জন্ম জন্মান্তর – অভয়ঙ্কর
“বন্ধুরা সকলেই তাঁর সঙ্গ প্রার্থনা করে। তাঁর উপস্থিতিতে সরস ও সজীব হয়ে ওঠে যে কোনো শ্রেণীর বৈঠক। মিশতে পারেন তিনি শিল্পীদের সঙ্গে শিল্পীর মতো। আবার রাম-শ্যামের সঙ্গে রাম-শ্যামের মতো। তাঁর মুখে হাসির বুলি ও হাসির গল্প জমে ওঠে অপূর্বভাবে। এমন গপ্পিয়া মানুষ আধুনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে আমি আর দেখিনি। অতিসাধারণ কথা তাঁর ভাষণ-ভঙ্গীতে হয়ে ওঠে অসাধারণ।”
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গে উপরোক্ত কথাগুলি লিখেছিলেন তাঁর আবাল্য সুহৃদ হেমেন্দ্রকুমার রায় ‘এখন যাদের দেখছি’ নামক গ্রন্থে। আমাদের সৌভাগ্য যে, এই দুই লেখককেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলেছে। উভয়েই তখন প্রবীণ, কিন্তু কি প্রচণ্ড প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সঙ্গে যখন পরিচয় হল তখন তিনি জরাক্রান্ত, খুব বেশি ঘোরাফেরা করতে পারেন না, তবু কি মনের জোর। জীবন সম্পর্কে চিরউদাসীন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তখন শেষ খেয়ায় পাড়ি জমানোর কথা ভাবছেন। তথাপি সরস রসিকতা কিংবা শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ে কোনো রকম আলোচনায় তাঁর আগ্রহের অভাব ছিল না। আমরা তাঁর নিজের মুখে তাঁর অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার কিছু কিছু কাহিনিও শুনেছি।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর রচনাবলীর সংখ্যা পরিমিত। যে কয়খানি উপন্যাস বা যেসব ছোটগল্প লিখেছেন তার মধ্যে আছে বিচিত্রলোকের সংবাদ, অনেক ক্ষেত্রে তাঁর পরিচিত জগতের ছবি। সবাই তাঁকে ‘বুড়োদা’ বলে ডাকত, কারণ তাঁর বাড়ির ডাকনাম ছিল বুড়ো, মানুষটি কিন্তু সজীবত্বে অনেক ছোকরাকে হার মানিয়ে দিতেন। তবে মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন পরমপ্রাজ্ঞ। তাই হয়ত তাঁর স্মৃতিচারণমূলক এপিক উপন্যাসটির নাম করেছিলেন ‘মহাস্থবির জাতক’। প্রেমাঙ্কুরের প্রিয় কবি লিখেছেন–”এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম জন্মান্তর”-প্রেমাঙ্কুরের জীবনে অনেকবার জন্মান্তর ঘটেছে তাই তিনি পরিণত বয়সে যখন এই উপন্যাসটি রচনা শুরু করলেন তখন তার নামকরণ করলেন ‘মহাস্থবির জাতক’। প্রেমাঙ্কুরের জীবনে সাফল্য আসেনি; কিন্তু ‘মহাস্থবির জাতক’ তাঁকে খ্যাতির সর্বোচ্চশিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বাংলা ভাষায় রচিত একশখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘মহাস্থবির জাতক’ যে অন্যতম সেই স্বীকৃতি তাঁর জীবদ্দশাতেই মিলেছে। তাঁর বন্ধু প্রভাতচন্দ্ৰ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন–”মহাস্থবির জাতক” লিখে রাতারাতি প্রেমাঙ্কুর দিগ্বিজয় করে নিল বলা যায়।”
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গে অতি চমৎকার ভঙ্গীতে লিখেছেন পরিমল গোস্বামী তাঁর ‘আমি যাঁদের দেখেছি’ গ্রন্থে। প্রেমাঙ্কুর চরিত্রের এমন যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আর চোখে পড়েনি। পরিমল গোস্বামী প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন–”প্রেমাঙ্কুরের মতো এত বেশি স্তরের সঙ্গে সহজে কোনো বাঙালির পরিচয় ঘটেছে কি না আমার সন্দেহ আছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের সঙ্গে হয়তো অনেকটা মিল আছে। কিন্তু তবু মনে হয় প্রেমাঙ্কুরের অভিজ্ঞতা যেন তাঁকেও হার মানিয়েছে।”
আর প্রেমাঙ্কুরের ‘মহাস্থবির জাতকে’র সঙ্গে বাঙলা সাহিত্যের আরেকটি গ্রন্থ তুলনীয়। তা শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’। প্রেমাঙ্কুর যেন শরৎচন্দ্রকেও অতিক্রম করেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্তের’ মর্ম-বাণী ব্যাখ্যা করেছেন মোহিতলাল, প্রেমাঙ্কুরের ‘মহাস্থবিরে’র ব্যাখ্যা করার মতো লেখকের আজ অভাব ঘটেছে। শরৎচন্দ্র নাকি একদিন প্রেমাঙ্কুরকে “তীব্র ভাষায় যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলেন সিনেমায় মেতে উঠে সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কে চুকিয়ে দেবার জন্য।” (দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়–মরমী কথাশিল্পী)–শরৎচন্দ্রের এই স্নেহের তাড়নায় হয়ত প্রেমাঙ্কুর তাঁর মরিচাধরা কলমটি আবার হাতে নিয়েছিলেন। ‘মহাস্থবির জাতক’ যখন ‘শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হতে লাগল তখন সবাই চমৎকৃত হলেন, অল্পকালের মধ্যেই ছদ্মনামী লেখককে সবাই খুঁজে বার করলেন। জাতকের তিনটি পর্ব শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হয় : এখন চতুর্থ পর্ব সংযোজিত চারখণ্ডে সম্পূর্ণ ‘মহাস্থবির জাতক’ প্রকাশিত হল। কবি উমা দেবী লেখকের খাতা থেকে প্রেস কপি করে দিয়েছেন এবং পরে তিনি সুস্থ অবস্থায় মুখে মুখে যেমনটি বলেছেন উমা দেবী তাই লিখে নিয়েছেন।
মহাস্থবির জাতকের প্রথম পর্বে এই শতকের প্রথম দিককার কলকাতার পরিচয় পাওয়া যাবে। ঘোড়ার ট্রামের কলকাতা, কলকাতার লোকজন আর সেই কালের নবজাগ্রত ব্রাহ্মসমাজ। প্রেমাঙ্কুরের পিতৃদেব মহেশচন্দ্র আতর্থী ছিলেন আদর্শবাদী ব্রাহ্ম কিন্তু পুত্রদের মানুষ করার জন্য তিনি অযথা উৎপীড়ন করতেন। মানুষটি যে খারাপ ছিলেন তা বলা যায় না, তাঁর পরোপকার স্পৃহা, তাঁর জেদ অর্থাৎ চিলের পিছনে অপহৃত মাছের জন্য, ছোটা, পাগলদের প্রতিপালন, চা-বাগানে বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে মৃতকল্প হওয়া প্রভৃতি মহেশচন্দ্রের উদ্ভট প্রকৃতির পরিচায়ক। এর ফলে বড় ছেলে ঘর ছেড়ে গিয়েছিলেন, তিনি পরে বিদেশে বড় ডাক্তার হয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় প্রেমাঙ্কুর বালক অবস্থা থেকেই ঘরের বাইরে বিরাট বিশ্ব যেখানে বাহু মেলি রয় সেই বাহুর আলিঙ্গনে ধরা দিলেন। আর কনিষ্ঠ জ্ঞানাঙ্কুর। তিনি শেষ পর্যন্ত প্রেমাঙ্কুরের কাছেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। স্নেহপরায়ণা উদ্বেগাকুল জননীর কথাও প্রেমাঙ্কুর লিখেছেন অতিসূক্ষ্ম রেখায়। কিন্তু এই রেখাচিত্র কয়েকটি ক্ষেত্রে অদ্ভুত হয়ে উঠেছে, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘হন্ট’। প্রেমাঙ্কুর মহাস্থবিরের অনেকগুলি আমাকে রীতিমতো ‘হন্ট’ করেছে। সহপাঠিনী নন্দার সঙ্গে বিচিত্র অবস্থায় তার স্বামীর মৃত্যুর মুহূর্তে সাক্ষাৎকার। তিনপয়সা চুরির অপবাদ দিয়েছিল যে সুবর্ণ তার পাগল হয়ে যাওয়া। স্কুল-জীবনে টমরী সাহেব এবং শ্যাম ও সুরেশ্বর পর্ব প্রভৃতি এক একটি চিত্র। তারপর পাগলা সন্ন্যাসীর কাছে ইংরেজি কাব্যের সঙ্গে পরিচয় লাভ। তিয়াত্তর বছরের এই বৃদ্ধ ছিলেন পণ্ডিত, মদ্যপ এবং গাঁজাখোর। মদ খাওয়াটা শিখেছিলেন নিজের ছেলের কাছ থেকে। তিনি একদিন প্রেমাঙ্কুরদের দুই ভাইকে মদ্য পানের দীক্ষা দান করলেন। তখন প্রেমাঙ্কুরের বয়স মাত্র চোদ্দ বছর। পাগলা সন্ন্যাসীর কবিতা পাঠ প্রসঙ্গে প্রেমাঙ্কুর প্রথম পর্বে লিখেছেন :
“কবিতার ভাষা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদের ছিল না। শুধু ধ্বনি ও সুর মনের মধ্যে একটার পর একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে লাগল। চোখের সামনে যেন দেখতে লাগলুম অ্যালাস্টারের কবি চলেছে দূরে, সুদূরে–তার অন্তরে যে চেতনা জেগেছে। তারই সন্ধানে। চলেছে–চলেছে কত দেশ, কত মেয়ে এল তার জীবনে, তবু সে চলেছে বিরামবিহীন।”
এই পথচলায় পেয়েছিল প্রেমাঙ্কুরকে। অন্তহীন পথ পরিক্রমা। এই পাগলা সন্ন্যাসীর পুত্রবধূ গোষ্ঠদিদিও এক বিচিত্র চরিত্র। এই কালেই লতুকে ভালোবাসতে শিখেছেন লেখক, সেও ভালোবাসত লেখককে! আর এই প্রথম প্রেমের স্পর্শ সারা জীবনকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছে। মালাবদল করে গান্ধর্ব মতে বিবাহ হয়েছিল হয়ত, আনুষ্ঠানিক বিবাহ হল অন্যজনের সঙ্গে।
পনেরো বছর বয়সে ব্রাহ্মমুহূর্তে প্রথম গৃহত্যাগ করলেন লেখক আর এখানেই প্রথম পর্বের সমাপ্তি।
দ্বিতীয় পর্বের প্রথমে কাশীতে গুরুমার সঙ্গে পরিচয়। তাঁর দ্বারা প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়া। গুরুমার আদর। আড়ালে এই গুরুমা রাজকুমারী হয়ে উঠতেন আর সেই রাজকুমারীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে পঁড়ে থাকা। এবং রাজকুমারী আদর করে বলতেন গোপাল। এই রাজকুমারী পর্বের বিবরণ অন্য কোনো লেখকের হাতে পড়লে কি.আকৃতি নিতে পারত তাই ভাবি।
যাই হোক রাজকুমারী ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কাশী ছাড়তে হল।
তারপর ছোট সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। কি বিচিত্র মানুষ এই ছোট সাহেব। ব্যাধিজর্জর দেহে কত বড় মন। আর তেমনই মহিয়সী মহিলা তার ভগ্নী, লেখকের হাতে ‘দিদিমণি’র যে ছবি আঁকা হয়েছে তা তুলনারহিত। তারপর বৃন্দাবনে দিদিমণির সঙ্গে যে অবস্থায় আবার দেখা হল তা নাটকীয়। এক অতিশয় সমৃদ্ধ অবস্থা থেকে একেবারে পথের ভিখারিনী। দিদিমণিকে যখন প্রশ্ন করা হল তোমার কি অর্থকষ্ট আছে? তখন দিদিমণি বললেন–’গোবিন্দের ইচ্ছায় আমার কোনো অভাব নেই।’
এখানেই দ্বিতীয় পর্বের সমাপ্তি। এই পর্বের আর দুটি চরিত্র পেয়ারা সাহব আর তাঁর সন্তজনোচিত দাদামশাই নবাব সাহেব। এমন মানুষ কি একদা সত্যিই ধরাধামে বিচরণ করেছেন–এই প্রশ্ন মনে জাগে।
তৃতীয় পর্বের এক জায়গায় প্রেমাঙ্কুর লিখেছেন–’মানুষের মধ্যে যতপ্রকার শ্রেণী আছে–অর্থাৎ জ্ঞানী, অজ্ঞানী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, বিবেচক, অবিবেচক, ধূর্ত, নির্বোধ, সুবোধ, দুর্বোধ–এদের কারুকেই স্রেফ দেখেই বোঝা যায় না সে কোন শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ যারা পরশমণির ছোঁয়া পেয়েছে–তাদের দেখলেই চেনা যায় অন্তত এই শ্রেণীর যত লোকের সাহচর্যে আমি এসেছি তাদের দেখেই চিনতে পেরেছি।’
সুরাটের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব গয়ারাম সম্পর্কে লেখক লিখেছেন– ‘জীবনযাত্রার প্রাক্কালে আমরা যে মহাপুরুষের দর্শনলাভ করেছিলুম, আজ জীবনসন্ধ্যায় বিশেষ করে তাঁকে স্মরণ করে বলি–হে মহাত্মন! আজ হতে প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে যে দুটি দীন ও তুচ্ছ বাঙালি বালক কম্পিত হৃদয়ে সাহায্যের জন্যে আপনাদের দ্বারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, দুঃখে সুখে তাদের দিন কেটে গিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বিদায় নিয়েছে, আর একজন পথের শেষে এসে অতিক্রান্ত অতীতের দিকে চেয়ে আপনাকে স্মরণ করেছে।’
সেই অন্ধকার দিনে ম্যাজিস্ট্রেট গয়ারাম এবং তার বন্ধু পণ্ডিতজী লেখকের রচনা-কৌশলে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন। পণ্ডিতজী, শঙ্কর ও দেবী যেন মর্তের মানুষ নয়। দেবীর মৃত্যুতে সব শেষ হল। লেখক বলেছেন–’পণ্ডিতজী ও শঙ্করের খবর পাইনি তবে দেবী আমাকে ভোলেনি মাঝে মাঝে স্মৃতির সরণী বেয়ে এসে সে আমাকে চমকে দিয়ে চলে যায়।’
চতুর্থ পর্বে আছে বোম্বাই শহরের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিবরণ। সেখানে দৈনিক ছ’পয়সার মজুরিতে ক্ষেতে কাজ করেছেন। ছাগলদুগ্ধ বিক্রি করে যাদের চলে তাদের কাছে পেয়েছেন অযাচিত স্নেহ, অথচ তারা নাকি ডাকাত। অনেক অলৌকিক কাহিনিও ছড়ানো আছে এই গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে।
পূর্বেই লিখেছি যে ‘মহাস্থবির জাতক’ বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে যে পরিমাণ স্থানের প্রয়োজন সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠায় তা সম্ভব নয়।
এই চার খণ্ডে সম্পূর্ণ গ্রন্থটির মুদ্রণ পরিপাট্য প্রশংসনীয়।
[ সাপ্তাহিক অমৃত, : ১০ম বর্ষ ২য় সংখ্যা ]