1 of 2

জনৈক কাপুরুষের কাহিনী – প্রেমেন্দ্র মিত্র

জনৈক কাপুরুষের কাহিনী
প্রেমেন্দ্র মিত্র

সকালবেলা করুণা নিজ হাতে চা নিয়ে এলো।

চায়ের আনুষঙ্গিকের বহর দেখে না হেসে পারলাম না, বললাম—”তোমাদের এদেশী জলহাওয়া ভালো হতে পারে, কিন্তু আমার জীর্ণ করবার ক্ষমতাটা এখনো স্বদেশী আছে—এই দুদিনে তার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।”

উত্তরে শুধু একটু হেসে প্লেটগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে করুণা চলে যাবার উপক্রম করতে আবার ডেকে বললাম-”তুমি কি আমার সঙ্গে লৌকিকতা শুরু করে দিলে নাকি? বিমলবাবু লৌকিকতা করলে নাহয় বুঝতাম, কিন্তু-”কথার মাঝখানেই করুণা বললে—”বিমলবাবুর হয়েই যদি করি— দোষ আছে কি?”–তারপর হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

চায়ের পেয়ালা সামনে ঠাণ্ডা হতে লাগলো। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।

না, করুণার ব্যবহারটা মোটেই ভালো লাগছে না, একথা নিজের মনের কাছেও স্বীকার করতে আর বাধা নেই।

করুণা নাটকীয় একটা কিছু করে বসবে তা অবশ্য আশা করিনি। আশা কেন, সেটা রীতিমতো আশঙ্কার বিষয়ই ছিলো। গোড়ায় তার সহজ স্বাভাবিকতায় তাই বুঝি আশ্বস্তই বোধ করেছি। কিন্তু মনের কোনো গোপন কোণে আহত অহংকার তারপর ধীরে ধীরে সাড়া দিতে শুরু করেছে। মনে হয়েছে, এতটা হবার বুঝি দরকার ছিলো না। সূর্য অস্ত গেছে যা কিন্তু তার বিলম্বিত রঙ পশ্চিমের মেঘে একটু লেগে থাকলে ক্ষতি কি ছিল!

নাটকীয় না হয়ে করুণা অতিমাত্রায় কঠিন ও সংযত হয়ে উঠলে বুঝি সবচেয়ে খুশি হতাম। ধরা দেবার ভয়ে তার সেই সযত্ন সাবধানতায় আমার আত্মাভিমান সবচেয়ে বোধহয় তৃপ্ত হত।

কিন্তু করুণা নাটকীয় উচ্ছাস বা কঠিন ঔদাসীন্য—দুই-এর কোনো দিক দিয়েই গেলো না।

তাতে আমার কিছু আসে যায় না, অনায়াসে এই কথাই ভাবতে পারতাম। এবং তাই ভাবাই ছিলো উচিত। সত্যি করুণার সঙ্গে দেখা হবার কোনো আশা বা আকাঙ্ক্ষা আমার তো ছিলো না। তার সঙ্গে দেখা হবার কথাও নয়। বিশাল পৃথিবীর জনতায়। এমন নিশ্চিহ্ন হয়ে আমরা হারিয়ে গেছিলাম যে কোনো দিন আবার পরপ্রকে খুঁজে পাওয়াই ছিলো অভাবিত।

কিন্তু সেই অভাবিত ব্যাপার যখন ঘটলো তখন দেখলাম, করুণাকে অনায়াসে ভুলে গেছি যখন মনে করেছি তখনও সে আমায় ভুলতে পারে না—মনের এ গোপন গর্বটুকু ত্যাগ করতে পারিনি।

এ রকম একটা গর্ব থাকা খুব অস্বাভাবিক বোধহয় নয়।

সে-সব দিনের কথা একেবারে ভোলা তো যায় না! বিশেষ করে সেই একটি বিকেল। সারাদিন বাইরে অবিশ্রান্তভাবেই বৃষ্টি পড়েছে, ইচ্ছে থাকলেও কোথাও আর বার হওয়া হয়নি। বিকেলে চাকর এসে খবর দিলে একটি মেয়ে দেখা করতে এসেছে।

এই হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে একটি মেয়ে। প্রথমটা সত্যিই একটু বিমূঢ় হয়ে গেছিলাম। চাকরের সঙ্গে করুণা যখন ঘরে এসে ঢুকলো তখনও আমার মুখের বিস্ময় নিশ্চয় অত্যন্ত স্পষ্ট।

চাকর চলে যাবা পর করুণা কাছে এগিয়ে এসে বললে— “খুব আশ্চর্য হয়েছো না?”

“তা একটু হয়েছি, কিন্তু তুমি যে একেবারে ভিজে গেছে!”— আমি সত্যই ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।

করুণা কাছের একটা চেয়ারে বসে বললে— “বৃষ্টিতে বেরুলে ভিজতে হয়, তোমার ব্যস্ত হতে হবে না।”

তারপর হেসে উঠে বললে—”ব্যস্ত হয়ে করবেই বা কি! তোমাদের এ নারী বিবর্জিত রাজ্যে মেয়েদের পোশাক পাবে কোথায়? সখের থিয়েটার পার্টি তো নিশ্চয়ই তোমাদের নেই!”

একটু ভেবে বললাম—”ওপরে দশ নম্বরে একজনেরা আছেন— স্বামী-স্ত্রী!”

করুণা আবার আসলো—”তাঁদের কাছে শাড়ি ব্লাউজ চাইতে যাবে? কি বলে চাইবে?”

হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বললে—”তার চেয়ে ভিজে কাপড়েই আমি বেশ আছি। আমার অসুখ করবে না, ভয় নেই।”

অগত্যা তার পাশে গিয়ে বসলাম। আমি কোনো প্রশ্ন করবার আগেই সে আবার বললে—”ভাবছো, এমনভাবে এখানে আসার মানে কি? কেমন?”

এবারও কোনো উত্তর দিলাম না। করুণা খানিকক্ষণের জন্যে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মনে হলো। তারপর সম্পূর্ণ রূপান্তর। এই দুর্বার আবেগ সে এতক্ষণ জোর করে ধরে রেখেছিল বুঝলাম।।

একেবারে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে ব্যাকুল স্বরে বললো— “আমায় পাটনায় নিয়ে যাচ্ছে। মামা কাল চিঠি দিয়েছেন।”

বুঝতে কিছু পারলাম না এমন নয়। তবুও বেদনাময় সত্যটা যতক্ষণ সম্ভব অস্বীকার করে বললাম-”তোমাদের কলেজের তো ছুটি হচ্ছে?”

করুণা আরো ব্যাকুল স্বরে বললে—” না না, তা নয়। তুমি বুঝতে পারছে না। এখানে আমায় আর রাখবে না; এই যাওয়া আমার শেষ!”।

তার ঠাণ্ডা একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। হ্যাঁ, বেদনা সেদিন আমার হৃদয়েও ছিলো, কিন্তু করুণার উদ্বেল আবেগের তুলনায় সে বুঝি কিছু নয়! আমার ভালোবাসার মধ্যে সে উদ্দামতা ছিলো না যা ভাগ্যের বাধার বিরুদ্ধে উদ্ধত বিদ্রোহ করতে পারে।

কিন্তু করুণা খানিক বাদে অশ্রুসজল মুখ তুলে দৃঢ়স্বরে বললে—”আমি যাবো, কিছুতেই যাবো না। কেন যাবো?”

কি উত্তর একথার দেবো ভেবে পেলাম না। মনের গভীরতায় হয়তো সেইদিনই তার এ বিদ্রোহে আমার সায় ছিলো না। তখনই আমি জানতাম যে এ বিদ্রোহ নিষ্ফল।

কথাটা একটু ঘুরিয়ে দেবার ষ্টোয় বললাম-”তুমি যা মনে করছে তা তো নাও হতে পারে করুণা; তুমি হয়তো মিছিমিছি ভয় পাচ্ছো।”

করুণা আবার অস্থির হয়ে উঠলো—”না না, আমি জানি; জোর করে তাঁরা আমায় সেখানে বন্দী করে রাখতে চান। তাদের ধারণা এ-সব ছেলেমানুষী সারাবার তাই অব্যর্থ ওষুধ।”

করুণা একটু তিক্ত হাসি হাসলো।

তারপর বললে—”আমি কলেজে যাবার নাম করে বেরিয়ে এসেছি। এখানে এসে তোমায় অসুবিধায় ফেলবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু না এসে যে উপায় নেই, পিসিমার বাড়িতে তোমার যাওয়া তো প্রায় বন্ধ হয়েছে। সেখানে এসব কথা তোমায় জানাতেও পারতাম না।”

একটু থেমে করুণা আবার অস্থির হয়ে উঠলো আবেগে—”সত্যি কি আমায় নিয়ে যাবো জোর করে! কিছুই আমরা করতে পারবো না?”

সেদিন কি আশ্বাস, কি সান্ত্বনা দিয়ে করুণাকে তার পিসিমার বাড়ি রেখে এসেছিলাম, তার বিবরণের এখানে প্রয়োজন নেই, কিন্তু মনে যত বড়োই ব্যথা পেয়ে থাকি না, কিছুই তারপর করতে পারিনি এটা ঠিক।

করুণাকে তার মামারা জোর করে কিনা জানি না তারপর পাটনায় নিয়ে গেছে; যাবার আগে দেখা করবার সুযোগও মেলেনি আমাদের।

নিমন্ত্রিত অবশ্য হইনি, কিন্তু একদিন কোথা থেকে করুণার বিয়ে হয়ে যাওয়ার সংবাদও কানে এসেছে। নির্লিপ্ত নির্বিকার মনে সে-সংবাদ শুনেছি এমন কথা বলতে পারবো না, কিন্তু আজ বিশ্লেষণ করে দেখে বুঝতে পারি এসংবাদ পাবার পর কয়েকটি দিন ও রাত যে আমার কাছে হতাশায় ধূসর হয়ে গেছে, তা প্রধানতঃ করুণার দুঃখের কথা ভেবে। ভালোবেসে না পাওয়ার ব্যর্থতা সেদিন নিজের দিক দিয়ে নয়, করুণার দিক দিয়েই উপলব্ধি করেছি, এবং সেই উপলব্ধির বেদনায় নিজের

আত্মপ্রসাদ কিছু মেশানো ছিলো কিনা তা বোঝবার শক্তি তখন ছিলো না।

করুণার স্মৃতি যখন ম্লান হয়ে এসেছে তখনও মনের কোন গোপন কোণে এ বিশ্বাস বুঝি ছিলো যে, আমি ভুললেও সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না!

সে-বিশ্বাসে রূঢ় আঘাত পাওয়ার পরই মনের যে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া শুরু হলো তাতে নিজের কাছেই নিজে কেমন একটু লজ্জিত বোধ করলাম, কিন্তু তবু আত্মসংযম করতে পারলাম না।

করুণা খানিক বাদে যখন আমার ঘরে এলো তখন আমার আচরণে ও কথায় একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন চেষ্টা করলে হয়তো সেও লক্ষ্য করতে পারতো।

করুণা খাবার প্লেটটার দিকে চেয়ে বললে—”একি! কিছুই যে খাওনি!”

পাঞ্জাবির বোম আঁটতে আঁটতে তার দিকে ফিরে চাইলাম; একটু হেসে বললাম-”লৌকিকতার বদলে লৌকিকতাই করতে হয় যে, দুর্ভিক্ষপীড়িতের মতো cট সাফ করে ফেললে তুমি ভাবতে কি?”

“তুমি এখনো সেই এক কথা ধরে বসে আছো!”–করুণার স্বর একটু যেন ক্ষুণ্ণ।

“এক কথা ধরে বসে থাকা আমার একটা দুর্বলতা করুণা, এখনও এটা শোধরালো না।”—আমার স্বর বেশ গাঢ়।

করুণা অন্যদিকে ফিরে খাবার প্লেটটা সরিয়ে রাখছিলো, তার মুখ দেখতে পেলাম না। কিন্তু যে উত্তর সে দিলে তাতে সহজ কৌতুক ছাড়া আর কিছুই আভাস নেই।

“আর ঘ দুর্বলতা তাহলে শুধরে ফেলেছ!”—আমার দিকে ফিরে করুণা আবার বললে—”একি, এরই মধ্যে বেরুচ্ছো নাকি?”

“হাঁ, গাড়িটার কতদূর কি হলো একবার দেখতে তো হয়!”

“তুমি দেখলেই তো সেটা তাড়াতাড়ি মেরামত হয়ে যাবে না। উনি তো খোঁজ নিয়ে আসবেন বলেছেন। ওঁর ফিরতে আর দেরি নেই। তোমায় থাকতেই বলে গেছে।”

“সুতরাং ততক্ষণ তোমার সঙ্গে বসে গল্প করতে বলেছেন?”— হেসে বলবার চেষ্টা করলাম।

সকৌতুক মুখভঙ্গি করে করুণা বললে—”তা করতে পারো।”

আমার স্বর আপনা থেকে তখন বুঝি গাঢ় হয়ে এসেছে—”অনায়াসে বলে ফেললে যে করুণা!”

“এমন কি একটা কঠিন কথা সে অনায়াসে বলা যায় না?”করুণার মুখে একাধারে হাসি ও বিস্ময়।

“এমন কিছু কঠিন নয় করুণা? সত্যি বলছো? আমার সঙ্গে একা বসে গল্প করতে তোমার ভয় করে না? আমার যে নিজেকে এখনো ভয় করে।”

“তোমার মাথাটি বেশ খারাপ হয়েছে দেখছি।”–বলে হেসে আমায় বেশ একটু অপ্রস্তুত করে করুণা এবার বেরিয়ে গেলো। দরজার কাছ থেকে ফিরে আবার বললে—”তুমি কিন্তু যেও না, আমি এখুনি আসছি।”

কিন্তু অনেকক্ষণ করুণা তারপর আর আসে না। ঘরের ভেতর পায়চারি করে বেড়াতে বেড়াতে মনের মধ্যে কী একটা জ্বালা অনুভব করি। সেটা আমার নিজের না করুণার বিরুদ্ধে বোঝা শক্ত। হয়তো সেটা নিয়তির বিরুদ্ধে।

কী দরকার ছিলো এমন করে আবার তার সঙ্গে দেখা হবার! দেখা হওয়াটা দৈরে আয়োজিত পরিহাস ছাড়া আর কি?

ক-দিন ছুটি পেয়ে মোটরে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কাল রাত্রে এই শহরের মাঝখানে এসে যখন তার কল হঠাৎ বিগড়ে গেছিলো তখন জঙ্গলের পথে না হয়ে একটা ভদ্রগোছের শহরের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদই দিয়েছিলাম। ভবিষ্যতটা তখন জানতে পারলে বোধহয় জঙ্গলের পথটাই শ্রেয়ঃ মনে করতাম।

একে রাত্রিকাল, তায় অচেনা শহর। ডাকবাংলো ও স্টেশনের ওয়েটিংরুম থেকে দরিদ্রতম হোটেলে পর্যন্ত টাঙ্গা করে ঘুরে আশ্রয় না পেয়ে শেষে, যে কারখানাতে মোটর মেরামত করতে দিয়েছিলাম, সেখানেই ফিরে গেছিলাম হতাশ হয়ে। সেখানেই বিমলবাবুর সঙ্গে পরিচয়। কাছাকাছি একটা কয়লার খনিতে তিনি কাজ করেন। সেখানকার কি প্রয়োজনে একারখানায় এসেছিলেন। প্রবাসে বিপন্ন বাঙালীর সাহায্যে তিনি নিজে থেকেই অগ্রসর হয়ে তার বাড়িতে রাত্রি কাটাবার প্রস্তাব করেছিলেন। সামান্য একটু আপত্তি হয়তো করেছিলাম, কিন্তু তিনি তা শোনেননি।

শহরের নির্জন এক প্রান্তে বিমলবাবুর বাড়ি। সেখানে পৌঁছে দেখা গেছিলো সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। দরজার কড়া নাড়তে নাড়তে বিমলবাবু বলেছিলেন–“আজ আমার আবার কথা ছিল ন কিনা! চাকর ব্যাটারা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে!”

খানিকক্ষণ পরে একটি মহিলাই লণ্ঠন হাতে এসে বাইরের দরজা খুলে নিদ্রাজড়িত স্বরে বলেছিলেন—”বড় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তুমি যে বলে গেছিলে আজ আসবে না!”

বিমলবাবু হেসে বলেছিলেন—”ব্বাতে একটা পরোপকারের পুণ্য ছিলো, তাই বোধহয় আসার সুবিধে হয়ে গেল। আমি না এলে এই ভদ্রলোক একটু বিপদেই পড়তেন বোধহয় অজানা শহরে!”

করুণা এইবার আমায় দেখতে পেয়েছিল। মাথায় ঘোমটা দিয়ে সরে যেতে গিয়ে হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

বিমলবাবু তখনও বলে চলেছেন—”তুমি চাকরগুলোকে ডেকে দাও, বাইরের ঘরটা খুলে একটা বিছানা ঠিক করে দিক। ভদ্রলোকের একটু কষ্ট হবে–”

হঠাৎ তাকে করুণার কথায় সবিস্ময়ে থেমে যেতে হয়েছে। করুণা হেসে বলেছে–“বিদেশ-বিভূঁয়ে একটু কষ্ট হলেই বা ভদ্রলোকের!”

বিমলবাবু অবাক হয়ে আমাদের দুজনের মুখের দিকে চেঁচিয়ে ওঠেন—”তার মানে! এঁকে তুমি চেনো নাকি!”

“তা একটু চিনি বৈকি!”— করুণা হেসে উঠেছে।

“কী আশ্চর্য!”

“আশ্চর্যটা কিরে! তোমার অচেনা বলে আমার চেনা হতে নেই! তোমরা সঙ্গে তো মাত্র তিন বছর বিয়ে হয়েছে, তার আগে কুড়ি বছর আমি সলিটারি সেলে ছিলাম মনে করো!”

বিমলবাবু হেসে ফেলে বলেছেন—”কিন্তু ভদ্রলোককে বাইরে ঠাণ্ডায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের দাম্পত্য জীবনের নমুনাটা নাই দেখালে।”

করুণা গম্ভীর হবার ভান করে বলেছে—”ও আমি শুধু ঝগড়া করি এই তুমি বোঝাতে চাও!”

এবার একটা কিছু বলা উচিত বলেই হাদারচেষ্টা করে কথা বলেছি—”ব্যবসাই পেশা বিমলবাবু, নমুনা দেখে আমি ভুলি না।”

এতদিন বাদে করুণার প্রথম আলাপের ধরনে তখনই মনে কোথায় আমার একটা খটকা লেগেছে।

.

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন নিজেই বেরিয়ে পড়বে কি না ভাবছি তখন রুশা এলো। সাজ-পোশাকের পরিবর্তন দেখে যা বলতে যাচ্ছিলাম নিজে থেকেই তার উত্তর দিয়ে সে বললে—”একটু বাইরে যেতে হবে। আসবে আমার সঙ্গে?”

চাদরটা আলনা থেকে তুলে নিয়ে বললাম—”শুধু আদেশের অপেক্ষা। কিন্তু কোথায় যাচ্ছো?”

“বাজার করতে।”–বলে করুণা হাসলে।

“বাজার করতে।”—অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

“আমি তো প্রায়ই যাই।” সে হেসে বললে—”এখানে ‘চেঞ্জার’ ছাড়া বাসিন্দাদের মেয়েরা বড়ো একটা নিজেরা বাজারে যান না বটে, কিন্তু আমি ও-সব মানি না; উনি না থাকলে আমি নিজেই চাকর নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।”

“কিন্তু বিমলবাবু তো আজ আছেন!”

“ও, তোমায় বুঝি বলা হয়নি! উনি খবর পাঠিয়েছেন আজ আসতে পারবেন না, হঠাৎ বিশেষ জরুরি কাজে আটকে পড়েছেন।”

করুণা বেশ সহজভাবেই কথাটা বলে গেলো। কিন্তু আমি রাস্তার মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম-”তা হলে?”

“তা হলে আর ভাবনা কিসের! উনি না থাকলে কি তোমার যত্ন হবে না!”

করুণার চোখে মুখে কৌতুকের দুষ্টু হাসি!

“তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করলে আমায় একাই এগিয়ে যেতে হবে।”

অগত্যা নীরবে তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হলো। এদিকের পথটা বেশ নির্জন। দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি। তারও অনেকগুলি খালি পড়ে আছে। রাস্তায় লোক নেই বললেই হয়।

খানিকদূর নীরবে চলার পর প্রশ্ন না করে পারলাম না—”বিমলবাবু আজ রাত্রে ফিরবেন তো?”

 “বোধহয় না। এখন দু-চার দিন হয়তো সেখানে থাকতে হবে।”

আবার নীরবে অনেকটা পথ পার হয়ে গেলাম। করুণা কয়েকবার আমার দিকে ফিরে তাকাবার পর হেসে বললে—”কি ভাবছো অতো গম্ভীরভাবে?”

“ভাবছি আজই আমায় চলে যেতে হবে।”

“তোমার গাড়ি তো আজকের মধ্যে মেরামত হয়ে উঠবে না।”

“গাড়ি এরা পরে পাঠিয়ে দেবেখন। আমি ট্রেনেই যাবো।”

“এত ব্যস্ত কেন? তোমার এখানে ভয় কিসের?”

রাস্তার মাঝে আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম-”বলেছি তো ভয় আমার নিজেকে। নিজেকে আমি বিশ্বাস করি না।”

করুণা এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলো—”না-ই বা করলে, তাতে কারুর তো কোনো ক্ষতি নেই!”

না, এ বুঝি আর সওয়া যায় না। হঠাৎ সমস্ত সংযম হারিয়ে তার হাতটা ধরে ফেললাম–”ক্ষতি যদি তোমারই হয়…”

করুণা হাত ছাড়িয়ে নিলো না। কিন্তু পরিহাসের হাসিতে আমার সমস্ত আবেগকে নিষ্ঠুরভাবে হাকা করে দিয়ে বললে-” কেমন করে হবে? আমি তো নিজেকে বিশ্বাস করি!”

করুণার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম—”সে বিশ্বাস এখনো কি ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে না করুণা? সমস্ত নোঙর ছিঁড়ে তোমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ঢেউ কি আসতে পারে না?”

করুণার চোখে সেই দুর্বোধ সকৌতুক হাসি—”কি জানি, পরীক্ষা অবশ্য হয়নি।”

তারপর কি বলতাম ঠিক জানি না, কিন্তু রাস্তা এবার জনবহুল হয়ে এসছে। বাধ্য হয়েই চুপ করে গেলাম।

সকালবেলা বাইরে বার হবার পোশাকে করুণার একরূপ দেখেছিলাম। দুপুরবেলা সোড়শোপচার আহারের আয়োজনের আসনের সামনে বসে তার আর একরূপ দেখলাম। একটি সাদা সেমিজের ওপর লাল চওড়া কস্তাপাড় শাড়ি পরে আধ-ঘোমটার পাশ দিয়ে ভিজে এলোচুল পিঠে এলিয়ে সে কাছে এসে বসলো। এমন আশ্চর্য তাকে কোনেদিন লাগেনি।

পাখাটা নাড়তে নাড়তে হেসে সে বললে-”কি দেখছো? কখন দেখোনি নাকি!”

“মনে হচ্ছে সত্যি কখনও দেখিনি!”

“তা হতে পারে!”–বলে সে অদ্ভুতভাবে হাসলো, তারপর জিজ্ঞাসা মলে—”আচ্ছা, আমার বাজার করা দেখে কি ভাবছিলে বলো তো?”

“এই কথাই ভাবছিলাম যে তুমি আমার কাছে একটা নতুন আবিষ্কার!”

“তাই নাকি, কিন্তু, দোহাই, বেচারা কলম্বাসের দাবিটুকু উড়িয়ে দিও না।”

“কলম্বাসেরও আগেকার দাবি যদি থাকে?”

“দাবি থাকলেও দলিল নেই তো!”–নিজের রসিকতায় করুণা নিজেই হেসে মাত করে দিলে।

নিঃশব্দে অনেকক্ষণ খেয়ে যাবার পর বললাম—”দলিলের দাম সকলের কাছে নেই! ও তুচ্ছ জিনিস অনায়াসে পুড়িয়ে ফেলা যায়।”

এবার করুণা হাসলো না। আমার মুখের দিকে খানিক অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থেকে—”তোমায় মিষ্টি দেওয়া হয়নি,” বলে হঠাৎ উঠে গেলো।

তারপর মিষ্টি করুণা নিয়ে এলো না, নিয়ে এলো ঠাকুর।

কিন্তু খানিক বাদে ঘরে সে নিজেই পান নিয়ে এলো এবং হঠাৎ বলে বসলো–”তুমি আজ সন্ধ্যের গাড়িতেই তাহলে যাচ্ছো?”

সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। আমারই মনের ভুল, না তার মুখে একটা অস্ফুট অস্থিরতার ছায়া?

বললাম—”বেশ, তাই যাবো।”

“বেশ তাই যাবো মানে? আমি যেন তোমায় জোর করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি তো তোমায় থাকতেই বলছি, তুমি নিজেই তো যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলে তখন।”

গলার ঝাঁঝটা এবার লুকোবার নয়।

হেসে বললাম—”আমি কি তোমায় দোষ দিচ্চি? আমার সত্যিই না গেলে নয়।”

একটু যেন লজ্জিত হয়ে করুণা হাসবার চেষ্টা করে বললে—”তা জানি, এমন জায়গায় তোমার মন টেকে? কিন্তু শোনো, সন্ধ্যায় ঐ একটি ছাড়া আর গাড়ি নেই তা জানো তো? ঠিক সাড়ে ছটায়, মনে থাকে যেন।”

গাড়ির সময় আমার মনে রাখবার প্রয়োজন ছিলো না। বিকেল না হতেই জিনিসপত্র বাঁধিয়ে, আমার মোটরের কারখানায় খবর দিতে পাঠিয়ে, স্টেশনে যাবার গাড়ি ডাকিয়ে করুণা নিজেই সব বন্দোবস্ত করে ফেললে এবং স্টেশনে যাবার পনেরো মিনিটের পথ যেতে পাছে কোনো গোলমাল হয় বলে এক ঘণ্টা আগে আমায়—গাড়িতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।

এতক্ষণ আমার সঙ্গে বিশেষ কিছু বলবার অবসর তার মেলেনি।

বাড়ি থেকে টাঙ্গায় ওঠবার সময় সে কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললে—”তুমি আমায় কি ভাবছে কে জানে! যেন তোমায় বিদেয় করতে পারলেই বাঁচি মনে হচ্ছে, না?”

“সেইটুকু ভেবেই যা কিছু সান্ত্বনা!”

করুণ হেসে উঠলো—”সান্ত্বনাটা এতো সস্তা হলে আর সত্যিকার কিছু মেলে!” টাঙ্গাওয়ালা গাড়ি চালানোর শব্দে তার হাসির রেশ মিলিয়ে গেলো।

.

এ-গল্পের শেষ ঐখানেই হলে ভালো হতো, কিন্তু তা হলো কই!

স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখনও ট্রেনের অনেক দেরি। ওয়েটিংরুমে জিনিসপত্র রেখে এদিক-ওদিক অকারণে ঘুরে বেড়িয়েও সময় কাটাতে না পেরে তখন বই-এর স্টলে এসে দাঁড়িয়ে কি কেনা যায় ভাবছি। হঠাৎ পাশে চোখ পড়ায় চমকে উঠলাম।

“একি! করুণা, তুমি এখানে?”

ম্লান একটু হেসে বললে–“এই এলাম!”

স্টেশনের শেডের আবছা আলোর দরুন, না সত্যিই করুণাকে কেমন দুর্বল দেখাচ্ছে।

স্টল থেকে একটু সরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—”আমি ঠিক বুঝতে পারছি না করুণা, হঠাৎ স্টেশনে আসার মানে?”

করুণা আবার হাসলো, তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললে—”দলিল পুড়িয়ে দিয়ে এলাম।”

খানিকক্ষণ সত্যিই কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে বিমুঢ়ভাবে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ব্যাকুলভাবে বললাম—”কি বলছে করুণা!”

“খুব অসম্ভব কি কিছু বলছি? ব নোঙর ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মতো ঢেউ কি আসে না কখনো?” করুণার স্বর ক্রমশ যেন গাঢ় হয়ে উঠলো।

আমার বুকের একেবারে কাছে এগিয়ে এসে চোখের দিকে চোখ তুলে সে বললে—”তুমি আমায় নিয়ে যেতে পারো না? যাবে না নিয়ে, বলো?”

অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়লাম—”আমি…তোমায় নিয়ে…”

“কোথায় যাবে ভাবছো? যেখানে খুশি!”

কোনো কথা এবার আর মুখ দিয়ে বেরুলো না। মনের ভেতর শুধু একটা অস্থির আলোড়ন অনুভব করছি।

“তোমায় অনেক অসুবিধা, অনেক লাঞ্ছনা সইতে হবে জানি, কিন্তু আমিও তো তারই জন্যে প্রস্তুত হয়ে সমস্ত লজ্জা, নিন্দা মাথায় নিয়ে এসেছি!”

করুণা কারভাবে মুখের দিকে চেয়ে আছে। কী বলবো? কী এখন বলতে পারি! নির্বোধের মতো আমিই তার রুদ্ধ বন্যার বাঁধ খুলে দিয়েছি, এখন তাকে কেমন করে ফিরিয়ে দেবো?

“কিন্তু ব কথা তুমি বোধ হয় ভালো করে ভেবে দেখোনি, করুণা। যে ঝড় এবার উঠবে তা কি তুমি পারবে সইতে? তার সঙ্গে যুঝতে বুঝতে ক্লান্ত হয়ে হয়তো আমরা পরস্পরকেই একদিন ঘৃণা করতে শুরু করবো।”

করুণা তখনও আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কিন্তু ধীরে ধীরে—অত্যন্ত ধীরে ধীরে তার সমস্ত মুখ যেন বিদ্রপের হাসিতে ভরে উঠলো।

“তোমার মূল্যবান উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। আর একটু হলেই নোঙর উপড়ে গেছলো আর কি!” করুণা এবার সশব্দেই হেসে উঠলো।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। সমস্তই কি তবে আমাকে বিদ্রুপ করবার জন্যে অভিনয়!

করুণা সহজভাবে বললে–“যাও, ট্রেন আসবার ঘণ্টা পড়েছে। আমার। ট্রেনেরও বোধহয় দেরি নেই।”

“তোমার ট্রেন!”

“পিসিমারা কলকাতা থেকে আসছেন। তারা বাড়ি চেনেন না। উনিও নেই, তাই নিজেই এলাম নিয়ে যেতে। শুনে খুব হতাশ হলে বুঝি?”

কোনো কথা আর না বলে ও ধারের প্লাটফর্মে যাবার জন্যে ওভারব্রিজের দিকে অগ্রসর হলাম। করুণাকে শেষ যখন দেখতে পেলাম তখন স্টলের বইগুলোর দিকে সে ঝুঁকে পড়েছে।

সত্যিই পিসিমাদের নিয়ে যাবার জন্যে সে কি স্টেশনে এসেছিলো?

জীবনে কোনোদিন সে-কথা জানা যাবে না।

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ June 10, 2022 at 7:46 pm

Satyajit Ray

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *