জন-যাজক – ১

লিফটের দরজাটা খুলে সন্তর্পণে যে লোকটি নামল তার ডান হাতের সুদৃশ্য ট্রেতে টি পট, পেয়ালা, ডিস, দুধ চিনির চীনেপাত্র, কাচের বাটিতে আলাদা করে মাখন এবং জেলির পাশে হালকা সেঁকা পাউরুটির ফালি তারের জাল দেওয়া ঢাকনার নিচে বন্দী। কয়েক পা হেঁটে বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু শব্দ তুলল সে। এই সকালেও লোকটির স্নান হয়ে গেছে। পরনের সাদা আলখাল্লার মত পোশাকে বিন্দুমাত্র ময়লা নেই। দ্বিতীয় বারের আওয়াজের পরেও ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে লোকটা ঈষৎ অসহিষ্ণু হল। তৃতীয়বারে সে একটু জোরেই আঘাত করল।

লোকটি ডান দিকে সরে গিয়ে একটা টুলের ওপর ট্রে রেখে পকেট থেকে চাবির তোড়া বের করল। তারপর নম্বর মিলিয়ে চাবি বেছে দরজার গর্তে ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই সেটা ধীরে ধীরে খুলতে লাগল। পুরো না খুলে লোকটা থেমে গেল। তারপর খুব বিনয় মিশিয়ে উচ্চারণ করল, ‘ছোটে মহারাজ!’

ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না। লোকটা দরজাটা খুলে দিল। তিনটে ঘর। কোথাও ছোটে মহারাজের পাত্তা নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে আতঙ্কিত মুখে ছুটে গেল টেলিফোনের দিকে। বোতাম টিপতেই নিচের রিসেপশন থেকে সাড়া মিলল। লোকটা তড়িঘড়ি জানাল ছোটে মহারাজ তাঁর ফ্ল্যাটে নেই। যে শুনল সে চিৎকার করে উঠল।

এই বাড়ির সিঁড়ি দোতলা পর্যন্ত। তিনতলাটা পুরো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ওই তলায় লিফটের দরজা কালে ভদ্রে খোলে। চারতলার ফ্ল্যাটের সামনে মিনিট চারেকের মধ্যে চারজন চিন্তিত লোক একত্রিত হল। এদের ওপর নির্দেশ আছে ছোটে মহারাজের দেখা-শোনা করার। ছোটে মহারাজ যখন কলেজে যান তখন এদের একজন গাড়িতে সঙ্গে থাকে। তিনি কলেজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। এ বাড়িতে ছোটে মহারাজের কোন বন্ধুবান্ধবের প্রবেশ নিষেধ। সেই ছোটে মহারাজ সিঁড়িবিহীন চারতলা থেকে উধাও হয়ে গেলে বড় বা মেজ মহারাজের কাছে মুখ দেখাবে কি করে? বাবা বলেছেন, ‘তোমার ওপর ন্যস্ত কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব তোমার। দায়িত্বহীনতা কোন ক্ষমা পেতে পারে না।’ শূন্য ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে চারজন পরস্পরকে দায়ী করতে লাগল। একজন গতরাতে ছোটে মহারাজের খাবার দিয়ে যাওয়ার পর ঘুমাবার আগে নামগানের ক্যাসেটটা বন্ধ করে যায়নি! আর একজন সকাল বেলায় সেই ক্যাসেটটা চালিয়ে দিতে ওপরে ওঠেনি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও যে ভয়ঙ্কর বিপদ সামনে থাবা তুলেছে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে ওরা শেষপর্যন্ত একত্রিত হল। ছোটে মহারাজকে পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু ছোটে মহারাজের যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার থাকবে না চারজনেরই। কিন্তু ওরা ভেবে পাচ্ছিল না ছোটে মহারাজ এই সিঁড়ি বিহীন চারতলা থেকে বেরিয়ে গেল কি করে। রাত্রের খাওয়া শেষ হবার পরেই লিফটের দরজায় চাবি পড়ে যায়। একমাত্র চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। ওরা আবার ঘরগুলো দেখল এবং নিঃসন্দেহ হল ছোটে মহারাজ ধারে কাছে নেই। শেষপর্যন্ত টয়লেটের পেছনে এসে ওরা পালাবার কৌশলটা আবিষ্কার করল। টয়লেটের জানলা থেকে গোটা আটেক ধুতিকে গিঁট পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে নিচে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাপড়টাকে ওপরে তুলে শিউরে উঠল চারজন। মেজ মহারাজ এই দামী বস্ত্র গত সপ্তাহে এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর যে কোন একটা গিট আলগা হয়ে গেলে! চারজন পরস্পরের দিকে তাকাল। এখনই খবরটা তিনু মহারাজকে জানানো দরকার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বড় মহারাজের সঙ্গে। বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অধিকার কারো নেই। বড় মহারাজ জানলেই ছোটে মহারাজ যদি বেঁচে থাকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না।

ওরা লিফটে চেপে নিচে নেমে এল। নিচের বিশাল হলঘরে তখন কয়েকজন শিষ্য বাবার ছবির সামনে নতজানু হয়ে বসে আছেন। ওরা চারজন বাবাকে প্রণাম করল। প্রায় দেওয়াল জোড়া ছবির ওই মুখখানি এমন জীবন্ত যে তাকালেই মনে হয় তিনি সবকিছু দেখতে পাচ্ছেন। আসলে বাবা তা পানও। মনের কথা যিনি বলে দিতে পারেন তিনিই অন্তযামী। বাবার ক্যাসেট প্রতি সন্ধ্যায় এখানে বাজানো হয়। অনেক সারগর্ভ কথার পরে সবশেষে বাবা বলে থাকেন, ‘তোরা যা করিস, কাছে কিংবা দূরে যেখানেই থাকিস, আমার দুটো চোখ তোদের পেছনে সবসময় আছে। তোরা দেখতে পাস না, কারণ দেখার জন্যে মুখ ঘোরাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি তোদের পেছনে চলে যাই যে।’ চারটি লোক একই সঙ্গে মনে মনে ককিয়ে উঠল, ‘বাবা আমি কি করব?’

.

এখন দুপুর। সর্বত্র নির্জনতা। মেজ মহারাজ তার কক্ষে বসে আশ্রমসংবাদের সম্পাদকীয় কলম লিখছিলেন। প্রতি মাসে প্রায় তিন কোটি শিষ্যের জন্যে এই আশ্রমসংবাদ পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের যে কোন কাগজ তো বটেই, ভারতবর্ষের সব কাগজের চেয়ে আশ্রমসংবাদের প্রচার সংখ্যা বেশী। সেদিন কে যেন বলছিল কলকাতা থেকে যত বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিক বের হয় তাদের মিলিত সংখ্যার সঙ্গে সাপ্তাহিক পাক্ষিক এবং মাসিক যোগ করলেও এই প্রচার সংখ্যার অনেক নিচে থাকে। বিজ্ঞাপনদাতারা প্রতিদিন অনুনয় বিনয় করছে তাদের বিজ্ঞাপন ছাপার জন্য। কিন্তু বাবার নির্দেশ অমান্য করার সাহস কারো নেই। পঞ্চাশ লক্ষ শিষ্য নগদ আট টাকা খরচ করে এই কাগজটি সংগ্রহ করে থাকে। এতে শুধু বাবার বাণী এবং তাঁর অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের কথাই ছাপা হয় না, আশ্রমে যেসব জনহিতকর কাজকর্ম করা হয় সেইসব খবরও ছাপা হয়। জীবনযাত্রা নির্বাহ করার জন্যে সৎ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সংখ্যার মলাটে বাবার বাণী স্থান পেয়েছে, ‘গৃহস্থের কর্তব্য সুসঙ্গ। যেখানেই নামগান, আমার কীর্তন সেখানেই যাবে। আমি মানে হাত-পাওয়ালা মানুষ নই, আমি মানে সত্য।’

আশ্রমসংবাদ পত্রিকার সর্বাঙ্গীণ দায়িত্ব মেজ মহারাজের ওপর ন্যস্ত। প্রকাশের পর প্রথম কপিটি নিয়ে তাঁকে যেতে হয় বাবার কাছে বড় মহারাজের অনুমতি নিয়ে। বাবা স্পর্শের মাধ্যমে পত্রিকাটিকে আশীর্বাদধন্য যতক্ষণ না করছেন ততক্ষণ প্রচারের আদেশ দেওয়া হয় না। মেজ মহারাজ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে সম্পাদকীয় লিখছিলেন। সম্প্রতি আর একটি ধর্মীয় সংস্থা থেকে কিছু অপপ্রচার করা হয়েছে। তার জবাব নয় কিন্তু তাকে উপেক্ষা করার জন্যে শিষ্য ও ভক্তদের প্রতি আহ্বান করা কর্তব্য। মেজ মহারাজ লিখলেন, ‘তোমার গুরু সবার গুরু। কিন্তু সবার শুরু তোমার শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারবেন যখন গুরু বলে অভিহিত সেই প্রধান পুরুষেরা তোমার গুরুকেই পিতা বলে স্বীকার করে নেবেন। মনে রেখ শুধু প্রজনন করলেই পিতা হওয়া যায় না। এক দঙ্গল বানরের মধ্যে যেমন পিতা ও পুত্রকে আলাদা চিহ্নিত করা অসম্ভব।’ এবং এই সময়েই অপারেটার টেলিফোনে জানাল কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছে। ঈষৎ উষ্ণ গলায় মেজ মহারাজ বলেন, ‘তোমার ওপর নির্দেশ ছিল এইসময় আমাকে বিরক্ত না করার। এই মুহূর্তে কলকাতায় এমন কোন মূল্যবান মানুষ নেই যার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি। দ্বিতীয়বার আর বিরক্ত করো না।’

অপারেটার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তিনু মহারাজ জোর করছেন যে!’

মেজ মহারাজ একমুহূর্ত নীরব হলেন। তিনুর ওপর দায়িত্ব আছে বেশ কয়েকটি বিষয়ে। তার অন্যতম হল আশ্রমের সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা দেখাশোনা করা। কিন্তু ওই ব্যাপারে কোন সমস্যা হয়ে থাকলে তিনু বড় মহারাজকেই জানাবে। ঈষৎ কৌতূহলী হয়ে তিনি লাইনটিকে সংযুক্ত করতে বললেন। পরক্ষণেই তিনুর গলা শোনা গেল, ‘জয় বাবা! আমি তিনু, নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমি আপনার শরণাপন্ন হচ্ছি!’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘তিনু, তিন কোটি শিষ্যের মধ্যে আমরা দু‘জন ছাড়া তোমরা মাত্র দশ জন মহারাজ হবার যোগ্যতা অর্জন করেছিলে। কিন্তু মনে হচ্ছে সেই যোগ্যতা ঠিক জরিপ করা হয়নি। তিরিশ বছর ধরে বাবার স্নেহ লাভের পর তুমি বলছ আমার শরণাপন্ন হয়েছ? তুমি কি জানো না আমরা মাত্র একজনেরই শরণ নিতে পারি?’

তিনু মহারাজের গলা কেঁপে উঠল, ‘ক্ষমা করুন। আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। বাবাকে অশ্রদ্ধা করার আগে যেন আমার জিভ খসে পড়ে।’

‘কি কারণে তুমি অস্থির হয়েছ?’

‘মেজ মহারাজ—।’ তিনু মহারাজের গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এল।

‘সময় নষ্ট করো না, আমার সম্পাদকীয় লেখা শেষ হয়নি।’

‘ছোটে মহারাজ, ছোটে মহারাজকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনু মহারাজ প্রায় কেঁদে ফেললেন।

‘কি বললে? হা বাবা।’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মেজ মহারাজ।

‘এইমাত্র সেবকরা সংবাদ দিয়েছে আমাকে। ছোটে মহারাজ কাল রাত্রে কাউকে না জানিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমি সম্ভাব্য সব জায়গায় খবর নিচ্ছি।’

‘কি করে বুঝলে সে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাকে তো ইলোপ করা হতে পারে।’

‘না। আপনি যে বস্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন তাই পাকিয়ে দড়ি বেঁধে তিনি নেমে গিয়েছেন।’

মেজ মহারাজ এবার উত্তপ্ত হলেন, ‘কি প্রলাপ বকছ? যে ছেলে কখনও কায়িক পরিশ্রম করেনি সে চারতলা থেকে দড়ি বেয়ে নেমে যেতে পারে?’

তিনু মহারাজ বললেন, ‘আমি নিজের চোখে সেই দড়ি দেখে এসেছি। লিফট বন্ধ ছিল। কোন মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই দড়ি বেয়ে নামানো যায় না। আমি দু’ জন সেবককে বরখাস্ত করেছি।’

‘তারা কোথায়?’

‘এখানেই আছে।’

‘ওদের ঘরেই আটক করে রাখ। আমি চাই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ছোটেকে তুমি খুঁজে বের করবে। আর এই খবরটা যেন পুলিশ না জানতে পারে। দু ঘণ্টা পর পর ফোন কর।’ টেলিফোন নামিয়ে রেখেই তিনি আবার বোতাম টিপলেন। অপারেটরের গলার স্বর পেয়ে বললেন, ‘এইমাত্র তিনুর সঙ্গে আমার যে কথা হল তার একটি শব্দও যদি প্রকাশিত হয় তাহলে—।’ লাইনটা কেটে দিলেন তিনি। শাস্তির পরিমাপ উচ্চারণ করার অধিকার একমাত্র বাবার।

কিন্তু সম্পাদকীয় লেখা হল না তাঁর। তারই ছোটে মহারাজ নিরুদ্দিষ্ট। এ অবস্থায় তিনি স্থির চিত্তে অন্য কাজ করতে পারেন না। ধীরে ধীরে কক্ষের বাইরে এলেন। চার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এই আশ্রমের ঠিক মাঝখানে উপাসনাগৃহ। উপাসনাগৃহের গায়ে তিনতলা আনন্দভবনে বাবা বাস করেন। কাছাকাছি ভক্তিধামে বড় মহারাজ আর এক কিলোমিটার দূরে এই বিনয়ধামে মেজ মহারাজের বাসস্থান। নিচে ভক্ত এবং সেবকরা গল্প করছিল। তাঁকে দেখামাত্র ওরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করল। এখানে একমাত্র বাবা ছাড়া কেউ প্রণামের অধিকারী নন, এবং বাবার আদেশানুযায়ী বড় মহারাজ ইদানিং নমস্কার পাচ্ছেন। মেজ মহারাজ শান্ত স্বরে উচ্চারণ করলেন, ‘ভক্তিধামে যাব।’

সঙ্গে সঙ্গে নীল মারুতি এসে গেল। একজন সেবক দরজা খুলে তাঁর প্রবেশের সুবিধে করে দিলেন। পেছনের আসনে হেলান দিয়ে মেজ মহারাজ বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। হয়তো দড়ি পাকানো কাপড়টি ভাঁওতা হতে পারে। হয়তো দুই সেবককে ষড়যন্ত্রের সঙ্গী করে ছোটে মহারাজকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে—! ওরা কি ছোটে মহারাজের জীবনহানি করতে পারে? মেজ মহারাজের মুখে একটা কষ্টের ছায়া নামল। তিনি দেখলেন পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে। আশ্রমে আমিষের কোন স্থান নেই। কিন্তু পুকুর থাকলে মাছ থাকবেই। দু‘বছর অন্তর সেই মাছ বাইরে বিক্রী করে দেওয়া হয়। এই এলাকার ভেতরে যেমন ট্র্যাক্টরে জমি চাষ করে, ফসল ফলানো হয় তেমনি নানারকম কারখানায় শিষ্যরা জিনিসপত্র উৎপাদন করে থাকেন। বিজ্ঞানভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন শিষ্য তাঁর গাড়ি দেখতে পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মস্তক নত করল। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবার মন নেই আজ। ছোটে মহারাজের মুখ মনে পড়ছিল বারে বারে। তাঁদের পরিবারে ওই একমাত্র সন্তান যার গায়ের রঙ চাঁপা ফুলের মত, নাক চোখ চিবুক ঠিক গৌরাঙ্গ বসানো। বারো বছর বয়স পর্যন্ত ওকে গৌর নামেই ডাকা হত। উপনয়নের পর বাবা আদর করে ছোটে মহারাজ নামে ডাকলেন। কিন্তু যেহেতু দীক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি তাই ওকে পূর্ণ মহারাজ বলা যায় না। সেই ছেলে যদি মারা গিয়ে থাকে—! মেজ মহারাজ গাড়ি থামাতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। ভক্তিধামের সামনে শিষ্য ও ভক্তদের ভিড় বেশী।

আনন্দভবনের সামনে অযাচিত ভিড় করা নিষেধ। সেবকরা এ ব্যাপারে খুব কঠোর। ভক্ত এবং শিষ্যরা যাতে মনে আঘাত না পান তাই তাঁদের বড় মহারাজের ভক্তিধামের সামনে জমায়েত হতে দেওয়া হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ নিয়মিত এখানে বাবাদর্শনে এসে থাকেন। অবশ্য দর্শন পাওয়া অত্যন্ত ভাগ্যের ব্যাপার।

মেজ মহারাজ গাড়ি থেকে নামতেই সেবকদলের চারজন এগিয়ে এসেছিল। অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে তারা তাঁকে নিয়ে গেল ভিতরে। উপস্থিত দর্শকরা মেজ মহারাজের পরিচয় জানতে পারামাত্র গুঞ্জন করে উঠল। মূল গেট থেকে একটা চাতাল পেরিয়ে ভক্তিধামের সিডিতে পা রাখতে হয়। সেই চাতালে সেবকদলের কয়েকজন চব্বিশ ঘণ্টা প্রহরায় থাকে। তাদের ডিঙিয়ে মেজ মহারাজ সিঁডি ভেঙে ওপরে উঠে এলেন। তিনজন প্রধানা সেবিকা দরজার বাইরে অপেক্ষায় রয়েছেন। এই তিনজন নিয়ন্ত্রিত হন পূজনীয়া বউদিমণির ইচ্ছায়। মেজ মহারাজ দরজায় পৌঁছানোমাত্র এদের একজন ছুটে গেল ওপাশে। সম্ভবত পূজনীয়া বউদিমণিকে খবর দিতে। দ্বিতীয়জন নতমস্তকে জানাল, ‘বড় মহারাজ একটু আগে নিদ্রায় গিয়েছেন।’

‘আজ এই ব্যতিক্রমের কারণ?’

দ্বিতীয়া উত্তর দিল, ‘আনন্দভবন থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল।’

মেজ মহারাজ ফিরে দাঁড়ালেন। বড় মহারাজের দিবানিদ্রা বিলাসের কথা সবাই জানে। দুপুরে দু ঘণ্টা এবং মধ্যরাতে দু ঘণ্টা তিনি নিদ্রার জন্যে ব্যয় করলেও দুপুরেরটিকে তিনি বিলাস বলেই অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘শরীরের জন্যে নিদ্রার প্রয়োজন, নিদ্রার জন্যে শরীর নয়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর নিশীথে শরীরকে নিদ্রামগ্ন করলে সমস্ত ক্লান্তির ময়লা সাফ হয়ে যায়। সেই ময়লা সাফ করতে কারো আট ঘণ্টা প্রয়োজন কারোর বা দু ঘণ্টাই যথেষ্ট। তাই দ্বিপ্রহরে নিদ্রামগ্ন হওয়া বিলাস ছাড়া কিছুই নয়।’

দু বছর আগে বড় মহারাজের বুকে যখন যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই চিকিৎসকের নির্দেশে এই ‘বিলাসের’ ব্যবস্থা। কিন্তু ওঁকে না জানিয়ে বাবার কাছে যাওয়াও অসম্ভব। তিনি বড় মহারাজের মতামত জানতেই চাইবেন।

মেজ মহারাজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তেই পূজনীয়া বউদিমণি পাশের দরজায় এসে উপস্থিত হলেন। আশ্রমবাসিনীর পরিচয় তাঁর বেশবাসেও। ঘোমটা নেমে এসেছে চোখের ওপর। তিনি বললেন, ‘উনি খুব ক্লান্ত। অবশ্য প্রয়োজনটা আপনি বুঝবেন।

‘হ্যাঁ। সেটা বুঝেছি বলেই আসতে বাধ্য হয়েছি। দরজা খুলতে আদেশ দিন।’

পূজনীয়া বউদিমণির ইঙ্গিতে সেবিকারা দরজা খুলে দিতেই মেজ মহারাজ ভেতরে ঢুকলেন। প্রথম কক্ষ সর্বদা ধূপধুনায় আচ্ছন্ন থাকে। দ্বিতীয় কক্ষে তার ঘ্রাণ সামান্য পাওয়া যায়। বড় মহারাজ তৃতীয় কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটি পালঙ্কে নিদ্রামগ্ন। মেজ মহারাজ তাঁর পায়ের কাছে এসে দাঁড়াতেই কাকাতুয়া চিৎকার করে উঠল, ‘জয় বাবা’।

সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললেন বড় মহারাজ। অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছেন তিনি। মেজ মহারাজ আজ বড় মহারাজের জুলপিতে সাদা ছোপ দেখতে পেলেন। সম্ভবত নিয়মিত কলপ করা হয়নি কোন কারণে। তিনি দুটো হাত যুক্ত করে নমস্কার করলেন, ‘জয় বাবা’। সঙ্গে সঙ্গে কাকাতুয়া দ্বিতীয়বার বলে উঠল, ‘জয় বাবা’। বড় মহারাজ তার দিকে তাকিয়ে খুব প্রশ্রয়ের গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আঙুর খাবি? আত্মারাম?’

পাখিটা জবাব দিল না। দাঁড়ে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে মেজ মহারাজকে দেখতে লাগল। সেটা লক্ষ করে বড় মহারাজ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার মনে দুশ্চিন্তা আছে মেজ?’

মেজ মহারাজ চমকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিভাবে অনুমান করলেন?’

‘আত্মারামকে দেখে। সরল হৃদয় বা দুশ্চিন্তাবিহীন মানুষের সান্নিধ্যে ও আমার প্রশ্নের জবাব দেয়। দেখলে তো ও ওর প্রিয় খাদ্য আঙুরও প্রত্যাখ্যান করল। আত্মারাম মানুষকে বুঝতে পারে, বোঝাতে পারে না পাখি বলে, বুঝে নিতে হয়।’ কথাগুলো বলে মৃদু হাসলেন বড় মহারাজ। তাছাড়া আমার বিলাসের সময় তুমি নিশ্চয়ই সুচিন্তা নিয়ে প্রবেশ করোনি!’

মেজ মহারাজ আত্মারামের দিকে আর একবার তাকালেন। পাখিটার বিশেষত্বের গল্প তাঁর কানেও গিয়েছে। কিন্তু ওর কৃতিত্ব যে এতখানি তা জানা ছিল না। তিনি বললেন, ‘আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। কলকাতা থেকে তিনু টেলিফোন করেছিল—।’

‘কোন তিনু? মহারাজ?’ বড় মহারাজ কথার মাঝখানে বাধা দিলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনু—’ কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন মেজ মহারাজ ইঙ্গিত দেখে।

‘দাঁড়াও। আগে তোমাকে জানিয়ে দিই তারপর তোমারটা শুনব। আজকাল স্মৃতি সবসময় সক্রিয় থাকে না। তিনুকে বলো শ্যামবাজারের অধীরচন্দ্র মল্লিকের বসতবাড়িটি অবিলম্বে অধিকার করতে। সে ওই বাড়িটি বাবার নামে উৎসর্গ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল মৃত্যুর আগে। এই মর্মে তিনখানা পত্র দিয়েছে আমাকে। আজ সকালেই তার মারা যাওয়ার খবর পেলাম। অধীরের কোন উইল নেই। অতএব ওই পত্রাবলীই যথেষ্ট।’

‘কিন্তু ডিড না করে গেলে আইন মানবে?’

‘তোমার আমার সে-চিন্তা নয়। কি বলছিলে যেন?’

মেজ মহারাজ আড়চোখে বড় মহারাজকে দেখে নিলেন, ‘তিনু টেলিফোনে আমাকে একটা খারাপ খবর দিয়েছে। গতরাত্রে কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে ছোটে মহারাজ উধাও হয়ে গেছে।’

‘উধাও হয়ে গেছে মানে?’ বড় মহারাজ ধীরে ধীরে সোজা হলেন।

‘তাকে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। তিনু বলছে সে কাপড় দড়ির মত পাকিয়ে চারতলা থেকে নেমে গিয়েছে। ব্যাপারটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। খবরটা বাবাকে জানানো দরকার।’

‘তোমার কি ধারণা?’ বড় মহারাজের মুখ শক্ত।

‘বুঝতে পারছি না। যদি শত্রুপক্ষ আঘাত হানতে চায়—।’

‘সেবকরা কি করছিল? ওঃ। আমি এই ভয়ই করছিলাম। ছোটের সম্পর্কে আমার কানে কিছু উড়ো কথা ভেসে এসেছে। গতবার কলেজ ছুটির সময়েও সে এখানে আসেনি। মহিলাসংক্রান্ত ব্যাপারে সে যে এতখানি আত্মভ্রষ্ট হবে তা আমি ভাবতে পারছি না।’

‘কিন্তু শত্রুপক্ষরা তো পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আপনার কি মনে হয় না এক্ষেত্রে তারা একটা ভূমিকা নিতে পারে?’ মেজ মহারাজ নিজস্ব সন্দেহের কথা বললেন।

‘ঠিকই বলেছ। কিন্তু তিনুকে কি বলেছ ব্যাপারটা গোপন রাখতে?’ মেজ মহারাজ মাথা নাড়লেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। সে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করছে।’

‘ওই বাড়ির সেবকরা যেন বাইরে না যায়। কোন ভক্ত বা শিষ্য এই খবর জানুক, তা আমি চাই না। তুমি একটু অপেক্ষা কর আমি তৈরী হয়ে আসছি।’ বড় মহারাজ শব্দ করতেই দু’ জন সেবিকা ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়াল। বিশাল সাদা আলখাল্লা বাঁধতে বাঁধতে তিনি তাদের পিছু পিছু অন্তর্হিত হলেন। চোখ বন্ধ করেছিলেন মেজ মহারাজ। তিন কোটি শিষ্য যে বাবার, তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। ধর্ম এক। কিন্তু তার ব্যাখ্যা বোধ এবং বুদ্ধি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সনাতননাথ অতিশয় ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তিনি দাবী করেন তাঁর শিষ্যসংখ্যা দশ লক্ষ। কিন্তু প্রলোভন দেখিয়ে নাকি সেই শিষ্যদের এই আশ্রমের অনুকূলে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ যে নিতান্তই অপপ্রচার তা শিশুরাও বুঝবে। কিন্তু আরও কিছু গুরু সনাতননাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন। একটা বিরুদ্ধ জনমত গঠনের চেষ্টাও সমানে চলছে। আজ দুপুরে তিনি ভেবেছিলেন ব্যাপারটা উপেক্ষা করাই ভাল। কিন্তু ছোটে মহারাজের ঘটনাটা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

‘চুমু খাও। দুটো চুমু। তিনটে চুমু।’

ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন মেজ মহারাজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন আত্মারাম নিরীহ মুখে তাকে দেখছে। চোখাচোখি হওয়ামাত্র পাখিটা বলে উঠল, ‘জয়বাবা।’ ক্রুদ্ধ মেজ মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি বললি হতভাগা? ‘

আর এইসময় বড় মহারাজ পোশাক পাল্টে কক্ষে প্রবেশ করলেন। মেজ’র দিকে তাকিয়ে তিনি বিস্মিত, ‘কি হল? উত্তেজনা কিসের?’

‘না। পাখিটা—মানে—আত্মারাম অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করল।’

‘অশ্লীল? আত্মারাম? ধমকে উঠলেন বড় মহারাজ।

‘জয় বাবা।’ আত্মারাম নিরীহ স্বরে বলল।

বড় মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করেছে মেজ?’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘ও নিশ্চয়ই কোন পাপাচারীর কাছে কথা শিখছে। এই আশ্রমে চুম্বনের কোন জাযগা নেই। তবু আত্মারাম দুটো তিনটে চুমুর কথা বলছে।’

শোনামাত্র হো হো করে হেসে উঠলেন বড় মহারাজ। তারপর বললেন, ‘তুমি নিতান্ত জাগতিক চোখে ওর কথা বিচার করলে হে। চুম্বন মানে মিলন। ও নিশ্চয়ই একটা চুম্বনের কথা বলেনি। একটা চুম্বন হল সুখরূপ মিলনাস্বাদন। দুটো চুম্বন হল আনন্দস্বরূপ আর তিনটে চুম্বন হল সত্যস্বরূপ। এই দুটোই হল পরমপিতাব মূল্যায়ন। চল, অকারণে সময় ব্যয় হচ্ছে।’

বড় মহারাজের সঙ্গে ভক্তিধাম থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগল। শতাধিক শিষ্য নমস্কার করছে, আশীর্বাদ চাইছে। মনে মনে আজ একধরনের তিক্ত স্বাদ ছড়িয়ে পড়ল। বড় মহারাজ যেন অকারণে শিষ্যদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। যা বাবার পক্ষে মানায়, তা ওঁর এই মুহূর্তে করা উচিত নয়। দূরত্ব বেশি না হলেও বড় মহারাজ তাঁর কনটেসা গাড়িতে উঠলেন। ওঠার আগে তাঁকে নির্দেশ দিলেন সহযাত্রী হতে। গাড়িতে উঠে বসামাত্র বড় মহারাজ বললেন, ‘বাবাকে সকালে খুব চিন্তিত দেখেছি। সম্ভবত অধীবচন্দ্রের মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।’

মেজ মহারাজ মাথা নত করলেন। কখনও কখনও প্রিয় শিষ্যের মৃত্যুর আগের মুহূর্তে বাবা সেটা অনুভব করেন। সেই মুহূর্তে তিনি যোগবলে শিষ্যের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হন। শিষ্য যাতে শান্তিপূর্ণ হৃদয়ে পরমপিতার সঙ্গে মিলিত হতে পারে, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই কাজের ফলে তাঁর শরীরে প্রচুর ক্লান্তি আসে। সেই সময়টা তিনি জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে থাকেন। এটা সমাধিস্থ হওয়ার ঘটনা নয়। যোগের মাধ্যমে এই যাতায়াতের প্রক্রিয়া বাবা বড় মহারাজকে শিখিয়ে দিচ্ছেন। আজ ব্যাপারটা মনে পড়তেই মন এলোমেলো হয়ে গেল।

গাড়ি প্রধান ফটক পেরিয়ে যখন আনন্দভবনে প্রবেশ করছে তখন সেবকরা যুক্ত করে দাঁড়িয়ে। গতমাস থেকেই এখানে সেবকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। মেজ মহারাজ ঘড়ি দেখলেন। সান্ধ্যারাধনার এখনও দেরি রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে বড় মহারাজ প্রধান সেবককে বললেন, ‘বাবাব অনুমতি নিয়ে এস। অসময়ে সাক্ষাতের প্রয়োজন হয়েছে।’

বড় সেবক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। পাশের উপসনামন্দিরে মৃদুস্বরে ঘণ্টা বাজছে। চব্বিশ ঘণ্টা পালা করে শিষ্যরা ওই ঘণ্টা বাজিয়ে থাকেন। ওই সুশব্দ তরঙ্গ একটি পবিত্র আবহাওয়া তৈরি করে। প্রধান সেবক ফিরে এসে হাতজোড় করে নতমস্তকে বলল, ‘বাবা অবিলম্বে আপনাদের যেতে আদেশ করলেন।’ পথ চেনা। অজস্রবার যাতায়াত হয়েছে। তবু অসময়ে এলে এই শিষ্টাচার প্রয়োজন হয়। একতলায় লিফটের দরজা খুলে দিল এক সেবক। স্বয়ংক্রিয় সেই লিফটে উঠলেন দুই মহারাজ। তিনতলায় উঠে সেটি আপনি উন্মুক্ত হলে শীতল বাতাসের স্পর্শ এল যেন। যদিও মেজ মহারাজ জানেন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তিনতলায় কোন বাতাস বইতে পারে না তবু অনুভূতি প্রথমে সেইরকমই হয়।

সেবিকারা এখন নতমস্তকে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। তাদের উপেক্ষা করে দুই মহারাজ ধীরে ধীরে বাবার কক্ষে প্রবেশ করলেন। বিশাল আরশির সামনে একটি বেতের ডেকচেয়ারে বাবা শায়িত। তাঁর শরীর সাদা আলখাল্লায় আবৃত। দু‘জন সেবিকা তাঁর পদযুগলে চন্দনের রেণু মাখিয়ে দিচ্ছে। বাবার চোখ বন্ধ। সাদা দাড়িতে বাম হাত আলস্যভরে রাখা।

মেজ মহারাজ দাঁড়িয়ে পড়লেন। বড় মহারাজ এগিয়ে গিয়ে নতজানু হলেন। বাবার চোখ তখনও বন্ধ। সেই অবস্থায় বড় মহারাজ বললেন, ‘বাবা, আমরা বিপদগ্রস্ত!’

বাবা তখনও চোখ খুললেন না। এই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে কোন শব্দ নেই। বড় মহারাজ যে কথা উচ্চারণ করলেন, তা বাবার কানে গিয়েছে কিনা বোঝা গেল না। তাঁর বাম হাত তখন সাদা দাড়িতে মোলায়েম আদর রাখছে। সেই অবস্থায় তিনি আচমকা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার পাখিটির নাম কি যেন?’

‘আজ্ঞে আত্মারাম।’ বড় মহারাজ নিচু গলায় জবাব দিলেন।

‘আত্মারাম। রাম মানেই আরাম। আত্মার আরাম। রাম না থাকলেই ব্যারাম। বড়, তুমি তোমার আত্মারামকে একবার এখানে নিয়ে এসো তো। শুনেছি, সে খুব কথা বলে।’

‘এখনই নিয়ে আসব বাবা?’ বড় মহারাজ তড়িঘড়ি বলে উঠলেন।

‘না। এখন আমি স্নান করব।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন বাবা। সেবিকারা সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল। দ্বিতীয় দরজার দিকে যেতে যেতে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই মেজ। সম্পাদকীয়তে লিখবে অন্ধকারের কোন ছায়া নেই কারণ সে নিজেই ছায়া। সনাতননাথের শিষ্যরা যদি আলো ও অন্ধকারের ভেদাভেদ বুঝতে পারে সেটা তাদের কৃতিত্ব। তবে সনাতননাথের নাম উল্লেখ করবে না। তোমার কাগজ কি দিন তিনেকের মধ্যে প্রকাশিত হবে?’

উত্তরের অপেক্ষা না করে বাবা কক্ষান্তরে চলে গেলেন। জবাব দিতে গেলে তাঁকে অনুসরণ করতেই হবে। বড় এবং মেজ মহারাজ সেই কক্ষটি পেরিয়ে একটি ঈষৎ উষ্ণ কক্ষে প্রবেশ করে বাবার দর্শন পেলেন। এখানে অন্য কেউ উপস্থিত নেই। কক্ষের মাঝখানে দশ বাই পাঁচ ফুট একটি বাথটব। তাতে গোলাপের গন্ধ দেওয়া নির্মল জল টলটল করছে। বাবার শরীর দীর্ঘ। তিনি দুটো হাত ডানার মত সঞ্চালন করতেই আলখাল্লাটি মাটিতে পড়ে গেল। তাঁর বয়স্কশরীর এখন সম্পূর্ণ নিরাবরণ। ধীরে ধীরে তিনি সেই বাথটবে প্রবেশ করলেন। দুই মহারাজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাথটবে শরীর ডুবিয়ে বাবা স্থির হতেই মেজ মহারাজ উত্তর দিলেন, ‘দিন তিনেকের মধ্যে প্রকাশ যাতে হয় আমি সেই চেষ্টাই করব।’

‘মেজ, হংসোপনিষদে নাদ কয়রকমের আছে?’

‘আজ্ঞে দশ রকমের।’

‘অষ্টম নাদটি কি?’

‘মৃদঙ্গ নাদ।’

‘চমৎকার। মৃদঙ্গের বোলের মত উত্তম বাক্শক্তি যেন হয়। কিন্তু এসব তো ব্যক্তনাদ। জাগতিক। কিন্তু অব্যক্ত নাদ? সেটা শুনতে চেষ্টা করো। বিন্দুনাদে পৌঁছে যাও। তৈলধারামিচ্ছিন্নং, দীর্ঘ ঘণ্টা নিনাদবৎ। বিন্দুনাদ কালাতীতং যস্তং বেদ স বেদচীত ॥’ হাত বাড়িয়ে তোয়ালে নিয়ে শরীর জলে রেখে মাথার ভেজা চুল শুকনো করতে লাগলেন ধীরে ধীরে। এবং তারপরেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বড়, আমাদের বিপদ কোন ক্ষেত্রে?’

‘এখনই ক্ষেত্রটা বুঝতে পারছি না।’ বড় মহারাজ এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রসঙ্গে আসতে পারলেন, ‘ছোটে মহারাজ চারতলা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছেন।’

‘কোথায়?’ হাতটা একবার থেমে আবার সক্রিয় হল বাবার।

‘সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তিনু মহারাজ অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।’

‘কোন বান্ধবীর সঙ্গে সে মিশতো?’

‘কলেজে দু-একজন ছিল, কিন্তু তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বলে মনে হয় না।’

‘আমার সন্তানের স্বরূপ অত সহজে চেনা যায় না।’

বড় মহারাজ খোঁচাটা হজম করলেন, ‘মেজ বলছিল শত্রুপক্ষের হাত থাকা অসম্ভব নয়।’

বাবা নিরাবরণ অবস্থায় বাথটব থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে দেওয়ালে ঝোলানো আর একটি আলখাল্লায় নিজেকে আবৃত করলেন, ‘অসম্ভব নয়। খবরটা কজন জানে?’

‘তিনু কলকাতার কজনকে জানিয়েছে জানি না, কিন্তু এখানে অপারেটার ছাড়া শুধু আমরাই জানি। তিনু অবশ্য বলেছে সমস্ত গোপনীয়তা থাকবে।’ বড় মহারাজ জানালেন। ধীরে ধীরে বাবা ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওঁরা দুজন আবার পিছু নিলেন। শয়নকক্ষে প্রবেশ করে বাবা বললেন, ‘সুধাময়কে টেলিফোনে ধর।’

বড় মহারাজ দ্রুত টেলিফোনের কাছে চলে গেলেন। এস. টি. ডি-তে কলকাতা পেতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। সুধাময় সেন অফিসে ছিলেন। তাঁকে পাওয়া গেলে বাবা বললেন, ‘ওকে বল, এখনই তিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করে ছোটেকে খুঁজে বের করতে। আমি ছ’ ঘণ্টা সময় দিলাম।’ বড় মহারাজ সেকথা সুধাময় সেনকে জানিয়ে দিলেন। মেজ মহারাজ সুধাময় সেনকে চেনেন। কলকাতার অন্যতম বড় প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কর্তা। বাবার অত্যন্ত অনুগত শিষ্য। টেলিফোন রেখে বড় মহারাজ ঘুরে দাঁড়াতেই বাবা বললেন, ‘আর একটা লাইন নাও। পার্ক সার্কাসের ইউনিসকে বল ছোটের খবর আমি ছ’ঘণ্টার মধ্যে চাই। ঘটনাটা ওকে বল। কিন্তু তিনুর সঙ্গে যেন ইউনিস যোগাযোগ না করে।’

বড় মহারাজ একটি ডায়েরি খুলে ইউনিসের নাম দেখে নম্বর বের করলেন। দেখলেই বোঝা যায়, এই কাজে তিনি অভ্যস্ত। ইউনিসকে পাওয়া গেল না। খবর দেওয়া হল, সে যেন ফিরলেই এখানে যোগাযোগ করে। মেজ মহারাজ ইউনিসকেও চেনেন। বাবার ভক্তরা যে কেবল হিন্দু তা নয়। কিছু মুসলমান শিষ্যত্ব গ্রহণ না করলেও বাবার অনুগত হয়ে আছেন। বিপদে-আপদে তাঁরা বাবার সাহায্য পেয়ে থাকেন। ইউনিস নামের মানুষটি অত্যন্ত প্রতাপশালী।

তাঁকে বাবা বলেছেন, ‘ইসলাম হল সাম্য মৈত্রী আর ভালবাসার মন্ত্র। নামাজ, রোজা, হজ বা জাকাৎ হল তার অঙ্গ। একজন মুসলমান হিসেবে তোমার উচিত ইসলামকে পবিত্রভাবে অনুসরণ করা। ইসলাম ধর্মই তোমার জীবন ধারণের পথ।’

হঠাৎ বাবা দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন, ‘ছোটে এখানে কতদিন আসেনি?’

‘আট মাস।’ বড় মহারাজ জবাব দিলেন।

‘আমাদের আচার সে পালন করে?’

‘কলকাতার বাড়িতে তো পালন করতেই হয়।’

বাবা ঘুরে দাঁড়ালেন মেজর দিকে, ‘তুমি ঠিক কথাই বলেছ। ছোটে কোথায় আছে, আমার জানার দরকার নেই। কিন্তু তুমি সনাতননাথকে জানাও, ছোটেকে যদি আট ঘণ্টার মধ্যে না ফেরত দেয় তাহলে পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে।’

‘কিন্তু তাতে তো ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে।’ বড় মহারাজ বললেন। ‘না। সনাতননাথ গোপন রাখবেই। নিজের স্বার্থে।

মেজ মহারাজ না বলে পারলেন না, ‘কিন্তু ছোটর সঙ্গে ওদের সম্পর্ক যদি না থাকে?’

বাবা হাসলেন, ‘সেক্ষেত্রে সুধাময়, তিনু কিংবা ইউনিস ওকে ফিরে পেলে পাওয়াটাকে গোপন রাখতে হবে।

মেজ মহারাজ যেন নিজের কানকেই অবিশ্বাস করলে ভাল বোধ করতেন। বাবা সংসার সম্পর্কে উদাসীন কিন্তু সাংসারিক জ্ঞান গ্রখর এইরকম ভাবনাই কাজ করত। নাহলে এই বিশাল আশ্রম ক্রমশ সম্পদশালী হত না। এই সম্পদ কার জন্যে তাও মেজ মহারাজ জানেন না। বাবার বয়স অবশ্যই পঁচাত্তরের নিচে নয়। মা গত হয়েছেন পনের বছর। এই মা বাবার দ্বিতীয় পক্ষের। ছোটে মহারাজ তাঁর সন্তান। কিন্তু বাবার আচরণ, বুদ্ধি এবং স্বাস্থ্য বার্ধক্যকে প্রশ্রয় দেয়নি। তাঁরা যা চিন্তা করেন বাবা যেন কয়েকধাপ বেশি এগিয়ে যান। ঠিক এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। এটি বাবার কাছে যারা সরাসরি কথা বলার অধিকারী, তাদের জন্যে। বড় মহারাজ বাবার নির্দেশে রিসিভার তুলে জানতে চাইলেন ওপারে কে? তারপর বাবাকে জানালেন, ‘ইউনিস কথা বলছে।’

বাবা বললেন, ‘জানিয়ে দাও।’

বড় মহারাজ তখন বিস্তারিত বললেন ইউনিসকে। রিসিভার রেখে দেওয়ামাত্র বাবা বললেন, ‘আজ আমি উপাসনাগৃহে যাব। সেইমত ব্যবস্থা কর।’ এটা নির্দেশ। নির্দেশ এই ঘর থেকে চলে যাওয়ার। বড় মহারাজ সেইমত নতজানু হয়ে প্রণাম সেরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। মেজ মহারাজ যখন প্রণাম সারছেন তখন বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তিনু আবার কখন টেলিফোন করবে?’

‘আজ্ঞে দু ঘণ্টা পর পর করতে বলেছি।’

‘সময়টা পার হয়নি?’

‘না।’

‘তিনু সম্পর্কে নতুন কিছু ভাবতে হবে।’

মেজ মহারাজ প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়ালেন। বড় মহারাজ দরজায় তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মনে হচ্ছে তোমার কিছু জানার আছে!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি তো ইচ্ছে করলে জানতে পারেন ছোটে মহারাজ এই মুহূর্তে কোথায় আছে। আমরা জানি আপনার অন্তর্দৃষ্টি বাধাহীন। কত ভক্তশিষ্যদের আপনি এই ধরনের কৃপা করে থাকেন। তাহলে এইক্ষেত্রে কেন নিজের শক্তি প্রয়োগ করছেন না?’ মেজ মহারাজ এই প্রথম বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু জানতে চাইলেন, যা উচ্চারণ করার সাহস বড় মহারাজেরও কখনও হয়নি। বাবা হাসলেন, ‘নিজের জন্যে কিছু করতে আর ভাল লাগে না। তা ছাড়া ডাক্তাররা তো নিজের সন্তানের চিকিৎসা অন্য ডাক্তার দিয়েই করায়। এসো।’

.

আজ বাবা উপসাসনাগৃহে আসবেন। খবরটা এক মুহূর্তে আশ্রমের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ দৈনিক উপাসনা পরিচালনা করেন বড মহারাজ। কোন কারণে তিনি অনুপস্থিত থাকলে মেজ মহারাজ দায়িত্ব নেন। বিশেষ বিশেষ তিথিতে বাবা উপাসনাগৃহে এসে শিষ্যদের দর্শন দেন। এখানে কেউ তাঁকে কোন প্রশ্ন করতে পারবে না। উপাসনান্তে বাবা কিছু উপদেশ দেবেন। তারপর মন্দিরাভ্যন্তরে থাকবেন রাত নটা পর্যন্ত। শরীর সুস্থ থাকলে সপ্তাহে এখন তিন দিন বাবা শিষ্যদের সঙ্গে আলাপ করেন। অনেক আগে থেকে চিঠি লিখে সাধারণ শিষ্যদের এ ব্যাপারে অনুমতি নিতে হয়। কি কি প্রশ্ন বাবাকে করা হবে, তাও আশ্রম কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। ভি আই পি অথবা একান্ত জরুরী প্রয়োজন হলে বড় মহারাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে সাক্ষাৎ করিয়ে দেন ওই তিন দিনই। মন্ত্রী বা সচিব এলেও এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয় না।

উপাসনাগৃহের সামনে ইতিমধ্যেই ভিড় জমতে শুরু করেছে। বাবার বাণী শোনার, বাবাকে দর্শন করার জন্যে প্রথম দিকে বসতে চাইছে সবাই। বড় মহারাজ গাড়ি থেকে নামলেন। মেজ মহারাজকে বললেন, ‘আজ তুমি উপাসনা না করলে কোন অন্যায় হবে না। বাবার আদেশ পালন করা উপাসনা করারই সামিল। তুমি সনাতননাথের সঙ্গে যোগাযোগ কর।’

নিজের গাড়ি নিয়ে বিনয়ধামে ফিরে এলেন মেজ মহারাজ। তিনি অকৃতদার। দু বছর পরে পঞ্চাশ পূর্ণ হবে। প্রকৃত ব্রহ্মচারীর জীবন তাঁর। বড় মহারাজ জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে বাস করেন বলেই সেবিকা রাখার অধিকার পেয়েছেন। বাবা এসব নিয়মের ঊর্ধ্বে। যিনি স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সন্ন্যাসী, আসক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেও চরম নিরাসক্ত সেই ঈশ্বরপুত্রের বিচার চর্মচক্ষে করা অসম্ভব।

মেজ মহারাজ গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন বিনয়ধামের সামনে কেউ অপেক্ষা করে নেই। শুধু কয়েকজন সেবক প্রহরায় আছে। তারা তাঁকে দেখামাত্র নতমস্তকে দাঁড়াল। তিনি ধীরে ধীরে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন। আশ্রমসংবাদের সম্পাদকীয় অর্ধসমাপ্ত রয়েছে। বাবার নির্দেশমত তাতে কিছু কথা সংযুক্ত করতে হবে। সংখ্যাটি যাতে তিন দিনের মধ্যে প্রকাশিত হয় তার জন্যে এখনই উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পত্রিকার সঙ্গে জড়িত প্রধান কয়েকজন কর্মীকে তিনি ডেকে পাঠালেন। এবং এইসময় টেলিফোন বাজল। অপারেটর বলল, ‘কলকাতার লাইন।’

এই আশ্ৰম-এলাকায় সমস্ত টেলিফোন নিয়ন্ত্রিত হয় অপারেটরের মাধ্যমে। একমাত্র আনন্দভবনেই সরাসরি লাইন আছে। মেজ মহারাজ রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে তিনুর গলা শোনা গেল, ‘মেজ মহারাজ, আমি পনের মিনিট আগেও টেলিফোন করেছি। ছোটে মহারাজকে এখনও খুঁজে পাইনি। ওর ক্লাসের সমস্ত বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি। তবে হাল ছাড়ছি না।’

‘ঢোল পেটাতে আর কি বাকি রাখবে?’

মেজ মহারাজের গলা শোনামাত্র থমকে গেল তিনু। তারপর বলল, ‘না-না, তিনি যে হারিয়ে গেছেন তা কাউকে জানাইনি। আর হ্যাঁ, অনেকভাবে যাচাই করে নিঃসন্দেহ হয়েছি যে, সেবকরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। কোন আদেশ আছে?’

‘সুধাময় সেন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?’

‘হ্যাঁ, মেজ মহারাজ। তিনি সমস্ত তথ্য জেনে নিয়েছেন।’

‘শ্যামবাজারের অধীরচন্দ্র মল্লিক করে গত হয়েছেন?’

‘আজ ভোরে। খবরটা আশ্রমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

‘ওঁর বসতবাড়িটি উনি যেহেতু আশ্রমের কাজে দান করে গেছেন তাই তুমি ওটি অবিলম্বে দখল করবে। এই সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

‘আদেশ পালিত হবে মেজ মহারাজ।’

‘দু ঘণ্টার পরে যেন ভাল খবর পাই। বাবা তোমার ব্যাপারটা পছন্দ করেননি। তোমার ওপর দায়িত্ব ছিল ছোটে মহারাজকে রক্ষা করা।’ মেজ মহারাজ ও পক্ষের কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা না করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তিনু মহারাজ আজ রাত্রে নিশ্চয়ই ভাল করে ঘুমাতে পারবেন না। তিনু খুব কাজের মানুষ কিন্তু অতিশয় ভোগী। মহারাজ শ্রেণীতে উন্নীত হওয়া সত্ত্বেও ভোগের স্বাদ হারাতে নারাজ। কোন কিছু হারাতে হবে শুনলে, সে ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।’

মেজ মহারাজ চোখ বন্ধ করে কর্তব্য স্থির করে নিলেন। সনাতন নাথের সঙ্গে এখন তাকে যোগাযোগ করতে হবে। বাবা কোন কাজের গাফিলতি সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু সনাতন নাথ। যে-সে মানুষ নন। কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে তাঁর যে আশ্রম সেখানকার বর্ণনা শুনেছেন তিনি। হয়তো শিষ্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষ বাড়িয়েই বলা হয়ে থাকে কিন্তু তাদের অনেকেই জঙ্গীপ্রকৃতির। আগে সনাতননাথ কদাচিৎ জনসমক্ষে বের হতেন। ইদানিং তাঁকে প্রায়ই প্রকাশ্য ধর্মসভা করতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যেখানেই যান তাঁকে ঘিরে রাখে শিক্ষিত দেহরক্ষী বাহিনী। মেজ মহারাজ জানেন তিনি চেষ্টা করলেও সনাতন নাথের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। সনাতন নাথের প্রধান শিষ্য নিত্যনাথের মাধ্যমেই তাঁকে মতামত দেওয়া-নেওয়া করতে হবে। টেলিফোনে এত কথা বলা সমীচীন নয়। কলকাতা থেকে দূরত্ব রেল বা গাড়িতে প্রায় এগার ঘণ্টার। বিদেশী বা ধনবান শিষ্যভক্তদের সুবিধার জন্যে বাবা চেয়েছিলেন আশ্রমের মধ্যেই একটি ছোটখাটো রানওয়ে তৈরী করতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই আবেদন নানান আইনের নজির দেখিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন। হয়তো বাবার নামে আবেদন করা হয়েছিল বলেই সরাসরি বাতিল করতে পারেননি। কিন্তু একমাত্র বাবার ব্যবহারের জন্যে হেলিকপ্টার রাখার অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। অবশ্য বাবার নির্দেশে অন্য কেউ ওটা ব্যবহার করলেও সরকারি তরফ থেকে কোন আপত্তি ওঠে না।

এই সময় ধ্যানেশের কথা মনে পড়ল। আজ সমস্ত দেশে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ধ্যানেশের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিখ্যাত হবার পেছনে বাবার অবদান সর্বজনবিদিত। সাধারণ একজন কেরানি হিসেবে বেচারা জীবন শুরু করেছিল। গান গাইত কিন্তু তার শ্রোতা ছিল না। সেইসময়ে কপালগুণে রেডিওতে গাইবার সুযোগ পেয়ে গেল ধ্যানেশ। রেডিওর সি গ্রেড শিল্পী হয়ে সারাজীবন যারা কাটিয়ে দেয় ও তাদের সংখ্যাই বাড়াতো। একদিন সকালে গীত গাইছিল সে দশ মিনিটের জন্যে। বড় মহারাজের কানে রেডিওর সেই গান পৌঁছায়। ভাল লাগায় তিনি ওর নামটি মনে রাখেন। কিছুদিন পরে বাবা জানতে চান শিল্প সাহিত্য সঙ্গীত জগতে উদীয়মান প্রতিভা তেমন কেউ আছে কিনা। বড় মহারাজ তখন ধ্যানেশের নাম করেন। বাবা ধ্যানেশের সন্ধান নিতে বলেন। সেই ধ্যানেশ এখন ভারতবর্ষের বিখ্যাত শিল্পী। আর তাকে কেরানিগিরি করতে হযনি। এগিয়ে যাওয়ার পথে যে কোন বাধা এলেই সে বাবার কাছে ছুটে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাধা অপসারিত। প্রতিটি পূর্ণিমার রাত্রে সে এসে বাবাকে গীত এবং ভজন শোনায়। যত ব্যস্ত থাক বাবার জন্মদিনে এখানে সে আসবেই। বাবার লেখা কিছু গীতিকবিতায় সুর দিয়েছে সে। লক্ষ লক্ষ কপি ক্যাসেট বিক্রী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মেজ মহারাজ অপারেটরকে বললেন ধ্যানেশকে ধরতে। অবিলম্বে। লাইন পাওয়া মাত্র অপারেটর যেন বোর্ড ছেড়ে চলে যায় পাঁচ মিনিট। এটা আদেশ।

মেজ মহারাজ সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলেন। সেটি শেষ করার মধ্যেই কর্মীরা এসে গেল। তাদের পুরো কর্তব্য বুঝিয়ে অবিলম্বে দিনরাত কাজ শুরু করার নির্দেশ দিলেন তিনি। ওরা বেরিয়ে যাওয়া মাত্র টেলিফোন বাজল। ধ্যানেশের গলা পাওয়া গেল, ‘জয় বাবা। কেমন আছেন মেজ মহারাজ?’

‘জয় বাবা। ভাল। বাবার আশীর্বাদে তো খারাপ থাকা উচিত নয়। তোমাকে খুব জরুরী প্রয়োজনে ডেকেছি। এখনই তুমি সনাতননাথের আশ্রমে চলে যাও। সম্ভবত তাঁর দর্শন তুমি পাবে না কিন্তু তাঁর প্রধান শিষ্য নিত্যনাথের সাক্ষাৎ পাবে। তুমি যাচ্ছ বাবার প্রতিনিধি হয়ে। অতএব ওরা তোমাকে গ্রহণ করতে বাধ্য।’

‘আপনি আমাকে কি করতে আদেশ করছেন?’

‘গত পূর্ণিমায় এখানে এসে তুমি জেনেছিলে সনাতননাথ ঈর্ষাবশত আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে চলেছেন। তাঁর শিষ্যদের একাংশ বাবার শিষ্যত্ব গ্রহণ করায় এই ঈর্ষা মাত্রা ছাড়িয়েছে। ব্যাপারটা এতকাল উপেক্ষা করা হয়েছিল। হঠাৎ আজ সকালে আমাদের কলকাতার বাড়ি থেকে ছোটে মহারাজ উধাও হয়ে গেছেন। আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে এর পেছনে সনাতন নাথের ভূমিকা আছে। তুমি বাবার দূত হিসেবে ওদের সঙ্গে দেখা করবে। বলবে যে ছয় ঘণ্টার মধ্যে সনাতননাথ যেন ছোটে মহারাজকে ফিরিয়ে দেন। নইলে পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে। তোমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’ মেজ মহারাজ আচমকা প্রশ্ন করলেন।

‘যদি ওঁরা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তাহলে কি?’

‘না। তুমি দূত। অপমান সহ্য করে ফিরে আসবে। ব্যবস্থা নেবার দায়িত্ব আমাদের।’

‘ছোটে মহারাজকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাকে দেবেন?’

‘না। তার জন্যে অন্যলোক আছে। তুমি একজন সঙ্গীতশিল্পী। তুমি সেইমত আচরণ করবে। ফিরে এসেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’ মেজ মহারাজ টেলিফোন রেখে দিতেই উপাসনা সঙ্গীত শুনতে পেলেন। উপাসনাগৃহ থেকে মাইকে সমস্ত আশ্রম প্রাঙ্গণে ওই সুরতরঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেজ মহারাজ তাঁর নিজস্ব উপাসনা কক্ষে গিয়ে নতজানু হলেন। চোখ বন্ধ করে তিনি উপাসনাসঙ্গীত গাইতে লাগলেন। উপাসনা সঙ্গীতের পর ধ্যান। আধঘণ্টার জন্যে এই জগৎসংসার থেকে চিত্তের মুক্তি। তখন বোধ পৌঁছে যাবে সেই স্তরে যেখানে সেই মহান বর্তমান। আজকাল প্রথম পনের মিনিটের প্রয়োজন হয় মেজ মহারাজের মন স্থির করতে। তারপর ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে অতিক্রম করতে পারেন। একবার সেই স্তরে পৌঁছে গেলে আর ফিরে আসার বাসনাও লোপ পায়। ধ্যান সমাপ্তির ঘণ্টা মাইকে প্রচারিত হতেই যে শব্দতরঙ্গ চেতনায় আঘাত করে তাই বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ধ্যানের পর বাবা ভাষণ শুরু করলেন। মেজ মহারাজ তাঁর এই কক্ষে বসেও সেই ভাষণের প্রতিটি শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। বাবা বললেন, ‘কেউ কেউ বলে আমার কাছে এসেও নাকি আমার দেখা পাওয়া যায় না, কথা শোনা যায় না। তা আমি বলি আমাকে কি তারা সত্যি দেখতে চায়? নাকি আমার মধ্য দিয়ে ঈশ্ববকে দেখতে চায়! তা তাঁকেই তো সবাসরি দেখলে হয়। আমি তাঁর দালাল না পাণ্ডা যে দেখাবার দায়িত্ব নিয়েছি। বুদ্ধি যাদের বাড়াবাড়িরকমের তাদের কাছে আমি কে? কিন্তু তাই বলে কি মা শিশুকে হাঁটতে শেখায় না? অসুস্থকে নার্স পরিচর্যা করে না? করে। অসহায় মানুষকেই তো সাহায্য করা দরকার। নইলে তুমি তো স্বার্থপর। এই মানুষেরা যখন আমার কাছে আসে তখন না দেখা দিয়ে আমি পারি। নিন্দুক যারা তারা ভোর হবার সময়েও মিথ্যে বলে যাবে। তা যা বলছিলাম, ওরা বলে ঈশ্বরের সৃষ্টি, ঈশ্বর ধ্বংস করেছেন, ঈশ্বর এই করলেন সেই করলেন। আরে ঈশ্বরের অত সময় কোথায়? কোটি কোটি মানুষ রোজ জন্মাচ্ছে, অজস্র কোটি প্রাণ নিত্য পৃথিবীতে আসছে, একা ঈশ্বরের পক্ষে সব সামলে ওঠা সম্ভব? তাহলে কি করে হচ্ছে? না। ঈশ্বর সৃষ্টি করেন না। এবং সৃষ্টি করেন না বলেই ধ্বংস করার ইচ্ছেও তাঁর হয় না। এই যে মানুষ, নানারকম বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যে মানুষের আকার নিয়েছে, নিজের প্রয়োজনমত যে বিন্যস্ত হয়েছে তার ভাল মন্দ, দোষ—গুণই সৃষ্টি কিংবা ধ্বংসকে ডেকে আনে।

সুধাময় সেনের বয়স হয়েছে। দীর্ঘকাল তিনি পুলিশ সার্ভিসে ছিলেন। বাবার আশীর্বাদে আইনসঙ্গত রিটায়ারমেন্টের বয়সে পৌঁছানোর আগেই তিনি স্বইচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এই ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। আজ তাঁর এজেন্সির নামডাক পশ্চিমবাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষিত এবং দক্ষ গোয়েন্দাবাহিনী তাঁর অধীনে কাজ করে। অর্থ আসছে হু হু করে। পুলিশ যা পারে না তা তিনি ওই বাহিনীর সাহায্যে সমাধান করেছেন অনেকবার।

সুধাময় কিন্তু আজ সন্ত্রস্ত হয়ে টেলিফোনের সামনে বসে আছেন। তাঁর এই অফিসের টেলেক্স নিয়মিত আশ্রমে সংবাদ দিয়ে যাচ্ছে। মেজ মহারাজ টেলেক্স ব্যবহার না করে কেন যে টেলিফোনে কথা বলতে গেলেন! হাজার হোক এতে গোপনীয়তা থাকে না। কিন্তু বাবা এবং তাঁর প্রধান শিষ্যদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। যে সময়সীমার মধ্যে ছোটে মহারাজকে খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে তার অর্ধেকটা খরচ হয়ে গিয়েছে। বাবার অবাধ্য হওয়া মানে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করা। কিন্তু তিনি কি করতে পারেন! একটি একুশ বছরের ছেলে যদি স্বইচ্ছায় পালিয়ে যায় তাহলে তাকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া এই ক’ঘণ্টায় তিনি যেসব সংবাদ পেয়েছেন তাতে আরও নাভার্স হয়ে পড়েছেন। বাবার কনিষ্ঠ পুত্র এই কলকাতায় পড়তে এসে নিয়মিত ক্লাস করতেন না। সেবকরা গাড়ি নিয়ে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে আসত কলেজে আবার বিকেলে ফিরিয়ে আনত। এই সময়টুকু পাঠে ব্যবহার না করে ছোটে মহারাজ গোপনে বেরিয়ে যেতেন। কখনও কফি হাউসে কখনও খিদিরপুরে ওই সময়ে তাঁকে দেখা গিয়েছে। অবশ্য যেখানেই যান তিনি ফিরে আসতেন কলেজ ছুটির আগেই। সুধাময় জানেন অবশ্যই বাবা কিংবা বড় বা মেজ মহারাজ এই তথ্য পাননি। বাবা যে অন্তযামী সেই বিশ্বাস সুধাময়ও করেন। কিন্তু তিনি কনিষ্ঠ পুত্রের আচরণ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকলেন কোন লীলায় তাই বোধগম্য হচ্ছিল না। ছোটে মহারাজের খিদিরপুর অঞ্চলে যাতায়াতের ব্যাপারটাই তাঁকে চিন্তিত করছিল। আশঙ্কা হচ্ছিল আরও এমন খবর পাবেন যা শিহরিত করবে। এই কলেজ পালানোর ব্যাপারটা বড় মহারাজকে জানানো কর্তব্য। গাফিলতি ধরা পড়তে বিলম্ব হবে না। সুধাময়ের মনে পড়ে আজ থেকে মাত্র দশ বছর আগে একটি অপরাধের কিনারা করতে তিনি পুলিশ অফিসার হিসেবে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন। অপরাধী এত সেয়ানা ছিল যে তিনি কিছুতেই কূল পাচ্ছিলেন না। বিফল হয়ে কলকাতায় ফিরে আসার আগে তিনি বাবার কথা জানতে পারেন। বাবার নাম অবশ্য কলকাতাতেই কানে এসেছিল কিন্তু তেমন আগ্রহ তৈরী হয়নি। আশ্রমের এত কাছে এসে বাবাকে দেখার ইচ্ছে হল। তখনও লাইন পড়ত। তিনি লাইনে দাঁড়িয়েও ছিলেন। যারা আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে আসে, লাইনে দাঁড়ালে বাবার ইচ্ছানুযায়ী তাদের কেউ কেউ দর্শন পেয়ে যায়। প্রায় শেষ মুহূর্তে একজন সেবক এসে তাঁকে লাইন থেকে বেরিয়ে আসতে বলল। কিছুটা মুগ্ধ হয়েই তিনি সেবককে অনুসরণ করে মেজ মহারাজের কাছে পৌঁছে গেলেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে মেজ মহারাজ বড় মহারাজের কাছে নিয়ে গেলেন। বড় মহারাজ তাঁর উত্তর বাংলায় আসার উদ্দেশ্য এবং কাকতালীয় ভাবে বাবাকে দর্শনের আকাঙ্ক্ষার কথা জেনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। সেই সময় একজন শিষ্য এসে কান্নাকাটি শুরু করায় সম্ভবত তার প্রতি বিরক্ত হয়েই বড় মহারাজ সুধাময়কে নিয়ে বাবার কাছে উপস্থিত হন। বাবা তখন কয়েকজন শিষ্যের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। তার মধ্যেই একজন শিষ্য সাষ্টাঙ্গে বাবার শ্রীচরণে চুম্বন করছিল। সেই ভক্তিময় পরিবেশে সুধাময় নিজের অজান্তেই নতজানু হয়ে বসে পড়লেন। শুধু দক্ষ পুলিশ অফিসার নয়, কর্তব্যে কঠোর হওয়ার জন্যে সুধাময়ের কুখ্যাতি বেড়েছিল অপরাধী মহলে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তিনি নিজেকে ভুলে গিয়েছিলেন। বাবার দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল ওই জ্যোতির্ময় পুরুষের কাছে তাঁর কোন কিছুই অজ্ঞেয় নেই। হঠাৎ বাবা বললেন, ‘কাজ শেষ না করে ফিরে যাওয়া তোমায় মানায় না। দুষ্টের দমন তোমার মাধ্যমেই হবে। কিন্তু ছেলে, এখন থেকে নিজের ময়লা সাফ করার উদ্যোগ নিতে আর দেরি করো না। তোমার গাড়ি কখন?’

সুধাময় কোনক্রমে সময়টা বলতে পেরেছিলেন। তাঁর সমস্ত শরীরে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারিত হচ্ছিল। এত সুখ তিনি জীবনে কখনও অনুভব করেননি। হঠাৎ মনে হল তিনি গভীর জলের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কিন্তু ওপরে উঠে আসার কোন ক্ষমতা নেই। এবং সেই মুহূর্তে এক উজ্জ্বল আলো ওই গভীর জলের তলায় আবির্ভূত হল। তিনি শেষবার কোনক্রমে চোখ মেলে দেখলেন উজ্বল আলো এক সুন্দর মূর্তি ধারণ করে তাঁকে সস্নেহে জলের ওপর টেনে তুলছে। বাতাসের স্পর্শ পেতেই সেই আলোকময় পুরুষ হেসে বললেন, ‘যা। চলে যা।’ ব্যাপারটা কি হল বোঝার আগেই মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তিনি শুনতে পেলেন, ‘ওরে,ওকে একটু পরমান্ন দে।’

সুধাময় চোখ মেলে দেখলেন বাবা অন্যান্য শিষ্যদের সঙ্গে আলাপ করছেন। কারো নজর এদিকে নেই। সুধাময় বুঝতেই পারছিলেন না তিনি যা দেখলেন তা সত্যি না স্বপ্ন। এইসময় এক সেবক এসে পরমান্ন দিয়ে গেল। খুব সন্ত্রস্ত হয়ে তিনি তা খেলেন। মনে হল অমৃতের স্বাদ এর কাছে কিছু নয়। এইসময় বাবা বললেন, ‘আর দেরি করো না। ট্রেন তো বসে থাকবে না।’ তিনি নতজানু হয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে এলেন। স্টেশনে পৌঁছানো পর্যন্ত তাঁর শরীরে যেন শক্তি ছিল না। টিকিট আগেই কাটা ছিল। সুধাময় দেখলেন আর বেশী দেরি নেই ট্রেন আসার। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল দূরে একটা চায়ের স্টলের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকা ঘুরে খবরের কাগজ পড়া শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে সুধাময় সেনের কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি কোমর থেকে রিভলবার বের করে এগিয়ে গেলেন। লোকটির উল্টোদিকে পৌঁছে বুঝতে পারলেন ওটি দিন কয়েক আগের কাগজ। অপরাধীকে বন্দী করতে তাঁর কোন অসুবিধে হয়নি। এবং এই কাজের জন্যে ডিপার্টমেন্টে তাঁর সুখ্যাতি বেড়েছিল। সি সি রোলে ভাল কথা লেখা হয়েছিল। কিন্তু এসবে আর মন ছিল না সুধাময়ের। তিনি তখন প্রতি শনিবার কলকাতা ছেড়ে উত্তর বাংলায় আসা শুরু করলেন। গভীর জলের নিচে যে আলোকময় পুরুষ তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত রূপ তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। আজ সুধাময় জানেন কোন কিছুই তাঁর অজানা থাকে না। অতএব যে রিপোর্টই আসুক আশ্রমে পাঠানো তাঁর কর্তব্য। এইসময় রায় তাঁর ঘরে ঢুকল। সুধাময় সেনের ডিটেকটিভ এজেন্সির এক নম্বর অফিসার হচ্ছে রায়। সুধাময় তাঁকে দেখে আশান্বিত হলেন। রায় চেয়ারে বসে বলল, ‘খুব অদ্ভুত ধরনের কেস স্যার। এই ছোটে মহারাজ কলকাতার ভূগোল ভাল করে জানেন না বলে তিনু মহারাজের ধারণা। কিন্তু ওকে ট্যাংরার কাফেলা রেস্টুরেন্টেও দেখা গিয়েছে।’

‘কবে?’ সুধাময় সোজা হয়ে বসলেন।

‘দিন সাতেক আগে। এক দুপুরে। ওঁর কলেজের নাম নির্মল ভট্টাচার্য। ছোটে মহারাজ হিসেবে বন্ধুবান্ধবরা চেনে না। খিদিরপুরের ব্রিজের নিচে এক সোর্স বলল নির্মলের ট্যাংরায় যাতায়াত ছিল। সেই সূত্রেই কাফেলার খবর পেলাম।’ রায় জানাল।

‘কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি কোথায়?’

‘সেটাই বুঝতে পারছি না। কাপড়ের দড়ি বেয়ে নির্মল নামেন একাই এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ওর সবকটা বন্ধুকে ট্যাপ করেছি কিন্তু হদিশ পাইনি।’

রায়ের বক্তব্য শুনে বিরক্ত হলেন সুধাময়, ‘রায়, আপনি আমার কাছে ওঁকে ছোটে মহারাজ বলে রেফার করবেন। আর হদিশ পাইনি বললে আমরা কোথাও পৌঁছাচ্ছি না। হদিশ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোন সময়ে ছোটে মহারাজ ফ্ল্যাট থেকে চলে গিয়েছেন?’

‘মনে হয় ভোরের একটু আগে। ঠিক ভোরবেলায় ওই বাড়ির পেছনের খাটালে অনেকে দুধ নিতে আসে। সেইসময় বেরুলে নজরে পড়তই।’ রায় জানাল।

‘খিদিরপুরের সোর্স কি বলল? ওখানে কেন যেতেন উনি?’

রায় মাথা নিচু করল। তারপর বলল, ‘স্যার, আমি অনুমান করছি ওঁর ব্যাপারে আপনার কোন সফ্টনেস কাজ করছে। কিন্তু ঘটনা হল ছোটে মহারাজ ট্যাবলেট খাওয়া শুরু করেছিলেন।’

‘হা বাবা!’ চিৎকার করে উঠলেন সুধাময়, ‘কি যা-তা বলছেন আপনি?’

‘এটা সত্যি ঘটনা। তবে দেখা গিয়েছে মাত্র দুবার। সোর্স যা বলছে তাতে মনে হয় এখনও পাকাপাকি এ্যাডিক্ট হননি। প্রথমদিন গিয়েছিলেন সাপের ছোবল খাওয়া দেখতে।’

‘কে খেয়েছিল?’

‘ওখানকার এক পুরোন খদ্দের। ছোটে মহারাজ এসেছিলেন আর একজন সঙ্গীর সঙ্গে।’

‘সেই সঙ্গীটি কে?’

‘তাকে ট্রেস করেছি। কিন্তু ছেলেটা আউট অফ দি সিটি এই মুহূর্তে।’

‘ফাইন্ড হিম। তবে তার আগে সমস্ত রিপোর্টটা টাইপ করে আমার কাছে দিয়ে যান। আমাকে ওটা এখনই পাঠাতে হবে।’ সুধাময়ের ইঙ্গিতে রায় উঠে গেল। আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। সুধাময়ের বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড যেন সেই শব্দে নড়ে উঠল। তিনি জানেন টেলিফোন এসেছে আশ্রম থেকে। কি বলবেন তিনি, কি বলতে পারেন! রিসিভার না তুলে যে এই মুহূর্তে এড়িয়ে যাবেন তাও সম্ভব নয়। কারণ তাঁর নজর এখন এখানেও রয়েছে। কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে হেলো বলতেই ওপার থেকে গলা ভেসে এল, ‘জয় বাবা। সুধাময় বলছেন? আমি তিনু মহারাজ। কোন খবর পেলেন? আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে!’

নতুন কেনা মারুতি এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে ঠিকানাটা বলল ধ্যানেশ। একটু আগে সনাতননাথের আশ্রমের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। সনাতননাথ তো দূরের কথা, তাঁর প্রধান শিষ্য নিত্যনাথ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি সে। আশ্রমের অধ্যক্ষকে সে জানিয়েছে বাবার প্রতিনিধি হিসেবে কোন বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। ব্যাপারটা খুব জরুরী। বাবার নাম শুনে অধ্যক্ষ খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। ধ্যানেশের নামও তিনি শুনেছেন। টেলিফোন নম্বর নিয়ে পরে জানাবেন বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মিনিট দশেকের মধ্যেই টেলিফোন বেজেছিল। অধ্যক্ষ জানিয়েছিলেন প্রভু তাঁর প্রধান শিষ্য শ্রীনিত্যনাথের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু ওই আলোচনা দশ মিনিটের বেশী স্থায়ী হবে না।

দশ মিনিটই সই। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কলকাতার ট্রাফিক কাটিয়ে ড্রাইভার নিপুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাবা যদি আদেশ দেন তাহলে সে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের ছাদ থেকেও লাফিয়ে পড়তে পারে। সনাতননাথ এখন তাদের শত্রুপক্ষ। কিন্তু দূতের কোন ভয় নেই। ইদানিং অনুষ্ঠান রেকর্ড আর ছবিতে গান গাইতে গাইতে এক ধরনের একঘেঁয়েমি এসে গিয়েছিল। বাবার গানগুলো গেয়ে ধ্যানেশের মনে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারিত হয়েছে। তার কোন গানের ক্যাসেট পঞ্চাশ লক্ষ বিক্রি হয়নি। ধ্যানেশ চায়নি ওই বাবদ দক্ষিণা নিতে। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় তাকে ক্যাসেট পিছু এক, টাকা নিতে হয়েছে। এর পরিমাণ অনেক শিল্পীর সারাজীবনের স্বপ্ন। বাকিটা আশ্রমের কল্যাণে সে প্রণামী হিসেবে দিয়ে দিয়েছে। ধ্যানেশ জানে আজ ভারতবর্ষের অনেক নামজাদা শিল্পী তাকে ঈর্ষা করে। গতবছর লন্ডনে সমস্ত পৃথিবীর সেরা সঙ্গীতশিল্পীদের একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে ওরা একজন পুরুষ শিল্পীকে চেয়েছিল। অবধারিতভাবে ধ্যানেশের নাম তখন উল্লেখিত হয়নি। কিন্তু পূর্ণিমার রাত্রে ভজনের পর হঠাৎ বাবা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিরে, মনে কোন কষ্ট হয়?’ তখনই সে বলেছিল, ‘আপনি আশীর্বাদ করুন যাতে পৃথিবীর সবাইকে গান শোনাতে পারি। আপনার বন্দনা সবার সামনে করতে পারি।’

আর তার কয়েকদিন পরেই খবর এসেছিল ধ্যানেশ নির্বাচিত হয়েছে ভারতবর্ষের প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনের সম্মেলনে গান গাইবার জন্যে। একথা ঠিক, বাবা যদি তাকে সামান্য করুণা না করতেন তাহলে আজ তাকে লালদীঘিতে বাদাম খেতে হত। সেই দুঃসময়ে হঠাৎ বাবার এক শিষ্য এসে অনুরোধ করলেন আশ্রমে যাওয়ার জন্যে। তখন সংসারের হাল খুব খারাপ। গান গাওয়া প্রায় বিলাসিতার পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। দেবদ্বিজে কোন ভক্তি ছিল না। তবু কি মনে হল ধ্যানেশ রাতের ট্রেনে আশ্রমে পৌঁছালো। এত ভিড়, এত ধর্মীয় অনুশাসন, এত নিয়মকানুন যে সে শুধু বাবার দর্শন পেয়েছিল কিন্তু গান শোনাবার সুযোগ পায়নি। ফেরার সময় ট্রেনের জানলায় বসে সিগারেট খাচ্ছিল। ওটাও ছিল রাতের ট্রেন। ধ্যানেশের একটা পুরোন অভ্যেস আছে। টাকা ভাঁজ করে সিগারেটের বাক্সে ভরে রাখত যাতে পকেটমার না বুঝতে পারে। আজ সেইসঙ্গে টিকিটটাও রেখেছিল। শেষ সিগারেট খাওয়া হয়ে গেলে অন্যমনস্ক হয়ে প্যাকেটটাকে সে ছুঁড়ে দিল জানলা গলিয়ে। এবং তখনই তার খেয়াল হল টাকা ও টিকিটের কথা। টাকা বেশি ছিল না কিন্তু টিকিট ছাড়া যে দুরবস্থায় পড়তে হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠেছিল। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে হু হু করে ট্রেন ছুটে যাচ্ছিল। ধ্যানেশ দেখতে পেল টিকিট চেকার এপাশে এগিয়ে আসছে। কি করবে বুঝতে না পেরে সে প্রাণপণে বাবাকে ডাকতে লাগল। পরে সে অনেকবার এই ব্যাপারটার কথা ভেবেছে। কেন তার ওই মুহূর্তে বাবার কথা মনে পড়েছিল কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু যেই বাবার সদাহাস্যময় মুখ মনে ভেসে উঠল অমনি ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল আচমকা। যাত্রীরা ট্রেন থামার কারণ জিজ্ঞাসা করছিল টিকিট-চেকারকে। সঙ্গে সঙ্গে হুঁশ ফিরল ধ্যানেশের। একটি নির্জন প্রান্তরে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ! আকাশময় তারা আর অন্ধকার। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে সে লাফিয়ে নেমেছিল দরজা দিয়ে। খোয়া বিছানো রেলপথ ধরে দৌড়ে যাচ্ছিল পেছনের দিকে। কেন যাচ্ছে কোথায় যাচ্ছে সেই খেয়াল নেই তখন। ট্রেন ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর চেতনা হল। ট্রেন যে গতিতে এসেছিল তাতে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অন্তত সিকি মাইল পেছনে উড়ে পড়েছে সেটা। তাছাড়া ওটা লাইনের আশেপাশেই যে পড়বে তার কোন মানে নেই। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ধ্যানেশের মনে হয়েছিল নামবার সময় জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়নি। তাহলে কাছাকাছি স্টেশনে পৌঁছে নতুন করে টিকিট কেনা যেত। পকেটে টাকা না থাকলেও হাতের ঘড়ি বিক্রী করে কিছু অন্তত পাওয়া যেত। সে ট্রেন পেছনে রেখে পাগলের মত রেললাইনের একপাশ খুঁজতে চেষ্টা করছিল। মিনিট পাঁচেক পরেই সে প্যাকেটটাকে দেখতে পেল। একেবারে লাইনের ধারে পড়ে রয়েছে সোজা হয়ে। ছোঁ মেরে ওটাকে তুলে নিয়ে দেখল টিকিটটা আছে কিনা! নিশ্চিন্ত হয়ে ধ্যানেশ আকাশের দিকে তাকাল। বিড়বিড় করে বাবাকে ডাকল। তারপর প্যাকেটটাকে মুঠোয় নিয়ে ছুটতে ছুটতে দেখল ট্রেনটা আবার ছাড়ার জন্যে গর্জন শুরু করেছে। নিজের কামরায় যখন পৌঁছাতে পারল তখন ট্রেন দুলকি চালে চলতে শুরু করেছে। টিকিট চেকার দাঁড়িয়েছিল দরজায়। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘কি মশাই, অমন চোরের মত দৌড়ে গেলেন কেন? ধান্দাটা কি?’

ধ্যানেশ আমতা আমতা করেছিল। চেকার বলেছিল, ‘সামনের ব্রিজটা একটু খারাপ বলে ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। না পৌঁছাতে পারলে তো আপনাকে ছেড়েই আমরা চলে যেতাম। দেখি, আপনার টিকিট দ্যাখান।’ হাত বাড়িয়েছিল লোকটা।

সিগারেটের প্যাকেট থেকে যখন টিকিট বের করে এগিয়ে দিল ধ্যানেশ তখন বাবার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় তার হৃদয় মথিত। সেই শুরু। বাবার অস্তিত্ব তার জীবনের প্রতি পদক্ষেপে এরকম প্রমাণ বারংবার পেয়ে আসছে সে। আজ যদি বাবার সেবার জন্যে সে কিছু করতে পারে তাহলে নিজেকে ধন্য বলে মনে করবে। গত পূর্ণিমায় গান গাইতে গিয়ে শুনে এসেছিল যে সনাতননাথ আরও কিছু ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।

কিন্তু ওরা যে ছোটে মহারাজ পর্যন্ত হাত বাড়াবে তা কল্পনা করা যায়নি। ছোটে মহারাজ বাবার সংগঠনের মধ্যে কোন পদে নেই। ধার্মিক জীবন যাপন করতে গেলে যে শিক্ষাকে এড়িয়ে যেতে হবে এই বিশ্বাস বাবার নেই। তিনি একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হিসেবে ছোটে মহারাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আশ্রমের অনুশাসনের মধ্যে ওঁকে এখনই বাঁধতে চাননি। কলকাতার বাড়িতে গিয়ে ধ্যানেশ অনেকদিন গান করে এসেছে। ছোটে মহারাজকেও সে দেখেছে। একটি পবিত্র চেহারার তরুণ ছাড়া কিছু মনে হয়নি। কিন্তু তার এও জানা আছে পরবর্তীতে এই তরুণই সাধনার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছাবে। সিংহের সন্তান কখনই সারমেয় হয় না। এই উজ্জ্বল তরুণকে যদি সনাতননাথের শিষ্যরা আটকে রেখে কোন চাপ তৈরি করতে চায় তাহলে—! ধ্যানেশ ভেবে পাচ্ছিল না, কি ভয়ঙ্কর পরিণাম হতে যাচ্ছে। বাবা এখনই ব্যাপারটা প্রকাশ করতে চান না কিন্তু যদি তাঁর কোটি কোটি শিষ্য সত্য জানতে পারে, তাহলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে সনাতননাথের আশ্রমের ওপর। মহারাজ তাকে বলেছেন সে যেন দূত এবং সঙ্গীতশিল্পীর মত আচরণ করে। অতএব ওই সময় নিজেকে সংযত রাখলেই হবে।

সনাতননাথের আশ্রম কলকাতার উপকণ্ঠে। জায়গাটি নির্জন। বিশাল প্রাচীরে ঢাকা বাড়িটির সদরে চারজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনে গৈরিক বস্ত্র। কোমর বন্ধনী থেকে ভোজালি ঝুলছে। প্রহরীদের প্রত্যেকেরই দাড়ি রয়েছে। ভঙ্গিতে উদ্ধত ভাব। গাড়ি থামা মাত্র একজন প্রহরী এগিয়ে এল। ধ্যানেশ বলল, ‘আশ্রমাধ্যক্ষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে এইসময় আসতে বলেছেন।’ প্রহরী জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার নাম?’ প্রশ্নটি হিন্দীতে।

ধ্যানেশ অবাক হল। পশ্চিমবাংলার যে কোন জায়গায় সে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে ভিড় জমে যায়। আগে থেকে জানা থাকলে লোকে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে আসে। সবাই তাকে চেনে এই ধারণাতেই সে এখন অভ্যস্ত। যেন কোন বিদেশীর সামনে দাঁড়িয়েছে ধ্যানেশ এমন মনে হচ্ছিল। তবু নাম বলতে হল। প্রহরী বাংলাভাষাতেই বলল, ‘ও, আসুন। আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার আদেশ আছে।’ গেট খুলে গেল। একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ড্রাইভারের পাশের আসনে বসে বলল, ‘সোজা এগিয়ে গিয়ে ডাইনে ঘুরতে হবে।’

গাড়ি চলছে কাঁকর বিছানো পথে। তীব্র আলোয় চারধার উজ্জ্বল। মাঝে মাঝে বিদেশী বিদেশিনীদের দেখা যাচ্ছে। দেশী শিষ্য-শিষ্যারা দলবদ্ধভাবে ঘোরাফেরা করছে। প্রত্যেকের পোশাক গেরুয়া। একটি দোতলা বাড়ির সামনে পৌঁছে প্রহরী ড্রাইভারকে থামতে বলল। সে দরজা থেকে নেমে দাঁড়াতেই আর একজন প্রহরী সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে কথা বলল। ধ্যানেশ গাড়ি থেকে নেমে দ্বিতীয়জনকে অনুসরণ করল। এইসময় অন্য কোন ভবন থেকে প্রার্থনা সঙ্গীত ভেসে এল। ধ্যানেশ দেখল দুজন প্রহরী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেই প্রার্থনায় যোগ দিয়েছে। তার এই মুহূর্তে কিছুই করার নেই। সামনের লন, পথে যারা ঘোরাফেরা করছিল তারাও এই মুহূর্তে স্থির। যেন সমস্ত কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।

প্রার্থনা শেষ হলে প্রহরী আবার সচল হল। সিঁড়ি ভেঙে ওরা দোতলায় উঠে আসতেই একজন মুণ্ডিত-কেশ শিষ্য এগিয়ে এসে পরিচয় জানতে চাইলেন। এতক্ষণে নিজের ওপর আস্থা হারিয়েছে ধ্যানেশ। তাহলে এই কলকাতা শহরের অনেকেই তাকে চেনে না!

শিষ্যটি ধ্যানেশকে অনুসরণ করছিলেন। দ্বিতীয় দরজায় পৌঁছে ঘর পেরোতেই শিষ্য ঘোষণা করল, ‘ধ্যানেশ ভট্টাচার্য আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যান, ভেতরে যান।’

ধ্যানেশ জুতো খুলে ভেতরে ঢুকল। সুন্দর কার্পেটের ঠিক মাঝখানে বসে আছেন আশ্ৰমাধ্যক্ষ। তাঁরও পোশাক গেরুয়া। বয়স পঞ্চাশের ওপাশে। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বসুন।’ ধ্যানেশ ঈষৎ দূরত্ব রেখে পা মুড়ে বসল। আশ্ৰমাধ্যক্ষ বললেন, ‘বাবা আপনাকে পাঠিয়েছেন জেনে আমরা অবাক হয়েছি। আপনি শ্রীনিত্যনাথের সঙ্গে কথা বলতে চান?’

‘না। আমি শ্রীসনাতননাথের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম।’

‘একটু সংশোধন করিয়ে দিচ্ছি। মহাপুরুষকে আমরা শ্রীশ্রী বলেই অভিহিত কবি। এর পরের বার মহাপুরুষের নাম ব্যবহার করতে হলে দুইবাব শ্রী বলবেন। যেকথা বলছিলাম, মহাপুরুষের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ এই মুহূর্তে অসম্ভব।’ প্রধানাধ্যক্ষ হাসলেন, ‘আর এই বিষয়ে আমরা সম্ভবত টেলিফোনেও আলোচনা করেছি, তাই না?’

‘বেশ। তাহলে আমি শ্রীনিত্যনাথের সঙ্গেই কথা বলব।’

‘বিষ্যটা জানতে পারি?’

‘আমি বাবার প্রতিনিধি হিসেবে এসেছি। বিষয়টি আমি শ্রীশ্রীসনাতননাথের উপযুক্ত প্রতিনিধির সঙ্গেই আলোচনা করতে চাই।’

‘আপনি মোটামুটি গান-বাজনা করেন বলেই শুনেছিলাম কারো কাছে, কিন্তু কুটনৈতিক কথাবার্তাতেও অভ্যস্ত তা জানতাম না। শ্রীনিত্যনাথ এখনই এখানে উপস্থিত হবেন। আপনি অপেক্ষা করুন।’ আশ্রমাধ্যক্ষ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে একটি হালকা নীল আলো জ্বলছিল। কাছাকাছি কোথাও কি জেনারেটার চলছে? সেইরকম আওয়াজ কানে এল। এই বিশাল ঘরে পুরু কার্পেটের ওপর পা মুড়ে বসে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ধ্যানেশের। প্রহরীরা তাকে চিনতে পারেনি সে নাহয় মানা গেল, কিন্তু আশ্রমাধ্যক্ষ বললেন যে সে মোটামুটি গান গায়! ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করেছে যে, ইচ্ছেমতো ছবি নির্বাচন করে গান গেয়ে থাকে যে, সে মোটামুটি গায়? অপমানের আর কি বাকি থাকল! তাও উনি শুনেছেন কারো কাছে, নিজের কানে নয়। যেকোন বারোয়ারি পুজোয় মাইকে তার গান বাজে। অদ্ভুত। শূন্য ঘরে চোখ ফিরিয়ে ধ্যানেশের মনে হল ঘরের নীল আলো যেন হালকা থেকে একটু বেশি ঘন হয়েছে। কার্পেটের রঙ সেই গাঢ় নীলে জমাট সমুদ্রের মত মনে হচ্ছে। ধ্যানেশ যেন তার মানসিক শান্তি হারিয়ে ফেলছিল। মনের জোর ফেরাতেই সে বাবাকে ডাকতে লাগল নিঃশব্দে।

‘কি কারণে আপনাকে এই আশ্রমে বাবা পাঠিয়েছেন?’

কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল ধ্যানেশ। ঘরের শেষ প্রান্তে সিংহাসনের মত একটি চেয়ারে বসে আছেন মুণ্ডিত-কেশ শীর্ণ বৃদ্ধ। ঘন নীল তাঁর অঙ্গের গৈরিক পোশাকে মাখামাখি হয়ে এক বিচিত্র রঙের জন্ম দিয়েছে। ধ্যানেশ হাতজোড় করল। সে যেন হঠাৎই তীব্রভাবে মানসিক শক্তি ফিরে পেল, ‘আমি কি শ্রীনিত্যনাথের সঙ্গে কথা বলছি?’

‘সতর্কতার কোন প্রয়োজন ছিল কি? হ্যাঁ, আপনি আমার সঙ্গেই কথা বলছেন। শ্রীনিত্যনাথকে এক ফোঁটা নড়তে দেখল না ধ্যানেশ। তিনি কখন যে এই ঘরে ঢুকে ওই সিংহাসনে বসেছেন তাও তার নজর এড়িয়ে গিয়েছে। সে বলল, ‘আমার আসার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আপনি জানেন। অতএব বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।’

শ্রীনিত্যনাথ বললেন, ‘আশ্চর্য! আমি অন্তযামী নই। আমি মহাপুরুষ শ্রীশ্রীসনাতননাথের দীন সেবক মাত্র। কোনরকম ভেলকিবাজিতে বিশ্বাস করার শিক্ষা মহাপুরুষ আমাদের দেননি। আপনি গৃহী। জানি না কেন বাবা আপনাকে নির্বাচন করলেন তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে। যাহোক, আপনার আগমনের উদ্দেশ্য আমার জানা নেই।’

ধ্যানেশ থতমত খেয়ে গেল। ওই বৃদ্ধ যে কথায় অনেক বেশি পারদর্শী তা বুঝতে আর বাকি রইল না। অতএব একটু বুদ্ধিমানের মত এগোতে হবে। সে বলল, ‘আপনার কাছে একটু অনুগ্রহ চাই। সাধারণ মানুষ আমি, সাধারণ আলো ও পরিবেশে কথা বলতে স্বস্তি বোধ করি। এই নীল আলোর ঘনত্ব যদি কমিয়ে দেন তাহলে সুবিধে হয়।’

‘নীল হল বিষের প্রতীক। বিষ ক্ষরিত রক্ত কালো আর নীলে মেশামেশি। তবু আপনার কথা রাখা আমার কর্তব্য।’ শ্রীনিত্যনাথ করতালি দিয়ে বললেন, “হালকা নীল আলো আমাদের অতিথি পছন্দ করছেন। তাই জ্বেলে দাও।’

এবার আলো সহনীয় হল। বৃদ্ধের চোখমুখ স্পষ্ট। বয়স অনুমান করা মুশকিল। ধ্যানেশ বলল, ‘বাবা আপনাদের সঙ্গে সংঘাতে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মত হল সকল সম্প্রদায় যাতে নিজস্ব ধারায় উপাসনা করতে পারে এমন পরিবেশই কাম্য। কিন্তু সেই পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে একটা ধারণা আমাদের মনে জন্ম নিচ্ছে।’

বৃদ্ধ হাসলেন, ‘এ আর নতুন কথা কি! ভূমি তার নিজস্ব ধাবণ-শক্তি অনুযায়ী বীজের জন্ম দেয়। পাহাড়ের মাটি যা ফলাতে পারে সমুদ্রের পাশের বেলাভূমিতে তা ফলে না। আপনাদের ধারণা আপনাদেরই যোগ্যত। অনুযায়ী জন্মাচ্ছে।’

ধ্যানেশ একটু উষ্ণ গলায় বলল, ‘আপনি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন?’

‘অবশ্যই নই। বরং বলতে পারি ঈশ্বরোপাসনার যে চিরন্তন প্রক্রিয়া এই দেশে চিরকাল চলে এসেছে আপনাদের বাবা তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।’

ধ্যানেশ সোজা হয়ে বলল, ‘মাপ করবেন, শিষ্য হয়ে আমি বাবার কোন বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে অভ্যস্ত নই।’

‘আপনার বক্তব্য এখনও বলেননি।’

‘বক্তব্য শোনার পরিবেশ আপনি রাখতে চাননি।’

বৃদ্ধ হাসলেন, ‘বেশ, এবার ভূমিকা ছেড়ে ভূমিতে নামুন।’

ধ্যানেশ সরাসরি তাকাল, ‘ছোটে মহারাজকে ফিরিয়ে দিন।’

‘কে ছোটে মহারাজ?’ বৃদ্ধের স্বরে বিস্ময় স্পষ্ট।

‘বাবার কনিষ্ঠ পুত্র। আমাদের আশ্রমের ভবিষ্যৎ মহারাজ।’

‘যে ভবিষ্যতে মহারাজ হবে তাকে এখনই মহারাজ বলে সম্বোধন করছেন কেন?’

.

.

‘সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার বক্তব্য আপনি শুনেছেন।’

‘ধর্মকে যারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করে তারাই ধর্মের প্রধান শত্রু। শুনেছি উত্তর বাংলায় আপনাদের বাবার বিশাল আশ্রম রয়েছে। সেখানে হেলিকপ্টার পর্যন্ত রাখা হয়েছে। আমার কোন আপত্তি নেই। ধর্মীয় সংগঠন মানে হিমালয়ের সন্ন্যাসীর মত জীবন যাপন এই থিওরিতে আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না। পুরাকালেও করত না। মহামুনি বশিষ্ঠের একটি কামধেনু ছিল। সে ইচ্ছে করলে দশ হাজার সম্রাটের চেয়ে বেশি ধনসম্পত্তি মহামুনিকে দিতে পারত। তাই বলে কি বশিষ্ঠের যোগশক্তি ক্ষয় পেয়েছিল? মুনি ঋষিবা তখন হিমালয়ে বাস না করে রাজামহারাজের সভায় বিচরণ করতেন। রাজকন্যাদের সঙ্গে ঋষিদের বিবাহ হয়েছে অনবরত। তাঁরা নিশ্চয়ই বিষয়হীন সন্ন্যাসী ছিলেন না, অথচ তাঁদের মহিমা বিন্দুমাত্র ক্ষয় পায়নি ওই কাজের জন্যে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ নির্বোধ মানুষকে ভেলকি দেখিয়ে নিজের এবং পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধি করাকে আর যাই বলা হোক, ধর্মাচারণ বলে স্বীকার করা যায় না। ত’ ছোটে মহারাজের কি হয়েছে ‘ বৃদ্ধ একটানা কথার শেষে প্রশ্ন করলেন।

‘সেটা কি আপনার অজানা?’

‘একটু আগে শুনলেন আমি তাঁর পরিচয়ই জানি না।’

‘কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তিনি আপনাদের দ্বারা অপহৃত। তাঁকে অবিলম্বে মুক্তি দিন। না হলে পরিণাম ভয়াবহ হবে।’

‘এই হুমকি কি বাবা আমাদের দিতে বলেছেন?’

‘আমি বাবার আজ্ঞাবহ।’

‘চমৎকার। তবে তাঁকে জানিয়ে দেবেন, ছোটে মহারাজ সংক্রান্ত কোন খবর এখন পর্যন্ত আমাদের জানা নেই। তা সত্ত্বেও যদি ওই ভয়াবহ পরিণামের জন্যে বাবা প্রস্তুত থাকেন তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমরা এটাকে ধর্মযুদ্ধ হিসেবেই গ্রহণ করব।’

এবার সত্যি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না ধ্যানেশ। নিত্যনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর কিছু বক্তব্য আছে আপনার? মনে হয় দশ মিনিটকাল অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে।’

‘হ্যাঁ। ছোটে মহারাজ আমাদের অত্যন্ত প্রিয়জন। ওঁকে আটকে আপনারা কোন চাপ সৃষ্টি করলে বাবার শিষ্যরা তা ক্ষমা করবেন না। ওঁকে অবিলম্বে মুক্তি দিন। শ্রীশ্রীসনাতননাথের যেসব শিষ্য বাবার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন তা তাঁরা করেছেন স্ব-ইচ্ছায়। এই কারণে আপনাদের ঈর্ষান্বিত হবার কোন যুক্তি নেই!’

‘এটাও কি আপনাদের বাবার বক্তব্য?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তাহলে এর জবাব দেওয়া আমি প্রয়োজন বোধ করছি না।’ বৃদ্ধ সিংহাসন থেকে উঠে পড়লেন। তারপর পাশের দরজায় পৌঁছে বললেন, ‘আপনি এই আশ্রমে অতিথি। আপনার সেবার আয়োজন হয়েছে। দূত হিসেবে আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোন বিরূপ ধারণা নেই। তবে সেবা গ্রহণ না করে চলে যেতে চাইলে খুব অপমানিত বোধ করব। বৃদ্ধ আর দাঁড়ালেন না।

.

পার্ক সার্কাসের নিজস্ব আড্ডায় বসে ইউনিস মাথার চুলে হাত বোলাচ্ছিল। এই মুহূর্তে তার সাকরেদরা সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। পাড়ায় পাড়ায় যত ছোট বড় মাস্তান রয়েছে তাদের মাধ্যমে ছোটে মহারাজের খবর নিচ্ছে। ছোটে মহারাজ খিদিরপুরে যেত তা বসির আলির কাছে এইমাত্র জানতে পেরেছে ইউনিস। জেনে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাবার ছেলে হয়ে ছোটে মহারাজ খিদিরপুরে যেত সাপের ছোবল খাওয়া দেখতে। হা বাবা। কিন্তু বসির আলি বলল আর একটা দল এখন ছোটে মহারাজেব পাত্তা লাগাতে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দলটি কারা? যদি কেউ ছোটে মহারাজকে হাপিস করে থাকে তবে তারা নিশ্চয়ই খবর নেবে না। সে বসির আলিকে বলেছে লোকগুলোর ওপর নজর লাগাতে। বড় মহারাজ যে সময় দিয়েছেন তা পার হতে বেশি দেরী নেই। তার ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি কর্পোরেশন ইলেকশনে জিতে কাউন্সিলর হওয়া কার দৌলতে? ওই বাবা না থাকলে তাকে তো এতদিনে পার্ক স্ট্রিটের পুলিশ দিনরাত তাড়া করে নিয়ে যেত। বারো বছর আগে মনে একটু পাপবোধ এসেছিল। পার্ক সার্কাসে তখন আমির আলির রাজত্ব। বাঘে গরুতে জল খায় এক মগে। দিনরাত এক হয়ে যায়। লাখ লাখ টাকা তোলা ওঠে খালি কুঠি আর ব্যবসাদারদের কাছ থেকে। ইউনিস ছিল আমির আলির আট নম্বর চামচা। পুলিশ ধরে আর আমির আলির লোক ছাড়িয়ে আনে। তা একদিন আমির আলি ডেকে বলল, ‘দ্যাখ ইউনিস, তুই আমার হেড চামচা বনবি? আরে ব্বাস। ওই পোস্টের জন্য কত কাড়াকাড়ি মারামারি। ঠিকঠাক হুকুম মানো, তুমি আছ। মাস গেলে বিশ হাজার পকেটে আসবে। কিন্তু যেই তোমার লোভ হল, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে খতম হয়ে যাবে।’ আমির আলি বলল, ‘তাহলে কান খাড়া করে লে শোন। একটা খুন হবে। ঢাকতে পারব না। তোর জেল হবে দু বছরের জন্যে। জেল থেকে বেরিয়ে এলে আমার হেড চামচা বনে যাবি! না-না। খুন করবে অন্যলোক। তুই শালা তাব বদলে জেল খাটবি। কি রাজী?’ না বললে বিপদ, হ্যাঁ বলতে মন চাইছিল না। কিন্তু সেই রাত্রেই নিজেই খুন হয়ে গেল আমির আলি। খুন হল নিজের বিবির হাতে। দুধে বিষ মিশিয়ে ভাল করেছিল না খারাপ করেছিল, এই নিয়ে নানান লোক নানান কথা বলে। কিন্তু মনে পাপবোধ ঢুকে গেল ইউনিসের। আজমীর শরীফে চলে গেল সে একা। আর তখন আগ্রা স্টেশনে সে প্রথম বাবার দর্শন পেল। একই ট্রেন থেকে নেমেছেন বাবা। শয়ে শয়ে ভক্ত তখন বাবাকে প্রণাম করছে, জয় বাবা ধ্বনি তুলছে। মজা লাগছিল ইউনিসের। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সে। হঠাৎ বাবা তার হাতে যেসব মালা জমেছিল তা শিষ্যভক্তদের দিকে ছুঁড়ে দিতে শুরু করলেন। সবাই পাগল হয়ে গেল সেই মালা কুড়োতে। এমনি ফুলের মালা সেসব। একটা মালা এসে পড়ল ইউনিসের গায়ে। খুশিতে সে তুলে নিয়ে তাজ্জব। মালাটা একটা সোনার হার হয়ে গেল। মুখ তুলে সে দেখল সবাই বাবাকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু মালা যখন শূন্যে ভাসছিল তখন ইউনিস স্পষ্ট দেখেছে ওটা ছিল ফুলের। এখন আঙুল বলছে, চোখ বলছে এটা ধাতুর আর ধাতুটা সোনার। চুপচাপ পকেটে ঢুকিয়েছিল ইউনিস। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শরীর গরম হয়ে যাচ্ছিল। অন্তত পাঁচ ভরির হার। হোটেলে গিয়ে হারটাকে আবার বের করল। কোন ভুল নেই, সোনারই। বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না। এটা কি করে হল? তখন আগ্রায় রাত। ইউনিস হারটা নিয়ে বেরিয়ে এল। চেনাশোনা কেউ নেই আগ্রায়। তবু সাহস করে একটা সোনার দোকানে ঢুকে যাচাই করতে চাইল হারটাকে। জহুরী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘হারটা কার?’

ইউনিস মাথা নেড়েছিল, ‘আমারই। ওটায় সোনা আছে কতখানি?’

জহুরী বলেছিল, ‘নিজের হার বলছ আর জানো না কতখানি সোনা আছে? কোথায় পেয়েছ মালটা?’ ব্যস ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। দোকানদার পুলিশ ডাকল। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল থানায়। বলল, ‘আগে বল মালটা কোত্থেকে ঝেড়েছ, তারপর অন্য কথা।’ ওরা ওর ঠিকানা জানতে চাইল। ইউনিস বুঝল আর বাঁচার কোন পথ নেই। পাক সার্কাসের ঠিকানা বলে দিলে পুলিশ পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে ওর সম্পর্কে যে রিপোর্ট পাবে সেটা প্রমাণ করবে এটা চুরির মাল। প্রায় ভেঙে পড়ল সে থানায়। কেঁপেকেটে সত্যি কথা বলতে লাগল অফিসারকে। পুলিশরা হো হো করে হাসতে লাগল তার গল্প শুনে। ইউনিস যতই বলে সে আজ স্টেশনে নেমে এক সাধুজীর কাছে ওটা পেয়েছে অফিসাররা তত হাসে। লকআপে ওরা রেখে দিল ইউনিসকে। রাত্রে কেঁদে- কেটে একসা ইউনিস। আজমীর শরীফ আর দ্যাখা হল না তার। স্টেশনে দেখা সেই বাবার মুখ মনে পড়ল। কেন তার দিকে ফুলের মালা ছুঁড়তে গেল! গেল যদি, কেন তবে মালা হার হয়ে গেল!

ভোর বেলায় আগ্রার দুই সজ্জন মানুষ এলেন থানায়। তাঁরা অফিসারকে বললেন যে বাবা ওঁদের পাঠিয়েছেন। তিনি একটি লোককে গতকাল স্টেশনে সোনার হার উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু অফিসাররা ভুল বুঝে তাকে লক আপে আটকে রেখেছে। সজ্জন দুটি সকলের এত পরিচিত যে ইউনিসকে বের করে আনা হল। তার তখন মুখে কথা ফুটছিল না। বক্তব্য লিখিত ভাবে জানিয়ে সজ্জনরা ইউনিস আর তার হার নিয়ে এক ধনী শিষ্যের বাড়িতে গেল যেখানে বাবা অবস্থান করছিলেন। ওকে সামনে উপস্থিত করতেই বাবা বলেছিলেন, ‘বড় সন্দেহ তোর, না রে? কাউকে দেখে বিশ্বাস করতে পারিস না, না? যাচাই করলে যে অনেক সময় ঠকতে হয়। আজমীর যাচ্ছিস ঘুরে আয়। তবে আর ওসব কাজ নয়। অন্যায় শক্তিকে ন্যায়ের পথে চালাবি, তবেই না মানুষ। আর ওই হার কখনও গলা থেকে খুলবি না। যা।’

সেই শুরু। তারপর প্রতি পদে পদে বাবার আশীর্বাদ নিয়েছে ইউনিস। এখনও তোলা ওঠে এ তল্লাটে। কিন্তু সেই টাকায় গরীব-দুঃখীরা খিচুড়ি খায় রোজ। জামা-প্যান্ট বিলি করা হয়। কাঠের ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেছিল। সেটা বেড়ে যেতে ফ্ল্যাট বাড়ি বানাবার ব্যবসায় লেগেছে সে। টাকা এখন তার পেছনে ছোটে। আজ যদি ছোটে মহারাজকে সে উদ্ধার করতে না পারে তাহলে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। এই সময় টেলিফোন বাজল। বড় মহারাজের গলা, ‘ইউনিস, কোন খবর আছে?’

‘এখনও পাইনি মহারাজ। জান কবুল করে খুঁজছি মহারাজ।’

‘তার আগে আর একটা কাজ কর। ধ্যানেশ গিয়েছিল সনাতননাথের আশ্রমে ছোটে মহারাজের খোঁজে। দু ঘণ্টা হয়ে গেল, ফেরেনি। কোথায় আছে সে দ্যাখো।’

‘আশ্রমে হামলা করব?’

‘না। তোমাকে শুধু বলেছি এবার ধ্যানেশকে খুঁজতে হবে।’

.

রাত নটায় উপাসনাগৃহ থেকে বের হলেন বাবা। ভক্ত শিষ্যরা তাঁর জয়ধ্বনি দিচ্ছে সমানে। দুটো হাত ওপরে তুলে সহাস্য মুখে বাবা এগিয়ে চলেছেন সেবকদের করে দেওয়া পথে। গাড়িতে ওঠার আগে তিনি ফিরে দাঁড়ালেন। সবাই তাঁর আশীর্বাদ চায়, স্পর্শ প্রার্থনা করে। হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছিল কিন্তু সেবকদের কঠোর শৃঙ্খলায় তা প্রশমিত হয়েছে। বাবা সেই আকুল জনতার দিকে তাকালেন। তারপর উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘মানুষ হও।’ সঙ্গে সঙ্গে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা, আমার একমাত্র ছেলে অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তুমি দৃষ্টি ফিরিয়ে দাও’, কেউ বলল, ‘বাবা, আমার স্বামীর ক্যানসার হয়েছে, তুমি বাঁচিয়ে দাও নইলে ভেসে যাব।’ প্রায় প্রতিটি গলা থেকে দাও দাও ধ্বনি ছিটকে উঠল। মানুষের যন্ত্রণার কান্নায় উপাসনাগৃহের সামনের চত্বর ককিয়ে উঠেছে। বাবা চোখ বন্ধ করলেন। বড় মহারাজ তাঁর পাশেই ছিলেন। নিচু স্বরে বললেন, ‘গাড়ি প্রস্তুত।’

বাবা হঠাৎ শূন্যে হাত মুঠি করলেন। একবার দুবার তিনবার। যেন কিছু ধরার চেষ্টা করছেন অথচ সেটা মুঠোয় আসছে না। এর মধ্যে একজন সেবক গাড়ির ভেতর থেকে একটা পোর্টেবল মাইক এনে তাঁর সামনে ধরেছে। শেষ পর্যন্ত বাবা বললেন, ‘দেখলি তো! আমি কত চেষ্টা করলাম তবু শূন্য থেকে কিছু যোগাড় করতে পারলাম না। ওরে, শূন্য যে সে দেবে কি করে! এক থেকে কোটি কোটি হয়। শূন্য থেকে হয় না। আমি তো ম্যাজিক জানি না যে খপ করে একটা রসগোল্লা তৈরি করব, নাকি দু-একটা সংস্কৃত মন্ত্র আউড়ে বিদেশীদের ডেকে এনে আশ্রম বানাবো। আমি কিছুই জানি না। শুধু তোদের বলি প্রাণভরে তাকে ডাক, দেখবি প্রাণ ভরে যাবে।’ বাবা গাড়িতে উঠে বসলেন। ভক্তরা ততক্ষণ বাবা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেই জায়গার মাটি নিয়ে কপালে ঠেকাচ্ছেন। কেউ কেউ সযত্নে তা কাপড়ে বাঁধছেন।

আনন্দভবনের সামনে গাড়ি থামলে বাবা নামলেন। সেখানেও সেবকরা শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। কোন কথা না বলে বাবা ভেতরে চলে গেলেন। বড় মহারাজ দেখলেন মেজ মহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন মাথা নিচু করে। তিনি তাঁকে ইশারায় ডেকে নিয়ে ভেতরে চললেন। অসময় নয়, তাই অনুমতির প্রয়োজন নেই। বড় মহারাজ মেজ মহারাজকে নিয়ে বাবার কক্ষে প্রবেশ করলেন। বাবা সারাদিনে একবার আহার আর দুবার পান করেন। সূর্যাস্তের মুহূর্তে বন্দনা শেষ করে তিনি একটি বড় পাথরের গ্লাসে ঘোল এবং এক চামচ মধু পান করেন। দ্বিপ্রহরে ছানা, পরমান্ন এক হাতা, দুটি ফল, এবং বাদামগোলা দুধ আহার হিসেবে গ্রহণ করেন। রাত্রে এক বড় শ্বেথপাথরের বাটিতে আঙুরের রস এবং একটি আমলকি গ্রহণ করেন। বড় মহারাজ মেজকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন সেবিকারা সশ্রদ্ধায় বাবার পানের আয়োজন করছেন। বাবা পাথরের বাটি থেকে দু আঙুলে একটি আমলকি তুলে নিরীক্ষণ করছিলেন একমনে। বড় মহারাজ এবং মেজ মহারাজ উপস্থিত হওয়ামাত্র তিনি বলে উঠলেন, ‘সুপক্ক না হওয়া পর্যন্ত আমলকি জাতে ওঠে না। তাহলে বল পাকামিরও একটা প্রয়োজন রয়েছে। ছোটের খবর কি?’

মেজ মহারাজ নিবেদন করলেন, ‘সুধাময় টেলেক্স পাঠিয়েছে।’ ‘ছোটে কি ফিরে এসেছে?’

‘আজ্ঞে না। তার সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।’

‘সুধাময় কি জানিয়েছে?’

মেজ মহারাজ টেলেক্স মারফত প্রাপ্ত খবরটি চোখের সামনে ধরলেন, ‘ছোটে প্রত্যহ কলেজে গিয়েই চুপিসাড়ে বেবিয়ে যেত। তাকে সব বিচিত্র জায়গায় দেখা যেত। কখনও কফিহাউসে কখনও খিদিরপুরে। সুধাময়ের প্রধান গোয়েন্দা রায় বলেছে যে ছোটে মাদকজাতীয় ট্যাবলেট গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে। সম্ভবত এই কারণে তাকে ট্যাংরাতেও দেখা গিয়েছে। যে ছেলেটির সঙ্গে ছোটেকে এসব জায়গায় দেখা গিয়েছে সে আপাতত কলকাতায় নেই। এমন হতে পারে ছোটে তার সঙ্গেই উধাও হয়ে গিয়েছে। সুধাময়ের এজেন্সি ওকে খুঁজে বের করতে আরও ছদিন সময় চেয়েছে।’

‘ছোটে কি ঠিক সমযে কলেজে ফিরে আসত?’ বাবার গলার স্বর স্বাভাবিক।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

বাবা মৃদু কামড় দিলেন আমলকিতে। সেটি রেখে দিয়ে পাত্র থেকে আর একটি তুলে নিলেন, ‘তিনু কি অধীর চন্দ্র মল্লিকের বসতবাড়ি অধিকার করেছে?’

বড় মহারাজ জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে এখনও খবর পাইনি।’

‘আমি বুঝতে পারি না তোমাদের ভাবনাচিন্তা এত সীমিত কেন? যে মানুষ তার শেষ ইচ্ছার কথা বারংবার আমাকে জানিয়েছে, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যে আমার কাছে নিবেদিত হয়ে থেকেছে তার কোন মূল্য সে পাবে না? তিনু যদি আজ এই কর্তব্য সম্পাদন না করে থাকে তাহলে ওকে মহারাজ হিসেবে আর সম্মানিত করবে না। ইউনিস কি বলে?’ দ্বিতীয় আমলকি মুখে দিলেন বাবা। বড় মহারাজ বললেন, ‘ইউনিস প্রাণপণে চেষ্টা করছে। সে সন্দেহ করছে আর কেউ ছোটের খবরাখবর করছে। ওকে সুধাময়ের কথা বলা হয়নি। ইউনিস যে তথ্য পেয়েছে তা সুধাময়ের সঙ্গে মিলে গেছে। আমি ইউনিসকে বলেছি ধ্যানেশের খবর নিতে। সে কেন এখনও সনাতননাথের আশ্রম থেকে ফিরে আসছে না সেইটেই ভাবার বিষয়। তার বাড়ির টেলিফোন বেজে যাচ্ছে।’

‘ধ্যানেশকে সনাতননাথের কাছে পাঠানোটা মেজ’র উচিত হয়নি।’

মেজ মহারাজ বললেন, ‘ধ্যানেশ আমাদের অতি বিশ্বাসভাজন। সে আপনাকে অত্যন্ত ভক্তি করে। সবাইকে বলে আপন পিতার চেয়েও আপনি—।’ তাঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন বাবা, ‘ঠিকই। কিন্তু পুত্রের স্বভাবের পরিচয় আমি জানি। সে আমার জন্যে জীবন দান করতে পারে। কিন্তু নারীসঙ্গ পেলে মোহিত হয়। শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হবার সঙ্গে সঙ্গে এই স্খলন হয়েছে তার। আমি ভাবতাম সোনায় খাদ না মেশালে যেমন তা দিয়ে গহনা তৈরি করা যায় না তেমনি শিল্পীর এই স্বভাবকে মেনে নেওয়াই উচিত। না, আমি বলছি না সনাতন নাথের আশ্রমে গিয়ে সে নারীর ছলনার শিকার হয়েছে কিন্তু ওর ওপর সবক্ষেত্রে আস্থা রেখে কাজ করতে দেওয়া মানে ওকেই ভুল বুঝতে হতে পারে। বড়, তোমার গৃহিণীর সঙ্গে ছোটের তো মধুর সম্পর্ক ছিল?’

বড় মহারাজ বললেন, ‘হ্যাঁ, ছোটের জননীর অভাব সে দূর করেছে বলেই জানি।’

‘তাঁকে প্রশ্ন কর। নারীজাতি যদি স্নেহশীলা হয় তাহলে পুরুষের হৃদয়ের কথা অগ্রিম পড়তে পাবে। হয়তো ছোটের মনের গতি কোন দিকে যাচ্ছে তা তাঁর আন্দাজে ছিল।’

‘সেরকম বুঝলে কি আমাকে জানাতো না বাবা?’

‘স্নেহ বড় বিচিত্র বোধ। শেষ মুহূর্তে সংশোধিত হতে পারে ভেবে সে নিজেকেও প্রতারিত করতে পারে। সনাতননাথের সঙ্গে আনন্দ সরস্বতীর যোগাযোগ এখন চিন্তাব বিষয়। আনন্দর শিষ্যরা রাজনীতি করে। কি ধরনের রাজনীতি?’

‘আজ্ঞে নির্বাচন নয়। তারা দেশের মানুষের চরিত্রবদলের জন্যে বিপ্লবের কথা বলে। তারা ধর্মীয় পথে এই সমাজব্যবস্থা ভেঙে ফেলার কথা বলে।’

‘চমৎকার। আমি আজ রাত্রে নিদ্রার কৃপা পাব না বলেই মনে হচ্ছে। যদি তেমন কোন প্রয়োজন হয় যোগাযোগ করতে পার।’

এইটে চলে যাওয়ার নির্দেশ। আঙুরের রস ততক্ষণে পরিবেশিত হয়েছে। বড় ও মেজ মহারাজ চলে যেতে উদ্যত হলেন। হঠাৎ বাবা বললেন, ‘রাজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তোমার শেষ কবে কথা হয়েছিল?’

বড় মহারাজ বললেন, ‘পাঁচ সপ্তাহ আগে।’ ‘কি যেন বলেছিলেন তিনি?’

‘আপনার আশীর্বাদে ধন্য হতে চান।’

‘নির্বাচন কবে?’

‘সম্ভবত মাস ছয়েকের মধ্যেই।’

তাঁরা আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন কিন্তু বাবা আর কথা বললেন না। ওঁরা ধীরে ধীরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। চিন্তায় দুজনের মুখ গম্ভীর। হঠাৎ বড় মহারাজ বললেন, ‘ভাবতে পারো আমাদের ভাই, বাবার সন্তান মাদকদ্রব্য খাচ্ছে? যদি শিষ্যরা জানতে পারে তাহলে কি সর্বনাশ হবে!’

মেজ মহারাজ উত্তর দিলেন, ‘খবরটা শোনার পরেই আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমি কোন হিসেব মেলাতে পারছি না। ছোটের মুখ মনে করে এই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করছে না।’

বড় মহারাজ বললেন, ‘আমাদের একমাত্র কর্তব্য হল এই সংবাদটা যাতে কেউ না জানতে পারে তার ব্যবস্থা করা। কোন ঝুঁকি আমি নেব না।’

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *