জটা তান্ত্রিকের খপ্পরে – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

জটা তান্ত্রিকের খপ্পরে – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

কথায় আছে, কানার পা-ই খানায় পড়ে। তাই পড়ল শেষপর্যন্ত। পই পই করে বারণ করেছিল সকলে, শেওড়াতলি থেকে বেলতলা, নেহাত কম রাস্তা তো আর নয়, এমন সময়ে যাত্রা না-করাই ভালো। বিশেষ করে রাস্তায় পড়বে জটা তান্ত্রিকের আখড়া, একবার যদি তার হাতে পড়েছ তাহলেই গেলে—ভূত ভবিষ্যৎ সব একেবারে ঝরঝরে। তা শুনলে তো সে-কথা কাঙালিচরণ। উঠতি মস্তান, এধার-ওধার তিড়িং-বিড়িং করে বেড়াচ্ছে, ভাবলে এ আর কী এমন কাজ, আঁধার নামার আগেই পৌঁছে যাব বেলতলায় গুল্লুমামার কোলে। নাও, ঠেলা সামলাও এখন!

না, সাবধান কাঙালিচরণ হয়নি বলাটা ঠিক হবে না। চোখে না-দেখলেও জটা তান্ত্রিকের নামে হাড় হিম হবে না এমন চ্যাংড়া ভূভারতে নেই। বড়োরাই আঁতকে ওঠে তার কথা শুনে, ছোটোদের তো কথাই নেই। তবে সাবধানের যেমন মার নেই বলে, মারেরও তো সাবধান নেই! সেই রকম ব্যাপারই একটা ঘটে গেল বলা যেতে পারে। মাঝ রাস্তাতেই দিনের আলো কেমন নিবে এল, সাঁই সাঁই করে ছুটে এল ঝড়ো হাওয়া, দিগবিদিক ঠিক করতে না-পেরে বিরাট এক বট না-অশ্বত্থের গুঁড়িতে মাথা ঠুকে যেই পড়েছে মাটিতে মাথা ঠুকরে, শুনতে পেয়েছে পিলে-চমকানো হাসি—’হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ। হোঃ হোঃ  হোঃ  হোঃ। হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ!  ব্যোম শংকর—জয় তারা।’

বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চোখ ভয়ে, কিন্তু যা দেখবার তার মধ্যেই দেখে নিয়েছিল। যেন আর এক মহাদুর্যোগ! ছুটে আসা কালোমেঘের মতো দাড়ি-গোঁফ-জটার জঞ্জাল। ঝলকে ওঠা বিদ্যুতের মতো ঝকঝকে দাঁতেরপাটি, আর মেঘ গর্জনের মতো কণ্ঠস্বর—হাসির ফাঁকে ফাঁকে বলছিল, ‘আমার হাত থেকে পালাবি, ব্যাটা পিলে-পটকা ঘমের পাঁচন কোথাকার!’ ফলে, চোখ খুলতে আর ভরসা হচ্ছিল না, ওই ভাবেই মটকা মেরে পড়েছিল।

না, চোখে দেখেনি কাঙালিচরণ জটাকে এর আগে। সে ক-টা লোকই বা তাকে চোখে দেখেছে! কিন্তু শুনেছে তার সম্বন্ধে অনেক কিছু। জ্যান্তো-মানুষের সঙ্গে নাকি তেমন পটে না জটা-তান্ত্রিকের, তার কারবার সব মরা মানুষ নিয়ে। মানুষের মুণ্ডু নিয়ে পঞ্চমুণ্ডির আসন বানিয়েছে, মানুষের রক্ত দিয়ে তার পুজোবেদির আলপনা আঁকা হয়, মরা মানুষের বুকের ওপর চেপে নাকি তার সাধনা। সারাদিন মদ-ভাঙ খেয়ে ঝিমোয় জটা, সূর্যের আলো নিবু নিবু হলেই নাকি তার পরাক্রম বাড়ে। যেমন আজ এখন বেড়েছে।

সবাই বলে জটা তান্ত্রিক পিশাচসিদ্ধ। মানেটা কাঙালিচরণ ভালো বোঝে না। তবে এটুক বোঝে, মানুষ তো কোন ছার—ভূতপ্রেতরাও জটার কাছে ছেলেমানুষ। তা যে-লোক মরা মানুষের দেহ সাধনা করে, ভূতপ্রেতরাই বা তার কী করবে! ভূত-পেত্নিরা নাকি তার হুকুমে ওঠে বসে, এমন কথাও শুনেছে কাঙালিচরণ! চোখে দেখার পর মনে হয়েছে কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে। এরকম ভয়ংকর জায়গায় যে থাকে তার মনে কি আর ভয়ডর বলে কিছু থাকতে পারে! ভূতদের নিয়ে তো সে ছেলেখেলা করতে পারে।

সে না-হয় হল, কিন্তু কাঙালিচরণকে মিছিমিছি এভাবে আটকাল কেন জটা, সেটাই তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য জটাই যে ওকে আটকেছে সেটা বলা ঠিক নয়, কাঙালি নিজেই ঝড়ের দাপটে গোঁত্তা খেয়ে পড়েছে, কিন্তু ওকে দেখে জটা তান্ত্রিকের যে উল্লাস, সে তো আর মিথ্যে নয়। ওকে দেখে জটার এত আনন্দ কেন! তাহলে কি সাধনা করার জন্যে নতুন একটা শবই খুঁজে পেয়ে গেল জটা? সেই জন্যেই ওই হাসি?

কথাটা মনে হতেই বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠল কাঙালির। চোখ বন্ধই ছিল, এখন জোর করে চোখের পাতা আরো চেপে ধরল ও। টের পেল বোধ হয় সেটা জটা। চোখ বুজেই শুনতে পাচ্ছিল জটা বলছে, ‘কীরে ব্যাটা উচ্চিংড়ে, খুব ঘেবড়ে গেছিস মনে হচ্ছে।’

না, ঘাবড়ে যাবে না!  চোখের সামনে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাঁড়িয়ে আছ তুমি—দাড়িগোঁফের জঙ্গল থেকে বত্রিশ পাটি চমকাচ্ছ, হাসির তালে তালে তোমার দশমনি ভুঁড়ি নাচছে, এতেও যদি ঘাবড়াব না তো ঘাবড়াব কীসে! কথাগুলো মুখে বলবার ক্ষমতা অবশ্য কাঙালির ছিল না, কোনো রকমে একটুখানি চোখ খুলে পিটপিট করে চাইল, বলল, ‘আজ্ঞে তা একটু গেছি।’

‘একটু কেন, বিলক্ষণ!’ আবার ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসল জটা তান্ত্রিক, বলল, ‘তা মরতে এলি কেন এখেনে? মতলবটা কী তোর?’

‘কিছু মতলব নেই এজ্ঞে’—একটু যেন আশার আলো দেখতে পেয়েছে এইভাবে হাঁকুপাকু করে বলে উঠল, ‘ঝড়জলে রাস্তা ঠাহর করতে পারিনি, তাই এসে পড়েছি। নইলে সাধ করে এজ্ঞে আপনার এখেনে কি কেউ’—

‘কেন কেন কেন?’ হুংকার দিয়ে উঠল জটা, সমস্ত গাছপালা কেঁপে উঠল যেন সে-হুংকারে, দাঁত খিঁচিয়ে, বলল, ‘আমি বাঘ না-ভাল্লুক? ধরব আর তোকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলব?’

তা তুমি পারো বাপু, আমার মতো একশোটাকে ধরে কচমচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারো, সে আমি জানি।

না, এবারও কথাটা মুখে বলল না কাঙালি, ভয়ে ভয়ে শুধু মুখ দিয়ে তার বেরুল, ‘না না, সেকি কথা এজ্ঞে, আপনি এত বড়ো তান্ত্রিক, আর আমি একটা বাচ্চা ছেলে’—

‘ও বাচ্চাই হও আর চৌবাচ্চাই হও, আমার কাছে কারো রেহাই নেই’—আবার এক হাড়কাঁপানো হাসি! হাসতে হাসতেই বলল জটা, ‘মানুষ তো কোন ছার, দত্যিদানোও ভয় করে আমাকে দেখে।’

‘জানি তো এজ্ঞে।’ ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে কাঙালির।

‘বটে! কী করে জানলি?’

‘শুনেছি এজ্ঞে লোকের মুখে।’

‘চোখে দেখে যা এবার’—সামনের বিরাট ডালপালাওয়ালা গাছে কয়েকটা চামচিকে ঝুলছিল, সেদিকে আঙুল তুলে জটা বলল, ‘কী বল দিকি ওগুলো?’

‘বাদুড় চামচিকে এইসব বোধহয় কিছু’—

‘তোমার মুণ্ডু!’ ধমকে উঠল জটা, ‘ওগুলো সব গেছো ভূত। চামচিকে বানিয়ে রেখেছি আমি ওদের। খেলা দেখতে চাস তো বল, নামিয়ে আনি ওদের গাছ থেকে।’

‘না না এজ্ঞে’—আর্তনাদ করে উঠল কাঙালি, ‘ওসব দেখে কাজ নাই আমার।’

‘কাজ নাই! কী বললি, কাজ নাই? তাহলে কী করে বুঝবি আমার মাহিমা?’

‘আপনার মহিমা হুজুর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এ তল্লাটে কে জানে না আপনার কথা?’

‘সব তল্লাটে জানবে। তিন কুড়ি শবসাধনা করে আমি পিশাচসিদ্ধ হয়েছি, দত্যিদানো রাক্ষস পিশাচ সব আমার মুঠোর ভেতর—কারো ক্ষমতা নেই ট্যাঁ-ফোঁ করে।’

‘জানি এজ্ঞে।’

‘কী করে জানলি?’

‘ওই যে এজ্ঞে দেখালেন গেছো ভূতদের!’

‘আরো অনেক দেখাতে পারি, গাছতলায় ওই যে যন্তরটা পড়ে রয়েছে দেখতে পাচ্ছিস?’

‘কোনটা এজ্ঞে, ওই যে আখমাড়াই বলের মতো যন্তরটা?’

‘ওটা আখমাড়াই কল নয়।’

‘তবে?’

‘ভূত-মাড়াই কল।’

‘এজ্ঞে!!!’ বিস্ময়ে গলাটা চিঁ চিঁ করে উঠল কাঙালিচরণের।

‘ভূত ধরে ওতে মাড়াই করি আমি। তাইতে কালো কুটকুটে তেল বেরোয়, আলকাতরার মতো কালো। সেই তেল অনেক কাজে লাগে আমার।’

কী কাজে লাগে জিজ্ঞাসা করবার সাহস ছিল না কাঙালির। গোটা ব্যাপারটা হজম করাই খুব কঠিন হচ্ছিল ওর পক্ষে। মনে হচ্ছিল গায়ে আর ছিটেফোঁটা শক্তিও নেই। ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকাচ্ছিল চকাভুলকোর মতো। দেখে আর এক দফা হাসি জটা তান্ত্রিকের, তবে এবার আর ঘাবড়ে গেছে কিনা জিজ্ঞাসা করল না, বলল, ‘বাদ দে ওসব কথা। তোকে কী-কাজে লাগাব মনে করেছি সেটাই এবার বলি।’

বুকটা ধক করে উঠল কাঙালিচরণের। কোনো রকমে সাহস সঞ্চয় করে শোনার চেষ্টা করল কী বলছে লোকটা! আর একবার ব্যোম শংকর আর মা তারা হাঁক ছেড়ে বলল, ‘তিন কুড়ি শব সাধনা করে পিশাচসিদ্ধ হয়েছি আমি, আরো দু-কুড়ি করতে পারলে ঠাকুর-দেবতাও আমার কিছু করতে পারবে না, এমনি হবে আমার শক্তি। কিন্তু সেই দু-কুড়ি পূর্ণ করতে এখনও পারিনি আমি, এক কুড়ির মতো এখনও বাকি আছে। তাই তোকে দেখে আমার এত আনন্দ হয়েছিল।

কী সর্বনাশ! এ তো যা ভেবেছিল তাই!

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিল, আওয়াজ বেরুছিল না মুখ দিয়ে, কোনো রকমে কাঁচুমাচু মুখ করে বললে কাঙালিচরণ, ‘এজ্ঞে, আমাকে ওসব বলবেন না, ভয় করে।’

‘ভয় করে! কেন?’

‘হাজার হোক, বয়সটা অল্প তো এজ্ঞে, মারব ধরব শুনলে’—

‘দূর ব্যাটা হতচ্ছাড়া বিটলে কেলো ভীতুর ডিম!’ গর্জন করে উঠল জটা তান্ত্রিক, ‘মায়ের কাছে উচ্ছুগগু করা হবে তোকে, এতো পুণ্যের কথারে! এ জন্যে তুই ভয় পাচ্ছিস!’

শুকনো গলায় চিঁচিঁ আওয়াজ বার করে কাঙালি বললে, ‘আমাকে ছেড়ে দ্যান তান্ত্রিক-মশাই, আর কোনোদিন এ তল্লাট মাড়াব না আমি, এই নাকে খত দিচ্ছি।’

‘দূর কালীকুষ্টি খ্যাঁদাচরণ। নাক তোর নেই মোটে তা খত দিবি কী! যা বলছি তাই শোন’—

‘এজ্ঞে’—

‘কথা না-শুনেই এজ্ঞে! মনে হয় একহাতে মুচড়ে দিই তোর ঘাড়টা’—জটা তান্ত্রিক চোখ গোল গোল করে বললে, ‘তোকে আমি বলেছি, আমার শবের আসন করব?’

‘না এজ্ঞে ওই যে কেমনধারা কথা বলছিলেন’—

‘চোপ! মায়ের কাছে আগে মানত না-করলে তার শবে কাজ হয় না। সে মানত আমি একজনকে করে রেখেছি।’

‘আঃ বাঁচালেন’—কবুতরের খাঁচার মতো বুকথেকে ফোঁস করে খানিকটা নিশ্বাস বেরিয়ে গেল কাঙালিচরণের, বললে, ‘তাইলে আমাকে এমন ভয় দেখাচ্ছিলেন কেন হুজুর?’

‘আরে বেল্লিক ছুঁচো, তোকে একটা কাজ করে দিতে বলছিলাম আমার। পারবি? তা হলে বেঁচে গেলি এ যাত্রা, নইলে—’

‘একশোবার পারব হুজুর, হাজারবার পারব, পেত্যয় না-হয় বলেই দেখুন একবার।’

‘বলবার আগেই তো দাঁতমুখ ছটকে বসে আছিস। কথাটা বলি তাহলে, মন দিয়ে শোন।’

‘বলুন এজ্ঞে!’

‘এই গাছ পেরিয়ে দু-কদম গেলেই একটা ছোটো নদী, নদীর ওপারে আম-জাম-কাঁঠালের বন। সেই বনে আজ দু-দিন থেকে দেখছি তোর মতো একটা উচ্চিংড়ে নিয়ম করে আসছে।’

‘জানে না বোধহয় এজ্ঞে এখেনে আপনার অধিষ্ঠান, জানলে পরে’—

‘চোপ! বাজে কথা একদম বলবি না। গরিব ছোঁড়া, ফল-পাকুড়ের সন্ধান পেয়েই আসে নিশ্চয়ই। আর সন্ধে হলেই নদীর ওপারে দু-হাত জড়ো করে এক পেট জল খায়, তারপর পেছন ফেরে। ওই সেই ছোঁড়াকেই মনে মনে আমি উচ্ছুগ্গু করেছি মায়ের কাছে।’

‘বেশ করেছেন এজ্ঞে’— ছেলেটাকে চোখে দেখেনি কাঙালিচরণ, কিন্তু তবু কেমন যেন মায়া হচ্ছিল তার জন্যে। মুখে সে ভাবটা একেবারেই না-ফুটিয়ে বলল, ‘আমাকে তাহলে ছেড়ে দ্যান এবার।’

‘ফের মুখের ওপর কথা বলে।’ ধমকে উঠল জটা তান্ত্রিক, ‘তোকে যে একটা কাজ করতে হবে বললাম, সেটা ভুলে বসে আছিস !’

‘কী কাজ এজ্ঞে!’

‘নদীর এপারে আমাকে দেখেই ছোঁড়া পালায়। ভয় পায় নিশ্চয়ই, চেহারাটা তো আমার খুব ভদ্রসভ্য নয়, কী বলিস!’ গাঁক গাঁক করে হেসে উঠল জটা তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘ওই ছোঁড়াটাকেই এখেনে ডেকে আনতে হবে তোকে।’

‘আমি!’

‘কেন, তুমি কোন হদ্দমুদ্দ খাজান খাঁ। এটুকু করতে পারবি না আমার জন্যে!’ মন থেকে সায় পাচ্ছিল না, তাং কাঙালি বলল, ‘ওকে এনে দিলেই ছেড়ে দেবেন আমাকে? সত্যি বলছেন!’

‘তবে কি তোর সঙ্গে মশকরা করছিরে হ্যাঁংলা মুখো। চিৎকার করে উঠল জটা তান্ত্রিক, ‘আমার যে কথা সেই কাজ। ছোঁড়াটাকে তুই আনতে পারবি কিনা তাই বল।’

‘একশোবার পারব—বললাম তো এজ্ঞে!’ কাঙালিচরণ বললে, ‘কিন্তু আপনি তো বললেন সন্ধেবেলায় আসে ছোঁড়াটা; এখন তো রাত্তির!’

‘ধ্যাৎ হাঁদা গঙ্গারাম! ঝড়জল বলে ওরকম মনে হয়েছে। আসলে এবারই সন্ধে লাগছে।’

‘নদীর ধারে গেলে দেখতে পাব ওকে?’

‘পাবি।’

‘তবে যাচ্ছি।’ কাঙালিচরণ এগুতে যাচ্ছিল, পেছন থেকে হাঁক শুনে থামল। জটা তান্ত্রিক বলছিল, ‘যদি পালাবার চেষ্টা করিস তো মরবি।’

‘এজ্ঞে ছি, পালাব কেন?’

‘কথাটা মনে করিয়ে দিলাম। একটা যন্ত্রর তো তুই দেখেছিস, আরো অনেক যন্তর আমার এখেনে মজুত আছে—এখেন থেকে কল টিপব, নদীর ওপারে মুখে রক্ত তুলে মরবি। আমার নাম জটা তান্ত্রিক, মনে রাখিস কথাটা।’

‘মনে থাকবে এজ্ঞে, একটুও ভুল হবেনি।’

‘অবশ্য আমি তোর পেছনেই থাকব, ভুল হলে, মনে করিয়ে দিতে হবে তো’—বিকট হাসি ছাড়ল একটা জটা, বললে, ‘চল।’

ভুল বলেনি জটা তান্ত্রিক। সন্ধে হয়ে এসেছে। আবছা আলো। ওপারে বড়ো বড়ো গাছ কেমন আঁধার করে রেখেছে জায়গাটা। তা সত্ত্বেও কাঙালি দেখতে পাচ্ছে লাঠির ডগায় বড়ো একটা পুটলি বেঁধে তারই বয়সি একটা ছেলে নদীর ধারে আসছে জল খেতে।

‘সোজা, চলে যা সাঁতার দিয়ে, এই আমি দাঁড়িয়ে রইলাম গাছের আড়ালে’—জটা বললে ‘এপারে অনেক সোনাদানা আছে বলবি, গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিস বলবি—বলবি তুই একা বয়ে নিয়ে যেতে পারছিস না, সেইজন্যে ওকে ডাকতে এসেছিস। মনে থাকবে!’

‘খুব থাকবে এজ্ঞে। খুব করে লোভ দেখাতে হবে ওকে।’

‘অ্যাই ! বোকা হলে কী হয়, বুদ্ধি আছে তোর? যা, চলে যা।’

বলার যেটুকু অপেক্ষা, নদীর ওপর দিয়ে শাঁ শাঁ করে ভেসে বেরিয়ে গেল কাঙালিচরণ। ওপারে নেমে চেয়ে দেখল, অবাক চোখে তাকিয়ে আছে জটা তান্ত্রিক, বিড় বিড় করে কী সব বলছে যেন। এবার হাসার পালা কাঙালিচরণের সে খিক খিক খ্যাঁক খ্যাঁক ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে হেসে বললে, ‘ভুল করেছো গো জটা তান্ত্রিক, আমি তো কী বলে ওই ছোঁড়ার মতো মানুষ নই গো, এসব বিদ্যে আমার জানা আছে। তোমার ওই যন্তর এখন আমার কিছু করতে পারবে না গো। শেওড়াতলির আড্ডা থেকে গুল্লুমামার কাছে যাচ্ছিলাম বেলতলার শ্মশানে। মাঝপথে বেবভুল করে ধরা পড়েছিলাম তোমার হাতে। তবে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে খুব গো জটে ঠাকুর, অস্বীকার করব না। এই আমি পগার পার হলাম, আর কোনোদিন আসবনি এখেনে।’

ফুস করে হাওয়ায় উড়ে সত্যিই কাঙালিচরণ পগার পার। তবে আকাশ পথে নিজেকে মেলে দিয়ে সত্যিই ভেতর থেকে একটা হাসির দমক ঠেলে আসছিল ওর। মানুষ মরে ভূতের ভয়ে, আর ভূতই পালাচ্ছে মানুষকে দেখে। কথাটা শুনলে গুল্লুমামা যা হাসবে, এখনই দেখতে পাচ্ছে যেন চোখে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *