওয়া হয়ে গেলে পশুপতি বলল, ‘আপনি এখান থেকে চলুন। কানাইবাবুর লোক এসেছিল। বলেছে হাওয়া খুব খারাপ। ন’বাজে একটা টেরেন আছে হাওড়া ইস্টিশান থেকে, এই ঠিকানা। আপনাকে আজই চলে যেতে হবে! এ বস্তিতে কেউ কেউ সন্দেহ করেছে আমার ঘরে লোক আছে।’
চটজলদি বেরিয়ে পড়ল নির্মল পশুপতির সঙ্গে। অন্ধকার বলে একটা আড়াল পাওয়া গেল। কেউ কিছু বোঝার আগেই বড় রাস্তায়। আলোর নিচে দাঁড়িয়ে ঠিকানাটা পড়ল সে। অবিনাশচন্দ্র দে। স্কুল শিক্ষক। স্কুলের মাঠের পেছনে। কোলাঘাট।’ হাওড়া স্টেশন থেকে কোলাঘাট কতদূর জানা নেই নির্মলের। এইসময় একটা বাস আসছিল। পশুপতি তাগাদা দিল, ‘উঠে পড়ন বাবু, এই বাস ইস্টিশান যাবে। উঠে পড়ুন।’
ভিড় বাস ঠেলে ওপরে উঠল নির্মল। মানুষের চাপে, ঘামের গন্ধে তার শরীর খারাপ করতে লাগল। প্রাণপণে নিজেকে ঠিক রাখছিল সে। যেন অনন্তকাল সময় নিয়ে বাস হাওড়া স্টেশনে পৌঁছল। মানুষের স্রোতে গা ভাসিয়ে সে যখন পৌঁছে গেল প্লাটফর্মে তখন জানল সামনের ট্রেনটাই কোলাঘাটে থামবে। টিকিট হয়নি, সেটা কোথায় পাওয়া যায় তাও জানা নেই, নির্মল আর দেরি করল না। ট্রেন ছাড়বার মুহূর্তে চেপে বসল।
.
খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চুপচাপ বসেছিল ধ্যানেশকুমার। এই কয়ঘণ্টায় লোকটার বয়স যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। চোখের তল বসে গেছে, মুখের চামড়ায় কালচে ছায়া নেমেছে। ঝড়ের আসল দাপটে যখন একটি বৃক্ষ পত্রশূন্য হয় তখনও তার নতুন করে প্রকাশিত হবার সুযোগ থাকে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সব শেষ হয়ে গেল। এখন আত্মহত্যা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। বাবার মুখ মনে করল সে। স্নেহহীন অমন মুখ সে কখনও দ্যাখেনি। হঠাৎ ধ্যানেশকুমারের রাগ হল ছোটে মহারাজের ওপরে। ছেলেটা যদি না পালাতো তাহলে তার এমন দুর্দশা হত না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল ওই স্ত্রীলোকগুলোকে সে মনেই করতে পারছে না যাদের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে নগ্নছবিগুলো তোলা হয়েছে। কারা তুলল? বাড়িতে ফিরেই সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ড্রাইভার বলছে সেই রাত্রে সে নাকি আশ্রমের চত্বরে রাখা গাড়িতে উঠে বসেছিল। ড্রাইভার নিজেও স্টিয়ারিং-এ বসতে এগিয়েছিল। তারপর যখন তার চেতনা এল তখন সে পার্ক স্ট্রীটে। ওখানে কি করে গেল তা সে জানে না। ধ্যানেশ লোকটাকে বিশ্বাস করল। কিন্তু ধাঁধাটার সমাধান করতে পারল না।
কিন্তু টেলিফোনের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে সে রিসিভার নামিয়ে রাখল। ওইটুকুনি খবর অথচ সবাই দেখেছে। শেষ ফোন করেছিল রেকর্ড কোম্পানির মালিক, ‘ধ্যানেশবাবু, খবরটা কি সত্যি? সর্বনাশ হয়ে গেল। আপনার লেটেস্ট ভজনের রেকর্ড এই সপ্তাহেই বাজারে বেরুবে। কিন্তু এ খবরের পর কেউ তো কিনবে না।’
‘কেন?’ ভাঙা গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল ধ্যানেশ।
