জনসন, ডঃ বোস এবং দুর্গা রায়
জনসন আর কিরণকাকুকে নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে এই স্মৃতিচারণ সম্পূর্ণ হবে না। কিরণকাকু মানে, ড. কিরণ বোস বা ডক বোস। জ্যোতি বসুর নিজের বড় দাদা। ড. কিরণ বোস এবং তাঁর স্ত্রী জলপাইগুড়ির রায়কত রাজ—এর রাজকুমারী প্রতিভা দেবী এবং রাজকুমারীর সব জামাইই আমাদের মক্কেল ছিলেন। ছোট জামাই IFB—র বিজন নাগ অবশ্য সুইৎজারল্যান্ড থেকে ফিরে IFB প্রতিষ্ঠা করার আগে অবধি মক্কেল ছিল। আমিই বিজনকে এস আর বাটলিবয়ের অমল সি চক্রবর্তীর কাছে পাঠিয়েছিলাম।
শিলিগুড়ির দুর্গা রায়ের সঙ্গে জনসন সাহেবের আলাপ আমাদেরই মাধ্যমে। দুর্গাকাকুর কথা পরে বলব আলাদা করে। উনি একবার আমাকে অন্ধকারে রেখে জনসন আর কিরণকাকুকে নিয়ে উত্তরবঙ্গে গেছিলেন শিকার করাবার জন্যে। কিরণকাকুর নাম ডক বোস ছিল কারণ ওঁর অত্যন্ত অবস্থাপন্ন বাবা ওঁকে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন দাঁতের ডাক্তার হওয়ার জন্যে আর জ্যোতিবাবুকে পাঠিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যে। ব্যারিস্টারি পাশ করতে মেধা লাগে না তাই বড়লোকের ছেলেরা সহজেই ব্যারিস্টার হতেন এবং পরে অধিকাংশই ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হতেন। জ্যোতিবাবু আমাদের নেহরু সাহেবেরই মতো কোনও দিনই প্র্যাকটিস করেননি। করলে, মেধার পরিচয় পাওয়া যেত। স্টেটস থেকে দাঁতের ডাক্তার হয়ে ফিরে আসেন দাদা। দাঁত তুলে কিরণকাকুর আর কতই বা রোজগার হত? তার বদলে একটি রাজকুমারী তুলে তিনি বিনা মেহনতে কোটিপতি হয়ে গেলেন। সারা জীবন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আর স্কচ হুইস্কির সঙ্গ করে দিব্যি জীবন যাপন করে গেলেন। মানুষটা কিন্তু ছিলেন চমৎকার। সোজা—সাপটা।
কিরণকাকু দারুণ ইলিশ মাছ রাঁধতেন। জলপাইগুড়ির রাজবাড়িতে আমাকে নিজে হাতে যে ইলিশ মাছ রেঁধে খাইয়েছিলেন তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। রাজকুমারী প্রতিভা দেবীও আমাকে সন্তান স্নেহেই দেখতেন। তবে ডঃ বোস বা কিরণকাকু শিকারি আদৌ ছিলেন না এবং ওঁদের অ্যাকাউন্ট্যান্টের মুখে শুনেছি, ওঁর বিয়ের পরে রাজ এস্টেটের খাসমহল—বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে উনি এমন বেধড়ক গুলি চালিয়ে মাদী হরিণ মেরেছিলেন যে রাজা প্রসন্নদেব রায়কত তাঁর একমাত্র জামাইয়ের ওপরে অত্যন্তই অপ্রসন্ন হয়েছিলেন।
এক ভাই প্র্যাকটিস না—করা দাঁতের ডাক্তার আর অন্য ভাই প্র্যাকটিস না—করা ব্যারিস্টার। তবে কিরণকাকু সহজ—সরল মানুষ ছিলেন আর তাঁর ছোট ভাই জ্যোতিবাবু ঝানু রাজনীতিক। তিরানব্বই বছর পার করেও রাজনীতির মধুবন ছেড়ে বানপ্রস্থে যেতে নারাজ।
দুর্গাকাকু চিরদিনই ধনী—সঙ্গে কাটিয়েছেন। শুনেছি, নাটোরের মহারাজের বাড়িতেও নাকি থাকতেন এক সময়ে। তবে কোন দাবিতে তা ঠিক জানি না। নানা জনের কাছে নানা মানুষে নানা কথা বলেন। অনেক বছর উনি দক্ষিণ কলকাতার রায়কত রাজাদের বাড়ি শরৎ ব্যানার্জি রোডের জলপাইগুড়ি হাউসেই থাকতেন। তার পরে কিছুদিন আমাদের পৈতৃক নিবাস, রাজা বসন্ত রায় রোডের ‘কনীনিকা’তে। তারও পরে বেঙ্গল ল্যাম্পের গেস্ট হাউসে।
দুর্গাকাকুর তখন হিলকার্ট রোডে, প্রায় সুকনার কাছে একটি খামারবাড়ি ছিল শালবাড়িতে। একটি হাতিও ছিল। খামারে চাষ—বাসও হত। পুকুর ছিল। সিলভার কার্প ও তেলাপিয়া মাছের চাষও হত। দুর্গাকাকুর চোরাশিকারি হিসেবে বেশ বদনাম ছিল উত্তরবঙ্গে। আর ব্যক্তিগত বৈরিতা ছিল বিখ্যাত, কৃতী, সৎ, এবং সর্বার্থে পরিশীলিত বনপাল কনক লাহিড়ী মশায়ের সঙ্গে।
দুর্গাকাকু তো ফ্লাইটে জনসন ও কিরণকাকুকে নিয়ে বাগডোগরা পৌঁছে সেই সন্ধেতেই তাঁর হাতির পিঠে মোটরগাড়ির ড্রাইসেল ব্যাটারি, স্পটলাইট এবং জনসন সাহেব ও কিরণকাকুকে চড়িয়ে দিয়ে স্বহস্তে রান্না করতে লেগে গেলেন। হুইস্কির গ্লাসট্লাস সাজিয়ে ডিনারের জন্যে একেবারে রেডি।
এদিকে হাতি তো বৈকুণ্ঠপুরের সুগভীর জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল সন্ধের পরে। সেই জঙ্গলই বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ—এর জঙ্গল। সন্ন্যাসীকাটা হাটের লাগোয়া একটি চা—বাগানও ছিল রাজকুমারীর। সেই বাগানেও থেকেছি একবার।
কিছুদূর যাওয়ার পরেই স্পটলাইটের আলোতে একটি মস্ত বড় শিঙাল দেখা গেল জঙ্গলের মধ্যে, তৃণভূমিতে। জনসন সাহেব গুলি করলেন এবং সেই শিঙাল পড়ে গেল হয়তো রাজার জামাইয়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতেই। শিঙাল তো মরে ধন্য করল কিন্তু তাকে কী প্রকারে শালবাড়ির খামারে নিয়ে যাওয়া যায়? কিরণকাকুর আদেশে হাতিকে বসানো হল। জনসন সাহেব বললেন, দড়াদড়ি দিয়ে ভাল করে শিঙালকে বাঁধো। তারপর বললেন, ডক বোস, ইউ গেট ডাউন অ্যান্ড পুশ ফ্রম বিলো অ্যান্ড মাইসেল্ফ অ্যান্ড দ্যা মাহুত উইল পুল ইট আপ অন দি এলিফ্যান্ট’স ব্যাক।
পরিকল্পনা ঠিকমতোই এগোচ্ছিল, কিরণকাকু মাটিতে নেমে প্রাণপণে ঠেলছিলেন এবং মাহুত এবং জনসন সাহেব মৃত শিঙালকে আরও প্রাণপণে ঊর্ধ্বপানে আকর্ষণ করছিলেন।
ইতিমধ্যে ঘটে গেল এক বিপত্তি। মৃত হরিণের শিংয়ের ছুঁচোল মুখ ‘অচানক’ হাতির শুধু পুরুষ হাতিরই নয়, সব পুরুষেরই একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গ থাকে তাতে আঘাত করামাত্র হাতি বিনা বাক্যব্যয়ে এবং রায়কত রাজার একমাত্র জামাই বা বঙ্গভূমের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একমাত্র দাদা বলে বিন্দুমাত্র রেয়াৎ না করে মুহূর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে সোজা শালবাড়ির ক্যাম্প বলে দৌড়।
জনসন সাহেব ও মাহুত হাতির পিঠের ওপরে শুয়ে পড়ে ডালপালার আঘাত থেকে কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে শালবাড়িতে ফিরলেন।
দুর্গাকাকু উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, হোয়্যার ইজ ডক বোস?
জনসন সাহেব মাথা নিচু করে বললেন, হি ইজ লেফট ইন দ্যা জাংগল।
তখন তো শিকার মাথায় উঠল। গারাজ থেকে জিপ বের করে হাতির পিঠ থেকে স্পটলাইট নামিয়ে জিপের বনেটের নিচে ব্যাটারির সঙ্গে ক্ল্যাম্পে লাগিয়ে জিপ নিয়ে ডক বোসকে খোঁজার জন্যে দুর্গাকাকু স—জনসন বেরিয়ে পড়লেন। মাহুতও সঙ্গে গেল জায়গাটা চেনাতে।
ওইদিকে নেপথ্যে কী ঘটছিল তার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক আপনাদের। কিরণকাকুর হাতে ছিল একটি .৩৭৫ ডাবল—ব্যারেল ইংলিশ হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ডের রাইফেল। রাইফেলটি এতটাই ভাল যে যিনি তা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেন তাঁর পক্ষে বাঘ বা গাউর এমনকী হাতি মারাও কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু রাইফেল বন্দুক কিরণকাকু বহুযুগ ব্যবহার করেননি। মাঝে একবার বাবার সঙ্গে ওড়িশাতে গিয়ে হয়তো গুলি ছুড়েছিলেন দু—একটা। তবে যতদূর শুনেছিলাম আমার দু ভাইয়ের কাছে যে কিরণকাকু অথবা দুর্গাকাকু কারোও রাইফেল—নিঃসৃত গুলির সঙ্গেই কোনও জানোয়ারের শরীরের কোনও অংশেরই যোগাযোগ হয়নি।
যেখানে শিকার অর্থাৎ মৃত শিঙাল এবং ওঁকে ফেলে রেখে হাতি বিদ্যুৎগতিতে দৌড় লাগিয়েছিল সেটা গভীর বনের মাঝে একটি তৃণভূমি। বেশ কিছুটা জায়গাতে পরিষ্কার নজর চলে। কিরণকাকু ভয়ঙ্কর ভয়ে ভীত না হয়ে ওই ফাঁকা জায়গাতেই বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতেন ওই রাইফেলকে সঙ্গী করে। ভূত—প্রেত হলে অন্য কথা ছিল, কোনও প্রাণীকে ভয় করার কোনও ন্যায্য কারণ তার ছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে উনি ভাবলেন, মাটিতে না থেকে একটা গাছে চড়া দরকার। কিন্তু গাছে শেষবার চড়েছিলেন বহুযুগ আগে সেই শৈশবাবস্থায়। কিন্তু কালক্ষেপ করার সময় কোথায়? উনি একটি মাঝারি মাপের গাছে হান্টিং—বুট পরে চড়তে গিয়ে হাত পাঁচেক ওপরে উঠেই পপাত ধরনিতলে। মেরুদণ্ডে লাগল বেজায় চোট। তাতে ভয় তাঁকে আরও গলা টিপে ধরল।
দুর্গাকাকু তখন জঙ্গলময়, জিপের ও স্পটলাইটের আলোর বন্যা বইয়ে ছুটোছুটি করছেন আর মুখে হরিনামের মতো আকুল স্বরে কিরণ! কিরণ! করে ডাক ছাড়ছেন। কিন্তু কীসের কিরণ? কোথায় কিরণ?
হঠাৎ একটি চিঁচিঁ চিৎকার শোনা গেল একটি গাছের ওপর থেকে, এঁই যেঁ। আঁমি এঁকাঁনে।
আলো ফেলতেই দেখা গেল মাটি থেকে দু—হাত ওপরে দু—পা দিয়ে একটি গাছের কাণ্ড জড়িয়ে কিরণকাকু আধো শোয়া হয়ে আছেন।
এতসব যে ঘটে গেছে তা আমার জানা ছিল না কারণ দুর্গাকাকু পুরো ব্যাপারটাই ঘটিয়েছিলেন আমাকে ঘুণাক্ষরে না জানিয়ে। পরদিনই ফ্লাইটে জনসন ও কিরণকাকু কলকাতা ফেরেন। কিরণকাকু সোজা উডল্যান্ডস—এ গিয়ে ভর্তি হয়ে যান।
তার তিনদিন পর আমাকে জনসন সাহেব ফোন করেন। উত্তেজিত গলাতে জিজ্ঞেস করেন, আর উ্য বিজি?
হোয়াই?
ক্যুড উ্য প্লিজ কাম ওভার ফর ফাইভ মিনিটস?
আয়কর ভবন থেকে আমার অফিসে ঢিল মারলেই পড়ে। তাই গেলাম। দেখলাম, ব্যাজার মুখে জনসন বসে বসে পাইপ খাচ্ছেন। আমি ঢুকেই বললাম, হোয়াটস আপ?
কথা না বলে, উনি একটি চিঠি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। খোলা চিঠি। মনে হল, একটু আগেই খোলা হয়েছে। চিঠিটি তুলে নিয়ে দেখলাম পশ্চিমবঙ্গের কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টস কনকেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর অফিসিয়াল প্যাডে লেখা চিঠি। লিখেছেন : ‘আই হ্যাভ কাম টু নো ফ্রম রিলায়েবল সোর্সেস দ্যাট উ্য হ্যাড বিন টু দ্যা বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্ট অ্যান্ড শট আ স্ট্যাগ অন সানডে লাস্ট অ্যারাউন্ড সেভেন পি. এম.। উ্য ডিডনট হ্যাভ আ পারমিট আইদার। প্লিজ এক্সপ্লেইন ইওর কনডাক্ট।
আমি তো চিঠি পড়ে থ।
জনসন সাহেব তারপর বললেন পুরো ঘটনা। বললেন, ‘দিস ব্লাডি চ্যাপ, ডক বোস, হি গেভ দ্যা ম্যাটার সাচ আ হেল অফ আ লট অফ পাবলিসিটি দ্যাট দ্যা হোল অফ ক্যালকাটা নো বাউট দি ইনসিডেন্ট।’
আমি বললাম, চিঠিটা নিয়ে এখন কী করবেন? জবাব দেবেন কী?
জনসন সাহেব বললেন, ‘মাই ফুট। হোয়াট দ্যা হেল ক্যান আই ড্যু উইথ ইট? হোয়াট রিপ্লাই? মাই ফুট। আই উইল পুট দ্যা লেটার ইন মাই পাইপ অ্যান্ড স্মোক ইট অফফ।’
শুধু দুর্গাকাকুই নন, আমার বন্ধু গোপালও এই রকমই আমাকে ঘুণাক্ষরে না জানিয়ে জনসন সাহেবকে নিয়ে আসানসোলের নর্থব্রুক কলিয়ারির আমাদের অনুজপ্রতিম প্রণব রায়ের সঙ্গে পরেশনাথ পাহাড়ের নিচে তোপচাঁচি লেকের পারের জঙ্গলের গভীরে একটি কেঁদ গাছে পাঁঠা বেঁধে জিপেই বসেছিল। অন্ধকারের একটু পরেই একটি চিতা এসে পাঁঠার ঘাড় মটকায়। প্রণব টর্চ ফেলে এবং জনসন সাহেব ঘোড়া দাবেন। বাঘ জনসন সাহেবকে ওবলাইজ করে লক্ষ্মী ছেলের মতো নরকে যায়।
ওই ঘটনার কথাও জনসন সাহেব কলকাতায় ফিরেই আমাকে জানান। কারণ, দুর্গাকাকু বা গোপাল সকলেরই আলাপ হয় জনসন সাহেবের সঙ্গে আমারই মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, সেই শনিবারই জনসন সাহেব গোপাল ও আমাকে ওঁর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একতলা ভাড়া বাড়িতে সেই লেপার্ড মারা সেলিব্রেট করার জন্যে নেমন্তন্ন করেন। প্রণব আসেনি, অবশ্য ও কলকাতাতে ছিল কি না জানি না। সেই পার্টিতেই কেনেথের বড় ভাই লেসলির সঙ্গে আলাপ হয়। লেসলি জনসন আই সি এস ছিলেন এবং তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধরমভীরা সাহেবের ব্যাচমেট ছিলেন। উঠেও ছিলেন কলকাতাতে রাজভবনেই। লেসলি তখন ও এন জি সি—র চেয়ারম্যান। দু—ভাইয়ের চেহারাতে কোনও মিল ছিল না। কেনেথকে দেখে বোঝা যেত যে তিনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, কিন্তু লেসলির চেহারা ছিল একেবারে সাদা সাহেবেরই মতো।
ডক বোস এবং জনসন সাহেবের বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে ‘কেলো’ করার কয়েকমাস পরে কালাহান্ডিতে শিকারে যাওয়ার কথা হয়। Ken জনসন, তাঁর এক স্কটসম্যান বন্ধু Jim ক্যালান, দুর্গাকাকু আর আমি যাব ঠিক হয়। জিম তখন কলকাতার ব্রিটিশ হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ছিলেন। হৃষ্টপুষ্ট, হাসিখুশি স্কটসম্যান, পানীয়র ওপরেই থাকতেন। তবে স্কটল্যান্ড বা ইংল্যান্ডে একটি শিয়ালও মারেননি তিনি। নিজের বন্দুক—রাইফেল পর্যন্ত নেই অথচ ইন্ডিয়াতে বিগ—গেম শিকার করার খুবই শখ।
জনসন সাহেবের অনুরোধে বাবার একটি অর্ডিনারি .৩৭৫ সিঙ্গল ব্যারেল রাইফেল নিয়েছিলাম জিমের জন্যে। সেই রাইফেলের গ্রুভস প্রায় অবশিষ্ট ছিল না। ব্যারেল প্রায় জলের কল হয়ে গিয়েছিল। শিকারি অনুযায়ী আদর্শ অস্ত্র। আমি নিয়েছিলাম একটি ফোর সেভেন্টি ফাইভ ডাবল ব্যারেল রাইফেল—উত্তরবঙ্গের কমিশনার আইভান সুরিটা (পিয়ার্সনের ভাই) ওটি আমাকে প্রায় জলের দামেই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি এ দিয়ে অনেকই শিকার করেছি, কিন্তু এখন আর এই চোদ্দো পাউন্ডের রাইফেল ব্যবহার করতে পারি না। বাট আই ক্যানট গিভ দিস টু এনি টম ডিক অ্যান্ড হ্যারি।
এই রাইফেলটিই আমাকে ‘নগ্ন—নির্জন’ উপন্যাসটি লিখতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু সে অন্য গল্প।
দুর্গাকাকু একদিন ফোন করলেন আমাকে। তখন আমাদের বাড়িতে আর থাকেন না—বেঙ্গল ল্যাম্পের গেস্ট হাউসেই থাকেন। তপন রায়, বেঙ্গল ল্যাম্পের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আগে উত্তরবঙ্গের এক সাহেবি চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন। সেই সময় থেকেই দুর্গাকাকুর সঙ্গে আলাপ। বেঙ্গল ল্যাম্পও আমাদের মক্কেল ছিল।
ফোন করে দুর্গাকাকু বললেন, কিরণ খুব ধরেছে সে আমাদের সঙ্গে কালাহান্ডিতে যাবে। আমি সেই মতো জনসনকে বলেওছিলাম। কিন্তু জনসন রাজি নন। তুমি একবার বলে দেখো না। তোমার বন্ধু।
আমি আয়কর ভবনে গিয়ে অনুরোধ করলাম জনসন সাহেবকে। পাইপ ভরতে ভরতে ভুরু কুঁচকে উনি বললেন, হুঁ?
বললাম, ডক বোস।
জনসন সাহেব বৈকুণ্ঠপুরের ব্যাপারে এতই ক্ষেপে ছিলেন যে বললেন, ওঁকে গিয়ে বোলো যে, একটি শর্তে ওঁকে সঙ্গে নিতে পারি।
কী শর্তে?
‘‘I will tie him up as a bait for the tiger. If he is agreeable he can come along.’’ বলাই বাহুল্য, কিরণকাকুর যাওয়া হয়নি।
কালাহান্ডিতে অবশ্য জনসন সাহেব একটি বাঘ মেরেছিলেন। কালাহান্ডির বাঘেদেরও সুন্দরবনের বাঘেদের মতো মানুষখেকোর বদনাম ছিল। বদনাম যে মিথ্যে নয়, তা আমরা নিজ চোখে দেখেওছি। এই জঙ্গলেই আহত বাঘকে গুলি করে মাচা থেকে নেমে বিখ্যাত ব্যারিস্টার এবং ‘ঝিলে জঙ্গলে’র লেখক শিকারি কুমুদনাথ চৌধুরি বাঘের হাতে নিহত হন, অথচ তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখাতে বারবার করে নিষেধ করেছিলেন সব শিকারিকেই, বাঘকে গুলি করে মাচা থেকে না নামতে।
কালাহান্ডির প্রাকৃতিক পরিবেশ ওড়িশার এবং আমাদের দেশের অন্য অনেক জায়গার সঙ্গেই মেলে না। আফ্রিকা আফ্রিকা গন্ধ আছে একটু। বুঝিয়ে বলতে গেলে অনেক বিস্তার করে বলতে হয়। কালাহান্ডিতে দেখেছি বাঘের জন্যে যে Bait দেওয়া হয়, সে যে জানোয়ারই হোক না কেন, তাকেও একটি ছোট মাচার ওপরে রাখা হয়। অমনটি পৃথিবীর আর কোথাওই দেখিনি।
কালাহান্ডির বনের মানুষরা বিশ্বাস করে যে, যে সব মানুষ মানুষখেকো বাঘেদের পেটে যায়, তারা একরকমের ভূত হয়ে যায়। সেই ভূতেদের নাম ‘বাঘ্বমুণ্ডা’। তারা ছোট ছোট পাখির রূপ ধরে থাকে ও রাতের বেলা নিজেরা গাছের ডালের ঝুপড়ির আড়ালে অদৃশ্য থেকে ডাকে : ‘কিরি—কিরি—কিরি— কিরি—ধূপ—ধূপ—ধূপ—ধূপ—ধুপ। ‘নগ্ন—নির্জন’ উপন্যাসে বাঘ্বমুণ্ডার কথা আছে। ওড়িশার বাঘ্বমুণ্ডার পটভূমিতে লেখা উপন্যাস।
জনসনের সঙ্গে অনেক জায়গার জঙ্গলেই গেছি শিকারে—সুন্দরবনে, আসামে, ওড়িশার কালাহান্ডিতে, কিন্তু বাঘ ওঁর হাতে মারা পড়ে একমাত্র কালাহান্ডিতেই— অন্য জায়গাতে আমাদেরই মারা পড়ার কথা ছিল— এখনও বেঁচে যে আছি, এ আশ্চর্যের ব্যাপার। জনসন সাহেব বাঘ দেখলেই ভীষণই ঘাবড়ে যেতেন। বাঘের এমনই ব্যক্তিত্ব যে, বাঘের সামনাসামনি হলে, বিশেষ করে পায়ে হেঁটে, তখন যেন ভূতগ্রস্ত হয়ে পড়তে চায় শরীর। মেসমেরাইজড করে দেয় বাঘ মানুষকে। তাই ভয় পাওয়াটা আশ্চর্যের কথা নয়, কিন্তু যাঁরা বাঘকে মারতে চান, তাঁদের তো অন্যদের মতো হলে চলে না। আজকালকার অভয়ারণ্যের ‘পোষা’ বাঘ তো ছিল না সেই সব বাঘ। স্বাভাবিক বাঘেদের চালচলনই ছিল অন্যরকম।
তবে জনসনের কালাহান্ডির বাঘের চামড়াটা উদ্ধার করা যায়নি। পরদিনই ভাইজাগ থেকে ট্রেন ধরার ছিল আমাদের। স্ট্র—প্রোডাক্টসের রায়গড়ার গেস্ট হাউসে রাত কাটিয়ে আমরা ভাইজাগের দিকে বেরিয়ে পড়ি। আহত বাঘের খোঁজ করার ভার দিয়ে আসি রামচন্দ্র দণ্ডসেনা নামক এক পেশাদার শিকারিকে। সে আবার জনসন সাহেবের দাদা লেসলি জনসনের অধীনে পেশাদার শিকারি হিসেবে কাজ করেছিল যখন লেসলি দণ্ডকারণ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন।
বাঘটা পেটে রাইফেলের গুলি খেয়ে নিজের গুহার দিকে চলে যেতে চেয়েছিল। মানুষসুদ্ধ, সব প্রাণীই যেমন নিজের জায়গাতে গিয়েই মরতে চায়। কিন্তু অনেক রক্তপাত হওয়াতে বেচারি গুহামুখের সামনে একটি মস্ত বড় চ্যাটাল কালো পাথরের ওপরে শুয়ে পড়েছিল, গুহাতে আর ঢুকতে পারেনি। দণ্ডসেনা রক্তের দাগ অনুসরণ করে দলবল নিয়ে হাঁকা করে যখন সেখানে পৌঁছেছিল, তখন বেলা প্রায় আটটা। তার আগেই শকুনরা ছিঁড়েখুঁড়ে তাকে খেয়ে ফেলেছিল। গায়ের চামড়া বলতে কিছু ছিল না।
ক্রিসমাসের আগে আগে, জনসন সাহেব তখন বম্বেতে গেছেন। জনসন সাহেবের পাঞ্জাবি পি এ, এ এল সুড আমার কাছে একটি টেলিগ্রাম নিয়ে এলেন। তাতে লেখা—‘‘carcass found in front of the cave, congratulations.’’ টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন আর্য ভৌমিক সাহেব, বেহরামপুর গঞ্জামের অ্যাপেলেট অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। আমি সঙ্গে সঙ্গে জনসনের বম্বের ঠিকানাতে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিই—ফোন নম্বার জানা ছিল না। জিন জনসন তারপরে বহু বছর পর্যন্ত আমাকে বলত, ‘দ্যা নাইসেস্ট ক্রিসমাস গিফট উই এভার হ্যাভ ওজ ইওর টেলিগ্রাম, লালা।’