জটাধরের জট – আনন্দ বাগচী
আবেগের ঝোঁকে কী একটা কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম জটা আর আমার পাশে নেই। একসঙ্গে পথ চলতে চলতে কখন দাঁড়িয়ে পড়েছে। নির্ঘাত স্যান্ডেলের ফিতেটিতে ছিঁড়ে আর হাঁটতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে আবার ওর দিকে ফিরে গেলাম। কয়েক পা এগিয়েই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা গুরুতর। শিকারি বেড়ালের মতো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ও যেন চোখ-কান-নাক দিয়ে একসঙ্গে বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত, এই মুহুর্তে ও কোনও রহস্যের গন্ধ পেয়েছে।
আর পায়ও বাবা! এই কলকাতা শহরে পদে পদে যে এত রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছড়িয়ে আছে, কথায় কথায় এত রহস্যজনক ঘটনা ঘটছে সে-কথা জটার চেয়ে বেশি আর কে জানে। শুধু গল্পের বই-ই নয়, অপরাধ জগতের অনেক গোপন তথ্যই তার গুলে খাওয়া আছে। এক-এক সময় সন্দেহ হয় রাডার যন্ত্রের মতো একটা বাড়তি কোনও চুম্বক-ইন্দ্রিয় ওর ভেতরে ভগবান হয়তো পুরে দিয়েছেন।
ওর কাছ বরাবর পৌঁছবার আগেই জটা এক কাণ্ড করে বসল। সুতোকাটা ঘুড়ির মতো এপাশে-ওপাশে বার দুই লাট খেয়েই আচমকা গোঁত্তা মেরে ও কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেল। আমি বেকায়দা বোকা বনে গেলাম। একবার মনে হল ভ্যানিশ হবার আগের মুহূর্তে ওর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়েছে নইলে ওর ঠোঁটের হাসি আর একচোখের ওরকম ইশারার কোনও মানেই হয় না।
কিন্তু এ কী কাণ্ড! ও যে একেবারে নেই হয়ে গেল। এই ভরা বিকেলে, জনবহুল কলকাতার রাস্তা থেকে কর্পূরের মতো উবে যাওয়া— এ ভোজবাজি ছাড়া আর কী! আমার প্রাণের বন্ধু, ক্লাস এইটের সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা এবং সেলফ-মেড গোয়েন্দা শ্রীমান জটিলেশ্বর ধর ওরফে জটার প্রবেশ-প্রস্থান অনেক সময় এই রকমই নাটকীয়। ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে হাড়ে হাড়ে আমার এ শিক্ষা হয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়িই ফিরে যাব ভাবছি এমন সময় হঠাৎ সামনের রেস্তোরাঁর মধ্যে চোখ পড়ল। চমকে গেলাম, আরে ওই তো এককোণে জটা বসে আছে। বিশ্বাস করা শক্ত।
ঘুড়ি ধরতাই দেবার মতো করে মুখের সামনে দুই হাতে খবরের কাগজখানা ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ওই সাতবাসি কাগজখানা আমি চিনি, ওর জায়গায় জায়গায় পেরেক দিয়ে ছোট ছোট ফুটো করা আছে। দূর থেকে দেখা যায় না কিন্তু দিব্যি অন্য লোকের ওপর নজর রাখা যায়। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী কাঁধের ঝোলার মধ্যে গোয়েন্দাগিরির এমনিতর অনেক দরকারি জিনিস মজুত থাকে সব সময়। ঝুটো দাড়ি-গোঁফ, স্পিরিট গাম, রবারের নকল আব, কালো চশমা, ডুপ্লিকেট চাবির গোছা ইত্যাদি।
এরকম পরিস্থিতি হলে আমাকে কী করতে হবে তালিম দেওয়াই ছিল। আমি তাই ওকে ঘাঁটালুম না। খোদ ডিটেকটিভের সুযোগ্য অ্যাসিসট্যান্টের মতো চুপচাপ চায়ের দোকানের ভেতর ঢুকে কায়দা মতন একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। যেন নিতান্তই চা খেতে ঢুকেছি, জটাকে আমি কস্মিনকালেও চিনি না। জটাও তাই, সে আমাকে দেখেও যেন দেখতে পেল না। উঁচু গলায় বয়কে ডেকে এক কাপ চা চাইল। আমিও। আমার হাত তিন-চার তফাতে অন্য একটা টেবিলে দুটো অদ্ভুত চেহারার লোক নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় মশগুল ছিল। খবরের কাগজের আড়াল দিয়ে জটা যে ওদের ওপরেই নজর রেখেছে বুঝতে কষ্ট হল না। হিন্দি সিনেমার ভিলেন মানে শয়তানের মতো দেখতে লোকটার মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, চোখে কালো চশমা, ঠোঁটের কোণে একটা লম্বা সিগারেট নৌকোর দাঁড়ের মতো ঝুলে আছে। কোনাকুনি বসা অন্য লোকটা ঢ্যাঙা, দড়ি পাকানো সিরিঙ্গে চেহারা, বাঁ চোখটা রামট্যারা— ছুঁচোবাজির মতো কোন দিকে যাচ্ছে ধরা যায় না। পুরনো চিনে আমলের ঝোলা গোঁফ। লোকটা মনে হয় দাড়িয়ালের শাকরেদ। আড়চোখে ওদের মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছিলাম আর কান খাড়া রেখেছিলাম কী কথা বলে শোনবার জন্যে।
এ-কথা সে-কথার পর দাড়ি বলল, “তোমার ঘুঘু পাখি ভাগেনি তো?”
ট্যারা-চোখ হায়েনার মতো হেসে উঠল, “ওস্তাদ, ডোন্ট ওরি। বাছাধন একবার যখন ফাঁদে পড়েছেন—”
“ভাবি কি সাধে। গতবার শেষ মুহূর্তে কী রকম হাত ফসকে পালাল মনে আছে তো— বি কশাস, কাকপক্ষীও যেন টের না পায়। টিকটিকি কিন্তু ঘুরঘুর করছিল—” চাপা গলা লোকটার।
“জানি এখনও নজর রেখেছে। তবে আমার এই কাঁচি চোখে ধুলো দেওয়া অত—”
আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল, চমকে তাকালাম। ওরা বোধহয় জটাকে চিনে ফেলেছে। টিকটিকি মানে যে ডিটেকটিভ, মানে শখের গোয়েন্দা, গল্পের বই মারফত সে-কথা আমার জানা। কিন্তু খবরের কাগজ-চাপা গোয়েন্দার দিকে সম্ভবত এখন ওদের নজর নেই। এইমাত্র ওদের টেবিলে মোগলাই পরোটা পৌঁছল। ট্যারার উলটো- সোজা দুটো চোখই সেই লোভনীয় ডিশের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ধোঁয়া-ওঠা কষা মাংস উইথ চাটনি-পেঁয়াজ ল্যান্ড করল।
দাড়ি জিভের জলের ঢোক গিলে বলল, “মোদ্দা কথা ছলে-বলে-কৌশলে কাজ হাসিল করা চাই। লিখে দিতে বাধ্য করা। এদিকে দিন কিন্তু ঘনিয়ে এসেছে, হাতে সময় নেই। একেবারে ফিনিশ করে দিতে বলো।”
“তা হলে তো গুরু, শুধু কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, কিছু পাত্তি ছাড়তে হবে। আগাম চাই।”
“পাবে। কিন্তু কাজ কদ্দূর?”
“যে রকম দেখে এসেছি, আজ রাতেই মার্ডারটা কমপ্লিট হয়ে যাবে। তারপর তো সব ছকমাফিক, টাইম নেবে না।”
চায়ের দোকানে বসে এরকম রোমহর্ষক আলোচনা শুনছি ভাবাই যায় না। আমার তিন-চার হাত তফাতে বসে দুটো জলজ্যান্ত বদমাশ খুনের প্ল্যান আঁটছে, আমি নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কে জানে ভুল শুনছি কি না। জটার দিকে তাকালাম। তার চোখদুটো ছানাবড়া, চুলগুলো খাড়া খাড়া হয়ে উঠেছে। বুঝলাম কথাগুলো তারও কানে গেছে।
চা এসে গিয়েছিল, অন্যমনস্ক হয়ে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁটে ছ্যাঁকা খেলাম, জিভও পুড়ল। ওদিকের টেবিলেও আর কথা নেই, শুধু মোগলাই-কষা মাংসের কষ্টদায়ক শব্দ শুনতে পাচ্ছি। লোভ থেকে রাগ, ডবল রাগ হচ্ছে লোকদুটোর ওপর। হঠাৎ কানে এল, ট্যারা-চোখ চাকুম-চুকুম গলায় বলছে, “স্যার, তা হলে একবার অকুস্থলে চলে আসুন সন্ধের পর, নিজের চোখে অবস্থাটা প্রত্যক্ষ করে যান। আমি আটটা নাগাদ দানাপানি দিতে যাব অবিশ্যি।”
দাড়ি খ্যা খ্যা করে হাসল, ‘ঠিকাচে। কিন্তু তোমার শিকারটিকে তুলেছ কোথায়?”
“রাস্তার ও-ফুটে ব্যাঙ্কবাড়ির তিনতলায়। সাতাশ নম্বর ঘর। চাবি রেখে যাচ্ছি আপনার জন্যে।”
উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল। যাক এইটুকুই আমাদের জানবার ছিল। এই রেস্তোরাঁ থেকে বিশ-পঁচিশ গজের মধ্যেই এক অসহায় মানুষ মৃত্যুর অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনছে কেউ শুনলেও বিশ্বাস করবে না।
জটা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। অর্থপূর্ণ চোখে সে আমার দিকে তাকাল।
ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে চাপা অস্বস্তি আর আশঙ্কায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এক-একটা সেকেন্ডকে মিনিট মনে হচ্ছে। আমার এক হাত ব্যাঙ্কবাড়ির দোতলার সিঁড়িতে, অন্য হাত বাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা গুপ্তিটার বাঁট শক্ত করে ধরে আছে। কাঠবেড়ালির ল্যাজের মতো পুরুষ্ট গোঁফজোড়া নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এই সশস্ত্র ছদ্মবেশ আমার আদপে পছন্দ না।
আসলে একটু আগেও আলো ছিল। একে রবিবার তায় অফিসবাড়ি বলে একতলা দোতলার সব ঘরগুলোই তালাবন্ধ। সিঁড়িটা নির্জন। দু’জনে সন্তর্পণে তিনতলায় উঠছিলাম এমন সময় ঝপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। আলো নিবে যাওয়ায় ক্ষতি ছিল না বরং এক দিকে সেটা আমাদের পক্ষে সুবিধেরই হত। কিন্তু দেখা গেল বাড়ি থেকে আমরা হাবিজাবি অনেক জিনিসই এনেছি শুধু টর্চ ছাড়া। এই অ্যাডভেঞ্চারে যার খুব জরুরি দরকার ছিল। এই রকমই হয়, অনেক বুদ্ধির খেলা খেলেও ছোট্ট একটা ভুলের জন্যে খুনির যেমন ভরাডুবি হয় গোয়েন্দাদেরও তেমনি।
জটা রাস্তা থেকে দেশলাই কিনে আনতে গেছে, কখন তার ফিরে আসার কথা, কিন্তু আসছে না। ও কি কোনও রকম বিপদে পড়ল? শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যায়নি তো?
ফিরে যাব যাব ভাবছি এমন সময় সিঁড়ির তলায় ফস করে কেউ দেশলাই জ্বালল, তারপরে মোম। আমি ঝুঁকে পড়ে সেই মোমের আলোয় মুখে চাপ-দাড়ি সাঁটা জটাকে দেখতে পেলাম। ও মোমটাকে হাতের আড়াল দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে এল।
চাপা গলায় শুধাল, “কেউ আসেনি তো?”
আমি ঘাড় নাড়লাম। তারপর দু’জনে তরতর করে উঠে গেলাম তেতলায়। একদম ফাঁকা দেখে স্বস্তি পেলাম। টানা করিডোরের এক কোণে সাতাশ নম্বর ঘরখানা খুঁজে পেতে দেরি হল না। দরজার হুড়কোয় একটা ছোট্ট তালা। আমি মোমবাতি ধরে দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর রাখলাম। জটা তার কাঁধের ঝোলা থেকে চাবির থলো বের করে খুটখাট কাজে লেগে গেল। চাবির পর চাবি ঢুকিয়ে অক্লান্ত হাতে চেষ্টা করে গেল। যত সময় যাচ্ছে আমার বুকের ভেতর তত ঢিপঢিপ শব্দ তালে এবং ওজনে বাড়ছে।
বেয়াড়া তালাটা কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলল না। মরিয়া হয়ে গিয়ে জটা শেষ পর্যন্ত পকেট-হাতুড়ির রডটা তালার আংটার মধ্যে ঢুকিয়ে প্রাণপণে মোচড় দিল। ঘটাং শব্দ করে তালাটা ভেঙে যেতেই আমরা ঝড়ের বেগে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম, আমার হাতে খাপ-খোলা গুপ্তি সরু তরোয়ালের মতো ধরা, জটার হাতে একটা স্টিলের হান্টার। কিন্তু ঘরের মধ্যে হাত-পা-মুখ বাঁধা কাউকে দেখতে পেলাম না। ব্যাটারি বাতির আলোয় টেবিলে বসে একটা লোক বোধহয় কিছু লিখছিল, সে আমাদের মূর্তি দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠল। আমরা দু’জনেই চাপা গলায় একসঙ্গে বলে উঠলাম, “প্রাণে বাঁচতে চান তো এই মুহূর্তেই পালান। শিগগির!”
কথাটা শেষ করেছি কি করিনি চোখ ধাঁধিয়ে ঘরের ইলেকট্রিক আলো জ্বলে উঠল। আর চমকে যাওয়া সেই মুহূর্তের ফাঁক দিয়ে ওই বোকা ভিতু ভালমানুষ চেহারার লোকটা গুগলি বলের মতো যেন আমাদের উইকেট ভেদ করে বেরিয়ে গেল। প্রাণের ভয় মানুষের স্পিড এত বাড়িয়ে দেয় জানা ছিল না। ঘরের দরজা, করিড়োর, সিঁড়ি— সব পেরিয়ে লোকটা বোধকরি ওভার বাউন্ডারি হয়েছে— মানে রাস্তায় পৌঁছে গেছে।
এগিয়ে গিয়ে টেবিলে দেখলাম টেবিলের ওপর দিস্তেখানেক লেখা কাগজ, তার ওপর লোকটার ক্যাপ খোলা কলমটা পড়ে আছে। সদ্য শেষ করা একটা উপন্যাস ‘খুনের পরে খুন’। পাশে কয়েকটা রহস্য রোমাঞ্চ পত্রিকা থাক দিয়ে রাখা, যার একটার নাম— টিকটিকি। বেকুব চোখে আমরা দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কারণ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির মাথায় যাঁর নাম সইটার কালি তখনও ভাল করে শুকোয়নি, তিনি আমাদের রক্তজল-করা জনপ্রিয় লেখক ভীমভবানী সেন। এই মুহূর্তে পলাতক, ফেরার।
১৩ জুলাই ১৯৮৩
অলংকরণ: দেবাশিস দেব