জট

জট

আমি স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করি। এর জন্য নামমাত্র অনুশোচনা বা অপরাধবোধ আমার নেই। না, কোনও দূরারোগ্য চিরস্থায়ী ব্যাধি আরতির, মানে আমার বউয়ের নেই। একঢাল কালো চুলের আরতি আজও স্নিগ্ধ-সুন্দরী। একটু হিমোগ্লোবিনের খামতি ছাড়া সে আমার চেয়ে অনেক সুস্থ। আমাকে নিয়মিত প্রেশার এবং ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। তাই আমার কামনা সব সময়ই মাথা হেঁট করে থাকে ওর সুস্থতার সামনে। এখন কথা হচ্ছে, আমি কেন চাইছি আরতি মরে যাক? বিয়ের আগে দু’বছর এবং পরের পাঁচ বছর আরতিকে আমি কাচের পাত্রের মতো সম্ভ্রম করতাম। উৎসব-অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলে মনে হত পাত্রটা বুঝি অন্যের হাতে দিয়েছি। আলতো একটা নজর রাখতামই। ক্রমশ এই পাহারাদারি আলগা পড়ে গেল। কারণটা আরতি নিজে। আমার বন্ধু এবং তাদের বউয়েরা আমাকে বহু বার বলেছে, একটা বউ বটে তোর বা আপনার। যে প্রসঙ্গেই কথা হোক, তোকে বা আপনাকে একবার টেনে আনবেই।

আরতির এই পতিব্রতা স্বভাব মা-ও খুব পছন্দ করত। আরতিকে বলত, এখন নিজের মরে যাওয়া নিয়ে আর চিন্তা হয় না, আমার ছেলেকে যত্নেই রাখতে পারবে তুমি।

মা-বাবার আমি একমাত্র সন্তান। বাবা মারা গেছেন আমার তখন মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ার। মা গেল বছর চারেক হল। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করি। পৈতৃক বাড়িতে আমি, আরতি, দশ বছরের ছেলে জয়মাল্যকে নিয়ে আমাদের ছায়া ঘেরা পুকুরের মতো শান্ত সংসার। এরকম একটা সুস্থির অবস্থায় থেকেও আমি কেন বউয়ের মৃত্যু কামনা করছি? প্রশ্নটা অনেকের কপালে ভাঁজ ফেলতে পারে। তাদের বলি, আমার ধারণা দাম্পত্যের বয়স বারো-চোদ্দো বছর হয়ে গেলে প্রত্যেক দম্পতি কখনও সখনও একে অপরের মৃত্যু কামনা করে। অবশ্যই, আর্থিক ভাবে গাড্ডায় গিয়ে না পড়লে তবেই।

আমার আন্দাজ আরতিও আমার মৃত্যু কামনা করে। আর্থিক অনটনে পড়বে না, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট, আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইনশিয়োরেন্স মিলিয়ে ভালই পাবে। একদিন ঠাট্টার ছলে আরতিকে বলেছিলাম, বুঝলে, হিসেব করে যা দেখছি, হঠাৎ করে মরে গেলে তুমি কিন্তু এখনকার থেকে সংসার চালানোর টাকা বেশিই পাবে।

এটা শোনার পর যে-কোনও দজ্জাল বউ বলত, এ কথা বলার আগে থান কাপড় নিয়েই ঘরে ঢুকতে পারতে। আর একটু নরম বউ হলে বলত, তুমি কী মনে করো, টাকার জন্যই তোমার কাছে পড়ে আছি! এতটা নীচ ভাবতে পারলে আমাকে! আরতি এইসব মন্তব্যের ধারপাশ মাড়াল না। কথাবার্তা স্বাভাবিক চালিয়ে গেল। রাতে খেল না। পরের দিন

সকালেও না খেতে দেখে, আমার ইয়ারকির জন্য গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করি। ক্ষমাও চাই। আরতি উপবাস ভাঙে।

আরতির এহেন আচরণে আমি যে খুব কনভিন্সড, তা মোটেই নয়। আমার মৃত্যুর প্রত্যাশা ও করেই, আমি ওর জন্য যতটা করি, তার চেয়ে হয়তো কম। বারো-চোদ্দো বছর গায়ে-পিঠে একটা মানুষকে সহ্য করা খুবই কঠিন কাজ। আমার হাই তোলা থেকে শুরু করে ক্ষণে ক্ষণে চশমা হারিয়ে ফেলা… সমস্তটাই ওর কাছে ভীষণ ক্লিশে। আমার কাছে ওর অভ্যেসগুলোও তাই। আমাদের সম্পর্ক এখন আউট হয়ে যাওয়া কোয়েশ্চেন পেপারের মতো। যৌনতার ভূমিকাও ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। অনেকে বলতে পারেন, আমি নিজের অবদমিত নোংরা বাসনাটা আরতির মনে চাপিয়ে দিচ্ছি। ও কখনওই আমার মৃত্যু কামনা করে না। হতে পারে, অস্বীকার করছি না। সত্যিই আমি তো আর আরতির মনের ভিতর বসে নেই। তবে খেয়াল রাখবেন, আমি যে ইচ্ছার কথা বলছি, তা নিতান্তই অফলদায়ী। আমি ভাবলাম আর আমার বউ মরে গেল, তা তো হওয়ার নয়। ভাবনাটা কেউ দেখতেও পাচ্ছে না। সমাজ পরিবারের নিন্দিত হওয়ার সুযোগ নেই। আমি খুশিমতো এই ভাবনা ভাবতেই পারি। যেমন, আরতি মরে গেলে আমি তোর্সাকে বিয়ে করব। দরজা জানলায় নতুন পরদা লাগাবে তোর্সা। আমার অফিস বেরোনোর সময় অনভ্যস্ত হাতে জিনিসপত্তর এগিয়ে দেবে। চোখেমুখে নার্ভাস ভাব। ক্লাস ফোর-এর জয়মাল্য ওর সত্মাকে মেনে নেবে না। হস্টেলে পাঠাতে হবে ওকে। বড় হলে বুঝবে, তেতাল্লিশে বিপত্নীক হয়ে যাওয়া মানুষের পুনরায় বিবাহ করা খুবই স্বাভাবিক। জয়মাল্যর সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে যাবে তোর্সার। ফের আমার সংসার সুখের হবে। এই বাসনাও নিষ্ফল! বাই চান্স আরতি মরেও যায়, আমার মনে হয় না তোর্সা আমাকে বিয়ে করবে। আজও তোর্সাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। তোর্সা আমার প্রেমিকা। এখন তোর্সাদের বাড়িতেই যাচ্ছি। দু’বছরে এই প্রথম বার। আজ হয়তো তোর্সাকে কিছুটা বোঝা যাবে। তোর্সা থাকে বেহালা, আমি মানিকতলা। ট্যাক্সিতে চলেছি, রবিবারের বিকেল। আরতি জানে আড্ডা মারতে যাচ্ছি সল্ট লেকে সুবিমলের বাড়িতে। সুবিমল আমার খুব কাছের বন্ধু। ওর অফিসেই দু’বছর আগে তোর্সার সঙ্গে আমার আলাপ। সুবিমল ছোটখাটো কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির মালিক। ওর রিসেপশনিস্ট তোর্সা। মেয়েটিকে প্রথম দিন দেখেই ভাল লেগেছিল। আগের মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট, সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কখনও চোখ টানেনি। আমি একটি মেয়ের রূপ ও ভঙ্গির মধ্যে যা যা খুঁজি অনেকগুলোই তোর্সার মধ্যে আছে। কথা বলছিল কাউন্টারে দাঁড়ানো একজনের সঙ্গে। না তাকিয়েই মেয়েদের প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা দিয়ে টের পেয়েছিল আমার থমকে যাওয়াটা মুগ্ধতার। বাইরে সেটা বুঝতে না দিয়ে শীতল অফিস সৌজন্যে বলেছিল, হোয়াট ক্যান আই…

উত্তর দিতে অশিষ্ট সময় নিয়েছিলাম আমি। সে-দিনই সুবিমলকে আমার ভাল লাগার কথাটা বলিনি। ‘খুব পছন্দ’ ব্যাপারটা মানুষ বেশ কিছু দিন নিজের কাছে রাখতে চায়। তার পর থেকে সুবিমলের অফিসে ঘনঘন যেতাম। এই যাওয়াটাকে সুবিমল সন্দেহের চোখে দেখেনি। কারণ, মহিলা-প্রীতি নিয়ে আমার কোনও দুর্নাম নেই। সেই ক’দিনে আমার

মোহ-ঘোর অবস্থাকে ‘লাজুক অথচ ন্যাকা নয়’ টাইপের হাসি দিয়ে স্বাগত জানায় তোর্সা। আলাপ হয়। সুবিমলের অগোচরে আমরা কয়েকদিন আউটিং-এও যাই। তোর্সার কাছে আমি কিছুই লুকাইনি। লুকানোর সুযোগ কম। সুদর্শন, ভদ্রস্থ রোজগেরে তেতাল্লিশের আমি বিয়ে করিনি বললে, বিশ্বাসযোগ্য হবে না। তা ছাড়া এ ধরনের মিথ্যে বলে সম্পর্ক ক’দিনই বা বজায় রাখতে পারব। আরতি, জয়মাল্যর কথা সব বলেছি। তোর্সা বিয়ে করেনি। কেন করেনি? জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, করব। এর পর আর প্রশ্ন চলে না। অদৃশ্য বেড়া চলে আসে সম্পর্কের মাঝে। পরের বউ হবে, যতটা সম্ভব নিষ্কলুষ রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। তবু ধন্দ থেকে যায় বিয়ের বাজারে রীতিমতো সুন্দরী মেয়েটি তিরিশ পেরিয়েও কেন বিয়ে করল না? পরের আউটিংগুলোয় প্রশ্নটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তুলেছি। নানারকম উত্তর দিয়েছে, বিয়ে করে কী হয়? এখন যেমন আছি, তার চেয়ে যদি খারাপ থাকি। বিয়ে করার মতো একটা ছেলে পেলাম না। পেলে দেখা যাবে।

আমার মধ্যে কী পেলে যে, সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারছ? জিজ্ঞেস করেছিলাম। ফাজলামির হাসি হেসে তোর্সা বলেছিল, প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল আপনার সঙ্গে আমার জমবে। ঠাট্টার আড়ালে থাকা অনুরাগটা ধরতে অসুবিধে হয়নি আমার। তোর্সা বলতে চেয়েছিল, আপনি আমার প্রতীক্ষার অবসান। আরও কয়েকটা কমপ্লিমেন্ট তোর্সা আমাকে দেয়। আপনি বেশ অকপট। ফ্ল্যাটারি যে করছেন, সেটাও বুঝিয়ে দেন। আমার মন পেতে চেয়ে অযথা বউদির নামে নিন্দেমন্দ করেন না। বেশির ভাগ অবৈধ প্রেমের ওটাই হাতিয়ার।

তোর্সাকে বলেছিলাম, প্রেম কখনও অবৈধ হয় না।

আমাকে আপনার হঠাৎ এত পছন্দ হয়ে গেল কেন? জানতে চেয়েছিল তোর্সা। বলেছিলাম, জানি না।

এত কথার পরে যেখানকার প্রশ্ন, সেখানেই রয়ে গিয়েছিল, ওর বিয়ে না করার কারণটা জানা যায়নি।

সুবিমল স্কুলবেলার বন্ধু। ওকে তোর্সার কথা বলেই ফেললাম। মিনিটখানেক অবাক হয়ে বসেছিল। বলল, আমি কিছুই টের পেলাম না! কত দূর এগিয়েছিস তোরা?

বললাম, বেশি দূর নয়। রাত কাটাইনি কোথাও। ওই ধরনের অ্যাপ্রোচ করার সিচুয়েশন তৈরি হয়নি। ট্যাক্সিতে বসলে হাতটাত ধরি। সিনেমা থিয়েটার দেখতে গিয়ে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে শব্দভেদী বাণের আন্দাজে আচমকা চুমু খাই, প্রায়শই তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

ওর দিক থেকে রেসপন্স কেমন? জানতে চেয়েছিল সুবিমল।

বলেছিলাম, মজা পায়। বাধা দেয় না। আগ বাড়িয়ে কিছু করে না। এমনকী ফোনও নয়। যোগাযোগ ব্যাপারটা আমি একতরফা রক্ষা করি। দেখি ও ফোন করে কি না, পরীক্ষা করতে গিয়ে একবার কুড়ি দিন পার করেছি। ফোন সেই আমাকেই করতে হল, নয়তো সম্পর্কটা থাকতই না।

টাকাপয়সা খসায় কেমন, যখন বেরোস টেরোস?

খরচ আমি করি। ও খেয়াল রাখে, সেটা যাতে বেশি না হয়ে যায়। বেচারি নিজে কিছু

খরচ করে উঠতে পারে না। স্যালারি যা দিস, তাতে সম্ভবও নয়।

আমার খোঁচাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গম্ভীর মুখে বসে রইল সুবিমল। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল, মেয়েটা কি তোকে বিয়ে করতে চায়? তার আগে সব কিছু দিয়ে ফেলতে চাইছে না?

বললাম, বরং উলটো। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই বলেছি। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসব। বউ-ছেলের খাওয়া-পরার সংস্থান থাকবে। তোর্সা এ কথা উড়িয়ে দিয়েছে। আমিও যে খুব একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রোপোজালটা দিয়েছিলাম, তা নয়। ওকে টেস্ট করার জন্যই বলা। তোর্সার বক্তব্য, কারও সংসার ভাঙতে আমি চাই না। এ সব বলার আগে আপনার নিজের ছেলের কথা ভাবা উচিত ছিল। ওর বয়সের সন্তান তার বাবাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল লোক বলে মনে করে। আমি বলেছিলাম, তা হলে আমাদের এই রিলেশনের মানে কী, পরিণতিই বা কী হতে যাচ্ছে? আমি তো তোমাকে সারাক্ষণের জন্য পেতে চাই। ভেবেছিলাম তোর্সা বলবে, এই সম্পর্কটা সুন্দর বন্ধুত্বের। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো দরকার পড়লেই প্রেমিক-প্রেমিকারা বন্ধু শব্দটাকে ব্যবহার করে। তোর্সা কিন্তু করল না। বলল, এটাকেই প্রেম বলে। প্রেমের পরিণতি সব সময় মিলন নয়।… আমার কথা শেষ হতেই সুবিমল বলে উঠেছিল, অল বোগাস। মেয়েটা নির্ঘাত লেসবিয়ান, মাঝখান থেকে তোকে একটু নাচাচ্ছে। ছেলে নাচানো ওর কাছে অবসর বিনোদন।

সুবিমলের সঙ্গে সহমত হতে পারলাম না। বললাম, আমি চার-ছ’ঘণ্টা হামেশাই ওর সঙ্গে কাটিয়েছি। বাড়ি থেকে ছাড়া ওর মোবাইলে অন্য কোনও ফোন আসেনি। সমকামী পার্টনার বা কোনও নৃত্যরত ছেলে থাকলে নিশ্চয়ই একবার হলেও ফোন করত।

তা হলে অবশ্য ওর কোনও অসুখ আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। বিয়ের পক্ষে যা প্রধান অন্তরায়। তোর সঙ্গে গভীরতম সম্পর্কে মেয়েটা কোনও দিনই জড়াবে না। খামোকা অশান্তিতে মরবি। রিলেশনটা থেকে বেরিয়ে আয়।

সুবিমলের উপদেশ শোনার পর বললাম, আমি বোধহয় আর বেরোতে পারব না রে। সত্যিই ওর প্রেমে পড়ে গেছি। বহুদিন আগে যেমন হত, তাকে একটুখানি দেখা, খানিকক্ষণ কাছাকাছি থাকতে পেরেই যেমন ধন্য হয়ে যেতাম। তোর্সার বেলাতেও তাই হয়। এক ধরনের তেষ্টা। সেটাও মোটেই তেমন শরীরকেন্দ্রিক নয়।

সুবিমল বলল, ও সব কিছুই না, পঁয়তাল্লিশ ছুঁতে যাওয়া পুরুষদের ওরকম একটু হয়। পড়ন্ত যৌবনের সিনড্রোম। সংসারে মন দে, বউ-ছেলের সঙ্গে সময় কাটা। দেখবি, ঠিক বেরিয়ে আসতে পারছিস।

সুবিমলের পরামর্শ ম্যাগাজিনের ‘কানে কানে’ বিভাগের মতো শোনাল। মোটেই গ্রহণ করলাম না। উলটে রোখ চেপে গেল। অসুখ গোপন করে আমাকে নিয়ে এভাবে পুতুল খেলার কোনও মানে হয়। ঠকে যাওয়া মানুষ মনে হতে লাগল নিজেকে। আরতির বদলে তোর্সাকে নিয়ে ঘর করার বাসনাটা ইদানীং চরম বিদ্রূপের মতো ঠেকে। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাই। তাই দেখে আরতি কপট সন্দেহে যখন জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, এত

কী ভাবছ? কার কথা? আরতির মিচকি হাসির পিছনে পরিহাসই দেখতে পাই। যেন বলছে, যতই ছটফট করো, আমি ছাড়া তোমার গতি নেই।

