ছেলে বয়সে – ১

শ্রীকান্ত বড় হলে, লোকে তাকে জিজ্ঞেস করল যে তার জীবনে কাকে এবং তাকে কে প্রথম ভালবেসেচে,—শ্রীকান্ত দুটি চোখে স্মৃতির স্বপ্ন ভরে নিয়ে প্রশ্নকর্তার চোখে চোখে চেয়ে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, রাজলক্ষ্মী। সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীকান্ত আরও ধীরে একটু মাথা নেড়ে নিজের কথাটারই অব্যক্ত সায় দিল;—সেটা তার পুরনো স্মৃতির দোলা।

প্রশ্নকর্তা উত্তর শুনে বিমুগ্ধই হলেন, বিশেষ করে উত্তর-কর্তা যখন তাঁকে রাজলক্ষ্মীর স্বহস্তে তৈরি এক পেয়ালা চা ও পর্যাপ্ত সন্দেশ দিয়ে সম্বর্ধনা করলেন। কিন্তু বিমূঢ় হলেন কেবল বিধাতা—হতভাগ্য ইন্দ্রনাথকে স্মরণ করে।

শ্রীকান্ত সারাজীবন ধরে রাজলক্ষ্মীরই পূজা করে চলল, এবং তার জীবনে ইন্দ্রনাথের ঋণ-স্বীকারের আর কোনো চেষ্টা এপর্যন্ত দেখা গেল না বটে, কিন্তু এটাও ত অস্বীকার করা চলে না যে ছেলেবয়সে ইন্দ্রনাথই তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। এবং যার আকর্ষণে মৃত্যুর মুখ পর্যন্ত সে বারবার অভিসারে বেরিয়েছে, সেই প্রথম-প্রিয়ের প্রতি তার প্রথম প্রেম যে প্রথম প্রিয়ার চাইতে কিছুমাত্র কম ছিল তাই বা কে বলবে?

কেবল চোখে নয়, মুখে নয়, মস্তিষ্কে নয়, হৃদয়ে নয়—সমুদয় স্নায়ু-শিরা-মজ্জায় জড়ানো ছেলে বয়সের এই ভালোবাসা। ছেলেরা মাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি অগোচর ও একান্ত। ছেলেবেলার এই স্বপ্নের কাহিনী বড়বেলার স্মৃতির বাহিনীর মধ্যে হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যায় না, এটা সত্য।

শ্রীকান্তর বয়সে, আমাদের এই আখ্যায়িকার অশান্তকে যদি একই প্রশ্ন করা যেত তাহলে সেও তার মোহনের কথা ভুলে গিয়ে কোনো মানসীর নামই করত হয়ত, কিন্তু সেই বয়সটা আসতে এখনও তার কিছু বাকি আছে, এখন তার বয়স চৌদ্দ কি পনের।

এখন, মোহনের সঙ্গে তার প্রথম দেখা কি করে ঘটল, তাই আরম্ভ করা যাক, তাহলে।

ঘটনার দিন সন্ধ্যায় অশান্ত, কর্নওয়ালিস থিয়েটারে বসে একটা রোমাঞ্চকর ছবি দেখছিল। তখন বড়দিনের ছুটি, রোজই নতুন নতুন ভালো ভালো ছবি। গল্পের নায়ক, কখনো বাঘের কবলে পড়চে, কখনো জ্বলন্ত ঘরের ভেতর থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করে আনচে, কখনো বা ডিনামাইটের মুখে নিঃশব্দে উড়ে যাবার অপেক্ষায় আছে—তারই পাকচক্রে অশান্তর মন অত্যন্ত অশান্ত হয়ে উঠেচে; এমন মুহূর্তে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল, ‘ইন্টারভ্যাল’ ঘোষণা হল ও ‘ড্রপ’ পড়ল।

অশান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বাইরে যাবার জন্য উঠে পড়তেই, এক জায়গায় বাঁধা পড়ে তার পা ও চোখ দুটি অচল হয়ে গেল। ছেলেটি চার-পাঁচ সারের পিছনে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তার সামনাসামনি। তারই সমবয়সী, ছেলেটি সুন্দর। তাকে তার হঠাৎ কেমন ভালো লেগে গেল যে, একটু বাধ-বাধ ঠেকলেও, কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না।

ছেলেটির আশেপাশে আরও কয়েকটি ছেলে ছিল—তাদের সঙ্গে হেসে গল্প করছিল—ঐ ছবিরই গল্প। হঠাৎ একটা ছেলে অশান্তকে দেখিয়ে তাকে বল্লে–দেখছিস ভাই, ওই ছেলেটা তোর দিকে তাকিয়ে আছে!

অশান্তর দিকে মোহনের চোখ পড়ল, তার চোখ দুটি আনন্দের আলোয় গলে পড়ছিল, অশান্তর মনে হল সে যেন তার দিকে চেয়ে হাসলে।

আর এক জন বল্লে—“মোহন, ও বোধহয় তোর সঙ্গে ভাব করতে চায়।”

মোহন বল্লে, “বেশ ত, ডাক না ওকে এখানে। একটু চেপে বসলে সবারই জায়গা হবে।”

এক জন বল্লে, “না না, ডেকে কাজ নেই। অচেনা ছেলে।”

অশান্ত কিন্তু লজ্জা পেয়ে ইতিমধ্যে নিজের জায়গাটিতে বসে পড়েছে। কিন্তু ঐ কালো ছেলেটির প্রতি তার বড় রাগ হচ্ছিল। সে কেন তাকে দেখিয়ে দিলে।

যথাসময়ে আলো নিবে গেল, ড্রপ উঠল, ছবি দেখানো শুরু হল। চোখের ওপর অনেক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে লাগল—কিন্তু অশান্তর মনের চোখে ভাসতে লাগল ছেলেটি তার দিকে চেয়ে কেমন মিষ্টি হাসলে! গল্পের নায়ক উঁচু পাহাড়ের রাস্তায় মোটর সাইকেলে তীব্র বেগে ছুটে যেতে যেতে, দুর্জয় দুঃসাহসে নিচের চলন্ত রেলগাড়ির ছাদে লাফিয়ে পড়ল এবং পড়েও থামল না, ট্রেনের ছাদেই সাইকেল চালাতে শুরু করল–তখনও অশান্তর মন এই চিন্তায় ব্যাপৃত রইল বায়োস্কোপ শেষ হলে কি সূত্রে কেমন করে ঐ ছেলেটির সঙ্গে কথা বলবে।

কিন্তু পালা যখন শেষ হল, তখন বাইরে ঝম্ ঝম্ করে পৌষের অকাল বর্ষণ নেমেছে! সেই মুহূর্তে অশান্তর মনে হল, ঐ বা, ছাতা আনে নি! বিকেল থেকেই ত আকাশটা মেঘমেঘ করেছিল। কিন্তু ছেলেটিকে দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরুতে দেখেই সে সচেতন হয়ে উঠল, এবং বৃষ্টির মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে পড়ল।

ভিড়ের মধ্যে যথাসম্ভব পা ও চোখ চালিয়ে, অবশেষে গেটের কাছে এসে দেখতে পেল, একটিমাত্র ছাতার তলায় সেই ছেলেটি ও আরো দুজন অতিকষ্টে মাথা বাঁচিয়ে কোন ক্রমে অগ্রসর হচ্ছে। তার মনে হল, হায়, যদি ছাতা আন্ত তাহলে আজ সহজেই ছেলেটিকে ছাতার তলায় ডাকতে পারত, তাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দেবার সুযোগে বেশ তাদের ভাব জমে উঠত।

অগত্যা ঠিক করল, যাহোক ছেলেটিকে ছাড়া নয়, ভিজেই হোক আর যে করেই হোক, তার বাড়ি দেখে আসতে হবে। কিন্তু অতগুলি লোকের ভীড়ের অত্যাচারে আর গাড়ি ঘোড়ার আড়ালে একটু পরেই সে যে কোথায় হারিয়ে গেল তার কোনো খোঁজই পেল না। তখন হতাশ হয়ে, বৃষ্টির জোর-ছাঁট থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য সামনে যে ট্রাম আসছিল তাতেই উঠে আশ্রয় নিল।

বিডন স্ট্রীটের মোড়ে তাকে নামতে হল, কারণ তাদের বাড়ী সেই পথে যেতে হয়। তখন বৃষ্টিটাও এসেচে খুব জোর। একটি পথিকের ছাতার তলায় দৌড়ে গিয়ে বল্ল, “মশাই, আপনার সঙ্গে একটু যেতে পারি কি?”

তিনি বিরক্ত হয়ে দাঁড়ালেন, কিন্তু অশান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর একটু মায়া হল, সহানুভূতিভরে বল্লেন, আচ্ছা, এস। পথে আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় তিনি করলেন না, এবং যথাসম্ভব আত্মরক্ষা করে যেটুকু ছাতা তাকে দিলেন তার বেশি দিলেন ছাতার জল।

বিডন স্ট্রীটে কিছুদূরে একটি বাড়ি বর্ষার অশ্রুধারাকে উপেক্ষা করে আলোকমালায় হাসছিল, সেই বাড়িতে বিয়ে। ভদ্রলোকটি বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন এবং জানালেন এই বাড়িতেই তাঁকে পথশেষ করতে হবে। অশান্ত কি করে? বৃষ্টির তুফানে পথঘাট ঝাণ্সা হয়ে উঠেছে, সেও বল্লে, আমারও এই বাড়ি। ভদ্রলোকের সঙ্গে সঙ্গে সেও বাড়ির ভেতরে গেল, একটি প্রশ্নও কেউ তাকে করল না। ঝোড়ো কাকের মত, একপ্রান্তে একটি কাঠের চেয়ার দখল করে সে চুপ করে ভাবতে লাগল, কখন বৃষ্টি ধরবে, কখন বাড়ি গিয়ে মাসিমার বকুনি আর সেজদার প্রহার ভোগ করবে। এই দুর্ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে কেবল একটি হাসিমুখ মাঝে মাঝে উঁকি মেরে তার সব ভাবনা ভুলিয়ে দিচ্ছিল।

একটি ছেলে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখে দাঁড়িয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, “একি, অশান্ত যে?” অশান্ত তার দিকে চেয়ে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেল; বল্ল, “আপনি এই বাড়িতে থাকেন নাকি?” দেবেন বল্লে, “হ্যাঁ, এই আমার বাড়ি। আজ আমার বোনের বিয়ে। তুমি এলে কি করে?”

অশান্ত বল্ল, “এসে পড়েচি। আপনি এখানে থাকেন আমি জানতুম না। খুব আশ্চর্য ত!”

দেবেন বল্ল, “আশ্চর্য বই কি। এসেচ বেশ করেচ। তোমাকে নিমন্ত্রণ করতে যাবো আজ কবার ভেবেচি, কিন্তু কাজের তাড়ায় গিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু মনে মনে যে ডেকেছিলাম তাই তোমাকে আসতে হয়েছে।”

অশান্ত উত্তরে শুধু একটু হাসলে। এতক্ষণ এই লোকজন, সমারোহ, গান-বাজনা, যা তাকে একটুও আকর্ষণ করতে পারেনি, একমুহূর্তে সবকিছুর সঙ্গে যেন তার আত্মীয়তা হয়ে গেল।

তার কয়েকদিন আগের ঘটনা বলা দরকার।

দেবেন-ছেলেটির বয়স সতের আঠারো, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, বলিষ্ঠ উন্নত গঠন, যৌবনশ্রী-প্রদীপ্ত চেহারা।

সেদিন সন্ধ্যায় স্টার থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে সে একজন লোকের প্রতীক্ষায় ছিল, দু’খানা থিয়েটারের টিকিট কিনেচে, নিজের জন্য ও তার জন্য;—কিন্তু যখন পালা আরম্ভ হবার নির্দিষ্ট সময়ের এক মিনিট আগে পর্যন্ত তার দেখা পাওয়া গেল না, তখন সে বাকি টিকিটির সদ্ব্যবহারের হেতু মনোমত সঙ্গী নির্বাচনে মন দিল। কিন্তু ঐ অনেক লোকজনের মধ্যে পরিচিত একজনও তার চোখে পড়ল না। একটি ছেলে তার চোখে লাগল ঘটে, কিন্তু সে অচেনা–ছেলেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আগ্রহে থিয়েটারের বিজ্ঞাপনগুলো পড়ছিল। সে তার কাছে গিয়ে বললে, “কি ভাই, থিয়েটার দেখবে?”

ছেলেটি তার দিকে অবাক চোখে চাইল।

‘‘আমার একখানা টিকিট বেশি হয়েছে, একজন লোকের আসার কথা ছিল সে আসেনি। তুমি দেখবে থিয়েটার? ফার্স্ট ক্লাস সিট।”

“কই, দেখি টিকিট।”

দেবেন টিকিট দেখাল, ছেলেটি বল্লে, কিন্তু আমার কাছে ত টাকা নেই।

দেবেন বল্লে, তোমার টাকা লাগবে না, আমার এ টিকিটটা তো নষ্টই হত, তুমি দেখলে এটা কাজে লেগে গেল, এই আমার লাভ।

ছেলেটি রাজি হয়ে বল্লে, আচ্ছা দেখতে পারি, একঘণ্টা কি দুঘণ্টা। বেশি দেরি করলে কিন্তু বাড়িতে বকবে।

“বেশ তাই দেখো। তোমার নামটি কি ভাই?”

“অশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।”

“অশান্ত? বেশ নামটি ত। আচ্ছা এস থিয়েটার শুরু হয়ে গেছে।”

দুজনে গিয়ে রঙ্গমঞ্চের সামনের দুখানি চেয়ার অধিকার করে বসল। দেখবার অবসরে অশান্ত বিবিধ প্রশ্ন করতে লাগল, দেবেন তার উত্তরে কে কি অভিনয় করচে, কোন্ অভিনেতার কি নাম, তাদের পরিচয়কাহিনী বলে যেতে লাগল। প্রথম সে যখন জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে? উত্তরে অশান্ত বল্লে, মন্দ না। কিন্তু আধঘণ্টা পরে প্রশ্ন করতেই সোৎসাহে বল্লে, বেশ লাগচে।

“তুমি এর আগে আর কি কি নাটক দেখেচ?”

“এর আগে আমাদের দেশের থিয়েটার দু’তিনবার দেখেছিলাম, কলকাতায় এই প্রথম। এ থিয়েটার অনেক ভালো তার চেয়ে।”

“কোথায় তোমার দেশ?”

“মালদহে। বড়দিনের ছুটিতে সেজদার সঙ্গে বেড়াতে এসেছি। আর তিন চারদিন বাদেই চলে যাব।”

“এখানে কোথায় আছো?”

“বলরাম দে স্ট্রীট। মাসিমার বাড়িতে।”

“আমাদের বাড়িও ঐ দিকে। তোমার ভয় নেই, বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

“আমার একটুও আর ভয় করে না।”

“তোমার সেজদা কি করেন?”

“তিনি মালদার সাব পোস্টমাস্টার।”

“তুমি কোন্ ক্লাসে পড়?”

“থার্ড ক্লাসে। আমি বোর্ডিংএ থেকে পড়ি। সেজদাকে মফঃস্বল পোস্টাপিসে ঘুরে বেড়াতে হয় কি না।”

“তোমার বাবা কি করেন?”

“বাবা, মা আমার ছোটবেলাতেই মারা গেছেন। আমার আর দুই দাদা পশ্চিমে চাকরি করেন।”

“বাবা মা নেই?” দেবেন আস্তে আস্তে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বল্লে, “তোমাকে বাড়ির সবাই খুব ভালবাসে, না? কে তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে?”

“সেজদা আর মাসিমা। কিন্তু কোনো দোষ করলে আর কেউ কিছু বলে না, মাসিমাই খুব বকেন, আর সেজদার কাছেই মার খেতে হয়। তবু আমি সেজদাকেই বেশি ভালবাসি।”

অভিনয়ের এক অঙ্ক শেষ হল। দেবেন বল্লে, “তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে, এসো কিছু খাওয়া যাক।

“না, খিদে পায়নি। আপনি বসুন।”

“না– তুমি আমার সঙ্গে এসো।”

থিয়েটার-সংলগ্ন কেবিনে গিয়ে দুজনে চা-রুটি-মাখন ও পুডিং খেল। এই সুশ্রী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেবেনের মনে হল, তার যে ভাইটি ছেলেবেলায় মারা গেছে অশান্ত দেখতে ঠিক তারই মত। তাই অশান্ত যখন পুডিং আর খেতে পারবে না বলে মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল তখন অসঙ্কোচে তার মুখটি কাছে টেনে খানিকটা পুডিং খাইয়ে দিতে তার একটুও বাধা ঠেকল না। ছেলেটিও সহজে তার হাতে খেল।

আবার দুজনে পাশাপাশি গিয়ে বসল। দেবেন বল্লে, “নটা বাজে, এবার তোমাকে রেখে দিয়ে আসি।”

“আপনি আর দেখবেন না?”

“তোমাকে বাড়িতে বকবে, তার চেয়ে একদিন নাই দেখলুম।”

“না, তা কেন? আমার ভালো লাগচে, শেষ পর্যন্ত দেখব।”

“তুমি নাটকের গপ্পটা ধরতে পেরেচ?”

“গপ্পটা এখনও বুঝতে পারিনি। তবু বেশ লাগচে।”

দেবেন একটুমাত্র হাসল, ও আদর করে তার গাল দুটি টিপে দিল। অশান্ত কোনো কথা না বলে, দেবেনের মাথায় মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে দেখতে লাগল।

আরো দুটি অঙ্ক হয়ে গেল। অশান্ত একবার দেবেনের কাঁধে মাথা রাখতেই, দেবেন বাহু দিয়ে তার গলা জড়িয়ে বল্লে, ঘুম পাচ্ছে না কি? ঘুম তার পাচ্ছিল সত্যি, কিন্তু সে তখনই সোজা হয়ে বসে বল্লে, ঘুম কি পায়? পঞ্চম অঙ্কের গোড়াতে করুণ রসের অবতারণা ছিল, সেই জায়গাটির অপূর্ব অভিনয় দেখে দর্শকদের অনেকেই কাঁদছিল, অশান্তর চোখেও জল এল। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। দেবেন সেই ছেলেমানুষটিকে তার বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললে, কাঁদচ কেন, এসব কি সত্যি? ও যে অভিনয়। তার চোখ মুছিয়ে দিল, মুখে হাত বুলিয়ে দিতে খানিকক্ষণে অশাস্ত শান্ত হল।

অবশেষে রাত বারোটার পরে পালা শেষ হল, দেবেনের হাত ধরে অশান্ত বেরিয়ে পড়ে বল্লে, এবার তাড়াতাড়ি চলুন। সেজদা আজ মিনার্ভা থিয়েটারে গেছে, তিনি বাড়ি ফিরবার আগে আমাকে পৌঁছতে হবে।

“তোমার ভয় নেই। মিনার্ভা শেষ হতে এখনো একঘণ্টা দেরি। আমি প্রায়ই থিয়েটার দেখি, আমি জানি।”

অশান্ত অনেকটা ভরসা পেল, এবং দেবেনের হাতটা মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল। তাদের বাসার গলিপথের মোড়ে এসে দেবেন থমকে দাঁড়াল, “কি অন্ধকার!”

“কদিন থেকে এই গলির গ্যাসটা জ্বলছে না, তাই এমন।”

“আচ্ছা, আমি তা হলে এখান থেকেই আসি ভাই।”

“না, আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিন, ভয় করছে।” দুজনেই অতি সন্তর্পণে পরস্পরকে অবলম্বন করে ঐ নাতিদীর্ঘ সঙ্কীর্ণ পথটুকু, এখানে ওখানে হোঁচট খেয়ে, কোনোমতে অতিক্রম করে বাড়ির দরজায় এল। ভয়গ্রস্ত অশান্তকে বাহু-বেষ্টনের মধ্যে রক্ষা করে দেবেন অগ্রসর হচ্ছিল, এবং অশান্তও এই পরনির্ভরযোগ্য পথের বন্ধুটিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছিল।

জোরে কড়া নাড়াতে চাকর এসে দরজা খুলে দিল। বিদায় নেবার সময় অশান্ত ক্ষণেকের জন্য, দুটি হাত মালার মত করে দেবেনের গলায় জড়িয়ে দিল, এবং দেবেন অভিভূত হয়ে ক্ষণেকের জন্যই তার কোঁকড়া চুল ভরা নরম মাথায় গাল পেতে রাখল।

অশান্ত প্রশ্ন করল, সত্যি আপনি আমাকে মনে মনে খুব ডাকছিলেন? কেন? আচ্ছা, মনে মনে ডাকলেই কি দেখা পাওয়া যায়?

দেবেন হেসে জবাব দিল, যায় বই কি। তুমি ধ্রুবর গল্প পড়োনি? সে তো মনের ডাকে ভগবানকে পেয়েছিল।

অশান্ত বল্লে, আচ্ছা মনে করুন, এই কলকাতার পথে অচেনা কেউ হারিয়ে গেলে তো আর কোনো জন্মে পাবার যো নেই। মনের ডাকে কি তাকেও ফিরে পাওয়া যায়?

“নিশ্চয়। মনের টান এমনি আশ্চর্য রহস্য। নইলে তুমি তো আমার বাড়ি দেখোনি, আমাকে তেমন চেনও না, কেমন করে এলে বল দেখি?”

অশান্ত মাথা নেড়ে বল্লে, তা বটে।

“তা ত বটে!” দেবেন হেসে বল্লে, “কই কাছে, এসো ত দেখি মাথাটা। অ্যাঁ, এ যে জলে চব্‌চব্‌ করচে, কাপড়জামা সব ভিজে। কতক্ষণ এই ভিজে কাপড়ে আছ?”

“বেশিক্ষণ না। এই ত এলাম।”

“এসো আমার ঘরে। জামা কাপড় ছাড়িয়ে দিই। কি ভয়ানক! অসুখ না করলে বাঁচি।”

নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুখ গা হাত মুছিয়ে দিয়ে, গরম কাপড়জামা পরিয়ে দেবেন তাকে পড়বার ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে বইভরা আলমারির পাশে ইজিচেয়ারে বসিয়ে রেখে বল্লে, অনেক ছবির বই আছে তুমি বসে বসে দেখ। ততক্ষণ আমি বাইরে একটু কাজ দেখিগে। শীগ্রিই ফিরব।

সে বেরিয়ে যেতেই অশান্ত ব্যগ্র হয়ে বলল, “আপনার নামটা কি তা তো বল্লেন না?”

“আমার নাম? আমাকে আর ‘আপনি’ বলে ডাকবে না, ‘তুমি’ বলবে, আগে বল তবে।”

অশান্ত একটু হেসে বললে, আচ্ছা তাই বলব।

“আমাকে দেবেনদা বলে ডেকো, তুমি আমার ছোট্ট ভাইটি হলে, কেমন? তোমার এখানে কোনো ভয় নেই; কেউ কিছু বলবে না”,—কাছে এসে আদর করে অশান্তর মাথাটা নেড়ে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল।

অশান্ত কিছুক্ষণ ছবির বই এর দুএকটা পাতা উলটে দেখল, কিন্তু বাড়ির ভাবনায় তার মন উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাইরেও বৃষ্টি ধরবার নামটি নেই। আধঘণ্টা পরে দেবেন ফিরে আসতেই, অশান্ত ডাকল, দেবেনদা—

“বলো ভাইটি।”

“যদি রাগ না করো ত বলি, দেবেনদা!”

“না রাগ করব কেন?”

“আমার তো আর এখানে থাকা চলে না। বাড়ি না গেলে মাসিমা সেজদারা ভেবে অস্থির হবেন যে। কি করি বল, আমাকে একটা ছাতা দাও, এই বৃষ্টিতেই বেরুতে হবে।”

“তোমার বাড়ির কথাই ত বলতে এসেছি। আমি লোক পাঠিয়েছিলুম এই বলে যে ভাবনার কিছু নেই, অশান্ত আমাদের বাড়িতে আছে। তাকে বিয়ের উৎসবে নিমন্ত্রণ করেছি, আজকের এই বাদলায় তো পাঠানো চলে না, কাল সকালে দিয়ে আসব। তোমার মাসিমা আর সেজদা খুশিমনে রাজি হয়েছেন।”

“সত্যি? রাজি হয়েছেন?” অশান্ত চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দুই হাতে দেবেনকে জড়িয়ে ধরল। তার আনন্দ দেখে দেবেনের মন অপূর্ব সুখে ভরে উঠল। সে অশান্তর নিটোল গালে গাল চেপে বল্লে, তোমার এখানে ভাল লাগছে, ভাইটি? মুখ না টেনে সেইভাবে জড়িয়ে ধরেই সে উত্তর দিলে, আমার খুব ভালো লাগছে।

“চল আমরা নীচে যাই। কত আলো, লোকজন, গান বাজনা হচ্চে।”

“চল। ব্যাণ্ডের লোকেরা সব বসে আছে। তারা বাজাবে না? আমার বেশ লাগে শুনতে।”

“ব্যাণ্ড বাজবে কাল, বর-কন্যার শোভাযাত্রায়। তুমি যদি শুনতে চাও ত আমি তাদের বাঁশী বাজাতে বলে দিচ্চি চল।”

নরনারীর জীবনে চোদ্দবছর বয়স একটা বিশেষকাল। এই সময়ে প্রথম ভালোবাসতে শেখে, আত্মহারা হয়ে ভালোবাসে, আদরের স্পর্শে একেবারে গলে পড়ে; এমন কি, পরিচয়হীন লুব্ধ-শিকারীর লালসার ফাঁদেও সহজে ধরা দেয়। এই জন্য এই বয়সেই মানুষের পরম পরিপূর্ণতা ও চরম সর্বনাশের সূচনা হয় যার জের তারা সারাজীবন টেনে চলে। অশান্তর এখন এই বয়স।

প্রথম যৌবন আর এক বিচিত্র কাল। এই বয়সে সুন্দরের পূজা, সৌন্দর্যের স্বপ্নই সমস্ত মন জুড়ে থাকে। চোখে যাকে দেখতে ভালো লাগে, তাকেই একান্ত করে ভালোবাসতে চায়। এই বয়সে সহজেই পরাজয় মানে, তাই জয় করাও এই বয়সে সবচেয়ে সহজ। সহজেই আকৃষ্ট হয়, তাই সহজেই আকর্ষণ করে। এই বয়স হচ্ছে দেবেনের।

অশান্তকে নিয়ে দেবেন চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল, তাকে এঘর ওঘর সবঘর একে একে দেখাল। বাড়ির লোকজন ও মা-রা সবাই ব্যস্ত তাই কারু সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে পারল না। তবু, বাইরের লোকজন যে-ই অশান্তকে দেখে প্রশ্ন করেছে, এটি কে? দেবেন তাকেই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছে, আমার ভাই।

সকলের খাওয়া দাওয়া হতে বেশ একটু রাত হবে জেনে সে অশান্তকে নিয়ে ভেতরে গেল, –এসো তোমাকে খাইয়ে দিই। বড্ড রাত হয়ে যাচ্চে।

“আমি একলা খাবনা, তোমাকেও সঙ্গে খেতে হবে।”

“বেশ, আমিও খাব। কিন্তু খেয়ে দেয়ে তুমি একলাটি আমার বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবে ত? আমি শীঘ্রি শুতে আসবো। দাদারা সব কাজ করচেন, আমাকে না দেখতে পেলে রাগ করবেন।”

“আমি কিন্তু বেশিক্ষণ একলা শুয়ে থাকতে পারব না।”

“আচ্ছা সে হবে। যদি ঘুমিয়ে পড়ো, তা হলে ত আর কথা নেই?”

তারা খেয়ে নিল, তারপরে অশান্তকে শুইয়ে, তার গায়ে লেপ ঠিকঠাক করে দিয়ে দেবেন বল্লে, এবার আমি যাই ভাইটি?

“একটু বসো দেবেনদা।”

একটুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ বুজে এসেছে দেখে ঘুমিয়েছে মনে করে দেবেন উঠে দাঁড়ালো, অশান্তর শুভ্র কপালে একটা চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। অশান্ত কিন্তু ঘুমায় নি, এই অভাবিত আদরে তার সারা দেহ মন কেমন করে উঠল, তার চোখের ঘুম পালিয়ে গেল, সে কত কি ভাবতে লাগল।

সহসা তার মনে একটা হারানো স্মৃতির ছবি ভেসে উঠল—–—একটি ছেলের কথা। তখন তার বয়স দশ। একবার মাসিমার সঙ্গে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে সেই সমবয়সী ছেলেটির সঙ্গে ভাব হয়েছিল। তার সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ কিছু হয়নি, আলাপও বেশিদূর গড়ায়নি, শুধু মনে পড়ে যে ছেলেটি তারপর থেকে সোজারাস্তায় না গিয়ে একটু ঘুরে তাদের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতো; আর সে প্রতিদিন দশটার সময় বাড়ির দরজায় তার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতো। চোখোচোখি হলেই দুজনে হাসি দিয়ে দুজনকে খুশি করত এবং কোনোদিন পাঁচ, কোনোদিন দুই, কোনোদিন পনের মিনিট তাদের গল্প চলত, দরজার পাশের ইঁটেগাঁথা সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে।

তারপর একদিন থেকে সে আর এলো না, রোজ যথাসময়ে প্রতীক্ষা করে যখন দেখা মিলত না, তখন অশান্তর সমস্ত মন অশ্রুময় হয়ে যেতো, কখনো কখনো সেই বাষ্প তার দুই চোখে ভারি হয়ে আসত, দূরের পথের বাঁক চোখের ওপর ঝাপসা হয়ে উঠত, সে বিছানায় গিয়ে, চুপ করে শুয়ে থাকতো। সেই ছেলেটির-বিরহের ভুলে-যাওয়া বেদনা আজ নতুন করে তার মনে জাগল। তার কথা, আজকের বায়োস্কোপে দেখা ছেলেটির কথা, দেবেনদার কথা—এই সব অশান্তর মনে তোলপাড় করতে লাগল। বিশেষ করে এই কটি দিনে তার জীবনে, বায়োস্কোপের মত, এ কি আশ্চর্য ঘটনা সব ঘটতে শুরু হয়েচে–তাই ভাবতে লাগল।

একঘণ্টা পরে দেবেন ফিরে এসে বিছানায় আশ্রয় নিল। শয্যা পার্শ্বের বাতিটা তখনো জ্বলছিল, সেই আলোতে ছেলেটির কচি মুখখানি ভালো করে দেখে নিল; দেখে দেখে চোখ যেন ভরে না। হাত বাড়িয়ে বাতিটা কিছু কমিয়ে দিয়ে, তারপর অতি আস্তে ছেলেটির নরম গালে একটি চুমু দিল।

অশান্ত বল্লে, তোমার ফিরতে বড্ড দেরি হয়েছে দেবেনদা।

দেবেন চকিত হয়ে বল্লে, এ কি, এখনো তুমি জেগে আছো?

“ঘুম আসচে না যে। তুমি গপ্প বল।”

“এত রাত্রে গল্প? আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমোও।”

“ঘুম আসবে না। চোখ জ্বালা করচে!”

“আচ্ছা, আমি চোখের জ্বালা সারিয়ে দিচ্চি।” দেবেন চোখ দুটিতে আদর করে চুমু দিল, বল্ল, এইবার নিশ্চয় ঘুম আসবে।

অশান্ত বাহু দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল, দেবেন তাকে আরও বুকের কাছে টেনে আনল, বুকের মধ্যে, মুখের মধ্যে, সারা অঙ্গের মধ্যে একটা অননুভূত-পূর্ব আনন্দের আস্বাদে তন্ময় হয়ে, বৃষ্টির ঝরঝরানি সুরের মধ্যে পৌষমাসের একটি রজনী তারা প্রভাত করলে।

বড়দিনের ছুটির পর কয়েক মাস কেটে গেছে, এখন সত্যিই বড় দিন পড়েছে, এখন জৈষ্ঠির শেষাশেষি।

দেবেনের বিশেষ সখ ছিল ভূ-ভারত ঘুরে বেড়ানোর এবং বিশিষ্ট সখ ছিল বিনা টিকিটে। রেলপথের ছোট বড় কর্মচারী, গার্ড, চেকার, ফ্লাইং চেকার, বেমালুম ফাঁকি দিয়ে, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ কোনো জায়গা ভ্রমণের তার বাকি নেই। তার যে টাকার বড় অভাব ছিল তা নয়, বরং সব সময়েই যথেষ্ট টাকা তার কাছে থাকতো এবং ধরা পড়লে, টিকিটের দ্বিগুণ কেন চারগুণ দাম সানন্দে ধরে দিতে সে প্রস্তুত ছিল—কিন্তু কেউই কোনো দিন তাকে ধরতে পারেনি।

বিপদের দিকে সঙ্কটের দিকে তার প্রবল প্রলোভন ছিল, ফাঁড়া ভয় করত না, ফাঁড়া কাটিয়ে যেতেই সে ভালোবাসত, তার অন্তরের দুঃসাহসী ভাবটা এইভাবে তবু কতকটা তৃপ্ত হত। তাই নেহাৎ বাধা না থাকলে, চলার পথে এইভাবে বাধা সৃষ্টি করাই ছিল। তার রুচি।

এবার সে মধুপুর-মুখে বেরিয়েছিল; হাওড়ায় একটা প্ল্যাটফরম টিকিট মাত্র কিনে অম্লান বদনে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় চড়ে বসেছে। সেই কামরায় একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটি কিশোরী ও দুটি বালক তার সহযাত্রী। লেমোনেডওয়ালা এসে লেমোনেড দিতে চাইলে, যদিচ তার একটুও পিপাসা ছিল না, কিন্তু সেকেণ্ড ক্লাসোপযোগী প্রেস্টিজ বজায় রাখবার জন্য চার গ্লাস লেমোনেড কিনে, এক গ্লাস নিজে নিল, বাকি তিন গ্লাস ছেলেমেয়েদের হাতে দিল। ভদ্রলোক ঈযৎ আপত্তির উপক্রম করতেই সবিনয়ে বাধা দিয়ে বল্লে, ওরা আমার ভাই বোন।

ঘণ্টা দুই পরে, মাঝে কি একটা স্টেশনে, সহযাত্রীরা নেমে গেলে দেবেন ঘড়ি খুলে দেখলে দশটা বেজে গেছে। আলোর আধারে নীল আবরণটা টেনে দিয়ে সে নিদ্রার সাধনায় মন দিল। তারপরে অনেকক্ষণ কেটে গেছে, কোন্ কোন্ স্টেশন অতিক্রম করে চলেছে সে সম্বন্ধে সজাগ প্রাণীর সংখ্যা সমস্ত গাড়িতে তখন মুষ্টিমেয়, কি একটা স্টেশনে গাড়ি অল্পক্ষণের জন্য ধরতেই, একটি ইউরোপীয় তরুণ সেই কামড়ায় প্রবেশ করল। যদিচ দেবেনের গায়ের রঙ, রূপের বিচারে, সাহেবের সাদা চামড়ার তুলনায় কোনো অংশে হীন ছিল না তবু এই কালা আদমিটাকে নির্বিচারে এতখানি জায়গা জুড়ে অকাতরে ঘুমোতে দেখে তার মনে অত্যন্ত বিরাগের সঞ্চার হল। সে গিয়ে দেবেনের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বল্লে, ওহে, উঠে পড়, উঠে পড়।

দেবেন একবার চোখ মেলে চেয়ে বল্লে, ঐ ত জায়গা আছে, বসে পড় না, বাবা!

“উঠবে না তবে নাকি?” সাহেব তার বুকের উপর চেপে বসল। নেটিভ লোক দেখে তার ঝগড়া বাধাবার দুষ্টু-ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।

এবার সত্যিই দেবেনের চোখের ঘুম ছুটে গেল। তার সর্বাঙ্গ রাগে জ্বালা করে উঠল। সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করিয়ে সোজা খাড়া হয়ে উঠে তৎক্ষণাৎ তার কপালে এক ঘুমি ঠুকল। সাহেব ঘুষির টাল সামলে নিয়ে, চকিতের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে দেবেনকে আক্রমণ করল। দেবেনও তৈরি ছিল, কিছুক্ষণ মুষ্টি বিনিময়ের পর সহসা একটা প্যাঁচ কসে টান দিতেই সাহেব সজোরে ঘুরে পড়ল, – তার মাথা ঠুকে গেল, বেঞ্চের খুরোয় লেগে কপালের একাংশ কেটে গেল, ক্ষণেকের জন্য বিভ্রান্ত চোখে সে অন্ধকার দেখলে।

এতক্ষণ পরে দেবেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখবার অবসর পেল, পরিপুষ্ট গঠন বটে, কিন্তু ইউরোপীয়ানটি যুবক নয়, তরুণ; বয়সে তার চেয়ে এক-আধ বছরের বড় হলেও দৈহিক শক্তিতে তার সমকক্ষ নয় বলে তার মনে হল। চোখদুটি নীল, চুলগুলো সোনালি, মুখখানি বড় সুন্দর, বিবর্ণমুখ দেখে তার মায়া হল। তার দুচোখ যদি রাগে অন্ধ হয়ে না থাকত, এবং চকিতের জন্যও প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখবার নয় –হেরবার অবকাশ ঘটত। তাহলে এই বিগ্রহের পূর্বে, যুদ্ধ ঘোষণা না করে সে সন্ধি কামনাই করত।

যাক, যা হয়ে গেছে! দেবেন অর্ধমূর্ছিত প্রতিদ্বন্দ্বীকে সামান্য আয়াসে তুলে, সে যে আসনে ঘুমোচ্ছিল, সেইখানেই শুইয়ে দিল এবং নিজে তার পাশে বসল।

ছেলেটি একটুক্ষণেই উদ্যম ফিরে পেয়ে উঠে বসবার উদ্যোগ করতে গেল, কিন্তু সতর্ক দেবেন তাকে চেপে শুইয়ে রাখলে। ছেলেটি এবার দুই হাতে ঘুষি ছুড়তে লাগল, দেবেন, তাকে চেপে ধরে রাখবার অবসরে, কোনটা কোনটা আটকাবার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু অধিকাংশ ঘুষিই হাসিমুখে হজম করল; একটি মারেরও প্রতিদান দিল না। একতরফা লড়াই করে ক্লান্ত হয়ে ছেলেটি অবশেষে নিরস্ত হল।

দেবেন ছেলেটির মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, ছেলেটি একটা বিশেষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে ক্ষণেক চেয়ে থাকল, তার পরে সজোরে দেবেনের হাতটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে। দেবেন তার কপালের ক্ষত পরীক্ষা করে দেখছে এমন সময়ে গাড়ি একটা অজানা স্টেশনে থামলো।

দেবেন নেমে গিয়ে খানিকটা বরফ কিনে নিয়ে এল, এবং নিজের কাপড় ছিঁড়ে একটা ব্যাণ্ডেজ তৈরি করে কপালে বরফ-জলের পটি বেঁধে দিল। দেবেনের এই অভাবিত ব্যবহারে ছেলেটি এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে ইচ্ছা থাকলেও এই কাজে বাধা দেবার শক্তি তার এতটুকু ছিল না। একটুকরা বরফ ভেঙে তার ঠোঁট দুটির উপর ধরতেই ছেলেটি হাঁ করে বস্তুটি মুখের মধ্যে নিল।

সস্নেহে তার কপালের চুলগুলি দুপাশে সরিয়ে দিতে দিতে দেবেন প্রশ্ন করলে, আমার নাম দেবেন, তোমার নামটি কি বলবে ভাই?

ছেলেটি এবার আর তার হাতের কাজে বাধা দিল না, শুধু বল্লে, সিগার্ড।

“সিগার্ড? সেই পৌরাণিক বীর? ইসেনের নাটকে যার গল্প পড়েছি। তুমিই সেই, তাই নাকি?”

ছেলেটি উত্তরে একটুমাত্র হাসলে। খানিকক্ষণ চোখ বুজে ললাটে আদরের স্পর্শ অনুভব করলে। তার পরে চোখ খুলে বল্লে, কিন্তু সিগার্ডের চেয়েও তোমার গায়ের জোর বেশি।

“কিন্তু সিগার্ডের মনের জোরও কম নয়। সে সহজেই প্রতিদ্বন্দ্বীর অপরাধ ভুলে গিয়ে তাকে ক্ষমা করতে পারে!”

এটি তার প্রতিদ্বন্দ্বীরই গুণ তার ঘাড়ে আরোপ করা হয়েছে সিগার্ড বুঝল; এবং এতক্ষণে সত্যিই তার সব আঘাত জুড়িয়ে গেল, দেবেনকে তার ভালো লাগল। সে কেবল বল্লে, তাহলে তুমি আমাকে ক্ষমা করেচো? তার উত্তরে দেবেন কিছু না বলে মুঠোর মধ্যে সিগার্ডের হাত দুটিতে একটু চাপ দিল। তাদের কথাবার্তা ইংরেজিতে চলছিল।

“যদি কিছু না মনে কর ত একটা প্রশ্ন করি। তুমি কি ইংরেজ? না আমেরিকান? এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান তুমি কখনই নও।”

‘‘আমি আইরিশ।”

“আইরিশ!” বিস্মিত হয়ে দেবেন বল্লে, তাই তুমি দেখতে এত সুন্দর! একটুক্ষণ কি ভেবে বলে উঠল, আইরিশ ও আমাদের একই উদ্দেশ্য।

“তুমি কি বলতে চাও যে তুমি একজন বাঙালী বিপ্লববাদী?”

“না, না, তা আমি বলছিনে। আমি বলতে চাই যে, আইরিশদের মত আমরাও পূর্ণ স্বাধীনতা চাই।”

“আমার বড় ভাইরা সবাই সিনফিন্। আমার বাবা দেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। আমি নিজেও সিনফিন্। সিনফিদের পথ ছাড়া কখনো দেশের স্বাধীনতা হতে পারে না।”

“তুমি সিনফিন্? এত অল্পবয়সে?”

“আমার মত এমন কতশত আছে। রবার্ট এমেট একুশবছর বয়সে আইরিশ বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন। আমি তোমাদের বারীন ঘোষের নাম শুনেচি।”

“হ্যাঁ, আমাদের দেশেও যাঁরা বিপ্লব শুরু করেন তাঁদের বয়স খুব বেশি ছিল না।”

“তা হবে। কিন্তু তাঁরা কি এখনো আন্দামানে আছেন? ইংরেজরা কি তাঁদের ছেড়ে দেবে না?”

“এই যুদ্ধের সময়? এখন টাটকা অনেক যুবককে ধরে ইন্টার্ন করচে। যুদ্ধে ইংরেজদের জয় হবে বলে তোমার মনে হয়? জার্মানরা নিশ্চয় বাঙালীদের সাহায্য করবে।”

দেবেন এই প্রশ্নের কোনই জবাব দিল না দেখে সিগার্ড বলল, ওহো, আমার ভুল হচ্চে। এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা বা তার উত্তর দেওয়া নিয়ম নয়।

একটি স্টেশনে গাড়ি থামল, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্টেশনের নাম জেনে দেবেন বলল, এর পরেই জসিডি জংশন। আমাকে সেইখানেই নামতে হবে। সিগার্ড দেবেনের মুখের দিকে চেয়ে বল্লে, তোমার ভাব দেখে মনে হয় সেখানে তোমার মিলনের জন্য কেউ অপেক্ষা করচে? তোমার কোনো বন্ধু, নয়?

দেবেন হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বল্লে, তা হতে পারে। তুমি বেশ কল্পনা করতে পারো, দেখচি।

“তোমার অনেক বন্ধু আছে, নয় কি? এবং তুমি তাদের সকলেরই প্রিয়, কি বল?”

“হাঁ, আমার অনেক মিষ্টি বন্ধু আছে, এবং তাদের মধ্যে আজ আর এক জনকে হয়ত পেলাম।” বলে তার দিকে চেয়ে হাসল।

সিগার্ড কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ছেলেবেলায় গল্প শুনেছিলাম যে বাঙালীরা ছেলে বয়স থেকেই খুব ভালোবাসতে শেখে। আজ তার সত্যি পরিচয় পেলাম।

ট্রেন জংশনের মধ্যে ঢুকল। দেবেন সিগার্ডের দিকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা-ভরা চোখে চেয়ে বললে, এখন আমাকে বিদায় নিতে হবে। সিগার্ডের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে কিছুক্ষণ তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে রইল।

ট্রেন থামল। কুলীয়া “জসিডি জংশন, কুলী চাই” হেঁকে ফিরচে। সিগার্ড ও দেবেন উঠে সোজা হয়ে কাল। দেবেন কি ভেবে, একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি কি ভায়ের মত একটি বিদায় চুমু দেবে না?

সিগার্ড হাসিমুখ বাড়িয়ে দিল, দেবেন মুখটি ধরে তার আহত কপালে একটি চুমু খেল। বিনিময়ে সিগার্ড তার নিটোল গালে নিবিড় চুমু দিল।

দেবেন উঠল, তার হাতটি হাতে ধরে বল্লে, ভগবান করুন, আমরা আবার মিলব।

‘ভগবান তাই করুন’ বলে সিগার্ড জোরে হাত ঝাঁকি দিল। দেবেন গাড়ি থেকে নামতেই ট্রেন ছাড়ল, চেয়ে দেখে সিগার্ড রুমাল নাড়চে, প্ল্যাটফরমের অতি প্রান্তে প্রায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে, তাই তার কাছে মনে হল গার্ডের আলোকসঙ্কেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *