জন্মের ঋণ – প্রবোধকুমার সান্যাল

জন্মের ঋণ – প্রবোধকুমার সান্যাল

সেন্ট্রাল জেল-এর ভিতরের মস্ত লোহার ফটকটি একটু ফাঁক করে দুইজন কনস্টেবল একটি তরুণ যুবককে বাইরের দিকে এনে মিঃ গুপ্তর আপিসে তুলে দিল। সকাল তখন প্রায় দশটা।

কারাগারের কড়া নিয়মগুলি একেবারে নিখুঁত। এদিক ওদিক একটু পর্যবেক্ষণ করলে গা ছমছম করে।

জেলের প্রধান অভিভাবক বয়সে তেমন প্রবীণ নন। চোখে বেশ মোটা চশমা, গায়ের রঙটি ধবধবে ফর্সা, মাথায় অনেকটা টাকপড়া। সম্প্রতি তিনি বিলাত জার্মানী প্রভৃতি দেশে গিয়ে সেখানকার কারাগারগুলি পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন।

তরুণ যুবকটির সঙ্গে একজন কনস্টেবল পাহারায় দাঁড়িয়েছিল। মিঃ গুপ্ত তাকে বাইরে যেতে বললেন। তারপর যুবকটির দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললেন, আজ তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, বিমল। জান তো, আজ থেকে তোমার ছুটি?

আজ্ঞে হ্যাঁ—

চান করে খেয়েদেয়ে নিয়েছ? রুইমাছ ভাজা, ডিম সিদ্ধ, মাংস—পেট ভরে খেয়েছ তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ—

বেশ।—বলে মিঃ গুপ্ত একটি ফাইল ওলটপালট করে পরীক্ষা করলেন। পরে বললেন, তোমার রিপোর্ট খুব ভাল। মন দিয়ে কাজ করেছ, সকলের বাধ্য ছিলে, ঠিক সময়ে হাজিরা দিয়েছ, সকলের সঙ্গে মিষ্ট ব্যবহার করেছ। তুমি ভালই রেমিশন পেয়েছ হে, আর কি চাই? কয়েকটা টাকা তুমি বেশি খেটে রোজগারও করেছ দেখছি!—এই নাও ভাই, এখানে একটা সই করে দাও।

একখানা কাগজ মিঃ গুপ্ত বিমলের দিকে এগিয়ে দিলেন। পরে হেসে বললেন, ওপরে ওই ফিগারটা দেখে নিতে পার, তোমার ওজন প্রায় দশ পাউন্ড বেড়েছে এই ক’মাসে। দুঃখ হয় তোমার মতন ছেলে যখন জেল খাটতে আসে। তুমি আদর্শ কয়েদী ছিলে, বিমল।

একখানা কাগজের উপর বিমল নাম সই করে দিল, এবং মিঃ গুপ্ত ডেস্কের ভিতর থেকে কয়েকটি টাকা বার করে তার হাতে দিয়ে বললেন, গুণে নাও ভাই, ছত্রিশ টাকা সাত আনা—

বিমল তার টাকাটা গুণে নিল। অঙ্কটা ঠিকই আছে।

জেল সুপার একটু থেমে পুনরায় বললেন, তোমাকে আমি উপদেশ দিচ্ছিনে বিমল, তেইশ বছর তোমার বয়স হয়েছে, সংসার কেমন এ তুমি দেখতে শিখেছ। কিন্তু তোমার কনভিকশন কি কারণে হয়েছিল একটু ভেবে দেখ, ভাই। চুরি ডাকাতি খুন রাহাজানি—এসব তুমি করনি। কোনও ব্যক্তিকে তুমি ঠকাওনি, গালাগালি দাওনি, বিশ্বাসঘাতকতা করনি, মারপিট করবারও চেষ্টা পাওনি, কোনও হুজুগে পড়ে আইনভঙ্গ করনি—না, এসব কোনও নালিশ তোমার বিরুদ্ধে নেই। কিন্তু সামান্য একটুখানি অসামাজিক কাজ করে ফেলেছিলে! তোমার এই বয়সে সাধারণত যে-চেতনা মনে আসে, তুমি তারই রাশ একটু আলগা করেছিলে মাত্র।একটু সংযম, একটু বিবেচনা, একটু সামাজিক শিক্ষা, একটুখানি সম্মানবোধ-এর পরিচয় তুমি যদি দিতে বিমল—তাহলে আর এই জেল তোমাকে খাটতে হত না, ভাই—

বিমল এবার একটু গাঢ় আবেদন বিজড়িত কণ্ঠে বলল, আপনি বিশ্বাস করুন, সমস্ত দোষটা আমার নয়। মেয়েটা আমাকে আশকারা দিয়েছিল। ওর চাল চলন, কাপড় জামা পরার ধরন—তারপর চোখ বেঁকিয়ে আমাকে ইশারা—আপনি বিশ্বাস করুন মিস্টার গুপ্ত, আমি বুঝতে পারিনি যে, আমার জন্যে সে ফাঁদ পেতেছিল!

হাসি মুখে মিঃ গুপ্ত বললেন, ঠিক বলেছ বিমল, আমি জানি এই অন্যায়ের মূল সূত্র কোথায়! পুরুষ মানুষ একটু স্বভাব-সরল কিনা, তাই লোভের খোঁচা একটু পেলেই তেতে ওঠে। কিন্তু অসামাজিক কোথায় জান, ভাই ? রাত্রের দিকে, গলি-ঘুঁজিতে, একলা মেয়ে যাচ্ছে, আর তুমি তাকে জড়িয়ে একটু ভালবাসতে গিয়েছিলে—এইটুকু মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। মেয়েটা যে চেঁচিয়ে উঠে তোমাকে ধরিয়ে দিল, সেটা হল তার সামাজিক সম্ভ্রম রক্ষার দায়ে—কেননা, পাড়ার একটি লোক এই ঘটনাটি চোখে দেখেছে। একই ঘটনা! কিন্তু ঘরের মধ্যে ঘটলে ওটাকে বলে ভালবাসা ; বাইরে ঘটলে বলে শ্লীলতাহানির অপরাধ !—যাকগে, আমি আশা করব বিমল, এই শিক্ষা তোমার জীবনকে উন্নত করেছে! তুমি তোমার কল্যাণের পথ বেছে নিয়েছ!—সুরত সিং?

কনস্টেবলটি ঘরের মধ্যে উঠে এল। মিঃ গুপ্ত বললেন, লে যাও, রিলিজ হো গিয়া। —আচ্ছা, এস ভাই।

বিমল নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে গেল।

বিমল আমারই সহপাঠী ছিল এবং আমি তার প্রতি একটু অনুরক্তই ছিলুম। কিন্তু ইস্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে কোন ছেলেটি কেমন এবং ঠিক কোন শ্রেণীর, অথবা তার বংশপরিচয়, কিংবা সামাজিক পদমর্যাদা—এসব বিচার করে কেউ সতীর্থদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না।

বিমল কোথায় থাকত এবং তার বাপ কি করত—এ ধরনের কোনও খবর আমি কোনদিন নিইনি, এবং তার দরকার হয়নি। মিশনারী ইস্কুলে সকল শ্রেণী ও সকল জাতির ছেলে পাশাপাশি বসে পড়ে গেছে এবং খেলাধুলা করেছে। আমরা সবাই সহপাঠী এবং বন্ধু—এই ছিল আমাদের প্রধান পরিচয়।

বিমল বোধ হয় ম্যাট্রিক পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু নতুন বই কিনে নতুন ক্লাসে যখন সবাই একত্র হয়ে আবার বসলুম, সেদিন থেকে বিমলকে আর দেখতে পাওয়া গেল না।

কেউ বলল, ছেলেটা খালাসী হয়ে কোন্ জাহাজে চড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। কেউ বলল, না রে, ওর বাপ মোটর কারখানায় কাজ করে, ও সেই কাজ শিখছে। কেউ বলল, বিমল যে সিগারেট খায়, জানিস ? আরেকজন কে যেন বলল, ছেলেটা কিন্তু খুব শান্ত, না রে? কেউ বা বললে, তোরা জানিস ছাই। বাপের বাক্স ভেঙে টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে! দেখগে যা বিলেতে কিংবা আমেরিকায়!

আসল কথা এই, বিমলের খোঁজখবর কেউ জানে না, এবং তাকে মনে রাখার মতও কারও কোনও গরজ নেই। ছেলেটা হারিয়ে গেল!

বছর তিনেক পরে বিমলকে হঠাৎ একদিন দেখতে পেয়েছিলুম রাস্তার অপর ফুটপাথে। থমকে একবারটি দাঁড়িয়েছিলুম। বিমল একটি সাইকেল মেরামতের দোকানে একখানা সাইকেল হাতে নিয়ে কি যেন কথাবার্তা বলছিল। তার গোঁফ বেরিয়েছে, দাড়ির ছায়া দেখা দিয়েছে। পরনে আলগা একটা পায়জামা, উপর দিকে পাঞ্জাবি এবং তার উপরে জ্যাকেট। ওটার নাম নাকি নেহরু জ্যাকেট। কিন্তু আগের যুগে বাঙালী নাপিতরা ঠিক ওই জামা পরত।

বিমল আমাকে দেখতে পায়নি, এবং আমিও আর দাঁড়িয়ে রইলুম না।

এর পর বিমলকে দেখলুম বছর সাতেক পরে। সরকারী কাজে আমাকে যেতে হয়েছিল বরিশালে। ফিরবার পথে খুলনায় এসে যখন নামলুম, তখন সন্ধ্যা প্রায় উত্তীর্ণ। খুলনা থেকে শিয়ালদার ট্রেন ছাড়ে বোধ হয় রাত দশটায়। ওরই মধ্যে একসময় এক ছোট খাবারের দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে নেব, দেখি দোকানের সামনে বিমল দাঁড়িয়ে। তাকে চেনা কঠিন। কিন্তু আমাকেই সে আগে চিনল। বলল, কি সাহেব, কলকাতা যাচ্ছ নাকি? আছ কেমন? চিনতে পার?

পারি বৈকি।—আমি হাসলুম,—এই কলকাতায় ফিরছি ভাই।

বেশ, চল, একসঙ্গেই যাওয়া যাক। কিন্তু তোমার নিশ্চয় ফার্স্ট ক্লাস?—বিমল বলল, তা হলে চলবে না। আমি ভাই দেউলেফকির লোক। রেলগাড়িতে যে সব সময় ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করি, একথাও সত্যি নয়। এর ওপর যদি আবার ফার্স্ট-সেকেন্ড ক্লাসে যেতে বল, তাহলে তো তোমার কাছেই ভিক্ষে করতে হবে!

হাসি মুখে বললুম, বেশ তো —তোমার ভাড়াটা না হয় আমিই দিয়ে দেব। চল, একসঙ্গেই যাওয়া যাক। কতদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, কত পুরোন দিনের কথা মনে পড়ছে! কিন্তু তুমি হঠাৎ এখানে যে?

বিমল বলল, হঠাৎ নয় হে, কাজ কারবারের জন্যে যেতে আসতে হয়। স্টিমার কোম্পানীতে মাল সাপ্লাই করি। ওরাই তদ্বির তদারকের জন্য মধ্যে মাঝে এখানে পাঠায়। বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজ হে।

ওটা শীতকাল ছিল। আমার সুটকেশটি একপাশে রেখে দুজনেই আমরা একটি ছোট বেঞ্চি দখল করে খেতে বসে গেলুম। অনেক পুরোন গল্পই করা গেল। আহারাদির শেষে আমিই প্রথম কোটের পকেট থেকে মনিব্যাগ বার করে হোটেলের দাম চুকিয়ে দিলুম। আমাদের উভয়ের পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে এতই স্পষ্ট পার্থক্য যে, দোকানদার আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। আমি সোৎসাহে বিমলের সঙ্গে বেরিয়ে এলুম।

টিকিট ঘরের দিকে এগোবার আগে আমি একবারটি থমকে পিছন ফিরে পানের দোকানে এসে সিগারেট চাইলুম। পানওয়ালা বলল, বাবু, দেখলুম তখন থেকে, লোকটা বেশ গায়ে পড়ে আপনার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিল। ওরা স্টিমারঘাটার লোক বাবু, সাবধানে থাকবেন।

আমি হাসলুম। বললুম, তুমি বুঝতে পারনি ভাই। যার কথা বলছ সে আমার ছোটবেলাকার বন্ধু, একসঙ্গে পড়েছি, একসঙ্গে খেলা করেছি। ওকে বাল্যকাল থেকে আমি চিনি।

পয়সা চুকিয়ে দিয়ে আমি চলে গেলুম বিমলের সঙ্গে। পিছন থেকে পানওয়ালা একটু ক্ষুণ্ণচক্ষে আমাদের দিকে চেয়ে রইল।

বরিশাল থেকে খুলনা পর্যন্ত সমস্ত নদীপথটি একা আমাকে আসতে হয়েছিল, একটি কথা বলারও মানুষ খুঁজে পাইনি। সেই জন্য বিমলকে যখন পেলুম, তখন তাকে একপ্রকার লুফে নিয়েছিলুম। কিছুক্ষণের জন্য আমরা যেন ফিরে গিয়েছিলুম আমাদের সেই বালককালে, এবং সেখানে সেদিন যারা আমাদের সঙ্গে ছিল—তাদেরই গল্প নিয়ে আমরা মশগুল হয়ে রইলুম। বাল্যবন্ধু চিরকালই বড় আপন।

খুলনা থেকে কলকাতার ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট সহজেই পাওয়া যায়, এবং যে কারণেই হোক, ট্রেনে প্রায়ই ভিড় কম। আমিই সোৎসাহে দুখানা লোয়ার বার্থ রিজার্ভ করে বিমলকে নিয়ে গাড়িতে উঠলুম, এবং ছোট বেডিংটি খুলে তার ভিতর থেকে একখানা কম্বল এবং রবারের ফোলান একটি বালিশ বার করে বিমলকে বললুম, তোমার সঙ্গে তো বিছানাপত্র নেই দেখছি। এই কম্বলখানা পেতে নাও, ভাই। না, না, ব্যস্ত হয়ো না, আমার নিজের মতন ঠিক আছে। রাত হয়েছে—এস এবার একটু গুছিয়ে বসা যাক। তোমাকে দেখে আমার তরুণ বয়সটি ফিরে এল।

পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বার করে জানলার ধারের টেবিলটির ওপর রাখলুম। আমার সুটকেশ থেকে বেরোল গরম গরম কফির একটা ফ্লাস্ক এবং কিছু বাদাম।

বিমল খুশি হয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে বলল, মনে পড়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে যেদিন সিগারেট খেতে শিখলুম?

উল্লসিত কণ্ঠে বললুম, বাঃ, মনে নেই? বল কি? সেই যে হেদোর রেলিংয়ের কোণে ফুলগাছটার আড়ালে—সেই তুমি, আমি, বারিন, তপন ঘোষ, ননীপদ—!

বিমল বলল, বাঃ, তোমার সব মনে আছে দেখছি, দেবু।

বললুম, মনে না থেকে পারে? এই তো মাত্র কুড়ি-বাইশ বছর আগের কথা। কিন্তু মুশকিল কি জান, আমি যখন প্রেসিডেন্সিতে আই-এস-সি পড়তে গেলুম তখন থেকে সেই যে ছাড়াছাড়ি, আর কেউ কারও সঙ্গে মিশতে পারলুম না। তুমি কি করলে তারপর?

বিমল বলল, আমি ডাক্তারি লাইনে যাব মনে করেছিলুম। বাবা বললেন, তার আগে কিছু হাতের কাজ শিখে নে। আমি গিয়ে কাজ নিলুম বটকেষ্ট পালের দোকানে। বেশ কাজ শিখেছিলুম ভাই, কিন্তু হঠাৎ একদিন ওদের সঙ্গে বচসা বাধল! কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এলুম বাবার মোটরের কারখানায়—

দেখতে দেখতে আমাদের গল্প জমে উঠল। গাড়িখানা কখন ছেড়েছে বুঝতেও পারিনি। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল। ইতিমধ্যে দৌলতপুর পার হয়ে গিয়েছিল। আমি উঠে ফ্লাস্ক থেকে একটু কফি ঢেলে বিমলের দিকে বাড়িয়ে দিলুম। কফির সঙ্গে বাদাম চিবোতে চিবোতে আমাদের নিজেদের পূর্বজীবন তোলাপাড়া করতে লাগলুম। আমার নিজের জীবনের ভিতরে কোনও ঘটনার বৈচিত্র্য নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে পাঁচ বছর বিলেতে ছিলুম এবং সেখানে একের পর এক বাসা বদলের হিড়িকের মধ্যে শুধু এক বাড়িওয়ালীর একটি মেয়ের সঙ্গে আমার মাত্র কয়েকদিনের জন্য একটুআধটু হাসি তামাসার সম্পর্ক ঘটেছিল। ব্যস, এই পর্যন্তই। —দেশে ফিরে সরকারী চাকরি নিয়েছি এবং এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। আমার স্ত্রী ভারি লাজুক, এবং বিশেষ ভদ্রপ্রকৃতির মেয়ে। আমার কোনও সন্তানাদি নেই।

বিমলের আত্মকাহিনীর মধ্যে কৌতুক ও কৌতুহল ছিল। তার জীবন নানা বৈচিত্র্যে আলোড়িত। সেগুলি বিশেষ ঔৎসুক্যের সঙ্গে শোনবার লোভে আমি বেশ গুছিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। স্টিমারে ভ্রমণ করেছি সারাদিন, সেজন্য যদিও আমার অপরিসীম ক্লান্তি ছিল, তবুও বিমলের কাহিনী শোনার জন্য আমার একান্ত আগ্রহ সজাগ হয়ে রইল।

বাইরে কালিঝুলিমাখা অন্ধকার। ঠাণ্ডার জন্য জানলার কাচগুলি তুলে দিলুম। ভিতরের আলোটা স্বাভাবিক ভাবেই কম। গাড়িখানা চলছিল মন্দগতিতে। তারই দোলায় আমরা দুলতে লাগলুম।

একটি সামান্য অসুবিধা শুধু বোধ করছিলুম। কালক্রমে যে কারণেই হোক বিমলের কথাবার্তার ভাষাটি তেমন দুরস্ত হয়নি। ওটা যেন একটু অসামাজিক, এবং কতকটা অশ্লীলও বটে। তাছাড়া তার তালব্য ‘শ’ উচ্চারণটি দন্তীয় ‘স’-র মতই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এ ত্রুটি আজকে আমাদের আনন্দের মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ মাত্র। আমার মত ব্যক্তি সমাজজীবনের বাইরের রঙিন খোসাটারই খবর রাখে, কিন্তু বিমলরা ওর শাঁসটার সঙ্গে পরিচিত। তার স্বাদটি কখনও কটু, কখনও তিক্ত, কখনও অম্ল, কখনও বা ছিল মধুর।

দেবরায় তার গল্পটা ধরেছিল দিল্লী থেকে কিছু দূরে ওখলার বাগানে বসে। সামনেই যমুনার মস্ত বাঁধ। তারই কয়েকটি লক-গেটের ভিতর দিয়ে দুরন্ত জলরাশিকে একটু একটু করে ছাড়া হচ্ছিল এবং বড় বড় চিতল মাছের উৎক্ষিপ্ত দৃশ্যটা অভ্যাগতরা উপভোগ করছিলেন।

ওখলার বাগানটা বেশ নিরিবিলি। শীতের দুপুরে ওখানকার ছায়ার আশেপাশে পিকনিকের আয়োজনটা মন্দ লাগে না। দেবরায় তার দলবলসহ এখানে বিশ্রম্ভালাপে মশগুল ছিল। ওরা প্রায় সকলেই সরকারী পূর্তবিভাগের লোক, এবং সচ্ছল ওদের অবস্থা।

তিন-চারজন চাপরাশি ওদের ফাইফরমাসে মোতায়েন ছিল। প্রচুর কাচ, কলাই ও এলুমিনিয়মের বাসনপত্র এবং বহুবিধ খাদ্যসামগ্রী-সম্ভার এর আগেই এসে পৌঁছেছে। ওরা সবাই এখানে হাজির হয়েছে সকাল দশটায়, কারণ দিল্লীর জলহাওয়ার গুণে দ্বিতীয় প্রাতরাশের প্রয়োজন ছিল।

‘A band of gluttons!’ কথাটা বলে কে একজন এর মধ্যে যেন হাসির হুল্লোড় তুলেছিল।

কাবাব এবং কফি সহযোগে যখন আহারাদি আরম্ভ হল, তখন চৌহান সাহেব এবং দলীপ সিং সমস্বরে বলে উঠলেন, তারপর বলুন, স্যার, বিমল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বেরোল !—তারপর?

দেবরায় বলল, হ্যাঁ, খুলনা-কলকাতার ট্রেনে শুয়ে-শুয়ে বিমলের গল্প শুনছিলুম। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিমল বাইরে এসে এদিক ওদিক চেয়ে দেখল, না, কেউ তাকে অভ্যর্থনা করতে আসেনি। সে ভাবছিল, তার শেষ চিঠিখানা কি বাবার হাতে পড়েনি? জেলের মধ্যে বসেই সে একদিন খবর পেয়েছিল, তার মায়ের মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যু-সংবাদ শুনে সে কাঁদেনি, বরং স্বস্তিলাভ করেছিল। উল্টোডিঙির পুরোন পাড়ায় একখানা বাড়ির নিচের তলায় দুখানা ঘর ভাড়া নিয়ে তারা ছিল। বাপ ছিল মোটর মেরামতি কারখানার হেড মিস্ত্রি। কিন্তু তার মাসিক বেতনের টাকাটার মোটা অংশটা বাইরে কোথায় কিভাবে খরচ হয়ে যেত, এ নিয়ে বিমলের মায়ের সঙ্গে তার নিত্য কলহ লেগে থাকত। মা অনেক সময় বিষ খেয়ে মরবার ভয় দেখাতেন। আত্মহত্যার সেই ভীতিপ্রদর্শনের মধ্যে কেবলমাত্র অর্থনীতিক কারণটাই প্রধান ছিল কিনা, সেটা বিমল এতটা তলিয়ে দেখেনি। আভাসে ইঙ্গিতে অন্যপ্রকার একটা সংবাদ মাঝে মাঝে তার কানে আসত। সুতরাং মায়ের মৃত্যুটা ঠিক স্বাভাবিক কারণে ঘটল কিনা, এ সম্পর্কে মনে মনে তার প্রশ্ন রয়ে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে সে বাড়ির দিকে চলল। পকেটে তার টাকাকড়ি ছিল, একবার চট করে সে বাসেও উঠে পড়েছিল। কিন্তু ভাড়াটা চুকিয়ে দেবার পরই তার মনে হল, বাসের মধ্যে সে যেন বন্দী। সে তৎক্ষণাৎ নেমে পড়ল এবং ধীরে ধীরে একদিকে চলতে লাগল। নিজের পায়ে হাঁটাই হল স্বাধীনতা। শুধু পা নয়, মন হাঁটছে তার সঙ্গে, হাঁটছে মুক্তি, হাঁটছে চিন্তা। হাঁটতে হাঁটতে সে এসে পৌঁছল তাদের উল্টোডিঙির সেই বাড়ির সামনে।

বাড়ির নিচের তলা থেকে এক অপরিচিত লোক বেরিয়ে এল। বিমল তাঁকে চিনতেও পারল না। ভদ্রলোক বললেন, ও, কেষ্টবাবুকে চাও? তারা তো নেই এখানে? দুর্গাপুর না কি নাগপুরের কোন্‌ কারখানায় তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে চলে গেছে। সেখানেই বুঝি থাকে। ঠিকানা কই দেয়নি তো!

স্বামী-স্ত্রী! কথাটায় বিমলের যেন খটকা লাগল। সে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল। স্বামী-স্ত্রী ! আশ্চর্য বটে। বাবার বয়স পঞ্চাশ হতে চলল যে! তবে কি সেই মেয়েছেলেটা, যাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাবার চাপা মনোমালিন্য ছিল ? কিন্তু বাবা তাঁর পিছনের পায়ের চিহ্ন মুছে দিয়ে গেছেন বৈকি! ঠিকানাটাও তিনি রেখে যাননি।

ইস্কুলে পড়া তার শেষ হয়নি, কেননা, বাবার দরকার ছিল তাকে দিয়ে চাকরি করানো! ওষুধের দোকানে কাজ করে সে পড়াশুনো করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবার জন্য তাকে বিকেলের দিকে যেতে হত মোটরের কারখানায়। সে চাকরি করেছে, কিন্তু মাইনে যেত বাবার পকেটে। মাঝে মাঝে নানা জায়গা থেকে তার বাবাকে তুলে আনতে হত—সে-সকল জায়গায় সন্তানের পক্ষে যাওয়া সাধারণত নিষিদ্ধ। তারই মাইনের টাকা পকেটে নিয়ে বাস-কন্ডাক্টরদের আড্ডায় বাবাকে যেতে সে দেখেছে অনেকদিন, সেখানে তাসখেলা শেষ করে বাবা যখন ফিরেছেন—পকেটে তাঁর কিচ্ছু নেই! একদিন পুলিশ নাকি সেই আড্ডায় হানা দিয়েছিল, এবং তার ফলে বাবাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল কিছুদিন।

পথ দিয়ে বিমল হাঁটতে লাগল তার খুশিমত। পথটা তার জানা বৈকি, কিন্তু উদ্দেশ্যটা ঠিক নির্দিষ্ট নয়। বিমল ভাবছিল, একটা কাজ তাকে যোগাড় করতেই হবে—যে কাজটা কিছু ভদ্র। কিন্তু তার পক্ষে আপিসে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়—কারণটা সুস্পষ্ট।

এর পর বিমলের জীবনটা কি প্রকার এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে অনেক ইতিহাস। চলতি ভাষায় যেটাকে বলে অন্ধকার যুগ। তবে একদিন দেখা গেল, কর্পোরেশনের শ্রমিকদলের সঙ্গে মিলে সে গাঁইতি দিয়ে রাস্তা কাটছে—নতুন রাস্তা বানানোর কাজে সে লেগেছে। বস্তিতে সে থাকে, নিজের হাতে ভাত ফুটিয়ে খায়। ঘর একখানা তার জোটেনি, সুতরাং কাঠের গুঁড়ি-চেরাইয়ের এক কারখানার একপাশে সে রাত কাটায়। জীবনটা বড় জটিল মনে হতে লাগল। সকল কাজই প্রিয় কাজ—যদি তার পরিণামে কোনও একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে কোনও উদ্দেশ্য নেই। এ একপ্রকার জান্তব জীবনযাত্রা, যেটার সঙ্গে তার মনের কোনও যোগ নেই। সুতরাং কোনও একটা সময়ে বিমল সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।

মুদির দোকানে সে কাজ নিয়েছিল, কিন্তু দাঁড়িপাল্লা ধরার সেরকম যোগ্যতা তার ছিল না। হাসপাতালে বেয়ারার কাজ সে যোগাড় করেছিল, কিন্তু ডাক্তার আর ডাক্তারি ছাত্রদের সুপারিশ পাওয়া গেল না। দেশীয় স্টিমার কোম্পানীতে খালাসী হবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খালাসীদলের মধ্যে যে চক্রান্তটা আছে, সেটা সে ভেদ করতে পারল না বলে নিরাশ হয়ে ফিরল।

এমনি সময়টায় তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার এক মাসীর। বিমল এক ফড়ের সঙ্গে উবু হয়ে বসে যখন বেগুন কেনাবেচার আলোচনা করছিল, সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল তার মাসী যাচ্ছে গঙ্গাস্নানে। চট করে বিমল উঠে এসে ডাকল, বিনুমাসি, আমি!

বিনুমাসি চমকে দাঁড়াল। ভ্রূকুঞ্চন করে বলল, তোর না জেল হয়েছিল?

হ্যাঁ। তুমি যে বিকেলবেলায় গঙ্গাস্নানে যাচ্ছ? হাতে ঘটি, গামছা—

হ্যাঁ যাচ্ছি, আজ ‘গেরোণ’। যাই—

বিনুমাসি চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু বিমল তার পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, তোমাদের সবাইকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি, বিনুমাসি।

অ, খুঁজে বেড়াচ্ছ! বলি কোন খবরটা রেখেছিলে? তোর মা ম’ল কি জন্যে, খোঁজ নিয়েছিলে কি একবার? যেমন খুঁনে ফাঁসুড়ে বাপ, তেমনি তার জেলখাটা ছেলে। সরো, পথ ছাড়—

বিমলের চোখে জল এল। প্রশ্ন করল, বাবা কোথায় বিনুমাসি, আমাকে বলবে?

বিনুমাসি একেবারে জ্বলে উঠল। ফুটপাথের মাঝখান থেকে একটি দোকানের দেওয়ালের ধারে সরে এল। বলল, নাম করিসনে বিমল, নাম করিসনে। জলজ্যান্ত দিদি আমার, অসুখ বিসুখ নেই, মাথা ধরাটি পর্যন্ত নেই। হঠাৎ শুনলুম মরে গেছে। আমি ছুটে গিয়ে পড়লুম ওই দানো-দস্যির ঘরে। ভাবলুম দিদি গেছে যাক, আমি ওর ঘরকন্না দেখাশুনো করি। অসময়ে না হয় ওকে দেখব—আমাকেও না হয় দুমুঠো খেতে দেবে। দস্যু কি বশ মানল? রামোঃ। দুমাস যেতে না যেতেই দেখলুম, আমাকেও ঠকাচ্ছে!

তোমায় কি ঠকালেন তিনি, বিনুমাসি?

ওমা, ছেলের কথা শোন! আমি ৩বে কার মুখ চেয়ে ছিলুম? আমি যে গতর খাটালুম, ভাত দিলুম রেঁধে, বাসন মাজলুম—আমার মনের কথা বুঝি ছিল না কিছু—বিনুমাসি অন্তর্দাহের সঙ্গে বলল, আমাকে ডিঙিয়ে নাপতেপাড়ার একটা মেয়েছেলের সঙ্গে আশনাই করতে যায়, আগে কি জানতে পেরেছিলুম? তুই তো সেই নচ্ছার মানুষেরই ছেলে! আমাকে পায়ে ধরলেও আর আমি যাব না, দেখা হলে বলে দিস।

শান্ত কণ্ঠে বিমল বলল, কেমন করে দেখা হবে? বাবা তো এদেশে থাকেন না?

কে বললে তোকে রে?—বিনুমাসি ফুঁসিয়ে উঠল,—থাকে না। থাকে না তো যাবে কোন চুলোয়? মেয়েছেলেটাকে নিয়ে এই ক’মাস ছিল বুঝি কাঁকুড়গাছির ওদিকে। এখন গিয়েছে চার নম্বর পোলের কাছে বস্তিতে। আমি সে ঘরটাও জানি—এগার নম্বর। আগে ওই চামড়ার কারখানায় নাম ভাঁড়িয়ে কাজ নিয়েছিল, এখন—, বিনুমাসি একটু গলা নামিয়ে বলল, গাঁজা-চরসের কারবার করে লুকিয়ে!

তুমি কোথায় থাক, বিনুমাসি?—বিমল বিমর্ষ কণ্ঠে জানতে চাইল।

আমি!—বিনুমাসি বলল, আমার থাকার ভাবনা কি? যেখানে গতর খাটাব, সেখানেই জায়গা পাব? রামের ঘরে জায়গা না পাই, শ্যামের ঘর আছে। তুই ছেলেমানুষ, তোকে আর কি বলব? ডাঁটো থাকব যতদিন, ভাতও ততদিন বাঁধা! যাই, গেরোণ ছাড়বার সময় হয়ে এল।

বিনুমাসি হনহনিয়ে বৌবাজারের পথ ধরে পশ্চিম দিকে চলে গেল।—

সেন সাহেব বললেন, মাসিটি খুব এন্টারপ্রাইজিং!

সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। বৃদ্ধ সুকুল সাহেব এবার আর থাকতে পারলেন না। বললেন, Oh yes, freedom first, freedom last—as far as youth is concerned!

উচ্চকণ্ঠে সকলের হাসির হট্টগোল পড়ে গেল। ভোজের আসরে ততক্ষণে মাংসর টুকরো ভাজা এবং মাছের ফ্রাই এসে পৌঁছে গেছে।

দেবরায় বলল, ট্রেনের সেই কামরায় লোয়ার বার্থে শুয়ে চুপ করে বিমলের আত্মকাহিনী শুনছিলুম:

চার নম্বর পুলের কাছাকাছি গিয়ে বিমল সেই এগার নম্বরের মাঠকোঠার একখানা ঘর খুঁজে একদিন বার করল। তখন রাত্রিকাল। ভিতর দিকে একটি ফোকরে কেরোসিনের লম্প জ্বলছিল। একটি ময়লা ধরনের মেয়েছেলে বেরিয়ে এসে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল, কোথ্থেকে এসেছ? কাকে চাই?

বিমল বাপের নাম বলল।

মেয়েছেলেটি বলল, কোন্ কেষ্ট? কোথাকার কেষ্ট? এই যে কয়লার দোকানের ওদিকে এক কেষ্ট থাকে—অক্ষয় তাঁতীর ছেলে। ওখানে গিয়ে দ্যাখো গে। কি জন্যে এসেছ গা?

বিমল বলল, তিনি তাঁতী নন, কায়স্থ। কৃষ্ণ দে। আমার বাবা।

বাবা নাম, না বাবা পাতানো?—মেয়েছেলেটা তবুও ভ্রূকুঞ্চন করে তাকাল। পরে বলল, আচ্ছা দেখছি, দাঁড়াও—

একটু পরেই যিনি একখানা লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এলেন, তিনি বিমলের পিতা। মেয়েছেলেটা আলোটা এনে পিতাপুত্রের সামনে ধরল। লোকটা কাবুলী প্যাটার্নে বড় বড় চুল রেখেছে, এবং তার ছোটখাটো একটু দাড়িও হয়েছে। স্বাস্থ্যটা তার খুবই ভাল। কিন্তু বিমলকে দেখামাত্র তিনি চক্ষু রক্তবর্ণ করলেন, কোন্ মুখ নিয়ে এলি আমার কাছে, শূয়োর? তোর মুখ আমি দেখতে চাইনে। জেলখাটা আসামী!

শান্ত কণ্ঠে বিমল বলল, আমাকে তুমি মানুষ হতে দাওনি কেন? কেন লেখাপড়া শিখতে দাওনি?

আমি দিইনি?—চাপা আক্রোশ তিনি প্রকাশ করলেন, ফের মুখ নেড়ে কথা বলছিস? এখনি জুতিয়ে—

আহা হা—কি কর গা?—মেয়েছেলেটি বাধা দিল, আমার বাঁধা খদ্দেরের আসবার সময় হল। গুণ্ডাবাজী কর কেন?

বিমল একটু হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এ ধরনের অভ্যর্থনা তার কপালে ঘটবে, এটি সে আশা করেনি। এবার বলল, আমি তোমার কাছে থাকতে এসেছিলুম, বাবা—

বাবা মুখ বিকৃত করে বললে, এঃ, আমার কাছে থাকতে! কেন, আমাকে ফাঁসাবার জন্যে? জেল খাটাবার জন্যে? দাগী—বদমায়েস!

বিমল বলল, সত্যিই বলছি বাবা, তোমার সঙ্গে মিলে কাজ করব, ভালভাবে থাকব। তারপর যদি মানুষ হয়ে উঠতে পারি—

এঃ, মানুষ হবে! বনমানুষ আবার মানুষ হয়!—বাবা তেমনি ঘৃণার সঙ্গে বললেন, ব্যাটার ছেলে বাপের নাম ডুবোল! জানিস, চুরি ধরা পড়লে তবে চোর হয়, তার আগে নয়? তোর বাপ আমি নই, যা বেরো! বাঁদির বাচ্চা কোথাকার!

বাবা ভিতরে চলে গেলেন। মেয়েছেলেটা একবার বিমলের দিকে অদ্ভুত একপ্রকার দৃষ্টিতে তাকাল। পরে বলল, বাপ বলে আর নাইবা ডাকলে গো, তার চেয়ে মায়ের জন্যে কাঁদোগে যাও। মেনীমুখো!

ভিতরে গিয়ে সে মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিল।

কিছুক্ষণ অবধি স্তব্ধ হয়ে বিমল দাঁড়িয়ে রইল ওইখানে ঠিক ওইভাবে। তারপর মাঠকোঠার সীমানা ছাড়িয়ে পথের উপর এসে এক জায়গায় বসে বাপের ঘরখানার দিকে চেয়ে রইল। চুপ করে সে বসে রইল অনেকক্ষণ। কী দেখছিল বা কী ভাবছিল বলা কঠিন। তারপর একসময় উঠে সে কতক্ষণ পায়চারি করে বেড়াল, এবং একসময়ে বস্তির চারদিকটা ঘুরে কি যেন পর্যবেক্ষণ করে এল। আবার এসে সামনের দিকে একবার দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল একদিকে। রাত্রির আলোছায়ার মধ্যে একসময়ে বিমল দূরে মিলিয়ে গেল।

দেবরায় বলল, পৃথিবীর অজানা মানুষের ভিড়ের মধ্যে কোথাও বিমল চিরকালের জন্য হারিয়ে যেতে পারত, কিন্তু তা যায়নি। মাস ছয়েক পরে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল হুগলি জেলার একটি ছোট শহরে। বাপের কাছে সে মিথ্যে বলেনি, সে বাঁচবার চেষ্টা করছিল। সে যদি মানুষ হতে পারে, যদি কোনমতে সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়—তবে আর কিছু না হোক, সেন্ট্রাল জেল-এর সেই মিঃ গুপ্তর কথাটার মান রক্ষা হয়। তিনি বলেছিলেন, কল্যাণের পথ বেছে নিয়ো! বিমল বিশ্বাস করেছিল, ভদ্রজীবন যাপন করার পথই তো কল্যাণের পথ!

দেখতে পাওয়া গেল, বিমল একখানা সাইকেল-রিক্সা চালাচ্ছে। গাড়িখানা ঠিক আনকোরা নয়, কিন্তু অবস্থা তার ভাল। মালিককে দৈনিক পাঁচ সিকা দিতে পারলে তার নিজের দৈনিক উপার্জন কমবেশি দু’টাকা। পাল-পার্বণে খাটতে পারলে এক একদিন পাঁচ টাকাও তার পকেটে ওঠে। এক টাকা থেকে দেড় টাকা পড়ে তার খাই-খরচা। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছে ছাতু খাবি বিমল, দুধ খাবি। পয়সা জুটলে মাংস। পারিস তো রোজ একটা ডিম। ভাত দুটি খাস রাত্রে, ঘুম হবে ভাল। দুটো করে কলা খেতে পারিস, হুগলির কলা খুব সস্তা!

বিমল তার উপার্জন বাড়াবার চেষ্টায় যথাসাধ্য ভাল খাবার চেষ্টা পায়। গাড়িখানা নিজের হাতে ঝাড়েমোছে। কখনও যদি ভাগ্য ফেরে তবে সে নিজেই একখানা গাড়ি কিনবে। একখানা, তারপর আরেকখানা—এমনি করে বাড়িয়ে যাওয়া! তারপর সে লোক রাখবে। নিজে একখানা দোকান দেবে। সেই দোকানে মনোহারী জিনিসপত্র সাজানো! ঝলমল করছে তার দোকান। দোকানের ঠিক সামনে সে বসিয়ে দেবে একটা জলসত্র। বিনামূল্যে চৈত্র-বৈশাখে ঠাণ্ডা জল! মুটে মজুর আসুক, সাইকেল-রিক্সা চালকরা আসুক, ঘেসেড়া মেয়ে মাথার মোট নামিয়ে এসে দাঁড়াক—যারা মেহনত করে তারা সবাই এসে বিশ্রাম নিক ওই বটগাছটার তলায় ছায়ার নিচে জলসত্রের কাছে। ওরা শুধু স্নিগ্ধ শীতল জল বুক ভরে পান করে যাক।

জলসত্রটা করবে সে মায়ের নামে। তার পরলোকগতা মা—কল্যাণী দেবী! জলসত্রের নাম দেবে সে, কল্যাণ-সত্র! ওই সত্রে জলপান করতে আসবে তারাই—যাদের মা নেই, যারা পিতৃস্নেহবঞ্চিত, যাদের বন্ধুপরিজন কেউ কোথাও নেই, যাদের কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত!

বিমল দিবাস্বপ্নের আনন্দে যেন পথ ভুলে যায়।

রাত্রে সে গিয়ে ওঠে স্থানীয় ধানকলের পাশের এক বস্তিতে। সেখানে এক বুড়ীর জন্যে সে রান্না করে দেয়। কিন্তু বুড়ী চোখে একটু কম দেখে এবং কানে একটু কম শোনে বলেই বিমলকে সে বিশ্বাস করে না। নিজের তেল-নুন-চাল-ডাল ও মশলাপাতি ইত্যাদি রান্নার সামনে এনে দিয়ে নিজেই পাহারায় বসে থাকে। বুড়ীর সম্পর্কে এক নাতনী ধানকলে কাজ করে এবং বুড়ীকে সে খাওয়ায়। বুড়ী এই বস্তিতে নাকি কাঠা তিনেক জমির মালিক। বুড়ী চোখ বুজলে ওই নাতনী নাকি জমিটুকু পাবে, এমনি একটা কথা চালু আছে। ওই নাতনীটার ঘরে সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে যখন হারমোনিয়ম বাজে, বিমল তখন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এবং বুড়ী চুপ করে বাজনা শোনে। নাতনীকে না জানিয়ে বিমল প্রতি মাসে দুটি করে টাকা বুড়ীর হাতে দেয় এবং ওই খামারের কোণে পুরোন গোয়ালঘরটিতে রাত্রে সে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রাত্রের দিকে স্নান করে এসেও গরমে তার ঘুম হতে চায় না, সেই জন্য সে দাওয়ার একপাশে এসে মশার ভয়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি, দেখতে দেখতে তার তন্দ্রা আসে।

হঠাৎ একদিন ঘুমের ঘোরে সে ঠেলা খায়। জেগে উঠে পাশ ফিরে দেখে, ছায়ামূর্তি। চোখের ঘুম ছড়িয়ে সে প্রশ্ন করে, কে?

আঃ, আস্তে কথা বল। আমি বিনোদ।—এই বলে নাতনী তার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে পুনরায় বলে, একটু কাজ করে দে বিমল, নেশা না করলে লোকটা টাকা বার করতে চায় না!

কে লোক?

ওই যে আসে মাঝে মাঝে চটকল থেকে আমার কাছে? এই যে আট আনা, লক্ষ্মীটি, ছুট্টে এনে দে!

বিনোদিনীর অনুরোধ এড়ানো কঠিন। অগত্যা বিমলকে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। বিনোদিনী দু’পা এগিয়ে গিয়ে বিমলের পিঠের দিকে একখানা হাত রেখে কানে কানে বলে, দেখিস, রাখু মিস্তিরি যেন টের পায় না। পেলে আর রক্ষে নেই, তক্ষুণি ও গিয়ে ফাঁড়িতে খবর দেবে! আমার ওপর রাগ আছে, জানিস তো? বুড়ী বোধ হয় ঘুমিয়েছে, না?

বিমল প্রশ্ন করল, কেন?

বুড়ী ভয়ানক বজ্জাত। —বিনোদিনী বলল, রাখুর সঙ্গে ওর সড় আছে, তা জানিস! আমার বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে বুড়ী একদিন শেষ রাত্তিরে আমার টাকা বার করে নিয়েছিল!

মাইরি! ও যে রাধুকে ঠাণ্ডা রাখে! রাখুর বাপ যে ছিল ওর সঙ্গে!—যা, তুই শিগগির নিয়ে আয়, লক্ষ্মীটি—খুব ভালবাসব তোকে একদিন!

বিমল গা-ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাত তখন অনেক।

দেবরায় মাংসর বড়া মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ চিবোল। প্রায় লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। ওখলার বন-বাগানের ছায়াপথে আরও দু’একটি ছোট ছোট দল ছুটির দিনে পরিভ্রমণ করতে এসেছে। দু’একটি অবসর-বিনোদিনী কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে এখানে ওখানে সর্বনাশের ফাঁদ পাতছিল। শ্রোতাদের ঔৎসুক্য এবার তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে।

দেবরায় বলল, ট্রেনের দোলায় মাঝে মাঝে আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হচ্ছিলুম, কিন্তু বিমলের আত্মকাহিনীর মধ্যে বাস্তবজীবনের এমন একটা কাঁচা রস ছিল যে, আমার ঘুমোবার উপায় ছিল না। আমার মন ওর সম্বন্ধে সমবেদনায় ভরে উঠেছিল।

বোধ হয় জুন মাসের সেটা মাঝামাঝি। দু’চার পশলা বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। হুগলির ওদিকে গ্রামে বসন্তর মড়ক লেগেছিল, এবং সেই মারী রোগের হাত থেকে ধানকলের লোকরাও রেহাই পেল না। দেখতে দেখতে বুড়ী মারা গেল। বিমলই তাকে টেনে-টুনে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে এল। রাখুর বউটা হয় দিনের দিন মারা পড়ল—এবং বিমল যখন দেখল, বিনোদিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাখু এসে ধানকলের ছোটবাবুর গদির একটা ঘর দখল করল, তখন সেও আর বুড়ীর ওখানে থাকতে সাহস পেল না। বিছানার পুঁটুলিটা সাইকেলে তুলে নিয়ে বিমল সোজা চলে এল হুগলি শহরের গঙ্গার ধারে। হুগলি থেকে চুঁচড়োর মধ্যে কোথাও না কোথাও সে ঠিকই কাটিয়ে দিতে পারবে কিছুদিন।

কিছুদিন ধরে দু’বেলা সে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে মনের আনন্দে স্নান করতে লাগল—বৃষ্টি বাদল কিছু মানল না। ওরই মধ্যে একদিন এক প্যাসেঞ্জারকে পেয়ে সে তাদের সেই ধানকলে পৌঁছে দিতে গেল। ওই সুযোগে সে দেখে আসতে চাইল, বিনোদিনী কেমন রাখুর সঙ্গে তার নতুন ঘরকন্না পেতেছে। প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দিয়ে সে ধানকলের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরে দেখল, না আছে রাখু, না বা বিনোদিনী। বর্ষার দিকে এখন ধানকলের কাজকর্মও একপ্রকার বন্ধ। বিমল গিয়ে রাখুর ঘরের মধ্যে মাথা গলিয়ে দেখে এল, কিন্তু রাখুদের কোন চিহ্নও নেই।

কাণাবুড়ীর ঘরের দিকে ফিরে চাইতেও বিমলের গা ছমছম করছিল। ওই তিনকাঠা জমি আর বেড়াবাঁধা কাৎ-হওয়া গোলপাতার ঘরখানায় বুড়ী নিশ্চয় পেত্নী হয়ে এখন ঘুরে বেড়ায়। বিমল সেদিকে একবার তাকিয়ে চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ লক্ষ্য করল ধানকলের সেই বুড়ো পাহারাদারটা বুড়ীর দাওয়া থেকে নেমে আসছে।

বিমল থমকে দাঁড়িয়ে ডাকল, গোঁসাই যে? ওখানে কেন?

বুড়ো গোঁসাই বলল, আর ভাই বলিসনে। ছুঁড়িটার গায়ে গুটি বেরিয়েছে, তাই ওকে এখানে ফেলে রেখে পালিয়েছে ওই রাখু শালা। দ্যাখ দেখি ভাই, দিন-দুপুরে শেয়াল এসে ঢুকছে, নেড়িকুকুর এসে ঘুরে যাচ্ছে। ছুঁড়িটা তো বাঁচবে না, কপালে যে-ক’দিন দুঃখ আছে। আমি বুড়ো মানুষ…বলি যাই ছুঁড়িটা যতক্ষণ আছে—একটু বার্লি খাইয়ে আসি। গাঁয়ে চারদিকে মড়ক!

বলতে বলতে গোঁসাই পুকুরধার দিয়ে ধানকলের ওদিকে চলে গেল।

বিনোদিনী বড় চটুল। সত্যি বলতে কি, বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওর ওপর কোন বিষয়ে নির্ভর করা চলে না। নইলে সেদিন রাখুর সঙ্গে চলে গেল—একবার পিছন ফিরে দেখল না? একটি কথাও বলল না?

বিমল তার সাইকেলখানার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল। বৃষ্টি এসে পড়েছে, হুডটা না তুলে দিলে সীটটা ভিজবে। বিমল সযত্নে হুডটা তুলে কাব্জাটা আটকে দিয়ে গাড়িতে উঠে চালিয়ে দিল। না, এদিক থেকে প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাবে না, সীটটা খালিই পড়ে থাকবে। কি মনে করে আবার সে গাড়িখানা ঘোরাল, এবং সোজা চলে এসে বুড়ীর খামারে ঢুকে দাওয়ার সামনে এসে থামল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে দাওয়ায় উঠে মুখ বাড়াল। ঘরের মধ্যে দুর্গন্ধ।

একপ্রকার নগ্ন অবস্থায় বিনোদিনী মেঝের উপর পড়ে রয়েছে। পায়ের শব্দ পেয়ে ঈষৎ ক্ষীণকণ্ঠে সে সাড়া দিল, কে? গোঁসাই?

না, আমি—বিমল! কেমন আছ তুমি?

বিনোদিনী একটু থেমে মৃদু কণ্ঠে বলল, ভাল নেই রে। উঠতে পারছি নে—

বিমল চুপ করে রইল।

একটু পরে ক্ষীণস্বরে বিনোদিনী বলল, শিয়াল ঢুকছে যখন তখন, মাথার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে, পা শুঁকে যাচ্ছে। ওরা জানে আমার আর দেরি নেই।

বিমল শান্ত কণ্ঠে বলল, হাসপাতালে যাবে, বিনোদ?

হাসপাতালে! কে নিয়ে যাবে?—বিনোদিনী যেন কেমন একটু চেতিয়ে উঠল। আনন্দে তার কান্না পেয়ে গেল।

একটা চোখ বোধ হয় ইতোমধ্যেই তার নষ্ট হয়েছিল। সেটি বিমল লক্ষ্য করল। এবার সে বলল, আমার গাড়ি আছে সঙ্গে—তোমাকে নিয়ে যেতে পারব। যাবে?

হ্যাঁ—

বিমল একবার এদিক ওদিক তাকাল। তারপর নিজের পরনের নতুন ধুতিখানা থেকে মালকোঁচার অংশটুকু আন্দাজ করে পড়পড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর সেই টুকরোটা নিয়ে উবু হয়ে বসে বিমল বলল, তোমার গা’টা একটু ঢেকে না নিয়ে এভাবে তো গাড়িতে তোলা যায় না। পথের লোক হাঁ করে চেয়ে থাকবে।

বিনোদিনীকে কোনও প্রকারে প্রস্তুত করে নিয়ে বিমল তাকে কোলে তুলে বাইরে এল, এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাকে গাড়িতে বসিয়ে মাথাটা হেলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিল। পরে বলল, ভয় পেয়ো না বিনোদ, আমি আস্তে যাব। মাথাটা যদি ঘোরে, আমাকে বোলো গাড়ি থামাব।

চোখ বুজে বিনোদিনী বলল, আমাকে বাঁচাতে পারবে তুমি?

আমি কেন বাঁচাব? হাসপাতালে ওরাই বাঁচাবে। নাও, এবার আমি চালাব। একটু কষ্ট করে থাক, মাইল দুই রাস্তা!

শারীরিক পরিশ্রমের জন্য বিনোদিনী হাঁপাচ্ছিল। এবার ক্লিষ্ট কণ্ঠে ধীরে ধীরে ডাকল, বিমল?

বিমল ফিরে তাকাল। বিনোদিনীর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। তবু সে বলল, বিমল, আমি যদি ভাল হয়ে উঠি, আমাকে বিয়ে করবে তুমি? দুজনে বেশ ঘরকন্না পাতব! বল, বিয়ে করবে?

বিমল কতক্ষণ কি যেন ভাবল। পরে বলল, হ্যাঁ করব—তুমি যদি রাজী থাক। আমিও ভেবেছি কতদিন—

মৃদু জড়িত কণ্ঠে বিনোদিনী বলল, আমি জানি, তুমি কত আমাকে ভালবাস। আমি নতুন করে ঘর সাজাব, বাসন বিছানা কিনব, তোমাকে রান্না করে দেব। আচ্ছা, একটা কথা শুনে রাখ, বিমল।

বিমল তখন গাড়ি চালাচ্ছিল। অনেকটা পথ ততক্ষণে পেরিয়ে এসেছে। এবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলছ?

বিনোদিনী ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, বুড়ীর তক্তার নিচে মাটির মধ্যে আমার কিছু টাকা পোঁতা আছে! যদি না বাঁচি, ও টাকা তুমি তুলে নিও, বিমল।

গাড়ি চালাতে চালাতে বিমল একবার কপালের ঘাম মুছল। পরে বলল, দূর পাগল, ও টাকা নিয়ে আমি কি করব? তুমি ভাল হয়ে ওঠ, ও টাকা তোমারই থাকবে। আমাকে বকশিস দেবার কথা তুলো না, বিনোদ। ওটা আমার অপমান।

বিনোদিনী চোখ বুজে চুপ করে বসে রইল। বিমল হনহনিয়ে গাড়ি চালাল।

জাত বসন্ত, সন্দেহ নেই। ভিতরে ভিতরে ‘হেমারেজ’ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর মধ্যে কোনও একটা ব্যাখ্যা বোধ হয় নিগূঢ় রহস্যের অন্তরালে রয়ে গেছে। বিনোদিনী কেমন করে বেঁচে উঠল, তার কোনও কৈফিয়ৎ নেই। হয়তো বাঁচবার প্রবল ইচ্ছাটাই বাঁচবার অন্যতম কারণ।

বিমল দুবেলাই এসে দেখত, এবং খবর নিত। শুধু হাতে সে একবারও আসেনি। কখনও ফল, কখনও হরলিকস, কখনও বা কেক-বিস্কুট। এ সমস্ত খরচ তার আনন্দের, তার দুঃখময় জীবনের ভালবাসার।

সপ্তাহ তিনেক পরে বিনোদিনী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে এল। সামনেই সাইকেল-বিক্সাখানার হ্যান্ডেল ধরে বিমলও হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিল। ওই সঙ্গে ভাগ্যনিয়ন্তাও বুঝি একটু হেসেছিল। মেয়েটা সোৎসাহে গাড়ির উপর চড়ে বসল।

বিনোদিনীকে নিয়ে বিমল যখন ধানকলের পাশ কাটিয়ে বুড়ীর খামারের ধারে এসে থামল, দেখল, রাখু সামনে দাঁড়িয়ে। চক্ষু রক্তবর্ণ করে রাখু বলল, এই যে, শালা এসেছে! বলি এই, আমার মেয়েছেলেকে তুই ফুসলে বার করে নিয়ে গেছলি কেন রে?

বিমলের চোখ দুটো হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠল। কিন্তু শান্ত কণ্ঠে সে বলল, তোমার মেয়েছেলে মানে? কে বললে, ফুসলে নিয়ে গেছলুম?

রাখু বলল, হারামজাদা, ফের কথা বলছিস? কে না জানে, বিনোদ আমার বউ? আমাদের বিয়ে হয়েছিল তার সাক্ষী আছে, তা জানিস?

বিমল একবার বিনোদিনীর দিকে তাকাল। পরে বলল, মিথ্যে কথা। বিশ্বাস করিনে। বলুক তো বিনোদিনী?

মুখ খিঁচিয়ে রাখু মিস্তিরি চেঁচাল, এখন বুঝি মেয়েমানুষের মতামত শুনতে চাস? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব, যদি ফের কথা বলিস! পরের বউ নিয়ে পালাচ্ছিলি—গাঁয়ের লোক ডেকে তোকে কুকুর-মারা করব এখুনি! হারামি শালা—

এতক্ষণ পরে বিনোদিনী বলল, বিমল, বড় ঝগড়া করিস তুই। রাখু মিস্তিরি তো ঠিকই বলছে! তুই বা দাবি করছিস কেন? আমি তো আর তোর সঙ্গে একঘরে শুইনি! আমার খামারে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে আমাদের মারতে এলি যে? কেন, গাঁয়ে মানুষ নেই?

গোঁসাই এসে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এবার বলল, রাখুটা বেইমান সবাই বলবে, কিন্তু তুই কেন এলি বিনোদের ওপর দখল নিতে? মেয়েছেলের গন্ধ পেলে বুঝি মাথার ঠিক থাকে না? যা পালা এখান থেকে!

একটা পৈশাচিক ভঙ্গি করে রাখু এগিয়ে এসে বিনোদিনীর হাতখানা ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। বিনোদিনী ফিরেও তাকাল না!

বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে সেখানে দাঁড়াল, তারপর সাইকেলখানা নিয়ে ধীরে ধীরে খামার থেকে বেরিয়ে একদিকে চলে গেল।

হুগলিতে বিমলকে এর পরে আর দেখা যায়নি। মালিকের সাইকেল-রিক্সাখানা অবশ্য মালিকের কাছেই সে রেখে গিয়েছিল। কালক্রমে তার বিছানার পুঁটলিটা একটু ভারী হয়েছিল; দু-চারটে ভাল জামা-কাপড়ও বুঝি কেনাকাটা করেছিল; একজোড়া নতুন জুতোও বুঝি ওই চুঁচড়ার বাজার থেকে কিনেছিল। কিন্তু সেগুলো সবই এক পাইস-হোটেলে গচ্ছিত রেখে সে যে সেই নিরুদ্দেশ হল, আর এপাড়া মাড়ায়নি!

হঠাৎ একদিন বিমলের আবির্ভাব ঘটল সেন্ট্রাল জেলের সেই মস্ত ফটকে। গেটের সেপাই এবং পাহারাওয়ালারা তাকে ভাল করেই চিনত। সুরত সিং হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আও ভাই বিমল, ক্যা খবর?

বিমল জানতে চাইল, ভিতরে গুপ্তসাহেব আছেন কিনা, কারণ সে একবারটি দেখা করতে চায়। সুরত সিং হাসিমুখে ভিতরে গেল, এবং পরে ফিরে এসে বলল, সায়েব আছেন ভেতরে। এস।

বিমল গুপ্তসাহেবের ঘরে এসে নমস্কার জানিয়ে দাঁড়াল। গুপ্ত বললেন, কি হে, কেমন আছ বিমল? হঠাৎ আমাকে মনে পড়ল যে?

বিমল বলল, আমি জেলের মধ্যে ভাল ছিলুম। আবার আমাকে নিন দয়া করে। বাইরে আমার ভাল লাগছে না, স্যার।

গুপ্তসাহেব অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি জানেন, ঘরছাড়া দিশেহারা অনেক এমন আছে যারা বেপরোয়া—যাদেরকে জঞ্জালে ফেলে দিয়েছে মানুষের বৃহত্তর সমাজ। বিমলের চেহারায় সেই সব হালভাঙা পালছেঁড়া চোট খাওয়ার চিহ্ন ছিল অনেক। তিনি বললেন, অপরাধ না করলে তো ভাই এখানে কেউ আসে না! তোমাকে কেমন করে জায়গা দেব? চুরিদারি রাহাজানি না করলে এখানে কেমন করে আসবে?

মাথা নেড়ে বিমল বলল, না, না, ওসব করতে পারব না, স্যার।

মিঃ গুপ্ত হাসিমুখে বললেন, তাহলে আর এখানে তোমার জায়গা হল না, বিমল!

আচ্ছা!—বলে নমস্কার জানিয়ে বিমল বেরিয়ে চলে গেল।

নিজেকে বিমলের বড়ই ঘৃণ্য মনে হল। সে যেন একটা অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন মাংসপিণ্ড—আর কিছু নয়। কেন সে পৃথিবীতে এল? কেন জন্মাল? এই জীবনজোড়া ধিক্কার নিয়ে সে কি করবে? কেন সে মানুষ হবার সুবিধা পেল না? সংসারের সর্বপ্রকার বিবেচনা ও স্নেহ থেকে এমন করে সে কেন বঞ্চিত হল? শুধু কি সেই দায়ী এর জন্যে?

কয়েকটা টাকা বিমলের পকেটে ছিল। সে কালীঘাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা ইস্পাতের দোকানে এসে বসল, এবং সেখানে বিশেষ অর্ডার দিয়ে একখানা বড় ধারাল ছোরা ঘণ্টা তিনেক ধরে তৈরি করিয়ে দাম চুকিয়ে বেরিয়ে এল। ছোরাখানা বাঁ হাতে নিল আস্তিনের মধ্যে।

সেখান থেকে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে একখানা হুগলির টিকিট কিনে বিমল গাড়িতে গিয়ে উঠল, এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সে এসে নামল হুগলি স্টেশনে। তারপর ধানকলের পথটা ধরে সোজা চলল।

আধঘণ্টার মধ্যে সে এসে পৌঁছল ধানকলের পাশ কাটিয়ে রাখু মিস্ত্রির খামারে। বুঝতে পারা গেল, রাখুরা কেউ ঘরে নেই। এদিক ওদিক ফিরে পুকুরঘাটের দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল, বিনোদিনী বুক-জলে মনের আনন্দে স্নান করছে। বিমলের জামায় আস্তিনের মধ্যে তার মুঠোটা শক্ত হয়ে উঠল। সোজা হয়ে সে দাঁড়াল।

স্নান সেরে ভিজে কাপড় গায়ে জড়িয়ে টেনেটুনে বিনোদিনী উঠে যাচ্ছিল! হঠাৎ পাশ ফিরে সে দেখল বিমল। বিনোদিনী সহাস্যে প্রশ্ন করল, আবার এ পাড়ায় কেন? কার জন্যে?

তোমার জন্যে!

আমার জন্যে? কী ভাগ্যি! হুকুম কর শুনি?

বিমল বলল, তোমাকে খুন করব বলে এসেছি, বিনোদ।

চোখ উলটিয়ে বিনোদিনী বলল, শোন কথা, তোমার জন্যে তো মরেই আছি, এর ওপর আবার খুন? বলিহারি! আচ্ছ বাপে জন্ম দিয়েছিল তোমাকে, লজ্জা-সরমের মাথা খেয়ে আবার এসেছ আঁচল টানতে! বামন হয়ে চাঁদে হাত!

বিনোদিনী সেই ভিজা শাড়িসুদ্ধ গা দুলিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

বিমল একবার সেদিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে সেখানে থেকে ফিরে চলল।

মাস কয়েক পরে আবার উঠল যবনিকা। বেলেঘাটার ওদিকে চার নম্বর পুলের কাছাকাছি এক বস্তিতে সেই যে অন্ধকার এক রাত্রে কেষ্ট দে নামক একটা লোক খুন হয়েছিল, কলকাতার পুলিশ তার কোনও কিনারা করতে পারেনি। ঘন বর্ষার এক রাত্রে মাঠকোঠার ছায়াচ্ছন্ন আঙনে কেষ্টর রক্তাক্ত মৃতদেহ এবং একখানা রক্তমাখা ছোরা পাওয়া যায়। পুলিশ তদন্তে শুধু জানা গিয়েছিল, কেষ্টর এক জেলখাটা ছেলে আছে, নাম তার বিমল।

প্রায় ছ’ মাস কেটে গিয়েছিল। অবশেষে বিমল আবার একদিন এসে সেন্ট্রাল জেলের গেট পেরিয়ে গুপ্তসাহেবের ঘরে এসে উঠল। অত্যন্ত সুস্থ, সবল, সুহাস্য বিমল।

কি হে? আবার যে?

আমি ধরা দিতে এলুম, স্যার। এবার আমি খুনে আসামী!

বলা বাহুল্য, আদালতে গিয়ে বিমলই প্রমাণ করে দিয়েছিল, তার বাবার হত্যা তার হাতেই সংঘটিত হয়েছে!

বিমলের গল্পের শেষাংশটা ভাল করে আমি শুনতে পাইনি। খুলনা-কলকাতার সেই ট্রেনের কামরায় বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। শুধু এইটুকুই মনে আছে, জেলে গিয়ে বছর দুই পরে বিমল জেলের পাঁচিল টপকে একদিন মাঝরাত্রে পালিয়ে যায়, এবং পুলিশ তাকে আর কোনদিন ধরতে পারেনি।

দেবরায় বলল, গাড়ির মধ্যে সেদিন অগাধে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম! সেই ঘুম ভাঙল ভোরবেলায়, তখনও সূর্য ওঠেনি। উঠে বসে দেখি, ছোট গাড়িখানায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বিমল কোথায় এবং কখন নিঃশব্দে নেমে গেছে জানিনে। এদিক ওদিক চেয়ে দেখি, সুটকেশটা নেই। মনিব্যাগসুদ্ধ গরম কোটটাও গেছে, বিমলের সঙ্গে। কম্বল, রবারের বালিশ, গায়ের চাদর—কোনটাই খুঁজে পেলুম না!

অসুবিধা আমার হয়েছিল বটে, কিন্তু বাল্যবন্ধুর ওপর রাগ করতে পারলুম না। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যে যখন বেয়ারিং বুকপোস্টে আমার নামে সমস্ত দরকারী কাগজপত্রগুলো এসে পৌঁছল, বিমলকে তখন মনে মনে ধন্যবাদই দিয়েছিলুম।

ওখলার বাগানে শীতের মধুর উত্তাপের সঙ্গে স্নিগ্ধ হাওয়া জড়ানো ছিল। চাপরাশি বাবুর্চিরা এবার প্লেট সাজিয়ে লাঞ্চ দেবার আয়োজন করতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *