ছোট রাজার পোষ্য – সৈকত মুখোপাধ্যায়
ফোয়ারাপুকুরের পাশের ছোটো ঘরটাকে সবাই জলটুঙ্গিই বলত। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও ওই মার্বেলের ফোয়ারার মুখ থেকে দুধের ফেনার মতন জল উথলে উঠতে দেখেছেন ছোটো রাজা জিতসুন্দর মহাবল। পাথরের লতাপাতার গা বেয়ে সেই জল এসে পড়ত ফোয়ারাপুকুরে।
জলটুঙ্গির শীতল ছায়ার বসে জিতসুন্দরের বাবা মহারাজা শ্যামসুন্দর মহাবল আর মহারানি করুণাময়ী গ্রীষ্মের বিকেল কাটাতেন। তবে সেআরও আগের ঘটনা। তখন মোহনপুরের রাজা ছিলেন সত্যিকারের মহারাজা। তারপর তো ভারত স্বাধীন হল। মোহনপুরের মতন ছোটো ছোটো স্বাধীন রাজ্যগুলো ভারতের সঙ্গে মিশে গেল। ব্যাস, রাজাগিরি শেষ। রাজা বা রানি কেউই তারপর আর বেশিদিন বাঁচেনি।
জিতসুন্দর ওই জলটুঙ্গিতে একা একা বসে দেখতেন ফোয়ারা থেকে কেমন জল ঝরে যাচ্ছে। ততদিনে দুধসাদা মার্বেল হলুদ হয়ে এসেছে। ফোয়ারা পুকুরের স্বচ্ছ জলে গুঁড়ি গুঁড়ি কচুরিপানার সবুজ আস্তরণ।
তারপর একদিন ফোয়ারা থেকে জল পড়াও বন্ধ হয়ে গেল।
তবে পাথরের তৈরি জলটুঙ্গি, পাথরের টালি দিয়ে বঁাধানো ফোয়ারাপুকুর আর পাথরের লতাপাতায় মোড়া ফোয়ারা,— এগুলো সব রয়ে গেল। রয়ে গেলেন মোহনপুরের বিশাল রাজবাড়িতে একা যুবরাজ জিতসুন্দর। রাজত্ব নেই বলে যার আর কোনোদিনই বড়ো রাজা হওয়া হল না; চিরকাল ছোটো রাজা হয়েই রয়ে গেলেন। আজ এই আশি বছর বয়সেও তিনি মোহনপুরের মানুষের কাছে ছোটো রাজা।
অবশ্য মাঝের এই বছরগুলোতে জিতসুন্দর একা ছিলেন বলাটা বড়ো ভুল। মানুষ সঙ্গী ছিল না ঠিকই, কিন্তু সঙ্গী ছিল তার পোষ্যরা। অনেকদিন অবধি তারা ছিল। যতদিন কেনবার সামর্থ্য ছিল, তাদের কিনেছেন। যতদিন তাদের খাওয়ানোর সামর্থ্য ছিল খাইয়েছেন। সেই কোন ছোটোবেলার নেশা—জংলি জীব পোষা। সহজে ছাড়া যায় কি?
এখনও আছে কয়েকজন, তবে তারা আড়ালে থাকতেই পছন্দ করে। দেখাশোনাও বিশেষ করতে হয় না। তারা অনেক স্বাবলম্বী।
আজকেও তো, ওই লোক দুটো তাকে ধাক্কা মেরে জলটুঙ্গির মধ্যে ঢুকিয়ে যখন দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল, তখন ওদের মধ্যে একজন বেশ ব্যাঙ্গের সুরেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি ছোটোরাজা, এখন আর কিছু পুষছ টুষছ না? সাপ? কাঁকড়াবিছে, চিতাবাঘ?’
আরেকজন তাই শুনে বলল, ‘বাপস! ছোটোবেলায় কি ভয়ই না পেতাম এদিকটায় আসতে। রাতেরবেলায় আমাদের বস্তি থেকেও শোনা যেত নানারকম জন্তু-জানোয়ারের চিৎকার। আজব নেশা ছিল বটে ছোটো রাজার। তারপর লোকটা মিছিমিছি চারদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সাচ সাচ বাতাইয়ে ছোটা সরকার, কুছ হ্যায় ইয়া নেহি।’
তারপর দু-জনেই হা হা করে হেসে উঠল। জলটুঙ্গির দরজায় শেকল তুলে দিয়ে চলে গেল ভাঙা রাজবাড়ির কোথায় কি লুঠ করার মতন সামগ্রী এখনও অবশিষ্ট আছে, তাই খুঁজতে, আর জিতসুন্দর মহাবল মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘যদি কিছু থাকেই, তাহলেও তোদের তা বলতে যাব কেনরে? ছ্যাঁচড়া ডাকু যত। বুড়ো মানুষের গায়ে হাত দিতে লজ্জা করে না?’
আশি বছর বয়সে বোধহয় কোনো অনুভূতিই বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না, এমনকী রাগও নয়। তাই একটু বাদেই জিতসুন্দর একটা থামে হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। ডাকাত দুটো তার হাত-পা মুখ কিছুই বাঁধেনি। প্রয়োজন নেই বলেই বাঁধেনি। এই দেডশো বছরের পুরোনো ভাঙাচোরা রাজপ্রাসানের বাইরে দশ বিঘের বাগান, দু-মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ছোটো রাজা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচালেও ওই বাগান পেরিয়ে লোকালয়ে তার গলার আওয়াজ পৌঁছবে না, সেটা ওই ডাকু দু-টো ভালো করেই জানে।
ওরা এটাও জানে যে, ছোটো রাজার একমাত্র সহায় বুড়ো চাকর ভানুদেও আজ দুমকা গেছে নাতনির ছেলের ভূজনোয়। ‘সেছাড়া আর কারুর বয়েই গিয়েছে ছোটো রাজার খোঁজ নিতে আসার।
এসব কথা জিতসুন্দরও জানেন। জানেন যে চেঁচামেচি করলে তার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না। তাছাড়া ডাকু দু-টো নেবেই বা কী? হয়তো দু-টো লোহার রেলিং খুলে নেবে, বা একটা সেগুন কাঠের দরজা। সোনা-দানা, দামি দামি মূর্তি, ফুলদানি, পুরোনো আমলের পেইন্টিং—সেসব তো তিনি নিজেই এতবছর ধরে বেচে খেয়েছেন। নিজে খেয়েছেন। যতদিন পারেন, তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় পোষ্যদেরও খাইয়েছেন। এখন এই বাড়ি আর বাগান ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একটাই বঁাচোয়া যে, এই পৃথিবীতে তিনি একদম একলা। আর কারুর পেট ভরাবার চিন্তা তাকে করতে হয় না। ভাদুদেও বাগানে সবজির চাষ করে। সেই সবজি বাজারে বিক্রি করে। তার বদলে ছোটো রাজাকে দুবেলা রান্না করে খাইয়ে যায়। দরকার মতন ডাক্তার ওষুধের ব্যবস্থা করে। ঠিকই আছেন, বেশ আছেন ছোটো রাজা। কোনো অসুবিধে নেই তার।
সময় কাটে কেমন করে?
কেন, সেই কৈশোর থেকে শুরু করে যত পোষ্যকে তিনি কোলে-পিঠে করে বড়ো করেছেন, তাদের কথা ভাবেন বসে বসে। সেসব স্মৃতি একটুও নষ্ট হয়নি তার। বরং যতদিন যাচ্ছে, ততই আরো যেন উজ্জ্বল হচ্ছে তাদের ছবি।
জলটুঙ্গির পাথরের থামে হেলান দিয়ে বসে আবার সেরকমই স্মৃতির পুকুরে ডুব দিলেন ছোটো রাজা জিতসুন্দর মহাবল।
প্রথম এসেছিল রোরো,—চিতাবাঘ। তখন ছোটো রাজার বয়েস বোধহয় বছর পনেরো হবে। মায়ের সঙ্গে দলমা পাহাড়ের কোলে মুক্তকেশী কালীর মন্দিরে গেছেন। পঁয়ষট্টি বছর আগে সেই মন্দিরের চারপাশে ছিল ঘন জঙ্গল। মা দাসদাসীদের নিয়ে মন্দিরের ভেতরে পুজোর জোগাড় করছেন, আর জিতসুন্দর মন্দিরের বাইরের শালগাছে ছাওয়া লাল কাঁকরের রাস্তা ধরে পায়চারি করতে করতে পৌঁছে গেছেন মন্দিরের পেছনের আদিবাসী বস্তিতে। হঠাৎই দেখেন ক-টা আদিবাসী ছেলে একটা চিতাবাঘের ছানাকে গলায় দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। জিজ্ঞেস করতে জানাল, ওরা বাচ্চাটাকে পেয়েছে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে একটা পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির খোঁদলে।
বাচ্চাটার বয়েস বোধহয় মাসদুয়েক হবে। তখনই কী তেজ। সারাক্ষণ রাগি বেড়ালের মতো মুখে ফ্যাঁসস ফ্যাঁসস আওয়াজ করছে, আর ছোটো ছোটো থাবা তুলে হাওয়ায় ঝাপটা মারছে।
কিন্তু কী আশ্চর্য, জিতসুন্দর তার সামনে বসে মুখে হালকা একটা শিস দিতেই সেই বুনো বাচ্চা এক্কেবারে শান্ত। জিতসুন্দর নিজের আঙুলটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরতেই করকরে গোলাপি ভিজ দিয়ে তার আঙুলটা চেটে দিল চিতাবাঘের ছা।
জিতসুন্দর মায়ের কাছে তুমুল বায়না করে সেই বাচ্চাকে মোহনপুর রাজবাড়িতে নিয়ে এল। রাজা শ্যামসুন্দর একটু অবাক হলেও ব্যাপারটা মেনে নিলেন। মোহনপুর রাজবাড়ির তখন জমজমাট চেহারা। সেখানে একটা পোষা বাঘ থাকলে ভালোই মানিয়ে যাবে, এমনটাই হয়তো ভেবেছিলেন মহারাজ শ্যামসুন্দর। বাড়ির মধ্যে অবশ্য নয়, রোরোর থাকার জায়গা হল বাগানের সবচেয়ে দূরের কোণাটাকে উঁচু লোহার রেলিং দিয়ে ঘিরে।
বনের জানোয়ারকে যেমন ঘরে নিয়ে এলেন, তেমনি ছোটো রাজা নিজেও তারপর থেকে যখন খুশি চলে যেতে লাগলেন বনে। মোহনপুর আর দলমার জঙ্গলের মধ্যে তখন তেমন দূরত্ব তৈরি হয়নি। রাজবাড়ির পনেরোটা বিদেশি গাড়ির মধ্যে থেকে ছোটো রাজা নিজের জন্যে একটি উইলি জীপ বেছে নিয়েছিলেন। সেইটা চালিয়ে যতটা পারতেন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যেতেন। যেখানে গিয়ে উইলিও অচল হয়ে যেত, সেখান থেকে শুরু করতেন পায়ে হাঁটা। কখনো আদিবাসী মানুষ তার সঙ্গী হত, কখনো একদম একা।
এইরকমই এক যাত্রায় পেয়েছিলেন কালোমানিককে। শঙ্খচূড়ের বাচ্চা। বেজির পাল্লায় পড়েছিল। ছোটো বলেই বেঁজি সাহস পেয়েছিল কাছে ঘেঁষতে। পূর্ণবয়স্ক শঙ্খচূড়কে দেখলে হাতি বা বাঘও রাস্তা ছেড়ে দেয়—এমনই বিশাল, বিষাক্ত আর ক্রোধী সেই নাগরাজ। লোকে বলে শঙ্খচূড় সাপ নাকি এমনই রাগী যে, মাটির ওপর উড়ন্ত পাখির ছায়াকেও তেড়ে গিয়ে কামড়াতে চায়। তা, জিতসুন্দরের যত্নআত্তিতে কালোমানিকও হয়েছিল ঠিক তেমনি। দশফুট লম্বা। হিসস হিসস গর্জন…ঠিক যেন কানাডিয়ান রেল ইঞ্জিনের স্টিম ছাড়ার শব্দ। কালোমানিককে বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারেনি। রানি করুণাময়ী ছেলের অপঘাতে মৃত্যুর আশঙ্কাতেই বোধহয় নিজেই অসুখ বাধিয়ে বসলেন। দুরারোগ্য কোনো অসুখ। তিনি যখন মারা গেলেন, তখন ছোটো রাজার বয়েস ষোলো পেরিয়ে সতেরোর দিকে চলেছে।
তার পর পরই ভারতের স্বাধীনতালাভ, দেশীয় রাজাদের রাজত্বের অবলুপ্তি আর হৃদরোগে রাজা শ্যামসুন্দর মহাবলের মৃত্যু, সবই খুব দ্রুত ঘটে গেল।
ততদিনে হিংস্র, বিষাক্ত, ধূর্ত পশুপাখি আর পোকামাকড় পোষার নেশাটা জিতসুন্দরের রক্তের গভীরে বাসা বেঁধেছে। উপরন্তু রাজা শ্যামসুন্দরের বিপুল সম্পত্তির তিনি ছাড়া আর কোনো দাবিদার ছিল না। ফলে সেই নেশার পেছনে জলের মতো পয়সা ঢালতে লাগলেন ছোটো রাজা।
আঃ, কী সব দিন গেছে তখন। সারা পৃথিবীর বন্যপশু সংগ্রাহকদের কাছে মোহনপুরের ছোটো রাজার নাম পরিচিত ছিল। তার বিচিত্র পছন্দের কথাও জানত সবাই। যত হিংস্র, যত নিষ্ঠুর, যত বেশি বিষাক্ত হবে কোনো পশু বা পাখি বা পোকা, ততই তার জন্যে দাম দেবেন মোহনপুরের ছোটো রাজা।
আরে বাবা, ময়ূর, পায়রা, কুকুর, ঘোড়া—এরা তো জন্ম থেকেই মানুষের ন্যাওটা। এদের পোষার মধ্যে কী যে মজা আছে, তা তো এখনো ভেবে পান না ছোটো রাজা। কিন্তু একটা গলিয়াথ মাকড়শা তার রোমশ বাদামি আটটা ঠ্যাং আর তীক্ষ্ণ চোয়াল নিয়ে যখন হাতের পাতার ওপর শান্তভাবে বসে থাকে, তখন একইসঙ্গে গা শিরশিরানো আর খুশি মেশানো যে অনুভূতিটা, তা কি ওই ময়ূর, হরিণ পুষে কখনো পাওয়া যায়?
আফ্রিকা থেকে একটা বেবুন এসেছিল একবার, সেব্যাটা মরা পশুপাখির মাংস দিলে খেত না। তার জ্যান্ত প্রাণী চাই। নিজের হাতে মেরে তারপর খাবে। এমন মাংসভুক বেবুনের কথা শোনেনইনি তার আগে জিতসুন্দর।
তার সেইসব পোষ্যরা তাকে যে আনন্দ এককালে দিয়েছে, তার কথা ভেবে এখনো ঠোঁটের কোণে একটা সুখের হাসি ফুটে উঠল জিতসুন্দরের—যদিও ডাকাত দুটো তার হাত মুচড়ে ধরায় তার ডানহাতের কবজিটা ফুলে গেছে, যদিও আজ এই বেলা তিনটে অবধি তার পেটে একটা দানাও পড়েছি, তেষ্টাতেও গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তিনি সব ভুলে আবার স্মতিচারণায় ডুবে গেলেন।
ব্ল্যাক মাম্বাও পুষেছিলেন তিনি—আফ্রিকায় যাকে যমের দোসর ভাবা হয়, সেই ব্ল্যাক মাম্বা সাপ। তাকে তার এজেন্ট যেটা এনে দিয়েছিল, সেটা ছিল আট ফুট লম্বা। সেটাকে দেখার আগে অবধি ছোটো রাজা ভাবতেন, ব্ল্যাক মাম্বার গায়ের রং বোধহয় কালো, তাই এরকম নাম। দেখলেন মোটেই তা নয়। তার পোষা সাপটার রং যেমন ছিল হালকা সবুজ। শুনলেন ছাই কিম্বা খাকি রঙের মাম্বাও পাওয়া যায়। ওদের নামের সঙ্গে ‘ব্ল্যাক’ কথাটা জুড়ে গেছে ওদের মুখের ভেতরের কুচকুচে কালো রঙটার জন্যে। ব্ল্যাক মাম্বা কাউকে যখন ছোবল মারার জন্যে হাঁ করে, তখন ওই কালো রংটাকে মৃত্যুর রং বলেই মনে হয় নিশ্চয়। ছোটো রাজা তার জন্তু-জানোয়ারদের দেখাশোনা করার জন্যে এক প্রাক্তন সার্কাস কর্মচারীকে মাইনে দিয়ে রেখেছিলেন। নাম ছিল সওদাগর। ব্ল্যাক মাম্বা আসার পর সেচাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। কিছুতেই তাকে আটকানো যায়নি। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, সেই সাপটাকেও তিনি সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মুর্গি খাওয়াতেন। কই, কোনোদিন তো তাকে তেড়ে আসেনি।
তার পোষ্যদের কাছ থেকে ছোটো রাজা এই শিক্ষাটা পেয়েছেন, যে জন্তুরা ওরকম অকারণে কাউকে মারে না। খিদে পেলে কিম্বা ভয় পেলে তবেই ওরা আক্রমণ করে।
কিন্তু মানুষরা কী করে? ওই তো দোতলায় দুজনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বোধহয় মার্বেলের কোনো টালি শাবল দিয়ে খুঁড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আওয়াজ হচ্ছে দুমদাম করে। ওই মানুষ দুটো তো দিব্যি আরেকটা অসহায় মানুষকে আক্রমণ করে বসল। যাগগে, ওদের কথা যত কম ভাবা যায়।
ছোটো রাজা নিজেও কত জায়গায় গেছেন জন্তুর খোঁজ পেয়ে। এই তো মাত্র বছরদশেক আগে। বিক্রি করতে করতে তখন পুরোনো সোনাদানা সব শেষ। জমিজমাও আর বেশি বাকি নেই। তবু কে যেন কানে তুলে দিল, আর্জেন্টিনায় সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ার ব্যাট পাওয়া যায়। রক্তচোষা বাদুড়। ব্যাস চলে গেলেন আর্জেন্টিনা। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে নিয়েও এলেন দুটো রক্তচোষা বাদুড়। প্রথম তাদের দেখে অবশ্য একটু হতাশই হয়েছিল, —আকারে খুবই ছোটো, চামচিকের থেকে হয়তো সামান্য বড়ো হবে। দেখতেও মোটেই ভয়ংকর নয়, বরং কোনো কার্টুন চরিত্রের মতন মিষ্টি। বাঁেচা নাক, জ্বলজ্বলে পুঁতির মতন চোখ। কিন্তু যে লোকটা ওদের ধরে নিয়ে এসেছিল, সেরাত গভীর হতেই ওদের আস্তাবলে ছেড়ে দিল, আর ওরাও ইঁদুরের মতন মাটির ওপর দিয়ে খুরখুর করে হেঁটে গিয়ে একটা ঘোড়ার পেছনের পায়ে নিজেদের ধারালো দাঁত দিয়ে গর্ত করে চেটে চেটে রক্ত খেতে লাগল। তাই দেখে তো ছোটো রাজা একেবারে মুগ্ধ।
অনেকদিন সেই দুই পোষ্য, সেই টম আর জেরী, তার কাছে ছিল। তবে ওরা তো এমনিতেই বেশিদিন বাঁচে না।
সেইবারেই, সেই আর্জেন্টিনা সফরেই তার শেষ জমিটুকু বিক্রি হয়ে গেল। যাকে বলে সত্যিকারের কপর্দকশূন্য হয়ে পড়লেন ছোটো রাজা। এখনো মাঝে মাঝে ভাবেন, অমন করে কি তিনি ভুল করেছিলেন? পরক্ষণেই নিজের বুকের মধ্যেই প্রতিবাদ শুনতে পান, কীসের ভুল? টম আর জেরীকে জানোয়ারের চামড়ায় দাঁত বসিয়ে দিতে দেখার সেই আনন্দ… তার কোনো দাম হয় নাকি?
দাম হয় না বলেই, তারপরেও একবার একঝাঁক পোষ্যকে নিয়ে এসেছিলেন এই বাড়িতে। সেই শেষ। ওরাই তার শেষ পোষ্য। কিন্তু বড়ো বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল তার জন্য।
একটা বিদেশি জার্নালে পড়েছিলেন তাদের কথা, তাদের হিংস্রতার গল্প। ওই ম্যাগাজিনেই লিখেছিল যে, এখানেও, মানে ভারতে ঠিক নয়, বাংলাদেশের কাপ্তাইয়ে ওরা নাকি দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে, বংশবৃদ্ধি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে জিতসুন্দরের মাথার পুরোনো পোকা আবার নড়ে উঠল। এজেন্টকে ফোন করলেন, আমার ওই জিনিস চাই।
পুরোনো এজেন্ট। সেজিতসুন্দরের আর্থিক অবস্থা জানত। আমতা আমতা করে বলল, অনেক খরচার ব্যাপার ছোটো সরকার। তারপরে কাজটা বেআইনিও বটে। পুলিশে জানতে পারলে আমি-আপনি দু-জনেই হাজতে চলে যাব…’
‘খরচ নিয়ে ভেব না।’ ফোনটা কানে ধরে রেখেই জিতসুন্দর তাকিয়েছিলেন রাজবাড়ির দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা সারি সারি পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতির দিকে। খাঁটি সোনার পাতে মোড়া আঠোরোটা অয়েল পেন্টিং-এর আঠোরোটা বিশাল বিশাল ফ্রেম। তার মধ্যে একটা প্রতিকৃতি তার বাবার—শ্যামসুন্দর মহাবলের। আর একটা রানি করুণাময়ীর। তা হোক। এইসব মানসিক দুর্বলতার মানে হয় না। তিনি দ্বিগুণ তেজে বললেন, খরচের ব্যাপারটা নিয়ে ভেবো না। আর ওদের রাখব আমার বাড়ির ভেতরে। কাকপক্ষীও টের পাবে না, তো পুলিশ।
সেই শেষ এ প্রাসাদে কোনো পোষ্য ঢুকেছিল। অবশ্য খালি দেয়ালগুলোর দিকে তাকালে এখনো বড়ো অস্বস্তি হয়।
চুপ করে বসে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখ দুটো জুড়ে এসেছিল ছোটো রাজার। হঠাৎই সেই লোক দুটোর চিৎকারে ঘুমের চটকা ভেঙে গেল তার। কী বলছে ওরা?
বাপবাপান্ত করছে ছোটো রাজার। তাদের এত পরিশ্রম নাকি বৃথাই গেছে। কিছুই নেবার মতন পায়নি। শুধু এইটা ছাড়া। ‘ওকে রেখে দাও। ছোঁবে না। ছোঁবে না বলছি ওকে।’ ক্ষিপ্ত মাম্বার মতনই জিতসুন্দরের বসে থাকা শীর্ণ শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল জলটুঙ্গির ভেতরে। দরজায় শেকল তোলা না থাকলে তিনি নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওই দুই ডাকাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
‘রেখে দিয়ে যাও ওকে এ এ এ’… আবার চিৎকার করে উঠলেন তিনি।
না করেই বা করেন কী? ওরা যে রোরোকে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, রোরোকে…তার প্রিয় বন্ধু, তার প্রথম পোষ্য রোরোর মাউন্ট করা শরীরটাকে নিয়ে ওরা নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে।
রোরোর মৃত্যুর পর তার শরীরটা তিনি লণ্ডনের এক বিখ্যাত ট্যাক্সিডার্মিস্টকে দিয়ে মাউন্ট করিয়ে এনেছিলেন। রোরো গুঁড়ি মেরে বসে আছে, যেন ছোটো রাজা একবার ‘রোরো ও ও’ বলে ডাক দিলেই সেলাফিয়ে তার কাছে চলে আসবে। আবার আগের মতন তার দুই কাঁধে থাবার ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার গাল চেটে দেবে।
বেঁচে থাকার জন্যে, পোষ্যদের বঁাচিয়ে রাখার জন্যে তার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন জিতসুন্দর, কিন্তু রোরোর এই মাউন্ট করা শরীরটা কিছুতেই প্রাণে ধরে বিক্রি করতে পারেননি, যদিও বহু টাকার প্রস্তাব এসেছে ওটা কিনবার জন্য।
আর আজ ওরা ওই স্ট্যাচুটাকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে!
ছোটো রাজার চিৎকার শুনে ডাকাত দুটো এক মুহূর্ত অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারপরেই ব্যাপারটা ওদের মাথায় ঢুকল। খুব নিষ্ঠুর একটা হাসি হাসতে হাসতে ওরা এগিয়ে এল জলটুঙ্গির পাথরের জাফরি ঘেরা দেয়ালের সামনে। বেড়াল যখন ইঁদুরকে মুঠোর মধ্যে পায়, তখন মেরে ফেলার আগে তাকে নিয়ে যেমন কিছুক্ষণ খেলা করে, সেইভাবেই তারা জিতসুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বুড়ো? পোষ্যর জন্যে কষ্ট হচ্ছে না কি?’’ বলেই একটা শাবল তুলে একজন রোরোর স্ট্যাচুটার পিঠে বাড়ি মারল।
‘না, না। তোমাদের পায়ে পড়ি…।’ নিজের কথাটা নিজের কানে যেতেই চমকে থেমে গেলেন জিতসুন্দর। কী বললেন তিনি! তিনি মোহনপুরের ছোটো রাজা, —ওই সামান্য দুটো লুঠেরাকে বললেন, ‘পায়ে পড়ি’! কিন্তু আর কীই বা করতে পারেন তিনি? এরা করুণা না করলে কে বঁাচাবে রোরোকে? তাকেই বা কে বঁাচাবে?
‘কেন, তোমার পোষ্যরা? তুমি তাদের জন্যে জীবন দিয়ে দিয়েছ, আর বিপদের সময় তারা তোমায় দেখবে না?’ কে যেন ছোটো রাজার মাথার ভিতর ফিসফিস করে বলে উঠল।
‘তাই তো। তাই তো’ হঠাৎ ছোটো রাজার চোখের ঘোলাটে মণি দুটোর ভেতরে নীল আগুনের আভা নেচে উঠল। ক্ষীণ একটা হাসিও যেন তার শুকনো ঠোঁটের কোণে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। সেসবের কিছুই অবশ্য ওই ডাকাত দুটোর চোখে পড়ল না। তারা খেলার ছলেই আবার রোরোর শরীরটাকে আছাড় মারার জন্যে মাথার ওপর তুলে ধরল।
‘ওকে ছেড়ে দাও! তার বদলে এটা নাও…এটা…।’ কথা বলতে বলতেই ছোটো রাজা তার জামাটা খুলে ফেললেন। তার বুকের ওপর পড়ন্ত দুপুরের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা হিরে,—মোহনপুরের মহাবল রাজবংশের সৌভাগ্যমণি। সোনার হারের মাঝখানে গাঁথা সেই হিরেটাকে দ্রুত গলা থেকে খুলে নিয়ে জাফরি দিয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দিলেন ছোটো রাজা।
হা হা করে উঠল ডাকাত দুটো। ‘কী করেন, কী করেন?’ কিন্তু তার আগেই বাতাসে একটা গোলাপি বিদ্যুতের রেখা এঁকে, সেই কমলহিরের মালা উড়ে গিয়ে পড়ল পানার আন্তরণে ঢাকা ফোয়ারাপুকুরের মাঝখানে। পড়েই টুপ করে ডুবে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই লোক দু-টো সবকিছু ফেলে ঝাঁপ দিল পুকুরের জলে।
এর পরের দৃশ্যটা জিতসুন্দর দেখতে চাইছিলেন না। কিন্তু কী যেন এক অদৃশ্য সম্মোহন তার চোখ দুটোতে ওইদিকেই আটকে রাখল। লোক দুটো কিছুদূর সাঁতরে যাওয়ার পরেই ফোয়ারাপুকুরের জল তোলপাড় হয়ে উঠল, যেন পুকুরের নীচে হঠাৎই কেউ আগুন জ্বেলে দিয়েছে, আর তার আঁচে টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে পুকুরের জল। ডাকাত দুটোর আর্ত চিৎকারে ফালাফালা হয়ে গেল দেহাতি দুপুরের নৈ:শব্দ।
আস্তে আস্তে ওদের উৎক্ষিপ্ত দুজোড়া হাত জলের নীচে তলিয়ে গেল। সবুজকে ছাপিয়ে এখন সেই জলে ভেসে উঠেছে দলা দলা রং। রক্তের লাল।
ছোটো রাজা খুশি হলেন, ওরা সংখ্যায় এত বেড়েছে দেখে। ওরা এখন তৃপ্তিতে জলের ওপর লাফালাফি জুড়েছে। ঝিকিয়ে উঠছে তাদের রুপোলি দাঁতের সারি আর পেটের কমলা আঁশ।
আহা, খুশি হবে না? কতদিন বাদে ওরা আজ পেট ভরে মাংস খেতে পেল। কলম্বিয়া থেকে চোরাপথে নিয়ে আসা তার শেষ পোষ্য—ওই পিরানহা মাছেরা।