‘আরে মশাই,আপনি চরিত্রহীনতার কাজ করেছেন বলে আশ্রম থেকে জানানো হয়েছে। আপনার গলায় বাবার ভজন ভক্তরা শুনতেই চাইবে না। আরে সবাই তো সব কিছু করে, কিন্তু সেটা লুকিয়ে রাখার কায়দা জানতে হয়। নিজেও ডুবলেন আমাকেও ডোবালেন।’ লোকটা যে ভবিষ্যতে আর যোগাযোগ করবে না সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। এর ওপর সকাল থেকে সাংবাদিকরা তার সঙ্গে দেখা করবে বলে তাগাদা দিয়ে আসছে। সে বলে পাঠিয়েছে অসুস্থ। তবু কেউ বাড়ি ছেড়ে নড়ছে না। ধ্যানেশকুমারের মুখ থেকে কিছু কথা শুনতে চায়। বাবা বলেছিলেন ইউনিস তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে প্রয়োজন হলে। কিন্তু তাকে তো নিষেধ করেননি যোগাযোগ করতে। লোকটাকে চেনে ধ্যানেশ। পার্ক সার্কাস ময়দানে প্রতিবছর বিরাট জলসার আয়োজন করে ইউনিসের সাকরেদরা। তখন তাকে যেতেই হয়। ধ্যানেশের নামে ভাল টিকিট বিক্রি হয়। ধ্যানেশ প্রায় দৌড়ে এসে টেলিফোন টেনে নিল। ইউনিসকে পাওয়া গেল একবারেই। মাঝে মাঝে এই কলকাতার সবকিছু কেমন ঠিকঠাক চলতে শুরু করে! ধ্যানেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘ছোটে মহারাজের খবর পেলেন ইউনিসভাই?’
ইউনিস নির্লিপ্ত হয়ে বলল, ‘এর উত্তর তো শুধু আশ্রমকেই দেবার কথা আমার।’
ধ্যানেশ অসাড় হল। ইউনিস এর মধ্যেই পাল্টে গিয়েছে। এই পরিবর্তন হবে সবখানে। সে আব কথা বলতে পারছিল না। ইউনিস জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কিছু বলবেন?’
‘আমি একটা চক্রান্তের শিকার হলাম ইউনিসভাই। আমি নিরপরাধ।’
‘আপনি সেটা ভাল জানেন।’
‘কিন্তু আমি কি করব? আমি বাবার সেবা করতে চাই।’
‘আমি কি বলতে পারি বলুন! নিজের মনে সেবা করুন। মন্দির-টন্দির করুন। আচ্ছা, প্রয়োজন হলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।’ লাইন কেটে দিল ইউনিস।
রিসিভার ধরে কিছুক্ষণ বসে বইল ধ্যানেশ। এই কয়বছরে যে সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছিল তা ভেঙে গেল। কিন্তু তার নিজের যে সাদা এবং কালো টাকা রয়েছে তা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। বেঁচে থাকার পক্ষে তা দুই জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। সে চাকরকে ডেকে বলল, ‘সাংবাদিকদের বল আমি ওদের সঙ্গে দেখা করব।’
স্নান করেও শরীরের ধকল গেল না। মনের ওপর পাথরচাপা থাকলে শরীর সেটা প্রকাশ করেই। বাইরের ঘরে ঢুকে ধ্যানেশ দেখল জনা বারো সাংবাদিক বসে আছেন। তাকে দেখামাত্র প্রশ্নগুলো তীরের মত আসতে লাগল, ‘আপনাকে আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? বাবা আপনার সংস্রব ত্যাগ করেছেন? কি ধরনের চরিত্রহীনতার কাজ আপনি করেছেন? আপনি কি বাবার আদর্শে আঘাত করেছেন? নারীঘটিত ব্যাপার বলে ইতিমধ্যেই কিছু খবর প্রচারিত হয়েছে, সেটা কি সত্যি? বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আপনার প্রফেসনাল লাইনে কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে?’
ধ্যানেশ জানত প্রশ্নগুলা এইরকমই হবে। তার আশঙ্কা ছিল তার সেই সব ছবি যদি এবা সঙ্গে করে আনে তাহলে কি জবাব দেবে! বাবা ঠিকই বলেছেন যারা ছবি পাঠিয়েছে তারা কপিগুলো খবরের কাগজেও পাঠাতে পারে। কিন্তু এরা এখনও খবরটা পায়নি বলেই মনে হচ্ছে যদিও সেটা বেশিদিন চাপা থাকবে না।
প্রশ্নাবলী শেষ হলে ধ্যানেশ একটা চেয়ারে বসল। খুব চেষ্টা করছিল নিজেকে শান্ত রাখতে এবং ধীরে ধীরে কথা শুরু করল, ‘আমি বাবার শ্রীচরণে আশ্রিত। তিনিই আমার ইহকাল পরকাল। কিন্তু আমরা জানি ঈশ্বরেরও শত্রু আছে। দেবতাদের বিরুদ্ধে দানবরা চিরকাল যুদ্ধ করেছে। যদিও পরিণতিতে দানবদের পরাজয় অনিবার্য কিন্তু পরিবেশ নষ্ট করতে তাদের জুড়ি নেই। এই দেব-দানবের যুদ্ধে আমি বলি হয়েছি। মিথ্যে ঘটনায় আমার চরিত্রে কালি ছিটিয়েছে তারাই যারা বাবার ক্ষতি করতে চায়। প্রাণ থাকতে সজ্ঞানে আমি এমন কিছু করতে পারি না যাতে বাবার অসম্মান হয়। অজ্ঞান করে যদি কিছু করা হয় আমাকে নিয়ে তাহলে কিছু বলার নেই। আশ্রমের সম্মান, বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় আমি ওই আদেশ মেনে নিয়েছি। কিন্তু বাবার প্রতি অনুরক্ত আমি। বাবার নামগান করে যাব শেষদিন পর্যন্ত।’
একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই দানবরা কারা? কি নাম?’ ‘বাবার প্রতি ঈর্ষাকাতর সংঘবদ্ধ কিছু মানুষকেই আমি দানব বলেছি। নাম বলতে পারব না এখন কিন্তু সময় হলেই প্রকাশ করব।’
দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চরিত্রহীনতার ঘটনাটা বলবেন?’
‘আমি চরিত্রহীন নই। বাবার চরণাশ্রিত মানুষ চরিত্রহীন হতে পারে না। কিন্তু ধরুন আপনাকে অজ্ঞান করে মুখে মদ গুঁজে যদি বলা হয় আপনি মদ্যপ তাহলে দর্শকরা আপত্তি করবেন না। আমার ক্ষেত্রে এইরকম অবস্থা হয়েছে।’
‘আপনি এখন কি করবেন?
‘এখন আমার আত্মপ্রমাণের সময়। যতদিন নিজেকে শুদ্ধ প্রমাণ করতে না পারব, ততদিন জলসা রেকর্ড অথবা সিনেমায় গান গাইব না।’
সাংবাদিকবা খবর পেয়ে খুশি, ‘কি করবেন এখন?’
‘কলকাতায় বাবার নামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করব।’ ইউনিসের কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় উত্তেজিত হল ধ্যানেশ, ‘সেই মন্দিরে নামগান করব। আমার গুরুভাইরা স্বচ্ছন্দে আসতে পারেন সেখানে। আমি জানি না এতে কারো আপত্তি হবে কিনা!’
একজন প্রশ্ন করলেন, “বিখ্যাতা অভিনেত্রী সুমিতা সোমকে নিয়ে আপনার সম্পর্কে যে গল্প চালু আছে সেটাই কি বাবার ক্রোধের কারণ? ‘
‘সুমিতা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। বাবা সত্যদ্রষ্টা। তিনি এমন ভুল করবেন না।’
.