জন্মদিনের গল্প
তখন ক্লাস নাইন। পড়াশুনো ধীরে ধীরে সেকেন্ড গিয়ারে উঠছে। এক বন্ধুর বাড়িতে পড়তে যেতাম। সে আমাদের ক্লাসের থার্ড বয়। আমি সারা বছর পড়তাম না। যত পড়া পরীক্ষার আগে। তা সত্ত্বেও কোন এক ম্যাজিকে দশের মধ্যে থেকে যেতাম। আমার নিজের মধ্যেও একটা লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করা ছিল। এক থেকে দশের মধ্যে থাকলেই হল। বিরাট কোন লক্ষ্য ছিল না। একবার বোধ হয় বাংলায় ৫৪ পেয়েছিলাম। এত কম নম্বরে খুব মুষড়ে পরেছিলাম। সব সাবজেক্টে ৭০ করে পেলেই খুশি থাকতাম। বাড়ি থেকেও খুব একটা চাপ দিত না।
যে বন্ধুর কথা বলছিলাম তার নাম ছিল অরিন্দম। তাদের বাড়িতে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ইংরেজি পড়াতে আসতেন। উনি শুধু প্রোজ আর পোয়েট্রি মুখস্থ ধরতেন। তা সত্ত্বেও ক্লাসগুলি জোলো ছিল না কারণ উনি আমাদের সাথে বন্ধুর মত মিশতেন। আমরা ছোট ছিলাম বলে মনে হত না। সব ব্যাপারে ওনার সাথে বয়স্কের মত কথা বলতাম। মনে আছে একবার খুব ঘ্যাম নিয়ে বলেছিলাম, “স্যার, মহাভারত পড়ে জানলাম বেশিরভাগ লোকই বাবার ছেলে নয়”। একমাত্র তখনই শুনে গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন “সেটা বুঝতে আরেকটু বড় হতে হবে”।
স্যার নোটস দিতেন না। নিজে থেকে প্রশ্নের উত্তর লেখার ব্যাপারে জোর দিতেন। এটা পরবর্তীকালে বেশ কাজে লেগেছিল।
অরিন্দমের বাড়ি যাবার পথে পড়ত আমার তখনকার ব্যথার বাড়ি। সাইকেল চালিয়ে তিন তলার বাড়িটা দেখতে দেখতে আসতাম। কখনও কখনও দেখাও যেত। দেখতে পেলেই যে কি আনন্দ হত সেটা আর বলে বোঝানো যাবে না।
অরিন্দম আমি আর তন্ময় বলে একটা ছেলে পড়ত আমাদের ব্যাচে। আমি চিরকালই পড়ার বইয়ের থেকে গল্পের বইই বেশি পড়তাম। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাই বাগানের ভূত, টেনিদা, সূর্য কাঁদলে সোনা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খেত। আর খুব গোপনে লুকিয়ে রাখা তখনকার ব্যথা।
আমি আর তন্ময় ছিলাম খুব বন্ধু। সাইকেল চালিয়ে এলাকা ঘুরে বেড়াতাম বিকেলে নিয়ম করে। যে লেভেলে সাইকেল চালিয়েছি, এখন ভাবা যায় না।
এক বুধবার পড়তে পড়তেই অরিন্দম বলল আসছে রোববার ওর জন্মদিন। তারপর আর কিছু বলল না। সে সময়টা আমাদের সবারই জন্মদিনে লুচি মাংস পায়েস হত। বেশ মজাদার ছিল। আর কারও জন্মদিনে বন্ধুদের বলা তো অবধারিত ছিল। পড়া থেকে বেরিয়ে আমি তন্ময়কে বললাম,” কি রে, অরিন্দম কি রোববারের নেমন্তন্ন করল?” তন্ময় বলল,” বলল যখন করল নিশ্চয়ই”। আমি বললাম,”পুরোপুরি তো কিছু বলল না”। তন্ময় বলল,” তাহলে নিশ্চয়ই বাড়ি গিয়ে করে আসবে দেখিস”। আমারও তাই মনে হল। বিশেষ করে অরিন্দমের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের বিশেষ সখ্যতা আছে। অরিন্দমের বাবা- মার বিয়েটা আমার দাদু করিয়েছিলেন। সেটা অরিন্দমের বাবা – মাও প্রায়ই বলেন।
আমি বাড়ি ফিরে বাবাকে বললাম গিফটের জন্য। রোববার অরিন্দমের জন্মদিন, ভাল কিছু দেওয়া প্রয়োজন।বাবা বলল ঠিক আছে আগে রোববার আসুক। বাড়িতে সবাইকেই বললাম অরিন্দমের জন্মদিন। মা বলল পয়লা বৈশাখে কেনা নতুন পাঞ্জাবিটা তো এখনও পড়িস নি। ওটাই পড়ে যাবি।
আসলে অরিন্দম তখন সবে সবে বন্ধু হয়েছে, এর আগে ওর জন্মদিনে কখনও যাই নি, এবারই প্রথম তাই উৎসাহটা বেশি।
আমার জন্মদিন অক্টোবরের ১০ তারিখ। চিরকালই কোন না কোন অনুষ্ঠানের মধ্যে। চিরকাল ছুটি ছাটার মধ্যে জন্মদিন পড়ে। আমাদের স্কুলে যার জন্মদিন হত, তার বাড়ি থেকে লজেন্স পৌঁছে দিত স্কুলে। আমার জন্মদিন চিরকাল ছুটির দিনে পড়ত বলে আমার দুঃখ ছিল। দেখা গেল অরিন্দমের জন্মদিন আমার জন্মের ২৫দিন আগে।
সেপ্টেম্বর মাস। বর্ষা বিদায় নেব নেব করছে। মাঝে মাঝেই শরতের নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে। অরিন্দমদের পাড়ায় মস্ত দুর্গাপূজা হয়। বাঁশ পড়ে গেছে প্যান্ডেলের। পুজোর কেনাকাটাও শুরু পুরো দমে। আমার আর তন্ময়ের তখন পূর্ণ উড়ু উড়ু ভাব। রাস্তায় সাইজের মেয়ে দেখলেই উদাস চোখে তাকাই। যেন আমরা কত উপেক্ষা করছি। ক্লাসের সায়ন তখন আমাদের চোখে হিরো। আদর্শের সাহানা ওকে হলুদ গোলাপ দিয়েছে। ওর গল্প শুনি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
বৃহস্পতিবার এল। অরিন্দমদের বাড়ি গিয়ে ভাবছি এই হয়ত ওর বাবা কিংবা মা বলবে “তোরা রোববার বিকেলে এখানেই খাবি।“ রোববার আমাদের পড়া থাকত না ওদের বাড়িতে সুতরাং নেমন্তন্ন করার দরকার ছিল বৈ কি।
কিন্তু না, বৃহস্পতিবার গেল, শুক্রবার গেল, শনিবার গেল নো ইনভিটেশন।ওদিকে আমাদের বাড়িতে গিফট কেনাও হয়ে গেছে। তন্ময় আবার ঠারে ঠোরে অরিন্দমকে ইঙ্গিত দিচ্ছে “এই রোববার একটু হাবরা যাব, একটু কাজ আছে”, ভাবছে অরিন্দম বোধহয় বলবে কোথায় যাবি, সেদিন ফাঁকা রাখবি, কিন্তু কোথায় কি! কিছুই তো বলেনা ছেলে! রোববার বারাসাত যাবে বলে মা ঠিক করেছিল পুজোর কেনাকাটার ব্যাপারে। আমি না করে দিয়েছিলাম। রোববারের নেমন্তন্নের আরও একটা দরকার ছিল সেটা হল সেদিন রাত আটটায় ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। আমি আর তন্ময় একটা স্যারের কাছে ভৌতবিজ্ঞান পড়তাম। রোববার বিকেল পাঁচটায় মনমরা হয়ে আমি আর তন্ময় ভাবছিলাম আজ নেমন্তন্নটা হলে পরীক্ষাটা দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যেত। আমার বাবাও বুঝতে পারছে ছেলের মাথা গরম আছে। বাবার সাথে আমি আর তন্ময় বসেছিলাম।
বাইরে হঠাৎ বেল বাজল। বাবা বলল দেখ কে এসছে। হয়ত শেষ মুহূর্তে অরিন্দমের বাড়ির কেউ ডাকতে এসেছে। আমরা দুই হ্যাংলা লাফাতে লাফাতে দরজা খুলে দেখি ভৌতবিজ্ঞান স্যার। বিকেলেই হাজির। তার নাকি অরিন্দমের বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। অরিন্দমকে উনি প্রাইভেটে পড়াতেন। আমাদের প্রশ্ন দিয়ে কেটে পড়লেন। বাবাকে বলে গেলেন, “একটু দেখবেন তো দাদা”। রোববার বাবার অফিস ছুটি। বিকেলে কি করবে বুঝতে পারছিল না। আমাদের দুই বেচারাকে পেয়ে খুশিই হল। আমি তন্ময়কে বললাম,”ভাই এই অপমানের বদলা কি করে নেওয়া যায় বলত?”
তন্ময়ের জন্মদিন ডিসেম্বর মাসে। সুতরাং যা করার আমার জন্মদিনের সময়ই করতে হবে। দ্রুত একশান দরকার। দেরী করলে চলবে না।
পরের বুধবার পড়তে গেলাম অরিন্দমের বাড়ি। আমাদের মুখ গোমড়া। চুপচাপ পড়ে চলে এলাম।
মা জিজ্ঞেস করল পূজায় কি নেব? বললাম কিচ্ছু চাই না। খালি এবার আমার জন্মদিনটা বড় করে কোর। মা বুঝেছিল অরিন্দমের বাড়িতে আমাদের বলে নি বলে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি তাই কিছু বলল না। রাজি হয়ে গেল।
পরের দিন স্কুল ছুটি হবে। আমি অরিন্দমকে বাদ দিয়ে আমাদের গ্রুপের সবাইকে নেমন্তন্ন করলাম। তন্ময় আর আমি রোজ অরিন্দমের বাড়ি গিয়ে আমার জন্মদিনের প্ল্যান করি। আমাদের ইংরেজি স্যারকেও বললাম। কিন্তু অরিন্দমকে বললাম না। আমার জন্মদিনও খুব ধুমধাম করে পালিত হল। অরিন্দমের মুখ গোমড়া। আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে।
আমি তন্ময়কে বললাম তুই কিন্তু জন্মদিনে অরিন্দমকে বলিস না। তন্ময় বলল সে আর বলতে। কিন্তু চমকটা খেয়েছিলাম ওদের বাড়িতে পৌঁছে। গিয়ে দিব্বি দেখছি অরিন্দম বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে মিচকে মিচকে হাসছে। আমি দুম দাম করে বেরিয়ে গেলাম তন্ময়দের বাড়ি থেকে। খাই নি সেদিন। এখনও মনে আছে।
#
তারপর দেড় যুগ কেটে গেছে। অরিন্দম এখন বেঙ্গালুরুতে। তন্ময় গুজরাট। নিজেদের জন্মদিনের দিন নিজে নিজে কাটাই। কোন কোনদিন কাজের চাপে ভুলেও যাই আজ আমার জন্মদিন ছিল। মা এলে মাঝে মাঝে পায়েস করে।
সেই ঘটনার পরের বছর থেকে প্রতি জন্মদিনেই ও আমাদের বলে। পরে জেনেছিলাম সে বছরটা ওদের অশৌচ ছিল বলে পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে শুধু গেট টুগেদার করেছিল। ভৌতবিজ্ঞান স্যার ওর নিজের পিসেমশাই সেটাও পরে জেনেছিলাম। সেই অনুশোচনা আমার এখনও যায়নি। অরিন্দম সেদিন ফেসবুকে ওর জন্মদিনের ফটো আপলোড করেছিল। আমায় ট্যাগ করেছিল। অনেকদিন পরে কেকে ঢাকা অরিন্দমের মুখের ফটোর নিচে লিখেছিলাম “সরি ভাই। এদিকে এলে সময় করে আসিস আমার জন্মদিনে। এক সাথে কেক খাওয়া যাবে”। আর কিছু লিখতে পারিনি।
তবে মাইরি বলছি, তন্ময়ের উপর রাগ আমার এখনও যায় নি!!!