জনৈক আব্দুল মজিদ
আমার তিন মেয়েরই তাদের লেখক বাবার লেখা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল। এদের একজন শীলা আহমেদ) ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ার সময় বলতো- “সব লেখকদের লেখা স্কুলে পাঠ্য হয় বাবারটা কেন যে হয় না।”
‘জনৈক আব্দুল মজিদ’ লেখাটি ইন্টারমিডিয়েট বাংলা সিলেকশনে পাঠ্য হয়েছে। আমার তিন মেয়ের কাউকেই এই লেখা পড়তে হয় নি, কারণ তারা পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে।
তবে এই লেখাটা পাঠ্য না হলেই ভাল হত! বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে ফরমায়েসী এক তাড়াহুড়ার লেখা গল্প বলা বা গল্প নির্মাণের আনন্দ অনুপস্থিত, প্রবন্ধের মুক্ত যুক্তির প্রান্তরও নেই। কি আর করা।
*
প্রায় এক যুগ আগের কথা (১৯৯৪), আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মানুষদের জন্যে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করবে। বিষয় এইডস। জনসচেতনামূলক ছবি। ডকুমেন্টারি তৈরির দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আমি গভীর জলে পড়লাম। এইডস বিষয়ে আমার জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি। শুধু জানি এটি একটি ভাইরাসঘটিত ব্যাধি। যে ভাইরাস থেকে রোগটা হয় তার নাম Human Immunodoficiency ভাইরাস। সংক্ষেপে HTv, ঘাতক ব্যাধি। ওষুধ আবিষ্কার হয় নি। এইডস হওয়া মানেই মৃত্যু।
শূন্যজ্ঞান নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরিতে হাত দেয়া যায় না। বিষয়টা ভালোমতো জানা দরকার। একজন AIDS-এর রোগীকে খুব কাছ থেকে দেখা দরকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সিলেটের এক গ্রামে একজন এইডস রোগীর দেখা সন্ধান পাওয়া গেল। ধরা যাক তার নাম আব্দুল মজিদ। সে কাজ করত ইন্দোনেশিয়ায়। ঘাতক ব্যাধি সে বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা বিরাট হৈচৈ শুরু করল, আব্দুল মজিদের এইডস হয় নি। সবই দুষ্ট লোকের রটনা। আব্দুল মজিদ নেক ব্যক্তি। আদর্শ জীবন যাপন করেন– ইত্যাদি।
আমার লেখক পরিচিতির কারণেই হয়তোবা রোগীর দেখা পাওয়া গেল। ছোট্ট একটা ঘরে কঙ্কালসার একজন মানুষ শীতলপাটিতে শুয়ে আছে। একটু পর পর সে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ঠোঁটের কাছে কয়েকটা মাছি বসে আছে। হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার ক্ষমতাও মানুষটির নেই। তার চোখ যক্ষ্মারোগীর চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। সে প্রতীক্ষা করছে মৃত্যুর। বেচারাকে দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই তার কপালে হাত রাখলাম। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তার এইডস হয়েছে এটা সত্যি। সে কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবে এটাও সত্যি। তার একমাত্র দুঃখ কেউ তার কাছে আসে না। তার স্ত্রী দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। কেউ তার ঘরে পর্যন্ত ঢোকে না। তাকে খাবার দেয়া হয় জানালা দিয়ে। তার ঘরের একটা মাত্র জানালা, সেটাও থাকে বন্ধ। অথচ সে পরিবারের জন্যে কত কিছুই না করেছে।
আমি তাকে বললাম, ভাই রোগটা বাঁধালেন কীভাবে?
সে মাথা নিচু করে বলল, বিদেশ থেকে নিয়ে আসছি। খারাপ মেয়েমানুষের সাথে যোগাযোগ ছিল। আমার পাপের শাস্তি।
পৃথিবীতে অনেক ব্যাধিকেই পাপের শাস্তি কিংবা ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়েছে। যেমন– কুষ্ঠ রোগ। AIDS-এর কপালে পাপের শাস্তির সীল ভালোমতো পড়েছে কারণ সম্ভবত এই রোগের সঙ্গে অসংযত যৌনতার সরাসরি সম্পৃক্ততা।
এই রোগ প্রথম ধরা পড়ে সমকামীদের মধ্যে (১৯৮১ সন, নিউইয়র্ক এবং ক্যালিফোর্নিয়া)। শুরুতে গবেষকরা ধারণা করেছিলেন, এই রোগের প্রধান কারণ সমকামিতা। এই ধারণা এখন আর নেই। ১৯৮৩ সনে ফরাসি গবেষক লকু মনটরগনিয়ার এবং ১৯৮৭ সনে আমেরিকার রবার্ট গ্যালো আবিষ্কার করেন ভাইরাসঘটিত এজেন্ট HIy টাইপ ওয়ান থেকে এইডস ব্যাধির সৃষ্টি। পশ্চিম আফ্রিকার এইডস রোগীদের পরীক্ষা করে HIV টাইপ টু বের করা হয়। এইচআইভির’র প্রধান কাজ, মানুষের শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া। টাইপ ওয়ান এই কাজটি করে দ্রুত, টাইপ টু ভাইরাস কাজ করে ধীরে। রোগের লক্ষণ জটিল কিছু না– দুর্বলতা, জ্বর, ডায়েরিয়া, লসিকা গ্রন্থির ফুলে যাওয়া। এই অতি সাধারণ লক্ষণের অসুখ এক সময় সংহারক মূর্তি ধারণ করে।
এই কালান্তক ব্যাধির ভয়াবহতার কারণেই জাতিসংঘে গঠিত হয়েছে এইডস বিষয়ক সংস্থা (UNAIDs)। পহেলা ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘের এইডস বিষয়ক সংস্থার পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ২০০৫ সনের হিসেবে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ছিল চার কোটির বেশি। বর্তমান পৃথিবীতে প্রতিদিন ১৪ হাজার মানুষ এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। সাহারা মরুভূমির চারপাশের আটচল্লিশটি দেশে এখন মৃত্যুর প্রধান কারণ এইডস। অনেক দেশেই এই মরণব্যাধি মানুষের গড় আয়ু দশ বছর কমিয়ে দিয়েছে। ভারত, নেপাল, বার্মা, চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যাণ্ডে এইডস দ্রুত ছড়াচ্ছে।
সেই তুলনায় আমরা এখনো ভালো আছি। ঘোড়া এখনো লাগাম ছাড়া হয় নি। UNAIDS-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা ১৩৪, এইডস থেকে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৪, এইচআইভি পজেটিভ মানুষের সংখ্যা ৬৫৮। এই পরিসংখ্যানে আনন্দে উল্লসিত হবার কিছু নেই। পাগলা ঘোড়া যে-কোনো সময় লাগামছাড়া হতে পারে। কীভাবে পারে তা ব্যাখ্যা করার আগে এইডস কীভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কে একটু বলে নিই।
মানুষের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস কোথায় থাকে? তার অবস্থান তিন জাতীয় তরল পদার্থে। রক্তে, বীর্যে এবং মায়ের দুধে। কাজেই রোগ ছড়াবে তিন জাতীয় তরলের আদান-প্রদানে।
ক. এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলনে। অনিরাপদ যৌন মিলনের অর্থ কনডমবিহীন যৌন মিলনে। লিখতে অস্বস্তি লাগছে কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে স্পেডকে স্পেড বলাই বাঞ্ছনীয়।
খ. রক্ত আদান-প্রদান। এইচএইভি আক্রান্ত রোগীর রক্ত শরীরে নেয়া।
গ. শিশুদের এইচআইভি আক্রান্ত মায়ের দুধ পান।
বাংলাদেশ শিক্ষায় অনগ্রসর হতদরিদ্র একটি দেশ। পতিতাবৃত্তি দরিদ্র দেশের অনেক অভিশাপের একটি। যৌনকর্মীরা (নারী এবং পুরুষ) নগরে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শিক্ষিত আধুনিক তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নৈতিকতা অনুশাসন তেমনভাবে কাজ করছে না। অবাধ মেলামেশাকে তারা অনেকেই আধুনিকতার অংশ মনে করছে। তথাকথিত এই আধুনিকতার কারণে তারা যে কত বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে তা তারা বুঝতেও পারছে না।
বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে এ দেশের মেয়েরা। তাদের যৌন শিক্ষা নেই বললেই হয়। মূল কারণ যৌনতা-বিষয়ক সমস্ত ব্যাপারই এ দেশে ট্যাবু। সমাজের মেয়েদের অবস্থান দুর্বল। অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে বাধা দেবার ক্ষমতাও এদের নেই।
আমাদের পাশের দেশগুলোতে এইডস রোগ বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এইসব দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। আনন্দ-পিপাসুরা সেসব দেশে যাচ্ছেন। ভিনদেশের যৌনকর্মীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে। তারা দেশে ফিরছেন এইচআইভি ভাইরাস নিয়ে। নিজেরা কিন্তু চট করে সেটা বুঝতে পারছে না। কারণ এইচআইভি মানুষের শরীরে দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশ বছর এইচআইভি থাকবে ঘুমন্ত। এইচআইভি ঘুমন্ত থাকলেও তারা তো ঘুমন্ত না। তারা মহানন্দে তাদের শরীরের এইচআইভি ছড়িয়ে বেড়াবেন। জাতি অগ্রসর হবে ভবিষ্যতহীন অন্ধকারের দিকে।
বাংলাদেশে মাদক গ্রহণের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। হিরোইন আসক্তরা উঁচ দিয়ে শরীরে বিষ ঢোকাচ্ছে। একই সুই অন্যরাও ব্যবহার করছে। এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর কী সুন্দর সুযোগ!
এই দেশের কিছু অসহায় মানুষ বেঁচে থাকেন শরীরের রক্ত বিক্রি করে। তাদের কারোর এইচআইভি পজিটিভ রক্ত যখন অন্য কাউকে দেয়া হবে তখন অবস্থাটা কী? অনেক উন্নত দেশেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। দূষিত রক্ত মিশে গেছে ব্লাড ব্যাংকের রক্তে।
সিলেটের এইডস রোগীর কাছে ফিরে যাই। আমি রোগীর আত্মীয় স্বজনকে ডেকে বুঝালাম যে এই রোগ অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগের মতো না। স্বাভাবিক মেলামেশায় এই রোগ ছড়াবে না। এইডস রোগী যে গ্রীসে পানি খাচ্ছে সেই গ্লাসে অন্য কেউ যদি পানি খায় তাতেও তার রোগ হবে না। আমার কথায় তেমন কাজ হলো বলে মনে হলো না। তারা রোগীর দিকে ঘৃণা এবং ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
পশু-পাখিদের মধ্যে কেউ যদি রোগগ্রস্থ হয় তখন অন্যরা তাদের ত্যাগ করে। রোগীকে মরতে হয় সঙ্গীবিহীন অবস্থায় একা একা। মানুষ তো পশুপাখি না। মানুষ রোগীকে দেখবে পরম আদরে এবং মমতায়। রোগকে ঘৃণা করা যায়, রোগীকে কেন?
আমি এইডস রোগী আব্দুল মজিদকে (আসল নাম না, নকল নাম) বললাম, ভাই আমি AIDS নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানাব। আপনি কি সেখানে কাজ করবেন?
আব্দুল মজিদ ক্লান্ত গলায় বলল, আমার লাভ কী? আমি তো মরেই যাব।
আমি বললাম, আপনার লাভ হলো, ডকুমেন্টারি দেখে বাংলাদেশের মানুষ সাবধান হবে। আব্দুল মজিদ রাজি হলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারলেন না। আমি সিলেট থেকে ফিরে চিত্রনাট্য তৈরি করার পরপরই শুনলাম তিনি মারা গেছেন।