ছেলে বয়সে – ২০

২০

শহরে এক যাত্রার দল এসেচে, ছেলেবুড়ো সবাই তাই নিয়ে মেতে উঠেচে। পরদিন রবিবার,—তাই ছেলেদের বহু আবেদন-নিবেদনে অবিনাশবাবু তাদের যাত্রা দেখবার ছুটি দিয়েছিলেন। অশান্ত ও মোহন দুজনে মাথায় মাথায় ঠেকিয়ে পাশাপাশি বসে যাত্রা শুনছিল।

যাত্রার দলে একটি কিশোরী নাচওয়ালি বিবিধ ভঙ্গীতে নাচছিল, অশান্ত ও মোহন তারই দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। সব ছেলেরই দৃষ্টি ও মন সেই বালিকা হরণ করেছিল।

এতো সহজে মনে বিপ্লব ঘটাতে পারে দুটো জিনিস—বাঁশী আর নাচ। বাঁশীতে সুরের খেলা, নাচে রূপের লীলা—এই রূপ ও সুরের কাছে মানুষের আত্মা বাঁধা। সব বয়সেই বাঁশীর ও নাচের প্রভাব কেউ এড়াতে পারে না, তরুণ বয়সে ত এর মোহ অসীম। যে বাঁশী বাজায়, যে নাচে তার পায়ে প্রাণটা দিয়ে ফেলতে পারলে যেন বাঁচা যায়। মেয়েটির প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে ছেলেদের বুক দুলে উঠছিল।

মেয়েটি সকলের কাছে ঘুরে ঘুরেই নাচছিল, তবে সব ছেলেদের মাঝে সে মোহনের দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়েছিল, মোহনের তা অগোচর ছিল না। মোহনের দৃষ্টির সঙ্গে তার মুগ্ধ দৃষ্টি বাঁধা—এযেন অনন্ত কালের রহস্য। যেন দুটি আকাশের তারা দুজনের দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকত বা এখন তারা দুটি অপলক চোখের তারায় ফুটে উঠেছে। তারা প্রশ্ন করচে অথচ উত্তরও যেন পেয়ে গেচে।

নাচতে নাচতে সে যখন মোহনের একান্ত কাছে আসছিল তখন মোহনের গালদুটি রাঙা হয়ে উঠছিল, চেষ্টা করে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে কেমন লজ্জায় সে চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল, মেয়েটি অমনি মুচকি হেসে সরে যাচ্ছিল।

অবশেষে গভীর রাতে যাত্রা ভাঙলে যখন অশান্তকে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল, তখন কোথায় যেন একটু ব্যথার টান লাগল, মনে হল কাকে যেন ফেলে রেখে যাচ্চে!

বেরুবার পথে ভিড়ের ঠেলায় অশান্তর সঙ্গে মোহনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, গভীর রাতের ক্ষীণ চাঁদের আলোয় বাইরে বেরুতেই হঠাৎ তার মনে হল এ যেন অপরিচিত জগৎ! এই যে এত লোক কলরব করে চলেচে এরা কেউই তার চেনা নয়, সে যেন পথহারা কোনো পথিক। পাশেই যাত্রার যাত্রীদের ছোট ছোট তাঁবু খাটানো, সেদিকে চাইতেই সেই নাচওয়ালি মেয়েটি হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকলে।

মোহন একবার তার দিকে একবার জনতার দিকে তাকাল, তার পরে কিসের আকর্ষণে পায়ে পায়ে এগিয়ে তার কাছে গেল। যেতেই সে খপ্ করে তার হাত ধরে ‘এসো’ বলে তাঁবুর ভেতরে নিয়ে গেল। চৌকির ওপর বসিয়ে আলোটা উসকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার সঙ্গে দেখা না করেই যাচ্ছিলে? আমরা যে কালই যাবো।”

তার এই অভাবিত ব্যবহারে মোহন বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে গেল।

“কালই যাবে”—সে কেবল তার কথারই পুনরুক্তি করল।

“হ্যাঁ। আমার নাম অমিয়া। অমি বলে সবাই ডাকে। তোমার নামটি কি ভাই?”

“মোহন।”

কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে মেয়েটি বল্লে, “রাত অনেক হয়েচে। তোমার খিদে পেয়েচে নিশ্চয়। রাজবাড়ি থেকে খাবার এসেচে, তুমি একটুখানি বোসো,—আমি নিয়ে আসি।”

খাবার-ভরা রেকাবি হাতে সে ফিরে এল, রেকাবিটা বিছানার ওপরে তার কাছে রেখে বল্লে, “খাও।”

খেতে তার বাধছিল না, কোনদিনই বাধে না, তবে খেতে বাধা ছিল। একটু ইতস্তত করে সংক্ষেপে বলল, “আমার খিদে নেই।”

“খিদে নেই কি রকম? বোসো, আমি খাইয়ে দিচ্চি।”

খাবার হাতে করে মুখের কাছে ধরে বলল, “খাও। কোন দোষ নেই।”

স্নেহের অনুরোধে মোহনকে খেতে হল,—সে বলল, “আমি নিজেই খাচ্চি।”

মেয়েটি মোহনের পাশেই বসে পড়ল, মোহন একটু সঙ্কুচিত হয়ে বসল।

মোহনের বাঁ হাতের আঙুলগুলো নাড়তে নাড়তে হঠাৎ সে পরিহাস করে বল্লে, “আচ্ছা তুমি আমার দিকে অমন করে তাকাচ্ছিলে কেন? আমাকে তোমার ভালো লাগছিল?”

মোহনের ঘাড় আপনিই হেঁট হয়ে এল, মেয়েটি চিবুকে হাত দিয়ে মুখটি তুলে ধরে বল্লে, “আমাকে ভালবেসেচ বুঝি?”

উপন্যাসে আর সহপাঠীদের কৃপায় ভালবাসার সঙ্গে সে অপরিচিত ছিল না, তবু এই নীরব নিশীথে একজন সমবয়সী সুন্দর মেয়ের মুখে এই সুলভ কথা ও দুর্লভ জিনিসটির প্রশ্ন শুনে অজ্ঞাত আশঙ্কায় তার সারা দেহ শিউরে উঠল। সে চুপ করে রইল।

“ভালবাসনা তা হলে?”

মোহন নিরুত্তর রইল। এই ধরনের কথাবার্তায় সে বড় অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। দৈবাৎ এসে পড়ে যে তাকে এইভাবে বিপদগ্রস্ত হতে হবে তা সে ভাবেনি। কথাটার ধরন বদলাবার জন্য সে বলল, “তুমি খাচ্চ না যে। তুমিও খাও।”

“খাচ্চি। একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবে?”

“নিশ্চয় করব।”

“তবে শুনে কাজ নেই।… আমার ব্যবহার দেখে তোমার বোধ হয় আশ্চর্য মনে হচ্ছে? বয়সে তোমার চেয়ে আমি বেশি বড় নই, কিন্তু এইটুকু জীবনেই অনেক লোকের সঙ্গে মিশে, অনেক অবস্থায় পড়ে, অনেক ভেবে আমার অনেক অভিজ্ঞতা জন্মেচে। কিন্তু তোমার ঐ সুন্দর মুখখানি আজ এক নিমেষে আমার সব ধারণা ওলোটপালোট করে দিয়েচে। এতদিন আমি কী জীবন যাপন করেচি! প্রাণের মধ্যে টান বলে যে একটা কিছু আছে, তা তুমিই আজ আমাকে জানিয়েচ!”

“আর খেতে পারচি না। এবার আমি উঠি?”

“আর খাবে না? আর একটুখানি বোসো, আমি চট করে আসচি।”

অমিয়া খাবারের রেকাবিটা তুলে কি ভেবে পাশের টিপয়ে রেখে দিল, তারপরে হঠাৎ দুহাতে মোহনের মুখখানি তুলে ধরে টপ করে একটু চুমু খেয়ে রেকাবি হাতে দ্রুতপায়ে চলে গেল।

মেয়ের চুমু! মোহনের সমস্ত শরীর বার বার শিউরে উঠল, কি এক বিদ্যুন্ময় চেতনার আড়ালে তার সমস্ত জগৎ এক মুহূর্তে হারিয়ে গেল।

ক্ষণেক পরে যখন তার মধ্যে সে ফিরে এল তখন, অনিচ্ছাতেও মেয়ের চুমু নিয়ে কত বড় অপরাধের বোঝা তার ঘাড়ে চেপে বসেচে, এই কথা ভেবে তার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। মেয়েটি ফিরে এসে তাকে নিস্তব্ধ দেখে তার মনের অবস্থা বোধ করি বুঝল, একটিও কথা না বলে সহজ স্নেহে তার মাথায় হাত বুলোতে লাগল। একটু পরে বলল, “তুমি লজ্জা পাচ্চ কেন? আমি ত মেয়ে নই—”

এই বলে সে গায়ের ওড়নাটা মাটিতে ফেলে দিতেই, সুন্দর কিশোর-তনু প্রকাশ হয়ে পড়ল। মোহন তার দিকে চেয়ে বিমূঢ় হয়ে শুধু বল্লে, “তুমি?”

“হ্যাঁ। আমি ত মেয়ে নই, যাত্রাদলের ছেলে অমিয়। তুমি আমায় ধরতে পারোনি। কি মজা!”

মোহন তার হাসিতে যোগ না দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “তুমি তাহলে এতক্ষণ আমার সঙ্গে কেবল মজা করছিলে?”

অমিয় তার মুখখানি ধরে বল্লে, “না ভাই লক্ষ্মীটি! রাগ কোরো না। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেচি—”

তার হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে মোহন বল্লে, “এখন তবে যাই। বেশি দেরি করলে বোর্ডিংএর দরজা খোলানো দায় হবে।”

অমিয় ম্লানমুখে বলল, “এত রাত্রে বাড়ি যাবে? একলা?”

“হুঁ।”

“ভয় করবে না ত?”

তৎক্ষণাৎ মোহনের মনে হল যে নদীর ধারের সেই পথ দিয়ে যেতে শ্যাওড়া গাছের ডালে লম্বমান মস্তক ও দোদুল্যমান দীর্ঘ পদযুগলের বিশ্বাসযোগ্য কত জনশ্রুতি আছে। তবু সাহস সঞ্চয় করে বলল, “ভূত আমি মানিনে।”

“ভূতের কথা বলচিনে। সাপখোপ।”

“চাঁদ এখনো ডোবেনি।”

“আচ্ছা এসো তাহলে। বোর্ডিংএর ছেলে না হয়ে যদি বাড়ির ছেলে হতে তাহলে আজ তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতুম না, আমার কাছে রাখতুম!”

মোহন উঠে দাঁড়াল। অমিয় বল্লে, “একটু দাঁড়াও।” তার হাতের চুণী বসানো সোনার আংটিটা খুলে মোহনের আঙুলে পরিয়ে দিল, এই দামী জিনিসটা কোনো জমিদারের ছেলের মনোরঞ্জন করে সে পেয়েছিল। বল্ল, “এটা তুচ্ছ জিনিস। এমনি তুচ্ছ হলেও আমাকে তোমার একটি রাতের বন্ধু বলে মনে রাখবে ত?”

“রাখব। কিন্তু এটা নাও।”

“এটা রাখবে না?” এমন সুরে কথাগুলো বল্লে সে, যে মোহনের না-বলবার শক্তি রইল না। সে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল, তার যাওয়ার কথা ভুলে গেল। যে ছেলেটি তাকে একটি রাতের জন্যই ভালোবেসে এমন দামী আংটিটা উপহার দিল, তারই মনের আশ্চর্য রহস্যে যেন সে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইল। বিদায় নেবার কথা তার মনে এল না।

অমিয় দুহাতে মোহনের গলা জড়িয়ে ধরল, মোহন বাধা দিল না, তাদের গালে গালে ঠেকল—তারই নিবিড় স্পর্শ এবার তার মনে মোহ সঞ্চার করল। একটু পরে তাকে ছেড়ে দিয়ে অমিয় বল্ল, “তোমার রাত হয়ে যাচ্চে, আর দেরি কোরো না। কাল সকালে তুমি যদি না আসো ত আমি তোমার বোর্ডিংএ যাবো। মনে থাকে যেন।”

ঘাড় নেড়ে মোহন বেরিয়ে গেল। বিছানার ওপর একলাটি বসে অমিয় কত কি ভাবতে লাগল, অনেকক্ষণ বসে থেকে বাতিটা নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ল বটে, কিন্তু আরো বহুক্ষণ তার চোখে ঘুম এল না।

মোহন পথটা খাটো করবার জন্য একটা নিষিদ্ধ অঞ্চলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা বাড়ির দরজা খুলে তারেশ বেরুল, তখন তার বেশ একটু মদের নেশা ধরেচে।

মোহন কাছে আসতেই তাকে লক্ষ্য করে জড়িতকণ্ঠে তারেশ বলল, “এতরাত্রে কে বাবা দুষমনের মত চলেচ! কোন্ গাছ থেকে নামলে যাদু?”

মোহন তার দিকে তাকিয়েই অক্ষুট চিৎকার করে উঠল। তারেশ তাকে দেখে বল্লে, “কে বাবা মোহনচাঁদ যে? কোথায় যাচ্ছ বাবা? গোলাপীর গোলাপ-কুঞ্জে নাকি? মাইরি!”

মোহন তাড়াতাড়ি সরে পড়ছিল, তারেশ গিয়ে তার হাত চেপে বললে, “ভয় নেই বাবা, আমি বাঘ ভালুক নই, খেয়ে ফেলব না। কিন্তু বাবা, এই বয়সে ডবল প্রমোশন নিয়ে আমাকে যে তাক লাগিয়ে দিয়েচ চাঁদ।”

মোহন হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে বল্লে, “ছাড়ুন, আমি যাই।”

“আমার স্পর্শে তোমার সতীত্ব নাশ হবে না যাদু। আমি গোলাপী নই। পথে পেয়েছি, সহজে ছাড়চি না, একটা চুমো খেতে দাও বাবা—”

বলে সে মোহনকে চুম্বন করতে উদ্যত হল, মদের গন্ধে মোহনের মন দারুণ বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। সে আত্মত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে লাগল।

নির্জন নিশীথ, কেউ কোথাও নেই, চাঁদও ডুবে যাচ্ছে। কেবল নিরাপদ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে একটা পথের কুকুর মোহনের এই দুর্দশায় দূর থেকে আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছিল, এবং মাঝে মাঝে বিরক্তিপূর্ণ স্বরে প্রতিবাদ করে তারেশের এই অভদ্র আচরণের সমালোচনা করছিল। তারেশ বড় সেদিকে কান দিচ্ছিল না।

এমন সময়ে অত রাত্রে সাইকেল চালিয়ে দেবেন কোথা থেকে আসছিল, তাদের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামল। বিস্মিত কণ্ঠে বল্লে, “এ কি মোহন যে। এত রাত্রে এখানে?”

“এই মাতালের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন।”

দু’তিনটা মোলায়েম গলাধাক্কা দিতেই তারেশ পথের পর সটাং শুয়ে পড়ল, তার আর উঠবার শক্তি হল না, শুয়ে শুয়েই সে বলতে লাগল, “তোমরা খাও বাবা, আমি দেখে চোখ জুড়াই, না হয় আমি চোখ বুজছি। বাবা জগৎসিংহ, তোমার বরাৎ ভালো, আয়েষা তোমারই, তুমিই আয়েষ কর।”

দেবেন ঘৃণাভরে তার দিকে চেয়ে মোহনকে বল্ল, “এখান থেকে চল। তোমাকে বোর্ডিং এ রেখে আসি, সাইকেলের পিছনে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে?”

“খুব পারব।”

পথে যেতে যেতে দেবেন জিজ্ঞেস করল, “এত রাত্রে কোত্থেকে আসছিলে?”

“যাত্রা দেখে ফিরতে পথে এই।—”

“ওঃ, আজও বুঝি যাত্রা ছিল? এত ব্যস্ত থাকি কাজে যে এ’কদিনের একদিনও দেখা ঘটে উঠল না। এই ত এখনি দশ মাইল দূর থেকে আসচি। কেমন যাত্রা হল?”

“বেশ।”

“ওই মাতালটাকে তুমি জানো? আমার চেনা চেনা মনে হল যেন?”

“আমি জানিনে।”

“আর কখনো একলা যাত্রা দেখতে যেয়ো না।” এই বলে তাকে বোর্ডিংএর সামনে নামিয়ে দিয়ে দেবেন চলে গেল।

২১

বোর্ডিংএর দরজায় একদিন সকালে কুড়ি বাইশ জন চাষী এসে হাজির, তারা সব বিভিন্ন গাঁয়ের মোড়ল, বহুদূর থেকে এসেছে! সুপারিন্টেণ্ডেন্ট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কাকে চাও?” উত্তর হল, “সতীশবাবুকে।”

সতীশবাবু কে? সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বড় সমস্যায় পড়ে গেলেন, এ নামে ত এমন কেউ এখানে নেই যাকে এরা চাইতে পারে।

কৌতূহলী হয়ে মাস্টাররা সব এলেন, হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি চাও?”

ঐ একই উত্তর! সতীশবাবুকেই তারা চায়!

হেডমাস্টার পুনরায় বলিলেন, তিনি কি করেন? এখানে ঐ নামে কোনো ভদ্রলোক নেই!

তারা বলল, “নিশ্চয় আছেন। তিনি নিজেই আমাদের এই ঠিকানা দিয়েছেন। আমাদের বিপদে আপদে বুদ্ধি দিতে তিনিই একমাত্র ভরসা। আমাদের ছেলের বয়সী হলেও তিনিই আমাদের বন্ধু! জমিদারের অত্যাচারে আমরা মারা যাচ্ছি তাই তাঁকে আমাদের বাইশীতে নিয়ে যেতে এসেছি!

বাইশীটা কি?

বাইশ গ্রামের চাষী প্রজা মিলে সতীশবাবুর হুকুম শুনতে এক ঠাঁই জড়ো হয়েছে।

বটে? কিন্তু কে এই অদ্ভুত সতীশবাবু? তাঁরা সকলে মিলে গবেষণা করচেন, এমন সময়ে সতীশ এক কোণ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে দেখে চাষীরা সকলে কলরব করে উঠতে সে থমকে দাঁড়াল।

এই যে আমাদের বাবু! এই যে আমাদের সতীশবাবু!—চাষীরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সমস্বরে তাদের অভিযোগের বর্ণনা শুরু করল,—মাস্টারদের সামনে এই ভাবে ধরা পড়ে সতীশ লজ্জিত হয়েছিল, সে তাদের নিরস্ত করবার জন্য বললে, “চলো, এখুনি আমি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি, সব সেখানেই শুনব।”

সতীশ তাদের সঙ্গে চলে গেল, মাস্টার ও ছাত্ররা কিছুক্ষণের জন্য বিস্ময়ে এমন বিমূঢ় হয়ে রইলেন যেন তাঁরা এইমাত্র চোখের সামনে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য প্রত্যক্ষ করচেন!

সতীশের অন্তরে চাষীদের জন্য সত্যিকার দরদ ও ভালোবাসা ছিল, তারা যাতে তাদের দাবি-দাওয়া বুঝে মানুষের মত উঁচু মাথায় বেপরোয়া চলাফেরা করতে পারে তাই ছিল তার কামনা ও সাধনা। চাষীরাও তাদের এই তরুণ বন্ধুটিকে চিনেছিল, তাই সব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নিঃশেষে তার ওপরে ন্যস্ত করতে তাদের বাধেনি। জাতের, শ্রেণীর ও বয়সের পার্থক্য—–ভালোবেসে যারা মিলতে চায় তাদের মধ্যে কোনদিনই বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। মনে ও মাথায় বড় বলে চাষীরা সবাই সতীশকেই তাদের একচ্ছত্র নেতা ও চালক বলে মেনে নিয়েছিল। সতীশও তাদের সঙ্গে মিশত ঠিক বন্ধুর মত, আপন জনের মত, কোনোদিনই নিজের চারিধারে ভেদের গণ্ডী রচনা করেনি—তাই মিলন-মন্ত্র তার মধ্যে সহজেই মূর্ত হয়েছিল।

সতীশের এই নেতৃত্ব লাভের মূলে একটা ছোট্ট ঘটনা আছে। নৈশ-বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টায় এক রবিবারে এক গাঁয়ে গিয়ে শুনল, সেখানে বাইশী বসেছে। সেও সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে বসল।

নিজের কাজের জন্য নিজের জমিতে নিজের রোপা গাছ কাটবার অধিকার প্রজার নেই, নিজের গাছ কাটতে হলে জমিদার সরকারে আবেদন জানাতে হবে, সেজন্য যথেষ্ট আক্কেলসেলামী দিতে হবে, তবে যদি হুজুরের মর্জি হয়।

দুটি প্রজার এই অপূর্ব ন্যায়ের তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম ছিল না, তারা দরকারে পড়ে নিজেদের দুটো গাছ কেটে ফেলে,—এজন্য জমিদার-কাছারিতে তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জরিমানা করা হয়। এই জবরদস্তি জরিমানা দিতে রাজি না হওয়ার জন্য সেখানে তাদের ওপর অত্যাচার ও লাঞ্ছনার অবধি থাকে না। জমিদারের এমনই ভীষণ আক্রোশ ও দুর্ধর্ষ প্রতাপ যে কেবল সেইখানেই ক্ষান্ত না হয়ে হাতি দিয়ে চষিয়ে এই হতভাগা প্রজাদুটির ঘরবাড়ি ভিটেমাটি নিশ্চিহ্ন করে মুছে দিয়েছেন। এই অত্যাচারের প্রতিকারে কি করা যায় তাই নিয়ে আলোচনা করতেই সেদিনের বাইশী বসেছিল, কিন্তু তারা কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিল না, কেবল চেঁচামেচি করছিল। তখন নবাগত সতীশ উঠে তাদের ভরসা দিলে,—তাদের ঐক্যের মধ্যেই অদ্ভূত শক্তি লুকিয়ে আছে—এই মন্ত্র তাদের প্রাণের মধ্যে সঞ্চার করে তাদের যেন নতুন জীবনের দীক্ষা দিলে!

তার পরদিনই সতীশের বুদ্ধিমত দুশো ঘর প্রজা মিলে নিজেদের দুশো গাছ কেটে ফেলল—দুজনের উদাহরণের জ্বলন্ত শিক্ষা যে দুশো রাম উল্টা বুঝে নিল এই দেখে জমিদার সরকার দস্তুরমত ভড়কে গেলেন। সহসা কারু ওপর অত্যাচার করতে তাঁদের সাহস হল না, হাতের নিসপিসানি হাতেই চেপে রাখলেন, আদালতে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ রুজু করলেন, প্রজারা চাঁদা তুলে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা লড়তে লাগল। অবশেষে আদালতে প্রজাদেরই জয় হল, তাদের দাবী সাব্যস্ত হল—সেইদিন থেকে প্রজারা সতীশকে দেবদূতের মত মানতে লাগল।

এবার তাদের বিপদ আরো গুরুতর—এবার তাদের জীবন মরণের সমস্যা! একটা প্রকাণ্ড বিল জমিদার বাঁধ দিয়ে বেঁধেছেন, জলকর থেকে বিপুল লাভের প্রত্যাশায়। জেলেরা ঐ বিলে মাছের চাষ করবে তা থেকে জমিদার সরকারে বছরে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকা আয় হবে।

কিন্তু এই বিলের পাশে অসংখ্য প্রজার জমি,—বানের জল যদি বেরিয়ে যাবার পথ না পায় তাহলে তাদের সম্বৎসরের ফসল মাঠে মারা যাবে। খণ্ড দুর্ভিক্ষে, মহাজনের পীড়নে, আর জমিদারের অত্যাচারে বাইশ গ্রামের দশ হাজার প্রজা উচ্ছন্ন উজার হয়ে যাবে। তাদের বাঁচবার স্বত্ব, তাদের হাড়মাসকে একত্র রাখবার অধিকার আছে কিনা—উদ্ধত জমিদার এই প্রশ্নই যেন তাদের মনুষ্যত্বের কাছে দাবি করেছে; তারই উত্তর দেবার জন্য এই দুর্যোগ-দুর্দিনে বাইশ গ্রামের প্রজা একত্র।

সেই বিলের পাশেই বাইশী বসেছিল। পৌষের শেষে এবার যে বিপুল বর্ষণ হয়ে গেছে তারই জল ঐ বিলে থৈ থৈ করছিল। সতীশ সেই বিরাট সভায় তরুণ জয়ন্তের মত দাঁড়িয়ে ভাবগম্ভীর কণ্ঠে বলছিল—“ভাই সব, ওই যে জমিদারের উচ্চ প্রাসাদ ও আমাদেরই বুকের রক্তে লাল! আর এই যে সামনে বিপুল বিল এ আমাদেরই চোখের জল! ঐ রাজপ্রাসাদের রক্ত যুগিয়েছে আমাদের বাপদাদারা, আমরাও যোগাচ্চি! আর এই বিলভরা চোখের জল যোগাব আমরা, আর যোগাতে থাকবে আমাদের ছেলে, ছেলের ছেলেরা! আমাদের মধ্যে যদি প্রাণের মিল থাকে, যদি হাতে জোর, মনে বল থাকে, যদি ঐক্য থাকে, তবে এসো আজই আমরা এই অশ্রুজলের শেষ করে দিই! একটা করে কোদাল আর একটা করে ঝুড়ি! এই চাই! এক্ষুনি আমরা সবাই মিলে বাঁধ কেটে জলের পথ করে দেব!”

সবাই একসঙ্গে মহাকলরবে জয়ধ্বনি করে উঠল,—“এই ত পথ, এত সহজ! এতক্ষণ কারু মনে পড়েনি! সতীশবাবু ঠিকই বলেচে, বাঁচবার দাবি তাদের সবারই আছে, সে অধিকার নিজের বাহুর জোরেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে—এর জন্য ভিক্ষা কার কাছে, ক্রন্দন কিসের! ভগবানের আইনের বড় দুনিয়ায় আর কী আছে!

সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি বাড়ি থেকে অনেক কোদাল আর ঝুড়ি জোগাড় হয়ে গেল,—এতক্ষণ যে দশ হাজার লোক আসন্ন বিপদের ভয়ে মনমরা হয়ে ছিল, এখন যেন প্রাণের স্পর্শে এক বিরাট দৈত্যের মত বিপুল উৎসাহে জেগে উঠল! সতীশ নিজেও তাদের সঙ্গে কোদাল ধরল,—কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঁধ কেটে পথ করা হল, বার্ষিক ত্রিশ হাজার টাকা সেই পথে জলের মত হু হু করে খরচ হয়ে চলল।

ভগ্নদূতে জমিদারের কাছে খবর নিয়ে গেল—কি করবেন কিছুই তাঁরা স্থির করে উঠতে পারলেন না। এতগুলি বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে লাগা জারের বিরাট কসাকবাহিনীর পক্ষেও হয়ত সম্ভব ছিল না—কেননা সত্যের দাবি ছিল ঐ দশ হাজার প্রজার দিকেই। কাজেই তাঁদের সব আক্রোশ গিয়ে পড়ল একমাত্র সতীশের ওপর—তারই কুমন্ত্রে ত এতটা ঘটেছে। তাঁরা ঘোষণা করলেন, যে সতীশের মাথা এনে দিতে পারবে তার পুরস্কার হাজার টাকা! আর যে প্রজা তাকে আশ্রয় দেবে তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে!

এই ঘোষণা যখন সতীশ ও তার চাষী বন্ধুদের কানে পৌঁছল তখন রাত দশটা বেজে গেছে—তারা সকলেই চিন্তিত হয়ে উঠল। কেননা দশ হাজার প্রজার প্রতি যে অত্যাচার সম্ভব নয়, বিশিষ্ট কয়েকজনের প্রতি তা অনায়াসেই তারা করতে পারে—মাথা নেওয়া আর ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া ত অতি সামান্য কথা! এই ঘোষণার পর সতীশ একান্ত অনুরোধেও তাদের কারু বাসায় অতিথি হতে রাজি হল না, তাদের অনেক বুঝিয়ে নিরস্ত করল। অত্যন্ত বেদনাপূর্ণ হৃদয়ে তারা সতীশকে বিদায় দিল!

সতীশ বলল, “এখান থেকে স্টেশনতো বেশি দূর নয়। রাত্রের গাড়িতেই আমি মালদা চলে যাব,—ট্রেনে এক ঘণ্টার তো পথ।”

একজন বলল, “মালদা গিয়ে পৌঁছতে পারলে আপনার আর ভয় নেই! সেখানে কোম্পানীর সরকার, জমিদারের ট্যাঁ ফোঁ সেখানে চলছে না।”

সতীশ হেসে বলল, “আমি নিজের জন্য ভয় করিনে, কিন্তু তোমাদের জন্য ভাবনা রইল। মাঝে মাঝে তোমাদের লোক পাঠিয়ে খবর দিয়ো!”

“তা দেব। এখন চলুন, আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“না না, এত লোকজন ভীড় হৈচৈ করে গিয়ে কাজ নেই, এমনি একা চুপচাপ চলে যাব কেউ টের পাবে না। আর এতো রাত্রে জমিদারের কোন্ লেঠেল আমার মাথা নিতে বসে আছে!”

তারাও ছাড়ে না, সতীশও রাজি হয় না। অবশেষে সতীশেরই জিৎ হল, ক্ষীণ চাঁদের আলোয় গ্রামের সরু পথ দিয়ে সতীশ একাই চলে গেল। সতীশ যাবার পরই তার কয়েকজন চাষী-বন্ধু হাতিয়ার-লাঠি নিয়ে দূর থেকে তার অনুসরণ করে চলল, সে নিরাপদে স্টেশনে পৌঁছল দেখে তারা নিশ্চিন্ত মনে ফিরে গেল,—তার দরদী বন্ধুরা যে তার পিছু পিছু এসে তাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে সতীশ তা জানতেও পেল না।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সতীশ যে মুহূর্তে স্টেশনে পৌঁছল সেই মুহূর্তেই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তারপরে আর পরদিন ছাড়া গাড়ি নেই। সতীশ স্টেশনের এক কোণে একটা ভাঙা বেঞ্চিতে বসে এখন কি করবে তাই ভাবতে লাগল।

রাত্রের মত কাজ সেরে, রেলের কর্মচারীরা স্টেশনের বাতি নিবিয়ে দিয়ে চলে গেল,—গ্রাম্য স্টেশন, উপরে একটা টিনের ছাদ—চারিদিকে খোলা, হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। কোনো বিশ্রামের ঘর নেই, কোনো বিশ্রামার্থীও নেই। নিঃসঙ্গ সতীশ শীতে হি হি করে কাঁপতে লাগল।

সতীশ ভাবল, এই ভাঙা বেঞ্চের উপরে সারারাত ঘুমোলে ঠাণ্ডা লেগে পরদিন তার কি অবস্থা দাঁড়াবে তা অনুমান করা নিতান্ত কঠিন নয়। তার ওপরে চাইকি ভোরে উঠে হয়ত দেখবে তার মস্তকটির যেখানে থাকবার কথা ভুলক্রমে সেখানে সেটি নেই!

তার চেয়ে এই রেলপথ ধরে হেঁটেই মালদা চলে যাকনা কেন, ভোর নাগাদ গিয়ে পৌঁছবে। হাঁটতে হাঁটতে শরীরও একটু গরম হবে, মাঘের এই হাড়-ভাঙা শীতও সহজে চেপে বসতে পারবে না। এবং কাল সকালেই তার বোর্ডিংএ পৌঁছানো দরকার, পুরো একটা দিন বোর্ডিংএ অনুপস্থিত, এর তো কৈফিয়ৎ দিতে হবে!…সে হাঁটাই শুরু করল।

নির্জন রেলপথ কখনো দুধারে সীমাহারা চষা-মাঠ, কখনো ফসল ক্ষেত, কখনো বন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেছে। কখনো তার দুই পাশে ক্ষুদ্রতম পাহাড়ের মত মাটির ঢিবি বহুদূর জুড়ে চলে গিয়েছে,—তার ওপর থেকে হালুম করে হঠাৎ নেকড়ে বাঘ লাফিয়ে পড়া বিচিত্র কিছু নয়!

এই স্টেশন থেকে মালদা স্টেশন অন্তত কুড়ি মাইলের ব্যবধান, অবশ্য চার পাঁচ মাইল অন্তর অন্তর ছোট ছোট স্টেশন আছে। পথের আশেপাশে যে সব গাঁ, রেললাইন থেকে তাদের কারুরই দূরত্ব তিন মাইলের কম হবে না, কোথাও দশ মাইলেরও বেশি! সতীশ একাই এই পথ অতিক্রম করে চলল,—এই চলার পথে তার প্রাণে কোথা থেকে যেন অসীম শক্তির আভাস এসে স্পর্শ করছিল, তারই অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে গোপন আনন্দে সে চলছিল।

রেলের সাঁকোগুলি সে সন্তর্পণে পেরুচ্ছিল, কেননা চাঁদ তখন প্রায় ডোবে ডোবে, আর সেতুর মাঝে বড় বড় ফাঁক। এই রকমে সে পনের মাইল পথ অতিক্রম করে একটা বড় সাঁকোর কাছে এল, তখন চারিদিকে ঝাপসা আঁধার, কিছুই পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সাঁকোর ওপর দিয়ে অতি সাবধানে পা টিপে টিপে চলল, কেন না পা-ফেলা-ছন্দের মধ্যে ঈষৎ যতিভঙ্গ হলেই মাঝের বড় বড় ফাঁক গলে একেবারে নিচের স্রোতস্বতীর মধ্যে অনিবার্য পতন!

সে যখন সাঁকোর প্রায় মাঝামাঝি গেছে তখন অদূরে দেখল একটা আলোর গোলা তার দিকে ছুটে আসচে—একটা মালগাড়ি! হেলির ধূমকেতুর মত এই মালগাড়িগুলো কখন আসবে কখন যাবে কিছু সুনির্দিষ্ট নয়। সতীশ দেখল ভয়ানক বিপদ, গাড়ি প্রায় তার ঘাড়ে এসে পড়েচে! তখন সাঁকোর যে ফাঁককে সে এতক্ষণ গুপ্তশত্রুর মত ভয় করে চলছিল তাই তার পরম বন্ধুর কাজ করল, এক নিমেষে সেই ফাঁক গলে সে নদীর নিরাপদ বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল!

ভালো সাঁতার জানত, তাই স্রোতের টানে খানিকদূর ভেসে গিয়েও আবার রেলপথে ফিরে এল। ভিজে কাপড়েই চলতে লাগল,—বরফের মত ঠাণ্ডা জল,—তার আপাদ মস্তক যেন প্রতিমুহূর্তেই জমে যাচ্ছিল। অবশেষে বাকি পাঁচ মাইলও সে অতিক্রম করল, অবসরের মত অতি ভোরে বোর্ডিংএ এসে পৌঁছল, এতো ক্লান্তি, এতো শ্রান্তি, এতো ঘুম তাকে পেয়েছিল, খুঁজে পেতে কাপড় বদলাবার অবসর তার হলোনা, ভিজে কাপড়ের শীতল আলিঙ্গনের মধ্যেই সে বিছানায় ঢলে পড়ল।

২২

মোহনের মধ্যবর্তিতায় আলাপের সূচনা হয়ে এত দিনে সতীশ ও দেবেনের মধ্যে বন্ধুত্ব পাকা হয়ে উঠেছিল। সেদিন বোর্ডিংএর একটি ঘরে বসে সতীশ দেবেনকে খবরের কাগজের সর্বপ্রধান খবরটি পড়ে শোনাচ্ছিল—

রসা রোডে অদ্ভূত হত্যাকাণ্ড

সি-আই-ডির কর্মচারী শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার সাহা সাইকেলে চড়ে রসা রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একটি যুবক এসে তাঁর ললাট লক্ষ্য করে তিনবার পিস্তল আওয়াজ করে, তিনটি গুলিই তাঁর ললাটে বিদ্ধ হয়েচে। অক্ষয় বাবু সাইকেল থেকে পড়ে যান, তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রাণবিয়োগ হয়। রাস্তার লোকজন এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় এমনই হতভম্ব হয়ে যায় যে যুবকটি অক্ষয়বাবুরই সাইকেলে চড়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেও কেউ তাকে বাধা দিতে পারেনি।

কিছুদূর চলে যাবার পর সকলের চেতনা হয়, এবং অনেকেই তার পিছু পিছু তাড়া করে দৌড়ায়, তবু তাকে ধরা সহজ হতনা যদি না একজন সাহেবের পিস্তলের গুলিতে তার সাইকেলের চাকা ফাটত। সাহেবটি মোটরে তার অনুসরণ করেছিলেন।

ধরা পড়ে যুবকটি তার নামধাম কিছুই প্রকাশ করেনি। তাকে লালবাজার থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পকেটে একখানা চিঠি পাওয়া গেচে সেখানি তার কোনো বন্ধুকে লেখা—তাতেই জানা গেছে তার নাম সুধীর। তার বয়স অন্তত পঁচিশের কম নয়, দেখলে তাই মনে হয়। পুলিসের জোর তদন্ত চলচে।…

সতীশ কাগজ পড়ছিল, ও মাঝে মাঝে দেবেনের দিকে তাকাচ্ছিল, সুধীরের নাম শুনে তার দুটো চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে এল দেখে সে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “একি?”

শ্বাসরুদ্ধের মত দেবেন বলল, “শীগ্রি দেখ? কোন সুধীর? সুধীর রায় কি? সতীশ দেখে বলল, তাতো কিছু লেখেনি, এই শোন না।—”

বাকিটুকু শুনে দেবেন আশ্বস্ত হল। বলল, “ওঃ, তাই ভালো। বয়স পঁচিশের বেশি, এ সে নয়।”

“তুমি কার কথা বলচ?”

“আমি সুধীরকে জানি, এ সে নয়। সে বড় জোেড় কুড়ি, প্রায় আমার বয়সী।”

“সে কি বিপ্লববাদী?”

“হ্যাঁ-না, -তা নয়। সে বিপ্লববাদী বটে, তবে এত সুন্দর, তার প্রাণ এত কোমল যে সে কিছুতেই এমন বীভৎস কাজ করতে পারে না। মানুষ খুন, কি ভয়ানক!”

“শুনেছি তাদেরকে অনেক সময়ে কর্তার আদেশে কর্তব্যের অনুরোধে, প্রাণের ধর্মের বিরুদ্ধ অনেক কাজ করতে হয়।”

“তা, হয় ত হয়। কিন্তু সুধীরের পক্ষে, সে মুখে খুব বড়াই করলেও, তা কাজে করা অসম্ভব। আমি ছেলেবেলা থেকেই তার মন জানি। তার অন্তরে দেশের স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিরন্তর জ্বলছে একথা সত্যি, তা বলে সে কখনই হত্যাকারী হতে পারে না।”

“সে তোমাকে চিঠি লেখে? এর মধ্যে তার চিঠি পেয়েচ?”

“সে এখন ভাগলপুরে। কিছুদিন থেকে তার চিঠি পাইনি বটে তবে তার শেষ চিঠি আমার পকেটেই আছে, এই দেখ।”

একটি খাম সতীশের হাতে দিল, সতীশ চিঠিখানা বের করে তার ওপর চোখ বুলিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “এর ত আমি একবিন্দুও বুঝতে পারছিনে। এটা চিঠি, না, equation-এর আঁক?”

“দেখি!…তাই ত! এটা আমাদের সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা, এতে আমাদের কাজের কথা আছে, এ তুমি কিছু বুঝবে না, আর তোমাকে বলবারও অধিকার আমার নেই। কিছু মনে কোরো না। বাংলা চিঠিখানা বাড়িতে ফেলে এসেছি, তোমাকে দেখাব।”

“তুমি তাকে খুব ভালোবাসো, না?”

“আমি? আমি তাকে ভালোবাসি আমার প্রাণের মত, আমার দেবতার মত, দেশের মত। আমি মনে মনে তার পূজা করি, ঘুমিয়ে তারই স্বপ্ন দেখি। অনেক ছেলেই আমার প্রিয়, কিন্তু সে আমার প্রিয়তম।”

“ভারি আশ্চর্য ত! অনেক রকম বন্ধুত্বের কথা শুনেচি, কিন্তু এরকম ভালোবাসার কথা ত শুনিনি। তুমি কি ছেলেবেলা থেকেই তাকে এমনি ভালোবাসচ?”

“ছেলেবেলায় তাকে আরো বেশি ভালোবাসতুম, সে ভালোবাসার কেবল স্বপ্নটুকু এখন আমার মনে জাগে, তেমন ভালোবাসা আমি এপর্যন্ত কাউকে ভালবাসতে পারিনি, বোধ হয় কেউই তেমন ভালোবাসতে পারে না।”

“বটে? কি রকম?”

“তার কতটুকুই স্মরণ করে এখন তোমাকে বলতে পারব! বারো বছর বয়সে যেদিন আমি স্কুলে ভর্তি হই পঞ্চম শ্রেণীতে, সেই দিনই আমি আমার এই পরম সুন্দর সহপাঠীটিকে ভালোবেসে ফেলি—যাকে বলে প্রথম দর্শনেই প্রেম। কিশোর দেবকুমার—তার হাসিতে চাউনিতে, কথাবার্তায়, চলাফেরায় যেন অপরূপ রূপ অনুক্ষণ ঝরে পড়ত!”

“বল কি? এ তো ভারি রোম্যান্টিক!”

“দুটি বছর আমি তার সঙ্গে পড়েছিলুম, সেই দুটি বছর আমার যেন স্বপ্নে স্বপ্নেই উড়ে গেছে। পড়াশুনা কিছুই করতুম না, দিনরাত কেবল তার কথা ভাবতুম। তার নাম লিখে লিখে আমার খাতাপত্র ঘরের দেয়াল সব ভরে গেছল, তাকে একটুখানি দেখবার জন্য বিশেষ বিশেষ জায়গায় কতক্ষণ অপেক্ষা করতুম, আড়ালে আবডালে জানলার ফাঁকে তাকে একটু দেখে নিতে পারলে নিজেকে কত ধন্য মনে করতুম,—সে ছিল এক অদ্ভুত ভালোবাসা। এখনো আমি তাকে সারা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি বটে, কিন্তু ছেলেবয়সের সেই ভালোবাসার কথা মনে হলে আমারই এখন হাসি পায়!”

“সেও তোমাকে ভালবাসতো?”

“সে কথা জানবার আমার কোনদিন অবসর হয়নি। আমি নিজে ভালোবেসেই এত বিভোর ছিলুম যে তার ভালোবাসা পাবার কথাই আমার মনে জাগেনি। তখন জানতুম একা একা ভালোবাসাই হচ্ছে প্রেমের সত্য এবং তাতে আমার আনন্দ কম ছিল না। তার প্রতি আমার প্রেম এত গভীর ছিল যে দুবছরে আমি তার সঙ্গে একটি কথাও বলতে সাহস করিনি, নীরবে চোখের ভাষায় আমাদের আলাপ চলত। তার চোখ দিয়ে চাঁদের মত এমন স্নিগ্ধ কিরণ ঝরত, সেই সুধাতেই আমার প্রাণের তৃষ্ণা মিটত। সে বেশ জানত আমি তাকে ভালোবাসি, তাই আমি কাছে গেলেই তার গাল দুটি গোলাপের মত লাল হয়ে উঠত। কেন জানি না, দুবছর আমরা কেউই কার সঙ্গে মিশতে পারিনি। এটাও আমার এখন খুব আশ্চর্য ঠেকে।”

সতীশ। বৈষ্ণব কবিদের প্রেমের গাথায় অনেকটা এই ভাবের পরিচয় আছে। সৌন্দর্য ও প্রেমের আকর্ষণে দেখছি লিঙ্গভেদ নেই!

দেবেন। বৈষ্ণব কবিরা রাধাকৃষ্ণকে যেমন ভালোবাসতেন তার প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল তেমনি তন্ময়, তাকে নিয়ে আমার কত কি সাধ মনে জাগত, শুনলে তুমি হাসবে, আমার নিজেরই এখন হাসি পায়! কিন্তু এত কাছে পেয়েও তার আমার মধ্যে যে বিরহের ব্যবধান ছিল, তা বোধ হয়, আজও ঘোচেনি, হয়ত সত্যিকার প্রেমে তা কোনদিন ঘোচে না।

সতীশ বলল, “তাই ত কবি বলেচেন—

আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন

তোমাতে করিব বাস,

দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস!—”

দেবেন হেসে বললে, “অবশ্যি তার কারণ অনেকটা আমাদের নিজের গড়া, আমি ছিলাম ভীরু, আর সে ছিল লাজুক, তাই আমরা সে বয়সে মিশতে পারিনি। এখন তো আমার প্রাণ যাকে চায় তাকে আমি এক দণ্ডের মধ্যে আপনার করে নিতে পারি অতি সহজেই,—কিন্তু তখন এই কাজটিই কত শক্ত ছিল।”

“তারপর আবার কবে তোমাদের মিলন হলো?”

“সে বহুদিন পরে, কলেজে ভর্তি হয়ে। ভাগ্যক্রমে সে আর আমি একই কলেজে পড়েছিলুম তাই,—নইলে এজীবনে আর পরস্পরকে চেনবার, পাবার সুযোগ হত কিনা কে জানে! তখন আমরা অতি সহজেই মিশলুম, যেন ছেলেবেলার বন্ধুর মত, তখন সেও লাজুক নয়, আমিও আর ভীরু নই।”

“তারপর থেকে কেমন ভালোবাসা চলচে? আজ কাল?”

“অত কথা কি এক নিশ্বাসে বলা যায়? বিপ্লবের পথে পা দিয়ে সে আর আমি দুজনেই কলেজ ছেড়েচি, সে আগে ছেড়েছিল, পরে সেই আমাকে দলে টেনে নিল, তারই কাছে আমার স্বাধীনতার প্রথম মন্ত্রদীক্ষা! আমি তাকে এখনও তেমনি ভালোবাসি, কিন্তু তার প্রেমের মধ্যে তাকে সম্পূর্ণ—যতটা তাকে চাই ততটা যেন আমি পাই না, সে ভালোবাসে, কিন্তু তার মধ্যে ব্যবধান একটা কেমন যেন ঘোচে না!”

“সত্যি, তোমার সুধীরকে দেখবার আমার এত লোভ হচ্চে, তেমনি খুব শ্রদ্ধাও জাগচে! তিনি কি এখানে আসবেন, তাঁকে একবার এখানে আনাতে পারো না?”

“আনাতে পারি কিন্তু সাহস হয় না। তার পদেপদেই এখন বিপদ। তোমাকে গোপনে বলতে বাধা নেই, এই তরুণ বয়সেই সে এখন বাঙলার বিপ্লবী নেতাদের একজন। আবার তার দেখা পাব আমি নিজেই কখনো এ আশা করি না!”

“তবে থাক, কাজ নেই। তুমি যাকে দেখে ভালোবেসেছিলে, আমি তাকে না হয় না দেখেই ভালবাসলুম। হাসচ যে? সুধীরকে ভালোবেসে তোমার মত আমি অধীর হব না, ভয় নেই!”

দেবেন কহিল, “কথায় বেলা পড়ে এল। বিকেলে আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। তোমার বোর্ডিংএর খবর কি? অশান্ত-মোহনকে দেখতে পাচ্ছিনে যে? কোথায় গেল?”

সতীশ বিরস মুখে বলল, “তাদের নিয়েই ত যত গোল বেধেছে। তাদের বন্ধুত্ব নিয়ে ছেলেরা কুৎসা রটাচ্চে, মাস্টাররা তাদের নৈতিক চরিত্রে সন্দেহ করচেন। তারা নাকি—”

“সে কি? তারা পরস্পরকে নষ্ট করচে এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে।”

“কিন্তু অনেক ছেলেই চোখে দেখেচে যে। অবশ্যি বেশি কিছু দেখেনি,—তবে সকলের সামনেই তারা চুমো খায়!”

দেবেন উচ্চহাস্য করে বলল, “চুমো খায়, এই কেবল! শুনে আমার এত পুলক হচ্চে, কি বলব! প্রাণ খুলে ভালোবাসবে না ত বাঁচবে কিসে, জীবনে অমরত্ব অর্জন করবে কোন অমৃতে?”

“কিন্তু তাতে বোর্ডিংএর আর সব ছেলের খারাপ হবার ভয় আছে।”

“অমন খারাপ হতে পারলে তোমার বোর্ডিংএর ছেলেরা উদ্ধার হয়ে যাবে। আমি এসে অবধি দেখচি তোমাদের বোর্ডিংএর একটি ছেলেও নষ্ট না হয়ে নেই, সবাই নিজের ও পরের মস্তক চর্বনে অভ্যস্ত,—অথচ যা তাকালেই চোখের ওপর ধরা পড়ে সেদিকে কর্তাদের দৃষ্টি নেই,—কিন্তু যে ছেলেদুটির নিষ্কলঙ্ক মুখ দেখলে মূর্ত ব্রহ্মচর্যের কথা মনে পড়ে তাদেরকেই তোমরা অপরাধী ঠাউরে বসে আছ। বেশ ত মজা!”

সতীশ আশ্চর্য হয়ে বলল, “তুমি কি বলতে চাও শুধু চুমু খাওয়াতে কোনো দোষ নেই! দৈহিক নষ্ট না হয় নাই করল, কিন্তু কেবল চুমো খাওয়াতেই কী হতে পারে জানো?”

“জানি বই কি। চুমোর কি মন্ত্রশক্তি তা আমি আর জানিনে! কেবল একটিমাত্র প্রাণের চুমো দিয়ে একটি ছেলের ঘুমন্ত প্রাণকে জাগানো যায়, তার অন্তরের উদ্বোধন হয়, তাকে ভালো করা যায়, সে ভালোবাসতে শেখে, তার মনে সত্যের—সুন্দরের বোধ জাগে—যা শত শত বক্তৃতা, উপদেশে হবার নয়। যাকে বলে আত্মার জাগরণ তাই হয়—ভালোবাসার একটি চুমুর ইন্দ্রজালে।”

“সোজা কথায়, চুমু দিয়ে তাকে এঁচোরেই বেশ পাকিয়ে তোলা যায়, তাতে আর ভুল নেই!”

দেবেন গম্ভীরভাবে বলল, “তা হবেও বা। এই জন্যই বোধ হয় মানুষের দাড়ি গোঁফ পেকে যায়, কেবল বউ-এর চুমু পেয়ে পেয়ে।”

সতীশ হেসে ফেলে বল্লে, “কিন্তু ভাই, তোমার চুমোর মন্ত্রশক্তির কোথায় যেন গলদ আছে। যে চুমুতে অশান্ত ও মোহন পরস্পরের প্রাণের ফুল ফোটাল তাতে কিন্তু গুরুজনদের মানসিক অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠেছে, তাঁরা ঐ ইন্দ্রজালে ঠিক মুগ্ধ হতে পারচেন না।”

“মাস্টাররাও তাদের চুমু খেতে দেখেচেন নাকি?”

“দেখেননি, তবে শুনে তাঁদের বিশ্বাস হয়েছে। তাইতেই তে বিপদ। তাঁরা নিষেধ করে পরস্পরের সঙ্গে মেশামেশি বন্ধ করে দিলেন, দুটো দিন সবুর কর তা নয়, হতভাগা ছেলেদুটো তবু মিশতে ছাড়বে না, আবার তাঁদের দেখিয়ে দেখিয়েই। বলে, মিশে তারা কোন অন্যায়টা করচে!”

“বটে? এখন ওদের কি হবে তাহলে?”

“ঠিক বলা যায় না। বড় ছেলে হলে এত স্পর্ধা তাঁরা সহ্য করতেন না, কোনদিন “রাজটীকা” পরিয়ে তাড়িয়ে দিতেন। কিন্তু নেহাৎ ছোট বলে মাস্টারদের মনেও মায়া হচ্চে, এই যা রক্ষা!”

“সাধে কি বঙ্কিমবাবু তাঁর দুর্গেশনন্দিনীতে লিখে গেছেন সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র! লাখ কথার এক কথা! এই সর্বপ্রত্যক্ষ মন্ত্রের তিনিই সর্বপ্রথম দ্রষ্টা এজন্য তাঁকে বারম্বার নমস্কার করি!”—এই বলে দেবেন যুক্ত কর কপালে ঠেকাল।

তাদের নিয়ে সতীশ ও দেবেনের মধ্যে যখন এইসব আলোচনা চলছিল, অশান্ত ও মোহন তখন অশান্তর দাদার বাসাতে নানারকম জল্পনকল্পনায় মশগুল। তারা ঠিক করেচে আর বোর্ডিংএ থাকা নয়, কেউ কাউকে ছেড়ে যখন একদণ্ড থাকতে পারবে না এটা স্থির, তখন এই বাঁধাবাঁধির মধ্যে থেকে প্রাণকে পিষে মারা কিছু নয়। তারা ত জানে পরস্পরকে তারা নষ্ট করেনি, কোনদিন করবেও না, তা হলেই হল—পরের কাছে তার সাফাই দেবার এত কি গরজ! তারা ভালো, আর তারা কেবল ভালোবাসে,—আর কেউ না জানুক মা দুর্গা ত একথা জানেন। মা দুর্গা ছাড়া আর কাউকেই তারা কেয়ার করে না।

তাই তারা বোর্ডিং ছেড়ে স্কুল ছেড়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে আজ সন্ধ্যার ট্রেনেই নিরুদ্দেশ-যাত্রা করবে। কোথায় যাবে সেটা গাড়িতে বসেই ঠিক হবে, যেখানে খুশি হবে সেখানেই নেমে পড়বে, তারপরের কথা তারপরে। ভয় বা ভাবনার কী আছে, মা দুর্গা ত সর্বদাই তাঁর এই ছেলে দুটিকে দেখবেন।

সামনের ছুটিতে গৌড় পাণ্ডুয়া দেখবে বলে অশান্ত তার বৌদির কাছে কিছু টাকা চেয়ে নিয়েছিল, তাই এখন তাদের পথের সম্বল। অবশ্যি গৌড় পাণ্ডুয়া দেখবার তাদের খুবই সখ ছিল, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না,—যখন আরো বড় হবে তখন দেখবার অনেক অবসর পাবে এই হল সান্ত্বনা। ছোট্ট উল্কাকে মোহনের কাছে রেখে অশান্ত ভেতরে গেল দুজনের কাপড়চোপড় ও আর সব দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে।

মোহন আদর করে ডাকল, “উল্কা!”

উল্কা কাছে এল, আধ-আধ ভাষায় বলল, “কি বলচ!”

অশান্তর এই ক্ষুদ্র ভাইপোটিকে মোহনের বড় ভালো লাগত, আজ একে ছেড়ে যাবে তার বড় দুঃখ করতে লাগল। সে তাকে টেবিলের ওপর বসিয়ে গালে একটা চুমু খেল।

এই সমাদর উল্কার পছন্দ হল না, সে ছোট্ট হাতে ঘুষি তুলল, কিল খেয়ে মোহন তার সেই হাতে চুমু দিল। উল্কা তখন লাথি ছুঁড়ল, মোহন তার পা ধরে চুমু খেল,—উল্কা তখন আর কোনো উপায় না দেখে মোহনের চুল আঁকড়ে ধরল, একমাত্র এই অস্ত্রেই সে তাকে কাবু করতে পারত।

মোহন তখন এই বিদ্রোহী ক্ষুদ্র শিশুকে তার কোলের কেল্লায় বন্দী করে হাত পা চেপে ধরে তার দুই গালে অগুন্তি চুমু দিল—আদরের চাপে উল্কার দুই গাল আপেলের মত লাল হয়ে উঠল। সেই রাঙা রাঙা গাল দুটি সে আপনার গালে চাপতে লাগল।

মোহনকে যখনি দেখতে পেত তখনি উল্কা তার কাছে ছুটে আসত, কিন্তু তাই বলে, মোহনের এত আদর তার ক্ষুদ্র প্রাণে সহ্য হত না,—প্রথম প্রথম কিছুক্ষণ চুপ করে সইত, তারপরেই রীতিমত বাধা দিতে শুরু করত। কিন্তু তাকে মোহনের এত ভালো লাগত যে সে আদরের মুখে কেবল তাকে পীড়ন করছে একথা তার খেয়ালই হত না। মোহন দস্তুরমত একজন শিশু-শিকারী হয়ে উঠেছিল!

এইভাবে বন্দী হয়ে উল্কা বড় ফাঁপরে পড়ল, আর কিছু না পেরে মোহন যতবার তার চুমু খেল ততবার সে তার মুখে কামড় দিল—তার দংশনে মোহনের ঠোঁট দুটি জ্বালা করতে লাগল। শিশুর কচি কচি দুধে দাঁতগুলি যে মধু-বিষ ছড়ায় তার লোভ ত কম নয়, তবু সেই প্রলোভন দমন করে মোহন অবশেষে তাকে মুক্তি দিল!

অশান্ত একটা ছোট পুঁটুলি নিয়ে ফিরে এল। মোহন জিজ্ঞেস করল, “কি কি নিলে ওতে?”

“খান কয় কাপড়চোপড়, আমার মার ছবিখানা, খান দুই গল্পের বই যা হাতের কাছে পেলাম, আর—”

“আবার কি?”

“চিঁড়ে আর পাটালি গুড়, কি জানি যদি খাবার না জোটে, পথে পথেই দুদিন কেটে যায়, তাই আগে থেকে রসদ সঙ্গে রাখলুম।”

“ঐ সঙ্গে কিছু খাজা আর রস-কদম বেঁধে নিলে না কেন? তোমাদের মালদার বিখ্যাত দুটি চীজ!”

“এখন ত ঠাট্টা হচ্চে, কিন্তু বলি, কার বেশি খিদে পায়? আমি শিবরাত্রির উপোষ করে দেখেচি এক দিন এক রাত কিছু না খেয়ে থাকতে পারি, কিন্তু তোমার যে দুঘন্টা অন্তর অন্তর খিদে পেতে থাকে, তখন কি উপায় হবে?”

“নিয়েচ বেশ করেচ, আমি কি মানা করেচি? পাটালি গুড় ত আমিই নিতে বলেছিলাম, মনে নেই?”

“খুব মনে আছে, এখন চল, বেলাবেলি বেরিয়ে পড়ি। একেবারে ছেড়ে চলে যাচ্চি, যাবার আগে চারধারটা চোখ ভরে দেখে নিই।”

“নদীর ধারের পথটা দিয়ে চল, বেড়াতে গিয়ে যেখানে আমরা বসি সেখানেও আজ একটু বসতে হবে।”

অশান্ত উল্কাকে কোলে নিয়ে বলল, “উল্কা-মণি, যাচ্চি। তুমি দুষ্টুমি কোরো না। নদীর ধারে যেয়ো না। ঘরে বসে খেলা কোরো, কেমন?”

উল্কা তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বল্ল, “আমিও বেড়াতে যাব কাকু।”

“না লক্ষ্মীটি! তুমি মার কাছে যাও, মা ডাকচেন।”

অশান্ত উল্কাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরল, বুকটা যেন তার সত্যিই জুড়িয়ে গেল। সে উল্কাকে বলল, “আমাকে একটা চুমু দাও ত মণি!”

উল্কা চুমু দিল। অশান্ত আর একটা, আর একটা বলে যতগুলো চুমু চাইল উল্কা ততগুলি চুমু দিল।—অশান্তর চোখে জল এল।

মোহনকে দেখিয়ে বলল, “একেও চুমু দাও।”

উল্কা মোহনকেও চুমু দিল।

অশান্ত একবার বলল, “দেবেনদার কাছে বিদায় নেওয়া হল না, বড় দুঃখ থেকে গেল। কিন্তু কি করব, জানতে পেলে তিনি কিছুতেই আমাদের ছাড়তেন না।”

উল্কার চুমু খেয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল।…

২৩

গ্রেপ্তার হয়ে সারাদিন সুধীরকে লালবাজার গারদে আটক থাকতে হল, সমস্ত দিন। তাকে কিছু খেতে দিল না, সন্ধ্যার পর মুড়ি আর চিনি দিয়ে গেল, সে তা স্পর্শও করল না। ক্ষুদ্র ঘরটির মধ্যে অবরুদ্ধ সিংহের মত সে অনবরত ঘোরা-ফেরা করতে লাগল।

দলের আদেশে অক্ষয়কে সে খুন করেছিল, কাজের জন্য অনুতাপ না হলেও অক্ষয়ের জন্য তার দুঃখ হচ্চিল। হোক সে শত্রু, তবু এমন একটা প্রতিভা, যা তাদের বিরুদ্ধে লেগে তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল, তা দেশের সেবায় নিযুক্ত হলে কত বড় কাজে আসত,—আজ পরাধীন দেশের দুর্দৈব, তাকেই তাদের হত্যা করতে হল।

ভেবে দেখলে, তাদের সঙ্গে যে ছলনা করেছিল তাতে অক্ষয়ের দোষ ছিল, না—ফাঁকি দিয়ে তাদের কর্মকেন্দ্র দেখে এসে সব কথাই সরকারের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল সেজন্য তাকে বড় অপরাধী করা যায় না। কেননা ঐ কাজই তার কর্তব্য,—আর প্রাণ বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলার অধিকার মানুষ মাত্রেরই আছে। সরকারের সঙ্গে এতদিনের বিশ্বাস যে সে নষ্ট করেনি, বিপ্লবীর হাতে মৃত্যু অনিবার্য জেনেও তার কর্তব্য পালন করেচে—এখানেই ত তার মনুষ্যত্বের সত্য পরিচয়! অক্ষয়ের জন্য সুধীরের সহানুভূতি জাগছিল।

কিন্তু সেও ত অক্ষয়ের পথেরই যাত্রী! আজ না হোক কাল তাকেও ফাঁসি কাঠে প্রাণ দিতে হবে! মরতে তার একটুও ভয় নেই, কারুর জন্য ভাবনাও তার ছিল না,—মৃত্যু ত তাদের খেলার সহচর। এই ত সেদিন তার দুর্জয়দাদা হাসিমুখে আত্মদান করেচে!

মরতে ভয় সংসারীদের,—তাদের হাসি আছে কান্না আছে, সম্মান আছে, প্রতিষ্ঠা আছে, ভালোবাসা আছে, সংসার আছে, তারাই মরণকে এড়িয়ে চলতে চায়! আর বিপ্লবীদের! মৃত্যু নিশিদিন তাদের শিয়রে জেগে পাহারা দিচ্চে! হয়ত পরলোকে সে দুর্জয়দার সঙ্গে মিলবে, আবার তারা বাংলাদেশে জন্ম নেবে, মানুষকে, মানুষের দেশকে, স্বাধীন করবার সাধনা এইখানেই তারা করবে! কতদিনে যে মানুষের এই ব্রত উদ্‌যাপিত হবে কে জানে, আরো কতবার তাদের জন্মমৃত্যুর মোহনা ঘুরে আসতে হবে।

সুধীর সারারাত ঘুরে ঘুরে কত কি ভাবতে লাগল,—সে তার অন্তরের মধ্যে বিচিত্র সমস্যার দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। একবার তার মনে প্রশ্ন হল—হত্যা কি ভালো? যতই সে এর জবাব খুঁজছিল, হত্যার বীভৎসতা ততই তার মনের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। উত্তেজনার বশে যে এই কাজ করেছিল, এখন ঠাণ্ডা মাথায় সে কথা ভাবতেই তার সর্বাঙ্গ সিঁটিয়ে উঠল!

পাশের গারদে একটা পাগলের চোখেও সারারাত ঘুম ছিল না। সে মাঝে মাঝে হাউ হাউ করে কেঁদে কেঁদে উঠছিল,—কখনো কখনো অব্যক্ত স্বরে কি কথা বলে যাচ্ছিল। সুধীর কদাচ থমকে দাঁড়িয়ে তার মর্ম জানবার চেষ্টা করছিল,—এই অব্যক্ত ক্রন্দন ধ্বনির সঙ্গে তার অন্তরের কোন্ হতভাগা পাগলের যেন সুরে মিল ছিল।

সুধীরের মনে হল, তারা বিপ্লবীরা হয়ত ভুলপথে চলেচে। যে কাজ সুন্দর নয়, তা কখনো কল্যাণের কাজ—সত্যের কাজ হতে পারে না। যা প্রকাশ্যে করা চলে না তার মধ্যে নিশ্চয় সৌন্দর্যের দৈন্য আছে। হয়ত তা বিধাতার কাজ নয়।

ক্রমশ যতই রাত গভীর হতে চলল, একটি দুটি করে কনস্টেবলের ঝোলায় চেপে মাতালের আমদানি বেড়ে চলল,—তারা সবাই সামনের গারদে ভর্তি হল। তাদের চেঁচামেচিতে গারদঘরের ল এবং অর্ডার দুইই অত্যন্ত ক্ষুণ্ন হতে লাগল।

পরদিন সুধীরকে আদালতে নিয়ে গেল, হত্যাকারী দেখবার জন্য সেদিন ভিড় কম হয়নি, কিন্তু আসামীর কাঠগড়ায় এই তরুণ সুকুমার মূর্তি দেখে সকলের বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। সেখান থেকে কয়েদী-গাড়িতে আর সব চোর ডাকাতের সঙ্গে বন্ধ করে তাকে আলিপুর জেলে নিয়ে গেল। পথে যেতে যেতে তার কেবলি মনে হতে লাগল, পুলিস তার কাছ থেকে দেবেনকে লেখা চিঠিটা নিয়ে গেছে, হয় ত তাকেও এই লাঞ্ছনা পোহাতে হবে।

জেলের ফটকের মধ্যে ঢুকে আর সব কয়েদীর সঙ্গে তাকে জোড়া জোড়া সারি বেঁধে দাঁড়াতে হল; সেখানে তাদের কয়েকবার গুনতি হল,—আদালতের নথিপত্রের সঙ্গে তাদের নামে নামে মিলিয়ে নেওয়া হল।

তারপরে কয়েদীদের তল্লাসী শুরু হল,—সকলের সামনে প্রত্যেকের বস্ত্রহরণ করে, তারা কেউ একটা বিড়ি বা একটা পয়সা দেহের কোথাও লুকিয়ে রেখেচে কিনা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। যারা এই তল্লাসীতে আপত্তি করল বা একটু বাধা দিল, জেলের ওয়ার্ডারদের হাতে তাদের লাঞ্ছনার আর সীমা রইল না।

সুধীরের তল্লাসীর আগেই সে সহকারী জেলারকে গিয়ে জানাল যে সে রাজনৈতিক কয়েদী, আর ভদ্রঘরের ছেলে, এই ভাবে তল্লাসীতে সে অভ্যস্ত নয়। জেলার তার মুখ দেখে দয়া করলেন, তাকে আর সম্পূর্ণ নগ্ন হতে হলনা। যে প্রাণ দিতে যাচ্চে সে যে এই তুচ্ছ লজ্জাটুকু ছাড়তে পারচে না এই কথা ভেবে জেলার ও সুধীর, দুজনেরই মনে মনে হাসি পেল!

তারপরে সুধীরকে বিখ্যাত ৪৪ ডিগ্রীর একটা সেলে নিয়ে বন্ধ করে রাখল। ছোট্ট একটুখানি ঘর, তার মধ্যেই মলমূত্রের ব্যবস্থা,—কম্বলের শয্যায় শুয়ে সুধীর ভাবতে লাগল, বিপ্লব-গুরু বারীন্দ্র-উপেন্দ্রদের পাদস্পর্শে এই কুঠরী ঘৃণ্য তীর্থে পরিণত হয়েছে! সে মাথা ঠেকিয়ে দ্বীপান্তরের পরপারে তাদের উদ্দেশে প্রণাম জানাল।

সকালে উঠে তার সব আগে চোখে পড়ল মাটিতে খোদা রয়েছে কোন্ অজানা বিপ্লবী কবির রচনা দুছত্র কবিতা—

“এইরূপে যেন শত শত দাস,

আজীবন করে হেন কারাবাস।”

বারবার সেই দুটি ছত্র আবৃত্তি করে পড়চে, এমন সময় প্রাতঃভোজনের তলব এল। ফ্যান-ভাতের একটা দুঃখাদ্য সংস্করণ—সেই লপসী, দুদিন অনাহারের পরে, যতটা পারল তাকে খেতে হল।

সেদিন যখন সে আবার আদালতে গেল, তখন দেখতে পেল অনেক বড় বড় উকিল ব্যারিস্টার স্বেচ্ছায় তার পক্ষ সমর্থনের জন্য দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু সে স্থির করেছিল যে আপনাকে আহুতি দিয়ে বাঙালী যুবকদের সাধনার জন্য তার কর্মপন্থার একটা জ্বলন্ত আদর্শ রেখে যাবে। সে যে হত্যা করেছে এ অস্বীকার করে ফল নেই, কেননা এ অপ্রমাণ করা চলবে না—কেবল এই নিয়ে মিথ্যা উকিলি তর্ক বাড়িয়ে তার আদর্শকে খাটো করে তার দলের বা দেশের কোন লাভ হবে না। সে তো দেশের মুক্তির জন্য বিশেষ কিছু করে উঠতে পারল না, এখন যদি এই বীরত্বের আদর্শটা শুধু রেখে যেতে পারে তাই হবে দেশবাসীর কাছে তার সব চেয়ে বড় দান। মামলা লড়লে, অপরাধ অস্বীকার করলে, হয়ত প্রাণদণ্ড না হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘকালের জন্য কারাদণ্ড বা দ্বীপান্তর নিশ্চয় হবে,—জেলের দেয়ালের মধ্যে তিলে তিলে মরার চেয়ে ফাঁসিকাঠে মরা তার পক্ষে অনেক সহজ। আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে এই প্রাণ বাঁচিয়ে রাখলে প্রাণ ত বাঁচবেই না, তার ওপরে আদর্শও মারা যাবে। কাজেই উকিল ব্যারিস্টাররা তাকে যা করবার পরামর্শ দিলেন, সে তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে সবিনয়ে বলল, ঐ উপদেশ গ্রহণ করবার তার শক্তি নেই।

সে কোর্টে দাঁড়িয়ে অপরাধ স্বীকার করে এক অনতিদীর্ঘ জবানবন্দী দিল, তার ছত্রে ছত্রে তার গভীর দেশপ্রীতি, নির্ভীকতা, আত্মত্যাগের আদর্শ, আগুনের অক্ষরে ফুটে উঠেছিল। শ্রোতারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সহানুভূতিতে অনেকের চোখেই জল এল,—উকিল ব্যারিস্টাররা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। এর ফলে বিচারকের রায় অনিবার্যরূপে কি দাঁড়াবে তা অনুমান করা কারু পক্ষেই কঠিন হল না।

সেদিন জেলে ফিরে গেলে সকলেই তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখতে লাগল, একজন কর্মচারী জিজ্ঞেস করলেন তার এমন কোন ইচ্ছা আছে কি না যা তারা পূর্ণ করতে পারে। সুধীরের মন তখন সম্পূর্ণ শান্তিতে ভরা, সে বলল, “ধন্যবাদ, আর কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।”

৪৪ ডিগ্রীর পথে একটি ফুলের গাছ আছে, ডিগ্রীর মুখে ঢুকতে রোজই তার লোভ হত গাছটিকে একটু স্পর্শ করে, কিন্তু রোজই সেই ইচ্ছা দমন করত। আজ সে সেই গাছটির কাছে গিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, তার কচি ডালের পাতাগুলি নিজের মুখের ওপর বুলোতে লাগল—যেন এই ছিল তার জেলের পরম বন্ধু। এই গাছটির মতই সে উদ্ধত মুক্তির দাবি নিয়ে এসেছিল, তাই আজ তাকে প্রাণের দেনা চুকিয়ে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হচ্চে।

২৪

অশান্ত ও মোহনের পলায়নের পর কয়েকদিন কেটে গেছে, এই নিয়ে সারা শহর জুড়ে একটা মুখরোচক আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যে সতীশের কুড়ি মাইল দূরের কীর্তিকথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় সকলের বিপুল বিস্ময়ের ধাক্কার মধ্যে এই অত্যন্ত মজার আলোচনাটা হঠাৎ চাপা পড়ে গেল। সতীশের এই অদ্ভুত হঠকারিতার খবরই তখন লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।

ক্ষতিগ্রস্ত জমিদার নিজে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এসে এসম্বন্ধে কত কি অভিযোগ করেছেন, তাঁদের কথাবার্তা গোপনে হয়ে থাকলেও শহরের গুজবের মুখে তা প্রকাশ হতে বাকি ছিল না। সতীশের অদৃষ্টে কি ঘটবে তাই নিয়ে ভবিষ্যদবাণীর অন্ত ছিল না, অবশেষে অনেকের মতেই সাব্যস্ত হল, নিতান্ত ফাঁসি না হলেও, দ্বীপান্তর বাসের মত ছোটোখাটো কিছু নিশ্চয়ই তার বরাতে আছে।

সতীশ সেদিন দেবেনের বাসায় এসেছিল, তাদের মধ্যেও এই নিয়েই কথা হচ্ছিল। দেবেন তাকে আশ্বাস দিয়ে বলছিল, “জমিদার কচু করবে! দু-দশ হাজার লোকের বিরুদ্ধে জমিদারই যে জিতবে তার কি ঠিক? প্রজাদেরও ত প্রাণের দাবি আছে? আর তোমার নিজের কোনই ভয় নেই, তোমার চুলও তারা স্পর্শ করতে পারবে না।”

সতীশ বলল, “তুমি যা বলচ আমিও তা ভেবে দেখেছি। তবে আমার তারা যা করবে আমি এঁচে নিয়েছি, বড় জোর আমাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে। সেজন্যেও আমি বড় ভাবিনা। মানুষের সেবার যোগ্যতা অর্জনের জন্যই পড়াশুনা যা কিছু,—যখন সেই সেবার ডাক আমার কাছে এসে পৌঁছেচে, তখনই আমি স্থির করে রেখেচি যে পড়াশুনা ছেড়ে সেই ডাকেই সাড়া দেব। তবে দুদিন পরে দিতাম, না হয় আজই দিলাম।”

“স্কুল ছেড়ে তুমি কি করবে ভেবেচ?”

“মনে আমার অনেক কল্পনা আছে, আপাতত তার একটার কাজে আমি হাত দেব। জার্মানীর Wander-vogel দলের কথা বইয়ে পড়েচি, আমাদের জেলায় সেই রকম একটা দল গড়ে তুলব। লক্ষ্মীছাড়া ছেলের অভাব তো নেই, দেখবে আমার দলে এসে তারা সমাজের কত বড় কাজে আসে। জার্মানীর সঙ্গে আমাদের উড়োপাখী দলের তফাৎ এই যে, কেবল ফুর্তি করা ওদের আদর্শ, আর ফুর্তির সঙ্গে কাজ করাই হবে আমাদের উদ্দেশ্য।”

“তা তো যেন হল, কিন্তু কি কাজ করবে তোমরা?”

“দল বেঁধে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াব, ম্যাজিক লণ্ঠন দেখিয়ে অজ্ঞতা ও অস্বাস্থ্য সম্বন্ধে দেশের লোককে সচেতন করে, যতটা পারি দৈন্যের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। দেশের যুবকদের মধ্যে যৌবনের আন্দোলন জাগাব। এই ত এখন স্থির, তারপরে কাজ করতে করতেই কত কাজ ছেড়ে যায়, কত কাজ বেড়ে যায়—তার হিসাব এখন দিই কি করে?”

“কিন্তু তোমাদের এই দলবলের খরচ চলবে কিসে?”

“লোকের সত্যিকার সেবা করতে পারলে কেবল সহানুভূতি নয় তাদের সাহায্যও নেহাৎ দুর্লভ হবে না। দেশের লোকের প্রতি আমার সে বিশ্বাস আছে। তাদের ভালোবাসলেই তারা জানতে পায়, ফাঁকি দিলেও ঠিক ধরতে পারে। আমরা যদি তাদের যথার্থ মঙ্গল চাই তাহলে অর্থের অভাবে কোনদিনই আমাদের কাজ বন্ধ হবে না। তারা কি আমাদের ভালোবাসেনা তুমি বলতে চাও?”

“তুমি খাটতে পার, কিন্তু তোমার দলের ছেলেরা কতদিন এই ভূতের বেগার খাটবে?”

“আনন্দের আকর্ষণে তারা খাটবে। এই যে উড়োপাখীর মত ভবঘুরের জীবন এর সুখ কি কম? রোজই অ্যাডভেঞ্চার, রোজই পিকনিক। স্ফূর্তির সঙ্গে কাজ করলে কাজের স্ফূর্তি আপনিই হয়।”

এই সব কথা হচ্চে এমন সময়ে স্কুলের পিয়ন ঘরে ঢুকল, সতীশকে বলল, “আপনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছি। বোর্ডিংএ না পেয়ে, একটা ছেলের কাছে শুনে এইখানে এলাম। এই নিন, সুপারিন্টেণ্ডেন্ট বাবু আপনাকে দিতে বলেচেন।”

সতীশ কাগজখানা হাতে নিল, সেখানা হেডমাস্টারের নোটিশ। তার সংক্ষিপ্ত মর্ম, কর্তৃপক্ষের ইচ্ছানুসারে তাঁকে অত্যন্ত দুঃখের সহিত জানাতে হচ্চে যে স্কুলের খাতা থেকে সতীশের নাম কেটে দেওয়া হয়েছে; সে যেন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বোর্ডিং ছেড়ে চলে যায়।

সতীশ হেসে নোটিশখানা দেবেনের হাতে দিল—“এই দেখ। আমরা যা ভাবছিলুম তাই হয়েছে।”—একটুকরা কাগজে, সে যে রাজি আছে এইটুকু লিখে পিয়নের হাতে দিয়ে বলল, “হেডমাস্টার আর অবিনাশবাবুকে দিয়ো।” পিয়ন চলে গেল।

নোটিশখানা পড়ে দেবেন বলল, “আমার ভরসা ছিল হেডমাস্টার তোমার পক্ষ সমর্থন করবেন।”

সতীশ বলল, “তাঁর এসব বিষয়ে কোনই হাত নেই। ছেলেদের প্রতি তাঁর স্নেহ কোনোদিন কম নয় আমি তা ভালোমত জানি। তাঁর শক্তি নেই, তিনি কি করবেন?”

দেবেন কহিল, “যাক গে সে কথা। স্কুল কলেজে না পড়লেই যে শিক্ষা হয় না, একথা আমি মানিনে। কিন্তু আমি একটা কথা বলি, তুমি ভেবে দেখ,—গাঁয়ে গাঁয়ে অমন টো টো করে না ঘুরে, তুমি কেন আমাদের দলে এসো না?”

“তোমার দলে? মানে, বিপ্লবীদের দলে?”

“হ্যাঁ, আমি সেই কথাই বলচি। দাঁড়াও, আমি সদর দোরটা বন্ধ করে আসি, কেউ হঠাৎ এসে পড়ে।”

দেবেন ক্ষণপরে ফিরে এলে, সতীশ তার দিকে চেয়ে হেসে বললে, “যে কথা গোপনে বলতে হয়, যে কাজ লুকিয়ে করতে হয়, তার মধ্যে অন্তরের সত্য নেই, এ তুমি জেনো। সে কাজ করবার শক্তি, সিদ্ধি, আনন্দ জুটবে কোথা থেকে?”

“দরজার খিল এঁটে এলাম বলে বলচ? বিপ্লব যেদিন আত্মপ্রকাশ করে সেদিন তার রুদ্র মূর্তি লুকোন থাকে না, কিন্তু তার সাধনা তো গোপনেই করতে হয়।”

“কে বললে? বিপ্লব যদি সত্য হয়, মঙ্গল হয়, তবে প্রকাশ্যেই তাকে ঘোষণা করতে হবে, তার মধ্যে রাখবার ঢাকবার কিছু থাকবেনা—যদি থাকে তবে তেমন বিপ্লবে কোনোদিন মানুষের স্বাধীনতা আসবেনা। আমার মনে হয় গুপ্ত সাধনায় এদেশের মুক্তি নেই।”

“তবে মুক্তি হবে কিসে শুনি?”

“গোড়ায় রোগের কারণ কি ছিল কে জানে, কিন্তু এখন আমাদের যে রোগ দাঁড়িয়েচে তা হচ্চে জাতির বিপুল দৈন্য। দারিদ্রই আমাদের সমস্ত গুণ ঢেকে রেখেচে, সমস্ত শক্তি ক্ষুণ্ন করচে, জাতীয় ধর্ম সঙ্কুচিত করেচে। দৈন্য কত দিকে! অর্থের দৈন্য, সামর্থ্যের দৈন্য, দেহের দৈন্য, মনের দৈন্য, প্রাণের দৈন্য, আত্মার দৈন্য—দেশজোড়া এই বিরাট দৈন্যের সমস্যা সব আগে সমাধান করতে হবে, তবেই মুক্তিপথের যাত্রী-দল “হাজির হাজির” বলে ছুটে আসবে।”

“কিন্তু এও ত অস্বীকার করতে পার না যে এই বিবিধ দৈন্য একটি রোগের বিভিন্ন উপসর্গমাত্র,—আসল রোগ হচ্ছে পরাধীনতা। আমরা সেই গোড়াতেই হাত দিয়েচি;—দেশ স্বাধীন হলেই এই দৈন্যের সমস্যা মিটতে পারে, নইলে নয়।”

“কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেই জাতি স্বাধীন হবে না এটা তুমি ঠিক জেনো। দেশের এই অধীনতা আজকের নয় ও কেবল ইংরেজের নয়;—বহুদিন থেকে আমরা পরাধীন বহু জনের কাছে। এই পরাধীনতার শিকড় অন্তর থেকে উপড়ে ফেলতে হবে,—বিদেশীদের তাড়াতে পারলেই আমরা স্বাধীন স্বচ্ছন্দে স্বতন্ত্র হয়ে উঠব না। নিশ্চয়!”

“তার মানে? তোমার বক্তব্য আমি বুঝে উঠতে পারচিনে। তুমি বলতে চাও কি?”

“আমি বলতে চাই, জাতির অধীনতা কেবল ইংরেজের কাছে নয়, জাতির এই শোচনীয় দীন অবস্থার কারণ আমাদেরই জমিদার, আমাদের মহাজন, আমাদেরই সমাজপতি ব্রাহ্মণ। বেশি করে এদের অধীনতাই আমাদের মর্মে মর্মে পীড়িত পঙ্গু পক্ষাহত করে রেখেছে। যদি সত্যিই বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হয় তবে স্বদেশী দড়াদড়ি বিদেশী চেনের সঙ্গেই বিসর্জন দিতে হবে।”

“অর্থাৎ তুমি চাচ্চ সমাজবিপ্লব। আমি বুঝেচি।”

“বিপ্লবের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এমন বিশেষ বিশেষ কোনো রূপ নেই। মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের অভিযানই হচ্চে বিপ্লব,—রাষ্ট্র, সমাজে, ঘরে, বাইরে, ধর্মে, কর্মে, শিক্ষায়, সভ্যতায় যেখানেই মিথ্যা মেকি ছেয়ে আছে—বিপ্লবের আগুন তার যে কোণে জ্বলে উঠুক না কেন সব কোণের জঞ্জাল সে সাফ করে মুক্ত করবে।”

“আগুন ধরে গেলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেরি লাগে না তা জানি, কিন্তু এই আগুন ধরাতেই যে কষ্ট।”

“সেই সাধনা করতে হবে। জাতির মুক্তি কত বড় ধন, সে ত কম দামে বা ফাঁকি দিয়ে মিলবে না। গুপ্তহত্যা, দাঙ্গাহাঙ্গামা এমন কি তোমার ওই গরিলা যুদ্ধেও কিছু হবে না, অন্য দেশের ইতিহাস যে সাক্ষ্যই দিক, অন্তত এদেশের মুক্তি, এ জাতির কল্যাণ ও পথে নয়। সত্য যদি লক্ষ্য হয় তবে উপায়ও করতে হবে বৈধ। প্রাণ দান করলেই এই মুক্তি পাওয়া যাবে না, এর জন্য জীবন দান করতে হবে—সারাজীবন ধরে প্রতিদিনের কথায়, কাজে, চিন্তায় এই মুক্তির সাধনা চলবে। প্রতিদিন ধরে!”

“কিন্তু এই মুক্তির সাধনা করবে কারা? সে ত এই ছেলের দল?”

“ছেলের দলই অবশ্য পথ দেখাবে, সব দেশে সব কাজেই তারা অগ্রদূত। কিন্তু বিপ্লব দিয়ে মুক্তি অর্জন করতে হলে সমগ্র জাতিকেই বিপ্লবে যোগ দিতে হবে। সমস্ত মিথ্যার সঙ্গে সমস্ত সত্যের সংঘর্ষ বাধবে। ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে অব্রাহ্মণের, উচ্চশ্রেণীর বিরুদ্ধে নিম্নশ্রেণীর, পুরুষের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে নারীর, জমিদারের বিরুদ্ধে চাষীর, মহাজনের বিরুদ্ধে মজুরের বৈধপথে নিজের সত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়তে হবে। মিথ্যাকে অমান্য মিথ্যাকে অস্বীকার করলেই মিথ্যা আলোর স্পর্শে অন্ধকারের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে মিলিয়ে যায়। সকলের মুক্তির জন্য প্রত্যেকে, এবং প্রত্যেকের মুক্তির জন্য সকলে প্রাণপণ করবে। তারপরেই সত্য জাতি বিশ্বের কল্যাণে, বিচিত্র সৌন্দর্যের বিপুল মহিমায় নবীন জন্ম নেবে। তার আগে নয়।”

এই সময়ে সদর দরজায় প্রবল করাঘাত শোনা গেল, দেবেন জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বললে, “সর্বনাশ! চারিধার পুলিশে ঘিরে ফেলেচে, বোধহয় বাড়ি খানাতল্লাস করবে!”

“তাই নাকি? তবে ত তোমার ভারি বিপদ!”

“বিপদ কিসের! আমি দরজা খুলে ওদের কিছু সময় আটকে রাখবার চেষ্টা করব। তুমি ততক্ষণে এদিকে এই কাগজপত্রগুলো পুড়িয়ে শেষ করে দাও।”

“এসব ত দরকারি কাগজ? একেবারে পুড়িয়ে ফেলব? সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা এই চিঠিগুলো আগে পুড়োও। আর এই পুঁথিগুলো,—আগুনেই এদের জন্ম, এদের ভেতরেও আগুন, আগুনেই এদের সমাপ্তি হোক। উপায় কি?”

“আচ্ছা আমি পুড়োচ্ছি। তুমি যাও।”

দেবেন বাইরে গিয়ে দেখল দলবল নিয়ে পুলিশসাহেব নিজে বাড়ি তল্লাস করতে এসেছেন। সে যেতেই সাহেব সার্চওয়ারেন্ট দেখালেন, গ্রেপ্তারের হুকুম নেই দেখে দেবেন একটু আশ্বস্ত হল।

সাহেব বললেন, “আমি এখুনি তোমার বাড়ি সার্চ করতে চাই।”

দেবেন বলল, “তার আগে আমি আপনাকে সার্চ করে দেখব, কে জানে আপনি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গিয়ে আমার বাড়ির মধ্যে রেখে দেবেন না?”

সাহেব বললেন, বেশ, যাতে তোমার সন্তোষ হয় সেই ভাবে তুমি আমায় সার্চ করতে পারো, আমি রাজি আছি।”

দেবেন সাহেবের পকেটগুলো খুঁজে দেখল, প্যান্টের পকেটও দেখল, তারপরে সাহেবের জামার হাতার ভেতর থেকে হঠাৎ একখানা বিপ্লবের পুঁথি বের করল,—“এটা কি?”

বিপ্লবের পুঁথিখানা নিশ্চয়ই জামার হাতার মধ্যে ছিল না, তবু ম্যাজিকের মত সেখান থেকেই বেরুতে দেখে সাহেব এবং আর সবাই নিতান্ত আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সাহেব আমতা আমতা করে বল্লেন, “আমি ত জানিনা। ওটা কোথা থেকে এল?”

“ভগবান জানেন। কিন্তু এর পর কিছুতেই আমি আপনাকে আমার বাড়ি তল্লাস করতে দিতে পারি না। আপনি অনুগ্রহ করে চলে যান। …হ্যাঁ, এই পুঁথিখানাও নিয়ে যান।”

সাহেবের সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠল। তিনি নীরবে সাইকেলে উঠে চলে গেলেন, তাঁর দলবল তাঁর পিছনে পিছনে গেল। দেবেন হাসিমুখে ভেতরে ফিরে দেখে ইতিমধ্যে সতীশ পত্র-যজ্ঞ সমাধা করে বসে আছে! সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কি খবর? ওঁরা আসচেন নাকি?”

“ওদের ভাগিয়ে দিয়েচি। আর তিনদিনের মধ্যে এবাড়ি সার্চ করবার নাম করবে না। ওটা কি কাগজ!”

“একটা প্রেমের কবিতা। তুমি সুধীরকে উৎসর্গ করেচ দেখে রেখে দিয়েচি।”

“কই দেখি! তুমি যে এটা আগুনে দাওনি এজন্য তোমাকে শত শত ধন্যবাদ!”

“হাতের লেখাটা কাঁচা দেখছি, এটা তোমার কতদিনের রচনা?”

“এই আমার জীবনের প্রথম কবিতা। সুধীরকে ভালোবেসেই আমি কবি হই, অবশ্যি বেশি কবিতা আমি লিখিনি। এটি আমার অতি কিশোর কালের রচনা। মনে পড়ে এই কবিতাটি লিখে সুধীরের হাতে দেবার জন্য স্কুলের পথে ঝাউবনের ধারে কতক্ষণ ধরে প্রতীক্ষা করেছিলাম। সে যখন এল তখন কত ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে প্রেমের এই প্রথম উপহারখানা তার হাতে গুঁজে দিলাম। তার সমস্ত মুখ রাঙা হয়ে উঠল, আমার বুক ঢিব ঢিব করতে লাগল,—এখনো বুকের সেই স্পন্দন যেন অনুভব করতে পারি।

“এটি বুঝি সেই কবিতারই নকল? তাই বুঝি এতদিনেও এটি কাছছাড়া করতে পারোনি। নাও, এখন এটিকে মাদুলি গড়িয়ে বুকে ঝুলিয়ে রাখো। হৃদরোগের অব্যর্থ ঔষধ!”

“তা না হয় রাখচি। কিন্তু তুমি কি কালই বোর্ডিং ছেড়ে দেবে?”

“হাঁ, কাল সকালেই।…… কোথায় যাব, কে বলতে পারে?”

“কোথায় যাবে?”

“যদি আর কোথাও না যাও এবং তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তবে আমার দ্বার তোমার জন্যে উন্মুক্ত রইল, আমি নিমন্ত্রণ করে রাখচি।”

“আচ্ছা, সে হবে এখন।”

২৫

বাঙালীর স্বপ্ন, বাঙালীর স্মৃতি, বাঙালীর গল্প, বাঙালীর গীতি, বাঙালীর সৌন্দর্য, বাঙালীর প্রীতির কাল হচ্চে তার ছেলে বয়স। নিশ্চিন্ত, নির্মুক্ত, নির্মেঘ জীবন হচ্চে বাঙালীর এই কৈশোর। বাঙালীর যৌবনে কোন রোমান্স নেই,—তা’ শুধু বেদনা, বোঝা আর ব্যর্থতায় পুঞ্জীভূত। যৌবনে বাঙালী ভালোবাসতে পারে না, প্রাণ খুলে হাসতে পারে না, দারিদ্র-দুর্ভাবনার জাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট নীরস কেরানীগিরির নিরীহ জীবনটাকেই প্রতিদিন কোনোমতে টেনে নিয়ে চলে। বাঙালী সৌন্দর্যের স্বপ্ন দেখে, সাহিত্যের সাধনা করে, সমাজের সেবায় লাগে, আদর্শের উপাসনা করে, আত্মহারা হয়ে ভালোবাসে তার তরুণ বয়সে।…

সতীশকে তাদের জন্যই স্কুল ছেড়ে দিতে হচ্চে এ খবর বাইশ গ্রামের দশ হাজার প্রজার কাছে পৌঁছাতে বেশি দেরি হল না। সতীশ তার জিনিসপত্র আগের দিনই দেবেনের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল, পরদিন সকালে বোর্ডিংএর চারিধার তার চাষী বন্ধুতে ভরে গেছে। ব্যাপার কি, জানবার আগেই গ্রামের মোড়লরা এসে তার গলায় ফুলের মালা দুলিয়ে দিল। চারিদিকে অমনি জয়ধ্বনি উঠল।

আগের দিন রাত থাকতেই বাইশ গ্রামের সব চাষী সতীশের জন্য অভিযান করে বেরিয়েছিল,—সূর্যোদয়ের পরে লোকের ভিড়ে শহরের পথ ঘাট বোঝাই হয়ে গেল। যেদিকে চোখ পড়ে সেই দিকেই চাষীর দল! চারিদিকে যেন মহোৎসব লেগে গেচে! প্রজারা যেন তাদের কোন রাজাকে অভিনন্দন দিয়ে সম্বর্ধনা করতে এসেচে।

একদল চাষী সতীশকে কাঁধে বসিয়ে জয়ধ্বনি করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে বেড়াতে লাগল! কর্তারা যাকে লাঞ্ছিত করেছে তাদের সেই তরুণ নেতাকে তারা যুবরাজের সম্মান দিয়ে বরণ করে নিল। শহরসুদ্ধ লোক বিস্ময়ে থ হয়ে এই অবাক কাণ্ড দেখতে লাগল।

দেখতে পেল না কেবল দেবেন। অতি ভোরে পুলিস তার বাড়িতে গিয়ে অন্তরীণের পরোয়ানা দেখিয়ে গ্রেপ্তার করে, —পুলিস কনস্টেবল দ্বারা পরিবৃত হয়ে সেই সকালে স্টেশনের ওয়েটিংরুমে সে গাড়ির প্রতীক্ষা করছিল।

গাড়ি আসতেই সে প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠে বসল, তার সঙ্গে পাহারাওয়ালারাও উঠতে বাধ্য হল। সমস্ত গাড়িতে একটিমাত্র প্রথম শ্রেণী,—তাতে একজন সাহেব আরোহী। তিনি আবার কোনো জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছিলেন, দেবেনের এই হঠকারিতায় তিনি অত্যন্ত আপত্তি করলেন। দেবেন তাঁর কথায় কান না দিয়ে সেদিনের খবরের কাগজ পড়ায় মন দিল। সাহেব তখন গিয়ে স্টেশন মাস্টারকে জানালেন, তিনি এসে দেবেনকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এই গাড়িতে কেন? কই দেখি আপনার টিকিট।”

দেবেন কোন কথা না বলে ইন্টার্নমেন্টের অর্ডারখানা দেখাল। বাংলা গভর্নমেন্টের হুকুম! সসম্ভ্রমে পরওয়ানাখানা ফিরিয়ে দিয়ে স্টেশনমাস্টার সাহেবকে বল্লেন, “উনি স্বেচ্ছায় না নামলে ওঁকে বাধ্য করবার এক্তিয়ার আমার নেই। আপনি অন্য গাড়িতে চলুন, রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আপনি অতিরিক্ত ভাড়াটা ফেরৎ পাবেন।”

সাহেব অগত্যা দুর্জনকে দূরে পরিহার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর একটি কামরায় আশ্রয় নিলেন। দেবেন পুনরায় খবর কাগজে মনোনিবেশ করল,—সে জানতেও পেল না তার সুধীর সেই মুহূর্তেই কারাগারে ফাঁসিকাঠে, তরুণ বয়সের মাঝখানে একটা দাঁড়ি টেনে দিল।…

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *