জঞ্জাল-বুড়ো ॥ কৃষণ চন্দর / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
জঞ্জাল-বুড়ো – কৃষণ চন্দর
যখন সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল, তখন ওর পাদুটো কাঁপছে। ওর সারা শরীর ভেজা তুলোর মতো চুপসে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। ওর মন চলতে চাইছিল না, ওই ফুটপাথে বসে পড়তে চাইছিল।
জেল-হাসপাতালে তার আরো এক মাস থাকা উচিত ছিল, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওকে ছেড়ে দিলেন। হাসপাতালের প্রাইভেট ওয়ার্ডে সে সাড়ে চার মাস ছিল আর দেড় মাস ছিল জেনারেল ওয়ার্ডে। এই সময়ের মধ্যে তার একটি কিডনি অপারেশন করে বাদ দেয়া হয়েছে, আর অন্ত্রের এক অংশ কেটে দিয়ে তার অন্ত্রের-ক্রিয়া ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এখনো তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিক হয়নি। তবু হাসপাতাল ছেড়ে ওকে চলে আসতে হল, কারণ তার চেয়েও খারাপ অবস্থার অন্য রোগীরা প্রতীক্ষা করছে।
ডাক্তার তার হাতে এক লম্বা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলেছিল, এই টনিক খেয়ো আর পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে, এখন আর হাসপাতালে থাকার কোনো আবশ্যকতা নেই।’
ডাক্তার সাহেব, আমি আর হাঁটতে পারছি না। সে ক্ষীণকণ্ঠে বলেছিল।
‘ঘরে যাও, কিছুদিন বিবি সেবাযত্ন করবে, বিলকুল ঠিক হয়ে যাবে।’
খুব ধীরে-ধীরে টলমলে পদক্ষেপে ফুটপাত দিয়ে চলতে-চলতে সে ভাবল, ঘর!–কিন্তু আমার ঘর কোথায়?’
কিছুদিন আগেও আমার একটি ঘর নিশ্চয় ছিল–ছিল এক বিবিও; তার এক বাচ্চা হবার কথা ছিল। তারা দুজনে ঐ আগতপ্রায় বাচ্চার কল্পনায় কত খুশি হয়েছিল। দুনিয়ার জনসংখ্যা অনেক হতে পারে, কিন্তু সে তো তাদের দু’জনের প্রথম সন্তান। দুনিয়ায় তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নিতে আসছিল।
দুলারি খুব সুন্দর জামা সেলাই করেছিল নিজের বাচ্চার জন্য। হাসপাতালে তা নিয়ে এসে দেখিয়েছিল। আর ওই জামায় হাত বুলিয়ে তার মনে হয়েছিল যে, সে তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছে।
কিন্তু গত কয়েক মাসের মধ্যে তাকে অনেক কিছুই হারাতে হল। যখন তার কিডনির প্রথম অপারেশন হয় তখন দুলারি নিজের গয়না বেচে দিয়েছিল। কারণ, গয়না তো এই রকম সময়ের জন্যই। লোকে ভাবে গয়না স্ত্রীলোকের সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য, কিন্তু আসলে অন্য প্রয়োজন মেটাবার জন্যই তার ব্যবহার হয়। পতির অপারেশন, বাচ্চাদের লেখাপড়া, মেয়ের বিয়ে–এইসব প্রয়োজনের জন্যই স্ত্রীলোকের গয়নার ব্যাংক খালি হয়। স্ত্রীলোক গয়নাগাটি সামলাতে ব্যস্ত থাকে, আর জীবনে বড়জোর-পাঁচ-ছ’বার এই গয়না পরবার সৌভাগ্য লাভ করে।
কিডনির দ্বিতীয় অপারেশনের আগে দুলারির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেল। তা তো হবেই– দুলারিকে দিনরাত খুব খাটুনি পোয়াতে হচ্ছিল, তার জন্যে এই বিপদ গোড়াতেই জমা ছিল। মনে হয়েছিল যে, দুলারির একহারা উজ্জ্বল শরীর এই কড়া খাটুনির জন্য তৈরি হয়নি। এইজন্য ঐ বুদ্ধিমান বাচ্চা মাঝপথেই সরে পড়েছে। বিরূপ পরিবেশ আর বাপ-মায়ের দুর্দশা আঁচ করতে পেরে সে নিজেই বুঝেছিল জন্ম নেয়া উচিত হবে না। কোনো-কোনো বাচ্চা এরকম বুদ্ধিমান হয়ে থাকে। দুলারি কিছুদিন হাসপাতালে আসতে পারেনি। তারপর যখন এসে সে খবরটা দিল তখন দুলারির স্বামী খুব কেঁদেছিল। যদি তার জানা থাকত যে-ভবিষ্যতে তাকে আরো অনেক কাঁদতে হবে তাহলে এই ঘটনায় কান্নার বদলে সে সন্তোষ প্রকাশ করত।
কিডনির দ্বিতীয় অপারেশনের পর তার চাকরি চলে গেল। দীর্ঘকালীন রোগভোগে এইরকমই হয়, কে আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে। রোগ তো মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। এই কারণে যদি সে চায় যে তার চাকরি বজায় থাকবে, তবে তার দীর্ঘদিনের রোগভোগে পড়া ঠিক হবে না। মানুষ যন্ত্রের মতোই। যদি কোনো যন্ত্র দীর্ঘকাল ধরে বিগড়ানো অবস্থায় থাকে, তাহলে তাকে এক ধারে ফেলে রেখে দেয়া হয় আর তার জায়গায় নতুন যন্ত্র এসে যায়। কারণ কাজ থেমে থাকতে পারে না, ব্যবসা বন্ধ হতে পারে না, আর সময় থেমে থাকতে পারে না। কাজেই যখন তার উপলব্ধি হল যে, তার চাকরি চলে যাচ্ছে, তখন দ্বিতীয়বার কিডনি অপারেশনের সময় যে-রকম ধাক্কা লেগেছিল সে-রকমই লাগল। এই ধাক্কায় তার চোখ দিয়ে জলও পড়েনি। সে অনুভব করেছিল, তার হৃদয়ের মধ্যে এক শূন্যতা বিরাজ করছে, পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে। মাটি আর নাড়িতে রক্তের বদলে দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছে ভয়।
কিছুদিন যাবৎ আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে ভয়ে সে ঘুমোতে পারেনি। অনেকদিনের রোগের চিকিৎসায় খরচও হল অনেক। এক-এক করে ঘরের সব দামি জিনিস বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু দুলারি হাল ছাড়েনি। সে তার স্বামীকে সাড়ে চার মাস প্রাইভেট ওয়ার্ডে রেখেছিল, সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা করিয়েছিল সে তার, এক-এক করে নিজের ঘরের সব জিনিস বেচে দিয়েছিল আর শেষ পর্যন্ত চাকরিও নিয়েছিল। দুলারি এক ফার্মে কর্মচারী হয়েছিল। একদিন তাদের ফার্মের মালিককে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল দুলারি। মালিক এক রোগা-পাতলা বেঁটে মতো লোক, মাঝবয়েসী আর লাজুক। তাকে দেখতে-শুনতে কোনো ফার্মের মালিকের বদলে কোনো দোকানের। মালিক বলে মনে হয়। দুলারিকে ওই ফার্মে দু’শ’ টাকার মাসমাহিনার কর্মচারী হয়ে যেতে হল, কেননা সে খুব বেশি লেখাপড়া জানত না। তার কাজ ছিল খামের উপর ডাকটিকিট লাগানো।
দুলারির স্বামী বলল, ‘এ খুব সহজ কাজ।’
ফার্মের মালিক বললেন, ‘কাজ তো সোজাই, কিন্তু যেদিন পাঁচ-ছশ’ চিঠির খামের উপর টিকিট লাগাতে হয় সেদিন এই খুব সোজা কাজই খুব কঠিন মনে হয়।’
দুলারি মুচকি হেসে বলল, ‘সত্যি খুব হয়রান হয়ে যাই।’
ফার্মের মালিক তাকে বললেন, ‘তুমি সেরে ওঠ, তারপর তুমি তোমার বিবির বদলে খামে টিকিট লাগিয়ো, আমি এই কাজ তোমাকে দেব।’
যখন ফার্মের মালিক চলে যাচ্ছেন তখন দুলারিও তার সঙ্গে চলে গেল। দুলারির স্বামী অনুভব করল যে, আজ দুলারির পদক্ষেপে এক অদ্ভুত আত্মমর্যাদা প্রকাশ পাচ্ছে। দুলারির শরীর কোনো এক ফুলন্ত ডালের মতো নমনীয় হয়ে গেছে। ওয়ার্ডের বাইরে এসে মালিক দুলারির জন্যে এক হাতে দরজা খুলে ধরে দুলারিকে দরজার বাইরে যেতে সাহায্য করতে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন, আর এক মুহূর্তের জন্য তাঁর অপর হাত দুলারির কোমরের ওপর রাখলেন। ফার্মের মালিকের প্রথম হাতের ভঙ্গি দুলারির স্বামীর ভালো লেগেছিল কিন্তু দ্বিতীয় হাতের ভঙ্গি পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে আপন মনকে এ-কথা বলে সান্ত্বনা দিয়েছিল যে, কখনো-কখনো এক হাত যা করে তা অপর হাত জানতে পারে না। আবার এ-ও তো হতে পারে যে, তার চোখের নজর ঠিক নেই–কেবল ভ্রম মাত্র– এ-কারণে সে বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে নরম-নরম বালিশের ওপর মাথা রেখে ঘুকোজ ইনজেকশনের প্রতীক্ষা করেছিল।
তার তৃতীয় অপারেশন হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে হয়েছিল। সে সময় দুলারি ফার্মের মালিকের সঙ্গে দার্জিলিং চলে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কে আর কতদিন অপেক্ষা করতে পারে! জীবন ক্ষণস্থায়ী আর জীবনের বসন্ত তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী। যখন আবেগ প্রবল হয় আর চোখে নেশা লাগে, যখন আঙুলের ডগায় আগুনের জ্বলুনি অনুভূত হয় আর বুকে মিষ্টি-মিষ্টি বেদনা হতে থাকে, যখন চুম্বন ভ্রমরের মতো ওষ্ঠের পাপড়ির ওপর এসে পড়ে আর বঙ্কিম হংসগ্রীবা কারো গরম-গরম নিঃশ্বাসের মৃদু আঁচে ব্যাকুল হয়, তখন কে কতদিন পর্যন্ত ফিনাইল আর পেচ্ছাবের গন্ধ শুঁকতে পারে, থুতু, পুঁজ আর রক্তের রঙ দেখতে পারে আর মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে-আসা হেঁচকি শুনতে পারে? সহ্য করার একটা সীমা আছে; বিশ বছরের যুবতী সহ্য কি করেনি? যার বিয়ের পর দু’বছরও পেরোয়নি, যে আপন পতির সঙ্গে বিপদ ছাড়া আর কিছুই দেখেনি, সে যদি আপন স্বপ্নে ভর করে দার্জিলিং চলে যায় তবে তাতে কার কী দোষ?
দুলারি যখন বাড়ি থেকে চলে যায় তখন দুলারির স্বামী অন্য কাউকে দোষী বলার মতো অবস্থা থেকে চ্যুত হয়েছিল। তার ওপর একটার পর একটা আঘাত এসে তাকে পাগল করে তুলেছিল। এখন তার বিপদ আর কষ্টে কোনো ভাবনা বা অশ্রু ছিল না। বারবার হাতুড়ির চোট খেয়ে ধাতুর পাতের মতো হয়ে গিয়েছিল তার হৃদয়। এই কারণে আজ সে (দুলারির স্বামী) যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল তখন সে ডাক্তারের কাছে কোনো মানসিক যন্ত্রণার কথা বলেনি। সে ডাক্তারকে বলেনি, এই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখন সে কোথায় যাবে? এখন তার নেই কোনো ঘর, নেই বিবি, নেই বাচ্চা, নেই কোনো চাকরি, তার হৃদয় শূন্য, তার পকেট ফাঁকা; তার সামনে এক বিরাট শূন্য ভবিষ্যৎ।
কিন্তু তখন সে কোনো কথাই বলেনি, কেবল বলেছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, আমি আর চলতে পারছি না।’
ওই একমাত্র সত্য তখন সে অনুভব করেছিল, বাকি সব কথা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তার মন থেকে। এ সময় চলতে-চলতে সে কেবল অনুভব করতে পারল যে, তার শরীর ভিজে তুলো দিয়ে তৈরি, তার শিরদাঁড়া কোনো পুরনো ভাঙা চারপাইয়ের মতো খটখট করছে। রোদের তেজ খুব, আলো তীরের মতো চোখে বিধছে, আকাশে এক ময়লা হলুদ রঙের বার্নিশ লেপে দেয়া হয়েছে। সারা পরিবেশ কালো ঘোলাটে আর জড়ো-হওয়া নোংরা মাছির মতো ভনভন করছে। লোকের দৃষ্টি যেন তার গায়ের নোংরা রক্ত ও পুঁজের মতো তার শরীরে সেঁটে যাচ্ছে। তাকে কোথাও পালিয়ে যেতে হবে, দূরে কোথাও, লম্বা। লম্বা তার জড়ানো আলোর থামওয়ালা রাস্তা দিয়ে যেতে হবে, তার মধ্য দিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি পথ ধরে পালিয়ে যেতে হবে অনেক দূরে। তার মনে পড়ল মরা মায়ের কথা, মরা বাপের কথা, তার আফ্রিকা চলে-যাওয়া ভাইয়ের কথা। শ-শ-শন্ শব্দ করে একখানা ট্রাম তার কাছ দিয়ে চলে গেল। ট্রামের বিজলির ট্রলি, বিজলির লম্বা তারে ঘষতে-ঘষতে যেন তার শরীরে ঢুকে যেতে লাগল। তার আপন শরীরে পুরো ট্রামটাই ঢুকে যাচ্ছে বলে সে অনুভব করল, মনে হল, সে যেন কোনো মানুষ নয়, যেন এক ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তা।
নেকক্ষণ ধরে সে চলছিল, হাঁপিয়ে পড়ছিল আর চলছিল। আন্দাজে, এক অজানা দিকে–যেদিকে কোনো একদিন তার ঘর ছিল। এখন তার মনে হচ্ছে, তার কোনো ঘর নেই। কিন্তু এ কথা জেনেও সে ওই দিকেই চলছিল, ঘরে যাবার তাগিদে অসহায় হয়ে সে পথ চলছিল কেবল। কিন্তু রোদ খুব চড়া, তখন আর সে রাস্তাও ভুলে গেল। শরীরে এমন শক্তি ছিল না যে, সে কোনো পথিকের কাছে রাস্তার খোঁজ নেয়; জেনে নেয় শহরের এটা কোন অঞ্চল। ধীরে-ধীরে তার কানের মধ্যে ট্রাম আর বাসের আওয়াজ বাড়তে লাগল, চোখের সামনে বাঁকা হয়ে যেতে লাগল দেয়াল। বাড়িঘর ভেঙে পড়তে লাগল। বিজলিবাতির থামগুলো ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে যেতে লাগল কেমন। সে তার চোখের সামনে আঁধার আর পায়ের তলায় ভূমিকম্প অনুভব করল। আর হঠাৎই পড়ে গেল মাটিতে।
যখন তার হুশ ফিরে এল, তখন রাত হয়ে গেছে। এক ঠাণ্ডা আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। সে চোখ খুলে দেখল, যে-জায়গায় সে পড়ে গিয়েছিল এখন পর্যন্ত সেই জায়গাতেই শুয়ে আছে। এটা ফুটপাথের এমন একটা মোড় যার পেছন দু’দিকে দুই দেয়াল খাড়া হয়ে আছে। এক দেয়াল ফুটপাতের গায়ে-গায়ে সোজা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। অপর দেয়াল চলে গেছে উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে। দুই দেয়ালের জোড়ের মুখে সে শুয়েছিল। এ দুই দেয়াল প্রায় চার ফুট উঁচু আর এই দেয়ালগুলোর পেছনে ছিল বাঁশঝাড় আর ম্যাগনোলিয়া লতার ঝাড়, পেয়ারা আর জামগাছ। ওইসব গাছের পেছনে কী ছিল তা সে দেখতে পায়নি। অন্যদিকে, পশ্চিম দিকের দেয়ালের সামনে পঁচিশ-তিরিশ ফুট ছেড়ে দিয়েছিল এক পুরনো বাড়ির পেছনের অংশ। বাড়িটি তিনতলা; প্রতি তলার পেছন দিকে একটি জানালা আর ছ’টি বড়-বড় পাইপ। পেছন দিকের পাইপ আর পশ্চিম দিকের দেয়ালের মাঝখানে এক পঁচিশ-তিরিশ ফুট চওড়া কানাগলি, তার তিনদিকে দেয়াল আর চতুর্থ দিকে পথ। দূরে কোথায় গির্জার ঘণ্টায় রাত তিনটে বাজল। সে ফুটপাতের উপর শুয়ে-শুয়ে কনুইয়ের ওপর জোর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। পথ একেবারে খালি। সামনের দোকানগুলো বন্ধ আর ফুটপাথের আঁধারে ছায়ায় কোথাও কোথাও কমজোর বিজলিবাতি ঝলমল করছে। কিছুক্ষণের জন্য এই ঠাণ্ডা আধার তার খুব ভালো লাগল। কিছুক্ষণের জন্য সে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে ভাবল, সে বোধহয় কোনো দয়ার সমুদ্রের জলে ডুবে যাচ্ছে।
কিন্তু এই অনুভূতি দিয়ে সে কেবল নিজেকেই মুহূর্তের জন্য ধোকা দিচ্ছিল, কারণ এখন তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য আরামদায়ক ঠাণ্ডা উপভোগের পর সে অনুভব করল তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তার অন্ত্রের অপারেশন হওয়ার পর থেকে তার খুব ক্ষিদে পায়। সে ভাবল ডাক্তার তার অন্ত্রের কাজ জাগিয়ে দিয়ে তার কোনো রকম উপকার করেননি। পেটের মধ্যে নাড়ি বিচিত্রভাবে পাক খাচ্ছিল আর অন্ত্রের একেবারে ভেতরে মোচড় দিচ্ছিল। এ সময়ে তার নাসিকা সভ্য নাগরিকের নাসিকার মতো কাজ করছিল না, বরং কোনো জংলি পশুর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের মতো কাজ করছিল। তার নাকে আসছিল নানা বিচিত্র গন্ধ। সুগন্ধের এক ঐকতান তার চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আশ্চর্যের কথা এই যে, সে এই সুগন্ধ-ঐকতানের এক-এক সুরের আলাদা-আলাদা অস্তিত্ব চিনে নিতে পারছিল। এই হল জামের গন্ধ, এটা হল পেয়ারার গন্ধ, এটা হল রজনীগন্ধার কলির গন্ধ, আর এ হল তেলেভাজা পুরীর গন্ধ। এটা হল পেঁয়াজ-রসুনে সাঁতলানো আলুর গন্ধ, এটা মুলোর গন্ধ, এটা টমেটোর গন্ধ, এটা হল কোনো পচা ফলের গন্ধ, এটা পেচ্ছাবের গন্ধ, এটা জলে ভেজা মাটির গন্ধ বোধহয় নানা গন্ধের সমাবেশ থেকেই গন্ধগুলো আসছিল। এইসব গন্ধের প্রতিটি রূপ, ধরন, গতি আর উগ্রতা পর্যন্ত সে অনুভব করতে পারছিল। হঠাৎ তার সম্বিৎ হল, আর কী অসম্ভব ক্ষিদে তার সুপ্ত ঘ্রাণশক্তিকে কীভাবে সজাগ করে দিয়েছে তা ভেবে সে চমকে উঠল। কিন্তু এই কথা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা না-করে যেদিক থেকে তেলেভাজা পুরী আর রসুনে-সাঁতলানো আলুর গন্ধ আসছিল সেইদিকে শরীরটাকে ধীরে-ধীরে আঁধার গলির ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কারণ নিজের শরীরে হাঁটবার সামর্থ্য সে একেবারেই পাচ্ছিল না। প্রতি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল যে, সে গভীর জলে ডুবে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন কোনো ধোপা তার পেটের অন্ত্রগুলোকে ধরে মোচড় দিচ্ছে। আবার তার নাসারন্ধ্রে পুরী আর আলুর ক্ষিদে-জাগানো গন্ধ এল। সে অধীর হয়ে আধ-বোজা চোখে নিজের প্রায় নির্জীব শরীরটাকে ঘেঁষে টেনে নিয়ে যেদিক থেকে আলুপুরীর গন্ধ আসছিল সে-দিকে যেতে চেষ্টা করল।
খানিকটা সময় পরে সে ওই স্থানে পৌঁছে দেখল, পশ্চিমের দেয়াল আর তার সামনের ইমারতের পেছন দিকের পাইপগুলোর মাঝখানে পঁচিশ-তিরিশ ফুট ব্যবধানে আবর্জনার একটা খুব বড় খোলা লোহার টব রয়েছে। এই টবটা পনেরো ফুট চওড়া আর তিরিশ ফুট লম্বা। রকমারি আবর্জনায় ভরা। পচাগলা ফলের খোসা, পাউরুটির ময়লা টুকরো, চায়ের পাতা, একটা পুরনো জ্যাকেট, বাচ্চাদের নোংরা ন্যাকড়া, ডিমের খোসা, খবরের কাগজের ভেঁড়া টুকরো, পত্রিকার ছেঁড়া পাতা, রুটির টুকরো, লোহার পাত, প্লাস্টিকের ভাঙা খেলনা, কড়াইশুটির খোসা, পুদিনার পাতা, কলার পাতায় কিছু এঁটো পুরী আর আলুর তরকারি। পুরী আর আলুর তরকারি দেখে তার পেটের মধ্যে। মোচড় দিল। কিছুক্ষণ সে তার অধীর হাতটাকে টেনে নিল, কিন্তু ওইসব সুগন্ধ যখন তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল তখন আগের পুরী আর তরকারির ক্ষিদে-জাগিয়ে-দেয়া সুগন্ধ তীব্র হয়ে উঠল। মনে হল ঐকতানের বিশেষ কোনো স্বর হঠাৎ খুব চড়া হয়ে বেজে উঠছে। হঠাৎই তার সংযমের শেষ প্রাচীর ভেঙে পড়ল। তখনি তার কম্পিত অধীর হাত কলার পাতা খাবলে নিল আর অমানুষিক ক্ষুধা অসহায় হয়ে ওই পুরীগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পুরী-তরকারি খেয়ে সে বারবার কলার পাতা চাটল। পাতাখানিকে চেটে এত সাফ করে দিল যে মনে হল তা গাছের নতুন পাতা। কলার পাতা চাটার পর সে নিজের আঙুল চাটল আর লম্বা-লম্বা নখের মধ্যে জমে থাকা আলুর তরকারি জিভের ডগা দিয়ে চেটে নিয়ে খেল। এতেও তার তৃপ্তি হল না। সে হাত বাড়িয়ে আবর্জনারাশি নেড়ে-চেড়ে তার থেকে পুদিনার পাতা বার করে খেল; মূলোর দুটি টুকরো আর আধখানা টমাটো মুখে দিয়ে তার রস খেল আরাম করে। আর সব যখন খাওয়া হয়ে গেল তখন তার সারা শরীরে নেমে এল আলস্যভরা ঘুমের ঢেউ। সে ওই টবের ধারেই ঘুমিয়ে পড়ল।
আট-দশ দিন এভাবেই আলস্যভরা ঘুম আর অর্ধচেতনার মধ্যে কেটে গেল। সে ঘষতে-ঘষতে টবের ধারে যেত। যা খাবার পাওয়া যেত খেয়ে নিত সবই। আর যখন ক্ষিদে-জাগানো গন্ধের তৃপ্তিসাধন হয়ে যেত তখন তা ছাপিয়ে অন্য নোংরা গন্ধ উঠত। তখন সে ঘষতে-ঘষতে টব থেকে দূরে ফুটপাতের মোড়ে চলে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
পনেরো-বিশ দিন পর ধীরে-ধীরে তার শরীরে বল ফিরে এল। ক্রমান্বয়ে সে নিজের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল–জায়গাটা কেমন ভালো, এখানে রোদ নেই, আছে গাছের ছায়া, কখনো-কখনো পেছনের ইমারত থেকে কেউ জানালা খোলে আর। কেউ হাত ঘুরিয়ে নিচের টবে রোজ আবর্জনা ফেলে। এই আবর্জনা ছিল তার অন্নদাতা, তাকে দিনেরাতে আহার জোগাত। এ ছিল তার জীবনরক্ষক। দিনে পথ মুখরিত হয়ে উঠত, খুলত দোকানপাট, লোকজন ঘুরে বেড়াত, বাচ্চারা পাখির মতো কিচকিচ করতে-করতে যেত পথ দিয়ে, স্ত্রীলোকেরা রঙিন ঘুড়ির মতো হেলেদুলে চলে যেত– কিন্তু সে ছিল অন্য এক জগৎ। এই জগতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না, এই জগতে কেউ ছিল না তার, আর সে-ও কারো ছিল না। এই দুনিয়ার প্রতি তার ছিল সীমাহীন ঘৃণা। এই দুনিয়া থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। শহরের গলি-বাজার-পথ তার কাছে হয়ে গিয়েছিল এক ধোয়াটে ছায়ায় তৈরি জগৎ। বাইরের মাঠ, ক্ষেত আর খোলা আকাশ তার কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক ব্যর্থ কল্পনা। ঘর-সংসার, কাজ-কর্ম, জীবন, সমাজ-সংঘর্ষ–এসব অর্থহীন শব্দ পচে-গলে আবর্জনারাশিতে গিয়ে মিশেছিল। ওই দূরের জগৎ থেকে সে ফিরিয়ে নিয়েছিল তার মুখ। পনের ফুট লম্বা আর তিরিশ ফুট চওড়া ওই টব–এই ছিল তার নিজের জগৎ।
ধীরে-ধীরে মাস আর বছর চলে গেল। সে ওই পথের মোড়ে বসে থাকত, স্মৃতিচিহ্নের মতো। কারোর সঙ্গে কথা বলত না, কাউকে সাহায্য করত না, কারোর কাছে ভিক্ষে চাইত না। কিন্তু যদি কোনোদিন সে উঠে চলে যেত তো সেখানকার প্রতিটি ব্যক্তি এতে বিস্মিত হত, আর বোধহয় কিছুটা দুঃখিতও হত।
সবাই তাকে বলত জঞ্জাল বুড়ো। কারণ সবাই জানত যে, সে কেবল জঞ্জালের টব থেকেই আপন আহার্য সংগ্রহ করে। আর যেদিন তা থেকে কিছু মিলত না, সেদিন সে না-খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। বছরের পর বছর ধরে পথিকেরা আর ইরানি রেস্তোরাঁওয়ালারা তার এই স্বভাবের কথা জেনেছিল। তার জন্য যা কিছু দেবার তারা প্রায়ই জঞ্জাল-স্তূপে ফেলে দিত। আবার ইমারতের পেছনের জানালা দিয়ে ময়লা-আবর্জনার অতিরিক্ত অন্য খাবার জিনিসও প্রায়ই লোকে ফেলে দিত। আস্ত-আস্ত পুরী, কাবাব, অনেকটা তরকারি, মাংসের টুকরো, আধখাওয়া আম, চাটনি, কাবাবের টুকরো আর ক্ষীরমাখানো কলাপাতা। খাওয়া-পরার সব ভালোমন্দ জিনিস জঞ্জাল-বুড়ো এই টবের মধ্যেই পেয়ে যেত। কখনো-কখনো ছেঁড়া পাজামা, ফেলে দেয়া জাঙিয়া, ছেঁড়া জামা, প্লাস্টিকের গেলাস। এ কি শুধুই আবর্জনার টব? তার জন্যে এটা ছিল এক খোলা বাজার–সেখানে সে দিনে দুপুরে সকলের চোখের সামনে গালগল্প করত। যে-দোকানে যে-সওদা প্রয়োজন তা সে বিনা পয়সায় পেত। এই বাজারের সে ছিল একমাত্র মালিক। গোড়ায়-গোড়ায় কয়েকটি ক্ষুধার্ত বিড়াল আর ঘেয়ো কুকুর তার সঙ্গে ঝগড়া করেছিল। কিন্তু মারমার করে সে তাদের ভাগিয়ে দিয়েছিল। এখন সে এই টবের একমাত্র অধীশ্বর। সবাই মেনে নিয়েছিল তার অধিকার। মাসে একবার মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা আসত আর এই টব খালি করে দিয়ে চলে যেত। জঞ্জাল-বুড়ো তার বিরোধিতা করত না। কারণ তার জানা ছিল পরদিন থেকেই টব আবার ভর্তি হতে শুরু করবে। তার বিশ্বাস ছিল যে, এই দুনিয়ার মঙ্গল শেষ হয়ে যেতে পারে, প্রেম শেষ হয়ে যেতে পারে, বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আবর্জনা শেষ হয়ে যাবে না কোনোদিন। সারা দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বাঁচবার শেষ উপায় শিখে নিয়েছিল।
কিন্তু কথা এ নয় যে সে বাইরের দুনিয়ার খবর রাখত না। যখন শহরে চিনির দাম বেড়ে যেত তখন মাসের পর মাস আবর্জনার টবে মিঠাইয়ের টুকরোর চেহারা দেখা যেত না। আবার গমের দাম বেড়ে গেলে পাউরুটির একটি টুকরোও মিলত না। অন্যদিকে যখন সিগারেটের দাম বেড়ে যেত তখন এত ছোট সিগারেটের পোড়া টুকরো মিলত যে, তা ধরিয়ে ধূমপান করতে পারত না সে। যখন জমাদারেরা হরতাল করেছিল তখন দু’মাস ধরে টবের কোনো সাফাই হয়নি। আবার বকরিদের দিন যত মাংসের টুকরো মিলত তা অন্যদিন পাওয়া যেত না। দেয়ালীর দিন তো টবের আলাদা-আলাদা কোণে মিঠাইয়ের অনেক টুকরো পাওয়া যেত। বাইরের দুনিয়ার এমন কোনো ঘটনা ছিল না যার সন্ধান সে আবর্জনার টব থেকে না-পেত। গত মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে মেয়েদের গোপন ব্যাধি পর্যন্ত সবকিছুরই সন্ধান পেত সে। যদিও বাইরের দুনিয়ার প্রতি তার কোনো রুচি ছিল না।
পঁচিশ বছর ধরে সে এক আবর্জনার টবের ধারে বসে-বসে আপন জীবন কাটিয়ে দিল। দিনরাত, মাস-বছর তার মাথার উপর দিয়ে বায়ুতরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়ে গেল। তার মাথার চুল শুকিয়ে-শুকিয়ে ঝুলতে লাগল বটগাছের ঝুরির মতো। তার কালো দাড়ি শাদা হয়ে গেল। গায়ের রঙ হল তামাটে। নোংরা চুল, ছেঁড়া ন্যাকড়া আর দুর্গন্ধভরা শরীর নিয়ে পথচারীর কাছে সে নিজেই যেন একটা জঞ্জাল-টবের মতো প্রতিভাত হত। সে ছিল এমন একটা টব যা কখনো-কখনো অঙ্গভঙ্গি করে, আর অন্যের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে আর জঞ্জাল-টবের সঙ্গে কথা বলে।
জঞ্জাল-বুড়োকে জঞ্জাল-টবের সঙ্গে কথা বলতে দেখে লোকে আশ্চর্য হয়ে যেত। কিন্তু এতে আশ্চর্যের কী আছে? জঞ্জাল-বুড়ো লোকদের সঙ্গে কোনো কথা বলত না, কিন্তু এদের আশ্চর্য হতে দেখে মনে-মনে নিশ্চয় ভাবত যে, এই সংসারে কে আছে যে, অপরের সঙ্গে কথা বলে। বাস্তবে এই সংসারে যত কথাবার্তা হয় তা মানুষের মধ্যে হয়, হয় কেবল নিজের জাতের সঙ্গে আর তাদের কোনো স্বার্থের মধ্যেই। দুই বন্ধুর মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তা বাস্তবে এক প্রকার স্বগত-কথন মাত্র। এই দুনিয়া একটা খুব বড় আবর্জনার স্তূপ। এখানে সব লোক আপন আপন স্বার্থের কোনো টুকরো, ব্যক্তিগত লাভের কোনো খোসা বা মুনাফার কোনো ন্যাকড়া খাবলানোর জন্যে সব সময় তৈরি হয়ে আছে। যারা আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বা নীচ মনে করে তারা মনের পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখুন–সেখানে কত-না ময়লা-আবর্জনা রয়েছে। ওই আবর্জনা কেবল যমরাজই উঠিয়ে নিতে যেতে পারে।
এইভাবে দিনের পর দিন যায়, কত দেশ স্বাধীন হল, কত দেশ পরাধীন হল, কত সরকার এল, কত গেল, কিন্তু জঞ্জালের এই টব যেখানে ছিল সেখানেই আছে আর তার কিনারে জঞ্জাল-বুড়ো ওইভাবেই অর্ধচেতনভাবে দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বসে, মনে-মনে বকবক করে, আর জঞ্জালের টব হাতড়ায়।
তারপর এক রাতে ওই আধার গলিতে যখন সে টব থেকে কয়েক ফুট দূরে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ছেঁড়া কাপড় গায়ে কুঁজো হয়ে ঘুমোচ্ছিল, তখন সে এক খুব তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গিয়ে জঞ্জাল-টবের দিকেই দৌড়ে গিয়েছিল। তারই ভেতর থেকে ওই তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
জঞ্জালের টবের কাছে গিয়ে সে টব হাতড়াল। তার হাত নরম-নরম মাংসপিণ্ডে ধাক্কা খেল। আরেকবার শুনতে পেল সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার। জঞ্জাল-বুড়ো দেখল টবের মধ্যে পাউরুটির টুকরো, চোষা হাড়, পুরনো জুতো, কাঁচের টুকরো, আমের খোসা, বাসি চাটনি আর টেড়াভাঙা বোতলের মাঝখানে এক নবজাত উলঙ্গ শিশু পড়ে আছে। হাত-পা নেড়ে নেড়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করছে সে।
কিছুক্ষণ জঞ্জাল-বুড়ো আশ্চর্য হয়ে এই মানবকটিকে দেখল। বাচ্চাটি নিজের ছোট্ট বুকের সব জোর দিয়ে নিজের আগমন ঘোষণা করছিল। বুড়ো চুপচাপ হতভম্ব হয়ে চোখ বড়-বড় করে এই দৃশ্য দেখতে লাগল। তারপর তাড়াতাড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে জঞ্জালের টব থেকে বাচ্চাকে নিজের বুকে তুলে নিয়ে তাকে ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে নিল।
কিন্তু বাচ্চা তার কোলে গিয়ে কোনোমতেই চুপ করে না। সে এ জীবনে সদ্য-সদ্য এসেছে, তারস্বরে ঘোষণা করছিল নিজের ক্ষুধা। সে এখনো বোঝেনি দারিদ্র্য কী হতে পারে, মমতা কতটা ভীরু হতে পারে, জীবন বিগড়ে যেতে পারে কীভাবে, জীবনকে কীভাবে ময়লা দুর্গন্ধময় হয়ে জঞ্জালের টবে ফেলে দেয়া যেতে পারে। এখন তার কিছুই জানা নেই। এখন সে কেবল ক্ষুধার্ত। সে কেঁদে-কেঁদে নিজের পেটে হাত। রাখছিল আর পা ছুড়ছিল।
জঞ্জাল-বুড়ো কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সে কী করে এই বাচ্চাকে চুপ করাবে। তার কাছে কিছুই ছিল নানা দুধ, না চুষিকাঠি। তার তো কোনো ছড়াও জানা নেই। সে অস্থির হয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে চাপড়াতে শুরু করল আর খুব হতাশ হয়ে রাতের আঁধারে চারদিকে চেয়ে দেখল এ সময়ে বাচ্চার জন্যে দুধ কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু যখন তার মাথায় কিছু এল না তখন সে তাড়াতাড়ি জঞ্জালের টব থেকে একটা আমের আঁটি বার করে নিয়ে তার প্রান্তভাগ বাচ্চার মুখে দিয়ে দিল।
আধ-খাওয়া আমের মিষ্টি-মিষ্টি রস যখন বাচ্চার মুখে যেতে থাকল তখন সে কাঁদতে-কাঁদতে চুপ করে গেল আর চুপ করতে-করতে জঞ্জাল-বুড়োর কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। আমের আঁটি পিছলে পড়ে গেল মাটিতে আর বাচ্চা তার কোলে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে রইল। আমের হলুদ-হলুদ রস তখন পর্যন্ত তার কোমল ঠোঁটের উপর লেগে ছিল। তার কচি-কচি হাত দিয়ে সে জঞ্জাল-বুডোর বুড়ো আঙুল খুব জোরে ধরে রেখেছিল।
এ মুহূর্তের জন্য জঞ্জাল-বুড়োর মনে হল বাচ্চাটাকে এখানে ফেলে দিয়ে কোথায় পালিয়ে যায়। ধীরে-ধীরে জঞ্জাল-বুড়ো বাচ্চার হাত থেকে নিজের বুড়ো আঙুল ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বাচ্চা খুব জোরে ধরে রেখেছে তার হাত। জঞ্জাল-বুড়োর মনে হল, জীবন তাকে ফের ধরে ফেলেছে আর ধীরে-ধীরে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসছে। হঠাৎ তার দুলারির কথা মনে পড়ল। আর মনে পড়ল সেই বাচ্চার কথা, যে দুলারির গর্ভেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আর হঠাৎই জঞ্জাল-বুড়ো ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মনে হল, আজ সমুদ্র-জলে এত বুদ্বুদ নেই, যা তার চোখের জলে ছিল। গত পঁচিশ বছরে যত ময়লা আর নোংরা তার মনে জমে ছিল, আজ তা অশ্রুর তুফানে এক ধাক্কায় সাফ হয়ে গেল।
সারা রাত জঞ্জাল-বুড়ো ওই নবজাত শিশুকে নিজের কোলে নিয়ে অস্থির ও অশান্ত হয়ে ফুটপাতে পায়চারি করল। যখন সকাল হল, সূর্যের আলো দেখা দিল তখন লোকে দেখল জঞ্জাল-বুড়ো আজ জঞ্জালের টবের কাছাকাছি বসে নেই, বরং পথের ধারে তৈরি-হওয়া ইমারতের নিচে ইট বইছে, আর এই ইমারতের কাছে এক কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় ফুলের নকশাওলা কাপড়ে শুয়ে এক ছোট্ট শিশু মুখে দুধের চুষিকাঠি নিয়ে হাসছে।