জঙ্গলের রাজা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
চিরিমিরি মধ্যপ্রদেশে। সেখানে জঙ্গল আছে। কথা ছিল, আমরা তিন বন্ধু সেখানে বেড়াতে যাব। রথীন আর অমিয় অনেক জঙ্গল দেখেছে। তাদের এ ব্যাপারে প্রচুর অভিজ্ঞতা। রথীন রাইফেল চালাতেও জানে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি রাইফেল ছুঁড়তে জানলেও জঙ্গল বলতে কী বোঝায়, কোন ধারণা নেই। বন্দুক রাইফেল পিস্তল কেন, কখনও ছড়ি দিয়েও কাউকে আঘাত করিনি। তাছাড়া নিজেই যে প্রচণ্ড একটা আঘাতে সারাজীবন আহত, আঘাত করার জোর কোথায় তার?
কিন্তু চরম সময়ে রথীনের দাদা মারা গেলেন। তার যাওয়া হল না। অমিয় হঠাৎ হেড অফিসের জরুরী তলব পেয়ে প্রথমে দিল্লী, তারপর বোম্বাই হয়ে ক্যানাডা পাড়ি দিল। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল।
আমার মধ্যে একটা সহজাত জেদ বা গোঁড়ামি আছে। একবার কোনকিছু ঠিক করে ফেললে তা না চুকিয়ে ফেলা অব্দি রেহাই দিইনে। তাছাড়া রথীন চিরিমিরি জঙ্গলের ওখানে একটা ডাকবাংলোর ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করে ফেলেছিল। বিলাসপুরে ওর এক আত্মীয় রেলের্ বড় অফিসার।
তাই ঠিক করলুম, আমি একাই যাব। আমার অবশ্য বন্দুক নেই, রাইফেল নেই—খাঁটি একটি নিধিরাম সর্দার। জঙ্গলে বাঘ-ভালুক হায়েনা বুনো হাতি ইত্যাদি সব হিংস্র জানোয়ার রয়েছে নাকি। একটু আশঙ্কাও না হল, এমন নয়। কিন্তু মনকে বোঝালুম, আমি তো শিকার করতে যাচ্ছিনে, জঙ্গলের নাকি অতুলনীয় সৌন্দর্য আছে—তা উপভোগ করতেই যাচ্ছি। ঠিক যেভাবে রাস্তায় নিরাপদে সুন্দরী পরস্ত্রীদের দেখি, সেভাবেই চিরিমিরি দেখে আসা যেতে পারে।
বিলাসপুরে নেমে রথীনের আত্মীয় ভদ্রলোকের বাসায় গেলুম। প্রবাসী বাঙালীরা যে অতিমাত্রায় ভদ্র এবং অতিথিপরায়ণ তাতে কোন ভুল নেই। সেই বিকেল এবং রাতটা কোনমতে
ছাড়লেন না। পরদিন সকালে চিরিমিরিগামী একটা বাসে তুলে দিলেন তিনি। বললেন, এখন বর্ষার সিজন। ট্যুরিস্টের ঝামেলা নেই। খুব ভাল সময়ে এসেছেন। নির্জনতা পাবেন। তাছাড়া বৃষ্টি নামলে তো কথাই নেই। সে এক গ্র্যাণ্ড ব্যাপারে হবে! দেখবেন—নেচার কী দারুর মিস্ট্রিয়াস! অভিজ্ঞতা হবে—নির্ভয়ে চলে যান। বাংলোর ব্যবস্থা রয়েছে।
বাস ছাড়ার মুহূর্তে জানালার ধারে এসে ফের বলে গেলেন, হ্যাঁ, একটা কথা। ওখানে টিম্বার মার্চেন্ট কোম্পানীর এক কন্ট্রাক্টারের খোঁজ করবেন। বলবেন—বনওয়ারীবাবু। নামটা মনে থাকবে তো? বনওয়ারীলাল কারফরমা। এ বিগ নেম! বাঙালী! রথীনের সঙ্গে আলাপ ছিল ভদ্রলোকের। ওঁকে কায়দা করতে পারলে আপনি তখন জঙ্গলের রাজা। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ!…উনি কেন কে জানে বেজায় হাসতে পাবেন।
পথে বৃষ্টি নামল। দুধারে অজস্র গাছপালা ঝোপঝাড়—বসতি খুব কমই। শুনলুম,
দণ্ডাকারণ্যের একাংশে চলেছি। তাহলে এই জঙ্গল! বৃষ্টি মুষলধারে হচ্ছিল কিন্তু রাস্তা খুব ভাল। বৃষ্টির মধ্যে জঙ্গল দেখে সত্যি ‘মিস্ট্রিয়াস’ বা রহস্যময় মনে হচ্ছিল। আমি জানালার কাচ
তুলে কিছুক্ষণ দেখার পর সহযাত্রীদের ভয়ে নামিয়ে দিলুম। বাসে ক’জন উদ্বাস্তু বাঙালীও ছিলেন। তাঁরা বিলাসপুর বা কলকাতা থেকে আসছেন। বাদ বাকী অবাঙালীদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ দেহাতী সাধারণ লোক, কিছু আদিবাসী মেয়ে।
বাঙালীরা অবশ্য রাজনীতি চর্চাই করলেন সারাপথ। তারপর নিজের নিজের জায়গায় নেমে গেলেন একে একে। এই প্রথম যাচ্ছি শুনে প্রত্যেকে অজস্র উপদেশও দিতে ভুললেন না। ততক্ষণে বৃষ্টি নেমে গেছে। কিন্তু সুন্দর পরিবেশ। মন আনন্দে ভরে গেল।
যে বাংলোয় উঠলুম, তা চিরিমিরি থেকে মাইল তিনেক দূরে। দু’মাইল রিকশা, তারপর হাঁটা
ছাড়া উপায় নেই। একটা টিলার গায়ে বাংলোটা রয়েছে। ওটা ফরেস্ট ডিপার্টের সম্পত্তি। সঙ্গে জিনিসপত্র বলতে একটা স্যুটকেস আর কিটব্যাগ। বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেছি। চৌকিদার আমার অপেক্ষা করছিল। ব্যবস্থা দেখে খুশি হলুম।
সন্ধ্যার মুখোমুখি ফের এত জোরে বৃষ্টি এল যে টিলার মাথায় গিয়ে প্রকৃতি দর্শন করার
প্রোগ্রাম ভেস্তে গেল। সেই বৃষ্টি রাত নটা নাগাদ ছাড়ল। তখন বারান্দায় বেরিয়ে দেখি চাঁদ
উঠেছে। জ্যোৎস্নায় ভিজে গাছপালা ঝকমক করছে। নিচে নদীর আওয়াজটা খুব বেড়ে গেছে। চৌকিদার গণরাজ জানাল, এবার জোর বন্যা হবে এলাকায়। শুনে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলুম।
এত অস্বাভাবিক নির্জনতার স্বাদ জীবনে কখনও টের পাইনি। আনন্দের পাশাপাশি একটা অস্বস্তিও পেয়ে বসছিল। রাতটা কীভাবে কাটাব কে জানে! সামান্য নিরামিষ খাওয়াদাওয়ার পর গণরাজ গল্প করতে এল। ওর বাড়ি জঙ্গল এলাকার একটা বস্তিতে—এখান থেকে মাইলখানেক দূরে। আজ সে এত রাতে আর বাড়ি ফিরছে না। বৃষ্টি নামলে ভিজে বেকায়দায় পড়বে। তাছাড়া ইদানীং এ এলাকায় একটা বাঘ বেজায় উৎপাত করছে। গণরাজ জঙ্গলের খবর অনেক দিল। তার মধ্যে শতকরা নব্বুইটা ভূতপ্রেত সংক্রান্ত। একদল বুনো হাতি কীভাবে একবার তাদের সাংঘাতিক জ্বালিয়েছিল, সে গল্পও শোনাল। তারপর আমি বনওয়ারীবাবুর কথা জিগ্যেস করলুম ওকে।
গণরাজ বলল—বানারীবাবুকে কে না চেনে। ওই গাছটাকে জিগ্যেস করুন, বলে দেবে বানারীবাবু কোথায় আছে। তবে বানারীবাবু নিজে কনট্রাকটার নয়, কনট্রাকটারের লোক। মালিক থাকে টাঙিপুরে—অনেক দূর এখান থেকে। বানারীবাবুর তাঁবু আছে মাইল তিনেক দূরে জঙ্গলের মধ্যে। বাঘটার ভয়ে লোকজন পালিয়েছে বলে বেমরশুমে এখনও পড়ে রয়েছে। কনট্টাক্টের গাছগুলো কাটা শেষই হয়নি। আর এমন জায়গায় গাছ—যেখানে দিনদুপুরে অন্ধকার। বলুন স্যার, কোন ছেলেপুলের বাপ যেতে চাইবে সেখানে? তার ওপর যা বরষাচ্ছে, হঠাৎ বানবন্যা হলে সব্বাই ভেসে যাবে, নয়তো গাছে চড়ে জান বাঁচাতে হবে। লেকিন বানারীবাবুকা এইসা খেয়াল! উও সিরফ্ পাগলা আদমী হ্যায়, স্যার।
বললুম—তাই বুঝি?
হ্যাঁ স্যার। নৈলে বলুন, আজীব বাত—ওই গহন জঙ্গলে তাঁবুতে কেউ নিজের বিবি নিয়ে বাস করে?
বল কী? বনওয়ারীবাবুর বউ থাকেন?
বলছি কী তবে! আর বউটাও অদ্ভূত—দিব্যি হেসেখেলে কাটাচ্ছে। গাছকাটার মরশুম জুনেই খতম হয়ে যায়। তারপর আর গাছে হাত দেওয়া মানা। লেকিন এই জুলাই মাসের উন্নিশ তারিখ অব্দি বানারীবাবু গাছ কাটছে। কিছু সমঝালেন?
না। তো।
রহস্যময় ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে গণরাজ বলল—বড় কপাল স্যার বানারীবাবুর। আমি স্যার ছোটা আদমী বড় কথা বলতে বাধে। ওই বিবি যদ্দিন আছে, বানারীবাবু জঙ্গলের রাজা।
বউটি খুব সুন্দরী নিশ্চয়!
লাই পেয়ে গণরাজ মাথায় চড়ল। খৈনি দলাটা একহাতের চেটোয় রেখে অন্য হাতের চেটোয় ফটাফট তার ওপর চাঁটি মেরে ফ্যাঁচ করে হাসল সে। দেখলুম তার সামনের দুটো দাঁত ভাঙা। খৈনিটা মুখে ফেলে জিভ উল্টে অস্পষ্টভাবে সে যা বলল, তার মানে দাঁড়ায় : ফরেস্ট ডিপার্টের রথী-মহারথীরা ওই উর্বশীর পায়ে মাথা রেখে ভেউ ভেউ করে কাঁদেন। জী হাঁ-হাম পনা আঁখসে দেখা যায়। জঙ্গলের বানারীবাবু পিকনিক করে। রাত অন্ধকার হলে হ্যাজাগ জ্বলে। টেবিল সাজানো হয় বিলিতি মদের বোতলে। জ্যোৎস্না হলে অফিসাররা আলো জ্বালাতে দেয় না। গণরাজকে প্রায় থাকতে হয় ওইসব পার্টিতে। সে পরিবেশন করে। এমনি এক জ্যোৎস্নার রাতে বানারীবাবুর বউয়ের পা ধরে এক মাতাল অফিসার (তার নাম গণরাজ বলবে না, চাকরি যাবে) ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল। আর ক্যাম্পচেয়ারে বসে বিবি মিটিমিটি হাসছিল। আশেপাশে কেউ ছিল না? ছিল। আর দুজন অফিসার ঢলে বেঁহুশ পড়েছিল। বানারীবাবু? সে তাঁবুতে গিয়ে মজাসে ঘুমোচ্ছিল। গণরাজ কী করছিল? সে পিঠ ঘুরিয়ে তফাতে বসে ছিল। তার পর কী হল? অফিসার সেখানেই ঘাসের উপর পড়ে রইল। বানারীবাবুর বউ আস্তে আস্তে গিয়ে তাঁবুতে ঢুকল। ব্যস? জী হাঁ হুজুর—সব খতম। লেকিন—ইয়ে খতমকা বাত নেহী। ইয়ে তো পহলে শুরুকা বাত।
ক্যায়সে গণরাজ?
আপনি দেখবেন, হামার বেটাবেটির কিরিয়া—বানারীবাবু ঔর বানারীবাবুর বিবি দুইভি খতম হবে। প্যারমে ধোঁকা বহুৎ খারাব—বহৎ। পীরিতে ধোঁকা কদ্দিন মানুষ সইতে পারে? তিনশো গাছ বাড়তি মরশুমে বে-আইনী করে কাটছে বানারীবাবু। ওজর দেখিয়েছে—লোক মিলছে না। আরে, মিলছে না তো শেরটা খতম করো।
বাঘটা মারার চেষ্টা করে না বনওয়ারীবাবু?
মনে তো হয় না।
উনি জঙ্গলে থাকেন। ওঁর বন্দুক নেই?
নেই কেন? দামী রাইফেল আছে।
তাহলে তো নিজেও উনি শিকার করতে পারেন?
আলবাৎ। একটা বুনো হাতি সেবার কে মেরেছিল? ওই বানারীবাবুই তো।—লেকিন—শের সে মারছে না। বুঝলেন না স্যার, ওই তো কূটবুদ্ধি—ওই হচ্ছে চালাকি।
বুঝলুম না, গণরাজ।
আমিও বুঝিনি স্যার। শুধু মনে হয়, কী একটা ব্যাপার আছে। কই জাসুসী ব্যাপার। বানারীবাবু খুব সহজ লোক নয়।….
সারারাত সারাদিনের জার্নির ক্লান্তি—ঘুম আসছিল। শুয়ে পড়লুম। দরজা এঁটে দিতে বলল গণরাজ। সে শুলো বসবার ঘরে। নদীর জলের শব্দ, তারপর কী একটা রাতচরা পাখি জন্তুর ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লুম। সে-ঘুম যখন ভাঙল, তখন ভোর হয়ে গেছে।
কারো নাম শুনে মনে যে চেহারার ইমেজ আসে, বাস্তব মানুষটির চেহারার সঙ্গে তার মিল তো থাকেই—না বরং আকাশপাতাল পার্থক্য হয়ে যায় অনেক সময়। আমি ভেবেছিলুম, বানারীবাবু মানে একজন অর্ধশিক্ষিত গোঁয়ারগোবিন্দ গোছের লোক—ধুতি শার্ট পরা, পায়ে পাম্পসু এবং চুলগুলোয় সিঁথি থাকবে। কূটবুদ্ধি রোজগেরে বাঙালী বাবুদের ওই চেহারার আদর্শ আমার মাথায় ছিল। খানিকটা কেরানী-টাইপও হতে পারে। কাঠের আড়তে এমন লোক কলকাতায় অনেক দেখেছি—যাঁরা উরু অব্দি ধুতি তুলে গদিতে বসে থাকেন।
পরদিন দশটা নাগাদ যখন গভীর জঙ্গলে ট্রাকের চাকার দাগ ধরে অকুতোভয়ে বনওয়ারীবাবুর ক্যাম্প খুঁজে পেলুম, বেশ ডাঁটে গিয়ে আলাপ করার মতলব মাথায় ছিল। কারণ সম্ভবত—বউটি নাকি সুন্দরী। তার কাণ্ডকারখানা শুনে একটু চাপা লাম্পট্যভাব মনে না এসেছিল—তা নয়।
কিন্তু—মাই গুডনেস! এই ভদ্রলোক বনওয়ারীবাবু!
এ যে দস্তুরমত সাহেব! পাক্কা সাড়ে ছ’ ফুট উঁচু বিশাল শরীর—ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ, মাথায় সুদৃশ্য টাক, সরু গোঁফ এবং চমৎকার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, ঘিয়ে রঙের প্যান্টের ওপর চাকর-বাকরা স্পোর্টিং গেঞ্জি, দাঁতে পাইপ—ভাবা যায় না, ভাবা যায় না!
এই মানুষের পিঠে যখন রাইফেল এবং কোমরে বুলেটের বেল্ট থাকে, তখন কী সাংঘাতিক
মেকসিকান কাউবয় টাইপ মূর্তি হয়ে ওঠে—আমার এখুনি ভাবা উচিত।
ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন বনওয়ারীবাবু, যখন আমি ক্যাম্পের সামনে খোলা জায়গায় আবির্ভূত হয়েছি।
একটা খালি ট্রাক একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘন ঘাসের মধ্যে চাকা ডুবিয়ে। বৃষ্টির ফলে জায়গাটা ভিজে—কিন্তু কাদা নেই ঘাস থাকার দরুন। পরপর তিনটে তেরপলের তাঁবু রয়েছে। একটা তাঁবুর দরজার পর্দা একটু গোটানো—বাকীগুলো খোলা। জনাকতক লোক তাঁবু দুটোর ভেতর বসে খাওয়াদাওয়া করছে। দুটো করাতও দেখতে পেলুম। অন্যদিকে কাঠের পাঁজা রয়েছে কয়েকটা। টাটকা কাটা তা বোঝা যাচ্ছিল। কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম। তিনদিকেই দুর্ভেদ্য জঙ্গল—উঁচু গাছপালা। দিনদুপুরে সেদিকে অন্ধকার মনে হচ্ছে। এখানটায় সূর্যের প্রচুর আলো পড়েছে। আমি বনওয়ারীবাবুর বউকে দেখতে পাচ্ছিলুম না।
উনি কিছু বলার আগেই আমি নমস্কার করে বললুম—আপনিই কি সেই মিস্টার বনওয়ারী…(ওই চেহারার লোককে বাবু বলার ভরসা পেলুম না)…
বনওয়ারীবাবু হেসে অমায়িক স্বরে বললেন আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই সেই বনওয়ারীবাবু। আসুন, আসুন। নিশ্চয় কলকাতা থেকে আসছেন! বাঃ, খুব আনন্দ হল আপনাকে দেখে! বসুন, বসুন!
মুহুর্তে অস্বস্তি ঘুচে গেল। লোকটির মধ্যে কোন ঘোরপ্যাঁচের চিহ্ন তো নেই। দিব্যি সরলচেতা মানুষ বলেই বোধ হচ্ছে। নিজেই তাঁবুর ভিতর থেকে দুটো ভাঁজ করা ক্যাম্পচেয়ার এনে পেতে দিলেন। তখন নিজের পরিচয় দিলুম। রথীনের নাম শুনে বললেন—চেনা মনে হচ্ছে। হয়তো এখানেই কোনসময় দেখে থাকব। যাক্গে, জঙ্গল দেখতে এসেছেন যখন—বাংলোয় নিরাপদে বসে কী দেখবেন মশাই? কোন অসুবিধে নেই—আমার আতিথ্য গ্রহণ করুন, যদ্দিন খুশি। আমিও আনন্দ পাব। বুঝতেই তো পারছেন, অরণ্যে নির্বাসন একেবারে। প্রাণ খুলে দুটো ভাল মন্দ কথা বলার লোকই পাইনে।
তারপর তাঁবুর দিকে ঘুরে ডাকলেন—রমা। এস—ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই! তা—এমন সময় এলেন মশাই, ঘুরে আনন্দ পাবেন কম। এ এলাকায় ভীষণ বৃষ্টি হয়। সেজন্যেই তো জঙ্গল গজিয়েছে। তবে কী জানেন, এ জঙ্গলে ভিজেও সুখ আছে। কারণ, প্রকৃতির মধ্যে ভব্যতার বালাই তো নেই। আপনাকে এখানে আপিস যেতে হচ্ছে না, ক্লাবে বা সিনেমায় যেতে হচ্ছে না—কোন অবলিগেশান নেই কিছুর।
হয়তো অনেকদিন পরে বাঙালী পেয়েই ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত। অনর্গল কথা বলতে থাকলেন। জানতে পারলুম, বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। ছেলেবেলায় বেরিয়ে পড়েন। নানা ঘাটে অঘাটে জল খেতে খেতে জাহাজে চাকরি নিয়ে চলে যান আফ্রিকা। তারপর জাহাজ ছেড়ে নাইরোবিতে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর কাঠের কোম্পানী—সেই সুবাদে জঙ্গলে যেতে হত। স্যাভোর অরণ্যে অনেকদিন বাস করেছেন এক শিকারী কোম্পানীর মাইনে করা শিকারী হিসেবে। তখন থেকে কয়েক বছর প্রফেশনাল হানটার হয়ে ওঠেন। নানাদেশের রাজারাজড়া বড়লোক আফ্রিকায় শিকারের শখে যেতেন। এই প্রফেশনালদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কার্যত এঁরাই জন্তুজানোয়ার মেরে দিতেন। ওঁরা তার ওপর পা রেখে বন্দুক কাঁধে নিয়ে ছবি তুলতেন এবং ট্রফি হিসাবে সেগুলো স্বদেশে নিয়ে গিয়ে বড়াই করতেন। কলকাতার এক অভিজাত ব্যক্তির নাম করলেন—যাঁর ঘরে অজস্র জন্তুর মামি রয়েছে। সেগুলো কিন্তু বনওয়ারীবাবুর শিকার। অথচ ভদ্রলোকের শিকারী বলে প্রচণ্ড খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে।
সেখান থেকে বনওয়ারীবাবু চলে আসেন কলকাতা। আফ্রিকার জঙ্গলে খুব কড়াকড়ি নিয়ম চালু হয়। তার ফলে পেশাদার শিকারীর ভাত মারা যায়। কলকাতায় এসে বিয়ে করেন। তারপর এক যোগাযোগে আজ বছর তিনেক হল মধ্যপ্রদেশের এই অরণ্যে জুটেছেন। সবই ভাগ্য। বন্যতাই বলুন, খাময়েখালীপনাই বলুন—বনওয়ারীবাবুর রক্তে কিছু ছিল! প্রকৃতিই শেষঅব্দি দেখা যাচ্ছে তাঁর খারাপ। কোলের ছেলেকে পেয়ে প্রকৃতি খুব খুশি। ছেলেও কম খুশি নয়!
বাঘটা—হ্যাঁ, বাঘটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এখনও বিশেষ আঁচড় দেয়নি কারো গায়ে। কিন্তু ভয় দেখাচ্ছে যেন। গাছ কাটতে শুরু করলেই কোথ্থেকে এসে এমন জোরে গর্জন করে যে করাতীরা পড়ি-কী-মরি করে পালিয়ে আসে। আশ্চর্য, বাঘটা বনওয়ারীবাবুর সাড়া পেলেই কেটে পড়ে। তাই তিনি কদিন থেকে গাছ কাটার সময় সঙ্গে উপস্থিত থাকছেন।
কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে প্রকৃতিকে হত্যা করা কেন? জঙ্গল উচ্ছেদের কাজ কেন করতে এলেন বনওয়ারীবাবু?
তার জবাবে বললেন—পেটের জন্যে। এ ছাড়া জঙ্গলে থাকবেন কীভাবে? সারাক্ষণ নির্জন অরণ্যবাস তাঁর প্রিয়। তাই এই অন্যায় (স্বীকার করলেন—কাজটা অন্যায়) না করেও উপায় নেই।…
এতক্ষণ ধরে আমাকে অন্যমনস্ক করে রেখেছিল রমার চিন্তা। রমা আসছে না কেন? রমা দেখতে কি সত্যিই অসাধারণ সুন্দরী?
বনওয়ারীবাবুর যেন এতক্ষণে খেয়াল হল, রমা আসছে না। চা আসছে না। তাই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁবুর পদার ভিতর দিয়ে ডাকলেন—কী ব্যাপার? দেরি করছ কেন?
তারপর উনি একটু সরে দাঁড়ালেন এবং চায়ের পেয়ালা হাতে তাকে বেরোতে দেখলুম, মুখের ওপর ফণা তোলা সাপ দেখলেও অত আঁতকে উঠতুম না। নিজের চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না। আমার সারা শরীর পলকে ঠাণ্ডা বরফ হল। কয়েকশো কুইন্টাল ওজন চেপে বসল আমার মধ্যে।
সেজন্যে এত দেরি হচ্ছিল বেরোতে। নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিল চা করার অজুহাতে। বনওয়ারীবাবু আলাপ করিয়ে দিয়ে (দরকার ছিল না) বললেন, রমা ভীষণ অতিথিপরায়ণা, বুঝলেন মশাই? সে আপনি ক্রমশ বুঝবেন। নিন, চা নিন।
যন্ত্রের হাতে চায়ের পেয়ালা নিলুম। এ মুহূর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারছিলুম না। রমা পুতুলের মত নমস্কার করে তাঁবুর দরজায় দাঁড়াল। আকাশ কিংবা জঙ্গল দেখতে লাগল। বনওয়ারীবাবু কি কিছু আঁচ করলেন? বললেন—আজ আবার শরীর খারাপ করছে নাকি তোমার? দেখি, ওবেলা চিরিমিরি গিয়ে ডাক্তারকে ধরা যাবে বরং। বুঝলেন? ওর এ ক্লাইমেটটা অ্যাদ্দিন বেশ সইত—এখন কে জানে কেন, সইছে না। প্রায়ই অসুখবিসুখ হচ্ছে। অবশ্য শিগগির কাজ শেষ করে আমরা চিরিমিরির বাড়িতে চলে যাব। মুশকিল কী জানেন? বাড়িতে একা ওকে ফেলে রেখে নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। এলাকার লোকগুলোও কেমন যেন। কথা বলার জন্যে কাকেও তো চাই। এদিকে আমাকে নানান জায়গায় ঘুরতে হয়—বেশির ভাগ সময় অভ্যাসে জঙ্গলেই পড়ে থাকি। কাজ থাক আর নাই থাক!..
শয়তান বনওয়ারী করফরমা মিথ্যে বলেছে যে সে তিন বছর আগে কলকাতায় মৃদুলা ওরফে এই রমাকে বিয়ে করে।
মাত্র এক বছর আগে আমার জীবনে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটে। বিয়ের কিছুদিন পরে আমার বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই মৃদুলাকে আসানসোল নিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের বাড়িতে। বিকেল চারটের সময় হাওড়া থেকে ট্রেনে রওনা হন তাঁরা। আমি তুলে দিয়ে আসি। মৃদুলা কতক্ষণ ধরে জানলায় হাত নেড়েছিল। মাত্র কুড়ি বাইশ দিনের বিবাহিত জীবন আমাদের।
বর্ধমানে যখন ট্রেনটা পৌঁছয়, সামনের কোন স্টেশনে জনতা ও রেল-পুলিশের আকস্মিক সংঘর্ষে সব ট্রেন বন্ধ হয়ে রয়েছে। শোনা গেল সে রাতের মত গাড়ি চলবে না। তখন ওঁৱা জি টি রোডে বাসের চেষ্টা করেন। সব বাসে প্রচণ্ড ভিড়। কোনমতে জায়গা পান না। সেই সময় একটা ট্রাক ওঁদের লিফট দিতে চায়।
তারপর আর দুজনে বাড়ি পৌঁছয়নি। এসব ব্যাপারে যা করা হয়—পুলিশ ইত্যাদি যথেষ্ট করা হয়েছিল। কোন ফল হয়নি। পরে রাস্তার ধারে শ্বশুর মশাইয়ের লাশটা পাওয়া যায়।
আশ্চর্য লাগল যে মৃদুলা এই জীবন মেনে নিয়েছে। সম্ভবত পিতৃহত্যাকারীরই ঘর করছে।
কী করব বুঝতে পারছিলুম না। বনওয়ারীর চেহারাটা আমার চোখে বদলে গেছে। তাকে এখন বিশাল আর বিপজ্জনক জানোয়ার দেখাচ্ছে। একটা কাজ করা যায়। চিরিমিরি থানায় গিয়ে সব জানিয়ে দিতে পারি।
কিন্তু আমাকে অন্য একটা ইচ্ছে পেয়ে বসল।
বনওয়ারী আমাকে গভীর জঙ্গলে গাছ কাটা দেখাতে নিয়ে গেল। তখন বললুম—বরং চলুন, আরও কোথাও ঘোরা যাক। হরিণটরিণ আছে নিশ্চয়?
হরিণ দেখবেন? তা আছে। বলে বনওয়ারী তার গুলিভরা রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে এগোল। আমি তাকে অনুসরণ করলুম।
কিছুদূর গিয়ে যখন আর গাছ কাটার শব্দ কানে এল না, তখন দাঁড়িয়ে বললুম—আমাকে রাইফেল ছোঁড়া শেখাবেন? নিজের হাতে একটা কিছু মেরে ট্রফি নিয়ে যেতুম।
ট্রফি চাই? বলে হো হো হেসে উঠল ডাকাতটা। —রাইফেল ছোঁড়া তেমন কিছু শক্ত না। আসলে এইম করাটাই হচ্ছে শেখার ব্যাপার।
বলে সে রাইফেলের নানা ব্যাপার আঙুল দিয়ে দেখাতে ও বক্তৃতা করতে থাকল। কলেজজীবনে এন সি সিতে ছিলুম। রাইফেল ছুঁড়তে আমি জানি। কিন্তু আগেই বলেছি, আমার স্বভাব কাকেও আঘাত দেওয়ার বিরোধী। হিংস্রতা আমি অন্যায় মনে করি।
দেখি আপনার রাইফেলটা কত ভারী। …বলে প্রায় কেড়ে নিলুম। এবং তক্ষুণি একটা মারাত্মক হিংস্রতা মাথায় শিরশির করে উঠল। ঝট্ করে কয়েক হাত সরে গিয়ে লোকটাকে তাক করলুম।
অমনি বনওয়ারী লাফিয়ে উঠল : আরে, করছেন কী? করছেন কী? গুলি পোরা আছে। সাবধান!
আমি আরও পিছিয়ে গর্জে উঠলাম, খবর্দার শুয়োরের বাচ্চা ডাকাত। চুপ করে দাঁড়া। একটু নড়লে গুলি করব!
বনওয়ারী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল—আপনার নির্ঘাৎ মাথা খারাপ হয়েছে। আ ছি ছি।
সেফটিক্যাচ তুলে ট্রিগারে আঙুল রেখে বললুম, আমার স্ত্রী মৃদুলাকে তুই লুঠ করেছিস—তার বাবাকে খুন করেছিস—সেইজন্যে তোকে চরম শাস্তি পেতেই হবে শুয়োরের বাচ্চা!
বনওয়ারীর মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে। ও যে ভয় পাবে, আমি ভাবতেই পারিনি। সে অব্যক্ত ভাষায় কাকুতিমিনতি করতে লাগল।
ট্রিগারে চাপ দেবার মুহুর্তে পিছনে মৃদুলার কণ্ঠস্বর শুনলাম। দৌড়ে এল একটা ঝোপ থেকে।—না, না! ওকে খুন করো না, খুন করো না!
বুঝলুম তাঁবু থেকে বেরোনো অব্দি মৃদুলা আমাদের অলক্ষ্যে অনুসরণ করে এসেছে। ও একটা কিছু আঁচ করেছিল নিশ্চয়।
আমি কিছু বলার আগেই সে দৌড়ে বনওয়ারীর বুকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল—মারবার ইচ্ছে হলে আমাকেও মেরে ফেলো।
মৃদুলা! আমি আরও স্তম্ভিত আর বিমূঢ় হয়ে পড়লুম। আমার হাতে ভারী রাইফেলটা থরথর করে কাঁপতে থাকল।
মৃদুলা কাঁদতে কাঁদতে বলল—যা কিছু হয়েছে তা আমি তো মেনে নিয়েছি। কেন তুমি আমার সুখের সংসারে আগুন জ্বালাবে?
সুখের সংসার! মৃদুলা, ও তোমার বাবাকে খুন করেছে।
না! বাবা ট্রাক থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।
আশ্চর্য! মৃদুলা—তুমি…
আমার মা দাদা সবাই যা মেনে নিয়েছে, তুমি কেন মানবে না?
মেনে নিয়েছে! ওরা জানে, তুমি কোথায় আছ?
জানে! পরে সব জানিয়েছিলুম। দাদা-মা সবাই আসে মধ্যে মধ্যে।
কিন্তু তুমি তো আমার বিবাহিত স্ত্রী!
মৃদুলা ছটফট করছিল। বলল—ভুলে যাও ও কথা। আমাকে সুখে বাঁচতে দাও তুমি।
মৃদুলা? ডাকাতের ঘর করছ—তাই কি সুখ?
সে তোমাকে বোঝাতে পারব না।
আমার শরীর ভারী হয়ে আসছিল। রাইফেলটা নামালুম। বনওয়ারী নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে পা বাড়ালুম। তখন বনওয়ারী একটু কেসে ভাঙা গলায় বলল, রাইফেলটা দিয়ে যান। ওটা না থাকলে জঙ্গলে টিকতে পারব না ভাই।
মৃদুলা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ। তোমার কোন ক্ষতি করবে না ও। ওটা দিয়ে যাও।
বললুম, থানা থেকে নিয়ে আসতে বলবে।
মৃদুলা যেন বিদ্রূপ করে বলল—ঠিক আছে তাই হবে। ওকে থানায় সবাই খাতির করে। তুমি সেখানেই যাও। তবে শুনে যাও—কোন লাভ হবে না।
রাইফেলটা তবু দিতে পারলুম না। স্বীকার করছি; এবার আমি নিজেও ভীত হয়ে পড়েছি। পথ চেনা ছিল না। তাই দুটি স্থির মূর্তিকে পিছনে রেখে সাবধানে এগিয়ে চললুম—উত্তর দিকে গেলে রাস্তা পেয়ে যাব। সতর্ক হয়ে হাঁটতে হল। একে বাঘটার ভয়—তার ওপর বনওয়ারী লোকজন নিয়ে এসে হামলা করতে পারে।
জঙ্গল থেকে বেরোতে আমার চারঘণ্টা লেগে গেল। মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছিল, পথ হারিয়ে একই জায়গায় ঘুরছি না তো! তাই ডাল ভেঙে চিহ্ন দিয়ে এগোচ্ছিলুম। কিন্তু পাহাড়ী এলাকার জঙ্গল—তাই শেষ অব্দি পৌঁছোন গেল নদীটার ধারে।
জল খেয়ে আবার ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলুম। জানতুম—এই নদীরই ওপর দিকে বাংলো পেয়ে যাব।
সারাপথ ভাবছিলুম—মাত্র কুড়ি-বাইশ দিন মৃদুলা আমার ঘর করেছে। তার মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ছিল—যাতে টের পাওয়া উচিত ছিল আমার যে সে আমাকে পছন্দ করেনি? প্রতিটি ঘণ্টার স্মৃতিচারণা করছিলুম। খুঁজছিলুম সেই পরম সত্যটিকে। মনে হল হ্যাঁ, এখানেই সেটা রয়েছে, আবার কোনটা মনে হল যুক্তিহীন। শেষ অব্দি সংস্কার আমাকে পেয়ে বসল। আইনত এখনও তো মৃদুলা আমারই স্ত্রী।
বাংলো দেখতে পেয়ে রাইফেলটা তক্ষুনি নদীর জলে ছুঁড়ে ফেললুম। তারপরই অদ্ভুত ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়লুম।
প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, বনওয়ারী লোকজন নিয়ে এসে হামলা করবে। তাই দুপুরের খাবার গণরাজকে যা খুশি করতে বলে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লুম। প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে বলা যায়। যাবার সময় বারবার পিছু ফিরে ট্রাক আসতে দেখামাত্র ঝোপে লুকিয়ে পড়ছিলুম।
কিন্তু না বনওয়ারী এল না।
বিলাসপুরে শেষরাত্রে ট্রেনে বসে হঠাৎ একটা উল্টোরকমের ভাবনা হল। ওদের রাইফেলটা আমি নদীতে ফেলে দিয়ে এসেছি। বনওয়ারী এখন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হয়ে জঙ্গলে রইল। ওর কাঠ কাটতে এখনও কিছু দেরি আছে। ওদিকে একটা বাঘের উৎপাত চলেছে। বনওয়ারী নিশ্চয় বিপদে পড়ে গেল।
বনওয়ারীকে বাঘে খেলে মৃদুলা কী করবে? কিংবা যদি বাঘটা মৃদুলার ওপরই চড়াও হয়?
বনওয়ারী কিংবা মৃদুলা, কার জন্যে জানি না—সারাপথ আমার বড্ড কষ্ট হল। কাজটা ঠিক করিনি। জঙ্গলের মানুষকে নিরস্ত্র করার পাপ আর সব পাপের চেয়ে সাংঘাতিক।