ছোটাচ্চুর অফিস যাত্রা…
ছোটাচ্চু ফুটপাথে দাঁড়িয়ে তার অফিসের দিকে তাকাল। সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা, দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। ওপরে বাংলায় নিচে ছোট করে ইংরেজিতে। তার নিচে ঠিকানা। কতদিন পর আজ ছোটাচ্চু তার অফিসে আসছে। তার নিজের হাতে তৈরি করা অফিস অথচ সরফরাজ কাফী সেটা দখল করে নিয়েছিল। বাসার বাচ্চাদের নানা কাজকর্মে ছোটাচ্চু মাঝে মাঝেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হবে তাদের জন্য শেষ পর্যন্ত ছোটাচ্চু তার অফিসটা ফেরত পেয়েছে। আবার সে এখানে কাজ শুরু করবে। ছোটাচ্চু একটুখানি আবেগপ্রবণ হয়ে গেল।
ছোটাচ্চু পকেট থেকে চাবি বের করে দরজাতে লাগাতে গিয়ে একটু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। শুধু যে বন্ধ তা-ই না, মনে হলো ভেতরে মানুষজনের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কী আশ্চর্য!
ছোটাচ্চু দরজায় শব্দ করল, তখন শুনল একজন এসে দরজার ছিটকিনি খুলে একটুখানি দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
ছোটাচ্চু গলার স্বর চিনতে পারল এবং মানুষটিকেও চিনতে পারল, তার ভাগনি টুম্পা। টুম্পা এখানে কী করছে জিজ্ঞেস করার আগেই টুম্পা তাকে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু? তুমি? তুমি এখানে কী করছো?”
ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি কী করছি মানে! আমার অফিসে আমি আসব না?”
টুম্পা বলল, “কিন্তু পাসওয়ার্ড না জানলে অফিসে ঢোকা যাবে না। বলো পাসওয়ার্ড কী?
“পাসওয়ার্ড?” ছোটাচ্চু রেগে বলল, “ঢং পেয়েছিস?”
টুম্পা বলল, “উঁহু, হয় নাই। ‘ঢং পেয়েছিস’ পাসওয়ার্ড না।”
বলে কিছু বোঝার আগেই টুম্পা দড়াম করে তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। ছোটাচ্চু কয়েক সেকেন্ড কী করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আবার দরজা ধাক্কা দিলো। এবার আগের থেকে জোরে।
এবারে ছোটাচ্চু দরজার অন্য পাশে একটু ফিসফিস কথা শুনতে পেল, তারপর আবার দরজা খুলে গেল, এবার দরজার ফাঁক দিয়ে ছোটাচ্চু পুরো বাহিনীকে দেখতে পেল, মুনিয়া, টুম্পা, টুনি, প্রমি, শান্ত এবং অন্য যারা আছে। শান্ত গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তুমি কী চাও?”
ছোটাচ্চু এবারে সত্যি সত্যি রেগে উঠল, “আমি কী চাই? আমি কী চাই মানে? তোরা এখানে কী করে এসেছিস? তোরা কী চাস?”
টুনি শান্ত গলায় বলল, “তোমার যোগাযোগ না করে আসা উচিত হয় নাই ছোটাচ্চু। যোগাযোগ করে আসা উচিত ছিল।”
ছোটাচ্চু এবারে প্রায় চিৎকার করে বলল, “আমার নিজের অফিসে আসার আগে তোদের সাথে যোগাযোগ করে আসা উচিত ছিল?”
এবারে শান্ত বলল, “এটা এখনও তোমার নিজের অফিস হয় নাই ছোটাচ্চু। আমরা এটা উদ্ধার করেছি, সেই জন্য এখন এইটা আমাদের অফিস। আমরা যখন তোমাকে বুঝিয়ে দেবো তখন থেকে এইটা হবে তোমার অফিস।”
টুম্পা বলল, “তার মানে যখন তোমাকে হস্তান্তর করব—”
ছোটাচ্চু প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বলল, “হস্তান্তর? তুই হস্তান্তর বানান জানিস?”
টুম্পা শান্তভাবে বলল, “জানব না কেন? শুধু দন্ত্য-স না মূর্ধন্য-ষ সেটা মাঝে মাঝে একটু প্যাঁচ লেগে যায়—”
দরজায় সবচেয়ে নিচে মুনিয়ার মাথাটা দেখা গেল। সে রিনরিনে গলায় বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চু, পাসওয়ার্ড ছাড়া তুমি ঢুকতে পারবে না। পাসওয়ার্ডটা শুরু হয়েছে চ দিয়ে–-”
ছোটাচ্চু হুংকার দিলো, “চোপ—”
“হয় নাই।”
মুনিয়ার কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল, সেটা শুনে ছোটাচ্চু আরো রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল আশেপাশে মজা দেখার জন্য বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। ছোটাচ্চু এবারে গলা নামিয়ে নরম গলায় বলল, “এই তোরা কী পাগলামো করছিস? দরজা খোল–চারপাশে মানুষ জমে যাচ্ছে—”
বাচ্চারা নিজেদের মাঝে ফিসফিস করে কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর টুনি বলল, “ঠিক আছে তোমাকে ঢুকতে দিচ্ছি কিন্তু ঠিক দশ মিনিটের জন্য। তারপর তুমি চলে যাবে।”
“সেটা দেখা যাবে।”
টুম্পা বলল, “কিন্তু আগে পাসওয়ার্ডটা বলো। পাসওয়ার্ড হচ্ছে ‘ইলিশ মাছ’।”
ছোটাচ্চু দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “ইলিশ মাছ মোটেও চ দিয়ে শুরু না।”
বাচ্চারা ছোটাচ্চুর কথায় উত্তর না দিয়ে দরজা খুলে দিলো। ভিতরে ঢুকে দেখে অফিসে সবাই আসর জমিয়ে বসেছে। কাগজপত্র ছড়ানো- ছিটানো, এদিক-সেদিক চিপসের খালি প্যাকেট এবং কোল্ড ড্রিঙ্কসের খালি বোতল। সরফরাজ কাফী টাকা-পয়সা উপার্জন করার জন্য নানা ধরনের স্যুভেনির বিক্রি করত। তার মাঝে একটা হচ্ছে মগ। মগগুলো একটার ওপর একটা রেখে পিরামিডের মতো একটা টাওয়ার বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে, যেকোনো সময়ে সেগুলো পড়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে। বাইরের ঘরের মাঝামাঝি সিলিং ফ্যানের একটা খালি হুক থেকে একটা দোলনা ঝোলানো হয়েছে। তার দামি চেয়ারটা এক পাশে পড়ে আছে, মনে হচ্ছে একজন সেখানে বসে অন্যরা সেটা ঠেলে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। পিছন দিকে তার নিজের অফিসটার দরজা খোলা, দেখা যাচ্ছে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর একটা বিছানা পাতা আছে।
ছোটাচ্চু এক নজর দেখে মুখ কালো করে বলল, “এখানে কী হচ্ছে?” শান্ত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “মনে আছে তো, দশ মিনিট?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমার কোনো ক্লায়েন্ট যদি কেস নিয়ে আসে, তারা দেখে কী বলবে?”
টুম্পা বলল, “আসছে তো।”
ছোটাচ্চু গলা উঁচিয়ে বলল, “আসছে?”
“হ্যাঁ।”
“ভিতরে ঢুকছে?”
“হ্যাঁ।”
“এই অবস্থা দেখছে?”
“না। তখন আমরা গুছিয়ে ফেলি। তারা টের পায় না।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলে, “তোদের দেখে অবাক হয় না?”
“নাহ্! আমরা বলি তুমি এখন অফিসের বাইরে, আমরা তাই অফিস পাহারা দিচ্ছি।”
“তারা বিশ্বাস করে?”
“করবে না কেন?” টুনি বলল, “আমরা তাদেরকে বসতে বলি, চা খেতে বলি। কেউ অবশ্যি চা খেতে রাজি হয় না।”
শান্ত যোগ করল, “এমনভাবে বলি যেন তারা রাজি না হয়।”
“কীভাবে বলিস?”
“একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করি এক কাপ চায়ে কয় চামচ চা পাতা দিতে হয়। কতটুকু লবণ দিতে হয়। শুনে কেউ আর চা খেতে রাজি হয় না।”
ছোটাচ্চু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টুনি তখন ছোটাচ্চুকে সান্ত্বনা দিলো, বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই। তোমার একটা কেসও মিস হয় নাই।”
টুম্পা মাথা নাড়ল, “সবগুলি কেস আমরা নিয়ে রেখেছি।”
ছোটাচ্চু চোখে বড় বড় করে বলল, “সবগুলো কেস তোরা নিয়ে রেখেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
“আমরা তাকে একটা ফরম দিয়েছি। সেই ফরমে তারা সবকিছু লিখে দিয়েছে।”
ছোটাচ্চু চোখ আরো বড় বড় করে বলল, “ফরম? ফরম তোরা কোথায় পেলি?”
শান্ত বলল, “ড্রয়ারের ভিতর ছিল। মনে হয় সরফরাজ কাফী তৈরি করেছিল।”
ছোটাচ্চু কঠিন মুখে বলল, “আছে তোদের কাছে সেই ফরম? দেখি কীভাবে ফরমে লিখেছে?”
টুনি তখন টুম্পাকে বলল, “টুম্পা ফরমগুলি নিয়ে আয় দেখি।”
টুম্পা তখন খুব গম্ভীর মুখে ফরম আনতে গেল এবং একটু পরে একটা ফাইল নিয়ে হাজির হলো। ছোটাচ্চু সেই ফাইল হাতে নিয়ে ভেতর থেকে একটা ফরম বের করল। ফরমের ওপর কিছু ইংরেজি অক্ষর আর সংখ্যা লেখা। ছোটাচ্চু সেটা দেখিয়ে বলল, “এগুলো কী লেখা?”
মুনিয়া বলল, “এটাকে বলে স্মারক নম্বর। সবসময় ফরম ফিলআপ করলে স্মারক নম্বর দিতে হয়। তাই না টুনি আপু?”
টুনি মাথা নাড়ল।
ছোটাচ্চুও মাথা নাড়ল কিন্তু ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল একটু হতাশভাবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “এই স্মারক নম্বরগুলোর মানে কী?”
মুনিয়া বলল, “জানি না।”
“তাহলে কে জানে?”
টুনি বলল, “আমরাও জানি না। শুধু টুম্পা জানে।”
ছোটাচ্চু তখন টুম্পাকে জিজ্ঞেস করল, “এই স্মারক নম্বর কীভাবে দিয়েছিস? এই যে লেখা এম কে ডি ডি, তার মানে কী?”
টুম্পা বলল, “এই সহজ জিনিসটাও বুঝতে পারছো না? এম কে ডি ডি মানে হচ্ছে ‘মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি’।”
ছোটাচ্চু হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না, হাসি চেপে জিজ্ঞেস করল, “আর এই তেইশ স্ল্যাশ সাত স্ল্যাশ তিনশ বাহান্ন মানে কী?
“তেইশ হচ্ছে আমার বার্থডে, সাত হচ্ছে আমার প্রিয় সংখ্যা।”
“আর তিনশ বাহান্ন?”
“তিনশ বাহান্নর কোনো মানে নাই। এমনি একটা সংখ্যা। শুনতে ভালো লাগে।”
ছোটাচ্চু আরেকটা ফরম নিল। সেটার স্মারক সংখ্যাটা দেখে বলল, “এই ফরমের স্মারক সংখ্যাটার মানে কী? এন এন এম?”
“নাদুসনুদুস মহিলা।”
“আর ডি এম এইচ পি বি?”
“দেখে মনে হয় পেটে ব্যথা।”
ছোটাচ্চু ফরমগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ থেমে গেল। একটা ফরমের ওপর লাল কালিতে লেখা ‘কেস সলভড’। ছোটাচ্চু বলল, “এইটা সলভ হয়ে গেছে?”
সবাই মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কে সলভ করেছে?”
টুনি বলল, “তুমি।”
“আমি কখন সলভ করছি?”
“আমি তোমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছি, তুমি ফোনে বলে দিয়েছো।”
ছোটাচ্চু একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, “তুই কখন আমাকে ফোন করলি, আমি কখন তোকে বললাম?”
শান্ত বলল, “আসলে তুমি কিছু করো নাই কিন্তু আমরা এই মহিলাকে সেটা বুঝিয়েছি। তা না হলে পেমেন্টের জন্য বিল পাঠাতে পারব না।
“পেমেন্টের জন্য বিল পর্যন্ত পাঠানো হয়ে গেছে?”
শান্ত মাথা নাড়ল।
ছোটাচ্চু হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল, “দেখ, সবকিছুরই একটা সীমা থাকা দরকার। আমার নাম ব্যবহার করে কী করা হচ্ছে আমার সেটা জানতে হবে। কী হয়েছে বল।”
টুনি বলল, “অবশ্যই তুমি জানতে পারো ছোটাচ্চু। ব্যাপারটা হচ্ছে এ রকম–” বলে টুনি স্মারক নম্বর এম এম আর আর সি (মোটা মহিলা রাগী রাগী চেহারা) ২১/১৩/২৪২ কেসটা ছোটাচ্চুকে বলতে লাগল।
.
সকালবেলা দরজায় শব্দ শুনে একজন উঁকি দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ফিরে এসে ফিসফিস করে বলল, একজন রাগী রাগী চেহারার মহিলা এসেছে। সাথে সাথে সবাই কাজে লেগে গেল। শান্ত টেবিলের ওপর চেয়ার রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে ফ্যানের হুক থেকে দোলনাটা খুলে ফেলল। মুনিয়া ঝটপট চিপসের প্যাকেট আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের খালি বোতল সরিয়ে ফেলল। টুম্পা ছোটাচ্চুর চেয়ারটা ঠেলে ছোটাচ্চুর ঘরে নিয়ে গেল। প্রমি ঝটপট কয়েকটা বই খুলে এখানে- সেখানে রেখে দিলো এবং সবাই সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার ভান করতে লাগল। টুনি সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে সব ঠিকঠাক আছে সেটা নিশ্চিত করে এক হাতে একটা খোলা মোটা বই নিয়ে দরজা খুলে দিলো।
রাগী রাগী চেহারার মহিলা মুখ শক্ত করে ভিতরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকালেন। ডিটেকটিভ এজেন্সির বদলে কিছু বাচ্চাকাচ্চাকে বিভিন্ন জায়গায় বসে লেখাপড়া করতে দেখে বেশ অবাক হলো। মহিলা টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “এইটা ডিটেকটিভ এজেন্সি না?”
“জি।”
“তাহলে, তোমরা বাচ্চাকাচ্চারা এইখানে কী করছো? বড় মানুষ কই?”
“আমার চাচা হচ্ছেন ডিটেকটিভ শাহরিয়ার। চাচা ইমার্জেন্সি একটা কাজে বাইরে গেছেন। তাই আমরা পাহারা দিচ্ছি।”
“অন্য বড় মানুষ?”
“এখনও তারা কাজ শুরু করে নাই, তাই আমরা এসেছি।”
দূর থেকে শান্ত বলল, “নিরিবিলি লেখাপড়া করার জন্য। টুনি বলল, “আপনি কি কোনো কাজে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, কিন্তু যেহেতু তোমার চাচা নাই আমি আরেক দিন আসব।”
“আপনি বসতে পারেন। আমার চাচা বলেছেন কেউ যদি আসে তাহলে যেন আমরা বসতে বলি। একটু চা-নাস্তা দিই।”
চা-নাস্তার কথা শুনে মহিলা মনে হয় একটু দুর্বল হলেন, আরো কয়েক পা অগ্রসর হলেন। টুনি তখন একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো। মহিলা সেখানে বসলেন।
টুম্পা এসে বলল, “টুনি আপু, আমি কি চা বানিয়ে আনব?”
“তুই কি পারবি?”
“শুধু বলে দাও এক কাপ চা বানাতে কয় চামচ চা, কয় চামচ চিনি আর কতটুকু লবণ দিতে হবে।”
মহিলা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “না, না, চা বানাতে হবে না।”
টুনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মহিলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি হাসি মুখে বলল, “ম্যাডাম, আমার চাচা বলেছেন কেউ যদি কোনো সমস্যা নিয়ে আসে তাহলে আমরা যেন তার সমস্যাটার কথা জেনে রাখি। আমার চাচা পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন।”
মহিলা ভুরু কুঁচকে বললেন, “তোমরা কেমন করে সমস্যার কথা জেনে রাখবে? তোমরা এত ছোট মানুষ?”
টুনি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না আমরা নিজেরা জেনে রাখব না। আমরা আপনাকে একটা ফরম দিবো, আপনি সেই ফরমে সবকিছু লিখে দেবেন।”
মহিলা বললেন, “ও।” মনে হলো ফরমের কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন। পৃথিবীর সব মানুষ ফরম ফিলআপ করার কথা শুনলে একটু ঘাবড়ে যায়।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “দিবো একটা ফরম?”
মহিলা দুর্বলভাবে বললেন, “দাও একটা ফরম। দেখি।”
টুনি গলা উঁচিয়ে বলল, “টুম্পা, একটা ফরম নিয়ে আয় দেখি।”
টুম্পা তার ফাইল থেকে একটা ফরম নিয়ে দ্রুত ওপরে স্মারক নম্বর দিয়ে দিলো এম এম আর আর সি (মোটা মহিলা রাগী রাগী চেহারা) ২১/১৩/২৪২ তারপর ফরমটা মহিলার হাতে তুলে দিলো। মহিলাটা ফরমটা নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, মনে হলো তার মুখটা আরো বেজার হয়ে গেল। তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “চশমাটা আনতে ভুলে গেছি।”
টুনি বুঝতে পারল চশমা আনতে ভুলে যাওয়ার কথাটি আসলে ভুয়া! মহিলার হাতের লেখা নিশ্চয়ই খুবই খারাপ, একেবারে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং আর নিশ্চয়ই কিছু লিখতে গেলেই বানান ভুল করবে! টুনি তখন মহিলাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করল, বলল, “ম্যাডাম, আপনি যদি চান তাহলে আপনি মুখে বলতে পারেন, আমি লিখে দিবো।”
মহিলার মুখের বেজায় ভাবটা একটু দূর হলো। বললেন, “হ্যাঁ। সেইটাই ভালো।”
টুনি তখন ফরম থেকে পড়ে শোনাতে লাগল এবং মহিলা মুখে বলতে লাগলেন এবং টুনি তার ঝকঝকে হাতের লেখায় সেটা লিখে দিতে লাগল। নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর, ই-মেইল—এগুলো শেষ হওয়ার পর ফরমে সমস্যার বর্ণনা লেখার কথা। মহিলা বলতে লাগলেন এবং টুনি কম কথায় গুছিয়ে লিখতে লাগল। মহিলার সমস্যাটা একদিক দিয়ে খুব গুরুতর না আবার অন্যদিক দিয়ে দেখলে বেশ গুরুতর।
সমস্যাটা হচ্ছে, গত কিছুদিন থেকে মহিলা হঠাৎ করে দেখছেন তার ব্যাগ থেকে কেউ যেন খুচরা টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। খুচরা টাকা তো আর কেউ হিসাব করে ব্যাগে রাখে না, তাই সেখান থেকে কিছু খুচরা টাকা কেউ সরিয়ে নিলে সেটা কেউ সহজে ধরতে পারে না। একদিন রিকশা ভাড়া দেওয়ার জন্য একটা বিশ টাকার নোট দিতে গিয়ে দেখেন সেই নোটটা নাই। ঘটনাক্রমে এই বিশ টাকার নোটটার কথা তার মনে ছিল কারণ ব্যাগে রাখার সময় আলাদা করে তার চোখে পড়েছিল। নোটের ওপর কেউ কলম দিয়ে লিখে রেখেছিল ‘দিন যায় কথা থাকে’।
যখন তার সন্দেহ হতে থাকে যে তার ব্যাগ থেকে কেউ খুচরা টাকা সরিয়ে নিচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার বাসায় যে মহিলা কাজ করে তার ওপর সন্দেহ হয়েছিল। সেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করার পর মহিলা একেবারে কিরা-কসম কেটে বলল সে তার ব্যাগ থেকে টাকা নেয় নাই। যখন খুব রাগ করলেন তখন হঠাৎ করে বালিশের নিচে সেই টাকা পাওয়া গেল। মহিলা তখন একটু লজ্জাই পেয়েছেন।
মহিলা যখন এই অংশটা বর্ণনা করছিলেন তখন টুনি জিজ্ঞেস করল, “বালিশের নিচে টাকাটা কীভাবে পেয়েছিলেন? মহিলা বললেন, “আসলে আমি নিজে খুঁজে পাই নাই। আমার ছেলে খুঁজে বের করেছে।”
টুনি সাথে সাথে বুঝে গেল মহিলার ব্যাগ থেকে খুচরা টাকা কে সরিয়ে নিচ্ছে কিন্তু তার পরেও নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলের বয়স কত?”
“তেরো বৎসর।”
টুনি ছেলের বয়সটা ফরমে লিখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি বালিশের নিচে কেন টাকা রেখেছিলেন!”
মহিলা মাথা চুলকালেন, বললেন, “সেইটা তো মনে করতে পারছি না। আজকাল প্রায়ই অনেক কিছু ভুলে যাই। ডেঙ্গু হয়েছিল, মনে হয় সেই জন্য।”
ডেঙ্গু হলে মানুষ ভুলে যায় টুনি সেটা জন্মেও শুনে নাই, কিন্তু তারপরেও সেটা ফরমে লিখে নিল। তারপর বলল, “ম্যাডাম, আমার চাচা থাকলে আপনাকে আরো অনেক প্রশ্ন করতেন আমি তো সেইগুলো জানি না। কিন্তু তারপরেও যেটা প্রশ্ন করতে পারতেন সেটা কি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারি?”
মহিলা ভুরু কুঁচকে টুনির দিকে তাকালেন তারপর একটু অনিশ্চিতের মতো বললেন, “করো।”
“আপনি কাউকে সন্দেহ করেন?”
“বাসায় তো সবই নিজের মানুষ। আমি, আমার ছেলে আর ছেলের বাবা। বাইরের মানুষ হচ্ছে কাজের মেয়েটা। সন্দেহ করলে তো তাকেই করতে হবে। কিন্তু —”
“কিন্তু কী?”
“মেয়েটা অনেক দিন থেকে আছে। এই টাকা সরানোর অভ্যাস হওয়ার আগে তো ভালোই ছিল। বিদায়ও করে দিতে পারছি না। আজকাল কাজের মানুষ পাওয়া খুব মুশকিল।”
টুনি এবারে মোক্ষম প্রশ্নটা করল, “আগেও কি এ রকম হয়েছে যে আপনি টাকা কোথাও রেখে ভুলে গেছেন? পরে খুঁজে পেয়েছেন।”
মহিলা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝেই হয়। টাকা খুঁজে পাই না। চিৎকার করার পর একটু খোঁজাখুঁজি করে খুঁজে পাই।”
“কে খুঁজে পায়?”
“আমার ছেলেই খুঁজে পায়।”
“কোথায় খুঁজে পায়?”
“কখনো বালিশের নিচে। কখনো বইয়ের ভেতরে। কখনো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে। নিশ্চয়ই মনের ভুলে রেখে দিই, মনে থাকে না।”
টুনি মাথা নাড়ল তারপর বলল, “আমার মনে হয় আপনার পুরো সমস্যাটি আমি লিখে ফেলেছি। আমি কি একবার পড়ে শোনাব?”
টুনি পড়ে শোনাল এবং মহিলা এখানে-সেখানে এক-দুইটা শব্দ ঠিক করে দিলেন। টুনি তখন জিজ্ঞেস করল, “আপনি যদি চান আমি তাহলে ফোনে আমার ডিটেকটিভ চাচার সাথে কথা বলতে পারি। পাব কি না জানি না—”
“ঠিক আছে দেখো।”
টুনি তখন ছোটাচ্চুর অফিসে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ভেতর থেকে সে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলার অভিনয় করল। একটু পরে মুখ গম্ভীর করে বের হয়ে এলো। মহিলা জিজ্ঞেস করল, “পেয়েছো তোমার ডিটেকটিভ চাচাকে?”
“জি পেয়েছি। কথাও বলেছি।”
“কী বলেছেন?”
“বলেছেন আপনার ছেলে টাকা সরাচ্ছে। টাকা সরানোর অনেক পুরোনো টেকনিক হচ্ছে ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে অন্য জায়গায় লুকিয়ে রাখা। যদি সেটা নিয়ে হইচই হয় তাহলে খুঁজে বের করে দেওয়া হয়। যদি হইচই না হয় তাহলে কয়েক দিন পর টাকাটা মেরে দেওয়া হয়।”
মহিলার মুখটা কালো হয়ে গেল। নাকটা কেমন যেন ফুলে উঠে তারপর সেই নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের হয়ে আসে। তাকে দেখে কেমন যেন ভয় হতে থাকে। মহিলা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “পাজি বদমাইশ বান্দরের বাচ্চা—আজকে যদি আমি খুন করে না ফেলি। পিটিয়ে লাশ ফেলে দিবো। আমার সাথে মাস্তানি?”
মুনিয়া রিনরিনে গলায় বলল, “ম্যাডাম—”
মহিলা ঘুরে মুনিয়ার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী?”
মুনিয়া বলল, “শারীরিক শাস্তি দেওয়া ঠিক না। সেটা শিশুদের চারিত্রিক গঠনের অন্তরাল—”
টুম্পা ঠিক করে দিলো, “অন্তরাল না, অন্তরায়।”
মহিলা বিষ দৃষ্টিতে একবার মুনিয়ার দিকে আরেকবার টুম্পার দিকে তাকালেন, তারপর দুপদাপ করে দরজার দিকে হেঁটে গেলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে শান্ত দৌড়ে এসে তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো।
মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কী?”
“এই ডিটেকটিভ এজেন্সির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর।”
মহিলা কাগজটা হাতে নিয়ে দুপদাপ করে বের হয়ে গেলেন।
.
পুরো কাহিনিটা শুনে ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইল। তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তোরা কী ডেঞ্জারাস! সর্বনাশ”
টুম্পা মনে করিয়ে দিলো, “দশ মিনিট হয়ে গেছে ছোটাচ্চু!”