ছোটো জলকন্যার কথা

ছোটো জলকন্যার কথা

অনেক অনেক দূরে বিশাল সাগরের মাঝখানে, যেখানে জলের রঙ সুন্দরী অতসী ফুলের মতো নীল আর স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, সমুদ্র সেখানে এত গভীর যে জলের তলা থেকে উপরে পৌছতে হলে, একটার উপরে একটা অনেকগুলো গির্জার চুড়ো চাপাতে হয়। সেইখানে জল-মানুষরা থাকে। যেখানে সবচাইতে গভীর জল, সেইখানে জল-রাজের প্রাসাদ। তার দেওয়ালগুলো প্রবালের, সরু খিলান দেওয়া জানলা হলুদ স্ফটিকের। ছাদ আস্ত-আস্ত ঝিনুক দিয়ে তৈরি, তার উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে গেলে সেগুলি একবার খোলে একবার বন্ধ হয়। ঝিনুকের মধ্যে মুক্তে জ্বলজ্বল করে, তাতে আরো সুন্দর দেখায়। ঐ মুক্তোর একটিকে তুলে যদি মাটির জগতের কোনো রাজার মুকুটে বসান যেত, তার কাছে আর-সব মণিমাণিক্যকে তুচ্ছ মনে হত।

ঐ প্রাসাদে জল-রাজ থাকতেন। অনেকদিন আগেই তাঁর রাণী মারা গেছেন, বুড়ি মা সংসার দেখেন। মোটের ওপর বুড়ি ভারি বুদ্ধিমতী, তবে বংশ আর উঁচু পদ নিয়ে বড়ো অহংকার। বুড়ি রানীর ল্যাজে বারোটা ঝিনুক শোভা পেত, সমুদ্রের তলার আর কোনো অধিবাসী ছটার বেশি পরার অনুমতি পেত না। এটুকু ছাড়া বুড়ি রানীর অশেষ প্রশংসা করা উচিত। ছয় নাতনিকে তিনি কতই-না ভালোবাসতেন। তারা দেখতে বড়ো সুন্দর। তাদের মধ্যে সবার ছোটোটি সবচাইতে রূপসী। গোলাপের পাপড়ির মতো মোলায়েম তার গায়ের চামড়া, মাঝসমুদ্রের মতো গাঢ় নীল তার চোখ। তবে অন্যান্য জলকন্যাদের মতো তারও পা ছিল না ; তার বদলে শরীরের তলার দিকে ছিল মাছের মতো ল্যাজ। সারাদিন রাজকুমারীরা রাজবাড়ির মস্ত-মস্ত ঘরে খেলা করে বেড়াত। ওদের ঘিরে দেয়াল জুড়ে কি সুন্দর সব ফুল ফুটত। হলদে স্ফটিকের জানলা খুলে দিলে, মাছগুলো সাঁতরিয়ে ঘরে যেত, ঠিক যেমন করেেআমাদের জগতে পাখিরা উড়ে এসে ঘরে ঢোকে। মাছরা সোজা রাজকুমারীদের কাছে যেত, তাদের হাত থেকে খাবার খেত, তাদের আদর করলে কিছু বলত না।

রাজবাড়ির সামনে সে যে কী চমৎকার বাগান ছিল ! সেখানে টকটকে লাল আর গাঢ় নীল গাছ ছিল, সে গাছের ফল সোনার মতো ঝকঝকে, আর ফুল দেখলে উজ্জ্বল সূর্যের কথা মনে হত। বাগানেই মাটির বদলে ছিল চকচকে নীল বালি, গন্ধকে আগুন ধরলে যেমন রঙ দেখায়। সব কিছুর উপরে অপূর্ব একটা নীল আভা ছড়িয়ে থাকত, তাই দেখে হঠাৎ কেমন মনে হত এ তে সাগরের তলা নয়, এ যেন শূন্যে অনেক উঁচুতে উঠেছি, উপরে আকাশ, নীচেতে আকাশ ! জল যখন নিথর হয়ে থাকত, সূর্যকে মনে হত মস্ত একটা বেগনি ফুল তার গোল পাত্রটির মধ্যে থেকে রশ্মি করে সমস্ত পৃথিবীতে আলো দিচ্ছে!

বাগানের মধ্যে প্রত্যেক রাজকন্যের নিজের একটুখানি জায়গা ছিল, সেখানে তারা ইচ্ছামতো চারা লাগাতে, বীজ বুনতে পারত। একজনের জায়গাটি ছিল ঠিক একটা তিমিমাছের আকারে, আরেকজনেরটি জলকন্যার মতো ; কিন্তু সবার ছোটো যে রাজকুমারী তার বাগানটি ছিল সূর্যের মতো গোল আর তাতে যত ফুল ছিল, তাদের রঙ লাল, রাজকুমারীর চোখে সূর্য যেমন লাল ।

ছোটো রাজকুমারী অন্যদের চাইতে একটু আলাদা রকম ছিল, খুব শান্ত, সব সময় কি যেন ভাবত। ডুবো-জাহাজ থেকে নানারকম ঝকঝকে চকচকে জিনিস এনে একবার বোনেরা যখন সাজগোজ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল, ছোটে রাজকুমারী তখন ভবে-জাহাজে পাওয়া, শ্বেত পাথরে খোদাই করা সুন্দর একটি ছেলের মূর্তি ছাড়া আর কিছু নিল না। মূর্তিটি সে তার নিজের বাগানে রাখল ; তার পাশে লাল একটা গাছ পুঁতল, তার ঝোলা পাতা দেখে মনে হত গাছটি যেন কঁদছে। দেখতে দেখতে গাছ বেড়ে উঠল, উজ্জ্বল নীল মাটির উপর তার ডালপালা নুইয়ে পড়ল। সেখানকার ছায়াগুলো সদাই নড়ত-চড়ত আর বেগুনি রঙের খেলা দেখাত, দেখে মনে হত ডালপালা আর শিকড়গুলো যেন এ ওকে আদর করছে।

সমুদ্রের উপরে ডাঙার জগতের মানুদের কথা শুনতে ছোটো রাজকন্যে যেমন ভালোবাসত, তেমন আর কিছু নয়। জাহাজ, শহর, মানুষ আর ডাঙার জন্তু-জানোয়ার সম্বন্ধে বুড়ি ঠাকুমা যা কিছু জানতেন, সব তাকে বলতে হত। রাজকন্যে যখন শুনল যে উপরের জগতে যে-সব ফুল ফোটে তাদের সে কি সুগন্ধ, তখন সে কী খুশিই-না হল । সমুদ্রের নীচেকার ফুলের তো গন্ধই নেই। তার উপর পৃথিবীর বনের রঙ নাকি সবুজ, সেখানকার গাছের ডালপালার মধ্যে যে-সব মাছ ধড়ফড় করে উঠে বেড়ায়, কি তাদের রঙের বাহার আর কী মিষ্টি সুরে জোরে জোরে তারা গান গায়! আসলে ঠাকুমা পাখির কথা বলে ছিলেন, কিন্তু পাখিকে বলেছিলেন মাছ, কারণ নাতনিরা তো কখনো পাখি দেখে নি, তার কথা বুঝবে কি করে ?

ঠাকুমা বললেন, “তোর যখন পনেরো বছর বয়স হবে, তখন তুই সাগরের উপরে ভেসে উঠবার অনুমতি পাবি। তখন চাঁদের আলোতে, সাগরতীরের পাথরের ধাপে বসে দেখবি জাহাজ কেমন ভেসে যায়, কাকে বলে শহর, কাকে বলে মানুষ।”

পরের সালে বড়ো রাজকুমারীর পনেরো বছর বয়স হল। সে বোনদের কাছে কথা দিল যা দেখবে শুনবে, সব কথা ফিরে এসে তাদের বলবে। ঠাকুমা আর কতটুকু বলেন, আরো তো কত কি আছে, বোনেরা সে-সব শুনতে চায়।

কিন্তু ছোটো বোনের মতো আর কেউ সেই সুখের বয়সের জন্য আমন আগ্রহে অধীর হয়ে বসে থাকে নি। তাকেই সবচাইতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে তার সেই ছিল সবচাইতে শান্ত তার ভাবুক প্রকৃতির। রাতে সে অনেক সময় খোলা জানলার ধারে দাড়িয়ে নির্মল নীল জলের ভিতর দিয়ে চেয়ে দেখত। মাথার উপর দিয়ে ছায়া ভেসে গেলে, রাজকন্যে জানত ওটা হয় তিমিমাছ, নয়তো মানুষ বোঝাই জাহাজ । সে মানুষরা কেউ জানত না যে অনেক নীচে জলের তলায়, ছোটো এক জলকন্যা আকুল হয়ে তাদের জাহাজের খোলের দিকে সাদা সাদা হাত দুখানি বাড়িয়ে দিয়েছে।

সবার বড়ো বোন প্রথম বার সাগরের উপর থেকে ঘুরে এসে হাজাররকম গল্প করল। তার সবচাইতে ভালো লেগেছিল চাঁদের আলোয় বালির চরে বসে, সমুদ্র-তীরের শহরটিকে দেখতে। সেখানকার আলোগুলো তারার মতো জ্বলজ্বল করছিল, বাজনা বাজছিল। দূর থেকে লোকজন গাড়িঘোড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, গির্জার উঁচু চুড়োগুলি দেখা যাচ্ছিল, ঘণ্টার শব্দ কানে আসছিল । ওখানে যাবার কোনো উপায় ছিল না বলেই ঐ সব জিনিসের জন্য জলকন্যার আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছিল। কি মনোযোগ দিয়েই না ছোটো জলকন্যা দিদির কথাগুলো শুনেছিল। তার পরে যখন আবার রাতে খোলা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে, নীল জলের ভিতর দিয়ে সে উপরে তাকিয়ে দেখল, সেই মস্ত গমগম করা শহরটার কথা তার এত বেশি করে মনে পড়ল যে, মনে হল যেন গির্জার ঘণ্টার শব্দ তার কানে আসছে।

তার পরের বছর মেজো বোন ইচ্ছামতো সাঁতরে বেড়াবার অনুমতি পেল। সূর্য যেই ডুবুডুবু, সে জলের উপরে উঠে এল।

সূর্য ডোবা দেখে সে এমনি মুগ্ধ হল যে ফিরে গিয়ে বোনদের বলল যে, জলের উপরে উঠে ঐ সূর্য ডোবার চাইতে সুন্দর কিছু তার চোখে পড়ে নি। মেজো রাজকুমারী বলল, “সমস্ত আকাশের গায়ে সোনার রঙের ছোয়া লাগল, মেঘের সে রূপের কথা বলবার আমার সাধ্য নেই। এই লাল, এই ফিকে বেগুনি, মাথার ওপর দিয়ে মেঘেরা ভেসে চলল। তার চাইতেও বেগে জলের ওপর দিয়ে ঠিক যেখানে সূর্য পাটে নামছে, সেই দিকে উড়ে গেল এক ঝাঁক বুনো রাজহাঁস। তাদের দিকে চেয়ে রইলাম, কিন্তু সূর্য দৃষ্টির নীচে নেমে গেল আর সমুদ্রের জলের ওপর থেকে, মেঘের কিনারা থেকে, ঝকঝকে গোলাপি আলোও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।”

তৃতীয় বোনের সাহস এদের চাইতে বেশি। যখন তার পালা এল, সে সাহসে ভর করে একটা নদীর মুখে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে সে দেখতে পেল ছোটো-ছোটো সবুজ পাহাড়, তাদের গায়ে গায়ে বন আর আঙুরের বাগান, তারই মাঝে মাঝে মাথা তুলে রয়েছে কত বাড়ি, কত প্রাসাদ। পাখির গান শুনতে পেল সে। সূর্যের সে কি তেজ ! থেকে থেকেই তাকে জলের তলায় ডুব দিয়ে মাথা মুখ ঠাণ্ড করতে হচ্ছিল। ছোটাে একটা উপসাগরের তীরে দেখল এক দল ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়ে স্নান করছে, লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে। রাজকুমারীর ইচ্ছা করছিল ওদের খেলায় যোগ দেয়, কিন্তু ওকে দেখেই ছেলেমেয়েরা বেজায় ভয় পেয়ে ডাঙার দিকে দৌড় দিল আর একটা ছোটো কালো জানোয়ার এমনি খেউ-খেউ করে ডাকতে লাগল যে শেষপর্যন্ত ও নিজেও ভয় পেয়ে, সমুদ্রের দিকে পালিয়ে বাঁচল। তবু ঐ সবুজ বন, গাছে ঢাকা ঐ শ্যামল পাহাড় ঐ ছোটো-ছোটো ছেলেমেয়েদের কথা কিছুতেই সে ভুলতে পারছিল না। যদিও তাদের পাখনা নেই, তবু তারা নদীর জলে কেমন নিৰ্ভয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল।

চতুর্থ বোনের অত সাহস ছিল না , সে খোলা সমুদ্রের উপরেই থেকে গিয়েছিল, তার পর ফিরে গিয়ে বোনদের বলেছিল এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। দূর দিয়ে জাহাজ ভেসে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের পাখি। আর দেখেছিল জলের মধ্যে শুশুকরা কেমন মনের খুশিতে খেলা করছে আর বিশাল বিশাল তিমিমাছরা আকাশে বাতাসে হাজার হাজার ঝলমলে জলের ফোয়ারা ছুঁড়ছে।

পঞ্চম বোনের জন্মদিন পড়ল শীতকালে। সে যখন জলের উপরে উঠল, দেখল সমুদ্রের রঙ সবুজ, তার উপর বড়ো-বড়ো বরফের চাংড়া ভাসছে। রাজকুমারী বলল, ওগুলো দেখতে মুক্তোর মতে, কিন্তু অনেক বড়ো, মানুষদের গির্জার চুড়োর চেয়েও বেশি উঁচু। রাজকুমারী একটা বরফের চাংড়ার উপর বসে, বাতাসে চুল মেলে দিয়েছিল। কিন্তু তাই-না দেখে, যেখানে যত জাহাজ ছিল সবাই পাল তুলে দিয়ে, যত তাড়াতাড়ি পারল পালিয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলায় নৌকোর পালে পালে যেন আকাশ ছেয়ে গেল, প্রকাণ্ড বরফের টুকরোগুলো একবার করে ভুবতে আবার ভাসতে লাগল, তাদের গা থেকে লালচে আভা বেরুতে লাগল, মেঘ থেকে বিদ্যুতের ঝলক দেখা গেল, বাজ বার বার গর্জাতে লাগল। অমনি সব জাহাজ পাল গুটিয়ে ফেলল ; তাদের পাটাতনে যারা ছিল তাদের সে কি ভয়! কিন্তু রাজকুমারী বরফের চাংড়ার উপরে বসে বসে বিদ্যুতের নীল ঝলকানি দেখেছিল।

প্রথমবার সমুদ্রের উপরে উঠে বোনেরা সবাই এতরকম নতুন নতুন সুন্দর জিনিস দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার পর সে-সব পুরনো হয়ে গেল, তখন জলের তলায় নিজেদের বাড়িটাকেই সবচাইতে ভালো বলে মনে হতে লাগল। কারণ নিজেদের বাড়িই তো মনের মতো জিনিসে ঠাসা থাকে।

সন্ধেবেলায় অনেক সময় পাঁচটি বোন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের অতল গভীর থেকে উঠে আসত। মানুষের গলার চাইতে তাদের গলার স্বর অনেক বেশি মধুর। ঝড় আসছে দেখলে তারা জাহাজের সামনে গিয়ে সে যে কী মিষ্টি গান গাইত, সে আর কি বলব ! সমুদ্রের তলায় যারা বাস করে তাদের সুখের জীবনের কথা গাইত, নাবিকদের বলত, ভয় পেয়ে না, নেমে এসো নীচে আমাদের কাছে। মাঝিরা ওদের কথার মানে বুঝত না, ভাবত বুঝি বাতাসের শনশন।

সন্ধেবেলায় বোনেরা যখন সাঁতরিয়ে বেড়াত, ছোটো জলকন্যা তার বাবার প্রাসাদে একলা থাকত, এতটুকু নড়ত-চড়ত না, এক দৃষ্টে দিদিদের যাওয়ার পথে চেয়ে থাকত। যদি পারত, তা হলে হয়তো সে কাঁদত, কিন্তু জলকন্যারা কাঁদতে পারে না, তাই দুঃখ হলে মানুষের চাইতে শতগুণ বেশি কষ্ট পায়।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ছোটা রাজকুমারী বলত, “ইস্, একবার আমার পনেরো বছর হলেই হয় ! আমি ঠিক জানি জলের উপরের জগৎটাকে আর সেখানকার মানুষগুলোকে আমার বড়ো ভালো লাগবে।” অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এল।

ঠাকুমা বললেন, “এই তো এবার তোর পালা। কাছে আয়, তোকেও তোর দিদিদের মতো করে সাজিয়ে দিই।” এই বলে বুড়ি তার চুলে একটা সাদা ফুলের মালা জড়িয়ে দিলেন, সে ফুলের প্রত্যেকটি পাপড়ি আধখানা মুক্তে দিয়ে তৈরি। তার পর বুড়ি আটটি বড়ো-বড়ো ঝিনুককে বললেন

রাজকুমারীর ল্যাজে বুলে থাকতে, তাতেই বোঝা যাবে কন্যার বংশ কত উঁচু।

ছোটো রাজকুমারী বলল, “কিন্তু ওতে যে বড়োই অস্বস্তি লাগছে ঠাকুমা।” বুড়ি বললেন “আহা, সুন্দর দেখাতে হলে ঐরকম একটুআধটু অসুবিধা সইতেই হয়।”

রাজকুমারী কিন্তু এই-সব জাকজমক ছেড়ে দিয়ে, ঐ ভারী মুকুটের বদলে তার নিজের বাগানের লাল ফুল পরলেই বেশি খুশি হত আর তাতে তাকে মানাতও ঢের বেশি। কিন্তু অত সাহস কোথায় পাবে ? ওদের কাছে বিদায় নিয়ে, এক টুকরো ফেনার মতো সে ভেসে পড়ল।

যখন জলের উপরে পৌছল, তখন সূর্য সবে দিগন্তের নীচে নেমেছে, মেঘ থেকে ঝলমলে সোনালি আর গোলাপির ছটা বেরুচ্ছে, পশ্চিমের ফিকে আকাশে সন্ধ্যা-তারা জ্বলছে, কাচের আয়নার মতো নিথর সাগর। স্থির জলের উপরে তিনটি মাস্তুল তুলে প্রকাণ্ড একটা জাহাজ ভাসছিল। মাস্তুল থেকে অগুন্তি নিশান বাতাসে উড়ছিল ; একটিমাত্র পাল তোলা ছিল। কোথাও এতটুকু বাতাস নেই ; জাহাজের তক্তায়, সিঁড়িতে নাবিকরা চুপ করে বসেছিল। পাটাতন থেকে গান বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তার পর যেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল, অমনি হঠাৎ শত-শত আলো জ্বলে উঠল।

ছোটো জলকন্যা সাঁতরিয়ে গেল জাহাজের কাপ্তানের ছোটো কুঠরির কাছে। ঢেউয়ের দুলুনির সঙ্গে যখন জাহাজটা একটু উঁচুতে উঠছিল তখন জানলার পরিষ্কার কাচের মধ্যে দিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখা যাচ্ছিল। রাজকুমারী দেখল চমৎকার সাজ-পোশাক পরা কয়েকজন মানুষ। তাদের মধ্যে সবচাইতে

যে রূপবান, সে একজন রাজপুত্র, গভীর কালো তার চোখ। সেদিন তার ষোলো বছর পূর্ণ হল, জাহাজের লোকরা তাই মহা ধুমধাম করে তার জন্মদিনের উৎসব করছিল। নাবিকরা পাটাতনের উপরে নাচছিল, সেখানে রাজপুত্র দেখা দিতেই, হু করে আকাশে একশো হাউই উঠল, রাত হল দিন। ভয়ের চোটে জলকন্যা জলের নীচে ডুব দিল। একটু বাদেই ছোটো মাথাটি তুলে দেখে যেন আকাশ থেকে ওর-ই উপর তারা করে পড়ছে। এমন আলোর ফুলকি ঝরা আগে কখনো দেখে নি সে, মানুষরা যে এমন আশ্চর্য ক্ষমতা ধরে, তাও কখনো শোনে নি। মনে হল তার চারদিকে বড়ে-বড়ো সূর্য ঘুরছে, রঙ-চঙে মাছ সব শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, আর সাগরের স্বচ্ছ শান্ত বুকে সব কিছুর ছায়া পড়ছে। জাহাজে এত আলো যে, প্রত্যেকটি জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আহা, রাজপুত্রের আজ কী আনন্দ । নাবিকদের হাত ধরে নাড়ছে, তাদের সঙ্গে গাল-গল্প, ঠাট্টা-তামাসা করছে আর রাতের নৈঃশব্দের সঙ্গে সঙ্গীতের মধুর সুর মিলে একাকার হচ্ছে।

এদিকে রাত বাড়ছে, কিন্তু জলকন্যা কিছুতেই ঐ আলোয় আলো জাহাজ আর ঐ পরমসুন্দর রাজপুত্রকে ছেড়ে যেতে পারছিল না। ছোটো কুঠরির জানলা দিয়ে সে ভিতরের দিকে তাকিয়েই ছিল, ঢেউয়ের দোলায় তার শরীরটা উঠছিল পড়ছিল। তার পর জাহাজের তলাটা ফেনিয়ে উঠল, ঘড়ঘড়, করে জল পাক দিয়ে উঠল, জাহাজ চলতে আরম্ভ করল। অমনি সব পাল তুলে দেওয়া হল। তার পর উঁচু উঁচু ঢেউ উঠতে লাগল, আকাশে ঘোর কালো মেঘের ঘনঘটা, দূরে বাজ পড়ার শব্দ শোনা গেল। নাবিকরা বুঝল বড় আসছে, অমনি সব পাল নামিয়ে দিল। ঝোড়ো সমুদ্রের বুকে ঐ প্রকাণ্ড জাহাজ একটা হালকা নৌকোর মতো দোল খেতে লাগল। পর্বত প্রমাণ ঢেউ জাহাজের মাথা ছাড়িয়ে উঠতে লাগল আর জাহাজ একবার তার নীচে তলিয়ে যায়, একবার তার মাথায় চড়ে ! ছোটো জলকন্যার কাছে এসব বড়ো আনন্দের ব্যাপার, কিন্তু নাবিকদের কথা আলাদা। বিশাল ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজে মড়মড় করে ফাটল ধরল, ঐ মোটা মাস্তুল তাও বেঁকে গেল, হুড় হুড় করে খোলের ভিতরে জল ঢুকে পড়ল। নিমেষের জন্য জাহাজ ধড়ফড় করে উঠল, তার পর নলখাগড়ার বোটার মতো বড়ো মাস্তুলটি ভেঙে পড়ল ; জাহাজও তখুনি উলটিয়ে গেল, গবগব করে খোলটি জলে ভরে গেল ।

এতক্ষণ বাদে ছোটো জলকন্যা বুঝতে পারল জাহাজের মানুষদের এবার সমূহ বিপদ। নিজেকেও সাবধান হতে হয়, জাহাজ থেকে ছিঁড়ে-আসা কড়ি বরগা তক্তা ঢেউয়ের মাথায় ভাসছে।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, চোখে কিছু ঠাহর হয় না। খানিক পরে ভয়ংকরভাবে বিদ্যুৎ চমকাল, তার আলোতে জাহাজডুবির সর্বনেশে দৃশ্য দেখা গেল। জলকন্যার দুই চোখ তারই মধ্যে রাজপুত্রকে খুঁজে বেড়াতে লাগল, ঠিক সেই সময় টুপ করে জাহাজটি ডুবে গেল। প্রথমে তার বেজায় আনন্দ হল, ভাবল এবার তাহলে রাজপুত্রকে জলের তলায় তাদের বাড়িতে যেতে হবে। তার পরেই মনে পড়ল জলের নীচে তো মানুষেরা বঁচে না। জল-রাজের প্রাসাদে যদি কখনো রাজপুত্র যায়, শুধু তার মরা দেহটিই যাবে।

‘মরা! না, না, তাকে মরতে দেব না ? চারদিকে ভাঙা জাহাজের বরগা তক্ত ভাসছে, তারই মধ্যে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে, জলকন্যা রাজপুত্রকে খুঁজতে লাগল। শেষপর্যন্ত পেলও তাকে ; ততক্ষণে রাজপুত্রের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে, অনেক কষ্টে শুধু নিজের মাথাটুকুকে জলের উপরে ভাসিয়ে রেখেছে। চোখদুটি বোজা। ডুবেই যেত নিশ্চয়, যদি-না জলকন্যা তাকে বাঁচাত। জলকন্যা তাকে জড়িয়ে ধরে, জলের উপরে তুলে নিয়ে, স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলল।

খানিক পরেই দেখল শুকনো ডাঙা, পাহাড়ের উপরে বরফ ঝক্মক্ করছে। সমুদ্রের ধারে ধারে সবুজ বন, বনের কিনারায় একটা মন্দির, কিম্বা আশ্রম, জলকন্যা চিনতে পারল না কি। তার চারদিকে বাগান, সেখানে কলম্বী আর কাগজি লেবুর গাছ ; সদর দরজা অবধি চলে গেছে লম্বা-লম্বা তালগাছের বীথি। ঐখানে একটা ছোটো উপসাগরের মতো হয়েছে, স্থির জল, কিন্তু বড়ো গভীর। উঁচু পাথরের পাড়ির নীচে শুকনো শক্ত বালি। সেইখানে জলকন্যা রাজপুত্রকে নিয়ে এল ; দেখে মনে হয়’বুঝি তার দেহে প্রাণ নেই। জলকন্যা তাকে সামান্য গরম বালির উপর শুইয়ে, মাথাটিকে সাবধানে উঁচু করে রাখল, মুখটি রোদের দিকে ফিরিয়ে দিল ।

সামনের মস্ত সাদা বাড়িতে ঘণ্টা বাজতে লাগল, কয়েকজন অল্প-বয়সী মেয়ে বাগানে বেড়াবে বলে বেরিয়ে এল। জলকন্যা তীর থেকে সরে গিয়ে পাথরের আড়ালে লুকোল, সমুদ্রের ফেনা দিয়ে মাথাটি ঢেকে রাখল, যাতে কেউ তাকে না দেখতে পায়। সেখান থেকে রাজপুত্রকে সে দেখতে লাগল।

বেশিক্ষণ কাটে নি, এমন সময় একটি মেয়ে কাছে এল ! রাজপুত্রকে ঐভাবে মরার মতো পড়ে থাকতে দেখে সে বেজায় ভয় পেল। তখনই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বোনদের ডাকতে ছুটে গেল। ছোটো জলকন্যা দেখল রাজপুত্র ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠেছে, তাই দেখে সকলে হাসছে, তাদের মনে যেমন সহানুভূতি, তেমনি আনন্দ। কিন্তু রাজপুত্র একবারও জলকন্যাকে খুঁজল না, সে তো জানেই না যে জলকন্যাই তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। তার পর যখন সবাই মিলে রাজপুত্রকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল, রাজকুমারীর এমনি মন খারাপ হয়ে গেল যে অমনি সে এক জুবে তার বাবার প্রাসাদে ফিরে এল।

আগেও ছোটে রাজকুমারী ছিল বড়ো শান্ত আর ভাবুক এখন যেন আরো বেশি হল । বোনেরা জিজ্ঞাসা করত উপরের জগতে সেদিন কি দেখে এসেছিল, ছোটো জলকন্যা কোনো উত্তর দিত না।

সন্ধ্যাবেলায় অনেক সময় ছোটো রাজকুমারী ভেসে উঠে সেই জায়গাটাতে যেত, যেখানে সে রাজপুত্রকে রেখে এসেছিল। দেখত পাহাড়ের উপরের বরফ গলল, বাগানের ফল পাকল, কিন্তু রাজপুত্রের আর দেখা না পেয়ে, মনের দুঃখে ঘরে ফিরে যেত। একমাত্র আনন্দ ছোটো বাগানে বসে সুন্দর মূর্তিটিকে দেখা ; মূর্তির সঙ্গে রাজপুত্রের আশ্চর্য সাদৃশ্য। আর সে ফুলগাছের যত্ন করত না, গাছগুলি বেড়ে জঙ্গল হয়ে গেল ; সিঁড়ি ঢেকে গেল ; লম্বা বেঁটা আর পাকান শুঁয়োর সাহায্যে গাছের ডালপালার সঙ্গে তারা জড়িয়ে রইল। বাগানটাই হয়ে উঠল একটা কুঞ্জবন।

শেষপর্যন্ত মনের দুঃখ আর মনে গোপন করতে না পেরে, দিদিদের একজনকে একদিন সে সব কথা বলে ফেলল। সে অন্য বোনদের বলল, তারা বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে বলল। তাদের মধ্যে ছিল আরেকজন জলকন্যা ; রাজপুত্রকে তার খুব মনে ছিল, ঝড়ের দিনে জাহাজের উৎসব সে-ও নিজের চোখে দেখেছিল। তার উপর সে জানত রাজপুত্রের দেশ কোথায়, সেখানকার রাজার কি নাম ।

রাজকুমারীরা ছোটো বোনকে আদর করে বলল, “আয়, আমাদের সঙ্গে।” এই বলে তারা হাত ধরাধরি করে জল থেকে ভেসে উঠল একেবারে রাজপুত্রের প্রাসাদের সামনে। সে প্রাসাদ হলুদ পাথরে তৈরি। বাড়ি থেকে সমুদ্রের ধার অবধি শ্বেত পাথরের সিঁড়ি। বাড়ির মাথায় সোনালি রঙের গম্বুজ যেন সোনার মুকুট শোভা পাচ্ছে। বাড়ির চারদিকে থামের মাঝে মাঝে শ্বেত পাথরের মূর্তি, দেখে মনে হয় যেন সত্যিকার মানুষ। উঁচু জানলার স্বচ্ছ কাচের ভিতর দিয়ে কেউ যদি দেখত, তার চোখে পড়ত জমকাল সব ঘর, তাতে রেশমী পর্দা ঝুলছে, দেয়ালে সুন্দর করে আঁকা রঙিন ছবি। মানুষ থাকবার এমন চমৎকার বাড়ি দেখে জলবাসিনী রাজকুমারীরা মুগ্ধ। সবচাইতে বড়ো ঘরগুলির একটার জানলা দিয়ে ওরা দেখে ঘরের মধ্যিখানে ফোয়ারা থেকে জল উঠছে একেবারে মাথার উপরে গম্বুজ অবধি। গম্বুজের ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি ঢুকে জলের উপরে নাচছে, জলের চারদিকে স্বন্দর স্বন্দর ফুল ফুটেছে, আলো লেগে তারা ঝলমল করছে।

এতদিন পরে ছোটে রাজকুমারী জানতে পারল তার বড়ো প্রিয় রাজপুত্র কোথায় থাকে। এর পর থেকে প্রায় রোজ সন্ধ্যায় সে সেখানে যেত। বোনের সাহসে ভর করে যতদূর গিয়েছিল, ছোটো জলকন্যা প্রায়ই তার চেয়ে অনেক বেশি কাছে যেত। এমন-কি কখনো কখনো একটা সরু খাড়ি ধরে শ্বেত পাথরের ঝোলান বারান্দার তলায় গিয়ে পৌছত। রাতে যখন চাঁদের আলো ফুটফুট করত, সেখান থেকে সে রাজপুত্রকে দেখত ; রাজপুত্ৰ মনে করত তার কাছে কেউ নেই।

মাঝে মাঝে একটা রঙ-চঙে নেীকো করে রাজপুত্র বেড়াত, মাথার উপর নানা রঙের নিশান উড়ত। জলকন্যা জলের ধারে সবুজ নল-বনে লুকিয়ে লুকিয়ে রাজপুত্রের গলার স্বর শুনত । রাতে অনেক সময় বাতি-ঘরের আলোয় জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরত। জলকন্যা শুনতে পেত ওরা রাজপুত্রের কথা, তার নানান বীরত্বের কথা বলাবলি করছে। এই ভেবে তার ভারি আনন্দ হত যে, রাজপুত্রের প্রাণ তারই জন্যে বেঁচেছিল। মনে পড়ত, রাজপুত্রের মাথাটি কেমন তার বুকের উপর লুটিয়ে পড়েছিল, সে কেমন আস্তে একটা চুমো খেয়েছিল, কিন্তু রাজপুত্র সে কথা টেরও পায় নি, স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। যতই দিন যায়, মানুষদের তার ততই ভালো লাগে, বড়ো ইচ্ছা করে, আহা, সে-ও যদি মানুষ হত ! জলের মানুষদের জগতের চাইতে এদের জগৎটাকে অনেক বেশি বড়ো মনে হত। জাহাজে চড়ে মানুষরা যেমন সমুদ্রের উপরে ভেসে বেড়াতে পারে, আবার আকাশ-ছোয়া পাহাড়ের শিখর অবধি চড়তে পারে। জলকন্যাদের চোখ যতদূর যায়, তার চাইতেও অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে ওদের বনে ঢাকা রাজ্য।

অনেক জিনিস ছোটো রাজকুমারী বুঝতে পারত না, মনে হত কেউ বুঝিয়ে দিলে ভালো হয়, কিন্তু দিদিরাও ঠিক উত্তরটি বলতে পারত না। শেষপর্যন্ত বুড়ি রাজ-মাতাকেই জিজ্ঞাসা করতে হত, তিনি তো উপরের জগতের বিষয়ে অনেক কিছু জানতেন। সে জগৎকে তিনি বলতেন, ‘সাগরের উপরের রাজ্য ।” একদিন ছোটো জলকন্যা জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, ঠাকুমা, মানুষরা যদি ডুবে না যায়, তা হলে কি তার চিরকাল বেঁচে থাকে ? আমরা যারা সাগরের তলায় বাস করি, আমাদের মতো ওরা মরে যায় না ?”

ঠাকুমা উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমাদের মতাঁ ওরাও মরে যায়, এমন-কি, ওরা আমাদের চাইতে কম দিন বাঁচে। আমরা তো তিনশো বছর বাঁচি, কিন্তু মরে গেলে আমরা সমুদ্রের ফেনা হয়ে যাই, প্রিয়জনের কাছাকাছি একটা কবরের একটু ভাগও পাই না। আমাদের অমর আত্মা নেই, আমরা আবার জন্মাই না ; ঘাস কেটে ফেললে যেমন চিরদিনের মতো শুকিয়ে যায়, আমরাও তেমনি মরে গেলে নিঃশেষ হয়ে যাই! মানুষদের কিন্তু আত্মা আছে ; দেহ ধুলোর সঙ্গে মিশে গেলেও ওদের আত্মা বেঁচে থাকে। আমরা যেমন জল থেকে উঠে মুগ্ধ হয়ে মানুষদের বাড়িঘর দেখি, ওরাও তেমনি মরে গেলে আকাশ পারের অপূর্ব অজানা আবাসে উঠে যায়। সে জায়গা চোখে দেখবার আমাদের অধিকার নেই।”

ছোটো জলকন্যা বলল, “তা কেন ? আমাদের কেন অমর আত্মা নেই ? মরে যদি আকাশ পারের সেই স্বৰ্গে ঢুকবার অধিকার পাই, তা হলে আমি খুশি হয়ে এই তিনশো বছরের জীবনের বদলে একটিমাত্র দিন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই ।”

ঠাকুমা বললেন, “ও কথা ভাবতে হয় না। এই যেমন আছি, এই ভালো। মানুষদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি দিন বাঁচি আর অনেক বেশি সুখে থাকি।” ছোটো জলকন্যা কেঁদে বলল, “তবে কি আমাকে মরে গিয়ে ফেনার মতো সমুদ্রের উপরে আছড়ে পড়তে হবে, আর কোনোদিনও সুন্দর ফুল, আলোয় আলো সূর্য দেখতে পাব না! বল, ঠাকুমা, এমন কোনো উপায় নেই কি যাতে আমিও অমর আত্মা পাই ?”. বুড়ি ঠাকুমা বললেন “না, বাছা, তবে এ কথাও সত্যি

যে, যদি কোনো মানুষ তোকে মা-বাপের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, সমস্ত প্রাণমন দিয়ে যদি সে তোকে ভালোবাসে, যদি পুরুতঠাকুর যখন তোদের দুজনার হাত এক সঙ্গে বেঁধে দেবেন, তখন সে প্রতিজ্ঞা করে যে, চিরদিন তোকে ছাড়া আর কাকেও মনে স্থান দেবে না, তা হলেই তার আত্মা তোর মধ্যেও প্রবাহিত হবে, আর তাই যদি হয়, তবেই তুই মানবজন্মের সুখের ভাগ পাবি। কিন্তু সে তো হবার জো নেই ; তার কারণ আমাদের দেহের যেটুকু আমাদের চোখে সবচাইতে সুন্দর, অর্থাৎ কিনা আমাদের ল্যাজটি, ওদের চোখে সেটিই হল সবচাইতে কুৎসিত, ওটিকে ওরা সইতে পারে না। ওদের চোখে সুন্দর দেখাতে হলে, দুটি আনাড়িপানা ঠেকো দরকার, তাকে ওরা বলে পা ।”

ছোটো জলকন্যা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, মুখ ভার করে নিজের শরীরের আশে ঢাকা জায়গাটুকুর দিকে তাকিয়ে রইল ; শরীরের বাদবাকিটুকু কি ফরস, কি সুন্দর।

বুড়ি ঠাকুমা বললেন, “আমরা কত সুখী রে, তিনশো বছর ধরে কেমন লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে সাঁতরে কাটাতে পারি। সে তো অনেকদিন রে মানিক, তার পর মরে গিয়ে কেমন শান্তিতে ঘুমুব ! জানিস্, আজ সন্ধ্যায় রাজসভায় নাচ-গান হবে!” রানীমা যে নাচের আসরের কথা বলছিলেন তেমন জমকাল ব্যাপার পৃথিবীতে কখনো দেখা যায় না। সভাঘরের দেয়ালগুলি স্ফটিক দিয়ে তৈরি, খুব পুরু, তবু কি স্বচ্ছ। দেয়ালে শতশত বড়ো-বড়ো ঝিনুক বসান, কোনোটার রঙ গোলাপের মতো, কোনোটা ঘাসের মতো সবুজ। সবগুলি থেকে উজ্জ্বল আলো বেরুচ্ছে ; সেই আলোতে সভাঘর আলোয় আলোময়। কাচের মতো দেয়াল ভেদ করে সেই আলো জলের মধ্যে কত দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। অগুন্তি মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে, ছোটো বড়ো লাল বেগুনি সোনালি রুপোলি ; ভালো লেগে তাদের গায়ের আঁশ বলমল করছে। সভাঘরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিকমিকে নির্মল একটি জলের ধারা। সেই জলের ধারায় জল-মানবরা জলকন্যারা নাচছে আর মিষ্টি গলায় নাচের তালে তালে গান গাইছে ।

ছোটো রাজকুমারী সবার চাইতে সুরেলা গলায় গান গাইল, সবাই হাত-তালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। তাতে তার বড়োই আনন্দ হল। সে জানত সমুদ্রের নীচেই হোক, বা উপরের জগতেই হোক অমন মধুর কণ্ঠ কারও নেই। তবু খানিক বাদেই তার সমস্ত মন ভরে উঠল উপরের জগতের চিন্তায়। রাজপুত্রের কথা সে কিছুতেই ভুলে থাকতে পারত না ; একটা অমর আত্মা না থাকার দুঃখ রাখার জায়গা সে খুঁজে পেত না। রাজবাড়িতে সকলে আনন্দে মত্ত, শুধু ছোটো রাজকুমারী কাউকে না জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে, নিজের বাগানটিতে বসে চিন্তায় ডুবে রইল। সে বাগানের আজকাল কেউ যত্ন নেয় না।

হঠাৎ তার কানে এল জলের উপরে দূরে কোথায় শিঙা বাজছে। মনে মনে জলকন্যা বলল, “যাকে আমি আমার মা-বাবার চেয়েও বেশি ভালোবাসি, সে এখন শিকারে বেরুল । ওকে এবং একটি অমর আত্মা পাবার জন্য আমি সব খোয়াতে রাজি। রাজবাড়িতে দিদিরা এখনো নাচ-গানে ব্যস্ত, এই বেলা যাই জাদুকরীর কাছে। এত-কাল তাকে কি ভয়ই-না করেছি, কিন্তু এখন সে ছাড়া কেউ আমাকে বুদ্ধিও দিতে পারবে না, সাহায্যও করতে পারবে না।’ ছোটো জলকন্যা বাগান ছেড়ে ফেনাভৱা ঘূর্ণিজলের দিকে

চলল ; ঘূর্ণির ওপারে জাদুকরীর বাড়ি। এদিকে এর আগে সে কখনো আসে নি। এ পথে ফুল ফোটে না, সাগর তলার ঘাস গজায় না। অনেকখানি ন্যাড়া ধূসর বালি পার হয়ে সে ঘূর্ণিজলের কাছে পৌছল। ময়দা-পেষা কলের মতো সেখানকার জলগুলো কেবলই ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, নাগালে যা কিছু পাচ্ছে তাকেই ধরে পাক খাইয়ে অতল গভীরে ফেলে দিচ্ছে । জাদুকরীর এলাকায় পৌছতে হলে এই ভয়াবহ জায়গাটা পার হতে হয়। সেটি পেরিয়ে সামনে দেখে শ্যাওলাভরা একটা জলাভূমি টগবগ করে ফুটছে। জাদুকরী এ জায়গাকে বলত তার ঘাস-বিল ।

তারও পরে বন, সেই বনে জাদুকরীর বাড়ি। বড়ো অদ্ভুত সে বাড়ি। তার চারধারের গাছপালা ঝোপঝাড় সব জ্যান্ত প্রাণী, দেখে মনে হয় যেন শত শত মাথাওয়ালা সাপ না কেঁচো, মাটি থেকে গাছের মতো গজিয়েছে। তাদের ডালপালাগুলো পিছলা লম্বা হাতের মতে, আঙুলগুলোও যেন জোঁক। শিকড় থেকে মগ-ডাল অবধি সে গাছগুলো কেবলই নড়ছে চড়ছে, হাত বাড়াচ্ছে! যদি কিছু ঐ হাতে পড়ে, তার আর ছাড়া পাবার উপায় নেই।

সেই বিকট বনের দিকে চেয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়াল জলকন্যা ; ভয়ে বুক চিপ-চিপ করতে লাগল ; কাজ শেষ না করেই হয়তো সে ফিরে আসত, কিন্তু ঠিক সেই সময় রাজপুত্রের কথা, অমর আত্মার কথা মনে পড়ে গেল, আর ফিরে আসা হল না। অমনি মনে নতুন করে সাহস পেল। তখন জলকন্যা করল কি, লম্বা কোঁকড়া চুলগুলোকে এঁটে খোঁপা বেঁধে নিল, যাতে জন্তুগুলো না ধরতে পারে। তার পর বুকের উপরে হাত দুটিকে জড়ো করে নিয়ে জলের মধ্যে মাছ যেমন তীর বেগে ছুটে

বেড়ায়, তার চেয়েও বেগে ছুটে বীভৎস গাছগুলো পার হয়ে গেল। তাকে ধরবার জন্য তারা বৃথাই আঁকুপাকু করে হাত বাড়াল। পার হয়ে যাবার সময় রাজকুমারী দেখতে পেল প্রত্যেকটি বিকট হাতের মুঠির মধ্যে একটা কিছু ধরা রয়েছে, ছোটাে-ছোটাে আঙুলগুলো লোহার বাঁধনের মতো সেগুলোকে ধরে রেখেছে ! কত জুবে যাওয়া মানুষের সাদা কঙ্কাল, কত জাহাজের হাল, কত সিন্দুক, কত ডাঙার জানোয়ারের হাড়গোড়, এমন-কি, ছোটো একটি মরা জলকন্যা, তাকে ডাল পালাগুলো ধরে, দম বন্ধ করে মেরেছে ! কি ভয়ংকর দৃশ্যইনা দেখল হতভাগিনী রাজকুমারী !

সেই ভয়াবহ বন পার হয়ে জলকন্যা একটা শ্যাওলা-ঢাকা পিছল জায়গায় এল, সেখানে প্রকাণ্ড মোটা-মোটা সব গুগলি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর তারই মধ্যিখানে জাহাজডুবি

হয়ে প্রাণ হারান হতভাগ্য লোকদের হাড়-গোড় দিয়ে তৈরি একটা বাড়ি । বাড়ির সামনে জাদুকরী বসে একটা কোলাব্যাঙকে আদর করছিল, যেমন করে অনেকে পোষা পাখিকে আদর করে। কদাকার ভোঁদা গুগলিগুলোকে জাদুকরী বলত তার মুরগি-ছানা, ওর গায়ের চারদিকে তারা ঘুরে বেড়াত, বুড়ি কিছু বলত না ।

ছোটো রাজকুমারীকে দেখেই জাদুকরী বলল, “তুমি কি চাও সে আমি ভালো করেই জানি । ঘোর বোকামি হলেও, সে ইচ্ছা তোমার পূর্ণ হবে, ওগো রূপসী রাজকন্যে ! অবিশ্যি তাতে তুমি দুঃখ ছাড়া আর কিছু পাবে না ! ঠিক সময় বেছেই এসেছ যা হোক ; সূর্য-ডোবার পরে এলে, এক বছরের মধ্যে

তোমার জন্যে কিছু করতে পারতাম না। সাঁতরে যেও ডাঙার কাছে, তার পর সাগর-তীরে বসে, একটা ওষুধ দিচ্ছি, সেটি খেও । অমনি তোমার ল্যাজটি খসে শুকিয়ে মানুষরা যাকে পা বলে, তাই হয়ে যাবে। সে সময় কিন্তু বড়ো যন্ত্রণা পাবে, মনে হবে তোমার শরীরের মধ্যে ধারাল ছোরা চালান হচ্ছে। কিন্তু তার পরে যারাই তোমাকে দেখবে তারাই বলবে এমন সুন্দর মেয়ে কখনো দেখে নি। অপূর্ব লাবণ্যে ভরা থাকবে তোমার চলা-ফেরা, তোমার মতো হাল্কা পায়ে কেউ নাচতে পারবে না, কিন্তু পা ফেললেই মনে হবে বুঝি শান দেওয়া তলোয়ারের উপরে হাঁটছ, রক্ত ঝরছে। পারবে এত কষ্ট সইতে ? পার তো তোমার ইচ্ছা পূরণ করি।”

কাপা কাপা গলায় রাজকুমারী বলল, “পারব।” মনে পড়ল রাজপুত্রের কথা, হয়তো অমর আত্মা পাবে সেই কথা। জাদুকরী বলল, “কিন্তু মনে রেখো, একবার মানুষের রূপ ধরলে আর কখনো জলকন্যা হতে পারবে না। আর কখনো বোনদের কাছে তোমার বাবার রাজপ্রাসাদে ফিরে যেতে পাবে না। তা ছাড়া রাজপুত্র যদি তোমাকে এতখানি ভালো না বাসে যে তোমার জন্য মা বাবাকে ছাড়তে পারে তার সব চিন্তাকে সব ইচ্ছাকে এক তুমি জুড়ে থাক আর যদি পুরুত এসে তোমাদের হাতে হাত মিলিয়ে বিয়ে না দেয়, তা হলে কিন্তু ঐ যে অমর আত্মাটি চাইছ, ওটি তোমার পাওয়া হবে না। যেদিন রাজপুত্র অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে, তার পর দিনই তোমার মৃত্যু হবে। দুঃখে তোমার বুক ফেটে যাবে, তুমি একটুখানি সমুদ্রের ফেনা হয়ে যাবে।”

যে মরতে বসেছে তারই মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল জল কন্যার মুখ, সারা গা কাপতে লাগল। তবু সে বলল, “সে সাহস আমার আছে।”

বুড়ি বলল, “তার উপরে আমি আছি, আমাকে দাম দিতে হবে। এত কষ্ট করব তোমার জন্যে, কাজেই যেমন তেমন দাম দিলেও চলবে না। সব সাগরবাসীদের মধ্যে তোমার গলার স্বরটি সবচাইতে মিষ্টি, হয়তো মনে ভেবেছ ঐ গলা দিয়েই রাজপুত্রের মন ভোলাবে, কিন্তু ঐটি আমার চাই। আমার এই জাদুর ওষুধের বদলে তোমার সেরা জিনিসটি আমাকে দিতে হবে, কারণ আমার নিজের গায়ের রক্ত না দিলে ওষুধে দো-ফলা তলোয়ারের ধারটি আসবে কেন ?”

ছোটো রাজকুমারী বলল, “কিন্তু তুমি আমার গলার স্বরটি নিয়ে নিলে, রাজপুত্রকে মুগ্ধ করব কি দিয়ে ?”

জাদুকরী বলল, “কেন, তোমার রূপ দিয়ে, তোমার কোমল লাবণ্যে ভরা চলা-ফেরা দিয়ে, তোমার ভাষাময় চোখ দুটি দিয়ে। এ-সব জিনিস দিয়ে মানুষদের দেমাকে ভরা মন ভোলান খুবই সহজ। কি হল ? সব সাহস উবে গেল নাকি ? ছোটো জিবটি এবার বের কর দিকিনি, কুছ করে কেটে আমার ওষুধের দাম উসুল করি।”

রাজকুমারী বলল, “বেশ, তাই হোক।” বুড়ি তখন কড়াই নিয়ে ওষুধ পাকাতে বসল। এক মুঠো ব্যাঙ আর গুগলী দিয়ে কড়াই মাজতে মাজতে জাদুকরী বলল, “পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো কিছু নেই বুঝলে ?” তার পর নিজের বুক আঁচড়িয়ে কয়েক ফোঁটা কুচকুচে কালো রক্ত কড়াইতে ধরল, তার সঙ্গে কতরকম নতুন উপকরণ ঢালল। ওষুধের ধোয়া নানারকম বিকট আকার নিতে লাগল, গো-গো শব্দ বেরুতে লাগল, তার পর জাদুর ওষুধ বিশুদ্ধ জলের মতো টলটলে পরিষ্কার হয়ে গেল। ওষুধ তৈরি।

জাদুকরী বলল, “এই নাও ওষুধ ” এই বলেই রাজকুমারীর জিবটি কেটে নিল। বেচারি জলকন্যা অমনি বোবা হয়ে গেল, আর কথাও বলতে পারত না, গানও গাইতে পারত না। জাদুকরী বলল, “আমার কুঞ্জবনের ভিতর দিয়ে যাবার সময় জ্যান্ত গাছগুলো যদি তোমাকে ধরবার চেষ্টা করে তবে ওদের গায়ে কয়েক ফোটা ওষুধ ছিটিয়ে দিও, অমনি ওদের হাতগুলো হাজার টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে।” অবিশ্যি তার দরকার হল না, জ্যান্ত গাছগুলো যেই দেখল জলকন্যার হাতে ওষুধের শিশিটি তারার মতো জ্বলজ্বল করছে, অমনি তারা সরে গেল। সেই ভয়ংকর বনের মধ্যে দিয়ে, জলাভূমি পার হয়ে, ফেনায় ভরা ঘূর্ণিজলের উপর দিয়ে, রাজকুমারী নিরাপদে চলে এল। যখন জলকন্যা রাজপুত্রের প্রাসাদের কাছে এসে, বড়ো চেনা ঘাটের শ্বেত পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল, তখনো সূর্য ওঠে নি। শিশির আশ্চর্য ওষুধ খাবার সময় সে দেখল আকাশে তখনো চাঁদ রয়েছে। সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন একটা ধারাল ছোরা চলে গেল, রাজকুমারী অচেতন হয়ে পড়ে গেল। সূর্য ওঠার সময় তার চেতনা ফিরে এল, সমস্ত অঙ্গে সে কি নিদারুণ ব্যথা। কিন্তু তাকিয়ে দেখল পাশে দাঁড়িয়ে তার এত ভালোবাসার পাত্র সেই তরুণ রাজকুমার, তার ঘন কালো চোখ দিয়ে কি যেন জানতে চাইছে।

গভীর লজ্জায় চোখ নামাতেই জলকন্যা দেখল কোথায় তার সেই লম্বা মাছের ল্যাজটি, তার জায়গায় দুখানি কী সুন্দর পা। পরনে কিছু নেই, লম্বা ঘন চুলের গোছা দিয়ে রাজকুমারী গা ঢাকতে চেষ্টা করল। রাজপুত্র শুধোল, “কে তুমি ? কি করে এখানে এলে ?” উত্তরে রাজকুমারী মৃদু হেসে, দুটি উদ্ভাসিত নীল চোখে তার দিকে চেয়ে রইল।

হায়, তার কথা বলার সাধ্য ছিল না। তখন রাজপুত্র তার হাত ধরে রাজবাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। পা ফেলতেই মনে হল যেন শান দেওয়া তলোয়ারের উপরে হাঁটছে ; খুশি হয়েই সে ব্যথা বইল। রাজকুমারী হেঁটে চলল, শরীর যেন বাতাসের মতো হাল্কা, চলা-ফেলার কী সুললিত ছন্দ। রাজবাড়িতে পৌছলে পর তাকে দামী দামী মসলিন আর রেশম পরান হল। তার মতো রূপসী সেখানে কেউ ছিল না, কিন্তু সে কথাও কইতে পারত না, গানও গাইতে পারত না। রেশম আর সোনার কিংখাবের পোশাক পরে ক্রীতদাসীরা রাজা, রানী, রাজপুত্রের সামনে গান গাইল। একজনের গলা বড়ো মিষ্টি। তার গান শুনে রাজপুত্ৰ হাততালি দিয়ে তারিফ করল। রাজকুমারীর সে কী দুঃখ, ওর নিজের গলার স্থর যে আরো বেশি মধুর ছিল। সে ভাবল, ‘হায়, উনি যদি জানতেন ওঁর জন্যেই আমি চিরকালের মতো আমার গলার হরটি দিয়ে দিয়েছি।”

ক্রীতদাসীরা নাচতে শুরু করল। তখন রূপসী রাজকন্যাও উঠে এসে সুন্দর সাদা দুই বাহু তুলে নাচ ধরল। সে কি নাচ ! এতটুকু নড়লেই দেহের সুষমা, চলনের লাবণ্য উপচিয়ে পড়ে। যে দেখে সে চোখ ফেরাতে পারে না। ক্রীতদাসীদের মধুর গানের চেয়েও রাজকন্যার দুই চোখের নীরব ভাষা তাদের হৃদয়ের মৰ্মমূলে গিয়ে পৌছল। সবাই মুগ্ধ হল, বিশেষ করে রাজপুত্র। সে বলল, “এ আমার বড়ো আদরের কুড়িয়ে পাওয়া ধন।”

বারেবারে রাজকুমারী নাচ দেখাল, প্রতি পদক্ষেপে সে কি অসহ বেদনা ! শেষে রাজপুত্র বলল, “তুমি সদাই আমার কাছে থেকে।” সেই ব্যবস্থাই হল। রাজপুত্রের নিজের মহলে, তার শোবার ঘরের লাগোয়া ঘরে, মখমলের গদি বিছিয়ে

রাজকুমারীর শোবার জায়গা হল। রাজপুত্র তার জন্যে পুরুষদের মতো পোশাক করাল, তাই পরে সে তার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াবে বলে। সুগন্ধে বনভূমি ম-ম করত, সবুজ শ্যামল গাছের ডালপালা তাদের গায়ে স্পর্শ করত, নতুন পাতার আড়ালে পাখিরা আনন্দে গান গাইত। রাজপুত্রের সঙ্গে জলকন্যা খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠত, কচি পায়ে রক্ত ঝরত, রাজকুমারী হাসরতা আর ভালোবাসার ধন রাজপুত্রের পায়ে পায়ে পাহাড়-চুড়োয় গিয়ে উঠত। সেখান থেকে দেখতে পেত নীচে মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে, পাখির ঝাঁক ভিন দেশে উড়ে যাচ্ছে। রাতে যখন রাজবাড়ির সকলে ঘুমিয়ে থাকত, রাজকুমারী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসত, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে, অগাধ জলে পা ডুবিয়ে শীতল করতে চাইত। তখন সাগরতল-বাসী তার সেই-সব প্রিয়জনদের কথা মনে পড়ত।

একদিন সে সাগরের জলে পা ধুচ্ছে, এমন সময় একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে, তার দিদিরা সবাই গান গাইতে গাইতে উঠে এল । সে গান বড়ো করুণ। ছোটো জলকন্যা হাতছানি দিয়ে তাদের কাছে ডাকল। তাকে দেখেই তারা চিনল, কত দুঃখের কথাই-না তাকে বলল, তার অভাবে তার বাপের বাড়ির সবাই কত কাতর। তার পর থেকে দিদিরা রোজ রাতে তাকে দেখতে আসত। একদিন বুড়ি ঠাকুমা এলেন, কত কাল তিনি উপরের জগৎ দেখেন নি। মাথায় মুকুট পরে, তাদের বাবা জলরাজ নিজে এলেন একদিন তাকে দেখতে। কিন্তু তাদের বয়স হয়েছে, ডাঙার কাছে কেউ এলেন না, ছোটো রাজকুমারীর সঙ্গে কথা বলা হল না।

ছোটো রাজকুমারীর উপর রাজপুত্রের টান দিনে দিনে বাড়তে লাগল। কিন্তু রাজকুমারীকে তার মনে হত মিষ্টি একটি

ছোটো মেয়ে, তাকে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও কখনো মনে হয় নি। কিন্তু বিয়ে না হলে তো সে অমর আত্মা পাবে না, বিয়ে না হলে তাকে যে এক মুঠো ফেনা হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ভেসে বেড়াতে হবে! রাজপুত্র তাকে আদর করে, যখন সুন্দর কপালে চুমো খেত, জলকন্যার চোখ দুটি জিজ্ঞাসা করত, ‘তুমি কি আমাকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাস ? রাজপুত্ৰ বলত, “হ্যাঁ, তোমার মতো ভালো আর কেউ নেই, তোমাকেই সব চেয়ে বেশি ভালোবাসি। তুমিও আমাকে কত ভালোবাস। তোমাকে দেখে আমার আরেকটি মেয়ের কথা মনে পড়ে, তাকে একবার মাত্র দেখেছি, আর হয়তো দেখা হবে না। জাহাজে ছিলাম হঠাৎ ঝড় উঠে জাহাজ ডুবি হল। ঢেউগুলো আমাকে নিয়ে তীরে আছড়ে ফেলল পবিত্র এক মন্দিরের সামনে। সেখানে কয়েকজন মেয়ে দিনরাত সাধন-ভজন নিয়ে থাকে। ওদের মধ্যে যে সবার ছোটো সে আমাকে সাগর তীরে দেখতে পেয়ে, আমার প্রাণ বাঁচাল। একটিবার মাত্র তাকে দেখেছি, কিন্তু তার মুখখানি আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে, তাকে ছাড়া আর কাউকে আমি ভালোবাসতে পারব না। তবে সে তো মন্দিরে উৎসর্গ করা। তুমি তার মতোই দেখতে। মনে যাতে সাস্তুনা পাই তাই তোমাকে পেলাম, তোমাকে কখনো কাছ-ছাড়া করব না।”

বুক-ভাঙা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জলকন্যা ভাবল, ‘হায়, উনি জানেনও না যে আমিই ওঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম।” একদিন সভাসদরা বলাবলি করতে লাগল, “পাশের রাজ্যের রাজার মেয়ের সঙ্গে আমাদের রাজপুত্রের বিয়ে হবে। তাই ঐ চমৎকার জাহাজ সাজান হচ্ছে। সবাই জানে রাজপুত্র বিদেশে বেড়াতে

যাচ্ছে, কিন্তু আসলে রাজকন্যাকে দেখতে যাচ্ছে। এ ধরনের কথা শুনলে ছোটো জলকন্যার হাসি পেত ; আর কেউ না জানুক সে তে রাজপুত্রের মনের কথা জানত।

একদিন রাজপুত্র বলল, “আমাকে যেতেই হবে ; গিয়ে সেই সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখে আসতে হবে। মা-বাবার বড়ো সাধ । অবিশ্যি তাই বলে সে মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনতে কেউ আমাকে বাধ্য করতে পারবে না। তাকে ভালোবাসা আমার পক্ষে অসম্ভব, তার তো আর তোমার মতো মন্দিরের সেই রূপসীর সঙ্গে সাদৃশ্য থাকতে পারে না। বিয়ে যদি করতেই হয়, ওরে আমার কুড়িয়ে-পাওয়া মুখ-চোরা ধন, চোখ যার কথা বলে, তার চেয়ে বরং তোমাকেই আমার বেশি পছন্দ !

এই বলে রাজপুত্র তাকে চুমে খেয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। আর জলকন্যার মনের মধ্যে ফুটে উঠল মানব-জন্মের সুন্দর আর অনন্ত আনন্দের মধুর এক ছবি। চমৎকার সুসজ্জিত জাহাজে করে ওরা পাশের রাজ্যের রাজার কাছে যাচ্ছে ; দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, এমন সময় রাজপুত্র বলল, “ও আমার মিষ্টি মেয়ে, মুখে যার কথা নেই, তুমি সাগর দেখে ভয় পাবে না তো ?” তার পর রাজপুত্র তাকে সমুদ্রের ঝড়ের কথা বলল, সাগর-জল তখন কেমন খ্যাপা হয়ে ওঠে, গভীর জলের মাছদের কথা বলল, ডুবুরীরা সমুদ্রের তলায় কি অদ্ভুত সব জিনিস দেখতে পায়, সে কথা বলল। জলকন্য শুধু একটু হাসল। অগাধ সাগরের তলার কথা সে যেমন জানে, ডাঙার মানুষদের ছেলেমেয়েরা কি করেই-বা জানবে ?

রাতে চারদিকে চাঁদের আলো ফুটফুট করত, জাহাজের সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, পাটাতনে একা বসে ছোটো রাজকুমারী জলের নীচে চেয়ে দেখত। জাহাজের খোল যে ফেনার রেখা একে যাচ্ছিল, ওর মনে হচ্ছিল তার ভিতর দিয়ে যেন বাবার প্রাসাদ, ঠাকুমার রুপোলি মুকুট দেখতে পাচ্ছে। তার পর দেখল যেন দিদিরা জলের উপরে ভেসে উঠে ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছে মুখে তাদের কী করুণা ! ছোটো রাজকুমারী তাদের দিকে মাথা নেড়ে, হেসে, জানাতে চাইল যে সে যেমনটি চেয়েছিল সব ঠিক তেমনি হবে। ঠিক সেই সময় জাহাজের ছোকরা চাকর এসে দেখা দিল, আর দিদিরা এমনি হঠাৎ ঝাপ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল যে, সে ভাবল বুঝি ঢেউয়ের মাথায় যা দেখল সে শুধু ফেনা ছাড়া আর কিছু নয়।

পরদিন সকালে রাজার জমকাল রাজধানীর বন্দরে এসে জাহাজ পৌছল। কেউ ঘণ্টা বাজাল ; কেউ শিঙায় ফুঁ দিল ; পতাকা উড়িয়ে, তলোয়ারের ঝলক দিয়ে, সেনাদল শহরের মাঝখান দিয়ে মিছিল করে চলল। মহা ধুমধাম হল, রোজরোজ নতুন ধরনের উৎসব, নাচ-গান, ভোজের পর ভোজ । তবে রাজকন্যা তখনো শহরে এসে পৌছয় নি। অনেক দূরে কোনো আশ্রমে তাকে পাঠান হয়েছিল লেখা-পড়া আর রাজ-বংশের যোগ্য নানা বিদ্যা শিখতে। অবশেষে একদিন সে রাজবাড়িতে ফিরে এল। তার সঙ্গে দেখা হবামাত্র রাজপুত্র বলে উঠল, “এ যে সে-ই ! যখন মরার মতো সমুদ্রের ধারে পড়েছিলাম, এ-ই তো আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল ?” রাজকন্যার মুখ রাঙা হয়ে উঠল । রাজপুত্র তাকে আলিঙ্গন করল।

কুড়িয়ে-পাওয়া বোবা মেয়েকে রাজপুত্র বলল, “আজ আমার কত সুখ! যা কখনো আশা করি নি, শেষে তাই হল। আমার সুখে তুমিও সুখী হও, আমাকে যারা ঘিরে থাকে, তাদের মধ্যে কেউ আমাকে তোমার মতো ভালোবাসে না।” বুক ভরা

নীরব বেদনা নিয়ে জলকন্যা রাজপুত্রের হাতে চুমে খেল । মন্দিরের ঘণ্টা আবার বেজে উঠল, বর-কনে পরস্পরের হাতে হাত দিয়ে পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করল ; তাদের বিয়ে হয়ে গেল । রেশম আর সোনালি জরির পোশাক পরে, বিয়ের কনের লুটান আঁচলের কোণা ধরে, তার পিছনে ছোটো জলকন্যা দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তার কানে সেই সুগম্ভীর বাজনা পৌছয় নি, তার চোখ দুটিও সেই পবিত্র অনুষ্ঠানের কিছুই দেখতে পায় নি। তার কেবলই মনে হচ্ছিল এবার জীবন শেষ হয়ে গেল, ইহলোক পরলোক দুই-ই খোয়া গেল। সেদিনই সন্ধ্যায় বরকনে জাহাজে উঠল ; কামান ছোড়া হল, বাতাসে পতাকা উড়ল, পাটাতনের মাঝখানে বেগুনি আর সোনালি কিংখাবের চমৎকার চাদোয়া তোলা, তার তলায় কী জমকাল, কী নরম, কী আরামের সব কুরশি-কেদারা। এইখানে রাজপুত্র আর রাজকন্যা রাত কাটাবে। অনুকূল বাতাসে পাল ভরে উঠল, নীল জলের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে জাহাজ ভেসে চলল।

যেই অন্ধকার নামল, রঙিন বাতি ঝোলান হল, পাটাতনে নাচ-গান শুরু হল । ছোটো জলকন্যার মনে পড়ে গেল, প্রথমবার জলের উপরে উঠে এই দৃশ্যই সে দেখেছিল । আজকের উৎসবও তেমনি জমকাল। তাকে আজ নাচে যোগ দিতে হল, পাখির মতো হাল্কাভাবে জাহাজের কাঠের মেঝের উপর সে যেন ভেসে বেড়াতে লাগল। সবাই তার প্রশংসা করল, এমন অপূর্ব ললিত ভঙ্গিতে আগে কখনো সে নাচে নি। ছোটো-ছোটো পা দুটিতে সে কী নিদারুণ যন্ত্রণা, কিন্তু আর সে বোধ ছিল না, হৃদয়ের বেদনা তার শত গুণ বেশি। যার জন্য ঘরবাড়ি প্রিয়জন ছেড়ে এসেছে, আজ সন্ধ্যায় এই তার সঙ্গে শেষ দেখা। এরই জন্য তার অমন সুন্দর কণ্ঠ গেছে, এরই জন্য রোজ কি অসহ বেদনাই-না সয়েছে, অথচ সে ঘূণাক্ষরে কিছু টের পায় নি। ভালোবাসার মানুষটি যে বাতাসে নিশ্বাস ফেলে, আজ সন্ধ্যার পর আর সে বাতাস দিয়ে সে বুক ভরবে না। আর কোনো সন্ধ্যায় ঘন নীল সমুদ্র দেখবে না, তারা ভরা আকাশ দেখবে না। এর পর শুধু অসীম রজনী, আর সে কিছু ভাববেও না, স্বপ্নও দেখবে না। জাহাজে সে কী আনন্দ ! বুক ভরা মরণের চিন্তা নিয়ে, জলকন্যা সকলের সঙ্গে মাঝরাতের পর অবধি হাসল, নাচল । তার পর রাজপুত্র তার রূপসী কনেকে চুমো খেয়ে, সুন্দর করে সাজান শিবিরে শুতে গেল ।

চারদিক নিস্তব্ধ ; হাল ধরে মাঝি একলা দাঁড়িয়ে। শুভ্র বাহুতে ভর দিয়ে ছোটো জলকন্যা ভোরের অপেক্ষায় পুর্ব দিকে চেয়ে রইল। সে জানত যে প্রথম সূর্যের আলো দেখা গেলেই, সে ফেনা হয়ে যাবে। দেখলে দিদিরা জল থেকে ভেসে উঠেছে। মুখগুলি তাদের মরার মতো সাদা, লম্বা চুল আর পিঠে লুটোচ্ছে না, সব ছোটো করে কাটা।

তারা বলল, “চুলগুলো জাদুকরীকে দিয়ে এসেছি, যাতে সে তোমাকে মরণের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের সাহায্য করে। এই নাও ছুরি। সূর্য ওঠার আগে রাজপুত্রের বুকে বসিয়ে দাও। ওর গরম রক্ত তোমার পায়ে পড়লেই পা দুটি আবার লম্বা মাছের ল্যাজ হয়ে যাবে, তুমিও আবার জলকন্যা হয়ে যাবে, সমুদ্রের ফেনা হয়ে যাবার আগে তিনশো বছর বাঁচবে। তাড়াতাড়ি কর । সূর্য ওঠার আগে হয় তাকে, নয় তোমাকে মরতে হবে। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সূর্য উঠবে, তার পর আর তোমার গতি নেই! এই বলে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল।

যেখানে রাজপুত্র আর রাজকন্যা ঘুমিয়ে ছিল, জলকন্যা তার বেগুনি পরদা সরাল। তার পর বুকে পড়ে রাজপুত্রের কপালে চুমো খেল, আকাশের দিকে চেয়ে দেখল ভোরের আলো ক্রমে ফুটে উঠছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজপুত্র তার কনের নাম উচ্চারণ করল, তাকে ছাড়া স্বপ্নেও আর কারও চিন্তা নেই! হতভাগিনী জলকন্যার হাতের ছুরি কাঁপতে লাগল। হঠাৎ সেটিকে ছুড়ে জলে ফেলে দিয়ে আর একবার ভালোবাসার মানুষটিকে দেখল, চোখের দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসছিল। তার পর জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিল । বুঝতে পারল শরীরটা আস্তে আস্তে গলে গিয়ে ফেনা হয়ে যাচ্ছে ; জল থেকে সূর্য উঠল, কোমল গরম কিরণগুলি জলকন্যার গায়ে পড়ল, সে যে মরে যাচ্ছে সে কথা প্রায় টেরই পাচ্ছিল না। তখনো অপূর্ব গৌরবময় সূর্য দেখতে পাচ্ছিল। মাথার উপর হাজার হাজার জলের মতো স্বচ্ছ সুন্দর ওরা কারা ভেসে বেড়াচ্ছে ? বাতাসে তৈরি তাদের কি মধুর গলার স্বর, মন শান্তিতে ভরে যায়। ও তাদের ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না ; ডাঙার মানুষদের তাদের স্বর শুনবারও সাধ্য নেই। ওরা এত হাল্কা যে ডানা ছাড়াই চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিল ছোটো জলকন্যা চেয়ে দেখল ওর নিজেরও তাদের মতে হাল্কা দেহ হয়েছে, সমুদ্রের ফেনার উপর থেকে ধীরে ধীরে সে কেমন আকাশে ভেসে উঠছে !

ছোটো জলকন্যা বলল, “ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?” ওদেরই মতো মধুর তার স্বর। কে একজন উত্তর দিল, “তুমি কি বাতাসের মেয়েদের কথা বলছ ? জলকন্যাদের অমর আত্মা থাকে না, মানুষের ছেলের ভালোবাসা পেলে তবেই সেই স্বৰ্গীয় গুণটি লাভ করে।

মানুষের সঙ্গে মিলন হলে, তবে সে অমর হয়। বাতাসের মেয়েদেরও অমর আত্মা থাকে না, কিন্তু ভালো কাজ করলে তারা অমর হয়। গরম দেশের শুকনো হাওয়ায় মানুষরা অবসন্ন হয়ে পড়ে, আমরা সেখানে যাই ; আমাদের শীতল নিশ্বাসে তারা সুুস্থ হয়। আমরা বাতাসে ছড়িয়ে থাকি ; ফুলের সুগন্ধ দিয়ে বাতাসকে মধুর করে রাখি, সমস্ত পৃথিবীতে আনন্দ আর স্বাস্থ্য ছড়াই। তিনশো বছর এভাবে কাটালে আমরা অমর হই, মানুষরা যে সীমাহীন আনন্দ ভোগ করে, তার ভাগ পাই।

“আর তুমি, দুঃখিনী জলকন্যা, মনের বাসনা পূর্ণ করতে গিয়ে কতনা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছ, তাই তুমি বাতাসের অপার্থিব জগতে আসতে পেরেছ । তিনশো বছর ভালো কাজ করলে, তুমিও অমর আত্মা লাভ করবে।” স্বচ্ছ বাহু দুটি জলকন্যা সূর্যের দিকে তুলে ধরল, জীবনে এই প্রথম তার চোখের পাতা জলে ভিজে এল ।

এদিকে জাহাজে সকলে জেগে উঠে উৎসবের আনন্দে মেতেছে। জলকন্যা রাজপুত্রকে আর রূপসী রাজকন্যাকে দেখতে পেল। ওরা ওকে খুঁজে পায় নি। মনের দুঃখে ফেনায় ভরা জলের দিকে ওরা চেয়েছিল, যেন বুঝতে পেরেছিল ও জলে ঝাঁপ দিয়েছে। অদৃশ্যভাবে রাজপুত্রের কপালে একটি চুমো খেয়ে, জলকন্যা জাহাজের মাথার উপরকার শান্ত গোলাপি মেঘের অনেক উপরে উড়ে চলে গেল। “তিনশো বছর পরে আমরা স্বৰ্গলোকে পৌছব।” এক বোন কানে-কানে বলল, “তারও আগে পৌছান যায়। যেখানেই মানুষের ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, আমরা সেখানে যাই ; কেউ আমাদের দেখতে পায় না। যদি কোথাও দেখি লক্ষী ছেলেমেয়ে মা-বাবাকে সুখী করে তাদের ভালোবাসার যোগ্য হয়ে উঠছে, আমাদের তিনশো বছরের মেয়াদ থেকে এক বছর কমে যায়। যদি দেখি বেয়াড় দুষ্ট, ছেলেমেয়ে, আমরা করুণভাবে কাঁদি আর এক-এক ফোঁটা চোখের জলে আমাদের মেয়াদ একদিন করে বেড়ে যায়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *