জঞ্জালীর জ্বালা – সুবোধ ঘোষ

জঞ্জালীর জ্বালা – সুবোধ ঘোষ

ওই যে রূপসী, যার নাম মুক্তাকণা, যাকে আজ এক বছর ধরে সদাসর্বদা চোখের সামনে দেখছেন ছোট কুমার সাহেব, অর্থাৎ রায়জাদা অবনীশ রায়, তাকেই আজও মাঝরাতের অথবা শেষরাতের কোন প্রহরে হঠাৎ ঘুম-ভাঙা চোখ তুলে দেখতে গিয়েই তিনি চমকে ওঠেন। এবং চমকে উঠলেও অনেকক্ষণ ধরে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে মুক্তাকণা নামে ওই নারীর মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে কি যেন বুঝতে চেষ্টা করেন ছোট কুমার সাহেব, অর্থাৎ মজিলনগরের রাজবাড়ির সেই সৌখিন আর ফুর্তিবিলাসী মানুষটি, সেই অবনীশ রায়।

ইনিই হলেন সেই অবনীশ রায়, যিনি স্কচ হুইস্কি, কবুতরের মাংস, ডিটেকটিভ উপন্যাস আর তাসের রং-মিল খেলা ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু ভালবাসেন কিনা, তা কেউ জানে না। হ্যাঁ, এই এক বছর ধরে আর একটি বস্তু তাঁর ফুর্তিময় জীবনের নতুন বিলাস হয়ে উঠেছে। সে হল ওই মুক্তাকণা। অবনীশ রায়ের ঘণী নয় মুক্তাকণা, শুধুই সঙ্গিনী, যদিও এক বছর ধরে দিন ও রাতের সকল মুহূর্তে অবনীশ রায়ের ঘরেরই শোভা আর মোহ হয়ে রয়েছে মুক্তাকণা।

মাঝরাতে অথবা শেষরাতের কোন প্রহরে অবনীশের হুইস্কির নেশা যখন একঘুমের পর ফিকে হয়ে যায়, তখন ধড়ফড় করে জেগে উঠেই দেখতে পায় অবনীশ রায়, ঘরের খোলা জানলার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তাকণা। জানলার বাইরে শুধু নিরেট অন্ধকার, তাছাড়া আর কিছুই দেখবার নেই, তবু সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তাকণা, দু’চোখের পলক পড়ে না।

অবশ্য রোজই নয়, মাঝে মাঝে, এবং বিশেষ করে কোন নতুন জায়গায় এসে আশ্রয় নেবার পর প্রথম কয়েকটি রাত্রিতে অবনীশের সঙ্গিনী ওই নারীর মনটা যেন কোন এক নিশির ডাক শুনতে পায়। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, যে রাতে আকাশে আর মাটিতে ধবধবে চাঁদের আলো ছড়িয়ে থাকে, সে রাতে কখনও এমন ঘটনা ঘটে না। চাঁদনি রাতের সঙ্গে যেন একটা আড়ি আছে মুক্তাকণার। যে রাতে বাইরে আকাশভরা চাঁদের আলো, সে রাতে ঘরের ভেতর ফরাশের ওপর পড়ে অঘোরে ঘুমোতে থাকে মুক্তা।

প্রথমে দেখা গিয়েছিল, আগ্রার সেই হোটেলের ঘরে। তারপর একবার সাসারামের ডাকবাংলোতে। তারপর মধুপুরে অবনীশের নিজেরই এস্টেটের সেই প্রকাণ্ড বাড়িতে, যার চারদিকে বসরাই গোলাপের মস্ত বড় বাগান। কে জানে কখন, বোধ হয় ঠিক যখন গভীর ঘুমে অসাড় হয়ে পড়ে থাকে অবনীশ রায়ের নেশাড়ে শরীর, আর বাইরের কালো অন্ধকারে ক্লান্ত জোনাকির পাখাও আর মিটমিট করে জ্বলে না, তখন হয় এই ঘর নয় ওই ঘরের কোন একটা খোলা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুক্তাকণা। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, মুক্তকণার সারা মুখ জুড়ে সেই সময় যেন একটা কৌতুকের হাসি থমথম করে। যেন বাইরের অন্ধকারের সঙ্গে মনে মনে একটা ঠাট্টার খেলা খেলছে মুক্তাকণা।

মধুপুরের বাড়িতে যে দৃশ্য দেখতে হয়েছিল, সেই দৃশ্য এই হীরাপুরের বাড়িতে এসেও দেখতে হল। ঠিক, সেই রকমই আবার মাঝরাতে ঘরের খোলা জানলার কাছে গিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুক্তাকণা, আর মনে হয়, সেই রকমই ভঙ্গিতে হাসছে।

দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে মুক্তকণার দিকে এগিয়ে যায় অবনীশ। গম্ভীরভাবে বলে, কি ব্যাপার মুক্তা ? তুমি ওরকম করে হাসছ কেন ? তোমাকে এত অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন ?

সত্যিই মুক্তাকে বড় অদ্ভুত দেখায়। খোলা জানলা দিয়ে শুধু বাইরের ঘন অন্ধকারের ভয়াল চেহারাটা দেখা যায়। দিগন্ত জুড়ে ঠেসে রয়েছে সেই নিরেট অন্ধকার। আকাশে তারা ঝিকঝিক করে ; মনে হয় তারাগুলি ভয় পেয়ে কাঁপছে। দেখা যায় না, নিকটে বা দূরে কোথায় গাছপালার ভিড় মুখ লুকিয়ে রয়েছে। শুধু বড় বড় তালের মাথাগুলিকে এক-আধটু ঠাহর করা যায়। তালের পাতায় বোধ হয় মাথা ঠোকে কোন রুগ্‌ণ শকুন। তাই একটা ক্ষীণ আর্তনাদ যেন আছাড় খেয়ে কাঁপতে থাকে। আর শোনা যায়, দূরের ঝাউবনের একটানা হাঁপানির শব্দ। বাতাস কখনও মৃদু হয়ে, আবার কখনও বা বেশ ঝড়ের মত হয়ে সেই অন্ধকারের জগৎ থেকে যত আক্ষেপ আর যত অদ্ভুত কাতরানির শব্দ ছড়িয়ে বেড়ায়। মুক্তা চুপ করে আর দুচোখ অপলক করে বাইরের সেই অন্ধকার দেখে আর কাতরানির স্বর শোনে।

ঘরের ভেতরে আলো জ্বলে, তাই মুক্তার মুখটাকে খুব স্পষ্ট দেখা যায়। দেখতে পায় অবনীশ, মুক্তার চোখ দুটো যেন দপদপ করে হাসছে। অত যত্ন করে বাঁধা খোঁপা, তাও যেন একেবারে ভেঙেচুরে ঝরে পড়তে চাইছে। ফুরফুর করে উড়তে থাকে উসকো-খুসকো চুল। মুক্তার কপালটা লালচে হয়ে ওঠে, যেন আগুনের আঁচ লেগেছে। দাঁতে দাঁত ঘষা লেগে বিশ্রী শব্দও হয়। পান-খাওয়া ঠোঁট স্যাঁতসেঁতে ; মুক্তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে যেন রক্তমাখা লালা ঝরে পড়তে চায়। বড় অস্বাভাবিক মুক্তার মূর্তিটা। মাঝে মাঝে থরথর করে কাঁপে মুক্তার শরীরটা। ওর চোখ-মুখ-ঠোঁট, সবই যেন ওই অন্ধকারের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে নিঃশব্দে কথা বলছিল। কে জানে কোন্‌ ভয়ানক রহস্যের কথা। সেই রহস্য যেন একটা ভাষাহীন কৌতুক। তাই মুক্তার চোখ দুটো ওরকম দপদপ করে হেসে উঠছে।

অবনীশের গম্ভীর গলার স্বর শুনে আস্তে আস্তে মুখ ফেরায় মুক্তা। কিন্তু তবু মনে হয়, অবনীশের কথাগুলির অর্থ যেন বুঝতে পারছে না মুক্তা। তেমনই দুই চোখ অপলক করে অবনীশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঘুম-ভাঙা চোখের ভীত-বিস্মিত শিহর মুছে ফেলবার জন্য দু-হাতে চোখ ঘষে মুক্তার মুখের দিকে ভাল করে তাকায় অবনীশ রায়। কিন্তু কী অদ্ভুত, সত্যিই, মুক্তাকে যে মুক্তা বলেই মনে হয় না। সারাটা দিন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, গানে-গল্পে, হাসিঠাট্টায়, আর কত রঙে ঢঙে ও রগড়ে কুমারবাবুর-ফুর্তির জীবনকে মাতিয়ে রেখেছিল যে নারী, সে এখন এই মাঝরাতের স্তব্ধ প্রহরের কোন্ অভিশাপে এমন করে এলোমেলো হয়ে বোবা নিশাচরীর মত তাকিয়ে থাকে, আর দু’চোখের তারা নাচিয়ে দপদপ করে হাসে ?

অবনীশ রায়ের বিস্ময় এইবার দুঃসহ ভয়ে শিউরে ওঠে, চেঁচিয়ে ওঠে অবনীশ, কথা বলছ না কেন ? শিগগির কথা বল। উত্তর দাও মুক্তা।

মুক্তার চোখদুটো এইবার ভয় পেয়ে চমকে ওঠে। যেন এতক্ষণে অবনীশের কথাগুলি কানে শুনতে পেয়েছে মুক্তা। ব্যস্তভাবে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে মূর্তিটাকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে মুক্তা বলে, কি বলব ? কি শুনতে চাও তুমি ?

তারপরেই চেঁচিয়ে ওঠে অবনীশ ভ্রুকুটি করে : সত্যি করে বল, কে তুমি ?

এইবার শিউরে ওঠে মুক্তার চোখের তারা। অবনীশের ওই প্রশ্নই যে তীক্ষ্ন ছুরির মত একটা ধারাল অস্ত্র। মুক্তার জীবনের এই সুন্দর ছদ্মবেশটাকে এই মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন করে দেবার জন্য উদ্যত হয়েছে ওই প্রশ্ন। যদি উত্তর দিতে একটুও ভুল করে মুক্তা, যদি মনের ভুলে কিংবা হঠাৎ ভয়ে সত্য কথাটা বলেই ফেলে মুক্তা, তবে এই মুহূর্তে মুক্তার এত বড় সুখের প্রাসাদ ধুলো হয়ে যাবে। এত টাকা, এত সমাদর, এত আহ্লাদ আর এত সোনা আর জড়োয়ার উপহারে ধন্য হওয়া ঝকঝকে জীবনের সব উল্লাস স্তব্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই বা কেন ? অবনীশ নামে খামখেয়ালী ওই বড়লোকের মেজাজ হয়তো এই মুহূর্তে পাগল হয়ে গিয়ে তার এত আদরের মুক্তাকে ঘেন্না করে কিংবা পিস্তলের একটি গুলিতে শেষ করে দেবে।

কে তুমি ? অবনীশের এই প্রশ্নটাই যে অবনীশের মর্মভেদী একটা সন্দেহ। মুক্তাকণা সত্যিই মুক্তাকণা তো ? মুক্তাকণাও জানে, অবনীশের মনে মাঝে মাঝে একটা সন্দেহ বড় তীব্র হয়ে ওঠে। ভয় হয় মুক্তার, সেই সন্দেহের আঘাতে মুক্তার ওপর অবনীশের এত মায়া আর ভালবাসার নেশাটাই বুঝি চুরমার হয়ে যাবে।

খিলখিল করে হেসে ওঠে মুক্তা ; সে কি কথা ? আমি যে তোমারই মুক্তাকণা গো !

হ্যাঁ, ঠিক সেই রকমই ঝর্নার জলের মত উচ্ছল স্বরে হেসে উঠেছে অবনীশের সঙ্গিনী মুক্তাকণা। সকাল থেকে সন্ধ্যা, তারপর রাত, এই রূপসী নারীই হেসে-গেয়ে অবনীশের ফুর্তির পিপাসাকে তৃপ্তি দিয়েছে। স্কচ হুইস্কির নেশা কোন নেশাই নয়, যদি মুক্তাকণা নিজের হাতে গেলাস তুলে নিয়ে অবনীশের হাতের কাছে এগিয়ে না দেয়। ডিটেকটিভ উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ান ঘটনার শত রহস্য নিংড়েও কোন রসের স্বাদ অনুভব করা যায় না, যদি অবনীশের বই পড়বার সময় তার গা ঘেঁষে মুক্তাকণা বসে থাকে। বাজী রেখে মুক্তাকণার সঙ্গে তাসের রং-মিল খেলে অবনীশ রায়। মুক্তাকণার কাছে মুঠো মুঠো টাকা হেরে যেতে অবনীশ রায়ের ভালই লাগে। একদিন জাগা চোখেই স্বপ্ন দেখেছে অবনীশ, মুক্তাকণার মুখটা যেন ফুলদানির ওপর রাখা হয়েছে। হাসছে মুক্তার সুন্দর মুখ, কাঁপছে রঙিন ঠোঁট আর চোখের কালো তারা। মনে হয় অবনীশের, মুক্তাকণা যেন তার জীবনের সব তৃষ্ণাকে চিরটা কাল এইভাবে মধুর মাদক হাসিতে ভরে দিয়ে তার চোখের সামনে এইভাবে ফুটন্ত রূপ নিয়ে বসে থাকবে।

খুশি হয়েছে, সুখী হয়েছে অবনীশ। তাই তো সে এইরকম অজস্রভাবে, অঢেল উপহারে মুক্তাকণারও সব সুখের দাবীকে পূর্ণ করে দেবার জন্য সর্বক্ষণ তৈরি হয়ে রয়েছে। মুক্তাকণার নিজের ব্যবহারের আলমারিতে তিনটে মখমলের বাক্স সোনার অলঙ্কারে আর জড়োয়াতে ভরে গেছে। একটা সুগন্ধ সাবান দু’বার স্পর্শ করে না মুক্তা। অবনীশ নিজেই আপত্তি করে। বাসি সাবান গায়ে মাখলে মুক্তাকণার গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে যেতে পারে, ভয় আছে অবনীশের মনে। আগ্রাতে থাকতেই মুক্তাকে কড়া হুকুম দিয়েছিল অবনীশ, এখন থেকে রোজ আতর-জলে স্নান করবে মুক্তা। সাবধান, যেন ভুলেও কোন ভুল না হয়।

এত বড় আদরের সিংহাসনে বসিয়ে রাখা হয়েছে যে রূপসী নারীকে, তাকেই আজও মাঝে মাঝে সন্দেহ করতে হয়। অবনীশ নিজেরই ওপর রাগ করে। মিছিমিছি হঠাৎ ভয় পেয়ে এরকম সন্দেহ মনের ভেতর ডেকে আনবার কোন দরকার ছিল না। পালিয়ে যাবে না মুক্তা, চলে যাবার কোন লক্ষণও দেখা যায় না। কোনদিন কোন মাঝ দুপুরের আলোতে জানলার পর্দা সরিয়ে পথের কোন মানুষের মুখের দিকে তাকায়নি মুক্তা। কাউকে চিঠি লেখে না মুক্তা ; পৃথিবীর কোন আনাচ-কানাচ থেকে মুক্তার নামে কোন চিঠি আসে না। অবনীশের আদরের জগৎ থেকে মুক্তাকণাকে চুরি করে নিয়ে যাবার মত কোন অভিসন্ধি এই পৃথিবীতে নেই। মুক্তাকণার প্রাণটাকেই কিনে ফেলেছে অবনীশ। মুক্তাকণাও স্বীকার করে, মেয়েমানুষকে এমন করে কোন স্বামীও ভালবাসে না।

ওসব ভয় নয়। কিন্তু তবু কেমন যেন মনে হয়, এবং মাঝরাতের এই মুক্তাকণাকে জানলার কাছে ওই মূর্তিতে ওভাবে দপদপ করে চোখের তারা নাচিয়ে হাসতে দেখে অবনীশের মনের ভেতরটা যে শিহর সহ্য করে, সেটা একরকমের ভয়েরই শিহর।

মুক্তাকণার খিলখিল হাসির স্বর শুনে অবনীশের চোখের তীব্র সন্দেহ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়। মুক্তাও বড় বুদ্ধিমতী। চট করে একটি মিনিটের মধ্যে কেমন সুন্দর আবার নতুন করে পরিপাটির সাজে সেজে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুক্তাকণার গা-ভরা গহনার ওপর আলোর আভা ঝলমল করে। মুক্তাকণার হাত ধরে সোফার ওপর বসে অবনীশ।

মুক্তা হাসে— তুমি হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আর ছুটে এসে আমার মুখের দিকে ওরকম রাগ করে তাকাও কেন বল তো ?

অবনীশ হাসে— তুমি কথা দাও, আর কক্ষনো ওভাবে মাঝরাতে একা একা খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাসবে না ?

আশ্চর্য হয় আর ফ্যালফ্যাল করে অবনীশের দিকে তাকায় মুক্তা— অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাসি আমি ?…কি বলছ তুমি ? যত সব মিথ্যে কথা।

অবনীশ—খুব সত্যি কথা বলছি।

মুক্তা রাগ করে— তাহলে বল, আমি একটা পাগল, নয় আমার মাথার রোগ আছে।

আনমনার মত তাকিয়ে আক্ষেপ করে অবনীশ—কে জানে ?

তারপরেই হেসে ওঠে অবনীশ— তবু ভাল !

কোন উত্তর দেয় না মুক্তা। চোখের ওপর শুধু কুটিল একটা ভ্রূভঙ্গি ফুটে ওঠে, তার মধ্যে তীব্র একটা চতুরতার ছায়াও লুকোচুরি খেলতে থাকে। জানে মুক্তাকশা, এবং আজও আবার অবনীশের ওই আক্ষেপ আর অভিযোগের ভাষা শুনে বুঝতে পারে, কিসের সন্দেহে অবনীশের মাঝরাতের ঘুম-ভাঙা চোখ ওভাবে চমকে ওঠে। এক বছর ধরে এত টাকা, আদর, গহনা আর ভালবাসা দিয়ে কাছে ধরে রাখা নারীর মনটাকে কাছে পাওয়া গেল না, এই তো অবনীশের সন্দেহ। সাসারামের ডাকবাংলোতে সেই শীতের রাতে অবনীশ স্পষ্ট ভাষায় মুক্তার কাছে এই অভিযোগ করতে গিয়ে প্রায় ফুঁপিয়ে উঠেছিল। সত্যিই বড় ব্যথা পায় ছোট কুমার সাহেব। মুক্তাকণার ভালবাসায় ফাঁকি কিংবা ভেজাল আছে, ভাবতেই চমকে শিউরে আর চেঁচিয়ে প্রায় আধ-পাগলের মত হয়ে যায় ভদ্রলোক।

যেমন আগ্রার হোটেলে, সাসারামের ডাকবাংলোতে আর মধুপুরের গোলাপবাগে, তেমনই আজও হীরাপুরের এই বাড়িতে মাঝরাতের প্রহরে সোফার ওপর বসে ফুর্তিময় জীবনের সবচেয়ে বড় সাধের সঙ্গিনী এই রূপসী মুক্তাকণাকেই হঠাৎ ব্যাকুলভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে অবনীশ— সত্যি করে বল মুক্তা ?

এই প্রশ্ন শোনবার জন্যই মনে মনে তৈরি হয়েছিল মুক্তা। এই প্রশ্নের কি উত্তর দিতে হবে, তাও মনে মনে তৈরি করে রেখেছে মুক্তা। তাই প্রশ্ন শোনবার সঙ্গে সঙ্গেই খিলখিল করে হেসে বলতে থাক— সত্যি করেই বলছি, তুমিই আমার ভালবাসার দেবতা গো ! আমার স্বামী তোমার চেয়ে ঢের ঢের বড়লোক ছিল, কিন্তু সে মানুষটা আমাকে তোমার মত ভালবাসতে পারেনি কোনদিন। তাই তো ভাবি⋯ভাবলে আমার পরাণটাই যে হেসে ওঠে গো, কী ভাগ্যির জোরেই তোমাকে পেয়েছি !

আর বেশি কিছু বলবার দরকার হয় না। অবনীশের ক্লান্ত নেশার সব উদ্বেগ দূর হয়ে যায়। ওই নারী, মুক্তাকণা যার নাম, যার দু’চোখের কোলে সরু কাজলের টান এখন আরও মায়াময় হয়ে অবনীশের বুকের নিশ্বাসে টান ধরিয়ে দিচ্ছে, সেই নারী হল বিচিত্র এক কাহিনীর নারী। ওই কাহিনীটা না থাকলে মুক্তাকণা আজ মজিলনগরের ছোট কুমার সাহেব রায়জাদা অবনীশ রায়ের সৌখিন জীবনের সর্বক্ষণের আমোদর কাছে এত বড় আদরের আস্পদ হয়ে উঠতে পারত না নিশ্চয়। বেশ উঁচু বংশের, অতি বনেদী এক পরিবারের মেয়ে হল এই মুক্তাকণা। দিনাজপুরের মস্ত এক জমিদার বাড়ির বধূ হল এই মুক্তাকণা। যেমন বড়লোক, তেমনই শিক্ষিত সেই জমিদার। কিন্তু মুক্তাকণার দুর্ভাগ্য, স্বামী তাকে ভালবাসতে পারেনি। একদিন, শ্রাবণের এক ভয়ানক ঝড়ের রাতে স্বামী হঠাৎ হিংস্র মূর্তি ধারণ করে ঘুমন্ত মুক্তাকণাকে হাত ধরে টেনে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়েছিল ; আর মুক্তার হাতে তুলে দিয়েছিল কালো বিষের শিশি— যাও, আত্মহত্যা করে আমাকে নিশ্চিন্ত করে দাও। —শুধু এই কথা বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল সেই জমিদার স্বামী।

তারপর ? সে কাহিনীও শুনেছে অবনীশ। তারপর স্বামী-বিতাড়িতা ওই মুক্তাকণা সন্ন্যাসিনী হবার জন্য কাশী রওনা হয়ে গেল। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাবে কাশী পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। গয়া পর্যন্ত এসে, এবং এক সরাইখানার কুঠুরির ভেতরে আশ্রয় নিয়ে, আর ঘরের কপাট বন্ধ করে দু’দিন ও দু’রাত শুধু কেঁদেছিল।

তারপর ? তারপরেই অদ্ভুত এক ঘটনার অনুগ্রহে অবনীশের সঙ্গে মুক্তাকণার দেখা হয়ে গেল। ভাগ্য ভাল, সেই সময়ে গয়া শহরেরই কাছে ফল্লুর ধারে অবনীশ রায় তার সেই নতুন বাংলোবাড়িতে ছিল ! ভাগ্যিস সরাইখানার দারোয়ান সেই বাবুলালকে আগে থেকেই জানত অবনীশ ! আরও ভাগ্যের কথা, বাবুলাল নামে সেই লোকটাও অনেকদিন থেকেই জানত, কি চান, কি খুঁজছেন এবং কোনটি পেলে খুশি হবেন ছোট কুমার সাহেব।

বাবুলালই এসে প্রথম খবরটা দিয়েছিল— আপনি যেমনটি চান, ঠিক তেমনটি জিনিস পাওয়া গেছে হুজুর।

—কোথায় ? কে সে ?—হুইস্কির ঢেঁকুর তুলে প্রশ্ন করে অবনীশ।

—সরাইখানার ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে সে। মস্ত বড় এক জমিদারের বউ।

—কেন ? কিসের দুঃখে ?

—স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে। তাই কাশী চলে গিয়ে সন্ন্যাসিনী হতে চায়।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অবনীশ। চোখ জুড়ে তীব্র একটা পিপাসার উল্লাস জ্বলজ্বল করে। বাবুলালের হাতে একশো টাকার নোট তুলে দিয়ে অনুরোধ করে অবনীশ ; চেষ্টা কর মুন্সী, জিনিসটা যেন হাতছাড়া না হয়।

না, হাতছাড়া হয়নি। তাই তো আজ সেই নারী ছোট কুমার সাহেব অবনীশ রায়ের ফুর্তিময় জীবনের সঙ্গিনী হয়ে এই হীরাপুরের বাড়িতে সোফার ওপর বসে আছে, আর তার গা-ভরা গহনা আলোর আভায় ঝলমল করছে।

মুক্তাকণার মুখের হাসিও ঝলমল করে ওঠে। মুক্তা বলে— যাও, এইবার ভাল করে একটা ঘুম দিয়ে মেজাজটা ঠিক করে নাও।

হ্যাঁ, হীরাপুরের কালো অন্ধকারের রাত বোধ হয় এইবার শেষ হয়ে যাবে। তালগাছের পাতায় মাথা ঠুকে কোন রুগ্‌ণ শকুন আর কাঁদে না। দূরের শালবনের দিক থেকে কাকের ডাকের সাড়া শোনা যায়।

বিছানার দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যায় অবনীশ, আর মুক্তাকণা তেমনি সারা মুখের ঝলমল হাসি নিয়ে পান আর জর্দার ডিবা খোঁজবার জন্য অন্য ঘরে চলে যায়। এবং অন্য ঘরের ভেতরে গিয়েই হাঁপ ছেড়ে হেসে ফেলে মুক্তাকণা। বোধ হয় সরাইখানার দারোয়ান সেই বাবুলালের ধূর্ত চোখ দুটোকে মনে পড়ে যায়। বুদ্ধি আছে লোকটার। কী চমৎকার পরামর্শই না দিয়েছিল, আর কেমন সুন্দর একটা গল্পও তৈরি করেছিল লোকটা। মুক্তাকণার কাছ থেকেও একশ’ টাকা দস্তুরি আদায় করেছে বাবুলাল। করুক, ভালই করেছে। বাবুলালের পরামর্শ না শুনলে এতদিনে বোধ হয় আবার তারকেশ্বরের সেই গলির ভেতরে ফিরে যেতে হত ; কিংবা বেনারসের দালকামণ্ডি; নয়তে কয়লাখনির দেশ ঝরিয়ার বাজার। জাল নোট দিয়ে পালিয়ে যায়, হাতে ধরে শত সাধলেও দরের বেশি একটা টাকাও দেয় না, যত সব ফতো লুচ্চোকে খুশি করেও ঠকে যাবার সেই দুঃসহ জীবনের কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠতে হয়।

জর্দার সুগন্ধে নিশ্বাসের বাতাস মেতে উঠলেও মুক্তার মনের ভেতরটা যেন আবার হঠাৎ ভয়ে মিইয়ে যায়। কাজল-আঁকা চোখ আর পান-চিবানো রাঙা ঠোঁট থেকে সব হাসির শিহর ঝরে পড়ে যায়। দুরদুর করে বুক। যদি কোন মুহূর্তে কোন কথার ভুলে ধরা পড়ে যায় মুক্তা ? যদি একবার বুঝে ফেলতে পারে অবনীশ যে এই মুক্তা হল তারকেশ্বরের মুক্‌তো, আর ঝরিয়া বাজারের মুক্তাবাঈ ? তবে ? থরথর করে কাঁপতে থাকে মুক্তার গায়ের ঝকঝকে সোনার গহনাগুলি। কখনই ক্ষমা করবে না, এক মুহূর্তও বোধ হয় আর দ্বিধা করবে না ওই সৌখীন কুমার সাহেব ; পিস্তল তুলে নিয়ে এসে এক মুহূর্তের মধ্যেই মুক্তার এই ভয়ানক ছলনার হিসেব-নিকেশ করে দেবে।

খুব সাবধান। যেন কখনই ধরে না ফেলতে পারে অবনীশ। মুক্তা তার ভীরু মনটাকেই সাবধান করে দিয়ে আবার চোখের চাহনিটাকে চতুর করে তুলতে থাকে। জানুক অবনীশ, চিরকাল ধরে জানুক, পৃথিবীর একটা বাজে গলির বাজে মেয়েমানুষ নয়, মস্ত বড় এক জমিদার বাড়ির ঘরছাড়া বধূ তার ফুর্তিময় জীবনের একটা অদ্ভুত সখের ক্ষুধা মিটাবার জন্য তারই সঙ্গিনী হয়ে রয়েছে।

আর কিছুক্ষণ পরে, যখন সকালের ঘুমের পালা শেষ করে আবার উঠে আসবে অবনীশ, তখন আঁতর-জলে স্নান করে আর ভিজে চুল এলিয়ে দিয়ে অবনীশের চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে অবনীশের চোখ। জয়ীর মত, মস্তবড় ঘরের এক নারীর দেহ আর মন কিনে ফেলা গর্বের আবেগে বিহ্বল হয়ে মুক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে অবনীশ।

ঠিকই ভেবেছে মুক্তা। সকাল হতেই আবার সেই গল্প গান আর হাসির পালা ; সেই হুইস্কি, কবুতরের মাংস, ডিটেকটিভ উপন্যাস আর তাসের রং-মিল। সৌখিন ফুর্তিবাজের জীবনে সব আমোদের মেজাজ রঙে ঢঙে মাতিয়ে তুলতে একটুও ভুল করে না মুক্তা।

অবনীশ বলে— তুমি কিন্তু আজ আবার মাঝরাতে ওরকম ভূতে-পাওয়া মানুষের মত চেহারা নিয়ে খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে হাসবে না।

ভ্রূকুটি করে মুক্তা— এরকম একটা মিথ্যে কথা কেন বলছ গো ?

অবনীশ— মিথ্যে কথা নয়। খুব সত্যি কথা বলছি।

মুক্তা জানে, মিথ্যা কথাই বলছে অবনীশ। সন্দেহের মানুষ নেশার চোখে ওই রকমই দেখে থাকে। মুক্তার কখনও মনে পড়ে না, বিশ্বাসও করতে পারে না মুক্তা, মাঝরাতে খোলা জানলার কাছে এসে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে কখনও চোখের তারা দপদপিয়ে হেসেছে। মুক্তাও তার ভ্রূকুটিতে একটু অভিমানের ভান ভরে দিয়ে অভিযোগ করে— তুমিও মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ওরকম চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাকে সন্দেহ করতে পারবে না।

অবনীশ হাসে। কিন্তু মুক্তা আরও গভীর অভিমানে একেবারে যেন ভেঙে পড়তে চায়— উঃ তুমি যখন ‘কে তুমি’ বলে চেঁচিয়ে ওঠো, তখন আমার যে কি ভয় করে, কি আর বলব !

অবনীশ—না, আর কখনো ওকথা বলব না মুক্তা।

কিন্তু সন্ধ্যা পার হলেই এই দুই জীবনের সব আমোদের মেজাজ ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে। তারপর আরও কিছুক্ষণ, এবং তারপরেই যখন স্তব্ধ পৃথিবীর বুক জুড়ে ঘন অন্ধকার থমথম করে, তখন মাঝরাতের প্রহরটা আবার ঠিক সেই রহস্যময় অভিশাপ নিয়ে দেখা দেয়। দিনের বেলার এত শক্ত প্রতিজ্ঞাটা যেন অলস অবসাদে ঝিমিয়ে পড়ে। খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মুক্তার চোখ দুটো দপদপ করে হাসে। আর অবনীশও তেমনই হঠাৎ ঘুম ভাঙা চোখে চমকে ওঠে। তারপর, আবার ঠিক সেই সব প্রশ্ন। সেই সন্দেহ আর ভয়। সেই অভিযোগ। সেই খিলখিল হাসি এবং আবার নিশ্চিন্ত মনে সোফার ওপরে বসে দুজনের সেই রকমই গল্প !

মুক্তার মাথায় কোন দোষ আছে, এই সন্দেহ করতেও যে বড় কষ্ট হয় অবনীশের। অবনীশ বিরক্ত হয়ে বলে, নাঃ— এই বাড়িটাও একটা অপয়া বাড়ি মুক্তা। ভাবছি, এইবার কোন একটা গেঁয়ো বাগানবাড়িতে গিয়ে থাকব।

ছোট কুমার সাহেবের এস্টেটের অনেক বাগানবাড়ি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল বাগানবাড়ি হল এই বাড়ি। চার বিঘা জুড়ে বাতাবি লেবুর বাগান। দুটো বড় পুকুর, একটা পুকুরে জলটুঙ্গী আছে, ছোট একটা পানসীও সেই পুকুরের এক কোণে জলের ওপর ভাসে।

মুক্তাকণার হাত ধরে মোটরগাড়ি থেকে নেমে অবনীশ যখন বাগানবাড়ির ফটকের মাটিতে দাঁড়ায়, তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দূরে কানা দামোদরের কিনারায় কাশবনের সাদার ভিড় তখনও স্পষ্ট চেনা যায়। বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধে শুধু সন্ধ্যার বাতাস নয়, সন্ধ্যার অন্ধকারটাও যেন ভরে গেছে। অবনীশের মনে হয়, ভালই হল, এরকম সুগন্ধভরা অন্ধকারকে বোধ হয় মাঝরাতের কোন প্রহরের অভিশাপ সহ্য করতে হবে না। আশা জাগে মনে, এই অন্ধকারের সুগন্ধ মুক্তাকণার মাথার দোষ সারিয়ে দিতেও তো পারে।

মুক্তা বলে— এটা আবার কেমন জায়গায় এলাম গো ?

অবনীশ— এটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের বাগানবাড়ি, নাম প্রিয়নিকুঞ্জ।

মুক্তা—গাঁয়ের নাম কি ?

অবনীশ—ভুবনপুর।

চমকে ওঠে মুক্তা— সে কি গো !

অবনীশ হাসে— হ্যাঁ গো, আর ওই যে দূরের নদীটাকে এখন খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, ওটা হল কানা দামোদর।

যেন ভয় পেয়ে ফিসফিস করে আবার আশ্চর্য হয় মুক্তা— সে কি গো !

ছোট কুমার সাহেবের প্রিয়নিকুঞ্জে ফুর্তিময় জীবনের কোন উপাদানের অভাব ছিল না। ছিল স্কচ হুইস্কি, ছিল কবুতরের মাংস, ডিটেকটিভ উপন্যাস আর তাস। তার ওপর ছিল শালুক ছড়ানো বড় পুকুরের জলের ওপর ভেসে বেড়াবার পানসী, আর বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধে আকুল হওয়া অন্ধকার।

প্রিয়নিকুঞ্জের একটি ঘরে ফরাশের ওপর বসে সেই সন্ধ্যায় অবনীশের সঙ্গে যখন তাসের রং-মিল খেলে মুক্তা, তখন তার গা-ভরা সোঁনার গয়না তেমনই ফূর্তির উল্লাসে ঝলমল করে। অবনীশের হাতে দুইস্কিভরা গেলাস শিথিলভাবে যখন কাঁপতে থাকে, তখন নীরব হয়ে যায় রাত্রিটা। এবং তারপরেই, কে জানে কতক্ষণ পরে, মাঝরাতের প্রহরে ঘুম-ভাঙা চোখ তুলে তাকাতে গিয়েই দেখতে পায় অবনীশ, কাছে নেই মুক্তা।

বোধ হয় বড় বেশি আশ্চর্য হয়েছিল অবনীশ, তাই আর চেঁচিয়ে ওঠে না। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে চলতে থাকে। ঘরের পর ঘর পার হয়ে খুঁজতে খুঁজতে শেষে দেখতে পায় অবনীশ, হ্যাঁ ঠিকই, দক্ষিণের খোলা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে মুক্তা।

সত্যিই বড় সুগন্ধভরা অন্ধকার। মুক্তাকণার মুখটাকে দেখতে একটুও আশ্চর্য লাগে না, ভয় তো দূরের কথা, বড় বেশি করুণ দেখাচ্ছে মুক্তাকে। চোখদুটো হাসি-হাসি, কিন্তু চোখের কাজল ভিজে গেছে মনে হয়। বেচারা ! কে জানে, কেমন একটা মনের রোগে রোজ এই কাণ্ডটা করে, কিন্তু নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। এটাও বোধ হয় নিশির ডাক শোনার মত একটা রোগ।

পা টিপে টিপে মুক্তার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ায় অবনীশ। আরও ভাল করে মুক্তার মুখটাকে দেখতে পাওয়া যায়। দেখতে থাকে অবনীশ। কিন্তু কি আশ্চর্য, মুক্তা যেন জাগা চোখেই ঘুমোচ্ছে। দেখতে পাচ্ছে না মুক্তা, কত কাছে দাঁড়িয়ে আছে অবনীশ।

কি দেখছে মুক্তা ? কি-ই বা বুঝতে পারছে মুক্তা ? ওই যে কানা দামোদরের কিনারায় কাশবনের বাতাসে শ্বাসটানা শব্দের মত একটা স্বর ছুটে ছুটে বেড়ায়, তারই পাশে শ্মশান। দশ গাঁয়ের মড়া ওখানে এসে পুড়ে ছাই হয়। আরও একটু দূরে, ওই যে একটা বাতি মিটমিট করছে, ওটা হল লক্ষ্মীহাটির কলুবাড়ির বাতি। গাঁয়ের আর সব ঘরের চেহারা এখন আর দেখা যায় না। আর, আরও দূরে ওই যে মাঠের একটা জায়গা লাল হয়ে রয়েছে, ওটা হল নায়েব ডাঙা, চাষীরা আখের রস জ্বাল দিচ্ছে। এই সবই যে, কানা দামোদরের এপার আর ওপারের বিশটা গ্রামই যে অবনীশ রায়ের জমিদারী।

কানা দামোদরের কিনারায় কাশের বনে একটা ঝড় উথলে উঠছে বলে মনে হয়। শ্মশানের আশেপাশে দপদপ করে নেচে একটা আলেয়া দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। দেখতে পায় অবনীশ, দু’চোখ অলপক করে তাকিয়ে আছে মুক্তা।

—মুক্তা ?

ডাক শুনে মুখ ফেরায় মুক্তা। তারপরেই চমকে উঠে উত্তর দেয়— কি বলছ ?

অবনীশ হাসে— ওই যে দপদপ করে একটা আলো নেচে নেচে দৌড়চ্ছে, ওটা কি ?

মুক্তা— জানি না।

অবনীশ— ওটা একটা আলেয়া।

—আলেয়া ! ভয়ে শিউরে উঠে অবনীশের বুক ঘেঁষে দাঁড়ায় মুক্তা।

অবনীশ হাসে— গাঁয়ের লোক বলে, ওটা হল জঞ্জালীর হাসি।

—কি বললে ? —চেঁচিয়ে ওঠে মুক্তা। থরথর করে কাঁপতে থাকে মুক্তার গলার স্বর।

অবনীশ বলে— জঞ্জালীর হাসি।

অবনীশের হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে ফেলে মুক্তা— সত্যি করে বল, আমাকে একটু বুঝিয়ে বল না গো, আলেয়াটা জঞ্জালীর হাসি কেন হবে ?

মুক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয় অবনীশ— ওটা একটা গল্প, তুমি মিথ্যে এত ভয় পেও না মুক্তা।

চোখ টান করে তাকায় মুক্তা— গল্প ?

অবনীশ— হ্যাঁ। লক্ষ্মীহাটি নামে ওই গাঁয়ে একটা লোক থাকত, কে জানে কোন একটা বুনো কিংবা বেদে জাতের লোক। লোকটার বউটা কিন্তু দেখতে বড় সুন্দর ছিল।

মুক্তা— কি করত লোকটা ?

অবনীশ— লোকটা যত শিকড়-বাকড় আর সাপের কামড়ের ওষুধ হাটে হাটে বিক্রি করে বেড়াত। কিন্তু লোকটাকে রোগে ধরল। আর খাটতে পারত না লোকটা। তখন বউটাই খেটে বেড়াতে শুরু করল।

মুক্তা যেন স্বপ্নের মধ্যে বিড়বিড় করে, তা, কি আর করবে বল ! দুটো পেটে খেয়ে বাঁচতে হবে, আর সোয়ামীটাকেও বাঁচাতে হবে তো !

অবনীশ— হ্যাঁ, তাই তো। কিন্তু শাক বেচে, পরের বাড়িতে ঢেঁকি কুটেও কিছু হল না। তখন বউটা⋯

মুক্তা— বউটার নামটা জানো না ?

অবনীশ— হ্যাঁ, ওই বউটার নাম ছিল জঞ্জালী। শেষে বউটা প্রায়ই গাঁ ছেড়ে গঞ্জের দিকে চলে যেত। মাঝে মাঝে বাইরে রাত কাটিয়েও ঘরে ফিরত।

মুক্তা— মেয়েমানুষ জলে আর দুঃখে পড়লে, আর কোন উপায় না থাকলে ওরকম না করেই বা⋯

অবনীশ— তাই তো বলছি। টাকা-পয়সা নিয়ে ঘরে ফিরত জঞ্জালী। স্বামীর জন্য কবরেজী ওষুধ আর ভাল ভাল ধুতি-গামছাও নিয়ে আসত। কিন্তু স্বামীটা কতবার জঞ্জালীর হাত ধরে সেধে বলেছে আমাকে সুখে মরতে দে জঞ্জালী, তুই আর বাইরে যাস নে। কিন্তু কে শোনে কার কথা ? তারপর একদিন⋯

কানা দামোদরের কিনারায় কাশবনের ধারে শ্মশানের আশেপাশে তখনও সেই আলোয়াটা দৌড়াদৌড়ি করছে। সেইদিকে তাকিয়ে অবনীশ বলে, গাঁয়ের লোকেরা বলে, পুরো সাতটা দিন আর রাত বাইরে কাটিয়ে একদিন ঠিক মাঝরাতের সময় গা-ভরা গয়না বাজিয়ে ঘরে ফিরে এল জঞ্জালী।

মুক্তাকণার দু’চোখের তারা দুটো যেন দপ করে জ্বলে ওঠে— মিথ্যে কথা, ভয়ানক মিথ্যুক গাঁয়ের লোকগুলো। গা-ভরা গয়না অত সস্তা নয়।

অবনীশ— যাই হোক, জঞ্জালী ঘরে ফিরে আসতেই গাঁয়ের লোক লাঠি হাতে নিয়ে তেড়ে এসে বলে, ঘরে নয়, ঘরে নয় ! হোই শ্মশানের দিকে চলে যা জঞ্জালী।

দু’চোখের দৃষ্টি উদাস করে তাকিয়ে, আর যেন দম বন্ধ করে অবনীশের গল্প শুনতে থাকে মুক্তা। অবনীশ বলে, স্বামীটা সেদিনই দুপুরে মরে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে শ্মশানের দিকে তাকিয়েছিল জঞ্জালী। ওর স্বামীর চিতার আগুন তখনও ধিকধিক করে জ্বলছিল।

তারপর কি করল জঞ্জালী ? —মুক্তাকণা যেন দাঁতে দাঁত ঘষে প্রশ্ন করে।

অবনীশ বলে, গাঁয়ের লোক বলে, অনেকক্ষণ ধরে বেশ শান্তভাবে দাঁড়িয়ে, তারপরেই একগাল হাসি হেসে গাঁয়ের এতগুলি লোকের সামনেই হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল জঞ্জালী।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, সিগারেট ধরায় অবনীশ। তারপরেই হো হো করে হেসে উঠে বলে, কিন্তু গাঁয়ের লোকগুলো বলে কি জান ? পালিয়ে যায় নি জঞ্জালী। এখনও মাঝরাতে ওই শ্মশানের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায় জঞ্জালী। ওই যে আলেয়া, ওটা আলেয়া নয়, ওটাই হল জঞ্জালীর হাসি।

গল্প শেষ করেই চমকে ওঠে অবনীশ। এ কি করছে মুক্তা ? মাথা হেঁট করে আর আঁচলে মুখ লুকিয়ে এমন করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেন মুক্তা ?

কি হল মুক্তা ? —মুক্তার মাথাটা টেনে তুলে বুকের কাছে চেপে ধরে অবনীশ।

মুক্তা বলে, গাঁয়ের লোক বড় মিথ্যে কথা বলতে পারে গো ! কী সব্বনেশে মিথ্যে কথা !

অবনীশের চোখের চাহনি হঠাৎ এক ভয়ানক দুঃসহ ও তীব্র সন্দেহের জ্বালায় যন্ত্রণাক্ত হয়ে ছটফট করে। চিৎকার করে অবনীশ— কি বললে মুক্তা ?

মুক্তা বলে, ওটা জঞ্জালীর হাসি নয় গো, ওটা যে জঞ্জালীর জ্বালা।

কি বললে ?⋯তুমি একথা বলছ কেন ?⋯কে তুমি ? —বলতে বলতে হিংস্র পাগলের মত মূর্তি ধরে ভেতরের ঘরের দিকে ছুটে যায়, আর পিস্তল হাতে নিয়ে মুক্তার চোখের সামনে এসে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় অবনীশ।

কে তুমি ? অবনীশের গর্জনের মধ্যেই যেন আগুনের জ্বালা ঝলক দিয়ে ওঠে !

আমিই তো। আমি জঞ্জালী।

একটুও ভয় পায় না, একটুও কাঁপে না, অদ্ভুত একটা গর্বের আবেগে সোজা মাথা তুলে তাকিয়ে থাকে মুক্তা। শান্ত ও অবিচল স্বরে উত্তর দেয় মুক্তা !

ছোট কুমার সাহেবের সেই প্রিয়নিকুঞ্জে মাঝরাতের বাতাসে পিস্তলের শব্দ বেজে উঠবার পর বারুদের ধোঁয়ার ক্ষীণ গন্ধও অল্পক্ষণ পরেই মিলিয়ে যায়। কি আশ্চর্য, একটা আর্তনাদও করেনি মুক্তাকনা।

কানা দামোদরের কিনারাতে কাশবন আজও আছে, আর তার পাশে সেই শ্মশানে আজও মাঝরাতের আলেয়া ছুটোছুটি করে। কিন্তু প্রিয়নিকুঞ্জ আর নেই, সেখানে শুধু কয়েকটা পুরোন ইটের ভাঙা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। ছোট কুমার সাহেব রায়জাদা অবনীশ রায় আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর হল বাতাবি লেবুর ফুলের সুগন্ধে আকুল এক সন্ধ্যায় ছটফট করে মরে গিয়েছেন।

কিন্তু কে জানে কেমন করে, গাঁয়ের লোকের গল্পের ভাষাতেই মস্ত একটা ভুল ঘটে গেছে। জঞ্জালীর হাসি নয়, জঞ্জালীর জ্বালা। লক্ষ্মীহাটির শ্মশানে মাঝরাতের আলেয়াকে দৌড়তে দেখলেই গাঁয়ের লোক গম্ভীর ভাবে বলে, হোই দেখ, জঞ্জালীর জ্বালা আবার ছটফটিয়ে ছুটতে লেগেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *