জন্মদাতা
অশোক ঠাকুর, ওর এই বয়সে, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। কলকাতা থেকে পঁচিশ-তিরিশ মাইল দূরে, মফস্বল শহরে থাকলেও, অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে, অশোক একটি বিশিষ্ট নাম! চব্বিশ পরগণার প্রশাসনের অনেক হোমরাচোমরা ওর নাম জানে। যদিও স্থানীয় থানার অফিসার ইনচার্জশ্যামাপদ কিছুতেই ওকে যেন প্রাণ ধরে বিশ্বাস করতে পারে না। বরং তার ধারণা, অশোক একটি রকবাজ ফচকে ছেলে। পোশাকে আচরণে মাস্তান বিশেষ মনে করে। তথাপি, একথাও সত্যি, বড় রকমের জটিল কোনো অপরাধ ঘটলেই, শ্যামাপদ ওব কাছেই ছুটে আসে। অশোককে সে কোনো রকমেই অস্বীকার করতে পারে না! বোধহয়, তার বাহ্যিক আচরণ বাদ দিলে, সে মনে মনে অশোককে তারিফ করে এবং একটু ভালোবাসে।
অশোক এ পর্যন্ত বিবিধ ধরনের অপরাধের সত্য উদঘাটন করেছে। কিন্তু গতকাল যে ঘটনার রহস্য উদঘাটনের অনুরোধ ওর কাছে এসেছে, তাকে ঠিক অপরাধ বলা যায় কী না, ওর ধারণা নেই। এরকম একটা ঘটনা যে কেউ ওর কাছে ব্যক্ত করবে, কোনোদিন ভাবতে পারে নি। এত অবাকও কখনো হয় নি। এবং মানুষের জীবন বা চরিত্র যে এত বিচিত্র আর জটিল হতে পারে, আগে কখনো মনে হয় নি।
অশোকের নিজের একটা থিওরি আছে। সেটা কতখানি ওর নিজস্ব, তা ও নিজেও বলতে পারে না। হয়তো অনেক অপরাধতত্ত্ববিদেরা এই থিওরিতে কাজ করেন। অশোক কোনো অপরাধের কথা শুনলে, আগে নিজেকে অপরাধী চিন্তা করে নেয়, তারপরে নিজের মধ্যেই, মোটিভের সন্ধান করে নেয়। মোটিভের সন্ধান পেলে, তারপরে অ্যাকশনের ফরমূলা, নিজের কাছ থেকে বের করে নেয়। অতি নিপুণভাবে, সকলের চোখে ধুলো দিয়ে, কীভাবে অপরাধটা করা যায়, ও নিজেকে দিয়ে আগে সেটা ভাবে। অপরাধতত্ত্বের শ্রেণীবিভাগে, এ ক্ষেত্রে ওর নিজের মানসিকতার কী বিচার হতে পারে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু গতকাল যে ঘটনার সত্য উদ্ধারের অনুরোধ ওর কাছে এসেছে, সেই ঘটনার মধ্যে, ও নিজেকে দিয়ে, কিছুই চিন্তা করতে পারছে না।
গতকাল বিকেলে, সুবিমলদা এসেছিলেন। সুবিমল দাশগুপ্ত। সুবিমল এশহরের আদি বাসিন্দা নন। এক পুরুষের বাস। আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে, বরিশালে। এখন এ শহরে বাড়ি করেছেন। অবস্থাও বেশ ভালো। কলকাতা আর এ শহরে দুটো বাস-সার্ভিস আছে। একটি পেট্রোল-পাম্প আছে। ওঁর এক দাদা আছেন। তিনি কলকাতায় থাকেন। তিনিও ব্যবসায়ী, সুবিমলের ব্যবসার সঙ্গে কোনো যোগ নেই। বাসের ব্যবসা সুবিমলের বাবার ছিল। তিনিই ছোটছেলেকে দিয়ে গিয়েছেন। পেট্রোল পাম্পটা সুবিমল নিজে করেছেন। বাবা, মা, দুজনেই মারা গিয়েছেন। স্বামী-স্ত্রীর সচ্ছল সংসার সুখী দম্পতি বলেই, শহরের লোকে ওঁদের জানে। সুবিমলের একটি ছোট গাড়ি আছে, নিজেই চালান। ড্রাইভার রাখেন নি।
সুবিমলের স্ত্রীকে ঠিক আধুনিক বলা যায় না। বাইরে তাঁকে বিশেষ দেখা যায় না। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে বা নিমন্ত্রণের বাড়িতে বা সিনেমায় দেখা গেলেও, একলা কখনো দেখা যায় না, সুবিমল সঙ্গে থাকেন।বিভা, সুবিমলের স্ত্রীকে অশোক কয়েকবার দেখেছে! কথাবার্তা হয় নি, কারণ সুবিমল কখনো ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে, মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দেন নি। আজকাল সামাজিকতা বলতে যা বোঝায়, সেদিক থেকে, সুবিমল হয়তো কিছুটা রক্ষণশীল। অথবা ওঁর স্ত্রী বিভাই হয়তো, বাইরের লোকজনদের সঙ্গে, তেমন কথাবার্তা বলতে, বা মেলামেশা করতে পারেন না। অথচ অশোক শুনেছে, বিভা দাশগুপ্ত শিক্ষিতা। ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে নাকি পাস করেছেন। বয়স অনুমান তিরিশ-বত্রিশ হতে পারে।
সুবিমল নিজে স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ। বয়স চল্লিশ প্রায়। ওঁর পাশে, বিভা আরো সুন্দর। রূপসী তাঁকে বলতেই হবে, এবং স্বাস্থ্যবতীও বটে। অশোক কয়েকবার যা দেখেছে, মনে হয়েছে, মহিলা বেশ বুদ্ধিমতী, এবং অমায়িক হাসি-খুশি। প্রায় আট বছর বিয়ে হয়েছে। অভাব একটি মাত্র, কোনো সন্তানাদি হয় নি। অনেকেই অনুমান করে, আর বোধহয় হবেনা! যার দোষেই হোক।
সুবিমল এক সময়ে, শহরের অ্যাথলেটিক ক্লাব, থিয়েটার ইত্যাদি নিয়ে খুব মাতামাতি করতেন। পারলে এখনো করেন। সেজন্য, অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের কাছেই, তিনি সুবিমলদা। তিনিও বেশ হাসিখুশি লোক, সকলের সঙ্গেই মেলামেশা করেন, কথাবার্তা বলেন। কিন্তু গতকাল সুবিমল অশোককে অবাক করে দিয়েছেন। গতকাল বিকালে অশোক সবেমাত্র দোতলা থেকে নেমে, ওদের মন্দিরের রকে গিয়ে বসেছে। সুবিমল ওঁর ছোট গাড়িটা নিয়ে তখন এলেন। মুখখানি শুকনো, একটু গম্ভীর, যদিও অশোকের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, গোয়েন্দা ঠাকুর, তোমার কাছে একটু এলাম।
অশোক তাড়াতাড়ি রক থেকে নেমে জিজ্ঞেস করেছিল, কী ব্যাপার সুবিমলদা? একটা খবর দিলে, আমি নিজেই যেতাম।
সুবিমল গাড়ি থেকে নেমে বলেছিলেন, তাতে সুবিধা হত না। তোমার সঙ্গে একটু বিশেষ কথা আছে। খুবই গোপন, তুমি আমি ছাড়া, কেউ জানবে না। আমার বাড়িতে বসে বলার অসুবিধা আছে বলেই তোমার কাছে চলে এলাম।
অশোক অবাক অনুসন্ধিৎসু চোখে সুবিমলের দিকে তাকিয়েছিল। দেখেছিল, ওঁর মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসি নেই। চোখের কোল বসা, কিন্তু দৃষ্টিতে কেমন একটা চঞ্চলতা। মুখ গম্ভীর। অশোক বলেছিল, তাই নাকি? আসুন, ঘরে গিয়ে বসি।
অশোক ওর বসবার ঘরে সুবিমলকে নিয়ে বসিয়েছিল। ওর বসবার ঘরজোড়া তক্তাপোশ, তার ওপরে শতরঞ্জি পাতা। গুটি কয়েক তাকিয়া। তাস দাবা ইত্যাদি খেলা, বা নিছক আজ্ঞা ছাড়া, ওর ঘরে আর কিছু হয় না। সুবিমল কোঁচা তুলে বসে, অন্যমনস্ক মুখে একটি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। খানিকক্ষণ কোনো কথা বলেন নি। অশোক ওঁর কাছেই বসেছিল। বেশ খানিকক্ষণ পরে, সুবিমল যেন নিজের থেকেই চমকে উঠে বলেছিলেন, ওহ্, হ্যাঁ, কথাটা বলি। তোমার কাছে একটা অনুরোধ, কথাটা পাঁচ-কান করো না।
অশোক বলেছিল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
সুবিমল বলেছিলেন, সেই ভরসাতেই, তোমার কাছে আগে এসেছি।
অশোক তখনো কিছুই বুঝতে পারছিল না, কোনো অনুমানই না। সুবিমল আবার একটু চুপ করে থেকে, বলেছিলেন, তুমি তো জানই, আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। সেজন্য তোমার বৌদির আর আমার মনে একটা কষ্ট বরাবরই খচখচু করে। কিন্তু মন তো মানে না, আশাও যায় না। তাই বহু জায়গায় বহু পুজো দিয়েছি, নানান থানে গিয়ে হত্যে দিয়েছি। তোমার বৌদি, এমন কি আমিও, বহু তাবিজ মাদুলি ধারণ করেছি। সবই বিফলে গেছে, কিছুই হয় নি। মন দুর্বল হলে, মানুষ কী না করে। এসব বিষয়ে, আগে কখনো বিশ্বাস ছিল না, তবু করেছি, বিশ্বাস করেই করেছি, যদি কিছু হয়ে যায়। হয় নি।
সুবিমল একটি নিশ্বাস ফেলে নতুন আর একটি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। অশোক লক্ষ্য করেছিল ওঁর আঙুল কাঁপছে। মনে হয়েছিল, নার্ভ টেনশনের ব্যাপার। সুবিমল আবার বলেছিলেন, প্রায় বছর দেড়েক আগে, এসব পুজো হত্যে মাদুলি তাবিজ নেওয়া, আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। তার কারণও আছে। আমি কলকাতায় বিশেষজ্ঞকে দিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়েছি। তাতে জানা গেছে, আমার বীর্য থাকলেও, স্পার্মোটা—মানে, শুক্রকীট মৃত। মৃতও বলা যায় না। আমার কোনো স্পার্মোটা সৃষ্টি হয় না। তার জন্য নরম্যাল সেকস্ লাইফের কোনো অসুবিধা হয় না, কিন্তু মানুষের জন্মের যা মূল, সেই শুক্রকীট না থাকার দরুন, আমার ঔরসে কখনোই কোনো সন্তান হবে না। কথাটা দুঃখের হলেও, নির্মম সত্য। বিশেষজ্ঞ একবার পরীক্ষায় এ রায় দেন নি, দুবার পরীক্ষা করেছিলেন। জানিয়েছেন, আমার ভেতরে, স্পার্মোটা সৃষ্টি করাও সম্ভব না। সাধারণত অল্প বয়সে কোনো ভারি রোগ হলে, অনেকসময় এরকম ঘটে। আমার কোনো ভারি অসুখ কখনো করেনি। আমার জন্মই শুক্রকীটহীন জীবন নিয়ে।
অশোক অবাক হয়ে, সুবিমলের দুঃখের কাহিনী শুনেছিল। মানুষের শরীরের বিষয়ে, এ ধরনের কোনো ব্যাপার ওর জানা ছিল না। সুবিমলের চোখ-মুখ যেন আরো শুকিয়ে উঠছিল, অথচ একটা উত্তেজনাও লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয় সিগারেট শেষ না হতেই, কম্পিত হাতে তৃতীয় সিগারেট ধরিয়ে বলেছিলেন, এর পরে, আর তোমার বৌদিকে পরীক্ষা করবার কোনো প্রশ্নই ছিল না। গলদ কোথায়, তা আমার জানা হয়ে গেছিল। কিন্তু তোমার বৌদিব কাছে, কথাটা আমি বলতে পারি নি। পারি নি তার কারণ, সেটাও একটা ইন্টারনাল কারণ বলতে পারো। পুরুষের রক্তের মধ্যেই বোধহয় এ দুর্বলতা মিশে থাকে। স্ত্রীর কাছে স্বামীতার পৌরুষের গর্বের কথা বলতে পারে। কিন্তু সামান্য দুর্বলতার কথাও বলতে পারে না।
এই পর্যন্ত বলে সুবিমল থেমেছিলেন। অশোক দেখেছিল, সুবিমল সিগারেটটা আঙুলের চাপে, দুমড়ে ফেলছিলেন। যা বলতে চাইছিলেন, তা উচ্চারণ করতে যেন কষ্ট হচ্ছি।অশোক তখনো ব্যাপারটা অনুমান করতে পারছিল না, সুবিমলের একটি আত্মিক কষ্ট ছাড়া। ও ওঁর মুখের দিকে অপলক তাকিয়েছিল।
সুবিমল সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে দিয়ে, হঠাৎ একটু যেন হাসবার চেষ্টা করে বলেছিলেন, দিন সাতেক আগে, তোমার বৌদি বললেন, তিনি সন্তান-সম্ভবা।
বলেই তিনি আর একটি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। অশোক সহসা যেন কথাটার সূত্র ধরতে পারছিল না। পরমুহূর্তেই বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতো, কথাটা ওর মস্তিষ্কে বিধেছিল। বুঝতে পেরেছিল। সুবিমল কেন এত বিচলতি হয়েছেন। কিন্তু এমন একটা দাম্পত্য বা পারিবারিক বিষয়, সুবিমল ওকে কেন বলতে এসেছেন, বুঝতে পারে নি। তবুও একটু দ্বিধার সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা কি নিতান্তই অসম্ভব?
সুবিমল শক্ত মুখে বলেছিলেন, যদি অসম্ভব বলে না মনে করি, তা হলে, পৌরাণিক কাহিনীর বা রূপকথার দেবতার বরকে বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব না। নিজের বিষয়ে, আমার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। যে বিশেষজ্ঞ আমার সিমেন্স পরীক্ষা করেছিলেন, তাঁর পরীক্ষাকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আমি নিশ্চিত, বিভার পেটে যে সন্তান এসেছে, তার জন্মদাতা আমি নই।
সুবিমলের দৃঢ়তা দেখে, অশোক কয়েক মিনিট কথা বলতে পারে নি। তারপরে বলেছিল, তবু আপনি বৌদিকে একবার পরীক্ষা করিয়ে দেখতে পারেন। অনেক সময় সুডো প্রেগনেন্সি–।
সুবিমল বলে উঠেছিলেন, করিয়েছি। একথা প্রথমে আমার মনে হয়েছিল। হয়তো এটা ফলস্ প্রেগনেন্সি। আমাদের রীতা মিত্রের মাদার্স হোমে নিয়ে গেছলাম। পরীক্ষায় জানা গেছে, বিভার প্রেগনেন্সি জেনুইন। এখন সে তিন মাসের গর্ভবতী।
অশোক আবার চুপ করে গিয়েছিল। কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিল না। তারপরে, হঠাৎ মনে হতেই জিজ্ঞেস করেছিল, বৌদির সঙ্গে এ বিষয়ে আপনার কোনো কথা হয়েছে?
কোন্ বিষয়ে?
আপনার বিষয়ে। বৌদিকে সব ভেঙে বলেছেন?
না। তা কেমন করে বলব? তা হলেই যে প্রশ্ন উঠে পড়বে, তার মুখোমুখি দাঁড়াব কেমন করে, সেটাই সমস্যা। আর দাঁড়ানো মানেই তুমি বুঝতে পারছ, হয়
এদিক, না হয় ওদিক।
সুবিমলের কথা শুনে, অশোক বুঝছিল, তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত। নিজেকে অপমানিত ভাবছেন তো বটেই, একটা তীব্র যন্ত্রণাও ভোগ করছেন। হয়তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এ বিষয়ে করণীয় বা কী থাকতে পারে? বিশেষ করে, অশোকের? ও জিজ্ঞেস করেছিল, তা এখন কী করবেন ভাবছেন?
সুবিমল বলেছিলেন, সাত দিন ধরে, দিন-বাত্র সেই কথাই ভাবছি। ভেতরে ভেতরে এ যন্ত্রণা পুষে রাখা কঠিন, তবু আমি কিছুই বলতে পারছি না। সর্বাগ্রে আমার জানা দরকার, কে সে? বিভা কার সঙ্গে যুক্ত?
অশোক বলেছিল, সে কথা তো আপনি বাড়ির অন্য লোকদের কাছেই জানতে পারেন।
সুবিমল বলেছিলেন, অন্য লোক বলতে দীপালি, যে মেয়েটি আমার বাড়িতে সর্বক্ষণ থাকে। ঠিকা ঝি দুবেলা কাজ করে দিয়ে চলে যায়। বিভা রান্নাটা নিজেই করে। বাদবাকী সংসারের যা কিছু, সবই দীপালি দেখাশোনা করে। দীপালিকে আমি নানান ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এমন কি প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়েছি। অবিশ্যি বিভাকে লুকিয়েই এসব করেছি। আমি জানি, দীপালি কিছুই জানে না। সে গরীবের ঘরেরস্বামী-পরিত্যক্তা, তিন কূলে কেউ নেই।এক হাজার টাকা তার কাছে অনেকখানি। তা ছাড়া, আমি ওর চোখ-মুখ দেখেই বুঝেছি, ওর কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য। জীবনে এত অবাক ও কখনো হয় নি। ছলনা করলে আমি বুঝতে পারতাম।
অশোক বলেছিল, দীপালিকে ফাঁকি দিয়ে, বাড়ির মধ্যে কারুর সঙ্গে মেলামেশা করা কি সম্ভব?
সুবিমল বলেছিল, সেটা আমারও প্রশ্ন, কিন্তু কোনো জবাব পাচ্ছি না।
বৌদি কি এর মধ্যে বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও গেছলেন?
কোথাও না। ছ মাস আগে, আমার সঙ্গে সাউথ ইণ্ডিয়াতে বেড়াতে গেছল, তা ছাড়া আর কোথাও ও যায় নি।
এ শহরে, কারোর বাড়িতে বৌদির নিয়মিত যাতায়াত আছে?
কোনো বাড়িতেই না। বিভাকে সেজন্য অনেকে দেমাকী ভাবে। আমার সঙ্গে ছাড়া, বাড়ি থেকেও কোথাও বেরোয় না।
অশোক আবার চুপ করেছিল খানিকক্ষণ। তারপরে বলেছিল, কিন্তু সুবিমলদা, এ বিষয়ে আমি কী করতে পারি?
সুবিমল বলেছিলেন, তুমি শুধু সেই লোকটিকে খুঁজে বের করে দাও। কে সে, যে বিভার সন্তানের জন্মদাতা?
অশোক বলেছিল, তা জেনেই বা আপনার কী হবে? আমার তো মনে হয়, এ বিষয়ে বৌদির সঙ্গে কথা বলে, যা তোক একটা ফয়সালা করে নেওয়াই ভালো।
সুবিমল হতাশভাবে হাত মেলে দিয়ে বলেছিলেন, বিভার সঙ্গে কী ফয়সালা আমি করব, কিছুই বুঝতে পারছিনা। তোমাকেও বুঝিয়ে বলতে পারছি না। এ এমন একটা ব্যাপার—আমি জানি না, তুমি ফীল করতে পারছ কী না। এত ডেলিকেট, অথচ—অথচ।
সুবিমল কথা শেষ করতে পারেন নি, একটা অসহায় যন্ত্রণা আর উত্তেজনায়, কথা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অশোক বুঝতে পারছিল, সুবিমলদার এ অবস্থাটা ভালো না। এর পরিণতি, ওঁর শরীর বা স্নায়ুর পক্ষে গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে। ওঁর অবস্থা দেখে, অনুমান করা যাচ্ছিল, বঞ্চনা এবং অপমানটাই সব না, সম্ভবত উনি স্ত্রীকে ভালোবাসেন। তা না হলে, রাগে এবং ঘৃণায়, সরাসরি একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ওঁর হাতে আছে। তাতে, ওঁর স্ত্রী দ্বিচারিণী, এটা প্রমাণ করা কিছুমাত্র অসুবিধার বিষয় না। বিচ্ছেদ অনায়াসেই হতে পারে। কিন্তু সেবকম কোনো ফয়সালার কথাও সুবিমল ভাবতে পারছিলেন না।
সুবিমল আবার নিজেই বলে উঠেছিলেন, এমন কি, আমার এ কথাও মনে হয়েছিল, সাময়িকভাবে হয়তো আমার স্পার্মোটা জন্ম নিতে পারে। মনে হতেই, আমি কলকাতায় সেই বিশেষজ্ঞকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এরকম কিছু ঘটতে পারে কী না? জবাবে তিনি বলেছেন, অসম্ভব। আমার সবকিছু তিনি যে ভাবে পরীক্ষা করেছেন, বাস্তব ক্ষেত্রে তা কখনো সম্ভব না। এর পরে—এর পরে–
বলতে বলতে সুবিমল যেন অস্থির হয়ে উঠেছিলেন, ওঁর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছিল, বলেছিলেন, এর পরে, আমি কী ব্যবস্থা করব জানি না, কিন্তু আমাকে জানতেই হবে, সে কে? কার সঙ্গে বিভার,কী ব্যাপার আছে? কী ভাবে সেই যোগাযোগ ঘটাচ্ছে? বিভাকে আমি সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারছি না, পারব না, কিন্তু না জানলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
অশোক সুবিমলের মনের অবস্থা কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিল। আট বছরের বিবাহিত জীবনে, যাকে উনি কখনো কোনো কারণে অবিশ্বাস করতে পারেন নি, দাম্পত্য জীবনের একটি চরম বিপর্যয়ে, একদিকে যেমন সমস্ত বিশ্বাস ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে, তেমনি পৌরুষেও এচণ্ড আঘাত লেগেছে। মনের ভারসাম্য এখনো আছে, ভেঙে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র না। অশোকের মনে হয়েছিল, এ থেকে আর একটি ভয়ঙ্কর-বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে, তা হল হত্যা। হয় বিভা হত্যা, অথবা, ইতিমধ্যেই যে অপরিচিতকে সুবিমল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে আরম্ভ করেছেন, তার নিধন। প্রবাদ, যুদ্ধ আর প্রেমে, মানুষ কোনো নীতি আদর্শকেই মানতে চায় না। মহাভারতও সেই সাক্ষী দেয়।।
অশোক আরো ভেবেছিল, সুবিমল তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে, তথাকথিত ভদ্রলোকের মতো কোনো ফয়সালা করতে পারবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, মানুষের মনে ঘৃণা যত তীব্র কৌতূহলও ততখানিই তীব্র। মেঘনাদের মতো কেউ মেঘের আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করে যাবে, এটা অসহনীয়। তাকে দেখতে এবং জানতে হবে।
সুবিমল আবার সিগারেট ধরিয়েছিলেন। অশোক জিজ্ঞেস করেছিল, গত সাত দিন ধরে বৌদির আচরণে নতুন কিছু লক্ষ্য করেছেন?
সুবিমল একটু ভেবে বলেছিলেন, তেমন একটা কিছু মনে করতে পারছি না।
মা হতে যাচ্ছেন বলে একটা খুশি খুশি ভাব।
না, সেরকম কিছু দেখি নি।শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। প্রেগনেন্সির নানান উপসর্গগুলো দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। আমি ইচ্ছা করেই কয়েকদিন একটু বেশি রাত্রে শুতে যাই যাতে বিভার সঙ্গে আমাকে বেশি কথা বলতে না হয়। কথা বলতে গেলে, কী বলতে কী বলে ফেলব, সেই ভয়ে দেরি করি। বিভা ঘুমিয়ে পড়ে। সেটাই যা রক্ষে।
অশোক বুঝতে পেরেছিল, বিভার ঘুমিয়ে পড়া মানেই সে নিশ্চিন্ত আছে। তবুও সুবিমলকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু আপনার মধ্যে তো বেশ পরিবর্তন হয়েছে, সেটা কি বৌদির চোখে পড়ছে না?
সুবিমল বলেছিল, অন্তত বিভার আচরণ কথাবার্তা থেকে তা বোঝা যায় না। অবিশ্যি, আমি ওর সামনে বিশেষ যাচ্ছি না।
অশোক তথাপি, এ বিষয়ে ওর করণীয় স্থির করতে পারে নি। খুনের রহস্য উঘাটনের থেকেও, ব্যাপারটা ওর কাছে বেশি জটিল মনে হয়েছিল। তা ছাড়া, এ-রকম বিষয়ের মধ্যে, ওর যেতে ইচ্ছা করছিল না। একটু সংকোচ করে বলেছিল, সুবিমলদা, এ ব্যাপারে আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। আমার পক্ষে এটা ঠিক হয়ে উঠবে না।
সুবিমল অশোকের হাত চেপে ধরে, ব্যগ্রভাবে বলেছিলেন, অশোক, এ বিষয় নিয়ে, আমি কারোর কাছে যেতে পারব না। এটা তো দশজনের কাছে খোলাখুলি বলে বেড়াবার কথা না। তোমার ওপরে আমার আস্থা আছে, তুমিই একমাত্র পায়রা এটা বের করতে। এটুকুন করে, তুমি আমাকে বাঁচাও।
সুবিমলের ব্যাকুলতা দেখে, অশোক হঠাৎ কিছু বলতে পারে নি। সুবিমল আবার বলেছিলেন, টাকা-পয়সার কথা তোমাকে আর কী বলব। তুমি যা বলবে
অশোক বাধা দিয়ে বলেছিল, আরে ছি ছি সুবিমলদা, টাকা-পয়সার কথা কী বলছেন!
সুবিমল বলেছিলেন, জানি ভাই, খাওয়া-পরার অভাব তোমাদের বাপ-পিতামহ রেখে যান নি। কিন্তু তুমি আমাকে রিফিউজ করতে পারবে না। আমি জানি, তুমি এটা পারো, তোমাকে আমার জন্য করতেই হবে।
অশোক একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, বেশ,আমি চেষ্টা করছি।তবে আপনাকে কিন্তু মনে রাখতেই হবে সুবিমলদা, যে লোকের সঙ্গে বৌদিতাঁর নিজের ইচ্ছায় কিছু করেছেন, তার কোনো ক্ষতি করা আপনার উচিত হবেনা। আর মনে যত কষ্টই পান, কিন্তু উত্তেজলর মাথায় বৌদিকে হঠাৎ কিছু করে বসবেন না।
হঠাৎ কিছু করে বসা বলতে কী বলছ?
অনেক কিছুই হতে পারে। হয়তো মারধোর করবেন?
সুবিমল একটু ভেবে বলেছিলেন, এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু মনে হয় নি।
অশোক বলেছিল, আর একটা কাজও আপনি করতে পারেন। ইমিডিয়েটলি কোনো ক্লিনিকে গিয়ে, অ্যাবরশন করিয়ে নিতে পাবেন! অবিশ্যি যদি বৌদির ইচ্ছা থাকে।
সুবিমল বলেছিলেন, তুমি কি বলতে চাও, তোমার বৌদির ইচ্ছাই সব? আমার মেনে নেবার কোনো প্রশ্নই নেই?
অশোক তাড়াতাড়ি বলেছিল, হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। আপনি মেনে না নিলে কিছুই হতে পারে না।
কিন্তু আমি সে-সব কথা এখনো কিছু ভাবিই নি। আগে আমি কেবল জানতে চাই, সে কে?
অশোক মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ঠিক আছে। আমি পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। হয়তো আপনার বাড়িতে আমাকে যেতে হতে পারে। আর চেষ্টা করবেন, বৌদির সামনে স্বাভাবিক থাকতে, ওঁর মনে যেন কোনো সন্দেহের উদ্রেক হয়।
সুবিমল বলেছিল, সে চেষ্টা আমি করে যাচ্ছি।
সুবিমল চলে যাবার পরে, অশোক অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ভেবেছিল। অবাস্তব না, কিন্তু এরকম একটা অদ্ভুত ব্যাপার নিয়ে ওর কাছে কেউ কখনো আসে নি। সুবিমলের কথা থেকে, এটা নিশ্চিত বোঝা গিয়েছিল, ঘটনাটি নিচ্ছিদ্র সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা, এটা প্রমাণিত, বিভা গর্ভবতী, এবং সুবিমলের দ্বারা তা সঞ্চারিত না। সন্তানের জন্ম কোনো অলৌকিক ঘটনাও হতে পারে না, অতএব জন্মদাতাও নিশ্চই কেউ আছে। কে সে? যোগাযোগ কী করে সম্ভব? দীপালি নামে ঝিকে সুবিমল অবিশ্বাস করেন না। তার অর্থ দাঁড়ায়, বাড়িতে সর্বক্ষণ একজন থাকা সত্ত্বেও, সে কিছুই জানতে পারে নি। বিভা একলা বাইরে বেরোন না। একলা কোনো বাড়িতে যাতায়াত নেই। বাড়িতে কোনো আত্মীয়-স্বজন কেউ আসে নি। কোনো পুরুষের পক্ষে বাড়ির অন্দরমহলে যাওয়া সম্ভব না।
সুবিমল প্রায়ই কলকাতা যান।সকালে যান, বিকালে আসেন, অন্যান্য দিন দুপুরেও বাড়িতেই থাকেন। রাত্রে তাঁর বাইরে থাকার কোনো প্রশ্নই নেই। অতএব, প্রশ্ন জাগে, বিভা দীপালিকে নিয়ে, সুবিমলের অবর্তমানে যখন দুপুরে বাড়িতে থাকেন, তখন দীপালি কোথায় থাকে, বিভা কোথায় থাকেন? সম্ভবত এর জবাব, বিভা ওপরে শোবার ঘরে শুতে যান।দীপালি নিচে বা ওপরেই বারান্দায় কোথাও থাকে। দীপালির যদি দিনে ঘুমোনো অভ্যাস থাকে, তবে সে সময়টা বিভা কাজে লাগাতে পারেন। আবার একথাও ভাবতে হয়, বিভা স্বভাব-দ্বিচারিণী নন। তা যদি হতেন, তা হলে, সুবিমলের অভিজ্ঞের দ্বারা পরীক্ষার আগেই, তিনি মা হতে পারতেন। সুবিমল কোনোদিন কিছুই বুঝতে পারতেন না। দেড় বছর আগে পরীক্ষা করিয়েছিলেন বলেই, এখন বুঝতে পারছেন। গত দেড় বছরের, এক বছরের মধ্যেও, বিভা নিশ্চয়ই কিছু করেন নি। গর্ভধারণে তিনি সক্ষম, কিছু করলে, আরো আগেই গর্ভবতী হতেন। এখন তিনি তিন মাসের গর্ভবতী। ধরা যেতে পারে, গত চার মাস থেকে ছমাসের মধ্যে, তাঁর সঙ্গে কোনো পুরুষের যোগাযোগ হয়েছে।
ছমাস আগে, বিভাকেনিয়ে সুবিমল দক্ষিণ ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।সম্ভবত মাসখানেক বেড়িয়েছেন। সেই সময়ের মধ্যে যদি কিছু ঘটে থাকত, তাহলে গর্ভকাল আরো বেশি হত। প্রায় চার পাঁচ মাস। অতএব বাইরে কিছু ঘটে নি। তা হলে? অশোকের চোখের সামনে, সুবিমলের দোতলা বাড়িটার ছবি ভেসে উঠেছিল। রাস্তার ওপরে, ছোট দোতলা বাড়ি, পুব-মুখখা। পিছনে পশ্চিম দিকে একটি ছোট বাগান আছে। পাঁচিল-ঘেরা বাগানের আশেপাশে আরো বাড়ি আছে। প্রতিবেশী কোনো পুরুষের ব্যাপার যদি হয়, দিনের বেলা পাঁচিল টপকে, সুবিমলের বাগানে ঢোকা কঠিন। লোকের চোখে পড়বেই। তাহলে?
গতকাল বিকালে তখনো অশোকের সান্ধ্য আড্ডার বন্ধুরা এসে জোটে নি। ও বাড়ির ভিতরে গিয়ে, খিড়কি দরজা খুলে, ছোট গলির অন্যদিকের মুখে, কাঞ্চন বৌদির বাড়ি গিয়েছিল। বিকলাঙ্গ জ্ঞাতি দাদা গোবিন্দের স্ত্রী কাঞ্চন বৌদি, নিঃসন্তান যুবতী, অশোকের বন্ধু। বাড়ির ভিতর ঢুকে দেখেছিল, গা ধুয়ে চুল বেঁধে, ধোয়া শাড়ি পরে, কাঞ্চন উঠোনের ধারে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে, পাথরবাটি থেকে তুলে কিছু খাচ্ছিল। অশোককে দেখতে পায় নি। ও পা টিপে টিপে, কাছে গিয়ে দেখেছিল, কাঞ্চন তেঁতুলের আচারে একেবারে মজে আছে। বিকালে অশোককে কাঞ্চন চা খাইয়ে এসেছিল। তারপরে আচার নিয়ে একলা বসেছিল নিশ্চয়। ও ঠোঁট টিপে হেসে বলে উঠেছিল, এ সুখবরটা ঘণ্টাখানেক আগেও তো দাও নি?
বাঞ্চন চমকে উঠে বলেছিল, কে রে?
মুখ ফিরিয়ে অশোককে দেখেই, ভেজা ঠোট ফুলিয়ে, ভুরু কুঁচকে বলেছিল, অসভ্য। এমন চমকে দিয়েছে, বাব্বা!
অশোক বলেছিল, তা না হয় হল, কিন্তু সুখবরটা চেপে গেছ কেন?
কাঞ্চন অবাক মুখে বলেছিল, কিসের সুখবর?
এই যে রসিয়ে রসিয়ে তেঁতুলের আচার গিলছ, তার তো একটাই কারণ।
সেটা কী?
অশোক ভুরু তুলে, গম্ভীর মুখে বলেছিল, শুনেছি বিবাহিতা মেয়েরা এক সময়ে খুব আচার টাচার খায়, মুখের রুচি নাকি নষ্ট হয়ে যায়।
কাঞ্চন লাফ দিয়ে উঠে, অশোককে কিল মারতে উদ্যত হয়েছিল। অশোক ছিটকে সরে গিয়েছিল। কাঞ্চন ফুসে উঠে বলেছিল, পাজী কোথাকার!মুখে কিছু আটকায় না, না?
বলেই কাঞ্চন অভিমানে মুখ ভার করে, আবার বলেছিল, এ জন্মে কোনদিন মা হতে পারব না জেনেই, এরকম ঠাট্টা করতে পারলে।
অশোকতৎক্ষণাৎ অনুতপ্ত হয়ে, হাতজোড় করে বলেছিল, দোহাই কাঞ্চন বৌদি, সিরিয়াসলি নিও না। একটু তোমার পেছনে লাগছিলাম।
কাঞ্চন যতক্ষণ না হেসেছে, ততক্ষণ অশোক হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, ক্ষমা তো?
কাঞ্চন বলেছিল, ফাজিল কোথাকার! তা এ সময়ে আড্ডা ছেড়ে বাড়ির ভেতর কেন?
এক কাণ্ড ঘটেছে, তোমাকে বলতে এলাম।
বলে অশোক সুবিমলের আর বিভার ঘটনা বলেছিল। অশোকের যা কিছু গোপন কথা সবই কাঞ্চন জানে। ওর সব আলোচনাই কাঞ্চনের সঙ্গে হয়। কাঞ্চনের স্বাভাবিক সাংসারিক বুদ্ধি, অনেক সময়, আশ্চর্য রকমের সূত্র ধরে দেয়। কাঞ্চন সব ঘটনা শুনে, হেসে উঠে বলেছিল, এ যে তোমার সেই, চিঠি মে লেড়কা হওয়ার মতো। সত্যি নাকি?
হ্যাঁ, এ সব কথা কখনো মিথ্যা করে বলা যায়?
কাঞ্চন নিবিষ্টভাবে খানিকক্ষণ ভেবে বলেছিল, দেখ বাপু, আমার মনে হয়, ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে গেছে। এটা কোনো নিয়মিত মেলামেশার ব্যপার নয়।
অশোক বলেছিল, সেটা আমার মনে হয়েছে। বিভা দাশগুপ্ত দুশ্চরিত্রা নয়, অ্যাকসিডেন্টাল কিছু ঘটে গেছে, যা মানুষ সব সময়ে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু সেই অ্যাকসিডেন্টটা ঘটতে পারে কার সঙ্গে?
কাঞ্চন বলেছিল, এমন কারোর সঙ্গে, যাকে কিছুতেই সন্দেহের মধ্যে আনা যায় না।
সেরকম কারোকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না।
কাঞ্চন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল, নিশ্চয়ই যাবে, যেতেই হবে। সে হয়তো সামনেই রয়েছে, কিন্তু তাকে চেনা যাচ্ছে না। ভালো করে খোঁজো, ঠিক পাবে।
অশোক গভীর চিন্তায় ড়ুবে গিয়েছিল।
বেলা প্রায় সাড়ে চারটে। অশোক এসে দাঁড়াল, সুবিমলের বাড়ির বিপরীত দিকে। নিচের দরজা-জানালা সবই বন্ধ। ওপরের ব্যালকনি ফাঁকা, সেখানে কেউ নেই। গ্যারেজের কোলাপসিবল গেট তালা-বন্ধ, গাড়ি নেই। সুবিমল কোথাও গিয়েছেন। অশোক ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, দরজা বন্ধ, জানালাগুলো খোলা। বিভা হয়তো এখন উপরেই আছেন। দীপালি কি নিচে কাজ করছে? সম্ভবত।
সুবিমলের বাড়ির পাশ দিয়ে, পশ্চিম দিকে একটা রাস্তা গিয়েছে সেদিক থেকে একটা কোলাহল ভেসে আসছে। অশোক সেদিকে গেল। সুবিমলের বাগানে পাচিলের পাশ দিয়ে গেল। পাঁচিল শেষ হতেই, বাঁদিকে বেশ খানিকটা পোড়ো জায়গা, মাঠ বলা যায়। সেখানে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছে। কোলাহলটা ওদেরই চিৎকার-চেঁচামেচি। মাঠের গায়েই সুবিমলের বাগানের পাঁচিলের সীমানা। অশোক ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখল, বাড়ির পশ্চিম দিকেও দোতলায় রেলিং ঘেরা বারান্দা রয়েছে।
এদিকটায় দরজা-জানালা সবই ভোলা, কিন্তু কারোকে দেখা যাচ্ছে না।
অশোক ছেলেদের খেলা দেখতে দেখতে খানিকটা এগিয়ে গেল। এ পাড়ায় ওর জানাশোনা দু তিনজন বন্ধু আছে। সকলেই চাকরি করে, এখনো ফেরেনি। অশোক আবার ফিরল, আর তখনই এক জনের শট লেগে, বলটা সুবিমলের পাঁচিল ডিঙিয়ে বাগানে গিয়ে পড়ল। পাঁচিল তেমন উঁচু না। সঙ্গে সঙ্গে দু তিনটে ছেলে, লাফিয়ে পাঁচিলে ওঠার চেষ্টা করল।বিভাকে দেখা গেল, রেলিংয়ের ধারে এসে দাঁড়ালেন। মাথার ঘোমটা নেই, আলুলায়িত কেশ। সত্যি রূপসী। বলে উঠলেন, তোদের আসতে হবে না, নিমু যাচ্ছে।
অশোক দাঁড়াল না, কিন্তু খুবমন্থরভাবে এগোল। পাঁচিলের ওপর ছেলেরা বাগানের দিকে তাকিয়ে বলল, এই নিমু, ওই যে, আমগাছের গোড়ায় বলটা পড়েছে।
অর্থাৎ নিমু নামে কেউ বাগানে এসেছে, অশোক দেখতে পাচ্ছে না। দু তিন সেকেণ্ড পরেই, শট করার আওয়াজ হল, বলটা মাঠে এসে পড়ল। ছেলেরা পাঁচিল থেকে নেমে মাঠে দৌড়ুল। আবার দু সেকেণ্ডের মধ্যেই, বাগানের ভিতর থেকে, পাঁচিলের ওপর একটি ছেলে লাফিয়ে উঠল। তেরো-চৌদ্দ বছরের ফরসা ছেলে, হাফ-প্যান্ট আর গেঞ্জি গায়ে, পঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে, প্যান্টের পকেট থেকে সে একটা ডাঁসা পেয়ারা বের করে, কামড় বসিয়ে, বিভার দিকে তাকাল। বিভা হাসলেন, বললেন, পড়ে যাবে নিমু, নেমে পড়ো।
নিমু লাফ দিয়ে পাঁচিল থেকে নামল, নেমেই মাঠের দিকে দৌড় দিল। বিভা একটু হেসে, ভিতরে চলে গেলেন। অশোক মাঠের দিকে তাকাল। সবাই প্রায় একই বয়সের কিশোর, পাড়ার ছেলে। অশোক না দাঁড়িয়ে চলতে লাগল। সুবিমলের বাড়ির সামনের দিকে এসে, আশেপাশের দিকে তাকাল। কয়েকটা ছোটখাটো দোকান। মুদিখানা, মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান, নিতান্ত পাড়ার মধ্যে যা থাকে। অশোক আবার বাড়িটার দিকে দেখল। দক্ষিণে লাগোয়া একটি একতলা বাড়ি, শ্ৰীশ মোক্তারের বাড়ি। অশোক যত দূর জানে, শ্ৰীশ মোক্তারের কোনো যুবক পুত্র নেই, একাধিক যুবতী কন্যা আছে। মোক্তার কন্যাদের শহরে একটু দুর্নামও আছে। কারোর বিয়ে হয় নি, ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। কিন্তু অশোকের কোনো কাজ হবে না তাতে। মোক্তারের মেয়েরা জন্মদাতা হতে পারে না। ও চিন্তিত মুখে, এগিয়ে চলল। বড়রাস্তায় গিয়ে, একটা সাইকেল-রিকশা নিয়ে,মাইল খানেক দূরে, সুবিমলেব পেট্রোলপাম্পে গেল। সুবিমল ছিলেন, অশোককে ডেকে ভিতরে নিয়ে বসালেন। অশোক বলল, আপনার বাড়ির আশেপাশে একটু ঘুরে এলাম।
সুবিমল কৌতূহলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু জানতে পারলে?
অশোক বলল, না। আশপাশটা একটু দেখে এলাম। আপনার বাগানের পিছন দিকে গেছলাম, যেখানে পাড়ার ছেলেরা খেলা করে।
সুবিমল বললেন, হ্যাঁ, ওখানে বাচ্চা ছেলেরা খেলা করে। বৌদিকেও দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। বলটা বাগানে গিয়ে পড়েছিল, নিমু বলে একটি ছেলে বোধহয় বাড়ির মধ্যেই ছিল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সুকুমারদার ছেলে, সুকুমার ব্যানার্জী, ডানলপে চাকরি করেন। বল-টল পড়লে, বা এমনিও নিমু কখনো যায়। বাগানের দিকটায় কি তোমার সন্দেহজনক কিছু মনে হল।
অশোক মাথা নাড়ল, না। আমি আজ যাই, দু একদিন পরে দেখা করব।
সন্ধ্যাবেলা। অশোক ও নিজের দোতলার ঘরে, খাটে বসে আছে। কাঞ্চন আর ও দুজনেই চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। অশোকের চোখে নিবিড় জিজ্ঞাসা।কাঞ্চনের চোখে একটি অর্থপূর্ণ সংকেত। অশোকজিজ্ঞেস করল, তুমি নিজের চোখে দেখেছ?
কাঞ্চন বলল, নিজের চোখে। তা বলে, ইচ্ছা করে কি দেখেছি? চোখে পড়ে গেছল, তাই দেখেছি। কেন, তোমার নিজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই?
বলতে বলতেই কাঞ্চনের মুখ লাল হয়ে উঠল, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অশোক যেন গভীর চিন্তা থেকে জেগে উঠে বলল, আছে, তবে, অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন রকম। কিন্তু পাখিটাকে ধরব কেমন করে বলো তো?
কাঞ্চন হেসে বলল, ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাও কোনো ফাঁকা জায়গায়, তারপরে–
কাঞ্চন কথা শেষ করল না, অশোকের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। অশোক ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, হুঁ। পাখিটা বেশি সজাগ হলেই মুশকিল।
কাঞ্চন বলল, তাহলে আর তুমি কেমন শিকারী?
তা বটে। আচ্ছা, তুমিও তো এভাবে মা হতে পারো। কাঞ্চন ঘাড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তারপরে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, সে আমি যখন খুশি হতে পারি, নিজেই ভালো জানো!
বলেই সে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
পরের দিন অশোককে দেখা গেল, বিকালবেলা গঙ্গার ধারের মুণ্ডেশ্বরীর নিরালা ঘাটে বসে থাকতে। এদিকে কেউ বেড়াতে আসে না। ও রাস্তার দিকে উগ্রীব চোখে তাকিয়েছিল। প্রায় মিনিট দশেক পরে, ও রবিকে দেখতে পেল। রবির সঙ্গে নিমু, একই বয়সী দুজনে। দুজনেই কথা বলতে বলতে ঘাটের কাছে এল। রবি অশোকের দিকে তাকাল। বাড়ির ছেলে, রবিকেই অশোক পাঠিয়েছিল, নিমুকে ভুলিয়ে নিয়ে আসতে। অশোক এগিয়ে, খপ করে নিমুর হাত কঠিন মুঠিতে চেপে ধরে, রবিকে বলল, তুই দৌড়ে চলে যা।।
রবি দৌড় দিল। নিমু হঠাৎ অবাক চোখে তাকিয়ে, প্রতিবাদ করে, হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল, বারে, আপনি আমাকে ধরলেন কেন?
অশোক কঠিন মুখে, জলন্ত চোখে নিমুর দিকে তাকাল। এক ঝটকায় নিমুকে আরো কাছে টেনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, চুপ! এক থাপ্পড়ে তোমার বদন বিগড়ে দেব, অসভ্য বদমায়েস নোংরা ছেলে! আমি জানি না, তুমি কী করেছ?
নিমুর চোখে ভয় ফুটল, বলল, কী করেছি?
কী করেছ? মায়ের বয়সী মহিলার সঙ্গে–
অশোক পুরো বাক্য শেষ না করে, বলে উঠল, ক্লাস এইটে পড়তেই এসব বিদ্যে? নাক টিপলে দুধ বেরোয়, তোমার গলা টিপে আজ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেব। বলো, সুবিমলদার বৌয়ের সঙ্গে কী হয়েছে?
নিমু মুহূর্তের মধ্যে কেবল চুপসে গেল না, ওর দুচোখে অন্ধকার দেখা দিল। প্রায় কাঁদতে লাগল বলল, আমার-আমার কী দোষ? কাকীমা নিজেই তো
নিমু চুপ করে গেল। অশোক ধমকে উঠল, কী, কাকীমা কী করেছেন? কাকীমা বি তোমাকে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন?
নিমু মাথা নেড়ে বলল, না, জোর করেন নি। প্রথম দিন দুপুরবেলা কাকীমা আমাকে তাঁর গা হাত পা টিপে দিতে বলেছিলেন, তারপর
নিমুর কথা আটকে গেল। অশোক জিজ্ঞেস করল, দুপুরে কেন গেছলে?
পাঁচিল টপকে বাগানের কাঁচা আম পাড়তে। তখন কাকীমা দেখতে পেয়ে ওপরে ডেকেছিলেন।
দীপালি তখন কোথায় ছিল?
নিচে ঘুমোচ্ছিল।
দুপুরে আর কদিন ওরকম গেছ?
তিন দিন।
অশোক দেখল, স্বাস্থ্যবান সুন্দর কিশোর, এখনো গোঁফের রেখাও স্পষ্ট হয় নি। বয়স তেরো-চৌদ্দর বেশি না, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। বিভা নিজের সর্বনাশ করেছেন, না এই কিশোরের? সে বিচারে অশোক যেতে চায় না, জীবন রহস্যই ওকে অবাক করেছে। জিজ্ঞেস করল, কাকামা তোমাকে দুপুরে আর যেতে বলেন না?
না।
অন্য সময়?
অন্য সময় যাই।
তখন কাকীমা কী বলেন?
এমনি আদর করে কিছু খেতে দেন।
অশোক নিমুর ভীরু চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বুঝল, বুঝেছ তো, আমি সবই জানতে পেরেছি! খবরদার, একথা বা আমার কথা যদি কারোকে বল, তাহলে তোমার বাবা-মাকে আমি সব কথা বলে দেব।
নিমু মাথা নেড়ে বলল, কারোকে বলব না।
তোমার কাকীমাকেও না।
কারোকে না।
অশোক নিমুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও, ভালো ছেলের মতো লেখাপড়া কর, খেলাধুলো কর, ওসবে আর যেও না।
নিমু ঘাড় কাত করে, চলে গেল। অশোক এখনো অবাক চোখে নিমুকে দেখতে লাগল। সত্যি, বিচিত্র মানুষের জীবন! কিন্তু সুবিমল তাঁর স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের জন্মদাতাকে কী চোখে দেখবেন, বা বিভার সঙ্গে কী ফয়সালা করবেন, অশোকের আর তা জানবার দরকার নেই।