জনপ্রিয় গানের নির্মাতা সুধীন দাশগুপ্ত

জনপ্রিয় গানের নির্মাতা সুধীন দাশগুপ্ত

Pop music বলতে আজকে আমরা যা শুনছি, বুঝছি, তা Pop সংজ্ঞাটিকে কদর্য রূপ দিচ্ছে৷ Pop কথাটা উঠে এসেছে Popular থেকে অর্থাৎ যা জনপ্রিয়৷ একটি বাংলা ছবিতে ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণেশ’-র মতো একটি কঠিন ও গভীর রবীন্দ্রসংগীত অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল— কিন্তু Pop শব্দটি ব্যবহারের রুচিহীনতায় এবং Popular অর্থাৎ জনপ্রিয় শব্দটি মালিন্যে ভরে যাওয়ায় রবীন্দ্রসংগীতটিকে Pop বলা যাবে না৷ Pop শব্দটি সাংগীতিকভাবে এমন বোধকে জনমানসে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে আর জনপ্রিয় হলেও সে গানকে Pop বলা যাবে না৷

বাংলা গানে সুধীন দাশগুপ্তর সব থেকে বড় অবদান ও উৎকর্ষ হচ্ছে তার সৃষ্টি অধিক গানই জনপ্রিয় হয়েছে৷ এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে গিয়েছে৷ যেমন ‘জীবনে কি পাব না’— band-এর শিল্পীরাও গায়৷ আর একটা গানের দিকে বোধহয় আধুনিক চিন্তার সংগীতশিল্পীদের দৃষ্টি পড়েনি সেটা হচ্ছে আরতি মুখোপাধ্যায় গীত ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’৷ এসব গান উনিশের দশককে ২০০০-এ পৌঁছে দিয়েছে৷ চলমানতার নিরিখে জাত আধুনিক নির্মাতা হিসেবে সুধীন দাশগুপ্তকে চিহ্নিত করতে হবেই৷ তবে সেই এক কথা, উনি যেমন বিদেশি সংগীত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তেমনি ভারতীয় সংগীত ও লোকসংগীতের ব্যুৎপত্তিতে একজন অতি সুদক্ষ নিবেদিত পর্যটক৷ যার জন্যে তাঁর নবনির্মাণ আগামী প্রজন্মকে স্পর্শ করলেও ঐতিহ্যের শিকড়ে ছিল তা বাঁধা৷ অত্যন্ত নিষ্ঠ মানুষ৷ শিক্ষিত মনকে সংযমে নিয়ন্ত্রিত করার অসম্ভব পারদর্শিতা ছিল৷ ব্যক্তিজীবনের অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে, যা, তার সান্নিধ্যে আসার ফলে আমার মানসিকভাবে সাংগীতিক পুষ্টি জোগাতে রসদ জুগিয়েছে৷

আমাদের উভয়ের সংগীত জগতে বাণিজ্যিক প্রবেশ প্রায় সমসাময়িক, যদিও তিনি ছিলেন বয়সানুযায়ী আমার অগ্রজ৷ তাই দাদা-ভায়ের সম্পর্ক নিয়েই আমাদের বিনিময় হত৷ এমনও হয়েছে, একদিন ডাকলেন বিশেষ প্রয়োজন বলে— প্রয়োজনটা পড়ে দেখলাম একেবারে ব্যক্তিগত ভালবাসার অঙ্গনের বিচরণ ক্ষেত্র৷ একসঙ্গে বীণা সিনেমায় একটি ইংরেজি ছবি দেখা ও পরে রেস্তোরাঁয় ভালমন্দ খেয়ে ছুটি পাওয়া৷ কেবল রাস্তায় দাঁড়িয়ে খালি গলায় দুটি গান শুনিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, কেমন লাগছে? আমার খুবই ভাল লাগল— আমি প্রায় inspired৷ যে সময়ের কথা বলছি তখন ঠিক এইরকম ভাবনা ধারায় অর্থাৎ সহজ পথ ধরে অথচ সাংগীতিক ব্যঞ্জনায় এক সুন্দর নির্মাণের তেমন শুরু হয়নি৷ তারপর বললেন, শ্যামলের গলায় কেমন হবে? আমি বললাম, দারুণ৷ গান দুটি কেবল দারুণ নয়,— জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিল৷ গান দুটি হচ্ছে, (১) চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে৷ (২) কার মঞ্জির বাজে রিনি ঠিনি ঠিনি৷

আমার গুরুদেব কবি সন্ন্যাসী শ্রীপরমানন্দ সরস্বতী প্রেমিক মানুষ চিনতে পারার দুটি সূত্র দিয়েছেন— সত্যি কেউ প্রেমিক কিনা তা দেখে বোঝা যায়৷ যেমন যুবতী ও শিশুর মধ্যে দেহগত পার্থক্য থাকে— তেমনি প্রেমিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভেদ রয়েছে৷

‘প্রেমের মানুষ হয় গো যারা৷
আউলা ঝাউলা হয় গো তারা৷’
ভালোবাসা অন্তরের এক মহান অনুভব—
‘মরমখানি বিছিয়ে দে
নেইকো সেজ বিছানা৷’

এই উদ্ধৃতি দিলাম এই কারণে সুধীনদার প্রকাশে এমন কোনও উদাসীন ভাবই ছিল না৷ অত্যন্ত নম্র, সজ্জন, পরিশীলিত রুচিবোধের মানুষ, যোগ্য মর্যাদা সম্পন্ন শৈল্পিক পরিমিতিবোধ তাঁর ছিল অথচ তাঁর প্রেমের গানে প্রেমের যে উচ্চ অনুভাব, বিভাব তা যে কোনও প্রেমের মনকে ঐশীবোধে বিমোহিত করে দেয়৷ আমার মনে আছে একদিন সুধীনদাকে বলেছিলাম— দেখুন আপনার রচিত ‘ক্লান্তি যদি নামে’ ও ‘আকাশে আজ রঙের খেলা’ শোনার সময় আমি মনে করি এ দু’টি আমার রচিত সংগীত না হলে আমি অসুস্থ বোধ করি৷ মন ভেঙে যায়— কারণ এ দু’টির অনুভব আমার অথচ এই সৃষ্টি আমি করতে পারিনি৷ জীবনে একাধিকবার এই দুটি গান গাইতে গাইতে আমি কেঁদেছি৷ ‘ক্লান্তি যদি নামে’ গানের অন্তরাতে ক্রশ লাইনে যখন ‘চেতনা দিয়োগো আমায়’ শব্দটি আসে আমি অভিভূত হয়ে কাঁদি— এই লাইনে প্রেমকে এখানে যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে তা বিস্ময়করভাবে প্রেমের সত্য অবস্থার সার্থক চিত্র৷ আর একটু স্বচ্ছ করে বলি— লাইনটি পুরো এইরকম—

‘জীবন যদি ব্যথায় ভেবে পড়ে যেতে চায়
দিয়ো গান দিয়ো প্রাণ দিয়ো সুর
চেতনা দিয়ো গো আমায়৷’

এই চেতনা কোন নারী দিতে পারে— যে শুধু স্ত্রী নয়, শুধু গৃহিনী নয়, শুধু সহধর্মিণী নয়— যে শক্তি৷ এ একেবারে আমাদের সনাতন শাস্ত্রীয় বাণী বৈষ্ণবীয় মন্ত্রের মতো প্রকাশিত৷ মনে পড়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’ গীতিনাট্যে অর্জুনকে চিত্রাঙ্গদা গ্রহণ করতে যখন রাজি হল তখন যে বলল যদি,

‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি
যদি পার্শ্বে রাখো মোরে সঙ্কটে সম্পদে
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে
পাবে তুমি মোরে চিনিতে মোরে৷’

