ছোটদার গল্প

ছোটদার গল্প

বাবা বুনোহাতি নন, বাঘভালুক নন, ভুতপ্রেত নন, কিন্তু বাবার ভয়ে আমরা তটস্থ থাকতাম। বাবা একটা জগত চাইতেন, যেখানে কেউ কোনও ভুল ত্রুটি করতে পারে না।

ছেলে মেয়েরা সারাদিন এবং সারারাত পড়ার টেবিলে বসে থাকে, বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলে। নাওয়া খাওয়া, পেচ্ছাব পায়খানা, ঘুম নিদ্রা ইত্যাদিতে অতি সামান্য সময় ব্যয় করে, যতটুকু না হলেই নয়। জ্ঞান বর্ষণ করতেন সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে, ছাত্ৰানাম অধ্যয়নম তপঃ। বড় বড় মাঠ ছিল বাড়ির সামনে, সেসব মাঠে খেলতে নামার স্বাধীনতা শৈশব কৈশোরে আমাদের ছিল না। বাবা ভাবতেন, ছেলে মেয়েরা বিলেত পাশ করা বড় বড় ডাক্তার হবে। ও হতে গেলে খেলাধুলা, হাসি তামাশা, আড্ডা গুলতানি সব জন্মের পর থেকেই নিষিদ্ধ করে দিতে হয়। পড়ালেখা ছাড়া আর সব কাজকেই বাবা বাজে কাজ বলে মনে করতেন। নিজে ছিলেন নামকরা ডাক্তার। ভালো ডাক্তার। অবিশ্বাস্য মনোবল আর অধ্যবসায়ের কারণে এক গহীন গ্রামের ছেলে শহরের বড় ডাক্তার বলতে পারে। না, আজ আমি আমার বাবার গল্প বলবো না। আজ বলবো ছোটদার গল্প। ছোটদা আমাদের বাড়িতে প্রথম বিপ্লব করেছিল। বাবার পায়ের আওয়াজ পেলে প্যান্টে পেচ্ছাব করে দিত বড়দা। সেখানে কি না ছোটদা বাবাকে দিয়ে নিজের জন্য একটা গিটার কিনিয়ে নিয়েছিল। আজও আমার ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে, কী করে তা সম্ভব হয়েছিল। ছোটদার কারণে আমাদের বাড়িতে প্রথম কোনও বাদ্যযন্ত্র এলো।

বই খাতা কলম পেনসিলের বাইরে প্রথম একটা জিনিস কিনলেন বাবা। হিমালয় নাড়িয়েছিল ছোটদা। এরপর এলো ক্রিকেটের ব্যাট বল। ছোটদা নেমে পড়লো রাস্তায়, ৬৯এর গণআন্দোলন তখন তুঙ্গে, পুলিশের গুলি চলছে, কাফু চলছে, ওসবের মধ্যে। বাবা জানলে পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে, জানার পরও। ছোটদার কাণ্ড দেখে ভয় লাগতো। ভাবতাম, যে কোনো সময় ছোটদা বুঝি পুলিশের গুলি খেয়ে মরবে।

গিটার তো হলো, এরপর ছোটদা বাড়িতে আরও একটা জিনিস নিয়ে এলো, যেটাও আনা সম্ভব বলে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। শহর টই টই করে ঘুরে বেড়ানো ছেলে ছোটদা। ছোটদার পক্ষেই সম্ভব ছিল। বিরাট একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর নিয়ে বাড়ি এলো ছোটদা। কুকুরের নাম রকেট। রকেট খেলা দেখায়, সোফায় ঘুমোয়, হ্যাঁণ্ডসেক করে। এক বিদেশি পাত্রী দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় তার কুকুরটা দিয়ে গেছে ছোটদাকে। আমাদের কাছে তখনও পোষা কুকুর মানে, যে কুকুর সারাদিন শেকল বাঁধা থাকে, রাতে খুলে দেওয়া হয় চোর তাড়ানোর জন্য। ছোটদার কারণেই একটা অ্যালসে সিয়ান দেখা হল। ওই অ্যালসেসিয়ানটা বাড়িতে থাকাতে ওর ওপর বড় মায়া জন্মেছিল! এই যে এখন আমি প্রাণী জগতের সব পশুপাখির অধিকার নিয়ে কথা বলি, বা বাড়িতে বেড়াল কুকুর পুষি, তার শুরুটা ওই রকেট, ওই অ্যালসেসিয়ানটাই করে দিয়েছিল। এখন যে কুকুরই পুযি, তার নাম রকেট রাখি। মনে আছে ছোটদার ওই রকেটটা যেদিন মারা গিয়েছিল, জন্মের কাঁদা কেঁদেছিলাম। এরপর ছোটদা আরও দুটো ভয়ংকর নিষিদ্ধ কাজে নিজেকে জড়িয়েছিল। এক, রাজনীতি করা। দ্বিতীয়, প্রেম করা। ছাত্র ইউনিয়ন করে বেড়াতো। প্রেম করে বেড়াতো। বাড়িতে কারও এসব করা তো দুরের কথা, কল্পনা কারও সাহস হয়নি। ছোটদার চেয়ে বেশি বয়সী বড়দা তখনও প্রেম করার কথা ভাবতেও পারতো না। সবচেয়ে সাহসী কাজ বড়দার পক্ষে যেটা করা সম্ভব হয়েছিল, তা হলো ঘরের কোনে বসে প্রেমের পদ্য লেখা। ছোটদাই ছোট ছোট রেভুলুশনগুলো করতো। একসময় সে পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করে ফেললো। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছেলে বিয়ে করেছে। কোথায় বাবা ভেবেছিলেন, বড়দার চেয়ে মাথায়-ভালো পড়াশো নায়-ভালো ছোটদা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র হবে, আর নাক-টিপলে-দুধ-বেরোয়-ছেলে, সে কিনা করেছে বিয়ে, তাও আবার হিন্দু মেয়েকে! বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বাড়িতে এনে শেকলে বেঁধে ছোটদাকে কয়েকদিন ধরে পেটালেন, কিন্তু লাভ হলো না কিছু। ছোটদা কিছুতেই তার কলেজের সহপাঠিনীকে, যাকে ফট করে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিল, ছাড়েনি।

 এই কাণ্ডগুলো ছোটদার মতো না বড়দা পারতো, না আমি পারতাম, না আমার ছোটবোন পারতো। ছোটদাই পেরেছিল। বিপ্লবী ছোটদা। বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা সে-ই বাঁধতো। তারপর যে সব বিপ্লব বাড়িতে ঘটিয়েছিলাম আমরা ভাইবোনেরা, সে ছোটদাকে দেখে শিখেই। আড়ষ্টতা, ভয়, দ্বিধা ছোটদাই কাটিয়ে দিয়েছিল। আমিও এক সময় প্রেম করতে শুরু করলাম ছোটদার মতো, আমিও কাউকে না জানিয়ে ফট করে একদিন বিয়ে করে বসলাম ছোটদার মতো। আমার ছোটবোনও তাই করলো। শুধু বঙ্গাটা একটু বেশি ভীতু ছিল বলে বাবার মারের ভয়ে না পেরেছে কারও সঙ্গে প্রেম করতে, না করতে পেরেছে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বিয়ে।

বাবা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। আবার ঘাড় ধরে ফেরত নিয়ে এসে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কিন্তু তখন আর ছোটদার পড়াশোনায় মন নেই। মাধ্য মিকে কয়েকটা স্টার নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করা ছেলে উচ্চমাধ্যমিক যেন তেন ভাবে পাশ করে অল্প বয়সে চাকরি করতে শুরু করলো। ছোটদার সঙ্গে তখন আমার সখ্য ছিল খুব। আমার ইস্কুল-কলেজের রিক্সাভাড়া থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ওকে দুটাকা তিন টাকা দিতাম। গল্পের বই পড়ে শোনাতাম। ছোটদার জন্য মায়া হত খুব। ছোটদার জীবনটা ছিল ভীষণ স্ট্রাগলের আবার অ্যাডভেঞ্চারেরও, যেসব আমরা কল্পনা করতে পারতাম না ওই বয়সে। হঠাৎ করে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা, এসব সিনেমায় ঘটতে দেখতাম, আর দেখতাম ছোটদার জীবনে। নিয়ম নীতির বাইরে বেরোনো, কাউকে তোয়াক্কা না করা, এমনকী বাবার মতো ভয়ংকর মানুষকে ভয়। না পাওয়া, ছোটদার কাছ থেকেই শেখা। সেই যে গিটার এনেছিল বাড়িতে প্রথম, এরপর বাড়িতে বড়দার জন্য বেহালা ঢুকেছিল, আমার জন্য একটা হাওয়াইন গিটার ঢুকেছিল, ছোটবোনের জন্য হারমোনিয়াম। ছোটদা দরজাটা খুলেদিয়েছিল, যে দরজা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা ঢুকেছিল বাড়িতে। কাউকে না কাউকে দরজা খুলতে তো হয়ই প্রথম।

আজ এই যে আমি অসাম্প্রদায়িক, সে কি এমনি এমনি? আকাশ থেকে অসাম্প্রদায়িকতার জ্ঞান বুদ্ধি আমার ওপর ঝরেছে? না, তা ঝরেনি। সেও ছোটদার কারণে। যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রেম হওয়া বা বিয়ে হওয়ার প্রচলন সমাজে ছিল না, তখন ছোটদা নির্দ্বিধায় প্রেম করতো হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে। তার ট্রাঙ্ক ভরা থাকতো প্রেমের চিঠিতে। সুযোগ পেলে সেগুলো পড়তাম, আর বিস্ময়-চাখে দেখতাম নিষেধের দেওয়াল ডিঙোনো ছোটদাকে। হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার পর ছোটদা বাড়ির লোকদের লুকিয়ে লুকিয়ে বউকে পুজোর শাড়ি কিনে দিত, পুজোর সময় বউকে তার বাপের বাড়িতে নিয়ে যেতো যেন পুজো করতে পারে। আমাদের বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নামাজ রোজা করতো না। কিন্তু তাই বলে যে সবাই অসাম্প্রদায়িক ছিল ভেতরে ভেতরে তা নয়। আমি অসাম্প্রদায়িক, এ কথাটা মুখে বলা সহজ, কাজে প্রমাণ করা সহজ নয়। যুদ্ধের সময় নারায়ণ নামের একটা হিন্দু ছেলেকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে জীবন বাঁচি য়েছিলেন বাবা। আর ছোটদা প্রচণ্ড হিন্দু-বিরোধী মুসলমান সমাজে জন্ম নিয়ে একটা হিন্দু মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে সে অসা ম্প্রদায়িক। ছোটবেলায় এ দুটো ঘটনা চোখের সামনে না দেখলে হয়তো লজ্জা নামের অসাম্প্রদায়িক বইটি লেখা আমার হতো না। আজ পৃথিবীর তিরিশটি ভাষায় অনূদিত লজ্জা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম একটি গ্রন্থ। জীবনে কত মহীরূহর বীজ যে সেই শৈশবেই নিজের অজান্তেই বপন করা হয়ে যায়। ছোটদানা থাকলে, আমি আজ যা, অসাম্প্রদায়িক, অকুতোভয়, আপোসহীন, তা হয়তো হতে পারতাম না।

সেই যে ছোটদার জন্য মায়া হতে শুরু করেছিল ছোটবেলায়, সেই মায়াটা কখনও চলে যায়নি। বড়দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, আমি ডাক্তারি পাশ করেছি, ছোটবোন। মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছে। আমাদের চাকরি বাকরি পাওয়া কঠিন ছিল না।

বড় অসহায় চোখে ছোটদার জীবনযুদ্ধ দেখতে হতো আমাদের। একসময় অবশ্য ছোটদা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল। বাবার সঙ্গেও ভাব হয়ে গেল। বাবা উজাড় করে। দিতেন। অভাব চলে গিয়েছিল ছোটদার। কিন্তু ছোটদার জন্য মায়াটা কিন্তু আমাদের সবারই থেকে গিয়েছিল।

কত কিছুই না ক্ষমা করে দিয়েছি। যখন সতেরো বছর বয়স আমার, নিচের পাটির দুটো মোলার দাঁতে একটু ব্যথা হচ্ছিল। ব্যস, ছোটদাতার এক দাঁতের ডাক্তারী পড়া বন্ধুর কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে বললো, জুয়েল, ওর দুটো দাঁত ফেলে দাও তো! ছোটদাই দেখিয়ে দিল কোন দুটো দাঁত ফেলতে হবে। সতেরো বছর বয়সে দুটো দাঁত খামোকা হারিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। অনেক বছর পর আমি বুঝতে পেরেছি, আমার দাঁত ফেলার সিদ্ধান্ত ছোটদা ভুল নিয়েছিল। কিছু বলিনি, মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছি। ছোটদা তো আর জেনে বুঝে ও কাজটা করেনি। ভেবেছিল, যে কোনও দাঁতে যেই না ব্যথা হবে, অমনি ওটাউপড়ে তুলে ফেলাই মঙ্গলজনক। মাথা ব্যথা হলে যেমন মাথাটা কেটে ফেলে দিতে হয়না, দাঁত ব্যথা হলেও দাঁত ফেলে দিতে হয় না। ছোটদা অনেক সময় বড় সরল, বড় নিরীহ ছিল। বাইরে থেকে সবাই তা বুঝতো না।

সিনেমার পোকা ছিলাম আমি ছোটবেলায়। একসময় সিনে-পত্রিকাগুলোতে লিখতে শুরু করলাম। বাড়িতে সিনে-পত্রিকা ঢোকার কোনও নিয়ম ছিল না। ওসব ছাইপাঁশ কিনছি বা পড়ছি জানলে বাবা হাড় গুঁড়ো করে দেবেন। মুশকিল আসান করতো ছোটদা। ছোটদা ওসব পত্রিকা বাড়িতে আনতো। আমার প্রথম লেখা কোনও একটা সিনে-পত্রি কাতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সিনেমার পত্র-পত্রিকাই ছিল সাহিত্যের পত্র পত্রিকা। ওসবেই ছোটগল্প উপন্যাস কবিতা এসব ছাপা হত। সেসময় ছোটদা আবার চিত্রালী পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সমিতির কেউ একজন হয়ে উঠলো। সিনেমার হিরোদের ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসতো অনুষ্ঠান করাতে। বিচিত্র সব বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেল্লার ক্ষমতা ছোটদার ছিল। এই গুণ সবার থাকে না। মানুষ অসম্ভব ভালোও বাসতো ছোটদাকে। সেই ছোটবেলাতেই দেখেছি, কত বন্ধু যে ছিল ছোটদার। নানান বয়সী বন্ধু। দ্বিগুণ বয়সী কারও সঙ্গে মিশছে, আবার হাঁটুর বয়সী কারও সঙ্গে। যে কারও সঙ্গে মিশতে পারতো ছোটদা। যে কোনও দলের সঙ্গে। যে কোনও মানসিকতার মানুষের সঙ্গে, বড় বিজ্ঞানী থেকে রাস্তার ভিখিরি, সবার সঙ্গে। জানিনা সবারই মায়া হতো কি না ছোটদার জন্য। সংসারের ব্ল্যাকশিপদের জন্য ঘরে বাইরে সবারই কিছু না কিছু ভালোবাসা, লক্ষ করেছি, থাকেই।

 ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সিনেমা খারাপ হতে শুরু করলো, সিনে-পত্রিকা পড়ারও চল উঠে গেল। আমরা যারা মাঝে মধ্যে লিখতাম ওসবে, অন্য পত্র পত্রিকায় বা লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে শুরু করলাম। একসময় আমি নিজেই কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলাম, নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রকাশও করতাম। ছোটদা বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিত, প্রেস জোগাড় করে দিত। যখন ঢাকায় চলে গেল বিমানে চাকরি নিয়ে, একবার ঢাকা থেকেও সেঁজুতি ছাপিয়ে দিয়েছিল। ছোটদার হাজার রকম বিষয়ে আগ্রহ ছিল। কোনওদিন এমন কিছু পাইনি, যা নিয়ে ছোটদা কোনও আগ্রহ দেখায়নি। ছোটদা সেই দুষ্প্রাপ্য ধরনের মানুষ, জুতো সেলাই থেকে যে চন্ডিপাঠ পর্যন্ত করতে জানতো। ছোটদা একসময় একটা নাটকের দলে নাম লিখিয়েছিল। ছোটদার কল্যাণেই একবার চমৎকার এক নাটক করে ফেলেছিলাম ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল মঞ্চে। ছোটদাকে নাটকের একটা স্ক্রিপ্ট দিলাম, পছন্দ হলো তার, আর তার পরই শুরু হল এক পোড়োবাড়িতে কলা কুশলী নিয়ে নাটকের মহড়া। আমার ওই আঠারো বছর বয়সে রীতিমত নাটকের পরিচালক হয়ে উঠেছিলাম। নাটকটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বেশ অনেকগুলো শো হয়েছিল টাউন হলে। রাতে রাতে আমরা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নাটকের রিহার্সেলে যেতাম। ছোটদার অ্যাডভেঞ্চার আমাকে নিশ্চিতই প্রভাবিত করেছিল। সেই তখন থেকেই তো শিল্পের জগতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঢুকছি আমি।

মাঝখানে অনেক বছর কেটে গেছে। দেশ থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার অঢেল সহায় সম্পত্তি ছোটদা আর বড়দা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ায়, বোনদের কোনও ভাগ না দেওয়ায় আমি খুব রাগ করেছিলাম। তারপরও ছোটদাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি আমেরিকার নানা শহরে। লাস ভেগাস, এ্যাণ্ড ক্যানিয়ন, ওয়াসিংটন ডিসি। আমি যখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ করছি, ছোটদা এসেছিল, তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছি বিখ্যাত হারভার্ড। এরও আগে আমি যখন জার্মানিতে, সুইডেনে, ছোটদা গিয়েছিল দেখা করতে। তখন। ছোটদাই ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া দেশ। ছোটদা এমন একটা মানুষ যার ওপর খুব বেশিদিন রাগ করে থাকা যায় না, নাকি আমি এমন একজন মানুষ যে বেশিদিন কারও ওপর রাগ করে থাকতে পারি না, জানি না। সম্ভবত ছোটদাই, যার ওপর রাগ করে থাকা যায় না। যার ওপর সেই শৈশব থেকেই আমরা কেউ রাগ করে থাকিনি। অল্প বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সেই যে সংসার চালাবার স্ট্রাগল করে যাচ্ছিল, আমরা সবাই ছোটদার সেই স্ট্রাগল চোখের সামনে দেখেছি বলেই হয়তো। কিছু কিছু মানুষ আছে সংসারে, যারা হরদম ভুলভাল কাজ করছে, ওলোটপালোট করে দিচ্ছে সবকিছু, কিন্তু তাদের জন্য মায়া জীবনে কখনও ফুরোয় না। অভিমান হয়, রাগ হয়। কিন্তু মায়াটা কোথাও না কোথাও থেকে যায়। ছোটদা নিজের জীবন এবং জগত নিয়ে ব্যস্ত। থাকতো। ভাই বোন বাবা মার সঙ্গে সময় কাটানোর সময় তার কখনও খুব বেশি হয়নি। অভিযোগের আমার শেষ নেই। তবে ছোটদার কাছে আমি অনেক কিছুর জন্য কৃতজ্ঞও বটে। ভারত সরকার যখন আমাকে তাড়িয়ে দিল দেশ থেকে, আমি না হয় দুর দেশে গিয়ে বেঁচেছি, কিন্তু আমার পোষা বেড়ালটিকে তো দূর দেশে কেউ ঢুকতে দেবে না। ভারতবর্ষে ওকে লালন পালন করার কেউ ছিল না। ওকে অগত্যা পাঠিয়ে দিই ঢাকায়, আমার ফ্ল্যাটে। ওখানে ছোটদাই ওকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল আড়াই বছর। পরে যখন বেড়ালটাকে ফেরত চেয়েছি, ছোটদার খুব মন খারাপ, বলেছিল, মানুষটা ছিল, চলে গেলে কষ্ট হবে না বুঝি?

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ফোন। কী! ছোটদা দিল্লি আসবে। রুটিন টেস্ট করতে গিয়ে দেখা গেছে লিভারে হেমানজিওমা। হেমানজিওমা কোনও ক্ষতিকর কিছু নয়। তারপরও একটা দ্বিতীয় মত ভারত থেকে কে না নিতে চায়। ছোটদা খুব স্বাস্থ্য সচেতন ছেলে। চিরকালই ফিট। আমার চুল পেকে সাদা হয়ে গেল। ছোটদার চুল পাকা টাকার ব্যাপার নেই। ছোটদার সঙ্গে কোথাও বেরোলে আমাকে লোকে জিজ্ঞেস করতো ও আমার ছোট ভাই কি না। কী আর বলবো, আমার চেয়ে ন বছরের বড় ছোটদাকে আমার চেয়ে বয়সে ছোট ভাবা হচ্ছে। আসলে মিথ্যে নয়, ছোটদার বয়স হলেও ত্বকে কোনও ভাঁজ পড়েনি। চুল খুব কম পেকেছে। বিয়ার খেলেও হুঁড়ি বাড়েনি, চিরকাল ওই স্লিমই রয়ে গেছে। কিছুদিন আগে শুনেছি লাখ টাকা খরচ করে একটা ট্রেডমিল কিনেছে। এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন হাঁটে। আমরা সবাই জানতাম আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে ছোটদার স্বাস্থ্যই সবচেয়ে ভালো। খামোকা কি সুন্দরী বিদুষী মেয়েরা টুপ টুপ করে প্রেমে পড়তো ছোটদার! যে কোনও বয়সের যে কোনও পেশার মেয়েই ছোটদার প্রেমে পড়ে যেতো দুদিনেই। কিছু একটা ছিল ছোটদার মধ্যে, জানি না ওই শিশুর মতো হাসিটিই কিনা।

 ছোটদা এল দিল্লিতে। লিভার হাসপাতালে আমি আগেই কথা বলে রেখেছিলাম। যে রাতে এল, তার পরদিন সকাল নটায় ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ডাক্তার ওই একই কথা বললেন, হেমানজিওমা অনেকের থাকে, এ নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তারপরও তিনি কিছু পরীক্ষা করতে দিলেন। লিভারের এমআরআই যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, তখন ডাই এর দরকার হলো। আমার বুক কাঁপল প্রথম। ডাই-এর দরকার কেন হবে। এমআরআইএর ডাক্তারের মত, কিছু যেন পাওয়া যাচ্ছে প্যানক্রিয়াসে। রক্ত পরীক্ষা করতে দিল ওইদিনই। পরদিন অজ্ঞান করে এণ্ডোসকপি করা হলো। আমাকে দেখানো হল ভেতরের অবস্থা। ডাক্তার বললেন, প্যানক্রিয়াস ক্যানসার। অত ছোট নয়, কিছুটা এগিয়েছে, অ্যাডভান্সড, রক্তের একটা নালীর গা ছুঁয়েছে। মা মারা গেছেন কোলন ক্যানসারে মাকে না হয় সারাজীবন হেলাফেলা করা হয়েছে। জ্বলা পোড়া খাবার খেতে হয়েছে মাকে, ক্যানসার হওয়ার আগে পলিপের উপসর্গ দেখা দিলেও মাকে কেউ ডা ক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। কিন্তু ছোটদার কেন হবে ক্যানসার! সে তো ঘন ঘন ডাক্তা রের কাছে যেতো, বছর বছর রুটিন টেস্ট করতো! যে রোগটার নাম মুখে নিতেও ভয় হয়, সে রোগ ছোটদার শরীরে! জগত ঘুরতে শুরু করলো চরকির মতো। আমি আর কিছুতেই মন দিতে পারলাম না। মার মৃত্যুশোক আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি, কিছুদিন আগে চোখের জলে ভেসে ভেসে পুরো একটা বই লিখেছি মাকে মনে করে। আর এখন কিনা ছোটদার ক্যানসার যন্ত্রণা চোখের সামনে দেখতে হবে। অবাক হয়ে দেখি, ছোটদা এই ক্যানসারকে দিব্যি মেনে নিয়ে, যেন এ গ্যাস্ট্রিক আলসার জাতীয় কোনও রোগ, পুরো উদ্যমে চিকিৎসা করতে শুরু করলো। কোনও চোখের জল নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই, কিচ্ছু নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা নেই। হতাশায় ডুবতে ডুবতে অবশ হয়ে যাওয়া নেই। বেড়াতে যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে। খাচ্ছে। গল্প করছে। ছোটদার জায়গায় আমি হলে আমি এত সব পারতাম না। কেঁদে কেটে হাল ছেড়ে দিয়ে কোনও গহীন অরণ্যে গিয়ে একা বসে থাকতাম।

সেই থেকে ছোটদা কম ভুগছে না। দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালও লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিস্তর ভোগান্তি দিয়েছে। প্যানক্রিয়াসের অপারেশন হবে, তার আগে এক উড়িষ্যার কার্ডিওলজিস্ট ফতোয়া দিয়ে বসলেন, আগে হার্ট অপারেশন করতে হবে। ছোটদাকে বলেছিলাম, তুমি আমেরিকার স্লোন কেটেরিংএ গিয়ে চিকিৎসা করো, সিঙ্গা পুরের ক্যানসার হাসপাতাল ভালো, ওখানে যাও, আর দুরে কোথাও না যেতে চাইলে বোম্বের টাটা মেমোরিয়ালে অন্তত যাও। ছোটদা সিদ্ধান্ত নিল দিল্লিতেই হওয়ার হবে। কেন? দিল্লিতে তার ছোটবোন, আমি, আছি। ছোটবোন ডাক্তার। হ্যাঁ ডাক্তার বটে, কিন্তু ডাক্তারি তো করি না বহু বছর। আমি ছোটবোন, আমি তো ক্যানসার ভালো করে দিতে পারবো না, সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা যেখানে পাবে, সেখানে যাও। ছোটদা শুনলোনা। আমার কাছে থেকে চিকিৎসা করালো। খামোকা একটা বাইপাস অপারেশন হতে হল, তা না হলে নাকি অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না প্যানিক্রয়াসের দীর্ঘ হুইপল সার্জারির জন্য। সবই হলো। হার্ট সার্জারি। হুইপল সার্জারি। ছোটদা ওই ভীষণ কষ্টগুলো সব সহ্য করলো। কাতরালো। ছটফট করলো। দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। চোখ মেললো। কিন্তু হাল ছাড়লো না। আমি তাকাতে পারতাম না ওই কষ্টের দিকে। বুক চিরে বার বার দীর্ঘশ্বাস বেরোতো। দুরে সরে থাকতাম।

অপারেশনের পর কেমোথেরাপির প্রেসক্রিপশান নিয়ে ঢাকায় ফিরে গেল ছোটদা। স্কাইপেতে কথা হতো আমাদের। ছোটদা একটা ল্যাপটপ কিনেছিল কথা বলার জন্যই। ক্যানসার নিয়ে বেশি কথা বলতো না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ভীষণ ভীষণ কাণ্ড হচ্ছে সেসব খবর দিত আমাকে। আমারও ইচ্ছে করতো না ক্যানসার নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু জোর করে কী আর মুখ বুজে থাকতে পারি। উদ্বেগ কোনও না কোনও ভাবে প্রকাশ পেতোই। ছোটদা নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া লোক, শুধু চেকআপের জন্য। তারই কিনা হলো এই রোগ! আমি ডাক্তারের কাছে না-যাওয়া লোক। আমার শরীরেও কোথাও নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আছে এই কর্কট রোগ। ছোটদাকে বলেছিলাম, আমাদের জিন খুব খারাপ জিন। অসুখ বিসুখে ভর্তি। হাইপারটেনশন, ডায়বেটিস, ক্যানসার। ছোটদাও জানে আমাদের জিন ভালো নয়। বারবারই বলেছে ছোটদা, আমিও যেন সব কিছু পরীক্ষা করিয়ে নিই। অল্প স্বল্প মদ্যপান করেছিল বলেই কি ক্যানসার হয়েছে? কত লোক তিরিশ চল্লিশ বছর প্রতি সন্ধেয় মদ্যপান করছে, তাদের লিভার যেমন ছিল তেমনই আছে। প্যানক্রিয়াসেও এক ফোঁটা কিছু বদল নেই। জিন খারাপ না হলে এমন হতো না।

প্যানক্রিয়াস ক্যানসার সাধারণত এত আগে কারও ধরা পড়ে না, ছোটদার যত আগে ধরা পড়েছে। কোনও উপসর্গই শুরু হয়নি। প্যানক্রিয়াসের বাইরে খুব কোথাও ক্যানসারটা ছড়ায়নি। তাই আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কারণ হুইপল সার্জারি যখন সাক সেসফুল, নিশ্চয়ই অনেক বছর বেঁচে থাকবে ছোটদা। কত চেনা মানুষ ন্যানসার হওয়ার পরও হেসে খেলে কুড়ি পঁচিশ বছর বেঁচে আছে। ছোটদার বেলাতেও নিশ্চয়ই তাই হবে। কিন্তু তিনমাস কেমোথেরাপি দেওয়ার পর ছোটদা যখন এলো পরীক্ষা করাতে আবার দিল্লিতে, রক্তে ক্যানসার ধরা পড়লো প্রচুর। তার মানে কেমোথেরাপির বিষ পেয়েও কর্কট রোগের ছিটেফোঁটা মরেনি, বরং শরীর জুড়ে আরও তাণ্ডব নৃত্য করেছে। তাহলে অত বড় যে বিলেত ফেরত সমীরণ নন্দী, উনি নিশ্চয়ই হুইপল সার্জারিটা ভালো করে করতে পারেননি। আমি যখন রেগে আগুন, সব ডাক্তারদের খিস্তি করছি, ছোটদা তখন ধীর, শান্ত। কোনও ডাক্তারের বিরুদ্ধে তার কোনও অভিযোগ নেই। কোনও ডাক্তা রই নাকি ভুল চিকিৎসা করেনি। সবই নাকি ছোটদার ভাগ্য। ভাগ্যে আমি বিশ্বাস করি না। কোথাও কোনও ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। ভীষণ ক্রুদ্ধ আমি, সমীরণ নন্দীকে জিজ্ঞেস করলাম, ভুলটা উনিই করেছিলেন কি না। কেউ কি আর ভুল স্বীকার করে। ছোটদা ঢাকায় ফিরে গিয়ে নতুন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রেডিওথেরাপি নিচ্ছে। জানিনা প্যা নক্রিয়াস ক্যানসারে রেডিওথেরাপি কতটা কাজ করবে। আমার খুব ভয় হয়। এখনও স্কাইপেতে কথা হয়, আগের মতো প্রতিদিন ছোটদা স্কাইপেতে আসতে পারে না। মা ঝেমাঝেই নাকি শরীর খারাপ থাকে। ভয়ে আমি ফোন করি না। ফোন এলে গা কাঁপে। না জানি কী শুনবো! প্রতিদিন সকালে যদি স্কাইপেতে না আসে, তিরতির করে একটা দুশ্চিন্তা মনের কোথাও যেন কাঁপে। দুদিন আগে বললাম, আর দিল্লি বোম্বে না গিয়ে যেন আমেরিকায় যায়, এখানে বড় ক্যানসার হাসপাতালে ডাক্তার দেখায়। বাঁচার জন্য চেষ্টা তো করতেই হবে। জীবন তো একটাই। মাঝে মাঝেই উপদেশ দিই, প্রতিটি মুহূর্তকেই যেন সে গুরুত্ব দেয়। যেন যা তার করতে ইচ্ছে করে, করে। বলি যখন, নিজের কণ্ঠস্বরই নিজের কাছে খুব অদ্ভুত ঠেকে। কেন আমি ভাবছি ছোটদা মরে যাবে শিগগিরই, আর আমি বেঁচে থাকবো অনন্তকাল? আসলে প্রতিটি মুহূর্ত সবার জন্যই মূল্যবান। জীবন সবার কাছে একবারের জন্যই আসে। এই পৃথিবীর পর আর কোনও পৃথিবী নেই, কোনও দোযখ বেহেস্ত নেই, কোথাও আমাদের কোনও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। একবার মরে গেলে আমাদের কারও সঙ্গে কারওর কোনওদিন আর দেখা হবে না। জীবন সকলেরই অনিশ্চিত। ছোটদা যখন বিছানায় শুয়ে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, আমরা সবাই উদ্বিগ্ন, বড়দাও, তখন বড়দারই হয়ে গেল একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। মরেও যেতে পারতো। ক্যানসার ভুগিয়ে মারে। হার্ট অ্যাটাক চোখের পলকে মারে।

ছোটদা কী করে এত ধীর, এত স্থির, এত শান্ত থাকতে পারে, জানি না। মাও এমন ছিল। মাকে যদিও আমরা কেউ জানাইনি যে মার ক্যানসার হয়েছিল। মা বুঝেছিল সবই। কোনও অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই, ধরিত্রীর মতো সহিষ্ণ ছিল মা।

 মাঝে মাঝে মনে হয় ছোটদা বোধহয় ক্যানসারের আতংককেই, এর সর্বগ্রাস কেই, ক্যানসারের মৃত্যুকেই অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নিয়েছে। সেই ছোটবেলার মতো, গিটার, গণআন্দোলন, রাজনীতি, প্রেম, গান্ধর্ব বিয়ে, বস্তির ঘর, চিপাঁচস, থিয়েটার, দুশো টাকার চাকরি, বাউণ্ডুলে জীবন, বিমান, রমণীকুলের পল্লবে ডাক, মদ্যপান সবই যেমন ছিল অ্যাডভেঞ্চার! ছোটদার জন্য মায়া হয়, ভীষণ মায়া। এবার যখন এসেছিল দিল্লিতে, আশায় টগবগ করছিল ছোটদা, কিন্তু ডাক্তাররা কোনও আশার কথা শোনালো না। না শোনাক, তারপরও ছোটদাকে নিয়ে ভালো ভালোসিনেমা দেখলাম, ভালো ভালো রেস্তোরাঁয় ভালো ভালো খাবার খেলাম, ছোটবেলার, বড়বেলার গল্প করলাম প্রচুর। থেকে থেকে আমি বিজ্ঞানের কথা পেড়েছি, বিগ-ব্যাঙ, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, প্রাণীর জন্ম, বিবর্তন, মানুষ। কত শত ঈশ্বরকে মানুষ রচনা করেছে, কত শত ঈশ্বর নির্বংশও হয়ে গেছে। ছোটদা সব মন দিয়ে শুনেছে এবার। মৃত্যুকে দুরকম ভাবে গ্রহণ করা যায়। এক, যাচ্ছি, এ যাওয়া সাময়িক, পরকালে আবার দেখা হবে। দুই, কোনওদিনই আর দেখা হবে না, আর সব প্রাণী যেমন যায়, বাঁদর-শিম্পাজি থেকে বিবর্তিত প্রাণীকেও তেমন যেতে হয়। সহস্র কোটি বছর ধরে প্রাণীজগতে এমনই হচ্ছে। ভালো যে জন্মেছিলাম, কত কিছু তাই জানলাম, দেখলাম, শিখলাম, কন্ট্রিবিউট করলাম। জীবনের অর্থ নেই। কিন্তু সামান্য কিছু হলেও তো অর্থপূর্ণ করতে পেরেছি জীবন! জীবনের ওইটুকুই সার্থকতা।

আমি দ্বিতীয় মতটিকেই সমর্থন করি। দ্বিতীয় মতে আছে সত্যকে বরণ করা, আর প্রথম মতে মিথ্যের আশ্রয়, মৃত্যুকে মেনে নিতে না পারা। মৃত্যুর মতো ভয়ংকর সত্যকে মানুষ মেনে নিতে পারে না বলেই তো স্বর্গ নরকের কল্পনা করেছে।

ছোটদা আর আমি আমার কিশোর বয়সে অচিনপুর নামে একটা উপন্যাস পড়তাম। উপন্যাসের প্রথম লাইনটা ছিল, মরবার পর কী হয়, নবুমামা?একটা আট ন বছর বয়সের ছেলে রাতের পুকুরে নেমে সাঁতার কাটতে থাকা তার নবুমামাকে এই প্রশ্নটি করেছিল। নবুমামা কী উত্তর দিয়েছিল, তা আমার আর মনে নেই। জানি না ছোটদার। মনে আছে কি না।

আমরা যতই বিজ্ঞান বুঝি, যতই তারা ধর্ম বুঝুক, কেউ মরতে চাই না। যতই বলি না কেন, দীর্ঘ যন্ত্রণাময় জীবনের চেয়ে চমৎকার নাতিদীর্ঘ জীবনই ভালো, সবাই আমরা। আসলে বাঁচতে চাই। দুঃখ কষ্টে জীবন ডুবে থাকলেও বাঁচতে চাই বেশির ভাগ মানুষ। অনন্তকাল যদি বাঁচা সম্ভব হতো, অনন্তকালই বাঁচতে চাইতাম। কেন মরবো, মরে কোথায় যাবো? কোথাও না। এই কোথাও না-টা কল্পনা করলে গা শিউরে ওঠে। এক সময় বিজ্ঞান হয়তো এমনই অগ্রসর হবে, যে, মানুষকে আর মরতে হবে না। এখনই তো অনেককিছুর রিসার্চ দেখে অনুমান করা যায়, ভবিষ্যতে মানুষ যতদিন খুশি বেঁচে থাকতে পারবে। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা ভবিষ্যতে জন্মাইনি। বর্তমানে জন্মেছি। নিশ্চয় করে আসলে কিছুই বলা যায় না। আর কুড়ি বছর পর হয়তো গোটা পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে। যেতে পারে পারমাণবিক বোমায়। আর তিরিশ বছর পর হয়তো এসটোরয়েড বা কমেট নেমে পৃথিবীর সব প্রাণীকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে, ডায়নোসরসহ সব প্রাণীকেই যেমন করেছিল ছশ পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে।

যখন চারদিক থেকে কোনও আশার বাণী শুনতে পাচ্ছিল না, ছোটদা এবার একটা কথা বলেছিল দিল্লিতে, সেই কথাটা এখনও বুকে বাজে, হু হু করে ওঠে ভেতরটা, আর বড় মায়া হয়, বড় মায়া হয় ছোটদার জন্য, বলেছিল, মারা যাচ্ছি এটা জানা, আর মারা। যাচ্ছি এটা না জানায় অনেক তফাৎ।

 অনেকক্ষণ আমি চুপ হয়ে ছিলাম। হয়তো হঠাৎ করে বড়দা বা আমি মরে যাবো। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, ছোটদা রয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের মৃত্যুতে এইটুকু সান্ত্বনা যে। আমরা মৃত্যুর আগে প্রতিটি মুহূর্তে জানছি না যে মারা যাচ্ছি। এই যে আমি শরীরের কোনও আনাচ কানাচে ক্যানসার বাসা বাঁধছে কিনা তা জানার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছি না, বা টেস্টগুলো করছি না, সে সম্ভবত এ কারণেই যে, যদি ক্যানসার হয় তা জেনে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পাওয়ার, দুশ্চিন্তা কার, হতাশায় ভোগার দরকার নেই। মৃত্যু একবারই আসুক, শতবার নয়, প্রতিদিন নয়।

ছোটদা আরও একটা কথা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ক্যানসার ধরা পড়ার পর দিনে একশ দুশ লোক ফোন করতো। এখন আর কেউ তেমন ফোন করে না। মনে মনে ভাবি, ক্যানসারের খবরটাই আজকাল মৃত্যুর খবরের মতো। সম্ভবত শোকবার্তাটা তাই প্রথমেই জানিয়ে দেয়।

 এত খাচ্ছি, তারপরও ওজন কমছে- ছোটদা একদিন দুঃখ করে বললো। কোনও সান্ত্বনা তাকে দিতে পারিনি। জীবনে এমন কিছু কিছু সময় আসে, যখন ঠিক বোঝা যায় না কী বলবো বা কী বলা উচিত।

এরকম যদি হতো, রেডিওথেরাপি শেষ হওয়ার পর দেখা যেতো ছোটদার ক্যানসার সেলগুলো সব মরে গেছে, আর ফিরে আসবে না ক্যানসার! অন্তত কুড়ি পঁচিশ বছরের মধ্যে তো নয়ই। আমি প্রকৃতির কাছে, অলৌকিকতার কাছে প্রার্থনা করছি, ছোটদা বেঁচে থাকুক। বিপ্লবী ছোটদা, অঘটনঘটনপটিয়সী ছোটদা, অসম্ভবকে সম্ভব করা ছোটদা আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর বেঁচে থাকুক। উড়ে ঘুরে দৌড়ে বাঁচুক। এভাবে অসুস্থ মানুষের মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে নয়। ছোটদা যা-ইচ্ছে-তাই-করে-বেড়ানোর ছেলে। ছোটদা আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াক। জীবনকে আরও অর্থপূর্ণ করুক, আলোকিত করুক। আবার গিটারে আগের সেই সুর তুলুক, যে সুরে পুরো শহর এক সময় মোহিত হতো।

ইচ্ছের কথাগুলো বলি একটু একটু করে। বলি, কিন্তু ছোটদার ওই ওজন কমতে থাকা শরীরটির দিকে তাকিয়ে বড় ভয় হতে থাকে। ভয়গুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। বাবা নেই। মা নেই। মার সামনে এই ঘটনা ঘটেনি, একদিক থেকে ভালো। ছোটদাকে খুব ভালোবাসতো মা। দেরিতে-কথা-বলা, দেরিতে-দুধ-ছাড়া ছেলেটি তার বুকের ধন ছিল। ছোটদার ক্যানসার মা কি আর একফোঁটা সইতে পারতো! কেঁদে কেঁদেই হয়তো একদিন মরে যেতো। ভয় হয়, কিন্তু নিজেকে বলি, আমরা নিশ্চয়ই আবার আগের মতো চা খেতে খেতে গল্পের বই পড়বো। আমি পড়বো, ছোটদা শুনবে। আবার নিশ্চয়ই ছোটদাকে নতুন নতুন শহর দেখাতে নিয়ে যাবো। শহরের ইতিহাস বলবো, ছোটদা মন দিয়ে শুনবে। আর ছোটদা যখন তার নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসবে, সেসব শুনবো মন দিয়ে, কোনওদিন বলে শেষ হবে না যেসব কাহিনী, ছোটদার অফুরন্ত রোমহর্ষক কাহিনী। আমাদের আর কী আছে স্বপ্ন ছাড়া?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *