১৫
মোহন কেমন করে তারেশের কবলে পড়ে ধ্বংসের মুখে যাচ্ছিল তার একটু ইতিহাস আছে,—যতটুকু প্রকাশ করা সম্ভব এইখানে তার উল্লেখ হয়তো অসঙ্গত হবে না। বোর্ডিংএ আসার কিছুদিন পরেই মোহনের একবার জ্বর হয়, সেই সময় তাকে একাই নিজের ঘরে পড়ে থাকতে হোতো। মোহনের ইচ্ছা করত অশান্তকে কাছে পায়, কিন্তু সুপারিন্টেণ্ডেন্টের কড়া শাসনে সে কদাচ স্কুল কামাই করতে পারত।
এমনি একদিনে মোহনকে দেখবার কেউ ছিল না, তার অসুখটা হঠাৎ খুব বেড়ে যায়। পিপাসায় সে জল জল বলে চীৎকার করছিল,— সেই সময়ে তারেশ এসে দেখা দেয়। তারেশ স্কুলে যাওয়া খুব কমই পছন্দ করত, এবং প্রায় রোজই পালিয়ে এসে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে সুখে ঘুমোত,— মোহনের ডাক তার কানে যাওয়ায় সেদিন সেই এসে তার সেবার ভার গ্রহণ করল। লোকের অসুখ-বিসুখে সেবা করা আর বিপদে-আপদে প্রাণ দিয়ে দাঁড়ানো তারেশের একটি সহজ গুণ ছিল।
মোহন মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, তাকে জল খাইয়ে তার পাশে বসে আস্তে আস্তে কপাল টিপে দিতে দিতে সে বেশ আরাম পেল,—রক্তাভ চোখ দুটি মেলে এই অসময়ের বন্ধুটিকে তার বড় ভালো লাগল, সে অন্তরের শ্রদ্ধা দিয়ে তাকে মনে মনে বরণ করে নিল। পাখার হাওয়া দিয়ে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তারেশ মোহনকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে চুপটি করে তার পাশে বসে রইল।
মোহনের স্বভাবসুন্দর মুখখানি জ্বরের তাপে আরো রাঙা হয়ে উঠেছিল এবং একটু কাহিল দেখাচ্ছিল বলে তার সৌন্দর্য যেন আরো বেড়ে গেছল। তাকে দেখে তারেশের বড় মায়া করল, সে ভাবল এই বার একে ভালোবেসে সে ভালো হবে,—এমনি একটি পরশমণি যেন সে অগোচর অন্তরে খুঁজে ফিরছিল!
তারেশ ছিল ‘ছেলে-শিকারী’, কিন্তু সে নিজে জানত যে তার কাজ ভাল নয়, তবু কি যেন নেশার মোহে এমনি পড়েছিল যে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছিল না। এই জীবনে একা সে যতজনের সর্বনাশ করেছিল, এখন তারা সবাই মিলে যেন তার সর্বনাশের ষড়যন্ত্র করেচে,—সে নিজে এর ভয়ঙ্কর পরিণাম প্রত্যক্ষ দেখে নিরস্ত হতে চাইলেও তার সঙ্গীরা আর তাকে রেহাই দিচ্ছিল না,—কাজেই দলবল নিয়ে সে পলে পলে রসাতলের দিকেই যাত্রা করে চলেছিল।
একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ! পাপের চক্র গড়লে চক্রান্তের যেন আর সীমা থাকে না। সে যদি নিজের ভালোবাসা দিয়ে স্নেহময় বন্ধুর দল গড়ে তুলত, হলে আজ প্রাণঢালা ভালোবাসায় তারা পরস্পরের সব বিপদ-আপদ দুঃখ অমঙ্গল ধুয়ে মুছে দিতে পারত, নিজে বড় হোতো, বন্ধুদের বড় করত, সমাজ বড় হোতো, দেশকেও বড় করত।
মোহনের মুখের দিকে চেয়ে আজ সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলে কোন্ সর্বনাশা কুক্ষণে যে ভুল ঘটে গেছে এবার তাকে আমূল সে শুধরে ফেলবে, এবার থেকে সে ছেলেদের সত্যি সত্যি ভালোবাসবে, তাদের ভালো করবে, নিজে ভালো হবে।
মোহনের সম্মুখে বসে সে আজ প্রথম তার কাজের পরিণাম ভেবে বার বার শিউরে উঠল,—সে একা যত ছেলের সর্বনাশ করেছে তারাও যদি প্রত্যেকে ততগুলো ছেলেকে মজিয়ে থাকে তাহলে আজ গাঁয়ে গাঁয়ে শহরে শহরে দেশে দেশে তার অঙ্কুরিত বিপুল সর্বনাশের তো আর অন্ত নেই। সেই তো দেশের সমাজের সত্যিকার শত্রু, অথচ তার দণ্ড দেবার কেউ নেই। জাতির যৌবনের ভাণ্ডার লুণ্ঠন করে সে তা অকাল বার্ধক্যে শূন্য করে দিচ্চে, যারা মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঙলার মুখ আলো করত, ছেলে বয়স থেকেই তাদের দেহ মন আত্মা, রোগ লালসা আর মিথ্যায় ভরে দিচ্ছে। তারই মতো অকাল-যৌবন-গ্রস্ত ছেলেদের জ্বালানো অত্যাচারের আগুনে, কে বলবে, ঐ মোহনের মতই কত অজ্ঞান ও অশক্ত ছেলে আজ আত্মবলি দিয়ে বাংলাদেশে ছেলে-হয়ে-জন্মানো-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করচে।
তারপর থেকে রোজই দুপুরে সে মোহনের কাছে আসত, কখনো কখনো নানারকম সন্দেশ এনে তাকে খাওয়াত, ঘরের পর খাবার খেতে তার বেশ লাগত। মোহন বিছানায় শুয়ে থাকত, তার পাশে বসে তারেশ কত কী মজার মজার গল্প বলত, সেসব কথায় মোহন ভারি আমোদ পেত। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, চুল টেনে দিত, গাল দুটি আস্তে আস্তে টিপত,—এই সব ছোটো খাটো বৈশিষ্ট্যে মোহনের মনে সে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারেশ চলে গেলে মোহন নিজের হাতে গাল টিপে দেখত—তারেশের আদর তার এত ভালো লাগে কেন তাই সে বুঝবার চেষ্টা করত।
এমনি হতে হতে একদিন একটু বেশি দূর গড়াল। স্কুলের ছুটির পর ছেলেরা বোর্ডিংএ ফিরচে, সুপারিন্টেণ্ডেন্ট বোর্ডিংএ ঢুকছেন, এরই মধ্যে মোহনের কাছে বিদায় নেবার সময় তারেশের মাথায় হঠাৎ খুন চেপে গেল,—সে দুহাতে মোহনের মুখখানি কাছে টেনে তার গালে একটি চুমু খেয়ে চলে গেল। সমস্ত রক্ত এক পলকে মোহনের মুখে ছুটে এল, সে চট করে হাতে গাল মুছে নিল, সেই মুহূর্তে সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট ঘরে ঢুকে সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু তাঁর কথার সুর মোহনের কানে গেলেও সে এতো অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে কিছুই বলতে পারল না।
তার পরের দুপুরে আবার তারেশ এল। মোহনের একটু ভয় ভয় করছিল, কিন্তু কথাবার্তায় আগের ঘনিষ্ঠতা ক্রমে সহজ হয়ে এল। মোহন আজ তারেশের পাশেই বসে গল্প করছিল, তারেশ আস্তে আস্তে তাকে কোলের উপর টেনে নিল। তার বাহু-পাশের মধ্যে বাঁধা পড়ে বাধা দেবার এতটুকুও শক্তি মোহনের এল না, হয়ত ইচ্ছাও হলনা। তারেশ অনায়াসে তার বন্দীর মুখে চোখে গালে কপালে অনেক চুমো দিল, মোহনের যখন বুদ্ধি কিরল তখন সে একবার মুক্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে অসহায়ের মত আদরের অত্যাচার সহ্য করতে লাগল।
তারপর থেকে সে তারেশকে একটু এড়িয়ে চলত, কিন্তু সুযোগ পেলে তারেশ তার সঙ্গ ছাড়ত না, নানারকম ছলছুতো করে মোহনের চুমো আদায় করত। সে কখনো কখনো বাধা দিত, কিন্তু তাতে তারেশের আবেগ আরো উগ্র হয়ে উঠত মাত্র। মোহন ধরে নিয়েছিল তারেশ তাকে ভালোবাসে, এবং চুমোটা অনাবশ্যক হলেও ওটা ভালোবাসার অনিবার্য বিপদ, ওকে অস্বীকার করা চলবে না। কিন্তু অশান্তও ত তাকে ভালোবাসে তার শান্ত স্নেহের মধ্যে সে যেমন আনন্দের স্পর্শ পায়, তার বুকে আশ্রয় নিলে যে স্নিগ্ধ শাস্তির হাওয়া তার গায়ে লাগে, অশান্ত তাকে যত প্রাণের মত ভালোবাসে—এই কথা যখন ভাবত তখন তারেশের ভালোবাসা তার কাছে কেমন কেমন মনে হত। সে অবশেষে স্থির করল তারেশের সব ভালো, কেবল ঐ আদরের বাড়াবাড়িটা বাদে।
অবশেষে সর্বনাশের সূচনা একদিন ঘনিয়ে এল। তারেশ মোহনের চুমু খেত বটে, কিন্তু আর কোনো কল্পনা তার মনে তখনো স্থান পায়নি, সে ভেবেছিল কেবল এক-আধটু আদর করা ছাড়া এই ছেলেটিকে তার ও তার দলের কুসঙ্গ থেকে নিরাপদ রাখবে,—কিন্তু শনি যদি কাউকে ভালবাসে তাহলে সে যেমন তার মুণ্ডপাত ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না, তেমনি মনে মনে ভালো করবার ইচ্ছা থাকলেও, স্বভাবত সর্বনাশ ছাড়া হতভাগা তারেশের কাউকে দেবার আর কিছু পুঁজি ছিল না,—সে এতদিন তার একান্ত প্রিয়জনদের নিজে হাতে যে মৃত্যু-গরল পরিবেশন করে এসেচে মোহনের বেলাও তার অন্যথা হলনা।
মোহনের মামা নরেন্দ্রবাবু তখন দূরের এক থানায় বদলি হয়ে ছিলেন, সেখান থেকে তার স্কুল ও বোর্ডিংএর খরচের টাকা তিনি মনিঅর্ডার করে পাঠিয়েছিলেন,—মোহন সেটা বিছানার তলায় গুঁজে রেখেছিল কিন্তু পরে আর খুঁজে পেলনা। এই সামান্য চুরি নিয়ে হৈ চৈ করা তার শান্ত স্বভাবের বিরুদ্ধ, অথচ স্কুলের বেতন আর বোর্ডিংএর চার্জও নির্দিষ্ট দিনে দিতে হবে, নইলে মহা মুস্কিলে পড়বে, কি করে, সে যেন অকূল সমুদ্রে পড়ে গেল।
অশান্তকে একথা বলা চলেনা, কেননা সে অত টাকা যোগাড় করতে পারবে না কেবল অযথা ব্যস্ত হয়ে উঠবে, কাজেই সে ভেবে চিন্তে অবশেষে তারেশের কাছে গেল। তারেশকে ঘটনাটা জানিয়ে বলল, এই টাকা হারিয়ে ফেলেচি জানলে মামা বড় রাগবেন, অথচ এদিকে স্কুলে নাম কাটা যায়, কি করব আমি কিছুই ঠিক করতে পারচিনা।
তারেশ বল্লে, “হারিয়ে ফেলেচো তা কি হয়েছে। তুমি কিছু ভেবনা। আমি এক্ষুনি দিচ্ছি, কটাকা চাই? পনের টাকা?”—তখনই সে টাকাটা দিয়ে দিল।
মাথা থেকে বোঝা নেমে গেলে যেমন অপূর্ব সুখ হয় তেমনি খুশিতে মোহনের সারা মুখ ভরে গেল। তারেশকে তার এমন ভালো লাগল, যে তার মনে হল তারেশদাকে এত ভালো সে কোনদিন বাসেনি। সে তারেশের হাত চেপে ধরল, হাতখানা তার মুখের উপর টেনে আনল।
তারেশ একটুক্ষণ কি ভাবলে, তারপর বললে, “একটা কথা আছে, রাত্রে খাবার পর আমার ঘরে এসো বলবো।”
মোহন তখনি রাজি হয়ে চলে গেল। তারেশদার কথাটা সে বুঝতে পারল, সে ভাবল এমন স্নেহময় সহৃদয় তারেশদার আদরের অত্যাচারে আর সে কোনোদিন বাধা দেবেনা, যদি পারে সেও তারেশকে দাদার মত শ্রদ্ধাভরে ভালবাসতে শিখবে। অনাহত কিশোর সে, তখনো বুঝতে পারেনি তারেশ তুচ্ছ পনের টাকার বিনিময়ে তার সব স্বপ্ন সব শ্রদ্ধা এক নিমেষে ভেঙে দিতে কি নিষ্ঠুর আঘাত সেই রাত্রে তার জন্য উদ্যত রেখেছিল।…
—এমনি করে স্বর্গের ফুল দানবের লালসার তাপে দিন দিন শুকোতে লাগল।
১৬
প্রাণের দরদ দিয়ে সতীশ যখন জিজ্ঞেস করল তখন এই সর্বনাশের কাহিনী মোহন অকপট চোখের জলে তার কাছে বলল। সব শুনে সতীশ স্তম্ভিত হয়ে গেল,—এতটা তার ধারণার বাইরে ছিল। সে মোহনকে স্বাস্থ্যতত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব সব আলোচনা করে বুঝাল কেমন করে ক্ষণিক সুখের প্রলোভনে উত্তেজনার বশে এই আত্মঘাতের ফলে ছেলেরা দেহে মনে রুগ্ণ অকেজো হয়ে পড়ে, কেমন করে তাদের জীবন যৌবন ভবিষ্যৎ, ঘুণধরা বাঁশের মত থেকেও থাকে না—মোহন প্রতিজ্ঞা করল সে আর তারেশের ছায়া মাড়াবে না, এবং এই ভয়ানক কাজ জীবনে দ্বিতীয়বার করবে না।
তখন তারেশকে ভালো করা সতীশের সংকল্প হল, সে দেখল কেবল তারেশের এই রোগ সারলে অনেক ছেলের ভবিষ্যৎ বিপন্মুক্ত হয়, সে আর নতুন ফাঁদ না পাতলে ইতিমধ্যে তার ফাঁদে যারা পড়েচে, যে করেই হোক তাদের উদ্ধার করা তার পক্ষে সহজ হবে।
কয়দিন সুযোগমত তারেশকে না পেয়ে অবশেষে একদিন বিকেলে পথে তাকে পাকড়াও করল, “একি তারেশ যে! কোথায় চলেচে?”
তারেশ মৃদু হেসে বললে, “সুভদ্র হরণে বেরিয়েচি।”
“তার মানে?”
“সুভদ্রাহরণ ত পুরনো ব্যাপার পুরাণে পড়েচ। এটা নতুন কিছু।”
এই সুভদ্রাহরণ-ব্যাপারটা একটু খুলে বলা দরকার। সব শহরেই ছেলেশিকারীদের একাধিক দল থাকে। একটি বা দুটি রাঙা ছেলেকে কেন্দ্র করে তার উপাসকদের একটি দল গড়ে ওঠে, রাঙা ছেলেটি হয় সেই দলেরই মক্ষিরাণী। অন্যদলের বা বাইরের কোন ছেলের তার সঙ্গে ভাব করবার কোনো দাবি থাকে না, তার রক্ষণ ও ভক্ষণ করবার কেবল তার দলের ছেলেদেরই একমাত্র অধিকার।
এক দলের রাঙা ছেলেকে যদি অন্যদলের চোখে ধরে তাহলে তখন কুরুক্ষেত্রের মত দলাদলি বেধে যায়, মারামারি লাঠালাঠি করে অপর দলকে হঠিয়ে তাদের রাঙা ছেলেটিকে ছোঁ মেরে লুঠে আনতে হয়। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা, যে দলের জোর বেশি তারা জেতে, ছেলেটি সেই দলেরই পাত্র হয়ে পড়ে—এই নিয়ম। তখন থেকে সে তাদের সঙ্গেই মেশে, খেলা করে, বেড়ায়, আড্ডা দেয়, আগের দলের বন্ধুদের কথা তার মনেও থাকে না।
এই রকম একটি শিকারের অভিযানে তারেশ বেরিয়েছিল। তার দলবল আগেই চলে গেছে।
সতীশ কহিল, “এই রকম ছেলের পিছু পিছু ঘুরতে তোমার ভালো লাগে? এই সব কাণ্ডে কোনদিন তুমি প্রাণ হারাবে।”
তারেশ, কিছু না বলে গুন্ গুন্ করে গাইল,—
“বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্ব জয়;
এ কি গো বিস্ময়!
অস্ত্র তোমার গোপন রাখ কোন্ তুণে।”
“দ্যাখো সতীশ, কাল এই ছেলেটিকে বাগাতে গিয়ে কি বিপদে পড়েছিলুম,—কেবল সমুদ্র মন্থন করাই সার হলো, লক্ষ্মী লাভ হলোনা।”
তারেশ তার হাতের পাট খুলে আঙুলের মূলের দগ্দগে ক্ষতচিহ্ন দেখাল, “এই দেখ।”
সতীশ চমকে বললে, “একি!”
তারেশ হেসে বললে, “স্বর্গ দখলের চেষ্টা করার এটা উপসর্গ। কাল তাদের দলের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের লড়াই যখন খুব জমে উঠেছে, তারা হেরে যায় আর কি—আমি ছেলেটির হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছি, এমন সময়ে ওদের এক ব্যাটা কোথা থেকে এক গাদা বন্দুক নিয়ে এসে হাজির, আমার ওপর গুলি চালাবে। বন্দুক দেখে আমাদের দলের যত বীরপুরুষ আমাকে ফেলে চম্পট দিল, আমি একা গিয়ে সেই বন্দুক চেপে ধরলুম। গুলিটা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল, বন্দুক ছাড়াতে না পেরে হতভাগাটা পকেট থেকে ছুরি বের করে হাতে বসিয়ে দিয়েছে। এ হচ্ছে সেই।”
সতীশ কহিল, “তবে লাভ তো যোলো আনা হয়েছে।”
তারেশ বললে, “নেহাৎ মন্দ লাভ হয় নি। হাত দিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত পড়চে, তখন সেই রাঙা ছেলেটিই নিজের কাপড় ছিঁড়ে হাত বেঁধে দিল,—এটুকু বড় কম লাভ নয়।” ক্ষত-আবরণের ওপর চুমু দিয়ে তারেশ বললে, “আমার মনে হয় ছেলেটি আমাকে ভালোবেসেছে, টানের জোর যাবে কোথায়?”
সতীশ বললে, “রোমান্টিক অ্যাভভেঞ্চার বটে, কিন্তু ওই আহত হাত নিয়ে আজই আবার কেন?”
তারেশ বলল, “তার পাণি গ্রহণ করতে। ছেলেটিকে, বলতে কি, আমার একটু ভালো লেগে গেছে। সে যদি আমার সঙ্গে চলে আসতে চায় তবে তাকে কে ধরে রাখতে পারে? আজ আমি একাই তাকে ভুলিয়ে আনতে চেষ্টা করব, কিন্তু যদি দেখি গতিক সুবিধা নয়, দলের ছেলেরা আশেপাশেই থাকবে, অমনি যুদ্ধং দেহি বলে ঝাঁপিয়ে পড়ব।”
সতীশ কহিল, “চমৎকার প্ল্যান। কিন্তু আমি একটা কথা বলি, “এই ছেলেশিকারের কাজ কি ভালো?”
তারেশ বললে, “ভালো কি মন্দ তা ভাই জানিনে, তবে এই শিকারের প্রবৃত্তি সেই আদিম যুগ থেকে মানুষের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাছই কর, আর বাঘই কর, মেয়ে কর আর ছেলেই কর সবই শিকার, মানুষের হাজার রকম পেশার কথা ভেবে দেখ তাহলে বুঝবে মানুষ-শিকার করেই মানুষ বেঁচে আছে। আর শিকার করতে যে আনন্দ, সমস্ত স্নায়ু যেন ঝন ঝন করে বাজতে থাকে, ধমনীতে ধমনীতে রক্ত-ধারা যেন নেচে চলে!”
সতীশ বলল, “কিন্তু এই দেহ ছাড়া হৃদয় বলে একটা জিনিস আছে, তাকে জয় করাই সত্যিকার আনন্দ।”
তারেশ কহিল, “হৃদয় জয় করা, তার অর্থ তো আরও নিগূঢ় ভাবে শিকার করা ছাড়া কিছু নয়। বুঝে দেখ।”
সতীশ কহিল, “এই মনহীন দেহ হাতে পাওয়া মানে ক্যাশ বাক্স হারিয়ে কেবল তার চাবিটি পাওয়া,—সেটা কত বড় দুঃখ, তাকে তুমি বলচ সুখ?”
তারেশ কহিল, “বলচি বই কি। তোমারি কবি বলেছেন,
“মন নিয়ে কেউ বাঁচে নাক মন বলে যা পায়রে,
কোন জন্মে মন সেটা নয় জানে না কেউ হায়রে!”
সতীশ বলল, “কবি তোমার মাথা বলেছেন। সত্যিকার ভালোবাসা পেলে আর ভালোবাসতে পারলে তোমার সারাজীবনের ভুল এক মুহূর্তে বুঝতে পারতে, আমাকে এত কষ্ট করে বোঝাতে হত না।”
তারেশের মুখ পলকের জন্য মলিন হয়ে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে হেসে বলে উঠল, “কিন্তু তোমার কবির মতেই আমাদের মত সতীশ!—
“চাইনেরে মন চাইনে!
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই,
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নেরে মন তাই নে!”
একজন চানাচুরওয়ালা পথ দিয়ে হেঁকে যাচ্ছিল, তারেশ কিছু চানাচুর কিনল, সতীশকে দিতে গেলে সে বলল, “আমি পথে যেতে যেতে খাইনে।”
তারেশ কহিল, “সব জিনিসই পথে খেতে বেশি মিষ্টি। এমন কি যে বস্তু লোকে স্থির হয়ে খায় এবং খেয়ে স্থির হয়ে যায়, আমি তাও পথে চলতে চলতে খেতে ভালোবাসি।”
সতীশ গম্ভীর হয়ে গেল, কিছু বলল না।
তারেশ বলে চল্ল, “সত্যি ভাই, এই চুমো জিনিসটা অপূর্ব—আমার মতে মানুষের সব চেয়ে বড় সৃষ্টি, আমি যতই এই বিষয়ে ভাবি ততই তন্ময় হয়ে যাই।—
“এই বস্তু কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে,
যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।”
সতীশ কিছু কহিল না।
তারেশ বলল, “তুমি মিছে রাগ করচ ভাই! ভেবে দেখ আমার বড় দোষ নেই;—তোমাদের সমাজ মেয়েদের পিঁজরের ভেতরে বন্দী করে রেখেচে, তাদের পাচ্ছিনে, তাইত তাদের ভাইদের ভালোবেসে এই Noble Revenge নিচ্চি।”
সতীশ রাগ করে বলল, “ভালোবাসো—এই কথা বলতে মুখ কালো হচ্ছে না! এরই নাম ভালোবাসা! অকাল-যৌবন যে অকাল বার্ধক্যের গোড়া এ তুমি জানো, জেনেও ছেলেদের জীবনে সেই সর্বনাশ ভরে দিচ্চ। বাঙলা দেশে তোমরাই সৌন্দর্যকে অভিশাপ, বন্ধুত্বকে বিপদ, আর ভালোবাসাকে হত্যার কাজ করে তুলেচ! যাক, তোমাকে বোঝানো বৃথা, তবে এই বলে যাচ্ছি, অবসর হলে ভেবে দেখো, তোমাদের কথা মনে হলে আমার রাগও ধরে, দুঃখও হয়।”
মোড়ের মাথায় সতীশ অন্যপথে ফিরল, তারেশের দিকে ফিরেও চাইল না। তারেশ খুব গম্ভীর হয়ে গেল,—কিন্তু যার শিকারে বেরিয়েছিল অনতিদূরে একাকী তাকেই দেখে জোর করে মুখের ওপর হাসির আবরণ টেনে দিল।
১৭
বিকেলে বেড়াতে যাবার জন্য অশান্ত বোর্ডিংএর ঘরে ঘরে মোহনকে খুঁজে বেড়াচ্চে, মোহন সেই সময়ে ছাতের সিঁড়ির ঘরে একটা দীর্ঘ পত্র অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়তে নিযুক্ত ছিল।
সে এই চিঠিখানি সেদিন টিফিনের ঘণ্টায় স্কুলে পেয়েচে, যে ছোট ছেলেটি দৌত্য কাজে এসেছিল সে চিঠিখানি মুড়েসুড়ে তার গায়ে ফেলে হেসে পালিয়ে গেল,—চিঠিটা খুলে দুএক ছত্র দেখেই তখন থেকে সে বুক পকেটে লুকিয়ে রেখেছে। সিঁড়ির ঘরে কদাচ কেউ আসে, সেইখানে বসে তার প্রণয়প্রার্থী কোন্ অজ্ঞাত বালকের এই গোপনীয় প্রেমপত্রখানি সে চুপিচাপি পড়ছিল।
এই ধরনের চিঠি পেতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এই ভাবে চিঠি পাওয়া ভালো না লাগলেও তার মন্দ লাগত না, –পড়ে শেষ করেই এই লোভনীয় আপদগুলো সে পুড়িয়ে নিঃশেষ করত।
একটি ছেলে তাকে প্রায়ই ‘বৌদি’ সম্বোধন করে পত্র লিখত। এ চিঠিখানি তার নয় সে বিবেচনা করল,—এটি কার রচনা হতে পারে অনেক ভেবেও সে ঠিক করতে পারল না। চিঠিখানি আগাগোড়া প্রেমের উচ্ছ্বাসে ভরা, হয়ত কোনো নামজাদা সাহিত্যিকের উপন্যাসের রোমান্টিক নায়ক তার রোমান্টিকা নায়িকাকে যে চিঠি লিখেচে—এটি তারই ছাঁকা নকল। চিঠির সব অংশের অর্থও সে ভালো বুঝতে পারছিল না, এর প্রেরকও যে চিঠির মানে জানত এমন বোধ হয় না।
এর সঙ্গে পূজার ছুটিতে অশান্ত তাকে যে সব চিঠি লিখেছিল তার তুলনা করল। অশান্তের চিঠিগুলো সাধারণ নয়, অথচ কত সহজ সরল, পড়লেই তার অর্থ যেন মনকে গিয়ে স্পর্শ করে। সে তাকে ‘ভাই অশান্ত’ বলে লিখত, অশান্ত ‘প্রাণের মোহন’ বলে তার চিঠি শুরু করত। সেই চিঠিগুলো কত মিষ্টি,—তাদের মোহন কত আদর করত, সব সময়ে দামী জহরতের মত সঙ্গে সঙ্গে রাখত, মাঝে মাঝেই পড়ে দেখত—এখনো তাদের চিঠিগুলো তারা কত যত্ন করে বাক্সে তুলে রেখেছে।
প্রথম প্রেমের চিঠি আর প্রথম প্রেমের চুমো মানুষের সারাজীবনের স্মৃতি মধুময় করে রাখে।
বোর্ডিংএর একটা ঘরে সেইসময়ে অশান্ত ও মোহনকে জড়িয়ে অত্যন্ত মুখরোচক একটা আলোচনা জমে উঠেছিল, মোহনের খোঁজে অশান্ত সেই ঘরে পা দিতেই ছেলেদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “এই যে মানিকজোরের একটি এখানে!”
সরিৎ অমনি তাকে লক্ষ্য করে থিয়েটারী সুরে গেয়ে উঠল,—
“পরের পরাণ তুমি কেন এলে এখানে,
যাও যাও ফিরে মন বাঁধা যেখানে!”
অশান্ত সেদিকে কান না দিয়ে প্রশ্ন করল, “মোহন কোথায় জানো?”
ভূপেন গান ধরল,—“তোমার মোহন রূপের তুলনা নাই!” এবং সেই সঙ্গে সব কটি ছেলে তাকে সপ্তরথীর মত এমনভাবে ছেঁকে ধরল যে বেচারা অশান্ত তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠল। অত্যন্ত দরকারি কাজে রাস্তা অতিক্রমের সময় পথের মোড়ে গরুর গাড়ির বহর ক্রমাগত একটির পর একটি চলতে থাকলে, গলে যাবার ফাঁক ও ফুরসৎ না পেয়ে পথিকের মনের অবস্থা যেমন হয়, বেড়াতে যাবার মুখে মোহনকে খুঁজতে এসে অশান্তর ভাবটা প্রায় সেই রকমই হল, দাঁড়াতেও পারে না, পালাতেও পারে না।
সেই সময়ে মোহন এসে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল। মোহন জানত এই ছেলেগুলি সবাই তার সঙ্গে ভাব করতে উৎসুক, অথচ সে অশান্তকে পছন্দ করে বলে এরা কেউই তাকে দেখতে পারে না, তার জন্য এদের কাছে অশান্তকে অনেক খোঁটা সইতে হয়। বিপুল কলরব ঝটিকার মুখে বিভ্রান্ত অশান্তর পাশে সে নীরবে এসে দাঁড়ালো, কোমল হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল, এবং ইচ্ছা করেই এতগুলো ছেলের সামনে তার গালে সুনিবিড় একটা চুমু দিল।…কেউ যার লাঞ্ছনার বাকি রাখল না, সুন্দর নিজে তার তপ্ত ললাটে জয়টীকা রচনা করে দিলেন।
অশান্ত এতক্ষণ পক্ষ সমর্থনের জন্য সমবেত চিৎকারের বিরুদ্ধে নিজের কণ্ঠস্বরকে যথাসাধ্য উচ্চ করবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু মোহনের চুমুতে কি ছিল জানি না, এর পরে সে একেবারেই নীরব হয়ে গেল, তর্ক চালাবার তার কোনো উদ্যম রইল না, সমস্ত কলরব তার কানের বাইরেই পড়ে রইল। তার বিপক্ষ ছেলেদেরও যেন জোর কমে গেল, কেউ মুচকি হাসল, কেউ ক্ষুণ্ন হল, কেউ রাগল, কিন্তু সকলেই মনে মনে বুঝল জয় অশান্তরই হয়েচে।
অশান্ত কিন্তু খানিক পরে একাকী নীরবে বেরিয়ে গেল, মোহনের জন্যই যে সে এখানে এসেছিল, মোহনকে নিয়ে বেড়াতে যাবে, এ কথা তার মনেই পড়ল না, সে তন্ময়ের মত হন হন করে হেঁটে চলল। মোহনের এই চুমুটি তার কতদিনের কামনা, কত রাত্রে ঘুমিয়ে সে এরই স্বপ্ন দেখেছে—এই স্বর্গের সৃষ্টি মর্তের মিষ্টি পরম আনন্দ। অশান্তর স্নায়ুতে স্নায়ুতে যেন অগোচরে এরই তৃষ্ণা জড়িয়ে গেছল—এটি পেতেই তার সব শিরা-ধমনী যেন এক সঙ্গে বেজে উঠে বলল—পেয়েচি, পেয়েচি! শরীরের সমস্ত লোমকূপ যেন এই আঙ্গুরের রস পান করে মাতাল হয়ে উঠল—অশান্ত অভিভূতের মত পথ চলতে লাগল।
শুধু তাই নয়, মোহন আজ সকলের সামনে নিঃসংশয়ে জানাল সে অশান্তকে ভালোবাসে, তাকেই চায়। মোহন আজ তার ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা দিল। এতগুলো ছেলের সামনে সে যে দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে, ভালোবাসায় এত বড় বুকের পাটা হয় বটে, কিন্তু বোর্ডিংএ বাস করে এতজনের সন্দেহ বিদ্রূপ ও ঈর্ষাভাজন হয়ে একজন ছেলের এতটা বেপরোয়া ভাবের পরিণতি কোথায় হবে কে জানে! মোহন যে আজ তাকে বিপদের মধ্যে বরণ করে নিল এই দুঃসহ সৌভাগ্যের আত্মহারা পুলকে অশান্তর দুচোখে জল এল!
অশান্তর সারা বুক আনন্দের আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, তার ইচ্ছা হচ্ছিল সে খুব লাফায়, খুব ছুটে বেড়ায়, জলে পড়ে খুব সাঁতার কেটে এই ভয়ানক খুশির উপশম করে। পথের ধারে একজনের ঘোড়া বাঁধা ছিল, সে তার লাগাম খুলে লাফিয়ে চেপে বসল, পাগলের মত তাকে দিগ্বিদিকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল।…
তার পরদিন অশান্ত নদীতে স্নান করে বোর্ডিংএ ফিরচে, মোহন সেদিন তার সঙ্গে ছিল না, দূরের একজনকে দেখে তার মনে হল—নিশ্চয়ই তার দেবেনদা। দেবেন সেদিনই সকালে মালদায় এসেছিল।
কাছে আসতেই অশান্ত ছুটে গিয়ে ভিজে কাপড়েই দেবেনকে জড়িয়ে ধরল।—“দেবেন দা!”
কলকাতায় থাকতে দেবেন ও অশান্তর ভালোবাসা খুব নিবিড় হয়ে উঠেছিল তার অনেক দিন পরে এই দেখা! অশান্ত অত্যন্ত খুশিতে দেবেনের বাহুমূলে কামড়ে দিল।
দেবেন তার কপালে একটা টু মেরে বললে, “কিরে, কেমন আছিস?”
“খুব ভালো।”
তার ভঙ্গী দেখে একটু হেসে দেবেন বল্লে, “খুব ভালো? বেশ। পড়াশুনা কেমন হচ্চে?”
“খুব চমৎকার।”
“বটে? আর দুষ্টুমি কেমন চলচে?” অশান্তর মুখখানি তুলে ধরে একটু নিরীক্ষণ করে বলল, “না, অশান্ত আর দুষ্টুমি করে না দেখচি।”
দুষ্টুমির ইঙ্গিত অশান্ত বুঝল। সে সলজ্জে ঘাড় নেড়ে বললে, “তুমি বারণ করে দিলে—সেই থেকে আর আমি করিনি।”
ভিজে চুলগুলি কপালের দুপাশে সরিয়ে দিতে দিতে দেবেন বলল, “তাই ত আমার এই ভাইটিকে এত ভালোবাসি, এত আদর করি।”
অশান্তর মুখ হাসিখুশিতে ভরে উঠল। সে উৎসাহভরে বলল, “দেবেনদা, বোর্ডিংএ চল একজনকে তোমায় দেখাব।”
দেবেন সকৌতুকে বলল, “কে সেই একজন রে? তোর নতুন বন্ধু নাকি?”
“নতুন নয় অনেক দিনের চেনা। তোমার সঙ্গে যতদিনের ততদিনের। চল না দেবেনদা।”
“আমার ভাইটিকে দেখেই সুখী হয়েছি, আর কারুকে দেখতে যাবার আমার সখ নেই।”
অশান্ত একগাল হেসে বলল, “দেখলে কিন্তু তুমি আরো ভারি খুশি হবে দেবেনদা, সে আমার চেয়েও সুন্দর।”
দেবেন তার গাল দুটি ধরে বললে, “আমার এই রাঙা ভাইটির চেয়েও দেখতে ভালো? তবে তো তাকে দেখতে হচ্চে।”
“তখন তুমি হয়ত আমাকেও ভুলে যাবে, তাকেই ভালোবাসবে।”
দেবেন একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তবে তুইও বুঝি আমাকে ভুলে গেছিস,—তাই আর চিঠি দিসনা!”
“তুমিও ত আর খোঁজ নাওনি আমার!”—অভিমানে অশান্তর ঠোঁট ফুলে উঠল।
অশান্তর মুখে একটা টোকা মেরে দেবেন বলল, “নে, আর রাগ করতে হবে না। আর কতদূর তোদের বোর্ডিং?”
“আর বেশিদূর নয়। মোহনের কাছে তোমাকে নিয়ে যাচ্চি, আমার এতো আনন্দ হচ্চে! সেও ভারি খুশি হবে দেবেনদা। এত ভালো ছেলে আমি দেখিনি, এমন ভালো মন। কারু উপর রাগতে পারে না, ঝগড়া করতে জানেনা, এত সবাই ওকে এত বিরক্ত করে, ও কিন্তু সকলকেই ভালোবাসে।”
“তুই তাকে খুব ভালোবাসিস?”
একমুখ হেসে অশান্ত জবাব দিল, “খু-উ-ব।”
দেবেন দুষ্টুমিভরা চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর সে? সে বুঝি তোকে খুব আদর করে?” নিরুত্তর অশান্তর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেচে দেখে দেবেন কথাটা ঘুরিয়ে নিল,—“আমার এমন ভাইটিকে আদর না করে কি কেউ পারে?”
অশান্ত দেবেনের হাতখানা নিজের গলায় জড়িয়ে নিয়ে চলছিল, দেবেনের অন্যত্র একটু বিশেষ কাজ ছিল, সে বলল, “আমার তো এখন সময় নেই ভাই, এখন ছেড়ে দাও। বিকেলে তোমাদের বোর্ডিংএ যাব।”
“না, সে হবেনা।”—বলে তার সেই হাতখানি অশান্ত ভালো করে চেপে ধরল, এবং অন্য হাত দিয়ে দেবেনের কটি-বেষ্টন করল।
এমন অবস্থায় পড়লে পরে সবারই মত বদ্লায়, প্রাণের টানে পড়ে দেবেনের দরকারি কাজ কোথায় ভেসে গেল। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি ছত্র তার কেবলি মনে পড়তে লাগল—
“কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা,
কাহারে কাঁদিয়ে বলে যেয়োনা যেয়োনা।
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা—
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা!”
এই নিবিড় বন্ধন ছাড়িয়ে যাবার জোর না থাকলেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বলল, “আমার যে দরকারি কাজ আছে শান্ত, এখুনি যেতে হবে।”
“যেতে দেবনা। দরকারি কাজ জানি, বোর্ডিংএ চল, সেখানে আগে নাওয়া খাওয়া করে, আজ ছুটি আছে, দুজনের সঙ্গে সমস্ত দুপুর গল্প করতে হবে। তারপরে বিকেলে আমরা বেড়াতে বেরুব।”
“তবে দেখচি আজ আমার আর ছুটি নেই। আচ্ছা এখন যাচ্ছি চল,—খেয়ে-দেয়ে কিন্তু আর ধরে রাখা চলবে না। আমি এবার এখানে দিনকত থাকব কিনা, একটা ভালো বাসা দেখতে হবে।”
“আচ্ছা ছাড়া চলবে কিনা সে মোহনের হুকুম নিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর বিবেচনা করা যাবে।”
ততক্ষণে তারা বোর্ডিংএ এসে পৌঁছেচে। অশান্ত দূরে মোহনকে দেখিয়ে দিল,—“ওই ওই ওই!”
মোহন কাছে আসতেই দেবেন তাকে চিনে ফেলল, এ যে তার সেই রেলপথের সাথী। সে বলল, “অশান্ত এ যে আমাদের মোহন!”
মোহন কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, “দেবেনদা! হঠাৎ কোথা থেকে?”
অশান্ত অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল, “মোহনকে তুমি চেন নাকি? কি রকম?”
মোহনকে দেবেনের কাছে পরিচিত করে দেবার আনন্দ মোহন দেবেনের পরিচিত জানার সঙ্গে সঙ্গে, পলকের জন্য যেন নিবে গেল, কিন্তু পর মুহূর্তেই তার চিত্ত আবার নতুন আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল।
১৮
তারেশ দিন দিন সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছিল। অবনতির এমন একটা সীমা আছে যেখানে নেমে হয় থেমে থাকতে হয় নয় উপরে উঠতে হয়, সে বোধ করি সেই লক্ষ্যেরই খোঁজে বেরিয়েছিল। আজকাল মাঝে মাঝে সে বাইরে নিশাযাপন করতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল, সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট মশায় একদিন রাত্রে তাকে বোর্ডিংএ না পেয়ে পরদিন আড়ালে ডেকে খুব ধমকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তাতে তার মনে অত্যন্ত বৈরাগ্যের সঙ্গে একান্ত রাগের সঞ্চার হয়েচে,—সে বোর্ডিং ছেড়ে চলে যাবে সেও স্বীকার তবু একবার সুপারিন্টেণ্ডেণ্টকে দেখে নেবে!
সুপারিন্টেণ্ডেন্ট মশায় এক-এক দিন নিশীথ-রাত্রে উঠে আঁধারে আলো হাতে নিয়ে বোর্ডিংএর ঘরে ঘরে ছেলেদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন, অনেক ‘ঘুমন্ত’ ছেলেই তা জানত, তারেশও জানত। কিন্তু তারা যে জানে অবিনাশবাবুর তা জানা ছিল না। তারেশ এক দিন গভীর রাত্রে এই অবস্থায় তাঁকে পাকড়াও করে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে এই মতলব আঁটল।
এমনি এক গভীর রজনীতে অবিনাশবাবু তাঁর চোরাবাতি হাতে নিয়ে বোর্ডিংএ ঘুরছেন, তারেশ টের পেয়ে মাথার কাছে তার মোটা বাঁশের লাঠিটা রেখে নিজের বিছানায় অকাতরে ঘুমিয়ে পড়ল। অবিনাশবাবুর ধারণা ছিল তাঁর এই কাজে ছেলেদের সম্বন্ধে অনেক অভিজ্ঞতা বাড়ে, কিন্তু আজ যে সেই অভিজ্ঞতা একটু বেশি মাত্রায় তাঁর জন্য সঞ্চিত ছিল তা তিনি কল্পনা করেননি। অবিনাশ বাবু ছেলেদের আন্তরিক ভালোবাসতেন, এবং তাঁর এই কাজের মূলে ছিল তিনি ছেলেদের গোপন অবস্থা অবগত হয়ে তাদের সত্যিকার কল্যাণ কাজে আসতে পারবেন—এই একান্ত ইচ্ছা।
কোনো কোনো ছেলে ঘুমের ঝোঁকে কথা বলছিল, তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কথা শুনে তাদের মনের মর্ম উদ্ধার করবার চেষ্টা করছিলেন। একটি ছেলে ঘুমের ঝোঁকে বিছানায় লাফিয়ে বসে চেঁচিয়ে উঠল—“গোওল!” আরেকটি ছেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁকছে—“সুবোধ, সুবোধ, পাস হিয়ার।” তারা ফুটবল মাঠের স্বপ্ন দেখছে। অবিনাশবাবু একটু হাসলেন, তারপরে উপবিষ্ট ছেলেটিকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অন্য ঘরে একটি শিশু ছেলে অস্ফুট কণ্ঠে বকচে—“বড় লাগচে আর মারবেন না সার্।” সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল,—অবিনাশবাবু অন্ধকারে তার মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন, এই শিশুকেও প্রাণ ধরে মারতে পারে এমন কসাই মাস্টারও দুনিয়ায় আছে! একটি ছেলে বুকে হাত বেধে ভয়ানক স্বপ্ন দেখে গোঁ গোঁ করছিল, তিনি চট্ করে তার কাছে গিয়ে হাতখানি তুলে পাশে রেখে দিলেন। ছেলেটি স্বপ্ন দেখছিল এক পাগলা হাতি ক্ষেপে গিয়ে তার পেছনে দৌড়চ্চে, সে কিন্তু কিছুতেই পালাতে পারচেনা, অবশেষে সে পড়ে গেচে, আর হাতি এসে তার বুকে পা চাপিয়ে দিয়েছে, বুকের হাড় পাঁজরা সব মডু মডু করে ভেঙে যাচ্চে,—এমন অবস্থার তার বুক থেকে হাতটা তুলে নিতেই তার মুখে আবার ঘুমের শান্তি ফিরে এল।
একটি ছেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল তার বিরহী খোকা ভাইটি যেন তার কাছে এসেছে, সে আধ আধ স্বরে “মণি মণি” বলে তাকে ডাকছিল, আদর করে তাকে অনেক চুমু দিচ্ছিল—তারই অস্ফুট শব্দ অবিনাশবাবুর কানে গেল। তিনি সেখান থেকে সরে অন্যত্র গেলেন।
অন্য ঘরে একটি ছেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাকে মিনতি করছিল, ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন, আমার ভালো লাগচেনা।…ছেলেটি আরও কত কি বকে যাচ্ছিল, তিনি চুপটি করে কথাগুলো বুঝবার আশায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। বোর্ডিং-জীবনের বিচিত্র রহস্য অবিনাশবাবু জানতেন, তিনি এই কথার সূত্র থেকে কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারলেন, পরদিন সকালে ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে সব জানবেন এই স্থির করলেন। ঘরের অন্য কোণে তখন আরেকটি ছোটো ছেলে তার মার কাছে বায়না ধরেছিল, খেতে দে মা, বড় খিদে পেয়েছে। বোর্ডিংএর ছেলেদের উপোষী দেহ-মনের একান্ত নিবেদন!
অবশেষে তিনি তারেশের ঘরে গেলেন। বিছানায় সে আছে কিনা দেখবার জন্য কাছে যেতেই তারেশ “চোর চোর” চীৎকার করে লাফিয়ে উঠল—তিনি প্রথম ভেবেছিলেন এও এক অদ্ভুত স্বপ্ন-দর্শন! কিন্তু স্বপ্ন দেখার পদ্ধতি দেখে তিনি একটু ভড়কে গেলেন, তারেশ মোটা লাঠিটা হাতে নিচ্চে দেখে তিনি আলো ফেলে দিয়ে লাঠিটা সবলে ছিনিয়ে। নিলেন। তারেশ তাঁকে দুই হাতে চেপে ধরে তখনো হাঁকছে–চোর, চোর!
তিনি কম্পিত স্বরে বললেন, “ও তারেশ আমি চোর নই। আমি, আমি।”
“কে তুমি, আমার ঘরে এত রাত্রে কেন? কি জন্য?”
“ও তারেশ, আমি সুপারি—আমি সুপারি!”
সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের বাকি দ্বিতীয় ভাগের অংশটা তাঁর ভয়াতুর কণ্ঠ দিয়ে বেরুল না।
“আমি পান-সুপারি জানিনে। আর এত রাত্রে আমার ঘরে পান-সুপারির আমদানি পছন্দ করিনে!”
তারেশ তখনো তাঁকে জোরে জাপটে ধরে রয়েছে। তার হাঁক-ডাকে ঘরের ছেলেদের ঘুম ভেঙে গেল, তারা লণ্ঠন জ্বেলে, যার হাতের কাছে যা ছিল,—পেন্সিল টানা রুল, কাগজকাটা ছুরি, ক্রিকেট ব্যাটের ভগ্নাংশ—তাই হাতে নিয়ে অগ্রসর হয়ে চোরকে দেখে সবিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল—এ যে মাস্টার মশাই!
তারেশ তৎক্ষণাৎ তাঁকে ছেড়ে দিল, “এ্যাঁ, সে কি! মাস্টার মশাই?”
মাস্টার মশাই মানে মানে মুক্তি পেয়ে, তারেশ সুযোগক্রমে যে কয়টা অন্তর টিপুনি তাঁকে দিয়েছিল তারই ঠেলায় তখন হাঁপাচ্ছিলেন, তাঁর মুখে কথা সরল না।
তারেশ বলল, “মাস্টার মশাই, আপনি এত রাত্রে এখানে!”
“এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলুম বাবা, ভাবলুম—”
যাই ভেবে থাকুন, কিন্তু কী ভয়ানক! যদি চোর মনে করে আমি মোটা লাঠিটা আপনার মাথায় বসিয়ে দিতুম তাহলে আপনি ত মরতেনই, আমাকেও গুরু-হত্যার পাপে পাতকী করতেন!”
অবিনাশবাবু শিউরে উঠে বল্লেন, “যা হয়ে গেছে গেছে, আর হবেনা বাবা। তোমরা ঘুমাও।”
“আমরা ঘুমুচ্চি, কিন্তু আপনি এত রাত্রে–! মাস্টার মশাই, বলতে কি, আপনার ওপর আমাদের কত শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু, আপনার এই রোগ?—”
ইঙ্গিতটা বুঝে অবিনাশবাবু লজ্জায় ঘেমে উঠলেন, তিনি নিজেই যেন চোর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই এমন কথারও প্রতিবাদটুকু করতে পারলেন না। এই লাঞ্ছনার জন্য মনে মনে নিজের কান মলতে মলতে, অপরাধীর মত তিনি ঘাড় হেঁট করে চলে গেলেন। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে বোর্ডিংএ ভয়ানক ভূতের উৎপাৎ শুরু হল। বোর্ডিংএর কোণে উনুনের ছাই-গাদার পাশে কে যেন নাকি সুরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। সন্ধ্যার পর ছেলে বুড়ো সকলেরই গা ছম্ ছম্ করতে শুরু হলো। রোজই রাত্রে এই কান্না! কারু সাহস হয় না গিয়ে দেখে। সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের এ বিষয়ে কর্তব্য ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর অভিজ্ঞতা লাভ ঘটেছিল, আবার ভূতের হাতে মার খেতে তিনি রাজি ছিলেন না।
অবশেষে এক দিন রাত্রে সকলে খেয়ে দেয়ে আঁচাচ্ছে, এমন সময়ে বোর্ডিংএর উঠানে কোথা থেকে সশব্দে কি একটা পড়ল। আলো নিয়ে গিয়ে সেটিকে দেখে সকলের চক্ষু স্থির! মড়ার মাথার খুলি, সাদা সাদা দাঁত বের করে বিকট হাসছে! সেদিন ভয়ে সকলের ঘন ঘন বুক কাঁপতে লাগল।
তারপর থেকে রোজই মড়ার মাথা পড়তে লাগল। এক একদিন মড়ার হাড়-গোড়ে মাথার খুলিতে সমস্ত উঠোন ভরে যেত। সারা শহরের লোক ব্যাপার দেখতে জমত,—কিন্তু কোথা থেকে পড়ে, কে ফেলে, কেউই ঠিক করতে পারে না, সকলে দাঁড়িয়ে দেখছে তারই মধ্যে এসে পড়ছে। একজন খুব সগর্বে আস্ফালন করছিলেন, “ভূত না আরো কিছু! এসব বদ লোকের কাজ। এই বিজ্ঞানের যুগে–!” তাঁর কথা আর শেষ হল না, তাঁরই কানের পাশ দিয়ে একটা মড়ার মাথা ছুটে এসে সকলের সামনে পড়ল। বক্তা বিবর্ণ-মুখে কাঁপতে লাগলেন।
অবশেষে এক সপ্তাহ পরে একদিন আপনিই উৎপাত বন্ধ হয়ে গেল,—কিন্তু সেই ভয়ের জের চলল বহুদিন ধরে। খাওয়া-দাওয়া করে ঘরে ঢুকলে, ছেলেরা দূরে থাক, মাস্টাররা পর্যন্ত নিতান্ত প্রয়োজনেও বাইরে বেরুতে সাহস পেতেন না। কেবল তারেশ আর তার নিশাচর বন্ধুর দল, ভূতের তোয়াক্কা না রেখে যা খুশি তাই করত, কেউ তা জানতেও পেত না।
সেদিন রাত্রে তারেশ তার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে শহরের কার বাড়ি থেকে খাসী চুরি করে এনেছিল, বোর্ডিংএর রান্নাঘরে এতক্ষণ সেটাকে কেটেকুটে পাক করে এখন সবাই মিলে খাওয়া শুরু করেছিল। খাসী আর মুরগী এরকম তারা প্রায়ই চুরি করে আনত।
একটা হাড় চুষতে চুষতে তারেশ বল্লে, “সে কদিন যে ভূতের খাটুনি খেটেছিলাম, এখন তা বেশ উসুল হয়ে যাচ্চে।”
বিনোদ বলল, “খাটুনি কি কম? দশ বারো মাইল থেকে সাইকেলে করে হাড়ের পাঁজা বয়ে আনা! কদ্লার শ্মশান,— কি এখানে!”
পরেশ বলল, “তার পরে বিপদ ঘাড়ে ষোল আনা! ওই বামাল আবার বোর্ডিংএ লুকিয়ে রাখা! ধরা পড়লে পত্রপাঠ বিদায়, তার সঙ্গে উপযুক্ত দক্ষিণা!”
তারেশ মাংসটা ভালো করে চিবিয়ে নিয়ে বল্লে, “মনে কর ছেলেরা যদি রাত্রে শুয়ে জানতে পারত যে তাদেরই চৌকির তলায় কারা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে রয়েছে তা হলে কী হত!”
সুরেশ বলল, “পণ্ডিত যদি জানতে পারে তার পূজোর ঘরের হাঁড়িকুড়ির মধ্যে এই পদার্থ ছিল তাহলে আর রক্ষা নেই! বেচারা পাগল হয়ে যাবে।”
বিনোদ খানিকটা ঝোল চেখে বলল, “রান্নাটা হয়েছে বেশ। যাই বল, সুরেশ রাঁধে খাসা!”
তারপর কিছুক্ষণ রান্নার গুণবর্ণনা চলল। তারেশ বললে, “আমার বড় সাধ হচ্ছে মোহনকে এনে এই মাংস খাওয়াই। কিন্তু সে ত ডাকলে আসবে না, একে ত ভূতের ভয়েই অস্থির, তার ওপরে আবার আমার ভয়!”
পরেশ বলল, “তাই ত, মোহনকে যে আর বড় তোমার কাছে দেখি না। ওর ঘাড় থেকে নামলে কবে?”
তারেশ হাড়ের টুকরা ছুড়ে ফেলে বললে, “দূর ভাই। ও আর ভালো লাগে না। ধরে বেঁধে প্রেম করা কদিন চলে। আর ছেলেটাও ভারি স্টুপিড্।”
সুরেশ জবাব দিল, “ঠিক বলেচ, ও আঙুর টক হয়ে গেছে।”
বিনোদ বলল, “ধরে বেঁধে প্রেম করা অন্যায় কিছু নয়। তবে নাসিকাটিকেও ত বাঁচাতে হবে।”
তারেশ বলল, “কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, ঐ নাকে ঘুষি মারার পরেই আমার ওকে সত্যি সত্যিই ভালো লেগেছিল। এত ছেলে আমার কাছে একটুতেই লুটিয়ে পড়েছে, কিন্তু সেদিনই প্রথম দেখলাম, একজন বাধার মত বাধা দিলে!”
প্রবোধ এতক্ষণ গিলবার কাজে ব্যস্ত ছিল, এবার বলল, “যাই হোক, তারেশ দা, আবার তুমি লেগে যাও। ছেলেদের সাইকলজি আমারও একটু জানা আছে, সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে এখন নিশ্চয় ওর আফশোস হয়েছে।”
পরেশ বলল, “যেমন তোমার একদিন হয়েছিল, কিন্তু ও সে ছেলে নয়, ছেলে দেখলেই চেনা যায়! তবে তোমাকেও বলি তারেশ, যদি সত্যিই ভালোবেসে ফেলে থাকো তবে একবার ‘যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি’ করে দেখনা কেন বাবা! জানই ত, There is nothing unfair in Love and War!”
তারেশ হেসে বল্লে, “ভালোবাসায় আর যুদ্ধে কিছু অনুচিত নেই সেকথা ঠিক, কিন্তু তা বলে ভালোবাসাকেই যুদ্ধে পরিণত করা উচিত কি?”
বিনোদ বলল, “আর তা ছাড়া তারেশ এখন গোলাপের গোলাপী নেশায় মশ্গুল! ও ছোঁড়াটা ত না জানে নাচতে, না জানে গাইতে, না জানে সাজতে, না জানে চাইতে!”
তারেশ বলল, “সত্যি ভাই, গোলাপ যা গায়! মাইরি! আজকের রাতটা খাসী খেতেই ব্যর্থ হল, কাল আর না!”
১৯
অক্ষয়বাবু সুধীরের অনুসরণ করছিলেন, তিনি সি-আই-ডির একজন কর্মচারী। কত কৌশল করেও সুধীর কিছুতেই তাঁর দৃষ্টি-পথের বাইরে যেতে পারছিল না। অবশেষে তার সঙ্গ ছাড়বার আশায় সে একটা জনবিরল গলিপথে ঢুকল, কলকাতায় বিচিত্র গলিপথের তো আর অন্ত নেই।
সুধীরকে অনুসরণ করে অক্ষয়বাবু যাচ্ছিলেন, এবং তাঁর পিছনে দুটি লোক সেই পথেই যাচ্ছিল। সেটা একটা কানা গলি, কিছুক্ষণ পরে বাধ্য হয়েই সুধীরকে ফিরে দাঁড়াতে হল। হঠাৎ সুধীরের আক্রমণ আশঙ্কা করে অক্ষয়বাবু তৎক্ষণাৎ তার ললাট লক্ষ্য করে রিভলভার তুলে ধরলেন।
সুধীর একটু মুচকি হেসে অক্ষয়বাবুকে বলল, “পিছনে তাকান মশাই।”
অক্ষয়বাবু পিছনে তাকিয়ে দেখেন, যে দুটি লোক এতক্ষণ নীরবে নিরীহ পথিকের মত পিছনে আসছিল, তাদের হাতে এক জোড়া রিভলভার তাঁরই মস্তক লক্ষ্য করে উদ্যত! অক্ষয়বাবুর মাথা ঘুরে গেল।
ততক্ষণে, তাঁর পিছনে তাকাবার অবসরে, সুধীর নিজের রিভলভার হাতে করেচে। অক্ষয়বাবুকে সে বলল, “ভানুমতীর ভোজবাজি মনে হচ্ছে, নয়? আপনাকে খুব আশ্চর্য করে দিয়েচি কিন্তু!”
অক্ষয়বাবু বল্লেন, “এ বাজিতে হেরেচি স্বীকার করি। না করে উপায় কি?”
সুধীর বলল, “দেখুন, আপনারা ভাবেন যে আপনারাই শুধু আমাদের অনুসরণ করেন, তা নয়, আমরাও আপনাদের ওপর নজর রাখি! তা নইলে কি পারি!”
অক্ষয়বাবু শুধু বললেন, “তাই ত দেখচি।”
সুধীর হেসে বললে, “এখনো যে দেখচেন এই আপনার সৌভাগ্য! আরো দেখুন, এটা একটা কানা গলি, কেউ এ পথে বড় আসে না, আর আমরা তিনজনই বিপ্লবী—ব্যাপারটা অনুমান করতে পারচেন তো? কাল সকালে বড় বড় হরফে কোন খবরটা সকলের আগে লোকের চোখে পড়বে? আপনাকে অমর করে দেবার এমন সহজ পন্থাটা ছাড়া আমরা সঙ্গত মনে করিনে।”
এই রহসাটা অক্ষয়ের কাছে বড় ভালো ঠেকল না। তবু তিনি সাহস বজায় রেখে সপ্রতিভ ভাবে বল্লেন, “আপনারা কি আমাকে কাপুরুষের মত হত্যা করতে চান?”
সুধীর বলল, “আপনার একান্ত অনিচ্ছা থাকলে তা চাইনে। তবে আপনি যদি বীরপুরুষের মত মরাই বাঞ্ছনীয় মনে করেন তাহলে আমাদের যে কোনজনের সঙ্গে ‘ডুয়েল’ লড়তে পারেন—যদি হাতের লক্ষ্য ঠিক থাকে তাহলে আপনি একে একে তিনজনকেই মেরে নিরাপদে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে পারবেন। ভেবে দেখুন।”
অক্ষয় বলল, “আমি একটা প্রস্তাব করি। তার চেয়ে আমরা যে যার পথে চলে যাই না কেন? আমি কথা দিচ্চি আর কখনো আপনার বা আপনাদের কারুর অনুসরণ করব না।”
সুধীর একটু ভাবল, বলল, “বেশ একথা মন্দ নয়। কিন্তু আপনার বিশ্বস্ততার পরিচয় স্বরূপ আপনাকে নিরস্ত্র যেতে হবে, আপনার রিভালবারটা আমাকে দিন।”
সুধীর তাঁর কাছ থেকে রিভলভারটা নিল। তারপরে গলি থেকে বেরিয়ে একটা বড় রাস্তার চৌমাথায় গিয়ে চারজনে চারদিকে চলে গেল।
হাওড়া স্টেশনে গিয়ে সুধীরের মনে হল আবার যেন অক্ষয় তার অনুসরণ করচে,—লক্ষ্য রাখল, দেখল সে যে গাড়িতে উঠেচে, অক্ষয় তারই পাশের কামরায় উঠল—তখন তার বুড়োর ছদ্মবেশ, তবু তার ভাবভঙ্গীতে সুধীর তাকে ধরে ফেলল।
তখন হাওড়া থেকে কয়েক স্টেশন পরেই সুধীর নেমে পড়ল, ছদ্মবেশী অক্ষয়ও নেমে তার পিছু পিছু চলল। কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে গাঁয়ের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে এক জায়গায় সুধীর দেখল চমৎকার এক কাঁদি কলা পেকে আছে। সে ছুরি দিয়ে কাঁদির সুললিত একাংশ কেটে নিয়ে খেতে খেতে চলল। কদলীকর্তনের অবসরে অক্ষয়কে বাধ্য হয়ে সুধীরের কাছাকাছি আসতে হয়েছিল, তাই কথা তোলার জন্য সে-ই প্রথমে জিজ্ঞেস করল, “এ গাঁয়ের নাম কি হে ছোকরা?”
সুধীর তীক্ষ্ণ দৃকপাত করে গম্ভীরভাবে বল্লে, “অক্ষয়গোলা।”
“বাঃ বেশ নামটি ত।…” এই নামোল্লেখে তার মনে কোনো সন্দেহ জাগল না, সুধীর তাকে চিনেছে এ কল্পনা সে করেনি, ভাবল সত্যই বুঝি এই নাম!
“কলা খাবেন?” এই প্রস্তাবে অক্ষয়কে ঘাড় নাড়তে দেখে সে বলল, “আপনি বুঝি এই বস্তুটি খেতে এতই অভ্যস্ত যে এতে আপনার আর রুচি নেই?”
উচ্চহাস্য করে অক্ষয় উত্তর দিল, “না বাপু, এ বয়সে আর ওসব ভালো হজম করতে পারিনে।”
যেতে যেতে এই রকম কথাবার্তা চলছিল। সুধীর কলার খোসাগুলো সামনের পথে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিল, হঠাৎ সেই খোসায় পা হড়কে গিয়ে অক্ষয় প্রায় পড়ে যায়, এমন অবস্থায় সুধীর তাকে ধরে ফেলল,—এই অবসরে তার জামার পকেট থেকে গুলিভরা রিভলভারটি অদ্ভুত কৌশলে তুলে নিয়ে নিজের পকেটে রাখল, অক্ষয় তা টেরও পেল না।
দুপুরবেলা আসন্ন, মাঠের শেষে তারা পৌঁছেচে, নির্জন চারি ধার রোদে যেন খাঁ খাঁ করছিল। বৃদ্ধ কোথায় যাবেন, এই অনাবশ্যক প্রশ্ন এতক্ষণ সুধীর করেনি, এইবার একটা ছোটোখাটো জঙ্গলের ধারে পৌঁছে, একটা গাছের গুঁড়ির উপর আরাম করে বসে সুধীর প্রশ্ন করল, “তারপর, অক্ষয়বাবু, আপনার কি খবর? কি মনে করে?”
এই প্রশ্ন শুনে অক্ষয় বেশ একটু চমকে গেল। সে তাড়াতাড়ি পকেটে হাত পুরে দিল। কিন্তু সেখানে কিছুই ছিল না।
সুধীর তাঁর রিভলভারটি বার করে বলল, “এই খেলনাটি আপনারই বোধ করি?”
অক্ষয়ের মুখে হতাশার ভাব ফুটে উঠল, সুধীর বলল, “আপনি বিশ্বাস ভেঙেছেন, আর এবার কাপুরুষের মত হত্যায়—অরুচির ওজর চলবে না। আপনি প্রস্তুত হন।”
এই বলে সুধীর রিভলভারটি পরীক্ষা করতে মনোযোগ দিল। তারপরে আরেকটি রিভলভার, বের করে অন্য হাতে নিয়ে বললে—“এ দুটিই আপনার রিভলবার, এর কোন্টিতে মরতে চান আপনিই পছন্দ করুন। আমি দুহাতেই চালাতে পারি।”
অক্ষয় এতক্ষণে কথা বলল, “সুধীরবাবু, এতটা পথ ভুলে ভুলে তোমার পিছু পিছু এসে পড়িচি বটে, কিন্তু আমার হত্যা ছাড়া কি এ সমস্যার মীমাংসা হতে পারে না?”
সুধীর বল্ল, “এক হতে পারে আপনি যদি আমাদের দলে নাম লেখান তাহলে এ যাত্রা আপনার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি।”
অক্ষয় কিছুক্ষণ ভাবল, তারপরে বল্ল, “আমি বিপ্লবীদলে যোগ দিতে পারি কিন্তু তার আগে, বিপ্লব করে তোমরা দেশ স্বাধীন করতে পারবে—এই ধারণা আমার জন্মানো দরকার। আমাকে অন্ধবিশ্বাসে দলে পাবে এ কি তোমরা আশা কর?”
সুধীর বলল, “আমাদের শক্তি-সামর্থ্যের পরিচয় কিছু কিছু দেখাতে পারি, কিন্তু শত্রুর গুপ্তচরকে বিশ্বাস কি?”
অক্ষয়। “কিন্তু ভেবে দেখ যদি সরকারের কর্মচারী থেকেই আমি বিপ্লবীদলে যোগ দিই তাহলে এমন অনেক গুপ্ত খবর তোমরা পাবে যাতে তোমাদের কার্য-সিদ্ধি সহজ হবে। আমাকে মারার চাইতে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের লাভ বেশি।”
সুধীর। “বেশ, আমি আপনাকে নিয়ে যাব এক জায়গায়, কিন্তু যে ভাবে নিয়ে যাব তাতেই রাজি হতে হবে।”
অক্ষয় রাজি হল, সুধীর তাকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে একটা ঝোপের পাশে গেল, সেখানে একখানা খালি মোটর পড়ে ছিল। দড়ি দিয়ে অক্ষয়ের দুহাত পিছনের দিকে শক্ত করে কসে, পুরু কাপড়ে চোখ বেঁধে দিল, তারপরে পাশে বসিয়ে মোটর ছেড়ে দিল।
তারপরে কতক্ষণ কাটল অক্ষয়ের কিছু মনে নেই, সারা পথ কেবল গাড়ির শব্দ ছাড়া মানুষের কণ্ঠস্বর তার কানে এল না, সে অনুমান করল বিজন পথ দিয়ে গাড়ি খুব বেগে ছুটেচে। কয়েকবার তার মনে হল গাড়ি যেন উপরের দিকে উঠচে, আবার মনে হল ঢালু পথে নেমে চলেচে,—কলকাতার উপনগর থেকে এরই মধ্যে কোথায় কোন্ পার্বত্যপ্রদেশে এসে পড়ল তাই সে ভাবছিল।
অবশেষে গাড়ি থামল, সে জায়গায় লোকজনের পায়ের শব্দ, কথাবার্তার সুর তার কানে গেল, সুধীর গাড়ি থেকে নামল, সে চুপ করে বসে রইল,—“আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসচি।”
“এ স্থানের নামটা কি জানতে পারি?”
“এটা আমাদের একটা কেন্দ্র। আপনি চুপ করে বসুন। নড়াচড়া করবেন না, আপনার ওপর পাহারা রইল।”
“তুমি কিজন্য যাচ্চ?”
“আপনার ভয় নেই, এতদূর এনে কোতল করব না। কর্তারা কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা তাই জানতে যাচ্চি। তাঁদের অনুমতি না হলে আপনাকে এই অবস্থায় ফিরে যেতে হবে, আমাদের কোনো কাজের পরিচয় পাবেন না।”
সুধীর চলে গেল, খানিক বাদে ফিরে এসে তার হাতের আর চোখের বাঁধন খুলে দিল। অক্ষয় সবিস্ময়ে চেয়ে দেখে, এ এক অদ্ভুত জায়গা! দূরে দূরে ছোটোখাটো পাহাড় চোখে পড়ে, দুর্গম কেল্লার মত সুরক্ষিত চারিদিক বাংলা, বেহার, উড়িষ্যার কোন্ অঞ্চলে যে এটা অবস্থিত কিছুই তার ধারণায় এল না।
কিছুদূরে একদল ছেলে বন্দুক হাতে কুচ করছিল, তাদের কাউকেই সে দূর থেকে চিনতে পারল না। বিপ্লবীর দল কিছু অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছে বলে তার মনে হল।
সুধীর তাকে নিয়ে একটা ঘরে গেল, সেই ঘরের চারিদিকেই খোলা তরোয়াল ঝুলচে, দিনের আলোয় সেগুলো ঝকমক করচে। সেখানে দুজনে একটা টেবিলের দুধারে বসল। সুধীর বলল, “এখন কোনো কর্তার সঙ্গে আপনার দেখা হবে না। যদি পরে আপনি বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে পারেন তাহলে আবার আপনাকে এখানে আনা হবে। এখন আমাদের বিপ্লব আয়োজনের এই যে যৎসামান্য পরিচয় পেলেন এরই উপর নির্ভর করে আপনাকে বিবেচনা করতে হবে আপনি আমাদের দলে আসতে পারেন কি না।”
চোরা-হাসি হেসে অক্ষয় বললে, “এই আয়োজন যা দেখলুম, তা বিপ্লব আয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট না হলেও এতে কিছু কাজ চলতে পারে আমার মনে হয়। হাঁ, আমি বিপ্লব দলে যোগ দিলাম। আমাকে কি করতে হবে বল?”
সুধীর লাফিয়ে উঠল, অক্ষয়ের কর মর্দন করে বলল, “এখন কিছুই না। আপনার জন্য যা ঠিক হবে পরে আমিই গিয়ে জানাব। এখন আসুন, কিছু খাওয়া যাক।”
দরোজার পাশে কেউ যেন প্রতীক্ষা করছিল, বলার সঙ্গে সঙ্গেই খাবার এনে টেবিলের ওপর রাখল। সুধীর বলল, “এ পর্যন্ত আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। নিন খান।”
অক্ষয় খেতে ইতস্তত করচে দেখে সুধীর হেসে বলল, “আপনাদের যে সন্দিগ্ধ মন! বিষ-টিষ নেই, দেখুন আমি আগে খাচ্চি। আমরা প্রতারণা করিনে, কিন্তু যে প্রতারণা করে তাকে কুকুরের মত খুন করি।”
অক্ষয় ও সুধীর একই পাত্র থেকে আহার করল। জয়ের আনন্দে সুধীরের মন ভরপুর ছিল, তার শেষ কথায় অক্ষয় যে একটু বাঁকা হাসল তা তার চোখে পড়ল না।
“না না; আমি গিয়েই কাজে ইস্তফা দেব। দেশের মুক্তি কি আমরা চাইনে?”
“আচ্ছা চলুন, আপনাকে যথাস্থানে রেখে আসি। যেমনভাবে এসেছিলেন ঠিক সেইভাবে যেতে হবে।”
“চোখ বাঁধাবাঁধি আর কেন? আমি তো এখন তোমাদেরই একজন?”
“বিশ্বাসং নৈব কৰ্ত্তব্যং—বলে কি একটা কথা আছে না? আমরা ওটা বড় মানি। আপনার একটু চাক্ষুষ অসুবিধা হবে বটে, কিন্তু কি করব এই বিয়ের এই মন্ত্র!”