জগদ্দলের জগাপিসি – প্রদীপ্ত রায়
হ্যাঁগা, দারোগাবাবু কোথায় গা?
ফাটা কাঁসরের মত খ্যানখেনে আওয়াজে চমকে উঠলেন জগদ্দল থানার ও-সি। মুখ তুলে তাকিয়েই চমৎকৃত হয়ে গেলেন। সামনে একটি বিচিত্র মূর্তি দাঁড়িয়ে! বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে মনে হয়। এই র্যাশনের যুগেও দেহটি দেখবার মতো। দু’হাত দিয়ে সেই মেদবহুল দেহের বেড় পাওয়া শক্ত। মাথার কাঁচা-পাকা খাটো চুল টেনে ব্ৰহ্মতালুর কাছাকাছি একটি বড়ি-খোঁপা। রং এককালে হয়তো ফর্সাই ছিল, এখন খয়েরী। একখানি খাটো থান ধুতি পরনে, গায়ে সেমিজের বালাই নেই। অলঙ্কারের মধ্যে গলায় তুলসীর মালা, আর দাঁতে মিশি।
তরুণ দারোগা হালে জগদ্দল থানায় বদলি হয়ে এসেছেন। তাই এ হেন মূর্তির সঙ্গে ইতিপূর্বে পরিচয় হয়নি। একটু থতিয়ে গিয়ে বললেন, আমিই দারোগা।
অ! তুমি!—মুখের ফাঁকে একসারি কালো কালো তরমুজের বিচি বেরিয়ে পড়ল। প্রৌঢ়াটি বললে, তা বাবা, একটি বিহিত করে দাও।
বসুন। আপনার নাম?
প্রৌঢ়া বললে, গোবিন্দ! গোবিন্দ! না বাবা, ছত্রিশ জাতের ছোঁয়া চেয়ারে বসতে পারব না। আমার নাম জগমোহিনী দেব্যা। পাড়ার নোকে ডাকে জগাপিসি।
দারোগা বললেন, কি হয়েছে বলুন।
চুরি হয়েছে বাবা—চুরি!
কি চুরি হয়েছে?
জগাপিসির ফাটা কাঁসরের মতো গলায় একটা আবেগ ঠেলে বেরোল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, নাড়ুগোপাল!
দারোগা হতভম্ব হয়ে বললেন, সে আবার কি?
ফাটা কাঁসর এবার জোরে খ্যানখ্যান করে উঠল : নাড়ুগোপাল কি জানো না? বলি, জাতে কি তুমি? হিঁদু তো?
অপ্রস্তুত হয়ে দারোগা বললেন, বুঝেছি। কি করে চুরি হল বলুন তো? ঘটনাটা কি?
জগাপিসি শুরু করলে, কাল ছেলো একাদশী, তাই ভেবেছিলুম ভোর ভোর উঠে গোপালের পুজো সেরে মুখে জল দেব। হায় রে, আমার পোড়া কপালের নেকন! ঘুম থেকে উঠে দেখি উঠোনে রোদ। ঠাকুর ঘরের দিকে নজর পড়তেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। দেখি, ঘরের দরজা হাঁ হাঁ করছে! রাতে শোবার আগে ঠাকুর ঘরের দরজায় কুলুপ লাগিয়ে তবে শুতে যাই। অথচ দরজা খোলা কেন? কে খুললে? পড়ি-কি-মরি করে ঠাকুর ঘরে ঢুকে দেখি, সব্বোনাশের মাথায় পা! আমার নাড়ুগোপাল নেই!
জগাপিসির দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে এল। আঁচলে মুছে আবার বলতে লাগল, কাঁদতে কাঁদতে মেঝেয় আছাড় খেয়ে পড়লুম। বললুম, কি দোষে আমায় ছেড়ে গেলি গোপাল? মা যশোদার কোল খালি করে কোথায় গেলি ধন? তারপর ভাবলুম, না, কেঁদে কিছু হবে না। এর বিহিত করতে হবে। তাই তোমার কাছে এসেছি বাবা।
দারোগা বললেন, আপনার নাড়ুগোপাল কিসের তৈরি? সোনারটোনার নাকি?
জগাপিসি বললে, না বাবা, কালো পাথরের। গেল বছর কাশী থেকে কেনা। তবে গোপালের হাতে আর গলায় সোনার গয়না গইড়ে দিয়েছিলুম।।
হুঁ।—দারোগা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চলুন, আপনার ঠাকুরঘরটা দেখে আসি।
ছোট্ট পুরোন বাড়ি জগাপিসির। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে একফালি উঠোন। তারই কোলে দালানের ওপর পুবমুখো ঠাকুরঘর।
ভেলভেট-পাতা কাঠের সিংহাসন দেখিয়ে জগাপিসি বললে, ওইখেনে আমার নাড়ুগোপাল ছেলো বাবা।
দারোগা দেখলেন, শূন্য সিংহাসনে কিছু শুকনো ফুল তুলসী পড়ে আছে শুধু।
জগাপিসি আরও অভিযোগ করলে, মুখপোড়া চোরে শুধু আমার গোপালকে নে যায়নি, গোপালের জন্যে ক’খানা বাতাসা আর তিলকুটো ছেল থালায়, তাও গিলে মরেছে গা!
দারোগা ততক্ষণে লক্ষ্য করে দেখেছেন, ঘরে মেঝেয় কোন পায়ের ছাপ নেই। গোপালের শোকে জগাপিসি যখন মেঝের ওপর আছাড় খেয়ে পড়েছিলেন, সম্ভবত জলহস্তীসদৃশ তাঁর দেহের গড়াগড়িতে যাবতীয় চিহ্ন লোপ পেয়েছে। তালাটা দরজার কড়ায় তখনও ঝুলছে। দারোগা বললেন, এ তালার চাবি কোথায় থাকে?
আমার শোবার ঘরে।—জগাপিসি বললে।
চাবিটা নিয়ে আসুন তো।
জগাপিসি চাবি এনে দিলে। চাবিটা সাবধানে তালায় ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে দারোগা বললে, তালা তো ঠিকই আছে। মনে হচ্ছে, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খোলা হয়েছিল। যাই হোক, তালাটা আমি নিয়ে যাই, এর গায়ে চোরের আঙুলের ছাপ পেতে পারি।
রুমাল দিয়ে মুড়ে তালাটা পকেটে রাখলেন দারোগা। জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে আর কে থাকে?
কে আর থাকবে বাবা? আমি আর গোপাল। তবে পাড়াপ্রতিবেশীরা—এই ধরো, পটলীর মা, কায়েত-বৌ, বিমলি, মানকে, ন্যাড়া—এরা সব আসে-যায়।
এদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?
জগাপিসি খ্যানখেনে গলায় বললে, না বাপু, না জেনে কাউকে সন্দ করব কেন? তুমি পুলিশ, তুমি চোর ধরে দাও, নইলে আর কিসের দারোগা হয়েছ?
দারোগা বললেন, দেখি সন্ধান করে। চোরকে পেলে খবর দেব।
কিন্তু একদিন দু’দিন করে সাতদিন কেটে গেল। খবর আর এল না।
নাড়ুগোপাল বিহনে জগাপিসির দিন-রাত সমান হয়েছে। গোপাল ছাড়া থাকা যায় না—বাঁচা যায় না।
পটলীর মা প্রভৃতি অনেকেই এসে সমবেদনা জানিয়ে গেল। ন্যাড়া কলকাতা গিয়েছিল, ফিরে এসেই জগাপিসির সঙ্গে দেখা করতে এল। ন্যাড়া পিসির বড় প্রিয়পাত্র। জগদ্দল স্টেশনের কাছে এক সাইকেল মেরামতের দোকানে কাজ করে। কিন্তু ছোকরা ভারি আমুদে আর সৌখিন। মাথায় রুখুচুলের বাবরি, গালে লম্বা জুলপি।
ন্যাড়া জিজ্ঞাসা করলে, দারোগা কি বলে গেল পিসি?
বলবে আর কি? বললে, চোরের সন্ধান পেলে খবর দেব।
চোরের সন্ধান পেয়েছে?
তেলে-বেগুনে জ্বলে জগাপিসি বললে, দূর, দূর। ড্যাকরা দারোগা কোন কম্মের নয়! চোর ধরবে না ছাই!
হেসে উঠে ন্যাড়া বললে, গোপাল তোমার বিন্দেবনে পাইলে গ্যাচে পিসি। এখন থেকে বাতাসা, মোয়া আর তিলকুটো আমাকে দিও, বুইলে?
জগাপিসি বললে, দূর হ মুখপোড়া! হ্যাঁরে, কলকেতা গিয়েছিলি কেন?
উত্তমকুমারের ইস্ত্রি দেখতে।
ইস্ত্রি! সে আবার কি র্যা?
সিনেমা গো, বাইশকোপ! গুরু যা একখানা পার্ট করেছে না, মাইরি পিসি, না দেখলে শ্লা জেবনই ব্রেথা!
আবেগের ঠেলায় ন্যাড়া ভ্যাড়ার মতো হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠল,
‘ও সে যতই কালো হোক, আমার ভাল লেগেছে
ও তার পটল-চেরা চক্ষু দিয়ে চাক্কু মেরেছে!’
জগাপিসির আর সহ্য হল না। খ্যানখেনে গলায় তেড়ে উঠে বললে, বেরো অনামুখখা, বেরো! সক্কালবেলা কোথায় গোবিন্দের নাম করব, ছোঁড়া কিনা খ্যামটা গাইতে এল! বেরো বলছি!
হাসতে হাসতে ন্যাড়ার প্রস্থান।
দিন দুই-তিন বাদে পাড়ার লোকে শুনল, জগাপিসি একটি নতুন নাড়ুগোপাল ঘরে এনেছে। এবার কাশী নয়, কেষ্টনগর থেকে। জগাপিসি নিজেই পাড়া-পড়শীদের কাছে খবরটা জানিয়েছে। নতুন গোপাল নাকি আরও সোন্দর! নাদুস-নুদুস চেহারা, মুখে মিটিমিটি হাসি। মরি মরি, দেখলেই কোলে নিতে সাধ হয়।
বিকেলে প্রতিবেশীরা বেড়াতে এল পিসির বাড়ি।
পটলীর মা বললে, বেশ করেছ পিসি, গোপালের জন্যে কেঁদে কেঁদে দেহ তোমার আধখানা হয়ে গ্যাচে।
ন্যাড়া মুচকে হেসে বললে, কী যে বলল মাইমা, পিসির ওই লাশ যদি আধখানা হয় তো বাচ্চু পালোয়ান খ্যাংরা কাঠি!
কায়েত-বৌ বললে, তা গোপালের গয়নাগাঁটি গড়াবে না?
খ্যানখেনে গলা নামিয়ে পিসি বললে, গড়িয়েছি মা, গড়িয়েছি। কথাটা পাঁচ কান করিস নে যেন। মাথায় মটুক, হাতে বালা, কোমরে গোটছড়া। দেড় ভরি সোনার গয়না দিয়ে গোপালকে সাজিয়েছি।
পটলীর মা চোখ কপালে তুলে বললে, দেড় ভরি!
পিসি বললে, আমার ঘরে ভোগ করবার কে আছে মা? যেটুকু আমার আছে, গোপালের সেবায় লাগুক!
তা পিসি, ঠাকুরঘরে তালা কেন গা? কেমন গোপাল আনলে, দেখাবে না?
দেখাব বৈকি! তবে এখন নয়। সামনের পুন্নিমায় ঘটা করে গোপালকে পিতিষ্ঠে করি, তখন দেখিস।
ন্যাড়া বললে, সেদিন মোয়া আর তিলকুটোর হরির লুঠ দিও!—হ্যাঁ পিসি, ঠাকুরঘরের দোরে অমন ফুচকে তালা লাগিয়ে রেখেছ কেন? আক্কেল হয়নি বুঝি? দেখো, তোমার গোপাল ফুস করে আবার বিন্দেবনে পাইলে না যায়!
জগাপিসি বললে, ঠিক বলেছিস রে! আজ আর হবে না, কালই একটা মজবুত কুলুপ কিনে লাগিয়ে দেব’খন।
সেই রাতেই—
রাত তখন দু’প্রহর পার হয়েছে। সপ্তমীর চাঁদ ঝাঁকড়া নিমগাছটার আড়ালে লুকিয়েছে। চারদিক নিশুতি, সাঁ সাঁ করছে। জগাপিসির উঠোনে ঝাপসা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গা মিশিয়ে, ছায়ার মতো একটা কালো পাতলা চেহারা চুপি চুপি পাঁচিল টপকালো। তারপর উঠোন পার হয়ে দালানে উঠে ঠাকুরঘরের সামনে দাঁড়াল। পকেট থেকে কি একটা জিনিস বার করে চাড় দিতেই, ছোট তালাটা গেল খুলে। সন্তর্পণে দরজা ঠেলে সে ঠাকুরঘরে ঢুকে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল জগাপিসির শোবার ঘরের কপাট। একটা হ্যারিকেন হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল স্বয়ং জগাপিসি। পা টিপে টিপে ঠাকুর ঘরের দোরগোড়ায় গিয়ে, খ্যানখেনে গলায় হাঁকলেন, কে র্যা?
আচমকা ফাটা কাঁসরের মতো আওয়াজ শুনে লোকটা চমকে ফিরে তাকাল। লণ্ঠনের আলো তার মুখে পড়তেই ফাটা কাঁসর ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল, অ মুখপোড়া, তুই ন্যাড়া! তোর এই কীর্তি! তিন পহর রাতে গোপাল চুরি করতে এসেছিস!
ন্যাড়া হেসে উঠল। তোৎলা হয়ে বললে, মা-মাইরি পিসি, তোমার ন্-নাড়ুগোপালের দিব্যি, চু-চুরি করতে আসি নি!
তবে কি করতে এসেছিস? বল্ মুখপোড়া!
ইয়ে—তি তিলকুটো সন্দেশ খেতে!
তপ্ত তেলে বেগুন ছাড়ার মতো ছ্যাঁক করে উঠল জগাপিসি ; বটে! গোপালই বা কোথায়, আর তিলকুটো সন্দেশই বা কোথায় রে মুখপোড়া? চোখের মাথা না খেয়ে দেখ্ না!
ন্যাড়া ঘুরে তাকাল। লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল, ভেলভেট পাতা কাঠের সিংহাসন আগের মতোই শূন্য! নতুন নাড়ুগোপালের চিহ্নও নেই, ভোগের থালাও খালি! তবে কি পিসি নতুন নাড়ুগোপাল আনে নি?
বোকার মতো হাঁ করে খানিক দাঁড়িয়ে রইল ন্যাড়া। তারপর হঠাৎ পিসির পাশ কাটিয়ে সট করে কেটে পড়ার চেষ্টা করতেই, জগাপিসি খপ করে তার বাবরি চুলের মুঠি ধরে তাকে একেবারে বগলদাবা করে ফেললে। ন্যাড়া বেরাল ছানার মতো ছটফট করতে লাগল।
জগাপিসি বললে, জগবাম্নিকে বোকা ঠাউরেছিস, না? তোর মতলব আমি বুঝি নে? একবার চুরি করে তোর আশ মেটে নি! মিথ্যে করে যেই বলেছি আবার গোপাল এনেছি, দেড় ভরি সোনার গয়না গড়িয়েছি, অমনি চোরের মত ফের ছোঁক ছোঁক করতে লেগেছে! দাঁড়া, তোর পিঠে আজ চ্যালাকাঠ ভাঙব! ড্যাকরা, অলপ্পেয়ে, উনুনমুখো!
হাউমাউ করে কেঁদে ন্যাড়া বললে, নাক-কান মলছি পিসি—অমন কম্ম আর করব নি! এবারটি ছেড়ে দাও!
বল্ আমার গোপাল কোথায়? বল্ মুখপোড়া!
পুকুরধারে গাবতলায় পুঁতে রেখেছি। ভোর হোক, এনে দেব।
আর গয়নাগুলো?
বেচে কলকেতায় ‘ইস্ত্রি’ দেখেছি, আর হোটেলে খেয়েছি—উঁহু-হু, বগলটা আর চেপো নি পিসি—প্রাণটা আমার বেইরে যাবে!
পরদিন একটু বেলায় থানার দারোগা এলেন জগাপিসির বাড়িতে। জানালেন, তালার গায়ে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এইবার চোর—
ফাটা কাঁসর বাজিয়ে জগাপিসি বলে উঠল, থাক মাণিক, ঢের হয়েছে! আর চোর ধরতে হবে না। আমার চোরকে আমিই ধরেছি। নাড়ুগোপালও ফিরে পেয়েছি।
দারোগা অবাক হয়ে বললেন, আপনি চোর ধরেছেন! কি করে ধরলেন?
জগাপিসি বললে, চোরকে লোভ দেখালেই ফাঁদে পা দেবে, এ তো জানা কথা! তাই একটা ফন্দি খাটিয়েছিলুম। এই জগবাম্নি অনেক দারোগার নাক কেটে দিতে পারে—হাঁ!
তারপর ব্যাপারটা সবিস্তারে বর্ণনা করলে।
দারোগা শুনে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন জগাপিসির পানে। তারপর যাবার আগে বলে গেলেন, সত্যি পিসি, এই অদ্ভুত গোয়েন্দাগিরির জন্যে আপনার পদ্মশ্রী পাওয়া উচিত!