সুধীনদারও ক্লান্তি যদি নামে গানটি গাইতে গাইতে আমার মন আমার প্রেমিকার চরণে মাথা নুইয়ে দেয়-তখন কাঁদি৷ এমন ‘কান্না আরও কেঁদেছি’, ‘আকাশে আজ রঙের খেলা’র অন্তরার লাইন গাইতে গাইতে ‘অনেক ব্যথায় অনেক ঝড়ে, মনের আকাশ শুধুই ভরে৷’ আর তেমনি চোখে প্রেমের অশ্রু বিগলিত হয়, ‘আমার দিন কাটে না’ শুনে৷ তবে এই গানগুলোর সুর বাণীকে যথাযোগ্যভাবে প্রকাশ করেছে বলেই এই Communication সম্ভব হয়েছে৷ আর সুধীনদা এই সব গানে সুরকে সহজ ও পরিমিত অথচ গভীর ব্যঞ্জনায় এমন প্রকাশ করেছেন যে আমার রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী স্মরণে এসে যায়৷ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, Art-এ থামবার জায়গাটা অত্যন্ত জরুরি— Art is never an exhibition but a revealation. সুধীনদাকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা আমার একটা কথা অনুভব করবেন যে একটি নিপাট ভদ্রলোক— ব্যবহারে পরিমিত, পরিশীলিত, বেফাঁস বাক্য বিনিময় করেন না— এমন একটা Organised মানুষের মধ্যে এত পূজার্হ প্রেমের উপাদান আছে৷ এমনটা খুব কমই দেখা যায়৷ তিনি তো ‘আউলা ঝাউলা’ নয়৷

আমার সুরকার জীবনে অনেকগুলো গানে সুর করতে গিয়ে আমার পরাজয় ঘটেছে৷ মানে একটি গানের বাণী আমি অনেক চেষ্টাতেও সুর করতে পারলাম না— পরে সেটি অন্য একজন এমন সহজভাবে এমন একটি আঙ্গিকে সুর করলেন যে আমায় ভাবতে হল৷ আরে এভাবে, ভাবা যেত কিন্তু আমি কেন পারলাম না৷ তার মধ্যে মান্না দে-র ‘আমায় একটু জায়গা দাও’ও আছে৷ আর সুবীর হাজরা রচিত দুটি গানের বাণী (১) আমার তখন একুশ বছর বয়স৷ (২) সুধীনদা সুরারোপিত, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গীত— ‘একটা গান লিখো আমার জন্যে’৷ একটা অত্যাধুনিক বাণী ব্যঞ্জনায় কি সুন্দর সাবেকি সনাতন সুরকে প্রয়োগ করে একটা আদ্যান্ত আধুনিক নির্মাণ-ভাবা যায় না৷ আমি গানটি শুনলে এখনও লজ্জিত হই— এভাবে কেন আমি বাণীটিকে Scan করতে পারলাম না৷ সুধীনদার সাংগীতিক পাণ্ডিত্য বিস্ময়কর কিন্তু নির্মাণে তিনি অনেক সময়েই বিষয়ের প্রতি আনুগত্যবোধে সহজিয়া৷ না হলে ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর’ বাণীটিকে সুর মারফত এতটা মর্যাদা দিতে পারতেন না৷ শিল্প সৃষ্টির সব থেকে বড় দায় শ্রোতার মনকে বিষয়ের সঙ্গে রস সংযোগ ঘটানো, যে কাজে সুধীনদা এতটাই পারদর্শী যার জন্যে তার অধিক গান জনপ্রিয়৷ তাঁর সব থেকে সফলতা গানকে popular করার দক্ষতায়৷ আর সে কাজে তাঁর আঙ্গিক নির্বাচনের বাহাদুরি তারিফ করার মতো৷ যদি আমরা ‘ডাকহরা’ ছবির গান নিয়ে গবেষণা করি দেখব প্রতিটি গানের পশ্চাতে ভাবনা যথাযথ অথচ সংযত৷ বিদেশি সুরের জ্ঞান, শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যুৎপত্তি অসাধারণ থাকা সত্ত্বেও ডাকহরকরার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরলতার প্রতি তাঁর আনুগত্য সজাগ ছিল অথচ এক একটি গান এক একটি Art form-এ বলা অথচ সবটাই গ্রামীণ সভ্যতার প্রতীকী সংগীত৷ ‘লাল পাগুড়ি বেঁধে মাথে’— গানটি শুনতে শুনতে বীরভূমের লাল রাস্তায় মন ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে উষ্ণ উদাস বাতাস, মনের মধ্যে একটা ভাব, কী যেন নেই, কে যেন নেই৷ অদ্ভুত৷ আর শেষ বিচারের আশায় গানটি শুনলে মনে হয়— জীবন দর্শনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘আমায় বিচার কর তুমি’ গানটির সমগোত্রীয় কিন্তু সুরে তা ভাটিয়ালির বৈরাগ্যে ভরপুর৷ সেখানে কিন্তু বাউলের অভিব্যক্তি পাই না— পাই এক জীবন পথিকের, জীবন পরিক্রমার পর, ক্লান্ত বিবাগী বোধ,— যা শুধু সংগীত নয়, দর্শন৷ আবার কাঁচের চুরির ছটাতে গ্রাম্য Street singer-এর আদবকায়দা আর Commercial ছবি বলে অধিক যন্ত্রে ভারাক্রান্ত না৷ কেবল বাংলা ঢোল আর বাঁশিকে অবলম্বন করে, বম্বে গিয়ে, গীতা দত্তের কণ্ঠে গান গাওয়াতে গিয়ে এই সংযম ভাবা যায় না৷ অন্তত আমি ভাবতে পারছি না৷ এটা সম্ভব হয়েছে সমস্ত ছবিটির আবেগ, আবেশকে আত্মীকরণ করেছিলেন বলে গানগুলো ছবিটির আত্মিক রসায়ণ-এ সহজিয়া সত্যের রসে সিঞ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল৷ আবার যখন ছদ্মবেশীতে বিহারি ড্রাইভারের মুখে গান করলেন তখন বাংলায় বাস করা বিহারি ব্যক্তির মুখে যে গান এল তা হিন্দি ও বাংলার সংমিশ্রণ৷ ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি৷ তাঁর প্রয়োগ শিল্প নন্দন বিভূতি বিধৃত হতে পেরেছে তার কারণ তাঁর শিক্ষার পাণ্ডিত্য তিনি কোথাও ফলাননি— অথচ তিনি যে একজন পূর্ণাঙ্গ শিক্ষিত সংগীত পরিচালক তার প্রমাণ রেখে গেছেন৷

একজন দক্ষ সংগীত পরিচালকের একটা বিশেষ পারদর্শিতা থাকা দরকার যে, সে যেন একটি গান নির্মাণের পর বুঝতে পারে এই গানের শিল্পী কে হলে সেই গানটি সুবিচার পাবে বা উল্টোভাবে এটাও ভাবা একটি শিল্পীর কণ্ঠে গান নির্বাচন করতে গিয়ে সেই শিল্পীর শ্রেষ্ঠ উপাদান কী করে বের করে আনা যায়৷ সেই মর্মে বিস্ময়কর নির্বাচন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’— শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সব গান৷ আর তাঁর আধুনিকতা, সাংগীতিক দক্ষতা, স্বকীয় মুনশিয়ানা, যুগনিষ্ঠতা সব কিছু ধরা পড়ে আরতির কণ্ঠে ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’তে৷ আসলে যে কোনও শিল্প, শিল্প হয়ে ওঠে না যদি না প্রয়োগে তা যথাযথ হয়ে ওঠে৷ এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বাণী অনুধাবনীয়৷ ‘কমল হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার৷’ বড় বড় দক্ষ বিদগ্ধ স্রষ্টাদের মধ্যে সবারই এই গুণ আছে না হলে সে মৌলিক হতে পারে না৷ যারা শিক্ষাকে পুরাতন করে রাখতে চায় তারা শিক্ষার শত্রু যারা শিক্ষাকে সনাতনভাবে, স্রোতে চলমান রাখে আগামীর দিকে তারাই সৃষ্টির সাধক৷ সুধীনদার সাহিত্য কাব্যবোধ, পুঁথিগত শিক্ষার মান, সাংস্কৃতিক রুচিশীলতা ছিল খুব উচ্চ মূল্যবোধে জারিত, যা থেকে সংগীত প্রভূত জারক রস সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে৷ সার্থক স্রষ্টা বলেই পাণ্ডিত্যকে রসে ডুবিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর সাঙ্গীতিক রস সম্ভার সত্য রসায়ণে সার্থক৷

ইউরোপীয় সংগীত ব্যবহারে সলিল চৌধুরির সঙ্গে সুধীনদার একটা basic application-এ আলাদা ছিল৷ আবহ সংগীত রচনার সময় বা গানে orchestration করার সময় সলিলদা যেমন out and out symphonic সুধীনদা তা নয়— তিনি effect-এ বেশি বিশ্বাসী৷ যদি একটা suspense music করতে হয় সুধীনদা uncanny effect দিয়ে করতে ভালবাসতেন এবং হাতের কাছে যা ছড়ানো আছে তা থেকে যদি source পাওয়া যায় সেইটাতেই তিনি বেশি খুশি হতেন৷ যেমন দুটো শিরীষ কাগজ ঘষলে ট্রেনের effect তৈরি করা যায়— সুধীনদার তবে সেটা পছন্দ— সলিলদা চান সেই ট্রেনকে Musically প্রতিষ্ঠা করতে৷ দুজনের দুটো গান দিয়ে বোঝাচ্ছি৷ সুধীনদা উৎপলা সেনের গান করলেন ‘পথের ধারে মুক্তো আমি ছড়িয়ে দিলাম’— কথাটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই accordian-এর একটা swell আছে— যেন মুক্তোগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হল৷ কিন্তু সেই মুক্তোয় কেউ মালা গাঁথল না৷ পরিণতি শ্রোতার ভাবনার স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হল৷ আর সলিলদা যখন ‘যারে উড়ে যারে পাখি’-র interlude-এ saxophone-এর একটা Music with arrangement throw করলেন মনে হল পাখিটা দিগন্তে উড়ে গেল৷ তার হৃদয়ের ভাষায় মনে হল সে Here to eternity-র দিগন্ত পথিক৷ নির্মাতা হিসেবে কে বড় কে ছোট-র প্রশ্ন নেই— কে কীভাবে ভাবতে ভালবাসেন সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করছি৷ যেমন R.D. Burman যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর গানে বিদেশী সুর আদব কায়দা ব্যবহার করেছে তা ইউরোপীয় সিম্ভনি নির্ভর নয়, আধুনিক পপ-এর সমগোত্রীয়৷ এ সব বলে বোঝাতে চাইছি সঠিক মূল্যায়ণের তাগিদে ভালমন্দের নম্বর দেবে কাল তথা ইতিহাস কিন্তু এই তিনজনের কে কীভাবে মৌলিক তা বুঝতে হবে৷

ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত শিল্পীর গান সুধীনদা করেছেন৷ কলকাতা বম্বের ছোট মাঝারি সর্বোচ্চ এমন কোনও শিল্পী বোধহয় নেই যিনি তাঁর গান না গেয়েছেন৷ যিনি বাংলা গানের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করবেন, গবেষণা করবেন, তিনি তাঁর সংগীত সংগ্রহ করে সৃষ্টিশীল অন্বেষণ করলে বুঝবেন বা চিহ্নিত করতে পারবেন বাংলা গানের প্রগতির ইতিহাসে তাঁর জায়গা কতটা৷ স্বল্পায়ু জীবনেও কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি অপরিসীম৷

সুধীন দাশগুপ্তের বোধে নজরুল প্রীতি বেশি ছিল— তিনি রবীন্দ্রপন্থী ছিলেন না— তবু আমি বলব তাঁর নির্যাসে রবীন্দ্র আঙ্গিকের প্রয়োগই আধিক৷ যেমন— আকাশে আজ রঙের খেলা, এত সুর আর এত গান, এই উজ্জ্বল দিন, সাগর থেকে ফেরা, আমি তার ঠিকানা রাখিনি, ডাকহরকরার গান ইত্যাদি বহু সৃষ্টিই নজরুল আঙ্গিকের নয়, রবীন্দ্র আঙ্গিকের৷ অর্থাৎ পর্দার চলনে সিম্ভনিক৷ বাণীর বোধে রবীন্দ্রদীপ্তি৷

সুধীনদা মাঝে মাঝে এক একজন শিল্পীর গান করতে গিয়ে তাঁর পরিচিত চলনকে বদলে নতুন করে রূপ দিয়েছেন৷ এ ক্ষেত্রে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘এই হাসতে মানা’৷ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য একজন খানদানি, শাস্ত্রীয় সংগীত পরিধিতে বিচরণ করা শিল্পী— তাঁর কাছে এই গান নিয়ে পৌঁছনোর বুকের পাটা কারও হত না৷ কিন্তু সুধীনদা তা করেছেন৷ অবশ্য সলিলদা পাশের বাড়িতে প্রথম সেই রক্ষণশীলতা ভেঙেছেন৷ ‘এই ঝির ঝির বাতাসে’ গানে৷ তবু সেখানে গানের বাণীর শব্দ চয়নে সনাতন ভাবেশব্দ ও তার ভাবব্যঞ্জনা ছিল— কিন্তু হাসতে মানা গান তো এমন একটি গান যা আগামী আঙ্গিক হিসেবে পৌঁছে যায় প্রায় আজকের ব্যান্ড সংগীতের কাছাকাছি৷ আমি মনে করি সতীনাথদার কণ্ঠে ‘এলো বরষা’ও তাই৷ আবার ওই গানটির কথা বলতে হয়— আকাশে আজ রঙের খেলা৷ যখন এই গান নিয়ে আশাজীকে দিয়ে গাওয়ালেন তখন বসে বসে ভাবলাম কি সংযোমী সংগীত রচয়িতা! এতবড় একজন দক্ষ শিল্পীকে পেয়ে আত্মম্ভরী দক্ষতার বা ওস্তাদির প্রকাশ করে বাহাদুরী না দেখিয়ে এমন এক সংগীত রচনা করলেন যা আমার চোখের জল হয়ে গেল৷ রতনে রতন চেনে৷ সুধীনদা তখন গ্রামোফোনে টুকটাক কাজ করছেন৷ বেচু দত্ত প্রমুখ বিদায়ী শিল্পীদের জন্যে আর নব্যযুবক শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের জন্যে (ভাঙা তরীর শুধু এ গান) এই রকমই৷ তখন কিছুটা তার ধর্না দিয়ে কাজ পাওয়ার সময়৷ গ্রামোফোনে তখন ম্যানেজার বিখ্যাত কৌতুকশিল্পী ক্ষিতীশ বসু৷ সলিলদা এসেছেন গ্রামোফোনের রিহার্সাল বাড়িতে— সুধীনদা অনুরোধ করলেন সলিলদাকে কিছু গান শোনবার জন্যে৷ সলিলদা রাজি হলেন এবং দুজনে দোতলায় গিয়ে গান শোনা ও শোনানোর পর্ব শুরু হল৷ বেশ কিছু পরে তাঁরা ওপর থেকে নিচে এলেন৷ সলিলদা তো talent Hunter— তিনি এসে ক্ষিতীশবাবুকে বললেন,— কী করছেন ক্ষিতীশবাবু— এ রকম একজন প্রতিভাবান সুরকারকে কাজে লাগাচ্ছেন না৷ আমি আজই ওর সুরে একটা গান লিখে দিলাম৷ ওকে যোগ্য কাজ দিন৷ সেই গান তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন, ‘চম্পা আমার ওগো শোন’৷ আমরা কাজ শুরু করার কিছু দিন পরই রেকর্ড কোম্পানিতে একটা ধর্মঘট হয়— তারপর কোম্পানি পুনরায় খুললে ম্যানেজার বদল হয়— আসেন স্বনামধন্য গীতিকার পবিত্র মিত্র৷ এই পবিত্রদাই, অন্তরাল থেকে নীরবে এই স্বর্ণযুগ তৈরি করে গেছেন৷ স্বর্ণযুগের তিনিই ছিলেন মূল রূপকার৷ ক্ষিতীশ বসু ‘গাঁয়ের বধূ’, ‘সেই মেয়ে’, ‘অবাক পৃথিবী’ প্রভৃতি দিয়ে যা উদ্বোধন করে দিয়েছিলেন তার বিকশিত, ব্যাপ্ত রূপ দিলেন শ্রদ্ধেয় পবিত্র মিত্র৷ এই পবিত্র মিত্রের সাংগীতিক বোধ ছিল বিস্ময়কর৷ গান, শিল্পী, বিষয় নির্বাচন বোধ ছিল তাঁর ভগবৎ দত্ত৷ তাই সেই অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভব দিয়ে সুধীন দাশগুপ্তকে চিনে নিতে তার একটা নিমেষ মাত্র ব্যয়৷ তারপর যে স্রোতে সুধীন দাশগুপ্ত গা ভাসালেন আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি৷

আমার বিচারে তাঁর নির্মিত ছায়াছবির গানে তাঁর প্রতিভার বিচিত্রতা সব থেকে ভাল বোঝা যাবে তিনটি ছবিকে পাশাপাশি বিচার করলে৷ ‘ডাকহরকরা’, ‘বসন্ত বিলাপ’ আর ‘ছদ্মবেশি’৷ পরপর গানগুলি ফেলছি— কেউ যদি বিচার করেন বুঝবেন একই মন থেকে সৃষ্টি, কিন্তু কারও সঙ্গে কারওর জাতের মিল নেই৷ সবার জাতই চলচ্চিত্রের দৃশ্যানুযায়ী৷ তবু দেখা যাবে যে কোনও দক্ষ সংগীত পরিচালক হলেই তা এভাবে ভাবতে পারত এমন নয়, তাই এ সব ক্ষেত্রে সুধীনদায় স্বকীয়তাই তার কাজকে উজ্জ্বল করেছে৷ বসন্ত বিলাপের গানে আমি Miss Calcuttaর মধ্যে যে প্রাদেশিক সুরের বৈচিত্র্য ব্যবহার, আগুন গানটাকে তিনতালের বন্দিশ, ডাকহরকরার লাল পাগড়ি, কাঁচের চুড়ির ছটা, ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় লোকগীতির প্রভাব আবার ছদ্মবেশির বাঁচাও কে আছ আর ড্রাইভারের গান, আমার দিন কাটে না-র বৈচিত্র বিস্ময়কর ৷ এক এক গান এক এক আঙ্গিকে সৃষ্ট৷ জীবন শিক্ষা ও সাংগীতিক শিক্ষার যথাযথ সহবাসেই এই সব মৌলিক সৃষ্টি৷ যা বৈচিত্র্যে, ঐশ্বর্যে ও সৌন্দর্যে সুধীন দাশগুপ্তরই গান৷

আমি সব সময়েই বলে থাকি ব্যক্তি মানুষের বোধ-নির্বোধ, মানবিকতা, স্বার্থপরতা, প্রেম অপ্রেম সব জড়িয়েই এক এক রূপকারের এক এক প্রকাশ৷ জীবনকে যে সুন্দর করে পায়নি তার রচনা সুন্দর হতে পারে না৷ অনেক গুণী মানুষ আমাদের মধ্যে এসেছেন৷ যাঁদের বেশ কিছু ভাল কাজ করা সত্ত্বেও অন্তিমে জনমানসে স্থায়ী আসন পাননি৷ কিন্তু সুধীন দাশগুপ্ত সত্যিকারের একজন মহান মানুষ৷ মানুষের ভালবাসা ও সম্ভ্রম আদায় করে নিতে তিনি জানতেন৷ যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছে বা যাঁদের সংস্পর্শে তিনি এসেছেন, তাঁদেরই কাছে তিনি কেবল একজন সুদক্ষ সংগীত স্রষ্টাই নয়, এক সুভদ্র, সুরুচিশীল, হৃদয়বান, সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত মানুষ৷ তিনি যেমন পেয়েছেন আমাদের শ্রদ্ধা তেমন ভালবাসা৷ এক ডাকে কাছে এসে গেছেন কিন্তু সম্ভ্রমের দূরত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বজায় রেখেছেন৷

তাঁর দরদি মনের একটি ঘটনা মনে পড়ছে৷ ভাতের হাঁড়ির একটি ভাত টিপলেই যেমন হাঁড়ির সমস্ত ভাতের অবস্থা আয়ত্ত করা যায় তেমনি একটি ঘটনা থেকেই একটি মানুষের পূর্ণ স্বভাব ধরা পড়ে৷

আমার একটা পূজা রেকর্ডিং— শিল্পী শ্রদ্ধেয় শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়৷ যে সময় Key Board ব্যাপারটার আমদানি হয়নি৷ Accordianটার চলই বেশি৷ কলকাতায় তখন দুজন নির্ভরযোগ্য accordian player, একজন V.Balsara আর একজন Y.S-Moolkiey… দুজনেই অন্য দুটি recording-এ engaged৷ সুধীনদা Piano, Piano Accordian, সেতার ইত্যাদি নানা যন্ত্র বাজাতে পারতেন৷ ডাকহরকরা ছবির আবহসংগীত রচনার সময় তাঁর তৈরি Music সেতার বাদক বাজাতে পারলেন না বলে নিজেই বসে গেলেন বাজাতে— এমনই দক্ষ৷ তাঁর কোনও শিক্ষাটাই গোঁজামিল দিয়ে শেখা নয়৷ আর এমনই Culture যে, কোন সংগীতকে কোন রসে ঢাললে একটি বিশেষ গানের অভিপ্রেত রস বেরিয়ে আসবে অথচ সুধীন দাশগুপ্ত এই মৌলিক সত্তার স্বাক্ষরও থাকবে তা অত্যন্ত সজাগভাবে বুঝতেন৷ যাই হোক আমি অনুরোধ করলাম সুধীনদাকে ওই রেকর্ডিং-এ Accordian বাজিয়ে দিতে৷ রাজি হলেন৷ rehearsal-এ জিজ্ঞাসা করলেন— কি music— আমি বললাম গান শুনে আপনি নিজে compose করে নিন৷ আপনাকে আমি music বলতে পারবেন না৷ তিনি compose করলেন৷ সহজ, সরল, almost filler-এর মতো৷ অভিজিতের গান আমি সুধীন দাশগুপ্ত একটু কায়দা করি-এসব পথে হাঁটলেনই না— একেবারে simplified piece rehearsal করলেন৷ পরের দিন চার ঘণ্টা সময় ব্যয় করে দমদমে গিয়ে রেকর্ড করে দিয়ে গেলেন৷ music composition থেকে record পর্যন্ত কোথাও অনুজের ওপর অগ্রজের অহঙ্কারকে চাপিয়ে দেননি৷ তাঁর স্বভাবসুলভ পরিমিতি বোধের আঙিনায় নিজেকে বেঁধে রেখে কেবল একজন নিষ্ঠ বাদকের ভূমিকা পালন করে গেলেন৷ এ কেবল শিক্ষার জৌলুস নয় শিক্ষণীয় বিষয়৷ এই একই কাজ— সলিলদার একটি recording-এ সলিলদা ও সুধীনদা হারমোনিয়মে করেছিলেন৷ এইসব আন্তরিক বিনিময় শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতির কথা যখন ভাবি, ভাবি এই সময়টা কত দরিদ্র আর আমরা ছিলাম কত ধনী৷

জীবন চললেই কিছু ত্রুটি থাকে৷ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাই৷ সেইজন্যে বিচারের আঙিনায় গুণগুলোকেই সংগঠিত করতে হয়৷ সেই বিচার থেকেই আমি মনে করি আর পাঁচজন বাংলা সংগীত নির্মাতার মতো, বাংলা গানের ইতিহাসে সুধীন দাশগুপ্তর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷ মান্না দে আরতি মুখার্জির জীবন পরিচয়ের অনেকটাই ফাঁক থাকবে যদি তাঁদের নামের সঙ্গে সুধীন দাশগুপ্ত নামটি জড়িয়ে না থাকে৷ সেই সময়ের বেশির ভাগ শিল্পী, সুরকাররা চলে গেছেন কিন্তু সুধীনদার কম বয়সে অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়া কোনও দিনই মেনে নিতে পারিনি৷ আজও পারি না— যতদিন বেঁচে থাকব পারব না— আমায় যে বড় ভালবাসতেন নিজের ভাইয়ের মতো৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *