জঙ্গলের রাজা টারজান (টারজান লর্ড অফ দি জাঙ্গল)

জঙ্গলেরাজা টারজান (টারজান লর্ড অফ দি জাঙ্গল)

সেদিন ভরদুপুরে জঙ্গলের ছায়াঘেরা গভীরে টারজনের প্রিয় বন্ধু ট্যান্টর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার গুঁড়টা দোলাচ্ছিল। এই বিশাল জঙ্গলের মধ্যে বহু বছর ধরে নুমা, শীতা, ডাঙ্গো প্রভৃতি কত সব হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের কাছাকাছি বাস করে আসছে হাতিটা। কিন্তু এদের কাউকে ভয় করে না সে। কেউ তাকে অকারণে মারতে আসে না বা লড়াই করতে আসে না তার সঙ্গে। একমাত্র মানুষই তার শত্রু। কালো সাদা সব মানুষই তার দাঁতের লোভে তাকে মারতে আসে।

মানুষদের মধ্যে একমাত্র টারজানই হলো ব্যতিক্রম। সে সাদা চামড়ার মানুষ হলেও তাকে কোনদিন মারতে আসেনি। ছেলেবেলা থেকে সে খেলা করে আসছে তার সঙ্গে।

একদিন ফাঁদ ও মতলগ নামে দু’জন আরব ফেজুয়ান নামে এক নিগ্রো ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে। শিকার করতে করতে উত্তর দিকে চলে আসে।

হাতিটাকে দূর থেকেই গুলি করে আরবরা। ফেজুয়ান প্রথমে দেখতে পায়। কিন্তু গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাতিটার পাশ দিয়ে চলে যায়। হাতিটা ছুটে পালিয়ে যায়। টারজান তখন হাতিটার পিঠের উপর শুয়েছিল। হাতিটা ডালপালা ভেঙ্গে সেখান দিয়ে পথ করে পালিয়ে যেতে গেলে একটা গাছের ডালে মাথায় জোর আঘাতের ফলে টারজান মাটিতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

ফেজুয়ান ফাদকে বলল, তোমার গুলিটা লাগেনি মালিক।

 ফাদ বলল, গুলিটার মধ্যে শয়তান ছিল। চল দেখি হাতিটার গায়ে হয়ত লেগেছে।

 ফাদ বলল, একটা হাতি শিকার করতে গিয়ে একটা শ্বেতাঙ্গকে মারলাম?

মতলগ বলল, একটা খ্রিস্টান কুকুর, আবার প্রায় উলফঙ্গ। গুলিটা ওর কোথায় লেগেছে?

ওরা টারজনের দেহটা পরীক্ষা করে দেখল তার দেহে কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নেই। শুধু মাথায় একটা ক্ষতচিহ্ন আছে।

ফেজুয়ান বলল, ও এখনো মরেনি। হাতিটা পালিয়ে গেছে। হাতিটা যখন পালিয়ে যাচ্ছিল তখন ওর মাথায় আঘাত লাগে।

ফাদ কোমর থেকে তার ছোরাটা বার করে বলল, আমি ওকে শেষ করব।

মতলগ বাধা দিয়ে বলল, আল্লার নামে বলছি তোমার ছোরাটা রেখে দাও। আমরা ওকে শেখের কাছে বেঁধে নিয়ে যাব। শেখ যা করার করবে।

ফাদ বলল, তাহলে ওকে বেঁধে ফেল।

টারজনের হাত দুটো পেটের উপর জড়ো করে উটের চামড়ার দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল ওরা। টারজান তখন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল। সে আরবদের দেখে চিনতে পারল। সে তাদের বলল, তোমরা আমায় বাঁধছ কেন? আমার বাঁধন খুলে দাও বলছি।

ফাদ হেসে বলল, তুমি যে দেখছি শেখের মত হুকুম চালাচ্ছ। নিজেকে শেখ ভাবছ নাকি?

টারজান বলল, লোকে আমাকে টারজান বলে। আমি হচ্ছি শেখের শেখ।

টারজান!

চমকে উঠল মতলগ। গলার স্বর নিচু করে বলল, আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই লোকটার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। গত দু’সপ্তাহর মধ্যে যে গাঁয়েই গিয়েছি সেখানেই ওর নাম শুনেছি। গ্রামবাসীরা একবাক্যে বলেছে, থাম, টারজান আসছে। তার দেশ থেকে ক্রীতদাসদের ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোমাদের হত্যা করবে সে।

ফাদ বলল, তুমি বাধা দিলে আমায়। ওকে মেরে ফেলাই ভাল ছিল।

মতলগ বলল, পরে একথা প্রচার হয়ে গেলে আমাদের আর জীবন্ত দেশে ফিরে যেতে হবে না। আমাদের ক্রীতদাসরাই পালিয়ে গিয়ে প্রচার করে বেড়াবে একথা।

ফাদ বলল, ঠিক আছে। শেখের কাছেই নিয়ে চল ওকে।

শেখ ইবন জাদের মঞ্জিলে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। মঞ্জিলের ভিতরে একটা তাঁবুর ঘরের ভিতরে টারজান হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়েছিল। বাঁধনগুলো খোলার জন্য অনেক চেষ্টা করল। কোনভাবে ছিঁড়তে বা খুলতে পারল না।

টারজান শুনতে পেল তাঁবুর বাইরে কারা ফিস ফিস করে কথা বলছে।

হঠাৎ ওরা কিসের একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল। সে শব্দ শুনে সবাই চমকে উঠল। ক্রীতদাসরা তাঁবুর বাইরে এসে দেখতে লাগল। আরবরা বন্দুক তুলে নিল হাতে।

ইবন জাদ বলল, তাঁবুর ভিতর থেকে শব্দটা আসছে। মনে হচ্ছে একটা পশু গর্জন করছে। বন্দীটা ত মানুষ।

ফাদ বলল, ও মানুষ হলেও ওর মধ্যে শয়তান আছে।

ইবন জাদ হাতে বন্দুক আর কাগজের লণ্ঠন নিয়ে টারজনের ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল টারজান ঠিকই আছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি একটা শব্দ শুনেছ? ওটা কিসের শব্দ?

টারজান বলল, এক পশুর প্রতি অন্য এক পশুর ডাক। জঙ্গলের ডাক শুনে বেদুইনরা ভয় পায়।

ইবন জাদ বলল, বেদুইনরা ভয় পায় না। আমরা ভেবেছিলাম বাড়ির মধ্যে হয়ত বা কোন জন্তু জানোয়ার ঢুকেছে। যাই হোক, আগামীকাল তোমাকে মুক্তি দেব।

টারজান বলল, কিন্তু আজ নয় কেন?

ইবন জাত বলল, সিংহ অধ্যুষিত এই নৈশ জঙ্গলে একা তোমাকে ছাড়া ঠিক হবে না।

টারজান হাসল। হাসিমুখে বলল, রাত্রির জঙ্গলে টারজান নিরাপদ। কোন সময়েই জঙ্গলকে ভয় করে না টারজান।

এদিকে টারজনের-ডাকটা জঙ্গলের মধ্যে দূরে একজন শুনতে পেয়েছিল এবং সে সাড়াও দিয়েছিল। সে হলো টারজনের বন্ধু ট্যান্টর। শেখের মঞ্জিলের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল এবং গোটা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে গেল তখন হাতিটা গঁড় তুলে জ্বলন্ত লাল চোখদুটো নিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হুড়মুড় করে আসতে লাগল।

এদিকে শেখের বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও শেখ তার ঘরের সামনে বসে তার ভাই-এর সঙ্গে বসে ধূমপান করছিল। শেখ এক সময় তার ভাই তোলোগকে বলল, কোন ক্রীতদাসকে জানাবে না যে তুমি টারজানকে হত্যা করছ। কাজটা হয়ে গেলে কবর খোঁড়ার জন্য দু’জন বলিষ্ঠ ক্রীতদাসকে জাগাবে। তাদের মধ্যে একজন হবে ফেজুয়ান আর একজন অন্য কেউ।

তোলোগ বলল, আব্বাস আর ফেজুয়ান-দু’জনেই বিশ্বস্ত।

শেখ বলল, তাহলে যাও। এখন সবাই ঘুমিয়েছে।

এই কথা বলে শেখ তার শোবার ঘরে চলে গেল। এদিকে হাতিটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্করভাবে ছুটে আসতে লাগল। তার পথের সামনে কোন সিংহ বা চিতাবাঘ দাঁড়াতে পারল না। সবাই একপাশে সরে যেতে লাগল।

অন্ধকারে পা টিপে টিপে তোলোগ টারজনের তাঁবুর ভিতরে চলে গেল। টারজান তখন মাটিতে কান পেতে কিসের শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল। তোলোগ তার ঘরে ঢুকতেই টারজান খাড়া হয়ে উঠে বসল। সে আবার সেই আগের মত চীৎকার করে উঠল। গোটা শিবিরটা কেঁপে উঠল সেই চীৎকারের শব্দে।

তোলোগ বলল, এখানে কোন জন্তু আসেনি ত?

সে দেখল তাঁবুর মধ্যে কোন জন্তু নেই। সে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে একটা কাগজের লণ্ঠন নিয়ে এল। তোলোগ দেখল টারজান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বলল, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছ!

তোলোগ টারজনের বুকে ছুরিটা বসাবার জন্যে এগিয়ে এলে টারজান তার বাঁধা হাতদুটো দিয়ে তাকে সরিয়ে দিল। তোলোগ আবার এলে টারজান তার মাথায় হাত দুটো দিয়ে এমনভাবে আঘাত করল। যে সে পড়ে গেল। কিন্তু তোলোগ উঠেই এবার টারজনের পেছন থেকে আঘাত করতে গেল। টারজান হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বাধা দিতে গেলে সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। তোলোগ এবার সুযোগ পেয়ে ছুরিটা টারজনের বুকে বসাতে গেলেই সে আশ্চর্য হয়ে দেখল গোটা তাবুটা উপর থেকে কে তুলে নিল। তারপর দেখল একটা বিরাট হাতি খুঁড় দিয়ে তার দেহটা জড়িয়ে ধরে তাকে তুলে একটা তাবুর মাথায় ফেলে দিল।

হাতিটা এবার টারজানকে খুঁড় দিয়ে তার পিঠের উপর চাপিয়ে বেগে ছুটে পালাতে লাগল।

 শেখের লোকজন ছুটে এসে দেখল বন্দী নেই। হাতিটা তখন জঙ্গলে পালিয়ে গেছে।

তোলোগ শেখকে বলল, বন্দীর একটা পোষা শয়তান আছে। সে হাতির রূপ ধরে এসে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

সব কিছু শুনে অনেক ভেবে শেখ বলল, কাল সকালেই আমরা শিবির গুটিয়ে উত্তর দিকে রওনা হব।

পরদিন সকালে কোনরকমে প্রাতরাশ সেরেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শিবির গুটিয়ে ফেলল ওরা। আরবরা ঘোড়ায় চাপল। ক্রীতদাসরা মালপত্র নিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। আতিজা আর জায়েদ ঘোড়ায়। চড়ে পাশাপাশি যাচ্ছিল।

তিন দিন ধরে আরবরা উত্তর দিকে হাবাসের পথে এগিয়ে যেতে লাগল ধীরে গতিতে। এদিকে টারজানও তিন দিন ধরে জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। হাতিটা। সর্বক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল। তিন দিন কোন খাদ্য বা একটু জল পর্যন্ত খেতে পায়নি। টারজান।

এই কদিনের মধ্যে মনু বা ছোট ছোট বাঁদরদের ডেকেছিল তার বাঁধনগুলো খুলে দেবার জন্য কিন্তু তারা কেউ তা পারেনি।

চতুর্থ দিন সকাল হতেই হাতিটা অশান্ত হয়ে উঠল। হাতিটা এই কদিন টারজানকে ফেলে দূরে। কোথাও যায়নি। কাছাকাছি ঘাসপাতা যা পেয়েছে তাই খেয়েছে। আজ সে তাই টারজানকে নিয়ে দূরে কোথাও যেতে চাইল।

কিন্তু টারজান সেখান থেকে যেতে চাইল না। কারণ সে ভাবল, বাঁদর-গোরিলারা যেখানে থাকে এই জায়গাটা হলো তার কাছাকাছি। নিশ্চয়ই এই পথে একদল বাঁদর-গোরিলা আসবে এবং তাদের মধ্যে দু একজন ঠিক টারজানকে চিনবে এবং দাঁত দিয়ে তার বাঁধনগুলো কেটে দেবে।

হাতিটা টারজানকে পিঠের উপর চাপিয়ে নিতেই টারজান বলল, আমাকে নামিয়ে দাও ট্যান্টর তুমি আমাকে দূরে নিয়ে গেলে আমার বাঁধন খোলার কাউকে পাব না।

তার কথা বুঝে হাতিটা তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

টারজান যা ভেবেছিল তাই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল বাঁদর-গোরিলা ঘুরতে ঘুরতে টারজান যেখানে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে ছিল সেখানে হাজির হলো।

টারজান বাঁদর-গোরিলাদের ভাষায় তাদের বলল, আমি হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান। তোমাদের বন্ধু। টারমাঙ্গানীরা আমাকে ধরে আমার হাত পা বেঁধে রেখে দেয়। তোমরা এসে আমার বাঁধন খুলে দাও।

একটা গোরিলা বলল, তুমি হচ্ছ টারমাঙ্গানী।

টারজান আবার বলল, না আমি বাঁদরদলের রাজা টারজান।

গাছের উপর থেকে একটা মনু বা ছোট বাঁদর বলল, হ্যাঁ, ও টারজানই বটে। গোমাঙ্গানী আর টারমাঙ্গানীরা মিলে ওকে ধরে নিয়ে বেঁধে ফেলে। আজ চারদিন হলো ও এইভাবে বাঁধা আছে।

সহসা গাছের আড়াল থেকে একটা গোরিলা এগিয়ে এসে বলল, আমি জানি টারজানকে।

টারজান বলল, আগে আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও।

মোয়ালাৎ টারজনের হাত ও পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দিল। মুক্ত হয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল টারজান। এমন সময় বাঁদর-গোরিলা দলের রাজা তোয়াৎ এসে হাজির হলো সেখানে। সে টারজানকে দেখেই মাটিতে ঘুষি মেরে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তার শক্তির আস্ফালন করতে লাগল। দলের রাজা হিসেবে যুদ্ধে আহ্বান করতে লাগল টারজানকে। মোয়ালাৎ বলল, ও হচ্ছে মাঙ্গানীদের বন্ধু।

তোয়াৎ বলল, না, ও হচ্ছে টারমাঙ্গানী ও মাঙ্গানীদের শত্রু। ওকে মেরে ফেলো।

গয়াৎও মোয়ালাতের দলে এসে বলল, আমি যখন ছোট ছিলাম এই টারজানই আমাকে সিংহের কবল থেকে বাঁচায়। ও আমাদের বন্ধু।

বাঁদর-গোরিলারা একটা বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামায় না। তোয়াৎ যখন দেখল অনেক গোরিলা এক এক করে টারজনের দলে এল তখন সে আহারের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেল। টারজান সেই বাঁদর দলেই রয়ে গেল তাদের বন্ধু হিসেবে।

জেমস হান্টার ব্লেক নামে এক ধনী আমেরিকান যুবক উইলবার স্টিম্বল নামে এক বয়স্ক ব্যক্তিকে সঙ্গে করে অভিযানে বার হয় আফ্রিকা জঙ্গলে। আফ্রিকার যত সব ভয়ঙ্কর জীব-জন্তুগুলোকে যতদূর সম্ভব চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় ধরে রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

তাদের সঙ্গে কিছু নিগ্রো আদিবাসী ছিল; তারা মালপত্র বহন করত, যাবতীয় কাজকর্ম করত। তারা সাবই স্টিম্বলের নির্দেশে চলত। কিন্তু স্টিম্বলের মেজাজটা ছিল বড় রুক্ষ্ম। কথায় কথায় সে ঝগড়া করত যার তার সঙ্গে। একদিন তার দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে চলচ্চিত্রের ক্যামেরাম্যান দল ছেড়ে চলে যায়। ফলে আফ্রিকার অরণ্য জীবনের সচিত্র ছবি তোলার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

দুপুরে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করতে বলল ব্লেক। ঠিক হলো ব্লেক শিবিরেই থাকবে আর স্টিম্বল একদল নিগ্রো যোদ্ধাকে নিয়ে শিকারে যাবে।

স্টিম্বল শিকারে চলে গেল। মাইলখানেক যাবার পর একটা বিরাটকায় বাঁদর-গোরিলা দেখতে পেল সে। গোরিলাটা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্টিম্বল তাকে পিছন থেকে গুলি করল। গুলিটা লাগল না তার গায়ে। গোরিলাটা গাছের আড়ালে আড়ালে পালাতে লাগল। কিন্তু তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করতে লাগল স্টিম্বল। সে তার নিগ্রো যোদ্ধাদের জিজ্ঞাসা করল, ওটা কি জন্তু?

তারা বলল, গোরিলা।

স্টিম্বল বলল, ওটাকে আমি ধরে নিয়ে যাব।

এদিকে টারজান তখন কাছাকাছি একটা গাছের উপর স্টিম্বলের গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। সে গাছের উপর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখল, একটা বাঁদর-গোরিলা গুলির ভয়ে গাছপালা ভেঙ্গে ছুটে পালাচ্ছে আর তার পিছনে বন্দুক হাতে একজন শ্বেতাঙ্গ তাকে মারতে যাচ্ছে।

টারজান দেখল বোলগানি বা গোরিলাটা যে পথে ছুটছিল সেই পথের ধারে একটা গাছে একটা বড় অজগর রয়েছে। প্রাণ ভয়ে পালাতে গিয়ে সাপটাকে দেখতে পায়নি গোরিলাটা। এখন গোরিলাটা ডালপালা ভেঙ্গে ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করতে করতে ছুটতে থাকায় অজগরটা তাকে কাছে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। গোরিলাটা তার কুণ্ডলি থেকে নিজেকে মুক্ত করার যতই চেষ্টা করতে লাগল সাপটা ততই জোরে চেপে ধরল তার দেহটাকে।

এমন সময় স্টিম্বল আর টারজান একই সময়ে হাজির হলো সেখানে। টারজান দেখল একজন শ্বেতাঙ্গ শিকারী রাইফেল তুলে ধরে একই সঙ্গে গোরিলা আর অজগর সাপটাকে মারতে যাচ্ছে।

টারজান যখন দেখল শ্বেতাঙ্গ শিকারী স্টিম্বলই গোরিলাটার এই অবস্থার জন্য দায়ী তখন সে স্টিম্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ফেলে দিল মাটিতে। স্টিম্বল উঠে দাঁড়াবার আগেই টারজান তার ছুরিটা কেড়ে নিয়ে সাপটার কাছে গিয়ে আঘাত করতে লাগল তাই দিয়ে। সাপটার গায়ে ছুরিটা আমূল বসিয়ে দিতেই সাপটা গোরিলাটাকে ছেড়ে টারজানকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। টারজান সাপটার গলাটা টিপে ধরে ক্রমাগত তার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় ছুরিটা বসাতে লাগল। অবশেষে তার মাথাটা কেটে দিল।

গোরিলাটা জোর আঘাত পেয়েছিল। সে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। টারজান তাকে বলল, আমি বাঁদর-দলের টারজান। তোমাকে হিন্তা অর্থাৎ সাপের কবল থেকে বাঁচালাম।

গোরিলাটা ভেবেছিল টারজান এবার তাকে মারবে। সে ভয়ে ভয়ে টারজানকে বলল, তুমি আমাকে বধ করবে না?

টারজান বলল, না আমরা এখন বন্ধু।

গোরিলাটা তখন বলল, আমাদের পিছনে যে টারমাঙ্গানীটা রয়েছে সে আমাদের দু’জনকেই ঐ বজ্র ভরা লাঠিটা দিয়ে হত্যা করবে।

টারজান বলল, না, ওকে আমি এখান থেকে তাড়িয়ে দেব।

স্টিম্বল এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল দাঁড়িয়ে। গোরিলাটার সঙ্গে টারজনের যে সব কথা হচ্ছিল তা সে বুঝতে পারছিল না। টারজান তার কাছে ফিরে এলে সে বলল, তুমি সরে যাও, এবার আমি গোরিলাটাকে বধ করব।

স্টিম্বল আর গোরিলাটার মাঝখানে এসে দাঁড়াল টারজান। বলল, তোমার রাইফেল নামাও।

স্টিম্বল বলল, মোটেই না, আমি কি শুধু শুধুই এতক্ষণ ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলাম? তুমি জান আমি কে? আমি হচ্ছি উইলবার স্টিম্বল। স্টম্বল এ্যান্ড কোম্পানি, নিউইয়র্ক-এর মালিক।

টারজান বলল, আমার এই দেশে কি করছ?

স্টিম্বল বলল, তোমার দেশ! তুমি কে?

টারজান তখন স্টিম্বলের নিগ্রো যোদ্ধাদের পানে তাকিয়ে বলল, আমি হচ্ছি টারজান। এই শ্বেতাঙ্গ এ দেশে কি করছে? এরা সংখ্যায় কত?

নিগ্রোরা তখন বলল, আমরা তোমাকে চিনি বড় বাওয়ানা। এরা সংখ্যায় আছে দু’জন। আমরা এদের কাছে কাজ করি। এরা শিকার করে বেড়ায়। এই লোকটা বড় খারাপ ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে। এখানে শিকার পাওয়া যাচ্ছে না। কালই ওরা চলে যাবে এখান থেকে।

টারজান আবার জিজ্ঞাসা করল, এদের শিবিরটা কোথায়?

নিগ্রোরা বলল, এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

টারজান এবার স্টিম্বলকে বলল, তোমাদের শিবিরে ফিরে যাও। আমি সন্ধ্যার সময় তোমাদের শিবিরে গিয়ে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে। এখন শুধু খাবার মত শিকার করে নিয়ে চলে যাও।

স্টিম্বলের যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু টারজনের ব্যক্তিত্ব আর তার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে ভয় হলো তার। টারজান চলে গেলে সে তার লোকদের বলল, আজ সারা দিনটাই মাটি হয়ে গেল। লোকটা কে?

নিগ্রোরা বলল, মালিক ও হচ্ছে টারজান, এই বনের রাজা। ওর কথাই হলো আইন। ওকে রাগিও না।

শিবিরে ফিরে এসে স্টিম্বল বলল, কিন্তু সেই বাঁদর লোকটা যখন আমার স্বরূপটা বুঝতে পারবে তখন আর সে উইলবার স্টিম্বলের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।

ব্লেক বলল, সে আমাদের এখানে আসবে। তাই হবে, তার সঙ্গে দেখা হবে। তার কথা আমি অনেক শুনেছি।

স্টিম্বল বলল, এই যে আমাদের লোকরা এসে গেছে।

সে তখন নিগ্রো কুলীদের লক্ষ্য করে বলতে লাগল, আমরা এবার থেকে দু’জনে ভাগ হয়ে যাচ্ছি। আমাদের মালপত্র সব ভাগ হয়ে গেছে। আমি পশ্চিম দিকে গিয়ে কিছুদিন শিকার করার পর সমুদ্র উপকূলে যাব। ব্লেক কোন দিকে যাবে তা আমি জানি না। তোমাদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক লোক ব্লেকের সঙ্গে যাবে আর বাকি অর্ধেক আমার সঙ্গে যাবে। যারা ব্লেকের সঙ্গে যেতে চাও তারা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াও।

এমন সময় হঠাৎ টারজান সেখানে এসে উপস্থিত হলো। শিবিরে যে আগুন জ্বলছিল তার আভায় ব্লেক টারজনের চেহারাটা দেখতে পেল।

স্টিম্বল বলল, সেই বুনো মানুষটা এসেছে।

 ব্লেক টারজানকে বলল, তুমিই বাঁদর-দলের টারজান ত?

টারজান বলল, হ্যাঁ, তুমি?

ব্লেক বলল, আমি হচ্ছি নিউইয়র্কের জিম ব্লেক।

টারজান বলল, শিকার করে বেড়াচ্ছ?

ব্লেক বলল, আমার সঙ্গে সচল ছবি তোলার একটা ক্যামেরা আছে। আফ্রিকার বন্য জীবনের কিছু চলমান ছবি তুলতে চাই।

টারজান বলল, তোমার সঙ্গী একটা রাইফেল ব্যবহার করছিল।

ব্লেক বলল, তার কাজের জন্য আমি দায়ী নই।

টারজান বলল, আমি তোমাদের কথাবার্তা শুনেছি। নিগ্রোরা তোমার সঙ্গী সম্বন্ধে আমাকে কিছু কথা বলেছে। তোমরা দুজনে একমত হতে পারছ না বলেই পৃথকভাবে যেতে চাইছ। তাই নয় কি?

ব্লেক বলল, হ্যাঁ।

টারজান বলল, তোমরা কে কোনদিকে যেতে চাও?

স্টিম্বল বলল, আমি পশ্চিম দিকে গিয়ে উপকূলে পৌঁছতে চাই।

ব্লেক বলল, আমি উত্তর দিকে গিয়ে কিছু সিংহের ছবি তুলতে চাই। এখন যদি স্টিম্বলের সঙ্গে কোন লোক না যায় তাহলে আমাদের সঙ্গেই যেতে হবে এবং তাহলে ছবি না তুলেই সোজা উপকূলে চলে যাব।

টারজান স্টিলের কথায় কান না দিয়ে বলল, আগামীকাল রওনা হবে তোমরা। আমি ঠিক সময়ে আসব। সঙ্গের লোকেরা যাতে দু’দলে ভাগ হয়ে ঠিকমত যায় আমি তার ব্যবস্থা করব। তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না।

এই কথা বলে বনের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল টারজান।

 পরদিন সকালে মালপত্র গুছিয়ে যাবার জন্য রওনা হতেই টারজান এসে পড়ল।

টারজান নিগ্রোভৃত্যদের এক জায়গায় ডেকে বলল, আমি হচ্ছি টারজান, এই বনের অধিপতি। তোমরা এই শ্বেতাঙ্গদের আমার দেশে আমার লোকজনদের মধ্যে নিয়ে এসেছ। তারা আমার লোকজনদের মারে, বনের জীবজন্তু মেরে বেড়ায়। যাই হোক, তোমরা যদি নিরাপদে গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে যেতে চাও তাহলে আমার কথা শোন।

এরপর নিগ্রোভৃত্যদের সর্দারকে টারজান বলল, তুমি ব্লেকের সঙ্গে যাবে। তাকে বনের জীবজন্তুদের কিছু ছবি তোলার অনুমতি দিচ্ছি আমি। তোমার দল থেকে অর্ধেক লোক বাছাই করে দাও। তারা যাবে স্টিম্বলের সঙ্গে। তবে স্টিম্বল একমাত্র আহার ছাড়া কোন প্রাণী বধ করতে পাবে না।

এরপর ব্লেকের দিকে ফিরে বলল, তুমি আমার অতিথি। সুতরাং ইচ্ছা করলে শিকার করতে পার।

স্টিম্বল রেগে গিয়ে ব্লেককে বলল, তুমি এই বোকা শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে বলে দাও আমি কে এবং আমি কিছুতেই তার এই সব হুকুম মেনে চলব না।

সেদিকে কান না দিয়ে টারজান স্টিম্বলের দলের লোকদের বলল, দেখবে এই ব্যক্তি যেন আমার আদেশ মত চলে। না চললে ওর দলে তোমরা থাকবে না।

এই কথা বলে টারজান জঙ্গলের ভিতরে চলে গেল।

অন্ধকার নেমে এল সারা বনভূমি জুড়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। টারজান যে গাছটার তলায় দাঁড়িয়েছিল সেই গাছটা হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে যেতে তার ডালপালায় আঘাত লেগে চাপা পড়ে গেল। সে অচেতন হয়ে পড়ল। অদূরে সেই বোলগানিটা দাঁড়িয়েছিল।

টারজনের বুকের উপর কান পেতে স্টিম্বল দেখল তার দেহে প্রাণ আছে, সে মরেনি। তখন টারজানকে হত্যা করার জন্য তার ছুরিটা বার করল। বোলগানি বা গোরিলাটা এতক্ষণ দেখছিল ব্যাপারটা। স্টিম্বল ছুরিটা টারজনের বুকের উপর তুলতেই বোলগানি এক লাফে সেখানে গিয়ে স্টিম্বলের গলার উপর একটা হাত রাখল। সে তার গলা টিপে হত্যা করতে যাচ্ছিল তাকে।

এমন সময় চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকাল টারজান। মুহূর্তমধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরে বোলগানিকে বলল, ওকে যেতে দাও।

টারজান স্টিম্বলকে বলল, আমি এখানে ছিলাম দুটো কারণে। আমি লক্ষ্য করছিলাম তুমি আমার আদেশ মেনে চলছ কি না। আর দেখছিলাম তোমরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে আমার কোন ক্ষতি করছ কি না। কিন্তু তুমি আমায় হত্যা করতে যাচ্ছিলে। তোমাকে হত্যা করাই উচিৎ। তবু আমি তোমাকে মারব না।

এবার স্টিম্বলের নিগ্রো মালবাহকদের বলল, এই শ্বেতাঙ্গ যতক্ষণ আমার আদেশ মেনে চলবে ততক্ষণ এর সঙ্গে থাকবে। তবে দেখবে এ যেন কোন শিকার না করে।

এই কথা বলে চলে গেল টারজান।

স্টিম্বল যখন বুঝল টারজান আর আসবে না তখন সাহস পেয়ে আবার খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। তার নিগ্রোভৃত্যদের সঙ্গে। সে টারজনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একটা হরিণ শিকার করল অকারণে। তবে তার নিগ্রোভৃত্যরা রেগে গেল।

স্টিম্বল ভাবল সে এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর ব্লেকের সন্ধানে বার হবে। সে একটা সিগারেট ধরাল।

স্টিম্বল একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসে ছিল। সহসা একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঝোপের ওপারে কালো কেশর ওয়লা একটা সিংহ দেখতে পেল। স্টিম্বল ভয়ে একটা গাছের উপর চড়ল। সিংহটা লাফ দিয়ে স্টিম্বলকে ধরতে গেল, কিন্তু পারল না। স্টিম্বল গাছে ওঠার সময় রাইফেল আর খাবারের মোটটা গাছের তলায় ফেলে যায় কিন্তু স্টিম্বলকে না পেয়ে সিংহটা রেগে গিয়ে খাবারের পুঁটলিটা ছিঁড়ে খুঁড়ে সব খাবার নষ্ট করে দিল। তারপর মুখে করে রাইফেলটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

স্টিম্বল গাছের উপর থেকে চীৎকার করতে লাগল।

কিন্তু সিংহটা রাইফেলটা মুখে করে সোজা একটা ঝোপের মধ্যে চলে গেল।

সে রাতটা গাছেই কাটাল স্টিম্বল। পরের দিন সকালে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল গাছ থেকে। তারপর ধীর পায়ে সে যখন ব্লেকের পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল। তার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে।

এদিকে ব্লেক সেদিন তার একজন নিগ্রোভৃত্যকে নিয়ে সিংহের ছবি তোলার জন্য মূল দল থেকে কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিল। বনে ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে তারা একটা জায়গায় একটা বড়ো সিংহ, একটা সিংহী আর চার-পাঁচটা বাচ্চা দেখতে পেল। কিন্তু তাদের দেখতে পেয়ে সিংহগুলো সরে গেল। তখন আকাশে কালো মেঘ থাকায় উপযুক্ত আলো না পেয়ে ছবি তুলতে পারল না ব্লেক।

তখন জনপদের আশায় আরো কিছুটা এগিয়ে গেলে পথের ধারে পাথরের আড়াল থেকে দু’জন নিগ্রো এসে তার পথরোধ করে দাঁড়াল।

তাদের কথাবার্তা থেকে ব্লেক জানতে পারল তাদের দুজনের মধ্যে একজনের নাম পিটার আর অন্যজনের নাম পল বোদকিন। পল বোদকিন তার সঙ্গীকে বলল, এই লোকটাকে দেখে সারাসীন জাতীয় বলে মনে হচ্ছে। এর ভাষা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। একে আমাদের ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চল।

পিটার বলল, পল, তুমি একে নিয়ে যাও ক্যাপ্টেনের কাছে, আমি এখানে পাহারায় থাকি। তুমি না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকব আমি।

পল ব্লেককে নিয়ে এগিয়ে চলল। ক্রমে তারা একটা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়ার পর সুড়ঙ্গপথ ধরল।

অনেকক্ষণ যাওয়ার পর ওরা এক প্রাচীন প্রাসাদের সামনে এসে পৌঁছল। গেটে ব্লেককে দেখতে পেয়ে রিচার্ডের কাছে এসে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল মেয়ে ও পুরুষরা।

রিচার্ড তাদের বলতে লাগল, ইনি হচ্ছেন স্যার জেমস হান্টার ব্লেক। ইনি একজন নাইট।

এবার ওদের রাজার কাছে ব্লেককে নিয়ে গেল রিচার্ড। রাজার চেহারাটা লম্বা এবং দামী পোশাক পরা। রাজা ব্লেককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল। ব্লেকের ভিজে ও ছিন্নভিন্ন পোশাক দেখে তাকে নাইট বলে মনে হলো না তার।

রাজকন্যা পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, ওঁকে কিন্তু শত্রু বলে মনে হচ্ছে না বাবা।

ব্লেক বলল, আমি একজন আমেরিকাবাসী।

 রিচার্ড রাজাকে বলল, না ও শত্রু নয়। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। ওকে কোন না কোন একটা কাজ দিন।

রাজা ব্লেককে বলল, তুমি কাজ করবে?

ব্লেক একবার রাজকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ করব।

স্টিম্বল ব্লেকের সন্ধানে পথ চলতে চলতে এক সময় শেখের শিবিরের কাছে এসে পড়ল। ফেজুয়ান নামে একটা ক্রীতদাস তখন বাইরে পাহারা দিচ্ছিল। সে স্টিলকে দেখতে পেয়েই তাকে ধরে নিয়ে গেল শেখ ইবন জাদের কাছে। বলল, একজন শ্বেতাঙ্গ বিদেশীকে বন্দী করে এনেছি।

শেখ স্টিম্বলকে প্রশ্ন করল, কে তুমি?

স্টিম্বল বলল, আমি খেতে না পেয়ে মরতে বসেছি। আগে আমাকে কিছু খাবার দাও।

শেখ খাবার আনতে বলল। শেখের কথা স্টিম্বল বুঝতে না পারায় ফাঁদ ফরাসী ভাষায় স্টিম্বলকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে বিদেশী? কোথা থেকে আসছ?

স্টিম্বল ফরাসী ভাষা বুঝতে পেরে বলল, আমি একজন আমেরিকান। জঙ্গলে পথ হারিয়ে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি।

শেখ ভাবল স্টিম্বলকে আটকে রেখে পরে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা রকমের টাকা আদায় করা যাবে। সে তাই ফাঁদকে বলল, একে তোমার তাবুতে বন্দী করে রাখ।

ফাদ স্টিম্বলকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, শেখ তোমায় মেরে ফেলত। ফাদ তোমায় রক্ষা করেছে।

 স্টিম্বল বলল, আমি তোমায় অনেক টাকা দেব। ধনী করে দেব তোমায়।

কয়েকদিনের মধ্যে ফাদের সঙ্গে ভালভাবে পরিচিত হয়ে উঠল স্টিম্বল। সে ফাদকে বুঝিয়ে দিল আমেরিকায় তার অনেক বিষয়সম্পত্তি আছে। ফাঁদও ভাবল তাকে দিয়ে তার অনেক উপকার হবে। ফাদ স্টিম্বলকে বুঝিয়ে দিল শিবিরের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র চলছে।

ফাদ রাতেরবেলায় প্রায়ই লক্ষ্য করত, রাতের খাওয়ার পর কাজকর্ম সেরেই আতিজা গোপনে জায়েদের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

একদিন রাত্রিবেলায় ফাদ দেখল খাওয়ার পর তার তাবুর সামনে শেখ বসে বিশ্রাম করছে। সে আরও দেখল শিবিরের বাইরে একা একা আতিজার জন্য অপেক্ষ করছে জায়েদ। এই অবসরে সে জায়েদের তাঁবুর ভিতরে গিয়ে তার গুলিভরা বন্দুকটা এনে জায়েদের কাছে দাঁড়িয়ে শেখকে লক্ষ্য করে। একটা গুলি করল।

কিন্তু গুলিটা শেখের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় পড়ল। গুলি করেই বন্দুকটা জায়েদের পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল ফাঁদ। তারপর চেঁচামেচি করতে লাগল। শেখ ও অন্যান্য সকলে ছুটে এলে ফাঁদ বলল, আল্লার নামে বলছি শেখ, জায়েদ তোমাকে গুলি করেছিল। আমি ওকে ধরে ফেলেছি।

জায়েদ আশ্চর্য হয়ে বলল, ও মিথ্যা কথা বলছে শেখ। আমি এ কাজ করিনি।

ফাদ বলল, দেখুন এ বন্দুকটা কার।

সকলে পরীক্ষা করে দেখল বন্দুকটা জায়েদেরই। কেউ জানত না ওটা ফাদ লুকিয়ে জায়েদের ঘর থেকে নিয়ে আসে।

শেখ হুকুম দিল, আজ জায়েদকে বেঁধে এক জায়গায় রেখে দাও। কাল সকালেই ওকে গুলি করে হত্যা করা হবে।

আতিজা শেখকে অনেক করে বলল। জায়েদের জন্য বারবার প্রাণভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ফল হলো না।

রাত্রিতে সবাই শুয়ে পড়লে আতিজা চুপি চুপি জায়েদের কাছে চলে গিয়ে তার হাতের বাঁধন কেটে তাকে মুক্ত করে বলল, বাইরে একটা ঘোড়া রেখেছি, তুমি এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যাও।

জায়েদ কোন কথা না বলে চলে গেল। তিন দিন ধরে সমানে ঘোড়ায় করে বনের মধ্য দিয়ে যেতে লাগল জায়েদ।

হঠাৎ ঘোড়াটা বনপথে যেতে যেতে একটা সিংহ দেখে একটা লাফ দিতেই জায়েদ পড়ে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে। মাটি থেকে উঠেই জায়েদ দেখল একটা সিংহ তার উপর ঝাঁপ দেবার জন্য উদ্যত হয়েছে।

এমন সময় জায়েদ দেখল কোথা থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ এসে সিংহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গাড় ধরে তার উপর একটা ধারাল ছোরা বসাতে লাগল। এবার জায়েদ চিনতে পারল এই দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গই টারজান যে একদিন শেখের শিবিরে বন্দী ছিল।

জায়েদ ভাবল টারজান তাকে শেখের লোক ভেবে মারতে পারে। তাই সে অনুনয় বিনয় করে বলল, আমাকে মেরো না, শেখ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

টারজান বলল, শেখ আমার দেশে কি করছে? কি চায় সে, ক্রীতদাস না হাতির দাঁত?

জায়েদ বলল, এ দুটোর কোনটাই চায় না সে। সে চায় নিমুরের ধনরত্ন।

 টারজান বলল, কিন্তু তুমি একা কেন? শেখ কেনই বা তোমায় তাড়িয়ে দিয়েছে?

জায়েদ বলল, আমি শেখের মেয়ে আতিজাকে ভালবাসতাম। তাই ফাদ চক্রান্ত করে একটা খুনের ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ে দেয়। সে নিজে গুলি করে বলে শেখকে আমি গুলি করেছিলাম। শেখ তাই আমাকে গুলি করে হত্যা করার আদেশ জারি করে। সেইদিন রাত্রিবেলাতেই আতিজা আমার বাঁধন কেটে দিয়ে মুক্ত করে আমাকে পাঠিয়ে দেয়।

টারজান বলল, এখন যাবে কোথায়?

জায়েদ বলল, আমার দেশ সুদানের অন্তর্গত একটা জায়গায়।

টারজান বলল, তুমি সেখানে একা যেতে পারবে না। আমি তোমাকে একটা গায়ে নিয়ে যাব। সেখান থেকে আর একটা গায়ে। এইভাবে তোমাকে তোমার দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।

টারজান যখন এইভাবে কথা বলছিল জায়েদের সঙ্গে তখন শেখের মঞ্জিলে চলছিল দারুণ গোলমাল। তোলোগ আর ফাদ চক্রান্ত করছিল দুজনে মিলে শেখের বিরুদ্ধে। ফাঁদের সঙ্গে স্টিম্বল চক্রান্ত করছিল। ক্রীতদাস ফেজুয়ান ভাবছিল মুক্তির কথা। আর আতিজা জায়েদের জন্য চোখের জল ফেলছিল নীরবে।

শেখ শুধু ভাবছিল নিমুরে যাবার কথা। কিন্তু কোথায় কিভাবে যাবে সেখানে তার কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না।

একদিন ফেজুয়ানকে ডেকে শেখ বলল, তুমি ছেলেবেলায় তোমার গায়ের লোকদের কাছ থেকে নিমুরের গল্প অনেক শুনেছ। তারা নিশ্চয় সেখানে যাবার পথ বলে দিতে পারবে। তোমাকে আপাতত মুক্তি দিচ্ছি। তুমি তোমার গায়ে চলে যাও। তারপর গাঁয়ের লোকদের কাছ থেকে সব জেনে আমাকে জানিয়ে যাবে তাহলে তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব।

ফেজুয়ান বলল, কখন যাব তাহলে?

শেখ ইবন জাদ বলল, কাল সকাল হলেই রওনা হবে তুমি।

পথ চলতে চলতে ফেজুয়ান যে তার গায়ের কাছে চলে এসেছে তা বুঝতে পারেনি সে। তার ছেলেবেলায় আরব বেদুইনরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাই তার গাঁয়ের পথটা নিজেই ভুলে গেছে সে।

গাঁয়ের কাছে আসতেই একদল নিগ্রো যোদ্ধার সামনে পড়ে গেল।

 নিগ্রোরা ফেজুয়ানকে বলল, তুমি আরব হয়ে আমাদের দেশে কি করছ?

ফেজুয়ান বলল, আমি আরব নই, আমিও তোমাদের মত নিগ্রো। তবে আরবরা আমার ছেলেবেলায় আমাকে চুরি করে নিয়ে যায়। সেই থেকে তারা আমায় আটকে রাখে।

নিগ্রোযোদ্ধাদের মধ্যে একজন বলল, তোমার নাম কি?

ফেজুয়ান বলল, আমার আসল নাম উলালা। আরবরা ফেজুয়ান বলে ডাকত।

এবার সেই নিগ্রোটি আনন্দে লাফিয়ে উঠে ফেজুয়ানকে জড়িয়ে ধরল। বলল, উলালা আমার ভাই। আমার নাম তাহো। চল গায়ে নিয়ে যাই। আমরা ভাবতাম তোকে সিংহতে ধরে নিয়ে গেছে। তুই আর বেঁচে নেই।

গাঁয়ে যেতেই সবাই এসে ভিড় করে দাঁড়াল। বাবা মা তাদের হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে চোখের জল ফেলতে লাগল।

উলালা বললর, এক যাদুকর বলেছে প্রাচীন নগরী নিমুরে অনেক ধনরত্ন আছে, আর এক প্রমা সুন্দরী মেয়ে আছে। সেখানে যাবার পথ জানার জন্য আমাকে এক আরব সর্দার আমার গায়ে পাঠিয়েছে। সে পথ বলে দিলে তারা আমাদের মোটা রকমের পুরস্কার দেবে।

গাঁয়ের সর্দার বাতান্দো বলল, তাহলে আমরা সেখানে যাবার পথটা দেখিয়ে দিতে পারি।

উলালা সর্দারকে বলল, তুমি বলেছিলে আরবদের নিষিদ্ধ নগরী নিমুরের পথ দেখিয়ে দেবে।

বাতান্দো বলল, তাদের সঙ্গে আর তাহলে লড়াই করতে হবে না। উত্তর দিকে যে পাহাড় আছে সেই পাহাড়ী পথ দিয়ে নিমুরে প্রবেশ করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না।

উলালা বলল, কি ধরনের লোক বাস করে নিমুরে তা জান?

বাতান্দো বলল, কেউ তা বলতে পারে না। যারা যায় তারা আর ফেরে না। কেউ বলে সেখানে প্রেতাত্মারা বাস করে। কেউ বলে সেখানে শুধু চিতাবাঘ আছে।

উলালা বলল, তাহলে আমি এখন কি করব?

বাতান্দো বলল, তুমি এখন আরব সর্দার শেখকে গিয়ে বল, আমরা তাদের নিমুরের উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে সেখানে যাবার পথ দেখিয়ে দেব। তাদের সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। তবে তাদের হাতে যে সব নিগ্রো ক্রীতদাস আছে তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে।

উলালা যথাসময়ে চলে গেল শেখের শিবিরে। গিয়ে সব কথা শেখকে বলল। শেখ প্রথমে তার নিগ্রো ক্রীতদাসদের ছেড়ে দিতে রাজী হলো না। কিন্তু উলালা যখন বলল তাদের ছেড়ে না দিলে অন্যান্য নিগ্রোযোদ্ধারা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠবে তখন বাধ্য হয়ে রাজী হলো শেখ। তবে সে ভাবল আপাতত সে রাজী হলেও পরে সুযোগ পেলেই সে মত পরিবর্তন করবে।

উলালার কথামত শেখ ইবন জাদ তিনদিন অপেক্ষা করল।

এদিকে টারজান জায়েদকে একটা আদিবাসী গায়ে নিয়ে গিয়ে সর্দারকে বলল, একে তোমাদের গাঁয়ে রেখে দেব।

সর্দার রাজী হয়ে গেল। জায়েদ তখন নির্জনে টারজানকে ডেকে বলল, আমার একটা কথা আছে বন্ধু। আমি একবার আতিজাকে শুধু চোখের দেখা দেখতে চাই। আমার বিশ্বাস ইবন জাদ তার দলবল নিয়ে এই পথেই নিমুরে যাবে। আমার অনুরোধ, শেখের দল না আসা পর্যন্ত তুমি আমার এই গাঁয়েই থাকার ব্যবস্থা করে দাও।

টারজান বলল, ঠিক আছে, তাই হবে। তুমি আজ হতে ছমাস এই গাঁয়ে থাকবে। এর মধ্যে শেখ যদি আসে তাহলে আমি তোমাকে আমার গায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। সেখান থেকে তোমার দেশ সুদান যাবার ব্যবস্থা করে দেবে।

জায়েদ টারজানকে কথায় কথায় বলেছিল শেখের শিবিরে একজন বন্দী আছে। টারজান ভাবল সে শ্বেতাঙ্গ হবে হয় স্টিম্বল না হয় ব্লেক।

এদিকে নিমুরের রাজপ্রাসাদে মলাদ নামে একজন নাইটের সঙ্গে ব্লেকের শত্রুতা ক্রমশই বেড়ে চলতে লাগল। ব্লেক সব সময় হাসিখুশিতে মেতে থাকলেও তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারল না মলাদ। রাজার কাছে ব্লেকের নামে প্রায়ই নিন্দা করত নানারকম। রিচার্ড অবশ্য ব্লেককে তলোয়ার খেলা, ঘোড়ায় চাপা প্রভৃতি নাইটদের নানারকম কার্যকলাপ ও আদবকায়দায় কুশলী করে তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগল।

একদিন মলাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়ে পরদিন তার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে চাইল ব্লেক।

ডুয়েলের আগে ব্লেকের পরম বন্ধু রিচার্ড কতকগুলো সৎ পরামর্শ দিল।

রিচার্ড বলল, সে যদি তোমার রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষান্ত হতে চাইত তাহলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এক্ষেত্রে সে তোমার মৃত্যু ঘটাতে চায়। তার প্রথম কারণ তুমি তাকে পাঁচজনের সামনে অপমান করেছ। দ্বিতীয় কারণ সে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চায় এবং এজন্য সে তোমার প্রতি ঈর্ষান্বিত। কারণ সে জানে রাজকন্যার প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে।

ব্লেক হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল রিচার্ডের কথাটা।

পরদিন সকাল সাতটা বাজতেই ওরা রাজপ্রাসাদের সামনের প্রাঙ্গণে গিয়ে উপস্থিত হলো। ব্লেক আর মলাদ দু’জনেরই সঙ্গে একজন করে নাইট থাকবে। ব্লেকের সঙ্গে থাকবে রিচার্ড। রাজা এক জায়গায় বসল। রানী ও রাজকন্যা জিনালদা তার পাশেই বসেছিল। দর্শকরা সব চারদিকে ঘিরে বসল। দু’পক্ষেরই প্রচুর সমর্থক ছিল।

ডুয়েল শুরু হয়ে গেল। জয়ঢাক বাজতে লাগল। ব্লেক আর মলাদ দু’জনেই ঘোড়ায় চড়ে এসে দু’জনের মুখোমুখি হলো।

ব্লেক মলাদের সামনে এলেই তার ঢালটা ফেলে দিল মাটিতে। মলাদ তার তরবারি দিয়ে ব্লেকের মাথায় আঘাত করতে এলেই ব্লেক ঘোটা সরিয়ে নিয়ে তার লক্ষ্য ব্যর্থ করে দিল। তারপর অকস্মাৎ তার তরবারি দিয়ে মলাদের পাঁজরের উপর এক জায়গায় আঘাত করল। জায়গাটা ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। মলাদের কোন আঘাতই লাগল না ব্লেকের গায়ে। একমাত্র মলাদের হাত থেকে তরবারিটা পড়ে গেল। এক্ষেত্রে নিয়ম অনুসারে মলাদকে ব্লেকের কাছে প্রাণভিক্ষা করতে হবে। কিন্তু অহঙ্কারের বশে তা করল না মলাদ। তা না করলেও উদারতাবশত ব্লেক মলাদের সহযোগী নাইটকে আর একটি তরবারি দিতে বলল মলাদকে।

মলাদকে আবার তরবারি দেয়া হলে আবার লড়াই শুরু হলো। দর্শকরা সবাই বুঝতে পারছিল ব্লেকই জিতছে। এবার মলাদ জয়লাভের জন্য জোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ব্লেকের তরবারির এক প্রচণ্ড আঘাত মলাদের মাথায় লাগাতেই মলাদ ঘোড়া থেকে সোজা মাটিতে পড়ে গেল।

ব্লেক তখন ঘোড়া থেকে নেমে মলাদের বুকের উপর একটা পা রেখে তার গলার উপর তরবারির মুখটা ঠেকিয়ে রাজাকে বলল, হে রাজন, আমি লড়াইয়ে জয়ী হলেও আমার প্রতিপক্ষ এই নাইটকে হত্যা করব না। এ আপনার কাজে নিযুক্ত থেকে আপনার সেবা করে যেতে পারবে।

এই বলে রিচার্ডের সঙ্গে সেখান থেকে তার বাসায় চলে গেল। সকলেই ব্লেককে নিমুরের সর্বশ্রেষ্ঠ নাইট বলে অভিনন্দন জানাতে লাগল।

ব্লেক বলল, আমি যে দেশের মানুষ সে দেশের এটাই হলো রীতি। শত্ৰু পরাজিত বা নিরস্ত্র হলে তাকে আঘাত করা উচিৎ নয়।

রাজা নিজে স্বীকার করল ব্লেকের কাছে, সত্যিই তোমার উদারতা ও বীরত্ববোধের তুলনা হয় না। তুমি যে দেশের মানুষ সে দেশের রীতিনীতি আমার জানতে ইচ্ছা করছে।

সেদিন শেখের মঞ্জিলে ফেজুয়ানের কথামত বাতান্দোরা না আসায় ইবন জাদ খুব ভাবছিল। এমত অবস্থায় কি করা যায় তা নিয়ে যুক্তি করছিল তোলোগের সঙ্গে। তখন রাত্রিকাল।

এমন সময় হঠাৎ টারজান তাদের সামনে এসে হাজির হতেই চমকে উঠল সবাই। ইবন জাদ বলল, টারজান এসে গেছে। আল্লার অভিশাপ নেমে আসুক ওর মাথায়।

আরবদের মধ্যে স্টিম্বলকে দেখেই টারজান প্রথমে তাকে বলল, ব্লেক কোথায়?

স্টিম্বল বলল, আমি জানি না। সে ত অন্য দিকে গেছে।

 টারজান বলল, তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

এরপর শেখ ইবন জাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে টারজান বলল, তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ। তুমি, বলেছিলে ব্যবসার খাতিরে তোমরা এখানে আছ। অথচ তোমরা একটা প্রাচীন নগরীতে গিয়ে ধনরত্ন। লুণ্ঠন করে আনার জন্যই এখানে আছ।

শেখ ব্যস্ত হয়ে বলল, কে বলেছে তোমাকে এ কথা? এটা মিথ্যা কথা। বল কে বলেছে?

টারজান বলল, যে বলেছে সে মিথ্যাবাদী নয়। যে বলেছে সে হলো জায়েদ।

টারজান এবার শেখকে বলল, কালই তোমাদের এখান থেকে রওনা হতে হবে। তোমরা সোজা তোমাদের দেশে চলে যাবে। তোমাদের মনের মধ্যে কুমতলব না থাকলে কেন তোমরা এর আগে আমাকে বন্দী করে আমার জীবননাশের চেষ্টা করো?

তোলোগ সঙ্গে সঙ্গে বলল, না না, আমি ঠাট্টা করছিলাম তোমার সঙ্গে। আমি মারতে চাইনি।

টারজান বলল, যাই হোক, আমার শোবার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দাও। এবার যেন কোন চক্রান্ত করো না।

এদিকে সবাই শুয়ে পড়লে শেখ তার ভাই তোলোগের সঙ্গে যুক্তি করতে লাগল। শেখ ঘুমন্ত টারজানকে ছুরি মেরে হত্যা করার কথা বলল তোলোগকে।

শেখ বলল, যেমন করে হোক ওকে সরানো চাই। আমরা এতদিন এখানে বসে থেকে ধনরত্ন না নিয়ে শুধু হাতে ফিরে যেতে পারব না। এক কাজ করো, স্টিম্বলকে ডেকে আন।

স্টিম্বল এলে শেখ বলল, টারজান বলেছে তুমিই ব্লেককে হত্যা করেছ। তার জন্য আগামীকাল হত্যা করবে টারজান তোমায়।

স্টিম্বল বলল, তুমি আমাকে বাঁচাও। তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব আমি।

শেখ বলল, আমি কোন কিছু করতে পারব না। তুমি নিজেই নিজেকে উদ্ধার করতে পার। তুমি ঘুমন্ত টারজানকে ছুরি মেরে হত্যা করতে পার। তোমাকে আমি এই সুযোগ দিতে পারি।

স্টিম্বল বলল, আমি কখনো কাউকে হত্যা করিনি জীবনে।

শেখ বলল, হয় হত্যা কর না হয় নিতহ হও।

স্টিম্বল একটা ছুরি হাতে নিয়ে টারজনের ঘরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

স্টিম্বল চলে গেল তোলোগ শেখকে বলল, স্টিম্বল টারজানকে হত্যা করলে টারজনের লোকেরা এলে আমরা বলব আমাদের কোন দোষ নেই। তাকে আমরা রাতের মত আশ্রয় দিয়েছিলাম কিন্তু স্টিম্বল তাকে হত্যা করেছে।

এদিকে আতিজা ঘুমোয়নি। কান পেতে সব কথা শুনে সে টারজানকে সতর্ক করে দেবার জন্য তার ঘরে গেল। কিন্তু ঘরে ঢুকতে যেতেই তোলোগ তাকে ধরে ফেলল। বলল, এই বিদেশী জায়েদের বন্ধু বলে তাকে বাঁচাতে যাচ্ছিস? চলে যা এখান থেকে।

কিন্তু আতিজা সেখান থেকে চলে আসতেই পিছন থেকে টারজান ধরে ফেলল তোলোগকে। তার গলা টিপে ধরল এমনভাবে যে সে চীৎকার করতে পারল না। তারপর তাকে হত্যা করে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বনের মধ্যে।

এদিকে স্টিম্বল ঘরে ঢুকে কাপড় ঢাকা তোলেগের মৃতদেহটাকে ঘুমন্ত টারজান ভেবে বারবার ছুরিটা বসিয়ে দিতে লাগল সেই দেহের মধ্যে। অবশেষে সে টলতে টলতে শেখের কাছে চলে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে শেখের মূর্তিটা পাল্টে গেল। সে চীৎকার করে সবাইকে জড়ো করে বলল, স্টিম্বলকে বেঁধে বন্দী করে রাখ ও আমাদের বন্ধু টারজানকে হত্যা করেছে। কাল ওর বিচার হবে।

কাপড় ঢাকা অবস্থাতেই সেই রাত্রিতে তোলোগের মৃতদেহটাকে কবর দিল ওরা। পরদিন সকালে তোলোগকে শিবিরের কোথাও পাওয়া না গেলে অনেকে বলল, সে হয়ত একা একা কোথাও শিকার করতে বেরিয়ে গেছে।

পরদিন সকালে শেখ শিবির গুটিয়ে সর্দার বাতালোর গায়ে গিয়ে নিজেই হাজির হলো। সর্দার তাকে যথেষ্ট খাতির করে বলল, আমরা তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব। তবে আমাদের জাতির সব ক্রীতদাসকে। মুক্তি দিতে হবে।

শেখ বলল, তাহলে আমাদের মালপত্র বইবে কারা?

বাতান্দো বলল, নিমুরের উপত্যকা পর্যন্ত আমরা সবাই যাব। তারপর আমাদের সঙ্গে ক্রীতদাসরা চলে আসবে।

ধনরত্নের লোভে তাতেই রাজী হয়ে গেল শেখ। শেখ বাতান্দোর সঙ্গে উত্তর দিকে একটা পাহাড়ের কাছে শিবির স্থাপন করে তার দলের মেয়েদের রেখে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করল। তারপর কিছু সশস্ত্র। আরব আর তার দেশ থেকে আনা কিছু ক্রীতদাস নিয়ে পাহাড়ের ওপারে সেই উপত্যাকাটায় গিয়ে। পৌঁছল।

বাতান্দো একটা উঁচু জায়গা থেকে শেখকে দেখাল, উপত্যকাটার ওধারেই আছে সেই নিষিদ্ধ নগরী নিমুর।

নিমূর থেকে কিছু দূরে উপত্যকাটার ওধারে সিটি অফ সেপালকার নামে একটি নগরী ছিল। সেই নগরীর রাজা ছিল বোহান। আজ হতে সাতশো বছর আগে এই দুই দেশের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি এবং যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। পরে এক চুক্তিবলে শান্তি স্থাপিত হয়।

সেই থেকে প্রতি বছর তিনদিন ধরে এক যুদ্ধ-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দুই দেশের নাইট ও বীরপুরুষেরা এই প্রতিযোগিতায় যোগদান করতে পারে। যে দেশ এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হয় সেই দেশ বিজিত দেশের রাজার কাছ থেকে পাঁচজন সুন্দরী মেয়েকে বাছাই করা হয়। দুটি দেশ থেকেই পাঁচজন করে সুন্দরী মেয়েকে পুরস্কার হিসেবে সাজিয়ে রাখা হয়। যে দেশ জয়লাভ করে সেই দেশের বীর নাইটদের হাতে বিজিত দেশ তাদের পাঁচজন মেয়েকে তুলে দেয়।

মোট তিনদিন ধরে এই অনুষ্ঠান চলে। প্রতিদিন কয়েকবার করে খেলা হয়। প্রতিবার বিরাট খোলা মাঠটার দু’দিকে একশোজন করে দুই দেশের নাইট ঘোড়ায় চেপে সারবন্দীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার। দক্ষিণ দিকে নিমুরের দল আর উত্তর দিকে সিটি অফ সেপালকারের দল ছিল। জয়ঢাক বাজতে থাকে। সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’পক্ষের নাইটরা এক এক জন বীর প্রতিপক্ষকে বেছে নিয়ে আক্রমণ করে। ঘোড়ার উপর থেকে তরবারি আর কখনো বা বর্শা দিয়ে যুদ্ধ হয়।

যাই হোক, খেলা শেষে দেখা গেল দুই পয়েন্টে নিম্নরই জয়লাভ করল প্রতিযোগিতায়। নিমুরের নাইটরা সবাই ঘোড়ায় করে উল্টোদিকে প্রতিপক্ষদের শিবিরে চলে গেল পুরস্কার নেবার জন্য।

এমন সময় সিটি অফ সেপালকারের রাজা বোহান তিন-চারজন নাইট আর একটা খালি ঘোড়া এনে

রাজকন্যা জিনালদাকে জোর করে ধরে খালি ঘোড়াটায় চাপিয়ে তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে গেল। তার নাইটরাও চলে গেল তার পিছু পিছু।

এদিকে বাতান্দোরা সেই শূন্য বিরাট উপত্যকার প্রান্ত থেকে চরে গেলে শেখ তার দলবল আর। অনেকগুলো বন্দুক নিয়ে উপত্যকাটা পার হয়ে সেই নিষিদ্ধ নগরীর দিকে এগিয়ে চলতে লাগল। সে নিমুরের পথে না গিয়ে বোহানের রাজ্য সিটি অফ সেপালকারের পথে যেতে লাগল।

শেখ নগরদ্বারে গিয়ে দেখল বাইরে লোকজন বেশি নেই। মাত্র দুই তিনজন প্রহরী নগরদ্বারে হাতে শুধু বর্শা আর কোমরে তরবারি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।

শেখের লোকেরা বন্দুক থেকে একটা গুলি করতেই একজন প্রহরী মারা গেল আর একজন আহত হলো।

নগরের মধ্যে ঢুকে বিশেষ কোন বাধা পেল না শেখরা। তাদের হাতে বন্দুক দেখে এবং দুই-একটা গুলি খেয়ে ভয়ে পালাতে লাগল সবাই।

শেখ তার দলের লোকদের নিয়ে সোজা রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ল। প্রাসাদের মধ্যে শেখ দেখল অনেক মণিমুক্তা, সোনা প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু ছড়ানো রয়েছে।

শেখ ইবন জাদ অনেকগুলো বস্তা বার করে তাতে যতদূর সম্ভব ধাতুগুলো ভরে নিল। তারপর সেই সব ধনরত্ন নিয়ে অবাধে ও নিরাপদে চলে না গিয়ে সে অন্য একটা পরিকল্পনা করল।

রাত্রিবেলায় শেখ ভাবল এই প্রাসাদের শীর্ষদেশ থেকে সে আজ দেখেছে উপত্যকাটা যেখানে গিয়ে দূরে একটা পাহাড়ের পাদদেশে মিশেছে সেই পাহাড়ের কোলে এই ধরনের আর একটা নগরী আছে। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলল কাল সকালেই সে সদলবলে যাবে সেখানে।

এদিকে সেদিন রাত্রিতে শেখের শিবির হতে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল থেকে ব্লেকের খোঁজ করতে থাকে টারজান।

টারজান নিমুরের উপত্যকায় পাথরের বিরাট ক্রসটার কাছে এসে দু’জন প্রহরীকে দেখে একটা ঝোপের ধারে লুকিয়ে পড়ল। একজন প্রহরীকে সে অতর্কিতে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কোন রাজ্যের লোক? তোমাদের রাজ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ এসেছে? আমার কথার যদি ঠিক ঠিক জবাব দাও তাহলে তোমার কোন ক্ষতি করব না।

প্রহরীটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে উত্তর করল, আমাদের এই রাজ্যের নাম নিমুর। এখানে কিছুদিন আগে এক শ্বেতাঙ্গ আসে। তার নাম স্যার জেমস ব্লেক।

টারজান বলল, এখন সে কোথায়? কি করছে?

প্রহরী বলল, এখন সে একজন বীর নাইট হয়েছে। আমাদের নিমুরের সম্মান রক্ষার জন্য সে এখন সেখানকার নগরীর সঙ্গে আমাদের যে যুদ্ধ-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে তাতে অংশগ্রহণ করেছে।

অনুষ্ঠানের মাঠে ওরা পৌঁছে দেখল সেখানে দারুণ গোলমাল চলছে। এইমাত্র বোহান নিমুরের রাজকন্যা জিনালদাকে জোর করে নিয়ে পালিয়ে গেছে। সে যাবার পর সেপালকারের নাইটরাও তার পিছু পিছু পালিয়ে গেছে। একথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ব্লেকসহ নিমুরের নাইটরাও তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছে।

কথাটা শুনে বাট্রাম টারজানকে বলল, যাবে আমার সঙ্গে?

 টারজান নীরবে তার ঘোড়াটা বাট্রামের পিছু পিছু ছুটিয়ে দিল।

ব্লেক সোজা গিয়ে যে নাইটটা জিনালদাকে নিয়ে যাচ্ছিল তার পাঁজরে তরবারিটা আমূল বসিয়ে দিল। নাইটটা ঘোড়া থেকে পড়ে যেতেই ব্লেক জিনালদার হাত ধরে তাকে নিজের ঘোড়াটার উপর চাপিয়ে নিল। তখন পাশের অন্য নাইটদুটো ব্লেককে আক্রমণ করতে এলে ব্লেক তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে গুলি করল পর পর দুটো।

গুলি খেয়ে দুটো নাইটই পড়ে গেল ঘোড়া থেকে এবং তাদের দলের অন্য সব নাইটরা পালিয়ে গেল ব্লেককে ছেড়ে দিয়ে। নিমুরের নাইটরা তখন তাড়া করে নিয়ে যেতে লাগল। এই অবকাশে ব্লেক জিনালদাকে নিয়ে পাশের একটা বনে গিয়ে প্রবেশ করল।

জিনালদা তাকে বলল, সত্যিই তুমি বীর। তুমি যেভাবে আমাকে উদ্ধার করেছ তা কল্পনা করাও যায় না।

ব্লেক তখন সত্যিই বড় ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। সে জিনালদাকে বলল, আমি আজ সকাল থেকে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তুমি আমাদের ঘোড়াটাকে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে দাও।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই করল জিনালদা। তারপর বনের মধ্যে চারদিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল সে। তার মনে হলো এখনি হয়তো কোন হিংস্র জন্তু বেরিয়ে এসে আক্রমণ করবে তাদের।

জিনালদা এবার ব্লেককে বলল, চল রওনা হওয়া যাক। তোমার এ আগ্নেয়াস্ত্রটা দিয়ে কত জন্তু তুমি মারবে?

এরপর সন্ধ্যা না হতেই বন পথে রওনা হয়ে পড়ল ওরা।

এদিকে ইবন জাদ তার সহচরদের নিয়ে বনের গভীরে এগিয়ে গেল। ওরা পশ্চিম দিক থেকে যেখানে ব্লেক জিনালদাকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে গেল।

শেখ বলল, ওকে এইখানে বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাও। ও এখানে মারা গেলে আমাদের কোন দোষী হতে হবে না।

শেখেরা সবাই চলে গেলে ব্লেক হাত পা বাঁধা অবস্থায় সেখানেই পড়ে রইল। সন্ধ্যা হতেই চাঁদ উঠল আকাশে। বনের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটায় পড়েছিল ব্লেক, সেখানে কিছুটা চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা চিতাবাঘ এগিয়ে এল তার দিকে। তার জ্বলন্ত চোখদুটো দেখতে পেল ব্লেক।

কিন্তু চিতাবাঘটা তাকে লক্ষ্য করে একটা লাফ দিতেই ব্লেক দেখল গাছের উপর থেকে একটা মোটা দড়ির ফাঁস এসে তার গলার উপর পড়ল আর তার গলাটা আটকে গেল। বাঘটা শূন্যে ঝুলতে লাগল।

এবার গাছ থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ নেমে এসে ব্লেকের সামনে দাঁড়াল। তাকে দেখে ব্লেক বিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল, টারজান তুমি!

টারজানও বিস্মৃত হয়ে বলল, ব্লেক তুমি! তোমাকে কত খুঁজে চলেছি আমি।

ব্লেকের হাতে পায়ের সব বাঁধন ছুরি দিয়ে কেটে দিল টারজান।

টারজান বলল, কারা তোমায় এভাবে বেঁধে রেখে গেল?

ব্লেক বলল, একদল আরব। একটি মেয়ে আমার কাছে ছিল। তাকে তারা ধরে নিয়ে গেছে।

 টারজান প্রশ্ন করল, কখন কোন্ পথে গেছে তারা?

ব্লেক একটা পথ দেখিয়ে বলল, ঘণ্টাখানেক আগে ঐ পথে গেছে তারা।

ওরা দু’জনে সেই পথে কিছুদূর এগিয়ে গেলে টারজান বাতাসে গন্ধসূত্র ধরে বলল, এখান থেকে আরবরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে দুদিকে গেছে। একদল গেছে উত্তর দিকে আর একদল গেছে দক্ষিণ দিকে নিমুরের পথে। তবে তুমি যে মেয়ের কথা বলছ তাকে শেখ উত্তর দিকে পাহাড়ের ওপারে নিয়ে গেছে। আমি জানি সেখানেই শেখের মঞ্জিল আছে। অবশ্য এটা আমার অনুমান। তুমি এখন উত্তর দিকে যাও। আমি যাব দক্ষিণ দিকে। আমি তোমার থেকে তাড়াতাড়ি যেতে পারব। আমি দক্ষিণ দিকে তাকে না দেখতে পেলে তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে তোমাকে ধরব। আর তুমি তাকে পেলে দক্ষিণ দিকে আমার কাছে চলে যাবে। এই কথা বলে ব্লেকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল টারজান।

 সারারাত ধরে ক্রমাগত উত্তর দিকে এগিয়ে চলল ইবন জাত তাদের দলের লোকদের নিয়ে।

শেখ সদলবলে এগিয়ে যেতে থাকল। এক দিকে ধনরত্ন আর এক দিকে এক সুন্দরী যুবতী। শেখের দারুণ ভয় হচ্ছিল। তার কেবলি ভয় হচ্ছিল কোন লুণ্ঠনকারী হয়তো এগুলো লুণ্ঠন করে নিয়ে যাবে। পথ চলার সুবিধার জন্য শেখ ধনরত্নগুলো ভাগ করে কয়েকটা বস্তায় ভরে বিশ্বস্ত কয়েকজন অনুচরের হাতে দিয়ে দেয়। জিনালদার ভার দেয়ে ফাঁদের হাতে। স্টিম্বলের জ্বর হয়েছিল। দুর্বল ও রুগ্ন অবস্থায় পথ হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তবু সে ফাঁদের পাশাপাশি অতি কষ্টে হেঁটে যাচ্ছিল।

পাহাড়টার পাদদেশে এসে আবার ইবন জাদ পূর্ব দিকের একটা পথ ধরল। কারণ সে বাতান্দোদের গায়ের কাছ দিয়ে যেতে চাইছিল না। তাতে নতুন বিপদ দেখা দিতে পারে।

সেদিন রাত্রিতে শিবিরে খুব তাড়াতাড়ি রান্নার কাজটা সারা হয়ে গেল। আতিজা একটু দূর থেকে দেখল ফাঁদ সবার অলক্ষ্যে শেখের খাবারে কি একটা জিনিস ফেলে দিল। তা দেখে সন্দেহ হলো আতিজার। সে ভাবল ফাঁদ হয়ত বিষ মিশিয়ে দিয়েছে তার বাবার খাবারের মধ্যে। তাই যেই খাবার জন্য তার বাবা মুখে তুলতে গেল সে এসে খাবারের থালাটা ছিনিয়ে নিল তার বাবার হাত থেকে। শেখ এর কারণ জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে ফাঁদ তার বন্দুকটা নিয়ে চলে গেল। সে প্রথমে মেয়েদের তাঁবুতে গিয়ে জিনালদাকে ধরে তাকে টানতে টানতে তার তাবুতে নিয়ে গেল। সেখানে। স্টিম্বলকে ডেকে বলল, শেখ তোমাকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছে। বাঁচতে চাও ত এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে পালিয়ে চল।

এদিকে আতিজা যখন শেখকে বলল ফাঁদ তার খাবারে বিষ মিশিয়ে পালিয়ে গেছে তখন শেখ ফাঁদকে ধরে আনার হুকুম দিল। একজন লোক ফাঁদকে ধরার জন্য তার শিবিরের দিকে গিয়ে দেখল, ফাঁদ জিনালদা আর স্টিম্বলকে সঙ্গে করে পালাচ্ছে। তারা তাকে ধরতে গেলে ফাঁদ গুলি করল বন্দুক থেকে। ওদের হাতে তখন অস্ত্র না থাকায় ওরা ফিরে এল। ফলে অবাধে শিবিরের সীমানা ছেড়ে পালিয়ে গেল ফাঁদ।

এদিকে টারজান দক্ষিণ দিকে গিয়ে শেখের আবদেল আজিজের দলটাকে ধরে ফেলল। কিন্তু যখন দেখল তাদের দলে কোন মেয়ে বন্দী নেই তখন সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিকে ফিরে পথ চলতে লাগল।

শেখের দল সেপালকার নগরীর সীমান্তবর্তী পাহাড়টার পূর্ব প্রান্ত থেকে আবার দক্ষিণ দিকে যেতে টারজান তাদের দেখতে পেল। কিন্তু সে দলে স্টিম্বল আর জিলানদাকে দেখতে পেল না।

শেখকে দেখে প্রচণ্ড রাগ হলো টারজনের। শেখ তাকে বরাবর মিথ্যা কথা বলে ঠকিয়ে এসেছে।

টারজান দেখল পাঁচজন লোক বস্তাভরা ধনরত্নগুলো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বোঝাভারে ভারাক্রান্ত হয়ে ধীর গতিতে পথ হাঁটছিল তারা।

সহসা সবার অলক্ষ্যে একটা বিষাক্ত তীর এসে শেখের পাশে হাঁটতে থাকা একজন মালবাহকের গলাটাকে বিদ্ধ করল ভীষণভাবে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল লোকটা। শেখরা অবাক হয়ে গেল। কোথাও কোন শত্রুকে দেখতে পেল না ওরা। শুধু পোকামাকড়ের ডাক ছাড়া আর কোন সাড়াশব্দ নেই।

সন্ধ্যা হতে পার্বত্য অরণ্যের মাঝখানেই পথের ধারে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করল শেখ। মৃত দেহটাকে পথের উপর ফেলে এসেছে তারা।

এদিকে আতিজার তাঁবুর পিছন দিকের পর্দাটা সরিয়ে সহসা একজন অন্ধকারে ঢুকে একটা হাত তার মুখে আর একটা হাত তার ঘাড়ের উপর দিয়ে কে বলল, কোন শব্দ করো না। চেঁচিও না, আমার কথার উত্তর দাও। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।

আতিজা বুঝল, এ নিশ্চয় কোন জিন বা অপদেবতার কাজ।

টারজান বলল, বল ইবন জাদ উপত্যকা হতে যে মেয়েটিকে ধরে এনেছিল সে এখন কোথায়?

আতিজা বলল, ফাঁদ তাকে নিয়ে পালিয়েছে।

টারজান আবার বলল, জায়েদকে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে সত্যি কথা বল আমায়। তারা কোথায়?

আতিজা বলল, সত্যি বলছি, গতরাতে মঞ্জিল থেকে তারা পালিয়েছে। এখন কোথায় তা জানি না।

 কারাগারের মধ্যে যে দু’জন নগ্নদেহি বন্দী ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল ব্লেক।

সহসা কার পদশব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠল ব্লেক। সঙ্গে সঙ্গে একটা বাতির আলো এগিয়ে আসতে লাগল কারাগারের অন্ধকারে। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্লেক দেখল বাতি হাতে সেখানকার দু’জন নাইট তার সামনে এসে দাঁড়াল। ব্লেক তাদের চিনতে পারল। তারা হলো স্যার গী আর স্যার উইলডারর্ড।

উইলডারর্ড বলল, স্যার গী আর আমি শুনলাম আগামীকাল তোমাকে পুড়িয়ে মারা হবে? আমরা তাই তোমাকে মুক্ত করার জন্য এসেছি। তোমার মত একজন বীর নাইটকে এভাবে হত্যা করলে এখানকার সব নাইটদের সারাজীবন ধরে এক অনপনেয় কলঙ্কের বোঝা বয়ে যেতে হবে।

এই কথা বলেই উইলডারর্ড ব্লেকের হাত পায়ের লোহার শিকলের বাঁধনগুলো খুলে দিল।

 ব্লেক বলল, তোমরা আমায় মুক্ত করে দিচ্ছ, একথা বোহান জানতে পারলে তোমাদের প্রাণ যাবে।

উইলডারর্ড বলল, না, জানতে পারবে না। স্যার গী তোমার সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে গিয়ে নগরপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে আসবে তোমায়। সেখান থেকে তুমি নিমুরে চলে যাবে।

স্যার গী এবার ব্লেককে বলল, একটা কথার উত্তর দেবে? তুমি রাজকন্যা জিনালদাকে নিজের হাতে উদ্ধার করেছিলে। কিন্তু আরবরা তাকে কিভাবে ধরে নিয়ে গেল?

ব্লেক তখন যা যা ঘটেছিল সব কথা খুলে বলল তাদের।

তখন বিকালবেলা। বাঁদর-গোরিলাদের রাজা তোয়াৎ তার দলের গোরিলাদের নিয়ে বনের মধ্যে আহার অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছিল। তাদের দিকে ধীর গতিতে তিনজন লোক আসছিল। একজন আরব, একজন শ্বেতাঙ্গ আর একজন নারী।

আগন্তুক তিনজনের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধ জ্বরে ভুগছিল। রুগ্ন অবস্থায় সে একটা গাছের ডাল লাঠির মত করে ধরে তার উপর ভর দিয়ে পথ হাঁটছিল। আরব লোকটির হাতে একটা বন্দুক ছিল। মেয়েটির পোশাকটা জমকালো হলেও তা ময়লা এবং ছেঁড়া।

জিনালদাকে তার লোমশ হাত দিয়ে ধরে ফেলল তোয়াৎ। সে, তাকে নিয়ে পালাতে চাইল। কিন্তু গোয়াদ নামে আর একটা বাঁদর-গোরিলা দাঁত বার করে তোয়াতের দিকে তেড়ে এল জিনালদাকে কেড়ে নেবার জন্য।

তোয়াৎ জিনালদাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু সে বেশিদূর যেতে পারল না। গোয়াদ তাকে তাড়া করল। তখন জিনালদাকে নামিয়ে দিয়ে গোয়াদের সঙ্গে লড়াইয়ে মত্ত হয়ে উঠল তোয়াৎ।

ওরা যখন দু’জনে জোর লড়াই করছিল জিনালদাকে হাত করার জন্য তখন চেষ্টা করলে সেই অবসরে পালিয়ে যেতে পারত জিনালদা। কিন্তু সে তখন অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ায় পালাতে পারল না।

এমন সময় সেখানে কালো কেশরওয়ালা সোনালী রঙের একটা সিংহ এসে পড়ায় লড়াই ছেড়ে পালিয়ে গেল তোয়াৎ আর গোয়াদ। সিংহের গায়ের সোনালী চামড়াটা শেষ বিকালের সূর্যের আলোয়। চকচক করছিল।

সিংহটা কাছে এসে পড়ায় জিনালদা কোন উপায় না দেখে শুয়ে পড়ল। সিংহটা এসে জিনালদার শায়িত দেহটা শুঁকতে লাগল।

এদিকে জায়েদের নেতৃত্বে টারজনের একশোজন ওয়াজিরি যোদ্ধা উত্তর দিকে আরবদের খোঁজ করে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় তারা তিনজনের পায়ের ছাপ দেখতে পায়। তিনজনের পায়ের ছাপের মধ্যে একজন মহিলার চটির ছাপ ছিল। জায়েদ তা দেখে বুঝল ওটা আতিজার চটির ছাপ।

এমন সময় ওরা দু’জন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। লোকদুটো সেই দিকেই আসছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল ফাঁদ। ফাঁদকে চিনতে পেরে তার কাছে ছুটে গিয়ে জায়েদ জিজ্ঞাসা করল, আতিজা কোথায়?

ফাদ ভয় পেয়ে গেল। বলল আমি জানি না।

জায়েদ রেগে গিয়ে তার ছোরাটা ফাঁদের বুকে আমূল বসিয়ে দিল। ফাঁদ সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ল। জায়েদ তখন তার ওয়াজিরি দল নিয়ে আবার উত্তর দিকে চল গেল।

এদিকে টারজান জিনালদার খোঁজ করতে করতে তার গন্ধসূত্র ধরে উত্তর দিক থেকে এসে সেই বনটায় ঢুকল। অবশেষে এক জায়গায় তোয়াতের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় তোয়াতের কাছ থেকে জানল জিনালদাকে একটা সিংহ ধরেছে।

টারজান জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

তোয়াৎ জায়গাটা দেখিয়ে দিলে টারজান সেখানে গিয়ে দেখল একটা মেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছে। মরার মত আর তার পাশে একটা সোনালী সিংহ বসে রয়েছে থাবা গেড়ে।

জিনালদা কার পায়ের শব্দ শুনে শুয়ে শুয়েই চোখ মেলে তাকাল।

টারজান সিংহটাকে দেখেই তাকে ডাক দিল, জাদ-বাল-জা, চলে এস এদিকে।

জিনালদা আশ্চর্য হয়ে দেখল এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ মানুষটি ডাক দিতেই সিংহটা তার কাছে পোষা কুকুরের মত ছুটে গেল।

টারজান এবার জিনালদার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমিই রাজকন্যা জিনালদা?

জিনালদা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

টারজান তাকে বলল, তুমি কি আহত? আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি তোমার বন্ধু। তোমার সঙ্গীরা কোথায়?

জিনালদা সব ঘটনার কথা বলল একে একে। পরে প্রশ্ন করল, কে তুমি, আমাকে চিনলে কি করে?

 টারজান বলল, আমি টারজান জেমন ব্লেকের বন্ধু। সে আর আমি তোমারই খোঁজ করছিলাম।

 জিনালদা উৎসাহিত হয়ে বলল, আপনি তার বন্ধু হলে আমারও বন্ধু।

টারজান হাসিমুখে বলল, আমি তোমাদের চিরকালের বন্ধু।

জিনালদা বলল, আচ্ছা স্যার টারজান, আমি বুঝতে পারছি না, সিংহটা আপনার কোন ক্ষতি করল না কেন এবং কেনই বা সে আপনার কথা শুনল।

টারজান বলল, ও হচ্ছে জাদ-বাল-জা বা সোনালী সিংহ। ওকে আমি বাচ্চাবেলা থেকে পালন করেছি। ও মানুষের কাছে বেশি থাকে বলে তোমার কোন ক্ষতি করেনি এবং আমাকে ভালবাসে।

জিনালদা বলল, আপনি কি নিকটেই কোথাও থাকেন?

টারজান বলল, না, আমি অনেক দূরে থাকি। আমার লোকজনরা কাছে কোথাও আছে বলেই সিংহটা তাদের সঙ্গে এসেছে।

সিংহটার কাছে টারজান জিনালদাকে রেখে তার জন্য কিছু ফল নিয়ে এল। জিনালদা তা খেয়ে সুস্থ হলো। তারপর জিনালদার হাঁটার শক্তি না থাকায় তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিমুরের পথে রওনা হলো। নগরের বাইরে সেই পাথরের ক্রসটার কাছে জিনালদাকে নামিয়ে দিল টারজান। তারপর জাদ-বাল-জাকে নিয়ে ব্লেকের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

আরবদের খোঁজ করতে করতে ব্লেকও ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। ঘোড়ায় চেপে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে দেখল একটা লোক শুয়ে আছে আর তার পাশে একটা চিতাবাঘ ওৎ পেতে বসে আছে। লোকটা মড়ার মত পড়ে থাকায় সে অপেক্ষা করছে লোকটা নড়লেই তাকে ধরবে।

ঘোড়র উপর থেকেই তার হাতের বর্শাটা চিতাবাঘের গায়ে সজোরে ছুঁড়ে দিল ব্লেক। বাঘটা সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল। ব্লেক তখন ঘোড়া থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়ে বলল, একি স্টিম্বল তুমি?

স্টিম্বল বলল, আমি এখন মরতে বসেছি ব্লেক। মৃত্যুর আগে সব কথা বলে যেতে চাই তোমায়। তুমি, এখানে কি করছিলে? নাইটদের মত বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্রই বা পেলে কোথায়?

ব্লেক বলল, এখন কিছু খাবারের জন্য নিকটবর্তী গায়ে নিয়ে যাব তোমাকে। আমি একবার সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে দেখে গাঁয়ের লোকেরা পালিয়ে যায়।

ব্লেক স্টিম্বলকে নিয়ে সেই আদিবাসীদের গায়ে চলে গেল। এবারেও গাঁয়ের লোকরা তাকে দেখে পালিয়ে গেল। ব্লেক প্রচুর খাদ্য পেল। স্টিম্বলকে পেট ভরে খাইয়ে সে তার ঘোড়াটাকেও খাওয়াল।

এমন সময় টারজনের ওয়াজিরি যোদ্ধারা সেখানে এসে হাজির হলো। তারা এসে ব্লেককে ইংরেজিতে বলল, তারা টারজনের লোক। তারা তাদের মালিকের খোঁজ করছে। যাই হোক, তারা সেই গাঁয়েতেই ব্লেককে নিয়ে রয়ে গেল। স্টিম্বল কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল। ব্লেক ভাবল এবার তাকে কোন। উপকূলে পাঠাতে আর কষ্ট পেতে হবে না।

শেখ ইবন জাদের দলের অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হয়ে উঠছিল। মালবাহকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার উপর তাদের পিছনে সর্বক্ষণ একটা সোনালী রঙের সিংহকে আসতে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তার মাঝে থেকে থেকে একটা কণ্ঠস্বর কানে আসছিল। তাদের, প্রতিটি রত্নের জন্য একফোঁটা করে রক্ত দিতে হবে তোমাদের। তবু ধনরত্নের লোভটা ছাড়তে পারছিল না শেখ।

হঠাৎ আবার একটা তীর এসে একজন মালবাহকের বুকে লাগল। লোকটা মারা যেতেই আবার সেই অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শেখ, তুমি নিজের সব ধনরত্ন তুলে নিয়ে বহন করতে থাক। তুমি নরহত্যা করে এই ধন লুণ্ঠন করেছ। তুমি হত্যাকারী। তোমার এই হলো শাস্তি।

বস্তা কাঁধে পথ চলতে পারছিল না শেখ। তার উপর তার পিছনে সিংহটা সমানে আসছিল। সে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। ..

তার এই অবস্থা দেখে আতিজা একটা বন্দুক হাতে তার বাবার কাছে এসে বলল, ভয় করো না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে আছি। আমি তোমাকে রক্ষা করব।

পথে যেতে যেতে ওরা একটা আদিবাসীদের গায়ে এসে উঠল। ওরা আর চলতে পারছিল না। সেই গায়েই ছিল টারজনের ওয়াজিরি যোদ্ধারা, জায়েদ, ব্লেক আর স্টিম্বল।

ওয়াজিরিরা আরবদের দেখে তাদের সব অস্ত্র কেড়ে নিল। ক্লান্ত ও ভীত অবস্থায় বাধা দিতে পারল না তারা। জায়েদ আরবদের বলল, ইবন জাদ কোথায়?

আরবরা বলল, পিছনে আসছে।

জায়েদ দেখল আতিজা তার বাবা শেখকে সঙ্গে করে সেদিকেই আসছে। সে ছুটে গিয়ে আতিজাকে জড়িয়ে ধরল। ওয়াজিরি যোদ্ধাদের দেখে ভয়ে মাটির উপর বসে পড়ল শেখ। ধনরত্ন ভরা বড় বস্তাটা পড়ে গেল তার হাত থেকে।

এমন সময় শেখের স্ত্রী হিরফা ভয়ে চীৎকার করে উঠল। সে দেখল একটা বড় সিংহকে নিয়ে দৈত্যাকার এক শ্বেতাঙ্গ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

টারজানকে দেখতে পেয়ে ব্লেক ছুটে এসে তাকে ধরল। বলল, দেরী হয়ে গেল টারজান, জিনালদা মারা গেছে।

টারজান হেসে বলল, বাজে কথা। আমি আজ সকালে তাকে নিমুর নগরীতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি।

ব্লেক বিশ্বাস করতে চাইছিল না। টারজান তাকে সব ঘটনা একে একে পরিষ্কার করে বললে সে শান্ত হলো।

পরদিন সকালে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। ব্লেক বলল, সে নিমুর নগরীতে ফিরে যাবে। রাজকন্যা জিনালদ্বাকে নিয়ে নিমুরের রাজপ্রাসাদেই বসবাস করবে। সে আর দেশে ফিরবে না। স্টিম্বলকে চারজন ওয়াজিরি আপাতত টারজনের বাংলো-বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে তার যাবার ব্যবস্থা করে দেবে টারজান।

জায়েদ আর আতিজাকে টারজনের বাড়িতেই কাজ করতে বলল টারজান। তার বাড়িতে রেখে দেবে তাদের। কিন্তু শেখকে ও বাকি আরবদের ক্ষমা করল না টারজান। ঠিক করল, আপাতত শেখদের ওয়াজিরি যোদ্ধাদের একটি দল একটা গায়ে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে ওদের আবিসিনিয়ায় নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *