প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

ছেলেরাও আজকাল কম যান না

ছেলেরাও আজকাল কম যান না

শুনেছিলুম বিখ্যাত চিত্রাভিনেতা উত্তমকুমার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতেন, গালে হালকা করে রুজের ছোঁয়া। একটু অবাক হয়েছিলুম, কিন্তু যাঁরা অভিজ্ঞ তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, অভিনেতাদের জীবিকার খাতিরে একটু সাজতে গুজতে হয়; কারণ তাঁদের জীবনের ভূমিকাটাই হল মানুষের মনোরঞ্জন।

একটা সময় ছিল যে সময় পুরুষদের সাজগোজ করাটাকে হীনচোখে দেখা হত, পুরুষালি বোঝাতে বলা হত, ‘গো অ্যাজ উই লাইক’। সেই যুগ আজ আর নেই। কলেজে পড়ার সময় আমার এক বন্ধু ছিলেন তিনি কলকাতার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। তাঁর কাছেই আমার প্রথম শোনা, ‘বিউটি স্লিপ’। ‘বিউটি স্লিপ’ বলে একটা জিনিস আছে, খাওয়া দাওয়ার পর দুপুরে জানালার পর্দা টেনে ঘর আধো-অন্ধকার করে পা দুটো একটু উঁচুতে বালিশের ওপর তুলে মাথাটাকে একটু নিচের দিকে রেখে ঘণ্টা দুয়েকের একটা ঘুম। এরপর ঘুম থেকে উঠে পাজামা আর বুক-খোলা পাঞ্জাবি পরে মুখে পাউডার পাফ বুলিয়ে, বুকের কাছে একটা সেন্ট ছুঁইয়ে তৈলহীন চুল আঁচড়াবার পর পেছনদিক থেকে হাতের ধাক্কা মেরে ‘কেয়ারফুল কেয়ারলেস’ হয়ে রাসবিহারীর মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। উদ্দেশ্য হল একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কোনও সুন্দরীর পড়ে যাওয়া। প্রেমিক যদি একটু সাজগোজ করেন, আপত্তির কিছু নেই। কারণ জীবন সংগ্রামের মতো প্রেমও এক সংগ্রাম। এই এলোমেলো পোশাকের দেশে কোনও পুরুষ মানুষ যদি উগ্র সাজগোজ করেন, হয় আমরা তাঁকে পাগল বলব না হয় তাঁকে আলাদা করে দূরে রাখব, আর যদি বন্ধুস্থানীয় হয় তা হলে ঠাট্টা করব, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করব। সে যুগ কিন্তু হঠাৎ পাল্টে গেল। বিদেশিদের মতো আমরাও সাজপোশাকে সচেতন হয়েছি। হবে নাই বা কেন? টিভির পর্দায় ঘন ঘন ভেসে ওঠে স্লো মোশানে একটি মেয়ে পরীর মতো ভাসতে-ভাসতে রাজপুত্রের মতো একটি ছেলের বুকে এসে প্রজাপতির মতো সেঁটে যাচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে ঘোষণা, স্বপ্ন সার্থক। কাপড় নির্মাতার কল্যাণে মানুষের এই অবস্থাই হয়। ঝরা পাতার মতো চতুর্দিক থেকে সুন্দরীরা উড়ে এসে ডোরা-কাটা জামা আর পিন স্ট্রাইপ প্যান্ট পরিহিত লালিমা পাল (পুং)-এর আষ্টেপৃষ্ঠে জোঁকের মতো আটকে যায়।

তারপর সবাই মিলে নাচতে-নাচতে সমুদ্র সৈকতের উপর দিয়ে ঢেউ-এর কোলে আছড়ে পড়ে। আর সমুদ্র থেকে লাফিয়ে ওঠে একটি ভৌতিক বোতল। সেই বোতলে থাকে বুড়বুড়ি কাটা পানীয় জল। হঠাৎ কোথা থেকে বেরিয়ে আসে একটা লাল মোটর গাড়ি, সেই মোটর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ড্রেসিং গাউন পরা একটি ছেলে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ড্রেসিং গাউনের একটি প্রান্ত একপাশে সরিয়ে দেখাতে থাকে তার জাঙ্গিয়া, আর তার কাঁধের পাশ থেকে উঁকি মারতে থাকে হাবুডুবু খাওয়া এক মহিলা, পরশুরাম যখন লালিমা পাল (পুং) নামটি আবিষ্কার করেছিলেন তখন সখী-সখী ভাব ছেলেদের নিয়ে হাসির গল্প নাটক লেখা হত। বই খুললে দেখা যেত লেখা আছে বীর্যহীন পুরুষদের এই অবস্থা হয়—দাঁতে নখ কাটে, আড়ে-আড়ে চায়, ফিক করে হাসে, রুমাল কামড়ে ধরে, কথা বলতে গিয়ে গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ে, উত্তেজিত হলে চড় মারে, খামচে দেয়। পরশুরামের কালে পুরুষের মতো পুরুষদের চওড়া দারোয়ানি গোঁফ অথবা হিটলারি বাটারফ্লাই রাখার রেওয়াজ ছিল, চুল কাটা হত খাটো করে। তখনকার কালের ছাঁটের নাম ছিল কদমছাঁট, পালোয়ানি ছাঁট, কম্যান্ডার কাট, কোকোনাট কাট, বাটি ছাঁট। উত্তমকুমারের ঘাড়ে ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো চুলের কেয়ারি দেখে বাঙালি যুবকেরা যেমনই দেখাক ওই ছাঁটের খুব ভক্ত হয়ে পড়লেন। বর্তমানে চালু হয়েছে হিপিকাট। ভালো ভালো সেলুন তৈরি হয়েছে। কোনও কোনও সেলুন আবার এয়ারকন্ডিশন্ড। একদিন এক কেশশিল্পী আমাকে বলেছিলেন, একালে চুল না কাটাটাই কাটা। একসময় বাঙালি পুরুষের বাড়ির পোশাক ছিল গামছা। পরে এল লুঙ্গি। তার পরে চালু হল পাজামা। লুঙ্গি আর পাজামা এখনও আছে। তারই নানা কেরামতি। সেকালে লুঙ্গি হত মার্কিনের। দাম খুবই কম অথচ টেকসই। তারপরে এল দক্ষিণ ভারতীয় লুঙ্গি। পাড় বসানো। নেহাত কম দাম নয়। তারপর এল উত্তরপ্রদেশের দামি লুঙ্গি। এক-একটা লুঙ্গির দাম ধুতির চেয়ে বেশি। পাজামা একসময় ছিল ঢোলা। তারপরে এসে গেল চুড়িদার, আলিগড়ি, প্যান্টকাট। সবই এখন চলছে, যাঁরা খুব ফ্যাশান সচেতন তাঁরা ড্রেসিং গাউন পরেন। কেউ ডাকলে কোমরে গাউনের দড়ি বাঁধতে বাঁধতে এসে দরজা খুলে দেন।

এ কালে শ্যাম্পু ছাড়া জীবন অচল। চুলে তেল গ্রাম্য মানুষরা দিতে পারেন শহুরে মানুষরা চুলে তেল দেন না। একদিন অন্তর শ্যাম্পু করেন। শ্যাম্পু আবার কত রকম, ফর ড্রাই হেয়ার, ফর অয়েলি হেয়ার, ফর নরম্যাল হেয়ার, উইথ কন্ডিশনার, উইদাউট কন্ডিশনার। ছেলেদের সেন্ট, মেয়েদের সেন্ট। ছেলেদের সেন্টের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে গায়ে মাখলে সেক্স-সেক্স গন্ধ বেরোবে। ঘামের গন্ধটাকে এ কালের ফ্যাশানে সেন্ট বলে ধরা হয়। পাউডার আর হেজলিনের চল কমে আসছে, তার স্থান নিয়েছে বিউটি ক্রিম, স্কিন টনিক, স্কিন লোশান, অ্যাস্ট্রিনজেন্ট। শেষোক্ত পদার্থটি মুখে মাখলে তেল-তেলে ভাব কমে যায়, মুখের চামড়া টান-টান হয়, যৌবন কিছুটা ফিরে আসে। গায়ে সরষের তেল ঘষে মাথায় নারকেল তেল থাবড়ে স্নানের রেওয়াজ নেই বললেই চলে। বাজারে হরেক রকমের সাবান। সাবান ছাড়া স্নান হয় না। গামছা ব্যবহার করাটা অসভ্যতার লক্ষণ। এখন চাই তোয়ালে। বিজ্ঞাপন-দাতারা তোয়ালের নানা বিজ্ঞাপন বের করেছেন। সেই বিজ্ঞাপনের তোয়ালে-সুন্দরী প্রায় অনাবৃত দেহে ঘোষণা করেন এই তোয়ালের নাম—’থারস্টি টাওয়েল’ বা ‘ওয়াটার হাংরী টাওয়েল’। বর্ষাকালে গামছা ভালো হলেও ভিজে তোয়ালের একটা আলাদা অভিজ্ঞতা আছে। দিনের পর দিন ভিজে থাকার ফলে তার অবস্থা গন্ধগোকুলের মতো। গা মোছার পর গায়ে আশি টাকার বিলিতি গন্ধ স্প্রে করার পরও ভদ্র-সমাজে গেলে জনান্তিকে সকলে বলতে থাকেন, কী একটা পচেছে! ট্রাউজার নিয়ে কম কেলেঙ্কারী! প্রথমে ছিল ইংলিশ কাট। সামনে দুটো ফোল্ড ঢোলাঢোলা, তলাটা ভাঁজ করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এসে গেল আমেরিকান ও ইটালিয়ান কাট। পায়ের দিকের ঘের বড় হয়ে চালু হল বেলবটম। বেলবটমের ঘেরের আবার মাপ ছিল এ দেশে। প্রস্তুতকারক জিগ্যেস করতেন, একটা দুধের টিন না দুটো দুধের টিন, মানে তলার ফাঁকে একটা টিন ঢুকবে না দুটো টিন ঢুকবে। বেলবটের সঙ্গে যা-তা জুতো পরলে চলবে না। প্লাটফর্ম শু চাই। কাঠের সোল লাগানো উঁচু জুতো। পরিধানকারীর উচ্চতা ছয় ইঞ্চির মতো বেড়ে যেত। তার হাঁটা দেখে মনে হত দূরে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য কোনও মা বলছেন, ‘আয় আয় খোকা হাঁটি হাঁটি পা পা।’ হঠাৎ এক সকালে উঠে দেখা গেল বেলবট প্যারালাল হয়ে গেছে। যার যেখানে যত ট্রাউজার ছিল সব কাটাকাটি শুরু হল। প্যারালাল থেকে আবার হল ড্রেন পাইপ। এর মাঝে এসে গেছে ব্যাগ পাইপ। ব্যাগির যুগ পড়েছে। অনেকটা জুতা হ্যায় জাপানির মতো প্যান্ট। তার সঙ্গে মানানসই জামা। মানানসই জামা মানে বুকের ছাতি ছত্রিশ হলে জামার মাপ ছেচল্লিশ। পুট নেমে কনুইএর কাছে খেলা করবে। পকেট আর বুকে নেই। পেটে, পিঠে, হাতে, কাঁধে যে কোনও জায়গায় থাকতে পারে। একটা জামার ভেতর স্বচ্ছন্দে একটা ‘পেয়ার’ ঢুকে যেতে পারে।

সাত-আটটা পকেট থাকার ফলে বাজারে ব্যাগ না নিয়ে গেলেও চলবে। এক পকেটে উচ্ছে, আর এক পকেটে ঢ্যাঁড়স। এক পকেটে কাঁচা লঙ্কা আর এক পকেটে আদা। বাড়িতে এসে পকেট ঝাড়লেই সংসারের হাঁড়ি চলে যাবে। ইনটেলেকচুয়ালদের মধ্যে জিনস কালচার চালু হয়েছে। জিনের প্যান্ট, টি-শার্ট, বুক পকেটে টোব্যাকো পাউচ। হিপ পকেটে মানিব্যাগ, গলায় ইস্টদেবীর লকেট, মণিবন্ধে কোয়ার্জ ঘড়ি। বুকের কাছে ম্যাস্কুলাইন সেন্টের ছোঁয়া, মুখে ব্রেশট, গদার, ফেলিনি ক্রফো। জিনের ব্যাকরণে কাচাকুচি বারণ। ইস্তিরি চলবে না। যত অপরিষ্কার ও ছোপ-ছোপ ধরা হবে, ততই তার আভিজাত্য বাড়বে। গরমের দেশে জিনস পরে ত্বকে চুলকানি হলেও ফ্যাশানের দাবিতে এইটুকু ‘স্যাক্রিফাইস’ করতেই হবে, কারণ শাস্ত্র বলছেন, ‘ফ্যাশান মেকস এ ম্যান।’ সেকালে শয়নকালে মানুষের পরিধানে থাকত দু-পাট করে পরা ধুতি অথবা একটা লুঙ্গি। পরবর্তী কালে পাজামা। এখন এসেছে স্লিপিং-স্যুট। ভাদ্রের গরমে ভদ্রলোক শুয়ে আছেন ডোরাকাটা পাজামা আর ডোরাকাটা চায়না কোট পরে। স্ত্রী হয়তো বলছেন, ‘কোট খুলে ফেল না বাপু, গরমে হাঁসফোঁস করে মরছ।’ ভদ্রলোক বলছেন, ‘তা কি করে হয়, ঘুমের পোশাক না পরলে ঘুম আসবে কি করে!’ ভদ্রমহিলা তখন তাঁর কানের কাছে ধীরে-ধীরে থাবড়া মারতে-মারতে গুন-গুন করে গাইতে লাগলেন, ‘আয় ঘুম, যায় ঘুম বর্গী পাড়া দিয়ে, ছেলে ঘুমোল পাড়া জুড়োল…।

একালের ছেলেদের যাই বলি না কেন, সেকালের ছেলেদের চেয়েও দেখতে সুন্দর হয়েছে। কত রকমের প্যান্ট, জামা, টি-শার্ট, লম্বা-লম্বা ফুরফুরে চুল, গায়ে মৃদু গন্ধ, পকেট থেকে যে রুমালটি বেরোল, সেই রুমালের দামে একটি গেঞ্জি কেনা যেতে পারে। যে কোনও মধ্যবিত্তের একদিনের বাজার খরচা হয়ে যেতে পারে। সারা মাসের কসমেটিকসের খরচে যে কোনও গরিব মানুষের সংসার হেসে খেলে চলে যেতে পারে। এ কালের একজোড়া জুতোর দাম শুনলে সন্দেহ হয় এ জুতো পায়ের না হাতের! আধুনিক সমাজের রূপরেখা যাই বলি না কেন, মনোরম একটা চেহারা নিয়েছে। পেটে কলের জল, মুখে বিউটি ক্রিম। ‘একসকিউজ মি ম্যাডাম’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাব ভেবেছিলুম। তিনি ঘুরে তাকালেন। অ্যাই সর্বনাশ! গোঁফ রয়েছে রে। ফুলছাপ কাপড়ের হাওয়াই শার্ট। ব্লাউজ ভেবেছিলুম। ববকাট চুল নয়! বিটলে কাট। সংশোধন করে বললুম, ‘একসকিউজ মি স্যার।’ মিস্টার মিস, দুইই এক হয়ে গেছে। দুজনেই ছুটছেন বিউটি পারলারের দিকে। দুজনেই ফ্যাশন ম্যাগাজিন পড়ে মুখে লাগাচ্ছেন—কিউকাম্বার পুলটিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *