ছেলে ধরা

ছেলে ধরা 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

একদিবস একখানি সংবাদপত্রে একটি ছেলে ধরার ঘটনা প্রথম প্রকাশিত হয়। ছেলেটির বয়ঃক্রম ষোল বৎসর। তাহার প্রকৃত নাম গোপন রাখিয়া, আমরা তাহাকে যদুনাথ ঘোষ নামে অভিহিত করিব। যদুনাথ যেরূপ বলিয়াছিল, তাহাই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। যদুনাথ বলিয়াছিল, শ্যামবাজারের যেস্থানে ট্রামওয়ের আস্তাবল, তাহারই সন্নিকটবর্ত্তী একটি গলির মধ্য হইতে রাত্রি আন্দাজ দশটার সময় যেমন আমি বাহির হইয়া বড় রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, অমনি তিনজন বলিষ্ঠ লোক দৌড়িয়া আসিয়া আমাকে ধরিল, ও একখানি কাপড় দিয়া মুখ বাঁধিয়া আমাকে একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ির ভিতর তুলিল। গাড়িখানি পূর্ব্ব হইতেই সেই স্থানে দাঁড়াইয়া ছিল। আমাকে গাড়ির ভিতর উঠাইয়া যেমন তাহারা গাড়ির ভিতর বসিল, অমনি গাড়িখানি ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতে ছুটিতে ক্রমে গঙ্গার ধারে আসিয়া পৌঁছিল ও গঙ্গার পুলের উপর দিয়া গঙ্গা পার হইয়া গাড়িখানা একেবারে শালকিয়ার দিকে দ্রুতবেগে ছুটিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে কিছুদূর গমন করিবার পর ক্রমে উহা গঙ্গার পশ্চিম পাড়স্থিত একস্থানে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। আমার মুখে কাপড় দিয়া সেই তিনজন লোক এরূপভাবে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল যে, আমি কোনরূপেই চীৎকার করিতে পারি নাই, ও উহারা ওই গাড়ির ভিতর বসিয়াছিল বলিয়া ওই বস্ত্র কোনরূপে উন্মোচন করিতেও সমর্থ হই নাই। একবার চেষ্টা করিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু উহাদিগের বল প্রয়োগে আমাকে সে আশা পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল। সেই স্থানে উপস্থিত হইবার পর সেইরূপ বন্ধন অবস্থাতেই উহারা আমাকে সেই গাড়ি হইতে নামাইল। 

নিকটেই একখানি জাহাজ গঙ্গার উপর ভাসিতেছিল। ওই জাহাজ হইতে একখানি প্রায় দেড় ফুট পরিসর তক্তা কিনারা পর্যন্ত এরূপভাবে রাখা ছিল যে, উহা দেখিলে লোকে সহজেই অনুমান করিত ওই জাহাজে গমনাগমন করিতে হইলে ওই তক্তার উপর দিয়াই করিতে হয়। 

যে তিন ব্যক্তি আমাকে ওইরূপ অবস্থায় ওই স্থানে আনিয়াছিল, তাহারা আমাকে ধরাধরি করিয়া ওই তক্তার উপর দিয়া সেই জাহাজের দিকে লইয়া যাইতে লাগিল। ওই তক্তার মধ্যস্থানে উপস্থিত হইলে আমি নিজের উদ্ধারের নিমিত্ত একবার শেষ চেষ্টা করিলাম। অর্থাৎ উহাদিগকে সজোরে এরূপ ভাবে ধাক্কা মারিলাম যে, সে ধাক্কা সামলাইতে না পারিয়া উহাদিগের একজন সেই গঙ্গাবক্ষে পতিত হইল, ও অপর দুই ব্যক্তিও সেই সঙ্গে তাহার অনুগমন করিল। আমিও পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গেলাম। সেই তক্তাখানি কোনরূপে ধরিয়া আপন জীবন রক্ষা করিলাম ও সেই তক্তার উপর বসিয়া সর্ব্বপ্রথম আমার সেই মুখের কাপড়খানি খুলিয়া সেই স্থান হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াইতে আরম্ভ করিলাম ও হাঁপাইতে হাঁপাইতে ক্রমে হাবড়া রেলওয়ে ষ্টেসনের সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে কয়েকখানি খালি গাড়ি ছিল, আমি তাহার একখানির অন্তরালে বসিয়া শ্রম দূর করিতে লাগিলাম। কিন্তু সেই স্থানেও এক নূতন বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন রেলওয়ে পুলিস-কর্ম্মচারী সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া চোর মনে করিয়া আমাকে ধৃত করিতে প্রবৃত্ত হন, কিন্তু তাঁহাকে আমি নিজ অবস্থার কথা আনুপূর্বিক বলিয়া তাঁহার নিকট কান্নাকাটি আরম্ভ করি। তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া পরিশেষে আমাকে নিষ্কৃতি প্রদান করেন। ইহার পর রাত্রিশেষে আমি আমার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করিয়া আমার অভিভাবকের নিকট আমার এই ভয়ানক বিপদের কথা বর্ণন করি। এই গোলযোগে আমার হস্তের মূল্যবান অঙ্গুরিটি কোথায় অদৃশ্য হইয়াছে, জানি না। 

ইহার পরদিনেই সংবাদপত্রে এই ঘটনার উপরোক্তরূপ বিবরণ প্রকাশিত হয়। 

সংবাদপত্রে কোন একটি বিষয় প্রকাশিত হইলে তাহাতে সকলের দৃষ্টি পড়ে, ও সকলে তাহার ফলাফলের শেষ পর্য্যন্ত দৃষ্টি রাখিয়া থাকেন। এরূপ একটি গুরুতর বিষয় সহরের মধ্যে ঘটিয়াছে বলিয়া সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হইল; সুতরাং সহরের মধ্যে একরূপ হুলস্থূল পড়িয়া গেল। সেই সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রে প্রত্যহ কোন্ কোন্ স্থান হইতে কাহার কাহার পুত্র কন্যা পাওয়া যাইতেছে না, তাহার এক একটি তালিকা বাহির হইতে লাগিল। সুতরাং সংবাদপত্রের আন্দোলনের সহিত হৃদয়ে প্রবল ভয়ের সঞ্চার হইতে লাগিল; সন্তান গণকে লইয়া বিশেষরূপ ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সংবাদপত্রের প্রবন্ধে ও লোকমুখে ছেলে ধরার সম্বন্ধে ক্রমে নানা কথা প্রকাশিত হইতে লাগিল। কেহ কহিলেন, কলিকাতা সহরে কোথা হইতে কয়েকজন ছেলে ধরার শুভাগমন হইয়াছে। অদ্য শ্যামবাজার, কল্য শোভাবাজার, পরশ্ব চাঁপাতলা প্রভৃতি স্থান হইতে অনেক ছেলে চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছে। ছেলে ধরার ভয়ে স্কুল, পাঠশালা সকল বন্ধ হইয়া গেল। থিয়েটারের একেবারে অর্দ্ধেক দর্শকবৃন্দ কমিয়া গেল। ভয়ে রাস্তায় আর কাহারও ছেলে বাহির হয় না। শেষে আরও প্রচারিত হইতে লাগিল যে, কেবল ছেলেতে কুলাইতেছে না, যুবা ও যুবতীগণ পর্য্যন্ত সহর হইতে চুরি যাইতেছে। 

কেহ কহিলেন, ছেলে ধরারা ছেলে চুরি করিয়া একটা জনমানবশূন্য দ্বীপে লইয়া গিয়া সেইখানে লোকের বসতি করাইতেছে। সেই কারণ কেবল ছেলে কেন, – ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, পুরুষ যাহাকে পাইতেছে, তাহাকেই লইয়া যাইতেছে। কেহ বলিলেন, কোথায় পোল প্রস্তুত হইতেছে, বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গিয়াও সে পোল বান্ধিতে পারিতেছেন না। সেইখানে ১০১টা নরবলি না দিলে সে পোল তৈয়ার হইবে না, এই কারণ এই কলিকাতা সহ হইতে মানুষ চুরি যাইতেছে। 

কেহ কহিলেন, ইহার ভিতর স্বদেশী ব্যাপার আছে। গত বৎসর পূজার সময় ছেলেরা বিলাতি কাপড় কেনা-বেচা বন্ধ করিয়াছিল; পাছে এ বৎসর পূজার সময়ও সেইরূপ ছেলেরা সেইরূপ করে, সেই ভয়ে বিলাতি কাপড় ব্যবসায়ী সাহেবেরা টাকা খরচ করিয়া কোথা হইতে কয়েকজন ছেলে ধরা আনিয়া সহরময় ছাড়িয়া দিয়াছে। ভয়ে মফঃস্বলের ছেলেরা দেশে পলাইয়া যাইবে, আর কলিকাতায় ছেলেরা ঘরের বাহির হইবে না; তখন তাঁহাদের বিলাতি কাপড়ের ব্যবসা অবশ্য জোর চলিবে। সর্ব্বাপেক্ষা আশ্চর্য ঘটনা, পুলিসের উপর বদনাম—ইহার ভিতর পুলিসের নিশ্চয়ই যোগ আছে; তাহা না হইলে দিন দুপুরে সহর হইতে কখন কি ছেলে চুরি যাইতে পারে? 

প্রতিদিন সংবাদপত্রে এই সকল ছেলে চুরির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হইতে লাগিল। সহরের মধ্যে একটা মহা হুলস্থুল ব্যাপার পড়িয়া গেল। 

এরূপও কথা উঠিয়াছিল যে, সহরের বড় বড় লোক পুলিসের সর্বপ্রধান সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের কথাবার্তায় এরূপ ভাবও প্রকাশ পাইয়াছিল যে, পুলিসের যোগেই এই ছেলে ধরার ব্যবসা চলিতেছে। এদিকে হাটে, মাঠে, বাজারে, রাস্তায়, ট্রামগাড়িতে কেবল ওই ছেলে ধরার গল্প চলিতে লাগিল। আবার এমন বৈঠকখানা নাই, যেখানে এই ছেলে ধরার কথা আলোচিত না হইতেছে। দুইজন লোক একত্রিত হইলেই ওই ছেলে ধরার কথা। শেষে পুলিসের প্রধান কর্ম্মচারী সাহেবেরও আসন টলিল। কারণ সংবাদপত্রে পুলিসের ঘাড়ে নানারূপ দোষারোপ করা হইতেছিল। সংবাদপত্রে বর্ণিত প্রত্যেক তদন্তের ভার পুলিস-কর্ম্মচারীর উপর অর্পিত হইল। সেই সকল কর্মচারীর মধ্যে আমিও একজন মনোনীত হইয়াছিলাম। 

এই সকল ছেলে ধরার ঘটনা অদ্ভুত হইলেও, অনেকগুলি এক রকমের, সুতরাং তাহা পাঠকগণের তৃপ্তিকর হইবে না। সেই কারণ বাছিয়া বাছিয়া কয়েকটি মাত্র প্রকাশিত করিলাম। 

যখন সহরবাসী সম্ভ্রান্ত লোকগণের মনে ধারণা হইল যে, প্রকৃতই বালক-বালিকা ও যুবক-যুবতীগণ ধৃত হইয়া স্থানান্তরিত হইতেছে, তখন তাঁহারা পুলিসের সর্বপ্রধান কর্মচারীর নিকট গিয়া কহিলেন, ট্রিনিদাদ ও মরিস প্রভৃতি স্থানে কুলির কার্য্য করাইবার জন্যই বোধ হয়, এই সকল ঘটনা ঘটিতেছে। সম্প্রতি শুনা যাইতেছে, যে জাহাজ ট্রিনিদাদ ও মরিসসে কুলি লইয়া যাইতেছে, সেই জাহাজে করিয়াই একটি ভদ্রবংশীয় বালক অপর কতকগুলি বালক-বালিকার সহিত চালান হইতেছে। বাস্তবিকই এই সংবাদ প্রাপ্তির একদিবস পূর্ব্বে ওই জাহাজ কলিকাতা বন্দর ছাড়িয়া গিয়াছিল। 

এই ঘটনার সত্যাসত্য নির্ধারণের জন্য সর্বপ্রধান পুলিস-কর্ম্মচারী ২৪ পরগণার মাজিস্ট্রেট ও এদেশীয় দুই একজন সম্ভ্রান্ত লোককে সঙ্গে লইয়া একখানি দ্রুতগামী ষ্টিমলঞ্চে আরোহণ পূর্বক সেই জাহাজের অনুসরণ করিলেন। অর্দ্ধ পথ যাইতে না যাইতে ওই জাহাজখানি ধরিয়া উহার ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলেন; –কোন অপহৃত বালক-বালিকা বা যুবক-যুবতী প্রাপ্ত হইলেন না। সুতরাং সেই স্থান হইতে বিষণ্নমনে সকলকেই প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। যে ভদ্রবংশীয় বালকের জন্য এত কষ্ট সহ্য করিতে হইয়াছিল, সেই বালককে বহুদিবস পরে পাওয়া যায়। সে পড়ার ভয়ে বাটী হইতে পলায়ন করিয়া কোন দূরদেশে গমন পূর্ব্বক লুক্কায়িত ভাবে অবস্থান করিতেছিল। যেরূপ উপায়ে তাহাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহার সবিশেষ বিবরণ পাঠকগণ পরে অবগত হইতে পারিবেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

দ্বিতীয় ঘটনাটি বালক নহে— একজন যুবা কেরাণী চুরি। তিনি নিজে থানায় আসিয়া যে সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, তাহার সারমর্ম্ম এইরূপ।- 

কেরাণীবাবু— দেশ হইতে কলিকাতায় চাকরী করিতে আসিয়াছিলেন। তিনি হ্যারিসন রোডের উপর একটা মেসে থাকিতেন। অনেকদিন দেশে যান নাই; বাড়ীতে যুবতী স্ত্রী আছে, সুতরাং যুবকের বাড়ী যাইবার জন্য মধ্যে মধ্যে মন বড়ই চঞ্চল হইত। দুই একদিনের ছুটিতে বাড়ী যাওয়া চলে না, সুতরাং আগামী পূজার সময় ছুটি পাইলেই বাড়ী যাইবেন স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। একদিন হঠাৎ এক টেলিগ্রাম পাইলেন, বাড়ীতে তাঁহার স্ত্রী পীড়িত ও একমাত্র পুত্র মারা গিয়াছে। এই টেলিগ্রাম পাঠ মাত্রেই তাঁহাকে দেশে রওনা হইতে বলা হইয়াছে। তিনি টেলিগ্রাম পাঠ করিয়াই মাথায় হাত দিয়া বসিলেন। অবশেষে চাকরী থাকুক, বা যাউক, সেইদিন রাত্রের গাড়িতেই বাড়ী যাওয়া স্থির করিলেন। সন্ধ্যার পর কয়েকটি আবশ্যকীয় দ্রব্য খরিদ করিতে বাহির হইয়াছেন, এমন সময় তিনজন খুব বলিষ্ঠ লোক আসিয়া তাঁহাকে জাপ্‌টাইয়া ধরিল, এবং তাঁহার মুখের ভিতর কাপড় পুরিয়া দিল। কেরাণীবাবুর তখন আর কথা কহিবার ক্ষমতা রহিল না। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার হাত পাও বাঁধা হইল। যুবকের আর নড়িবার চড়িবার শক্তি রহিল না। রাস্তায় ফুটপাতের গায়েই একখানি গাড়ি প্রস্তুত ছিল, তখন তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া সেই গাড়ির মধ্যে পোরা হইল। গাড়ি তৎক্ষণাৎ শ্যামবাজারের দিকে ছুটিল। টালার পোল পার হইয়া ব্যারাকপুর ট্রাঙ্করোডের উপর দিয়া বিদ্যুৎবেগে ছুটিতে লাগিল। ছুটিতে ছুটিতে শেষে সেই রাস্তার ধারের একটা বাগানের মধ্যে সে গাড়ি প্রবেশ করিল। ফটক পার হইয়া গাড়ি যখন সেই বাগানের মধ্যস্থিত একটা গাড়িবারান্দার নীচে আসিয়া পৌঁছিল, তখন সেই গাড়ি থামিল। তখন বাবুটিকে সেই গাড়ি হইতে ধরাধরি করিয়া নামান হইল। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, বাবুটির চীৎকার করিবার কিম্বা নড়িবার চড়িবার শক্তি ছিল না। ভয়েই তখন তাঁহার প্রাণ বাহির হইবার উপক্রম হইয়াছিল। অবিলম্বেই তাঁহাকে উপরে তোলা হইল। 

ত্রিতলের একটা ঘরের মধ্যে বাবুকে আবদ্ধ করা হয়। সে বাগান বাড়ীখানা সাজান ছিল না, – যেন পড়ো-বাড়ী। অন্ততঃ যে ঘরে বাবুকে আবদ্ধ করা হইয়াছিল, সে ঘরের মধ্যে আর কোন দ্রব্যাদি ছিল না; কেবল একখানা কম্বল বাবুর শয়নের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাবুর পরিধানে একখানি ধুতি আর একখানি চাদর মাত্র ছিল। সেদিন সমস্ত রাত্রি সেই কেরাণীবাবু সেই ঘরের মধ্যে রহিলেন। অবশ্য সেই ঘরের মধ্যে পুরিয়া তাঁহার হাত, পা ও মুখের কাপড় খুলিয়া দেওয়া হয় 

তাহার পর প্রভাত হইয়া গেল। তখন বাবু বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি এক বাগান বাড়ীর মধ্যে আবদ্ধ হইয়াছেন। কিন্তু কোথায় যে সে বাগান বাড়ী, তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। দিনের বেলায়ও সেই ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকিয়া কাহারও সাড়াশব্দ পাইলেন না। তখন সে বাগানে যে অন্য কেহ নাই, এই কথা মনে মনে স্থির নিশ্চয় করিলেন। রাস্তা হইতে সে বাড়ী অনেক দূর, সুতরাং চীৎকার করিলেও কোন ফল হইবে না, তাহাও বুঝিলেন। তথাপি চীৎকার করিতে ছাড়িলেন না। যতদূর উচ্চকণ্ঠ সম্ভব হইতে পারে, ততদূর উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া বলিলেন— “এখানে কে আছ–এখানে কে আছ?” 

প্রতিধ্বনি কেবল সেই কথার উত্তর দিল, অন্য কোন উত্তর আসিল না। তখন বাবু একেবারে নিরাশ হইয়া পড়িলেন। ক্রমে বেলা অধিক হইতে লাগিল। ক্ষুধাতৃষ্ণায় তিনি বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। বেলা একটার সময় একটা তালার চাবি খোলার শব্দ তাঁহার কর্ণে গিয়া পৌঁছিল। তাহার পর মুহূর্ত্তেই ঝনাৎ করিয়া সেই গৃহের দরজা খুলিয়া গেল। ভয়বিহ্বল দৃষ্টিতে তিনি সেই দরজার দিকে চাহিলেন- দেখিলেন, কালান্তক যমের তুল্য একজন দীর্ঘকায় হিন্দুস্থানী কতকগুলি খাবার ও একলোটা জল লইয়া উপস্থিত। গত রাত্রে তাঁহার নিদ্রা কিছুই হয় নাই। স্ত্রী পীড়িত ও পুত্ৰ মৃত, টেলিগ্রামে এই সংবাদ পাইয়া দেশে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন, তাহার উপর আবার এই বিপদ। সুতরাং তাঁহার মনের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। ক্ষুধায় উদরানল জ্বলিয়া উঠিয়াছে, তৃষ্ণায় ছাতি ফাটিয়া যাইতেছে। আহার্য্য সামগ্রী ও তৃষ্ণা নিবারণের জল সম্মুখে উপস্থিত, তথাপি সেদিকে কোন লক্ষ্য না করিয়া বাবু সেই ভীষণাকার হিন্দুস্থানীর চরণে লুটাইয়া পড়িলেন। সে লোকটা কিন্তু কোন কথা কহিল না– কেবল খাবার ও জল ঘরের মধ্যে রাখিয়া পূর্ব্বের ন্যায় ঘরের দরজা চাবি বদ্ধ করিয়া চলিয়া গেল। হতাশ হইয়া বাবু তখন সেই কম্বলের উপর শুইয়া পড়িলেন। শুইয়া পড়িয়া কিছুক্ষণ কাঁদিতে লাগিলেন, আর মনে মনে ভগবানকে ডাকিতে লাগিলেন। 

অনেকক্ষণ পরে আবার উঠিয়া বসিলেন। উঠিয়া বসিয়া ক্ষুধা ও পিপাসার শাস্তি করিলেন। ক্রমে সন্ধ্যা সমাগত। দেখিতে দেখিতে রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল। সে বাগান এত নির্জ্জন যে, দিনের বেলায়ও কোন জনমানবের সাড়াশব্দ নাই। এখন এই রাত্রিকাল, কত নিৰ্জ্জন হইয়াছে, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। তবে অদূরে ঝিল্লী পোকার : রব শোনা যাইতেছিল। আর একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দও আসিতেছিল! বাবুটি এই সময় কি মনে করিয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং একটা খড়খড়ী খুলিয়া দেখিলেন যে, জানালার গরাদ নাই। তখন উপর হইতে নীচের দিকে একবার চাহিয়া দেখিলেন। অন্ধকারে ভাল করিয়া দেখিতে পাইলেন না। মনে মনে একটা মলব স্থির করিলেন। সেই ঘরের মেঝেয় পাতা কম্বলখানি লম্বাদিক করিয়া তিনটুকরা করিলেন। তার পর তাহার মুখে মুখে খুব দৃঢ় করিয়া গেরো দিয়া উহা খুব লম্বা করিয়া লইলেন। 

এইবার সেই কম্বলখানিকে খড়খড়ী হইতে মাটির দিকে ঝুলাইয়া দেখিলেন; আবার তুলিয়া লইলেন। তুলিয়া লইয়া সেই চাদরখানি সেই কম্বলের এক খুঁটে বাঁধিলেন। তখন আশানুরূপ লম্বা হইল। এইবার সেই চাদরের এক খুঁট কাটা খড়খড়ীর নিম্নাংশে বাঁধা হইল। পরে সেই লম্বা চাদর ও কম্বল ধরিয়া ঝুলিতে ঝুলিতে নীচে নামিতে লাগিলেন। শেষে যখন মাটিতে তাঁহার পা ঠেকিল, তখন তাঁহার ধড়েও প্রাণ আসিল। সেই বাগানের মধ্যে কিছুদূর গমন করিয়া একটি প্রাচীর দেখিতে পাইলেন। সেই প্রাচীর উল্লম্ফন করিয়া রাস্তায় আসিয়া পড়িলেন। সম্মুখে যে রাস্তা পাইলেন, সেই রাস্তা ধরিয়াই দৌড়িতে আরম্ভ করিলেন। কোনদিকে চলিয়াছেন, কিছুই তাহার জ্ঞান ছিল না। দৌড়িতে দৌড়িতে তিনি কলিকাতা সহরের ভিতর আসিয়া পড়িয়াছেন বুঝিলেন বটে, কিন্তু সহরের কোন্ অংশে আসিয়াছেন, তাহা কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। শেষে যখন তিনি স্বর্গীয় কেশবচন্দ্র সেনের ‘কমল কুটিরের’ সন্নিকট আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন তাঁহার রাস্তা ঠাওর হইল। পরে তিনি হ্যারিসন রোডের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হন। তখন রাত্রি প্রায় ১টা। ভিতর দিক হইতে সে বাড়ীর দরজা তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। অনেক ক্ষণ কড়া নাড়ার পর বাসার একজন লোকের নিদ্রা ভঙ্গ হয়। সে আসিয়া দরজা খুলিয়া দেয়। বাবুর সাড়া পাইয়া বাসার অন্যান্য লোক তখন উঠিয়া পড়েন, এবং তাঁহার মুখে এই ছেলে ধরার ভয়ঙ্কর কাণ্ড সকল জানিতে পারেন। পরদিবস থানায় আসিয়া এই সংবাদ প্রদান করেন। তৃতীয়টি চাঁপাতলার ঘটনা;- এবার ছেলে ধরা নয় – মেয়ে ধরা। সে এক অদ্ভুত ঘটনা – এমন বিস্ময়জনক ঘটনা সচরাচর শুনিতে পাওয়া যায় না। চাঁপাতলায় একটা গলির মধ্যে একটি খোলার ঘরে বিহারীলাল দাস নামক একজন লোক বাস করে। তাহার সেই বাড়ীতেই ছাতার বাঁটের এক কারখানা আছে। বিহারী নিজে সেই কাজ করে, আর কয়েকজন কারিকরও রাখিয়াছে। প্রতিদিন শেষ রাত্রে উঠিয়া বেহারী চুলায় আগুন দেয়, তার পর কারিকরগণ আসিয়া ভোরের সময় হইতে কার্য্য আরম্ভ করে। তাহাদের ফুরাণ কাজ—সুতরাং তাহাদের কাজের দিকে বিহারীকে আর দেখিতে শুনিতে হয় না। ভোরের সময় বাঁটের কঞ্চি গণিয়া দেয়, আর রাত্রে তৈয়ারী জিনিষ গণিয়া লয়। সপ্তাহ পরে কারিকরদিগের দাম চুকাইয়া দেয়। প্রতি সপ্তাহই বিহারী মহাজনকে মাল চালান দেয়। মহাজনের নিকট টাকা লইয়া, সেই টাকা হইতে অগ্রে কারিকরদের প্রাপ্য দিয়া থাকে, অবশিষ্ট টাকায় বিহারী কঞ্চি ক্রয় করে। এইরূপ করিয়া বিহারী ছাতির বাঁটের ব্যবসা চালায়। 

এইবার আমরা বিহারীর সংসারের পরিবারদিগের কথা বলিব। পরিবারের মধ্যে বিহারীর স্ত্রী ও বৃদ্ধা জননী। বিহারীর বয়ঃক্রম ২৭/২৮ বৎসর হইলেও তাহার বিবাহ ২/৩ বৎসর মাত্র হইয়াছে। স্ত্রীর বয়ঃক্রম সাড়ে তের বৎসর মাত্র। নাম মঙ্গলা, দেখিতে সুশ্রী বটে, তবে আ-মরি গোছের নয়। 

এক সময়ে বিহারীর কঞ্চি ক্রয় করা কলিকাতায় সুবিধা হয় নাই; এই কঞ্চি খরিদের জন্য তাহাকে দূর দেশে যাইতে হয়। তাহাতে তাহার বাড়ী ফিরিতে প্রায় ৩/৪ দিন বিলম্ব ঘটে। কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়া বিহারী শুনিল, তাহার স্ত্রীকে ছেলে ধরায় ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। ভুবন নামে তাহার একজন কারিকর ছেলে ধরায় তাহার স্ত্রীকে ধরিয়া লইয়া যাইতে স্বচক্ষে দেখিয়াছে। বিহারী কঞ্চি কিনিতে যাইবার পূর্ব্বে কলিকাতায় ছেলে ধরার ভয়ের কথা শুনিয়া গিয়াছিল, সুতরাং তাহার মনে দৃঢ়বিশ্বাস হইল যে, তাহার স্ত্রীকে নিশ্চয়ই ছেলে ধরায় ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। 

সে থানায় আসিয়া উপরিলিখিতরূপ এজাহার করিল। 

চতুর্থ ঘটনা–বাগবাজারে গিরীশচন্দ্র দাস নামক একজন ৬০ বৎসরের বৃদ্ধ নবীন সেন নামক একজন ১৬ বৎসর বয়স্ক বালককে থানায় আনিয়া কহিলেন “মহাশয়, আমার সুশীল নামক পঞ্চদশ বৎসর বয়স্ক পুত্রটিকে ছেলে ধরায় কাল রাত্রে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। এই নবীন তাহার একজন বন্ধু। কিরূপে সুশীলকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, এই বালক তাহার সমস্তই অবগত আছে। ইহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিবেন। গিরীশচন্দ্র দাসের কথা শুনিয়া কিরূপ অবস্থায় সুশীলকে ছেলে ধরায় ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা নবীনকে জিজ্ঞাসা করিলাম। নবীন যে কথা বলিয়াছিল, তাহার সার মর্ম্ম এইরূপ। 

নবীন কহিল, তিনি ও তাহার বন্ধু সুশীল স্কুল হইতে আসিয়া ফুটবল খেলিতে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিবার সময় পথি মধ্যে একস্থানে তিন চারিজন লোক আপনা আপনি মারামারি করিতেছে দেখিতে পায়। পার্শ্বেই একখানি গাড়ি দাঁড়াইয়াছিল। ওই মারামারি দেখিয়া সুশীল ও নবীন যেমন সেই স্থানে দাঁড়াইল, অমনি যে কয় ব্যক্তি সেই স্থানে মারামারি করিতেছিল, তাহারা কহিল, ইহারাই এই মারামারি বাধাইয়া দিয়াছে, ইহাদিগকে ধরিয়া থানায় লইয়া যাও। এই বলিয়া উহাদিগের মধ্যে দুইজন সুশীলকে ধরিল ও তাহাকে সেই গাড়ির ভিতর তুলিল। ইহা দেখিয়া নবীন সেই স্থান হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া আপন জীবন রক্ষা করিল। কিন্তু সুশীলকে সেই গাড়িতে করিয়া তাহারা কোথায় লইয়া গিয়াছে, সন্ধান নাই। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও যখন উহার সন্ধান পাইলাম না, তখন বাধ্য হইয়া থানায় সংবাদ দিতে আসিয়াছি। 

এইরূপে যে সকল বালক চুরির সংবাদ আসিতে লাগিল, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাহার অনুসন্ধানও হইতে লাগিল। প্রথম ঘটনার নায়ক যদুনাথ ঘোষ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারা গেল যে, শালকিয়ার ঘাটে বা তাহার নিকটবর্ত্তী স্থানে যদুনাথ বর্ণিত কোন জাহাজ বা স্ট্রিমার নাই, বা সেখানে বিগত এক সপ্তাহের মধ্যে কোন জাহাজাদি ছিল, এ কথাও কেহ বলিতে পারিল না। রেলওয়ে পুলিসের কর্ম্মচারিগণের মধ্যে অনুসন্ধান করিয়াও এ কথা কেহ বলিল না যে, যদুনাথ ঘোষের সহিত কাহারও সাক্ষাৎ হইয়াছিল বা কাহারও নিকট তিনি ওই সকল কথা প্রকাশ করিয়াছিলেন। বহু অনুসন্ধানের পর ইহার প্রকৃত তত্ত্ব বাহির হইয়া পড়ে। কোন দুষ্ট লোকের চক্রান্তে পড়িয়া যদুনাথ কোন নিন্দনীয় স্থানে গমন করেন ও আমোদ-আহ্লাদে অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত তাঁহাকে সেই স্থানে অতিবাহিত করিতে হয়। সেই বাটী হইতে আসিবার সময় টাকার বিশেষ প্রয়োজন হয়, কিন্তু তাঁহার নিকট কিছুমাত্র অর্থ না থাকায়, তিনি বাধ্য হইয়া তাঁহার হস্তস্থিত অঙ্গুরীয় প্রদান করিয়া আপন বাড়ীতে প্রত্যাগমন করেন। তাঁহার পিতা সেই অঙ্গুরির কথা জিজ্ঞাসা করিলে কি উত্তর দিবেন, তাহা স্থির করিতে না পারিয়া, ওই অদ্ভুত উপাখ্যান রচনা করিয়া তাঁহার পিতার নিকট বর্ণন করেন ও ওই গোলযোগে তিনি তাঁহার মূল্যবান অঙ্গুরিটি হারাইয়া ফেলিয়াছেন বলিয়া বুঝাইয়া দেন। পিতামাতা সহজেই পুত্রের কথা বিশ্বাস করেন। এই অদ্ভুত উপাখ্যান ক্রমে প্রকাশিত হইয়া কলিকাতায় মহা অনিষ্টের সূত্রপাত করে। বলা বাহুল্য, অনুসন্ধানে পরিশেষে ওই অঙ্গুরীয় পর্য্যন্ত পাওয়া গিয়াছিল, কিন্তু এই সকল কথা তখন সাধারণে সহজে বিশ্বাস করে নাই। 

যে বালকের জন্য পুলিসের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারী ষ্টিমলঞ্চে গমন করিয়া ট্রিনিদাদ অভিমুখী জাহাজের অনুসন্ধান করিয়া আসিয়াছিলেন, সেই ছেলের অনুসন্ধানের ভার আমার উপর ন্যস্ত হয়। অনেক অনুসন্ধানের পর অবগত হইলাম যে, বিহারের একটি বালকের সহিত তাহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। ওই বিহারী বালকের অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে পাইলাম না, জানিতে পারিলাম, একই দিবস হইতে ওই দুটি বালক নিরুদ্দেশ হইয়াছে। যদি সেই বিহারী বালকের সহিত সে তাহার দেশে গমন করিয়া থাকে, এই বিবেচনা করিয়া, আমি তাহার দেশে গমন করিলাম। ইষ্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ের বকতিয়ারপুর ষ্টেসন হইতে একটি ক্ষুদ্র লাইন মার্টিন কোম্পানি বাহির করিয়া বিহার পর্যন্ত লইয়া গিয়াছে। পুসুরে বিহার বলিয়া যেস্থান প্রসিদ্ধ ছিল, ইহা সেই বিহার। পুরাতন গড় ও ভগ্ন অট্টালিকা সকলের চিহ্ন এখনও পৰ্য্যন্ত এই স্থানে বর্তমান আছে। মুসলমান রাজত্বের সময় ইহা একটি প্রসিদ্ধ স্থান ছিল। আমি ওইস্থানে গমন করিয়া ওই বিহারী বালকের বাড়ী পাইলাম, কিন্তু তাহারা কেহই সেই স্থানে গমন করে নাই। 

এই স্থানে পুরাতন ঐতিহাসিক বিষয়ের দুই একটি কথা না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না। বিহার হইতে ৭ মাইল মাত্র দূরে কুন্তলপুর নামক স্থান, উহা এখন বড়গাঁও নামে অভিহিত। এই স্থান হইতে শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণী হরণ করিয়াছিলেন। রুক্মিণীর পিতার সেই প্রকাণ্ড অন্তঃপুর মধ্যস্থিত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পুষ্করিণী সকল এখনও পর্যন্ত বর্তমান। পুরাতন ভগ্ন গৃহের চিহ্ন সকল এখনও দেদীপ্যমান রহিয়াছে। এই স্থানে বুদ্ধদেবের প্রস্তরময় একটি প্রকাণ্ড মূর্ত্তি আছে. বুদ্ধদেবের প্রস্তরময় অত বড় মূর্ত্তি যে আর কোন স্থানে আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। 

এই স্থান হইতে প্রায় ১৫ মাইল দূরে রাজগির নামক প্রসিদ্ধ স্থান। জরাসন্ধ রাজার কারাগার এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাহার অনেক নিদর্শন এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত হওয়া যায়। 

ওই স্থানে বালকদ্বয়ের কোন সন্ধান করিতে না পারায়, আমাকে বাধ্য হইয়া এ স্থান ত্যাগ করিতে হইল। অনন্তর পুরীতে গিয়া উহাদের উভয়কেই প্রাপ্ত হই। লেখা পড়ার ভয়ে উহারা কলিকাতা ত্যাগ করিয়া পুরীর একটি নিভৃত স্থানে লুক্কায়িত ভাবে অবস্থিতি করিতেছিল। উহাদিগকে প্রাপ্ত হইবার পর, সকলেই জানিতে পারিলেন যে, ছেলে ধরায় উহাদিগকে ধরিয়া লইয়া যায় নাই। 

হ্যারিসন রোডের যুবক কেরাণীবাবু ছেলে ধরার হাত হইতে পলায়ন করিয়া আপন বাসায় প্রত্যাগমন পূৰ্ব্বক যে সকল কথা প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহার অনুসন্ধান আমাকে করিতে হয়। আমি তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া বহির্গত হই। যে রাস্তা দিয়ে তিনি পলাইয়া আসিয়াছিলেন, সেই রাস্তা ধরিয়া গমন করিতে করিতে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে আসিয়া উপস্থিত হই। সেই স্থানে একটি প্রকাণ্ড বাগানের মধ্যস্থিত একটি বাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহেন, ওই বাটীতে তিনি আবদ্ধ ছিলেন। আমরা উভয়ে ওই বাগানে প্রবেশ করিয়া দেখি, ১০/১২ জন উড়িয়া মালি বসিয়া আছে। বাড়ীটি ত্রিতল নহে—দ্বিতল। তাহাদের সর্দ্দারের নিকট হইতে বাড়ীর চাবিকাটী লইয়া বাড়ীর দরজা খুলি, এবং ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখি, সমস্ত ঘরই উত্তমরূপে সাজান। ঘরের অবস্থা দেখিয়া কেরাণীবাবু কহিলেন, মহাশয়, আমার ভুল হইয়াছে, এ সে বাড়ী নহে। অগত্যা আমরা তথা হইতে বহির্গত হইলাম ও গ্রাও ট্রাঙ্ক রোডের চারি ক্রোশ পথ ভ্রমণ করিয়া প্রত্যেক বাগানের বাড়ীগুলি তাঁহাকে দেখাইলাম; কিন্তু তিনি যে প্রকার বর্ণন করিয়াছিলেন, সেই প্রকারের বাড়ি একখানি ও দেখিতে পাওয়া গেল না। সুতরাং আমাদিগকে প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। 

ওই কেরাণীবাবুর সঙ্গে আরও অনেক স্থান অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, তাঁহাকে লইয়া তাঁহার দেশে পর্য্যন্ত গমন করিয়াছিলাম। তথায় গিয়া জানিতে পারি যে, কেরাণীবাবু অনেক দিবস পূর্ব্বে একবার পাগল হইয়াছিলেন ও তাঁহার পিতা-মাতার যত্ন ও চিকিৎসায় তিনি আরোগ্য লাভ করেন। তাঁহার সেই পিতামাতা কয়েক বৎসর হইল, ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। সম্প্রতি তাঁহার স্ত্রী শয্যাশায়িনী, একমাত্র পুত্র কাল-কবলে পতিত। এই সকল কারণে অনেকেই অনুমান করিলেন যে, তাঁহার বর্ণিত বিষয়টি তাঁহার বিকৃত মস্তিষ্কের ফল ভিন্ন আর কিছুই নহে। বিহারীর স্ত্রী মঙ্গলার অনুসন্ধানের ভারও আমার উপর অর্পিত হয়। তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে আমাকে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। যে সকল উপায় অবলম্বন ও যেরূপ ভাবে আমি তাহার অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম, তাহা বর্ণন করিতে হইলে পাঠকগণের ধৈর্য্যচ্যুতি হইবার সম্ভাবনা। এই নিমিত্ত সেই সকল বিষয় বর্ণন না করিয়া কেবল এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, মঙ্গলাকে কোন প্রসিদ্ধ বেশ্যা-পল্লীর মধ্যে প্রাপ্ত হই। সেই স্থানে একখানি ঘর ভাড়া লইয়া সে অবস্থান করিতেছিল। বিহারীর ছাতার বাঁটের কারখানায় যে সকল কারিকর কার্য্য করিত, তাহাদিগের মধ্যে একজনকে আমি তথায় দেখিতেও পাইয়াছিলাম। বিহারীও এই সমস্ত অবস্থা পরে জানিতে পারিয়া, মঙ্গলার আর মুখ দর্শন করিল না, মঙ্গলাও আপন ইচ্ছামত সেই স্থানে বাস করিতে লাগিল। 

আমার হস্তে যে কয়েকটি অনুসন্ধানের ভার পড়িয়াছিল, আমি তাহার সমস্তই শেষ করিয়া ফেলিলাম। সকলেই দেখিতে পাইলেন যে, উহাদিগের মধ্যে কাহাকেও ছেলেধরায় ধরিয়া লইয়া যায় নাই। এই সকল কথা সংবাদপত্রেও বাহির হইল কিন্তু সকলের মনে যে ভয়ানক আতঙ্কের উদয় হইয়াছিল, তাহা সহজে দূর হইল না। কোন কোন ব্যক্তি ছেলে ধরা সন্দেহে নানারূপে অবমানিত ও নিগৃহীত হইতে লাগিল। ছেলে ধরার গাড়ি বিবেচনা করিয়া দুই একস্থানে দুই একখানি গাড়িও পুড়াইয়া নষ্ট করা হইয়াছিল। সহরের মধ্যে কোন বালকের সহিত কাহারও গমন করা একরূপ দায় হইয়া পড়িল। ক্রমে যত দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল, সকলের মনে আতঙ্ক ততই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে দুই একখানি দেশীয় সংবাদপত্র প্রতিদিন মিথ্যা ছেলে চুরির সংবাদ প্রকাশিত করিয়া ওই আতঙ্ক ক্রমেই বাড়াইতে লাগিল। 

এই সময় একজন “চা”র এজেন্টের যে অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা এই স্থানে বর্ণনযোগ্য। 

রাত্রি ১০টার পর একজন মুসলমান এজেন্ট একখানি গাড়ি ধৃত করেন। ওই গাড়িতে একটি খোঁড়া ঘোড়া জোতা ছিল। এজেন্ট গাড়োয়ানের নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন; এরূপ সময় কে বলিয়া উঠিল “ছেলে ধরা গাড়ি লইয়া দাঁড়াইয়া আছে।” এই কথা বলিবামাত্র সেই স্থানে একেবারে লোকে লোকারণ্য হইয়া পড়িল। ওই এজেন্ট যে ছেলে ধরা ও যে গাড়ির নিকট তিনি দাঁড়াইয়া ছিলেন, ওই গাড়িতে করিয়া অপহৃত বালক লইয়া যাওয়া হয়, এই সন্দেহে, যে যেরূপে পারিল, সেইরূপে তাঁহাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। সৌভাগ্যক্রমে এই ঘটনা থানার অতি সন্নিকটে ঘটিয়াছিল বলিয়া, এজেন্ট সাহেবকে ইহ-জীবন পরিত্যাগ করিতে হয় নাই। কিন্তু তিনি এরূপভাবে প্রহৃত হইয়াছিলেন যে, কিছু দিবস পর্য্যন্ত তাঁহাকে হাসপাতালে থাকিতে হয়। থানা হইতে অনেক লোক বাহির হইয়া কোন গতিকে তাঁহাকে উদ্ধার করিয়া আনে। জনতার মধ্যে কেহ কেহ ওই গাড়িতে অগ্নি প্রদান করিবার উদ্যোগ করিতেছিল, কিন্তু ঠিক সময়ে সেই স্থানে পুলিস উপস্থিত হওয়ায় সেই গাড়িখানি রক্ষা পায়। 

এই ঘটনাটি আরও বিস্ময়জনক। তিনটা জল-জীয়ন্ত ছেলে সমেত একজন ছেলেধরার ধরা পড়া। তখন বেলা প্রায় সাড়ে ছয়টা। সবেমাত্র শয্যাত্যাগ করিয়া আমি থানার অফিস গৃহে আসিয়া অফিসের কতক কাজ করিয়া সেদিনকার একখানি দৈনিক পত্রিকা পড়িবার জন্য খুলিতেছি, এমন সময় একজন পাহারাওয়ালা দৌড়িয়া আসিয়া আমায় সংবাদ দিল যে, শিয়ালদহের সন্নিকট ওল্ড বৈঠকখানা রোডে একজন ছেলে ধরা ধরা পড়িয়াছে। লোকটা পাঞ্জাবী – তাহার সঙ্গে তিনটি বাঙ্গালীর ছেলেও আছে। অনেক লোক জমিয়া গিয়াছে—আর সেই ছেলে ধরাকে মারিতেছে–সে এখনও প্রাণে বাঁচিয়া আছে কি না সন্দেহ। 

পাহারওয়ালার কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। তৎক্ষণাৎ পোষাক পরিধান করিয়া, ছয়জন পাহারাওয়ালা সঙ্গে লইয়া, সেই শিয়ালদহের দিকে দৌড়িলাম। আজ একেবারে বামাল সমেত ছেলে ধরা ধরিতে পারিব, মনে করিয়া আমি বড়ই আনন্দিত হইলাম। বৌবাজার ষ্ট্রীট হইতে ওল্ড বৈঠকখানা রোডে প্রবেশ করিয়া দেখি, একবারে লোকে লোকারণ্য, – কাহার সাধ্য সে জনতা ঠেলিয়া যায়? আমার সঙ্গে ছয়জন পাহারাওয়ালা ছিল বলিয়াই, কোন রকমে ধীরে ধীরে চলিতে লাগিলাম। কিন্তু কেবলই ত লোক দেখিলাম, ছেলেধরা ত দেখিতে পাইলাম না। শেষে অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, — ওই গলির মধ্যে যে একটা হোটেল আছে, ছেলেধরা প্রাণভয়ে সেই হোটেলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছ। ক্রমে ক্রমে সেই হোটেলের কাছে আসিয়া দেখিলাম, ভয়ঙ্কর ভিড়, কাহার সাধ্য বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করে? ছেলে ধরা ধরা পড়ায় সকলেরই আজ আনন্দ—আর মুখে কেবল “মার্মার্” শব্দ 

আমি অনেক চেষ্টা করিয়াও সে উন্মত্ত জনতাকে স্থির রাখিতে পারিলাম না। তখন পাহারাওয়ালাদের লোক হটাইয়া দিতে বলিলাম। কিন্তু আমার ছয়জন মাত্র পাহারাওয়ালা, আর সেখানে হাজার হাজার লোক। সুতরাং তাহাদের কথাই বা কে শোনে? আর বিশেষতঃ, ছেলে ধরার উপর তাহাদের ভয়ঙ্কর ক্রোধ জন্মিয়াছিল। আমার মনে হইতে লাগিল—সেই হোটেলের মধ্যে ছেলে ধরা বুঝি জীবিত নাই। ছেলে ধরাই হউক আর চোর-ডাকাত বা খুনি আসামীই হউক, পুলিস–কর্মচারীর সম্মুখে কাহাকেও খুন হইতে দেখিলে কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী স্থির থাকিতে পারেন না। আমি প্রথমে উচ্চৈঃস্বরে সেই উন্মত জনতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম “দেখুন, আপনাদের মধ্যে অনেক ভদ্রলোককে দেখিতেছি। আমি ভদ্র ইতর সকলকে বলিতেছি—আপনারা এখানে আর থাকিবেন না, যথাস্থানে চলিয়া যাউন। আমি যখন আসিয়াছি—তখন সে ছেলে ধরা ধরিবার ভার আমার। আপনারা এরূপ ভাবে বৃথা গণ্ডগোল কেন করিতেছেন? আমি যখন উপস্থিত, তখন সে ছেলে ধরা আর পলাইবে কোথায়?” 

আমার কথা শুনিয়া কোন কোন ভদ্রলোক ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন বটে, কিন্তু তাহাতে অসংখ্য জনতার কিছুই হ্রাস দেখা গেল না। যেমন বিশ-পঁচিশ জন লোক চলিয়া গেল, অমনি শত শত ব্যক্তি তাহার স্থান অধিকার করিল। লোকেরা ক্রোধে এরূপ উন্মত্ত যে, পুলিসের কথা তাহারা গ্রাহ্য করিল না। তখন আমি আর কি করিব? পাহারাওয়ালাদিগকে লোক হটাইয়া দিতে বলিলাম। অনেক কষ্টে আমি সেই হোটেলের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়া দেখি, বাড়ীর মধ্যেই সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভিড়। সেখানেও কেবল ‘মার্ মার্’শব্দ—কিন্তু ছেলে ধরাকে দেখিতে পাইলাম না। 

অবশেষে একটা ঘরের মধ্যে ছেলে ধরাকে দেখিতে পাইলাম। সে একজন প্রকাণ্ড পাঞ্জাবী জোয়ান। তাহার সঙ্গে তিনটি ছেলে। আমি তখন সেই পাঞ্জাবীর মাথার পাগড়ী খুলিয়া তাহা দ্বারা তাহাকে বাঁধিলাম। আর সেই ছেলে তিনটিকে একজন পাহারাওয়ালার জিম্মা করিয়া দিয়া অন্যজনকে একখানা গাড়ি আনিতে বলিলাম। গাড়ি আনিলে সেই গাড়ির মধ্যে ছেলে তিনটি আর সেই ছেলে ধরাকে তুলিলাম; আমিও সেই গাড়ির মধ্যে উঠিলাম। ২/৩ জন পাহারাওয়ালা গাড়ির ছাদে উঠিল। আমি তিনটি ছেলের সহিত ছেলে ধরা ধরিয়াছি, এই সংবাদ বিদ্যুৎবেগে সহরময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। আমি যখন বড় রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম, তখন দেখি, সে রাস্তাও লোকে লোকারণ্য! আমি গাড়ি করিয়া চলিয়াছি, আর শত সহস্র লোক আমার গাড়ির পশ্চাতে পশ্চাতে দৌড়িতেছে। তাহাদের মুখে আজ যে আর আনন্দ ধরে না। যথাসময়ে আমার গাড়ি থানার মধ্যে আসিয়া পৌঁছিল, জনতাও থানার সম্মুখের রাস্তায় অপেক্ষা করিতে লাগিল। আমি তিনটা ছেলের সহিত একজন ছেলেধরা ধরিয়াছি—এই সংবাদ থানায় আসিয়া টেলিফোনের দ্বারা প্রধান পুলিস-কর্ম্মচারী সাহেবকে জানাইলাম। আমার টেলিফোন করিবার বিশ মিনিট পরে দেখি, স্বয়ং বড় কর্ত্তা এক মোটরগাড়িতে করিয়া উপস্থিত। থানার সম্মুখে এরূপ ভয়ঙ্কর জনতা দেখিয়া, তিনি অবাক হইলেন; তৎক্ষণাৎ জনতা সরাইয়া দিতে আজ্ঞা দিলেন। 

তার পর সেই ছেলে চুরির তদন্ত আরম্ভ হইল। প্রথমেই বড় সাহেব সেই ছেলে ধরাকে কয়েকটি প্রশ্ন করিলেন। সে তাহার যথাসম্ভব উত্তর দিল। 

সেই সকল উত্তর ও তাহার নিকট যে সকল চিঠিপত্র ছিল তাহা দেখিয়া স্পষ্টই জানিতে পারা গেল যে, ওই পাঞ্জাবী বাস্তবিক ছেলে ধরা নহে, পঞ্জাব দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী একটি যুবক। পূৰ্ব্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষ হইয়া অনেকে খাইতে পাইতেছে না, এই সংবাদ পাইয়া পঞ্জাব প্রদেশীয় কয়েকজন প্রধান প্রধান লোক তাহাকে পূৰ্ব্ববঙ্গে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন; উদ্দেশ্য, ওই প্রদেশে যদি কোন অনাথ বালক থাকে, তাহাদিগের পিতামাতা যদি সম্মত হন, তাহা হইলে ওই বালকগণকে তিনি পঞ্জাবে লইয়া গিয়া, অনাথ বালকদিগের আশ্রমে রাখিয়া প্রতিপালন ও বিদ্যাভ্যাস করাইবেন। কেবল তিনি যে ওই কার্য্যের নিমিত্ত গমন করিয়াছিলেন তাহা নহে, সেইস্থানের প্রধান প্রধান লোক, কলিকাতা ও পূর্ব্ববঙ্গের প্রধান প্রধান লোককে এ বিষয়ে পত্রও লিখিয়া ছিলেন। ওই পাঞ্জাবী ভদ্রলোকটি পূর্ব্ববঙ্গে গমন করিয়া সেই স্থানের ভদ্রলোকের সাহায্যে কেবলমাত্র তিনটি বালক সংগ্রহ করিতে সমর্থ হন, ও তাহাদিগের অভিভাবকের অনুমতিক্রমে তাহাদিগকে লইয়া তিনি কলিকাতায় আগমন করেন; ইচ্ছা, এই স্থানে দুই একদিবস অতিবাহিত করিয়া পরিশেষে বালকগণকে লইয়া স্বদেশ যাত্রা করেন। শিয়ালদহ ষ্টেসনে রেল হইতে অবতরণ করিয়া ওই বালকগণের সহিত যেমন তিনি সদর রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হন, অমনি তিনি ছেলে ধরা বলিয়া অভিহিত হইয়া এই মহাবিপদে পতিত হন। তিনি সহস্র সহস্র লোক কর্তৃক যেরূপভাবে আক্রান্ত হইয়াছিলেন, আর পাঁচ মিনিট কাল যদি পুলিসের সাহায্য না পাইতেন, তাহা হইলে তাঁহার দেহের কিছুমাত্র অস্তিত্ব থাকিত না।

আমরা সকলেই তখন বুঝিতে পারিলাম যে, ইনি বাস্তবিক ছেলে ধরা নহেন, বা বালক তিনটি অপহৃত বালক নহে। কিন্তু সেই সময় উহাদিগকে থানার ভিতর স্থান দেওয়া এক ভয়ানক বিপদ হইয়া পড়িল। সহস্ৰ সহস্ৰ লোক আসিয়া থানার সম্মুখ ও ভিতর পর্যন্ত ছাইয়া ফেলিল। আমরা সকলে উহাদিগকে নানাপ্রকারে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম যে, এই ব্যক্তি ছেলেধরা নহে, বা বালকগণ অপহৃত নহে। কিন্তু আমাদিগের সে কথা কেহই বিশ্বাস করিল না। অধিকন্তু সেই সময়ে আর একটি দুর্ঘটনা ঘটিল। 

পঞ্জাবে একটি ফুটবল ক্লাব আছে, ওই ফুটবলের ক্রীড়কগণ সমস্তই পাঞ্জাবী ও সেই স্থানের স্কুলের ছাত্র। ওই ক্লাবের ২০/২৫ জন বালক তাহাদিগের কলেজের ইংরাজ প্রিন্সিপালের কর্তৃত্বাধীনে এ দেশে ফুটবল খেলিতে আসে। কলিকাতায় দুই একদিবস থাকিয়া, নদীয়া জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণনগরে ফুটবল খেলিতে যায়। সেই স্থানে উভয় দলে খেলা হয় ও কৃষ্ণনগরের দল জয়লাভ করে। পাঞ্জাবীরা পরাজিত হইয়া পূর্ব্বোক্ত ঘটনার দিবস প্রাতঃকালে শিয়ালদহ ষ্টেসনে আসিয়া অবতরণ করে। পরে কলিকাতার নির্দ্দিষ্ট বাসায় আসিয়া আপনাপন দ্রব্যাদি রাখে, তন্মধ্যে কতকগুলি আহারীয় সংগ্রহার্থ পুনর্ব্বার বহির্গত হয়। যে থানার ভিতর পূর্ব্ববর্ণিত পাঞ্জাবী যুবক বালক তিনটির সহিত আটক ছিলেন, সেই থানার সম্মুখে একটি হালুইকরের দোকান হইতে ইতিপূর্ব্বে তাহারা আহারীয় দ্রব্য লইয়া গিয়াছিল, সুতরাং আজও আহারীয় দ্রব্য সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত তাহারা ৮/১০ জন সেই দোকানে আগমন করে। 

পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, সেই সময় থানার সম্মুখে লোকে লোকারণ্য হইয়াছিল। ওই পাঞ্জাবীগণ সেই স্থানে আগমন করিয়া যেমন হালুইকরের দোকানে আহারীয় সংগ্রহের নিমিত্ত প্রবেশ করিল, অমনি সেই ভিড়ের মধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিল, উহারা নিশ্চয়ই ওই ছেলে ধরা পাঞ্জাবীর দলের লোক, নতুবা উহারা এ সময় এখানে আসিবে কেন? 

এই কথা বলিবামাত্র অনেক লোক সেই হালুইকরের দোকানে প্রবেশ করিল। হালুইকর দেখিল যে, তাহার দোকানে এক নূতন বিপদ উপস্থিত। সে অনন্যোয় হইয়া উহাদিগকে দোকান হইতে বাহির করিয়া দিল; ও উহাদিগকে যথাস্থানে পৌঁছিয়া দিবার নিমিত্ত একজন লোক সঙ্গে দিল। ওই লোকটি উহাদিগকে সঙ্গে লইয়া চাঁপাতলা অভিমুখে প্রস্থান করিল। যে সকল লোক সেই সময় তাহার দোকানের সম্মুখে উপস্থিত ছিল, তাহারাও “ওই ছেলে ধরা যাইতেছে” বলিয়া জনতা বৃদ্ধি করিতে করিতে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। দোকানদারের যে লোক তাহাদিগের সঙ্গে যাইতেছিল, সে এই অবস্থ দেখিয়া সেই স্থান হইতেই অন্তর্হিত হইল। পাঞ্জাবী বালকগণও অনন্যোপায় হইয়া আপনাপন প্রাণভয়ে ঊর্দ্ধশ্বাসে গমন করিতে লাগিল। 

সেই সময় এক রব উঠিল যে, ছেলে ধরা পলাইতেছে। এই রব উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক হইতে সহস্র সহস্র লোক ছুটিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। ইহার পরই যে যেরূপে পারিল, উহাদিগকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিল। ছেলে ধরার দলের একজন ধরা পড়িয়াছে, ও অপরাপর সকলে পলায়ন করিতেছে, সুতরাং তাহাদিগের উপর কাহারও কিছুমাত্র দয়া নাই। কেহ ছাতি, কেহ জুতা, কেহ লাথী, কেহ ইট, যাহার যেরূপ সুবিধা হইল, সে সেইরূপেই উহাদিগকে প্রহার করিতে লাগিল। কেহ ভাবিল না, যে এইরূপ অবস্থায় উহারা মরিয়া যাইতে পারে। পাঞ্জাবী বালকগণ যতক্ষণ পারিল, ততক্ষণ দৌড়াইয়া আত্মরক্ষা করিল। অবশেষে ভয়ানকরূপে আঘাত প্রাপ্ত হইয়া অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া গেল, কাহার মস্তক ভগ্ন হইয়া সেই রক্তে রাজবর্ত রঞ্জিত হইতে লাগিল। কাহার হস্ত, কাহার পদ ভগ্ন হওয়ায় ধরাশায়ী হইল, তাহার উপর অবিরাম লাঠি পড়িতে লাগিল। এইরূপে সমস্ত পাঞ্জাবী বালকগণ বিশেষরূপে আঘাতিত হইয়া হতচৈতন্য অবস্থায় যে যেখানে পাইল, সে সেই স্থানে শয়ন করিল। যাহারা উহাদিগকে প্রহার করিল, তাহারা একবারের নিমিত্তও অনুসন্ধান করিল না যে, উহার কাহারা, কেনই বা এখানে আসিয়াছে, ও উহারা প্রকৃতই ছেলে ধরা কি না? 

কোন প্রসিদ্ধ ইংরাজ বণিকের একজন ইংরাজ কৰ্ম্মচারী এই সময় গাড়ি করিয়া ওই স্থান দিয়া গমন করিতেছিলেন। তাঁহার সম্মুখে ওই পঞ্জাবী বালকদিগের একজন পতিত হইল। তিনি দেখিলেন, ওই পতিত বালকের উপর সহস্রাধিক লোক লাঠি চালাইতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া ওই ইংরাজ কৰ্ম্মচারী মৃতবৎ পাঞ্জাবীকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত যেমন তাঁহার গাড়ি হইতে অবতরণ করিলেন, অমনি ভিড়ের মধ্য হইতে কে বলিয়া উঠিল “এই বালক চোরদিগের সর্দ্দার।” এই কথা একজনের মুখ হইতে উচ্চারিত হইতে না হইতে, সেই জনতা সেই পাঞ্জাবীকে পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার উপর পতিত হইল। দেখিতে দেখিতে তাঁহার দশাও সেই পাঞ্জাবীর দশায় পরিণত হইল। 

যখন এই ভয়ানক কাণ্ড আরম্ভ হয়, সেই সময় এই সংবাদ থানায় আসিয়া পৌঁছিল। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমি থানার উপস্থিত সমস্ত কনেষ্টবলের সহিত দ্রুতগতি ঘটনাস্থলে গিয়া সেই ভয়ানক জনতাকে তথা হইতে বিতাড়িত করিলাম ও সাংঘাতিকরূপে প্রহৃত পাঞ্জাবী বালক সকল ও সেই সাহেবকে তৎক্ষণাৎ হাসপতালে প্রেরণ করিলাম। দুর্ভাগ্য বশতঃ সেই সময় একজন ঠিকা গাড়োয়ান তাহার খালি গাড়ি রাস্তার উপর দাঁড় করাইয়া এই বিষম ব্যাপার সন্দর্শন করিতেছিল। ওই গাড়ি দেখিয়া ভিড়ের মধ্য হইতে একজন বলিয়া উঠিল, “এই গাড়িতে কয়েকজন ছেলেধরা আসিয়াছে।” এই কথা উচ্চারিত হইবামাত্র কতকগুলি লোক নিকটবর্ত্তী একখানি কেরোসিনের দোকান হইতে কয়েক টিন কেরোসিন তৈল আনিয়া ওই গাড়ির উপর ঢালিয়া দিয়া, উহাতে অগ্নি লাগাইয়া দিল। দেখিতে দেখিতে ওই গাড়ি ভস্মে পরিণত হইয়া গেল। 

এই ঘটনার পরই যে ছেলেধরার গোলযোগ মিটিয়া গেল, তাহা নহে, সহরের চারিদিকেই এইরূপ গোলযোগ চলিতে লাগিল। পঞ্জাবী দেখিলেই ছেলে ধরা স্থির করিয়া তাহাকে প্রহার করা হইত। নিকটে খালি গাড়ি থাকিলেই উহা ভস্মে পরিণত করা হইত। 

এই দাঙ্গাকারীগণের মধ্যে কতকগুলি লোক—যাহাদিগের লাঠিতে ওই সকল ব্যক্তি সাংঘাতিকরূপে আঘাতিত হইয়াছিল, তাহারা ধৃত হইল ও পরিশেষে বিচারার্থ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইল। বিচারে উহাদিগের প্রত্যেকেই কঠিন পরিশ্রমের সহিত কারাগারে প্রেরিত হয়। 

এইরূপে কতকগুলি লোক সহরের নানাস্থান হইতে ধৃত হইয়া ক্রমে কয়েদীর সংখ্যা পরিবর্ধিত করিতে লাগিল। তখন সকলেই বুঝিতে পারিল যে, ছেলেধরা একটা হুজুগ্‌মাত্র, প্রকৃত কিছুই নহে। ক্রমে ছেলেধরার গোলযোগ থামিয়া গেল; সহরে পুনর্ব্বার শান্তি বিরাজ করিল। 

সম্পূর্ণ 

[ কার্তিক, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *