1 of 2

জননী – বিমল কর

জননী – বিমল কর

আমরা ভাইবোনে মিলে মার পাঁচটি সন্তান। বাবা বলত, মার হাতের পাঁচটি আঙুল। সবার বড় ছিল বড়দা, মার উনিশ বছর বয়সের ফল। প্রথম বলে বড়দা মার সেই বয়সের রূপ যতটা পেরেছিল পুঁটলি বেঁধে নিয়ে জগতে এসেছিল। শুনেছি, ঠাকুরমা বলত, অত রঙ অমন মুখ চোখ নিয়ে যদি এলি, তবে দাদু মেয়ে হয়ে এলি না কেন?

ঠাকুরমার ক্ষোভ বছর দুয়েক পরে মা মিটিয়ে দিল। এবার এল বড়দি। বড়দা পুরুষমানুষ বলে ওপর ওপর থেকে মার রূপ চুরি করেছিল, বড়দি মেয়ে বলে আমাদের মার অন্তর থেকে সব যেন শুষে নিয়ে ঠাকুরমার কোলে এসে পড়ল।

নয়নের মণির মতন করে ঠাকুরমাবুড়ি বড়দিকে তিনটি বছর আগলে আগলে রেখে, লালন-পালন করে, ঝুলনপূর্ণিমাতে মারা গেল। বুড়ি মারা যাবার সময় আমাদের তিন বছরের বড়দিকে মরণের ঘোরে রাধাকৃষ্ণের গল্প শোনাচ্ছিল। শোনাতে শোনাতেই স্বর থেমে গেল।

আমরা এ-সব গল্প মা-বাবার কাছে শুনেছি। বাবাই বেশি বলত। বাবারই অতীত-মোহ অতিরিক্ত ছিল।

বড়দির পর আমাদের মেজদা। মেজদা বাবার মতন। অবিকল বাবার মুখের আদল তার। সেই রকম লম্বা লম্বা হাত। গায়ের রঙ একটু তামাটে।

ছোট আর আমি মাত্র দেড় বছরের এদিক-ওদিকে জন্মেছি। ছোটকে আমি দিদি বলিনি কোনোকালে, আজও বলি না। ছোট আমাকে ছেলেবেলায় ‘কড়ে’ বলত—মানে কনিষ্ঠ। তার খেপানো ডাক থেকেই আমার ডাকনাম কড়ি হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের সংসারে প্রথম শোক এল বড়দির বিয়ের পর। তার স্বামী খারাপ রোগে ভুগছিল। বড়দির প্রথম ছেলেটা হল নাকভাঙা, বিকলাঙ্গ। মরে গেল। পরে আরও একটা পেটে এসেই নষ্ট হয়ে গেল। স্বামীর রক্তে কোন রোগের পোকা বংশবৃদ্ধি করেছে, ততদিনে বুঝতে পেরে গিয়েছে বড়দি। নিজেও ভুগছিল। একদিন স্বামীকে ঘরের মধ্যে পুরে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে বড়দি চলে এল, আর স্বামীগৃহে যায় নি।

বড়দির পর, দ্বিতীয় শোক, মেজদার অন্ধ হওয়া। মেজদা দানাপুর যাচ্ছিল কাজে। ট্রেনে বড় ভিড়। যাত্রীরা ঢোকার দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। মেজদা পান কেনার জন্যে জানলা খুলে পানঅলা ডাকছিল। একদঙ্গল বেহারীকে আসতে দেখে গোলমালের ভয়ে কাঁচের জানলা নামিয়ে চুপ করে বসে থাকল। তারা প্রথমে দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করল, পরে জানলার কাছে এসে ক্ষিপ্তভাবে কি বলছিল। কামরার লোক মেজদাকে জানলা খুলতে বারণ করল। তখন খুব আচমকা বাইরে থেকে একটা লোক তার টিনের সুটকেস জানলায় ছুঁড়ে মারল। কাঁচ ভেঙে তার ধারালো ফলা মেজদার চোখে মুখে ঢুকে গেল, রক্তে তার সর্বাঙ্গ লাল হল।⋯হাসপাতালে একটানা ছ’মাস কাটিয়ে বেচারী মেজদা ফিরে এল বাড়িতে, তার দু’চোখ সেই নির্বোধ সুটকেসঅলা অন্ধ করে দিয়ে ভিড়েই মিশে থাকল।

আমাদের তৃতীয় শোক, বাবার মৃত্যু। বাবা সন্ন্যাসরোগে মারা গেল। মার কাছে বাবা স্নান করছিল। অল্প অল্প জ্বর ছিল গায়ে। মা ঈষদুষ্ণ জলে বাবার গা ধুইয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছিল ; বাবা মার কোলের ওপর হঠাৎ শুয়ে পড়ে কি বলতে গেল, পারল না ; মৃত্যু এসে বাবার মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা থামিয়ে দিল। বাবা তৈরি ছিল, চলে গেল।

বাবার মৃত্যুর বছর দুই পরে আমাদের চতুর্থ শোক এল। ছোট বড় জেদী। চিরকালই সে যখন যা ঝোঁক ধরেছে, করতে গেছে। আমি তাকে কত বলেছি, ওভাবে জেদ ধরে কাজ করতে যাস না। তুই সব পারবি এমন কোনো কথা নেই।⋯আমার কথা ছোট গ্রাহ্য করত না। তার ধারণা ছিল, সে চেষ্টা করলে সব পারে। ছোট এ-সব বুঝত না। বুঝতে চাইত না। অকারণে সে মেতে থাকত। তার কাজের অন্ত ছিল না, খাওয়া-দাওয়া বিশ্রামের বালাই ছিল না। সকালে মিশনারিদের অনাথ-আলয়ে গৃহিণীপনা করত, দুপুরে বড়দির সঙ্গে শখের চাকরি করতে যেত স্কুলে, বিকেলে আর সন্ধেবেলায় ফুলবাজারের সেই ঝুপসি ঘরটায় লণ্ঠনের টিমটিমে বাতির আলোয় বসে ওর দলের ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে রাজনীতির কাজ করত।⋯একদিন ছোট বুঝতে পারল, তার বয়সে যতখানি জীবনীশক্তি স্বাভাবিক, তার অনেক বেশি সে অত্যন্ত হঠকারীর মতন ব্যয় করেছে। এখন তার জীবনের কলসি প্রায় ফাঁকা। ডাক্তারবাবু স্পষ্টই বলে দিল, আর ওঠাচলা নয়, বেশি কথা বলাও না। বিছানায় শুয়ে থাকা। ইঞ্জেকশান ওষুধ, ভাল ভাল খাওয়া আর চুপ করে পড়ে থাকা। ছোট বলল, তাহলে আমি মরে যাব। জবাবে ডাক্তারবাবু বলল, দেখা যাক⋯।

সেই থেকে ছোট বিছানায়। বছর পুরো হয়ে গেছে। আরও কিছুদিন থাকতে হবে।

আমাদের সংসারে পঞ্চম শোক এসেছে সদ্য। মা মারা যাবার পর। এই ফাল্গুনের গোড়ায় মা চলে গেল। মার মাথার চুল সাদা হয়েছিল, গালের চামড়া দুধের জুড়ানো সরের মতন কুঁচকে এসেছিল। কপালভরা দাগ আর আধপাকা ছানি চোখ নিয়ে মা বিদায় নিল। যাবার সময় দেখে গেল তার হাতের পাঁচটি আঙুলই একে অন্যের পাশে রয়েছে।

তখনও সকালে হিম পড়ে। আমাদের দোতলার বড় বারান্দা শিশিরে ভিজে রয়েছে। সূর্য ওঠে নি, রঙ ধরেছে সবে ; মার বিছানার চারপাশে আমরা পাঁচজনে দাঁড়িয়ে, মা চলে গেল।

বড়দা আগেই বলেছিল, আমরা বারোয়ারি শ্মশানে মাকে নিয়ে যাব না, আমাদের বাড়ির বাগানে দাহ করব, পরে সেখানে একটা বেদী করে রাখব।

বিঘে খানেকের ওপর জমি নিয়ে আমাদের দোতলা বাড়ি। পাঁচ বিঘের বাগান। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

উত্তরের দিকে যেখানে করবীর ঝোপ, স্থলপদ্মর রাশীকৃত গাছ, ঘাসের জঙ্গল—সেই দিকটা মাকে দাহ করার জন্যে আমরা বেছে নিয়েছিলাম। ঘাস জঙ্গল পরিষ্কার করে কদম গাছটাকে মাথার কাছে রেখে মার চিতা তৈরি হল, পাশে বুড়ো কাঠচাঁপা দাঁড়িয়ে থাকল—আমাদের বাবার মতন দেখাচ্ছিল তাকে। তারপর মার দাহ হল।

যখন আগুন তার অকলুষ শিখা বিস্তার করে মার শরীর আগলে রেখেছিল, তখন আমি আমাদের পাঁচজনকে দেখছিলাম। বড়দা খানিক রোদে খানিক ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে চিতার দিকে তাকিয়ে ছিল, মাঝে মাঝে কি বলছিল ; বড়দি কদমতলায় মাটিতে গালে হাত দিয়ে বসে ছিল ; মেজদা বড়দির পাশে আসন-পা করে বসে দু’হাত বুকের কাছে, —তার অন্ধ চোখ চিতার দিকে ; কাঠচাঁপার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ছোট ফোলা ফোলা মুখ করে বসে; আমি ছোটর কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

ছোট এক সময় বলল, ‘এখন কি জল খেতে আছে রে, আমার বড় তেষ্টা পেয়েছে।’

আমি কিছু জানতাম না। বললাম, ‘এখন না। আর খানিকটা পরে খাস।’

এখন চৈত্র মাস। চৈত্রর শুরু সবে। মার শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছে। যে জায়গায় আমরা আমাদের মাকে দাহ করেছিলাম, সেই জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারপাশটা যেন নিকোনো। শ্রাদ্ধর পর পরই আমরা ওখানে সুন্দর করে বেদী করেছি। কাশীর সাদা পাথর দিয়ে বেদীটা মোড়া। এখনও যেন কাঁচা গন্ধ লেগে আছে ওর গায়ে। হাত রাখলে মনে হয় ঠাণ্ডা লাগছে ; নরম মসৃণ স্পর্শ।

মাসান্তে আমরা এই বেদীতে বসে ছিলাম। বেদীর মাথার দিকে ছোট একটু কুলুঙ্গির মতন, বড়দি সেখানে প্রদীপ এবং ধূপ জ্বেলে দিয়েছিল। বাতাসের ঝাপটা লাগছিল না বলে দীপের শিখাটি জ্বলছিল, অগুরু-চন্দনের ধূপ পুড়ে পুড়ে খুব ফিকে একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছিল। আর শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা বলে চাঁদের আলোয় সাদা বেদীটা ধবধব করছিল।

আমরা পাঁচজনে বেদীর ওপর বসে।

বড়দা বলল, ‘আমরা যতদিন বেঁচে আছি, মাসের এই দিনটিতে সবাই একসঙ্গে এখানে এসে বসব।’ বলে একটু থামল বড়দা, বড়দির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আবার, এই পরিবারের এটাই নিয়ম হল। কি বলিস, অনু।’

অনু বড়দির ডাক নাম। পুরো করে অনুপমা। ছোট-র নাম নিরুপমা। বড়দির সঙ্গে মিল করে রাখা। বড়দি মাথা নেড়ে বড়দার কথায় সায় দিল ; বলল, ‘বাবার বেদীটাও যদি আমরা করে রাখতাম!’ বড়দির গলায় আক্ষেপের সুর।

বড়দির আক্ষেপ খুবই সঙ্গত। কিন্তু তখন তো আমাদের মাথায় এবুদ্ধি আসে নি। মাও কিছু বলে নি।

বড়দা কয়েক দণ্ড আকাশের দিকে চেয়ে থাকল, তারপর নিশ্বাস ফেলল মুখ নামিয়ে। বলল, ‘খুবই ভাল হত। তবে, মা রাজি হত কিনা কে জানে।’

‘রাজি হত না!’ বড়দি বেশ অবাক হয়েছিল যেন, ‘কেন? মা কেন রাজি হত না?’

‘হত না হয়ত।’ বড়দা সন্দেহের গলায় বলল। ‘সবাই এসব পছন্দ করে না। সংস্কার। আমরা বোধ হয় অনেক কিছু পুরোপুরি অগোচরে রাখতে চাই।’

মেজদা হঠাৎ কথা বলল। আমরা তাকালাম। তার অন্ধ চোখ একদিকে স্থির রেখে মেজদা বলল, ‘শ্মশানে পুড়িয়ে আসার সময় আমরা কি ভাবি জানো, দিদি?’

‘কি?’

‘অনেকের মধ্যে দিয়ে এলাম। যেন সঙ্গীসাথীর মধ্যে।’

‘মরার পর আবার সঙ্গীসাথী কি?’ ছোট বলল।

‘কিছু না। মানুষ তবু ভাবে।’ মেজদা উদাস গলায় বলল। ‘তুই জানিস না ছোট, কত মানুষ মৃত্যুর পর আত্মার অবস্থাকে তীর্থযাত্রা কল্পনা করে নেয়।’

আমরা সকলে মেজদার দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। মেজদার গলার স্বর গোল ও নিটোল। বাঁশের আড়বাঁশির মতন মেঠো। এই স্বর শুনলে অনুভব করা যায়, মেজদার গলার সবটুকু অন্তর থেকে এসেছে। মেজদার কথাবার্তাও অন্যরকম। আমরা মনে মনে অহরহ কথা বলি, মুখে নয়। মনের সেই শব্দহীন বাক্যস্রোত যদি শব্দময় হয়ে ওঠে এইরকম শোনাবে হয়ত, মেজদার কথার মতন।

বড়দি বলল, ‘তুই স্বর্গের কথা বলছিস, দীনু!’

মেজদার নাম দীনেন্দ্র, ছোট করে দীনু। বড়দির কথায় মেজদা আলগা করে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না দিদি ; স্বর্গ তো শেষ কল্পনা। আমি এই মর্ত্যের পর স্বর্গের আগে যে-পথ তার কথা বলছি।’

‘সেটা আবার কি?’ ছোট বলল অবাক হয়ে, ‘মাঝপথের কথাও মানুষ ভাবে?’

‘ভাবে। যত ভাল করে ভেবে নিতে পারা যায় ততই ভাল রে, ছোট।⋯আমি রাঁচির দিকে মুণ্ডা না মুঙরীদের গ্রামে এক বাড়িতে ছবি দেখেছিলাম একটা।’

‘ওদের কথা বাদ দাও।’ ছোট বলল।

‘বাদ কেন, শোন না।’ মেজদা যেন অন্ধ চোখে জ্যোৎস্না মেখে সামান্য মুখ ফেরাল। বলল, ‘মাটির বাড়ি, বাইরের দেওয়ালে রঙ গুলে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি আঁকা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাচ্চাটা চলেছে, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে লাগাম ; কাঁধে খাবারের পুঁটলি, মাথায় তেষ্টা মেটাবার জন্যে জলের ঘটি রাখা।⋯ওই ছবির মানে বলে দিল ফরেস্টবাবু। ও-বাড়ির ছেলে মারা গেছে, তাই ওই ছবি।’

‘আ-হা—’বড়দি দুঃখ পেল।

মেজদা বলল, ‘মানেটা তুমি শোন, দিদি। বড় অদ্ভুত লাগে ভাবতে, ওরা বিশ্বাস করে নিয়েছে মৃত্যুর পর তাদের ছোট ছেলেটিকে একা একা অনেক দূর যেতে হবে। তাই তাকে বসিয়ে দিয়েছে ঘোড়ায়, হাতে দিয়েছে লাঠি, পুঁটলিতে বোধ হয় চিঁড়ে গুড়, আর মাথায় তেষ্টা মেটাবার জল।’

স্নেহ মমতা, ইহলোকের মায়া ও দুঃখ, পরলোকের দুর্ভাবনা—সব যেন এই ছবিতে মহৎ ও সুন্দর হয়ে কল্পিত ছিল। আমি অভিভূত হলাম। জ্যোৎস্নার ধারার মতন আমার কল্পনা সেই ছবি গায়ে আলো বর্ষণ করছিল।

অনেকক্ষণ বুঝি কেউ কোনো কথা বলল না আর। চৈত্রের চঞ্চল বাতাস বাগানের তৃণ এনে আমাদের গায়ে মাথায় ফেলে দিচ্ছিল। বেদীতে আমাদের পাঁচজনের ছায়া ; পরস্পরকে স্পর্শ করে যেন ছায়ার একটি আশ্চর্য রকম জাফরি তৈরি হয়েছে। চাঁদটা সমুদ্রের জলের মতনই নীল অনেকটা। পর্যাপ্ত জ্যোৎস্না। মার বেদীর মাথার কাছে সেই বৃন্দাবনের কদম্ব গাছ। মার পাশে বুড়ো কাঠচাঁপা।

কদম গাছটার বয়স আমার সমান। বৃন্দাবন থেকে এনেছিল বাবা। এখনও বর্ষায় ফুল ফোটে।

বড়দি প্রথমে নিশ্বাস ফেলল। বড়দার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার গা-টা একটু দেখ তো দাদা ।’

‘কেন রে, কি হল?’ বড়দা উদ্বেগের গলায় বলল, বলে বড়দির গা দেখল। ‘কই না, ভালই তো ।’

‘আমার গায়ে কেমন কাঁটা ফোটে। বড়দি নিজের গায়ের শিহরন প্রশমিত করছিল। সামান্য চুপ করে থেকে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমায় যদি কেউ মার হাতে কিছু দিতে বলে, কি দেব রে⋯!’ বড়দি আমাদের প্রত্যেকের মুখে একে একে তাকাল, তারপর কেমন করে যেন মাথা নাড়ল, বলল, ‘জানি না। কি দেব মার হাতে কে জানে!’

কথাটা আমাদের কানের পাশ দিয়ে ভেসে যেতে যেতে হঠাৎ যেন ঘুরে দাঁড়াল। আমাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হল। সহসা অনুভব করলাম আমরা বিহ্বল হয়েছি।

‘মার হাতে কি দেব— ’এই প্রশ্ন আচমকা বড়দি আমাদের সামনে ধ্বনিকার মতন নিক্ষেপ করল। আমরা অসংবিৎ ও বিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম। তারপর ক্রমশ বড়দির কথার পরিপূর্ণ মর্ম আমাদের হৃদয়ে অনুভব করতে পারলাম।

সমূলে সচকিত হবার মতন আমরা শিহরিত ও কম্পিত হয়ে দেখলাম, এই প্রশ্ন যেন আমাদের সমস্ত বোধ অধিকার করেছে। আমরা কি দেব, কি দিতে পারি মাকে? ⋯মনে হল, এই অদ্ভুত প্রশ্নে আমরা আমাদের সম্মিলিত বোধ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছি। যে কোনো ভয়ঙ্কর পর্বতচূড়ায় এনে কেউ আমাদের পরস্পরের দেহের সঙ্গে বাঁধা দড়ি কেটে দিয়েছে, আর আমরা বাই চুড়ার অন্তিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।

স্তব্ধ নিঃসাড় হয়ে আমরা বসে থাকলাম। চাঁদের আলো কদম গাছের ছায়াটিকে বেদীর সামনে শুইয়ে রেখেছে। করবীঝোপে বাতাস যেন ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে কেটে যাচ্ছিল, শব্দ হচ্ছিল পাতার। আমরা আমাদের ছায়ার নকশা থেকে চোখ তুলে কখন যে শূন্যে দৃষ্টি রেখেছি কেউ জানি না।

বড়দাই প্রথমে কথা বলল। মার কোলে বড়দাই প্রথম এসেছিল, বড়দাকে দিয়েই মার মাতৃত্ব শুরু, হয়ত তাই বড়দা এই নীরবতা এবং অপেক্ষা প্রথমে ভাঙল, যেমন করে মার সন্তানকামনার অপেক্ষা ভেঙেছিল।

‘অনু কিন্তু কথাটা মন্দ বলে নি।’ বড়দা ধীরেসুস্থে নরম গলায় থেমে থেমে বলতে লাগল, ‘আমরা কেউ মৃত্যুর পরটর বিশ্বাস করি না, তবু ভাবতে ভাল লাগছে আমাদের মা দীনুর গল্পর মতন দীর্ঘ পথ হেঁটে যাবে। আমরা মার জন্যে কে কি দিতে পারি?’

আমরা প্রকৃতপক্ষে ওই একই চিন্তা করছিলাম। মার সেই দীর্ঘ অন্তহীন পথযাত্রায় আমরা মাকে কি সম্পদ দিতে পারি?

বড়দা দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেলল ; কদমছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড, তারপর মুখ তুলে বলল, ‘কি যে দেব, আমিও ভেবে পাচ্ছি না।’ বড়দার গলার স্বর বিষন্ন উদাস। বড়দিকে দেখল বড়দা, কাঠচাঁপার বুড়ো গাছটাকে অন্যমনস্ক ভাবে লক্ষ করল। ‘মার অনেক দুঃখ ছিল, অনেক। আমি সব দুঃখের কথা জানি না। একটা দুঃখ জানি, আমায় নিয়ে।’

আমার মনে হল বড়দা ঠিক আমার মতন করেই ভাবছে। এ-সংসারে মা কি পায় নি, কি অভাব তার ছিল, কি পেলে মার সে-অভাব থাকত না, আমরা এখন তাই ভাবছিলাম। মার এই পরবর্তী যাত্রায় আমরা বোধ হয় মাকে সেই জিনিস দিতে চাইছিলাম যা এখানে দিতে পারি নি।

‘সে-রকম দুঃখ তো আমার জন্যেও মার ছিল।’ ছোট বলল বড়দাকে লক্ষ করে।

‘আমাদের সবায়ের জন্যেই ছিল।’ বড়দা জবাব দিল।

‘তাহলে কি আমরা মার হাতে সেই দুঃখগুলো আর দিতে চাই না?’ ছোট অসহায়ের মতন শুধালো।

‘তা ছাড়া আমরা আর কি দিতে পারি! ⋯’ বড়দা ছোটর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চাল কলা জল আমাদের মার দরকার নেই। মাকে যদি আমরা সেই মনের জিনিসগুলো দিতে পারি, এখানে যা পারি নি—মার কাজে লাগবে।’ ‘কাজ’ শব্দটা বড়দা টেনে বড় করে উচ্চারণ করল।

আমি মনে মনে বড়দার কথায় সায় দিলাম। মাকে আমরা অন্য কিছু দিতে পারি না।

‘তুই তো জানিস, অনু—’ বড়দা বড়দিকে লক্ষ্য করে কথা শুরু করল, ‘আমি বিয়ে করি নি বলে মার মনে মনে বড় দুঃখ ছিল। অভিমানও। মার কি সাধ ছিল আমি জানি। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল না।…আমার জন্যে মা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছিল, বাবা সেই মেয়েকে আশীর্বাদ করতে যাবে বলে ঠিক করেছিল, আমি অমত করায় আর ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত গড়ায় নি।’

‘তুমি অমত করলে কেন?’ আমি বড়দার ওপর যেন অপ্রসন্ন হয়ে বললাম।

‘কেন করলাম—!’ বড়দা আমার দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল। পলক ফেলল না। তারপর অতিশয় স্নিগ্ধ হয়ে বলল, ‘আমার বন্ধু অবনীর সঙ্গে সেই মেয়েটির ভাব ছিল।’

‘তা হলে সন্দেহ?’ ছোট যেন বিরক্ত হল।

‘না রে, সন্দেহ নয়। মেয়েটিকে অবনী ভালবাসত।’ বড়দা শান্ত গলায় বলল, ‘মাকে আমি বলেছিলাম। মা বলেছিল, কিন্তু কনক যে অপরূপ সুন্দরী। এ-মেয়ে এলে আমার বংশধররা কত সুন্দর হবে ভেবে দেখ।’ কয়েক দণ্ড থেমে বড়দা যেন মার সঙ্গে তার সেই কথোপকথন স্মরণ করল, তারপর বলল, ‘আমি সৌন্দর্য ভালবাসি, কিন্তু ভালবাসা আরও বেশি ভালবাসি।’ অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। বেদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘মা এই কথাটা কেন যে বুঝল না!’ বড়দা আক্ষেপের গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছিল তার কোনো পুরনো প্রদাহ সে আজ অত্যন্ত ব্যথার সঙ্গে আবার অনুভব করছে। অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বড়দা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, মৃদু গলায় টেনে টেনে বলল, ‘আমি মাকে আমার সেই ভালবাসার মন দিতে পারি।’

বড়দা নীরব হলে সাদা বেদীটার গায়ে চাঁদের আলো ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে মলিন হল সামান্য।

আমরা নির্বাক বসে থাকলাম। চৈত্রের বাতাস করবীঝোপের তলা থেকে ধুলোর গুঁড়ো এনে মাখিয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে একটা টাঙা যাচ্ছে, টাঙাঅলার পায়ে-টেপা ঘন্টি বাজছিল। কদম গাছের ছায়া একটু যেন হেলে গেছে।

‘তা হলে আমিও বলি—’বড়দি বলল। বড়দার পর বড়দিরই বলার কথা। আগে বড়দি দিশেহারা হয়ে বলছিল সে কি দেবে জানে না ; এখন বড়দার কথার পর বড়দি মন স্থির করতে পেরেছে ।

বড়দি কি দেয় শোনার জন্যে আমরা সকলে মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম। জ্যোৎস্না আবার স্পষ্ট হয়েছে। চন্দ্রকিরণে বড়দিকে রেশমের মতন নরম মসৃণ দেখাচ্ছিল। হাঁটু ভেঙে একপাশে হেলে বসেছিল বড়দি, তার হাতে সরু দু-গাছা করে সোনার চুড়ি, সাদা হাতে মিনের কাজের মতন চুড়ি দুটো চকচক করছিল।

অল্প সময় ইতস্তত করে বড়দি বলল, ‘আমি অমন করে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি বলে মা কোনোদিন খুশি হয়নি। তুই তো জানিস দাদা, মা তোকে কতবার সেই লোকটার কাছে যেতে বলেছে। কেন বলত! বলত যাতে তুই তাকে ভুলিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনতে পারিস।’ সোজা হয়ে বসে নিল বড়দি, বাঁ হাত গলার কাছে নিয়ে গিয়ে তার মটর-হারে আঙুল রাখল। ‘বাবাকেও মা বুঝিয়েছিল, আমি ওখান থেকে চলে এসে ভুল করেছি, অন্যায় করেছি। বরং চেপে বসে থাকলে তাদের জামাইকে শুধরে নিতে পারতাম।⋯মা আমায় বলত, এই তেজ দেখিয়ে তুমি তোমার ক্ষতি করলে। সারা জীবন পুড়বে।’

‘তুমি তো আজও মাঝে মাঝে কাঁদ, বড়দি।’ ছোট আচমকা বলল।

বড়দি ছোটর দিকে তাকাল। ভাবল যেন। বলল, ‘কাঁদি—’ আস্তে মাথা নাড়ল বড়দি, ‘কাঁদি, মা কেন আমায় আবার বিয়ে করতে বলল না।’

‘তোমার কি আবার বিয়ে করার সাধ ছিল?’ আমি অবাক হয়ে বড়দিকে দেখছিলাম।

‘হ্যাঁ, মা-বাবা যদি বলত, আমি আবার বিয়ে করতাম।⋯চামড়ার ব্যবসাদার সেই লোকটাকে ত্যাগ করে এসে আমি শুধু নিজেকে বাঁচিয়েছিলাম, কিন্তু আমার দরকারটুকু তো পাই নি।’

‘তোমার আবার বিয়ে করা খুব সহজ ছিল না, বড়দি।’ ছোট বলল।

‘না হয় কঠিনই ছিল। তাতে কি!. ⋯’ বড়দি যেন দ্বিধা বোধ করে থামল, তারপর বলল, ‘সংসারে এমন মানুষ ছিল যে আমায় বিয়ে করত।⋯মার সাহস হল না।⋯একদিন আমি মাকে বলেছিলাম, রোগ নোঙরামি কষ্ট সব সহ্য করি তাতে তোমার আপত্তি নেই ; আপত্তি সুখ পাবার ব্যবস্থা করতে। মা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল, বলেছিল—এ-বাড়ির মর্যাদা নষ্ট হোক এমন কিছু করতে আমি দেব না।⋯মা মর্যাদা চাইত, আমি সাহস চাইতাম।’ বড়দি সামান্য থামল, তার সমস্ত শরীর রেশম দিয়ে মোড়া সাজানো পুতুলের মতন দেখাচ্ছিল, ভাঙা হাঁটু, মাটির ওপর ভর করা হাত ; নিশ্বাস ফেলে বড়দি বলল, ‘মাকে আমি মানুষের উচিত সাহস দিতে পারি নি। মা যেন সেই সাহস পায়।’

কথা শেষ করে বড়দি আকাশের দিকে চোখ তুলল। আমরা স্তব্ধ। চৈত্রের বাতাস এসে কদমের কয়েকটি শুকনো পাতা ফেলে গেল, চাঁদের আলোয় একটা কাঠবেড়ালি কাঠচাঁপার ডাল বেয়ে এগিয়ে এসে আবার ছুটে পালাল।

বেদীর কুলুঙ্গির মধ্যে প্রদীপটা অকম্পিত জ্বলছে। ধূপধুনো ফুরিয়ে গেছে। আমরা আর গন্ধ পাচ্ছিলাম না।

এবার মেজদার পালা। আমরা মেজদার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। মেজদা কিছু বলছিল না।

ছোট মেজদার গায়ে হাত দিল। ‘মেজদা—তুমি?’

মেজদা মাথা নাড়ল। ‘এখনও কিছু ভেবে পাই নি। তোরা বল। তুই বল, ছোট।’

ছোটর স্বভাবই আলাদা। তার অত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবনা নেই। ছোট একবার প্রদীপের দিকে তাকাল, একবার আকাশের দিকে। খুকখুক করে কাসল ক’বার, তারপর বলল, ‘এত অল্প বয়সে আমার এমন একটা বিশ্রী অসুখ করল বলে মা বেচারী বড় কষ্ট পেয়েছিল। ভাবত, আমি আর বাঁচব না। আমিও প্রথম প্রথম সেই রকম ভেবেছি। মা বলত, তুই নিজে ইচ্ছে করে এই অসুখ বাধালি। কী বোকার মতন কথা বল তো বড়দি! অসুখ কি কেউ ইচ্ছে করে বাধয়—! না অসুখে সুখ আছে—!’ এক দমকে কথা বলছিল ছোট, বলতে বলতে থামল ; মনে হল সে কোনো কিছু না ভেবেই কথা শুরু করেছিল, তারপর খেই হারিয়ে ফেলেছে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমরা চুপ করে থাকলাম। ছোট একটু যেন অপ্রস্তুত হল। মাথার বেণী বুকের কাছে টেনে আঙুলে জড়িয়ে দু-চার বার দোলালো। ছোটর গায়ে হালকা রঙের একটা শাড়ি, গায়ে অর্ধেক-হাত জামা। ছোটর কপাল ছোট ; দু-পাশের চুল তার প্রায় সবটুকু কপালই ঢেকে ফেলেছে। নাকটি লম্বা ; চোখ দুটি খুব কালো। ছোটর হঠাৎ থেমে যাওয়া, হঠাৎ অপ্রস্তুত বোধ করা এবং এই আপাতচাঞ্চল্য থেকে মনে হল ছোট যেন খেই খুঁজে নেবার চেষ্টা করছে।

আরও একটু সময় নিল ছোট। সে তার কথা খুঁজে পেল। বলল, ‘অসুখ কেউ ইচ্ছে করে বাধায় না, অসুখে সুখ নেই—তাও ঠিক। তবু আমি এই অসুখে পড়ে একটা সুখ পাচ্ছিলাম।⋯তুমি তো জানো বড়দি, অসুখের সময় আমার বন্ধুটন্ধুরা খোঁজখবর নিতে আসত। বেশি আসত সুশান্ত, প্রায় রোজই। অনেকক্ষণ থাকত। আমায় ভোলাবার চেষ্টা করত, বলত, এ অসুখ কিছু নয়, কিছুই না।⋯মা কেন জানি এটা পছন্দ করত না, একেবারেই নয়।’ ছোট তার দীর্ঘ বেণী কাঁধের ডান পাশে রাখল, আকাশের দিকে তাকাল আবার, তাকিয়ে থাকল,বলল, ‘একদিন মা আমার সামনেই সুশান্তকে বলল, তুমি তো ডাক্তার নও; কেন অযথা ও-সব কথা বল। ওকে বকিয়ো না, বিরক্ত কোরো না।⋯সুশান্ত তারপর থেকে আর আসত না। আমি মাকে বলেছিলাম, অকারণে তুমি ওকে অপদস্থ করলে। মা বলেছিল, ওরা আমার অনেক করেছে, তোমায় মাতিয়ে এই অসুখ দিয়েছে। তা দিক, আর আমার সুখ দরকার নেই।’ ছোট আকাশ থেকে চোখ নামাল, তার গলা পাতলা, কাঁপছিল, চোখ যেন একটু চিকচিক করছে। ও বলল, মা আমার অসুখটাই দেখেছিল, সুখ দেখে নি। মা জানত না, জগতে সব রোগ কেবল ডাক্তার দিয়ে সারানো যায় না। আশা পাওয়া অনেক ; ভরসা পাওয়ার কত শক্তি⋯’ ছোট আমার দিকে তাকাল, ‘আমি মাকে আর কিছু দিতে পারি না, মন ছাড়া, আশা ছাড়া, ভরসা ছাড়া। মা যেন তার মনে ভরসা পায়।’

ছোট নীরব হল। মার বেদীতে কদম-ছায়া উঠে এসেছে। বড়দার পাশ দিয়ে ছায়াটা বড়দির কোলে গিয়ে বসেছে। বাতাবি লেবুর গাছটা অনেক দূরে। তার মাথার ওপর দিয়ে ভাঙা দেওয়ালের ফাঁকে রেল লাইনের বাতি চোখে পড়ছিল আমার। দশরথ ধোপার কুঠিতে ওরা গান গাইছে। গত সপ্তাহে দশরথের ছেলের বিয়ে হয়েছে, আজও থেকে থেকে সেই আনন্দের লহরী তোলে তারা।

খুব যেন ক্লান্ত হয়ে ছোট তার মাথা আমার কাঁধে রাখল। বলল, ‘কড়ি, এবার তোর পালা—’

বড়দা বড়দি আমার দিকে তাকাল। মেজদা তার অন্ধ চোখ অনুমানে আমার দিকে ফিরিয়ে রাখল। সহসা অনুভব করলাম, ওরা আমার হৃদয়ে লুকোনো মার ছবি দেখার জন্যে সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। আমার ভয় করছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কোনো সাক্ষীর বোধ হয় জবানবন্দি দেবার সময় এই রকম ভয় হয়।

এই মুহূর্তে সকলেই স্তব্ধ। চৈত্রের বাতাসও শান্ত হয়ে আছে। দুধের ফেনার মতন জ্যোৎস্নায় আমার চারটি উৎকর্ণ আত্মীয় নিষ্পলকে আমায় দেখছে। বড়দার দিকে তাকিয়ে আমি কথা বলার আয়োজন করছিলাম। বড়দার পাশ দিয়ে বেদীর কুলুঙ্গিতে প্রদীপ চোখে পড়ছিল। শিখাটি স্থির। মার চোখের মতন শিখাটি যেন আমায় লক্ষ করছিল।

‘ভেবে পাচ্ছি না—’ আমি বললাম। আমার মন স্থির নয়, নিঃসংশয় নয়। দ্বিধার গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে আমি বললাম, ‘কখনও মনে হচ্ছে অনেক কিছু যেন দেবার আছে, আবার মনে হচ্ছে কিছু নেই।⋯আমি সব চেয়ে ছোট বলেই মা আমায় তার শেষ গচ্ছিত ধনের মতন করে সরিয়ে রেখেছিল। মানুষ যেমন করে সিন্দুকে অবশিষ্ট অলঙ্কার তুলে রাখে অনেকটা সেইরকম। ব্যবহার করত না, দেখত না।’ কথা বলার সময় ক্রমশ আমার মনে হচ্ছিল আমি ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছি না। গলা কাঁপছিল তখনও, তবু আমার স্বর স্পষ্ট হয়ে এসেছে অনেকটা। ‘তোমরা মাকে যত পেয়েছ, যেমন করে পেয়েছ, আমি পাইনি। আমায় মা আমাদের সংসারকে তেমন করে বুঝতে দেয় নি। ভাবত, আমার এ-সবে দরকার নেই।⋯কিন্তু আমি মাকে দেখেছি।⋯একবার মার সঙ্গে আমায় কাশী যেতে হয়েছিল। তোর মনে আছে ছোট, বাবা মারা যাবার পর, মা একবার আমায় নিয়ে কাশী গিয়েছিল পনেরো-বিশ দিনের জন্যে। তোরা ভেবেছিলি মার মন ভাল নয়, বাবার অভাবে মা বড় কাতর—তাই মা কটা দিন তীর্থর জায়গায় মন জুড়িয়ে আসতে গেছে। হয়ত খানিকটা সেই উদ্দেশ্যেই মা গিয়েছিল কিন্তু সবটা নয়।…’ আমার গলা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমি আর ভীত হচ্ছিলাম না ; আমার মনের সামনে সব স্থির হয়ে গিয়েছিল, যা খোঁজার আমি যেন তা পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রদীপশিখাটি শেষবারের মতন দেখে আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মেজদাকে দেখছিলাম। কাশীতে বাবার এক বন্ধু থাকত। আমি কখনও তার নাম শুনি নি—’

‘শচীন জ্যেঠামশাই?’ বড়দা বলল অবাক হয়ে।

‘হ্যাঁ। তুমি তাহলে জানো!’

‘জানি বই কি। শচীনজ্যেঠাকে আমি কতবার দেখেছি। তুইও দেখেছিস, অনু।’

‘দেখেছি।’ বড়দি মাথা নাড়ল।

‘বাবার সঙ্গেই ব্যবসা করত। তারপর কি হয়, আলাদা হয়ে গেল। পরে আর আমি শচীনজ্যেঠার কথা শুনি নি।’

‘নানা জায়গায় ঘুরে শেষে তিনি কাশীতে গিয়েই শেষ জীবন কাটাচ্ছিলেন।’ আমি বললাম। বলার সময় শচীন জ্যেঠামশাইয়ের কাশীর সংসার আমার চোখে ভাসছিল, স্পষ্ট অনাবৃত। ‘বাঙালীটোলার অন্ধকার গলিতে নরকের মতন ছোট ছোট খুপরি ঘরে ওঁরা থাকেন ; উনি স্থবির হয়ে পড়েছেন, স্ত্রী শ্বাসরোগে শয্যাশায়ী, বড় ছেলে হোটেলের গাইডগিরি করে, দুটি মেয়ে—একটির পা খোঁড়া হয়ে গেছে টাঙা থেকে পড়ে, অন্যটি কোন বাড়িতে যেন রান্নাবান্নার কাজ করে দেয়। ছেলের বউ মারা গেছে দুটি বাচ্চাকাচ্চা রেখে।⋯কাশীর সেই অন্ধকার সরু নোঙরা পাতকুয়োয় একটি অসহায় পরিবার গলা পর্যন্ত ডুবে। মা গিয়েছিল সেখানে বাবার পুরনো কোন ব্যবসায় শচীনজ্যাঠা করে কাগজপত্রে বাবার অংশীদার ছিল সেটা নাকচ করিয়ে আনতে। উনি সে কথা মনেও রাখেন নি, মনে রাখার কথাও নয়। তবু মা আইনে ফাঁক রাখতে রাজি নয়। কে জানে কবে এই গর্ত খুঁড়ে সাপ বেরুবে না।⋯একশো টাকার দু’খানা মাত্র নোট মা শচীনজ্যেঠার হাতে দিয়ে সেই পুরনো অংশীদারী বাতিল করিয়ে নিল ।⋯আমি মাকে বলেছিলাম, তুমি তো অনেক আগেই এটা ওঁদের ছেড়ে দিতে পারতে মা। বাবাও তো কাঠের ব্যবসাটা আর করত না।⋯জবাবে মা বলেছিল, তুমি ছেলেমানুষ, বিষয়আশয়ের কিছু বোঝ না। ওই ব্যবসা অন্যের তদারকিতে দেওয়া আছে, বছরে হাজার দুয়েক টাকা বাড়িতে আসে। টাকাটা আমি অকারণে খোওয়াব! অত স্বার্থত্যাগ আমি শিখি নি।’ আমার গলার শিরা যেন কেউ আঙুলে জড়িয়ে জড়িয়ে টানছিল, সেই যন্ত্রণায় আমি কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারলাম না ; আমার সামনে পিচুঁটিভরা শচীনজ্যেঠার চোখ দুটি ভাসছিল, কী দুর্গতি তাঁর। ‘মা স্বার্থত্যাগ জানত না।’ আমি চাপা গলায় বললাম, ‘মা দীন ছিল, মার মন কৃপণ ছিল।⋯আমায় যদি কিছু দিতে হয় আমি মাকে স্বার্থত্যাগ দেব। আর কিছু না। কিছু নয়।’

আমি নীরব হলে বৃন্দাবনের কদম গাছ তার ছায়া আরও দীর্ঘ করল। বড়দির বুকে সেই ছায়া . দেখলাম। কয়েকটি খড়কুটো এল দমকা বাতাসে। দশরথ ধোপাদের বস্তিতে গানের সুর থেমে গেছে। একটি রাত্রিগামী ট্রেন সাঁকোর ও-প্রান্তে দাঁড়িয়ে হুইসেল দিচ্ছে পথের জন্যে। ধ্বনিটা ক্ষীণ হয়ে এখানে ভেসে আসছিল।

মেজদা কিছু বলে নি। এবার বলবে। মেজদার পালা ফুরোলে আমাদের পাঁচটি আঙুলই গুটিয়ে যাবে।

আমরা কেউ কোনো কথা না বলে মেজদার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

মেজদা কিছু বলছিল না। মেজদা শূন্যপানে মুখ তুলে রেখেছিল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম। অধীর উৎকণ্ঠিত সেই অপেক্ষা দীর্ঘ মনে হচ্ছিল।

‘দীনু—’ বড়দা মেজদাকে ডাকল।

মেজদা স্থির, শান্ত। যেন আকাশের দিকে তার অন্ধ চোখ মেলে সে হৃদয় দিয়ে মাকে দেখছে।

‘দীনু—’ এবার বড়দি হাত বাড়িয়ে মেজদার গা স্পর্শ করল।

মেজদা তবু পাথরের মতন বসে। তার নিশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না বোঝা যাচ্ছিল না।

ছোট ডাকল, ‘মেজদা।’

আমি হাত দিয়ে মেজদার গা স্পর্শ করে বললাম, ‘মেজদা, এবার তোমার পালা।’

মেজদা সামান্য নড়ল। আকাশের দিকেই তার মুখটি তোলা, অমন জ্যোৎস্না তার সমস্ত মুখ লিপ্ত করেছে, তার দুই অন্ধ নয়ন নিবিড় করে সেই আলো মাখছিল।

মেজদা তার সাদামাটা মেঠো সুরেলা গলায় বলল, ‘সৎকার শেষ হয়ে গেলে মানুষ আর কি দিতে পারে! তোমরা মার সৎকার শেষ করেছ। আমার কিছু দেওয়ার নেই।’ কয়েক দণ্ড থামল মেজদা, তারপর বলল, ‘আমাকে যেমন একটা নির্বোধ সুটকেসঅলা অন্ধ করে দিয়ে গেল, তেমনি মাকে এই সংসারের শনিতে অন্ধ করেছিল।⋯মা যে কত অন্ধ আমি জানতাম।⋯এই অন্ধ চোখ মাকে আর দিতে ইচ্ছে করে না। মা আমার হৃদয়ের চক্ষু পাক।’

মেজদা আর কিছু বলল না। কাশীর সাদা পাথরে বাঁধানো মার বেদীর ওপর আমরা পাঁচটি সন্তান বসে থাকলাম। শব্দহীন সেই চরাচরে বসে অনুভব করলাম, আমাদের মার সৎকার যেন এই মাত্র সমাধা হল।

সর্বগ্রাস এই দুঃখেও আমরা মার নির্বিঘ্ন যাত্রা কামনা করছিলাম। আমাদের যা দেবার সাধ্যমত দিয়েছি। মা সেই অন্তহীন পথ অতিক্রম করুন।

১৩৬৯(১৯৬২)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *