ছোটকার পাহারা

ছোটকার পাহারা

‘কেন? মেয়েরা যাবে না কেন?’ ছোটকা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। রামুকাকা বললেন, ‘মানে প্রসেশনের সময় যা ভিড় ধাক্কাধাক্কি হয়, মেয়েদের নিয়ে যাওয়া ঠিক সেফ নয়।’

ছোটকা বাঁকা হেসে বললেন, ‘হোপলেস। দেখ রামুদা, সেই আগের যুগ আর নেই। মেয়েরা এখন ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কী-না করছে? কোথায়-না যাচ্ছে? চৌধুরীবাড়ির মেয়েরা এখন সবাই প্রায় মডার্ন। এরা এখন শহরে থাকে। ট্রামে বাসে চলাফেরা করে। সিনেমা থিয়েটার যায়, মার্কেটিং করে। আর গাঁয়ের ভিড়ে সামান্য ঘেঁষাঘেঁষিতে এরা কি মুচ্ছো যাবে? যত ভুয়ো প্রেস্টিজ। বরং শহরের চাইতে গাঁয়ের লোক মহিলাদের অনেক বেশি সম্মান দেয়। এই প্রসেশনে হৈ চৈ করে যেতে ওদের কি সাধ হয় না? যাদের ইচ্ছে আছে চলুক-না আমাদের সঙ্গে।’

এখন উপলক্ষটা বলি।

চৌধুরীবাড়িতে রাসপূর্ণিমায় প্রতি বছর ঘটা করে পুজো হয়। সেইসঙ্গে চৌধুরীবাড়ির সামনের মাঠে ছোটোখাটো মেলা বসে। চৌধুরীরা একদা এই অঞ্চলের জমিদার ছিল। অতি প্রাচীন বিশাল চৌধুরীবাড়ি। তাদের রাসপূর্ণিমার উৎসব আর মেলার বয়সও শখানেক বছর হল। এখন আর চৌধুরীদের জমিদারি নেই। তবে এখনও নামডাক আছে যথেষ্ট। দেশের বাড়িতে থাকেন কেবল কয়েকজন, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। তবে বছরে একবার রাস উৎসবে এই দেশের বাড়িতে জমায়েত হয় চৌধুরীবংশের অনেকে।

তিন দিনের উৎসব। রোজই একবার চৌধুরীবাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে মন্দির থেকে বিগ্রহদের মহাসমারোহে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির বাইরে মাঠে শ দুই গজ দূরে রাসমঞ্চে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ পুজোটুজোর পর ফের শোভাযাত্রা করে ঠাকুররা ফেরেন তাঁদের আগের দেবালয়ে।

আজ পুজোর প্রথম দিন। রাত নেমে গেছে। বাড়ির মন্দিরে আরতি চলছে। একটু বাদেই ঠাকুর নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোবে। মন্দির থেকে কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। মন্দিরের সামনে পাঁচিল ঘেরা শান বাঁধানো প্রকাণ্ড চত্বরে লোক গিসগিস করছে। চৌধুরীবাড়ির নানা বয়সি পুরুষদের বেশির ভাগই এই শোভাযাত্রার সঙ্গে যায়। ঠাকুর রাসমঞ্চে পৌঁছে গেলে তারা ফিরে আসে। বাড়ির মেয়েরা চত্বরের ধারে উঁচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রা বেরিয়ে যাওয়া দেখে। সঙ্গে যায় না।

ছোটকা অর্থাৎ খুদু বুধু মণি টিয়াদের ছোটোকাকা দূর দেশে থাকেন। এক নামি কোম্পানির জাঁদরেল অফিসার। অনেক বছর বাদে এসেছেন রাসে। শোভাযাত্রার ঠিক আগে ফেউ তুলেছেন— বাড়ির মেয়েদেরও শোভাযাত্রায় যেতে বাধা কীসের?

কমবয়সি বউ-ঝিদের মুখ দেখে বোঝা গেল যে, শোভাযাত্রার সঙ্গে যেতে তারা উৎসুক।

রামুকাকা কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন সুরে বললেন, ‘উঁহু, রিস্কি। মেলায় কতরকম লোক আসে’–

তাঁর কথায় থাবড়া দিয়ে ছোটকা তর্জন করলেন, ‘অলরাইট। আমরা ছেলেরা মেয়েদের গার্ড দিয়ে নিয়ে যাব। আমরা দুপাশে, মেয়েরা মাঝখানে হাঁটবে। নজর রাখব যাতে ভিড় মেয়েদের ঘাড়ে না পড়ে।’

এই বলতেই খুদু বুধু বুলু ভুলু ইত্যাদি কমবয়সি ছেলেরা কাঁউমাউ করে আপত্তি জানাল— ‘আমি পারব না। আমায় একদম সামনে থাকতে হবে ভলেন্টিয়ার নিয়ে। নইলে প্রসেশন এগোবে না।’

—‘আমার বাজি পোড়ানোর ডিউটি আছে,’ জানাল খুদু।

—‘আমারও তাই’, ভুলু সুর মেলায়।

অর্থাৎ বোঝা গেল যে ছোকরারা কেউ এ দায়িত্ব পালনে রাজি নয়। এতক্ষণে জ্যাঠামশাই মুখ খুললেন। মন্দিরের সামনে বারান্দায় এই আলোচনা হচ্ছিল। রাশভারী জ্যাঠামশাই একখানা চেয়ারে বসে গড়গড়ার নলে টান দিতে দিতে সব শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘মেয়েরা প্রসেশনে যেতে চায় যাক। তবে বাপু অত দামি দামি গয়না পরে যাওয়া চলবে না। মণিমুক্তো বসানো গলায় সোনার হার, কানে সোনার দুল, খোঁপায় রুপোর কাঁটা— এসব খুলে রেখে তারপর যায় যাক।’

—‘কেন?’ ছোটকা অবাক।

রামুকাকা জ্যাঠার কথাটা লুফে নিয়ে বললেন, ‘আরে এই ব্যাপারটাই তো বলতে চাইছিলুম। তা না রেন্টুটা চেঁচামেচি করে থামিয়ে দিল। শোন, রেন্টু, আজকাল আর সেদিন নেই। মেলায় বেশি চুরি ছিনতাই হচ্ছে। গতবারই এই গাঁয়ের এক বউয়ের হার নিয়ে নিচ্ছিল ভিড়ের মধ্যে। ভাগ্যিস লোকটা ধরা পড়ে। আচ্ছা করে পিটুনির পর তাকে পুলিশে দেয় পাবলিক। এছাড়াও দুটো পকেটমার কেস হয়েছে। তারা কিন্তু ধরা পড়েনি। সেইজন্যেই তো বলছি, এই ভিড়ে মেয়েদের যাওয়া রিস্কি। মানে এত গয়নাগাঁটি পরে।’

‘আরে দূর দূর,’ ছোটকা রামুকাকার ভাবনা স্রেফ নস্যাৎ করে দিলেন— ‘এই ধ্যাড়ধ্যাড়েপুরে গেঁয়ো মেলায় আসে তো বড়োজোর কিছু লোকাল পাতি চোরছ্যাচোড়। দারোয়ান ভীম সিং তো প্রসেশনের সঙ্গে যায়। ও চলুক মেয়েদের পাশে পাশে গার্ড দিয়ে। ওর বন্দুক আর গোঁফ দেখলেই এসব বদলোক কেউ ধারেকাছে আসবে না। আর আমরা যে যার নিজেদের ফ্যামিলির ওপর নজর রাখব, তাহলেই হবে।’

—‘ওঃ ভীম সিং!’ কচিমামা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, ‘ওর কী হাল হয়েছে দেখেছ? বয়সের ভারে ঝুঁকে গেছে। ওই পেল্লাই গোঁফটুকুই যা সম্বল। বন্দুকটা কাঁধে তুলে রাসমঞ্চ অবধি যেতেই ওর দম বেরিয়ে যায়। ও দেবে গার্ড! আজকাল চোখেও ভালো দেখে না। নার্ভাস হয়ে গুলি চালালে চোর-ডাকাতের বদলে ভালো লোককেই না মেরে দেয়। ওর বন্দুকে তাই এখন গুলি ভরা থাকে না। পকেটে দুটো টোটা রাখে।’

রামুকাকা ফোড়ন কাটলেন, ‘নেহাত পুরোনো লোক, নইলে কবে ছুটি দিয়ে দিতাম। ভয় হয় ভিড়ে। কোনো দুষ্টুলোক ওর হাত থেকে বন্দুকটাই না ছেনতাই করে। ভাবছি, সামনের বছর থেকে প্রসেশনের সময় ওকে একটা নকল বন্দুক দেব।’

—‘ও!’ ছোটকা একটু থমকে গিয়ে বললেন, ‘তা বড়দা যেমন বলছে, মেয়েরা যদি কিছু গয়না কমিয়ে যায় মন্দ কি?’ তিনি বাড়ির বউ-ঝিদের মুখে একবার চোখ বোলালেন।

কিন্তু মেয়েদের হাবেভাবে গয়নার ভার লাঘব করে শোভাযাত্রায় যাবার বাসনা মোটেই ফুটল না। এ কটা দিন তারা একটু ভালোমতন সাজগোজ করে। লোকজনকে দেখায়।

মেয়েদের মনের গতি বুঝে ছোটকা দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘ঠিক হ্যায়, আমি নিজে নিয়ে যাব গার্ড দিয়ে। গয়না খোলার দরকার নেই। ওয়েট। আসছি এক্ষুনি।’ ছোটকা গটগট করে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। একটু বাদেই ফিরলেন। তাঁর ডান হাতের মুঠোয় খোলা রিভলবার। গর্বিত হেসে রিভলবার উঁচিয়ে বললেন, ‘লুক হিয়ার। এইটে দেখলে এখানকার কোনো ব্যাটা চোরছ্যাঁচোড় দশ হাতের ভেতরে ঘেঁষবে না। চলো’—

কিন্তু মেয়েদের তবু নড়বার লক্ষণ নেই। বড়োকর্তার হুকুম ভাঙার সাহস হচ্ছে না তাদের। জ্যাঠামশাই গম্ভীর বদনে ভুড়ুক ভুড়ুক করে গড়গড়া টেনে যাচ্ছেন।

ছোটকা এবার চটে গেলেন— ‘হোপলেস। যতসব ভিতুর দল। ঠিক আছে, মিনতি তুমি চলো। বড়দা, মিনতিকে নিয়ে গেলে তোমার আপত্তি আছে? মানে গয়না-টয়না না খুলে।’ জ্যাঠামশাই নিস্পৃহভাবে জানালেন, ‘নো। এটা তোমার পার্সোনাল রিস্ক।’

ছোটকার স্ত্রী মিনতি ওরফে মিনুকাকিমা কাঁচুমাচু ভাবে হাসছেন। ঠিক ভরসা হচ্ছে না যেতে। আবার অমন দাপুটে স্বামীর কথাও ঠেলতে পারছেন না -’পিস্তলটা কি লোডেড?’ কচিমামা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেন।

‘আলবাৎ লোডেড। একি তোমাদের ভীম সিং পেয়েচ?’ সদর্পে জবাব দেন ছোটকা, ‘কারো বেচাল দেখলেই ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব।’

.

এই সময় তুমুল হট্টগোলের মধ্যে পূজারিরা বেরিয়ে পড়ল মন্দির থেকে বিগ্ৰহ নিয়ে। ঢাকঢোল কাঁসি ঝাঁঝর শিঙা ইত্যাদি বাজনা-বাদ্যির বীর বিক্রমে কানে তালা লাগার জোগাড় হল। চৌধুরীবাড়ির পুরুষরা তড়িঘড়ি বারান্দা থেকে চত্বরে নেমে গেল শোভাযাত্রায় যোগ দিতে। ‘এসো এসো’- ছোটকাও মিনুকাকিমাকে তাড়া দিয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গ ধরলেন। যাবার সময় অন্যদের শুনিয়েই স্ত্রীকে বললেন, ‘আরও দুটো গয়না চাপিয়ে এলে পারতে। দেখোই-না সেভ করতে পারি কিনা?’

শোভাযাত্রায় প্রথমে কিছু বাজনা-বাদ্যি হ্যাজাকবাতি, তারপর পুরোহিতদের কোলে চেপে দামি দামি বসন-ভূষণে সজ্জিত কয়েকটি বিগ্রহ, তার পিছনে আবার একদল বাজনদার, এরপর চৌধুরীবাড়ির লোকেরা, তার পিছনে গ্রামের কিছু গণমান্য লোক।

বাজনা বাজতে বাজতে শোভাযাত্রা ফটক দিয়ে বেরোতেই বাইরে জমা মেলার বিশাল ভিড়টা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাদের ওপর

পা পা করে শোভাযাত্রা এগোয় অতি ধীরে। দুমদাম পটকা ফাটছে অজস্র। তুবড়ি আর রংমশালের রোশনাই মাঝে মাঝে ঝকমকিয়ে উঠছে। হুস হুস করে আকাশ ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে জ্বলন্ত হাউই। আর হাজার হাজার লোকের কী বিপুল কলরব। মূল শোভাযাত্রার গায়ে গায়ে দুপাশে হাঁটছে অগুনতি মানুষ

ছোটকা মিনু কাকিমাকে নিয়ে চলেছেন— বাঁ হাতে স্ত্রীকে কাঁধের কাছে বেড় দিয়ে ধরে আছেন, আর তাঁর ডান হাতে রিভলবার। দুপাশের ভিড় মাঝে মাঝেই ধাক্কা মারছে শোভাযাত্রাকে। ভলান্টিয়াররা সামলাচ্ছে বটে, তবে ঠেলা খেলেই ছোটকা রিভলবার শূন্যে উঁচিয়ে হুংকার ছাড়ছেন— ‘অ্যাই খবরদার। হটো হটো’— সঙ্গে সঙ্গে চালাচ্ছেন ডান হাতের কনুয়ের গুঁতো। চৌধুরীবাবুর হাতে সেই ভয়ংকর অস্ত্র দেখে, তাঁর গায়ে হামলে পড়া মানুষগুলো সভয়ে সরে যাচ্ছে তফাতে। ছোটকার তীক্ষ্ণ নজর পাহারা দিচ্ছে স্ত্রীর গয়নাগুলি।

.

ঘণ্টাখানেক বাদে চৌধুরীবাড়ির লোকেরা ফিরল ঘর্মাক্ত কলেবরে। অবশ্য কমবয়সি ছেলেগুলো বেশির ভাগই ফেরেনি। মেলার হুজুগ ছেড়ে তারা কি সহজে বাড়ি ঢোকে? ছোটকাও ফিরেছেন কাকিমাসহ

বৈঠকখানায় সবার মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে পা দিয়েই ছোটকা নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, ‘ওয়েল, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, অনুগ্রহ করে মিলিয়ে নিন কিছু খোয়াটোয়া গেছে কিনা?’

সবার চোখ পলকে মিনুকাকিমার গায়ের গয়নাগুলো জরিপ করে নেয়। নাঃ, সবই ঠিক আছে।

ছোটকা বিজয়ীর হাসি দিয়ে বললেন, ‘দেখলে? এই তো দিব্যি ঘুরে এলাম। হলটা কী? যত বাজে ভয় তোমাদের।’

ছোটকা এবার বুঝি একখানা জব্বর লেকচার ঝাড়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন, এমন সময় তেরো বছরের ভাইঝি উমা ফস করে বলে ওঠে, ‘ও ছোটোকাকা, তোমার ঘড়ি কই?’

অ্যাঁ, তাই তো! ঘরের সবাই দেখল যে তখনো রিভলবার ধরা ছোটকার পুরুষ্টু ফর্সা ডান হাতের কবজিতে শুধু একটা ঘড়ির মাপের গোল দাগ। কিন্তু সোনার ব্যান্ড লাগানো দামি বিদেশি ঘড়িখানা নেই। ছোটকা ওই ডান হাতেই ঘড়ি পরেন।

কয়েক মুহূর্ত কারো মুখে কোনো কথা ফোটে না। তারপরই মিনু কাকিমা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি ঘড়ি খুলে গিছলে?’

নিজের ডান হাতখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে ছোটকা হতভম্বের মতন ঘাড় নেড়ে মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করেন— ‘না।’

চোখ কপালে তুলে উত্তেজিত রামুকাকা বলে ওঠেন— ‘তবে গেছে। প্রসেশনে মেরে দিয়েছে। ওফ্ কী কাণ্ড দেখো―

রামুকাকার কথা শেষ হবার আগেই ছোটকা হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *