জন্ম
কানাইয়ের খুব বিশ্বাস ছিল যে ভবেন বিশ্বেসই তার বাপ। তা বলে আইন মোতাবেক নয়। ওই যেমন হয় আর কি! তার মা শেফালী ভবেন বিশ্বেসের বাড়িতে দাসী হয়ে আছে কম করেও পঁচিশ—ছাব্বিশ বছর। এখনো খাটে। ভবেনের বিশাল বাড়ি, ময়দানের মতো তিনটে উঠোন, লাগোয়া মস্ত আম আর লিচু বাগান, মেলা নারকোল গাছ, সবজির খেত, পনেরোটা গোরু নিয়ে বিরাট পাকা গোয়াল, সার সার মণ চালের গোলা, চালকল, আটাচাকি, তেলকল মিলিয়ে ডাইনে—বাঁকে মা লক্ষ্মী। আইন মোতাবেক ভবেনের চার ছেলে, তিন মেয়ে। না, কানাইকে তাদের মধ্যে ধরা হয় না। ধরতে নেই। তবে ভবেনের জনের দরকার, নইলে এতদিক সামাল দেবে কে? সুতরাং, কানাইও মাস মাইনে আর খোরাকি পায়, গতরে খাটে। বিশ বছর বয়সও হল তার। লেখাপড়াও শিখেছিল একটু। টেনেটুনে মাধ্যমিক পাশ করার পর সে ভবেনের খাজাঞ্চি হরিপদর লাগোয়া হল। ভবেনই তাকে ডেকে বলে দিল, হিসেবের কাজটা শিখে রাখ, পরে কাজে দেবে।
হিসেবের কাজ সব বিকেলবেলায় হয়, সারাদিনের আদায় উশুলের পর। আর দিনমানে ফাইফরমাশের অভাব নেই। তারই ফাঁকে ফাঁকে সে ভবেনের ছড়ানো ঐশ্বর্যের দিকে চেয়ে থাকে। তার মনে হল, এসবের একটা হিস্যে তারও ছিল। না, আইন মোতাবেক নয়।
শেফালী সোজা—সরল মানুষ। তার পেটে কথা থাকে না। তার ওপর ভবেন বিশ্বেসের মতো তালেবর লোকের সঙ্গ করার একটা বড়াইও তো আছে। একদিন বর নয়ন দাসের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটির পর ছেলেকে বলেই ফেলেছিল, তুই কী ওর মতো হেঁজিপেঁজির ছেলে? তোর আসল বাপ হল ভবেন বিশ্বেস।
কলঙ্কের ব্যাপার একটা আছে বটে, কিন্তু গৌরবও তো কম নেই। শুনে একরকম খুশিই হয়েছিল কানাই। আর তারপর থেকেই সে রোজ মিলিয়ে মিলিয়ে দেখেছে, ভবেন বিশ্বেসের সঙ্গে তার মিল কতটা। তা তার মা শেফালী দাসী মিছে বলেনি। কানাই হল লম্বাই চওড়ায় সা জোয়ান ছেলে, আর তার আইন মোতাবেক বাপ নয়ন দাস হল খেঁকুড়ে চেহারার একরত্তি মানুষ। মেলে না। কিন্তু ভবেন বিশ্বেসের সঙ্গে মেলাও। খাপে খাপে মিলে যায়। ভবেন বিশ্বেস লম্বাই চওড়ায় বিরাট মানুষ। রংটাও ফর্সার দিকেই। কানাইয়েরও অবিকল তাই। মিল খুঁজে পেয়ে নিশ্চিন্ত হল কানাই। দুঃখের কথা, বাপকে জ্যাঠা ডাকতে হয়, এই যা। তবে মনে মনে সে ভবেন বিশ্বেসকে বাবা বলেই ডাকে।
মনে মনে বাপ আর মুখে জ্যাঠা বলে ডাকাটা হল দু নৌকায় পা রেখে চলার মতো। সামাল দেওয়া মুশকিল। বাপ আর জ্যাঠা এমন গুলিয়ে যায় যে মাঝেমধ্যে বিপত্তি দেখা দেয়।
মুনশির হাটের রজব আলি এসেছিল সেদিন পাখি নিয়ে। ভবেন বিশ্বেসের ছোটো মেয়ে বিনীর খুব পাখি পোষার শক। দরদালানে বিস্তর পাখির খাঁচা ঝোলানো। সারাদিন কিচিরমিচির, হেগেমুতে একশা করে। দুর্গন্ধে তেষ্টানো যায় না। তার মা শেফালীই সব পায়খানা পরিষ্কার করে। বাবুর মেয়ে পুষেই খালাস, ভোগান্তি অন্যের। তা বিনী একটা কথা—বলা ময়নার কথা বলে রেখেছিল। রজব আলি নিয়ে এসেছে সেদিন। কথায় কথায় রজব তাকে বলল, তুই তো শুনি সব কাজের কাজি। ইলেকট্রিকের কাজ জানিস, পাম্পসেট সারাতে পারিস, কাঠের কাজ জানিস, তা এত গুণ নিয়ে পড়ে আছিস কেন? মুনশির হাটের মহাজন মহাদেব পোড়েল লোক খুঁজছে। কাজের লোক পেলে হাজার দু—হাজার বেতন দেবে। যাবি?
কথাটা মিথ্যে নয়। লেখাপড়ায় তেমন দড় না হলেও কানাই হাতের কাজে খুব পাকা। পাম্পটেস, জেনারেটার থেকে শুরু করে এ বাড়ির যাবতীয় যন্ত্রপাতিই সে টুকটাক সারিয়ে দেয়। ভবেন বিশ্বেসের মেজো ছেলে গোবিন্দ ছাদে মস্ত ডিশ অ্যান্টিনা লাগিয়ে, ঘরে ঘরে কেবল কানেকশন দিয়েছে সে কাজও কানাইকেই করতে হয়। এসবের জন্য বাড়তি পয়সাও পায় না সে। তার জন্য দুঃখও বিশেষ নেই তার। ভাবে, নিজের বাড়িরই তো কাজ।
রজব আলির প্রস্তাব শুনে সে উদাস মুখে বলে ফেলেছিল, বাপ—পিতেমোর ভিটে ছেড়ে কোথায় যাব রজব ভাই!
শুনে রজব হাঁ, বলল, এ আবার কবে থেকে তোর বাপ—পিতেমোর ভিটে হল রে? তোর বাপ তো নয়াগঞ্জের লোক! বাপের ভিটে এখানে দেখলি কোথায়?
বেফাঁস কথা। বুঝতে পেরে কানাই কথা ঘোরাতে লাগল।
রজব বলল, ভালো করে ভেবে দেখিস। মহাদেব বুড়ো হয়েছে। ভবেন বিশ্বেসের চেয়েও তার ভালো অবস্থা। দুগুণ—তিনগুণ হবে, ম্যানেজার গোছের লোক খুঁজছে। চাপাচাপি করলে দুই কেন, তিন হাজারেও রাজি হয়ে যাবে।
আর বেতন ছাড়াও রোজগার মেলা। সাত মেয়ের পর তার একটা মাত্র ছেলে। তা সে ছেলেও লায়েক হয়নি।
প্রস্তাব খুবই লোভনীয়। কিন্তু কানাইয়ের হল দু নৌকোয় পা। আইন মোতাবেক সে ভবেন বিশ্বেসের ওয়ারিশন নয় বটে, কিন্তু ধর্মত ন্যায্যত এই যে বিরাট বাড়ি, চাষের জমি, নানা কারবার এসবের একটা অংশ তারও। এইটে ভেবে একটা সুখ আছে। সেই সুখ কী অন্য কোথাও পাওয়া যাবে?
কুমোরপাড়ার হিমি পিসির জাঁতির খিল খুলে গিয়েছিল। কানাইকে ধরে পড়ল, দে বাবা লাগিয়ে। ত্রিশ বছরের পুরোনো জিনিস। এমনটি আর পাওয়া যায় না। বখশিশ দেবোখন।
এ কথায় দেমাক একটু লাগল কানাইয়ের। বলল, বকশিশের কথা কেন বলেন পিসি? ওসব দিতে হবে না। গায়ে ভদ্রলোকের রক্তটা তো আছে।
জাঁতিটায় রিপিট এঁটে যখন পৌঁছে দিল কানাই তখন পিসি তাকে আদর করে বসিয়ে একথা—সেকথার পর হঠাৎ বলল, হ্যাঁ রে, তুই তো ভদ্রলোকের ছেলে। তা অমন চাকরবাকরের মতো খেটে মরিস কেন?
কথাটার প্যাঁচ ধরতে পারেনি কানাই। ভালোমানুষের মতো বলে ফেলল, নিজের বাড়ির কাজ, লজ্জার কী আছে বলুন!
পিসি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, তাও তো বটে। আমরাও তো বলাবলি করি, কানাইয়ের চেহারাখানা দেখে কে বলবে ভদ্রলোকের ছেলে নয়? তেমনই লম্বা—চওড়া,তেমনই ফর্সাটে রং, তেমনই হাত—পায়ের গড়ন।
কানাই তবু প্যাঁচ ধরতে না পেরে প্রশংসা মনে করেই মিটিমিটি হাসছিল। হিমি পিসি নাড়ু আর জল খাইয়ে হঠাৎ আলটপকা বলে ফেলল, বুড়ো টসকাবার আগে একটু বুঝেসুঝে নিস বাবা। তোর ন্যায্য দাবি আছে কিন্তু।
এ কথায় একটু থমকায় কানাই। তবে কি সবাই জানে নাকি? কথাটা তো সেদিকেই ইশারা করছে।
লজ্জারই কথা। কানাইয়ের লজ্জাও করছিল। কিন্তু একটু আনন্দও যে না হচ্ছিল তা নয়। জানাজানি হওয়ায় অন্তত ব্যাপারটা নির্যস সত্যি বলেই প্রমাণ হচ্ছে।
হিমি পিসি ভালোমানুষের মতো বলল, বুড়োকে ভাঙিয়ে কত লোক করেকর্মে খাচ্ছে, আর তুই আঁটি চুষছিস। আমরা তো বলি, অত ভালো ছেলে…
নাড়ু খেয়ে কানাই উঠে পড়ল।
দাবিদাওয়ার কথাটা অবশ্য সে ভাবে না। ওসব করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। মনে মনে এটুকু জেনেই সে খুশি যে একটা তালেবর লোকের ছেলে। জানা বাপটা নয়, ছুপা বাপটাকেই তার পছন্দ।
গায়ে—গতরে আলিসান হয়ে ওঠার পর সে একদিন মেপে দেখেছে, ভবেন বিশ্বেসের চেয়েও সে দু—ইঞ্চি লম্বা। মাপজোখ করার সহজ উপায় তো ছিল না। তবে ভবেন বিশ্বেস যখন বারান্দার থামের পাশে দাঁড়িয়ে উঠোনে মুনিশদের ধান ঝাড়াই দেখে তখন মাথাটা থামের একটা চাপড়া—খসা জায়গায় পৌঁছায়। ওই মাপটা ধরে সে মেপে দেখেছে।
ইদানীং সন্ধের পর খাজাঞ্চির সঙ্গে তারও ডাক পড়ে ভবেনের ঘরে। মেঝের উপর বিভিন্ন খাতে আসা টাকাপয়সার স্তূপ। গোনাগাঁথা, খাতায় হিসেব তোলা এসব ভবেনের চোখের সামনেই হয়। বুড়ো হরিপদর চেয়ে সে অনেক বেশি চটপটে বলে ভবেনের যেন একটু পক্ষপাত দেখা দিচ্ছে তার প্রতি।
একদিন সন্ধেবেলা খাজাঞ্চি চলে যাওয়ার পর ইশারায় তাকে বসতে বলেছিল ভবেন।
ভবেন গম্ভীর গলায় বলল, কত মাইনে পাস যেন?
তিনশো টাকা। আর খোরাকি।
কম নয় তো! নয়ন কত পায় জানিস?
আজ্ঞে, রোজ কুড়ি টাকা করে। খোরাকি আছে।
ও বাবা, সে তো পাঁচ—সাতশো টাকার ধাক্কা! আর তোর মা?
দেড়শো টাকা আর খোরাকি।
তাহলে একুনে কত হল?
হাজার খানে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভবেন, বলে কত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে রে বাপ! তাই তো তেমন জমছে না আমার তবিলে।
কথাটা ঠিক নয়। তার ভবেন বাবা কত কামায় তার হিসেব কানাই ভালোই জানে। দিনে খরচখরচা বাদ দিয়ে আড়াই থেকে তিন হাজার। ফসলের সময়ে এর পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি।
ভবেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যা যায় যাক। তবু তো গরিবেরা খেয়েপরে বাঁচছে। কী বলিস?
যে আজ্ঞে।
আমার বাঁ হাঁটুতে আজকাল বড্ড ব্যথা হয়। বাতে ধরেছে। গনাকে একটু তামাক সাজতে বলে আয় তো। তারপর হাঁটুটা দাবিয়ে দে একটু।
পা দাবানোর হুকুমে খুশি হল কানাই। বাপ হলে কী হয়, চাকর আর মনিবের দূরত্ব তো আছেই। পা দাবানোর সুবাদে তবু একটু কাছাকাছি হওয়া গেল।
তামাকের সুন্দর গন্ধ ছাড়তে ছাড়তে ভবেনবাবু বলল, তোর মা এসেছিল কাল, তোর হয়ে দরবার করতে। অনেক ধানাইপানাই করল। তা তুই কিছু খারাপ আছিস বাপু? এর চেয়ে বেশি কেউ দেবে গ্রামদেশে?
কথাটা বলার ইচ্ছে ছিল না, তবু কেমন যেন ফস করে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে, একজন তিন হাজার টাকায় সাধছে আমাকে।
অ্যাঁ, বলে বড়ো করে চোখ মেলল ভবেন। কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলে, তিন হাজার! তা কাজটা কীসের?
ম্যানেজারি।
বলিস কী? কে সাধছে।
মুনশির হাটের মহাদেব মহাজন।
কে বটে লোকটা। কীসের কারবার?
তা জানি না। তবে মেলাই নাকি ব্যাবসাপত্তর। জমিজিরেত।
সে তোকে ম্যানেজারি দিতে চায় কেন?
তার একজন চৌকস লোক চাই।
তোকে চৌকস ঠাউরেছে বুঝি?
এখনো ঠাওরায়নি। বাজিয়ে নেবে।
তোর কী ইচ্ছে? যাবি?
কথাটা বলার ইচ্ছে ছিল না। তবু কে যেন ভিতর থেকে জোর করে কথাগুলি ঠেলে বের করে দিল, আজ্ঞে বাপ—পিতেমোর ভিটে ছেড়ে কার যেতে ইচ্ছে হয় বলুন। তবে আতান্তরে পড়লে যেতে হবে।
কথাটা বলে ফেলে সে কর্তার দিক থেকে যেমনটা আশা করেছিল তেমনটা ঘটল না দেখে অবাক হল।
কথাটার মধ্যে যে প্যাঁচটা আছে সেটা হয় ধরতে পারল না। নয়তো এড়িয়ে গিয়ে ভবেন কিছুক্ষণ ভুড়ুক ভুড়ুক করে তামাক খেয়ে গেল। তারপর হঠাৎ বলল, তোর তো আর ভাইবোন নেই।
না, আমি একা।
হুঁ।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর ভবেন নলটা সরিয়ে রেখে বলল, তুই তো গোবিন্দর সঙ্গে কাজ—টাজ করিস। সে তোকে কিছু দেয়—টেয়?
না, আমি চাইনি।
চাসনি কেন?
কাজটা শিখে রাখলাম। বড়দার তেমন হয়ও না কিছু। কিন্তু যত বাড়িতে লাইন দিয়েছি তাদের অর্ধেকও ঠিকমতো পয়সা দেয় না। গত মাসেও তিন বাড়ির লাইন কেটে দিতে হয়েছে।
অসন্তুষ্ট ভবে বলে, এককাঁড়ি টাকা জলে গেল। তখন বলেছিলুম গাঁ—গঞ্জে লোকের ভাতই জোটে না তো টিভি দেখবে!
ঠিকমতো করতে পারলে হয়। লোকে না খেয়েও ওসব দেখতে চায়।
কিছু হবে বলছিস?
ধীরে ধীরে হবে। কারেন্ট থাকে না বলে লোকে অর্ধেক দিনই দেখতে পায় না কিছু।
সেটাই তো বলছি। ওসব বিলাসিতা কি এখানে মানায়। দেখুক কিছুদিন। বেশির ভাগ ব্যাবসাই তো ধারবাকিতেই ডোবে কিনা।
আজ্ঞে।
তা গোবিন্দ যা হোক কিছু করছে। আর তিনজন তো বসে বসে হেদিয়ে গেল।
বটু কী পড়ছে যেন?
আজ্ঞে ক্লাস এইট হল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভবেন বলল, গতবার ফেল মেরেছে। অবিশ্যি পড়েই বা কী হবে? কাজ—কারবারে লাগলে কাজ হত। কিন্তু বাবুদের তো ইদিকে মনই নেই।
কথাটা জানে কানাই। দুঃখেরই কথা ভবেনের পক্ষে।
ভালো চোখে দেখেও না আমাকে।
বড়ো মানুষ হলেও ভবেন বিশ্বেসেরও দুঃখের দিক আছে। চার—চারটে ছেলের কেউই বাপকে যে বিশেষ গ্রাহ্য করে না এ সবাই জানে। তারা একটু বাবু গোছের, একটু আলগোছ। চাষবাস, মুনিশ খাটানো, চালকল, তেলকল এসব নিয়ে এই যৌবন বয়সে মাথা ঘামাতে তারা নারাজ। যতদিন মাথার ওপর বাপ বাবাজীবন গ্যাঁট হয়ে বসে আছে ততদিন ঘামাবেও না।
ভয় কি জানিস, অন্ধি—সন্ধি চিনল না তো, আমি মরলে সব না উড়িয়ে—পুড়িয়ে দেয়। আমার তো শত্তুরের অভাব নেই, আমি মরলে তারা এসে নানা শলাপরামর্শ দেবে, মাথায় হাত বুলিয়ে সব গাপ করে ফেলবে।
সব বাবারই এক রা। কথা কিছু নতুন নয়। কানাই খুব যত্নের সঙ্গে তার ছুপা বাবা আর প্রকট জ্যাঠার বাঁ পায়ের হাঁটু দাবাতে দাবাতে দার্শনিকের মতো বলল, অত ভাবেন কেন? কপালে যা আছে তা তো হবেই।
এ কথায় ভবেনের হাঁটু চমকে উঠল। ভবেন চোখ কপালে তুলে বলল, বলিস কী? একটা জীবন কম কষ্ট করেছি! বাপ তো রেখে গিয়েছিল লবডঙ্কা। না—খেয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই যে এতসব করলুম সে কি ভূতভুজ্যিতে যাবে নাকি?
এসব কথার জুতসই জবাব কানাইয়ের জানা নেই। সে বুঝল, ভবেন একটু সান্ত্বনা চাইছে, একটু বল—ভরসা। তোয়াজি কথা বললে কাজ হয় এ সময়ে। কিন্তু তার মাথায় আজ বোধহয় ভূতেই ভর করেছে। যা বলার কথা নয়, যেসব কথা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবে না, সেইসব কথাই যেন ভিতর থেকে অনিচ্ছেতেও ঠেলে বেরিয়ে আসছে। সে নির্বিকারভাবে বলে, তা ছেলেপুলে তো আরও আছে আপনার। তাদের ওপরেই ভরসা করে দেখুন না।
বাপ—পিতেমোর ভিটে কথাটা ভবেন শুনেও শোনেনি। কিন্তু এ কথাটা জায়গামতোই লাগল বোধহয়। ভবেন সোজা হয়ে বসে বলে, কী বললি কথাটা? অ্যাঁ! কী বললি রে হনুমান?
তটস্থ হয়ে কানাই বলে, কিছু ভুল বল্লুম নাকি বাবা?
ওই! ফের ওই বাপ—জ্যাঠায় গণ্ডগোল! মুখ ফসকে ‘বাবা’ ডাক বেরিয়ে গেছে। ভবেন নীচু হয়ে নিজের একপাটি চটি তুলে নিয়ে কটাস করে কানাইয়ের পিঠে বসিয়ে চাপা গর্জন করে ওঠে, যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! বেরো হারামজাদা, বেরো! আজই তোকে বরখাস্ত করলুম। ফের এ বাড়ির ছায়া মাড়ালে কেটে ফেলব। দূর হ সুমুখ থেকে।
পেট আর মুখের কথার তফাত রাখতে না জানলে মানুষের দুর্গতি হবেই। পেটে বাপ, আর মুখে জ্যাঠা বরাবর বজায় রাখতে পারলে টিকে থাকতে পারত। তা আর হল না। তার ওপর জুতোপেটাও খেতে হল। মনিবের জুতো খেলেও আঁতে লাগে, বাপের জুতো খেলেও আঁতে লাগে। তবে ভরসা এই যে, মনিবের জুতোয় যতটা আঁতে লাগে, বাপের জুতোয় ততটা নয়। মনকে এইটুকু বুজিয়ে সে বেরিয়ে এল।
মা শেফালী দাসীকে কথাটা বলতে চায়নি সে। কিন্তু ভবেনের বাড়ি হচ্ছে খোলা হাট। ঘটনাটা দু—চারজনের চোখে পড়েই থাকবে। তাই রটে যেতে দেরি হয়নি।
রাতে শেফালী বলল, হ্যাঁ রে, কর্তা নাকি তোকে জুতোপেটা করেছে?
না, তেমন জোরে মারেনি। ওই একবারই—তা লাগেনি তেমন।
তা তুই করেছিলি কী। কর্তার টাকাপয়সা সরাসনি তো!
আরে না না, ওসব নয়। খামোখা ফস করে চটে গেল।
বুড়োর ভীমরতি ধরেছে। সারাদিন জান চুঁইয়ে খাটছিস, ক পয়সা ঠেকায় তোকে? কাল গিয়ে বিষ ঝেড়ে দিয়ে আসবখন।
আরে না, ওসব করতে যেয়ো না।
তাহলে চটি দিয়ে মারবে?
আহা, বাপ বলেই ধরে নাও না কেন? তাহলে আর তত গায়ে লাগবে না।
বাপ তো সে বটেই, কিন্তু তা বলে অপমান করবে কোন মুখে?
কথাটা চাউর হল খুব। শুধু দেখা নয়, সেদিন বৈঠকখানায় যা কথাবার্তা হয়েছিল তা আড়ি পেতে শুনেছেও কেউ কেউ। কথাটা এমনভাবে রটল যে, কানাই ভবেনের কাছে সম্পত্তির ভাগ চেয়েছে ছেলে হিসেবে।
আড়ালে লোকে গা টেপাটেপি করে হাসছে আর ভবেনের বাড়িতে মেজাজ চড়ছে।
সন্ধেবেলা গিন্নিমা ডেকে পাঠাল।
কানাইয়ের তেমন ভয়ডর হচ্ছিল না। মাথা উঁচু করেই গিয়ে গিন্নিমার ঘরে ঢুকল। ভবেন বিশ্বেসের বউ রোগভোগা মানুষ। মুখ গম্ভীর, চোখে খর দৃষ্টি।
তার দিকে চেয়ে বলল, কী সব শুনছি?
কানাই হে�টমুণ্ডু হয়ে বলল, খারাপ কিছু বলিনি। কথাটা ঘুরিয়ে ধরেছে লোকে।
গিন্নিমা উঠে ঘরের দোর দিয়ে এল। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলল, কতটা কী জানিস বল তো।
আজ্ঞে, আমি আর কী জানব। কিছু জানি না।
ঢং করতে হবে না। কর্তার কীর্তি কিছু কম নেই। কিন্তু বলি, তোর এত সাহস হয় কী করে?
দাবিদাওয়া তুলেছিলি?
আজ্ঞে না।
তোর মা তোকে বুদ্ধি—পরামর্শ দেয়নি তো! ও বোকা মেয়েছেলে, সব করতে পারে।
না, আমার মা এর মধ্যে নেই।
আগেকার দিনের বড়োলোকদের ওরকম কত মেয়েছেলে থাকত। তা বলে তাদের ছেলেপুলেরা দাবিদাওয়া তুলবার মতো বুকের পাটা দেখায়নি।
তোকে কে বুদ্ধি দিচ্ছে বল তো!
আজ্ঞে ওসব ব্যাপার নয়।
ব্যাপার নয় মানে? তুই কোন সুবাদে সেদিন কর্তাকে বাবা বলে ডেকেছিলি?
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। অন্নদাদাও তো বাপের সমান।
এসবও তোকে কেউ শেখাচ্ছে। এই আমি বলে দিচ্ছি, মুখ থেকে আর কোনো বেফাঁস কথা বেরোলে কিন্তু কালু হাঁসুয়াকে খবর দিয়ে খুন করাব, বুঝেছিস?
কালু হাঁসুয়া ভাড়াটে খুনি, সবাই জানে। অন্য সময় হলে নামটা শুনে ভয় পেত কানাই। আজ যেন তবু ভয় হল না। শুধু বলল, বুঝেছি।
বিষয়—সম্পত্তির দিকে হাত বাড়ালে রক্ষে থাকবে না, এটা ভালো করে জেনে যা।
কানাই চুপচাপ চলে এল।
দু—দিন ধরে কাজকর্ম নেই। ঘরে বসে বসে মাজায় ব্যথা। তিনদিনের দিন সে একটু বেরোল। তালবাগানে কপিখেতের পাশে শীতের রোদে বসে বিড়ি ফুঁকছিল নিতাই। তাকে দেখে ডাকল, ওরে ইদিকে আয়। তোকে নিয়ে তো হুলুস্থুলুস কাণ্ড। বোস এখেনে।
তা বসল কানাই।
নিতাই বলল, নতুন কথা তো কিছু নয় রে। ওসব আমরা সেই কবে থেকেই জানি। বোকার মতো বলে ফেলে অমন চাকরিটা খোয়ালি। মুখ বুঝে থাকলে আখেরে লাভই হত। তেলকলের ম্যানেজার তপন, ট্র্যাক্টরের ড্রাইভার মদনা কেউ কী মুখ খুলেছে বল?
অবাক হয়ে কানাই বলে, তাদের আবার কী বৃত্তান্ত?
তোর যা ওদেরও তাই।
তার মানে?
তোর কী ধারণা তুই একা ভবেন বিশ্বেসের বে—আইনি ছেলে?
খুব হাসছিল নিতাই। কানাইয়ের তাতে গা জ্বলে গেল। বলল, প্রমাণ আছে?
সে কী তোরই আছে?
কানাই এই প্রথম ভবেন বিশ্বেসের ছেলে হিসেবে তেমন গৌরব আর বোধ করছিল না। বলল, না প্রমাণ নেই।
তবে? তপন আর মদনাও জানে তারা কোত্থেকে এসেছে। তবে রা কাড়ে না। তাতে সুবিধে একটাই। কর্তা তার এসব বে—আইনি ছেলেদের বিলিব্যবস্থা ঠিকই করে দেয়। তুই বাড়াবাড়ি করে ফেললি কিনা। চুপচাপ থাকলে দেখতিস পাকা বাড়ি হয়ে যেত, তলে তলে জমিজমাও করে দিত। কর্তা পাষণ্ড নয়। শত হলেও রক্তের সম্পর্ক তো!
কানাই একটু ভেবে দেখল, দুইয়ে দুইয়ে চারই বটে। তপন নামেমাত্র ম্যানেজার হলেও কুল্যে ছশো টাকা বেতন পায়। তা তারও পাকা বাড়ি হয়েছে গত বছর। মদনারও বাড়ি উঠছে গোয়ালপাড়ায়। ট্র্যাক্টর চালিয়ে সে হাজার টাকার বেশি পায় না। দুজনেই কানাইয়ের চেয়ে বড়ো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানাই উঠে পড়ল। মনটা বড্ড তেতো হয়ে গেল তার। সে ওদের মতো নয়। আদায় উশুলের পথে যায়নি কখনো। তার শুধু এই ভেবেই সুখ ছিল যে, আসলে সে ভবেন বিশ্বেসের ছেলে। সেই সুখটা হঠাৎ চড়াই পাখির মতো ফুরুত করে উড়ে গেছে কোথায় যেন।
তিনদিন বাদে মুনশির হাটে মহাদেবের কাজে লেগে পড়ল কানাই। মহাদেব সোজাসাপটা মানুষ। প্রথম হাজার টাকা মাইনে, কাজ পছন্দ হলে তিন মাস পর থেকে দু হাজার। আরও কাজ দেখাতে পারলে বেতন যে আরও বাড়ানো হবে সেটাও সাফ জানিয়ে দিল মহাদেব।
কাজের ধরন একই রকম। কানাইয়ের কাছে কাজ একটা নেশার মতো। খাটতে তার ভালোই লাগে। কাজ দেখে মহাদেবও খুশি। পাঁচটা কারবারে তার মেলা টাকা খাটছে। আর এ কথাও সত্যি যে মহাদেব ভবেনের চেয়েও বড়োলোক।
দিনরাত কোথা দিয়ে উড়ে যেতে লাগল তা ভালো করে টেরও পেল না কানাই। বছরখানেক বাদে মহাদেব একদিন তাকে ডেকে বলল, তোমার কাজ দেখে খুশি হয়েছি বাবা। এখন থেকে তিন হাজার করেই পাবে। পুজোয় পার্বণী, জামাটা—কাপড়টা— এসব নিয়ে ভেব না।
কানাই ওসব নিয়ে ভাবে না। কাজে ডুবে থাকে। কালেভদ্রে গাঁয়ে গিয়ে চুপি চুপি মাকে দেখে আসে। তার বোকাসোকা মা পেটের দায়েই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক যে ভুলটা করেছিল তার জন্য আজকাল তার দুঃখই হয়। তার মনের মধ্যে এখন আর ভবেনকে নিয়ে বাপ—জ্যাঠার দ্বন্দ্ব নেই। সে ভবেনের কথা আর ভাবে না।
মহাদেবের ঠান্ডা লেগে জ্বর হওয়ায় একদিন সকালে তার গদি সামালাচ্ছিল কানাই। মহাদেবের কর্মচারীরা এখন তারই তদারকিতে থাকে। কাজও মেলা।
বেলা দশটা নাগাদ একন বুড়ো রোগা মানুষ লাঠিতে ভর দিয়ে এসে গদিতে ঢুকল।
কানাই প্রথমে গ্রাহ্য করেনি। লোক তো মেলাই আসে।
লোকটা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে।
কাকে খুঁজছেন? মহাদেববাবুর জ্বর, আজ আসেননি।
তোমাকেই খুঁজছি বাবা। আমি ভবেন বিশ্বেস। তোমার বাবা।
কানাই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বসুন।
ভবেনকে চেনাই যায় না। বছরখানেকের মধ্যেই বুড়িয়ে খুনখুনে হয়ে গেছে। বসে একটু হাঁফ ছেড়ে বলল, নানা ব্যাধিতে শরীরটা শেষ হয়ে গেছে। তার ওপর মনের কষ্ট। বড়ো ছেলে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেছে বউ নিয়ে। মেজো জন মায়ের গয়না চুরি করে বোম্বাই না কোথায় পালিয়ে গেছে। সেজো ব্যাবসা করতে গিয়ে পথে বসেছে। ছোটোটাও শুনছি মদটদ খায়। আমার অবস্থা বড়ো খারাপ।
খুব মন দিয়ে শুনল কানাই। তারপর বলল, তা এখন কী করবেন?
বিষয়সম্পত্তি যে যায় বাবা কানাই। চারদিকে ষড়যন্ত্র। চারদিক থেকে নানা ফন্দিফিকির নিয়ে লোক আসছে। শুনি, তুই মহাদেবের কাজকারবার নাকি ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে তুলেছিস। সবাই তোর সুখ্যাতি করে। তা বাবা, আমাকে রক্ষে কর। এসে বিষয়সম্পত্তি সামাল দে। যা চাস দেব। শত হলেও তুই তো আমারই সন্তান।
কানাই একটু হাসল। বলল, একসময়ে আমারও কথাটা ভেবে খুব অহংকার হত। কিন্তু আজ আর হচ্ছে না কর্তাবাবু।
ভুলভ্রান্তি যা হয়েছে, মাপ করে দে। সত্যিই বলছি তোকে, ওরা আর আমার কেউ নয়। ফিরেও তাকায় না। আজ ভাবি অবৈধ ছেলে হলেও তোর বরং একটু মায়াদয়া ছিল। বড্ড ভুল করে ফেলেছি বাবা।
কিন্তু আজ যে আর আপনাকে আমার বাবা বলে মনে হয় না কর্তাবাবু! একদিন এমন ছিল, আপনাকে বাবা বলে ডাকার জন্য প্রাণ আনচান করত। আজ যে সেই ইচ্ছেটা মরে গেছে।
না হয় না—ই ডাকবি? তবু ফিরে চল। মহাদেব যা দেয় তার চেয়ে আমি দু—চার হাজার বেশিই দেব।
বিষয় সম্পত্তির ভাগ দেবেন?
আইনে তো তা মানবে না, তবে পুষিয়ে দেব।
কানাই খুব হাসল, আপনার আইনের ছেলেরা যেমনই হোক, বাপকে যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, বিষয় তারাই পাবে। আর এই আমরা যারা আপনাদের মতো লোকের কামকামনার অবৈধ সন্তান, যত ভালোই হই আমাদের কপালে ঢুঢু। দুনিয়াটা ভারী মজার জায়গা মশাই।
দুটো কাঁচা গালাগালও যদি দিস তো দে। বড্ড আতান্তরে পড়ে এসেছি রে বাবা, রক্ষে কর।
আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন জানেন?
জানব না কেন? তোর সাহায্য চাইতেই আসা।
সে তো ঠিকই। পয়সা ছড়ালে ম্যানেজার আপনি অনেক পাবেন। কিন্তু কানাই দাসের মতো এমন বশংবদ পাবেন না। আপনি ভালোই জানেন, কানাই আপনার অবৈধ সন্তান, সে আপনাকে বাবা বলে ভাবত, আপনার বিষয়সম্পত্তি রক্ষা করতে দিনরাত বেগার খাটত, নামমাত্র মাইনে পেত, তবু অন্য কোথাও যেতে চাইত না। তাকে তাড়িয়ে ভুল করেছিলেন বটে। সেটা বুঝতে একটু দেরিও করে ফেলেছেন। আজ আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন।
কেন জানেন?
কেন?
আপনার বিশ্বাস কানাই গিয়ে ফের বুক দিয়ে সব আগলাবে। বিষয়সম্পত্তি রক্ষা করবে যতদিন না আপনার বৈধ সন্তানেরা এসে ভার নিচ্ছে। ঠিক বলছি তো কর্তাবাবু?
না, না, ওরকম ভাবিসনি।
কর্তাবাবু, একসময়ে কানাইয়ের আপনার মতো একজন বাবার দরকার ছিল।
আজ আর নেই।
ভবেন স্তূপাকার হয়ে বসে রইল।
__