ভিতর ভিতর ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ি। তোর্সার সঙ্গে রিলেশনের একটা হেস্তনেস্ত চাই। আমি পড়ন্ত যৌবনের ভিখারি নই, যতটুকু দেবে, তাতেই কৃতার্থ হয়ে যাব। একই সঙ্গে এটাও জানি, তোর্সা যদি হঠাৎ রাজি হয়ে যায় আমাকে বিয়ে করতে, সংসার ছেড়ে সহজে বেরোতে পারব না। অমার কল্পনাবিলাস মতো আরতি যদি মরে যায়, কতটা শোকপ্রাপ্ত হব, তারও কোনও নির্দিষ্ট ধারণা আমার নেই। এমনও হতে পারে, আরতির সঙ্গে কাটানো সকল মুহূর্ত পাথরের ওজন নিয়ে নেমে আসতে পারে বুকে। এ সব সত্ত্বেও আমাকে নিয়ে তোর্সার এই খেলাটা মেনে নেওয়া যায় না। কিছুদিন ধরেই ওকে তাই বলতে শুরু করেছিলাম, আমাদের এই সম্পর্কের কোথাও কোনও স্বীকৃতি নেই। কেমন যেন বেওয়ারিশ। কোনও বন্ধুকে জোর দিয়ে বলতে পারি না, তোমার সঙ্গে প্রেম আছে। বন্ধু যদি ভেরিফাই করতে যায় তোমার কাছে, সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করবে। অদ্ভুত একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে রেখেছে। তোমার জগতে আমাকে প্রবেশ করতে দাও না, আমার জগতেও আসতে চাও না। আমাদের প্রেম যেন আলো-বাতাসের আড়ালে রয়ে গিয়েছে। বন্ধু পরিচয় নিয়ে একদিন আসতে পারো তো আমার বাড়ি। তোমার প্রিয় মানুষটি কোথায় শোয়, বসে। জানলাটা পশ্চিমে না দক্ষিণে…

কথা কেড়ে তোর্সা বলেছিল, আমি বউদিকে ফেস করতে চাই না। আপনার ছেলেকেও না। নিজেকে বড় অপরাধী লাগবে। আপনি বরং আমাদের বাড়িতে আসুন। আপনার প্রেমিকা কোথায় দাঁড়িয়ে আনমনে আপনার কথা ভাবে…

সেই সূত্রে আজ তোর্সার বাড়ি যাওয়া। বেহালা চৌরাস্তা এসে গেছে, তোর্সার নির্দেশ মতো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরতে বলি।

পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি তোর্সাদের। নীচের তলার বসার ঘরে বসেছি। তোর্সা ইতিমধ্যে দাদা, বউদি, বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। পরিচয় দিয়েছে অফিসের সিনিয়র কলিগ বলে। সিনিয়র হঠাৎ জুনিয়রের বাড়িতে আড্ডা কেন মারতে এসেছে, এর ব্যাখ্যা ওরা কীভাবে করছে জানি না। আমার সঙ্গে অবশ্য সহজ ভাবেই কথা বলল। মায়ের সঙ্গে এখনও আলাপ করায়নি তোর্সা, সম্ভবত উনি এখন বাড়ি নেই। বউদির সঙ্গে অবিবাহিত ননদ তোর্সার ভালই সম্পর্ক মনে হল, বউদির গাল টিপে আদর করে তোর্সা আলাপ করাল, আমার মিষ্টি বউদি। জানি না এটা কোনও তোষামোদ কি না। আমি এখন ওদের বাড়ির অ্যালবাম দেখছি। চা, স্ন্যাক্স খাওয়া হয়ে গেছে। ছোট বাইরে পাচ্ছে, টেনশনে অনেকক্ষণ করা হয়নি। তোর্সাকে বললাম, একটু টয়লেটে যাব।

আসুন না। বারান্দায় শেষে যে দরজাটা, ওইটা।

জলবিয়োগ করতে করতে একটু যেন বেশিই নির্ভার লাগছে। যাক, ঘোলাটে ভাবে হলেও, আমাদের সম্পর্কটার কয়েকজন সাক্ষী রইল।

টয়লেট থেকে বেরোতেই থতমত খেলাম। নীল ম্যাক্সি পরা এক বৃদ্ধা আমার দু’হাত দূরে। একেবারে মুখোমুখি। শরীরী ভঙ্গিতে ঘোর অস্বাভাবিকতা। চাউনিতে অদ্ভুত

আক্রোশ। বলে উঠলেন, এখানে কী চাই? কেন এখানে?

উচ্চারণ স্পষ্ট নয়। কেমন যেন ঘরঘরে। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। পায়ে তেমন জোর পাচ্ছি না। অনেক দিন পর নির্ভেজাল একটা ভয় আমায় বিবশ করেছে।

নিস্তার পেলাম তোর্সার এসে পড়াতে। আমার দেরি দেখে হয়তো বেরিয়ে এসেছিল বারান্দায়। ধমকের গলায় বলে উঠল, মা, ওঁকে আসতে দাও। ঘরে যাও তুমি। যাও বলছি।

সরে গেলেন মহিলা। তবে ঘরে গেলেন না। উলটো দিকের দেওয়ালে হাফ বডি সাইজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তখনই লক্ষ করলাম, তোর্সার মায়ের চুলে বিশাল জটা। যেন একটা গোসাপ ঝুলে আছে ঘাড়ে। আয়নার নীচের র‍্যাক থেকে চিরুনি তুলে নিলেন। তোর্সা আমাকে বলল, চলুন, ঘরে চলুন।

ফের আগের জায়গায় এসে বসলাম। ধাক্কাটা এখনও সামলে উঠতে পারিনি, তোর্ষা বলতে থাকল, মাকে নিয়েই সমস্যা। অফিস বাদে আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়। দাদার বদলির চাকরি। যখন তখন অর্ডার এসে যেতে পারে। বউদিও চলে যাবে। তখন চাকরিটা কী করে চালাব ভাবছি। বাবার বয়স হচ্ছে, একা মাকে সামলাতে পারে না।

বউদিকে তোষামোদের কারণটা ধরতে পারছি। ধাতস্থ হয়েছি একটু। তোর্সাকে বলি, ওঁর কথা তো আমায় কিছু বলোনি। কবে থেকে এরকম?

প্রায় পনেরো বছর। বাবা একবার দেনার দায়ে আমাদের কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে গিয়েছিল। ধারের ব্যাপারটাও আমরা জানতাম না। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বাবার নামে নানারকম কথা বলতে লাগল। বেশির ভাগই খারাপ সম্ভাবনার কথা। সে সব সহ্য করতে না পেরে পাগল হয়ে গেল মা। বাবা ফিরে আসার পরও সুস্থ হল না।

বুঝলাম, অসুখ তা হলে এখানে।

ফিরে এসেছি বাড়ি। তোর্সাদের ওখান থেকে বেরোনোর সময় দেখেছিলাম, বারান্দায় আয়নার সমনে দাঁড়িয়ে খুব আগ্রহভরে চুল আঁচড়াচ্ছেন তোর্সার মা। চিরুনি ঘাড়ে এসে থেমে যাচ্ছে বারবার। বড় একটা সিঁদুরের টিপ পরলেন।

অন্যান্য দিন আরতি বিছানায় আসার আগে ঘুমিয়ে পড়ি। আজ জেগে রয়েছি। আরতি এল। মশারি গুঁজে শুতে গিয়ে দেখে আমার চোখ খোলা। নাইট ল্যাম্পের আলোকে হারিয়ে দিয়ে মিলন সম্ভাবনায় উজ্জ্বল হল ওর মুখ। বুকে টেনে নিই আরতির মাথা। আঙুল চালিয়ে দিই ওর চুলে। থেমে যায় আঙুল। হঠাৎ বুক ফাঁকা হয়ে যায় আমার। তোর্সার বাবার মতো আমি

তো নিরুদ্দেশ হয়ে যাইনি এখনও। জোর লাগাই আঙুলে। আরতি বলে, উফ লাগছে। কথা শুনি না। বলি, এত জট কেন? কবে পাকালে? আরতি বলে, হবে না, সংসারে কত চিন্তা। মাথা থেকে উপচে চুলে জড়িয়ে যায়।

এই জট থেকে আমাকে বেরোতেই হবে। আঙুলগুলো যেন হরিণের প্রাণ পেয়েছে। জঙ্গলের লতাপাতায় আটকে গেছে শিং। খানিক দূরে আরতির মতো শান্ত টলটলে একটা হ্রদ। আমাকে পৌঁছোতেই হবে ওখানে।

রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা জানুয়ারি ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *