জজ সায়েবকে বলচি না – অমিত চট্টোপাধ্যায়
পুলিশ ইন্সপেক্টর অনাদি সেন লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরে ঢুকলেন। খুশিভরা গলায় বললেন, রমানাথ কবিরাজ লেনের খুনটা নিয়ে বোধ হয় আর হিমসিম খেতে হবে না, মিস্টার লাহিড়ী।
হাতের ‘হিপনো অ্যানালিসিস’ বইখানা থেকে চোখ তুলল প্রতুল। হাল্কা সুরে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ?
রুলটানা খাতার একগোছা পাতা তার হাতে দিয়ে অনাদি সেন বলেন, পড়ে দেখুন।
খানিকটা কৌতুহল বোধ করল প্রতুল। হাতের বইখানা নামিয়ে রেখে পাতাগুলোর ওপর। চোখ বোলাতে লাগল।
কাঁচা হাতের লেখা। অজস্র বানান ভুল। ভাষাটাও শুদ্ধ নয়।
বিভূতি মুখোপাধ্যায়ের ‘পোনুর চিঠি’ বইখানা পড়েছিল প্রতুল। কোথায় যেন তার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। কৌতুহল তার আরো বেড়েই গেল।
অনাদি সেনকে বসতে ইঙ্গিত করে, সে সাগ্রহে পড়তে শুরু করল:
আমার ভাল নাম শ্যামলি—শ্যামলি রায়। সবাই কিন্তু মন্টি বলে ডাকে। এগারো পেরিয়ে বানোয় পা দিয়েছি। মা কিন্তু সব সময় আট-ন’ বছর বলতে শিকিয়ে দিয়েচে। মা সবে চব্যিশ কিনা। যদদিন গ্যান হয়েচে, শুনচি মা চব্যিশ। বয়েস বাড়ছে না কেন জিগগেস করলে মা শুধু মুচকি হাসে। চুপি চুপি বলে যারা সিল্পি, সেই সব মেয়ের নাকি বয়েস বাড়ে না। মটর গাড়ির মতন মায়ের বয়েস পেচন দিকে হাঁটে বোধ হয়। হাঁটুক না। ফোঁকলা বুড়ি মা আমার একটুও ভালো লাগে না।
হো হো করে হেসে উঠল প্রতুল। ইন্সপেক্টর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, মায়ের চরিত্র কি নিখুঁত বিশ্লেষণ করেছে।
অনাদি সেন শুধু মুখ টিপে হাসলেন।
প্রতুল আবার পড়তে শুরু করল :
রোজ রোজ কত যে কাকা আর জেঠু আসে আমার। কেউ পিশতুতো, কেউ মাশতুতো, কেউ মামাতো। তারা অনেক অনেক খেলনা দেয় আমায়, পুতুল আনে। কি মজাই না লাগে। আমার।
সেই জেঠুদেরই একজন তো সেদিন রাত্তিরে খুন হল। হ্যাঁ, খুন।
থানার বড় দারোগা অনাদীবাবু আমায় বলল জজ সায়েবের কাচে নাকি সব কথা আমায় বলতে হবে। তাই ত গুচিয়ে লিখে রাখচি। জজ সায়েবের সামনে কথা বলতে গিয়ে না আবার কিছু ভুলে যাই।
আমরা আগে খুব গরিব ছিলুম। হব না কেন? বাবা যে চাকরি করতে কোথায় চলে গ্যালো, আসতও না, টাকাও পাটাতো না। আমাকে আর ফুলদিদিকে নিয়ে মা তখন গলির ভেতর ছোট্ট একটা বাড়িতে উটে গেল। ফুলদিদি কিনতু আমাদের সত্তিকার কেউ নয়। বাবাকে মানুষ করেছিল। খুব বুড়ি। বাবা চলে যাবার সময় ফুলদিদিকে বলেছিলো তুই আমার বৌকে আর মেয়েকে দেকিস ফুলমাসি। বুড়ি তখন খুব কেঁদেছিল, আর সেই থেকে এঁটেল চিমড়ের মতন আমাদের গায়েই লেগে আচে।
কাকাদের ফুলদিদি দুটি চোক্খে দেখতে পারত না। মাকে খুব বকাবকি করত আর বলত মেয়েটিকে এঁচোড়ে পাকা না করে তুমি ছাড়বে না।
মা শুনতই না বুড়ির কথা। কাকারা এলেই গান গাইত। খুব মিসটি গলা ত মায়ের। দেখতে সে সময় খুব ভালো লাগত আমার। বাবা থাকতে কিনতু মা কোনদিনও গান গায়নি। বাবা চলে যেতে আমরা গরিব হয়ে গেলুম। গান গেয়ে তাই মা টাকা রোযকার করত।
ফুলদিদি বলত কি দরকার। আমার ত টাকা আচে। দিচ্ছি। মা কিনতু শোনবার মেয়ে নয়। চাদ্দিকে চেসটা করতে লাগল। অতুল কাকাও যেখানে যেখানে গান গাইলে টাকা উপায় হয়, সেসব জায়গাতেই চেসটা করেচে। কিনতু ঘেঁচু! একদিন আড়ী পেতে শুনলুম অতুলকাকা মাকে বলছে গাইয়ে হওয়া তোমার বরাতে নেই, রাণী। তার চেয়ে আমি তোমায় হাজার টাকা ধার দিচ্চি। সংসার চালাও। শুনে মায়ের সে কী কাননা। হাজার টাকা পেলে কেউ নাকি আবার কাঁদে! আর কাঁদবে কেন? অতুলকাকা ত বাবার বন্দু। বাবার আগে তারি সংগে ত মায়ের বিয়ের কথা হয়েছিল।
আমি ইদিকে খুব চালাক মেয়ে। অতুলকাকা যখন আমার কাছে এল, মায়ের দেকাদেকি আমিও কানতে লাগলুম। অতুলকাকা আদর করে আমায় পাঁচটা টাকা দিয়ে বলল, তোমার যা খুশি কিনে খেও শোনামণি। কিনতু খপরদার তোমার মাকে যেন কিছুটি বোল না। বলবার জন্নে আমার ত আর ঘুম হচ্চে না। লুকিয়ে গিয়ে হরেণদার দোকান থেকে একটা মুকতোর মালা কিনলুম। আসল মুকতে হৱেণদা বললে। কাউকে দেকালুম না। মাকেও নয়, ফুলদিদিকেও নয়।
ইদিকে আমরা দিন দিন গরিব হতে লাগলুম। মা বলতে লাগল খাওয়া যুটবে না। একদিন অতুলকাকা মাকে আর আমাকে নেমন্তন্ন করলে। আমার জামা সব ছেঁড়া। কাননা কাটি করে খুব বায়না ধরলুম। অতুলকাকা নতুন জামা কিনে আনলে আমার জন্নে। মা আড়ালে নিয়ে গিয়ে এক চড় মারলে আমায়। তারপর হেসে ফেললে। আমায় আদর করে বললে, মেয়েরা কি করে আদায় করে শিকে ফেলেছিস দেখচি। ফুলদিদি শুনে গজগজ করতে লাগল জেমন মা তার তেমনি মেয়ে ত হবে। সেটা দোশ না গুণ বুজি না বাবা।
এরপর মাতায় আমাদের বজরাঘাত। একদিন খবর এল বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না। নিসচয় মরে গ্যাচে। চিঠি হাতে ফুলদিদির সে কী কাননা। বিচনায় পড়ে মাও কাঁদতে লাগল। দেকাদেকি আমিও কাঁদতে লাগলুম। কিন্তু বেসি কাঁদতে পারলুম না। পারবো কেন? ভাবছিলুম বাবা যদি সত্তি সত্তি মরে গিয়ে থাকে তাহলে মা বেস অতুলকাকাকে বিয়ে করবে। আমিও নতুন নতুন জামা পাব, টাকা পাব। বাবা যে আমায় একটুও দেকতে পারত না। একদিন ইসকুলের একটা মেয়ের কাচ থেকে মাতার কাঁটা চেয়ে নিয়েছিলুম বলে কি মারটাই মেরেছিল। পরের জিনিস নাকি চাইতে নেই। মাও তেমনি ঝগড়া করছিল বাবার সংগে। মুখের ওপর বলে দিয়েছিল মণ্টির গায়ে ফের যদি কোনদিন হাত তোল ত ওকে নিয়ে আমি আলাদা থাকব। বাবা দাঁত কড়মড় করে বলেছিল যাও না—বিদেয় হও মা বেটি। হাড় জুড়ক আমার। মা কিনতু আলাদা থাকল না। থাকলে বেস মজা হত কিনতু।
সত্তিকার ত আমার দুঃখু হয় নি, তাই মাকে একদিন চুপি চুপি বললুম তুমি কেন এইবার অতুলকাকাকে বিয়ে করো না। মা চমকে উঠে বললে আমি যে সেদিন বিধোবা হয়েচি রে। লোকে শুনলে কি বলবে। তার চেয়ে ঠাকুরপো যদি একটা কাজ জোগাড় করে দেয়, আমাদের আর দুঃখু থাকবে না। ফুলদিদি শুনতে পেয়েছিল আমার কথা। এই মারে ত এই মারে। অমন দেবতার মতন যার বাপ, তার মেয়ে কিনা এতো বড় মিটমিটে সয়তান।
কোথাও কাজ পেলো না মা, তাই আমরা তখন খুব গরিব হয়ে গেচি। তবু একটুও কসট ছিলো না। আমার অনেকগুলো কাকা জুটেছিলো। দিন নেই, রাত নেই, তারা আসত হৈ হৈ করত। খাওয়া দাওয়া, বায়োসকোপ দ্যাকা, থিয়েটার দ্যাকা। পড়াসুনো ফেলে রেখে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে মজাদার গপপ লিখতুম। সেশ হলে কেশব জেঠুকে আড়ালে ডেকে শোনাতুম। কেশব জেই বুড়ো। মাতায় টাক, সাদা গোঁফদাড়ী। আমার একটুও পছন্দ হত না তাকে। কিনতু মা বলে দিয়েছিলো কেশব জেঠুর দুটো থিয়েটার আছে। মাকে নাকি একটায় কাজ দেবে বলেচে—গান গাইবার চাকরি।
একদিন রাত্তিরে ঘুমুব বলে ঘরে শুতে গেচি, কেশব জেঠুর গাঁক গাঁক গলা শুনতে পেলুম। আমার নাম করেই যেন মাকে কি বলচে। উঠে গিয়ে দরজার আড়ালে আড়ী পেতে দাঁড়িয়ে রইলুম। শুনলুম কেশব জেঠু মাকে বলচে, মেয়ে তোমার বড় হচ্চে, ওকে ইসকুলের বোডিংয়ে রেকে দাও না কেন। মা যেদ করে বললে হয় শ্যামলি আমার সংগে যাবে, নইলে আমি তোমার থিয়েটারে কাজ করবো না। কেশব জেঠু ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল মেয়েকে আঁচলে বেঁদে নিয়ে যাবার কি দরকার। ও সব দেখবে শুনবে, সেটা কি ভাল? মা হিস হিস করে উঠল, শ্যামলি কি ফুলমাশি কেউ কিছু জানবে না। হেসে উঠল কেশব জেঠু। বললে এমন চেহারা তোমার, কাজে লাগবে না। তারপরই গলা খাটো করে যে কথাটা মাকে বললে, শুনতে পেয়ে আমি কানে আংগুল দিয়ে ছুটে পালালুম।
কেশব জেঠু থিয়েটারের কাচেই আমাদের জন্নে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিল। দু’খানা ঘর, বাথরুম, রাননা ঘর। চেয়ার, টেবিল, খাট পালং—সব এলো। কেশব জেঠু হাসে আর মাকে বলে আমি এর মদ্দে এলে তোমাদের যে কুঁকড়ে থাকতে হবে। আমার তখন আবার সর্দি কাশি। তাই ফুলদিদির কাচেই রোজ আমায় কুঁকড়ে ঘুমুতে হত। একটুও ভালো লাগতো না। আমার ফুলদিদি ঘুমের ঘোরে ঠোঁট দিয়ে বিচ্ছিরি একটা শবদো করত আর জেগে থাকলেই শোনাত বাবা ছেলেবেলায় কি কি করেচে, কত খেয়েছে।
থিয়েটারে মায়ের কি কাজ সেকথা আমাদের কিছু বলে নি, তাই আমি আর ফুলদিদি একটা ফনদি আঁটলুম। এবার যেদিন থিয়েটার হবে, টিকিট কেটে আমি আর ফুলদিদি দেকতে যাব। মা ত বলেছে সে সিলপি। আমি মানে বইয়ে দেকেচি সিলপি মানে যারা নকল করে, আসলকে ভ্যাংচায়। সামনের দিকে বসে মাকে ভ্যাংচাতে দেকলে আমি খুব হাততালি দোবো।
ফুলদিদি কিনতু মাকে মতলবটা বলে ফেলল। শুনে মায়ের মুখখানা একেবারে আমার খাতার পাতার-মতন সাদা হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে কড়া গলায় বললে, শ্যামলিকে নিয়ে তুমি যদি থিয়েটারের তিরসিমায় গ্যাচ ফুলদিদি, ত তোমার মুখও কোনদিন দেখবো না।
ভয়ে আমরা আর যাই নি। তবে মা নিসচয় ভালো থিয়েটার করত। আমরা দিন দিন বড়লোক হতে লাগলুম। একদিন কতকগুলো মিসতিরি এসে বাড়িতে একটা টেলিফোন বসিয়ে দিয়ে গেল। দিন রাত তাতে কিরিং কিরিং। মা না থাকলে আমি ধরতুম। যারা টেলিফোন করত, তারা সবাই ব্যাটাছেলে। জিগগেস করত ঝরণা দেবি আছেন? আমি বলে দিতুম না, ও নামের কেউ থাকে না। মায়ের নাম ত বিমলা আর ফুলদিদির নাম…কি জানি বাপু…একবার শুনেছিলুম যগঝম্পা না কি যেন। ফুলদিদিকে জিগগেশ করতে, মুখ বেঁকিয়ে বললে দ্যাক সুঁয়ো পোকা মরে গুটি পোকা হল কিনা।
এ আবার কেমন ধারা কথার ছিরি? মাকে বলতে মা ত ধমকে দিল, কেশব জেঠু আর অতুল কাকা ছাড়া টেলিফোনে খপরদার যেন আরো কারো সংগে কথা না বলি।
পুজো এসে গেচল। সসটির দিন সন্দেবেলায় ফুলদিদিকে নিয়ে ঠাকুর দেকতে বেরুচ্চি, কেশব জেঠু আমাদের বাড়িতে এল। মুখটা খুশি-খুশি। মুচকি হেসে বললে, এক ভদ্দর মহিলার জন্নে সামান্ন সওগাত এনেচি। পকেট থেকে একটা বাকস বার করলে সে। খুলতেই চোক আমার কপালে উঠে গ্যালো। হিরের বালা। তাতে আবার লাল নীল পাথর বসানো। ফুলদিদি ত মুচ্ছো যাবার মতন। হিস হিস করে উঠল, ইস্! চুনি আর পাননা সব।
ঠাকুর দেকা ঘুচে গ্যাল। ছুটলুম ভেতরে। কখোন কেশব জেঠু বালা জোড়া আমায় দেবে, খালি তাই চিনতা।
সন্দে পেরিয়ে রাত হল। সবাইকে এবার খেতে দেবে ফুলদিদি। আমি খালি ছটফট করতে লাগলুম। কেশব জেঠু এখনো বাকসটা দিচ্ছে না কেন?
রাত্তিরে খাবার আগে কেশব জেঠু একটা মস্ত বড় কাগজের বাকস আমাকে দিল। আদর করে বললে, পুজোর উপহার। আনন্দে বুকটা আমার কাঁপতে লাগল। ভাবলুম নিসচয় বালার বাকসটা এই কাগজের বাকসর ভেতর আছে।
আড়ালে নিয়ে গিয়ে কাগজের বাকসটা খুলে ফেললুম। কোথায় বালার বাকস! ভেতরে কিনা একটা গাল ফুলো বোকা বোকা পুতুল। ভাঁটা ভাঁটা চোখ দুটো শোয়ালেও বোজে না। গায়ে একটা জামা পযযনত নেই।
দেকে কাননা পেল আমার। কেশব জেঠুর ক্যামন ধারা আক্কেল? এগারো পেরিয়ে যে মেয়ে কিনা বারোয় পা দিয়েচে, তাকে একটা পুতুল দিতে লজ্জা হল না!
বালা জোড়া তাহলে আমায় দেকাবার কি দরকার ছিল? ফুলদিদিকে ওকথাই বা বলা কেন? আমি ত ধরেই নিয়েছিলাম যে ও জোড়া আমার। শুদু যা হাতে পরতে বাকি।
কেশব জেঠুর ওপর রাগে আমার সববাংগ জোলে গ্যাল। আবার ডান পকেটে রেকে দেওয়া হয়েচে। আমি যেন দেকতে পাই নি।
সত্তি বলচি আর একবার বালা জোড়া দেকবার, হাত বুলোবার বড় লোভ হল। একটা মতলব করলুম।
পাশের ঘরে মায়ের সংগে বসে বসে খুব গপ্প করচে কেশব জেঠু আর চা খাচ্চে। আমি গিয়ে তার কোলে চড়ে বসলুম আর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করলুম। বললুম পুতুলটা আমার খুব ভালো লেগেছে জেটু। আসলে আমার ছুঁতেই ঘেননা করছিল। কেশব জেঠু আমার গাল টিপে দিয়ে বললে, তাহলে মুখ ভার করেছিলে কেন শোনামণি? আমি সেই ফাঁকে কেশব জেঠুর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বালার বাকসটা বার করে নিলুম। কেশব জেঠু টেরই পেল না।
ছুটে নিজের ঘরে পালিয়ে এলুম। বাকসটা খুলতেই আলোয় হিরে আর লাল নীল পাথরগুলো ঝকঝক করে উঠল। আসতে আসতে হাতে পরলুম। কি ভালো যে লাগছিল। কিনতু বেশিকখন পরা হল না। মা খেতে ডাকলো। তাড়াতাড়ী বালা জোড়া লুকিয়ে রেকে ভালো মানুষটির মতন আমি খেতে গেলুম।
কিনতু খাবার কি ইচছে ছিল আমার? নিজের ঘরে গিয়ে কতোকখনে বালা জোড়া আবার বার করে দেকব, হাতে পোরব, মন পড়েছিল সেই দিকে। মা বারবার জিগগেস করলে, মন্টি, তোর কি খিদে নেই? শরির ভালো আচে ত? কেশব জেঠু ঠোঁট টিপে হেসে বললে এখুনি ওর শরির ভালো কোরে দিচ্চি।
খাওয়া দাওয়া হতেই মাকে কেশব জেঠু বললে বেচারা মন্টির মাকে পুজোয় ছোট একটা উপহার দিতে চাই। আমার দিকে চোক মটকে সে পকেটে হাত ভরালো। মা তো বড় বড় চোক করে তাকিয়ে রইলো।
কেশব জেঠু তখন থুড়িলাপ খেতে লাগলো। কোথায় গ্যালো গয়নার বাকস। এই পকেটে ছিল। এখানে যখোন আসি, তখোনও ছিল। বাড়িতেই কোথাও পড়েচে।
তার সংগে আমি আর ফুলদিদি চাদ্দিকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলুম। কোথায় পাওয়া যাবে। মা দেকি আমার দিকে চেয়ে ক্যামন একতরো হাসি হাসচে। তারপর আমায় অন্দকারে বারানদায় টেনে নিয়ে গ্যালো। জিগগেস করলে গয়নার বাকসটা তুই কি চুরি করেছিস মন্টি? আমি মাতা ঝাঁকিয়ে জোর গলায় বললুম, না মা, আমি কিচ্ছু জানি না। দেকিই নি বালা জোড়া। সত্তিই ত আমি চুরি করি নি, দেকব বলে লুকিয়ে রেখেছিলুম। মা বললে তুই যদি দেকিসই নি, তাহলে বাকসয় যে বালা আছে, জানলি কি করে? যা, ভালো চাস ত বার করে এনে দে, নইলে আমাকেই সব হাঁটকাতে হবে। আর যদি পাই, তোকে আস্ত রাখবো না।
ভয় পেয়ে গেলুম। মাকে চিনি ত। নিজের ঘরে গিয়ে বাকসটা বার করে নিলুম। জামার তলায় সেটা লুকিয়ে নিয়ে পাসের ঘরে ফিরে এলুম। ভেবেছিলুম চেয়ারের পাসেই বাকসটা ফেলে রাকব যাতে সবাই ভাবে কেশব জেঠুর পকেট থেকেই ওটা পড়ে গ্যাচে। কিন্তু রাখবার সময়েই কেশব জেঠুর কাছে ধরা পড়ে গেলুম। আমার হাতখানা মুচড়ে ধরে বাগের মতন গরজন করে উঠল তবে রে সয়তান মেয়ে। এই বয়েসে পাকা চোর হয়েচ তুমি? তারপরই গালে এক চড়। আমার ত যনতরণায় চোক দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল। মা রাকখুসির মতন ছুটে এসে কেশব জেঠুকে ধমকে উঠল, খপরদার আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না তুমি। এতো বড় সাহস তোমার কিসের? কেশব জেঠুও গলাবাজি করতে লাগল অমন চোর মেয়েকে হয় জেলে পুরব, আর নইলে বোডিংএ পাঠাবো কালই। ফুলদিদি ছুটে এসে আমায় বুকে টেনে নিল। মা আবার কেশব জেঠুকে চোক পাকিয়ে বললে, ওর দোষ কি। সবই পাপের ফল।
আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে এসে ফুলদিদি চোকের জল মুচিয়ে দিলো। আদর করে বললে। গয়না পরার বুজি খুব শখ হয়েচে দিদি। আমার একগাচা চেন হার আচে, পরাণ ধরেও ছাড়ি নি। তোকেই না হয় দোবো।
বুড়ি হার গাচা বার করে আনলো। বিচ্ছিরি দেকতে। আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললে লকখী মেয়ে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো দিকি নি।
ফুলদিদি চলে গ্যালো। আমার কিনতু ঘুম কিছুতেই আসছিলো না। মা পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলো। হাতে দেকি না সেই হিরের বালা জোড়া। কেশব জেঠুর সংগে তাহলে আবার ভাব হয়ে গ্যাচে। বিচানায় আমার পাসটিতে বসে মা বললে আজ মোহাসসটির দিন। ভালো মন্দ কিছুই দিতে পারলুম না। কি যে দুকখু হচ্চে।
মাকে জড়িয়ে ধরে আমি বললুম যদি একবারটি বালা জোড়া পরতে দাও মা, তাহলে আর কিচু চাই না। মা হেসে বালা জোড়া খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিলে। বললে আজকে রাত্তিরের মতন তোর হাতেই থাক। কিনতু পরের জিনিসে না বলে আর ককখনো হাত দিস না মন্টি। ককখনো না।
মায়ের গা ছুঁয়ে দিববি গাললুম।
এসব হচ্ছে কেশব জেঠু খুন হবার সাতদিন আগের কথা।
অতুলকাকা তখন আমাদের বাড়ির কাছেই একটা হোটেলে থাকে। প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসত। খুব মজা হত তখন। গপ্প হাসি খেলাধূলা। কিনতু মাজে মাজে ফুলদিদির সংগে চুপি চুপি কি জানি কি কথা বলত। আমি সামনে গেলেই ওমনি মুখ বন্দ।
একদিন অনেক রাত্তিরে অতুলকাকা এল। মা তখনো থিয়েটার থেকে ফেরে নি। ফুলদিদিকে সে যে কথা বললে, শুনতে পেয়ে আমি তো শিউরে উঠলুম। ও রকমটা কখখনো ভাবি নি। রাগে অতুলকাকার মুখখানা থমথম করছিলো। বললে আমি নিজের চোকে দেকে এসেছি। এসব কেলেংকারি বন্দ করতে হবে।
মা ফিরলো অনেকটা রাতে। আমি তখন মটকা মেরে পড়ে। যেই মা পাসের ঘরে ঢুকলো, ওমনি আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলুম। অতুলকাকা তখন রেগেমেগে বলচে কেশব নাগকে একদিন খুন করব আমি। নিজের বৌ আছে, তিনচারটে ছেলেমেয়ে আছে, তবু কিনা এই রকম নচ্ছারমি।
শুনে মা তো রেগে কাঁই। বললে আমি কাজ খুঁজছিলুম, কেশব ঠিক করে দিয়েচে। তুমি তো তাও পারলে না। অতুলকাকা চোক পাকিয়ে বললে রাজ্যির লোকের সামনে ল্যাংটা হয়ে ধেই ধেই করে নাচাকে কাজ বলছো তুমি? মা যতো না না বলে, ততো কাঁদে। অতুলকাকা মায়ের কাননা দেকে গলে গেচল বোধ হয়। শুনলুম মাকে বলচে এরকম নোংরা কাজ ছেড়ে দিয়ে তুমি আমায় বিয়ে করো না কেন? মা বললে কি করে করবো? আমি সত্তিকারের বিধোবা কিনা এখনো ত জানতে পারি নি। কাকা বললে, বেস। আমি তোমার কাচে কাচে থাকব, ভালোবাসো আর যেদিন বলবে সেইদিনই তোমায় বিয়ে করব।
আরো একটু শুনতুম, কিনতু ফুলদিদি এসে আমায় জোর করে টেনে নিয়ে গ্যালো শুতে।
ওর পরদিন রাত্তিরেই ত সেই রহোসসো কানড। আমি খেতে বসেচি। ফুলদিদি বসে খাওয়াচ্চে। মা রোজকার মতন কাজে বেরিয়ে গ্যাচে। এই সময় কে য্যানো বাইরের দরজায় কড়া নাড়লো। ফুলদিদি উটে দেকতে গ্যালো। গ্যালো ত গ্যালোই। আর আসে না। একলা আমার খুব ভয় করতে লাগল। উটে দেকতে গেলুম ফুলদিদি কোথায় গ্যাচে। কোথথাও আর খুঁজে পাই না। হঠাৎ জানলায় চোক পড়তে দেকি না ফুলদিদি রাশতায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বুড়ো লোকের সংগে কথা কইচে। শুধু তাই নয়, কি হাসি তার। আবার থেকে থেকে সাদাচুলো বুড়োটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করচে। দেকে ত আমার পিত্যি জোলে গ্যালো। ফুলদিদি ফিরে আসতেই ক্যাঁট ক্যাট করে বললুম, বুড়ো বয়েসে তোমার নিসচয় ভিমরতি ধরেচে ফুলদিদি, নইলে ওই পাকাচুলো বুড়োকে কিনা জড়িয়ে ধরে আদর করো। ওকে বুজি তুমি ভালোবাসো?
ফুলদিদির চোক দুটো জলে টলটল করতে লাগলো। ফোকলা মুকে কিনতু একগাল হাসি। বললে হ্যাঁরে দিদি। অতো ভালো আর কাউকে বাসি না। শুনে আমি ত ভয় পেয়ে গেলুম। বললুম তুমি কি ওকে বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? ফুলদিদি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললে, নারে দিদি। তোক ছেড়ে কি যেতে পারি? বরোন তোকে আজ আমার ভালোবাসার লোকের কাছে নিয়ে যাবে। কিনতু খপরদার মাকে বলবি না। আমি দিব্বি গাললুম বলব না বলে।
ফুলদিদি যাবার আগে আমার মাথা আঁচড়ে দিল। ধোবার বাড়ীর একটা জামা পরিয়ে দিল। বারবার শেকাতে লাগলো যেন বেফাঁস কতা কিচু না বলি। তার ভালোবাসার লোকের খুব অসুক করেছিলো ত।
ঘিনজি রাসতা দিয়ে ফুলদিদি আমায় একটা নোঙরা হোটেলে নিয়ে এলো। সেই বুড়ো লোকটা তখোন খাটের ওপর বসেছিল। আমরা ঘরে ঢুকতেই বুড়ো লাফিয়ে উটলো আর ছুটে এসে আমায় কোলে তুলে নিলো। বললে এই তাহলে আমার মেয়ে শ্যামলি। বুড়ো এমন জোরে আমায় জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল যে আর একটু হলেই আমার দম বনদ হয়ে যেতো।
আমাকে নাবিয়ে দিয়ে বুড়ো জিগগেস করলে বাবাকে দেকে আমার খুব আলহাদ হয়েছে কিনা। বাবা না ছাই! আমি বললুম আমার বাবা তো দেখতে সুনদোর? মাথায় কালো কোঁকড়া চুল আর জোয়ান।
বুড়ো ততো বলে আমিই তোর বাবা। ফুলদিদিও বুড়োর গোড়ে গোড় দিতে লাগলো, হ্যাঁরে, তোর বাবা। বিদেসে চাকরি করতে গিয়ে অসুকে মরতে বসেছিলো কিনা, তাই অমোন বুড়ো হয়ে গ্যাচে।
যাক আমার কিনতু একটুও পচনদ হয় না। বাবা যদি অমন বুড়ো, তাহলে ওর বউ—মা অমন জোয়ান কেন!
যে আমার বাবা বলছিলো সেই বুড়োটা আমায় জিগগেস করলে আমি আর ফুলদিদি তার সংগে এখান থেকে চলে যাব কিনা। আমি বলে দিলুম মা গেলে যাব।
বুড়োটা তখোন মায়ের আর কেশব জেঠুর কতা জিগগেস করতে লাগলো। আমিও যা জানি বললুম। বুড়োর মুখটা রাগে টকটক করতে লাগলো। ফুলদিদি ফিশফিশ করে বাবাকে কি য্যানো সব বলতে লাগলো। বুড়োটা ত খেপে লাল। চলে আসবার সময় আমায় একটু আদর সুদদু করলে না। ফুলদিদিকে বললে রাত্তিরেই সে আমাদের বাড়ীতে এসে মা ফিরলে দেকা করবে। আমরা য্যানো আগে থাকতে কাউকে কিছু না বলি। অবাক করে দেবে মাকে।
রাসতা দিয়ে আসতে আসতে আমি ফুলদিদিকে বললুম, নতুন বুড়ো বাবাকে আমার একটুও পচনদো হয় নি। ফুলদিদি কাঁদছিল। বিড়বিড় করে বললে তোর বাবা খুনখারাবী না করে। করলেও ওকে দোস দেওয়া যায় না। শুনে আমি ত অবাক। কিনতু ফুলদিদি আমার কাছে কিচু ভাংলে না। সুধু বললে য্যামোন করে হোক এসব বনদ করতে হবে। তাই বাড়ী না গিয়ে আমায় নিয়ে ফুলদিদি অতুলকাকার হোটেলে এলো। কি বললে আমি জানতে পারলুম না। ক্যানো না আমায় এক ধারে বসিয়ে রেকেছিল সে।
সব য্যানো আমার ধাদার মতন লাগছিলো। বুড়ো লোকটা কি সত্তি আমার বাবা। খুনখারাবী করতে চায় ক্যানো। কাকে খুন করবে? খুন করা কি আমি তা জানি। অনেক খুন খারাবী বায়োসকপে দেকেচি। দেকতে আমার খুব ভালো লাগে।
সন্দের পর কেশব জেঠু এলো। মা আজ য্যানো ক্যামোন গমভির। তার সংগে ভালো করে কতা বললে না। তারপর কাজে যাবার জন্নে বেরুতে যাবে, এই সময় দরজার কড়া ধরে কে নাড়লো। ফুলদিদির সংগে আমিও খুলে দিতে গেলুম। অতুলকাকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্চিল। ফুলদিদিকে দেকে বললে সব্বোনাস হয়েচে। ওর কাচে রিবলবার আচে। একখুনি এসে পড়বে। তারপর কি কানড যে হবে, ভগমান জানে।
ফুলদিদি আমার দিকে তাকিয়ে বললে তোর বাপ আবার যেলে যায়, তুই কি তাই চাস? আমি মাথা নেড়ে বললুম ককখোনো নয়।
ফুলদিদি তখন অতুলকাকাকে চুপি চুপি কি বললে আর অতুলকাকা পকেট থেকে একখানা দশ টাকার নোট বার করলে। ফুলদিদি আমায় বললে আমরা যা বলব, যদি তা করিস, ও টাকা তোকে দেবো।
শুনে তো আলহাদে আমার চোক গোল গোল হয়ে উটলো। বললুম আমায় কি করতে হবে, তাই বল না।
ফুলদিদি বললে, রিবলবার ক্যামোন দেকতে, তুই কি জানিস? বললুম ওমা, তা আর যানব না। বায়োসকোপে কত দেকেচি। বেস, ফুলদিদি বললে তোর বাপের পকেটে একটা রিবলবার থাকবে। য্যামোন করে কেশব জেঠুর পকেট থেকে বালা জোড়া চুরি করেছিলি, তেমনি ভাবে রিবলবারটা তোর বাপের পকেট থেকে চুরি করবি।
আমি রাজি হয়ে গেলুম। দশ টাকাটি ত কম নয়।
অতুলকাকার সংগে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলুম আমি। বুড়ো বাবা একটু পরেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসতেই বাপি বলে ছুটে গিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলুম। বাবা কিনতু আদরও করলে না, ফিরেও তাকালে না। অতুলকাকার সংগে তড়বড় করে কি য্যানো বলতে লাগল।
আগে আগে কি এসেচে দ্যাকবার জন্নে য্যামোন করে বাবার পকেটে হাত গলাতুম, তেমনি করে এবার হাত গলালুম। রিবলবার সত্তি ছিল। আলগোছে টেনে বার করে নিলুম। বাবা জানতেও পারলে না পারবে কি করে। সে ত তখনও অতুলকাকার সংগে ঝড় বওয়াচ্ছে। তারপরই আমায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বাবা ভেতরে ঢুকে গ্যালো। আমি রান্নাঘরে এসে রিবলবারটা ফুলদিদিকে দিলুম। ফুলদিদি কি খুসি। আদর করে চুমো খেলে আমায়। বললে ভগমান রোকখে করচেন। কাঁপতে কাঁপতে সে রিবলবারটা চালের টিনের ভেতর লুকিয়ে রেকে দিলে। ঢাকনাটা সে বনদ করে দিলে আমি দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই মনে হল আড়ালে কে য্যানো দাঁড়িয়ে আচে। ভালো চিনতে পারলুম না।
ফুলদিদি তখন সত্তি সত্তি আমায় দশ টাকা দিয়ে বললে, এবার লকখি মেয়ের মতন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়গে। না ডাকলে আর বেরিও না কিনতু।
নিজের ঘরে চলে এলুম আমি। কিনতু দরজাটা একটু ফাঁক করে রাকলুম যাতে সব শুনতে পাই। ওপাসের ঘরে বাবা যেন বুনো মোসের মতন দাপাদাপি করে বেড়াচ্চে। অনেকগুলো গলা একসংগে চেঁচামেচি করতে লাগলো। মা চিৎকার করে কেঁদে উটল। বললে আমি মনে করেছিলুম তুমি মারা গ্যাচো ভগমানের দিব্বি করে বলচি। তারপরেই দুম করে একটা আওয়াজ। অতুলকাকার গলা পেলুম, ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও বিনোদ। সংগে সংগে আবার দুম করে আওয়াজ। মা আবার পরিত্তাহি করে কেঁদে উটল। রাননাঘর থেকে ছুটতে ছুটতে ফুলদিদি গিয়ে ওঘরে ঢুকলো। বললে লোকটা মরে গ্যাচে বোধ হয়। অতুল ডাকতার ডাক—এখুনি।
একটু পরেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেকলুম কি অতুলকাকা আর ফুলদিদি কেশব জেঠুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরে শুইএ দিল। রকতে কেশব জেঠুর মুখখানা ভেসে যাচছিল। নড়েও না, চড়েও না।
ওরা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই আমি পা টিপে টিপে মায়ের ঘরে গেলুম। কেশব জেঠু মরে গ্যাচে কিনা দেকতে ইচ্চে হলো। সত্তিকার কাউকে মরে যেতে আজ ওবদি দেকিনি ত।
মরে গ্যাচে না ঘেঁচু। আমাকে দেকেই কেশব জেঠু বিছনার ওপর উটে বসলো। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল তুই চোর তোর মা চোর যে যেখানে আছে সব চোর। সব্বাইকে যেলে পুরবো আমি।
কপাল দিয়ে তার ফিনকি দিয়ে রকতো বেরুতে লাগলো। কি বিচছিরি যে দেকতে লাগছিলো। ম্যাগো!
ছুটটে পালিয়ে গেলুম আমি।
এরপর কি হয়েচে, দারোগাবাবুকে বলেচি, আমি তা জানি না। গুড়ুম করে একটা আওয়াজে ঘরখানা য্যানো কেঁপে উটলো। অতুলকাকা ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে আমায় কোলে তুলে নিলে। ফুলদিদির হাতে দিয়ে বললে এখুনি একে নিয়ে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাও। পুলিস এলো বলে। বিনোদ ওকে গুলি করেচে।
পকেট থেকে চাবির তাড়াটা বার করে সে ফুলদিদির হাতে দিয়ে বললে, হোটেলে নিয়ে গিয়ে একে আমার ঘরে লুকিয়ে রাকবে। আমি পরে যাব।
ফুলদিদি আমায় নিয়ে অতুলকাকার হোটেলে চলে এলো আর তার ঘরে পুরে রেকে আবার চলে গেল।
খুব বড় ঘর। আর কত রকোম খোশবোইওলা জিনিস। পাওডার কিরিম এসনো। ঠিক মায়ের ঘরে যে রকোম আচে, সেই রকোমের। সব খুলে খুলে মুখে মাকলুম, চুলে দিলুম। কি মজা যে লাগছিলো।
অনেকটা বাদে অতুলকাকা ঘরে এলো। মুকখানা প্যাঁচার মতন ভারি ভারি। আমায় বললে তোমাদের বাসায় একটা দূগঘটনা ঘটে গ্যাচে বুজলে। গুলি খেয়ে তোমার কেশব জেঠু মারা গ্যাচে। আমার কিনতু শুনে একটুও কাননা পেলো না। অতুলকাকা আবার বললে একখুনি একজন দারোগা আসবে আমার কাচে জিগগেস পড়া করতে। আমি যেন হুঁশ করে সব সত্তি কতা বলি। ক্যানো না পুলিশের ধারোনা বাবা খুন করেচে। কিনতু বাবা বলচে সে কিছু জানে না।
আমি চুপ করে রইলুম। অতুলকাকা দারোগাবাবুকে নিয়ে এলো। খুব ভালো লোক দারোগাবাবু। আমায় আদর করলে আগে। তারপর মিসটি মিসটি করে বললে তোমার বাবার পকেট থেকে রিবলবারটা বার করে নিয়ে খুব ভাল কাজ করেচ তুমি। খুব সাহোস আচে তোমার।
আমি তো চোমকে গেলুম। এ কতা কি করে দারোগাবাবু যানলে? হয় অতুলকাকা আর না হয় ফুলদিদি নিসচয় বলে দিয়েচে।
দারোগাবাবু তখোন আমার সংগে খুব গপ্প যুড়ে দিলে। কোন ইসকুলে পড়ি কোন কেলাসে। কার কাচে শুই। কেশব জেঠু আমায় কি রকোম ভালোবাসত।
আমি যা জানতুম গড় গড় করে বলে দিলুম, মায়ের রোজ রাত্তিরে কাজ করতে যাওয়া। কেশব জেঠু আর অতুলকাকা দুজনেই মাকে ভালোবাসে। দুজনেই তাকে বিয়ে করতে চায়। অতুলকাকা দেকি না চোক কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্চে। আমার মাতায় বুদধি এসে গ্যালো। দারোগাবাবুকে বললাম দুজনের মোদ্দে অতুলকাকাই খুব ভালো লোক। মাকে আমাকে বেসি ভালোবাসে।
শুনে দারোগাবাবু একটা হাসল। অতুলকাকাকে ইংরিজিতে কি য্যানো একটা বললে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিগগেস করলে ফুলদিদি যে চালের টিনে রিবলবারটা লুকিয়ে রেকেছিলো আর কেউ সেটা দেকেচিল কিনা। আমি বললুম একযন তখোন দরজা গোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল কিনতু আমি তাকে ঠিক চিনতে পারি নি। দারোগাবাবু বললে ভেবে দ্যাকো। তোমার বাবা হলে কেশ অন্নরকম হবে।
আমি বললুম ভাববো। দারোগাবাবু তখোন আবার কাল আসব বলে চলে গ্যালো। আমি অনেক ভাবতে লাগলুম। পাচে আবার কিচু ভুলে যাই, তাই লিকে রাকচি।
রাত্তিরে ফুলদিদি আমায় ঘুম পাড়াতে এলে আমি যেদ ধরলুম আমায় সব খুলে বলবার জন্নে। কি কি হয়েচে পুলিস এবার কি করবে, কাকে কাকে ধরে নিয়ে যাবে।
ফুলদিদি বললে, পুলিস তোর বাবাকে ধরে থানায় নিয়ে গ্যাচে। খুনের সময় তোর বাবা বলেচে ও তখোন কলঘরে ছিলো। কিন্তু পুলিসে বিসসাষ করে নি। তোর বাবা দিব্বি গেলে বলেচে খুন করে নি। ওর পকেট থেকে রিবলবারটা যে চুরি গ্যাচে ও তাও টের পায় নি, চালের টিনে যে লুকোনো ছিল তাও জানতো না।
ফুলদিদি আরো বললে গুলির সময় মা আর অতুলকাকা নাকি মায়ের ঘরে ছিল। তারা কেউ আর তাহলে কি করে খুন করবে। তাই পুলিস তাদের সনদেহ করে নি।
আমি তখোন ফুলদিদিকে জিগগেস করলুম, তুমি তখোন কোতায় ছিলে? ক্যামোন একরকোম করে ফুলদিদি যবাব দিলে, আমি তখোন টেলিফোন করে ডাকতার ডাকতে সামনের বাড়িতে গেচলুম। আমি বললুম পুলিস ক্যানো তোমাকে ধরলে না। রিবলবারটা তে তুমিই লুকিয়ে রেকেছিলে আর কেশব জেঠুকে তুমি দুটি চোককে দেখতে পারতে না। চাইছিলে ত সে মরুক।
ফুলদিদি হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললে ভগবান য্যানো তাই করে। তোর বাবাকে ছেড়ে দিয়ে পুলিস য্যানো আমাকেই ধরে নিয়ে যায়। তোর বাবা জিবোনে অনেক দুকখু পেয়েচে। আমি বুড়ো হয়ে গেচি। আর কদ্দিন বাঁচব। তোর বাবার বদোলে না হয় আমি ফাঁশির দড়ি গলায় পরে মরব।
আমি বললুম অতুলকাকা শুতে আসবার আগে আমায় বলেচে বাবার ফাঁশি হতে পারে না। বড্ড জোর এক বচর কি দু বচর যেল হতে পারে। কিনতু তুমি খুন করে থাকলে তোমার ফাঁশি হবে। মা কি অতুলকাকা খুন করে থাকলে তাদেরও হবে। ফুলদিদি বললে ওরা যে খুন করতে পারে তার জন্নে একটা গুচিয়ে ওযুহাত দিয়েচে। কিনতু পুলিসে বিসসাষ করবে না। অতুল যে তোর মাকে ভালোবাসে ওরা তা জানতে পেরেছে।
অত ভজোকটোর দরকার কি জানি না বাপু। তাই ফুলদিদিকে বললুম তোমাদের কারো ফাঁশি হবার চেয়ে বাবা যদি এক বচর কি দু বচরের জন্নে যেলে যায়, সেইটেই তো ভালো।
আঁতকে উটলো ফুলদিদি। চোক ঘুরিয়ে বললে ঘুমিয়ে পড় লকখিছাড়ি মেয়ে।
আমি কিনতু ঘুমুলুম না। ভাবতে লাগলুম—খুব খুব ভাবতে লাগলুম। মা কি ফুলদিদি কি অতুলকাকার ফাঁশি হলে বিচছিরি লাগবে আমার। তার চেয়ে বাবা যদি এক বচর কি দু বচরের জন্নে যেলে যায়, মা তখোন বাবার সংগে বিয়ে ঘুচিয়ে দিয়ে অতুলকাকাকে আবার বিয়ে করতে পারে। তখোন আর মাকে ল্যাংটো হয়ে রোজ রোজ নাচতে হবে না। কেশব জেঠু মরেচে না বেস হয়েচে। বেঁচে থাকলে ওর পকেট থেকে যে হিরের বালা চুরি করেছিলুম, ঠিক বাবাকে বলে দিত আর বাবাও বেত দিয়ে আমার পিটের ছাল তুলত। জেলে গেলে তা তো আর পারবে না। আর মা কি অতুলকাকা—কখকনো আমায় বেত দিয়ে ঠ্যাংগাবে না।
মাতায় একটা মতলোব এলো। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লুম।
পরদিন দুকুরে দারোগাবাবু আগেভাগেই জিগগেস করল কি খুকি, তোমার ফুলদিদি যখোন চালের টিনে রিবলবারটা রাখে, তখোন দরজা গোড়ায় কাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেকেছিলে, মনে পড়েচে? আমি মাতা নেড়ে বললুম না মনে পড়ে নি। কিনতু লোকটার মাতার চুল শাদা ছিল। যখোন ফিরলো, তখোন আমি দেকে ফেলেছিলুম কিনা।
দারোগাবাবু উকীলটার দিকে তাকিয়ে বললে, এটা আপনার মককেলের বিরুৎদে মসতো বড় প্রোমাণ, কারণ পাকা চুলতো আর কারুই নেই।
উকীলমশাই তখন আমায় নিয়ে পড়লো। কতো কথা জিগগেস যে করতে লাগলো। আমি পসটো বলে দিলুম গুলি খাবার আগে কেশব জেঠু মায়ের বিচানায় শুয়েছিল। গুলি লাগবার পর উটে বসতে বসতে কি চিৎকার আর গালাগাল। শুনতে শুনতে উকীলবাবুর চোক ট্যারা। দারোগাবাবুকে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললে আমি এখুনি হাজতে গিয়ে বিনোদবাবুকে দোস সিকার করতে বলচি। তাতে হয়তো সাশতিটা কম হবে।
যাবার সময়ে দুজনে আমায় খুব আদর করলে। বললে আমি লোকখি মেয়ে। জজ সায়েবের সামনেও যেন এই রকম সব সত্তি কতা বলি। সব কিনতু মনে রাকতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না। তাই তো আমি সব মনে করে রেকেচি। আর জজ সায়েবকে ঠিক ঠিক বলবার জন্নে লিকে রেকেচি।
তাই বলে বালা জোড়া চুরির কতা আমি জজ সায়েবকে বলচি না। কেশব জেঠু যে মায়ের ঘরে আমায় গালাগাল দেবার পর আমি কি করেছিলুম, সেটিও বলচি না।
জজ সায়েবকে কিচুতেই বলব না যে চুপি চুপি আমি রাননা ঘরে গিয়ে চালের টিন থেকে রিবলবারটা বার করে নিই, তারপর মায়ের ঘরে এসে ঢুকি। তারপর দরজাটা একটু ফাঁক করে, যে রকোমভাবে বায়োসকোপে গুলি ছোড়ে না, সেই রকোমভাবে কেশব জেঠুকে তাক করে রিবলবার ছুঁড়েছিলুম। এটিও বলচি না। তারপরই রিবলবারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ঘরে ছুটটে পালিয়ে এসেছিলুম।
এ বললে সবাই ভাববে বাবাই খুন করেচে। জজ সায়েব ত এক বচর কি বড় জোর দু বচরের যেল দেবে বাবাকে। কিনতু আমি খুন করেচি জানতে পারলে ফাঁশি দিক আর কি!
শ্যামলি অতো বোকা নয়।
পড়া শেষ হলে প্রতুল হো হো করে হেসে উঠল। বলল, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর হতে পারে না।