১০
সুধীর বেশ পালিয়েছিল, কিন্তু একটা পুলিশ কি করে জানতে পেরে তার পিছু নেয়, ঝোপঝাপ গাছপালার আড়ালে অনেক দূর গিয়ে সুধীরের কানে লাগল কেউ যেন তার অনুসরণ করছে। খোলা-মাঠে পড়েই পিছনে তাকিয়ে তার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ঘুচল। সুধীর চোঁ চোঁ দৌড় দিল, জমাদারও তাড়া করে ছুটল। তার হাতে গুলি ভরা সঙীন-বন্দুক ছিল, কিন্তু বিদ্রোহীকে জ্যান্ত ধরে দেওয়ার পুরস্কারের লোভে তার ব্যবহার করতে সে প্রস্তুত ছিল না।
প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে পাথরের ঠোকরে সুধীর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, তার সর্বাঙ্গ ছেঁচরে গেল, পায়ের দু’তিনটা নখ আমূল উড়ে গেল, জমাদারটা প্রায় তার পিঠের উপর এসে পড়েছে তখন।
কয়েক মুহূর্তেই ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার ছুটল, জমাদারও তার পিছন পিছন সমানে দৌড়ে চলেচে, কখনো কখনো তারা এত কাছাকাছি হয়ে পড়ছিল যে বন্দুকের সঙীনের ধারালো মুখ সুধীরের পিঠে খোঁচা দিয়ে রক্তপাত করছিল। পথের পাথর আর কাঁকর পায়ে বিঁধচে—সেই উগ্র তৃষাঙ্কুরদের মুখে রক্তের ছিটা ছিটিয়ে সুধীর ছুটেচে।
অবশেষে শহরের কাছাকাছি এসে পড়াতে সুধীরের মনে আশা হল,—সে একটা পাক দিয়ে একটা প্রাচীর লক্ষ্য করে কোনাকুনি দৌড়াতে লাগল, জমাদার এই হঠাৎ চালে একটু পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। মানুষ-উঁচু প্রাচীর! সুধীর উঁচু-লাফ দিয়ে অবহেলায় সেটা পেরিয়ে গেল। জমাদার তা পারল না, একটু ঘুরে দরজা দিয়ে ঢুকে দেখল সুধীর বেশ একটু এগিয়ে গেছে। তার কিছু পরে একটা কোমর-উঁচু বাঁশের বেড়া, সুধীরের মত জমাদারও এটা সহজেই লাফ মেরে ডিঙিয়ে গেল, কিন্তু একটা আলে লেগে তার বন্দুকটা বেড়ার এদিকে ছিটকে পড়ল, পুনরায় লাফিয়ে গিয়ে সেটা তুলে আনতে গেলে সুধীর চোখের বাইরে চলে যায়, অতএব সে বাসনা তাকে ছাড়তে হল।
তার পরেই রেলপথ, সুধীর দৌড়ে সেই উঁচু বাঁধের উপর উঠেচে ঠিক সেই সময়ে মেলগাড়ি প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসচে। সুধীর পেরিয়ে যেতেই গাড়িটা এসে পড়ল, এক মুহূর্ত দেরি হলেই সর্বনাশ হত! জমাদার গাড়িতে বাধা পেয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াতে বাধ্য হল। রেলের বাঁধ থেকে নেমেই একটা ছোট্ট নদী, একটিমাত্র জেলে-ডিঙি ঘাটে বাঁধা ছিল, সুধীর লাফিয়ে ডিঙিতে উঠেই লগি ঠেলে দিল, জমাদারকে তখন সাঁৎরে পার হতে হল।
তারপরে একটা ছোট খাল, জল তাতে কম, কাদাই বেশি। সুধীর লম্বা লাফে সেটা পেরুল দেখে জমাদার সাহেব তার অনুকরণ করতে গিয়ে খালের মাঝে ঝপাৎ করে পড়লেন। জল ঘেঁটে ও কাদা মেখে উঠে এবার সে মরিয়া হয়ে ছুটল, কেননা শহরের মধ্যে ঢুকলে আর পাবার আশা নেই। নগর-প্রান্তে জমিদারের বিলাস ভবন, তার দরজা খোলা পেয়ে সুধীর ঢুকে পড়ল, জমাদারও অনুসরণ করল, বাড়ি খালিই পড়েছিল, সদর পথে বেরিয়ে দুজনেই শহরের পথে পা দিল। দৌড় দৌড় দৌড়! ভোর রাত, রাস্তায় লোকজন কেউ নেই, দুজনে ছুটে চলেচে।
এবার সামনে একটা বাগানবাড়ি, তার পাঁচ-হাত-উঁচু প্রাচীর। কাছেই একটা বাঁশ পড়েছিল, সেইটার সাহায্যে লাফ দিয়ে প্রাচীর ডিঙিয়ে সুধীর বাগানের মধ্যে গিয়ে পড়ল। জমাদার সেই বাঁশটাকেই অবলম্বন করে অনেক আয়াসে ভেতর নামল, তখন সুধীর বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
একতলা পেরিয়ে দোতলায় উঠেই সুধীর দেখতে পেল একটি ঘরে কয়েকজন হিন্দুস্থানী যুবক মাতাল হয়ে পড়ে আছে, তার মধ্যে একটি বাইজীগোছের মেয়ে মদের নেশায় অচেতন। ঘরময় মদের চাট ছড়াছড়ি, এখানে একজনের বমি, ওখানে কয়েকটা খালি করা বোতল গ্লাস, এককোণে একজোড়া বাঁয়াতবলা। নাকে কাপড় দিয়ে এগিয়ে যেতেই, আরেকটি কক্ষ থেকে অসহায়া নারীর আর্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সুধীর নিজের বিপদের কথা ভুলে গিয়ে সেইদিকে ছুটল।
একটি বাঙালী যুবতীকে ঘিরে কয়েকটি বেহারী যুবক আক্রমণের উদ্যোগ করছিল, মেয়েটি এতক্ষণ পর্যন্ত প্রাণপণে পশুদের ঠেকিয়েচে, এখন তার সব জোর ভেঙে পড়বার মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ধারোলো ছুরি হাতে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে একজন সঙ্গীদের উৎসাহ দিচ্ছিল, সুধীরের বিরাট চড়ের বিদ্যুৎ-স্পর্শে হতজ্ঞান হয়ে বেচারা তৎক্ষণাৎ ঘুরে পড়ল। সুধীর ছুরিটা হাতে করে ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো।
বাঙালী দেখে মেয়েটির প্রাণ ফিরে এল, সে আর্তস্বরে বলল, “আমাকে রক্ষা করুন মশাই। এরা তখন থেকে আমার লাঞ্ছনার বাকি রাখেনি।”
“আপনাকে এরা ধরে এনেছে?”
“হাঁ, প্রায় একঘণ্টা হবে। ভোর রাতে বারান্দায় বেরিয়েচি, এরা সেখান থেকে মুখ বেঁধে জোর করে নামিয়ে এখানে ধরে এনেচে। আপনি না এসে পড়লে আমার কি সর্বনাশ হত!”
মেয়েটি শিউরে উঠল। বাতির আলোয় সুধীর দেখল, বাঙালী-ঘরের বিধবা মেয়ে, এবং তার রূপ বাতির আলোর মতই উজ্জ্বল, পতঙ্গের সমান আকর্ষণের বস্তু। সে মেয়েটিকে বল্লে, “আমার তো দাঁড়াবার সময় নেই। আমি বিপ্লববাদী, পুলিশ পিছনে তাড়া করছে, এখুনি পালাতে হবে। এই ছুরিটা নিন, এইটা হাতে করে দরজা খোলা আছে বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে যান, কোনো ভয় করবেন না, ভোর হোয়ে এসেচে।”
মেয়েটি লোকগুলোর দিকে চেয়ে ইতস্তত করতে লাগল, তারা এই ব্যাপারে একেবারেই অভিভূত হয়ে পড়েছিল। সুধীর তার মনের ভাব আন্দাজ করে বল্ল, “আপনি ভয় পাবেন না। এই কাপুরুষগুলো, ওই রামছোড়া থাকতে, আপনার কাছে এগুবেনা, যদি এগোয় আপনি কোন দ্বিধা না করে বসিয়ে দেবেন। আমার দুর্ভাগ্য, আপনাকে নিজে গিয়ে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিতে পারলুম না।”
মেয়েটি বল্লে, “আমি বুঝেছি। তোমাকে এগিয়ে দিতে হবে না। ভাগলপুরের পথঘাট আমার চেনা, ছোটোবেলা থেকে এখানে আছি। কিন্তু আবার কবে তোমার সঙ্গে দেখা হবে?”
সুধীর হেসে বল্লে, “আমার সঙ্গে? সামনে মৃত্যু, পিছনে মৃত্যু, আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না দিদি,—”
জমাদার এই সময়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। পুলিশ দেখে বেহারী বদমায়েসরা যে যেদিকে পারল পালালো। সুধীর তাদের কাণ্ড দেখে হেসে বলল, “আর ত তোমার ভয় নেই দিদি, এবার আসি তবে।”
জমাদার হাত বাড়িয়ে ধরতে যাবে, সুধীর তড়িৎ গতিতে পাশ কাটিয়ে এক লাফে বারান্দার রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ালো। কি সর্বনাশ! তার পরমুহূর্তেই একতলার ছাদ থেকে জোড়পায়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল, এবং পড়েই সটান দৌড় দিল। জমাদার তৎক্ষণাৎ সিঁড়ি দিয়ে নেমে তার পিছনে দৌড়াল। কেবল মেয়েটি স্তস্তিতের মত দাঁড়িয়ে ভীত চক্ষে সেইদিকে চেয়ে রইল।
এপথ সেপথ ঘুরে ফিরে অবশেষে সুধীর একজায়গায় এসে দাঁড়াল। সেখানে একটা তেতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছিল, তারই বাঁশের ধারা বাঁধা ছিল, সুধীর লাফ দিয়ে সেই ধারা ধরে উপরে উঠতে লাগল। জমাদারকেও ধারা বেয়ে উঠতে হল, তারা শেষ পর্যন্ত উঠল, তখনও একতলা দোতলা বা তেতলার ছাদ পাতা হয়নি, কেবল বড় বড় লোহার কড়িগুলো সাজানো রয়েছে। সুধীর সেই তেতলার ছাদের অপরিসর কড়ির উপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো, অপেক্ষাকৃত পরিসর বাড়ির দেয়ালের উপর বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে তার এই মরিয়ার মত দুঃসাহসিক কার্য দেখে জমাদারের মাথা ঘুরে গেল।
সেখান থেকে জমাদারকে সম্বোধন করে সুধীর প্রথম বাক্যালাপের সুযোগ পেলে, “জমাদার সাহেব, মেজাজ আচ্ছা ত? চলে এসো ধরবে এসো, আর আমি পালাব না, আর দৌড়াবই বা কোথায়? অমন কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দাঁড়িয়ে থেকো না জমাদার সাহেব।”
জমাদার মনের ভাগ যথাসাধ্য চেপে শুধু বলল, “তুম শালা ডাকু হায়!”
সুধীর হেসে জবাব দিল, “ওতো ঠিক হ্যায় জমাদার সাহেব। লেকিন তুমি কি করে চাকরি রাখবে আমি কেবল ওই ভাবতা হ্যায়। ভোর তো হো গিয়া, এখন বাসামে যাকে, শরীরমে যে বহুত কাদা উদা লাগা হ্যায়, ওসব তো ধুয়েটুয়ে থোরা সভ্যভব্য হতে হবে জমাদার সাহেব।”
জমাদার সমস্ত ক্রোধ হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বল্ল, “তুম্কা মাফিক বদমাসকো পাকড়েনেসে একদফে দেখ লেতা হাম।”
সুধীর উচ্চ হাস্য করে বলল “ওতো জরুর তুম্ দেখতা জমাদার সাহেব, হাম্ ধরা দেনেসে তো তুম হাম্কো গোঁফ্মে বাঁধকে লে যাতা—ও তো ঠিক হ্যায়! লেকিন, আমি এখন এই ভাগলপুরমে ভাগ যাতা, তুম খাড়া হোকে দেখো।”
এই বলে সে কড়ি পার হয়ে গিয়ে ওধারের দেয়ালের উপর দাঁড়ালো, সেখানে একটা বাঁশের মাথায় মোটা দড়ি বাঁধা ছিল, তাই ধরে ঝুলে দু’তিন দোলা খেয়ে মাঝের রাস্তাটা শূন্যে শূনো টপকে গিয়ে সম্মুখের দোতালা বাড়ির ছাদে গিয়ে পড়ল। জমাদার এগুতেও পারে না, নামতেও পারে না, কেবল দাঁড়িয়ে দেখতে পেলে, সুধীর এবাড়ির ছাদ থেকে ওবাড়ির ছাদ পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
সিঁড়ি থেকে নেমে দোতলাতে পা দিয়ে সুধীর অপরিচিত বাঙালী ভদ্রলোক দেখে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে বলে মনে করল, সে এতক্ষণে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, এই ধারণার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ঝিম ঝিম করে সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে এল।
ভদ্রলোকটি কিন্তু তাকে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে ভীষণ কণ্ঠে বললেন, “তুমিই আমার সর্বনাশ করেচ? বল বেটা আমার মেয়ে কোথা?”
সুধীরের চট করে সেই মেয়েটির কথা মনে হল, এবং কন্যা-শোকাতুর পাগলের মত লোকটিকে দেখে ব্যাপারটা সে একটু আন্দাজ করল। কিন্তু সব শক্তিই যেন তার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল, যে শুধু বলল, “আপনার মেয়ে? তাঁকে গুণ্ডারা ধরে নিয়ে গেছল, তিনি উদ্ধার পেয়েচেন, আসচেন। আমি বিপ্লববাদী, আমাকে আশ্রয় দিন—”
আর কিছুই সে বলতে পারল না, তার মূর্ছিত সুঠাম দেহ প্রৌঢ়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। তার মেয়ে উদ্ধার পেয়েচে, আসচে, আনন্দে প্রৌঢ়ের যেন বুক ফেটে যাবার উপক্রম হল, ক্ষণপরে সচেতন হয়ে তিনি দেখলেন তাঁর পায়ের কাছে পড়ে আছে রক্তরঞ্জিত ছিন্ন বস্ত্র বাংলামায়ের আদরের দুলাল!
১১
কয়েক দিনেই সুধীর বেশ সেরে উঠেচে, এবার তাকে অনিলা ও তার বাবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে এই কথাই হয়ত সে ছাতের এক কোণে আরামচেয়ারে বসে বসে ভাবছিল। অনিলার স্নেহের সেবা এই ক’দিনেই তার সৈনিকের প্রাণে যেন গৃহস্থের শান্তিনীড় রচনা করে দিয়েচে।
মানুষের হৃদয় এমনই রহস্যময় যে, এই যেখানে মরুভূমির শুষ্ক তৃষ্ণা আর্ত জ্বালায় খাঁ-খাঁ করচে, একটু আদরে তা যে এক পলকেই সিক্ত স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে তাই নয় হয়তো বানও ডাকে। মনের এহেন পরিবর্তনে সুধীর পালাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, কেননা দেহের বাঁধনের চেয়ে স্নেহের বাঁধনকেই সে বেশি ভয় করত।
অনিলা এক বাটি গরম দুধ হাতে হাসিমুখে প্রবেশ করে বলল, “চোঁ চোঁ করে এক চুমুকে এইটুকু খেয়ে ফেল ত, দেখি কেমন বীর।”
এই বস্তুটি গলাধঃকরণ করতে সুধীরের অমৌন অসম্মতির অন্ত ছিল না, এবং সেজন্যই তাকে সাধাসাধি করে খাওয়াতে অনিলার বেশ লাগত, কিন্তু সুধীর আজ বিনা বাক্যব্যয়ে দুধ খেয়ে ভালো ছেলেমির পরিচয় দিল দেখে সে একটু বিস্মিতই হল। সে একটু হেসে বললে, “হাঁ, দেশোদ্ধার করতে পারবে বটে!”
“কিন্তু দিদি, পাণিনি যে তোমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছেন; দুগ্ধ বীরের খাদ্য নয়, বিড়ালের খাদ্য, তা জানো কি?”
“জানি বইকি ভাই, দুটি প্রাণীকেই চেনবার একটি মাত্র উপায়। তা হচ্ছে গোঁফ।”
“কিন্তু আমার তো তা নেই।”
“তবে তুমি বীরও নও, বিড়ালও নও।” দুজনেই হেসে উঠল। অনিলা কহিল, “এতক্ষণ মুখ চুন করে বসে বসে কি ভাবছিলে বল তো?” একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে সুধীর উত্তর দল, “একজনকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারচিনে, তার কথাই ভাবছি।”
“কে সে?” জিজ্ঞেস করতেই অনিলার সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“সে? সে আমার দুর্জয়দা।” এই কথা বলতে সুধীরের চোখে যেমন আলো জ্বলে উঠল, অনিলার মুখের আলো কে যেন এক ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিলে।
“তাকে তুমি খুব ভালোবাসো?”
“হ্যাঁ, সেও আমাকে তার ভায়ের মত ভালোবেসেচে; কিন্তু সে আর নেই দিদি!”
সুধীরের দুটি চোখ করুণ হয়ে এল, অনিলা সমবেদনায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
“তোমার কে কে আছেন সুধীর?”
‘‘বাপ মা ভাই বোন কেউ নেই আমার, কিন্তু দুর্জয়দার মধ্যে একাধারে আমি সবাইকেই পেয়েছিলাম—অমন গভীর স্নেহ এ জীবনে কারু কাছে পাইনি—”
“আমার একটি কথা রাখবে ভাই?”
সুধীর অনিলার দিকে চাইল। বলল, “কি দিদি?”
“ফি বছর ভাইফোঁটার দিন ভাগলপুরে আসবে?”
একটুখানি হেসে সুধীর বল্লে, “তোমাকে ভুলব না দিদি। আমরা রক্তবীজের বংশ আমাদের মৃত্যু নেই বটে,—কিন্তু যদি সশরীরে বেঁচে থাকি তবেই আসতে পারব।”
এর পরে আর কারোই কথা সরল না, অনিলা ক্ষণেক নীরব থেকে “তোমার খাবার নিয়ে আসি” বলে আঁচলে চোখ মুছবার জন্য অন্য ঘরে গেল,—এই বিপ্লবী তরুণের করুণ সমাপ্তির ভাবী কাহিনী যেন ছবির মত তার চোখের উপর স্পষ্ট দেখে বেদনায় শিউরে উঠল।
সত্যই দুর্জয় সুধীরের জীবনের অনেকখানি দখল করেছিল। তাকে হারাবার এত বড় ব্যথা সুধীর সামলে উঠতে পারত কিনা কে জানে যদি না অনিলা তাকে ভায়ের সমাদরে ডেকে এনে অভিনব রাজ্যের রাজার অধিকারে অভিনন্দিত করত। দুর্জয়দার কথা ভেবে সুধীরের সারা বুক যখন সাহারার শূন্যতায় হু হু করে উঠত, পরমুহূর্তেই অনিলার হাসিমুখ যেন সেই শূন্যতার মধ্যে চাঁদের আলো হয়ে ভরে যেত। তেমনি স্নেহ ফিরে পেলে তারই মাঝে মানুষ হারানো প্রিয়জনকেও ফিরে পায় হয়ত।
এই কয়দিন কেবলি তার দুর্জয়ের কথাই মনে পড়েচে, তার প্রথম সাক্ষাৎ, প্রথম আলাপ, প্রথম পরিচয়ের কথা,—কত দিনের কত খুঁটিনাটি, কত ঘটনা। যেদিন দুর্জয় প্রথম তাদের বোর্ডিংএ বেড়াতে আসে তখন আর সব কৌতূহলী কিশোরদের মধ্যে বসে সেও তাকে দেখেচে। সেদিন দুর্জয় তাকে একটি কথাও বলেনি, কেবল বার বার তার দিকে তাকাচ্ছিল। অতগুলি ছেলের মধ্যে সেই যে দুর্জয়ের বিশেষ লক্ষ্যের বিষয় হয়েচে এইটুকু উপলব্ধি করে সেদিন সুধীরের মনটা কেমন সুখে ভরে উঠেছিল।
তার পরদিন টিফিনের ঘণ্টায় স্কুলের ঘেরা জায়গার মধ্যে আবার দুর্জয়ের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হল, চোখাচোখি হতেই কিসের টানে সে যে তার কাছে এগিয়ে গেল তা সে নিজেই জানে না। কাছে যেতেই দুর্জয় তাকে বুকের ওপর টেনে নিয়েছিল, সেও বিমুগ্ধের মতো দুটি হাত তার গলায় মালার মত পরিয়ে দিয়েছিল,—এর আগে তাদের একটি কথাও হয়নি অথচ এমনই মিলনের জন্য যেন তারা মনে মনে প্রস্তুত হয়েছিল।
দুর্জয় কেবল তাকে বল্লে, “আমার সঙ্গে এসো, কথা আছে।” অমনি সে একটুও না ভেবে পুঁথিপত্র ক্লাসেই ফেলে রেখে তার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল। কে সে দুর্জয়, কোথায় থাকে, কি করে, তার কিছুই ত সে জানত না, জানা দরকারও মনে করেনি; আর সব ছেলের কাছে শুনেছিল সে নাকি ভবঘুরে, তারাও তার বেশি কিছু জানত না; অথচ এই অপরিচিতের আহ্বানে বেরিয়ে পড়তে তার বাধেনি।
সেই দিনই তার জীবনে স্বদেশ-ব্রতের মন্ত্রদীক্ষা, দুর্জয় সেই দিনই তাকে ভাগলপুরে নিয়ে আসে, দুদিন পরে সে যখন পরিত্যক্ত বোর্ডিংএ ফিরল তখন সে অন্তরে অন্তরে নতুন মানুষ,—সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ও হেডমাস্টারের পীড়নেও এই দুদিনের রহস্য সে প্রকাশ করেনি। এমনকি “রাস্টিকেশনের”রাজটীকাতেও তার ভয় হয়নি।
সুধীর আগে ভালো ছেলে ছিল না, একটি খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়ে বদভ্যাস শিখে নষ্ট হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল, দুর্জয় তার এই গুপ্ত তথ্য কি করে জানল সেই জানে, কিন্তু সে যখন খোলাখুলি জিজ্ঞেস করল তখন সুধীর অকপট অশ্রুজলে সব কাহিনী খুলে বলে মনে সেদিন কী শান্তি পেয়েছিল! তারপর থেকে দুর্জয়ের উপদেশে সে ভালো ছেলে হয়ে গেল, এমনকি আর সব হতভাগ্য ছেলেদের এই প্রাত্যহিক আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করাই হলো তার বড় কাজ।
দুর্জয় তারপর থেকে যখনই পারত তাদের গাঁয়ে এসে কিছুদিন থাকত, দুর্জয়ের নানান কাজের মধ্যে তার জন্য আসাটাও যে একটা কাজ ছিল, দুর্জয় না বললেও এমনি একটা ধারণা সুধীরের মনে বদ্ধমূল ছিল। তাই দুর্জয় এলেই তার সমস্ত মুহূর্ত সে যেন হরণ করে নিত, তার ভালো করে খাওয়া হত না, ফাঁকি দিয়ে স্কুল পালাতে হোতো, এমনকি সন্ধ্যার পর বোর্ডিংএর কড়াকড়ি নিয়ম অমান্য করে সে দুর্জয়ের বাসার অভিসারে বেরুত।—যে আমবাগানের ঝাপসা অন্ধকারে দিনেই লোকে পা বাড়াত না, পথ সোজা করবার জন্য সুধীর সাপখোপ ও ভূতপ্রেতের ভয়কে একসঙ্গে অস্বীকার করে তার ভেতর দিয়েই পথ করে যেতো। দুর্জয়ের মুখের গল্প শোনার কি প্রচণ্ড ছিল তার লোভ। তাদের গভীর ভালোবাসার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যবধান দুর্জয় বরাবর রক্ষা করত, হয়তো সেই জন্যই তার আকর্ষণও ছিল এমন দুর্জয়।
এইসব কথাই সুধীর অনুক্ষণ ভাবছিল, –এইসব চিন্তা এর আগেও সে অমৃতের মত কতবার আস্বাদ করেছে, কিন্তু এইসব কাহিনীই আজ তার শিরায় শিরায় অব্যক্ত বেদনার নিবিড় বিষ সঞ্চার করে দিচ্ছিল। কিন্তু কর্তব্য সবার আগে, শোক অপেক্ষা করবে, ভালোবাসা অপেক্ষা করবে, এমনকি ভগবানও অপেক্ষা করবেন, কিন্তু বিপ্লবীর কাজ অপেক্ষা করতে পারে না, দুর্জয়ের কাছে এই শিক্ষাই সে পেয়েছিল। তার পরদিনই দেবেনের সঙ্গে কাটিহারে মিলবার কথা তার-যোগে ঠিক করা ছিল, তাই আজ তাকে সব স্নেহ-বাধা-বন্ধন অতিক্রম করে অসুস্থ শরীর নিয়েই উল্কার মত আপনার ধ্বংস-যাত্রা শুরু করতে হবে, অবশেষে এই সে ভেবে স্থির করল।
১২
সৈনিক যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটতে ছুটতে পথে রূপসী মেয়ে দেখলে ঘোড়া থামিয়ে তার চুমো লুটে নিয়ে আবার ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায়, এবং ঐ একটু ক্ষণের আগাগোড়া ফাঁকির মধ্যে পরম বস্তু পেয়ে গেচে ভেবে আনন্দ পায় তেমনি এই ঝোড়োপাখীর মত সাতদিনের নিরন্তর ঘোরাঘুরির মধ্যে, মোহনকে ট্রেনে সেই একটি রাতের জন্য পাওয়ার আনন্দটুকু দেবেনের সারা চিত্ত খুশিতে ভরে রেখেছিল। মোহনের সঙ্গে এ জীবনে দেখা হবে কিনা সে ভাবনা তার ছিল না, তার ঠিকানা পেলেও তার সঙ্গে মিলনের অবসর হয়তো আর হবে না, তবু, অন্যমনস্ক মনে সে যখন কাটিহারে নামল, তখনও তার চিন্তার কুজ্ঝটিকার ভেতরে মোহনের সুমোহন মুখখানি মাঝে মাঝে উঁকি মেরে আলোর সঞ্চার করছিল।
তখন সন্ধ্যা, তার পরদিন সকালের ট্রেনে ভাগলপুর থেকে সুধীরের আসার কথা। রেলওয়ে নোটিস বোর্ডে গিয়ে দেখল তার ছদ্মনামে পাঠানো সুধীরের এই টেলিগ্রাম দেওয়া রয়েছে— Reaching tomorrow morning with money in draw bush on gang goalie— এর অর্থ, দেবেন, সবটা ঠিক ধরতে পারল না তবু সুধীরের এতটা দুঃসাহসের পরিচয়ে সে খুশি হল না। পুলিশের কাছে যে এই তারের অন্তরের বার্তা এতক্ষণও গোপন আছে তাও সে বিশ্বাস করতে পারল না,—তার ক্লান্ত দেহের পক্ষে বিশ্রামের একান্ত দরকার ছিল, তাই সে চার আনা খরচ করে পরের স্টেশনের একখানা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনে ওয়েটিংরুমে প্রবেশ করল। ওয়েটিংরুমের আসবাবের মধ্যে একটা আয়না-দেওয়া ড্রেসিং টেবিল, একখানা বড় গোলটেবিল, তার চারধারে কয়েকটা চেয়ার আর ঘরের একপাশে একটা ইজিচেয়ার। ইজিচেয়ারে গা ঢেলে দিয়ে দেবেনের কয়েক মিনিট কেটেচে, ইতিমধ্যে একজন ইউরোপীয় রেলওয়ে কর্মচারী ঢুকে তাকে রুক্ষ কণ্ঠে ইংরেজীতে প্রশ্ন করল, “কে তুমি?”
সহজ গলায় দেবেন উত্তর দিল, “আমি যাত্রী।”
“এখানে কেন? বাহিরে যাও।”
“কেন, জিজ্ঞেস করতে পারি কি?”
কালা আদমির কথা কইবার স্পর্ধা দেখে সাহেবের রাগে পিত্ত জ্বলে গেল, সে পরুষ কণ্ঠে বল্ল, “সাধারণ যাত্রীর জন্যে এ জায়গা নয়, এক্ষুনি বেরিয়ে যাও।”
প্রত্যুত্তরে দেবেন চার আনার টিকিটখানা তার মুখের পর ছুঁড়ে দিল, সাহেব দেখল প্রথম শ্রেণীর টিকিট। বোতলের গ্যাস বেরিয়ে গেলে সোডাওয়াটার যেমন শান্ত হয়, সাহেবের মেজাজ তেমনি সহসা ঠাণ্ডা হয়ে এল, সে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করে বেরিয়ে গেল।
সেদিন রাত্রে সাহেবের স্টেশনে duty ছিল, তাই অত্যন্ত ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে দেবেন দেখল যে সে বেচারা ইজিচেয়ার না পেয়ে অগত্যা গোলটেবিলের উপরই লম্বা হয়ে আছে। তার সন্ধ্যার ঝাঁঝের কারণটা তখন বোধগম্য হল।
দেবেনের চোখে আর ঘুম এল না, তার মনে অকারণ আশঙ্কা জাগছিল, একটু পরে সে সেই অতি প্রত্যুষে বারান্দায় বেরিয়ে দেখতে পেল স্টেশনের চারিদিকে অস্ত্রধারী পুলিশ সজ্জিত হয়ে রয়েছে। দেখেই সে ইজিচেয়ারে এসে এবার নিতান্তই ঘুমিয়ে পড়ল।
বেলা সাতটা, ইতিমধ্যে যতগুলো গাড়ি প্লাটফরমে ঢুকেচে সবগুলোরই রীতিমত খানাতল্লাসী হয়েছে,—কিন্তু বি. এন. ডবলিউ. গাড়ির যা বৈশিষ্ট্য সেই খৈনির ডিবে, গাঁজার কল্কে ও ছাতুর পুঁটুলি এবং এদের মালিকরা ছাড়া আর বিশেষ কিছু ধরা পড়েনি।
যে গাড়িতে সুধীর আসছিল তার ধাপা মেলের মত ঢিমে তেতালা গতির জন্য কাটিহার পৌঁছতে তখনো আধ ঘণ্টা বাকি,—কাটিহারে যে সরকারের কর্মসচিবরা তাকে সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করেচে এমন কল্পনা সুধীর স্বপ্নেও করেনি। মাঝের একটা স্টেশনে একজন মাড়োয়ারি ব্যবসাদার একটা অত্যন্ত ভারি হাতবাক্স অতি কষ্টে নিজেই বহন করে তারই সেকেণ্ড ক্লাস কামরায় উঠলেন, আলাপ করে সুধীর জানল তিনি কাটিহারে তাঁর এক মাড়োয়ারি বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে কলকাতা যাবেন।
সুধীর অনুমান করল এই ক্ষুদ্র ভারি বাক্সটিতে কেবল সোনা ছাড়া আর কিছুই নেই,—একটা কল্পনা তার মাথায় এল, সে পরের স্টেশনেই তার ছোট ব্যাগটি হাতে নিয়ে নেমে গিয়ে পাশের খালি প্রথম শ্রেণীর কক্ষে উঠে পড়ল। হাত ব্যাগে প্রয়োজন মত বেশ বদলাবার সাজসজ্জা থাকত, ড্রেসিং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিটেই ঝাঁকড়া চুল, চাপ দাড়ি আর ইয়া গোঁফে তার চেহারা দস্তুরমত বদলে গেল। গুলিভরা রিভলবার উঁচু করে সে চলন্ত গাড়ির পাদানি দিয়ে পাশের কামরায় গিয়ে ঢুকল।
মাঠের মাঝখানে চলন্ত গাড়িতে পিস্তল হাতে এই দুষমন চেহারাকে উঠতে দেখে মাড়োয়ারি বেচারা একেবারে ভড়কে গেলেন, সুধীর অতি সহজেই হাতবাক্সটি হাতিয়ে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল, তবু ভদ্রলোকের অনেকক্ষণ পর্যন্ত হুঁশ হল না। যখন জ্ঞান হল, তৎক্ষণাৎ তিনি গাড়ি থামাবার শিকল বার বার টানলেন এমন কি বিপুল বপু নিয়ে চেন ধরে ঝুলে পড়লেন তবু গাড়ি থামল না, থামল একেবারে গিয়ে কাটিহার জংশনে।
কাটিহারের পুলিশ যখন সুধীরকে পাকড়াবার জন্য গোটা গাড়িখানা ঘিরে ফেলেচে, তখন গাড়ি থেকে সুধীরের বদলে রোরুদ্যমান মাড়োয়ারি নেমে পুলিসের কর্তার কাছে সদ্য ডাকাতির বৃত্তান্ত বিবৃত করল। এই রকম একটা ঘটবে এটা যেন তাঁদের স্বকপোল-কল্পনার মধ্যে ছিল তাঁদের ভাবে সকলের এমনি বোধ হল।
গোটা ট্রেনখানা তল্লাস করতে আধ ঘণ্টা লাগল, ততক্ষণ সুধীর ওয়েটিং রুমে দেবেনের কাছে এসে মিলেচে। যার জন্য এত কাণ্ড সে যে কখনই ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করতে পারে না পুলিশের মনস্তত্ত্বের এই সুযোগে সে এতটা সাহস করেছিল। খানিক বাদে দুজন সি-আই-ডি কর্মচারী মাড়োয়ারিটিকে নিয়ে সেই ঘরে গিয়ে বসলেন, তাঁদের জেরার চোটে অস্থির হয়ে ভদ্রলোককে ঝকমারির মাশুল গুণে দিতে হল।
একজন সি-আই-ডি কর্মচারী প্রশ্ন করলেন, “ডাকাত দেখতে কিরকম?”
মাড়োয়ারি তাঁদের দুজনকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে বললে, “অনেকটা তোমার মত, তবে দাড়িটা ফরাসি ছাঁট নয় আর চুল উস্কো খুসকো।”
সুধীর ও দেবেন এক সঙ্গে হেসে উঠল, দ্বিতীয় সি-আই-ডিও মজাটা উপভোগ করলেন।
প্রথম সি-আই-ডি বল্লেন, “এ তবে সুধীর নয়, তার চেহারার বৃত্তান্তের সঙ্গে এ ত মিলচেনা এ তবে কে।”
দ্বিতীয় জন্য বল্লেন, “আচ্ছা, কালকের সেই রহস্যময় উড়ো টেলিগ্রামের সঙ্গে কিছু মিলছে নাকি? Money in draw—”
“ঠিক বলেচ, এর সাঙ্কেতিক অর্থ হচ্ছে টাকা প্রায় পাওয়ার দাখিল,—বুঝলেন মশাই, আপনার এই সোনা যে চুরি যাবে তা অনেক আগে থেকেই তাদের ঠিক ছিল।”
“তারপরে হচ্চে bush on, অর্থাৎ কি না, মাল কোনো ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, সাহেবকে এক্ষুনি বলে দাও, আশেপাশের যত ঝোপঝাড় সব পুলিশ দিয়ে ঠেঙিয়ে দেখুক।”
“তারপর gang goalie, এই কাণ্ড এক আধ জনের কর্ম নয় এর পেছনে gang, একটা বড় দল আছে। যারা এই তার করেছে তার একজনের নাম হচ্ছে goalie, আচ্ছা এ নামটাতো বাঙালী-বাঙালী ঠেকছেনা? পাঞ্জাবী, মাদ্রাজী কিম্বা মুসলমানি, এটা কি রকম হল?”
“চলো সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা যাক, আপনার কোনো ভাবনা নেই মশাই, ডাকাতের দল মায় আপনার মাল সব ধরে দেব।” তারা সবাই চলে গেলে দেবেন সুধীরকে একান্তে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এই বিদ্ঘুটে তারের অর্থ আমিও বুঝতে পারিনি। ব্যাপারটা কি?”
“Money in draw bush on gang goalie—মানে, মণীন্দ্র ভূষণ গাঙ্গুলি,—অত বড় বিপ্লবীর নাম শোনোনি? তাঁরও আমার সঙ্গে আসবার কথা ছিল যে। বেলা হল, চলো এখন আমাদের আড্ডায় যাওয়া যাক।”
১৩
মোহন স্কুল থেকে বোর্ডিংএ ফিরলে তখনই অশান্ত তাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে তাকে বললে, “চৌকিতে বসো।”
অশান্ত দেরাজ থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বের করল, মোহনের মন কৌতূহলী হয়ে উঠল, সে জিজ্ঞেস করল, “ওতে কি আছে ভাই?”
“কি বলো দেখি?”
“খাবার?”
“খাবার নিশ্চয়ই, কিন্তু কি খাবার যদি বলতে পার তবে—”
“বলব? কোনো ফল? তরমুজ? জলপাই? তাও নয়? তবে তবে খেজুড়গুড়ের পাটালি? চন্দ্রপুলি? সন্দেশ রসগোল্লা?—তাও নয়? তবে কলা!”
মোহনের যে কয়টি প্রিয় খাদ্য ছিল প্রায় সবগুলিরই সে নাম করল। এছাড়া অশান্ত তার জন্যে আর কি রাখতে পারে? অশান্ত বললে, “আজ পৌষপার্বণ, মনে নেই?”
উৎসাহিত কণ্ঠে মোহন বলল, “তবে পিঠেপুলি?”
“তাই। বাড়ি থেকে এনেছি, আমি নিজেও খাইনি, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, একসঙ্গে খাব বলে।”
মোহন পরম আগ্রহে হাত বাড়াল। অশান্ত বললে, “কিন্তু তুমি কি খাবার বলতে পারোনি যে এজন্য এই শাস্তি নিজের হাতে খেতে পাবে না।”
মুখ বাড়িয়ে মোহন বল্লে, “বেশ তুমি খাইয়ে দাও।” একটুকরো পিঠে খেয়েই চেঁচিয়ে উঠল, “বাঃ কি মজা! এযে ক্ষীর-পিঠে!”
“ভালো লাগচে? তবে সবগুলো তোমাকে খেতে হবে।”
“বাঃ, তুমি খাবে না? এতো কে খাবে তবে? এস, আমিও তোমাকে খাইয়ে দিই। হাঁ কর।… কেমন?”
“তুমি খাইয়ে দিচ্চ বলেই বোধহয় ভালো লাগচে।”
“সত্যি?” মোহন তার দিকে চেয়ে হাসল, “বাঃ বাঃ, আঙুল কামড়াচ্চে যে?”
অশান্ত বল্লে, “আঙুলগুলো পিঠের চেয়ে বেশি মিষ্টি যে।”
মোহন বল্লে, “তবে তুমি আঙুলই খাও, আমি পিঠে খাই।”
অশান্ত সহসা আবেগভরে মোহনের গালদুটি টিপে গাঢ় স্বরে বলল, “দুষ্টু!”
মোহন ফিক করে হেসে বল্লে, “ও আবার কি?”
অশান্ত কিছুক্ষণ তার কৌতুকচপল মুখখানির দিকে চেয়ে থেকে বললে, “এক এক সময় এমন ইচ্ছে করে তোকে—”
“আমাকে পিঠের মত চিবিয়ে খেয়ে ফেল, নয়?”
মোহনকে সহসা বড় মোহময় বলে অশান্তর মনে হল। সে দুই হাতে তাকে বুকের উপর টেনে নিয়ে মুখের খাঁজে নিজের মুখখানি মিলিয়ে রাখল, এই আচম্বিত স্নেহস্পর্শের বিমূঢ় আনন্দে কিছুক্ষণ স্থির থেকে মোহন আপনাকে মুক্ত করে নিল। বলল, “তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে পিঠে খাওয়াচ্চ তারেশবাবু দেখতে পেয়েচে।”
“দেখুক না, আমার কি করবে সে?”
“ছেলেদের বলে দেবে। একেই ত ছেলেরা তোমাকে-আমাকে জড়িয়ে কত ঠাট্টা করে।”
“করুকগে, আমাদের বয়ে গেল।”
“আমরা এক সঙ্গে থাকি, খাইদাই বেড়াই এটা ওদের সহ্য হয় না। আমাদের জব্দ করবার ফন্দী আঁটে।”
“এক কাজ কর, ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমরা বেশি বেশি মিশব মাখামাখি করব, তাহলে ওরাই জব্দ হবে।”
“সেই বেশ। কিন্তু তারেশবাবু এতক্ষণ তাদের কাছে কত কি বানিয়ে বলছে, তা’ কে জানে?”
“তারেশবাবু তোমাকে তাঁর রিস্ট-ওয়াচটা দিয়েছিলেন না, কি করলে? সেদিন যে তোমার হাতে দেখলুম।”
“তার পরদিনই আমি ফিরিয়ে দিয়েচি। ওকে আমার ভালো লাগে না। বিশ্রী!”
“কেন, আগে ত তুমি ওর খুব গল্প করতে?”
“প্রথম প্রথম ওকে বেশ লাগত, অমন ভালো ফুটবল-প্লেয়ার, সব ছেলের কাছেই ওর প্রশংসা শুনতুম, কিন্তু এখন,—সে কথা যাক।”
“এখন কি হয়েছে? আমায় বলো না ভাই?”
মোহন কিছুক্ষণ কি ভাবল, অবশেষে চুপি চুপি বলল, “তোমাকে বলতে পারি, কিন্তু তুমি কাউকে বলবে না বল।”
মোহনের ভঙ্গি দেশে অশান্তর মনে কেমন ভয় হল। সে বলল, “তবে কাজ নাই, অমন কথা শুনতে চাইনে।”
মোহনের মুখ গম্ভীর হয়ে এল, সে বলল, “তুমি আমাকে ভালোবাসো, তুমি আমাকে একটা উপায় বলে দিতে পার, ওর হাত থেকে বাঁচাতে পার।”
তাদের সহজ সুন্দর ভালোবাসার মুক্ত ঝরনা এ কোন্ রহস্যময় চোরাবালির মধ্যে হারাতে চলেচে এই আশঙ্কায় অশান্ত তাড়াতাড়ি বলল, “সে কথা না হয় আরেক দিন শুনব। তাকে যদি তোমার ভালো না লাগে তবে তার কাছে আর যেয়ো না।”
“আমি তো যেতে চাইনা, আমাকে ছল করে ভয় দেখিয়ে ধরে নিয়ে যায়, এই ত হয়েছে বিপদ।”
“কিন্তু সে ত তোমাকে ভালোবাসে।”
“ছাই বাসে। তুমি দেখচি কিছু জানো না। সে যে কি—”
“আমি সব জানি, গোড়া থেকেই জানি সে তোমাকে ভালোবাসে। প্রথম প্রথম আমার বড় রাগ হত, কিন্তু ভেবে দেখলুম তুমি আমাকে ভালোবাসো তাহলেই হল,—আরো কত ছেলে ত তোমাকে আমার মত ভালোবাসতে পারে, সে অধিকার তাদের আছে। তার আমি কি করতে পারি?”
“তোমার মত ভালোবাসে? অনেক ছেলে আমার সঙ্গে ভাব করতে আসে বটে, কিন্তু তোমার মত কেউ আমাকে ভালোবাসে না। সত্যি সত্যি ভালোবাসা—কেমন করে যেন বোঝা যায়।”
অশান্ত কিছু না বলে চুপ করে রইল, ক্ষণেক পরে বলল, “ইচ্ছে করলেই কি ভালবাসা যায়, ভালো না বেসে পারে না বলেই লোকে ভালোবাসে। আমরা কিছুতেই ভালো না বেসে থাকতে পারতুম না।”
“আমিও অনেক সময় তাই ভাবি। ভগবান বোধহয় তোমার আমার মন একই রকম করে গড়েচেন তাই এত সহজে মিলে গেল।”
“তা তো গড়েচেন, কিন্তু এদিকে আমাদের বেড়াতে যাবার সময় যাচ্ছে, তা জানো?”
মোহন উঠল, এমন সময়ে ভূপেন এসে তাকে বল্লে, “তারেশদা তোমাকে ডাকচে।”
“আমি এখন যেতে পারব না।”
“এখনি ডাকচেন, বিশেষ দরকার।”
অশান্ত কহিল, “চট করে শুনে এসো না—কেন ডাকচেন।”
মোহন উদ্ধত স্বরে বললে, “কেন ডাকচে আমি বুঝেচি, আমি যাবনা তাকে বলগে।”
ভূপেন মোহনদের চেয়ে বয়সে কিছু ছোট, সে মুচকি হেসে বলল, “তুমি নাকি তাঁর কাছে ক’টা টাকা পাবে তাই নিতে ডাকচেন।”
মোহন রেগে বলল, “আমি তার কাছে কোনো টাকা পাব না। আমি কক্ষনো যাব না।”
অশান্ত কিছু বুঝতে না পেরে খানিকক্ষণ হতভম্বের মত থেকে বলল, “আমরা বেড়াতে বেরিয়েচি, এখন ও যাবে না। তারেশবাবুকে বলগে সন্ধ্যার পর আমি ওকে নিয়ে যাব।”
ভূপেন চোখের কি একটা ইঙ্গিত করে একটুখানি বাঁকা হেসে চলে গেল।
পথে যেতে যেতে মোহন হঠাৎ বললে, “চলো আমরা দুজনে কলকাতায় গিয়ে পড়িগে।”
অশান্ত বিস্মিত হয়ে বলল, “কেন? এ জায়গা মন্দ কি? পড়াশুনা ত বেশ হচ্চে।”
মোহন তার উত্তর না দিয়ে শুধু বললে, “তাহলে আমাকে বোর্ডিং ছাড়তে হবে দেখচি।”
শহরের এক প্রান্তে মাঠের পারে নদীর ধারে ঘাসের সবুজ মখমল মোড়া একটা বিজন স্থান তারা আবিষ্কার করেছিল, রোজ বিকেলে সেইখানটিতে দুজনে গিয়ে বসত, সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত, বোর্ডিংএ ছেলেদের নাম-ডাকার সময় না হওয়া পর্যন্ত গায়ে গায়ে ঠেস দিয়ে মাথায় মাথায় ঠেকিয়ে হাতে হাতে ধরে কত কি গল্প তারা করত। অনেক সময়ে চিঁড়ে আর খেজুর গুড়ের পাটালি পকেটে ভরে নিয়ে যেত, সেইখানে বসে দুজনের খাওয়া আর গল্প চলত।
উতল হাওয়া নদীর বুকে চপল ঢেউ তুলত, সেখানে সন্ধ্যার ছায়া দুলত, আকাশে দুটো একটা তারা দেখা যেত। তারা সেই সুদূর গ্রহলোকের কল্পনা-কাহিনী বলত, সেখানেও হয়ত এমনি স্কুল আচে বোর্ডিং আচে, ছেলেরা আছে, সেখানেও হয়ত ছেলেরা তাদের মা আর বন্ধুদের ভালোবাসে,—হয়ত এমনি সময়ে সেখানেও সন্ধ্যা হয়েছে আর এমনি নদীর তীরে অশান্ত আর মোহনের মত এমনি দুটি কিশোর বন্ধু বসে বসে গল্প করচে। করছে না যে তা কে বলবে? কিন্তু ঐ ধ্রুবতারার দেশের ছেলেরা বোধহয় স্বাধীন, তারা ইচ্ছা করলে নদীর ধারে ঘাসের ওপর বন্ধুর বুকে মাথা রেখে সারা রাতই গল্প করতে পারে, তাদের বোধহয় বোর্ডিং নাম-ডাকার তাড়া নেই!
কিন্তু আজ মোহনের মনটা এমন খারাপ হয়ে গেল কেন অশান্ত কিছুই তার স্বল্প অভিজ্ঞতায় বুঝে উঠতে পারল না। নদীর ধারের সেই স্থানটিতে গিয়েই মোহন অশান্তর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল, বলল, “মাথাটা বড় ধরেছে ভাই।”
মাথার চুলে আদর করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অশান্ত বললে, “ঠাণ্ডা হাওয়ায় এক্ষুনি সেরে যাবে।”
কিছুক্ষণ পরে, “মাথা ব্যথা সেরে গেচে,” বলে মোহন উঠে বসতে চাইল, অশান্ত তাকে জোর করে কোলে শুইয়ে রাখল, তার কোঁকড়া চুলে নিজের গাল চেপে ধরল, তাকে উঠতে দিল না। একমুহূর্তে মোহনের মন খুশি হয়ে উঠল, সে বলল, “আমার মাথাধরা সেরেচে। আমি এখন গাইব।”
মোহন গাইল অজানা কবির রচনা একটা পুরাতন গান, কোথায় সে শিখেছিল সেই জানে, তার ভাব পুরাতন, ভাষা পুরাতন, কিন্তু প্রেরণা নিত্য নূতন।…
“যত দিন দেহে প্রাণ রহিবে—আমি তোমারি, তুমি আমারি!”
নদীর এই তট যেন অপর তটে আঘাত করে এই কথাই গাইতে লাগল।
গানের সুরে কি ছিল জানিনা, এই গান গেয়ে ও এই গান শুনে দুজনেই মুগ্ধ বিহ্বল হয়ে পড়ল। দুজনের মুখেই স্বর্গের কি এক অপরূপ অপূর্ব সৌন্দর্য জাগল, তারা অবাক চোখে চেয়ে রইল, দেখে দেখে তাদের চোখ ফিরল না।
অশান্তর বুকে কিসের আবেগ ঠেলে উঠল, সে মোহনের গলা জড়িয়ে ধরল, তার মুখখানি নিজের মুখের অতি কাছে টেনে আনল, তার গোলাপ-কলির মত রাঙা ঠোঁট-দুটিতে একটা নিবিড় চুমো দিল। সহসা কি যেন অভাবিত অঘটন ঘটে গেল, যা তাদের কল্পনায় ছিল না। তারই হঠাৎ-স্পর্শ যেন দুজনকে এক মুহূর্তে কিসের স্বপ্নজালে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মোহনের মুখখানি এক পলকের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল, অশান্তর গালদুটি একটু লাল হল, তারপরে দুজনেই মৌন বিবর্ণ মুখে স্তম্ভিত হয়ে রইল। তারা যেন হঠাৎ কি একটা অপরাধ করে ফেলেছে, দুজনে দুজনের দিকে কিছুক্ষণ চোখ তুলতে পারল না, তাদের সহজ সম্বন্ধের মধ্যে ক্ষণেকের জন্য যেন প্রলয় ঘটে গেল।
অশান্ত ও মোহন পরস্পরকে এতো নিবিড় এতো বেশি ভালবাসতো যে তা হৃৎপিণ্ডের রক্তস্পন্দনের মতো অনুক্ষণের হয়েও অগোচরের বস্তু ছিল, তাই এই অভাবিত আত্মপ্রকাশের বিপুল আনন্দ তারা সহ্য করতে পারল না, তার অসহ্য আবেগ যেন তাদের একটু আঘাতই করল। যে পরম মুহূর্তটি তাদের ভাবী মুহূর্তগুলি অমৃতে মধুময় করে দিল তাকে প্রথম-মুহূর্তে তারা হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারল না,—পরশমণির যে স্পর্শ তাদের সারাজীবন সোনায় সোনা করে দিল প্রথম ক্ষণে তার আঘাতের বেদনাটাই যেন বেশি করে বাজল।
মোহন ধীরে ধীরে উঠে বসল, কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ; অবশেষে মোহন একটিমাত্র কথা বলল, “চল যাই।”
প্রতিদিন কত হাসি-কলরব-কৌতুকে এই পথটুকু তারা চলত, আজ কিন্তু তাদের একটিও কথা হল না, আপনার মধ্যে আত্মহারা হয়ে যেন যন্ত্রচালিতের মত তারা যাচ্ছিল, বোর্ডিংএর কাছাকাছি এসে মোহন বল্লে, “আজ রাত্রে কিছু খেতে পারব না, যে পিঠে খেয়েছি।”
অশান্ত শুধু বলল, “খুব পারবে। পিঠে খেলেই পেটে সয়।”
মোহন আর সব দিন বেড়িয়ে এসে অশান্তর ঘরে কিছুক্ষণ বসত, আজ সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। অশান্ত অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিত্যকার মত বাতি জ্বালবার কথা ভুলে বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে আলো জ্বেলে পড়তে বসল, কিন্তু বইয়ের একটি বর্ণও তার বোধগম্য হল না, মোহনের কাছে তার একখানা বই ছিল, সেটা আনবার ছুতায় তার কাছে যাবার প্রলোভন সে দমন করল, রোজই তারা একসঙ্গে পড়তে বসত, আজকের এই ছেড়ে পড়াটা তার মনে কেমন অস্বচ্ছন্দ অসোয়াস্তির মত ঠেকছিল,—বুকের ওপর বই চেপে, আজ সন্ধ্যায় এ কী যে ঘটে গেল—সেই কথাই নিঝুমের মত ভাবতে লাগল।
এদিকে খোলা বইয়ের সামনে বসে মোহনের চিন্তা অন্য ধারায় চলছিল। অশান্ত তাকে আজ চুমু দিয়েছে, স্নেহময় প্রাণের সহজ আদরের স্পর্শ তার জীবনে এই প্রথম, তখনো তার শিরায় শিরায় তারই তড়িৎ প্রবাহ খেলা করছিল। অশান্তর মধ্যে যেন তার চিরদিনের প্রাণের জন আজ তাকে দেখা দিল, সুন্দর যেন নিজের হাতে তার ললাটে সত্যের জয়-টীকা রচনা করে দিল,—এরই অজানা রহস্যের ছায়া যেন এই কিশোরের তরল চিত্তে পড়ছিল।
সে কেবলই ভাবছিল, কেন সে অশান্তর আদরের প্রতিদান দিতে পারল না, কেন সে অস্বাভাবিক রকম কেমনতর হয়ে গেল, কেন সে তার সঙ্গে ভালো করে দুটো কথা কইতেও পারল না!—অশান্ত না জানি তার সম্বন্ধে এখন কি ভাবচে!
সে আশা করছিল প্রত্যহের মত আজও অশান্ত তার কাছে পড়তে আসবে তখন কোনো সুযোগে তাকে এই ভালোবাসার বিনিময় দেবে, কিন্তু কাজটা যত সহজ তত সোজা নয়, তাই কেমন করে সে অশান্তকে চুমু দিতে পারে সেই উপায়ই মনে মনে কল্পনা করতে লাগল। কিশোর বয়সে আদর নেওয়া যত সোজা আদর দেওয়া ঠিক তেমনি কঠিন, ইচ্ছা না থাকলেও অপরের আদর অবিচলচিত্তে নেওয়া যায়, কিন্তু বুকজোড়া একান্ত ইচ্ছাতেও প্রিয়তমকে এতটুকু আদর করতে পারা যায় না।
কিন্তু অশান্ত পড়তে এলনা দেখে মোহন বড় ক্ষুণ্ন হল, বই বন্ধ রেখে শুয়ে পড়ল, তার পড়া হল না। অভিমানে সে খাবার ঘরে পাশাপশি বসে খেয়েও অশান্তর সঙ্গে একটিও কথা বলল না, আহত মনে অশান্তও চুপ করে রইল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে অশান্ত চুপ করে নিজের ঘরে চলে গেল, অন্যরাতের মত মোহনের ঘরে এসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিল না। তার মলিন মুখ দেখে মোহনের ইচ্ছা করছিল তখনই গিয়ে অশান্তর গলা জড়িয়ে ধরে,—অন্যদিন হলে ছুটে যেত কিন্তু আজ তার পা উঠল না।
পরের দিন অশান্তর খুব পড়ার চাপ ছিল, তাই খেয়েদেয়ে ঘুমোন তার হলনা, সে ঘরে গিয়ে স্কুলের ‘টাস্ক’ লিখতে শুরু করল। ভার মন নিয়ে পড়তে পড়তে কখন যে তার পড়ায় মন বসে গেছে, রাত বারোটা বেজেছে তাও তার খেয়াল নেই। এমন সময় দরজা ঠেলে মোহন ভয়াতুরের মত বিবর্ণ মুখে ঘরে ঢুকল,—অশান্ত বই থেকে চোখ তুলে তাকে দেখে বললে, “কি হয়েছে মোহন?”
মোহনের কথা সরল না, অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, “তারেশ—”
“তারেশ কি করেছে? এখন রাত কত?”
“বারোটা হবে।”
অশান্ত তার হাত ধরে কাছে বসিয়ে বলল, “এত ভয় পেয়েচ কেন? বোসো।”
তার সব রাগ দুঃখ এই আদরের ছোঁয়ায় চোখের জলের রূপ নিয়ে ঝরে পড়ল, অশান্ত হাত দিয়ে চোখ মুছিয়ে বলল, “কাঁদচ কেন? কি হয়েছে আমাকে বল। এত রাত্রে ঘুমোও নি যে?”
“ঘুম আসছিল না, শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম, এমন সময়ে তারেশ—”
“এতরাত্রে তারেশবাবু আবার কি করল?—”
মোহন অশ্রুজড়িত কণ্ঠে বলল, “সে আমার ঘরে গিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে দু’হাতে আমার মুখ চেপে ধরেছিল, আমি চিৎকার করে কাউকে ডাকতে পারিনা, সে আমাকে, সে আমাকে, সে আমাকে—”
মোহন আর বলত পারল না, কিন্তু এতক্ষণে তারেশের সমস্ত ব্যবহারের অর্থ অশান্তর কাছে যেন স্পষ্ট হল, সে অত্যন্ত উষ্ণ হয়ে উঠল, কিন্তু বন্ধুর বিপদ কল্পনা করে তেমনি গম্ভীর হয়ে পড়ল। তারেশ ভালো খেলোয়াড় বলে মাস্টার ও ছেলেদের কাছে তার খুব খাতির, তার এই সব ভয়ঙ্কর দোষও তাঁরা উপেক্ষার চোখে দেখেন। তার ওপরে সে সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের ডান হাত, বোর্ডিংএর মধ্যে সেই সর্বেসর্বা—নিরুদ্বেগে ছেলেদের মস্তক চর্বণ করবার অধিকার আর দাবি তার কম ছিল না! তবু সে বন্ধুকে সাহস দিয়ে বলল, “কোনো ভয় নেই আমি আছি, লাঠি মেরে ব্যাটার মাথা ফাটিয়ে দেব।”
“আমিও পালিয়ে এসেচি ওর নাকে ঘুষি মেরে। দুহাতে নাক চেপে বসে পড়েছে।”
“বেশ করেচ। যেমন দুষ্টু, তেমনি শাস্তি!”
“আজ আমি তোমার কাছে শোবো। একলা ঘরে শুতে আমার ভয় করচে।”
“তুমি একটু বসো। আমি তোমার র্যাফারটা নিয়ে আসি, একটা গায়ের কাপড়ে ত দুজনের কুলোবে না।”
মোহনের ঘর থেকে তার র্যাফার ও বালিশটা নিয়ে ফিরে এসে অশান্ত নিজের বিছানাটা ভালো করে পাতল। তারপরে আলোটা কমিয়ে দিয়ে দুজনে শুয়ে পড়ল।
মোহন অশান্তর বুকে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়েছিল, অশান্ত সেই চুলভরা মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, আর মাঝে মাঝে ফুলো ফুলো চুলের গুচ্ছে অধরের স্পর্শ দিচ্ছিল, চুলের ভিতর দিয়ে সেই আদরের অনুভূতি তার সারা অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছিল।
একটু পরে অশান্ত বললে, “একসঙ্গে দুজনের শোয়া নিষেধ, জানো তো? বোর্ডিং-এর এই নিয়ম আমরা খুব পালন করচি!”
মোহন বল্লে, “আজ থেকে রোজ আমি এখানে শোবো। কিম্বা তুমি আমার ঘরে শোবে। ছোট চৌকি হলেও আমাদের কুলোবে।”
“তাহলে তারেশ আমাদের নামে আরো কত কী বদনাম রটাবে।”
“রটাক সে। মিথ্যাকে আমি ভয় করিনে।”
“মাস্টারদের কানে তুলবে, হয়তো এখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেবে, ‘রাস্টিকেট’ করবে।”
“বেশত, এখানে না পড়ি, দুজনে কলকাতায় গিয়ে পড়ব।”
“বাঃ, কলকাতায় যাবার কি সোজা রাস্তা!—” দুজনেই হেসে উঠল।…
তারপরে দুজনেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। সেদিন সমস্ত দিনটা মেঘলা করেছিল, শেষরাতে অকালবর্ষণ শুরু হলো। বৃষ্টির ঝরঝরানি সুরে দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল, দুজনেই নীরবে বুকের মধ্যে অভিনব অনুভূতির সঞ্চার অনুভব করল। মোহনের ইচ্ছা হল অশান্তর বুকের মধ্যে আশ্রয় নেয়, সে দুষ্টুমি করে নিজের গায়ের চাদরটা মাটিতে ফেলে দিয়ে অশান্তর চাদরটা টানতে লাগল, অশান্ত জিজ্ঞেস করল, “কি হচ্ছে?”
“আমার গায়ে চাদর নেই, বড্ড শীত করচে।”
চাদরটা তার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিতে দিতে অশান্ত বল্লে, “তোমার চাদর কি হল?”
যেন কত নিদ্ৰাজড়িত কণ্ঠে মোহন উত্তর দিল, “কোথায় গেছে খুঁজে পাচ্চিনে।”
দুজনে একই চাদরের তলায় আসতেই মোহন অশান্তর বুকটি ঘেঁষে তার গলা জড়িয়ে ধরল, তার গালের উপর গাল রাখল, অশান্তরও ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়—সে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল।
১৪
শনিবার সন্ধ্যার পর বোর্ডিংএর উঠানে ছেলেদের দাঁড়ানো-মজলিস জমেছিল, সেদিন থার্ড ক্লাস বনাম সেকেণ্ড ক্লাসের ফুটবল ‘ড্র-ম্যাচে’ বাস্তবিক পক্ষে কারা জিতেচে তারই জোর আলোচনা চলছিল। ‘রেফারির’ একচোখো সূক্ষ্মদৃষ্টিরও যথেষ্ট সমালোচনা হল, কেননা সেইহেতু এমন কতকগুলো ‘হ্যাণ্ডবল’ আর ‘ফাউল’ তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে যার ‘পেনালটিশুটে’ নির্ঘাত গোল হোতো! যারা বিপক্ষ-দলকে প্রায় গোল দিয়ে দিয়েছিল আর কি, কেবল একটুর জন্য পারেনি তারাই সেই কলরব-সভার নেতৃত্ব করছিল। ছুটির দিনে তাস-পাশার মায়াপাশের আকর্ষণে মাস্টাররা অনুপস্থিত থাকায় ছেলেদের বক্তৃতার স্বাধীন অধিকারে ১৪৪ ধারা জারি করবার কেউ ছিল না।
এই সব থেকে দূরে একটি ঘরে সতীশ বলে যাচ্ছিল, “আমি ত প্রায় রোজই আমার সাইকেল নিয়ে একটা না একটা গাঁয়ে যাই, এখানকার কেউ জানে না, সন্ধ্যার পর লুকিয়ে যাই, প্রায় সব গাঁয়েই একটা করে নাইটস্কুল করেছি, সেখানে পড়াবার লোকও জুটেচে। মেথর পাড়ার আর কুলী পাড়ার স্কুলে পড়াতে কেউ রাজি হচ্ছে না, তাই হপ্তায় তিন দিন করে আমি নিজেই গিয়ে পড়াব ঠিক করেচি।”
তারেশ এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল, এইবার মাঝখান থেকে বলে উঠল, “ভদ্রলোকের ছেলেদের বরাতে যা নেই সেই দুর্লভ শান্তি চাষীদের ছেলেরা এতদিন নির্বিরোধে ভোগ করছিল, কিন্তু এই শিশুপাল হত্যার ব্রত তুমি কবে থেকে নিলে আমরা তো জানিনে।”
সতীশ বললে, “আমার স্কুলে শিশু কেউ নেই, সবাই ষোলর উপরে। এবং তাদের কেবল আমি বর্ণ-পরিচয় শেখাইনে, দেশের খবর, দুনিয়ার হালচাল, চাষীদের স্বত্ব ও স্বার্থ, নতুন আদর্শ, নতুন স্বপ্নের কথা তাদের আমি শোনাই! কিছু টাকা যোগাড় করতে পারলে ভেবেচি কলকাতা থেকে ম্যাজিক লণ্ঠন ও স্লাইড কিনে এনে গ্রামের স্বাস্থ্যরক্ষার ছবি তাদের দেখাব। তারা আমায় এত ভালোবাসে, এক একজন আমার ঠাকুর্দার বয়সী, কিন্তু আমার উপর তাদের এত নির্ভর! যেন আমি তাদের বন্ধু, তাদের কতকালের আপনার জন।”
সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে তারেশ বলল, “সখের মাস্টারিতে লাভ আছে যদি ছাত্রের পালে দু একটা রাঙা ছেলে থাকে। বই পড়ার চেয়ে প্রেমে পড়া আর শুয়ে পড়ারই আমি বেশি পক্ষপাতী, — একটা কিছু পড়লেই হলো! কিন্তু আমায় মাপ কর, তোমার ওই সখের দলে আমি ভর্তি হতে পারলুম না, তোমার যে সব “প্রাপ্তেতু ষোড়শে বর্ষে”—
সতীশ হেসে বল্লে, “মাভৈঃ, আমি তোমায় আশ্বস্ত করছি। সুন্দর যে ভগবানের প্রকাশ আমি তা মনে মনে মানি,— যদিও তোমার মত রাঙা ছেলেদের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াইনে তবু আমিও সৌন্দর্যের পূজারী। এবং আমার এই ভবঘুরে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় এমন জায়গা দেখিনি যেখানে সবাইকে অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাবার জন্য ভগবান তাঁর প্রতিনিধি মোতায়েন রাখেননি, এমনকি নরকে পর্যন্ত!”
তারেশ উৎসাহে সোজা হয়ে বল্লে, “বল কি! তোমার ওই চাষাভূষোর মধ্যেও সৌন্দর্য আছে নাকি?”
সতীশ বলল, “নিশ্চয়! রূপ তো কেবল রঙে নয়, রূপ হচ্চে দেহের গঠনে, অন্তরের স্বচ্ছ প্রকাশে,—সবল সরল চাষীর ছেলেদের মধ্যে তার অভাব নেই,—কদাচিৎ দুএকটা কটা চামড়াও যে চোখে পড়ে না এমন নয়, কিন্তু সে কথা থাক, আমি তাদের কারুরই প্রেমে পড়িনি কিন্তু সবাইকেই ভালোবেসেছি।”
তারেশ কহিল, “কিন্তু জানো ত আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জন লিখতে-পড়তেও জানে না,— নাইট স্কুলে পড়ে সবাইকে শিক্ষিত হতে হলে কলিযুগের এই বাকি কটা দিন অবলীলাক্রমে কেটে যাবে, তাতে আর ভুল নেই!”
সতীশ একটু চিন্তা করে বলল, “তুমি মিছে বলচ না! কিন্তু আমি ভেবে ভেবে একটা নতুন শিক্ষাপদ্ধতি আবিষ্কার করেচি যাতে করে মাত্র তিনমাস পড়িয়ে আমরা ছাত্রদের স্বাধীন ভাবে জ্ঞানার্জনের যোগ্য করে দেব,—জানবার স্পৃহা আর জানবার শক্তি জাগিয়ে দিলেই আমাদের ছুটি!”
তারেশ মুখখানা গম্ভীর করে বলল, “তাই নাকি? সেটা কী?”
তারেশের কৌতুকের ভঙ্গী দেখে সতীশের মুখ একটু ম্লান হল, সে ক্ষুণ্ন স্বরে বলল, “আমার মুখ থেকে বেরুচ্চে বলেই যদি কথাটা খেলো না হয় তবে বলি। নাইটস্কুলে আমি তাদের তিনমাসে কেবল লিখতে পড়তে সক্ষম করে দেব, তারপর তারা লাইব্রেরীতে ভর্তি হবে। প্রথমে শিশুপাঠ্য সব বই থেকে শুরু করে মাসের পর মাস বছরের পর বছর ধরে ঘরে বসে বাংলা সাহিত্যের সব বই পড়ে ফেলবে—সাহিত্যের মারফতে ক্রমশ তারা উপন্যাস, গল্প, নাটক, কবিতা, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজতন্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, স্বদেশী বিদেশী বিচিত্র আদর্শ ও ভাব সবকিছু হজম করে যে সত্যিকার শিক্ষা লাভ করবে তা হয়তো ইউনিভার্সিটির ছাপমারা তাদের উচ্চ শিক্ষিত ভাইদের চেয়ে কম নয়। এবং তাদের এই মস্তিষ্ক ও মনের রূপান্তর দিনের পর দিন এত সহজে এত অগোচরে ঘটবে যে চাষীর ছেলে হাল ছাড়তে ভুলে যাবে, তাঁতির ছেলে তাঁত ছেড়ে ফোতো বাবুয়ানি শিখবার অবসর পাবেনা,—ক্রমশ একটা শক্তিমান বিরাট জাতি গড়ে উঠবে।”
তারেশ এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত সতীশের মুখের দিকে চেয়ে তার কথা শুনছিল, সে হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে সতীশের করমর্দন করে বলল,— সত্যি, আমি তোমার এই কল্পনাশক্তির প্রশংসা করি। শুনেই আমার ধারণা হচ্চে হয়তো এটা কাজে খাটানো চলে।”
সতীশ অত্যন্ত খুশি হয়ে বলল, “কাজে খাটানো চলে কিনা তারই পরীক্ষার জন্যই তো এই নাইটস্কুলগুলো খুলেচি, যদি সফল হই তাহলে সারা বাংলায় এই বার্তা প্রচার করে বেড়াব, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তখন সর্বত্রই আমার এই পদ্ধতি গ্রহণ করবে। এই বিপুল নিরক্ষর জাতিকে যদি আমাদের জীবন-কালের মধ্যে শিক্ষিত দেখে যেতে হয় তাহলে স্কুল আর টেকস্ট বুকে তা সম্ভব হবে না, শিক্ষার মিডিয়ম করতে হবে সাহিত্য আর পাঠাগার।”
তারেশ বিস্মিত সুরে কহিল, “আমাদের জীবনকালের মধ্যে সবাই শিক্ষিত হবে, তুমি কি স্বপ্ন দেখচ!”
সতীশ যেন কোন্ অদূরের ভবিষ্যতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল, “হাঁ ভাই, আমি সেই স্বপ্নই দেখচি। শিক্ষার উপর নির্ভর করচে দারিদ্র-দুঃখের মোচন, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, রাষ্ট্রতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পরিবর্তন, জাতির ও মানুষের মুক্তি, এবং শিক্ষার উপরই নির্ভর করছে দেহের স্বাস্থ্য, মনের বল, আত্মার অনুভূতি,—এক কথায় পরিপূর্ণতা! এমন শিক্ষা আমি আমার জাতিকে দিতে চাই যে সে নিজে ভাবতে শিখবে, সবার ভালো করতে শিখবে, সবাইকে ভালোবাসতে শিখবে,—অনন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার আর অসীম প্রাণের ভাণ্ডার সবার কাছে মুক্ত থাকবে তা সে লাঙলই চালাক আর দেশই চালাক! আমি মরবার আগে দেখে যেতে চাই যে খর্ব খঞ্জ অন্ধ মানুষের দল আর হাহাকার করে ফিরচেনা, সুন্দর স্বচ্ছন্দ, সত্য মানুষ তার অন্তরের মধ্যে ও ভুবনের মধ্যে শক্তির রসের ও পূর্ণতার সন্ধান পেয়েচে!”
তারেশ বলল, “আমি আশাবাদী বটে, কিন্তু তোমার মত অতটা ক্ষেপে যাইনি! আমাদের মধ্যে দু’একজন পূর্ণতার সৌভাগ্য নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু আর সবাই সার্থকতা খুঁজি বটে, তবু ব্যর্থতাই আমাদের পুঁজি।”
সতীশ বলল, “আমি তা বিশ্বাস করি না। আমি নিজের জীবনে কত বড় অসম্ভবকে ঠেলে কেমন করে দাঁড়াচ্চি তা যদি বলি তা হলে বুঝবে পৃথিবীতে কারুর সম্বন্ধেই হতাশ হবার কিছু নেই। স্বচ্ছন্দ হবার শক্তি, সব বাধা বন্ধন ঠেলে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা সব মানুষের অন্তরেই আছে,—সত্যের শিক্ষা, স্বভাবের শিক্ষা আর আনন্দের শিক্ষাই তার সেই প্রেরণা সেই শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। প্রত্যেক মানুষ পূর্ণ হবে তার নিজের চিন্তার ফলে তার নিজের শক্তির বলে,—আমরা কেবল দেখব তাদের সেই বিষয়ের কেবল শিক্ষাটুকু দিতে পারি কিনা!”
তারেশ কহিল, “কেবল শিক্ষা দেওয়া—এই কেবল-টুকু নিতান্ত কম ব্যাপার নয়। আমার তো মনে হয় সর্বসাধারণের পক্ষে তাও অসম্ভব,”—
সতীশ কহিল, “তাহলে বলি সর্বসাধারণের একজন হয়ে আমার পক্ষে এই কেবল শিক্ষাটুকু কেমন করে সম্ভব হয়েচে। পাঁচ-ছ’বছরে বর্ণপরিচয় বোধোদয় সাঙ্গ করে আমি ছেলেদের মাসিকপত্র আর গল্পের বই পড়তে শুরু করি, সাত-আট বছর বয়সের মধ্যে আমি কৃত্তিবাস কাশীরামের রামায়ণ মহাভারত শেষ করে ফেলি, আমার বাবার ছিল প্রকাণ্ড লাইব্রেরী, আমি ওই অল্পবয়সেই বঙ্কিম, সঞ্জীব, রমেশ, দীনবন্ধুর গ্রন্থাবলী থেকে শুরু করে চার পাঁচ বছরে বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব বইই পড়ে শেষ করেচি। এখন আমি কি পড়চি, আমার শেলফে ওগুলো কি বই, জানো? ও হচ্ছে রবিবাবুর ‘সমাজ’ ‘সাহিত্য’, ‘ধর্ম’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’;—বিবেকানন্দর”—
তারেশ বাধা দিয়ে বললে, “প্রবন্ধ বস্তুটি বিচিত্র বই কি! রবিবাবুর নভেল,—নৌকাডুবি কি চোখের বালি হলেও না হয় পড়া যেত! অন্ততপক্ষে কবিতা, কি প্রেমের গান!”—
সতীশ কহিল, “উপন্যাসও আছে, কবিতাও আছে, রবিবাবুর ‘গোরা’ ‘খেয়া’”—
তারেশ বলল, “খেয়া! খেয়া নয় ধোঁয়া! অসহ্য! রবিবাবুর এত যে বই পড়েচো, ওর কিছু কি তুমি বুঝেচ? আমি তো”—
সতীশ কহিল, “কি বুঝিচি আর কি বুঝিনি তা আমার কাছে বড় নয়, তবে এই ধরনের শিক্ষা থেকে আমি যা পেয়েচি তা কাউকে বোঝাতে পারব না, তা হচ্চে রহস্যময় কিছু, যা কারণ দেখাতে পারেনা অথচ মানুষের বিপুল সম্ভাবনায় বিশ্বাস জাগায়, যার মূলে যুক্তি নেই, অথচ অনির্বচনীয় সত্য আছে।”
তারেশ হেসে বললে, “তোমার এই হেঁয়ালীর এক বর্ণও আমি বুঝতে পারচিনে, তবে একটা কথা আমার মনে হয় যার সত্যতা বোঝানো কিছুমাত্র অনির্বচনীয় নয়—তা হচ্ছে তোমার এই শিক্ষার-পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট টাকার দরকার, তা তুমি পাচ্চ কোথা থেকে?”
সতীশ কহিল, “আপাতত আমার বেশি টাকার দরকার নেই, কেবল একটা পাঠাগারের জন্য যা টাকা চাই,—তার অধিকাংশ আমি নিজের হাতঘড়ি, ফাউণ্টেন, আর কতকগুলো পড়ার বই বিক্রি করে যোগাড় করেচি, বাইসিকেলটাও বিক্রি করব, আর বাবার সেই লাইব্রেরীর যে-অংশ এখনো অবশিষ্ট আছে তাও আমার কাজে আসবে।”
তারেশ কহিল, “কিন্তু আরো ত টাকার দরকার হবে, তখন পাবে কোথায়?”
সতীশ ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবল, পরে বিছানায় ঘুষি মেরে বললে, “আমাদের জমিদাররা কেবল প্রজার ওপর অত্যাচার করে, আর তাদের বুকের রক্তে ফুর্তি ওড়ায়, নইলে দেশের ভাবনা ছিল কি! নিজেরা মানুষ না হলে অপরের মানুষ হবার দাবিতো বোঝা যায় না,—যতদিন একজন মানুষও অপূর্ণ থাকছে ততদিন আমিও অপূর্ণ, ততদিন আমার স্বস্তি কই!—এত বড় ব্যাকুল প্রাণ যদি তাদের বুকের মধ্যে জাগ্ত তবে তারা বুদ্ধের মত বিলাস-সম্পদ করে ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে মানুষের সেবার আনন্দে তন্ময় হয়ে যেত।”
তারেশ হেসে বললে, “আজ তা বড় মুখ করে বলতে পারচ বটে কিন্তু নিজে জমিদার হলে ওদেরই একটা দ্বিতীয় না হোক, আট আনা সংস্করণ হতে।”
দৃঢ় স্বরে সতীশ উত্তর দিল, “কখনই না! আমি যদি এমন মন নিয়ে জমিদার হতুম তা হলে বিয়ে করতুম না, পোষ্যপুত্রও নিতুম না, জমিদারির আয়ের সব টাকা দিয়ে দেশের অজ্ঞতা আর অজ্ঞান দূর করতুম,—তখন আমার এই শিক্ষাপ্রচারের কাজ দিন দিন বেড়ে চলত। আমার সব সম্পত্তি মানুষের সেবায় দিয়ে নিজে অন্যতম অভিভাবক মাত্র থাকতুম।”
তারেশ বললে, “কিন্তু তখনো যে তোমার এই মন থাকত তার প্রমাণ কি!”
সতীশ কহিল, “তার পরিচয় বড় রহস্যময়,—আমার সত্য আমার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করতই, এবং আমার এই জীবনে করবেই, এতে আমার এতটুকু সংশয় নেই। যে শিক্ষা-ধারা আমি বিস্তার করতে চাচ্ছি তা ভারতের চিরদিনের বস্তু, তা হচ্চে আত্মজ্ঞানের ও আত্মপ্রকাশের শিক্ষা।”
এমন সময় অশান্ত ও মোহন সেই ঘরের পাশ দিয়ে চলে যেতেই তারেশ ডাকল, “মোহন, শুনে যাও।”
মোহন কিন্তু শুনল না, সে অশান্তকে টেনে নিয়ে অবহেলায় চলে গেল। তারেশের মুখ কালো হয়ে উঠল।
সতীশ সে দিকে লক্ষ্য না করে বলল, “এদের দুটিকে আমার বেশ লাগে, এদের ভালোবাসা এমন শুদ্ধ এত সুন্দর যে দেখলে চোখ জুড়োয়, কখনো ইচ্ছে করে ভায়ের মত ওদের দুজনকেই বুকের মধ্যে চেপে ধরি!”
তারেশ ঠোঁটের কোণে হেসে বললে, “কেবল চোখের প্রতি পক্ষপাত করচ, বেচারা বুককেও কেন একটু জুড়োতে দিচ্চ না। আহা, বৈষ্ণব কবি কোন্ যুগে বলে গেচেন, “রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর,—প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর!”—তা দেখচি এযুগেও সমান সত্যি রয়েচে!”
সতীশ কহিল, “আর কোনো বাধা নেই, কেবল ভয় হয় আমার এই আদরের অত্যাচারে হয়তো ওদের সহজ ছন্দটি নষ্ট হয়ে যাবে, মনের প্রকাশের পথ রুদ্ধ হবে। যদিও আমি জানি যে আদরের স্পর্শে সুপ্ত মন জেগে ওঠে, বিকশিত হয়।”
তারেশ সকৌতুকে কহিল, “তুমি ওদের মানসিক ক্ষতির ভয়ে কাহিল, কিন্তু ওরা যে দৈহিক নষ্ট হচ্চে না তা কেমন করে জানলে? এই ত ওদের সোমত্ত বয়েস! এই বয়েস কালে আজকাল বাংলাদেশের কোথাও কোনো ছেলে অনাঘ্রাত বা অক্ষত থাকে না।”
সতীশ সবিস্ময়ে বলল, “তুমি বলচ কি তারেশ? এরা যে ফুলের মত দুটি কচি শিশু!”
তারেশ একটু হেসে বলল, “আমার অভিজ্ঞতায় এদের চেয়েও কচি শিশুকে উক্ত কর্মে অভ্যস্ত দেখেচি! যে নষ্ট করে সেও নিজের ইচ্ছায় করে না, যে নষ্ট হয় সেও নিজের ইচ্ছায় হয় না, মানুষের রক্তমাংসের ভেতরে কোন্ শয়তানের বাসা জানিনে, যার অস্বাভাবিক প্রেরণায় দুদলেরই এই সর্বনাশের যাত্রা!”
সতীশ কহিল, “তুমি যা বলচ তার কিছু হয়তো সত্যি হতে পারে, আমিও এ সম্বন্ধে অনেক ভেবেচি,—কিন্তু আমার মনে হয় সুন্দর ছেলেদের সবাই কেবল ভালোবাসে, তাদের নিশ্চয়ই কেউ নষ্ট করে না। কবি বলেচেন, “যে প্রদীপ আলো দেবে তাহে ফেল শ্বাস, যারে ভালবাস তারে করিছ বিনাশ!””
তারেশ কহিল, “ঠিক তার উলটো—সুন্দর ছেলেদের বন্ধুর সংখ্যা যেমন বেশি, তাদের সর্বনাশের মাত্রা তেমনি গুরুতর। দৈবাৎ যদি কেউ সত্যি সত্যি ভায়ের মত ভালবাসল তবেই রক্ষা, সেই সাবধান করে দিল, নিজের অন্তরের শক্তিতে ভালোর পথে নিয়ে গেল। নইলে আজ যাকে দেখলে সৌন্দর্যে স্বর্গের দেবকুমার, দুবছর বাদে তার বিরূপ চেহারা দেখে তাকে আর চিনতে পারবে না।”
সতীশ কিছুক্ষণ নতমস্তকে ভেবে বললে, “ভালোবাসাই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান, আর তো আমি কিছু পাচ্ছিনে। যে ভালবাসল সে নিজেও মুক্ত হল, অপরকেও মুক্তি দিল। তাই আমার মনে হয়, ছেলেরাই ছেলেদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, নইলে বাহির থেকে আর কেউই তাদের বাঁচাতে পারবে না।”
তারেশ কহিল, “সে কথা সত্যি। কিন্তু এই ভালোবাসাই দুর্লভ।”
সতীশ কহিল, “ভালোবাসার প্রেরণা অতি শিশুকাল থেকে সবার অন্তরেই আছে কেবল তার জাগরণ চাই, প্রকাশের পথ পেলে সে নিজের জোরে নিজেই বেড়ে উঠবে,—আলো যেমন অন্ধকার দূর করে তেমনি সহজে সে সব অমঙ্গল নষ্ট করবে। তুমি বলেচো যে সুন্দর ছেলেদের উপাসকের সংখ্যা খুব বেশি,—কিন্তু এতে সর্বনাশটা কোন্খানে? ছেলেবেলা থেকে সৌন্দর্যের দিকে টান, সুন্দরের পূজা, সৌন্দর্য-বোধ, ক্রমশ তাদের অমঙ্গল ও কদর্যতা থেকে নির্মুক্ত ও নির্মল করে তাদের জীবনের মহৎ সম্ভাবনাকে কি সত্যে পরিণত করবে না?”
তারেশ চুপ করে রইল, সতীশ বলে চল্ল, “জীবনে যারা বড় হয়েচে, মহৎ হয়েচে, কবি হয়েচে, শিল্পী হয়েচে, স্রষ্টা হয়েচে, যারা বিশ্বমানবের সেবা করেচে, মানুষের ভাগ্য গড়েচে তারা সবাই ছেলেবেলার বন্ধুর কাছে—ছেলেবয়সের ভালোবাসার কাছে ঋণী। ভালোবাসা না পেলে ভালো না বাসলে মানুষ ভালো করে কিছু গড়তেই পারে না। আমার তো খুব সাধ যায়,”—
তারেশ উৎসুক হয়ে কহিল, “কি সাধ যায়?”
সতীশ একটু থেমে বললে, “সাধ যায় আমার একটি প্রাণের বন্ধু থাকে তা সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, আমার চেয়ে বয়সে বড়ই হোক আর ছোটই হোক,—যার সৌন্দর্য হবে আমার কর্ম-দিবসের আলো, যার প্রেম হবে আমার বিশ্রামরজনীর আনন্দ। আমি যদি জানি কেউ আমায় ভালোবাসে তাহলেই আমি ‘আমি’ হতে পারি, আনন্দে বাঁচতে পারি, আবার তেমনি আনন্দে মরতে পারি।”
মোহন সেই ঘরের বাহির দিয়ে চলে যাচ্ছিল, তারেশ সতীশকে বলল, “মোহনকে এখানে ডাকোনা।”
সতীশ বলল, “আচ্ছা ডাকচি। ও এলেই যেন ঘরটা আলো হয়ে উঠে। মোহন, শুনে যাও ত।”
মোহন চলে গেছল, ফিরে এসে দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, “আমাকে ডাকছো সতীশদা?”
সতীশ বললে, “হ্যাঁ ভাই। তোমার বন্ধুটিকে নিয়েই দিনরাত ব্যস্ত, এদিকে তোমার হতভাগ্য দাদাগুলো যে একান্ত অবহেলায় এক কোণে পড়ে থাকচে সেদিকে খেয়াল নেই?”
মোহন সলজ্জ হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, “দাদারই কাজ হচ্চে ভাইদের দেখা, নইলে”—
সতীশ হেসে বললে, “নইলে কি? ভাইরা বেহাত হয়ে যাবে, নয়?”
মোহন সতীশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, এই কথার কোনো উত্তর দিল না, সতীশ বলল, “এইখানে একটু বোসো।”
মোহন সতীশের কাছ ঘেঁসে উভয়ের মাঝখানে জড়সড় হয়ে বসল।
সতীশ তারেশকে কহিল, “হ্যাঁ, আমি এতক্ষণ যেজন্যে তোমার কাছে এসেচি তাই বলিনি, আমার এই কাজের জন্য যে টাকার দরকার তার কিছু তোমাকেও দিতে হবে। তুমি রাঙা ছেলেদের জন্য এত টাকা নষ্ট কর, কালো ছেলেদের মানুষ হবার জন্য না হয় কিছু দিলে।”
‘রাঙা ছেলের’ উল্লেখে মোহনের মুখ চকিতের জন্য লাল হয়ে উঠল। সতীশ লক্ষ্য না করলেও তারেশের তা চোখ এড়ায়নি। সে মোহনের দিকেই দৃষ্টি রেখে বললে, “আমি ভস্মে ঘি ঢালিনে, আগুনে ঢালি। তুমি বলবে ওদুটোর একই ফল, আমার কাছে তা নয়। আগুনে ঘি ঢাললে আগুন আরো বেশি জ্বলে! যতক্ষণ ঘি ঢালি ততক্ষণই সে আমার, তার জীবন আমার, তার প্রেম আমার, তার সব আমার,—ততক্ষণই তার তাপে জীবনের এই পৌষমাসে আমার দুহাত গরম রাখতে পারি!”
এই কথা বলতে বলতে তারেশ লণ্ঠনের ‘বার্নারের’ চাবিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, কথাটা শেষ করেই সে চাবিটা ঘুরিয়ে আলো নিবিয়ে দিল,—কয়েক মুহূর্তের জন্য সমস্ত ঘর অন্ধকার! ‘ওকি করলে,’—এই বলে সতীশ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে দেশলাই বার করে বাতি জ্বালালো, কিন্তু এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মোহনের পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। মোহনের সমস্ত মুখ বিবর্ণ, চুলের থাক বিশ্রস্ত, তার গালে চুমোর দাগ জ্বলজ্বল করছে,—ইতিমধ্যে তারেশ যে তার প্রতি এই অত্যাচার করেচে তা তার অগোচর রইলো না।
নিজে না পারলেও কারও চুমো দেওয়া সে অপরাধ মনে করত না। তারেশ যদি তার সমুখেই মোহনকে চুমো দিত তাহলে সে কিছুই মনে করত না, কিন্তু এইভাবে আলো নিবিয়ে জোর করে চুমো খাওয়ায় সেই না-দেখা দৃশ্যটি যেন কদর্য হয়ে তার চোখের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হল, এবং ভালোবাসার সহজ প্রকাশ যে চুমো, অপবিত্র অপরাধের মত তার গোপন ভীরুতার মধ্যে এই কুৎসিত সুযোগ অনুসন্ধানের চেষ্টা সতীশের মনে আরো কত বিশ্রী বিষয়ের ইঙ্গিত করল, সেখানকার বাতাস সতীশের এক মুহূর্তের জন্য আর সহ্য হল না। সে দাঁড়িয়ে উঠে কেবল মোহনকে ডেকে বলল, “মোহন আমার সঙ্গে এসো।” তারপরে উভয়ে চলে গেল।
তার এই এক মুহূর্তের অসংযমে একি বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল, তাই ভেবে তারেশ নিজের প্রতি একান্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, জ্বালাময় চাবুক দিয়ে নিজের মনকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে সে কেবলি অন্তরে অন্তরে হাহাকার করে উঠতে লাগল—সোনা ফেলে তুচ্ছ কাঁচের প্রতি তার একি লোভ; যাকে চায় তার মন হারিয়ে গায়ের জোরে কেবল প্রাণহীন দেহটাকে নিয়ে দিনরাত তার একি নিরর্থক টানাটানি! দেহের দস্যু সে, রূপের রাক্ষস সে—ধিক্ তাকে।