জতুগৃহ
০১. অবতরণিকা
নিবারণবাবু লোকটাকে প্রথম প্রথম আমি যতটা বোকা ভেবেছিলাম, তিনি বোধ হয় তা নন।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আজ প্রায় বছর দেড়েক আলাপ। দিল্লি না বোম্বাই, কোথায় যেন বড় চাকরি করতেন, সেখান থেকে অবসর নিয়ে আমাদের গলির মোড়ের এক মালটিস্টোরিড বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাট কিনে ডেরা বেঁধেছেন।
আমাদের রাস্তাটা সরাসরি ময়দানের দক্ষিণ মুখে গিয়ে পড়েছে। মোড় পেরোলেই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড। গ্রাউন্ডের উলটো দিকে রানির উদ্যান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।
সকালে বিকেলে এদিকে যাঁরা হাঁটতে আসেন তাদের মধ্যে রাজা, উজির, কোটাল, কোটিপতি থেকে সামান্য কেরানি, মাস্টার, জোচ্চোর, হাসির গল্পের লেখক ইত্যাদি সব রকম লোক আছে। এদের মধ্যে একটাই মাত্র প্রভেদ যে, একদল ভিক্টোরিয়ার বাগানে হাঁটেন, অন্য দল ব্রিগেড প্যারেডের মাঠে হাঁটেন। যাঁরা ভিক্টোরিয়ায় হাঁটেন তারা কখনওই ব্রিগেড প্যারেডে যান না। অন্যদিকে ব্রিগেড প্যারেড হটিয়েদের কাছে ভিক্টোরিয়া অস্পৃশ্য।
এ পাড়ায় আমি খুব বেশিদিন আসিনি, বছর আটেক হবে বড় জোর। এখানে এসে প্রথম প্রথম প্রাতঃ ও সান্ধ্যভ্রমণের সময় এই ভ্রমণ বিভেদের ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ খটকা লেগেছিল। ভিক্টোরিয়াতেও মন্ত্রী থেকে কেরানি হাঁটছেন, ব্রিগেডেও তাই। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার মন্ত্রী কখনওই ব্রিগেড়ে হাঁটতে যাবেন না, আবার ব্রিগেডের কেরানি ভিক্টোরিয়ায়? নৈব নৈব চ।
অনেকদিন ধরে ব্যাপারটা অনুধাবন করার পরে এখন বুঝতে পেরেছি, এটা নিতান্ত একটা অভ্যাসমাত্র। এর মধ্যে কোনও গূঢ় সামাজিক মনস্তত্ত্ব বা তথাকথিত আর্থ-রাজনৈতিক কারণ নেই। একেকজনের একেকরকম অভ্যাস ও পছন্দ।
আমি অবশ্য ভিক্টোরিয়ায় এবং ব্রিগেডে, এই দুই জায়গাতেই স্বচ্ছন্দ ও সাবলীলভাবে বিচরণ করি। সকালে ব্রিগেডে হাঁটতে যাই, খোলা মাঠে নীল আকাশের নীচে শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের গালিচায় খালি পায়ে হাঁটি। আমার রক্তচাপ কমে, দেহেমনে আরাম হয়।
আর ছুটির দিনের বিকেল, ঠিক বিকেলে নয়, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে হাঁটতে যাই। সুবেশ পুরুষ এবং সুন্দরী রমণীদের, তদুপরি অগণিত বেশরম প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলদের সঙ্গসুখ লাভ করি।
বলে রাখা ভাল যে আমার এই দুই বেলার দুই রকম ভ্রমণব্যবস্থার কারণটা একটু অন্যরকম। একটি প্রাচীন সারমেয় প্রতিদিন সকালে আমার ভ্রমণসঙ্গী। তাকে ভিক্টোরিয়া ঢুকতে দেয় না, তাই সকালে তাকে নিয়ে ব্রিগেডের মাঠে হাঁটি। আর ছুটির দিনের সায়াহ্নে ভিক্টোরিয়ার বাগানে আমি একা একটু ঘুরি। কাঠের বেঞ্চিতে বসে একটু দেবদারুর হাওয়া খাই, মানুষজন দেখি, তাদের টুকরো কথাবার্তা শুনি।
এই বাগানেই আরও বহু লোকের সঙ্গে যেমন করে নানা সূত্রে আলাপ-পরিচয় হয়েছে, একদিন নিবারণবাবুর সঙ্গেও তাই হল।
দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের পুকুরের ধারে দেবদারুবীথির মধ্যে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসেছিলাম। এই বেঞ্চটাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, ঠিক সরাসরি ওপরে কোনও বৃক্ষশাখা নেই তাই পাখিরা বসে কোনও কুকর্ম করতে পারে না আবার ওই জন্যেই একটু খোলামেলা বলে প্রেমিক-প্রেমিকাঁদের এ বেঞ্চটা। তেমন পছন্দ নয়। গাছের আড়াল না হলে তাদের ভালবাসা জমে না।
সে যা হোক, ছুটির দিনের সন্ধ্যা তাই সেদিন শার্টপ্যান্ট নয়, আমার পরনে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি, তাও সাধারণ কোনও ধুতি-পাঞ্জাবি নয়, রীতিমতো রেয়নের ধুতি আর নকশি ফুলতোলা রেশমের পাঞ্জাবি।
কঠোর কার্পণ্যই আমার এই সুবেশের কারণ। আমার নিজের কোনও ভাল জামাকাপড় নেই, ধুতি-পাঞ্জাবির প্রশ্নই ওঠে না। টেরিকটনের দু-একটা প্যান্টশার্ট আছে আর আটপৌরে পোশাক বলতে পাজামা আর হাফশার্ট সম্বল।
ওই রেশমি পাঞ্জাবি আর রেয়নের ধুতি আর সম্প্রতি লাভ করেছি। ব্যাপারটা এ কাহিনিতে প্রক্ষিপ্ত, তবু সূত্রপাত হিসেবে একটু লিখছি।
বল্লভপাড়া গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা খন্দকার আলাউদ্দিন খান আমার বন্ধু, পুরনো ক্লাসফ্রেন্ড। অনেককাল আগের কথা, আলাউদ্দিন আর আমি একই বছরে দুজনে একই বিষয়ে একসঙ্গে এম. এ পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। আজকাল কী হয় জানি না, কিন্তু অনন্তকাল আগে সেই পঞ্চাশের দশকে যখন সামান্য আট আনায় ভাত-ডাল-তরকারি-মাছের ঝোল পাইস হোটেলে ভরপেট খাওয়া যেত, এমনকী দামটা বেশি বলে অনেকে মাছটা বাদ দিয়ে সাড়ে পাঁচ আনায় ভরপেট খেত, সেই সময় কেউই বোধ হয় এম. এ. পরীক্ষায় ফেল করত না। কদাচিৎ এক-আধজন, সেই প্রথম একসঙ্গে দুজন এম. এ. ফেল করল, আমি আর আলাউদ্দিন।
বলা বাহুল্য, এর পর থেকে আলাউদ্দিনের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা প্রচণ্ড বেড়ে যায় এবং সেই হৃদ্যতা আজও অব্যাহত রয়েছে। আমি আর জীবনে বিশেষ কিছু করতে পারিনি, সম্প্রতি হাসির গল্প লিখে (বেশিটাই বিলিতি হাসির গল্প থেকে বাংলায় টুকে) সামান্য নাম ও পয়সা হয়েছে, কোনও রকমে গ্রাসাচ্ছাদন চলে যাচ্ছে। এদিকে নানা ঘুরপথ ধরে অবশেষে আলাউদ্দিন এখন ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা হয়েছে।
আলাউদ্দিনের ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা কুচো চিংড়ি চাষের লোন পাইয়ে দিয়েছিলাম গজেন্দ্রকে। ফলতার কাছে একটা গ্রামে একটা শ্যাওলা ভরা কুঁচো চিংড়ির পুকুর এক। বছরের জন্যে ইজারা নিয়েছিল গজেন্দ্র, সে আমার পিসতুতো ভাইয়ের দূর সম্পর্কের শালা। সে হিসেব করেছিল ওই কুঁচো চিংড়িগুলো তিন মাসে বাগদা চিংড়ি হবে এবং এক বছরের মধ্যে গলদা চিংড়ি হবে, এতে লাভ হবে দশ গুণ। তা অবশ্য হয়নি কারণ পরে জানা গিয়েছিল কুঁচো চিংড়ি কখনও বাগদা চিংড়িতে কিংবা বাগদা কখনও গলদায় পরিণত হয় না। এর একেকটার একেক জাত, তা ছাড়া ওই পুকুরে সবটাই কুঁচো চিংড়ি ছিল না অনেকগুলোই ছিল ব্যাঙাচি, যথাসময়ে তারা লেজ পরিত্যাগ করে চারপায়ে জল থেকে লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আলাউদ্দিনের ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার লোনের পুরোটা অবশ্য গজেন্দ্র হাতে পায়নি। আলাউদ্দিনকে ফিফটি-ফিফটি মানে পঁচিশ হাজার তদুপরি কেরানি, ক্যাশিয়ার, পিয়ন, দারোয়ান এমনকী ব্যাঙ্কের দরজায় যে নেড়ি কুকুরী শুয়ে থাকে তার লেড়ে বিস্কুট, ধারে ফর্মের ফোটো, এফিডেভিট ইত্যাদি বাবদ সবসমেত একচল্লিশ হাজার চারশো বত্রিশ টাকা বাইশ পয়সা ব্যয় করতে হয়। অবশেষে পঞ্চাশ হাজার টাকার মধ্যে যখন সাকুল্যে তার হাতে হাজার সাড়ে আট টাকা আসে। এবং সেই সঙ্গে কুঁচো চিংড়িগুলো বাগদা বা গলদা না হয়ে ব্যাঙ হয়ে পালিয়ে যায় সে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং দুটি কাজ করে বসে। এক, একটি দুর্মূল্য রেয়ন ধুতি কিনে আমাকে উপহার দেয় এবং দুই, নিজে আত্মগোপন করে, এরপর থেকে তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
অবশ্য এই রেয়ন ধুতির চেয়ে অনেক বেশি রোমহর্ষক ইতিহাস আমার রেশমি পাঞ্জাবিটির।
আমার এক অকৃতদার খুল্লতাত আদালতের পেশকারি কাজ থেকে রিটায়ার করার পর যাত্রাদলে প্রম্পটার হয়েছিলেন। যাত্রাপার্টির সঙ্গে যখন তাকে বাইরে যেতে হত না তখন কলকাতায় আমার কাছেই থাকতেন।
গোয়ালপাড়া থেকে বালেশ্বর এবং সুন্দরবন থেকে তরাই কাঁপানো যুগান্তকারী যাত্রাপালা শাখা ভাঙো সিঁদুর মোছো দ্বিসহস্র রজনী অতিক্রম করেছিল তার প্রম্পটিংয়ে। সেই পালার একটি অবিস্মরণীয় দৃশ্য ছিল নায়িকা বিউটিবালা এক রাতে সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দুশ্চরিত্র, লম্পট স্বামীর খোঁজে পতিতালয়ে গেছে।
মারমার, কাটকাট সিন সেটা। কিন্তু কোনও এক নির্দিষ্ট কারণে, যাত্রার মালিক ভগবান মাইতির প্রৌঢ়া স্ত্রী সত্যভামা, রথযাত্রার পুণ্যতিথিতে যখন চিৎপুরের গদিতে বিউটিবালার। পাশে বসে ভগবানবাবু নায়েকদের সঙ্গে লেনদেন এবং মিঠে পান, মিঠে হাসি বিনিময় করছিলেন, সহসা প্রবেশ করে গদির নীচ থেকে একটি বঁটা তুলে নিয়ে বিউটিবালাকে। আপাদমস্তক আশীর্বাদ করলেন।
বিউটিবালাকে ভগবান মাইতি ধারণা দিয়েছিলেন যে তিনি বিপত্নীক কিন্তু সেই মুহূর্তে সমুদ্যত বঁটা, হাতের নোয়া,শাখা সেই সঙ্গে সিঁথির সিঁদুর,কস্তাপেড়ে লাল শাড়ি এবং সর্বোপরি অধিকারবোধ ইত্যাদি দেখে সত্যভামাকে বুঝতে বিউটিবালার এক লহমা লাগল। সে দ্রুত চিৎপুরের পথ ধরে পশ্চিমদিকে পালাল।
বিউটিবালা আর ফিরে আসেনি। কিন্তু ভগবানবাবু এরপর যথেষ্ট সাবধান হয়ে যান। বিউটিবালার স্থলাভিষিক্তা হয় শম্পারানী। তিনি তার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতেন।
কিন্তু অন্য একটা অসুবিধে হয়েছিল। বিউটিবালা ছিল প্রকৃত যাত্ৰাসুন্দরী। ওজন ছিল একশো কেজি, দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং গভীরতা ছিল পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট বাই আড়াই ফুট। এক কিলোমিটার দুরের সদ্য কাটা ধানখেতের আলের ওপর বসানো পাঁচ টাকার গ্যালারি থেকে জনতা তাকে চোখের সামনে দেখতে পেত।
বিউটিবালার ক অক্ষর ছিল গোমাংস। তার মানে লেখাপড়া শূন্য। সে তুলনায় শম্পা বিদ্যাবিলাসিনী, উত্তর মধ্যমপাড়া বালিকা বিদ্যালয় থেকে সে পর পর চারবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সে কারণেই কিংবা অন্য কোনও কারণে তার ওজন মাত্র চুয়াল্লিশ কেজি। ফলে শ্রীমতী বিউটিবালার পরিত্যক্ত পোশাক শম্পারানীর পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। তার জন্যে মহানুভব ভগবান মাইতি পয়সা খরচ করে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবির সেট বানিয়ে দেয়।
আমার প্রম্পটার খুল্লতাত প্রায় আমার মতোই স্থূলবুদ্ধি, স্ফীতোদর এবং কৃপণ ছিলেন। তিনি ভগবানবাবুকে বিশেষ অনুরোধ করে বিউটিবালার ওই পাঞ্জাবিটি নিজের জন্যে চেয়ে নেন।
কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই কোলাঘাটের কাছে এক গ্রামে একই রাতে শাঁখা ভাঙো সিঁদুর মাছে পালার পরপর দুবার অভিনয় হয়। দ্বিতীয়বার অভিনয়ের শেষদিকে প্রম্পটিং করতে করতে অকস্মাৎ হৃদরোগে আমার খুল্লতাত মহোদয় আক্রান্ত হন এবং পরের দিন কলকাতার একটি হাসপাতালে দেহত্যাগ করেন।
অকৃতদার খুল্লতাত মহোদয়ের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে যাত্রাপালার কয়েকটি মলিন হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি,এক জোড়া হাই-পাওয়ার চশমা, সামান্য তৈজসপত্র এবং তৎসহ জামাকাপড়ের সঙ্গে ওই সিল্কের পাঞ্জাবিটা আমি পেয়েছি।
ছুটির দিনের সায়াহ্নে গজেন্দ্রর দেওয়া রেয়নের ধুতি এবং বিউটিবালার রেশমের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেড়াতে বেরোই। বিউটিবালার পাঞ্জাবি আমাকে চমৎকার ফিট করেছে। তবে আমার এই হৃষ্টপুষ্ট, নধরকান্তি, ভুড়িওলা শরীরে ওই রেশমি পাঞ্জাবি পরলে কেমন একটা অবাঙালি, বেওসায়ি সুলভ চেহারা হয়। সেদিন নিউমার্কেটে মাংস কিনতে গিয়েছিলাম, অচেনা সব দোকানদার, তারা সমস্বরে আমাকে আইয়ে শেঠজি, আইয়ে শেঠজি বলে ডাকতে লাগল। শেঠজিরা যে মাংসাশী নয় সে কথা বুঝিয়ে আমি তাদের জানালাম যে আমি বাঙালি। তারা আমার কথা শুনে মিটমিট করে হাসতে লাগল। বোধ হয় মনে মনে ধরে নিল যে লোকটা মাংস খাওয়ার লোভে নিজেকে বাঙালি বলছে।
০২. মূল কাহিনি
এ গল্প তো নিবারণবাবুকে নিয়ে, অথচ আমি আমার নিজের কথাই বেশি বলে ফেললাম।
অনেক পুষ্করিণীতে সিঁড়ি বাঁধানো ঘাট থাকে। যখন জল গভীর থাকে টইটম্বুর বর্ষাকালে, সিঁড়িগুলো জলের নীচে থাকে। কিন্তু খর গ্রীষ্মে চৈত্র-বৈশাখে যখন জল ফুরিয়ে দিঘির নীচে নেমে যায় তখন দেখা যায় লম্বা সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে বহুদূর পর্যন্ত। আমার এই মূল কাহিনি খুবই সামান্য, গ্রীষ্মের দিঘির জলের মতোই অগভীর তাই অবতরণিকার সিঁড়িটা এত লম্বা।
যা হোক জলের কাছে এসে গেছি, এবার নিবারণবাবুর কাহিনিতে প্রবেশ করছি।
যা বলছিলাম, সময়টা ছিল বোধহয় আশ্বিনের কাছাকাছি। একটু আগে জোর একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়ার পুকুরধারে কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছি। দিন প্রায় শেষ, এখন মেঘ বা বৃষ্টি কিছু নেই। আকাশ সনাতন শারদীয় নীল আভায় ঝলমল করছে। সারা দুপুর গুমোট ছিল, এখন বৃষ্টির পর ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে, সেই হাওয়ায় একটু ঠান্ডার আমেজ মিশে আছে, টের পাওয়া যাচ্ছে শীতকাল আর খুব বেশি দূরে নয়।
আরামে হেলান দিয়ে বসেছিলাম বেঞ্চিটায়। এমন সময় মেরুন রঙের সাফারিসুট পরিহিত শীর্ণকায় এক ভদ্রলোক এসে হাত জোড় করে নমস্কার করে বিনীত হিন্দিতে রাম, রাম, পণ্ডিতজি বলে আমার অনুমতি চাইলেন আমার পাশে বসার জন্যে।
বুঝতে পারলাম খুবই খানদানি লোক, তা না হলে সরকারি বাগানের বারোয়ারি কাঠের বেঞ্চের শূন্য আসনে বসার জন্যে কেউ কারও কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে?
আমি আর অনুমতি কী দেব, একটু সরে বসে আমার নিশব্দ অনুমোদন জানালাম। ভদ্রলোক আমার পাশে বসে দিনশেষের ক্ষীণ আলোয় প্যান্টের পকেট থেকে একটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বাংলা যৌনরহস্যের পত্রিকা বার করে পড়তে লাগলেন। পত্রিকাটির প্রচ্ছদটি খুব চটকদার, একটি অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবতী এলোচুল রমণী বিবস্ত্র বসনে কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, তার পাশে বড় বড় রক্তাক্ষরে লেখা আছে এবারের প্রচ্ছদকাহিনিঃ ব্যভিচারের বলি বিশাখা।
তা হলে ভদ্রলোক বাঙালি, কিন্তু আমাকে ঠাউরেছেন অবাঙালি, একেবারে পণ্ডিতজি। কয়েকদিন আগে কইরা শেঠজি বলেছিল। আজ এই ভদ্রলোক পণ্ডিতজি বললেন। মনে মনে ঠিক করলাম বিউটিবালার রেশমি পাঞ্জাবি পরে আর রাস্তায় বেরোব না।
তবে ভদ্রলোক যেহেতু বাঙালি এঁকে একটু আত্মপরিচয় দেওয়া অনুচিত হবে না এই ভেবে তাকে আমি সাদা বাংলায় বললাম, আপনি কি নতুন? আপনাকে তো এর আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দেখেছি বলে মনে হয় না।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন এবং সেই সঙ্গে অতি দ্রুত এবং সন্তর্পণে যৌন রহস্যের কাগজটি প্যান্টের পকেটে চালান করলেন। তারপর কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে বললেন, আরে, বড়দা, আপনি বাঙালি? কলকাতায় তা হলে এখনও বাঙালি আছে?
ভদ্রলাকের সঙ্গে আলাপ হল, নাম নিবারণ দত্ত। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, এক ছেলে সেও বিদেশে, হিউসটনে অয়েল কোম্পানির একজিকিউটিভ।
দত্তমশায় বড় সরকারি কাজ করতেন, বহুদিন প্রবাসে ছিলেন, এখন রিটায়ার করে কলকাতায় বসবাস করতে এসেছেন। অনেকদিন আগেই টাকা জমা দেওয়া ছিল ক্যামাক স্ট্রিটের এক বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাটের জন্যে, টাকাটা বিদেশ থেকে ছেলেই পাঠিয়েছিল। কী সব আইনঘটিত গোলমালে ফ্ল্যাটটা পেতে বেশ দেরি হয়, মাত্র কিছুদিন আগে হাতে পেয়েছেন এবং স্বামী-স্ত্রী সেখানে এসে উঠেছেন। সংসারে আর কেউ নেই।
দিল্লি থেকে কলকাতার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সরল বিশ্বাসে ফ্ল্যাটের টাকা পাঠিয়েছিলেন নিবারণবাবু, তখন বুঝতে পারেননি ফ্ল্যাট কেনা আর ফ্ল্যাটে ঢোকা এক জিনিস নয়। তার চেয়েও বড় কথা তিনি জানতেন না যে এসব অঞ্চলে আজকাল বাঙালি প্রায় থাকেইনা, বিশেষত এসব অঞ্চলের ফ্ল্যাটে যাদের কালো টাকা বা বিদেশি অর্থ নেই তাদের পক্ষে মাথা গলানো অসম্ভব।
নিবারণবাবুর ফ্ল্যাটবাড়িটা আমি চিনি, আমার বাড়ির কাছেই। কী এক অজ্ঞাত কারণে বাড়িটার নাম জতুগৃহ। যাঁরা কিংবা যিনি এই নামকরণ করেছিলেন তাঁরা বা তিনি অবশ্যই অতি প্রতিভাবান, কল্পনাশক্তিসম্পন্ন লোক। কিন্তু জতুগৃহ নামক বাড়িতে নিবারণবাবুর মতো যাঁরা ফ্ল্যাট কিনেছেন তারাও অবশ্যই অসমসাহসী। তাদের প্রত্যেককে প্রজাতন্ত্র দিবসে পরমবীর চক্র দেওয়া উচিত।
নিবারণবাবুর সঙ্গে ক্রমে ক্রমে আলাপ হল। খুব বিষয়ী এবং সাবধানী লোক। তবে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার একটা অসুবিধে এই যে তার প্রায় সব কথাবার্তাই ওই ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে।
কয়েকদিন আগে দূরদর্শনে জ্বলন্ত চিত্র দেখিয়েছে দিল্লির একটি বহুতল বাড়িতে আগুন লাগার দৃশ্য। ফায়ার ব্রিগেডের ঘণ্টা, ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের দৌড়োদৌড়ি, লেলিহান অগ্নিশিখা–সেসব দেখে দারুণ ভয় পেয়ে গেছেন নিবারণবাবু, জতুগৃহ নামটা নিয়ে মাথা ঘামাতে আরম্ভ করেছে।
এই ফ্ল্যাটবাড়ির প্রমোটর হলেন মেসার্স জে এল আগরওয়ালা অ্যান্ড কোম্পানি। আমার পরামর্শমতো আগরওয়ালা কোম্পানির কাছে বাড়ির নামবদলের জন্যে নিবারণবাবু দরখাস্ত পাঠালেন। তার চিঠি পেয়ে আগরয়ালা কোম্পানি একদিন নিবারণবাবুকে অফিসে দেখা করতে অনুরোধ করল।
নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে নিবারণবাবু জে এল আগরওয়ালা অর্থাৎ কোম্পানির কর্ণধারের দেখা পেলেন বটে, তবে তার প্রাইভেট সেক্রেটারির দেখা পেলেন। সুখের বিষয় প্রাইভেট সেক্রেটারিটি বাঙালি, বিশদভাবে বলা উচিত মধ্যবয়সিনী, লাস্যময়ী বাঙালিনী। হাই হিল, বব চুল, গোলগাল শক্তসমর্থা, আদ্যনাম অফিসে কেউ জানে না, সেখানে সবাই মিসেস সেন বলে জানে।
মিসেস সেনকে নিবারণবাবু জতুগৃহনামে তার আশঙ্কা ও আপত্তির কারণ বিশদভাবে জানালেন। মিসেস সেন তাঁর সুচিক্কণ আঁকা ভুরু নাচাতে নাচাতে এবং বুকের ওপর থেকে লাল জর্জেট শাড়ির আঁচল পাঁচবার ফেলে এবং চারবার তুলে অতিশয় মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।
নিবারণবাবু জতুগৃহ নামের মহাভারতীয় উপাখ্যান এবং তৎসহ সাম্প্রতিক দিল্লির অগ্নিকাণ্ডের কাহিনি সবিস্তারে বললেন।
বিনিময়ে মিসেস সেন একটা দীর্ঘ হাই তুলে শেষ বারের মতো বুকের আঁচলটা তুলে বললেন, আপনি গোড়াতেই ভুল করেছেন।
মাঝে মাঝে হাইহিল জুতোসুদ্ধ চরণকমলদ্বয় নাচাচ্ছিলেন মিসেস সেন, সেদিকে অর্থাৎ গোড়ার দিকে অচঞ্চল দৃষ্টি রেখে নিবারণবাবু প্রশ্ন করলেন, মানে?
মিসেস সেন পা নাচানো থামিয়ে বললেন, আপনার ওই মহাভারত-টহাভারতের ব্যাপার নেই এর মধ্যে। আমাদের কোম্পানির কেউ কোনওদিন মহাভারত পড়েনি। সময় কোথায়? এমনকী টিভিতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দৃশ্য দেখার সময় পাওয়া যায়নি। মিস্টার আগরওয়ালা সেসব সিন ভিডিয়োতে তুলে রেখেছেন, সময় পেলে অবসরমতো দেখবেন। বুকের আঁচল আরেকবার ফেলে দিয়ে আবার পা নাচানো আরম্ভ করে মধুর হেসে মিসেস সেন যোগ করলেন, মিস্টার আগরওয়ালা বলেছেন তখন আমাকেও দেখাবেন।
বস্ত্রহরণের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে নিবারণবাবু থতমত খেয়ে গেলেন, এবার আর মিসেস সেনের পদপ্রান্তে নয়, মেঝেতে চোখ রেখে নিবারণবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তবে জতুগৃহ নাম কী জন্যে?
মিসেস সেন বললেন, আমাদের মালিক, মিস্টার আগরওয়ালা, জে এল আগরওয়ালা সাহেব, ওঁর পুরো নাম হল জতুলাল আগরওয়ালা। জতুলাল সাহেবের বাড়ি, তাই নাম দেওয়া হয়েছে জতুগৃহ।
বাড়ির নামকরণের কারণ বোঝা গেল। কিন্তু নিবারণবাবু আশ্বস্ত হতে পারলেন না।
ইতিমধ্যে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। আমি একদিন তার বাড়িতে গেছি। তিনি দুদিন আমার বাড়িতে এসেছেন। এবং আজকাল প্রায় প্রত্যেক সকালেই ব্রিগেড়ে প্রাতঃভ্রমণে তিনি আমার সঙ্গী। ছুটির দিনের সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়ায়ও তাকে পাশে পাই।
যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তিনি তার ফ্ল্যাট নিয়ে গজগজ করেন, বলেন, আগে জানলে কলকাতায় বাস করতে আসতুম না। সেই যদি অবাঙালিদের সঙ্গেই থাকব, তাহলে তো দিল্লিতে বা বোম্বাইতেই থাকতে পারতুম।
শুধু বাঙালির অভাবই নয়, জতুগৃহে অন্যান্য সমস্যাও আছে। লোডশেডিংয়ের সময় লিফটের জেনারেটার চালু থাকার কথা কিন্তু তা থাকে না। একদিন নীচের তলায় পৌঁছাতে যখন মাত্র দেড় ফুট বাকি, লোডশেডিংয়ে লিফট আটকিয়ে যায়, নিবারণ দত্ত পাকা দেড় ঘণ্টা বন্দি থাকেন সেই আলোবাতাসহীন অন্ধকূপে, নিজের আবাস থেকে নিতান্ত দেড় ফুট দূরত্বে।
আরেকদিন জলের পাম্প খারাপ হয়ে ছত্রিশ ঘণ্টা জল পেলেন না। একেক বালতি জল দশ টাকা করে কিনতে হল তার তেরোতলার ফ্ল্যাটে তুলে দেওয়ার জন্যে। জতুগৃহের কড়া আইন জলের বালতি নিয়ে লিফটে ওঠা যাবে না। সুতরাং দশ টাকা মজুরি বালতি প্রতি বেশি বলা চলে না।
সামনের দরজার শৌখিন মৎস্যমুখী ছিটকিনি একদিন রাতে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে খুলে গেল। সদর দরজা বন্ধ করতে পারা গেল না, সদর দরজা খোলা রেখে তো আর রাতে ঘুমোনো যায় না। অবশেষে স্বামী-স্ত্রী দুজনে ঠেলাঠেলি করে একটা সোফা এনে দরজায় ঠেকা দিয়ে সেই সোফার ওপর শুয়ে রাত কাটালেন।
পরদিন সকালে প্রতিবেশীদের একথা জানাতে তারা সমস্বরে নিবারণবাবুকে বললেন, এখানে তো আমরা সবাই নিজের ছিটকিনি, কড়া, এমনকী কেউ কেউ জানলা, দরজা, বাথরুম পর্যন্ত নিজের মতো করে নিয়েছি। আপনারও তাই করা উচিত ছিল, প্রমোটার আর কত করবে?
সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছে নিবারণবাবুর সব ফ্ল্যাট একই রকম দেখতে বলে। একদিন ভুল করে একতলা বেশি উঠে হনহন করে নিজের ফ্ল্যাট ভ্রমে এক প্রমত্তা গুজরাটি যুবতীর শয়নকক্ষে ঢুকে পড়েছিলেন। যুবতীটি মুডে না থাকলে সেদিন নির্ঘাৎ শ্লীতাহানির চেষ্টায়, অন্তত বেআইনি প্রবেশের দায় নিবারণবাবুর ঘাড়ে ঠিক চাপত।
অবশ্য নিবারণবাবু নিজের ভুল বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে জিব কেটে সরি, ভেরি সরি বলে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তবে এখনও লিফটে, সিঁড়িতে বা উঠোনে সেই সদাহাস্যময় গুজরাটি বধূটির সঙ্গে দেখা হলে নিবারণবাবুর বুক ঢিপঢিপ করে।
তাতেও কোনও রকমে চলে যাচ্ছিল, ইতিমধ্যে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল। ভবানীপুরের নবনির্মিত বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি নিমেষের মধ্যে তাসের বাড়ির মতো ভেঙে পড়ল। বহু লোক হতাহত হল। খবরের কাগজে, দূরদর্শনে, বেতারে হইচই, কেলেঙ্কারি। পুলিশ, করপোরেশন, সরকার সবাই মিলে তুমুল শোরগোল, কাদা মাখামাখি।
ব্যাপার-স্যাপার দেখে নিবারণ দত্তমশায় কেমন যেন ঘাবড়িয়ে গেলেন। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের জতুগৃহ ভেঙে পড়বে না তো মশায়? শেষে আপনাদের কলকাতায় এসে ধনেপ্রাণে বিনাশ হব মশায়? এসব প্রশ্নের আমি আর কী উত্তর দেব? কিন্তু দত্তমশায়ের মাথায় জটিলতর জিজ্ঞাসা উঁকি দিল। তিনি থাকেন চৌদ্দতলা বাড়ির তেরোতলায়। তার জ্ঞাতব্য হল, বাড়ি যদি সত্যিই
ধ্বসে বা ভেঙে পড়ে তবে ওপরের দিকের লোকদেরই বেশি বিপদ, বেশি জীবনসংশয় নাকি নীচের দিকের লোকদের।
আমি নিবারণবাবুকে পাঠালাম আমার পরিচিত এক স্থপতি মানে আর্কিটেক্টের কাছে। তার অভিজ্ঞতা আছে এ ধরনের বাড়ি বানানোর, তিনি যদি কিছু বলতে পারেন। ৫৭০
কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না। অন্য এক গৃহপতনের মামলায় আদালত থেকে অগ্রিম জামিন নিয়ে তিনি কিছুদিন হল নিরুদ্দেশ হয়েছেন। পুলিশই তাকে খুঁজে পাচ্ছে না, নিবারণবাবু আর তাকে পাবেন কী করে?
আজকাল নিবারণ দত্ত সস্ত্রীক যথাসম্ভব বাড়ির বাইরে থাকেন। দৈনিক নুন শো থেকে নাইট শো চারটে করে সিনেমা দেখছেন। গভীর রাত পর্যন্ত চোর ডাকাত, ছিনতাই পার্টি অগ্রাহ্য করে দত্ত দম্পতি ময়দানে, পার্কে ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। গভীর রাতে ঘুমের জন্যে প্রাণ হাতে করে কয়েক ঘণ্টার বাসায় ফেরেন। খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বাড়ির বাইরে সারেন।
নিবারণবাবু আমাকে বললেন, যতক্ষণ বাসায় থাকি, এমনকী ঘুমের মধ্যেও হাত মুঠো করে রাখি। কথাটা আমার চেনা, তবু জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? এত দুঃখের মধ্যেও নিবারণবাবু বললেন, প্রাণটাকে মুঠোর মধ্যে ধরে রাখি কি না?
শুধু নিজের বাড়ি সম্পর্কে ভয় নয়, আজকাল নিবারণবাবু কোথাও কোনও উঁচু বাড়ি দেখলে তার ধারে কাছে ঘেঁষেন না। যথাসাধ্য এড়িয়ে চলেন, কখনও মাথার ওপর ভেঙে পড়বে কে জানে?
নিবারণবাবুর মাথার ওপর অবশ্য বাড়ি ভেঙে পড়ল না। কিন্তু সত্যি সত্যি যা ঘটল তা অবিশ্বাস্য।
জতুগৃহ হল পাশাপাশি একজোড়া চৌদ্দতলা বাড়ি, একই কম্পাউন্ড, একই গেট, দুটো বাড়ির মধ্যে কুড়ি ফুট ব্যবধান। কী এক নৈসর্গিক কিংবা অনৈসর্গিক কারণে হয়তো বিশেষ পারস্পরিক আকর্ষণেই বাড়ি দুটি পরস্পর পরস্পরের দিকে ক্রমশ হেলতে শুরু করল।
প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেয়নি কেউ, তেমন বোঝাও যায়নি কিন্তু অল্প কিছুদিন পরে সকলের নজরেই পড়ল ব্যাপারটা, বাড়ি দুটির ছাদ পরস্পরের খুব কাছে চলে এসেছে।
ওপরের দুই চৌদ্দতলার মধ্যে দূরত্ব কুড়ি ফুট থেকে কমতে কমতে বারো, দশ, আট, অবশেষে দুই ফুটে দাঁড়াল। অবশ্য দুটি বাড়ির মধ্যে ব্যবধান অনিবার্য কারণেই এখন বিশ ফুট।
খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বাড়ি দুটোর ছবি ছাপা হল। বি বি সি চ্যানেল চার না পাঁচ থেকে টেলিভিশনের আলোকচিত্রী এসে জতুগৃহের ছবি তুলে সারা পৃথিবীর লোককে দেখাল। ফরাসি খবরের কাগজে অষ্টম আশ্চর্য ক্যাপশন দিয়ে পিসার হেলানো স্তম্ভের এবং হেলানো জতুগৃহের ছবি পাশাপাশি ছাপা হল।
নিবারণবাবুর বিবাহিত কন্যারা প্রবাসে থাকে। তারা টেলিগ্রাম পাঠাল ভ্যাকেট জতুগৃহ, কাম শার্প ছেলে সুদূর টেকসাসে হিউস্টন শহর থেকে ফোন করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ওই বাড়িতেই কি তোমরা আছ?
আছেন বটে নিবারণবাবু কিন্তু বড় কঠিন হয়ে গেছে ব্যাপারটা। বাড়ি দুটির মাথা এখন সম্পূর্ণ একত্র হয়ে গেছে। মাতালেরা যেমন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সেইরকম অবস্থা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় দুই অতি দীর্ঘকায় প্রাগৈতিহাসিক জন্তু পরস্পর গুঁতোগুঁতি করছে।
এদিকে বাড়ির মেঝে কাত হয়ে গেছে। চেয়ার, টেবিল, খাট, আলমারি সব কাত। কাত হওয়ার। জন্য লিফট আর উঠছে না, সিঁড়ির গর্তে কোনাকুনি ভাবে আটকিয়ে গেছে।
বাড়িতে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কিছু গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। টেবিল থেকে চিনেমাটির পেয়ালা, পিরিচ, কাঁচের গেলাস ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে ভেঙে যাচ্ছে। বইয়ের র্যাক বই সমেত গড়াগড়ি খাচ্ছে। আলমারি খুললে তাকের ওপর থেকে ভেতরের জিনিসপত্র নীচে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। এমনকী ঘুমন্ত মানুষ হেলানো খাট থেকে পড়ে গিয়ে আহত হচ্ছে, রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাচ্ছে। জেগে থাকা অবস্থায় খাটে শুয়ে থাকতে হলে খাটের বাজু আঁকড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
জতুগৃহের অধিবাসীরা একে একে বাক্স-বিছানা, আসবাবপত্র এবং মূল্যবান প্রাণ নিয়ে যে যার সাধ্যমতো পলায়ন করল। যে যেরকম দামে পারে ফ্ল্যাট বেচে দিতে লাগল। কেনার দাম ছিল সাড়ে আট লাখ টাকা, এখন বেচার সময় দাম পড়তে পড়তে তিরিশ হাজারে নেমে এল।
পাড়ায় থাকি, সব খবরই পাই। কিন্তু নিবারণবাবুর সঙ্গে আর দেখা হয় না। ধরে নিয়েছিলাম তিনিও পলায়ন করেছেন। কিন্তু হঠাৎ সেদিন রাস্তায় মোড়ে দেখা।
দেখা হতে জিজ্ঞাসা করলাম, কী খবর? আপনি এখনও আছেন?
নিবারণবাবু বললেন, আছি মানে কি? চমৎকার আছি। সব ছেড়ে যাওয়া খালি হওয়া ফ্ল্যাট আমি কিনে নিচ্ছি।
আমি বললাম, সর্বনাশ! এসব কী করছেন? আপনার শরীর মানে মাথা ঠিক আছে তো? এ তো জীবন নিয়ে খেলা, আপনার ছেলেকে জানিয়েছেন সব ব্যাপার?
নিবারণবাবু হাসলেন, হেসে বললেন, জানাব কী? ছেলের পরামর্শেই তো সব কিছু করছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পরামর্শ? আপনার ছেলে এ ব্যাপারে কী পরামর্শ দিয়েছে?
নিবারণবাবু বললেন, এ বাড়ি নিয়ে আমেরিকায় হইচই পড়ে গেছে। আমার ছেলে এ বাড়ির ফ্ল্যাটগুলো আমেরিকায় ধনকুবেরদের কাছে অষ্টম আশ্চর্য কলকাতার হেলানো ফ্ল্যাট (Leaning flats of Calcutta) নামে একেকটা পাঁচ-ছয় লাখ ডলারে বেচছে, যার মানে আমাদের টাকায় প্রায় এক কোটি টাকা।
আমি বললাম, তারপর।
নিবারণবাবু বললেন, তারপর আর কী? কোটিপতি হয়ে যাব। এ বাড়িতে থাকি ভাল, না থাকি যেখানে ইচ্ছে চলে যাব। আর থাকলেই বা অসুবিধে কী? আগেও অবাঙালির সঙ্গে ছিলাম, এখনও তাই থাকব। এরা তবু মন্দের ভাল, খাঁটি সাহেব, কুলীন মার্কিনি সাহেব।