ছেলে বয়সে – ৫

সেইখানে দাঁড়িয়েই সে দেখতে লাগল, যাত্রীর তাড়াতাড়ি পাণ্ডাদের কাড়াকাড়ি, আর রেলওয়ে কর্মচারীদের বাড়াবাড়ি। দূরে কাকে লক্ষ্য করে সে হাতের একটা অদ্ভুত সঙ্কেত করল, সেই ইঙ্গিতে আকৃষ্ট হয়ে লোকটি চটপট তার দিকে এগিয়ে এলো।

“সুধীর, তোমার এতো দেরি?”

“আমি তোমাকে ভীড়ের মধ্যে খুঁজছিলাম, তুমি যে এখানে দাঁড়িয়ে আছো তা কে জানে?”

“কি করব বল? আমার যে টিকিট নেই। সদরপথে গেলে কি অসভ্যরা সহজে ছাড়বে তুমি ভাবো?”

“না তা ভাবিনে। তবে এই দিক দিয়েই, অন্ধকারে, লাইন ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলে যাই, এসো।”

কতকগুলো লাইন পেরিয়ে গিয়ে যেমনি এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়েছে, অমনি, অন্ধকারে অজগরের মত জ্বলন্ত চোখ মেলে, একটা খালি ইঞ্জিন তাদের কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।

“সুধীর, গায়ে গরম জলের ছিটে পড়েছে ভাই।”

“একটুর জন্যে প্রাণে বেঁচে গেছ, এই ভেবে খোদাকে ধন্যবাদ দাও।”

“তা দিচ্চি, কিন্তু আমাদের কি ভগবান আছে?”

ততক্ষণে তারা তারের বেড়ার কাছে পৌঁছেচে, দুজনে উঁচু লাফ দিয়ে তারের বেড়া ডিঙিয়ে গেল। সুধীরের কাপড় আটকে খানিকটা ছিঁড়ে গেল।

“দেখচ সুধীর, কেবল আমি নয়, সবাই তোমাকে ভালবাসে। এই অপদার্থ তারের বেড়াটাও তোমাকে ধরে রাখতে চায়!”

“ঠিক বলেচ দেবেন। আমাদের চলবার পথে ভালবাসাটা এই তারের কাঁটার মতই অনাবশ্যক বাধা।”

দেবেন একটা দীর্ঘনিশ্বাস চেপে ফেলল, এবং চুপ করে তার সঙ্গে সঙ্গে চলল। ঝোপের পাশে এসে তারা দাঁড়াল, সেখানে একটা চালকবিহীন মোটর অপেক্ষা করছিল। সুধীর কয়েকবার হাতল ধরে ঘুরোতেই, অতি প্রত্যুষের শান্তি ভঙ্গ করে গাড়িটা যাবার অনিচ্ছা বারবার সশব্দে জানাতে লাগল। দেবেনকে পাশে বসিয়ে সুধীর মোটরে স্টার্ট দল।

মোটর চলচে, দুজনেই চুপ। ভোর হয়ে আসছে। ছোট বড় পাহাড়ের চূড়াগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠচে, একটা গোপন পথ দিয়ে তারা মধুপুরের দিকে চলেচে। দেবেন এতক্ষণে কথা বল্লে, আকাশের গায়ে পাহাড়ের ছবি কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে, দেখচ সুধীর।

সুধীর তার কোনো উত্তর দিল না, স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে ধরে ঈষৎ সংশয় প্রকাশ করে নিজের মনে বল্লে, পেট্রল ঠিক আসচে ত?

“তুমি কি মধুপুরেই আছো? বৈদ্যনাথে যাও না কখনো?”

হেড লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে সুধীর এই কথার জবাব দিল, যাই মাঝে মাঝে।

“বৈদ্যনাথ আমার বেশ লাগে। মনে পড়ে ছেলেবেলায় যখন প্রথম এসেছিলাম তখন মন্দিরের সিংহদ্বার খুঁজে বের করাই ছিল আমার প্রত্যহের কৌতূহল, ওটা খুবই শক্ত কাজ।”

স্টিয়ারিং হুইল্ ঘুরিয়ে গাড়িটাকে বাঁমুখো নিতে নিতে সুধীর বল্লে, হুঁ।

“কথা বলচ না কেন, তুমি কি ভাবচ?”

“কই, কিছু ভাবিনি ত? হ্যাঁ, এবার তুমি কতজনকে দলে ‘কনভার্ট’ করলে?”

“খুব বেশি নয়, বাইশ তেইশ-জন হবে। তবে এমন ছেলে বেছে করেচি, যারা অপরদের দলে টানবার শক্তি রাখে। তারাও অনেককে করেছে। সব বৃত্তান্ত ও নামের তালিকা পরে পাঠাব।”

“ডাকে পাঠিয়ো না। লোকের হাতে পাঠাবে, সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখে, বুঝেচ।”

“আচ্ছা।”

“আজ সন্ধ্যার পর তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো। কোথায় জানো? আমাদের গুপ্ত আড্ডায়, সেখানে দলের কর্তাদের সামনে আজ তোমার দীক্ষা হবে, এবং তুমি হবে দলের বিশেষ সভ্য।”

“দলের কর্তা? তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমার হবে?”

“কতকটা হবে বই কি। তোমাকে হয়ত তাঁরা দায়িত্বপূর্ণ নতুন কাজের ভার দিতে পারেন। তবে তার আগে তোমাকে হয়ত সেই ভাবে পরীক্ষা করতেও পারেন।”

“আমি তো বলেছি কাউকে খুনটুন করতে আমি পারব না, ওদিকে আমার মন বড় দুর্বল। তুমি কি তা বলো নি তাঁদের?”

“বলেচি, তাই তাঁরা তোমাকে রিক্রুটিংএর কাজই হয়ত দেবেন এমন আশা করচি। সহজে ছেলে পটাতে তুমি পারো আমি জানি। এবং এখন ছেলে যোগারই আমাদের সব চেয়ে দরকার–ধনবল আর জনবল।”

“কেন, এবার কি বড় রকমে কিছু শুরু হবে তুমি ভাবো?”

“তাই ত মনে হয়। যেমন টিকটিকিতে সারা দেশ ছেয়ে গেছে, আপনজনকে বিশ্বাস করতে ভরসা হয় না, তেমনি শহরে পাড়াগাঁয়ে সব স্কুলে ও কলেজে এবার আমাদেরও জোর রিক্রুটিং চলচে। যত ইনটার্ন করচে, তার চারগুণ দলে আসচে, যদিও তাদের অধিকাংশই কাঁচা মাল, আর হয়ত প্রথম ধোপেই টিকবে না।”

সুধীর ডানদিকে হুইল ঘুরাল, গাড়িও ডাইনে ফিরল।

“সত্যি, এবার বড় বিস্তৃতভাবে কাজ হচ্ছে। শহরের বা পাড়াগাঁর কোনো ছেলেকে ‘কনভাট’ করতে গেলেই দেখি, তারা আগে থেকেই ‘কনভার্টেড’, এমন ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে। একটা কিছু যে চলচে তার আঁচ সবাই যেন পাচ্চে।”

“গোপনতার একটা রহস্যময় আকর্ষণ আছে তার শক্তি বড় কম নয়। তাইতো ছেলেরা দলে দলে এই দিকে ঝুঁকছে—”

এমন সময়ে সশব্দে সামনের টায়ার ফেটে মোটর থেমে গেল। ‘এ আবার কি বিপদ!’ —সুধীর নেমে গিয়ে টায়ার খুলে নতুন ‘টায়ার’ লাগাবার কাজে মন দিল; এবং দশ মিনিটের মধ্যেই মোটর চলতে শুরু করল।

চারিদিকে পরিষ্কার হয়ে এসেছে, কাঁচা রোদ পাহাড়ের মাথায় পড়ে ঝক্‌মক্‌ করছে। সুধীর ‘ক্লাচের’ সাহায্যে মোটরের গতি কমিয়ে দিতেই, দেবেন জিজ্ঞেস করলে, “আবার কি হল? পেট্রল ফুরিয়েচে নাকি?”

‘ফুট্‌ব্রেক’ চেপে গাড়ি থামিয়ে সুধীর বল্লে, “ঠিক তা নয়। তবে কি না, আমি রোজ সকালে চা খাই, এবং সঙ্গী যিনি থাকেন তাঁকেও দয়া করে চাখাই! এখন তারই আয়োজন হবে।”

গাড়ির আরেক কোণ থেকে স্টোভ্, কেটলি, চায়ের কাপ, লিপটনের কৌটা, বিলিতি জমাট দুধ, ইত্যাদি সব সরঞ্জাম বেরিয়ে এল, অল্পক্ষণেই দূরের পাহাড়ের রঙের মতো অপূর্ব চা তৈরি হল— ঘ্রাণে, পানে ও দানে তৃপ্তি!

পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সুধীর বল্লে, গোটা উত্তর ভারত জুড়ে সর্বত্র একই দিনে বিরাট বিপ্লব ঘোষণার দিন পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেচে, এ সব হচ্ছে তারই উদ্যোগ —

দেবেন উৎসাহে লাফিয়ে উঠল, সমস্ত গরম চা তার হাতে গায়ে ও কাপড়চোপড়ে উথলে পড়ল। “তুমি জানো, সত্যি তুমি জানো?”

“এবং এও জানি যে বিপ্লবের রক্ত-চাকা প্রথম আমাদের চূর্ণ করে, আমাদের বুকের উপর দিয়েই যাবে। সেই জন্যে প্রস্তুত হও।”

দেবেন আবার ট্রেনে। বেলা প্রায় নটা। দূরে ছোটখাটো পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকিয়ে সে গত রাতের কথা ভাবছিল।… সুধীর তাকে চোখ বেঁধে মোটরে করে কোন্ অজানা জায়গায় নিয়ে গেল, সেই কক্ষর মধ্যে একটা গোল টেবিলের পাশে কয়েকজন বসেছিলেন, সবারই মুখোসে মুখ ঢাকা–চোখের আবরণ খুলে তাদের দেখেই তার অন্তর অজ্ঞাত আশঙ্কায় শিউরে উঠেছিল। তারপরে যে সব সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হল সেই সব। অবশেষে রিভলবার হাতে করে ভারতবর্ষের মানচিত্রের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাকে শপথ করতে হল, যতদিন বেঁচে থাকবে এই গুপ্তদলের কাজ করতে হবে, তার কর্তার আজ্ঞা নির্বিচারে মেনে চলতে হবে, কোনোদিন এই দল ছাড়বে না বা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না–করলে রিভলভারের গুলিতে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত থাকবে।

এই ভয়ানক শপথ কি করে উচ্চারণ করল ভেবে সে আশ্চর্য হল। সুধীরের মোহময় মুখের দিকে চেয়ে সে নিশ্চয় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছিল, তাই দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের স্বাধীনতা অত সহজে চিরদিনের মত বিসর্জন দিতে পেরেছে। আর সুধীর? সে তো জানে আমি তাকে কি রকম মনে মনে পূজা করি। যে কিনা অনায়াসে হেসে বলতে পারলে, এই শপথ ভাঙলে নিজের হাতে গুলি মেরে আমার মাথার খুলি ভেঙে দেবে? এত বড় আত্মদানের ফলে কি আমি তার কাছে এতটুকু আদর পাবার দাবি করতে পারি না? আমার এতো শ্রদ্ধা, এতো ভালোবাসার কি চিরদিন সে এই ভাবে প্রতিদান দিয়ে যাবে?

তার নতুন দায়িত্ব, নতুন কার্যভারের কথা চিন্তা করল। রাজসাহীর একটা গোটা বিভাগের সমস্ত কর্মীকে সংঘবদ্ধ করার কাজ এখন তার ঘাড়ে। সে এখন কলকাতা যাবে, সেখানে বাড়িতে থাকার তার একদিন মাত্র ছুটি, তারপরে রাজসাহী হয়ে তাকে কাটিহারে সুধীরের সঙ্গে মিলতে হবে। সুধীর সেই দিনই ডাউন ট্রেনে ভাগলপুর রওনা হয়েছে; প্রয়োজন হলে ভাগলপুরের এক ঠিকানায়, আরেক লোকের নামে, তার কাছে সাঙ্কেতিক টেলিগ্রাম করতে হবে। কাটিহার থেকে ফিরে তাকে রাজসাহী আর মালদায় কাজ করতে হবে।

এই সব কথা সে ভাবছিল, কিন্তু সব চেয়ে তাকে বেদনা দিচ্ছিল, আজ সকালে সুধীরের কাছে বিদায়-বেলার ঘটনা। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে গাড়ি ছাড়বার এক মিনিট মাত্র আগে, সুধীরের হাতটি হাতের মধ্যে চেপে ধরে দেবেন মিনতি করে চেয়েছে, তোমার হাতে একটি চুমু দিই ভাই? বন্ধুর অধিকারের এইটুকু দাবি! সুধীর তার উত্তরে হাত টেনে নিল, এবং দেবেনের গালে ছোট্ট একটা চড় মেরে বল্লে, এখনো দুষ্টুমি গেল না? সেই সামান্য অবহেলা ও আদরটুকু এখন দেবেনের সমস্ত মন আচ্ছন্ন করে রয়েচে।

ক্রমশ গাড়ির বিপুল গতি তার এই সব তুচ্ছ সুখ-দুঃখ ভুলিয়ে দিল, চলার গতিছন্দ তার চিত্ত অধিকার করল। গ্রহ উপগ্রহ-সঙ্কুল চলিষ্ণু এই বিরাট বিশ্বজগতের বিপুল আকর্ষণ তার স্নায়ুতে স্নায়ুতে অপূর্ব অনুভূতি জাগিয়ে দিল। তার কেবলি মনে হতে লাগল চলতে হবে, চলতে হবে! এমনি বিপুলবেগে বিরাট পথে। তার নাড়িতে নাড়িতে ঝঙ্কার দিয়ে অনাদি সুরে বাজতে লাগল—চলাই সত্য! জন্মে জন্মে যুগে যুগে লোকে লোকে! এই চলা হচ্ছে আত্মদান—নিজেকে দিয়ে দিয়ে যাওয়া, এবং দানেই মুক্তি। মানুষকে চলার পথে মুক্তি দিতে হবে, মানুষের বন্ধন মোচন করতে হবে। এই তো ব্রত সে নিয়েচে, তার নিজের সুখ-দুঃখের তুচ্ছ কথা ভাবনার অবসর তার কই,—তাকে যে মানুষের সেবায় নিঃশেষে আপনাকে ঢেলে দিতে হবে এখন।

সন্ধ্যার পর গাড়ি ব্যাণ্ডেল জংশনে দাঁড়াল, এইখানে তাকে গাড়ি বদল করে নৈহাটির গাড়িতে চাপতে হবে, হুগলি স্টেশনে একটি ছেলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে—হুগলি থেকে নৈহাটি হয়ে শিয়ালদহে নেমে বাড়ি গিয়ে চব্বিশ ঘণ্টার বিশ্রামের ছুটিটা যথাসম্ভব পুরো ভোগ করবে, এই ছিল তার মতলব। কিন্তু বিপ্লবপন্থী যা ঠিক করে, পুলিশে তা ভেঙে দেয় ––এই সনাতন কাহিনী।

ব্যাণ্ডেলে এসে দেবেনের প্রথম সন্দেহ হল সি-আই-ডি তার পিছু নিয়েচে, হয়ত মধুপুর থেকেই, সে লক্ষ্য করেনি। যে লোকটিকে সে সন্দেহ করেচে, সে খোলাখুলিই তার ওপর দৃষ্টি রাখচে এবং তার সঙ্গ ছাড়চে না। দেবেন একটা সন্দেশের দোকানে গিয়ে সামান্য কিছু জলযোগ করে, টিফিন ক্যারিয়ারে লুচি ও সন্দেশ ঠেসে নিয়ে, নৈহাটির গাড়িতে উঠল, সেই লোকটিও সেই গাড়িতে উঠল।

পরের স্টেশনে সে অন্য কামরায় গেল, লোকটিও একটা ছুতো করে সেই কক্ষে উঠে বসল। এই পষ্ট ইঙ্গিতের পরে দেবেন, হুগলি স্টেশনে তার ছেলেটিকে দেখতে পেয়েও, আর ডেকে আলাপ করতে সাহস করল না। অবশেষে গাড়ি নৈহাটি স্টেশনে দাঁড়াল।

দেবেন জানালা গলিয়ে মুখ বার করে দাঁড়িয়েছিল, এবং কি করে টিক্‌টিকির দৃষ্টি এড়াবে তাই কল্পনা করছিল। এমন সময়ে ডাউনযাত্রী একটা গাড়ি এসে তাদের গাড়ির পাশেই দাঁড়াল। তার সামনাসামনি কামরায় একটি কিশোর বসেছিল তাদের গাড়ির দিকেই তাকিয়ে,—তার অপরূপ সৌন্দর্যে আহত হয়ে ক্ষণিকের জন্য দেবেন বিশ্বজগৎ বিস্মৃত হল।

ইতিমধ্যে টি-টি-আই তাদের কামরায় টিকিট পরীক্ষা করতে ঢুকেচে, দেবেনের সেদিকে খেয়াল নেই। চেকার তার কাছে এসে চাইল, —টিকিট। দেবেনের চমক ভাঙলো এবং একমুহূর্তেই ব্যাপারটা তার পরিষ্কার হৃদয়ঙ্গম হল যে এতদিন পরে এবার সত্যিই হাতে হাতে ধরা পড়েচে এবং সি-আই-ডি বেটার সামনে এখন এই ফিরিঙ্গি চেকারটার কাছে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে।

তার পকেটে চার পয়সা দামের একটা বহু পুরোন টিকিট ছিল, সেইটে বের করে যেন চেকারের হাতে দিতে যাবে—এই সময়ে টিকিটটা হাত থেকে জানালা গলে মাটিতে লাইনের কাছে পড়ে গেল। চেকার তর্জন করে বললে, জলদি নিয়ে এস।

সামনের ডাউনযাত্রী গাড়ি তখন ছেড়েচে, এবং তাদের গাড়িরও বিদায়ের ঘণ্টা বেজেচে, দেবেন নিচে নেমে গিয়ে, সামনের চলন্ত গাড়ির লোহার ডাণ্ডা ধরে উঠে পড়ল, এবং হাতল ঘুরিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকল। গাড়ির লোক এই নবাগতের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল, বিশেষ করে সেই সুন্দর ছেলেটি, যে দরজার মুখেই বসেছিল।

দেবেনের পরিত্যক্ত গাড়িও চলতে শুরু করেছিল, দেবেন ও সি-আই-ডি যতক্ষণ দেখা যায় বিচিত্র চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল; কেবল চেকারটা, এমন হতভাগা শিকার হাতছাড়া হয়ে গেল দেখে তার অসৌজন্যে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠল।

দেবেন স্থির হয়ে প্রথম প্রশ্ন করলে, “এ গাড়ি কোথা যাবে?”

সেই রাঙা ছেলেটি উত্তর দিল, “লালগোলা। আপনি ও গাড়ি থেকে চলে এলেন কেন?”

“আমাকে এই গাড়িতেই যেতে হবে।”

“আপনি কোথায় যাবেন?”

“আমি? কোথায় যার ঠিক নেই, তবে রাজসাহী যাবার ইচ্ছা আচ্ছে। তুমি কোথা যাবে?”

“আমাকে এই নৈহাটিতে নামতে হত, যার আসবার কথা ছিল সে এল না। এখন আমি মালদায় যাব। আমায় নৈহাটি থেকে মালদার একটা টিকিট করতে হবে, কোন্ স্টেশনে করি বলুন তো?”

“ব্যস্ত কেন? রাণাঘাটে অনেকক্ষণ গাড়ি থামবে। সেইখানে কোরো।”

“তা তো করব। কিন্তু—কিন্তু একটা অসুবিধা আছে। আমার নেমে গেলেই ভালো ছিল।”

“টিকিট করার আবার অসুবিধা কি? তুমি ভেব না, আমি করে দেব। তোমার নাম কি? কি পড়?”

“এবার সেকেও ক্লাসে উঠেছি। আমার নাম মোহনলাল বসু।”

“সেকেন্ড ক্লাসে পড়, তোমার বয়স কত? তেরোর বেশি হবে?”

“অন্তত পনের।” বলে মোহন একটু হাসলে।

“মালদায় কি আম খেতে যাচ্চ?”

ছেলেটি হেসে বল্লে, “অনেকটা তাই বটে। সেখানে আমার মামা রেজিস্ট্রী আপিসে কাজ করেন, আমাদের স্কুল খোলার এখনও দেরি আছে তাই যাচ্ছি। জানেন তো বেশি দাম দিয়েও ভালো আম কলকাতায় কম মেলে।”

দেবেন প্রশ্ন করল, “এর আগে তুমি মালদা যাওনি আর কখনো? বেশ ছোটখাটো সুন্দর শহরটি, নদীর ধারে ধারে বাঁধা রাস্তা চলে গেছে, আমার বেশ লাগে।”

“এবার প্রথম যাচ্চি। যদি ভালো লাগে, আর শরীর ভালো থাকে তবে মালদার স্কুলেই ভর্তি হব, বাবা বলেছেন। কেন জানি না, কলকাতায় রেখে পড়াতে বাবার বড় ইচ্ছে নেই।”

“মাকে বলোনা কেন যে আমি পাড়াগাঁয়ে থাকবো না।”

“মা তো নেই, ছোট মা আছেন। তিনি আমাকে খুব ভালবাসেন, আদর করেন। বাবা বলেন যে আমি কলকাতায় থাকলে খারাপ হয়ে যাব তাই। আমার তো কখনই তা মনে হয় না। খারাপ হওয়া কি সোজা?”

দেবেন তার কথা শুনে একটু হাসলে,—“না, খারাপ হতে যাবে কেন? তুমি বেশ ভালো ছেলে; আমি দেখলেই বুঝতে পারি।” মোহনের নরম হাতখানি দেবেন নিজের হাতের উপর নিল। মোহন ছাদের গ্যাসের বাতির দিকে তাকিয়ে, মোহনের মতই হাসল, দেবেনের চোখ জুড়িয়ে গেল। ছেলেটি ঈষৎ দূরে বসেছিল, এবার দেবেনের পাশে ঘেঁষে এল। ঐ সুন্দর পোশাকে সাজানো সুকুমার তনু দুর্দম আবেগে বুকের মধ্যে টেনে নেবার একান্ত আকাঙ্ক্ষা দেবেন অতি কষ্টে সম্বরণ করল।

নৈহাটি থেকে রাণাঘাট পৌঁছবার মুখে তাদের আলাপ বিচিত্রপথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। ভালবাসা কখনো রেলপথে অঙ্কুরিত হলে, ক্ষণিকের মধ্যে এবং ক্ষণিকের জন্যই তা লতায় পাতায় পল্লবিত ও ফলে ফুলে সফল হয়ে ওঠে। গাড়ির গতিবেগ যেন প্রেমেরও পাল্লা বাড়িয়ে দেয়। মিলন অভাবিত, পুনর্মিলন অনিশ্চিত, এবং বিদায়ের সময় কাঁটায় কাঁটায় সুনির্দিষ্ট—এই জন্যেই হয়ত পথিকের প্রেম সব বাধা লজ্জা ও সঙ্কোচ সহজে অতিক্রম করে আত্মপ্রকাশ করে।

দেবেনের মনে বিলক্ষা আশঙ্কা ছিল রাণাঘাটে টিকিট চেক করবে। এবং সেই সি-আই-ডিটাও এতক্ষণে তারযোগে নিশ্চয় খবর দিয়েছে, এবং হয়তো রাণাঘাট থেকেই নতুন কেউ তাকে চোখে চোখে রাখবে। দেবেন ভেবেছিল যতক্ষণ না ট্রেন রাণাঘাট ছাড়ে ততক্ষণ স্টেশনে নেমে পায়চারি করলেই দুটো বিপদ একসঙ্গে এড়ানো যাবে, কিন্তু রাণাঘাটে ট্রেন থামতেই মোহন বল্লে, “বড় খিদে পেয়েছে। কি খাওয়া যায় বলুন ত?”

খিদে দেবেনেরও পেয়েছিল, আগের ট্রেনে লুচি ঠাসা টিফিনবাক্স ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েচে—সেই শোক তার মনে জাগল, মোহনকে বললে, “দেখচি কি পাওয়া যায় এখানে।”

ওধারের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্লাটফরমের একজন মিঠাইওয়ালার কাছে সন্দেশ কিনচে, এমন সময় যা আশঙ্কা ছিল, টিকিট চেকার সেই কামরায় প্রবেশ করল। সেই ধারের টিকিট দেখতে দেখতে যখন চেকারটি তার পাশের প্রৌঢ় ভদ্রলোকের টিকিট দেখছেন, তখন সেই আসন্ন দুর্যোগে দেবেন সন্দেশটা একটু চেখে দেখলে।

প্রৌঢ় ভদ্রলোকটির টিকিটে ও হাফটিকিটে সাত-আটখানা ছিল, এবং তাঁর পুত্রপরিজন ছত্রাকারে সমস্ত কামরার এখানে-ওখানে ছড়িয়ে বসেছিল, তিনি হাতের ইঙ্গিতে একবার তাদের দেখিয়ে দিলেন।

দেবেনের সন্নিকটে এতগুলি টিকিট একসঙ্গে পেয়ে গিয়ে, সন্দেশক্রয়ে নিযুক্ত ছেলেটিকে প্রৌঢ়েরই আত্মীয় ভেবে তার কাছে স্বতন্ত্র টিকিট চাইবার কল্পনাও চেকারের মনে এল না। তার মনস্তত্ত্বের এই সুযোগ লাভ করে পাশের ত্রাণকর্তাকে দেবেন মনে মনে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু দেবেন পেলেও, মোহন উদ্ধার পেল না, তার মাত্র নৈহাটি পর্যন্ত টিকিট করা ছিল, চেকার তার কাছে পেনালটি ইত্যাদি সহ দ্বিগুণ ভাড়া দাবি করে বসল।

দেবেন চেকারকে গিয়ে বল্লে, “দেখছেন ত ছেলেমানুষ এবং ছাত্র,—সঙ্গে কোনো অভিভাবক নেই। একে ছেড়ে দেওয়াই আপনার উচিত।”

চেকার বল্লে, “তা আমরা পারিনে। তাতে আমাদের কর্তব্যের অবহেলা হয়। তবে আমি অন্য ব্যবস্থা করতে পারি যদি—”

অন্য ব্যবস্থাটা কী তা দেবেন ও মোহন দুজনেই বুঝল, মোহন তার মানিব্যাগ খুলে দেখাল মাত্র একটা আধুলি আছে, তাতেই অন্য ব্যবস্থা সম্ভব হবে কিনা জানবার প্রত্যাশায় করুণ চোখে চেকারের দিকে চাইল।

দেবেন বল্লে, “অন্য ব্যবস্থাতে কাজ নেই আপনি ওকে নৈহাটি থেকে মালদা পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে রসিদ দিন, আমি টাকা দিচ্চি।”

“এতে আপনার পেনালটি দিতে হবে, কিন্তু অন্য ব্যবস্থায়—”

“তাহলে আপনি যান। যাতে পেনালটি না দিতে হয় সেই অন্য ব্যবস্থা আমরা গার্ডের সঙ্গে করে নেব। যে স্টেশনে নামব সেই স্টেশনে বা এখনই, গার্ডকে পুরো ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে রসিদ নেব।”

অগত্যা চেকার টাকা নিয়ে রসিদ দিয়ে, অন্য ব্যবস্থার আশায় অন্য কামরায় গেল।

“আপনি টাকাটা দিলেন যে?”

“তাতে কি হয়েচে? যদি আমি না হয়ে তুমি হতে, তা হলে কি তখন তুমি আমাকে, বড় ভায়ের মত, এমনি সাহায্য করতে না? আচ্ছা, তুমি বসো, এক্ষুনি একটা টেলিগ্রাম করে দিয়ে আমি আসচি।”

সুধীরকে তার করে দেওয়া দরকার, এবং রাণাঘাটে গাড়ি কিছুক্ষণ থামে, এ সুযোগ এই লাইনে আর কোথাও নেই। দেবেন এই তার করল—সুনির্মল দেব, প্রোফেসার, ভাগলপুর। রাজসাহী যাচ্ছি। এক হপ্তা পরে কাটিহারে যথাস্থানে মিলব। সুরেন্দ্র।

সুনির্মল দেবের নামে তার করলে সুধীরের পাবার কথা, আর সুরেন্দ্র হচ্চে দলের দেওয়া দেবেনেরই সাঙ্কেতিক নাম। তার করে বেরুতে তার একটু দেরি হয়ে গেল, ততক্ষণ ট্রেন চলতে শুরু করেচে,—গাড়ি ছেড়ে দিল অথচ দেবেন ফিরে এল না দেখে, ঠাসাঠাসি এত যাত্রী, তবু মোহনের বড় একা একা মনে হল। এখন কি করবে, নিরুপায় হয়ে তাই ভাবছে, এমন সময়ে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে হাসতে হাসতে দেবেন কামরায় ঢুকল। মোহন বিস্ময়ে ও আনন্দে অধীর হয়ে তার হাত চেপে ধরে বল্ল, “আমি ভেবেছিলুম আপনি বোধহয় উঠতে পারলেন না।”

“প্রায় সেই রকমই, চলন্ত গাড়িতেই, কয়েকটা কামরার ওধারে উঠেছিলুম।”

“আপনার খুব সাহস ত! যদি পড়ে যেতেন।”

“পড়ব কেন? ফ্লাইং চেকাররা কি করে আসে তবে?”

দেবেন তার অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে বসতেই মোহন এবার তার গায়ে হেলান দিল। যে সদয় ছেলেটি অনায়াসে এতগুলো টাকা দিয়ে তাকে বিপদে বাঁচাল, অপরিচিত হলেও, আপনজনের মত তার ওপর নির্ভর করবার অগোচর বাসনা মোহনের মনে জেগেছিল। দুজনেরই দুজনকে ভালো লেগেছিল, তাই যখন ঘাড় ফিরুতেই গালে গালে ঠেকল তখন কেউই মুখ টেনে নিল না।

“খিদে পেয়েছে বলছিলে, এসো কিছু খাওয়া যাক”, দেবেন খাবার বের করে বললে, “আমি তোমাকে খাইয়ে দি, কেমন?” হাসিমুখে মাথা নেড়ে মোহন বল্লে, “দিন।” নিজের ও মোহনের মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে দেবেন জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে?” মোহন বল্লে, “বেশ।”

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মোহন বলল, “যে গাড়িতে ভীড়, আজ আর কারু শোয়া হবে না।”

“তা কেন? তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শোও, আমি এই জানলায় হেলান দিয়ে ঘুমুই। এইটুকু জায়গাতেই দুজনের বেশ কুলিয়ে যাবে।” চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে ও গাল দুটি আস্তে আস্তে টিপে দিতেই অল্পক্ষণে মোহন তার কোলে, যতখানি সম্ভব, ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরবেলায় লালগোলা ঘাটে গাড়ি থামতেই দেবেন, মোহনের ঘুম ভাঙিয়ে, উঠে যা দেখল তাতে তার চক্ষু স্থির! বুঝল সেই প্রতারিত সি-আই-ডি সহজে ছাড়বে না।

“এত পুলিশ চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে কেন, দেবেনদা?”

“কি করে জানব ভাই? তবে তুমি এক কাজ কর, একলা ঐ রসিদ দেখিয়ে বেরিয়ে যাও, স্টিমারে আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো। আমার যেতে একটু দেরি হবে।”

এই লালপাগড়ী কনস্টেবলদের ব্যূহ একলা ভেদ করে যাবার উৎসাহ মোহনের ছিল না, সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। দেবেন এবার একটু জোর গলায় বল্ল, “দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও। নইলে বিপদে পড়বে।” অগত্যা তাকে, ক্ষুণ্ন মনে, যেতে হল।

চারিদিকে পুলিশ, সতর্ক পাহারা। প্রত্যেকের কেবল টিকিট নয়, চেহারা ভালো করে নিরীক্ষণ করে একে একে ছেড়ে দিচ্চে। দেবেন আর কোনো উপায় না দেখে, গাড়ির ছাদে উঠল, সকলের দৃষ্টি সদর গেটে—যেখানে যাত্রীদের অগ্নিপরীক্ষা চলছিল সেইখানে বদ্ধ ছিল তাই কেউই তাকে লক্ষ্য করল না। দেবেন গাড়ির ছাদে ছাদে গিয়ে ইঞ্জিনের কাছে এসেচে, এই সময়ে ইঞ্জিনও তৎসংলগ্ন ব্রেকভ্যান খুলে দিল। দেবেন এই ভরসা করেই ছাদে উঠেছিল, এখন ইঞ্জিন, গাড়ি ছেড়ে ধীরে ধীরে সরে যাচ্চে দেখে, সে গাড়ির ছাদ থেকে এক লম্বা লাফ দিয়ে ব্রেকভ্যানের ছাদে গিয়ে পড়ল। ইঞ্জিন বাঁশী বাজাতে বাজাতে, পুলিশের ঘেরাও স্থান অবলীলায় অতিক্রম করে সামনে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে দেবেনকে নিরাপদ স্থানে উত্তীর্ণ করে দিল। এক আনা দিয়ে পরের স্টীমার-স্টেশনের একটা টিকিট কিনে দেবেন একেবারে রাজসাহীর স্টীমারে গিয়ে উঠল,—এই দুর্যোগে আর গোদাগাড়ির স্টীমারে মোহনের সঙ্গে দেখা করতে তার সাহস হল না। মোহন আজ অযাচিত তাকে দেবেনদা বলে সম্বোধন করেচে, সেই মধুর কণ্ঠস্বর তার মন ভারি করে তুলল। ছেলেটিকে একটু আদর করে বিদায় দিয়ে আসতে পারল না,—সে এখন কি ভাবচে, অনুমান করে দেবেনের সারা মন বিধুর হয়ে উঠল। পরাধীন জাতির যে ভালবাসবারও অধিকার নেই!—চার পয়সার টিকিটখানি নাড়াচাড়া করতে করতে দেবেন এই সমস্যার কথাই ভাবচিল। স্টীমারের বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় অদূরে একটা ছোট নৌকা ডুবতে বসেছিল, আর সব যাত্রীরা নিরাপদে থেকে পরম কৌতুকে নৌকারোহীদের ভাগ্য-বিপর্যয় নিয়ে তখন আলোচনা করছিল।

অবশেষে যথাসময়ে রাজসাহীতে, ঐ চার পয়সার টিকিটখানিই টিকিট কালেক্টারের হতে গছিয়ে দিয়ে দেবেন বেরিয়ে গেল। মোহনও প্রায় সেই সময়ে মালদা স্টেশনে নেমেচে।

সেদিন মালদার মাঠে ফুটবল ম্যাচ ছিল, অশান্তও দেখতে গেছে। বিশাল মাঠের চারধার ছেলেয় ছেলেয় ভর্তি, সকলেই উৎসুক হয়ে খেলা দেখছিল। অশান্তর কি কারণে সেদিন মন ভালো ছিল না, সে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং যখন খুব জোরে উৎসাহধ্বনি ও হাতাতালি পড়ছিল তখনই কেবল খেলার দিকে মনোযোগ দিচ্ছিল। সমস্ত মাঠের মধ্যে, আপনার বলে ভাবতে পারে এমন একটা চোখ জুড়ানো মিষ্টি মুখ সে নিজের অগোচরে খুঁজে ফিরছিল। কেউ তার দিকে ফিরে চাইলে, হয়তো সে তাকে ডেকে সহানুভূতিভরে দুটো কথা বলবে এইটুকুর দুরাশায় সে অনেকের কাছেই দাঁড়ালো, কিন্তু এই স্নেহতৃষাতুর সুশ্রী ছেলেটির উন্মুখ হৃদয়ের রহস্য কেউ বুঝল না। তার দেবেনের কথা মনে পড়ল।

খেলার দ্বিতীয়ার্ধে, এমনি উদ্দেশ্যহীন অন্য মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন সময়ে দূরের একটি ছেলের দিকে তার হঠাৎ চোখ পড়ল, অস্তমান রবির আলো তার ছবির মত মুখখানি রাঙা করে তুলেচে। সেই প্রজ্বলিত রূপের টানে আকৃষ্ট হয়ে, কিশোর অশান্ত, কিছু দূর এগিয়ে যেতেই তার বুক দুরু দুরু করে কাঁপতে লাগল। ও যে তার সেই হারামণি! ছেলেটিও তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করেছিল, অশান্তকে তারই কাছে আসতে দেখে সেও তাকে দেখছিল।

প্রথম কেউ কথা বলতে পারল না কেবল অপলক চোখের এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, চোখ ফিরিয়ে নিতেও পারল না। অশান্তই আগে কথা বল্লে, “তোমাকে আমি এর আগে দেখেচি। কর্নওয়ালিস থিয়েটারে, নয় কি?”

মোহন ঘাড় নেড়ে বল্লে, “হ্যাঁ।”

অশান্ত বলল, “কয়েকটি ছেলের সঙ্গে তুমি বায়স্কোপ দেখতে এসেছিলে। সে দিন আবার কি বৃষ্টি!”

মোহন বল্লে, “তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়েছিলে আমার বেশ মনে পড়চে।”

অশান্ত ভাবছিল আমাকে ও ভোলেনি, আর মোহন ভাবছিল আমাকে ও মনে করে রেখেচে! বিচিত্র ভাবের সঞ্চারে তাদের হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। মোহন তাকে ইঙ্গিত করে বল্লে, “বসো।” অশান্ত তার পাশে বসল।

“আমার নাম অশান্ত। তোমার নাম কি?”

“মোহন।”

“মোহন! খুব মিষ্টি নাম তো! মোহন!”

“অশান্তও বেশ নাম।” দুজনেই হাসল।

“সেদিন বায়স্কোপে কি ছবি দেখাচ্ছিল ভুলে গেচি। কিন্তু তোমাকে আমি ভুলিনি।”

“সেদিন বোধ হয়, জ্যাকি কুগানের ছবি ছিল।”

“জ্যাকি কুগান। তার ছবিও আমি দেখেচি। কিন্তু সে দিন একটা ডিটেকটিভ গল্প ছিল যেন। খুব মারধোর, লাফ ঝাঁপ, খুনোখুনি ব্যাপার!”

“তা হবে! কিন্তু ঐ ছোট্ট ছেলেটি কি আশ্চর্য। আমার ওকে খুব ভালো লাগে।”

“দেখতেও বেশ সুন্দর। কেমন হাসে, কেমন তাকায়! কেবল একটা দোষ কথায় কথায় বড় কাঁদে। তাতে কান্না পায়। ওর বাড়ি কোথায়, বিলেতে, না জার্মানিতে, জানো?”

“মামার কাছে শুনেচি আমেরিকায় কি একটা জায়গায়।”

“সেইখানে আমার যাবার ইচ্ছা আছে, তার সঙ্গে ভাব করতে; বড় হলে যাব।”

“কিন্তু সে ত তখন আর জ্যাকি থাকবে না, বড় হয়ে যাবে।”

অশান্ত মোহনের মুখে চেয়ে বল্লে, “তোমাকে অনেকটা জ্যাকির মত দেখতে। তোমার চুলগুলো, আর মাথার পিছন দিকটা ঠিক জ্যাকির মত। বেশ দিব্যি!”

মোহন বল্লে, “কলকাতায় সেলুনে আমেরিকান ফ্যাসানে এমনি চুল ছেঁটে দেয়।”

“তুমি কলকাতায় কোথায় থাকো? সেই বায়স্কোপ দেখার পর তোমাকে আমি কতদিন খুঁজেছিলুম।”

“কোথায় খুঁজেছিলে?”

“কর্নওয়ালিস থিয়েটারেরই আশেপাশে রাস্তায়।”

“রানী ভবানী স্কুলে খোঁজ করলেই আমাকে পেতে। সেইখানে পড়তে যাই।”

“তা কি আমি জানি। এখানে কবে এসেছ?”

অশান্তর হাতটি মোহনের কোলের উপর ছিল, তাতে টোকা দিতে দিতে, মোহন বল্লে, “আমি আজ এসেছি। নরেন্দ্র বাবুকে চেনো? তিনি আমার মামা। দেখ দেখ, ঐ ছেলেটি কি চমৎকার খেলছে, কেউই ওর কাছ থেকে বল কাড়তে পারছে না।”

“গো-ও-ওল!…কেমন টুক করে গোল দিয়ে এল দেখলে? ও এত জোর ‘স্কোর’ করে যে “গোল্‌কি” ওর বল ধরতেই পারে না, আটকানো দূরে থাক।”

“কে ও? নিশ্চয় খুব বড় প্লেয়ার। স্কুলে পড়ে?”

“তারেশ ওর নাম। আমাদের সঙ্গে বোর্ডিংএ থাকে, ফার্স্ট ক্লাসে পড়ে।”

“তুমি বুঝি বোর্ডিংএ থাকো?”

“হ্যাঁ। এখন স্কুল বোর্ডিং সব বন্ধ, এখন বাসায় থাকি, বোর্ডিংএ না থাকলে পড়াশুনা হয় না।”

“যদি আমি মালদা স্কুলে ভর্তি হই তবে আমিও বোর্ডিংএ থাকবো।”

উৎফুল্ল হয়ে অশান্ত প্রশ্ন করল, “তুমি কি সেকেণ্ড ক্লাসে পড়?” মোহনকে মাথা নাড়তে দেখে, “তাহলে বেশ হয়েছে। দুজন এক সঙ্গে পড়াশুনা করব। কেমন?”

একসঙ্গে থেকে পড়াশুনা করার প্রলোভন মোহনের মনেও জাগছিল, সে উঠে দাঁড়িয়ে বল্লে, “চল, একটু নদীর ধারে বেড়ানো যাক।”

অশান্ত উঠল, বল্ল, “খেলা দেখবে না আর? চল তবে। নদীর ধার দিয়ে আমাদের বাসায় যাবার পথ, কাছেই বাসা, তোমাকে যেতে হবে। বাসায় কেউ নেই, কেবল আমি মেজদা আর বৌদি থাকি। আর উলকা।”

“উলকা কে?”

“উলকা খোকা, খুব ছোট্ট। তিন বছর মাত্র বয়স।”

বেড়াতে বেড়াতে মোহন বল্লে, “পাড়াগাঁ জায়গায় আসতে আমার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এখন আমার বেশ লাগচে। সমস্ত দুপুরটা একলা চুপ করে বসে বসে বাবার ওপর এমন রাগ হচ্ছিল, ভাবছিলুম দু তিন দিন বাদেই চলে যাব।”

“না না, এত শীঘ্রি যেওনা। এখানে দেখবার অনেক জিনিস আছে। শুনেচি গৌড় পাণ্ডুয়ায় আশ্চর্য আশ্চর্য কি আছে। বিলেত থেকে লোক দেখতে আসে।”

“সত্যি? তা, আমি এত শীগ্রি যাচ্ছিনা। তোমাদের বাসা আর কতদূর?”

দুজনে গলা জড়িয়ে ধরে যাচ্চিল, মোহনের গলা থেকে হাত খুলে নিয়ে অশাস্ত বললে, “এই আমাদের বাসা। এসো আমার সঙ্গে।”

মোহনকে তার নিজের পড়বার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তার পরে বিছানার উপর খবরের কাগজ পেতে একটা বড় কলাই করা প্লেটে, কতকগুলো আম ছাড়িয়ে সাজিয়ে রেখে বল্লে, “খাও। ছুরি দিয়ে কেটে চোকলা চাকলা কোরে দেব?”

“না, অমনি কামড়ে কামড়ে খেতেই ভালো লাগে। কিন্তু তুমিও খাও।”

দুজনে খাওয়া শেষ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে অকারণ একটু হাসল। যাদের কোনোদিন মিলবার আশা ছিল না, তাদের এই অভাবিত আশ্চর্য মিলন, হয়ত তাই এই হাসি।

অশান্ত জিজ্ঞেস করলে, “মোহন তুমি গাইতে জানো? জানো? তবে একটা গাও না ভাই। কোন ভয় নাই। সেজদা বেড়াতে গেছেন, বৌদি ভেতরে রান্নাঘরে। গাও তুমি।”

“তুমি শুরু কর আগে। আমি পরে ধরচি।”

অশান্ত রবিবাবুর একটা গান ধরল, মোহনও একটু পরে সুর মিলাল,—সে গান অনন্ত আশার, অসীম আশ্বাসের, মুক্ত যৌবনের—

“কত অজানারে জানাইলে তুমি

কত ঘরে দিলে ঠাঁই।

দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,

পরকে করিলে ভাই!”

গান শেষ হবার অনেকক্ষণ পরেও তার মোহ যেন ছেড়ে গেল না, চারিদিকে জুড়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে মোহন টেবিলের বইটই নাড়াচাড়া করছে দেখে অশান্ত বলে উঠল, “ওটা আমার ‘এসের’ খাতা, দেখো না। আমার হাতের লেখা বড় বিশ্রী।”

“আমারো ভালো নয়। তাছাড়া আমার বানান ভুল বড় বেশি। Whom লিখতে প্রায়ই আমি Whome লিখে ফেলি।”

“কই আগে দেখি তোমার লেখা, তবে খাতা ছাড়ব।” বলে অমূল্য সম্পত্তির মত খাতাখানা প্রাণপণে চেপে রাখল।

“আচ্ছা ফাউন্টেন দাও, লিখচি।”

অশান্ত বুক পকেট থেকে পেনটা খুলে দিল, “ইংরিজি লেখো আগে।”

মোহন অশান্তর একখানা বইয়ের কাগজমোড়া মলাটের ওপর লিখল- You are a very good boy.

“আচ্ছা বাংলা লেখো, দেখি।”

মোহন লিখল—আমি তোমাকে ভালোবাসি।

দুজনে দুজনের দিকে শুধু চেয়ে রইল। অভিভূত অশান্তর শিথিল মুঠো থেকে খাতা কখন খসে গেছে, কিন্তু সেদিকে কারুরই মনোযোগ নেই। লেখা ভালো কি মন্দ সে কথাও কেউ আর তুলল না। কিছুক্ষণ পরে মোহন কথা বল্ল, “সন্ধ্যা হয়েছে। এখন আসি। কাল সকালে আসব আবার।” সে উঠে দাঁড়াল।

অশান্ত বলিল, “আচ্ছা এসো। না, না, কলমটা ফিরিয়ে দিয়ো না, এটা আমি তোমাকে উপহার দিলাম।”

মোহন তার পকেট থেকে একটা মোটা লাল নীল পেনসিল বের করে অশান্তর হাতে দিয়ে বল্ল, “তবে আমার উপহার এই পেনসিলটা তুমি নাও।”

বন্ধুত্বের প্রথম উপহার, প্রথম পরিচয়! সেই ছোট পেনসিলটা হাতের মধ্যে চেপে, অশান্ত, যেন প্রেমের প্রথম স্পর্শ অনুভব করল। মোহনকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে যখন সে ফিরল, তখন এক অপূর্ব অনুভূতির স্পর্শে তার মন সমাচ্ছন্ন।

ভাগলপুর শহর ছাড়িয়ে কয়েক মাইল দূরে একটা পোড়ো বাড়ি। এই অঞ্চলটা আগে কোনোকালে হয়ত সমৃদ্ধ ছিল, এখন তার অবশেষ এই আধভাঙা বাড়িটা সেই পরিচয় দেয়। এই বাড়ির দু’মাইলের মধ্যে জনপ্রাণীর আর দ্বিতীয় কোনো কুটির নেই, চাষীদের গ্রামগুলো সব দূরে দূরে। অযত্ন-বর্ধিত গাছপালা লতাপাতায় অরণ্যাকারের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কেবল এই রহস্যময় বাড়িটা।

এই বাড়িটির ভেতরে একটি কক্ষে বিপ্লবী গুপ্তদলের সভা বসেছিল, তেরোজন যুবক মিলে কি আলোচনা করছে, তার মধ্যে আমাদের সুধীরও আছে। মধ্যিখানে গোটাচারেক বাতি জ্বলচে, তখন রাত তিনটা হবে।

মাঝে মাঝে এক একটি ছেলে উঠে গিয়ে চারিদিক লক্ষ্য করে আসছিল, এবার ফিরে এসে একজন বল্লে, “বাইরের অবস্থা বড় ভালো বোধ হচ্চে না। বাড়ির চারধারে যেন কাদের আবছায়া দেখে এলুম। খুটখাট শব্দ হচ্চে।”

“সে কি! ভূত দেখলে নাকি?”

“আজ অমাবস্যা বটে। কিন্তু আমাদের ঘাঁটাতে ভূতও ভয় পায়। আচ্ছা আমি দেখে আসচি কি হয়েছে।”

দুর্জয় ফিরে এসে বল্লে, “বিপদ! পুলিশ বাড়ির চারিদিকে ঘেরাও করে আছে, বোধহয় সকলের অপেক্ষায়।”

“পুলিশ! সর্বনাশ! কজন মনে হল?”

“একপাল।”

“আমরা তো মাত্র তেরোজন। কি করা যাবে?”

একজন বল্লে, “সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়া আর কি করা যেতে পারে? আত্মসমর্পণ তো কিছুতেই নয়।”

“নিশ্চয়! মুক্তি চাই, জীবনে মুক্তি অথবা মরণে মুক্তি। পিঞ্জরের মধ্যে মরে বেঁচে থাকা আমার তো ভাই পোষাবে না!”

“তবে প্রস্তুত হও।”

টেবিলের ওপর তেরোটি রিভলভার সাজানো ছিল, প্রত্যেকে নিজেরটি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে গুলি পুরে ঠিক রাখতে লাগল।

দুর্জয় বল্লে, “আজ যদি এই তেরোজন আমরা মৃত্যুবরণ করি তাহলে যে বিপ্লবীদের আমরা গড়ে তুলেচি এবং যাদের সঙ্গে কেবল আমাদেরই পরিচয় আছে তারা অকেজো হয়ে পড়বে ভেবে দেখেচো কি? এবং সেই সঙ্গে আমাদের ভাবী বিপ্লবের কল্পনাও আকাশে মিলিয়ে যাবে।”

“তবে কি করা যায় বল?”

দুর্জয় বল্লে, “মৃত্যুবরণও নয়, আত্মসমর্পণও নয়। কয়েকজন মাত্র প্রাণ দিক, বাকি সকলে সেই সুযোগে সরে পড়ুক। তারপর মরতে ত শীগ্রি হবেই, দুদিন আগে আর পরে, এখন সবাই মিলে ব্যস্ত হলে কাজ করবে কে?”

সুধীর জিজ্ঞেস করলে, “তুমি কী ভেবেছ দুর্জয়দা, খুলে বল দিকি।”

দুর্জয় ধীরে ধীরে গম্ভীর সুরে বলল, “আমি একা বাড়ির সদরপথের দিকে বন্দুক হাতে দাঁড়াচ্চি। তোমরা সকলে সেই দিকে পায়ের শব্দ করে দৌড়ে যাবে, তাহলে পুলিশরা সেই দিকে ঝুঁকবে, আমি ঘন ঘন বন্দুক আওয়াজ করে তাদের কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত করে দেব, সেই অবসরে কোণের গুপ্তপথ দিয়ে, নিঃশব্দে তোমরা চটপট সরে পড়বে।”

সুধীর বল্লে, “তা ত হল, কিন্তু তুমি—”

দুর্জয় বল্লে, “একজনকে মরতে হবেই। আমার সব কাজের ভার তোমাদের ওপর দিয়ে, তোমাদের কাছে আমি আজ সৈনিকের বিদায় চাই, প্রথম মৃত্যুর গৌরব আমাকে দাও ভাই।”

সুধীর গাঢ়স্বরে বল্ল, “তা হবে না দুর্জয়দা, আমাকেও তোমার সঙ্গে মরতে দাও। তুমি আমাকে ভায়ের মত ভালোবাসো আমি জানি, দাদার পাশে দাঁড়িয়ে বুদ্ধ করবার ভায়ের চিরদিনের অধিকার!”

দুর্জয় সস্নেহে তাকে কাছে টেনে নিয়ে পিঠে চাপড় দিয়ে বল্লে, “তবে, আমি আর সুধীর চল্লুম সদরপথে, তোমরা একটু পরেই, যেমন বল্লুম, করবে।”

একসঙ্গে মরার আনন্দ সুধীরের মুখে চোখে ফুটে উঠল। এই যে তার সেই দুর্জয়দা, যে তাকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত করেচে, তার চোখ খুলে দিয়েছে, তার অন্তরে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছে! আজ তারই সঙ্গে, তারই পাশে দাঁড়িয়ে, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পাশাপাশি মৃত্যুশয্যায় চিরনিদ্রার আয়োজন, তার মোহ, তার লোভ, তার আকর্ষণ কি কম!

সকলে তাদের দুজনকে শেষ আলিঙ্গন দিয়ে বিদায় দিল! একটি মাত্র রাইফেল ছিল—টোটা পুরে নিয়ে দুর্জয় সদর পথে গিয়ে দাঁড়াল; সুধীর তার অনুজ্ঞামত, পাশে একটু আড়ালমত জায়গায় রিভলভার হাতে প্রস্তুত হয়ে রইল—সীমানার মধ্যে এলেই সে গুলি ছুঁড়বে।

কয়েক মুহূর্ত হয়েছে, অত্যন্ত হৈচৈ করে বিপ্লবীরা যেন সদর পথ দিয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যাচ্চে–বিপুল পুলিশবাহিনী, যারা চারিদিক ঘেরাও করে জমজমাট হয়ে ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জনের সঙ্গে নাসিকা গর্জনের সুসঙ্গত মিল হতে পারে কি না হয়ত এই পরীক্ষায় তন্ময় ছিল,—এই আকস্মিক ধুমধামে সচকিত হয়ে তারা এক মুহূর্তে ক্ষিপ্র হয়ে উঠল; ফলে তাদের জোট ভেঙে গেল, তারা সকলেই সদর পথের দিকে ঝুঁকে পড়ল। সেই মুহূর্তেই সদরপথে বিরাট নির্ঘোষে দুর্জয়ের রাইফেল ঘন ঘন গর্জন করে উঠল,—অন্ধকার লক্ষ্য করে অদৃশ্য হাতের গুলি চলতে লাগলো।

এগারজন বিপ্লবী নির্দিষ্ট পথে পালিয়ে গেল, জমাদারের আদেশে পুলিশরা আবার যখন ঘেরাও হয়ে দাঁড়ালো, তখন খাঁচা প্রায় খালি হয়ে গেছে। পুলিশের দুডজন রাইফেল শব্দ লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল, একটি গুলি এসে দুর্জয়ের হাতে বিদ্ধ হল। একটি মাত্র বাতির ক্ষীণ আলোকে আহত বাহুখানি সুধীরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দুর্জয় বল্লে “ভাই, এটা চট করে বেঁধে দাও ত!” সুধীর কাপড় ছিঁড়ে ক্ষতস্থান ভালো করে বেঁধে দিল।

অল্পক্ষণেই পুলিশের সার্চলাইট জ্বলে উঠল। দুর্জয় বল্লে, “এবার ধরা পড়ে গেচি; ওরা দেখতে পাচ্ছে, আর নিস্তার নেই। আমার অসমাপ্ত ব্রত, তুমি ছাড়া কেউ উদ্যাপন করতে পারবে না, তোমার দাদার শেষ অনুরোধ রাখো, এখনও পালাও।”

তার চোখের ভাবে, তার কণ্ঠস্বরে সুধীর বিচলিত হল। সে দুর্জয়ের আহত হাতখানি বুকের মধ্যে চেপে ধরে বল্লে, “তুমি বলচ, আচ্ছা, আমি পালাচ্ছি। তোমারই প্রাণ, তোমার কাজেই দিয়েছি, তোমার কথায় আরো কিছুদিন ধরে থাকব। কিন্তু—”

“আর ‘কিন্তু’ নেই, ‘কিন্তু’ পরজন্মে যখন আবার আমরা মিলব, তখন সেইখান থেকে স্বাধীন ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে আমাদের ‘কিন্তু’ হবে। এই জন্মে আদর করতে পারিনি, ভালোবাসবার অবসর পাইনি, নিশ্চিন্ত হয়ে দু দণ্ডের জন্য মিলতে পারিনি—সব ‘কিন্তু’ সেই দিন, সেইখানে। কেমন?”

সুধীর হাসল। বল্ল, “কিন্তু আমাকে আরো কিছুক্ষণ তোমার কাছে থাকতে দাও।”

সে কথায় উত্তর না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলে, দুর্জয় বন্দুকের শেষ গুলি লক্ষ্য করল, তা এক জনের ললাটে গিয়ে মৃত্যুর মোহর দেগে দিল। তারপরে নীরব। দুর্জয় বল্লে, “এইবার ওদের পালা। আমি মাথা উঁচু করেই আছি।” পুলিশের কর্তা বুঝতে পেরেছিলেন গুলি ফুরিয়েচে, তিনি বল্লেন, “গুলি ছুঁড়ো না, তবে প্রস্তুত থাকো, শত্রুকে জীবন্ত ধরা চাই।”

তারা দুর্জয়ের দিকে ধীরে ধীরে এগুতে লাগল। দুর্জয় একটু হেসে বল্লে, “ওরা বন্দী করতে চায়। সুধীর, তোর পিস্তলে গুলি আছে? দেখি, যা, এইবার তুই পালা।” পিস্তল নিজের ললাটের উপর লক্ষ্য করল, তার অগ্নিমুখ অধর সেখানে মৃত্যু-চুম্বন এঁকে দিল। সুধীর নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল।

দুর্জয় শুয়ে শেষ কথা বল্লে, “ওরা এসে পড়েছে। পালা। পালা।” সত্যিই তারা এসে পড়েছিল, সুধীর গুপ্তপথে পালালো। পুলিশের কর্তা প্রবেশ করলেন, দুর্জয়ের দুর্জয় প্রাণ তখনো অবশিষ্ট ছিল। কথা দিয়ে নয় জীবনের শেষ হাসি দিয়ে সে তাঁর অভ্যর্থনা করল। পুলিশের বড় কর্তা টুপি খুলে এই বীরের প্রতি তাঁর শেষ সম্মান দেখালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *