রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

জঁ-জাক্ রুসো (১৭১২–১৭৭৮) – ফরাসি বিপ্লবের রূপকার

জঁ-জাক্ রুসো (১৭১২–১৭৭৮) – ফরাসি বিপ্লবের রূপকার

যাঁর কলম প্রকৃতই প্রমাণ করেছিল Pen is mighter than sword, যাঁর কলমের তীব্র বাণীধারার আঘাতে খানখান হয়ে ভেঙে পড়েছিল ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পাষাণ-প্রাচীর বাস্তিল দুর্গ, তিনিই আঠারো শতকের প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক জঁ-জাক রুসো ( Jean Jacques Rousseau) |

রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী দার্শনিক রুসো ছিলেন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে একান্ত বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস ও আদর্শই তাঁকে স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী করে তুলেছিল এবং তাঁর অগ্নিময় ভাষা আর বক্তব্য তীব্র করে তুলেছিল ফরাসি বিপ্লবকে। সারা ফ্রান্সের মানুষ তাঁর প্রদর্শিত আদর্শে উদ্যোগী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অত্যাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের ওপর। সংঘটিত হয়েছিল বিশ্বের প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা, ইতিহাসখ্যাত ফরাসি বিপ্লব।

এই মহান দার্শনিকের জন্ম সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে ১৭১২ সালে। শিক্ষাজীবন শেষে প্রবেশ করেছিলেন সরকারি চাকরিতে। কিন্তু মনোনিবেশ করতে পারেননি। তাই এখান থেকে ওখানে এমনি করে কয়েকবার চাকরিও বদল করেন তিনি। কিন্তু কোথাও মন টেকেনি। অবশেষে চলে যান জন্মভূমি জেনেভার বাইরে।

কিন্তু বাইরেও কোথাও মন বসল না। তিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে। তবু স্থায়ীভাবে কোথাও বসতে পারলেন না। এই উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরিতে তাঁর একটি ব্যাপারে লাভ হলো প্রচুর। বহু দেশ আর বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে এসে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পূর্ণ হলো। আর এই বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান পরবর্তী সময়ে তাঁকে জুগিয়েছিল নতুন দার্শনিকচিন্তার খোরাক। তাঁর এই বিচিত্র ও বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ ‘কনফেশন্‌স্’ (Confessions)-এ।

সারা ইউরোপে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়ানোর সময়েই তাঁর জীবনে আসে মাদাম দ্য ওয়ারেন নামে এক সুন্দরী মহিলা। রুসো ওয়ারেনকে বিয়ে করেন। তাঁর দার্শনিক আদর্শে অনুপ্রাণিত ওয়ারেন স্বামীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু তা পারেননি। তার জন্য রুসো নিজেই দায়ী। দায়ী তাঁর চিরকালের ছন্নছাড়া আর চরে বেড়ানোর মনোভাব।

১৭৩৮ সালে রুসো একবার কঠিন অসুখে পড়েন। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য তখন তিনি অবস্থান করছিলেন আন্দিজ পর্বতমালার কাছাকাছি মন্টপেনিয়ার স্বাস্থ্যনিবাসে।

কিন্তু এখানেই ঘটে আরেক ঘটনা। তিনি এখানকার এক সুইস রমণীর প্রেমে পড়ে যান। ফলে তিনি অবহেলা করতে থাকেন সতীসাধ্বী স্ত্রী ওয়ারেনকে।

তারপর দীর্ঘদিন পরে যখন তাঁর মোহমুক্তি ঘটে, তখন তিনি আবার ফিরে যান ওয়ারেনের কাছে। কিন্তু গিয়ে দেখেন ওয়ারেন ততদিনে অন্য এক পুরুষকে নিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছেন।

তিনি এবার ধাক্কা খেলেন সত্যিকার বাস্তবের সাথে। এবার তাঁর জীবন সম্পর্কেও হলো সত্যিকার অভিজ্ঞতা। এরপর সেখান থেকে সোজা চলে এলেন প্যারিসে। তাঁর তখন এক চিন্তা, অর্থ উপার্জন করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে জীবনে। তিনি বুঝলেন, অর্থ ছাড়া জীবন অর্থহীন। অর্থোপার্জনের জন্য তিনি শুরু করলেন সাচিবিক কাজ আর সেইসাথে একটি অপেরা দলের সাথেও যুক্ত হলেন।

এরই মধ্যে তিনি থেরেসা লে ভেসিয়ার নামে এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসারও পেতে বসলেন। এই ভেসিয়ারের সাথে তিনি কাটিয়েছিলেন তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময়।

তখন ফ্রান্সে ছিল রাজতন্ত্রের দোর্দণ্ড প্রতাপ। চারদিকে অত্যাচার-অবিচারের সীমাহীন তাণ্ডব। ইন্দ্রিয়পরায়ণ সমাজব্যবস্থা দেশের সাধারণ মানুষকে করেছিল নিপীড়িত ও নির্যাতিত। তারা মানবিক অধিকার হারিয়ে পরিণত হয়েছিল পশুতে।

এই অস্বস্তিকর পরিবেশে চিন্তা-চেতনায় স্বাধীন এবং বৈপ্লবিক মনোভাবাপন্ন রুসো জনগণকে উদ্বুদ্ধ করলেন এক নতুন দর্শনে। আর তখন থেকেই তাঁর লেখনি থেকে উৎসারিত হতে লাগল নতুন চেতনা। তিনি একটি শোষণযুক্ত গণতান্ত্রিক এবং সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্য করতে লাগলেন পথনির্দেশ।

এই মহান আদর্শের ভিত্তিতেই তিনি ১৭৪৯ সালে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন অ্যাকাডেমি অব ডিজনে। তাঁর এই বিরুদ্ধ মতবাদসমৃদ্ধ প্রবন্ধ তৎকালীন ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়।

১৭৫০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ডিসকোর্স্ অন দি অরিজিন ডিসইকুয়ালিটি’ (Discourse on the origin of disequality)। এই গ্রন্থে তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্টের জন্য দায়ী করেন ধাতুর ব্যবহার ও কৃষিবিপ্লবকে। তিনি বলেন, মানবসভ্যতার অগ্রগতি এবং ব্যক্তিমালিকানাই সব সামাজিক বৈষম্যের কারণ।

রুসোর এই গ্রন্থ পাঠ করে তৎকালীন আরেক মহান ব্যক্তিত্ব ভলতেয়ার খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি রুসোর এই বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করতে পারেননি। এই নিয়ে সমসাময়িক দুই পণ্ডিত—রুসো এবং ভলতেয়ারের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিষম তিক্ততার। ভলতেয়ার রুসোকে বলতেন ‘পাগল’; আর রুশো ভলতেয়ারকে গাল দিতেন ‘অধর্মের ঢোলক’ বলে।

রুসোর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ (Social Contract) প্রকাশিত হয় ১৭৬২ সালে। এই গ্রন্থেই তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র একটি মন্দ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মানুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির জন্য, তাদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এটার প্রয়োজন আছে। তিনি আরও বলেছেন, রাষ্ট্র একটি সামাজিক চুক্তি। এই চুক্তির ফলে সমাজের সকল মানুষ তাদের অধিকারসমূহ সমাজের কাছে অর্পণ করেছে, তাই রাষ্ট্রগঠন সম্ভব হয়েছে। এই বইখানা দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

তাঁর আরেকখানি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এমিলি’ প্রকাশিত হয় ১৭৬৭ সালে। বইখানি প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ড থেকে। এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা ইউরোপ জুড়ে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। ফলে ফ্রান্সের রাজা রুসোর ওপর এতই খেপে যান যে, তিনি বইখানার সমস্ত কপি পুড়িয়ে ফেলার এবং রুসোকে কারাগারে নিক্ষেপ করার আদেশ দেন।

তখন রুসো বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু সেখানেও তিনি টিকতে পারলেন না। শত্রুরা সেখানেও তাঁর পিছু নেয়। তারা তাঁকে নাস্তিক ও বিকৃতচরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তি বলে প্রচার করতে থাকে।

এরপর এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি পালিয়ে যান মার্টিয়াস নামের এক নিভৃত গ্রামে। সেখানেও তিনি নিশ্চুপ বসে থাকতে পারলেন না। তিনি গির্জাকে আক্রমণ করে এক জ্বালাময়ী প্রবন্ধ লিখলেন। ফলে গির্জার ধর্মগুরুরাও গেল খেপে। তাই সেখানেও তিনি টিকতে পারলেন না। চলে এলেন আবার ইংল্যান্ডে।

১৭৮২ সালে প্রকাশিত হয় রুসোর বিখ্যাত আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ ‘কনফেশন্‌স্‌’। এই গ্রন্থে ফ্রান্সের রাজসিংহাসনের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ায় তিনি আবারও রাজরোষের শিকার হন। তবে বইখানি জনমনে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

তিনি ‘লা রেভারিস’ নামেও একখানি বই লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এ গ্রন্থে তিনি নিজের জীবনের নিঃসঙ্গতা এবং অসহায়ত্বের কথা বর্ণনা করেছেন।

আসলে রুসোর শেষ জীবনটা সত্যি খুব সুখের ছিল না। এই সময় তিনি শত্রুর ভয়ে সর্বক্ষণ প্রায় ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন কাটাতেন। তাঁর কোনো নিকট আপনজনের সাথেও খুব একটা সংস্রব ছিল না তাঁর। এমনকি তাঁর নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী মাদাম ভেসিয়ারের সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল।

শেষ জীবনে অনেক ব্যর্থতা, দুঃখকষ্ট আর রোগে ভুগে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে রুসো মৃত্যুবরণ করেন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায়। কেউ কেউ বলেন, তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সম্ভবত তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *