জওহরলাল নেহরু (১৮৮৯-১৯৬৪) – ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ, যিনি স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বীয় শিক্ষাদীক্ষা, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শনের সঞ্জীবনী শক্তিতে ভারতের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই মহান পুরুষের নাম পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। পরাধীনতার গ্লানি বহন করে ভারতবর্ষ যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে,তার হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার জন্য যে কয়জন ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ নিরলস আত্মত্যাগ, তাঁদের মেধা ও মনন দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন ভারতের মাটিকে, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, নেহরু যৌবনের মূর্ত প্রতীক। সত্যিকার অর্থে সারা জীবনই তিনি ছিলেন চিরবসন্তের উজ্জ্বল প্রতীক। অসামান্য প্রতিভা, অমায়িক ব্যবহার, নির্মল আদর্শনিষ্ঠা এবং বিশ্বজনীন প্রীতি তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের আসনে।
জওহরলাল নেহরুর জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের এলাহাবাদে। পিতা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ও প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ পণ্ডিত মতিলাল নেহরু। মাতা ছিলেন স্বরূপরাণী।
একেবারে প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য পরিবেশে শিক্ষাজীবন শুরু হয় নেহরুর। জনৈক আইনবিদের কাছে হয় তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। তারপর ১৯০৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মা-বাবার সাথে চলে যান বিলেতে। সেখানে তিনি হ্যারো নামে বিখ্যাত এক স্কুলে ভর্তি হন। পরে ১৯০৭ সালে কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ট্রাইপস নিয়ে রসায়ন, ভূবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় তিন বছর পড়াশোনা করেন এবং ১৯১০ সালে ট্রাইপস-এ অনার্সসহ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি আইন অধ্যয়ন করার জন্য বার-এ ভর্তি হন। ১৯১২ সালে ইনার টেম্পল থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে স্বদেশে প্রত্যবর্তন করেন।
স্বদেশে ফিরে আইনব্যবসা শুরু করলেও তিনি অচিরেই রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। পরাধীন দেশকে মুক্ত করার সংগ্রাম তাঁকে ডাক দিয়ে যায়। তিনি সাড়া দেন দেশের ডাকে।
১৯১২ সালেই তিনি কংগ্রেসের বাঁকিপুর অধিবেশনে এবং পরের বছর ১৯১৩ সালে যুক্তপ্রদেশ কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯১৫ সালে সরকারের সংবাদপত্রের ওপর দমননীতির প্রতিবাদে তিনি সর্বপ্রথম এলাহাবাদে বক্তৃতা করেন। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম বক্তৃতা। তিনি ১৯১৬ সালে কমলা কাউরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই বছরেই তাঁর জীবনে ঘটে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কাশ্মির কংগ্রেসে সর্বপ্রথম মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। গান্ধি তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সফলকাম হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। ঠিক সেই সময়েই লখনউ কংগ্রেসে তাঁর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি মহাত্মার বিশাল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। তিনি সার্বিকভাবে অনুপ্রাণিত হন গান্ধির আদর্শে।
এর পর থেকেই তাঁর জীবন শুরু হয় নতুন পর্যায়ে। ১৯২১ সালে তিনি ইংল্যান্ডের যুবরাজ ও ভারতের ভাবী সম্রাট প্রিন্স অব ওয়েস্-এর ভারতভ্রমণ উপলক্ষে হরতাল আহ্বান করেন। এই অপরাধে জওহরলাল ও তাঁর পিতা মতিলাল নেহরু দুজনেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি ১৯২২ সালেও বিলাতি পণ্য বর্জন আন্দোলন পরিচালনা করার অভিযোগে কারাবরণ করেন।
১৯২৩ সালে তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৩০ সালে তাঁকে লবণ সত্যাগ্রহে যোগদানের অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এর পরও ১৯৩১ সালে এলাহাবাদ পরিত্যাগ না করার এবং কৃষক সম্মেলনে যোগদানের অপরাধে দুবছর, ১৯৩৪ সালে কলকাতায় তথাকথিত রাষ্ট্র বিরোধী বক্তৃতাদানের অভিযোগে দু’বছর, ১৯৪০ সালে সত্যাগহে যোগদানের অভিযোগে দুবছর এবং ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে প্রায় তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। এই সময় জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও কারাবাসজনিত তাঁর এই দুর্ভোগ ও ত্যাগই জনমানসে তাঁকে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করে।
১৯৪৫ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটেছে। নেতাজির নেতৃত্বে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সৈনিকদের লালকেল্লায় বিচার চলছে। এই দেশপ্রেমিক সৈনিকদের পক্ষ নেওয়ার জন্যই সুদীর্ঘকাল পরে পুনরায় আইনজীবীর পোশাক পরেন তিনি।
এর আগে তিনি ১৯৩৪ সালে বিহারে সংঘটিত প্রচণ্ড ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলায় গঠন করেন বিহার ভূমিকম্প ত্রাণ সংস্থা।
১৯৩৬ সালে জওহলাল নেহরু তাঁর রুগ্ণ পত্নী কমলা নেহরুর চিকিৎসার জন্য ইউরোপ গমন করেন। কিন্তু কমলা নেহরু রোগমুক্ত হলেন না। সেখানেই মারা যান তিনি।
নেহরু ১৯৩৫, ১৯৪১ এবং ১৯৪৬ সালে আরো তিনবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিষয় নিষ্পত্তির জন্য তিনি গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল ও লর্ড মাউন্টব্যাটেন-এর সঙ্গে আলোচনায় বৈঠক করেন। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে জওহরলাল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন।
যেদিন জওহরলাল স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সেদিন চারদিকেই ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। তিনি ভারতের শাসনব্যবস্থার হাল ধরেছিলেন খুব দৃঢ় হাতে। দীর্ঘ সতেরো বছর একটানা ভারত শাসন করে দেশ ও জাতির ললাটে তিনি পরিয়ে দিয়েছিলেন যৌবনের জয়টিকা। সারা দেশে করেছিলেন প্রাণসঞ্চার, ঘটিয়েছিলেন যৌবনের অভিষেক।
১৯৪৮ সালে তিনি লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদান করেন এবং জাতিসংঘে ভাষণ দেন। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেন।
১৯৫৩ সালে তিনি ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজবেথ-এর অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি সিংহলের রাজধানী কলম্বোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাধনমন্ত্রী সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনেরও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
১৯৪৮ সালে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি বহু ভারতীয় ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি শান্তিনিকেতনের আচার্যও ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ‘ভারতরত্ন’ উপাধি লাভ করেন।
জওহরলাল নেহরু তাঁর রাজনৈতিক কর্মবহুল জীবনেও স্বীয় সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে বিসর্জন দেননি। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজরেইলি ও উইনস্টন চার্চিলের মতো ছিলেন অসাধারণ সাহিত্যপ্রতিভার অধিকারী।
তাঁর রচিত ‘লেটারস ফ্রম ফাদার টু হিজ ডটার’ (Letters from father to his Daughter), ‘আত্মচরিত’ (Autobiography), ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি’ (Glimpses of World History), ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ (Discovery of India) শুধু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তিই নয়, তাঁর এসব গ্রন্থে তাঁর ইতিহাস-চেতনা ও দার্শনিকতারও সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বিধৃত। তিনি তাঁর জীবনের প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কারান্তরালে। এই মূল্যবান গ্রন্থগুলো সেখানে বসেই রচিত।
এই মহান পুরুষের মৃত্যু হয় ১৯৬৪ সালের ২৭ মে। আজও বিশ্ব ইতিহাসে তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সমুজ্জ্বল।
জওহরলালের মতো মহান প্রতিভা বিশ্বে সত্যি বিরল। তাঁর এই বহুমুখী প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁকে দুহাতে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, “আমাদের একমাত্র ভরসা তুমিই। তোমার পদচিহ্নই আগামীকালের পৃথিবীর কক্ষপথ।” আর রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ‘ঋতুরাজ’ বলে।