ছোট্ট পুরুত বলজিৎ – মহাশ্বেতা দেবী

ছোট্ট পুরুত বলজিৎ – মহাশ্বেতা দেবী

১৮৫৭ সাল শেষ হয়৷ যেমন শীত পড়েছে৷ তেমনি চারদিক খাঁ-খাঁ করছে৷ ছোট্ট পুরুত বলজিতকে ওর বাবা সব বুঝিয়ে দিচ্ছিল৷

‘এমনি করে পুজো করবি, এমনি করে মন্ত্র বলবি৷ এই নে মন্দিরের চাবি৷’

বলজিত গম্ভীর মুখে ঘাড় নেড়ে যাচ্ছিল৷ যথেষ্ট ভয় করছিল তার৷ আবার বেশ উত্তেজনাও হচ্ছিল৷

আজ কয়েক মাস হল সিপাহিরা সব বলোয়া (বিদ্রোহ) করেছে৷ বলজিতদের গ্রামের নাম চৈনপুর৷ গ্রামটা লখনউ থেকে মাইল দশেক উত্তরে৷ চৈনপুর গ্রামের অনেকগুলো ছেলে ফৌজে গিয়েছিল৷ তারা সবাই ‘বাগি’ হয়ে গেছে৷ বাগি মানে বিদ্রোহী৷

বলজিতের বাবা চৈনপুর গ্রামের মাথা বা সরপঞ্চ৷ সে গোপালজিউ মন্দিরের পূজারিও বটে৷ চৈনপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে গোগা নদী৷ গোগা নদীর ধারে গোপালজিউ মন্দির৷

বলজিতের বাবার যদি অসুখ না হত, তাহলে সেই পুজো করতে যেত৷ কিন্তু তার তো খুবই অসুখ৷ বলজিতের বয়স মোটে দশ৷ ওর দাদাও তো ফৌজে গিয়েছিল৷ আর সেও বাগি হয়ে গেছে৷ বাবা ইচ্ছে করে দাদাকে ফৌজে পাঠায়৷ ছেলে ফৌজে থাকলে ভালো৷

মা অবশ্য এখন বাবাকে বলে, ‘কেমন ভালো হল? ছেলেটা ঘরে আসতে পারে না৷ সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও বা কে জানে৷’

বাবা বলে, ‘সে রাতদিন শাসাত যে পুরুত হয়ে থাকবে না৷ সরপঞ্চ হবে না৷ ফৌজে যাবে আর লড়াই করবে৷ ফৌজে গিয়ে সে হাবিলদারও হয়েছিল আর সুনামও করেছিল৷’

-‘মরে যায় যদি?’

-‘এত জনের ছেলের যা হবে, তারও তাই হবে৷ আমি কী করব ভেবে ভেবে?’

এখন হয়েছে মহাবিপদ৷ এই যুদ্ধে কখনো বাগিদের সঙ্গে সায়েবদের মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে৷ এখন যা হচ্ছে, বাগিদের গ্রামে তারা নেই জেনে সায়েবরা মারমার করে এসে পড়ছে৷ বাগি সিপাহি ধরিয়ে দিলেই বকশিশ মিলবে, একথাও শোনা যাচ্ছে৷

চৈনপুর গ্রামটা বড়ো রাস্তা থেকে মাইলখানেক মাত্র দূরে৷ এর মধ্যে সায়েবরা কয়েকবার এ গ্রামের খোঁজ নিয়েছে৷

খুব বিশৃঙ্খল অবস্থা৷ দোকানপাট বন্ধ৷ হাটবাজার বসে না, সবাই ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে চৈনপুরে৷ যে গ্রামের সাতটি ছেলে ফৌজে আছে, সে গ্রামের লোক তো ভয়ে ভয়ে থাকবেই৷

অবশেষে গ্রামের মেয়েরাই বলজিতের বাবার কাছে এসে হাজির৷ গোপালজীউয়ের মন্দিরে পুজোর ব্যবস্থা করো৷ ছেলেগুলো বেঁচে ফিরুক৷ যুদ্ধে নামার পর ছেলেরা যখন একবার এসেছিল ওরা বলেছিল, দিল্লির বাদশাহ দিল্লিতে সিংহাসনে বসবে, যত রাজা-নবাব-তালুকদার শাসন করবে যে-যার মুলুক৷ আর বজ্জাত ইংরেজগুলোকে বেজায় জব্দ করে তাদের মুলুকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷

পুজো দিয়ে দেবতাকে খুশি করতে হবে৷ বলতে হবে, ছেলেদের কথা যেন সত্যি হয়৷

গণেশের দাদি বলল, ‘কথাগুলো কানে যাচ্ছে? না শুনতে পেলে না?’

-‘তোমার যে গলা! লখনউয়ে সবাই শুনতে পেল৷ আমি শুনতে পাব না?’

গণেশের দাদি পৃথিবীতে কাউকে ভয় করে না৷ সে কাছে এসে হেঁকে বলল, ‘অসুখটা বা কীরকম? ওষুধ খাচ্ছ না, শুয়ে আছ৷ খবর পেলেম বাটি বাটি ডাল আর রুটি খাচ্ছ৷’

-‘দাদি! বড্ড অসুখ৷’

-‘যাহোক! মন্দির খোলো, পুজো করো৷ আমরা যাব পুজো দিতে৷’

-‘বলজিত যাবে৷’

-‘সেই ভালো৷ ছোটো ছেলের মনে পাপ থাকে না৷ দেবতা তুষ্ট হয়৷’

বলজিত সকালে সেই জন্যেই পুজো দিতে চলল৷ খানিক পথ এসে সে এদিক-ওদিক চেয়ে শিস দিল৷ তখনি পাকা ধানের খেত থেকে হুড়মুড় করে এল মোহন৷ মোহন গয়লাদের ছেলে, বলজিতের প্রাণের বন্ধু৷ মোহন বলল, ‘ভুট্টা খাবি?’

-‘এখন নয়, পুজো দিয়ে৷’

এখন শীতের সময়ে গোসা নদীতে জল খুব কম৷ দু-জনে নদী পেরোল৷ চারিদিকে ধানখেত নদীর এপারে৷ ওপারে গোপালজিউয়ের মন্দির৷ চারদিকে কুল আর আমলকী গাছ৷ পাখির মেলা বসে গেছে৷ টিয়া, লালমোন, হরিয়াল, ছাতারে, শালিক৷ ধান পেকেছে, কুল পেকেছে, পাকা আমলকী ঝরে পড়ছে, ওরা ঠিক খবর পেয়ে যায়৷

গোপালজিউয়ের মন্দিরের চারদিকে দশেরি, চৌসা আর ল্যাংড়া আমের গাছ৷ আম পাকলে বলজিতের বাবা ঝুড়ি ঝুড়ি আম পাড়ায় আর সকলকে বিতরণ করে দেয়৷ কে কত খাবে খাও না৷ এ হল আমের দেশ৷ গরম কালে এত আম হয় যে গোরু ছাগলের আমে অরুচি হয়ে যায়৷

মন্দিরের তালাটি ভাঙা৷

বলজিত আর মোহন এ-ওর দিকে চাইল৷ তারপর ভেতর থেকে কে যেন আস্তে বলল, দরজা খোলা আছে, ঢুকে পড়ো৷

দু-জনে ভয়ে ভয়ে দরজা ঠেলল৷ দু-জন যুবক বসে আছে৷ মন্দিরের দেয়ালে দাঁড় করানো তাদের বন্দুক৷ দু-জনের হাতেই তরোয়াল উঁচোনো ছিল৷ ওদের দেখে নামিয়ে নিল৷ বলজিত বলল, ‘বাগি সিপাহি?’

-‘হ্যাঁ৷ তুমি কে, ভাই?’

-‘আমি পুজো করব৷ এখানে ঢুকেছ কেন? তালা ভেঙেছ কেন?’

-‘লখনউ যাব৷’

-‘সেখানে ইংরেজরা আছে৷’

-‘বাগিরা কোথায়?’

-‘তারা নাগপুরে৷ উত্তরদিকে৷’

-‘এখন তো মুশকিলে পড়লাম৷ আমার পায়ে জখম, তাই দলছুট হয়ে গেলাম৷’

-‘সতেরা নম্বর ফৌজের খবর জান?’

-‘সে খবরে দরকার?’

-‘আমার দাদা আর এই মোহনের কাকা তাতে আছে৷ আরও পাঁচজন আছে আমাদের গ্রামের৷ তারা সবাই বাগি বনে গেছে৷’

-‘ও! তাহলে তোমরা আমাদের ধরিয়ে দেবে না তো? আর আমাদের কথা কাউকে বলবে না?’

-‘না না৷ এখন বাইরে যাও৷ আমি পুজোটা সেরে নিই৷’

-‘কেন? আমরাও পুজো দেখি৷’

-‘ঢুকে পড়েছ যখন, তখন দেখো৷’

-‘ঢুকে কি আর এমনি পড়েছি? আমরা তো বুঝতেই পারিনি কোন দিকে যাচ্ছি৷ শেষে তোমাদের মতন দু-টি ছেলে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল৷ তালা ভেঙে দিল৷ বলল ‘এখানে থাকো?’

-‘দুটি ছেলে? কেমন দেখতে?’

যার পায়ে জোর জখম, সে চোখ বুজে বলল, ‘একজন ধপধপে ফরসা আর একজন কুচকুচে কালো৷ ফরসা ছেলেটার কাঁধে লাঙল! সে চাষির ছেলে হবে৷ কালো ছেলেটার হাতে বাঁশি৷ নিশ্চয়ই রাখাল ছেলে৷ কিন্তু খুব ভালো দেখতে আর কী মিঠা কথা৷ তাই নয়? বল না রে!’

ওর সঙ্গী বলল, ‘ও:! লখনউ বাজারে খাসা কালাকন্দের চেয়েও মিঠা কথা৷’

-‘দশেরি আম অমন মিঠা হয় না৷’

-‘সে কথা শুনলেই খিদে বেড়ে যায় ভালো ভালো খাবারের কথা মনে হয়৷’

বলজিত মোহনের দিকে চাইল দু-জনে মাথা নাড়ল৷ মোহন বলল, ‘তোমরা খুব ভাগ্যবান৷ আমরা শুনেছি যে এ মন্দিরের গোপালজিউ আর বলরাম রাতে জ্যান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান৷ তবে কেউ কখনো তাঁদের চোখে দেখেনি৷ তোমরা দেখেছ৷’

বলজিত হঠাৎ বলল, ‘কিন্তু গোপাল বলরামের গলার মালা, মাথার মুকুট, সব গয়না কোথায় গেল? ঠাকুরের গায়ের গয়না তো থাকেই, কেউ চুরিও করে না৷ সে সব গেল কোথায়?’

জখম যুবকটি বলল, ‘ছেলে দু-টির গায়ে তো কোনো গয়না দেখিনি৷ বড়ো ছেলেটির হাতে একটা মশাল জ্বলছিল, গয়না থাকলে কি চোখে পড়ত না?’

বলজিত আর মোহনের বাক্যি হরে গেল৷ মন্দিরে থাকে শাল গাছের আঠার ধুনো জড়ানো সরু মশাল৷ সে মশাল জ্বেলে দিলে তার গন্ধে মন্দিরের ছাতে বা ফাঁকফোকরে চামচিকে, পোকামাকড়, কিছুই থাকতে পারে না৷ প্রতিবছর পিলিভিতের চাঙ্গারাম আর হরজি এমন মশাল এক-শোটি দিয়ে যায়৷

সেই মশালের একটা দিক বলরামের হাতে গোঁজা৷

বলজিত খুব মন দিয়ে পুজো করল৷ পুজো হলে তাদের বলল, ‘তোমাদের খিদে পেয়েছে তো? দেখি, কিছু আনতে পারি কি না৷’

মোহন বলল, ‘চলতে যদি পার তবে এখানে থেকো না৷ কে কখন আসতে পারে!’

-‘যাব কোথায়?’

-‘কেন, টঙে?’

আম গাছের মাথায় মাচান বাঁধা থাকে৷ সে মাচানে বসে যদি দড়ি টিনের কৌটো না বাজাও, তাহলে আম পাকার সময়ে বাদুড়ের উৎপাতে পাকা ফল মোটে পাবে না৷

বলজিত আর মোহনের কাঁধে ভর দিয়ে ও চলল, আর ওর বন্ধু ওকে টেনে টেনে ওঠাল টঙে৷ মোহন বলল, ‘খড় দিয়ে যাব, ঢেকে-ঢুকে ঘুমিয়ো৷ রাতে সজাগ থেকো৷ চিতাবাঘ উঠে আসতে পারে ঘায়ের গন্ধ পেলে৷ আমরা এখন যাচ্ছি৷’

-‘কেউ যেন না জানে৷’

মোহন সগর্বে বলল৷ আমরা যথেষ্ট বড়ো হয়েছি৷ বার বার বলার দরকার কী?

-‘কত বড়ো হয়েছ ভাই?’

-‘বললাম তো সাতজন বাগি সিপাহি আছে৷ আর বাগিদের গ্রাম দেখলে সায়েবরা আমাদের মতো ছেলেদের গাছে ঝুলিয়ে দিচ্ছে৷ সেই জন্যে তো আমাদের চেয়ে বড়ো ছেলেরাও পালিয়েছে৷ আর সায়েবরা এসে পড়লে আমরাও পালাব৷’

জখম ছেলেটি নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ! এই বলোয়া তোমাদের মতো ছেলেদেরও বড়ো করে দিয়েছে৷’

-‘হ্যাঁ, বুঝলে তো? এখন চুপ করে পড়ে থাকো৷’

বলজিত আর মোহন বেজায় উত্তেজিত হয়ে গ্রামে ফিরল৷ গয়না নেই, সে কথাও বলা হবে না৷ বললেই সবাই দেখতে আসবে৷ নিশ্চয়, দুই দেবতা নিজেরাই গয়না লুকিয়ে রেখেছে৷ বলোয়া চলছে, তা তো দেবতারাও জানে৷ এ সময়ে সায়েবদের সৈন্যরা মন্দিরও লুট করে৷ দেবতারা জ্যান্ত হয়ে ঘুরতে পারে যখন, তখন গয়নাও লুকোতে পারে৷

মোহন বলল, ‘দেবতারা কি ভয় পেয়েছে?’

বলজিত বলল, ‘না রে! এ হল দেবতাদের বুদ্ধি৷’

-‘কোন দেবতার?’

-‘গোপালজিরই হবে৷ বলরামজি তো খালি গদা চালান আর লাঙল চালান৷’

-‘তাই হবে৷’

দু-জনে ঘরে ফিরে লক্ষ্ণীছেলের মতো যে-যার ঘরে খেতে বসে৷ খেয়ে-দেয়েই বলজিত বেরিয়ে পড়ে৷ গোরুটা খুঁজে আনতে যাচ্ছে৷

মা বলল, ‘দেখো৷ বলজিতের কেমন বুদ্ধি আর হুশ হয়েছে৷ সবসময়ে সংসারে মন৷’

বলজিতের বাবা বলে, ‘হুঁ৷’

সন্ধ্যে বেলা বলজিত ঘরে ফিরে দেখে মা চেঁচামেচি জুড়েছে৷ ‘এ কী ভূতুড়ে কাণ্ড বলো? আচারের ভাঁড় নেই, গোছা ধরা রুটি নেই, এ কী!’

পরদিন গণেশের দাদির চেঁচামেচিতে সবাই দৌড়ে যায়৷ তার রান্নাঘরের জানালা দা দিয়ে কেটে কে যেন ডালের হাঁড়ি নিয়ে গেছে৷

কে নিল, কে নিল, তা নিয়ে খুব হইচই হয়৷ শীতের দুপুরে পুকুরঘাটে মেয়েদের জটলা বসে৷

পরদিন সারা গ্রামেই হইচই পড়ে৷ বলজিতের বাবা বলে, ‘কী নিয়ে গোল বাধল?’

-‘এর বাড়ির রুটি, ওর বাড়ির গুড়, তার বাড়ির ক্ষীরের ডেলা, এ কেমন চোর জুটল? আর সবারে চেয়ে অবাক কাণ্ড, আমাদের গোবিনপ্রসাদের ঘর থেকে মলমপট্টি চুরি গেছে৷’

গণেশের দাদি বলে, ‘এবার চলো৷ সবাই গিয়ে পুজো দিই৷ বলজিতের বাবা না পারে তো ছেলেই পুজো করবে৷ গ্রামদেবতা ওই গোপালজিউ৷ তাতে বালক দেবতা৷ পুজো পাচ্ছে না বলে খেপে গেছে৷’

গ্রামবৈদ্যের বউ বলে, ‘মলম পট্টিও দেবতা নিয়ে যাচ্ছে? এ কেমন কথা?’

-‘এ হল দেবতার লীলা! তোর কাছে পুজো চায় ভালো করে৷’

পরদিন সব মেয়েরা তো রওনা হয় পেঁড়া, ক্ষীরের লাড্ডু, মুগের লাড্ডু, নানা নৈবেদ্য সাজিয়ে৷ আর বলজিত আগেভাগে গিয়ে ধূপের ধোঁয়াতে, গাঁদা ফুলের মালায় কৃষ্ণ-বলরামকে ঢেকে দেয় একেবারে মেয়েরা যেন ঠাকুরকে দেখতে না পায়৷

এমন মাথা নাড়িয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো করে বলজিত যে, বলজিতের মায়ের বুক দশ হাত হয়৷ ‘দেখো! আমার ছেলে কি যেমন তেমন ছেলে? পণ্ডিতজির কাছে শুধু শুনবে, বলজিত ভারি পাজি পড়তে চায়না৷ আরে! উপনয়নও হয়েছে, পুজো করতেও শিখেছে সেটা তো দেখবে?’

সবাই পুজো দেয়!

গণেশের দাদি বলে, ‘অ বলজিত! ধোঁয়া একটু কমা বাবা! ঠাকুরের মুখটা দেখি৷’

বলজিত পটপট করে বলে, ‘তা কেমন হবে? এখন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকবে৷ ঠাকুররা প্রসাদ খাবে, তাদের বুঝি খিদে পায় না?’

এ কথায় গ্রামের মেয়েরা বলে, ‘জয় গোপালজিউ! জয় গোপালজিউ! সত্যি! ছোটোছেলের মন কত পবিত্র৷ কেমন সহজে অত বড়ো কথাটা বলল বলজিত!’

সকলে চলে আসে৷ গণেশের দাদি বলে, ‘নাঃ! মনটা খুব ভালো হয়ে গেল আজ৷ বলজিতের মা! তোর এ ছেলে তার দাদার মতো হবে না৷ খুব ভক্তি আছে ওর৷ দেখিস! ওর কত নাম-ডাক হবে৷’

-‘আর চাচি! এ বলোয়া আগে শেষ হোক৷’

-‘হবে বই কী? নিশ্চয় হবে৷ আজ সন্ধ্যে বেলা আমি নতুন গাইয়ের দুধ এক ঘটি নিয়ে আসব৷’

সকলেই এ-ওর দিকে চাইল৷ নতুন গাছের ফল, নতুন গাইয়ের দুধ, মন্দিরে রেখে যাওয়ার নিয়ম তো ছিলই৷ ছেলেরা বাগি হল, বলোয়া করল, তাতেই সব ভুল হয়ে যাচ্ছে আজকাল৷

-‘একা আসবে, চাচি?’

-‘শোনো কথা! চিরকাল তো একাই আসি, একাই যাই৷ গণেশের দাদি মনে মনে ঠিক করল৷ সে সময় ঠাকুরের কাছে বসে মাপ চেয়ে নেবে৷ আজ কয়েক মাস সে নতুন গুড়, নতুন ফল, কিছুই দেয় না৷

এ কথা শুনে বলজিত বলল, ‘তা কেন? আমাকে দাও৷ আমি দিয়ে দেব৷ তুমি আবার যাবে?’

-‘যাব না কেন?’

-‘যেতে কষ্ট হবে তো?’

-‘কিচ্ছু কষ্ট হবে না৷’

-‘তাহলে যাবেই যাবে?’

-‘কেন এমন করছিস বল তো?’

-‘বেশ! যেয়ো৷’

হঠাৎ গণেশের দাদির মনে সন্দেহ হল! সে মনের ভাব চেপে নিয়ে বলল, ‘যাক গে! আজ গেলেও যা, কাল গেলেও তাই৷ কথায় বলে৷ মন চাঙ্গা তো কাঠরি মে গঙ্গা৷ নাহয় কালই যাব৷’

উৎসাহে নেচে উঠে বলজিত বলল, ‘তাই ভালো৷ তাই ভালো৷ আমি তোমায় নিয়ে যাব৷’

গণেশের দাদি মনে মনে বলল, ‘ব্যাপারটা কী তা দেখতে হচ্ছে৷ আমার চোখকে ফাঁকি মারা কি অতই সোজা? তোর বাবা পারেনি, তুই পারবি?’

সন্ধ্যের অন্ধকার তখন বেশ রিমঝিম হয়ে নেমেছে৷ বলজিত আর মোহন আম গাছের নীচে এসে দাঁড়াল৷

ওরা দু-জন গাছ থেকে নামল৷ বলজিত বলল, ‘এই নাও পুঁটলি, এতে ক্ষীরের লাড্ডু, পেঁড়া, এত এত আছে৷’

-‘দাও৷’

-‘মলমপট্টি তো দিয়েছি৷’

-‘স-ব দিয়েছ৷’

ওরা বলজিত আর মোহনের মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ৷ তারপর বলল, ‘চলি, কেমন? নাগপুর যেতে তো সময় লাগবে৷’

-‘লাগবেই তো৷ আবার আসবে৷’

-‘নিশ্চয়৷ সায়েবগুলোকে হাটিয়ে দিই আগে তারপর আসব৷’

-‘আমরা কাউকে কিছু বলিনি৷’

-‘তোমরা খুব ভালো ছেলে৷’

ওরা চলে গেল৷ ওদের তো আর দেখা যায়ই না৷ পাতলা আঁধারের ওপর গাঢ় আঁধার ঝরছে বৃষ্টির মতো৷ ওরা বাড়ি ফিরবে বলে পেছন ফেরে৷

হঠাৎ কাকে দেখে চমকে ওঠে ওরা৷ গণেশের দাদি৷ মুখে কথা নেই, ওদের দিকে চেয়ে আছে৷ বলজিত ভীষণ ঘাবড়ে যায়৷ একটু আগেও নিজেকে খুব বড়ো আর রাশভারী মনে হচ্ছিল৷

এখন নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়, বেজায় অসহায়৷ ওর বাবাকে দাদি আজও ধমকে কথা বলে৷ ধমক দেয় তালুকদারকে৷ বলজিতকে কী করবে?

-‘ওরা চলে গেল?’

মোহনটা এমন বাঁদর যে ‘বাপ রে!’ বলে দৌড় লাগায়৷ বলজিত ঘাড় হেলায়৷

-‘চল, ঠাকুরকে প্রণাম করে যাই৷’

বলজিত নীরবে মন্দিরের দরজা খুলে দেয়৷ এখন আর কিছু লুকোবার উপায় নেই৷

-‘ওরা নেয়নি৷ ঠাকুর-রাই তো ওদের ডেকে এনেছিল, তখন গায়ে গয়নাও ছিল না৷’

-‘ডেকে এনেছিল?’

-‘হ্যাঁ, সত্যি৷’

গণেশের দাদি মাথা নাড়ে আর বলজিতের গায়ে হাত বোলায়৷ তারপর বলে, ‘তোর বাবা ভাবে আমি বুড়ি হয়ে গেছি, বোকাও হয়ে গেছি৷ চল ঘরে চল৷ বড়ো ভালো ছেলে তুই৷ তুই আর মোহন৷’

-‘কাউকে বোলো না৷’

-‘না না, তাই বলি?’

তারপর কী হল বলো তো? গ্রামে ফিরে, বলজিতদের বাড়িতে ঢুকেই গণেশের দাদি বলে, ‘ঠাকুরের গয়না মাটিতে পুঁতে, তার ওপর বিছানা পেতে শুয়ে থাকতে হবে না৷ স-ব আমি ধরে ফেলেছি৷ ওঠ, ওঠ তো দেখি৷’

বলজিত দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিল৷ হঠাৎ অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে সে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে৷

কী কাণ্ড, কী কাণ্ড! বিছানা ছেড়ে উঠে বাবা গণেশের দাদির হাত ধরে অসম্ভব হাসছে, দাদিও হাসছে৷ হাসতে হাসতেই দাদি বলজিতের একটা হাত ধরে টেনে এনে ওকে জড়িয়ে ধরে৷

এখন হাসতে গিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বলজিত৷ হাসিকান্না এক হয়ে যায় ওর৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *