জন্তু ছবির চিত্রনাট্য
‘কি ধরনের গল্প চান?’
প্রশ্ন করে আমি চায়ে চুমুক দিলুম। আমার উলটোদিকে ছবির প্রডিউসার আর তরুণ ডিরেকটার। প্রডিউসার ভদ্রলোক-এর আগে কোনও ছবি প্রডিউস করেননি। হিমঘরের মালিক। কোনও জেলায় মনে হয় গোটা দুই কোল্ডস্টোর আছে। আলু ঢুকিয়ে চেপে রেখে, অচল আলুকে সচল রেখে, আট আনার মালকে তিন টাকায় তুলতে সাহায্য করে, নিজের চেহারাটাকে বেশ রাঙা আলুর মতো করে ফেলেছেন। অঢেল পয়সা হয়েছে। সেই কাঁচা টাকা এখন ছায়াছবিতে লাগাতে চান। এতকাল আকাশে ছিল আলু, এইবার সেই আকাশ তারকাখচিত হবে। হিরো, হিরোইনদের সঙ্গে একটু গা ঘষাঘষি হবে।
প্রডিউসারের কথার এখনও আড় ভাঙেনি। বেশ ‘স’-এর দোষ আছে। ঠোঁটে সিগারেট। ইংরেজি ছবির নায়কের মতো বাঁকা করে ধরা। বললেন, ‘এমন একটা মাল ছাড়ুন, যা আগে কেউ ছাড়েনি।’
‘সবই তো ছেড়ে বসে আছে। অবশ্য আপনার লাইনটা এখনও খোলা আছে। আলুর লাইনে কেউ কাজ করেনি।’
‘আলু! আলুর বিষয়ে ছবি! কী যে বলেন আপনি! আলুতো এগ্রিকালচার!’
‘আরে মশাই, এগ্রিকালচারই তো আমাদের আসল কালচার। পার্ল বাকের নাম শুনেছেন? তিনি গুড আর্থ বলে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই সিনেমা হয়েছিল। সে এক অসাধারণ ছবি। সেও ওই জমি, কৃষি।’
‘তাহলে ওইটা ঝেড়ে একটা নামান না।’
‘দুভাগে করতে হবে। ছ-ঘণ্টার বই। রাজকাপুরের মেরা নাম জোকারের মতো।’
‘ছ-ঘণ্টা! তাহলে থাক।’
‘আলু কিন্তু ভালো সাবজেক্ট। আপনি হবেন ভিলেন। গল্পটা এইরকম হবে, এক কৃষক আর কৃষক বধূ। সবে তাদের বিয়ে হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে। কৃষক যুবকটি ভালো গান গায়। ধরুন প্লে ব্যাক কিশোরকুমার। যুবকটি গ্রামের জলসায় গান গেয়ে মেয়েটির হৃদয় জয় করে নিয়েছে। দু-জনের আড়ালে-আবডালে দেখা হয়। ছেলেটি গায়। মেয়েটি গায়। মেয়েটির প্লেব্যাক লতা মঙ্গেশকর।’
‘না না, আশা ভোঁশলে।’
‘বেশ, তাই হোক। দুজনের মেলামেশা নিয়ে গ্রামে দক্ষযজ্ঞ। এক জমিদারের ছেলের নজর ছিল মেয়েটির দিকে। সে তার লোকলস্কর লাগিয়ে মেয়েটাকে একদিন বেলা শেষের মাঠ থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে।’
ডিরেকটার ছেলেটি বললে, ‘এখন তো জমিদার নেই।’
‘জমিদারের বদলে জোতদার। আজকালকার প্রগতিশীল নাটকে জোতদার থাকবেই। মনে আছে—অজিতেশবাবু কীরকম অভিনয় করতেন জোতদারের ভূমিকায়। জমিদার নেই তো কি হয়েছে, জোতদারের তো ছড়াছড়ি। এই দৃশ্যে আমরা পনেরো মিনিটের একটা রেপ সিন ঢুকিয়ে দি। তাহলে প্রথম আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা গোটা তিনেক গান, গোটা চারেকও হতে পারে, ইচ্ছে করলে এক রাউন্ড নাচ আর একটা বেশ জমাটি নাচসমেত রেপ স্যাটা-স্যাট ঢুকিয়ে দর্শকদের একেবারে চেয়ারের সঙ্গে পেরেক মারা করে ফেলব।’
প্রডিউসার ভদ্রলোক, সিগারেটে একটা বোম্বাই টান মেরে বললেন, ‘আমার তো মশাই শুনেই মনে হচ্ছে, জমে উঠেছে।’
‘এসব কাহিনির মার নেই। এর বাপ জমবে। ভালো রান্নার যেমন মশলা থাকে, ভালো কাহিনিরও যুগ যুগ ধরে পরীক্ষিত কিছু মশলা আছে। বিরিয়ানির মতো। সাজিরে, সামরিচ, জায়ফল, জৈত্রি। জমি মানে মাটি, মেয়েছেলে, প্রেম, কামনা, শক্তি আর ব্যভিচার, এযে কি মশলা, একেবারে মুর্গমসল্লম, আর কোন কলাপাতায় পরিবেশন করা হচ্ছে? গ্রামীণ সংস্কৃতির কলাপাতের একেবারে ফেটে ফ্রাকচার হয়ে যাবে?’
প্রডিউসার বললেন, ‘তারপর, তারপর!’
‘তারপর মনে করুন ভোর হচ্ছে। আকাশ লাল। এই জায়গায় একটু ক্যামেরার কেরামতি দেখাতে পারেন। দুটো পৃথিবীর তুলনা পাশাপাশি রাখতে পারেন। পবিত্র আর অপবিত্র। গোমুখসে প্রবাহিত গঙ্গা। গোমুখী থেকে গঙ্গা নেমে আসছে। ঋষিরা সব সামগান করছেন।’
‘এখন তো আর ঋষি নেই!’
‘কে বলেছে আপনাকে! ঋষিদের জায়গায় ঋষিরা ঠিকই আছেন। এদিকে জোতদার যেমন বাড়ছে ওদিকে ঋষিরাও তেমনি বাড়ছেন। পাপ আর পুণ্যের মধ্যে সবসময় একটা ব্যালেন্স থাকবেই। এরপর লছমনঝোলা অলকানন্দা হয়ে হরিদ্বার। হরিদ্বারে সম্প্রতি যে কুম্ভ হয়ে গেল তার দৃশ্য, স্টকশট কিছুটা জুড়ে, বেনারস হয়ে, সোজা আমাদের গ্রামে। ভোর পুণ্যের পৃথিবীতেও হচ্ছে, ভোর পাপের পৃথিবীতেও হচ্ছে। গ্রামে এসেই ক্যামেরা প্রথমে চার্জ করছে একটা টলটলে পুকুরে। সত্যজিৎ বাবুর পথের পাঁচালি সবসময় স্মরণে রাখবেন। অমর। সেই আদর্শে পুকুর। পুকুরে পদ্ম।’
‘পদ্ম কি থাকে? আমি তো কচুরিপানা ছাড়া কিছুই দেখি না।
‘ধ্যার মশাই, সে তো হল গিয়ে বাস্তবের পুকুর। সিনেমার পুকুরে পদ্ম ছাড়া কিছুই থাকে না। সেই পদ্মে ভোরের আলো। এই জায়গায় জলতরঙ্গ। একটা জল ফড়িং কুচিপুডি ড্যান্স করছে, পিড়িং, পাড়াং আর জলতরঙ্গ বাজছে। ওপাশে এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে একটা বক। এটা হল প্রতীক। পুকুর, পদ্ম, ফড়িং, জলতরঙ্গ হল পুণ্যের প্রতীক আর বক হল পাপ। বক হল জোতদার। পুণ্যের জীবনকে তছনছ করার জন্যে বসে আছে এক ঠ্যাঙে। ধৈর্য ধরে। দু-একটা প্রতীকী, দৃশ্য থাকলে অ্যাওয়ার্ড পাওয়া সহজ হয়। শুধু বক্স অফিস দেখলে হয়! পুরস্কার-টুরস্কারের কথা ভাবতে হবে না?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো ঠিক, সে তো ঠিক।’
‘এইবার কেবল কাট, কাট, কাট।’
‘সে আবার কি?’ ডিরেকটারের অবাক প্রশ্ন।
সে কি, ছবি করতে নেমেছেন, কাট জানেন না। পুকুর, পদ্ম, ফড়িং, জলতরঙ্গ। কাট। ক্যামেরা সরে গেল। এক ঠ্যাঙে দাঁড়ানো বকের ক্লোজ আপ! কটা। বকটা পুকুর থেকে একটা মাছ খপাং করে তুলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। ক্যামেরা বকটার উড়ে যাওয়া বকের চোখে দেখাচ্ছে।’
ডিরেকটার ছোকরা উৎসাহিত হয়ে নড়েচড়ে বসলেন, ‘সেটা কি জিনিস?’
‘সেটা হল, বকটি মাছ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে তো, তার চোখটা কোথায়? নীচের দিকে। প্লেন যখন খুব নীচু দিয়ে উড়ে যায়, আর আমরা যদি জানালা দিয়ে নীচের দিকে তাকাই, দেখব, মাঠ ঘাট, পুকুর নদী সব পেছন দিকে সরে যাচ্ছে। আপনি করবেন কি ক্যামেরাটাকে উঁচুতে ঝুলিয়ে’ বক যেদিকে গেল সেদিকে এগিয়ে যাবেন। ঝোপঝাড় গাছপালা, সাঁই-সাঁই, পেছন দিকে ছুটছে। হঠাৎ!’
ডিরেকটার বললে, ‘হঠাৎ! হঠাৎটা কি?’
‘হঠাৎ ক্যামেরার চোখে পড়ল ঘাস ঢাকা জলাতে সাদা মতো কি একটা পড়ে আছে। ক্যামেরা থেমে পড়ল। ক্যামেরা এইবার ধীরে-ধীরে নেমে আসছে সেই সাদা বস্তুটির দিকে। একটি মেয়ের দেহ। মুখ। ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি জড়ানো ক্ষতবিক্ষত একটি দেহ।’
‘খুন?’
‘না না, খুন করলে তো হয়েই গেল। খুন নয়। জোতদারের ছেলে সেই মেয়েটার ওপর সারারাত অত্যাচার করে ভোরে ফেলে দিয়ে গেছে। এই জায়গায় আমাদের দারুণ স্কোপ। যুবতীর অর্ধনগ্ন দেহ নানাভাবে দেখানোর সুযোগ আমরা ছাড়ব কেন?’
প্রডিউসার ভদ্রলোক মহোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘মার কাটারি। তারপর?’
‘ক্যামেরার চোখ ওই দৃশ্য কিছুক্ষণ দেখিয়েই, কাট। কাট করে চলে গেল গ্রামের পথে। এইবার বলুন তো, সকালবেলা সিনেমার গ্রামের পথে কি থাকবেই থাকবে?’
‘গরু।’
‘হল না। বাউল। বাউল ছাড়া গ্রামের পথ হয়! বুঁই-বুঁই করে একতারা বাজাতে বাজাতে নেচে-নেচে আসছে বাউল। মাঝে-মাঝে গাইছে, ‘বিধি, তুমি বিচার করলে না।’ বুঁই-বুঁই। বাউল আসছে। আর জানবেন, যাত্রায় বিবেক আর সিনেমার বাউলের এক ভূমিকা। সেই বাউল নাচতে-নাচতে গাইতে-গাইতে, বুঁই-বুঁই করতে, স্পটে, যেখানে অচৈতন্য ধর্ষিতা মেয়েটি পড়ে আছে।
বাউল মেয়েটির মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকবে। মুখটা একবার ভারতবর্ষের ম্যাপ হবে, একবার মুখ হবে। ম্যাপ মুখ, মুখ ম্যাপ, ম্যাপ মুখ, মুখ ম্যাপ।’
‘এর মানে?’
‘হায় ভগবান! সিনেমা করতে এসেছেন, সিনেমার প্রতীকী ভাষা বোঝেন না! ভারতমাতা এইভাবে ধর্ষিতা হচ্ছেন আজ। বাউল দেখবে না মেয়েটি বেঁচে আছে না মরে গেছে। সে আগে ঘুরে-ঘুরে দুলে-দুলে নাচবে আর গাইবে।’
দেখলাম এ সংসারে ভোজবাজীর প্রকার!
দেখতে-দেখতে ওমনি কেবা কোথায় যায়।
মিছে এ ঘরবাড়ি মিছে দৌড়াদৌড়ি করি কার মায়ায়।
তারপর সে মেয়েটির জ্ঞান ফেরাবে। কাট।
‘এইখানে কাট করবেন?’
‘হ্যাঁ, কাট করেই, পরের দৃশ্য। মেয়েটির প্রেমিক ছুটে আসছে। সে ডাকছে, তারা, তারা। ইকোতে শোনাচ্ছে, তারা আ, তারা আ আ আ। সে পাগলের মতো ছুটে আসছে। এই জায়গায় ট্রিকশট। ছেলেটিকে বিশাল বড় দৈত্যের মতো দেখাবে। ঘাসপাতা, ডালপালা থেঁতলে যাচ্ছে পায়ের চাপে। পাখি উড়ে পালাচ্ছে। কাঠবেড়ালি পিড়িক-পিড়িক করে ছুটছে। আতঙ্কে ত্রাসে।’
‘এইরকম কেন হবে?’
‘এইটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ। বোঝানো হচ্ছে, প্রেমের শক্তি পীড়নকারীকে একদিন ফেঁড়ে ফেলবে। ঘৃণার পৃথিবী, নিষ্ঠুর পৃথিবীকে পিষে ফেলবে একদিন। কাট। কাট করেই ক্যামেরা ধরছে একটা লরি। আলু বোঝাই লরি হাইওয়ে ধরে চলেছে। লরির পেছনে লেখা, বুরি নজর বালে তেরা মু কালা। লরি যাচ্ছে, যাচ্ছে। কোল্ড স্টোরেজ। সেই জোতদারের ছেলেটা অফিসে বসে, হ্যা -হ্যা করে হাসছে। কৌটো খুলে মুখে মশলা ফেলছে। কাট। প্রেমিক একটা ঠেলা গাড়িতে তার প্রেমিকাকে শুইয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলেছে শহরের হাসপাতালে। পেছনে-পেছনে ছুটতে ছুটতে আসছে একটি বাচ্চা ছেলে। ছেলেটি হল মেয়েটির ভাই।’
প্রডিউসার বললেন, ঠিক আছে। আপনি লিখে ফেলুন। শেষটা কি করবেন?’
‘আপনি শেষের কথা ভাবছেন। ছবি তো এখনও শুরুই হল না। মেয়েটি পাগল হয়ে যাবে। ছেলেটি মেয়েটিকে ভালো করবে।’
‘কীভাবে?’
‘গান শুনিয়ে। পরপর গান শোনাবে। গীত, গজল, রাগ প্রধান, পল্লীগীতি, শেষে দেশাত্ববোধক। মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হল বলিদান। মেয়েটি ভালো হবে, কিন্তু তার চরিত্র পালটে যাবে। হয়ে যাবে টেররিস্ট। একের পর এক যত পাপের ঘাঁটি আছে সব উচ্ছেদ করতে থাকবে। ছেলেটাও হয়ে যাবে টেররিস্ট। আর প্রেমের প্যানপ্যানানি নয়, পুরোপুরি ইংরিজি ছবি। গ্রামের পর গ্রাম দখল করে আদর্শ একটা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। এইবার নায়কে ভিলেনে লড়াই। ভিলেনের কোল্ড স্টোরেজে আগুন লাগিয়ে দেবে জনতা। ওরা গুলি চালাবে, এরা চালাবে তীর। ওরা ছুড়বে বোমা, এরা ছুড়বে আলু। শেষে ভিলেন পাহাড় প্রমাণ আলু চাপা পড়ে মারা যাবে।’
‘আলু চাপা পড়ে?’
‘হ্যাঁ, আজ পর্যন্ত কোনও সিনেমায় কোল্ড স্টোরের ভেতর লড়াই হয়নি। পাহাড়ে হয়েছে। ছাদে হয়েছে। ছাদের কার্নিশে হয়েছে। গুদমে টিনের ব্যারেলের ফাঁকে- ফাঁকে হয়েছে। মদের পিপের আড়ালে লুকোচুরি খেলতে-খেলতে হয়েছে, কারখানার যন্ত্রপাতির মধ্যে হয়েছে, জাহাজের ইঞ্জিন ঘরের মধ্যে হয়েছে। হয়নি জ্বলন্ত হিমঘরে। নায়কে ভিলেনে হিমঘরে লড়াই চলছে, হঠাৎ চারপাশ থেকে আলুর র্যাক ভেঙে পড়ল। পোড়া আলু চাপা পড়ে ভিলেন আলু পোড়া। তাকে উদ্ধার করা হল। সারাগায়ে আলুর মতো বড়-বড় ফোস্কা। তাকে রাখা হল খাঁচায়। খাঁচার গায়ে নোটিশ, জন্তু। সেই খাঁচার বাইরে, নায়ক আর নায়িকা তাকে দেখিয়ে-দেখিয়ে প্রেম করছে, নায়ক বাঁশি বাজাচ্ছে। আর চারদিক থেকে ছুটে আসছে মালা হাতে গ্রামবাসীরা। দুজনের বিয়ে দিয়ে ছবি শেষ। বিয়ের ভোজ, টন-টন আলু পোড়া। ছাড়াচ্ছে, নুন মাখাচ্ছে আর টপাটপ মুখে পুরছে।’
‘দারুণ, দারুণ।’
‘তাহলে পাঁচ হাজার অ্যাডভান্স করুন। পরে দশ হাজার।’
‘কী যে বলেন! বাংলা ছবির কাহিনিকারকে কেউ টাকা দেয় না কি? দোব বলে, ঝুলিয়ে রাখে। আপনি লিখে ফেলুন। পাঁচ হাজার এক টাকার, এক টাকাটা রাখুন।’