জননান্তর সৌহৃদানি

জননান্তর সৌহৃদানি

হলুদ গাঁয়ের রামকেষ্ট দাস রাস্তার ধারে নিজের বাড়ির দাওয়ায় বসে থেলো হুঁকোয় তামাক খাচ্ছিলেন। আজ হাটবার, হপ্তায় একদিন গাঁয়ের কিনারে হাট বসে; আজও বসেছিল। এখন অপরাহ্নে হাট ভাঙতে আরম্ভ করেছে; ভিন গাঁয়ের লোকেরা নিজের গ্রামে ফিরবে।

বছর তিরিশ আগের কথা বলছি। দেশের তখনো এমন দৈন্যের দশা হয়নি। হলুদ গাঁয়ের লক্ষ্মীশ্রী ছিল, সম্প্রতি হাট বসানোর ফলে লক্ষ্মীশ্রী আরো বেড়েছিল। দূর দূর থেকে হাটুরেরা আসত, কেউ কিনতে আসত, কেউ বেচতে আসত। গাঁয়ের লোক আনন্দে ছিল।

কেবল রামকেষ্ট দাসের প্রাণে আনন্দ নেই। তিনি থেলো হুঁকোয় টান দিতে দিতে নিজের ভাগ্যের কথা ভাবছিলেন। তাঁর বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, শরীর এখনো বেশ মজবুত; তাঁর কিছু জোতজমি আছে, লগ্নি কারবার আছে, পাকা বসতবাড়ি আছে। কিন্তু তবু যেন আস্তে আস্তে সব নিভে আসছে; সে দপদপা আর নেই। মা লক্ষ্মী যেন পা টিপে টিপে খিড়কি দরজা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। বাইরের ঠাট বজায় আছে, ভিতরে ফোঁপরা হয়ে গেছে। কবে থেকে এই ব্যাপার ঘটতে আরম্ভ করেছে? সেই যে-বছর গো-মড়কে তাঁর গাই বদল সব মরে গেল। প্রায় বারো বছর।

হুঁকোটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, রামকেষ্ট সেটা এক কোণে রাখতে যাবেন, এমন সময় তাঁর বৌ বাড়ির ভিতর থেকে এসে চায়ের পেয়ালা তাঁর সামনে রাখল, আর হুঁকোটা নিয়ে নিঃশব্দে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। আড়-ঘোমটা দেওয়া বৌটি দেখতে মন্দ নয়, বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। ললিতা তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের বৌ। রাশভারী প্রকৃতির মেয়ে, ভারি গুণের বৌ। এই এগারো বছর বিয়ে হয়েছে, এক দিনের তরেও কথা-কথান্তর হয়নি। তাঁর প্রথম পক্ষের বৌ লক্ষ্মী ছিল যেমন দজ্জাল খাণ্ডার, তেমনি কুচুটে কুটিল। একেবারে বিছুটি।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে রামকেষ্ট চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলেন। লক্ষ্মী মারা গিয়েছিল বারো বছর আগে, অর্থাৎ যে-বছর গো-মড়ক হয় সেই বছর। রামকেষ্ট লক্ষ্মীকে বাড়িতে রেখে বৃন্দাবনে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে দেখলেন লক্ষ্মী টাইফয়েডে মরমর। বাঁচল না। তারপর—সেই থেকে রামকেষ্টর অবস্থা খারাপ হতে আরম্ভ করেছে। লক্ষ্মী দুষ্টু-দজ্জাল ছিল বটে, কিন্তু বোধ হয় পয়মন্ত ছিল।

‘দাস মশাই—ও দাস মশাই।’

রামকেষ্ট শুনতে পেলেন না, তিনি নিজের মনের মধ্যে ডুবে গেছেন। লক্ষ্মী সত্যিই লক্ষ্মীমন্ত বৌ ছিল। মাত্র আট বছর সে তাঁর ঘর করেছিল; ছেলেপুলে হয়নি বটে, কিন্তু সংসার ফলে-ফুলে সোনাদানায় ভরে উঠেছিল। রামকেষ্টর কাছ থেকে লক্ষ্মী তিনশো ভরির গয়না আদায় করেছিল। গয়নাগুলো কোথায় গেল? লক্ষ্মীর মৃত্যুর পর সেগুলো বাড়িতে পাওয়া যায়নি।

‘বলি ও কর্তা!’

রামকেষ্টর চমক ভাঙল, তিনি চোখ তুলে চাইলেন। দেখলেন রাস্তার ওপর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাঁর দিকে চেয়ে ফিক ফিক করে হাসছে। মেয়েটার বয়স নয়-দশ বছরের বেশী নয়; বোধ হয় ভিন গাঁয়ের মেয়ে, হাটে এসেছে। নিজের গাঁয়ের মেয়ে হলে চিনতে পারতেন। রামকেষ্ট চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন, বললেন—‘কে রে তুই?’

মেয়েটা এগিয়ে এসে রাস্তার কিনারায় দাঁড়াল, যেন ভারি অবাক হয়েছে এমনিভাবে গালে হাত দিয়ে বলল—‘ওমা চিনতে পারলে না! আরো ভাল করে দেখ দেখি।’

মেয়েটার ভারি পাকা-পাকা কথা। রামকেষ্ট আরো ভাল করে দেখলেন। মুখখানা একেবারে অচেনা, কিন্তু চোখের দুষ্টুমিভরা দৃষ্টি যেন চেনা-চেনা, আগে কোথায় দেখেছেন। তিনি সন্দিগ্ধভাবে বললেন—‘তুই তো এ গাঁয়ের মেয়ে নয়। তোর নাম কি? কোন গাঁয়ের মেয়ে?’

মেয়েটা মুচকি হেসে বলল—‘আমার নাম এখন রমা, আগে অন্য নাম ছিল। পীরপুর গাঁয়ে আমার বাড়ি।’

রামকেষ্ট বললেন—‘পীরপুর! সে যে পাঁচ কোশ রাস্তা। এলি কি করে?’

রমা বলল—‘আমার বাপ পীরপুরের মস্ত জোতদার। হলুদ গাঁয়ে হাট বসে শুনে বাপ বলল, চল দেখে আসি। আমরা গরুর গাড়িতে এসেছি।’

রামকেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত চোখে রমার পানে চেয়ে রইলেন, বললেন—‘তোর বাপের নাম কি?’

‘কেশব মণ্ডল!’

‘চিনি না। পীরপুর গাঁয়েও অনেক দিন যাইনি। তুই আগে কখনো হলুদ গাঁয়ে এসেছিস?’

রমা মুখের একটি বিচিত্র ভঙ্গি করল, বলল—এ জন্মে এই প্রথম। এসে দেখি, ওমা সব চেনা। তারপর এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এই বাড়িটা চোখে পড়ল। সব মনে পড়ে গেল। কাছে এসে দেখি, তুমি ঠিক আগের মতো দাওয়ায় বসে আছ। তোমার চেহারা একটুও বদলায়নি, যেমন ছিল তেমনি আছে।’

রামকেষ্ট বুকের মধ্যে একটা প্রবল অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলেন, তাঁর মনে হলো তিনি একটা ভয়াবহ রহস্যের সম্মুখীন হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি একটু স্খলিত স্বরে বললেন—‘স্পষ্ট করে বল্‌ তুই কে, কোথায় তোকে দেখেছি!’

রমা একেবারে দাওয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়াল, রামকেষ্টর মুখের কাছে মুখ এনে বলল—‘স্পষ্ট করে না বললে বুঝতে পারবে না?—আগের জন্মে আমার নাম ছিল লক্ষ্মী। এবার চিনতে পেরেছ?’

রামকেষ্টর মাথাটা যেন ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে গেল, তিনি অবিশ্বাসভরা চোখ মেলে রমার পানে চেয়ে রইলেন। মেয়েটার চোখের চাউনি দুষ্টুমিতে ভরা; লক্ষ্মীর চাউনি ওই রকম ছিল, সর্বদাই যেন মনে মনে কু-মতলব আঁটছে। আর কথার বাঁধুনি। এতটুকু মেয়ের এমন পাকা কথা শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এ সবই লক্ষ্মীর মতো, কিন্তু তাছাড়া আর কোনও মিল নেই। নিজেকে সামলে নিয়ে রামকেষ্ট বললেন—‘তুই লক্ষ্মী! গাল টিপলে দুধ বেরোয়, আমার সঙ্গে রহলা করতে এসেছিস? যা বেরো!’

রমা চোখ ছোট করে বলল—‘বিশ্বাস হলো না? তাহলে হাঁড়ির খবর শুনবে?’ রমা গলা খাটো করে দু’-চারটি কথা বলল। দাম্পত্য জীবনের নিগুঢ় গুপ্তকথা, পৃথিবীতে কারুর জানার উপায় নেই। অথচ এই পুঁচকে মেয়েটা জানে! রামকেষ্ট যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন—‘অ্যাঁ—কি বললি! তুই জানলি কেমন করে! তুই তাহলে সত্যিই লক্ষ্মী! অবাক কাণ্ড! এ যে চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না!’

রমা মুচকি হেসে বলল—‘আচ্ছা, আজ চললুম। আমার বাপ বোধ হয় আমাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।’

সে পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করল। রামকেষ্টর মনটা আঁকুপাঁকু করে উঠল, তিনি গলা চড়িয়ে ডাকলেন—‘ওরে ও—কি বলে—রমা না লক্ষ্মী! শুনে যা—একটা কথা শুনে যা—’

রমা বোধ হয় জানতো রামকেষ্ট তাকে ফিরে ডাকবেন, সে এসে আবার দাওয়ার সামনে দাঁড়াল, দু’পাটি দাঁত করে বার বলল—‘কি বলবে বলো। বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারব না।’

রামকেষ্ট একবার ঢোক গিলে মুখে খোশামুদে হাসি এনে বললেন—‘তুই যদি সত্যিই লক্ষ্মী হোস, তাহলে তোর নিশ্চয় মনে আছে, তোকে বাড়িতে রেখে আমি বৃন্দাবনে তীর্থ করতে গিয়েছিলাম। দেড় মাস পরে ফিরে এসে দেখলাম তোর অসুখ। আর সোনার গয়নাগুলো একটাও তোর গায়ে নেই। কত জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তুই মুখ টিপে রইলি, কিছুতেই বললি না গয়নাগুলো কোথায়। কেন লুকিয়ে রেখেছিলি বল দেখি।’

রমা চোখের কুটিল ভঙ্গি করে বলল—‘যদি মরে যাই তাহলে আমার গয়না তুমি দ্বিতীয় পক্ষকে পরাবে, তাই লুকিয়ে রেখেছিলুম।’

রামকেষ্ট অপ্রস্তুত হয়ে বললেন—‘তা—তা—তুই যখন মরেই গেলি—বুঝলি না—এখন তো আবার জন্মেছিস—এখন বল-না কোথায় লুকিয়েছিলি।’

‘ইঃ! বলছি আর কি!’

‘তা যদি না বলিস তাহলে বুঝব কি করে তুই সত্যিই লক্ষ্মী?’

রমা রামকেষ্টর মুখের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলল—‘আমাকে যদি বিয়ে কর তবেই বলব, নইলে নয়।’ সে এক ছুটে হাটের দিকে চলে গেল।

রামকেষ্ট হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন।

দোরের কাছ থেকে গলা শোনা গেল—‘ভেতরে এস।’ ললিতার গলা। ললিতা বোধ হয় দোরগোড়া থেকে রমাকে দেখেছে। রামকেষ্ট উঠে বাড়ির ভিতরে গেলেন।

তিনি এদিক ওদিক চেয়ে বললেন—‘কানু কোথায়?’

ললিতা বলল—‘খেলতে গেছে, এখনি ফিরবে।’

কানু রামকেষ্টর একমাত্র সন্তান, অনেক বিলম্বে দ্বিতীয় পক্ষে এই একটি ছেলে হয়েছে। এখন তার বয়স আন্দাজ পাঁচ বছর।

ললিতা তারপর বলল—‘ও মেয়েটা কে?’

রামকেষ্ট একটু ইতস্তত করলেন। কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষের এই স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মনের সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ যে তার কাছে গোপন কিছুই নেই। তিনি ললিতাকে সব কথা বললেন।

শুনে ললিতা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। সে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, জন্মান্তরিত বৌ সম্বন্ধে তার মনে কোনও সংশয় জাগল না; যেন খুবই স্বাভাবিক পরিস্থিতি। সে কেবল প্রশ্ন করল—‘তিনশো ভরি সোনার দাম কত?’

রামকেষ্ট বললেন—‘তা আজকের বাজারে দশ হাজার টাকার কম হবে না। একটা জমিদারী কেনা যায়।’

আর এ বিষয়ে কথা হলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর কানু যখন ফিরল না, রামকেষ্ট বললেন—‘খেলায় মত্ত হয়ে আছে, যাই ধরে নিয়ে আসি।’

বাইরে তখনো আবছায়া দিনের আলো আছে। রামকেষ্ট হাটের কাছে গিয়ে দেখলেন, হাট ভেঙে গেছে, গাঁয়ের কয়েকজন লোক এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। রামকেষ্ট তাদের কানুর কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারা কেউ কিছু বলতে পারল না। একটি কিশোর বয়সের ছেলে বলল—‘কানু? সে তো গরুর গাড়িতে চড়ে চলে গেছে।’

রামকেষ্টর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল—‘সে কি! কোথায় গেছে?’

ছেলেটি বলল—‘তা জানি না। একটা মেয়ে তাকে গরুর গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল।’

‘মেয়ে! কত বড় মেয়ে?’

‘ন-দশ বছরের হবে।’

রামকেষ্ট ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এলেন, ললিতাকে বললেন—‘সর্বনাশ হয়েছে। লক্ষ্মী কানুকে গরুর গাড়িতে তুলে নিয়ে পালিয়েছে।’

ললিতা বিবর্ণ মুখে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভারি শক্ত মেয়ে তাই ভেঙে পড়ল না। রামকেষ্ট বললেন—‘আমি এখনি পীরপুরে যাচ্ছি; ছেলে নিয়ে ফিরব।’

সুদাম গোয়ালার গরুর গাড়ি আছে, তাইতে চড়ে রামকেষ্ট বেরুলেন। পাড়াগেঁয়ে কাঁচা রাস্তায় অন্য কোনও যানবাহন চলে না। পীরপুর পৌঁছুতে আড়াই ঘণ্টা লাগল। পীরপুর গ্রাম তখন নিশুতি।

একজনের দোর ঠেঙিয়ে খবর পেলেন, রমা কেশব মোড়লের মেয়ে। কেশব মোড়লের দোর ঠেঙিয়ে তাকে তোলা হলো। মোড়ল বলল—‘কি ব্যাপার?’

রামকেষ্ট বললেন—‘তোমার মেয়ে আমার পাঁচ বছরের ছেলেকে চুরি করে এনেছে। শিগ্‌গির ছেলে বের কর নইলে পুলিস ডাকব!’

মোড়ল বলল—‘রমা হলুদ-গাঁ থেকে একটা ছেলেকে এনেছে বটে। আমি মানা করেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। মেয়েটা ভারি ত্যাঁদড়, আমার কথা শোনে না। তুমি যদি পারো তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও।’

এই সময় রমা এসে দাঁড়াল, দাঁত বার করে বলল—‘কি দাস মশাই, ছেলের খোঁজে এসেছ?’

রামকেষ্ট তর্জন করে বললেন—‘তুই আমার ছেলে চুরি করে এনেছিস!’

রমা ঠোঁট উল্টে বলল—‘আমি কোন্ দুঃখে তোমার ছেলে চুরি করতে যাব! কানু নিজের ইচ্ছেয় আমার সঙ্গে এসেছে।’

‘কোথায় সে?’

‘কোথায় আবার! খেয়েদেয়ে আমার বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে। দেখবে তো এস।’

একটি ঘরে তক্তপোশের ওপর দু’জনের বিছানা। কানু অকাতরে ঘুমোচ্ছে; বেশ বোঝা যায়, রমা তাকে কোলের কাছে নিয়ে তার পাশে শুয়েছিল।

রামকেষ্ট ঘুমন্ত ছেলেকে বুকে তুলে নিলেন, কোনও কথা না বলে বাইরের দিকে চললেন। রমা তাঁর পিছু পিছু সদর দোর পর্যন্ত এল, বলল—‘নিয়ে যাচ্ছ যাও। কিন্তু আমি ওর বড়-মা, আবার আমি ওকে দেখতে যাব।’

রামকেষ্ট জবাব দিলেন না, ছেলে নিয়ে গরুর গাড়িতে উঠলেন। রাতদুপুরে ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।

পরদিন সকালে কানুর কিছু মনে নেই। ঘুম থেকে উঠে সে যখন মুড়ি-মুড়কি নারকেল-নাড়ু নিয়ে খেতে বসল, তখন রামকেষ্ট তাকে জেরা আরম্ভ করলেন। ললিতা বসে শুনতে লাগল।

‘হ্যাঁরে, কাল সন্ধ্যেবেলা তুই কোথায় গিয়েছিলি?’

কানু একটু ভাবল, তারপর তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল—‘বড়-মার সঙ্গে গিয়েছিলুম।’ এদিক ওদিক চেয়ে বলল—‘বড়-মা কোথায়?’

‘বড়-মা কে? কোথায় পেলি তাকে?’

‘ওই যে আমি হাটের কাছে খেলা করছিলুম, বড়-মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিল। জিজ্ঞেস করল, তোর বাপের নাম কি। আমি তোমার নাম বললুম। বড়-মা তখন হেসে বলল, তুই আমার সঙ্গে গরুর গাড়ি চড়ে বেড়াতে যাবি? আমি বললুম, যাব। বড়-মা তখন আমাকে গাড়িতে চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে গেল।’

‘ওকে বড়-মা বলছিস কেন? বোকা ছেলে! ও তো মোটে ন-দশ বছরের মেয়ে।’

‘বড়-মা বলেছে ও আমার বড়-মা। বড়-মা খুব ভাল, আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কত ভাল ভাল খাবার খেতে দিয়েছিল। নিজের কাছে নিয়ে শুয়েছিল।’

‘হুঁ।’

রামকেষ্ট ললিতার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। দু’জনেরই মন আশঙ্কায় ভরে উঠল। লক্ষ্মী বাঁজা ছিল, হয়তো প্রাণে সন্তান আকাঙক্ষা নিয়ে মরেছিল।

পরের হাটবারে রমা এল না, তারপরের হাটবারে এল। বিকেল আন্দাজ চারটের সময় রামকেষ্ট সবে মাত্র দাওয়ায় এসে বসেছেন, রমা হাটের দিক থেকে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল—‘আমার ছেলে কোথায়?’

রামকেষ্ট চোখ পাকিয়ে বললেন—‘তোর ছেলে! তুই পেটে ধরেছিস! বলতে লজ্জা করে না? তোর ছেলে!’

রমা বলল—‘হ্যাঁ, আমার ছেলে। আমি বেঁচে থাকলে ও আমার পেটেই জন্মাতো।’

এ রকম যুক্তির জবাব নেই। রামকেষ্ট ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। রমা গলা চড়িয়ে ডাকল—‘কানু! কানু!’

কানু তখনো খেলতে বেরোয়নি, বাড়িতেই ছিল, সে ছুটে এসে রমাকে জড়িয়ে ধরল—‘বড়-মা—বড়-মা!’

রমা রামকেষ্টর দিকে কুটিল হাসি হেসে কানুকে বলল—‘চল, হাটে যাই। তোকে অনেক অনেক খেলনা কিনে দেব।’

কানু লাফাতে লাফাতে রমার সঙ্গে চলল। রামকেষ্ট কিছুক্ষণ জবুথবু হয়ে বসে রইলেন, তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে তাদের পিছনে ছুটলেন—‘ওরে, আমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস—’

রমা উত্তর দেওয়া দরকার বোধ করল না।

তারপর হাটের সহস্র লোকের মাঝখানে রমা আর কানুর পিছন পিছন রামকেষ্ট ঘুরে বেড়ালেন। দশজনের সামনে চেঁচামেচি হাঙ্গামা বাধানো তাঁর স্বভাব নয়, কিন্তু এক পলকের তরেও তিনি কানুকে চোখের আড়াল করলেন না।

সূর্য পাটে বসতে যখন আর দেরি নেই, তখন রমা কানুকে হাটের বাইরের দিকে নিয়ে চলল। অনেকগুলো গরুর গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, যারা দূর দূর থেকে এসেছে, তাদের গরুর গাড়ি। একটা গরুর গাড়ির পিছন দিকে কেশব মণ্ডল সওদা করা মাল তুলছে। রমা কানুকে সেই দিকে নিয়ে গেল।

রামকেষ্ট ছুটে এসে কানুর হাত ধরলেন। কেশব মণ্ডল ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। রামকেষ্ট বললেন—‘দ্যাখো মোড়ল, তোমার মেয়ের নষ্টামিটা দ্যাখো, আজ আবার আমার ছেলেকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল।’

কেশব মণ্ডল মেয়েকে বকাবকি শুরু করল—‘তোর কি কোনও দিন হুঁস-আক্কেল হবে না! শেষে আমার হাতে দড়ি দিবি? রমা কিন্তু নির্বিকার, একদৃষ্টে রামকেষ্টর দিকে চেয়ে রইল। কেশব মণ্ডল তখন হাত জোড় করে রামকেষ্টকে বলল—‘কর্তা, তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও। আমার মেয়েটা হতচ্ছাড়া বজ্জাত; মা-মরা মেয়ে কোনও দিন শাসন পায়নি, তাই এমন ধিঙ্গি হয়েছে।’

রামকেষ্ট কানুর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কানু কাঁদো কাঁদো সুরে বলল—‘আমি বড়-মা’র সঙ্গে যাব।’

রামকেষ্ট ধমক দিয়ে বললেন—‘না, তুমি বাড়ি যাবে।’ যেতে যেতে তিনি শুনতে পেলেন পেছন থেকে রমা বলছে—‘আচ্ছা, কানুর খেলনা আমার কাছেই রইল। আবার আমি আসব।’

ললিতা বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে দেখতে পেয়ে কানু চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল—‘আমি বড়-মা’র কাছে যাব। বড়-মা আমাকে খেলনা কিনে দিয়েছিল, সেই খেলনা নিয়ে খেলব।’

ললিতা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল—‘আমি তোমাকে অন্য খেলনা কিনে দেব।’

কানুর কান্না সহজে থামল না। সে-রাত্রে সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুমিয়ে পড়ল।

স্বামী-স্ত্রী পরস্পর মুখের পানে আতঙ্কভরা চোখে চেয়ে রইলেন। শেষে রামকেষ্ট বললেন—‘হতচ্ছাড়া নচ্ছার মেয়েমানুষ, মরেও শান্তি দেবে না। আমার ছেলেটাকে গুণ করেছে। আমি এখন কী করি?’

ললিতা বলল—‘তুমি মাথা ঠাণ্ডা রাখো। এবার থেকে হাটবারে কানুকে বাড়ির বাইরে যেতে দেব না।’

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

দু’-তিনটে হাটবারে রমা এসে কানুকে ডাকাডাকি করল। কিন্তু বাড়ির সদর দোর বন্ধ, কেউ সাড়া দিল না। তারপর একদিন—সেটা হাটবার নয়—কানু বিকেলবেলা খেলতে বেরিয়ে আর ফিরে এল না।

বুঝতে বাকি রইল না কানু কোথায় গেছে।

রামকেষ্ট তখনি গরুর গাড়ি চড়ে বেরুলেন। এবার ললিতা তাঁর সঙ্গে।—

পীরপুরে পৌঁছুলে রমা এসে দোর খুলে দিল। দু’জনকে দেখে দাঁত খিচিয়ে হাসল—‘দু’জনেই এসেছ। ছেলেকে আটকে রাখতে পারলে?’

তারপর তিনজনে অনেক কথা কাটাকাটি হলো, অনেক চেঁচামেচি হলো। শেষে রামকেষ্ট বললেন—‘কানুকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেব। পঞ্চাশ কোশ দূরে ওর মামার বাড়ি। তখন কি করবি?’

রমার চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—‘কানুকে যদি না দেখতে পাই, আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব। আর ওকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।’

স্বামী-স্ত্রী আতঙ্কে শিউরে উঠলেন। ভয়-বিহ্বলভাবে কিছুক্ষণ জড়বৎ বসে থাকার পর রামকেষ্ট বলে উঠলেন—‘ওরে সর্বনেশে মেয়েমানুষ, তুই কি চাস্ বল।’

রমা বলল—‘আমি কানুর কাছে থাকব। ওকে যদি এখানে থাকতে না দাও, আমি ওর কাছে গিয়ে থাকব।’

‘তার মানে আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু লোকে বলবে কি? আজ তুই ছেলেমানুষ আছিস। চিরদিন তো ছেলেমানুষ থাকবি না।’

‘আমাকে বিয়ে করে তোমার ঘরে নিয়ে যেতে হবে।’

প্রস্তাবটা রামকেষ্টর কাছে নতুন নয়, তবু তিনি প্রবল ধাক্কা খেলেন। সতীনকে চোখে দেখেও বিয়ে করতে চায়। এমন নাছোড়বান্দা মেয়েমানুষ দেখা যায় না। রামকেষ্ট অসহায়ভাবে ললিতার পানে চাইলেন, দু’জনে অনেকক্ষণ চোখে চোখে চেয়ে রইলেন। তারপর ললিতা রমার দিকে ফিরে বলল—‘সোনার গয়না কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলে বার করতে পারবে?’

রমা বলল—‘পারব। কিন্তু ও আমার গয়না, আমি কাউকে দেব না।’

ললিতা বিরসকণ্ঠে বলল—‘তোমার গয়না কেউ চায় না। গয়না তুমিই নিও। ছেলেও তোমার কাছে থাকবে। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি। স্বামীর দিকে হাত বাড়াবার বয়স তোমার এখন হয়নি। স্বামীকে যদি বিরক্ত করো ভাল হবে না।’

রমা চোখ কুঁচকে চাইল—‘যদি বিরক্ত করি কী করবে তুমি?’

ললিতার চোখ কামারশালার আগুনের মতো গনগনিয়ে উঠল, সে বলল—‘ঝেটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব।’

দু’জনের চোখ খানিকক্ষণ পরস্পর আবদ্ধ হয়ে রইল, যেন চোখে চোখে মরণান্তক লড়াই চলছে। তারপর রমার চোখ আস্তে আস্তে নীচু হয়ে পড়ল।

বিয়েটা নমো নমো করেই সারতে হলো। তারপর রামকেষ্ট দশ বছর বয়সের বৌ নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন।

শ্বশুরবাড়ি এসেই রমা প্রথমে ছুটে গিয়ে কানুকে কোলে নিয়ে কয়েকটা চুমু খেল। তারপর কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বলল—‘ভাঙো উনুন। উনুনের নীচে আছে।’

রামকেষ্ট উনুন ভাঙলেন, তারপর শাবল দিয়ে উনুনের নীচে খুঁড়তে লাগলেন। কিছু দূর খোঁড়বার পর দেখা গেল একটা পাথরের পাটি পাতা রয়েছে। পাথরের পাটি সরানো হলো; তার নীচে একটি গর্ত, গর্তের মধ্যে পিতলের হাঁড়িতে তিনশো ভরি খাঁটি সোনার গয়না।

যদি বা আগে কিছু সন্দেহ ছিল, এখন আর সন্দেহ রইল না যে এ-জন্মের রমা আগের জন্মে লক্ষ্মীই ছিল।

তারপর দিন কাটছে। কানুকে নিয়ে রমা আলাদা শোয়, এ ছাড়া রামকেষ্টর পরিবারে আর কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি তৃতীয় পক্ষে বালা স্ত্রী বিয়ে করেছেন, এই নিয়ে গ্রামের লোক একটু ঠাট্টা তামাশা করে, কিন্তু রামকেষ্ট তা গায়ে মাখেন না। আসল কথাটা কেউ জানতে পারে না।

রামকেষ্টর মন মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে ওঠে। রমা বড় হয়ে কি জানি কি কাণ্ড বাধাবে, সংসারের শান্তি চিরদিনের জন্যে নষ্ট হয়ে যাবে। ললিতা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে—‘তুমি ভেবো না। আমি ওকে শাসনে রাখব।’

ক্রমে দুটি তত্ত্ব পরিস্ফুট হয়ে উঠতে লাগল। প্রথম, রামকেষ্টর ঘরে আবার লক্ষ্মীশ্রী ফিরে আসছে। লগ্নি কারবার জাঁকিয়ে উঠছে, মুদির দোকানেতেও আবার বেচাকেনা বেড়ে চলেছে। ক্ষেত-খামারের অবস্থাও উন্নতির পথে। যে গৃহলক্ষ্মী খিড়কির দোর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি আবার অকারণেই ফিরে আসছেন।

দ্বিতীয়, রমার স্বভাবচরিত্র আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। ললিতা তার ওপর খর দৃষ্টি রেখেছে, রমা মনে মনে তাকে ভয় করতে আরম্ভ করেছে। হয়তো এই ভয়ের ফলেই তার স্বভাব ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে।

শেক্সপীয়র Taming of the Shrew-তে মিছে কথা বলেননি। যতবড় খাণ্ডার স্বভাবের মেয়েই হোক, তার প্রাণে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারলে আখেরে ফল ভাল হয়।

২ জুন ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *