ছোটসাহেব
শরৎকালের কোনও কোনও বিকেলে বেগমবাহার ঘুড়ির কাটাকুটির মতো সাদা মেঘ আর কালো মেঘ ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে।
সহসা হু হু করে বাতাস আসে। কোন দিক থেকে আসবে বোঝা কঠিন, সাদাকালো মেঘগুলো ক্রমাগত দিক বদল করে। এদিকেরটা ওদিকে যায়, ওদিকেরটা এদিকে আসে।
গোপালগ্রামের ছোটসাহেব তাঁদের দোতলা বাড়ির ভাঙা ছাদে উঠে একটা অদৃশ্য লাটাই হাতে মেঘগুলোকে কন্ট্রোল করেন। কখনও সুতো ছাড়ছেন তো ছাড়ছেনই। একটা বেয়াদপ সাদা মেঘকে কখনও মণ্ডলপাড়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা তারপর ধানক্ষেত, বালির চর, খেয়াঘাটের ওপর দিয়ে ইছামতী নদী পার করিয়ে দেন।
আবার একটু পরেই একটা নাদুসনুদুস কালো মেঘকে মাথার ওপর টেনে আনেন। মেঘটা বড়সড়, মোটা-সোটা হলে কী হবে ভারি ভিতু, ছোটসাহেবের হাতে পড়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
ছোটসাহেবের মনটা খুব নরম। ভিতু মেঘটার কান্নাকাটি দেখে সেটাকে অব্যাহতি দেন, বলেন, যা, ছেড়ে দিলাম। এখন কিছুক্ষণ আমগাছের মাথায় যা, তারপর হাজিপাড়া হয়ে চলে যাবি।
আবার একেকসময় খুব কড়া ভাবে শাসন করেন গোলমেলে মেঘগুলোকে। গতকাল বিকেলে কোনও কারণ নেই, পরিষ্কার আকাশে হঠাৎ কোথা থেকে দুটো কালো মেঘ এসে মোষের মতো শিং উঁচিয়ে একেবারে মাথার ওপরে রামরাবণের যুদ্ধ শুরু করে দিল।
এদিকে পরশুদিনই সকালবেলা কাজের মাসি দুর্গারানীকে ছোটসাহেব বলেছিলেন কালকের দিনের জন্যে মেঘগুলোকে তাড়িয়েছি। দুর্গাদি, তুমি কাল ময়লা বাসি কাপড়জামা সব কেচে দাও। আমার মশারিটাও কেচে দিও। আর ছাদের ওপরে আচার, কাসুন্দি, ডালের বড়ি সব রোদে শুকোতে দাও।
দুর্গারানী ছোটসাহেবকে ছোটসাহেবের জন্ম ইস্তক দেখে আসছে। ছোটসাহেবের কথায় রোদ উঠবে, বৃষ্টি হবে না–এমন সব কথা বিশ্বাস করার পাত্রী সে নয়। কিন্তু ছোটসাহেবের কথামতো কাজ না হলে ঝামেলা হবে, এ কথা দুর্গারানী হাড়ে হাড়ে জানে।
সাত-সকালে উঠে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে দুর্গারানী ছাদে উঠে আচারকাসুন্দি সব রোদে দিয়েছিল। এসব কাজ শুদ্ধভাবে করতে হয়, না হলে আচার-টাচার সব পচে যায়।
ভোরবেলা ছাদে উঠে কিন্তু দুর্গারানীর মন প্রসন্ন হয়ে গিয়েছিল।
ফুরফুরে নীল আকাশ। সাদা বা কালো বা ঘেঁড়া ছেঁড়া কোনও রকম মেঘই আকাশে নেই। পুব দিক থেকে থেমে থেমে হালকা বাতাস বইছে। নীলকণ্ঠ ফুলের একটা বুড়ো লতাগাছ উঠোন থেকে ছাদে উঠেছে, তার সবুজ পাতা ঢেকে গেছে নীল ফুলে, সেগুলো হালকা হাওয়ায় তির তির করে কাঁপছে। পুজো এসে গেছে। দূরে কোথায় ডাক বাজছে।
এদিকে ছাদের নীচে ঠাকুরদালানের বাগানে শ্বেতকাঞ্চন আর টগরের সাদা ফুল থই থই করছে। ঘোর বর্ষার শেষে শ্বেত গন্ধরাজ ফুলের ঝাড়ে হঠাৎ রীতিমতো হইচই, কয়েকশো গন্ধরাজ ফুটেছে, তার সৌরভ এই খোলা ছাদে ছড়িয়ে পড়েছে।
দূরে হাটখোলার অশ্বত্থ গাছের দুটো বড় ডালের ফাঁক দিয়ে সূর্য উঠে এসেছে। আবছা গোলাপি বর্ণের রোদ আস্তে আস্তে সাদা হচ্ছে।
দুর্গারানী এত শত বোঝে না, বোঝার দরকারও নেই। কিন্তু সে বুঝতে পারে বর্ষাকালের শেষে এটা একটা আশ্চর্য সকাল।
আরেকটা ব্যাপার হয়েছে।
দুর্গারানী আজ তার বদ্ধমূল ধারণা বদল করতে চলেছে। মেঘ বাতাস-রোদ ওসবের ওপর ছোটসাহেবের ক্ষমতা জারির ব্যাপারটা সে পাগলামি বলেই এতকাল মনে করেছে। আজ বর্ষা শেষের এই সুনীল সুপ্রসন্ন ভোরবেলা তার মনে হল ছোটসাহেব ভুল বলেনি। যা বলেছিল, আজ সকালে অন্তত অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।
অবশ্য ছোটসাহেবের পাগলামির কম দাপট এতকাল তাকে সামলাতে হয়নি।
কী খটমট সব মন্ত্র ছোটসাহেবের, সেগুলো দুর্গারানী মনে রাখতেও পারে না, বলতেও পারে না, কিন্তু না বললে চলবে না।
গত সপ্তাহে একদিন ভরদুপুরবেলা ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। ছোটসাহেব দালানের বড় ঘরের খাটে গা এলিয়ে শুয়ে আছেন। সারা সকাল প্রচুর ধকল গেছে তার, গোটা দশেক অবাধ্য দেবদারু চারাকে উঠ-বোস করিয়েছেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে দেখলেন ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। এই সময়ে বৃষ্টি নামাটা ছোটসাহেবের মোটেই পছন্দ হয়নি। দেবদারুর বাচ্চাগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন আছে, কঠোর রোদে ওগুলোকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। অসময়ে বৃষ্টি এসে তাও সব ভেস্তে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে দুর্গারানীকে তলব। সবে সে ভাতঘুমে মাদুরের ওপরে কাত হয়ে পড়েছিল। তাকে বলা হল, মন্ত্র বল। আর সে যে কী মন্ত্র!
রসগোল্লা চমচম।
যায় রে বৃষ্টি ঝমঝম ॥
রসগোল্লা
চমচম।
যায় রে বৃষ্টি কমকম ॥
রসগোল্লা
চমচম।
আয়
রে রোদ গমগম ॥
রসগোল্লা চমচম।
ছোটসাহেব মেঘের যম ॥
রসগোল্লা
চমচম।
মেঘের বংশ হল খতম ॥
দুর্গারানীর গেঁয়ো উচ্চারণে এই দারুণ পদ্য সাপুড়ের সাপ খেলানোর কিংবা ওঝার ভূত নামানোর মন্ত্রের মতো শোনাচ্ছিল।
কিন্তু সেদিন কিছুতেই কিছু হয়নি। মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে দুর্গারানীর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। একশো আটবার মন্ত্র পড়তে হয়েছিল তাকে। কিন্তু তাতেও বৃষ্টি থামেনি। বরং আরও জোরে এসেছে।
ছোটসাহেব কিন্তু তাতে মোটেই দমেননি। দুর্গারানীকে বললেন, তুমি এত জোরে জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মন্ত্রগুলো বললে যে মেঘগুলো সব ভয় পেয়ে গেল। একসঙ্গে সব দৌড়ে পালাচ্ছে। তাই বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে।
দুর্গারানী জানে এসব বাজে কথা। যত সব পাগলামি ছোটসাহেবের। দূর আকাশের ওপারে মেঘেদের নিজের দেবতা আছে, তারা গোপালগ্রামের ছোটসাহেবের মন্ত্র মানতে যাবে কেন?
ছোটসাহেবকে গ্রামসুদ্ধ নোক ওই ছোটসাহেব নামেই ডাকে কিন্তু দুর্গারানী বলে ফুচু। জমিদারি নেই, সেই কবে চলে গেছে। তবু জমিদার বাড়ি আছে। সেই পোড় ইট বের হওয়া, পলেস্তারা খসা দালানের, প্রাচীন জমিদার বংশের শিবরাত্রির সলতে, এই ফুচু তথা গজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী।
এ বাড়িতে এই রকমই সব নাম। কাগজপত্রে, সরকারি দলিলে যিনি কীর্তিনারায়ণ, ফুচুর বা ছোটসাহেবের যিনি প্রণম্য পিতামহ তাঁকে তাঁর মা-পিসিরা ডাকতেন কচু বলে। তাঁর ছেলে রায়সাহেব গর্জন নারায়ণ, বাড়ির মধ্যে তাঁর নাম ছিল ঘেঁচু। তিনিই ভুচু-ফুচুর বাবা।
এসব দুর্গারানীর শিশুকাল থেকে দেখা।
ছোটসাহেবের ঘটনাটাও দুর্গারানী ভালই জানে। ছোটসাহেবের দাদার ডাকনাম ছিল ভুচু। কিন্তু এই ভুচু নামটা চলেনি। ছোটবেলায় ভুচুর গায়ের রং এতটাই ফরসা ছিল যে লোকের মুখে মুখে তার নাম হয়ে গিয়েছিল সাহেব।
সাহেবের থেকে ছোটসাহেব তিন বছরের ছোট। ছোটসাহেবের গায়ের রং মোটেই ফরসা নয়, আর দশজন গাঁয়ের লোকের মতো গায়ের রং তার। কিন্তু দাদার সুবাদে তার ক্ষেত্রেও ফুচু নামটা চলেনি। কী করে যে হল ব্যাপারটা বলা কঠিন। আস্তে আস্তে ফুচু ছোটসাহেব হয়ে গেলেন।
এদিকে আসল সাহেব বড় হয়ে লেখাপড়া করে সেই যে বিলাত গেলেন, আর ফিরলেন না। আগে মাঝে মধ্যে দু-একটা রঙিন ছবিওলা চিঠি আসত। আজ আট-দশ বছর তাও আসে না।
ছোটসাহেবের দাদা সেই প্রথম সাহেব এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা সেটাও কেউ জানে না। গ্রামের মানুষও তাকে আর খেয়াল রাখেনি।
এ বাড়িতে একসময় তোকজন গমগম করত। দুর্গারানীর সব মনে আছে। এগারো বছর বয়েসে সে বিধবা হয়েছিল। তার পরের বছরেই তার বাবা এসে তাকে এ বাড়িতে রেখে যায়।
সাহেব, ছোটসাহেবের বাবা রায়সাহেব ঘেচু তাকে খুব ভালবাসতেন। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে সেই যেদিন আশ্রয়ের খোঁজে সে এ বাড়িতে ঢুকেছিল, তারপর একদিনের জন্যেও এ বাড়ির বাইরে থাকেনি।
দুর্গারানীর চোখের সামনে ভুচু-ফুচুর মা মারা গেলেন, বিধবা পিসি, খুড়ি কেউ বেঁচে রইল না।
বাড়িতে নায়েব-গোমস্তা-মুনিষ ছিল। গোয়াল ভর্তি গোরু ছিল। একদিন জমিদারি উঠে গেল। তার পরে সবই ধীরে ধীরে চলে গেল।
এখন এই পুরনো ভাঙা বাড়িটা আছে। তাও ভয় হয়, কবে না মাথার ওপরে ভেঙে পড়ে। অল্প কিছু ধানজমি আছে, কয়েকটা ফলগাছ, একটা পুকুর। এতেই দুর্গারানীর আর ছোটসাহেবের কষ্টেসৃষ্টে কেটে যায়।
০২.
ছোটসাহেবের খাটের নীচে অনেকগুলো প্ল্যাকার্ড। চারফুট কাঠের খুঁটিতে নানা রকম ঘোষণা:
(১) সস্তায় কালো মেঘেদের আড়ং ধোলাই করে সাদা করা হয়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
(২) উচিত মূল্যে সাদা, কালো, ডোরাকাটা, ছাড়া ছাড়া বাচ্চা মেঘ বিক্রয়। গ্যারান্টি এক বছর।
(৩) বৃষ্টিভেজা রোদ প্রতি এক হাজার বর্গফুট একশো টাকা। আশ্বিন মাসে শতকরা পঁচিশ টাকা কমিশন।
এই রকম সব পোস্টার বা প্ল্যাকার্ড, এগুলো আসলে সবই বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপনের পিছনে একটা কারণ আছে।
মাসখানেক আগে ভাঁড়ার ঘরে মাটির জালা থেকে রান্নার চাল বার করতে গিয়ে দুর্গারানী দেখে মা লক্ষ্মী প্রায় বাড়ন্ত, যার অর্থ হল খাওয়ার চাল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।
এদিকে তখনও ভাদ্র মাস পড়েনি। তারপরে আশ্বিন আছে, কার্তিক আছে, তারপর মাঠের ধান উঠবে গোলায়। অবশ্য দুর্গারানীর সংসারী বুদ্ধি ভালই আছে। বাড়ির চারপাশে পুরনো কালের অনেকগুলো নারকেল গাছ আছে। সেগুলো থেকে নারকেল পাড়িয়ে পুজোর বাজারে বেচলে ভাল দাম পাওয়া যায়। তা দিয়ে চাল কেনা যাবে। কিন্তু সেখানে ছোটসাহেবের বাধা রয়েছে।
গাছ থেকে নারকেল কাটায় ছোটসাহেবের খুব আপত্তি। কারণ এই নারকেলের লোভ দেখিয়েই আকাশের এ মাথা ও মাথা থেকে লোভী মেঘদের তিনি ডেকে আনেন। নারকেল না থাকলে তারা আসবে না।
গত বছর নারকেল বেচা নিয়ে খুব চেঁচামেচি হয়েছিল। ফুচু মানে ছোটসাহেবকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে দুর্গারানী। এই এতখানি বয়েসেও কিন্তু সে পুরোপুরি সাব্যস্ত মানুষ হয়নি। তার ইচ্ছে করে না ফুচুর সঙ্গে ঝগড়া করতে। না হলে ঝগড়া করতে দুর্গারানী কখনও পিছ-পা নয়, এ গাঁয়ের সাতপাড়ার লোক সেটা জানে।
আর ঝগড়া করেই সে এই চৌধুরী বাড়ির চৌহদ্দি, নারকেল গাছ, ফলের বাগান, ভদ্রাসন এমন। কী অবশিষ্ট জোতজমি এতদিন রক্ষা করেছে। গোপালগ্রামের পাঁচজনে জানে দুর্গারানী না থাকলে চৌধুরীদের ছোটসাহেব কবে ইছামতীর গাঙের জলে ভেসে যেত।
সুতরাং দুর্গারানী ঠিক করেছে এবার নারকেল বেচা বাদ যাক। মজা পুকুর পাড়ে একটা আদ্যিকালের বুড়ো কাঁঠাল গাছ আছে। এখন ভাল করে কাঁঠালও আসে না। কঁঠালের মুচি কালো হয়ে শুকিয়ে পড়ে যায়। সেই গাছটা দরকার হলে বেচবে। আজকাল কাঁঠাল কাঠের খুব দাম।
এ বাড়িতে অবশ্য পুরনো আমলের খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল অনেক রয়েছে। সবই মেহগনি বা শাল কঁঠালের মতো দামি এবং একালে দুষ্প্রাপ্য কাঠের।
এ ছাড়াও আছে তামার পুজোর বাসান, খোদ বেনারসের। আর ইসলামপুর, খাগড়া আর কাগমারির কাঁসা পিতলের থালা-বাটি, গেলাস কলসি, পানের ডাবর, হুঁকোর ঘটি? অনেক রয়েছে। কাঠের সিন্দুকে সব থরে থরে সাজানো আছে।
টুকটুক করে, একটা দুটো করে এসব জিনিস চুরিও যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণ থাকতে, নিজের হাতে। দুর্গারানী এসব বেচবে না, কারণ সে নিজের চোখে এ বাড়িতে এসবের ব্যবহার দেখেছে। তার কেমন একটা ভুল ধারণা, আবার হয়তো কোনও সময় খুব হইচই হবে, লোকজন, ভুচুর বউ, ফুচুর বউ, তাদের ছেলেমেয়ে, পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনে ভর্তি হয়ে আবার বাড়ি গমগম করবে।
কিন্তু এসব কবে হবে দুর্গারানী তা ভাবতে পারে না। এ ব্যাপারে ছোটসাহেবের দায়িত্ব তো কিছু কম নয়। এই যে চাল ফুরিয়ে গেছে, ছোটসাহেবের তো কিছু করা উচিত। সে-ই বাড়ির কর্তা, তাকেই তো করতে হবে। বাড়িতে কম করেও পাঁচটা মুখ। ছোটসাহেব, দুর্গারানী, দুটো কুকুর, আর বাজারের এক ভিখিরি রাতে বারান্দায় শোয়। তাকেও দুবেলা খেতে দিতে হয়।
ছোটসাহেবকে দুর্গারানী ধরল, ভাঁড়ারে চাল ফুরিয়েছে।
অবস্থাটা বিপজ্জনক বুঝে ওড়ানোর চেষ্টা করলেন ছোটসাহেব, তার আমি কী করব?
দুর্গারানী বলল, তুমি করবে না তো কে করবে? তোমারই বাড়ি। তুমিই বাড়ির কর্তা।
ঘাড় চুলকিয়ে ছোটসাহেব স্বীকার করলেন, সেটা ঠিক, কিন্তু এ সম্বন্ধে আমি কী করতে পারি?
দুর্গারানী বলল, উপার্জন।
ছোটসাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, উপার্জন? আমি কী করে উপার্জন করব? আমি তো কোনও কাজ পারি না। কিছুই জানি না।
তুমি শুধু মেঘ চরাতে জানো। এই কথা বলে গজগজ করতে করতে দুর্গারানী ছুতোর পাড়ার দিকে চলে গেল কাঁঠালগাছটা বিক্রির ব্যবস্থা করতে।
মেঘ চরাবার কথাটা কিন্তু ছোটসাহেবের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। সত্যিই তো, আর কিছু না হোক আমি তো মেঘের ব্যবসা করতে পারি।
তারপর গত একমাস ধরে ছোটসাহেব বসে বসে কাঠের খুঁটিতে হেঁচা বাঁশের বেড়ার টুকরো কেটে কেটে লাগিয়ে এই প্ল্যাকার্ডগুলো বানিয়েছেন। বাজার থেকে ফুলস্ক্যাপ কাগজ কিনে এনে আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছেন, তারপর লালনীল কালি দিয়ে একের পর এক মেঘের বিজ্ঞাপন লিখেছেন। তার হাতের লেখা চমৎকার। বড় বড় হরফে প্ল্যাকার্ডে ফুটে উঠেছে:
যদি চাই ছোট মেঘ,
নাই কোনও উদ্বেগ।
সস্তায়
ঝুড়ি ঝুড়ি,
আশি টাকা এক কুড়ি।
ছোট মেঘের বিজ্ঞাপন এরকম হালকা ভাষায় লেখা। হালকা জিনিস, সস্তা দাম।
বড় মেঘ একেকটার দাম হাজার টাকা। এর বিজ্ঞাপনটা গুরুগম্ভীর ভাষায় অনেক মাথা খাটিয়ে ছোটসাহেবকে রচনা করতে হয়েছে:
প্রকৃত বড় মেঘ পূজা মণ্ডপের সামিয়ানার চেয়েও
বৃহৎ আকারের। প্রতিটির মূল্য দুই হাজার টাকা।
তিন সপ্তাহের আগাম নোটিশ লাগিবে।
বর্ষাকালে তিনদিনের নোটিশেও হইবে।
ঠিক এরই নীচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, গ্রাহকদের প্রতি নিবেদন:
বড় মেঘ প্রতিপালন করা অতি
কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
বড় মেঘ পুষিতে যাইবেন না।
ঘর সংসার তছনছ করিয়া দিবে।
ইহা অপেক্ষা বুনো মোষ কিংবা
গণ্ডার পোষা ভাল ॥
সবসুদ্ধ প্রায় তেরো-চোদ্দটি পোস্টার হয়েছে। একটা পুরনো পঞ্জিকা খুলে বিজ্ঞাপন দেখে দেখে ছোটসাহেব প্ল্যাকার্ডগুলো লিখেছেন। তাই যেমন রয়েছে:
সকল প্রকার মেঘের সব রকম দুরারোগ্য
এবং প্রাচীন ব্যাধির চিকিৎসা করা হয়।
ঠিক তেমনিই একটা বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলা আছে, এটা অবশ্য পঞ্জিকা থেকে টুকে নয় বাজারের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটা হ্যান্ডবিল থেকে ছোটসাহেব বানিয়েছেন:
মেঘশিশুদের নার্সারি বিদ্যালয়।
আর মাত্র অল্প কয়েকটা সিট
খালি আছে।
০৩.
আজ ছোটসাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলেছে। মেঘেরা তাদের মালিককে এতদিনে চিনতে শিখেছে।
এ কদিন এত মেঘবৃষ্টির পর আজ সারাদিন পরিষ্কার আকাশ। রোদ ঝলমলে দিন।
দুর্গারানী খুব খুশি। কাসুন্দি-আচারের বয়ামগুলো সারাদিন ছাদে খুব ভাল রোদ পেয়েছে। ডালের ধামায় মুগ, ছোলা এসব তোলা ছিল, সেগুলিতে ছোট ছোট কালো বর্ষার পোকা হয়েছে। রোদ্দুরে দিয়ে সেগুলো তাড়ানো হয়েছে। এদিকে ভাড়ার ঘরে ডাল খুঁজতে গিয়ে এক বড় পেতলের কলসি ভর্তি চাল বেরিয়েছে। চাল ভাঙানোর পর কিছুটা দুর্গারানী অদিনের জন্য আলাদা করে সরিয়ে রাখে, তা মনে ছিল না। আজ চালটা পাওয়ায় সে খুব খুশি।
সকালবেলাই সব জামাকাপড়, ধুতি-চাদর, মায় ছোটসাহেবের মশারি গরম জলে সেদ্ধ করে সাবান দিয়ে কেচে দিয়েছে দুর্গারানী। সেগুলো ছাদে পতপত করে উড়ছে। মশারিটা তো নৌকার পালের মতো ফুলে ফুলে বাতাস কাটছে। শরৎকালের নীল আকাশের নীচে সাবেককালের বাড়িটা এক বড় পানসি নৌকোর মতো দেখাচ্ছে।
ছোটসাহেব তাঁর খাটের নীচ থেকে পোস্টারগুলো বার করেছেন।
আজ শনিবার। পুজোর আগে ভাদ্রমাসের শেষ হাটবার। এ সময় হাটে ভিড় বাড়ে।
ইছামতী নদীর ধারে গোপালগ্রামের পুরনো হাট। নদীর এপার ওপার থেকে দুগাঁয়ের মানুষ কেনাবেচা করতে আসে।
সেই হাটের একপাশে একটু উঁচু মতন ফঁকা জায়গা দেখে ছোটসাহেব নরম মাটিতে প্ল্যাকার্ডগুলো পুঁতে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
গ্রামের লোকেরা জমিদারবাড়ির ছোটসাহেবকে ভাল করেই জানে। কিন্তু মেঘের ব্যাপারটা জানত না। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে লাগল। সবাই এসে অন্তত একবার পোস্টারগুলো পড়ে যাচ্ছে। যারা কিছু বুঝতে পারছে না, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, কালে কালে আর কত দেখব? মেঘ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। আবার কেউ বলছে, মেঘেরা কি মানুষ হয়ে গেল নাকি? এদের খাবার জোগাবে কে?
দুর্গারানী সংসারের সাপ্তাহিক তেলমশলা, আনাজপাতি কিনতে হাটে এসেছিল। ফেরার পথে দেখে এক জায়গায় বিরাট ভিড়। ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখে ছোটসাহেব প্ল্যাকার্ডগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দুর্গারানী যখন জামাকাপড়, আচারকাসুন্দি নামাতে ছাদে উঠেছিল তখন বিজ্ঞাপনগুলো ঘাড়ে করে ছোটসাহেব বেরিয়ে এসেছে।
প্ল্যাকার্ডগুলোয় কী লেখা আছে সেটা সবটা না বুঝলেও দুর্গারানী কিছুটা বোঝে। ছোটবেলায় বিয়ের আগে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেছিল সে।
ছোটসাহেবের প্ল্যাকার্ডের ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
দুর্গারানীকে দেখে ছোটসাহেব খুশিই হবেন, কী দুর্গাদি, কেমন বুঝছ?
দুর্গারানী জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কী করছ?
ছোটসাহেব বললেন, উপার্জন। তুমি বলেছিলে না উপার্জন করতে।
মাটির ওপর থেকে খুঁটিপোঁতা প্ল্যাকার্ডগুলো তুলতে তুলতে দুর্গারানী বলল, উপার্জনের নিকুচি করেছে। তুমি করবে উপার্জন?
ছোটসাহেব চারদিকে তাকিয়ে বললেন, এই তো কত ভিড় হয়েছে। এরা কি কেউ একটা মেঘ কিনবে না? একটা মেঘের চিকিৎসা করাবে না? একটা মেঘের বাচ্চার লেখাপড়া করাবে না?
দুর্গারানী ততক্ষণে সব প্ল্যাকার্ডগুলো গুটিয়ে ফেলেছে। এবার ছোটসাহেবকে কড়া গলায় ধমক দিল, চলো। বাড়ি চলো। মেঘের কদর বোঝে এমন একটাও লোক এখানে নেই।
ছোটসাহেব কী বুঝলেন কে জানে। গুটি গুটি দুর্গাদির পিছুপিছু বাড়ি রওনা হলেন। সবগুলি প্ল্যাকার্ডই দুর্গারানী কাঁধে তুলে নিয়েছে। শুধু একটা রয়েছে ছোটসাহেবের হাতে। তাতে লেখা:
যত হবে উদ্বেগ।
কালো হবে সাদা মেঘ ॥
যত যাবে উদ্বেগ।
সাদা হবে কালো মেঘ ॥